৭ মে, ২০২৫

একনজরে গত ২৫ বছরের ইতিহাস


১. ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এটা হিন্দুত্ববাদী ভারতের জন্য ছিল অসহনীয়।
২. ২০০১ সালে আমেরিকা 'ওয়ার অন টেরর' নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে লড়াই শুরু করে। আমেরিকান সিআইএ'র সহায়তায় তৈরি হওয়া জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার হামলাকে কেন্দ্র সারা পৃথিবীর ইসলামপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে পশ্চিমারা।
৩. ভারত ও পাকিস্তান সেই লড়াইয়ে আমেরিকার পক্ষ নেয়।
৪. বাংলাদেশ এই লড়াইয়ে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকা প্রথমে ভারতকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে রাজি করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
৫. ২০০২ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বাংলাদেশকে যুদ্ধে রাজি করানোর জন্য চলে আসে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি টনি ব্লেয়ারকে জানিয়ে দেন। বাংলাদেশ কারো বিরুদ্ধে কোনো লড়াইয়ে যুক্ত হবে না। বাংলাদেশ কাউকে শত্রু বানাতে চায় না।
৬. বাংলাদেশের এই অবস্থানে পশ্চিমা বিশ্ব বিরক্ত হয়। টনি ব্লেয়ার বাংলাদেশকে হুমকি দিয়ে যায়, যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি বাংলাদেশ, সেই সন্ত্রাসীদের আক্রমনের শিকার হতে হবে বাংলাদেশকে।
৭. এদিকে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নতি ভারতের ওপর চাপ তৈরি করে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ ১ নং পজিশনে চলে যাওয়া, সার্ক পুনঃগঠন করা ইত্যাদি। বাংলাদেশে আমেরিকার ইশারায় শুরু হয় ভারতের জঙ্গীবাদ প্রজেক্ট।
৮. আওয়ামী লীগ নেতা মীর্জা আজমের বোন জামাই শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় জঙ্গীবাদ প্রজেক্ট
৯. এই প্রজেক্ট আত্মপ্রকাশ করে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। বোমা মেরে মানুষ খুন করতে থাকে ভারতীয় জঙ্গীরা।
১০. বিএনপি - জামায়াত সরকার ১ বছরের মধ্যেই জঙ্গীবাদ কন্ট্রোল করে ফেলে। বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যারা আধিপত্যবাদীদের অস্ত্র হিসেবে কাজ করা জঙ্গীবাদকে পুরোপুরি কন্ট্রোল করতে সক্ষম হয়েছে।
১১. না ক্রসফায়ার দিয়ে নয়, সকল জঙ্গীকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
১২. আমরা জেএমবি সদস্যদের কাছ থেকে জেনেছি কীভাবে তারা অস্ত্র-বোমা নিয়ে এসেছে ভারত থেকে, এবং প্রশিক্ষণও নিয়েছে ভারতের মাটি ব্যবহার করে।
১৩. তাদের প্রজেক্ট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারত প্রতিশোধের চেষ্টা চালায়। তারা বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বিশ্বাসঘাতক মঈন ইউ আহমেদকে হাত করে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ করে ভারত নিয়ন্ত্রিত সেনাসরকার তৈরির চেষ্টা করে।
১৪. সেই চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগকে দিয়ে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি বৈঠার তান্ডব চালায়। ২৩ জন মানুষকে খুন করে। এটা হাসিনার ১ম গণহত্যা।
১৫. অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে ভারতের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও সেনাপ্রধান ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারী অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বানচাল করে।
১৬. শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সেনা শাসন। তবে তারা এটা কন্ট্রোল করতে পারে না। নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
১৭. ২০০৮ সালে ভারতের মধ্যস্থতায় দায়মুক্তি পাবে এই চুক্তিতে মঈন ইউ আহমেদ নির্বাচনের নাম করে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসায়। এই তথ্য আমরা ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির 'দ্য কলিশন ইয়ার্স' বইতে পাই।
১৮. মঈন ইউ আহমেদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কাজ করা ও ডানপন্থী সেনা অফিসারদের একত্র করে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫৭ সেনা অফিসারসহ ৭১ জনকে হত্যা করে ভারত। ভারতকে এই গণহত্যায় সরাসরি সহায়তা করে হাসিনা ও মঈন ইউ আহমেদ। এটা হাসিনার ২য় গণহত্যা।
১৯. সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারতীয় আধিপত্য ও র'য়ের সরাসরি এজেন্ট তৈরি হয়।
২০. ভারত এদেশে ইসলামপন্থা নির্মূলে হাসিনাকে দায়িত্ব দেয়। বিনিময়ে আজীবন হাসিনার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করে।
২১. জামায়াত নেতাদের বিচারিক হত্যার নীল নকশা করা হয়।
২২. বিচারিক হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার জামায়াত নেতাকর্মীদের দমন করার জন্য পাইকারি হারে খুন করতে থাকে। আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে হাসিনা। এটা হাসিনার ৩য় গণহত্যা।
২৩. ইসলামপন্থাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য নাস্তিকদের দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের আয়োজন করে ভারত। এর বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামপন্থার পক্ষে আওয়াজ তৈরি হয়।
২৪. ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চলে গণহত্যা। শতাধিক মানুষকে খুন করে হাসিনা। এটি ৪র্থ গণহত্যা। মূলত এই ঘটনার মাধ্যমে বিরোধী দলগুলো ও ইসলামপন্থার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয় ভারতীয় আধিপত্যবাদ।
২৫. এরপর আর শক্ত আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি স্বৈরাচার বিরোধী দেশপ্রেমিক দলগুলো।
২৬. ভারতীয় আধিপত্যবাদের কবলে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার গতি হারিয়ে ফেলে।
২৭. ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়া আলোতে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়
২৮. ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সেই স্ফুলিঙ্গে বারুদ জ্বালায়। হাসিনা সাময়িকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তবে পুনরায় ভারতের সাহায্যে বিপদ কাটায়।
২৯. নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পর থেকে হাসিনা আমেরিকার গুড বুক থেকে বাদ পড়ে।
৩০. হাসিনার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলতে থাকে।
৩১. ২০২১ সালে মোদির বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে মোদি বিরোধী আন্দোলন তৈরি হয়। শুধু মোদিকে দেশে আনতে ২০ জন মানুষকে হত্যা করে হাসিনা। এটা হাসিনার ৫ম গণহত্যা।
৩২. ২০২৩ সালে আমেরিকা হাসিনার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়। বিএনপির নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী দলগুলো আশার আলো দেখে। আন্দোলনের চেষ্টা চালায়। তবে হাসিনা ও ভারতীয় বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে আন্দোলন চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
৩৩. অন্যদিকে ভারতের সাহায্যে আমেরিকাকে ম্যানেজ করে ফেলে হাসিনা। ২০২৪ সালে একপেশে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে।
৩৪. স্বৈরাচারবিরোধী শক্তিগুলো চরমভাবে হতাশ হয়।
৩৫. এই সময়ই আসে আল্লাহর সাহায্য। ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্ররাজনৈতিক দলগুলোর (ছাত্রশক্তি, ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের) প্রচেষ্টায় আন্দোলন জমে ওঠে। আবাবিলের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র ও যুবকরা আন্দোলনে অংশ নেয়। পুলিশ গুলি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সহস্রাধিক মানুষকে খুন করলো হাসিনা। এটা হাসিনার ৬ষ্ঠ গণহত্যা।
৩৬. অবশেষে এলো ৫ আগস্ট। হাসিনা পালিয়ে গেলো। জনতার মুক্তি এলো।

৪ মে, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ১০ : নাগরিকত্ব, সংবিধান সংশোধন ও নৈতিকতা প্রসঙ্গ


বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে।

নাগরিকত্ব
বর্তমান সংবিধানের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে রয়েছে,
বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হবেন।

আমি মনে করি এখানে বাঙালি পরিচয় অনর্থক। বাঙালি মানে হলো যারা বাংলা ভাষাভাষী। 'বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি' এই কথাটি বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন না, তাদের জন্য অবমাননাকর। যদি রাষ্ট্রীয় সংহতি আমরা ধরে রাখতে চাই। সকল ভাষার জনগণকে সাথে নিয়ে সমন্বিত রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাঙালি থাকা যাবে না।

সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে তাই নাগরিকত্বের সংজ্ঞায় বলা উচিত, "বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হবেন"।

সংবিধান সংশোধন
বর্তমান সংবিধানের ৭ম খ অনুচ্ছেদে বলা আছে,
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।

এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না যে, সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তিত হবে না। সময়, চাহিদা ও প্রয়োজনের আলোকে সংবিধান যেভাবে সংশোধন হয় সেভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনগণের রায়ে অবশ্যই সংবিধানের মূলনীতিসহ সবকিছুই পরিবর্তন হওয়ার দাবি রাখে। তাই আমি মনে করি বর্তমান সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হওয়া দরকার।

জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা
বর্তমান সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
(১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
(২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷

ক. এখানে ১ নং পয়েন্টে 'আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত' এই কথা বলে মাদক ব্যবহারের ফাঁক সৃষ্টি করা হয়েছে। এই অংশকে ভিত্তি করে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মাদকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এটা আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে।

আল্লাহ তায়ালা মোট চারটি ধাপে মদ হারাম করেন।

প্রথম পর্যায়
আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন যে, তোমরা খেজুর ও আঙ্গুর দ্বারা মাদক তৈরির পাশাপাশি উত্তম খাদ্য বস্তুও তৈরি করে থাক। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক।’ (সূরা নাহল, আয়াত: ৬৭)

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি মাদক হারাম করেননি, তবে জানিয়ে দিলেন, মাদক ভিন্ন জিনিস। আর উত্তম খাদ্যবস্তু ভিন্ন জিনিস। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম ধারণা করে নিলেন যে, মাদক সম্পর্কে কোনো বিধান আল্লাহ তায়ালা অচিরেই নাজিল করবেন।

দ্বিতীয় পর্যায়
এরপর সাহাবায়ে কেরাম যখন মাদক সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন তখন আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে তার প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিলেন যে, মদের মাঝে উপকার ক্ষতি উভয়ই রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণটা বেশি।

কোরআনে এসেছে,‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে মাদকের প্রতি কিছুটা ঘৃণার সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল ক্ষতির দিক বিবেচনায় তা বর্জন করলেন। আরেকদল চিন্তা করলেন, যেহেতু কিছুটা উপকার রয়েছে তাই তা গ্রহণে কোনো সমস্যা হবে না।

তৃতীয় পর্যায়
এ পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছেও যাওয়া যাবে না। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।’ (সূরা নিসা, আয়াত: ৪৩)

চতুর্থ পর্যায়
এই আয়াতে সবসময়ের জন্য মদকে পরিষ্কার হারাম ঘোষণা না করায় অনেকেই নামাজের সময় বাদে অন্য সময় মদ গ্রহণ করতেন। ইতিমধ্যে ঘটে যায় আরও একটি ঘটনা। আতবান ইবনে মালেক (রা.) কয়েক সাহাবিকে দাওয়াত করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম একজন অতিথি ছিলেন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। খাবার শেষে মদপানের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। সেখানে আরবের প্রথা অনুপাতে কবিতা পাঠ ও নিজ নিজ বংশের গৌরবগাথা বর্ণনা শুরু হলে একজন মুহাজির সাহাবি আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসাকীর্তন করে আবৃত্তি করলেন একটি কবিতা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আনসারি এক যুবক উটের গলার একটি হাড় ছুড়ে মারেন তার মাথায়।

মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাসুলের কাছে ছুটে যান তিনি। অভিযোগ করেন সেই যুবকের বিরুদ্ধে। তখন রাসুল (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান করুন, যাতে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা মদ-জুয়াকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করলেন।’ ‘হে ঈমানদাররা! মদ, জুয়া, মূর্তি ও তীর নিক্ষেপ এসব নিকৃষ্ট বস্তু ও শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা এগুলোকে বর্জন করো। যাতে তোমরা সফল হতে পারো।

শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও তিক্ততা ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়। তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না!’ (সুরা মায়েদা : ৯০-৯১)। এই আয়াতে মদ ও জুয়াকে নিকৃষ্ট বস্তু ও ক্ষতিকর কাজ উল্লেখ করে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘যখন নবীজির পক্ষ থেকে একজন ঘোষক মদিনার অলিগলিতে প্রচার করতে লাগলেন যে, মদপান হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, তখন যার হাতে মদের যে পাত্র ছিল, তা তারা সেখানেই ফেলে দিয়েছিলেন। সেদিন মদিনায় এত পরিমাণ মদ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, মদিনার অলিগলিতে বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট কাদাপানির মতো অবস্থা হয়েছিল।

ইসলামে মদ পানের শাস্তি
মদ ক্রয়-বিক্রয়, পান-বহন মদের ব্যবসার অনুমোদন সবই ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। মদ্যশালার বৈধতা রেখে মাদকতামুক্ত সুস্থ সমাজ গড়া সম্ভব নয়। মাদকতায় শুধু শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতিই নয় পরকালের সুখময় জীবনকেও নরকে পরিণত করে। রসুল সা. এর বদদোয়া রয়েছে মাদকতায় জড়িতদের প্রতি। যারা এর অনুমোদন করে তাদের প্রতি। যারা সরবরাহ করে তাদের প্রতি।

হযরত আনাস রা. বলেন, রসুল সা. মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তিকে লানত করেছেন। ১. মদ প্রস্তুতকরী। ২. মদের ফরমায়েশ দানকারী। ৩. মদ পানকারী। ৪. মদ বহনকারী। ৫. যার কাছে মদ নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যক্তি। ৬. যে মদ পান করায়। ৭. মদ বিক্রেতা। ৮. মদের মূল্য ভোগকারী। ৯. মদ ক্রয়কারী। ১০. যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়। (মেশকাত ২৭৭৬)

রসুল সা. বলেন, ‘যখন কেউ (কোন নেশাকর দ্রব্য সেবন করে) নেশাগ্রস্ত হয় অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন কেউ মদ পান করে তখন তোমরা তাকে বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চতুর্থবার বললেন আবারো নেশাগ্রস্ত হলে তার গর্দান উড়িয়ে দিবে।’ (আবু দাউদ ৪৪৮২, তিরমিজি ১৪৪৪, ইব্নু মাজাহ ২৬২০, নাসায়ি ৫৬৬১, আহমাদ ৪/৯৬)

হযরত ওমর রা.-এর শেষ যুগে মদ পান করলে তিনি ৪০ বেত্রাঘাত করতেন। কিন্তু যখন মদপান বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন তিনি ৮০ বেত্রাঘাত করতেন। (মেশকাত-৩৬১৬) দুনিয়ায় যে আল্লাহর বিধান মেনে নেশা আর জুয়া থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের জন্য জান্নাতে শরাবের ব্যবস্থা করবেন। দুনিয়ায় মদ পান হারাম। নিষিদ্ধ। কিন্তু জান্নাতে মদ সুপেয় পানীয়। যারা দুনিয়ায় মদ পান করবে তারা আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত রসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করলো অথচ তওবা করলো না। আখেরাতে সে থেকে বঞ্চিত হবে। (মুসলিম ২০০৩)

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা.বলেন রসুল সা. বলেছেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াদাবদ্ধ যে ব্যক্তি নেশাজাতীয় বস্তু পান করে তাকে ‘তিনাতুল খাবাল’ পান করাবেন। আরজ হলো হে আল্লাহর রসুল সেটা কী? তিনি বললেন, জাহান্নামিদের দেহের ঘাম অথবা দেহনিঃসৃত রক্ত-পুঁজ। (মেশকাত ৩৬৩৯)

কারোর ব্যাপারে মদ অথবা মাদকদ্রব্য পান কিংবা সেবন করে নেশাগ্রস্ত হওয়া প্রমাণিত হয়ে গেলে তাকে আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে। সে যতবারই পান করে ধরা পড়বে ততবারই তার উপর উক্ত দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে। তবে তাকে এ জন্য কখনোই হত্যা করা হবে না। ’উলামাদের ঐকমত্যে প্রমাণিত এ শাস্তি।

অতএব বাংলাদেশে কোনো অবস্থাতেই মুসলিমদের জন্য মাদকের অনুমোদন করা যাবে না। তবে অমুসলিমদের জন্য সীমিত আকারে তাদের ঘরের অভ্যন্তরে তৈরি ও সেবনের অনুমোদন করা যেতে পারে। তারা শর্ত মেনে অনুমোদন পেতে পারে।

খ. ১৮ অনুচ্ছেদের ২ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ও সমকামের কথা যুক্ত করে এই চারটি অপরাধ বন্ধ করার নিমিত্তে রাষ্ট্র সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয় উল্লেখ করা দরকার। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনা করে ইসলামের বিধান অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার।

৩ মে, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৯ : রাষ্ট্রের নাম, জাতীয় সংগীত ও প্রতিকৃতি সংক্রান্ত


বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে।

১. নাম
রাষ্ট্রের নামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় 'ইসলামী শাসনতন্ত্র বাংলাদেশ' এমনভাবে নাম হলে। বাংলাদেশের বর্তমান নাম 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' এটা আসলে অনেকটা প্রতারণামূলক নাম। জনগণ রাষ্ট্রকে শাসন করে না। রাষ্ট্র যেভাবে শাসিত হয়, নাম সেভাবেই হওয়া উচিত।

২. বর্তমান সংবিধানে প্রথম অধ্যায়ের নাম রাখা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্র'। এটা সংশোধন হয়ে হওয়া উচিত 'ইসলামী শাসনতন্ত্র'।

৩. ভাষা
রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি আরবি ও ইংলিশও রাখা যেতে পারে। রাষ্ট্রের জনগণ বহু ভাষার বিশেষ করে আরবি ও ইংলিশের সাথে যুক্ত থাকলে রাষ্ট্রের উন্নতি ও ভিন্ন ভাষার জ্ঞানভান্ডার থেকে বঞ্চিত হতে হয় না। তাই বাংলার পাশাপাশি এই দুই ভাষা রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে যুক্ত থাকা দরকার।

৪. জাতীয় সংগীত
বর্তমান সংবিধানে জাতীয় সংগীত হিসেবে যুক্ত আছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'আমার সোনার বাংলা'র' ১ম দশ লাইন। এটা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, কারণ
ক. এই সংগীত লিখিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।
খ. এই সংগীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চেতনা প্রতিফলিত হয় নি।
গ. একটি জাতীয় সংগীতে যে যে উপাদান থাকা দরকার তা এই সংগীতে নেই।

নতুন একটি জাতীয় সংগীত লেখা হোক। সংগীতে যা যা উপাদান থাকা উচিত
i. আল্লাহর প্রশংসা
ii. রাষ্ট্রের সৌন্দর্যের বর্ণনা
iii. রাষ্ট্রের সংহতি
iv. রাষ্ট্রের জনগণের বীরত্ব
v. রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গিকার
vi. রাষ্ট্রকে ভালোবাসা ও
vii. রাষ্ট্রের জন্য জীবন দেওয়ার অঙ্গীকার
এই উপাদানগুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন একটি জাতীয় সংগীত লেখার ব্যবস্থা করা দরকার।

৫. শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি
বর্তমান সংবিধানে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।

শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি দুই কারনে প্রদর্শন করা যাবে না।
১. শেখ মুজিব একজন গণহত্যাকারী, স্বৈরাচার। তারা ছবির সম্মানসূচক প্রদর্শন রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য অবমাননাকারী।
২. কোনো ভালো মানুষের ছবি প্রদর্শন করাও ইসলামস্মমত নয়। এটা ইসলামে নিষিদ্ধ। মুহাম্মদ সা. বলেন, ছবি টানানো হলে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না ও নামাজ কবুল হয় না।

অতএব শুধু শেখ মুজিব নয়, কারো ছবিই প্রদর্শন করার কথা সংবিধানে থাকা যাবে না।

২ মে, ২০২৫

বেহেশতি কবর

১.
হালকা বাতাস বইছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভেজা মাটি থেকে ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছিল। পরিবেশটা বেশ মোহনীয়। কাগজি লেবু গাছ থেকে ভেসে আসছে হালকা সুবাস। কিন্তু লেবু গাছের পাশে বসে থাকা তামান্নার জন্য এটা মোটেই ভালো দিন নয়। সে বসে আছে সদ্য খোঁড়া একটি কবরের পাশে। যার জন্য কবরটি খোঁড়া হয়েছে তিনি তামান্নার বাবা। না, তার বাবা এখনো মৃত্যুবরণ করেন নি। তবে করবেন। তাই আগেই এতো আয়োজন।

কবরের এক পাশে তামান্না তার মেজ বোন রোকেয়ার হাত ধরে বসে আছে। অন্যপাশে আছে তার মা ও বড় বোন ফাতিমা। তারা অপেক্ষা করছে একটি লাশের। কিন্তু যার লাশ তিনি এখনো জীবিত।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। ঠিক ৬ টা বাজলেই মৃত্যুবরণ করবে তার বাবা। কান্না করতে করতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। তামান্নার খুব অভিমান হচ্ছে, রাগ হচ্ছে বাবার প্রতি। তার মনে হচ্ছে তার বাবা তাদের কথা ভাবেন নি। ভাবেন নি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা। তিনি কেবল ভেবেছেন তার আদর্শের কথা। তিনি কেবল ভেবেছেন তার রাজনীতির কথা।

কী দরকার ছিল দেশে ফেরার! যদি বিদেশে থাকতেন তবে তো আজ এই দিনের দুঃসহ অপেক্ষায় থাকতে হতো না। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে তামান্না চিন্তা করলো, বাবার সাথে আমার বিশেষ স্মৃতি কী? বাবা কি আমাকে বিশেষভাবে ভাবতেন? পাঁচ ভাইবোনের মাঝে আমি সবার ছোট, আমার জন্য কি বাবার বিশেষ স্নেহ ছিল?

তামান্না তেমন কিছু খুঁজে পায় না। সে খুব হতাশ হয়। হঠাৎ তার পঞ্চম শ্রেণির একটা কথা মনে পড়ে। খুব দুষ্টামি করার কারণে প্রায়ই তামান্নার বিরুদ্ধে বাবার কাছে অভিযোগ করতো তার মা। ৫ম শ্রেণির ফার্স্ট টার্ম শেষে তার রেজাল্ট হলো। রেজাল্টে তামান্না দুইটি বিষয়ে খুবই খারাপ করে। মোটের ওপর রেজাল্ট ভালো না। মা অনেক বকাঝকা করে। রাতে বাবা বাসায় ফিরলে মা এই বিষয়ে অভিযোগ করে এবং তামান্নার বাবাকেও বকাঝকা করে। তামান্নার বাবা’র প্রশ্রয়েই নাকি তামান্নার এই অধঃপতন।

তামান্নার মায়ের বকাঝকা শুনে বাবা খুবই রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি হঠাৎ করে তামান্নাকে কষে একটি চড় লাগিয়ে দেন। শুধু তামান্না নয়, ঘরের সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বেশি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন মীর আফজাল নিজেই।

তামান্না কী কান্না করবে, তামান্নার আগেই কেঁদে ফেলেন বাবা মীর আফজাল। রাগের মাথায় ছোট মেয়েকে চড় বসিয়ে দিয়েছে এই অনুশোচনায় তিনি পাগল হয়ে যান। তামান্নাকে কোলে তুলে আদর করতে থাকেন। পাগলের মতো মেয়ের গালে চুমু দিতে থাকেন। তামান্নার ফর্সা গালে চড়ের দাগ বসে যায়। সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারেননি আফজাল সাহেব।

তামান্নার আজ হঠাৎ করে এক যুগ আগের ঘটনাটি মনে পড়লো। গালে হাত দিয়ে সে যেন অনুভব করতে লাগলো সেই চড়ের দাগ। মেঝ বোনের কানের কাছে জিজ্ঞেস করলো,
- আপু, তোকে কি কোনোদিন আব্বু মেরেছে?
- না তো, কোনোদিন মারে নাই।
আস্তে করে বোনের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বড় বোনের পাশে গিয়ে বসলো
- বড় আপু, তোকে কি আব্বু কোনোদিন মেরেছে?
- (বড় বোন অবাক হয়ে) না, কোনোদিন মারে নি।

এবার তামান্না মায়ের পাশে গিয়ে বসে।
- মা, বাবা কি কখনো তার সন্তানদের মেরেছে?
- না, কোনোদিন তোদের বাবা তোদের মারে নি।
- আমাকে একদিন মেরেছে
- কবে? আমার তো মনে পড়ে না।
- ঐ যে একদিন, রেজাল্ট খারাপ করেছি। তুমি বকাঝকা করেছো। আব্বু রাতে এসে আমাকে একটি চড় মারলো। পরে আমিও কেঁদেছি, সেও কেঁদেছে।
- (মায়ের মনে পড়ে) হ্যাঁ, ঐ একদিনই।
- জানো মা, আমি ছাড়া কোনো সন্তানের কাছেই বাবার স্মৃতি নেই। আমার গালে এখনো আমি বাবার হাতের স্পর্শ পাচ্ছি।
- তুই তোর বাবার প্রতি অভিমান করিস না।
- না মা… এটা আমার সৌভাগ্য। বাবার এই স্পর্শ আমার বাকী জীবনের সম্বল
(এই বলে গাল স্পর্শ করে কাঁদতে থাকে তামান্না)

২.
কাতারের এয়ারপোর্টে মীর আফজাল।
কাতারে এসেছেন আল জাজিরা পরিদর্শনে। তাদের নিউজরুম সেটআপ, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি দেখতে এসেছেন। দেশে এরকম একটি আধুনিক নিউজ চ্যানেল চালু করার প্রক্রিয়ায় আছেন তিনি। এখান থেকে যাবেন আমেরিকায় ছোট ভাইয়ের কাছে। তাছাড়া আমেরিকায় একটি কনফারেন্সেও অংশ নেবেন।

বিমানে উঠতে যাবেন এমন সময় তার সহকারী বাংলাদেশ থেকে ফোন দিয়ে বললেন, স্যার আপনার নামে একটি রিপোর্ট হয়েছে পত্রিকায়। আফজাল সাহেব গুরুত্ব দেন নি। তিনি বললেন, ঠিক আছে, পরে কথা বলবো। আমি এখন বিমানে উঠবো। এই বলে তিনি কল কেটে দেন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসন চলছে। ইসলামপন্থী নেতা আফজাল সাহেব শুরু থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার চোখের বালি। তাই সরকারি স্পন্সরে প্রায়ই তার বিরুদ্ধে পত্রিকাগুলো রিপোর্ট করে। এটা নতুন কিছু নয়।

আমেরিকায় তাকে স্বাগত জানালেন আফজাল সাহেবের ছোট ভাই। বললেন, ভাই বাংলাদেশে তোমার বিরুদ্ধে তো আজ বেশ তোলপাড় হয়ে গেল। একগাল হেসে আফজাল সাহেব বললেন, এ আর নতুন কী?

ছোট ভাই বললেন, না, এটা নতুন। বাংলাদেশে পত্রিকাগুলো রিপোর্ট করেছে তুমি নাকি দেশ থেকে পালিয়ে কাতার চলে গেছো? এটা নিয়ে দেশে খুব তোলপাড় হচ্ছে। সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে ধরেছে তোমার বিষয়ে। সাহারা খাতুন বলেছে, তোমাকে যেভাবেই হোক দেশে ফেরত নেবে। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তা নেবে।

তাই নাকি? ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, সাহারার এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই দেশে যাবো।

ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত নিবে এই কথা মীর আফজাল সাহেবকে বেশ অপমানিত করেছে। দাগী আসামীদের মতো ইন্টারপোলের কথা বলায় তার জেদ চেপে গেছে। আফজাল সাহেব আমেরিকার কাজকর্ম শেষে গেলেন মিশরে। সেখানে কিছু ব্যবসায়িক মিটিং শেষে বাংলাদেশে ফিরে এলেন। বিমানবন্দরে তিনি অজস্র সাংবাদিকের মুখোমুখি হলেন।

- স্যার আপনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হচ্ছে জেনেও কেন ফিরে এলেন?
- আমি তো কোনো অপরাধ করি নাই। মামলা নিয়ে চিন্তিত নই। মামলা হলে আদালতে লড়বো।
- আপনি পালিয়ে গেলেন কেন?
- আপনার কি দেখে মনে হয়েছে, আমি পালিয়ে গেছি? আর যদি পালাতাম তাহলে ফিরলাম কেন?
- আপনি কি যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত?
- আমার স্পষ্ট কথা, আমি কোনো যুদ্ধাপরাধ তো দূরের কথা। আমি কোনো অন্যায়ের সাথেই জড়িত নই।
- আপনার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে খুন ও ধর্ষনের অভিযোগ আছে। এই ব্যাপারে কী বলবেন?
- অভিযোগ কে করেছে? আপনি? আমি তো এমন কোনো অভিযোগ বা মামলার কথা এখনো জানি না। আপনার ফ্যসিস্ট হাসিনার ভাষায় আমাকে অহেতুক প্রশ্ন করছেন। আজ এই পর্যন্তই…

সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে মীর আফজাল সাহেব গাড়িতে চেপে বসলেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ। গাড়ি চলছে সাঁই সাঁই।

বাসায় ফেরার পর সবাই খুবই তটস্থ। কী হবে সামনে এই নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। আত্মীয়রা সবাই টিভিতে খবর দেখেছে। দেখেছে সাংবাদিকদের সাথে আফজাল সাহেবের সাক্ষাৎকার। বিচলিত হয়ে সবাই ফোন করছে। মীর আফজাল সাহেব স্বভাবসুলভ শান্তভাবে সবাইকে বললেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সপ্তাহখানেক পর আফজাল সাহেবের সব ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে দিলো সরকার। আফজাল সাহেব বুঝতে পারলেন তিনি সহসাই গ্রেপ্তার হতে চলেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসলেন। পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। তিনি শান্তভাবে বললেন আমি পালিয়ে গেলে আমারই অপমান। সবাই ভাববে আমি সত্যিকারের অপরাধী। আমি সমাজের সামনে তোমাদের, আত্মীয়দের ও আমার রাজনৈতিক দলের লোকদের ছোট হতে দিবো না। আমি মামলা লড়বো।

৩.
আজকে বেশ কর্মব্যস্ত দিন গিয়েছে মীর আশরাফের। মীর আশরাফ তরুণ ব্যারিস্টার। আফজাল সাহেবের ছেলে। আজকে দুপুরের ডিবি পু্লিশের একটি দল আফজাল সাহেবকে তুলে নিয়ে গেছে।

আফজাল সাহেবকে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে হাসিনা সরকার। সবগুলো মামলাই বহু আগের, যখন তিনি ছাত্র ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন।

আশরাফ তার বাবার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কপি নিয়েছে। বাবার সাথে কথা বলেছে। কীভাবে অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণ করবে তা নিয়ে তার টিম মেম্বারদের সাথে কথা বলেছে। তারা বেশ কনফিডেন্ট। মামলাগুলো একেবারেই ঠুনকো। সবগুলো অভিযোগই উড়িয়ে দেওয়া যাবে।

পরিবারের সদস্যরা প্রতি শনিবার দেখা করতে যায় কারাগারে। সেখানে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলেন মীর আফজাল। দেখতে দেখতে তিন বছর পার হয়ে গেলো। ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিন এলো।

মীর আফজালের পরিবার ধরে নিয়ে নিয়েছে তিনি খালাস পাবেন সব মামলা থেকে। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের গৃহপালিত বিচারকরা মীর আফজালকে ফাঁসীর আদেশ দিলো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো পরিবারের সদস্যরা। মীর আফজাল স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ধৈর্য ধরো, আমার শাহদাতের মধ্য দিয়ে এদেশে ইসলামের বিপ্লব সূচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মুষড়ে পড়ে ছোট ছেলে আশরাফ। কারণ লড়াইটা তার ছিলো। সে তার বন্ধুদের সাথে কথা বলে। অনেকের কাছ থেকে সে পরামর্শ পায়, এই মামলাটিকে আন্তর্জাতিক কম্যুনিটির কাছে নিয়ে গেলে ন্যয়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্যরিস্টার আশারাফ সেই চেষ্টা করে।

আপীল বিভাগে শুনানীর আগে সরকার ভাবলো, যদি আশরাফ বাইরে থাকে তবে মীর আফজালকে হয়তো ফাঁসী দেওয়া যাবে না। মীর আশরাফ বাবাকে বাঁচাতে হেন চেষ্টা নেই, যা সে করছে না।

এদিকে মীর আফজালের পরিবার নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। আত্মীয় ও বন্ধুরা একে একে তাদের ছেড়ে যেতে শুরু করে। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় সবই হাতছাড়া হয়ে যায়। মীর আফজালের বড় ছেলে থাকে কানাডায়। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এলো আপিলের রায়ের দিন।

একদিন মীর আশরাফের বাসা ঘিরে ফেলে শত শত পুলিশ। টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় তাকে। কোথাও পাওয়া যায় না তাকে। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেলো। মীর আফজালের স্ত্রী চূড়ান্ত অসহায় হয়ে পড়েন। একদিকে ছেলে নিখোঁজ অন্যদিকে স্বামী মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায়।

৪.
রাত দশটা! হঠাত সাইরেনের শব্দ শুনতে পায় তামান্না। আব্বু আসতেছে আব্বু আসতেছে বলে চিৎকার করে ওঠে সে। চার বছর পরে তিন মেয়ে তাদের বাবাকে আজ কারাগারের বাইরে দেখতে পাবে। আজ তাদের বাবার মুক্তি মিলেছে।

একে একে দশটি পুলিশের গাড়ি এসেছে। তামান্নাদের গ্রামের বাড়ি পুরোটাই ঘিরে ফেলেছে তারা। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হলো মীর আফজাল সাহেবের ভারী শরীর। কেমন যেন নির্ভার, সৌম্য, শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন এক মুখচ্ছবি। চারদিকে যেন মিষ্টি ঘ্রাণ।

তামান্না তার মৃত বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে মানুষটা। একটা হাত টেনে নিয়ে গালে লাগিয়ে তামান্না বলে ওঠে, আহ যদি চড় দিয়ে শাসন করার জন্যও তুমি থেকে যেতে!! তিন মেয়ে ভাগাভাগি করে বাবার হাত ধরে বসে থাকে।

এদিকে পুলিশ তাড়া দিতে থাকে দ্রুত দাফন করার জন্য। ততক্ষণেও মীর আফজালের ছেলে ব্যারিস্টার আশরাফকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছেলে ও স্বামীর শোকে নির্বাক মীর আফজালের স্ত্রী।

হঠাৎ তামান্না খেয়াল করে তার বাবার বাম হাত মুঠি করা। হাতের মধ্যে যেন কিছু একটা। মুঠি খুলে দেখতে পায় একটি চিরকুট। খুব ছোট ছোট করে লেখা।

//আমার তিন আম্মু!!
নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে আজ।
তোমাদের একটি জাহান্নামে রেখে আমি রওনা হলাম জান্নাতের দিকে। তোমাদের আল্লাহর জিম্মায় রেখে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল দেখা হবে।//

দাফন হয়ে গেলো। চাঁদটা বেশ আলো ছড়াচ্ছে। লেবু গাছ থেকে ছড়িয়ে পড়া সুবাস আরো তীব্রতর হলো। সবাই ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক অসহায় মা ও তার তিন মেয়ে। কেন যেন তাদের এখন আর দুঃখ হচ্ছে না। সবাই যেন কোথা থেকে প্রশান্তি পাচ্ছেন।

তামান্না বলে উঠলো, দেখো মা! বাবা সবসময় ছিল আমাদের প্রোটেক্টর। সে আগে আগে পরকালে গিয়ে আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখবে। দেখবে আমাদের পরকাল নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। আমরা যখনই মৃত্যুবরণ করবো, দেখবো বাবা একগাল হেসে বলবে, আয় মা, বুকে আয়।

শেষ রাত! চারটা মানুষ! একটু দূরে একটা কবর! লেবুর সতেজ মোহনীয় ঘ্রাণ। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। চাঁদের আলো। যেন বেহেশত নেমে এসেছে মীর আফজালের কবর ঘিরে।

গল্প:
২ মে ২০২৫

৩০ এপ্রি, ২০২৫

হিন্দুত্ববাদ, এর পরিণতি ও আমাদের করণীয়



হিন্দুত্ববাদের শাব্দিক অর্থ হতে পারে, সিন্ধু নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা মতবাদ। আসলে এমন কোনো মতবাদ নেই। মুশরিকরা চালাকি করে তাদের নিজেদের ধর্মকে এখানের ভূমির সাথে কানেক্ট করেছে যাতে করে মনে করা হয় তারাই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। তারা তাদের ধর্মকে সনাতন ধর্মও বলে প্রচার করে যাতে মনে করা হয় তারাই প্রাচীন ধর্মের অনুসারী। অথচ প্রাচীণ এবং গোড়ার ধর্ম হলো ইসলাম, আর তা এসেছে আদি মানুষ আদম আ.-এর হাত ধরে।  

ইতিহাস
বাংলায় মুশরিকদের যাত্রা শুরু হয়েছে আর্যদের হাতে। আর্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ থেকে যখন বিপুল নিন্মবর্ণের মুশরিক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো তখন হিন্দুত্ববাদের উত্থান হয়। এখানে জাত-পাতকে কিছুটা মিনিমাইজ করে মুশরিক জাতীয়তাবাদী ধারণা দেওয়া হয়েছে।

হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস ১৯২৩ সালে শুরু হয়, যখন ভিনায়ক দামোদর সাভারকর এটি প্রচলন করেন। সাভারকর হিন্দুত্ববাদকে একটি জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে বর্ণনা করে, যা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, এবং সিখদের অন্তর্ভুক্ত করে। তবে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বহিরাগত হিসেবে বাদ দেওয়া হয়।

হিন্দুত্ববাদ হলো একটি রাজনৈতিক আদর্শবাদ যা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রচার করে এবং ভারতকে একটি হিন্দু-প্রভাবিত রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে চায়। এটি আরএসএস (১৯২৫ সালে গঠিত) এবং পরবর্তীতে বিজেপির মাধ্যমে প্রচারিত হয়। হিন্দুত্ববাদের আরো উত্থান হয় ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙচুর এবং ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির উত্থানের মাধ্যমে।

হিন্দুত্ববাদের প্রভাব ও আফটারম্যাথ
হিন্দুস্থানে এর প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে উপমহাদেশ জুড়ে ব্যাপক অস্থিরতা ও নানামুখী পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। হিন্দুত্ববাদের উত্থানের ফলে সম্ভাব্য পরিণতিগুলো নিয়ে আলোচনা ও এই ব্যাপারে একটি সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক বলে মনে করি।

১. সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি:

হিন্দুত্ববাদ প্রচারের মাধ্যমে মূলত হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লাগিয়ে যাচ্ছে RSS ও বিজেপি। মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা না দেওয়া, তাদের ইন্ডিয়া থেকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টা, গরু রাজনীতির মাধ্যমে মুসলিমদের খুন করা নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

২. সংস্কৃতিক আগ্রাসন:

হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের বহুধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে একটি একক মুশরিক সাংস্কৃতিক পরিচয় চাপিয়ে দিতে চায়, যা আঞ্চলিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে ক্ষুণ্ণ করছে। পৌত্তলিক মুশরিকরা ছাড়া বাকীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে। এই আগ্রাসন হিন্দুত্ববাদীরা শুধু ইন্ডিয়ায় নয়, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও চালিয়ে যাচ্ছে।

৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:

হিন্দুত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সরকারের দমন-পীড়ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের আস্ফালনে শুধু ইন্ডিয়ায় নয়, পুরো উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে।

৪. অর্থনৈতিক বিভাজন:

হিন্দুত্ববাদের পেছনে বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেট স্বার্থ জড়িত থাকায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে দাস বানিয়ে রাখার প্রবণতা বাণিজ্য ও অর্থণীতিতে বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে।

৫. গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা   

হিন্দুত্ববাদ ভারতকে একটি কর্তৃত্ববাদী ও অত্যাচারী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছে, যা গণমাধ্যম, আইনের শাসন এবং সিভিল সোসাইটির স্বাধীনতা কমিয়ে দিয়েছে। শুধু ভারতে নয়, হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনে পুরো উপমহাদেশে (বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভূটানে) গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থাকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে হিন্দুত্ববাদ। 

৬. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উৎপীড়ন

মুসলমান (১৪.২%), খ্রিস্টান (২.৩%), এবং শিখ (১.৭%) উপর বাড়তি সহিংসতা এবং বৈষম্য, যেমন "বিফ লিঞ্চিং" এবং আইন প্রয়োগের বিরুদ্ধাচরণ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্মূল করার চেষ্টা চলছে ইন্ডিয়ায়।

৭. সামাজিক এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা

প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে, বিশেষত পাকিস্তানের সাথে, সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়তে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে।

৮. মানবাধিকার লঙ্ঘন  

অযথা গ্রেফতার, আদালতের বাইরে হত্যা, এবং এনজিও-এর হস্তক্ষেপ সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বৃদ্ধি, যা ২০২১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে উল্লেখিত।

৯. মুশরিক ধর্মীয় রাষ্ট্রের ঝুঁকি    

ভারত একটি পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সহযোগিতায় প্রভাব ফেলবে, বিশেষত যদি যোগি আদিত্যনাথ প্রধানমন্ত্রী হন।

১০. ইন্ডিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা
অর্থনৈতিক অসমতা বাড়তে পারে, যা ১২টি রাজ্যে বিদ্রোহ এবং উত্তর-পূর্বে ৪০টি সশস্ত্র গ্রুপের উত্থানের সাথে জড়িত ।

১১. গাজওয়ায়ে হিন্দ
হিন্দুত্ববাদের উত্থানের ফলে মুহাম্মদ সা. কর্তৃক ঘোষিত গাজওয়ায়ে হিন্দ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হতে থাকবে। এই ব্যাপারে নিয়ামত উল্লাহ কাশ্মিরীর বক্তব্যও প্রণিদানযোগ্য।

এই প্রেক্ষিতে আমাদের করণীয়
হিন্দুত্ববাদ ঠেকিয়ে আমাদের দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা, সামাজিক সম্মতি, এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার প্রয়োজন। এটি কেবল আইন প্রণয়নের বিষয় নয়, বরং সমাজের সকল স্তরে ইসলামী নীতির প্রয়োগ ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা।

নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো:

১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
ইসলামী শিক্ষার প্রসার:
জনগণের মধ্যে কুরআন, হাদিস ও ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া। এর জন্য মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।
নৈতিক শিক্ষা: ইসলামী নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।
জনসচেতনতা: সেমিনার, ওয়াজ মাহফিল ও সামাজিক মাধ্যমে ইসলামী জীবনধারার গুরুত্ব তুলে ধরা।

২. ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
শরিয়াহভিত্তিক আইন: যেসব স্থানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ (যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান) এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থায় শরিয়াহর নীতি প্রয়োগ, যেমন- অর্থনৈতিক, পারিবারিক, ও ফৌজদারি আইন। তবে এটি জনগণের সম্মতি ও পরিস্থিতি বিবেচনায় করতে হবে।
ন্যায়বিচার: ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যেখানে সবাই সমান ন্যায় পায় এবং দুর্নীতি দূর করা হয়।
শূরাভিত্তিক (পরামর্শ) শাসন: শাসনব্যবস্থায় শূরার নীতি প্রয়োগ, যেখানে জনগণের প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেয়।

৩. অর্থনৈতিক সংস্কার
ইসলামী অর্থনীতি:
সুদমুক্ত ব্যাংকিং, জাকাত ব্যবস্থা, ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টন প্রতিষ্ঠা।
দারিদ্র্য দূরীকরণ: জাকাত ও সাদাকার মাধ্যমে দরিদ্রদের সহায়তা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
ন্যায্য বাণিজ্য: ব্যবসায় সততা ও ইসলামী নীতি অনুসরণ।

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার
পরিবার ব্যবস্থা:
ইসলামী পারিবারিক আইন ও মূল্যবোধের প্রচার, যেমন- বিবাহ, তালাক, ও উত্তরাধিকার বিষয়ে শরিয়াহ মেনে চলা।
নৈতিকতা ও পর্দা: সমাজে হায়া (লজ্জা) ও পর্দার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা।
অনৈসলামী প্রথা দূরীকরণ: কুসংস্কার, শিরক, ও বিদআতের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি।

৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নেতৃত্ব
সৎ নেতৃত্ব:
ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহভীরু ও জ্ঞানী নেতা নির্বাচন।
দুর্নীতি দূরীকরণ: স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা।
জনগণের অংশগ্রহণ: জনগণের মতামত ও সমর্থন নিশ্চিত করা, যাতে ইসলামী ব্যবস্থা জোরপূর্বক না হয়।

৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান:
অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী নীতি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
দাওয়াহ: বিশ্বব্যাপী ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।

৭. ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সংস্কার
তাকওয়া বৃদ্ধি:
ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভক্তি বৃদ্ধি।
ইবাদতের প্রচার: নামাজ, রোজা, জাকাত, ও হজের মতো ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করা।
আদর্শ সমাজ: ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী একটি ন্যায়, শান্তি ও সমৃদ্ধিময় সমাজ গঠন।

৮. কিছু বিষয়ে সতর্কতা:
জোরপূর্বক প্রয়োগ নয়: ইসলাম কখনো জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ধর্ম নয়। জনগণের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস জাগাতে হবে।
স্থানীয় সংস্কৃতি বিবেচনা: ইসলামী নীতি প্রয়োগের সময় স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হবে, যতক্ষণ তা শরিয়াহবিরোধী নয়।
আধুনিকতার সাথে ভারসাম্য: আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে ইসলামী নীতির সমন্বয় করা।

হিন্দুত্ববাদকে মোকাবিলা করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ভূখণ্ডে শুধু আইন প্রণয়ন নয়, বরং জনগণের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করা জরুরি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যেখানে ধৈর্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং আল্লাহর উপর ভরসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৭ এপ্রি, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৮ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!



বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত। 
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব 
২. আদল ও ইনসাফ 
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র) 
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা 
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা 

আমরা গত তিন পর্বে ১ থেকে ৪ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৫ নং মূলনীতি 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা' নিয়ে আলোচনা করবো। 

রাষ্ট্র পরিচালনা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহীতা না থাকা মানে শাসক স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তাই শাসককে স্বৈরাচার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য জবাবদিহীতা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল জবাবদিহিতার অনুভূতির দুর্বলতা। 

১. আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে (ক্বিয়ামতের দিন) দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। আখেরাতে কঠিন শাস্তির ভয়ে সে সদা কম্পবান থাকে। কেননা সে জানে যে, সেদিন ‘যার ওযনের পাল্লা হালকা হবে’, ‘তার ঠিকানা হবে ‘হাভিয়াহ’। ‘তুমি কি জানো তা কি?’ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি’ (ক্বারে‘আহ ১০১/৮-১১)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন ওযনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই হযরত ওমর (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে বলতে গেলে ঘুমাতেন না। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহ’লে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহ’লে প্রজাদের ধ্বংস করলাম। কেননা আমি তাদের উপর দায়িত্বশীল।  (মাক্বরীযী, আল-খুত্বাত্ব ১/৩০৮)। 

২. জবাবদিহিতার অনুভূতি ও দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। একদিন তিনি প্রচন্ড সূর্যতাপে ছাদাক্বার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামীমের নেতা আহনাফ বিন ক্বায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আসেন। যখন তারা নিকটবর্তী হ’লেন, তখন খলীফা ওমর আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় ছেড়ে দ্রুত এস এবং এই উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। কেননা এগুলি ছাদাক্বার উট। এর মধ্যে ইয়াতীম-মিসকীন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি ছাদাক্বা খাতের কোন একজন গোলামকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, আমার চাইতে ও আহনাফের চাইতে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন দায়িত্বে থাকে তার উপরে ঐরূপভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে একজন মনিবের প্রতি গোলামের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব’ (ইবনুল জাওযী, তারীখু ওমর ৮৯ পৃ.)।

৩. ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে যে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হ’ল এই যে, তার জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? তার যৌবন সে কোন কাজে জীর্ণ করেছে? সে কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? সে যা ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না?’ (তিরমিযী হা/২৪১৬)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে যদি প্রজাদের উপরে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তাদের উপর খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (বুঃ মুঃ)। কেবল শাসকই নন, বরং যেকোন দায়িত্বশীলের জন্য একই হুকুম।

৪.  রাসূল (সা.) বলেন, ‘মনে রেখ তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের উপরে দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। সে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃ মুঃ)। 

৫. আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তাদের কৃতকর্ম বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের যবান এবং তাদের হাত ও পা’ (নূর ২৪/২৪)। এমনকি প্রত্যেকের দেহচর্ম ও ত্বক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)। অতএব হে মানুষ! অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীদের থেকে সাবধান হও। হে দায়িত্বশীলগণ! ক্বিয়ামতের দিন নিজের আমলনামা নিজে পাঠ করার জন্য প্রস্ত্তত হও (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৪)। 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম ইসলামে জবাবদিহীতার গুরুত্ব কতটা বেশি!। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে আমরা তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা যুক্ত করতে চাই। সংবিধানের মূলনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা থাকা মানে হলো, 
১. সরকারপ্রধান তার সকল কাজ, সিদ্ধান্ত ও চুক্তির বিষয়ে জনগণের সামনে স্বচ্চ থাকবে। 
২. যে কোনো সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডের ব্যাপারে জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য থাকবে। 
৩. সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় জনগণের সামনে উন্মূক্ত থাকবে।  
৪. সরকার ও সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সংবিধান এমন কোনো স্বাধীনতা দিবে না যে, তারা যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
৫. রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন ব্যাক্তিগণ নিজেকে জনগণের সেবক ভাবতে বাধ্য থাকবেন। 
৬. দুর্নীতির সয়লাব বন্ধ হবে। 
৭. স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। 



১৬ এপ্রি, ২০২৫

ভারতের ওয়াকফ সংশোধনী বিল ও বিজেপি'র ষড়যন্ত্র


ভারতের পার্লামেন্টে সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ নিয়ে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি খোদ ভারতের বিরোধী দলের নেতারাও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। বলা হচ্ছে, এ আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রের মতো ধর্মীয় সম্পদগুলোয় সরকারি হস্তক্ষেপ ও দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতের লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, লোকসভায় পাসকৃত বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানা ও অধিকার হরণে বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টারই আরেকটি বহিঃপ্রকাশ।

ওয়াকফ সম্পত্তি কী?
মুসলিমদের কল্যাণে মুসলিমদের বরাদ্দ করা সম্পত্তিকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিজমি, দালানকোঠা, দরগাহ/মাজার ও কবরস্থান, ইদগাহ, খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ, প্লট, পুকুর, স্কুল, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ওয়াকফের প্রচলন ১২শ শতকে শুরু হয়, যখন মুসলিম শাসক মুহাম্মদ ঘোরি হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দুটি গ্রাম ওয়াকফ হিসেবে একটি লিখিত অনুদানের মাধ্যমে দান করেন। দিল্লি সালতানাতের শাসনামলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। যেখানে ইলতুতমিশ, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ও আলাউদ্দিন খলজি ওয়াকফ সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সময় ওয়াকফ ব্যবস্থার আরও প্রসার ঘটে।
আকবর ও শাহজাহান গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি ওয়াকফ করেন, যার মধ্যে তাজমহলও রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসার ও ধর্মান্তরের ফলে এই ব্যবস্থার বিস্তার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াকফের জন্য অর্থায়ন মূলত ওয়াকফকৃত গ্রামের রাজস্ব থেকে আসত, যা প্রায়ই হিন্দুপ্রধান গ্রাম ছিল এবং এই অর্থ মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য ব্যবহার করা হতো।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও সংগঠিত ও আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়, যা বর্তমান ভারতীয় আইনের অধীন এখনো প্রযোজ্য। ১৯১৩ সালে ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়, এবং ১৯২৩ সালে "মুসলমান ওয়াকফ আইন" প্রণয়ন করা হয়, যা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলোর কার্যক্রম ও সুষ্ঠু প্রশাসনের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করত। ওয়াকফ হল মুসলিম আইনে স্বীকৃত একটি স্থায়ী দান, যেখানে অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করা হয়। এই অনুদানকে "মুশরুত-উল-খিদমত" বলা হয়, এবং যিনি এই দান করেন তাকে "ওয়াকিফ" বলা হয়।

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫
ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ ভারতীয় লোক সভায় ২০২৪ সালে ৮ই আগস্ট পেশ করা হয়। এই বিলে ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওয়াকফ বোর্ড কতটুকু জমি আছে?
হিন্দুস্থানে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি আছে। ৯.৪ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে ওয়াকফ। যার আনুমানিক মূল্য ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ওয়াকফ বোর্ড ভারতীয় রেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরে তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক। মূলত এটাই বিজেপির মাথাব্যাথার কারণ। মুসলিমদের কল্যাণে ব্যবহার হওয়া এই বিপুল সম্পত্তি হস্তগত ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য ওয়াকফ সংশোধনী বিল আনা হয়েছে।

বিজেপি সরকার কেন ওয়াকফ আইন সংশোধন করছে?
১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিলে বলা হয়েছিল, ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের সম্পত্তি জেলা কালেক্টরদের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে, যাতে তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন নিশ্চিত হয়। বর্তমানে, ওয়াকফ বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হন, তবে নতুন বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পরে সমস্ত সদস্যকে সরকার মনোনীত করবে। আশঙ্কা রয়েছে যে এই বিধানটি ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বোর্ডের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে। নতুন বিলে বলা হয়েছে, একজন অমুসলিমও সিইও হতে পারবেন এবং কমপক্ষে দুজন সদস্য অমুসলিম হতে হবে।

বর্তমান ওয়াকফ বিলের ৪০ নম্বর ধারার আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের দখল করা সম্পত্তি বা জমিতে কোনো রকম সরকারি পর্যালোচনা বা রিভিউ করা যায় না। পর্যালোচনা ছাড়াই ওয়াকফ বোর্ড সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো সম্পত্তি নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ওয়াকফ বোর্ডের আইনি বিবাদ চললেও তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার। সংশোধিত বিলে সরকার মূলত ওয়াকফ অধিকার খর্ব করতে চাইছে। বিতর্কিত কোনো সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তাও খতিয়ে দেখার আইনি এক্তিয়ার সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে।

এর মাধ্যমে একাধিক ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করা হতে পারে। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনো অফিসারের হাতে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব। পুরোনো আইন অনুযায়ী কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করলে চিরদিনের জন্য সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবেই থেকে যেত। নতুন বিল পাস হলে এবার সেটাকেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ফলে যে সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের বলে ঘোষণা করে, তাতে ইসলামিক ধর্মস্থান বা অন্য কোনো ইসলামিক প্রার্থনাস্থল তৈরি হলেও সেটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করা যেতে পারে।

সমালোচকরা বলছেন, নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের (মূলত হিন্দুদের) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে কোনটা হবে না সরকারকে তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ ওয়াকফকৃত সম্পদ পরিচালনা ও ভোগের একমাত্র হকদার মুসলমানরা। এই বিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওয়াকফ আইনকে দুর্বল করে দেওয়া এবং ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও দখল করার আইনি পথ তৈরি করা।


৫ এপ্রি, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৭ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!

বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

আমরা গত দুই পর্বে ১ থেকে ৩ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৪ নং মূলনীতি 'মানবতা' নিয়ে আলোচনা করবো।

মানবতা মানে হলো একজন মানুষ পৃথিবীতে মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা। মানুষের জন্য সংবিধান কখনোই মানবতা বা ইনসানিয়াতের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।

১। জীবনের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকার

কুরআন মজীদে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি ছিলো মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম দুঃখজনক ঘটনা। সেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথম বারের মতো তখনই প্রয়োজন দেখা দেয় মানুষকে মানুষের প্রাণের মর্যাদা শেখানোর এবং একথা বলে দেয়ার যে, প্রত্যেক মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ ঘটনার উল্লেখ করার পর কুরআন বলছেঃ

“কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো গোটা মানব জাতিকে বাঁচালো।” (আল মায়েদাঃ আয়াত-৩২)

কুরআন মজীদ এ আয়াতে একজন মানুষের অন্যায় হত্যাকে গোটা মানব জাতির হত্যা বলে উল্লেখ করেছে। আবার একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে।

অন্য কথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে গোটা মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে। এ ধরনের প্রচেষ্টা এতো বড় কল্যাণের কাজ যে, এটাকে গোটা মানবতাকে জীবিত করার সমান গণ্য করা হয়েছে। কেবল দু’টি অবস্থায় এ নীতির ব্যতিক্রম করা যাবেঃ

একঃ কোনো ব্যক্তি হত্যার অপরাধে অপরাধী হলে কিসাস নেয়ার জন্য (বিচারের মাধ্যমে) তাকে হত্যা করা যাবে।

দুইঃ কোনো ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করলে তাকেও হত্যা করা যাবে (বিচারের মাধ্যমে)।

এ দু’টি ব্যতিক্রমী অবস্থা ছাড়া আর কোনো অবস্থায়ই মানুষ হত্যা করা যাবে না।

মানব ইতিহাসের প্রাথমিক যুগেই মহান আল্লাহ মানব জীবনের নিরাপত্তা বিধানের এ নীতি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন। অসভ্যতার অন্ধকারের মধ্যে মানুষের জন্ম, এমন ধারণা পোষণ করা ভুল। মানুষ তার আপন প্রজাতি অর্থাৎ অন্য মানুষকে হত্যা করতে করতে কোনো এক পর্যায়ে পৌছে চিন্তা করে যে, মানুষকে হত্যা করা ঠিক নয়, এ ধারণাও একেবারেই ভ্রান্ত। এটা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত। কুরআন আমাদের বলে, মহান আল্লাহ প্রথম থেকেই মানুষকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে মানুষের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

২। নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন এবং রসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে স্পষ্ট জানা যায়ঃ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও অসুস্থ মানুষ নিজ জাতির লোক হোক কিংবা শত্রু কওমের লোক, কোনো অবস্থায়ই তাদের উপর আঘাত করা বৈধ নয়। তবে তারা যুদ্ধরত থাকলে ভিন্ন কথা। তা না হলে অন্য যে কোনো অবস্থায়ই তাদেরকে আঘাত করা নিষিদ্ধ। এ নীতি শুধু নিজ জাতির জন্য নয়। বরং গোটা মানবতার জন্যেই এ নীতি প্রযোজ্য।

মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন শত্রুর বিরুদ্ধে কোনো সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় গোটা সেনাদলকে সম্বোধন করে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতেনঃ ‘শত্রুর উপর আক্রমণের সময় কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, আহত, পঙ্গু ও রুগ্ন ব্যক্তিকে আঘাত করবে না।’

শুধু তাই নয়, আল্লাহ তায়ালা মু'মিনদের নির্দেশ দিয়েছেন অসহায় মানুষদের উদ্ধার করার জন্য। তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। (সূরা নিসাঃ৭৫)

৩। মহিলাদের মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন মজিদ থেকে আরো একটি মৌলিক অধিকারের কথা জানা যায়। এটি সম্পর্কে হাদিসেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সেটি হলো, নারীদের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সর্বাবস্থায় অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ ক্ষেত্রেও যদি শত্রু কওমের নারীরা মুসলমান সৈনিকদের হস্তগত হয় তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা কোনো মুসলমান সৈনিকের জন্যে বৈধ নয়। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যে কোনো নারীর সাথে ব্যভিচার হারাম। সে নারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম। স্বজাতির হোক বা বিজাতির। বন্ধু দেশের হোক বা শত্রু দেশের-তাতে কিছু আসে যায় না।

৪। ন্যায় আচরণ লাভের অধিকার
কুরআন মজীদ একটি অলংঘণীয় নীতি প্রদান করেছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ
“কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা দলের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যোনো তাদের প্রতি বে-ইনসাফী করতে উৎসাহিত না করে। ইনসাফ করো এটি তাকওয়ার সর্বাধিক নিকটবর্তী।” (সুরা ৫ মায়েদাঃ আয়াত ৮)

এ আয়াতটিতে ইসলাম একটি নীতি ঠিক করে দিয়েছে। তাহলো, মানুষের সাথে-সে ব্যক্তি হোক বা গোষ্ঠী, সর্বাবস্থায় ইনসাফ করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ নীতি মোটেই ঠিক নয় যে, আমরা বন্ধুদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ করবো আর শত্রুর সাথে আচরণের ক্ষেত্রে এ নীতি পরিহার করবো।

৫। ভালো কাজে সহযোগিতা এবং মন্দ কাজে অসহযোগিতা
কুরআন আরো একটি মূলনীতি দিয়েছে। তা হলো, ভালো ও ন্যায়ের কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করা এবং অন্যায় ও যুলুমের কাজে কারো সাথে সহযোগিতা না করা। ভাইও যদি মন্দ কাজ করে তাহলে আমরা তার সাথেও সহযোগিতা করবো না। আর কল্যাণের কাজ যদি শত্রুও করে তাহলে তাকেও সহযোগিতা করবো। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“কল্যাণমূলক কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং পাপ কাজে কারো সাথে সহযোগিতা করোনা” ( আল কুরআন, সূরা ৫: আয়াত ২)

৬। সমতার অধিকার
আরেকটি নীতি কুরআন মজীদ অত্যন্ত জোরালোভাবে বলে দিয়েছে। নীতিটি হলো, সমস্ত মানুষ সমান। কেউ মর্যাদা লাভ করলে তা করবে উত্তম নৈতিক চরিত্রের কারণে। এ ব্যাপারে কুরআন ঘোষণা করেছেঃ
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি - যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি আল্লাহভীরু সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান।” (সুরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১৩)

এ আয়াতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো সমস্ত মানুষের জন্ম-উৎস এক। ভিন্ন ভিন্ন বংশধারা, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রকৃতপক্ষে মানব বিশ্বকে বিভক্ত করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হতে পারেনা।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হলো, ‘আমি মানব সমাজকে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি শুধু তাদের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য।’ অন্য কথায় একটি গোষ্ঠী, একটি জাতি এবং একটি গোত্রের অন্যদের উপর মর্যাদা ও গৌরবের এমন কিছু নেই যে, তা নিজেদের অধিকার বাড়িয়ে দেবে এবং অন্যদের কমিয়ে দেবে।

আল্লাহ তা’য়ালা যে সব পার্থক্য করেছেন অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দান করেছেন এবং পরস্পরের ভাষা আলাদা করেছেন, এসব পার্থক্য গর্ব প্রকাশ করার জন্যে নয়। বরং এ জন্যে করেছেন যাতে করে পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ের পার্থক্য করা যায়। যদি সব মানুষ একই রকম হতো তাহলে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা যেতো না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ বিভক্তি স্বাভাবিক। তবে এটা অন্যের অধিকার নস্যাত করা এবং বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে নয়। মর্যাদা ও গৌরবের ভিত্তি হলো উন্নত নৈতিক চরিত্র। এ বিষয়টি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলে দেনঃ

“কোনো আরবের কোনো অনারবের উপর এবং কোনো অনারব কোনো আরবের উপর এবং কোনো সাদা বর্ণের কোনো কালো বর্ণের মানুষের উপর এবং কোনো কালো বর্ণের কোনো সাদা বর্ণের মানুষের উপর কোনো প্রকার মর্যাদা নেই একমাত্র তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি ছাড়া। বংশের ভিত্তিতে কারো কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।”

অর্থাৎ- মর্যাদার ভিত্তি শুধু উন্নত নৈতিক চরিত্র এবং আল্লাহভীতি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, কোনো মানুষকে রৌপ্য, কোনো মানুষকে পাথর আবার কোনো মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বরং সমস্ত মানুষ পরস্পর সমান।

৭। রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের অধিকার

মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সমূহের মধ্যে ইসলাম একটি বড় অধিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাহলো সমাজের সমস্ত মানুষের রাজনৈতিক ও সরকারী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণের অধিকার। ইসলাম কোনো সমাজের মানুষকে উচু ও নীচু বা শাসক ও শাসিত হিসেবে বিভক্ত করার পক্ষপাতি নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষের পরামর্শক্রমে সরকার গঠিত হবে। কুরআন বলেছেঃ
لِـيَـسـتَـخـلِـفَـنَّـهُـم فِـى اَلارضِ
‘আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে-অর্থাৎ ঈমানদারদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন।’ (আল কুরআন, সূরা নূর, আয়াত-৫৫) এখানে আল্ল্লাহ বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন আমি কিছু সংখ্যক লোককে নয় বরং গোটা জাতিকে খিলাফত দান করবো। সরকার শুধু এক ব্যক্তির, এক পরিবারের কিংবা একটি শ্রেণীর হবে না। বরং তা হবে গোটা জাতির এবং সব লোকের পরামর্শের ভিত্তিতে তা অস্তিত্ব লাভ করবে। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ
شُـورى بَـيـنَـهُـم وَاَمـرُهُـم
অর্থাৎ ‘এ সরকার সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করবে।’ (আল-কুরআন, সূরা শুরাঃ আয়াত-৩৮। এ ছাড়া দেখুন- সূরা নিসাঃ আয়াত-১৫৯)

এ ব্যাপারে হযরত উমর রা· -এর সুস্পষ্ট মতামত বিদ্যমান। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া তাদের সরকার পরিচালনা বা তাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার কারো নেই। মুসলমানরা সম্মত হলে তাদের সরকার পরিচালনা করা যাবে। তারা সম্মত না হলে তা করা যাবে না। এ বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ও পরামর্শ ভিত্তিক সরকার গঠনের নীতি অনুমোদন করে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের ঘাড়ে রাজতন্ত্র চেপে বসেছিল।

৮। ব্যক্তি মালিকানার নিরাপত্তা
আর একটি মৌলিক অধিকার হলো মানুষের ব্যক্তি মালিকানার অধিকার। এ ব্যাপারে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করেছে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেনঃ وَلا تَـا كُـلُـوا اَمـوَالَـكُـم بَـيـنَـكُـم بِـالـبَـاطِـلِ ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের অর্থ-সম্পদ ভোগ দখল করো না।’ (সূরা ১ আল বাকারাঃ আয়াত ১৮৮)

কুরআন, হাদিস ও ফিক্‌হ অধ্যয়ন করলে অপরের অর্থ সম্পদ ভোগের অন্যায় পন্থা কি কি তা জানা যায়। এসব অবৈধ পন্থা ইসলাম অস্পষ্ট রেখে দেয়নি। এ নীতি অনুসারে কোনো ব্যক্তির সম্পদ অবৈধভাবে হস্তগত করা যায় না।

স্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে ইসলাম সম্পদ লাভের যেসব নিয়ম-নীতি ও পন্থা-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তা ভংগ করে কারো ব্যক্তি মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা সরকারের নেই।

৯। মান-সম্মানের নিরাপত্তার অধিকার

মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভ করাও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ অধিকার সম্পর্কে কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলছেনঃ

একঃ لا يَـسـخَـر قَـومٌ مّـن قَـومِ 'তোমাদের মধ্যকার একদল যেন আরেক দলকে নিয়ে হাসি-তামাশা বিদ্রুপ না করে।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
দুইঃ وَلا تَـنَـابَـزُوا بِـالالـقَابِ ‘তোমরা একজন অন্যজনকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
তিনঃ وَلا يَـغـتَـب بَـعـضُـكُـم بَـعـضًا ‘তোমরা একে অপরের নিন্দা (অসাক্ষাতে) করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১২)

অর্থাৎ মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের উপর আক্রমণ করার যতো উপায় ও পন্থা হতে পারে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, কোনো মানুষ সে সামনে উপস্থিত থাক বা না থাক তাকে নিয়ে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশা করা যাবে না, তাকে মন্দ নামে আখ্যায়িত করা যাবে না এবং তার নিন্দাবাদও করা যাবে না। কেও কারো মর্যাদার উপর আঘাত করবেনা। হাত ও মুখের দ্বারা কারো উপর কোনো প্রকার যুলুম করবে না। এটা প্রতিটি মানুষের আইনগত অধিকার।

১০। ব্যক্তিগত জীবনে গোপনীয়তার নিরাপত্তা

ইসলামের দেয়া মৌলিক অধিকার অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যক্তিগত জীবনকে নিরাপদ রাখার অধিকার রাখে। এ ব্যাপারে কুরআনে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।
‘তোমাদের নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করোনা যতোক্ষণ না তাদের সাগ্রহ সম্মতি পাও।’( আল কুরআন, সূরা ২৪ নূরঃ আয়াত-২৭)

কুরআনে বলা হয়েছে لا تَـجَـسَّـسُـو অর্থাৎ- অপরের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১২) নবী সা· বলেছেনঃ ‘নিজের ঘর থেকেও অন্যের ঘরে উঁকি দেয়ার অধিকার কারো নেই।’

নিজের ঘরে বসে অন্য কোনো লোকের শোর-গোল, উঁকি-ঝুঁকি ও হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকার পূর্ণ আইনগত অধিকার যে কোনো মানুষের আছে। যে কোনো ব্যক্তির খোলামেলা পারিবারিক পরিবেশ ও গোপনীয়তা বজায় থাকার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া কারো চিঠি-পত্র পড়াতো দূরের কথা উপর থেকে দৃষ্টি দিয়ে দেখার অধিকারও কারোর নেই। ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার পুরোপুরি নিরাপত্তা দেয় এবং অন্যের ঘরে উঁকি-ঝুঁকি মারতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করে। একইভাবে ডাকে আসা কারো জিনিস পত্রও দেখা যাবে না। তবে কারো ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় যে, সে বিপজ্জনক কাজ-কর্মে লিপ্ত আছে তা হলে ভিন্ন কথা। কারো দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয়।

১১. স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার

মানুষের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার (Freedom of expressian) অধিকার। কুরআন এটাকে বলেছে, ‘আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার (امـر بـالـمـعـروف ونـهـى عـن الـمـنـكر)’। এটা মানুষের শুধু অধিকারই নয় বরং এটা তার জন্য কুরআন ও হাদিস উভয়ের নির্দেশ অনুসারেই ফরয।(কুরআন বলেঃ كُـنـتُـم خَـيـرَ اُمَّـةٍ اُخـرِجَـت لِلـنَّـاسِ تَـامُـرُونَ بِـالـمَـعـرُوفِ وَتَـنـهَـونَ عَـنِ الـمُـنـكَـرِ- النساء:110 ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাহ। মানবতার কল্যাণের জন্যে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা মারূফ (ভালো) কাজের আদেশ করবে এবং মুনকার (মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে।’) মানুষের জন্য ফরয (কর্তব্য) হলো সে অন্য মানুষকে ভালো বা কল্যাণের কাজের জন্য আহবান জানাবে এবং মন্দ বা অকল্যাণের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।

কোনো মন্দ বা অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে থাকলে তার বিরুদ্ধে সে শুধু সোচ্চারই হবে না, বরং তা বন্ধ করার চেষ্টা করাও তার জন্য ফরয। এ ধরনের কাজের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রতিবাদ না করা হয় এবং বন্ধ করার জন্য চিন্তা-ভাবনা না করা হয় তা হলে অপরাধ হবে। ইসলামী সমাজকে পূত-পবিত্র রাখা মুসলমানের কর্তব্য। এ ব্যাপারে মুসলমানদের কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর নেই।

কেউ যদি কোনো কল্যাণমূলক কাজে বাধা দেয় তাহলে সে শুধু একটি মৌলিক অধিকারকেই হরণ করলো না, বরং একটি ফরয পালনেও বাধার সৃষ্টি করলো। সমাজ দেহের সুস্থতা বজায় রাখতে একজন মানুষের সর্বাবস্থায় এ অধিকার থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন ইসরাঈলীদের পতনের যেসব কারণ বর্ণনা করেছে তার মধ্যে একটি হলো, তারা একে অপরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতো না। (আল কুরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত-৭৯)

১২. স্বাধীন বিবেক ও বিশ্বাসের অধিকার
ইসলাম দিয়েছে لا اِكـرَاهَ فِـى الـدّيـنِ (দীনের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তির অবকাশ নেই) -এর নীতি। এ নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি কুফরি বা ঈমান এ দু’টি পথের যে কোনোটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা রাখে। বিবেক ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন থাকলে দু’টি ক্ষেত্রেই তা আছে।

একঃ ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও তার স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবিলার ক্ষেত্রে এবং
দুইঃ আইন-শৃঙ্খলা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য অপরাধ ও ফিৎনা-ফাসাদ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে।

১৩. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত থেকে বাঁচার অধিকার
বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করুক এবং একে অপরের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করুক ইসলাম তার পক্ষপাতী নয়। কুরআন প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস এবং তার ধর্মীয় নেতাদের মর্যাদা দিতে শিখিয়েছে। কুরআন বলেঃ وَلا تَـسُـبُّـوا الَّـذِيـنَ يَـدعُـونَ مِـن دُونِ الـلّهِ ‘তারা আল্লাহ ছাড়া আর যেসব বস্তুকে উপাস্য বানিয়ে ডাকে তোমরা তাদের (সেসব উপাস্যকে) গাল মন্দ করো না।’ (আল কুরআন, সূরা ৬ আল আনআম। আয়াতঃ ১০৮)

অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কথা বলা এবং তার যুক্তিসংগত সমালোচনা করা অথবা মতানৈক্য প্রকাশ করা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার জন্য কটুক্তি বা গাল-মন্দ করা অন্যায়।

১৪. অপরের কর্মকান্ডের দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির অধিকার
ইসলাম বলে, মানুষ শুধু নিজের কাজকর্ম এবং নিজের কৃত অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্য কারো অপরাধ বা কৃতকর্মের জন্য তাকে পাকড়াও করা যাবেনা।
কুরআন প্রদত্ত মৌলনীতি হলোঃ
وّزرَ اُخـرَى. الانـعام : 164 وَلا تَـزِرُ وَازِرَةٌ
“কোনো বোঝা বহনকারী অন্য কারো বোঝা বহন করবে না” (সুরা ৬ আল আন’আমঃ আয়াত ১৬৪)। ইসলামী আইনে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।

১৫. সন্দেহের শিকার হওয়া থেকে মুক্ত থাকার অধিকার
নিরঙ্কুশভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে সন্দেহ বশতঃ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এ ব্যাপারে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ হলো, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখো। অজ্ঞতা প্রসূত কোনো ব্যবস্থা যেনো তার বিরুদ্ধে গ্রহণ না করো। কুরআন নির্দেশ দেয়ঃ
اَجـتَـنِـبُـوا كَـثِـيـرًا مّـن الـظَّـنّ
অর্থঃ ‘ধারণা প্রসূত বেশিরভাগ বিষয় থেকে বিরত থেকো।’ (সূরা ৪৯ আল হুজুরাতঃ আয়াত ১২)

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে মানবতা থাকার মানে হলো
১. মানুষের অধিকার নষ্ট হয় এমন কোনো আইন বা বিধান সংবিধানে অন্তঃর্ভুক্ত হবে না।
২. মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো বিধান বাতিল হবে
৩. মানুষ তার মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে এদেশে বসবাস করতে পারবে।