২৬ ফেব, ২০১৬

জান্নাতের যাত্রী


সালমান আজ না খেয়েই বেরিয়েছে। এটাতো আর বাড়ি নয় যে মাকে বলবে ‘মা, আজ আমার একটু আগে বের হতে হবে, খেতে দাও’। এটা মেস। এখানে কাকে বলবে? বুয়া প্রায়ই দেরী করে আসে, আড়মোড়া ভেঙ্গে তার রান্না করতে করতেই ক্লাসের সময় পার হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। যেদিন একটু আগে বের হতে হয় সেদিনের সকালের খাওয়া বাদ। এতে অবশ্য সালমানের খুব একটা কিছু হয় না। মাঝে মাঝে গ্যাস জমে পেট ব্যাথা করে এই যা। এটা মোটামুটি তার অভ্যাসের মধ্যেই চলে আসছে।

আজকে ক্লাসের আগে তার মিছিল আছে। অপশক্তি স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে মিছিল। ইসলাম ও ইসলামী নেতৃত্ব রক্ষা করার আন্দোলনের মিছিল। তাই যথারীতি সে না খেয়েই বেরিয়েছে। বন্ধুদের সাথে নিয়ে সে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিল শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ গুলি ছুঁড়ে। পুলিশ এখন খুব আক্রমানত্মক। লাঠিচার্জ কিংবা কাঁদানো গ্যাসের কোন বালাই নেই। সরাসরি গুলি। তাও কোন ফাঁকা গুলি নয়। বুক বরাবর। মিছিলের সামনে থাকা সালমান প্রথম শিকার পুলিশের। বুকে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে সে। সে একা নয়, অনেকে। তার অন্যান্য সহকর্মীরা অনেককে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারলেও সালমান সহ সাত জনকে উদ্ধার করতে পারেনি।

কিছুক্ষন পর পুলিশ তাদের থানায় তুলে নিয়ে আসে। এসেই শুরু করে অত্যাচার। চিৎকার আর আর্তনাদে পুরো থানাটা যেন জাহান্নাম হয়ে উঠে। সাতটা গুলিবিদ্ধ মানুষের উপর ভাংতে থাকে এক একটা লাঠি। একজন পুলিশ মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে অপরজন শুরু করে। এভাবে পালাক্রমে চলছেই। রক্তের নহর বইতে থাকলো থানায়। একটা পুলিশতো দ্রুত হাঁটতে গিয়ে রক্তে পিছলিয়ে পড়ে গেলো। ঘন লাল রক্তে সেও রঞ্জিত হয়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠলো তার সহকর্মী অন্যান্য পুলিশেরা। রাগে লাল হয়ে গেলো সে। তার সব রাগ গিয়ে পড়লো উলট পালট কুন্ডলি পাকিয়ে থাকা সাতটি রক্তাক্ত দেহের উপর। কি যেন খুঁজতে লাগলো সে। কিছুক্ষন পর পাশের রুম থেকে নিয়ে এলো একটা লোহার পাইপ। এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো সে। সালমানরা শুধু আল্লাহকে ডেকেই চলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দ করে কবির নামে এক সহকর্মীর হাত ভেঙ্গে যায়। কবজি আর কনুইয়ের মাঝখান থেকে ঝুলতে থাকে তার রক্তাক্ত হাত। এ এক বিভীষিকাময় দৃশ্য।

বুকে, পেটে গুলি খাওয়া সালমানের শুধু নিঃশ্বাসটাই বাকী আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এখনই আল্লাহর কাছে চলে যাবে। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি তার মনে ভর করে। কত কিছু যে কল্পনা করছে সে। সারা জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। কিছু কিছু অন্যায়ের কথা মনে হতেই সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে। পুলিশের ক্রমাগত পিটুনি তাকে স্পর্শ করে না। সে আছে তার মত করে আনন্দে। মালিকের সাথে মিলিত হবার আনন্দ। বহু আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে সে। এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না তার। এমন সময় সে বুঝতে পারলো তাকে গাড়িতে তুলছে পুলিশেরা।

কিছুক্ষনপর মৃতপ্রায় সাতটি মানুষকে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তাররা দ্রুত চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যান্ডেজ করে প্রথমে রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করলেন। তারপর একের পর এক পরীক্ষা করতে থাকলেন কার অবস্থা বেশী খারাপ। কাকে সবার আগে অপারেশন করতে হবে। পরিক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেলো সালমানের কন্ডিশন সবচেয়ে খারাপ। ডাক্তার তাকে বললেন, 
- তুমি দ্রুত তোমার আত্মীয়দের খবর দাও। তোমার আত্মীয় কেউ কি এসেছেন?
- আমার কোন আত্মীয় স্বজন এই শহরে থাকে না। আর থাকলেও আমি তাদের ডেকে কষ্ট দিবো না। আমি তো আমার কোন ক্ষতি করিনি। তাছাড়া আমার কোন এক্সিডেন্টও হয়নি। 
- তোমার অভিভাবকের সাইন ছাড়াতো আমরা তোমার অপারেশন করতে পারবো না। পরে কোন সমস্যা হলে আমাদের উপর দায় পড়বে। 
- (পুলিশদের দেখিয়ে) আপনাদের উপর দায় পড়বে কেন? তারা আমাকে গুলি করেছে। তারপর আমাকে আবার কোন কারণ ছাড়া এক ঘন্টা পিটিয়েছে। দায় হলে তাদের হবে। আর আমার এখানে কোন অভিভাবক নেই। আমার অভভাবক একমাত্র আল্লাহ্‌। 
- আল্লাহ্‌ তো আর সাইন দিবেন না। এখন আমরা কি করবো? 
- (পুলিশদের দেখিয়ে) ওদেরকে বলুন সাইন করতে।

পুলিশও সাইন করতে অস্বীকৃতি জানালো। এরপর সালমান বললো আমাকে দিন আমিই সাইন করি। কিন্তু ডাক্তাররা বললো প্রথম কথা তোমার সাইন করার শক্তি নেই। আর দ্বিতীয়ত তোমার সাইন কাজে আসবে না। এরপর ডাক্তার সার্জারির প্রধান ডাক্তার প্রবীর কুমারকে জানালো। তিনি সব শুনে বললেন, আচ্ছা তাকে নিয়ে এসো। অপারেশনতো করতে হবে। 

ডাঃ প্রবীর কুমার সালমানকে দেখেই চমকে উঠলেন। আরে এতো সেই ছেলে। তিনি তাকে চিনেন। মাস ছয়েক আগের কথা, একদিন রাত দুটোয় হঠাৎ তার বাসায় কলিংবেলের শব্দ। তিনি বের হয়ে দেখলেন একটা শীর্ণকায় ছেলে। দরোজা খুলে দিলেন। সে ঘরে ঢুকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। ডাঃ প্রবীর তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন এবং বুঝতে পারলেন দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকার কারণে ভীষন দূর্বল হয়ে পড়ছে। অল্পক্ষন পরই তার জ্ঞান ফিরলো। সে অপরাধী ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ডাক্তার প্রবীরের দিকে তাকালো। ডাক্তার তাকে উঠালেন এবং বসালেন। তার কোন কথা শোনার আগেই তাকে খেতে দিতে বললেন তার স্ত্রীকে। সে খাওয়া দাওয়া শেষ করলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী বৃত্তান্ত? তুমি কি কর? এত রাতেই বা কোথা থেকে? 
সব শুনে ডাঃ প্রবীর বললেন, আমি তোমাকে আগে থেকেই জানতাম। প্রসূনের মুখে তোমার এত গল্প শুনেছি যে তোমার সব বিষয় মোটামুটি জানি। সালমান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে
- কোন প্রসূন?
- কেন তোমার ক্লাসমেট প্রসূন। সে আমার ছেলে। ঐ তো ঐদিকের রুমে ঘুমুচ্ছে।

সালমানের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। ডাক্তার প্রবীর সাহেব তাকে রাজনীতি করতে বারণ করছিলেন। কিন্তু এগুলো কিছুই তার কানে যাচ্ছিল না। সকাল দশটা থেকে পুলিশ তার পেছনে লাগছে। তার মেস ঘেরাও করেছে। কিন্তু কৌশলে বের হয়েছে। সারা শহর নিজেও ঘুরেছে পুলিশদেরও ঘুরিয়েছে। সে যে কোথাও গিয়ে বসবে তার ব্যবস্থা নেই। রাস্তার রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাহারা বসানো। খাবার দোকানগুলোতে গোয়েন্দারা বসে আছে। তাই সে অগত্যা টিকতে না পেরে এই ডাক্তারের বাসায় নক করেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তারা হিন্দু। সে একটু আগে মজা করে মুরগী দিয়ে ভাত খেয়েছে। তার ক্লাসমেট প্রসূনের নাম বলাতে সে বুঝতে পারলো সে কতটা ভুল করেছে। ওনারা কষ্ট পেতে পারেন তাই সে আঙ্কেল বমি আসছে এই কথা বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। গলায় হাত দিয়ে সব বমি করে দিলো। 

অন্য কেউ না বুঝলেও ডাক্তার বুঝলেন এটা সালমান ইচ্ছে করেই করেছে। অমুসলিমদের জবাই করা মুরগী মুসলিমদের খাওয়া বারণ এটাও জানা রয়েছে তার। তিনি কিছুই বললেন না কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নিল ছোট্ট এই ছেলেটির প্রতি। কতটা একনিষ্ঠ তার আদর্শের প্রতি। তারপর সে ওয়াশ রুম থেকে বের হলে তাকে এক গ্লাস দুধ দিলেন। যে ছেলে সারাদিন না খাওয়ার পর যা খেয়েছে তাও বিসর্জন দিতে পারে শুধু আদর্শের জন্য সে সাধারণ কোন ছেলে নয়। তার ছেলে প্রসূনের মুখে তার শুধু প্রশংসাই শুনেন। সারাদিন পুলিশের সাথে দৌড়াদৌড়ি, তার সংগঠনের কাজ সব করেও সে ক্লাসের ফার্স্ট। প্রসূন ও সালমান দুজনই চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এবার HSC পরিক্ষার্থী।

এক মুহুর্তে সব মনে পড়ে গেলো ডাক্তারের। তিনি দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করলেন। পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তারপরও বলা চলে অপারেশন সাকসেসফুল। তিনটি বুলেট এক্সরে রিপোর্টে ধরা পড়ছিলো। তিনটাই তিনি বের করতে পেরেছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়েই ছেলে প্রসূনকে ফোন করেছেন এবং বলেছেন সালমানের কথা। ততক্ষণে প্রসূন ও তার বন্ধুরা সবাই জেনেছে। সালমানের বাবা-মাও রওনা হয়েছেন গ্রাম থেকে। 

অপারেশনের আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও সালমানের জ্ঞান ফিরছে না। সবাই খুব টেনশনে। সালমানের বাবা সিজদায় পড়ে আছেন আছেন। আর মা ছোটাছুটি করছেন অপারেশন থিয়েটারের সামনের বারান্দায়। কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন তারা। সালমানের আন্দোলনের সঙ্গীরাও আছে দূরে দূরে। পুলিশের কারণে তারা সামনে আসতে পারছে না। তবে সালমানের মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখছে। সবার খাবার দাবার ঔষধ তারাই সরবরাহ করছে। বায়ান্ন ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরেছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছিল। খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছে। হঠাৎ তলপেটে সে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে। ডাক্তাররা আসলেন এবং এক্সরে করালেন। আরো দুটো বুলেটের অস্তিত্ব দেখা গেল সেখানে। আবার অপারেশন করতে হবে।

এক অপারেশনের ধাক্কাই সে নিতে পারেনি। এখন অন্য অপারেশন একেবারেই সম্ভব না। আবার ওদিকে বুলেটদুটো থাকার কারণে ভেতরে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে। অপারেশন না করলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। ডাক্তাররা রিস্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনই করতে হবে। সালমানের বাবা-মা কে পুরো কন্ডিশন বুঝালেন ডাঃ প্রবীর। তারাও মত দিলো। সবাই বুঝতে পারলো হয়তো সালমানকে আর পাওয়া যাবে না।

একে একে সবাই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলো। সালমানের বাবা, মা, ডাক্তাররা, নার্স, সহকর্মীরা সবাই। সালমান তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জান্নাতি সে হাসি। ডাঃ প্রবীর একজন জুনিয়র ডাক্তারকে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বললেন। আর সালমানের দিকে তাকিয়ে কন্ঠকে খুব স্বাভাবিক রেখে বললেন, বাবা সালমান, তোমার শরীরে আরো দুটো বুলেট আছে সেগুলো বের করতে হবে। তোমার অবস্থা খুব নাজুক। আমরা জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে। তবে তুমি আশঙ্কামুক্ত নও। এখানে সবাই আছেন। তুমি যদি কাউকে কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারো। তোমার ক্ষতির জন্য কারা দায়ী তাদের কথা তুমি বলে যাও।

সালমান তার মাকে ইশারায় ডাকলো। মা কতদিন তুমি আমাকে আদর কর নাই, দোষ আমার আমি বাড়ি যেতে পারিনি। আমাকে একটু আদর করবে? মা জড়িয়ে ধরলো শুয়ে থাকা সালমানকে । মা-ছেলের সাথে কান্না করতে লাগলো সবাই। ডাক্তার তাদের ছাড়িয়ে নিলেন। এবার সে বাবাকে ডেকে বললো আমার কিছু ঋণ আছে, শোধ করে দিবে? বাবা বললো, কি ঋণ আমাকে বল। আমি অবশ্যই শোধ করে দিব। বাবা ঋণটা তোমার কাছেই। তুমি কষ্ট করে রোজগার করে আমার জন্য পাঠাতে। আমি তোমার কোন আশাই পূরণ করতে পারিনি। আমার ঋণটা মাফ করে দাও। 

তারপর তার এক সহকর্মীকে কাছে ডেকে বললো, আমার বিছানার নিচে ৫০০ টাকা আছে এগুলো সোহাগ ভাইকে দিবে। আর কিছু ভাউচার আর বিগত মাসগুলোর হিসাব আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে। দয়া করে সেগুলোও সোহাগ ভাইকে দিবে। আর আমাকে মাফ করে দিও ভাই। সবাইকে বলিও যেন আমাকে মাফ করে দেয়। এবার ডাক্তারকে ইশারা করে বলে লিখুন।

আমি সালমান বলছি আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আল্লাহ্‌ তায়ালা যদি মনে করেন আমাকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যাবেন তাহলে এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। যারা আমাকে গুলি করেছে আমাকে মেরেছে তারা না বুঝে এসব করেছে। তারা যদি আমাদের বুঝতো তাহলে তারা এই জঘন্য কাজ কখনোই করতো না। এই অপরাধ আমাদের, আমরা এদেশের মানুষকে ভালোভাবে বুঝাতে পারিনি। আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য আজ এই অবস্থা। আমার প্রতি যারা নির্যাতন করেছে আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন।

সবার চোখে অশ্রু। সবাই কাঁদছে। পুলিশগুলো সহ। হঠাৎ ডাঃ প্রবীর এক পুলিশের কলার চেপে ধরে বলতে লাগলেন, কেমনে পারলে? কেমনে পারলে এই ফেরেশতার মত ছেলেকে গুলি করতে? বলে কাঁদতে লাগলেন। পুলিশগুলোও চোখ মুছতে লাগলো।

একে একে সবাইকে ডাক্তার প্রবীর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দিলেন। আরেকজন ডাক্তার সংজ্ঞাহীন করার ইঞ্জেকশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সালমানের দিকে।
২৫/২/২০১৬

১৪ ফেব, ২০১৬

হযরত আদম আঃ কে নিয়ে কিছু ভুল ধারণা


হযরত আদম আঃ কে সৃষ্টির সময়কার ইতিহাস নিয়ে নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। সেগুলো হলো 

১- খলিফা সৃষ্টির কথা জেনে ফেরেশতারা আপত্তি জানায়
২- আল্লাহ আদম আঃ কে গোপনে ইলম দান করে ফেরেশতাদের উপর আদম আঃ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। 
৩- আদম আঃ জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হওয়ায় আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের হুকুম করা হলো। 
৪- বেহেশতে ইবলিশের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার শাস্তি স্বরুপ আদম আঃ দুনিয়ায় নির্বাসিত হন। 
৫- দুনিয়ায় ৩০০ বছর তাওবা করার পর আদম আঃ নবী হন 
৬- দুনিয়ায় কারাগার থেকে পাকসাফ হয়ে গেলে আবার বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ আসবে। 


পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুতে এই নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে


(২:৩০) আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন , “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই ৷”তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে? আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি৷” আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না ৷” 

(২:৩১) অতপর আল্লাহ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শেখালেন তারপর সেগুলো পেশ করলেন ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন, “যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয় তাহলে একটু বলতো দেখি এই জিনিসগুলোর নাম? ”

(২:৩২) তারা বললোঃ “ত্রুটিমুক্ত তো একমাত্র আপনারই সত্তা, আমরা তো মাত্র ততটুকু জ্ঞান রাখি ততটুকু আপনি আমাদের দিয়েছেন ৷ ৪৩ প্রকৃতপক্ষে আপনি ছাড়া আর এমন কোন সত্তা নেই যিনি সবকিছু জানেন ও সবকিছু বোঝেন ৷” 

(২:৩৩) তখন আল্লাহ আদমকে বললেন, “তুমি ওদেরকে এই জিনিসগুলোর নাম বলে দাও ৷”যখন সে তাদেরকে সেসবের নাম জানিয়ে দিল। তখন আল্লাহ বললেনঃ “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আকাশ ও পৃথিবীর এমন সমস্ত নিগূঢ় তত্ত্ব জানি যা তোমাদের অগোচরে রয়ে গেছে? যা কিছু তোমরা প্রকাশ করে থাকো তা আমি জানি এবং যা কিছু তোমরা গোপন করো তাও আমি জানি ৷” 

(২:৩৪) তারপর যখন ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস অস্বীকার করলো৷ সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তরভুক্ত হলো ৷ 

(২:৩৫) তখন আমরা আদমকে বললাম , “তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়েই জান্নাতে থাকো এবং এখানে স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না ৷ অন্যথায় তোমরা দু’জন যালেমদের অন্তরভুক্ত হয়ে যাবে ৷ ” 

(২:৩৬) শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো ৷ আমি আদেশ করলাম, “ এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ তোমরা একে অপরের শত্রু । তোমাদের একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে৷” 

(২:৩৭) তখন আদম তার রবের কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তাওবা করলো ৷ তার রব তার এই তাওবা কবুল করে নিলেন৷ কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী৷ 

(২:৩৮) আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা৷ 

(২:৩৯) আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷


এখানে ছাড়াও পবিত্র কুরআনে আরো ছয়টি সূরায় এই বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।


১- আল আরাফ ২য় রুকু 
২- আল হিজর ৩য় রুকু
৩- বনী ইসরাঈল ৭ম রুকু 
৪- আল কাহফ ৭ম রুকু 
৫- ত্বাহা ৭ম রুকু 
৬- সোয়াদ ৫ম বা শেষ রুকু 

এই বিষয়ের উপযুক্ত ব্যাখ্যা হলো, 
১- দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা খলিফা পাঠাবেন বলে ঘোষনা শুনে ফেরেশতাদের মনে এই খটকা সৃষ্টি হলো যে তারা তো আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব যথাযথই পালন করছেন তাহলে আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি? ফেরেশতাদের ধারণা ছিল তারা যে দায়িত্ব পালন করেছেন এতে আল্লাহ পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তাই ঐ দায়িত্বটি আরো ভালোভাবে পালন করার জন্যই হয়তো আদম আঃ কে সৃষ্টি করার প্রয়োজন মনে করেছেন। ফেরেশতাদের এই ধারণা যে সঠিক ছিল না সে কথা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ তায়ালা ব্যবস্থা করেছেন। ফেরেশতারা তাদের আশংকার কথা জানিয়েছেন। আপত্তি করার ইখতিয়ার ফেরেশতাদের থাকেনা। 

২- আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে দায়িত্ব পালনের উপযোগী জ্ঞান তাদের দিয়েছেন। আদম আঃ কে যে দায়িত্ব আল্লাহ দিতে চাচ্ছেন সে দায়িত্বের উপযোগী জ্ঞানও তাকে দিলেন। ফেরেশতাদের কাছে আদম আঃ কে দেয়া জ্ঞান যে নেই একথা প্রমাণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বুঝিয়ে দিলেন আদম আঃ কে অন্যরকম দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। 

যেমন ডাক্তারী করার দায়িত্ব যাকে দেয়া হবে তাকে ডাক্তারী শিক্ষাই শিখানো হবে। অন্যদিকে যাকে দেশরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হবে তাকে তার উপযোগী সমরাস্ত্রের জ্ঞানই দেয়া হবে। তাই ডাক্তার শ্রেষ্ঠ নাকি সেনা অফিসার শ্রেষ্ঠ এই প্রশ্ন অবান্তর। ঠিক তেমনি ফেরেশতার দায়িত্বের জায়গায় ফেরেশতা যোগ্য। খেলাফতের দায়িত্বের জায়গায় আদম আঃ যোগ্য। এখানে আদম আঃ এবং ফেরেশতাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা বা তুলনার ভিত্তি নেই। 

৩- আদম আঃ জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ তাই তাকে সাজদা করার জন্য বলা হয়েছে এটা ঠিক নয়। যদি জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতেই সিজদা করার নির্দেশ দেয়া আল্লাহ সঠিক মনে করতেন তাহলে পিতাকে সিজদা করার জন্য সন্তানদের নির্দেশ দিতেন। শিক্ষককে সিজদা করার জন্য ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন। এতে বুঝা যায় আদম আঃ কে সিজদা করার নির্দেশ ভিন্ন কারণে। মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খিলাফতের কাজে সহযোগীতা না পেলে দুনিয়ায় কোন কাজই করতে পারবে না মানুষ। তাই খুব সম্ভবত ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো মানুষের ইখতিয়ারে যাতে হস্তক্ষেপ না করা হয়। ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানী করেন না এবং নাফরমানী পছন্দও করেন না তাদের সেই ইখতয়ারও নেই। মানুষ তার ইচ্ছামত কোন বস্তুর ব্যবহার করতে চাইলে সেই বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতা যদি বাধা দেয় তাহলে মানুষের ইখতিয়ার থাকেনা। আল্লাহর নাফরমান বান্দাদের দুনিয়ায় চলার পথে পদে পদে বাধা দিলে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও চেষ্টার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তা ব্যহত হতে বাধ্য। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা আদম আঃ কে সিজদা করার মাধ্যমে ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা হয়। 

৪- ইবলিশ নেতৃস্থানীয় জ্বিন ছিল। ফেরেশতা ছাড়াও জ্বিনদের মধ্যে শুধু ইবলিশকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হলো কারণ সে আদম আঃ কে খিলাফত দেবার বিরোধী ছিল এবং তার বিপরীতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিল। মহান আল্লাহ তায়ালা তার এই গোপন হিংসা প্রকাশ করার জন্যই তাকে সিজদা করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ আর ফেরেশতাদের নির্দেশের উদ্দেশ্য এবং কারণ ভিন্ন। 

৫- মানুষকে খিলাফতের অযোগ্য প্রমাণ করার জন্য ইবলিশ যে কত যোগ্যতার সাথে শত্রুতা করতে সক্ষম সে কথা প্রমাণ করার জন্য আদম আঃ কে দুনিয়ায় পাঠানোর পূর্বে জান্নাতে পাঠানো হয়েছে। খিলাফতের জন্য আদম আঃ এবং ইবলিশের মধ্যে কে বেশী যোগ্য ও উপযোগী তা প্রমাণ হয়েছে যে, আদম আঃ ইচ্ছে করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেনি। আর ইবিলিশ জেনেশুনে অমান্য করেছে। আদম আঃ যখন বুঝতে পারলেন আদেশ অমান্য হয়েছে তখন তিনি অনুতপ্ত হয়ে তওবা করেছেন আর ইবলিশ নাফরমানী করার যুক্তি প্রদর্শন করে জ্ঞানপাপী বলে পরিচয় দিয়েছে। 

৬- এই কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো ফেরেশতারা মানুষের প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং শুভাকাঙ্ক্ষী। আর এর বিপরীতে ইবলিশ মানুষের চরম শত্রু । 

৭- মানুষকে দুনিয়ায় খেলাফতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের পুরস্কার স্বরুপই মানুষ জান্নাতের অধিকারী হবে। তাই দুনিয়াটা মানুষের কর্মস্থল, কারাগার নয়। শাস্তি দেবার জায়গা দুনিয়া নয় এবং শাস্তির জন্য দুনিয়ায় পাঠানোও হয়নি। 

৮- আদম আঃ দুনিয়ায় নবীর মর্যাদা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন। নবী কখনো পাপী ও নাফরমান হন না। যে আদেশ অমান্য জান্নাতে হয়ে গিয়েছে এর তওবা সেখানেই কবুল হওয়ার মধ্য দিয়ে পবিত্র অবস্থায় তিনি দুনিয়ায় নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। 

আলোচ্য আলোচনার শিক্ষাঃ 
১- দুনিয়ায় খিলাফতের দায়িত্ব পালনই মানুষের জন্য সর্বোচ্চ দায়িত্ব। 
২- ইবলিশ মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । 
৩- মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভুলে ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার লক্ষ্যে কাজ করা এবং দুনিয়াবী উন্নতির রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর হওয়া মূলত ইবলিশের ওয়াসওয়াসা। 
৪- লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কৃত্রিম কুশিক্ষা দ্বারাই তা বিকৃত করা হয়। 
৫- মানুষের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো যৌন আকাঙ্ক্ষা। তাই এই পথে হামলা করাই শয়তান সহজ মনে করে। 
৬- ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা মানুষের পরিচায়ক নয় এটা শয়তানী বদভ্যাস। 
৭- ইবলিশের শত্রু তা মোকাবেলা বড়ই কঠিন। বাঁচার উপায় ইখলাস। নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে চলার চেষ্টা যারা করে তাদের ভয় নেই।

১ ফেব, ২০১৬

প্রমোশন


১.
খাবার টেবিলে আশরাফ সাহেব। সাথে মসজিদের হুজুর-খাদেম সহ তিনজন লোক। কোতোয়ালী থানার ওসি তিনি। হুজুরদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করার কারণে এটা মনে করার দরকার নেই তিনি ধার্মিক লোক। আপাদমস্তক অসৎ তিনি। মাসে একদিন ফকির-মিসকিন-হুজুরদের খাইয়ে তিনি তার পাপ কাটান। এই পাপ কাটানোর সিস্টেমটা তার আবিষ্কার নয়। তার দাদা ও বাবাকেও সে দেখেছে এভাবে পাপ কাটাতে।

ইদানিং তিনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে ভীষন চিন্তিত। তারা না করে পড়াশোনা, না শুনে কারো কথা। তিনিও তার বাল্যকালে বাবা-মায়ের অবাধ্য ছিলেন ঠিক কিন্তু এতটা বেয়াড়া ছিলেন না। ইদানিং তাদের বিরুদ্ধে অহরহ ইভটিজিং এর অভিযোগ আসছে। আরো উদ্বেগজনক খবর হল নেশার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। পাড়ালেখার তো হদিসই নেই। বাসায় তাদের প্রাইভেট টিউটর টিকে না। এক মাস পড়িয়েই তারা চলে যায়। আশরাফ সাহেব একের পর এক টিউটর ঠিক করেন আর তার ছেলেরা কিভাবে টিউটরকে তাড়ানো যায় সেই ব্যবস্থা করে।

খেতে খেতে ওসি সাহেব মসজিদের ঈমামকে বললেন, আমাকে একটা ভালো ছেলে দিন, যে আমার এই দুই ছেলেকে নিজের ভাইয়ের মত দেখাশোনা করবে। ঈমাম সাহেব বললেন শিক্ষক তো আর কম দিলাম না। কিন্তু তাদের অত্যাচারে কে এখানে পড়াবে বলুন! ছেলেদের কথা ভালোভাবেই জানেন ঈমাম সাহেব কারণ তিনি তাদের আরবী পড়ান। তিনিও অনেক চেষ্টা করেছেন তাদেরকে লাইনে আনার জন্য। কিন্তু বিধিবাম, কিছুতেই কিছু হয়নি। ঈমাম সাহেব কিছুক্ষন ভেবে বললেন একটা নতুন ছেলেকে দেখেছি। তাকে বলে দেখি সে হয়তো পারবে। তার মধ্যে প্রচুর ধৈর্য্য দেখেছি।

পরদিন ঈমাম সাহেব ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হতেই দেখা হল সাকিবের সাথে। সাকিব এই এলাকায় এসেছে বেশীদিন হয় নি। এই দুই কি তিন মাস। গ্রামের ছেলে, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে তাই শহরে আসা। ঈমাম সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন এই কয় দিনে সে এলাকার ছেলেদের মধ্যে নিজেকে ভীষন জনপ্রিয় করে তুলেছে।সাকিবকে ঈমাম সাহেব ওসি সাহেবের ছেলেদের পড়ানোর কথা বললেন। সাকিব রাজী হল।

২.
ওসি সাহেবের দুই ছেলে। সাজিদ আর সাঈদ। সাকিব তাদের সম্পর্কে আগে জেনে নিয়েছিলো। তাই সে এক সপ্তাহ কোন পড়াশোনার কথাই বলেনি। কেবল গল্পগুজব করেছে। এদিক-সেদিক ঘুরতে যায়। জগতের যে আরেকটি পিঠ আছে তা দেখানোর চেষ্টা করে। তাদের নিয়ে বস্তিতে যায়। মানুষের দূর্দশা দেখায়। হাসপাতালে যায় মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে শেখায়। আস্তে আস্তে তাদের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে লাগলো। সাজিদ- সাঈদ দেখলো সাকিব কোন টিউটর নয়, যেন তাদের কোন বন্ধু।

আশরাফ সাহেব খুব অবাক হলেন তার দুই ছেলের পরিবর্তন দেখে। মাসখানেকের মধ্যেই কেমন যাদুর মতন দুই ছেলেকে কন্ট্রোল করে ফেললো সাকিব। ওরা যে শুধু পড়াশোনা করে তা নয়, তারা এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে। সাকিবকে তিনি সম্মানের চোখে দেখতে লাগলেন। এরমধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আশরাফ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন রাজাকারদের ফাঁসীর বিরুদ্ধে এই দেশের টগবগে তরুণরা প্রাণ পর্যন্ত দিচ্ছে। কঠিন নির্যাতনেও ওদের দমাতে পারছেন না তারা। তারা যেন মার খাওয়ার জন্য বারবার মিছিল করছে।

সাকিব ইতিমধ্যে ওসি সাহেবের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠলো। ওসি সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি পুলিশের চাকুরীতে জয়েন করার পর অনেকেই বলেছে পুলিশের ছেলে মানুষ হয় না। সাকিবের প্রতি তিনি অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি প্রায়ই রাতে সাকিবকে খেয়ে যেতে বলেন। 

একদিন খেতে খেতে সাকিবকে বললেন, আচ্ছা ছেলেরা এভাবে রাজাকারদের জন্য জীবন দিচ্ছে কেন? সাকিব কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর নাতিদীর্ঘ একটা বক্তব্য দিয়ে দিল। ওসি সাহেব অবাক হয়ে শুনছিলেন। তিনি এতদিন ভাবতেই পারতেন না স্বাধীনতা বিরোধীদেরও যুক্তি থাকতে পারে। এত অকাট্য যুক্তি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তোমার যুক্তির বিরুদ্ধে আমার বলার যোগ্যতা নাই। তুমি আবার এগুলার সাথে জড়িত না তো? সাকিব সেদিন কোন উত্তর দেয়নি। 

৩.
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, শিবির দেখামাত্রই গুলি করতে হবে। যারা করতে পারবে তাদেরই কেবল প্রমোশন। আশারাফ সাহেব যেন এমন একটি ঘোষনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খুশিতে তার মুখ চকচক করতে লাগলো। আশরাফ সাহেব বহুদিন বহু অফিসার কে ঘুষ দিয়ে আসছেন তারপরেও প্রমোশন হচ্ছে না। তিনি প্রমাদ গুনলেন। এবার তার প্রমোশন হবেই। তিনি গুলি চালাবেন। একেবারে বুক বরাবর। প্রমোশন তাকে পেতেই হবে!
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বেশ খুশি ওসি সাহেব। কালই তিনি ঘটনাটা ঘটাবেন। কাল শিবিরের হরতাল। মিছিলে তিনি গুলি করবেন। সকালে কাকডাকা ভোরেই মিছিল শুরু হলো। তিনি এসআই দের বললেন গুলি চালাও। তারা গুলি চালালো ফাঁকা। তারপরও মিছিল থামছেনা।

তিনি তার পাশে থাকা এস আই থেকে রাইফেল কেড়ে নিলেন। তাক করলেন মিছিলের যুবকদের বুক বরাবর। ঠা ঠা ঠা টানা দশ রাঊন্ড। তিন জন যুবক লুটিয়ে পড়লো। হাসি ফুটে উঠলো ওসি সাহেবের মুখে। লাশের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
থানায় এসে নতুন অভিযানের পরিকল্পনা করছেন। এক এস আই জানালো, স্যার দুজন মারা গেছে একজন জীবিত আছে তাকে চিকিৎসা দেব? গালি দিয়ে উঠলেন তিনি ...... পুত শিবিরের জন্য কিসের চিকিৎসা? বাসা থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে। নানান ঝামেলায়  ও ব্যাস্ততায় তা ধরতে পারছেন না।

বিকেলে বাসায় গেলেন। দেখলেন তার স্ত্রী কাঁদছেন। সব শুনে বুঝতে পারলেন তিনি আজ হত্যা করেছেন সাকিবকে। বিমূঢ় হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন হাসপাতালে। দেখলেন তার দুই ছেলে ধস্তাধস্তি করছে পুলিশের সাথে। তিনি পৌঁছতেই দেখেন নিচে পড়ে আছে সাকিব। এখনো বেঁচে আছে। তার দুই ছেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে কিন্তু অন্যান্য পুলিশ তা দিচ্ছে না।
এরপর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। অনেক চেষ্টা করলেন, কিছুতেই কিছু হল না। আশরাফ বলতে লাগলেন আমি শুধু আমার ছেলেকে কে গুলি করে হত্যা করি নি, তিলে তিলে হত্যা করেছি।

কাঙ্খিত প্রমোশন হয়েছে আশারাফ সাহেবের। সাহসী পুলিশ অফিসারের পদক যখন গ্রহন করছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন পেছন থেকে দৌড়ে আসছে রক্তমাখা সাকিব। হাতে দুইটা রেজাল্ট কার্ড। বলছে দেখুন আঙ্কেল আমার দুই ভাই কত ভালো। তারা দুজনই ফার্স্ট হয়েছে।

পুনশ্চঃ আশরাফ সাহেব এখন হেমায়েতপুর। চিকিৎসার উর্ধ্বে তিনি।