১৬ মার্চ, ২০২৫
১৪ মার্চ, ২০২৫
বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন জাহাজের ইতিকথা
আমেরিকায় থাকাকালেই ছোট ভাই বাংলাদেশের অনিন্দ্যসুন্দর প্রবাল দ্বীপের খবর পান। দেশে এসেই বড়ভাইকে বলেন, চলো ভাই, আমরা সেন্টমার্টিন ঘুরে আসি। বড় ভাই রাজনীতিবিদ। ঘোরার সময় কই?
ছোট ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে দুই ভাইয়ের পরিবার, বাবা-মা সহ বড় ভাই রওনা হলেন সেন্টমার্টিন। একটি ট্রলারে করে তারা রওনা হলেন। যাওয়ার সময় কোনো বিপত্তি হয়নি। এতো সুন্দর একটা দ্বীপ সবাইকে বিমোহিত করে।
এই অসাধারণ উদযাপনের মধ্যে কপালে ভাঁজ পড়ে বড় ভাইয়ের। এতো সুন্দর একটা দ্বীপ। এতো সুন্দর পর্যটন এরিয়া। অথচ এখানে আসার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন।
দুইদিন থাকার পর এবার ফেরার পালা। পুরো পরিবার ট্রলারে উঠে বসলেন। এমন সময় হঠাৎ সমুদ্র উত্তাল। কাঁপতে শুরু করে ট্রলার। ট্রলারে থাকা মানুষগুলোর আর্তচিৎকার আর হাহাকারে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। দুই ভাই তাদের সন্তানদের আগলে ধরে রেখেছেন।
কিন্তু সমুদ্রের পানির দাপটে তা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিল। একবার ট্রলার পানির সাথে সাথে উপরে উঠছে। পরক্ষণেই আবার সমুদ্রে আছড়ে পড়ছে। এই কঠিন অবস্থায় ট্রলারের সবাই হতাশ হয়ে পড়ে। দুই ভাই এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়।
কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই কঠিন দিনের অবসান হয়। তারা কোনো রকম অর্ধমৃত অবস্থায় টেকনাফে পোঁছে। বড় ভাই পাড়ে এসে জানতে পারেন এটা নাকি সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাদের নিয়তি। এভাবেই তাদেরকে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করে চলতে হয়।
এবার টেকনাফ থেকে ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি। ঢাকা যাওয়ার সময় ছোট ভাইসহ সবাই ঘুমে। কিন্তু বড় ভাই জেগে আছেন টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনবাসীর চিন্তায়। এভাবে তো মানুষের জীবন চলতে পারে না।
ঢাকায় এসে বড় ভাই এই সমস্যা নিয়ে অনেক চিন্তা ও বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু সমাধানে আসা যায়নি। কারণ এই সমস্যার সমাধান হলো টেকনাফ - সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চালু করা। কিন্তু জাহাজ চালু করার মতো যাত্রী সেখানে নেই। সরকারিভাবেও ভর্তুকি দিয়ে জাহাজ চালু করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সেটাও সম্ভবপর হয়নি।
তখন বড় ভাইয়ের মাথায় নতুন আইডিয়া এলো। পর্যটন জাহাজ চালু করলে কেমন হয়। জাহাজের নৈমিত্তিক খরচ ওঠাতে পর্যটক লাগবে। ঐ রুটে এতো পর্যটকও নেই। তারপরও বড় ভাইয়ের দৃঢ় কঠিন সিদ্ধান্ত জাহাজ চালু করতেই হবে। এভাবে দ্বীপের মানুষকে বিপদে রেখে শান্তিতে থাকা যাবে না।
বড় ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, সেন্টমার্টিনে যাওয়ার কথা বলে একটা পর্যটন জাহাজ চালু করবেন। এটা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার করবেন। তাহলে যাত্রী পাওয়া যাবে। আর যাত্রী পাওয়া গেলে জাহাজের নৈমিত্তিক খরচ উঠে আসবে। ভর্তুকি দিতে হবে না। বিনিময়ে জীবনযাত্রা সহজ হবে সেন্টমার্টিনের অসহায় মানুষদের।
সাহস করে লক্ষ লক্ষ টাকা লগ্নি করলেন তিনি। চালু হয়ে গেল বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন জাহাজ। চারদিকে খবর রটে গেলো। হাজার হাজার পর্যটক জুটে গেলো টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে। আর সেই সাথে সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো সেন্টমার্টিনবাসীর।
শুধু তাই নয়। একমাত্র মাছধরা ছিল যে সেন্টমার্টিনবাসীর আয়ের উৎস, সেই সেন্টমার্টিনবাসীর আয়ের উৎসই চেইঞ্জ হয়ে গেলো। এখন পর্যটনই হচ্ছে সেন্টামার্টিনবাসীর মূল আয়ের উৎস। বড় ভাই সেই পর্যটন জাহাজে অনেক যাত্রী দেখে লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। এই জাহাজকে বাঁচিয়ে রাখবে পর্যটকরা, আর সেন্টমার্টিনবাসীকে উদ্ধার করবে জাহাজটি। মানুষকে যেন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন পাড়ি দিতে না হয়।
সেই জাহাজটির নাম কেয়ারি সিন্দবাদ। আর বড় ভাইয়ের নাম শহীদ মীর কাসেম আলী রহ.। যাঁর কাজ ছিল সমস্যা থেকে সম্ভাবনা তৈরি করা। দ্বীপবাসীর যাতায়াত সহজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সেন্টমার্টিনকে যুক্ত করে ফেললেন মীর কাসেম আলী রহ.। আল্লাহু আকবার। কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি।
২০০৩ সালে তিনি 'কেয়ারি ট্যুরস এন্ড সার্ভিস লিমিটেড' নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেন। কেয়ারি নামে আগেই তাঁর একটি হ্যাচারি, রিয়েল এস্টেটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন জাহাজ কেয়ারি সিন্দবাদ জাহাজ চালু হয়।
এই জাহাজের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগর এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের মনোরম সৌন্দর্য পরিদর্শন এবং উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই জাহাজে রয়েছে ৩৪৬টি বিলাসবহুল বসার ব্যবস্থা, প্রথম শ্রেণীর ক্যান্টিন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অত্যন্ত দক্ষ কর্মী, ১২টি লাইফ র্যাফট, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, ১১টি লাইফ বয়া এবং একটি উদ্ধারকারী নৌকা।
এছাড়াও যাত্রীদের জন্য রয়েছে জাহাজটির নিজস্ব জেটি। দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। এটি লম্বায় ১১২ ফুট, ২৫ ফুট প্রশস্ত। এখন পর্যন্ত এই রুটে ৭ টি জাহাজ চালু হয়েছে। কিন্তু এখনো সবচেয়ে কম ভাড়া হলো কেয়ারি সিন্দবাদের।
বাংলাদেশে এই মহানায়ককে বাঁচতে দিলো না মুশরিকরা। তারা তাদের দোসরদের দিয়ে হত্যা করেছে বাংলাদেশের মহান সন্তানদের। এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করার জন্য একাত্তরের সৃষ্টি। একাত্তরের চেতনা দিয়েই এদেশের সম্ভাবনাকে খুন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ফিড মিল তৈরির ইতিহাস
মোটা পলিথিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া বস্তির একটি ঘর। সেই ঘরের কর্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বস্তির মানুষদের দিনলিপি দেখা যায়। সেই দিনলিপি দেখে বস্তির মানুষদের জন্য কিছু সহায়তা করার চিন্তা আসে দালানে থাকা মানুষটার।
একদিন বস্তির সেই সন্তানসম্ভবা মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিল্ডিং-এ থাকা মানুষটা তার স্ত্রীকে নিয়ে ছুটে যান সেই মহিলার কাছে। গাড়ি ডেকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
বস্তির মহিলাটির ভীষণ অপুষ্টি। হিমোগ্লোবিন ছিল খুবই কম। দালানের মানুষটি ডাক্তার হাসপাতাল ইত্যাদির সাথে জড়িত মানুষ ছিলেন। বস্তির মহিলাটির সমস্যা সমাধানে পুরো হাসপাতাল তৎপর হয়ে গেলো।
কিন্তু সর্বনাশ তো আগেই হয়ে আছে। দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে থাকা মহিলাটির বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ছোট্ট বাচ্চাটি জন্ম নেয়ার সময়ই ইন্তেকাল করে। মহিলাটি এই যাত্রায় বেঁচে যায়। কিন্তু বাঁচার সংগ্রামটা ছিল বড়ই কষ্টসাধ্য।
দালানের মানুষটার কপালে ভাঁজ পড়ে। কিছু একটা করতে হবে এই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য। পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত করতেই হবে। অপুষ্টির জন্য মানুষ মারা যাবে এই দেশে, এটা তো কোনোভাবেই হওয়া উচিত না।
দিন রাত চিন্তা করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন মহিলাদের জন্য। মহিলারা ঘরের ছোট্ট কোণায় গড়ে তুলবে মুরগির খামার। (৪/৬/৮ টি মুরগির একটি খাঁচা + ৪/৬/৮ টি ডিম পাড়া মুরগি + মুরগির খাবার + ঔষধ) এই মিলে একটা প্যাকেজ। মহিলাদের ঘরের সদস্য অনুসারে প্যাকেজ দেওয়া হবে। তারা কিস্তিতে প্যাকেজের মূল্য পরিশোধ করবে। যারা কিস্তি তুলতে আসবে তারাই ছোট খামার তদারক করবে। মুরগির ঔষধ ও খাবার দিয়ে যাবে।
দালানের মানুষটা এর মাধ্যমে তিনটা উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছেন। এক. দেশের উৎপাদন বাড়ানো। দুই. মহিলাদের মাধ্যমে বাড়তি পারিবারিক আয়। তিন. মূল উদ্দেশ্য পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত।
পরিকল্পনা অনেক বড়। কিন্তু সামর্থ সীমিত। তাই নিজের শিক্ষক স্ত্রীকেই কাজে লাগালেন। তাঁর স্ত্রী নিজে প্রশিক্ষণ নিলেন, কীভাবে খাঁচায় মুরগী পালতে হয়? অসুবিধা কী কী হয়? সেগুলো কীভাবে ওভারকাম করতে হয়?
স্বামী স্ত্রী মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে থাকলেন। নিজের বারান্দায় মুরগির খামার গড়ে তুললেন। মহিলাদের ডেকে ডেকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন তারা। সফলতা পেতে শুরু করলেন। বহু মহিলা এই প্যাকেজ কার্যক্রমে যুক্ত হলেন। এরপর ওনারা দেখলেন ওনাদের প্রচুর ফিড দরকার।
এটি আশির দশকের ঘটনা। তখন পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশে বিকশিত হয়নি। তাই ফিডের ব্যবস্থাও ছিল না। বিদেশ থেকেই আসতো কিছু। বহু মানুষ মুরগি চাষ শুরু করায় মুরগির খাদ্যের সংকট দেখা দিলো। দালানের মানুষটা ফিড তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ফিড মিল তৈরি করে ফেললেন।
শুধু তাই নয়, শহর থেকে এই কার্যক্রম গ্রামে ছড়িয়ে দিলেন। সেখানে দেখা গেলো মানুষের পুকুরও আছে। কার্যক্রমে মাছ যুক্ত হলো। ধীরে ধীরে মুরগির বাচ্চা, মাছের পোনা, গরুর খাবার সবকিছুই তৈরি করতে লাগলেন।
যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, সুযোগ পেলে সবসময় পরামর্শ দিতেন সরকার যেন "একটি পরিবার একটি খামার" প্রকল্প গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি এটি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন।
দালানের সেই মানুষটির ফিড কারখানা ছিল গাজীপুরে। তিনি নানানভাবে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেন। সমবায় মন্ত্রনালয় অবশেষে তাদের পরিকল্পনায় বিষয়টি গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে "একটি পরিবার একটি খামার" প্রকল্পের পাইলটিং শুরু হয়। ততক্ষণে সরকার চেইঞ্জ হয়ে যায়।
কে ছিল সেই মানুষ? জানতে চান? বাংলাদেশের স্বৈরাচার জালিম হাসিনা এই অসাধারণ মানুষটাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে। তিনি আমাদের নেতা শহীদ মীর কাসেম আলী রহ.। আর তাঁর সেই প্রতিষ্ঠানের নাম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (AIT)। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ফিড তৈরির পাইয়োনিয়ার।
কী দারুণ মানুষ ছিলেন তিনি, জানি আর অবাক হই!!
১১ জানু, ২০২৫
আনন্দ মিছিল পরিণত হয় বিষাদে
৪ আগস্ট দেড়শতাধিক মানুষকে মেরে ফেলে পুলিশ। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্ররা। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ৬ তারিখের ঢাকামুখী লংমার্চ একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বৈরাচারী হাসিনাকে যে করেই হোক তাড়াতে হবে এমন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান। মিছিলে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, সরকারের পতন হয়েছে। তখন মনিরুজ্জামান তাঁর বন্ধু মো. আলম কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন গণভবনে। উৎসুক জনতার সঙ্গে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন তাঁরাও। কিন্তু এ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর।
৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল মনিরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু আলম। হাসিনা পালিয়েছে শুনে তারাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যান। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার দিকে গণভবন থেকে বের হয়ে আসেন। পরে তারা পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন।
তারা যখন মসজিদে ছিলেন তখনই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পুলিশ সদর দপ্তরে তখনো কিছু গণহত্যাকারী পুলিশ লুকিয়ে ছিল। জনতা তাদের ঘেরাও করলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় জনতা ও সন্ত্রাসী পুলিশের সংঘর্ষ। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসে মনিরুজ্জামান ও তার বন্ধু আলম। গুলির মুখে পড়ে যায় দুই বন্ধু। সন্ত্রাসী পুলিশের একটি গুলি এসে লাগে মুনিরুজ্জামানের গায়ে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। আহত হন বন্ধু আলম। এরপরও থেমে থাকে নি পুলিশ। লুটিয়ে পড়া মনিরের ওপর আবারো গুলি করেছে পুলিশ। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই দিন রাতেই মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
নিহত মনিরুজ্জামান মোল্লার (২৬) বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়ি। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লা। মনিরুজ্জামান রাজধানী ঢাকার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি একটি জুতার কোম্পানিতে কাজ করতেন। পরদিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় স্বজনেরা জানতে পারেন মনিরুজ্জামানের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রয়েছে। ওই দিন রাতে মনিরুজ্জামানের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়িতে আনা হয়। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন করা হয়।
রাজৈর উপজেলাধীন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের শানেরপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে শাখারপাড় মোল্লাবাড়ি গ্রাম। মনিরুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা একটি টিনশেড ঘর। এই ঘরেই মা-বাবা আর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতেন মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামানের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না তাঁর স্বজনেরা। তাঁর স্ত্রী সামিরা ইসলাম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। সামিরা বলেন, ‘আমার সন্তান এখনো পৃথিবীর আলো দেখে নাই, তার আগেই ও বাবাকে হারাল। এখন আমার সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে? স্বামী ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার আপন কেউ নাই। হায় আল্লাহ, আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমি কি আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার পাব?’
মনিরুজ্জামানের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা মনোয়ারা বেগম। ছেলের কথা ভেবে এখনো বারবার মূর্ছা যান তিনি। বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লাও বাকরুদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমার পোলাডারে গুলি কইরা মারছে, আমি কার কাছে এই কথা কমু? কার কাছে বিচার দিমু। আমার ছেলেডা ছোট হইলেও অনেক দায়িত্ব নিত। পোলাডা আমার মা-বাবা ছাড়াও বোনগো খেয়াল রাখত। আমার নয়নের মণি ছিল। আল্লারে তুমি আমার পোলাডারে ফিরাইয়া দাও।’
তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো বিজয় মিছিলে গেছিল। সেখান থেকে আর ফিরা আইলো না। আমার ভাইডাকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে।’
মনিরুজ্জামানের বন্ধু আলম কাজীর বাড়ি মাদারীপুর শহরে। ওই দিনের বর্ণনায় আলম বলেন, ‘আমরা গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিক থেকে তখন গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) আর বেঁচে আর নেই। সেই দিনের কথা এখনো চোখে ভাসছে।’
মনিরুজ্জামান মোল্লা লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকুরি করতেন। তার আয় দিয়েই চলতো সংসারের খরচ। দেশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করলেন তিনি। শহিদ হলেন। কিন্তু তার সংসারের চাকা গেলো অচল হয়ে। মনিরের মৃত্যুতে আর্থিক দুরাবস্থায় পড়লেন তার বাবা, মা ও স্ত্রী। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন,‘আমার ভাইকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে?’
এদিকে মনিরুজ্জামান পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আয় রোজগার করতে পারেন না। এখন সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবারটি।
৬ জানু, ২০২৫
দেশের খবর নিয়ে তৃপ্তির ঘুম দেন ফরিদ শেখ
ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিল সে। তাই মামলার ভারে জর্জরিত ছিল ফরিদ। পালিয়ে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু তাই বলে তো জীবন থেমে থাকে না। ফরিদকে বিয়ে দেয় তারর পরিবার। মায়ের বড় আদরের ছিলেন ফরিদ। ৫ মেয়ের পর ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে ফরিদের মা ফরিদকে পায়। ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন মানুষ থেকে ১১ লক্ষ টাকা ধার করে ফরিদ।
জীবনটা বড় কঠিন ফরিদের। সরকার ও আওয়ামী লীগের ক্রমাগত নির্যাতনে ব্যবসাটা ঠিকভাবে করতে পারে না মুন্সিগঞ্জের ফরিদ শেখ। ব্যবসায় লস করতে থাকে। একদিকে পরিবার চালানোর চাপ অন্যদিকে পাওনাদারদের তাড়া। জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে শেখ ফরিদের।
মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসেন যাত্রাবাড়ীতে। কাজ নেন ফলের আড়তে। মানবেতর জীবনযাপন করে টাকা জমিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেন কিছু দিয়ে পরিবারের খরচ চালান। এভাবেই চলছিল তাঁর জীবন। প্রায় দুই লক্ষ টাকা শোধও করেছনে তিনি।
শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন। ফরিদ শেখ প্রথমে ছাত্রদের সহায়তা করতেন। পরে একেবারেই সম্পৃক্ত হয়ে যান আন্দোলনের সাথে। ৪ আগস্ট ছিল খুবই উত্তপ্ত একটি দিন। যাত্রাবাড়ীতে সেদিন ২০ জনের বেশি মানুষ শাহদাতবরণ করে। বেলা ১১ টায় ফরিদ যখন ফলের আড়তের কাজ শেষ করে তখন ইতোমধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
ফরিদ তার বন্ধুদের নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেয়। তারা শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে। যাত্রাবাড়ির পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সমানে গুলি করতে থাকে। এমনি একটি গুলি ফরিদের পেটে এসে লাগে। নাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ফরিদের। বন্ধুরা ফরিদকে নিয়ে প্রথমে যাত্রাবাড়ীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা থাকায় নিয়ে যায় মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে।
এর পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট পালিয়ে যায় ডাইনী হাসিনা। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু জ্ঞান ফেরে না ফরিদ শেখের। ৬ আগস্ট অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান ফেরে তার। চোখ খুলেই জিজ্ঞাসা করে, দেশের কী খবর? তাকে স্বজনেরা জানায়, দেশ স্বাধীন! হাসিনা পালাইছে। যেন তৃপ্তি নেমে আসে ফরিদের চোখে। চোখ বন্ধ করে ফরিদ। এই চোখ আর খুলে নি।
৬ আগস্টই শাহদাতবরণ করে ফরিদ শেখ।
প্রতিদিন বাড়িতে মা-বাবার কাছে অন্তত দুবার ফোন দিয়ে কথা বলতেন মুন্সিগঞ্জের মো. ফরিদ শেখ। তাঁর বয়স এখন তিরিশের ঘরে। একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করা ফরিদ ৪ আগস্ট মাকে চারবার ফোন দিয়েছেন। প্রতিবার ফোনে মাকে দেশের অবস্থা জানিয়ে সতর্ক করেছেন। বাবা ও ছোট ভাইকে বাড়ি থেকে বাইরে যেতে নিষেধও করেন। কিন্তু ওই দিন নিজে আন্দোলনে গিয়ে শাহদাতবরণ করেন।
তাঁর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমাগো সাবধানে থাকতে কইয়া নিজে আন্দোলনে গিয়ে জীবন দিল। পোলাডার পেটে গুল্লি কইরা নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়া দিল। দুই দিন হুঁশ ছাড়া বাইচ্চা আছিল। ৬ আগস্ট কিছু না কইয়াই মইরা গেল।’
ফরিদ মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার সুখবাসপুর এলাকার সুলতান শেখের ছেলে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদ ভাইদের মধ্যে বড় ছিলেন। আলেয়া বেগম বলেন, ‘ফরিদ ৫ মেয়ের পর হইছে। আমার খুব আদরের পোলা। পোলাডাও আমারে ছাড়া কিছু বুঝত না। দেশের লাইগা আন্দোলনে গেল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের মাইনষেরা মাইরা ফালাইল।’
ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘আমাগো খুব অভাব-অনটনের সংসার। ফরিদ ব্যবসা করার লাইগা ১১ লাখ টাকা ধার করছিল। ব্যবসায় মাইর খাইয়া যাত্রাবাড়ী ওর চাচাতো ভাইগো দোকানে এক বছর আগে কাজ লইছিল। দুই লাখ টাকা ধার শোধ করছিল। এখন আমাগো সংসারই তো ঠিকমতো চলব না। ধারের টাকা কেমনে শোধ করমু?’
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে সুলতান শেখ বলেন, ‘ফরিদ ৪ আগস্ট সকালে আড়তে কাজ করছিল। দুপুর ১২টার দিকে ওর ফোন থেকে একটি ফোন আসে। ফোন রিসিভ করতেই অচেনা একজন বলল, ফরিদের পেটে গুলি লাগছে। ওরে হাসপাতালে নিতাছে। আমরা যেন তাড়াতাড়ি যাই। ওই দিন ঢাকার অবস্থা অনেক খারাপ আছিল। রোগী আর লাশে ভরা। কয়েকটা হাসপাতালে নিয়াও চিকিৎসা দিতে পারি নাই। শেষে মুগদা হাসপাতালে জ্ঞানহীন অবস্থায় ভর্তি করাই। পরদিন একবার চোখ খুইল্লা তাকাইয়া জিগাইল, দেশের কী অবস্থা। ওই দিনই বেলা ১১টার দিকে মারা যায়।’
ফরিদদের বাড়িতে গেলে জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘর দেখিয়ে জানানো হয়, ওই ঘরেই থাকতেন ফরিদ। ফরিদের বিছানায় বসে স্বজনদের সঙ্গে ফরিদের স্মৃতিচারণা করছিলেন তাঁর বাবা-মা। পাশেই বসে ছিলেন ফরিদের চাচাতো ভাই রবিউল ইসলাম। তাঁদের আড়তে কাজ করতেন ফরিদ।
রবিউল ইসলাম বলেন, জুলাই মাসে দেশে যখন আন্দোলন শুরু হলো, তখন থেকে ফরিদ আন্দোলনে যেতেন। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আড়তে ব্যস্ত থাকতেন। কাজ শেষ করে তাঁদের না জানিয়ে আন্দোলনে চলে যেতেন। বিষয়টি জানতে পেরে ওকে নিষেধ করতেন। যখন বলতেন, চুপ করে শুনতেন। পরদিন আবার আন্দোলনে চলে যেতেন।
ফরিদ শেখের আড়াই বছরের একটি মেয়ে আছে। স্ত্রী ও সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতেই স্বজনেরা জানালেন, চার বছর আগে ফরিদকে বিয়ে করান। মৃত্যুর পর পাওনাদাররা বাড়িতে আসতে পারেন ভেবে তাঁর স্ত্রী ইতি আক্তারকে বাবার বাড়িতে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। ফরিদের চল্লিশার দিন তাঁর আসার কথা আছে। ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, পুরো সংসারটি এলোমেলো করে দিয়েছে, আমি সেই হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
ফরিদের প্রতিবেশী ও জেলা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক ইমতিয়াজ নিপু বলেন, ‘ফরিদ সব সময় স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো কর্মসূচিতে আমাদের সঙ্গে অংশ নিতেন। বিয়ের পর কাজের জন্য আমাদের সঙ্গে কর্মসূচি করতে পারেননি। তবে ঢাকায় যেকোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।’ তিনি বলেন, ফরিদ দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এখন তাঁর পরিবার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
ছোট্ট আড়াই বছরের শিশু কন্যা ফাতেমা আক্তারকে এতিম করে চলে গেলেন ফরিদ। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ইতি আক্তারের আড়াই বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পিতার অভাব অনটনের সংসারে। বাবা ঢাকায় আছে বললে আদরের অবুঝ ফুটফুটে শিশু কন্যা ফাতেমা আশায় থাকে বাবা সেখান থেকে ‘মজা’ নিয়ে আসবে। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় আবার খেলার জগতে। বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারলো না ফাতেমা। যে দিন জানবে পিতার মৃত্যুর ঘটনা সেদিন তার সামনে চলে আসবে এক ভয়ংকর ইতিহাস। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে হাসিনার ফ্যাসিষ্ট দোসরদের।
ফরিদের মৃত্যুর তিন মাস পরেও মা অপেক্ষায় থাকেন ছেলের ফোনের জন্য। আদরের প্রথম পুত্র ফরিদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার।
ফরিদ স্থানীয় বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশুনা বেশি করতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন হিমাগারে কাজ করায় শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোন কাজ করতে পারিনা। সংসারে হাল ধরতে ফরিদ দেড় বছর আগে ঋণ নিয়ে ফোনের দোকান দেয়। ব্যবসায় মার খেয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে সুখ আনতে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে চাচাত ভাই নুরুল আমীনের কলার আড়তে কাজ শুরু করে।
ফরিদের পিতা জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। আগামী দিনের অজানা এক চিন্তায় দিশেহারা ইতি আক্তার আরো বলেন, বিশ হাজার টাকা শুধু পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামী থেকে শ্বশুর যে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছেন সেখান থেকে কিছুই আমি পাইনি।
এ সময়ে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখে ইতি বলতে থাকেন, ‘স্বামীর সংসারও করতে পারলাম না, শ্বশুর বাড়ীতেও এখন স্থান হচ্ছে না। জীবনের বড় সম্পদ স্বামীকে হারিয়েছি।’ এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন ইতি।
আমরা আমাদের বীর শহীদ, যারা নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে খুনী হাসিনার হাত থেকে রক্ষা করেছে তাদেরকে ভুলে যেতে দেব না। তাদেরকে তাদের সন্তানকে কোলে পিঠে করে রাখবো ইনশাআল্লাহ।
পুনশ্চঃ এই খবর জানার পর জামায়াত পুনরায় ফরিদ শেখের স্ত্রী ইতি'র কাছে এক লক্ষ টাকার সহায়তা হস্তান্তর করে।
২৪ ডিসে, ২০২৪
মা, যাচ্ছি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবো
২৩ ডিসে, ২০২৪
আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?
দুই বন্ধু ও আন্দোলনকারীরা শোহানকে পাশেই থাকা বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে থাকা কর্মকর্তারা চিকিৎসা দিতে চায় নি। প্রাথমিক কিছু কাজ শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে এক্স-রে করে বুকে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষও ভর্তি নেয়নি। তদুপরি তখন ঢাকা মেডিকেলেও সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা আহতদের ওপর নির্যাতন করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে আসেন তাঁরা।
এরপর আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে গুলিবিদ্ধ শোহানকে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় ১২ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শোহানকে। সেখানে ওই দিনই ছোট একটা অস্ত্রোপচার করা তাঁর। তবে গুলি শরীরে থেকে বের করা যায় নি।
ডাইনি শেখ হাসিনার নৃশংস নির্যাতন এখানেই শেষ হয়নি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে জামায়াত-শিবিরকে শোহানের সহকর্মী ওলিউল্লাহ ও নূর হোসেনকে পিটিয়েছে পুলিশ। ওলিউল্লাহ বলেন, গত ২২ জুলাই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শোহানকে অক্সিজেন নিতে সহযোগিতা করছিলেন। এমন সময় পুলিশ এসে ‘জামায়াত-শিবির’ বলে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। বাইরে বসে থাকা আরেক সহকর্মী নূর হোসেনকেও লাঠিপেটা করা হয়। শুধু তাই নয়, শোহানের দুই সহকর্মীকে আটক করে বনানী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ৪ ঘণ্টা আটক থাকার পর বহু চেষ্টা তদবির করে মুক্তি পান তারা।
এদিকে শোহানের অবস্থা খারাপ। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শোহানকে ভারতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। এর জন্য পাসপোর্ট করতে গিয়ে নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হয়। এমনকি শোহান যখন ঢাকায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি তখন গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় করা নাশকতার একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে।
২৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল খালেক। সেখানে আসামি হিসেবে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। মামলার এজাহারে ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে শাহ সেকেন্দারের ছেলে শোহানের। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন (২৪ জুলাই) সকাল ৬টার দিকে শ্রীপুরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির করছিলেন আসামিরা। একদিকে চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা অন্যদিকে মামলার আসামী হওয়ায় শোহান ও তার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।
অতঃপর ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়। বিপ্লবের ধাক্কায় নতুনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। ইনফেকশনের শিকার হয় শোহান। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অবহেলা হওয়াতে শোহানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ে। অবশেষে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট সিএমএইচ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহদাতবরণ করে সে।
খুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন শোহান শাহ। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই। পরিবারের সবার ভরসার শোহান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বুকে বুলেট নিয়ে ৩৯ দিন কষ্ট করেছে সে। এখন পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন অকুল পাথারে।
শোহান শাহের (২৯) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রী শম্পা বেগমের সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান শাহ। তবে তাঁদের সেই স্বপ্ন অপূরণ থেকে গেল।
শ্রীপুরে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী শম্পা বেগমের বিলাপ কিছুতেই থামছে না। পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার বলছেন, শোহানকে ছাড়া এখন আমি কীভাবে বাঁচবো? শম্পা বেগম বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। শম্পা বেগম বলেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, “শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।”’
গত মঙ্গলবার ঢাকায় সিএমএইচে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল শম্পার। তখন শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না।’ তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না উল্লেখ করে শম্পা বলেন, ‘স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সব সময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, “চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি।” আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?’
মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তাঁর বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশীল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।’
ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করছিলেন শোহানের মা সুফিয়া বেগমও। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, “মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না।”’ সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।’
বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ধারণা, ওর গুলি লেগেছে, এটা জেনেই এলাকার লোকজন ও পুলিশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তাঁকে আসামি করেছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, মিথ্যা মামলা দেওয়া সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।’
২০ ডিসে, ২০২৪
আমার জন্য গর্বিত হয়ো, মা !
জুলাই বিপ্লব দুই ধাপে হয়। ১ম ধাপ ১৬-২১ জুলাই। এরপর আন্দোলন থমকে যায়। শুরু হয় গণগ্রেপ্তার। ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে হাসিনা। একে একে ১৯ হাজার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে হাসিনা। আনাস এই কঠিন পরিস্থিতি দেখছে আর রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে। সরকারের জুলুমের ভয়ে আনাসকে আন্দোলনে যেতে বাধা দেয় তার পরিবার। মা তার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আন্দোলনের ২য় পর্যায় শুরু হয় ৩১ জুলাই থেকে। ৩ ও ৪ আগস্ট আবারো মানুষ খুন করতে থাকে আনাস। আনাসের আর সহ্য হয় না। ৪ তারিখে ভয়াবহ গণহত্যা তাঁর ছোট্ট মনকে ভেঙ্গে দেয়। এদিকে হাসিনা বৃদ্ধ থেকে শিশু বাচ্চা কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। ৭১ সালে পুরো ৯ মাসের যুদ্ধে ঢাকায় যত গুলি বর্ষিত হয়নি তার চেয়ে বেশি গুলি চলে জুলাই বিপ্লবের ১ মাসে।
আনাস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ৫ তারিখ সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে একটি চিঠি লিখে তার মাকে উদ্দেশ্য করে।
//মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।
-আনাস।//
আনাস উপলব্ধি করতে পারে তাকে তার মা বের হতে দিবে না, তাই সে চিঠি লিখে গোপনে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। ৫ আগস্ট কর্মসূচি শাহবাগ অভিমুখে লংমার্চ। সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই আনাস গেন্ডারিয়া থেকে শাহবাগ চলে আসে। হঠাত পুলিশ সায়েন্স ল্যাব থেকে গুলি ছুঁড়ে। ছাত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পর মুহূর্তেই তারা ঘুরে দাঁড়ায়। ইট পাটকেল হাতে পুলিশকে প্রতিরোধ করতে থাকে। ছাত্রজনতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে পুলিশকে। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে একের পর এক মানুষ ঢলে পড়ে যাচ্ছে। তবুও মানুষের ভয় নেই।
এদিকে নিউমার্কেট থানা থেকে আরেকদল পুলিশ চাংখার পুল হয়ে শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসে। তড়িৎ গতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছাত্ররা। তাদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের আজকের গল্পের নায়ক আনাস। চাংখার পুল থেকে পুলিশকে হটিয়ে দেয় ছাত্ররা। কিন্তু পিছু হটতে থাকা পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ঢলে পড়তে লাগলো একের পর এক ছাত্র। এর মধ্যে আনাসও গুলিবিদ্ধ হয়। দশম শ্রেণির কিশোর ছাত্র বুকের বাঁ পাশ দিয়ে হজম করে নেয় স্বৈরাচার হাসিনার নির্মম বুলেট। আনাস মাকে বলে এসেছিল আমার জন্য গর্বিত হয়ো। মাকে সেই গর্ব করার উপলক্ষ্য এনে দিয়ে আনাস বুক দিয়ে রুখে দিয়েছে হাসিনাকে। বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের মতো কোটি কোটি জনতাকে।
আনাসের পকেটে একটি পুরোনো ছোট মোবাইল ফোল ছিল। এতে সবার নম্বর ছিল। সেখান থেকে নম্বর নিয়েই মা সানজিদা খানকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের একজন। ফোন পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা। তিনি ভেবেছিলেন, ছেলের শ্বাসকষ্ট আছে, সে হয়তো কাঁদানে গ্যাসের শেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর বড় কোনো অঘটন ঘটলে গায়ে রাবার বুলেট লাগতে পারে। তবে হাসপাতালে গিয়ে মা দেখেন, সিঁড়ির পাশে একটি স্ট্রেচারে পড়ে আছে ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহ। যেই দেহে কোনো প্রাণ নেই।
সানজিদা খান বলেন, ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে বাইরে আনার পর বাসায় ফেরার জন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন। অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি। যে দেশটাকে ছেলে ভালোবাসল, সেই দেশ তো নিরাপত্তা দিতে পারল না। আমার বুক তো খালি হয়ে গেল। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।
অটোরিকশায় তিনি ও তাঁর স্বামী বসেন। কোলে নেন ছেলের লাশ। এভাবেই বাসায় ফেরেন তাঁরা। আন্দোলনে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিল ছেলে। বাবার নিষেধ থাকায় সে যেতে পারছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আর আটকে রাখা যায়নি। ছেলে আন্দোলনে যেতে পারছিল না বলে মন খারাপ করত।
শাহারিয়ার খান আনাস গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়তো। দুপুরে স্কুল থেকে ছেলে ফিরলে সবাই মিলে খাবার খেতেন। সানজিদা খানের কোনো মেয়ে না থাকায় আনাসই তাঁকে তাঁর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত। মায়ের কাছে ছেলের তেমন কোনো বায়না ছিল না। করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে বাবার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। বিষয়টি বুঝত আনাস। বাসার একটি চাবি আনাসের কাছে থাকত। অন্যদিন চাবিটি সঙ্গে রাখলেও সেদিন ছেলে ঠিকই চাবিটি বাসায় রেখে গিয়েছিল।
আনাসের শাহদাতের খবর যখন বাবা মা পেয়েছিলেন ততক্ষণে আনাসের রক্তধৌত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। ডাইনি হাসিনা পালিয়ে গিয়েছিল। সারা দেশবাসী আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ঢাকার এক কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করছিল। কিন্তু আনাসের বাবা মা হারিয়ে ফেললেন তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। হাসিনা পতনের খুশিতে আনন্দ করার অবকাশ পাননি আনাসের পরিবার। তাদের ছোট্ট আনাসের রক্তেই পবিত্র হয়েছে বাংলাদেশ।
আনাস শুধু তার মা-বাবার গর্ব নয়। আনাস আমাদের গর্ব। আনাস যেভাবে বীর বিক্রমে ও ভালোবাসায় আমাদের ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করেছে আমরাও সেই ভালোবাসা দিয়ে আনাসকে স্মরণ করবো ইনশাআল্লাহ।