ফিলিস্তিনে মূসা আ.-এর মৃত্যুর পরে কিছুদিন পর্যন্ত বনী ইসরাঈল সত্যের উপরেই ছিল। অতঃপর তারা শিরক ও বিদআতের মধ্যে নিমজ্জিত হযলো। আল্লাহ তায়াল ক্রমাগত তাদের মাঝে নবী পাঠান। কিন্তু যখন তাদের অন্যায় কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের শত্রুদেরকে তাদের উপর জয়যুক্ত করে দেন। তাদের শত্রুরা অর্থাৎ আমালিকরা তাদের বহু লোককে হত্যা করলো, বহু বন্দী করলো এবং তাদের বহু শহর দখল করে নিলো।
সামুয়েল নবী তখন ছিলেন বনী ইসলাঈলের শাসক। কিন্তু তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাই ইসরাঈলী সরদাররা অন্য কোন ব্যক্তিকে নিজেদের নেতা বানিয়ে তার অধীনে যুদ্ধ করার প্রয়োজন অনুভব করছিল। কিন্তু তখন বনী ইসরাঈলদের মধ্যে অজ্ঞতা এত বেশী বিস্তার লাভ করেছিল এবং তারা অমুসলিম জাতিদের নিয়ম, আচার-আচরণে এত বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল যে, খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্যবোধ তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা একজন খলীফা নির্বাচনের নয় বরং বাদশাহ নিযুক্তির আবেদন করেছিল।
এই ঘটনা বাইবেলে এভাবে বর্ণিত আছে, //সামুয়েল সারা জীবন ইসরাঈলীদের মধ্যে সুবিচার করতে থাকেন। আমালিকদের হামলার পর সব ইসরাঈলী নেতা একত্র হয়ে রামা'তে সামুয়েলের কাছে আসে। তারা তাঁকে বলতে থাকে, দেখো, তুমি বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছো এবং তোমার ছেলে তোমার পথে চলছে না। এখন তুমি কাউকে আমাদের বাদশাহ নিযুক্ত করে দাও, যে অন্য জাতিদের মতো আমাদের প্রতি সুবিচার করবে।
একথা সামুয়েলের খারাপ লাগে। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তায়ালা সামুয়েলকে বলেন, এই লোকেরা তোমাকে যা কিছু বলছে, তুমি তা মেনে নাও কেননা তারা তোমার নয়, আমারই অবমাননা করেছে। আমার বাদশাহীকে তারা মানতে চায় না।
সামুয়েল তাদেরকে (যারা তাঁর কাছে বাদশাহ নিযুক্তির দাবী নিয়ে আসেছিল) বললেন,
যদি বাদশাহ নিযুক্ত হয়, তবে সে তোমাদের ওপর রাজত্ব করবে। তার নীতি এই হবে যে, সে তোমাদের পুত্রদের নিয়ে যাবে। তার রথ ও বাহিনীতে চাকর নিযুক্ত করবে এবং তারা তার রথের আগে আগে দৌঁড়াতে থাকবে। সে তাদেরকে সহস্রজনের ওপর সরদার ও পঞ্চাশ জনের ওপর জমাদার নিযুক্ত করবে এবং কাউকে কাউকে হালের সাথে জুতে দেবে, কাউকে দিয়ে ফসল কাটাবে এবং নিজের জন্য যুদ্ধাস্ত্র ও রথের সরঞ্জাম তৈরী করাবে। আর তোমাদের কন্যাদেরকে পাচিকা বানাবে।
তোমাদের ভালো ভালো শস্যক্ষেত্র, আংগুর ক্ষেত ও জিতবৃক্ষের বাগান নিয়ে নিজের সেবকদের দান করবে এবং তোমাদের শস্যক্ষেত ও আংগুর ক্ষেতের এক দশমাংশ নিয়ে নিজের সেনাদল ও সেবকদের দান করে দেবে। তোমাদের চাকর-বাকর, ক্রীতদাসী, সুশ্রী যুবকবৃন্দ ও গাধাগুলোকে নিজের কাজে লাগাবে এবং তোমাদের ছাগল-ভেড়াগুলোর এক দশমাংশ নেবে। সুতরাং তোমরা তার দাসে পরিণত হবে।
সেদিন তোমাদের এই বাদশাহ, যাকে তোমরা নিজেদের জন্য নির্বাচিত করবে তার কারণে তোমরা ফরিয়াদ করবে কিন্তু সেদিন আল্লাহ তোমাদের কোনো জবাব দেবেন না। তবুও লোকেরা সামুয়েলের কথা শোনেনি। তারা বলতে থাকে, না আমরা বাদশাহ চাই, যে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। তাহলে আমরাও অন্য জাতিদের মতো হবো। আমাদের বাদশাহ আমাদের মধ্যে সুবিচার করবে, আমাদের আগে আগে চলবে এবং আমাদের জন্য যুদ্ধ করবে।//
সামুয়েল আ. তাদেরকে আরেকটি বিষয়ে সাবধান করেছিলেন যে, যদি বাদশাহ তাদের জিহাদ করতে বলে তবে কি তারা জিহাদ থেকে পালিয়ে যাবে? মূলত বনী ইসরাইলের বেশিরভাগ লোক যুদ্ধ না করেই আমালিকদের (আমুন মুর্তির পূজারী) হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। ওরা ভেবেছিল একজন বাদশাহ তাদের ওপর নিযুক্ত করলে সে তার সৈন্যবাহিনী দিয়ে তাদের উদ্ধার করবে।
নবী সামুয়েলের প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেছিল, আমাদের সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং আমাদের সন্তানাদিকে বন্দী করা হয়েছে। আমরা কি এতই কাপুরুষ যে তবুও আমরা মৃত্যুর ভয়ে জিহাদ হতে মুখ ফিরিয়ে নেবো? তখন জিহাদ ফরয করে দেওয়া হলো এবং তাদেরকে বাদশাহর সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করতে বলা হলো।
আল্লাহর নবীকে রেখে তারা অন্য কাউকে নেতা হিসেবে চাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাদের পরীক্ষাকে আরো কঠিন করে দেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে নবী সামুয়েল আ. একজন সাধারণ সৈনিক অথচ ঈমানদারকে (তালুত)তাদের সামনে বাদশাহরূপে পেশ করলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন না বরং একজন সৈনিক ছিলেন। ইয়াহূদার সন্তানেরা ছিল সম্ভ্রান্ত লোক এবং তালুত এদের মধ্যে ছিলেন না। তাই ইহুদীরা প্রতিবাদ করে বললো যে, তার অপেক্ষা তারাই রাজত্বের দাবীদার বেশী। দ্বিতীয় কথা এই যে, তিনি দরিদ্র ব্যক্তি। তাঁর কোন ধন-মাল নেই।
নবীর আদেশের সামনে তাদের এই প্রতিবাদ ছিল প্রথম বিরোধিতা। নবী আঃ উত্তর দিলেন, এই নির্বাচন আমার পক্ষ হতে হয়নি যে, আমি পুনর্বিবেচনা করবো। বরং এটা তো স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ। সুতরাং এই নির্দেশ পালন করা অবশ্য কর্তব্য। তাছাড়া এটাতো প্রকাশমান যে, তিনি তোমাদের মধ্যে একজন বড় আলেম, তার দেহ সুঠাম ও সবল, তিনি একজন বীর পুরুষ এবং যুদ্ধ বিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা রয়েছে।
সামুয়েল আ. আরো বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই হচ্ছেন মহাবিজ্ঞ এবং সাম্রাজ্যের প্রকৃত অধিকর্তা তিনিই। সুতরাং তিনি যাকে ইচ্ছে করেন তাকেই রাজত্ব প্রদান করে থাকেন। তিনি হচ্ছেন সর্বজ্ঞাতা ও মহাবিজ্ঞানময়। কার এই ক্ষমতা রয়েছে যে, তার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করে! তিনি যাকে চান নিজের নিয়ামত দ্বারা নির্দিষ্ট করে থাকেন, তিনি মহাজ্ঞানী। সুতরাং কে কোন জিনিসের যোগ্য এবং কোন জিনিসের অযোগ্য এটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন।
নবী আ. তাদেরকে বলেন- 'তালূতের রাজত্বের প্রথম বরকতের নিদর্শন এই যে, সেই সিন্ধুকটি তোমরা ফিরিয়ে পাবে, যার মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী। যার ভিতরে রয়েছে পদমর্যাদা, সম্মান, মহিমা, স্নেহ, ও করুণা। তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নিদর্শনাবলী যা তোমরা ভালভাবেই জান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই হারানো সিন্ধুক নব নিযুক্ত বাদশাহ তালুতের কাছে চলে এলো। এতে বনী ইসরাঈলের লোকেরা তালুতের আনুগত্য মেনে নিলো।
যখন লোকেরা তালূতকে বাদশাহ বলে মেনে নিলো তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে যুদ্ধে বের হলেন। তালূত তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। হযরত ইবনে আব্বাসের রাঃ উক্তি অনুসারে এই নদীটি উরদুন ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত ছিল। ঐ নদীটির নাম ছিল 'নাহরুশ শারীআহ। তালুত তাদেরকে সতর্ক করে দেন যে, কেউ যেন ঐ নদীর পানি পান না করে। যারা পান করবে তারা যেন আমার সাথে না যায়। এক আধ চুমুক যদি কেউ পান করে নেয় তবে কোন দোষ নেই। কিন্তু তথায় পৌঁছে গিয়ে তারা অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। কাজেই তারা পেট পুরে পানি পান করে নেয়। কিন্তু অল্প কয়েকজন অত্যন্ত পাকা ঈমানদার লোক ছিলেন। তাঁরা এক চুমুক ব্যতীত পান করলেন না।
হযরত ইবনে আব্বাসের রা. উক্তি অনুযায়ী ঐ এক চুমুকেই ঈমানদারদের পিপাসা মিটে যায় এবং তারা জিহাদেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যারা পূর্ণভাবে পান করেছিল তাদের পিপাসাও নিবৃত্ত হয়নি এবং তারা জিহাদের উপযুক্ত বলেও গণ্য হয়নি। যারা নদীর পরীক্ষায় পাশ করেছে তালুত তাদের নিয়ে নদী পার হলেন এবং মূর্তি পূজারীদের নেতা জালুতের মুখোমুখি হলেন।
জালুতের বীরত্বের কথা ও তার বিশাল সেনাবাহিনীর কথা জেনে বনী ইসরাঈলের লোকেরা আবারো ভীত হয়ে পড়লো। তারা যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা কাপুরুষতার সাথে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বসলো। শত্রু সৈন্যদের সংখ্যা বেশী শুনে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সুতরাং তারা স্পষ্টভাবে বলে ফেললো, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।'
তাদের মধ্যে যারা আলেম ছিলেন তারা তাদেরকে বহুরকম করে বুঝিয়ে বললেন, বিজয় লাভ সৈন্যদের আধিক্যের উপর নির্ভর করে না। ধৈর্যশীলদের উপর আল্লাহ তা'আলার সাহায্য এসে থাকে। বহুবার এরূপ ঘটেছে যে, মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকে বিরাট দলকে পরাজিত করেছে। সুতরাং তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহ তা'আলার অঙ্গীকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ কর। এই ধৈর্যের বিনিময়ে আল্লাহ তোমাদের সহায় হবেন। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও তাদের মৃত অন্তরে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো না এবং তাদের ভীরুতা দূর হলো না।
মূলত আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে প্রার্থক্য স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। বস্তুত দেখা গেল যারা বাদশাহ চেয়েছিল তারা কেউ আর জিহাদে নেই। এমন আশংকা নবী সামুয়েল আ. আগেই করেছিলেন। যাই হোক অতঃপর সেনাপ্রধান তালুত অল্প কিছু ঈমানদারকে সাথে নিয়ে জালুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। যুদ্ধের প্রাক্কালে তালুত ও ঈমানদারগণ একটি দোয়া করলেন। এই দু'আ আল্লাহ তায়ালা খুব পছন্দ করলেন। মূলত এই দু'আর প্রেক্ষাপট লেখার জন্যই এই ইতিহাস বর্ণনা করলাম।
তালুত ও তার অনুসারী হাত তুলে কায়মনোবাক্যে বললেন, رَبَّنَآ اَفۡرِغۡ عَلَيۡنَا صَبۡرًا وَّثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَانصُرۡنَا عَلَى الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِيۡنَ﴿٢٥٠﴾
রব্বানা আফরিঘ আলাইনা সাব-রান ওয়া থাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা আলাল-কাউমিল-কাফিরিন
অর্থ: "হে আল্লাহ! আমাদের ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে দাও, এবং আমাদেরকে অবিচল রাখো এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিজয় দান করো।" [সূরা আল-বাক্বারাহ:২৫০]
দোয়া করা শেষে তালুত বনী ইসরাঈলের মধ্যে একজন সাহসী সামনে আসতে বললেন যিনি আক্রমণের অগ্রভাগে থাকবেন। দাউদ আ. এ সময় ছিলেন একজন কম বয়সী যুবক। তিনি তালুতের আহবানে সামনে এলেন। মুশরিকদের বাদশাহ জালুত দ্বন্দ্বযুদ্ধে একজন আহবান করলো। দাউদ আ. নির্ভয়ে জালুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং জালুতকে হত্যা করলেন। এই ঘটনায় মুশরিক বাহিনীর মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে তাদের বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়।
এ ঘটনায় দাউদ আ. হয়ে উঠলেন ইসরাঈলীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তালুত নিজের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবুয়্যত দান করলেন। অবশেষে তিনিই হলেন ইসরাঈলীদের শাসক।
এই ঘটনায় আমরা যে শিক্ষা পাই,
১. মুশরিকদের সাময়িক জয়ে আমরা যেন ধৈর্যহারা না হয়ে পড়ি।
২. আল্লাহ তায়ালা ও নবী সা.-এর সিদ্ধান্তের বাইরে বাদশাহ হওয়া ও বাদশাহীর অনুসরণ যেন না কামনা করি।
৩. যুদ্ধ জয়ের জন্য মুসলিমদের বেশি লোকের প্রয়োজন নেই। দরকার অবিচল ঈমান।
৪. দলে মুনাফিক থাকলে যুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন। তাই মুনাফিক ছাঁটাই জরুরি।
৫. বিজয় আল্লাহর সাহায্যে হবে, তাই জয়ী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে হবে।
#রব্বানা
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন