১৮ মার্চ, ২০২৪

মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৪



পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম লীগ ইংল্যান্ডের পরামর্শ অনুযায়ী দেশকে সেক্যুলার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছে কথিত মওদূদীবাদের লোকেরা। অন্য সব ঘরানার আলেমদের সাথে নিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। এর ফলাফল হিসেবে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানে সুদ বন্ধ হয়। শরিয়াহ কোর্ট চালু হয়।

ইংরেজ আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাদিয়ানীরা নানান সরকারি চাকুরি অংশ নেয়। পাকিস্তান গঠনের পর কাদিয়ানীদের উচ্চপদস্থ আমলা ও সেনাবাহিনী অফিসাররা পাকিস্তানের হর্তা কর্তা হয়ে কাদিয়ানী মতবাদের প্রচার প্রসার করতে থাকে। খতমে নবুয়তের মতো বেসিক বিষয়ে দ্বিমত করে মুসলিম থাকা যায় না। মুসলিমদের রাষ্ট্রে কাদিয়ানীদের এই প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন মওদূদী। কথিত মওদূদীবাদের অনুসারীরা পাকিস্তানকে কাদিয়ানীদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। সেই চেষ্টায় মওদূদী ফাঁসীর দড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।

১৯৫৭ সাল। আওয়ামীলীগ তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে সংবিধান পাশ হয়। পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা দেয়। আওয়ামীলীগ থেকেই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। কমিউনিস্ট ভাসানী কাগমারিতে সম্মেলন আহবান করে। নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে তিনি দুইটি কারণে সালাম জানিয়ে বিদায় দেওয়ার কথা বলেন। ১. পাক-মার্কিন সিয়োটা চুক্তি। ২. পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা।

ভাসানী গণ্ডগোল লাগিয়ে দিলো। সারা পাকিস্তানে বামভাবাপন্ন রাজনীতিবিদেরা পরিস্থিতি ঘোলাটে তৈরি করলো। গভর্ণর জেনারেল ইসকান্দর মীর্জাও সোহরাওয়ার্দির বিপক্ষে গেল। এক পর্যায়ে ভাসানী বেশ কয়েকজন এমপিকে নিয়ে আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে দিল। তাতে সোহরাওয়ার্দি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো। ঘোর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন হলো সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। সে সামরিক শাসন শুরু করলো ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের বিদায় ঘটলো। ভাসানীসহ বামপন্থীরা আইয়ুবকে সাপোর্ট করলো।

পরবর্তীতে মানুষের নেতা নির্বাচন অধিকার ফিরিয়ে আনার মাওলানা মওদূদী আবার রাস্তায় নামলেন। সকল দলকে একত্র করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কন্ঠ উচ্চকিত করলেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। তারপরও থেমে যায় নি কথিত মওদূদীবাদীরা। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় কাশ্মীর ইস্যুতে। সেসময় আইয়ুব দেশ রক্ষায় মওদূদীর দ্বারস্ত হয়। মওদূদী আইয়ুবের অনুরোধে সংকটকালে দেশ রক্ষায় পাকিস্তানের রেডিওতে সকল জনগণ ও রাজনীতিবিদদের এক হতে বলেন। কথিত মওদূদীবাদীরা উম্মাহ চেতনায় মুসলিমদের জাগ্রত দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আইয়ুব আবারো তার হীন ও নীচ খেলা খেলতে থাকে।

দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে, বিশেষ করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী জমিয়তে তলাবার ছাত্রদের অপরিসীমের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতন হয়। ১৯৭১ সালে ভারতীয় মুশরিকদের সহায়তায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা কিছু বাঙালি গাদ্দার। আর এর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।

১৯৭১ সালে শেখ মুজিব দেশ স্বাধীন করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদেশের ইসলামপন্থীদের ওপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। এটা অনুমিত ছিল। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানকে ভাঙতে দিতে চায়নি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। বিশেষত কাদের সিদ্দিকীর অধীনে কাদেরিয়া বাহিনী ও জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনী। ঢাকা ও তার আশপাশের মুসলিম লীগের নেতা কর্মী, নেজামে ইসলামের নেতা কর্মী, জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, ন্যাপের নেতা-কর্মী, মসজিদ্গুলোর ইমাম মুয়াজ্জিন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের পল্টন ময়দানে জমায়েত করা হতো। তারপর তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। এটা কোনো গোপন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল খুবই প্রকাশ্য এবং দেশি-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে চলে বেসামরিক নাগরিক হত্যা। এদের অপরাধ ছিল তারা পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা চায়নি।

একইসাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিয়ে সেখানের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করে। এটাও ছিল যুদ্ধাপরাধ। বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ঘর দখল ও লুটপাটের আয়োজন করে মুক্তিবাহিনী। এ সবই ছিল যুদ্ধাপরাধ। যে মুহাজিররা ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলায় এসেছিল তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিবাহিনীর অত্যাচারে আবার ভারতে পাড়ি জমান। এ এক জিল্লতির জীবন ছিল। বিহারীরা ফিরে যেতে পারলেও এদেশের ইসলামপন্থীদের পালানোর জায়গা ছিল না বললেই চলে। সেসময়ের বেশ কয়েকজন ভিকটিমের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা নির্যাতনের মুখে তাদের নিজ জেলা থেকে পালিয়ে দূরের জেলায় পালিয়ে থেকেছে।

শুধু যে ইসলামপন্থীরা আক্রান্ত হয়েছে তা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ইসলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা ইসলামের প্রতি আক্রোশ দেখিয়েছে। যে সকল প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নামে ইসলাম ও মুসলিম ছিল সেগুলো থেকে তারা ইসলাম ও মুসলিম শব্দ বাদ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম বাদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে 'রাব্বি জিদনি ইলমা' ও কুরআনের চিহ্ন বাদ দেওয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ইসলাম বাদ দিয়েছে। পাবনার সেরা কলেজ ইসলামিয়া কলেজকে বুলবুল কলেজে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে সব স্থান ইসলাম ও মুসলিমকে উৎখাত করা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের বোরকা নিষিদ্ধ করে শাড়ি পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারনে বহু ছাত্রী একাত্তর পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে যায় নি।

সংবিধান প্রণয়ন করে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, নেজামী ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী এই দুইদলই ছিল সেসময় ইসলামী রাজনীতির ধারক ও বাহক। এদের নিষিদ্ধ করা হয় নাই যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। বরং তাদের এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, তারা ইসলামী রাজনীতি করেন। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ন্যাপ (মুজাফফর), মনি সিং এর কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল এই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ছিল ইসলামের সাথে। এই সাধারণ ব্যাপার সেসময়ের সকল ইসলামী রাজনীতিবিদ বুঝেছিলেন এবং তারা এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। সেসময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা রেডিও টেলিভিশনে বিসমিল্লাহ, সালাম দিয়ে শুরু করা বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভকামনা ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করেছে। রেডিওতে কুরআন তিলওয়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী একাডেমি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ইসলামী একাডেমীকেই তিনবছর পরে ইসলামী ফাউন্ডেশন নামে চালু করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবার পুনরায় রেডিও টেলিভিশনে সালাম, বিসমিল্লাহ, আযান ও কুরআন তেলওয়াত শুরু হয়েছিল।

মুজিব পরিবেষ্টিত ছিলেন তাজউদ্দিনদের মতো এক ঝাঁক কমিউনিস্ট দ্বারা। তার ফলে মুজিবের শাসনামলের শুরুর দিকে সমস্ত ইসলামবিরোধী কাজের জোয়ার শুরু হয়েছিল। সংবিধান থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাদ পড়েছে। মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস বাদ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কমিউনিজম, সেক্যুলারিজমের মতো ইসলাম ও ধর্ম বিদ্বেষী মতবাদকে। ক্ষমতায় থেকে ইসলামপন্থা দমনে সব কাজ করেছেন শেখ মুজিব। যখন জাসদ গঠিত হয় এবং বামপন্থীদের সাথে সরকারের চরম বিরোধ শুরু হয় তখন মুজিব কোনঠাসা হয়ে থাকা ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে থাকেন তার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। তবে অবশ্যই তিনি ইসলামী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি শুধুমাত্র অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছেন। তাবলীগের প্রসার করার চেষ্টা করেছেন। কওমীদের শুধুমাত্র মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে থেকে পড়ালেখার কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।

এই কঠিন অবস্থায় মওদূদীবাদের অনুসারীরা থেমে থাকে নি। কথিত মওদূদীবাদ ছাড়া বাকীরা সবাই ইসলামী রাজনীতি আর চালু হবে না এই মর্মে ঐক্যমত পোষণ করে ইসলামী রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেছেন। কিন্তু মওদূদীবাদ মুসলিম থামতে দেয়নি। মওদূদীবাদ ছিল এদেশের ইসলামের ঢাল। কথিত মওদূদীবাদই ইসলামকে বাংলাদেশে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে।

১৯৭১ সালে মুজিবের কর্মকান্ডের পর আরবরা আমাদের ত্যাগ করেছিল। জামায়াতের কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। পুরো মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশ যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিয়েছে। মুজিবের মৃত্যুর পর ইসলামকে দ্রুতই রাজনীতির মূল ট্র্যাকে নিয়ে এসেছে। সারা দেশে প্রতিটি জেলায় স্কুল কলেজ ও ও মাদ্রাসা স্থাপন করে বাংলার সন্তানদের মন ও মগজে ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি পুনরায় স্থাপন করার কাজ হাতে নিয়েছিল।

চলবে ...


১১ মার্চ, ২০২৪

মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৩


না, কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারে নি। ১৯৩২ সালে মওদূদী যখন ইসলামের মূল ব্যাপারটা মানুষের সামনে তুলে ধরলেন, তখন ইংরেজ, মুশরিক ও মুসলিমদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সবার কাছেই তিনি চক্ষুশূলে পরিণত হলেন।

মওদূদী যখন ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন তখন আলিয়া মাদ্রাসা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার অধীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশ সাড়া পড়ে যায়। যেহেতু তিনি পত্রিকায় লিখে ও বই লিখে তাঁর চিন্তার প্রচার করতে লাগলেন সেহেতু শিক্ষিত সমাজে তার গ্রাহক বেড়ে যায়। আল্লামা ইকবালের মতো বড় ব্যক্তিরাও তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে পড়েন।

মওদূদীর লেখায় মুসলিম ছাত্ররা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আশা খুঁজে পায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মাওলানা মওদূদীকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহবান করে। লেখালেখির সাথে এবার যুক্ত হলো মওদূদীর বক্তব্য। তাঁর বক্তব্যও ছিল তাঁর লেখার মতো দুর্দান্ত। ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য লিখে নিতেন এবং তা ছাপিয়ে প্রচার করতেন।

ধীরে ধীরে মওদূদীর ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকলো। সেই সাথে যুক্ত হলো আল্লামা ইকবালের স্নেহধন্য সাহায্য। যদিও আল্লামা ইকবাল মুসলিম লীগ করতেন তদুপরি তিনি গোড়া থেকেই মক্কায় আল্লাহর রাসূল যেই কাফেলার সূচনা করেছেন সেরকম একটি কাফেলা গঠনের তাকিদ দেন।

এরমধ্যে দেওবন্দী নেতা হুসাইন আহমদ মাদানী মুসলিমদের মিসগাইড করার জন্য ভূমির ভিত্তিতে জাতীয়তা অর্থাৎ উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম একজাতি এই ধরণের একটি ক্যাম্পেইন চালু করেন। তিনি মুশরিকদের পক্ষাবলম্বন করে এই ধরণের অবস্থান নেন। আমরা তো শোলাকিয়ার ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদকে দেখেছি, যিনি আল্লাহ তায়ালা ও নবী সা.-কে বিশ্রী গালি দেওয়া শাহবাগীদের সাথে কাতারবন্দী হয়েছেন। সুতরাং হুসাইন আহমদ মাদানীর চরিত্র বুঝতে আমাদের কষ্ট হওয়ার কথা না।

মওদূদী তাঁর পত্রিকায় মাদানীর ভুলভাল ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর ধারাবাহিক লেখায় হুসাইন মাদানীর পান্ডিত্যের দূর্গ ধ্বসে যায়। মাদানীর দল দুইভাগ হয়ে যায়। মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে নতুন দল গঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে। জ্ঞানে ও বক্তব্যে না পেরে মাদানীর অনুসারীরা মওদূদীর বিরুদ্ধে ফতওয়ার কামান ছুটিয়ে দিয়েছিল। মওদূদী মুসলিমদের মধ্যে তাজদিদী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। মুসলিমদের মূল টেক্সট থেকে জ্ঞান আহরণের আহবান জানিয়েছেন। মাদানীর অনুসারীরা এটাকেই মওদূদীবাদ হিসেবে ট্যাগিং করেছে এবং মওদূদী ও তার ভক্তদের কাফির ফতওয়া দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, মওদূদীকে কাফির প্রমাণের জন্য যত মিথ্যা কথা সম্ভব তত কথাই বলেছে। আমি হুসাইন মাদানীর অনুসারী মাদ্রাসা হাটহাজারীতে গিয়েছিলাম। সেখানের লাইব্রেরিতে একটা পুরো আলমিরাই ছিল জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে লেখা বই দিয়ে ভর্তি। আপনি অবাক হবেন লম্বা দাড়ি ও শুভ্র পোষাক পরিহিত লোকেরা ডা. জাকিরের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে কাফির প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছে। এই পার্টি মনে হয় সওয়াবের উদ্দেশ্যে কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা কথা তৈরি করে ও প্রচার করে।

মওদূদী-মাদানী পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মওদূদীর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। শিক্ষিত সমাজে মাওলানা মওদূদীর গ্রহনযোগ্যতা বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৪১ সালে মওদূদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়। সাইয়েদ মওদূদী মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে মুসলিম লীগের পক্ষে কলম ধরলেও উনি মুসলিম লীগে যুক্ত হননি। কারণ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন না। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে ফরজ ওয়াজিব, হালাল, হারামের বালাই ছিল ছিল না।

আমরা প্রথমেই শুরু করেছিলাম গরু দিয়ে। আবার একটু গরুতে ফিরে আসি। ১৭৫৭ সালে আমরা আমাদের সংস্কৃতি পালনের অধিকার হারিয়ে ফেলি। সেই অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়। আমরা মুশরিক ও ইংরেজদের থেকে বাঁচার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করি। এই সংগ্রামের মূল নেতা ছিলেন জিন্নাহ। আর তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন মওদূদী।

১৯৪৭ সালে আমরা যুগপৎভাবে ইংরেজ ও মুশরিকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। প্রায় দুইশ বছর পর এদেশের মানুষ পুনরায় ভূমির মালিকানা পেয়েছিলো। জমিদারী প্রথার বিলুপ্ত হয়। আমরা প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে উঠলাম। নিজের নেতা নিজেরাই নির্ধারণের সুযোগ পেলাম। আমরা আগে ঊনমানুষ ছিলাম। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে আমরা পরিপূর্ণ অধিকার সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত হলাম।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা তথা এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার জন্য জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকারের উপায় নেই। আমরা আমাদের পুরো জীবনের বন্দনা দিয়েও তাদের ত্যাগ ও প্রচেষ্টার উপকারের কৃতজ্ঞতা শেষ করতে পারবো না। আমার পরিবার উপমহাদেশের যে অংশে বসবাস করতেন তা মুশরিকদের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আমাদের পরিবার হিন্দুস্থান থেকে পাকিস্তানে চলে আসে। যারা আসেনি তারা জানে পাকিস্তান আমাদের জন্য কত বড় নিয়ামত ছিল। আমরা আবার বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে গরু কুরবানী করতে পেরেছি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের তামাদ্দুন, আমাদের মুয়ামেলাত আমরা ফিরে পেয়েছি। আজকে হিন্দুস্তানে গরুর গোশত আছে এই সন্দেহে পিটিয়ে মুসলিমদের হত্যা করা হয়। গত শুক্রবার দিল্লীতে জুমুআর নামাজের সময়ে সিজদারত মুসল্লিদেরকে পুলিশ লাথি মারতে থাকে। আর কতবার যে গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছে মুসলিমরা তা গণনা করার অবস্থায় নেই।

১৯৪৭ সালের পরেও পাকিস্তানেও তুর্কির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কামাল পাশা ব্রিটিশদের থেকে তুর্কি জাতিকে উদ্ধার করে। স্বভাবতই মুসলিমরা ভেবেছিল তিনি আবার প্রচলিত খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু খিলাফতের কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন তিনি। খিলাফত ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে সেক্যুলার তুরস্ক গঠন করেন। একই ব্যাপার ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ আমলে জিন্নাহ যখন বিভিন্ন জনসভায় যেতেন তখন তিনি বুক পকেটে থাকা ছোট্ট একটি কুরআনের কপি বের দেখিয়ে বলতেন, এটিই হবে পাকিস্তানের সংবিধান। কুরআনের ভিত্তিতেই চলবে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র।

যখন থেকে পাকিস্তান প্রস্তাব হয়েছে তখন থেকেই মুসলিম লীগের নেতারা বলতেন পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুসলিম লীগের এই দাবিকে সঠিক মনে করতেন না গত শতাব্দির পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি ১৯৪০ সালে এই বিষয়ে একটি লেকচার দেন যা পরে বই আকারে ছাপা হয়েছে। বইটির নাম ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়েম হতি হ্যায়। সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের বছর তিনি প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি সংগঠন কায়েম করেন, যার নাম জামায়াতে ইসলামী।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান একটি সেক্যুলার সংবিধান হবে বলে ধারণা দেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা।

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করে ১৯৪৮ সাল থেকে। আর সেটি ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি নিয়ে। ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন কথিত মওদূদীবাদের প্রবক্তা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে 'আদর্শ প্রস্তাব' গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।

দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।

এই দাবীগুলো নিয়েই জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে।

১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। গভর্ণর জেনারেল হন ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান। এই সময় থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ শাসকের ভূমিকায় থাকেন। লিয়াকত আলী খান সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ অক্টোবর ইসলামী শাসনতন্ত্রের মুখপাত্র সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পর ১৯৫০ সনের ২৮ মে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন যে, বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না।

১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলিল 'ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।'

দফাগুলো ছিলো নিন্মরুপ:

১. দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ।

২. দেশের আইন আল-কুরআন ও আসসুন্নাহ ভিত্তিতে রচিত হবে।

৩. রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার উপর সংস্থাপিত হবে।

৪. রাষ্ট্র মা‘রুফ প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুনকার উচ্ছেদ করবে।

৫. রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে।

৬. রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি দেবে।

৭. রাষ্ট্র শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবে।

৮. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।

৯. স্বীকৃত মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দ্বীনি স্বাধীনতা ভোগ করবে।

১০. অমুসলিম নাগরিকগণ আইনের আওতায় পার্সোনাল ল' সংরক্ষণ ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।

১১. রাষ্ট্র শারীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অমুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।

১২. রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ।

১৩. রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।

১৪. রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মাজলিসে শূরা থাকবে।

১৫. রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না।

১৬. সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে।

১৭. রাষ্ট্রপ্রধান তার কাজের জন্য মজলিসে শূরার নিকট দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না।

১৮. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে।

১৯. সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে।

২০. ইসলামবিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে।

২১. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে।

২২. আলকুরআন ও আসসুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।

এই নীতিমালা বিপুল সংখ্যায় লিফলেট আকারে ছাপিয়ে সারা দেশে ছড়ানো হয়। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে বহুসংখ্যক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। আবার জামায়াতের দাবির বিরুদ্ধেও কেউ কেউ অবস্থান নেন। মুসলিম লীগ নেতারা কৌশলী অবস্থান নেন। তারা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চান না। তবে তারা তা স্পষ্ট করেননি।

প্রকাশ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতারা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মাওলানা(!) আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও ছিল অন্যতম। তিনি তো পাকিস্তানকে সেক্যুলার হিসেবেও দেখতে চাইতেন না। তিনি মাওবাদী কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র বাস্তবায়ন হলে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করতেন।

আমরা প্রথম দুই পর্বে আলোচনা করেছি মওদূদী কে? আর মওদূদীবাদ কী? এই পর্বে খানিকটা আলোচনা করেছি মওদূদীবাদের প্রভাব। আগামী পর্বগুলোতে থাকলে এই অঞ্চলে কথিত মওদূদীবাদের ভূমিকা।

সাথে থাকুন। চলবে...।


মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব -০২


আগের পর্বে বলেছিলাম ইংরেজ আমলে অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কার মুসলিম সমাজে ছেয়ে গেছে। এই অবস্থার সুযোগ নেয় কিছু ধুরন্ধর মুসলিম নামের ধর্ম-ব্যবসায়ী। তারা স্থানে মাজার ও আখড়া স্থাপন করে। ইসলামকে তারা পীরের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা, পানি পড়া আর গানের তালে নেচে গেয়ে জিকির করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেললো।

ইংরেজরা ও স্থানীয় হিন্দুরা মুসলিমদের এই বিবর্তনকে স্বাগত জানায়। ধর্ম ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসাকে লাল করার করার জন্য নতুন নতুন বিদআত চালু করতে লাগলো। ইংরেজ ও মুশরিকরা বুঝতে পারে এই ইসলাম তাদের জন্য কল্যাণকর। এই ইসলাম দিয়ে তারা মূল ইসলামকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করছিল।

আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, শহীদ মাওলানা মীর নিসার আলী তিতুমীর ও হাজী শরিয়ত উল্লাহর আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মুসলিমদেরই একটা অংশ। তারাই মুশরিকদের আনুকূল্য পেতে ইংরেজদের কোর্টে মাওলানা তিতুমীর ও হাজী শরীয়ত উল্লাহর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করেছিলো। একই ঘটনা বাংলাদেশের কথিত মওদুদীবাদের ধারক নিজামী মুজাহিদদের বেলায়ও ঘটেছে। তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ম অবমাননার মামলা করে ফাঁসীতে দড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে মাজার পূজারী নামমাত্র মুসলিমেরা। মূলকাজ করেছে মুশরিক ও তাদের দোসররা, অপর্যাপ্ত মুসলিমরা তাদের হেল্প করেছে।

যাই হোক, আমরা মওদূদীবাদে ফিরে আসি। মওদূদী এই অবস্থা দেখে কলম ধরলেন। এটা ১৯৩২ সালের কথা। তাঁর বয়স তখন মাত্র ২৯ বছর। তিনি দেখলেন তাঁর বয়সী শিক্ষিত যুবকেরা ইসলামের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। নাচা-গানার সহিত জিকিরে আবৃত ইসলাম দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না, এটা তারা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিল। নাচা-গানার বাইরে আলিয়া ও কওমি ধারার মাদরাসা শিক্ষা প্রচলিত ছিল। যার মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে ইসলাম শেখা গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের স্বরূপ উদাঘাটিত হয় না।

মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সেক্যুলার শিক্ষা-ব্যবস্থারই আরেকটি রূপ। এই শিক্ষার ফলে মুসলিমরা বুঝতে পারে, দুনিয়া চালানো তাদের কাজ নয়, রাজনীতিতে অংশ নেওয়া তাদের কাজ নয়। দুনিয়া মানবরচিত আইনেই চলবে। এটা পরিবর্তন তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই শিক্ষিত মুসলিম যুবকেরা এমনকি মাদরাসা শিক্ষিতরাও পশ্চিমা পুঁজিবাদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছিলো। এর চাইতেও আগ্রাসীভাবে মুসলিম শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে পড়ে কম্যুনিজইম। মুসলিম যুবকেরা নাস্তিক ও কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছিল।

মুসলিমদের এই দুরাবস্থার মধ্যেই মওদূদী তাঁর চেষ্টা শুরু করেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। মওদূদী যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন সবাই বলতো অমুক পীরে এই বলেছেন, অমুক মুরুব্বি এই বলেছেন, অমুক আলেম এই বলেছেন আপনি নতুন কথা বললে হবে?

তখন মওদূদী বলেন, আমাদের সরাসরি কুরআন পড়তে হবে। সরাসরি হাদিস পড়তে হবে। আল্লাহর নির্দেশনা মানতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাড়া কাউকেই বিনা প্রশ্নে আনুগত্য করা যাবে না। অমুকের কথা যদি আল্লাহর রাসূলের সাথে ও আল্লাহর বিধানের সাথে না মিলে তাহলে তার কথা মানা যাবে না। এটাই ছিল মওদূদীবাদের মূল প্রিন্সিপ্যাল।

মওদূদী দেখেছেন, মুসলিমদের সামনে ইসলামের স্বরূপ উন্মোচিত নেই। একেক টাইপের মুসলিমদের কাছে ইসলাম একেকরকম। ইসলাম বলতে কী বুঝায় ও ইসলামের সঠিক তত্ত্ব সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য তিনি একটি বই লিখেন 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' নামে। বইটিতে তিনি ইসলামের স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পৃথিবীর সকল প্রধান ভাষাসহ প্রায় ২৩ টি ভাষায় বইটি অনুবাদ হয়।

বইটি সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে আফগানিস্তানে। ১৯৬০ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের মানুষ পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে কম্যুনিস্ট হতে শুরু করে। এই বইটি তাদেরকে কম্যুনিজম থেকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। আর এই বই নিয়ে আফগানিস্তান চষে বেড়িয়েছেন তৎকালীন কাবুল ভার্সিটির শিক্ষক ও পরবর্তিতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী।

বাংলায় 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' বইটি অনুবাদ হয় 'ইসলাম পরিচিতি' নামে। অনুবাদ করেন সৈয়দ আব্দুল মান্নান। আন্তর্জাতিক দায়ি বিলাল ফিলিপ্স বলেছেন তাঁর ইসলামের দিকে আসার জন্য দুইটি বই ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে একটি হলো রিসালায়ে দ্বীনিয়াত।

বইটিকে মাওলানা মওদূদী রহ. ৭ টি চ্যাপ্টারে ভাগ করেছেন।

১ম অধ্যায়ের নাম 'ইসলাম'
এই অধ্যায়ে মাওলানা কেন ইসলাম নাম দেওয়া হয়েছে, ইসলামের অর্থ, এর তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি কুফর কী? কুফরের তাৎপর্য কী? এই আলোচনা করেছেন। অধ্যায়ের শেষে কুফর তথা ইসলামকে অস্বীকার করার কুফল ও ইসলামের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

২য় অধ্যায়ের নাম 'ঈমান ও আনুগত্য'
এই অধ্যায়ে তিনি প্রথমে আনুগত্যের জন্য জ্ঞান ও প্রত্যয়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেছেন, মানুষ ততোক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য করতে পারে না, যতোক্ষণ না সে কতগুলো বিশেষ জ্ঞান লাভ করে এবং সে জ্ঞান প্রত্যয়ের সীমানায় পৌঁছে। সবার আগে মানুষের প্রয়োজন আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ প্রত্যয় লাভ। কেননা আল্লাহ আছেন, এ প্রত্যয় যদি তার না থাকলো, তা হলে কি করে সে তার প্রতি আনুগত্য পোষণ করবে?

এরপর তিনি ঈমানের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এর ভিত্তিতে মানুষকে চারভাগে ভাগ করেছেন। এরপর তিনি জ্ঞানর্জনের মাধ্যম তথা ওহি নিয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের শেষে তিনি ঈমান বিল গায়েবের আলোচনাও করেছেন।

৩য় অধ্যায়ের নাম নবুয়্যত
এখানে মাওলানা মওদূদী নবুয়্যত নিয়ে আলোচনা করেছেন। নবুয়্যতের মূলতত্ত্ব ও এর পরিচয় কথা বলেছেন। নবীর আনুগত্য ও তাদের ঈমানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি নবীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তাদের সাথে মানুষের বিভিন্ন আচরণেরও বর্ণনা দিয়েছেন। নবী হিসেবে মুহাম্মদ সা.-এর প্রমাণ ও নবুয়তের ভূমি হিসেবে আরবকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সবশেষে মুহাম্মদ সা. যে শেষ নবী সে বিষয়ে আলোচনা করেন।

৪র্থ অধ্যায়ের নাম 'ঈমানের বিবরণ'
এখানে মাওলানা মূলত কালেমা তাইয়েবার তাৎপর্য উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, এ কালেমা-ই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ-যা দিয়ে এক কাফের এক মুশরিক ও এক নাস্তিক থেকে মুসলিমের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। এ কালেমার স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি দ্বারা এক মানুষ ও অপর মানুষের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হয়। এ কালেমার অনুসারীরা পরিণত হয় এক জাতিতে এবং অমান্যকারীরা হয় তাদের থেকে স্বতন্ত্র জাতি। এর অনুসারীরা দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাতে পর্যন্ত উন্নতি, সাফল্য ও সম্মানের অধিকারী হয় এবং অমান্যকারীদের পরিণাম হচ্ছে ব্যর্থতা অপমান ও পতন। কালেমা তাইয়েবা সম্পর্কে একটি চমৎকার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। সাথে ঈমানের অন্যান্য বিষয় যেমন রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তাকদির ইত্যাদি নিয়েও আচোলনা করেছেন মাওলানা মওদূদী।

৫ম অধ্যায়ের নাম 'ইবাদত'
এখানে মাওলানা ইবাদতের হাকিকত ও গুরুত্ব উল্লেখ করেন। সেই সাথে সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব ও জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। জিহাদ ও জিহাদের পরিব্যপ্তি নিয়ে এখানে একটি সুন্দর আলোচনা রয়েছে।

৬ষ্ঠ অধ্যায়ের নাম 'দ্বীন ও শরিয়ত'
এখানে মাওলানা দারুণভাবে দ্বীন ও শরিয়তকে বুঝিয়েছেন। দ্বীন ও শরিয়তের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। শরীয়ত জানাত মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকাহ ও এর ডেবলেপমেন্ট নিয়ে কথা বলেছনে। সবশেষে তাসাউফ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকহ ও তাসাউফের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত করেছেন।

৭ম ও শেষ অধ্যায়ের নাম 'শরীয়াতের বিধি-বিধান'
এই অধ্যায়ে মাওলানা দারুণভাবে শরিয়তে সবার অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাওলানা বলেন, শরীয়াত হচ্ছে একটি চিরন্তন বিধান। এর কানুন সমূহ কোন বিশেষ কওম ও কোন বিশেষ যুগের প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর গড়ে ওঠেনি, বরং যে প্রকৃতির ভিত্তিতে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে, সেই প্রকৃতির নীতির বুনিয়াদেই গড়ে ওঠেছে এ শরীয়াত। এ স্বভাব-প্রকৃতি যখন সকল যুগে সকল অবস্থায় কায়েম রয়েছে, তখন এরই নীতির বুনিয়াদে গড়া আইনসমূহ ও সর্ব যুগে সর্ব অবস্থায় সমভাবে কায়েম থাকবে।

এই বইটি পড়লে ইসলামের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান অল্পতেই গোছানোভাবে জানা সম্ভব। ইসলাম কী? কেন? কীভাবে? ও কী চায়? সব জানা সহজ হয়ে যাবে। যারা এখনো পড়েননি বইটি পড়ে দেখুন। আপনার দিগন্ত উন্মোচন হয়ে যাবে। ইসলামের ব্যাপারে জোরালো আস্থা তৈরি হবে। একইসাথে মওদূদীবাদের মূল চিত্র আপনার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

চলবে...


১০ মার্চ, ২০২৪

মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব -০১


আবহাওয়াগত কারণে বাংলায় গরু ও মহিষ চাষ ভালো হয়। পানি বেষ্টিত এলাকায় এই পশুদের উৎপাদন ভালো। উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাংলায় আবহমানকাল থেকে এই পশুদের ব্যবহারও বেশি। হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা গরু ও মহিষকে অনেকভাবে কাজে লাগাতো। যেমন মানুষ পরিবহন, মালামাল পরিবহন, ছোট বড় শিল্প কারখানায় চাকতি ঘোরানো, হাল-চাষ ইত্যাদি।

খাদ্য হিসেবেও এই অঞ্চলের মানুষের গরুই বেশি পছন্দ। গরুর দুধ, দুধ থেকে ঘি, মাখন, মিস্টি ইত্যাদি তো আছেই। দেড় হাজার বছর আগে ইরান থেকে মুশরিক আর্যরা এসে এদেশ জবর দখল করলো। তারা তাদের অধিকৃত অঞ্চলে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ করে দিলো। তাদের সংস্কৃতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিলো। জাতের নাম দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করলো আর্য ব্রাহ্মণরা।

এই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে যারা তাদের এসব অনাচারের প্রতিবাদ করলো তাদের পিটিয়ে শহর ছাড়া করলো। তারা পালিয়ে গেলো পাহাড় পর্বতে। কেউ কেউ গেল সমুদ্র উপকূলে।

তাওহীদবাদী ও মুশরিকদের মধ্যেকার এই লড়াই চলতেই থাকলো। এদেশের কৃষ্টি কালচার লুকিয়ে পালন করতে হতো। হিন্দুস্থানের উত্তর অংশে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলিম শাসন শুরু হলেও বাংলায় মুসলিম শাসন চালু করা যায় নি। নদী বিধৌত অঞ্চলে মুসলিম সেনাবাহিনী ভালো করতে পারছিল না। অতচ তখন বাংলার একটি বড় অংশ মানুষ মুসলিম হয়ে নিজেদের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছিল।

বাংলার বৌদ্ধ ও মুসলিমদের আমন্ত্রণে মুক্তি দূত হয়ে আসলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। তার হাত ধরে আস্তে আস্তে এদেশে মুসলিম শাসন শুরু হয়। আমরা আবার আমাদের সংস্কৃতি, মুয়ামেলাত ফিরে পেতে শুরু করি।

১৭৫৭ সালে আবারো আমরা পরাজিত হই ইংরেজদের কাছে। আমাদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে ইংরেজদের সহায়তা করে এদেশের মুশরিকরা। ইংরেজ বিজয়ের পর তাই হিন্দুরাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এদেশের ইসলামপন্থীরা বার বার বিদ্রোহ করে। প্রায় ১০০ বছর বিদ্রোহ করেও আশানুরূপ ফল পায় নি ইসলামপন্থীরা।

একদিকে পরাজয়ের যন্ত্রণা, অন্যদিকে ইংরেজ-হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে মুসলিমরা শিক্ষা, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে হারিয়ে যেতে থাকে মুসলিম ঐতিহ্য। এমনই সময়ে জন্ম হয় মওদূদীর।

১৯১৮ সালে তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর তখন তিনি বিজনৌর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা 'মদিনা'য় কাজ শুরু করেন। অল্প বয়সেই সাহিত্য সাধনায় সিদ্ধহস্ত হয়েছিলেন।

কিছুদিন মদিনায় কাজ করার পর তিনি জীবিকা অন্বেষণে দিল্লিতে চলে যান। সেখানে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মনমতো দল পাচ্ছিলেন না যারা একইসাথে ব্রিটিশদের খেদাবে ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি “আনজুমানে এয়ানাতে নযরবন্দানে ইসলাম” নামে একটি ছোট দলের সন্ধান পান যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিলেন। তিনি এই দলের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

এরপর তিনি 'তাজ' পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ পান। এটি মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর থেকে প্রকাশিত হতো। তিনি জব্বলপুরে চলে আসেন। এসময় খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। জব্বলপুরের অভিজ্ঞতা ও খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী বলেন,

“সে সময় এখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে জনসভায় কিছু বলার কোনো লোক ছিল না। বাধ্য হয়ে আমাকেই এ কাজ করতে হয়। এতে আমার দু’টি বড়ো উপকার হয়েছিল। প্রথমটি এই যে, আমার মধ্যে বিরাট আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যা পূর্বে ছিল না। পূর্বে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে সাহস করতাম না। কিন্তু জব্বলপুরে যখন অপরের সাহায্য ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ একাকী এবং সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে সাংবাদিকতা ও জনসেবার কাজ শুরু করলাম, তখন অনুভব করলাম যে, আমার মধ্যে এমন কিছু শক্তি লুকায়িত আছে, যা প্রয়োজনের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে কোনো দায়িত্ব গ্রহণের কখনো দ্বিধাবোধ করিনি।

দ্বিতীয় উপকার এই যে, আমি আমার জীবনে একেবারে আত্মনির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। ইতোপূর্বে আমি কোন না কোন আত্মীয় বন্ধুর সাথে একত্রে বাস করতাম এবং অপরের উপর নির্ভর করার দুর্বলতা কিয়ৎ পরিমান হলেও আমার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু জব্বলপুরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে কাজ করতে পেরেছি।”

মাওলানা মওদূদী অল্প বয়সেই জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা ও অদম্য প্রেরণা সৃস্টি করার ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। তাঁর পূর্বাপর কথার মধ্যে ছিল পরিপূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। সে সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃক তুরস্কের প্রতি যে চরম অবিচার করা হয়েছিল, তিনি সেজন্যে ব্রিটিশের তীব্র সমালোচনা করে দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন। যার ফলে ‘তাজের’ প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। এর মাধ্যমে মাওলানা মওদূদীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।

খেলাফত আন্দোলনের সময়ে হিন্দুস্থানে হিজরত আন্দোলনও শুরু হয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯২০ সালে রাঁচী জেল থেকে মুক্তিলাভের পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন। তার অনুসারী কওমী আলেমগণ ফতোয়া দিতে শুরু করেন, 'ভারত দারুল হারব এবং এখান থেকে হিজরত করে কোন দারুল ইসলামে যেতে হবে'। অথচ তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে এতদিন মুসলিম লীগের বিরোধীতা করে আসছিলেন। জেলখানায় গিয়ে তার জাতীয়তাবাদ ছুটে যায়।

মওলানা আজাদের আহ্বানে বহু মুসলমান হিজরতের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। দিল্লীতে হিজরত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যথারীতি অফিস খোলা হলো। এই আন্দোলন যেহেতু মওলানা আজাদ আহ্বান করেছেন তাই আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মুসলিম প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলো, তারা তাদের সকল সহায় সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেশত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিলো। ১৯২০ সালের কেবলমাত্র আগস্ট মাসেই আঠারো হাজার মুসলিম হিজরত করে চলে যায়। এই মানুষগুলোর কোনো ব্যবস্থা হয় না আফগানে। তারা অবর্ণনীয় জিল্লতির শিকার হয়।

এদিকে প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান আফগানে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের ভিটেমাটি বিক্রয় করেছিলো। এ আন্দোলনের পেছনে ছিলো মূলত মওলানা আবুল কালাম আজাদের হুজুগ বা ঝোঁকপ্রবণতা। কোন একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এবং হিজরতের ফলাফল বিচার বিশ্লেষণ না করেই এ আন্দোলনে ঝাঁপ দেওয়া হয়েছিল।

হিজরত কমিটির সেক্রেটারি তাজাম্মল হোসেন ছিলেন মাওলানা মওদূদীর আত্মীয়। তিনি মাওলানাকে হিজরতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। মাওলানা হিজরত কমিটির সাথে আলোচনা করে দেখেন তাদের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। দলে দলে লোক আফগানিস্তানে চলে গেলেও আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে ছিলেন দায়িত্বশীল। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেখা করে একটি পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দেখিয়ে দেন।

তারা ত্রুটি স্বীকার করে মাওলানা মওদুদী সাহেবকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে অনুরোধ করেন। মওদূদী সাহেব বলেন সর্বপ্রথম আফগান সরকারের নিকটে শুনতে হবে যে তাঁরা হিন্দুস্তান থেকে হিজরতকারীদের পুনর্বাসনের জন্যে রাজী আছেন কিনা এবং পুনর্বাসের পন্থাই বা কি হবে। আফগান রাষ্ট্রদূতের সংগে আলাপ করা হলো। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বর্তমানে খুবই বিব্রত বোধ করছেন। যারা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে চলে গেছে তাদেরকে ফেরৎ পাঠাতে অবশ্য সরকার দ্বিধাবোধ করছেন। কিন্তু তথাপি তাদের বোঝা বহন করা সরকারের সাধ্যের অতীত’।

এরপর হিজরত কমিটি হতাশ হয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। আফগানিস্তানের আমীরও মুসলিমদের আফগানিস্তানে যাওয়া রুখতে বলেন। সবমিলিয়ে এই আন্দোলন চরমভাবে ব্যর্থ হয়। উদ্বাস্তু হয় পনের থেকে বিশ লক্ষ মুসলিম। তাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। তবে আন্দোলন আহ্বানকারী মাওলানা আজাদের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না। এরপর ১৯২৩ সালে তিনি কংগ্রসের সভাপতি হয়ে ভুলে যান মুসলিমদের অধিকার ও দুঃখ দুর্দশার কথা। তিনি থাকেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নিয়ে।

যাই হোক তাজ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে মাওলানা মওদূদী দিল্লীতে যান। সেখানে মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা আহমদ সাঈদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা জমিয়তের পক্ষ থেকে ‘মুসলিম’ নাম দিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং মাওলানা মওদূদীর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন মাওলানা। এখানে থাকাকালে মাওলানা জ্ঞানর্জনে মনোনিবেশ করেন। তিনি দিল্লীর দারুল উলুম ফতেহপুর অনেকগুলো বিষয়ে সনদ অর্জন করেন। ১৯২৩ সালে ইংরেজরা মুসলিম পত্রিকা বন্ধ করে দিলে ১৯২৪ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ 'আল জমিয়ত' নামে নতুন পত্রিকা শুরু করে। মাওলানা এই পত্রিকার সম্পাদনা করতে থাকেন।

১৯২৬ সালের শেষ ভাগে শুদ্ধি আন্দোলনের প্রবর্তক ও নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ এক মুসলমান আততায়ীর হাতে নিহত হয়। এর ফলে ভারতের হিন্দুসমাজ অতিমাত্রায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক অভিযান শুরু হয় হিন্দুদের পক্ষ থেকে। তারা প্রচার করেন যে, ইসলাম তার অনুসারীদের হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি মোহনদাস গান্ধী পর্যন্ত এই দাঙ্গা উস্কে দেয়। এক বিবৃতির মাধ্যমে সে জানায়, "অতীতে তরবারীর সাহায্যেই ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং বর্তমানকালেও তাই হচ্ছে"। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা ভারতের আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে এবং বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এ সমস্ত ভিত্তিহীন এবং উস্কানীমূলক প্রচারণা বন্ধ করতে গিয়ে অতীব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আহা! আজ যদি ভারতে এমন কোনো মর্দে মুজাহিদ আল্লাহর বান্দা থাকতো, যে তাদের এসব হীন প্রচারণার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পারতো, তাহলে কতই না ভাল হতো!”

তরুণ মাওলানা মওদূদী দিল্লী জামে মসজিদের উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে তিনি ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২৭ সালের প্রথম থেকেই তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। এটাই মাওলানা মওদূদীর প্রথম বই। এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ও বহু ভাষায় অনূদিত হয়।

আল্লামা ইকবাল এই বই সম্পর্কে বলেন, “জিহাদ, যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামী আইন-কানুন সম্বলিত এ বইটি অভিনব ও চমৎকার হয়েছে। প্রত্যেক জ্ঞানী ও সুধী ব্যক্তিকে গ্রন্থখানি পাঠ করতে অনুরোধ করি।”

১৯২৮ সাল থেকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে মাওলানা মওদূদীর মতবিরোধ তৈরি হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য মাওলানা মওদূদীর উত্থান দেওবন্দী বা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের হাত ধরেই। তাদের পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে তার লিখা সারা ভারতের মুসলিমদের কাছে পৌঁছে যায়।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিল দেওবন্দি আলেমদের সংগঠন। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে এই সংগঠন মুসলিম লীগের বিরোধীতা করতে থাকে ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন জাতীয় কংগ্রেসের সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিতে থাকে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ওপর মাওলানা আজাদের প্রভাব ছিল বলে এই ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। আলেমদের পত্রিকা 'আল জমিয়ত' হিন্দুদের সংগঠন কংগ্রেসের মুখপাত্রে পরিণত হতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে ১৯২৮ সালে তিনি আল জমিয়তের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।

এখান থেকেই শুরু হয় মাওলানার সাথে দেওবন্দী আলেমদের বিরোধ। হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসপন্থী আলেমরা মাওলানার নামে শত কুৎসা ও অপবাদ রটাতে থাকে। যার ধারাবাহিকতা আজো বিদ্যমান। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত মাওলানা আর কোনো পত্রিকার সাথে যুক্ত হননি। এর মধ্যে তিনি পড়াশোনায় রত ছিলেন। জ্ঞানর্জনের এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি আন্দোলন দাঁড় করাতে হবে। এর অংশ হিসেবে তিনি ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রকাশ করেন মাসিক “তর্জুমানুল কোরআন” নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বের ব্যাপারে মুসলিমদের সচেতন করে তুলেন।

এই পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা ইসলামের মর্মকথা পৌঁছে দেন বহু মানুষের কাছে। এর মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন আল্লামা ইকবাল। তার হাত ধরে এই মাওলানার এই আন্দোলন একটি শক্তিশালী নুসরাহ পায়।

চলবে ....

১৭ ফেব, ২০২৪

যেভাবে শিবির এলো দুনিয়ায় || পর্ব ২


প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষাটের দশকে ছাত্র ইসলামী আন্দোলন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। লোক সংগ্রহ, সংগঠন কায়েম, সংগঠনকে পরিচিতকরণ। ইত্যাদি কার্যক্রমেই বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়। ঐসময়ে যারা কাজ করছিলেন তারা ছাত্র সংগ্রহের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় বিরাহীনভাবে কাজ চালিয়ে যান। একজন দুইজন করে বাড়তে থাকে।

ষাটের দশকে মূলধারার রাজনীতির সাথে ছাত্র ইসলামী ছাত্র সংঘ তথা জমিয়তে তলাবার সম্পর্ক ছিল না। জমিয়তে তলাবা শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে একটি ইসলামী সমাজ গঠনের দিকে আহবান জানাতে থাকে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার মতো শক্তি হয়নি বিধায় তারা তখন সেদিকে শক্তি ব্যয় করেনি। তবে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন করার প্রায়াস ছিল।

ষাটের দশকে ছাত্র-রাজনীতি, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অবস্থা এখনকার মতো খারাপ ছিল না। অনেকটা গঠনমূলক বলা চলে। তারপরও ছাত্র-ইসলামী ছাত্রসংঘ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় নি। পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে বলা চলে। জামায়াতের নেতৃত্বে অন্যান্য ইসলামী দলের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার না হয়ে 'ইসলামিক রিপাবলিক' হয়। এর ফলে ইসলামী জমিয়তে তলাবার মূল আন্দোলন ছিল শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন।

ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা চালিয়েছে জমিয়তে তলাবা। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে আন্দোলনের জনশক্তির সচেতন করেছে। অপরদিকে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জনশক্তিকে জ্ঞানদান করা হয়েছে। ইসলামী জমিয়তে তলাবার এটাই ছিল বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা। এই ইস্যুতে ঢাকা ভার্সিটিতে প্রায়ই সভা ও সেমিনার করতো জমিয়তে তলাবা।

ষাটের দশকের পর্যায়টি ছিল সংগঠনের ভিত্তি গড়া, পরিচিতিকরণ ইত্যাদি প্রস্তুতিমূলক কাজ। যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র। শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হওয়া বা স্বীকৃতি লাভ করার পর্যায় তখন ছিল না। তাই প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো ছাত্র ইসলামী আন্দোলনকে বুঝে উঠতে পারেনি। যদিও কিছু কিছু বামপন্থী নেতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সার্বিকভাবে প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো ছাত্র ইসলামী আন্দোলনকে অনেকটা উপেক্ষা করেই চলছিল। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, ঠাট্টা, উপহাসের মধ্যে তাদের বিরোধিতা সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়েছে।

১৯৬৫ সালের পরে বর্তমান বাংলাদেশ ছিল আন্দোলনে উত্তাল। সেসময় ইসলামী ছাত্রসংঘকে তিনটি শক্তিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
১। স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের গুন্ডা সংগঠন এনএসএফ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গুন্ডামী করাই ছিল তাদের কাজ। এখন ছাত্রলীগ যেমন।
২। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এনএসএফের বিরোধীতার নামে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা ছিল তাদের কাজ। রাষ্ট্রীয় সংহতি নষ্ট করে বিভিন্ন ইস্যুতে দাঙ্গা লাগানো ছিল তাদের কাজ। গুন্ডামীতে তারাও পিছিয়ে ছিল না।
৩। নাস্তিক্যবাদী বাম সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মবিরোধীতা ছিল তাদের কাজ। ইসলামী জমিয়তে তলাবাকে তাদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করতে হয়েছে।

ছাত্র রাজনীতিতে এ সময় বামদের প্রাধান্য যথেষ্ট ছিল। গোটা পরিবেশটা ছিল প্রতিকূলের এবং ক্রমান্বয়ে তা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। এ পরিস্থিতিতে ইসলামী জমিয়তে তলাবাকে তার পথ রচনা করতে হচ্ছিল। যা ছিল পাহাড় অপসারণ করার মত এক দুরূহ কাজ। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনা সামনে রেখে অত্যন্ত ধৈর্যসহ ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের কাজ এগিয়ে চলছিল।

ঐ সময় আত্মগঠন, জনশক্তির মান উন্নয়নমূলক কাজকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হতো। বন্ধ সৃষ্টি, গ্রুপ ভিত্তিক দাওয়াতী কাজ, ব্যক্তিগত দাওয়াত, সামষ্টিক দাওয়াত, ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা, সাপ্তাহিক বৈঠক, মাসিক বৈঠক, সাংগঠনিক রিপোর্ট, সামষ্টিক পাঠ, পাঠচক্র, শববেদারী, শিক্ষা বৈঠক, শিক্ষাশিবির ইত্যাদি কাজগুলোকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হতো। ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, নামাজসহ ইবাদাত বন্দেগীর মান উন্নয়নে সবিশেষ নজর দেয়া হতো। সত্যিকার অর্থেই ইসলামী ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী চরিত্র গঠিত হচ্ছে কিনা তা গভীরভাবে মূল্যায়ন করা হতো। বক্তৃতার ভাষা, কবিতার ছন্দ, প্রবন্ধের বিষয় ও উপস্থাপনা ইসলামের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তার প্রতি খুবই নজর দেয়া হতো। কথা ও কাজের মিল না হলে যত বড় ব্যক্তিই হন না কেন দায়িত্ব দেয়া হতো না।

ইসলামী জমিয়তে তলাবার পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি যারা ছিলেন,

১. খাজা মাহবুব এলাহী, ১ম প্রাদেশিক সভাপতি (১৯৫৫-১৯৫৭)
২. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী (১৯৫৮-১৯৬০)
৩. হাবিবুর রহমান (১৯৬১-১৯৬২)
৪. এ বি এম নাজিম (১৯৬৩)
৫. এ কে এম নাজির আহমদ (১৯৬৪-১৯৬৫)
৬. গোলাম সারোয়ার (১৯৬৬-১৯৬৭)
৭. শহীদ মতিউর রহমান নিজামী (১৯৬৮)
৮. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম (১৯৬৯)
৯. শহীদ আলী আহসান মু. মুজাহিদ (১৯৭০-১৯৭২)
১০. আবু নাসের মু. আব্দুজ জাহের (১৯৭৩-১৯৭৬)

খাজা মাহবুবে এলাহীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী ছাত্র সংঘ কমিটি গঠন করতে থাকে। প্রায় দশ বছর পর একেএম নাজির আহমেদের সময় দেখা যায় জনশক্তির সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। দশ বছরে এটা ছিল বিস্ময়কর অগ্রগতি। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু কর্মী বৃদ্ধির দিক থেকে ১৯৬৫ সালে সমান সমান হয়ে যায়। এটা ছিল এখানকার আল্লাহর সাহায্য ও দা'য়ীদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফল।

ইসলামী ছাত্রসংঘের এই অঞ্চলের সভাপতি একেএম নাজির আহমদ দেখলেন প্রচুর রফিক (বর্তমান নাম সাথী) তৈরি হওয়ায় তাদের মান সংরক্ষন হচ্ছে না। তখন তিন হাজারের বেশি রফিক ছিল। এসব রফিকদের অনেকে ৩ বছরের অধিক সময় ধরে রফিক কিন্তু তারা রুকন (বর্তমান নাম সদস্য) হচ্ছে না।

তাই রফিকদের মানোন্নয়নের জন্য এক ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ইসলামী ছাত্রসংঘ বেশিরভাগ সাথীর সাথী পদ বাতিল করে। সকলকে একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় নির্দিষ্ট মানে পৌঁছার জন্য। ঐ সময়ের মধ্যে যারা মানে পৌঁছতে সক্ষম হন তাদেরকেই শুধু সাথী করা হয়। যার সংখ্যা চারশতের অধিক হবে না। অর্থাৎ এ পদক্ষেপের ফলে সাথী সংখ্যা কয়েক হাজারের কোটা থেকে কয়েক শতকে এসে দাঁড়ায়।

পূর্বের তুলনায় কম সংখ্যায় হলেও নতুন সাথীদের মান উন্নত হওয়ার কারণে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। সকলেই মানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। নিজ নিজ মান বৃদ্ধিতে যত্নবান হয়ে ওঠেন। ফলে ছাত্র মহলে ইসলামী ছাত্র সংঘের চারিত্রিক প্রভাব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর আন্দোলনের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে যায়।

পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘ কাজ করে যাচ্ছিল। এটা অনেকেই বিশেষ করে বামপন্থী সংগঠনগুলো বরদাশত করতে পারছিল না। যারা এই বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও জনমত গঠন করছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বগুড়ার মানুষ ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা শহরের নেতা আব্দুল মালেক। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে ক্ষুরধার বক্তব্য রাখেন তিনি। এরপরেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বামপন্থীদের হামলায় তিনি শাহদাতবরণ করেন। এটি ছিল ইসলামী জমিয়তে তলাবার ১ম শাহদাত। পশ্চিম ও পূর্ব মিলে এর আগে কোথাও শাহদাতের ঘটনা ঘটে নি।

১৯৭১ সালের গণ্ডগোলের সময় সভাপতি ছিলেন শহীদ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার জেরে গণহত্যার মুখোমুখি হয় এদেশের ইসলামপন্থী সমাজ। বহু আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসা শিক্ষক মুক্তি নামের ভারতপন্থীদের হাতে খুন হতে থাকে। এর ব্যতিক্রম হয় না জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ব্যাপারেও। হাজারো নেতা-কর্মী গণহত্যার মুখোমুখি হয়।

১৯৭২ সালে ছাত্রসংঘের যারা বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছেন তারা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। একটা বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যান। কেউ কেউ এলাকা থেকে পালিয়ে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। ইতিহাসের এই কঠিন সন্ধিক্ষণে প্রথমে ঢাকায় কয়েকজন মিলিত হয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পরে ঢাকার বাইরে খুলনায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছোট্ট অথচ যুগান্তকারী এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় খুলনার বয়রায় জনাব সিদ্দিক জামালের বাসায়। দুই রাত ও ১ দিনের এ মিটিং চলে।

যেখানে উপস্থিত ছিলেন:
১. আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
২. আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের
৩. মীর কাসেম আলী
৪. মরহুম মাওলানা সামছুল হক
৫. মাসুদ আলী
৬. সরদার আবদুস সালাম

এ মিটিংয়ের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক বিপদসংকুল, দুস্তর, দুঃসাধ্য পথের যাত্রা শুরু হয়। উক্ত বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :

১. সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সকল শক্তি নিয়োজিত করা।
২. উক্ত উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী-ইসলামীমনা সাহসী যুবকদেরকে সচেতন করা, সক্রিয় করা।
৩. আমাদের এ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে ঐক্যমত পোষণকারী ছাত্রের অন্বেষণ এবং আগ্রহ প্রদর্শনকারী ছাত্রদেরকে নৈতিক ও আত্মিক জ্ঞান ও কর্মে গড়ে তোলা।
৪. সময়, সুযোগ, পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সম্ভাব্য সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানো।
৫. আমাদের তামাম তৎপরতা হবে গঠনমূলক, নিয়মতান্ত্রিক আইনানুগ, কোন হটকারি আবেগ তাড়িত পথে পা বাড়ানো হবে না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

জাতিগঠনের এ তৎপরতাকে একটি সংবিধিবদ্ধ আঙ্গিকে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জনাব অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ সাহেবকে সভাপতি করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা।

মীরপুরের পল্লবীতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত বৈঠকের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল সারাদেশব্যাপী একটি চিহ্নিত মহলের দ্বীন ও দেশ বিরোধী বিষাক্ত তৎপরতার মোকাবেলায় সাধারণ ছাত্রদেরকে ইসলামী জীবন বিধানের আলোকে গড়ে তোলার স্বার্থে একটি দাওয়াতী সংগঠন গড়ে তোলা। এর নাম দেওয়া হয় 'ছাত্র ইসলামী মিশন'। ইতিহাস সাক্ষী, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংগঠন বিপুলভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। উক্ত সংগঠনের সভাপতি ছিলেন জনাব মাওলানা আবু তাহের।

১৯৭৫ সাল। এটি আর একটি ঐতিহাসিক বছর। এ বছর ঢাকায় যুবকদের জন্যে Youngman Muslim Association গঠন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই এই Association ঢাকার যুবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। একই বছর একটি পরিপূর্ণ প্রকাশ্য ইসলামী ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি সুবিন্যস্ত প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। সারা বছর ধরে এ প্রকল্পের কাজ চলতে থাকে। এভাবে '৭৫ সাল অতিবাহিত হয়। ইতিমধ্যে জমিন সিক্ত হতে থাকে। আমরা এর উর্বরতা লক্ষ্য করতে থাকি। বাংলাদেশের সর্বত্র একটি প্রকাশ্য ছাত্র আন্দোলন পাওয়ার আকাংখা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার পথে বাধা- বিপত্তি, জটিলতা, সমস্যা-সম্ভাবনা সবকিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বরের ইসলামপন্থী দায়িত্বশীল ছাত্রদের একটি কনভেনশন ডাকার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭৬ আমন্ত্রণপ্রাপ্ত ২২১ জন ছাত্র প্রতিনিধি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যোগদান করেন। সারাদেশে তৎপরতার রিপোর্ট পেশ এবং একটি প্রকাশ্য নতুন ছাত্র সংগঠন গঠনের লক্ষ্যে ১০০ ভাগ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, তখনকার দায়িত্বশীলগণ নতুনভাবে সংগঠনকে কীভাবে চালু করবেন তা নিয়ে অনেকগুলো পাইলট প্রকল্প চালিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল 'ছাত্র ইসলামী মিশন' ও 'ইয়ংম্যান মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন'। পাইলটিং শেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন তারা আগের মতোই একটি সংগঠন নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে চালু করবেন।

কুমিল্লার ছোটরায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন এদেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সারাদেশের দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছানো তাদের মতামত নেওয়ার জন্য একটি সম্মেলনের প্রয়োজন হয়। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বিয়ের অনুষ্ঠানে যারা মেহমান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, তারা এসেছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শহর ও মহকুমা থেকে। এরা সবাই ইসলামী ছাত্র সংঘের দায়িত্বশীল পর্যায়ের জনশক্তি ছিলেন। বিয়েটা ছিল তৎকালীন ছাত্রসংঘের সভাপতি আনম আব্দুজ জাহের সাহেবের। বিবাহোত্তর পরবর্তী দিনে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বিয়ের অনুষ্ঠানের মোড়কে। যা পরিচালনা করেন জনাব মীর কাসেম আলী। এই সম্মেলনেই নতুন সংগঠনের যে চিন্তা ছিল তা অনুমোদিত হয়।

সর্বাধিকসংখ্যক প্রতিনিধির মতামত অনুযায়ী এ নতুন ছাত্র সংগঠনের নাম "ইসলামী ছাত্রশিবির" হিসাবে চূড়ান্ত হয়। একই সময়ে পরবর্তী নেতৃত্ব নির্ধারণের জন্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অধ্যাপক নাজির আহমদ সাহেব নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর এই সংগঠনের সভাপতি হিসাবে জনাব মীর কাসেম আলীর নাম ঘোষণা করেন। জনাব মু. আবদুল বারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন।

এদিকের কর্মকান্ড চূড়ান্ত হওয়ার পর পাবলিক ঘোষণার আগে দায়িত্বশীলরা মাওলানা মওদূদীর অনুমোদন নিতে চাইলেন। তিনি সকল কর্মকান্ডে সায় দিলেন এবং ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অকুতোভয় যুবকদের প্রশংসা করলেন।

১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিলুপ্ত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। নতুন সংগঠনে ইসলামী ছাত্রসংঘের জনশক্তিতে যোগ দিতে আহবান করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের মিম্বারের পাশে বসেই আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।

দুনিয়ায় আসলো বাংলার প্রভাব সৃষ্টিকারী আলোর কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। মুশরিকদের ঘেরাও-এর মধ্যে অবরুদ্ধ হয়েও সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এক দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে ছাত্রশিবির। শুরু থেকেই শিবির জানে তারা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। লক্ষ ত্যাগের নমুনা পেশ করেছে শিবির, জীবন দিয়েছে এখন পর্যন্ত ২৩৪ জন।

৭ ফেব, ২০২৪

যেভাবে ছাত্রশিবির এলো দুনিয়ায় || ১ম পর্ব



১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ৭৫ জন নিয়ে জামায়াত যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন একজনমাত্র বাঙালি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নাম মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। তিনি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা ছিলেন। মাওলানা ৭৫ জনের মধ্যে ১৬ জনকে নিয়ে মজলিসে শুরা গঠন করেছিলেন সেই মজলিশে শুরাতেও ছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। সেই হিসেবে ১ম বাঙালি রুকন ও ১ম বাঙালি শুরা সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তিনি দুই বছরের মধ্যে জামায়াত ত্যাগ করেন।

১৯৪৬ সালে জামায়াতের সম্মেলনে যোগ দেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি কলকাতা থেকে সেখানে গিয়েছেন। তখন তার বয়স ২৮ বছর। তিনি মাওলানার সাথে দেখা করেন ও রুকন শপথ নেন। সেই হিসেবে ২য় বাঙালি রুকন হলেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ গ্রামে অর্থাৎ পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার শিয়ালকাঠি গ্রামে দাওয়াতী কাজ করেন। সেখানে তিনি ১০-১২ জন যুবককে ইকামাতে দ্বীনের কাজের জন্য রাজি করান। এদেরকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলার ১ম ইউনিট। ইউনিট সভাপতি ছিলেন মাওলানা লেহাজ উদ্দিন।

মাওলানা আব্দুর রহীম নাজিরপুরে একটি মাদ্রাসার হেড মাওলানা পদে চাকুরি শুরু করেন। এই মাদ্রাসাতেও আরেকটি ইউনিট তিনি গঠন করেন। এখানে স্থানীয় অতুল চন্দ্র ও ভবানীসেন নামে দুই বাম কমরেডের সাথে প্রায়ই মাওলানা আব্দুর রহীমের বিতর্ক হতো। সেই সূত্রে তিনি ইসলাম, কমিউনিজম ও অর্থনীতি নিয়ে 'ইসলামে অর্থনীতি' নামে একটি বই লিখে ফেলেন।

১৯৪৮ সালেও ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়নি। ততক্ষণে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে। ইংরেজমুক্ত হয়েছে উপমহাদেশ। ঢাকায় কাজ নিয়ে কেন্দ্র বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেভাবে সফল হওয়া যায়নি। ১৯৪৮ সালে খুরশিদ আহমদ বাট নামে একজন সরকারি কর্মকর্তা করাচি থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছিলেন। তিনি রুকন ছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন যাতে ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়। এজন্য তিনি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। কেন্দ্র তাকে মাওলানা আব্দুর রহীমের ঠিকানা দেন।

খুরশিদ আহমদ বাট ঢাকায় এসে চাকুরিতে জয়েন করেন। তিনি মাওলানা আব্দুর রহীমকে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। জবাবে মাওলানা আব্দুর রহীম জানান, ঢাকায় শুধু থাকার একটি জায়গা দিতে পারলে তিনি নির্দ্বিধায় চলে আসবেন। খুরশিদ আহমদ বাট একটি প্রশস্ত রুম ভাড়া করেন আব্দুর রহীম সাহেবের জন্য। এপ্রিলেই আব্দুর রহীম সাহেব ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা দুইজন ঢাকার কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে মাওলানা মওদূদী রহ. ঢাকায় কাজ করার জন্য বাগ্মী ও বিখ্যাত দায়ি রফি আহমদ ইন্দোরিকে ঢাকায় প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানের একজন শিক্ষক ছিলেন মাওলানা কারি জলিল আশরাফ নদভী। রফি আহমদ ইন্দোরীর নেতৃত্বে ঢাকায় এখন রুকন চারজন।
১. রফি আহমদ ইন্দোরি
২. কারি জলিল আশরাফ নদভী
৩. খুরশিদ আহমদ বাট
৪. মাওলানা আব্দুর রহীম

এর মধ্যে শুধু আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল অবাঙালী। ঢাকায় কাজের সম্প্রসারণ বেশি হয় মুহাজিরদের মধ্যে। লালবাগ, নবাবপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে মুহাজিরদের মধ্যে জামায়াতের কাজ দ্রুত বাড়তে থাকে।

এরমধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম দাওয়াতী কাজে ভীষণ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তাকে সামনে রেখেই রফি আহমদ ইন্দোরি ঢাকাকে জামায়াতের শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে আব্দুর রহীম সাহেবকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হয়। তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় এবং জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হন। মাওলানা মওদূদী তাঁকে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কাজ দেন। এভাবে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তিনি পূর্ণ মনোযোগের সাথে ঢাকার সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন।

অবশেষে কাজের বিস্তৃতি মোটামুটি হলে মাওলানা মনজুর আহমেদ জামেয়ীর নেতৃত্বে ঢাকা শহরের ইমারত গঠিত হয়। তিনি হন ঢাকার প্রথম আমীর। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠায় যাদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে পূর্বে বর্ণিত চার জন, মনজুর আহমেদ জামেয়ী ছাড়াও আরো রয়েছেন,

১. সাইয়্যেদ হাফিজুর রহমান, হেড মাস্টার, রহমতুল্লাহ মডেল হাই স্কুল
২. খাজা মাহবুব এলাহী, প্রথম সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৩. শেখ আমিনুদ্দিন, (বিহার থেকে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন)
৪. মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী, সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৫. মাওলানা আব্দুস সুবহান, সাবেক এমপি, পাবনা।
৬. ব্যারিস্টার কোরবান আলী।

এদিকে দেখা গেল, জামায়াতের ছাত্র ও যুবকদের কাজের গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না মুরুব্বি ও বয়স্করা। তখন জামায়াতে ইসলামী ছাত্রদের জন্য আলাদা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তার সূত্র ধরে ছাত্রদের জন্য নতুন সংগঠন অনুমোদন করে জামায়াতে ইসলামী। এই সংগঠনের নাম রাখা হয় ইসলামী জমিয়তে তালাবা (ইসলামী ছাত্রসংঘ)। ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর লাহোরে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ইসলামী জমিয়তে তালাবার ১ম কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন জাফরুল্লাহ খান।   

ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ :
১. ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে তাদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা 
২. যেসব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা।
৩. এই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তোলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী হিসাবে গড়ার কার্যকরী ব্যবস্থা করা 
৪. আদর্শ নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের দাবিতে সংগ্রাম।
৫. ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান।

১৯৫৫ সালে খাজা মাহবুবে এলাহীর নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের কার্যক্রম শুরু হয়। খাজা মাহবুবে এলাহীরা ছিলেন মূলত পাঞ্জাবের ঝিলাম জেলার অধিবাসী। ওনার নানা মোহাম্মদ আমিন ছিলেন পাঞ্জাবের ধনী ব্যক্তি। পাকিস্তান স্বাধীন হলে এদেশের রাজনীতিবিদেরা সারা পাকিস্তানের ধনীদের এদেশে এসে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য আহবান করেন। 

যেহেতু এই এলাকায় পাট বেশি হতো তাই পাটকলের চাহিদা পূর্ব পাকিস্তানে বেশি ছিল। পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারও বাংলা যাতে শিল্পোন্নত হয়, সেজন্য ব্যবসায়ীদের এখানে আহবান জানান ও শিল্প-কারখানা গড়ার জন্য তাদের নানাবিধ সুবিধা প্রদান করেন। সেই প্রেক্ষিতে খাজা মাহবুব এলাহীর নানা মোহাম্মদ আমীন ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তিনি চট্টগ্রামের ষোলশহরে আমিন জুট মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। পরে ১৯৭২ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার / শেখ মুজিবের সরকার আমিন জুট মিলসসহ মোহাম্মদ আমীনের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে।    

নানার সূত্র ধরে খাজা মাহবুব এলাহীও এদেশে আসেন। খাজা মাহবুবে এলাহী ইসলামী ছাত্র সংঘের তলাবার প্রতিষ্ঠাকালীন রুকন/ সদস্য ছিলেন। তার নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র সমাজের কাজে ইসলামের দাওয়াত ও ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছতে শুরু করে। বাংলায় ছাত্রদের একটি অংশ ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হলে ১৯৫৫ সালে খাজা মাহবুবে এলাহীর নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী ছাত্রসংঘের যাত্রা শুরু হয়। 

চলবে...


১৪ জানু, ২০২৪

শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার দোয়া


ফিলিস্তিনে মূসা আ.-এর মৃত্যুর পরে কিছুদিন পর্যন্ত বনী ইসরাঈল সত্যের উপরেই ছিল। অতঃপর তারা শিরক ও বিদআতের মধ্যে নিমজ্জিত হযলো। আল্লাহ তায়াল ক্রমাগত তাদের মাঝে নবী পাঠান। কিন্তু যখন তাদের অন্যায় কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের শত্রুদেরকে তাদের উপর জয়যুক্ত করে দেন। তাদের শত্রুরা অর্থাৎ আমালিকরা তাদের বহু লোককে হত্যা করলো, বহু বন্দী করলো এবং তাদের বহু শহর দখল করে নিলো। 

সামুয়েল নবী তখন ছিলেন বনী ইসলাঈলের শাসক। কিন্তু তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাই ইসরাঈলী সরদাররা অন্য কোন ব্যক্তিকে নিজেদের নেতা বানিয়ে তার অধীনে যুদ্ধ করার প্রয়োজন অনুভব করছিল। কিন্তু তখন বনী ইসরাঈলদের মধ্যে অজ্ঞতা এত বেশী বিস্তার লাভ করেছিল এবং তারা অমুসলিম জাতিদের নিয়ম, আচার-আচরণে এত বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল যে, খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্যবোধ তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা একজন খলীফা নির্বাচনের নয় বরং বাদশাহ নিযুক্তির আবেদন করেছিল। 

এই ঘটনা বাইবেলে এভাবে বর্ণিত আছে, //সামুয়েল সারা জীবন ইসরাঈলীদের মধ্যে সুবিচার করতে থাকেন। আমালিকদের হামলার পর সব ইসরাঈলী নেতা একত্র হয়ে রামা'তে সামুয়েলের কাছে আসে। তারা তাঁকে বলতে থাকে, দেখো, তুমি বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছো এবং তোমার ছেলে তোমার পথে চলছে না। এখন তুমি কাউকে আমাদের বাদশাহ নিযুক্ত করে দাও, যে অন্য জাতিদের মতো আমাদের প্রতি সুবিচার করবে। 

একথা সামুয়েলের খারাপ লাগে। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তায়ালা সামুয়েলকে বলেন, এই লোকেরা তোমাকে যা কিছু বলছে, তুমি তা মেনে নাও কেননা তারা তোমার নয়, আমারই অবমাননা করেছে। আমার বাদশাহীকে তারা মানতে চায় না। 

সামুয়েল তাদেরকে (যারা তাঁর কাছে বাদশাহ নিযুক্তির দাবী নিয়ে আসেছিল) বললেন, 
যদি বাদশাহ নিযুক্ত হয়, তবে সে তোমাদের ওপর রাজত্ব করবে। তার নীতি এই হবে যে, সে তোমাদের পুত্রদের নিয়ে যাবে। তার রথ ও বাহিনীতে চাকর নিযুক্ত করবে এবং তারা তার রথের আগে আগে দৌঁড়াতে থাকবে। সে তাদেরকে সহস্রজনের ওপর সরদার ও পঞ্চাশ জনের ওপর জমাদার নিযুক্ত করবে এবং কাউকে কাউকে হালের সাথে জুতে দেবে, কাউকে দিয়ে ফসল কাটাবে এবং নিজের জন্য যুদ্ধাস্ত্র ও রথের সরঞ্জাম তৈরী করাবে। আর তোমাদের কন্যাদেরকে পাচিকা বানাবে। 

তোমাদের ভালো ভালো শস্যক্ষেত্র, আংগুর ক্ষেত ও জিতবৃক্ষের বাগান নিয়ে নিজের সেবকদের দান করবে এবং তোমাদের শস্যক্ষেত ও আংগুর ক্ষেতের এক দশমাংশ নিয়ে নিজের সেনাদল ও সেবকদের দান করে দেবে। তোমাদের চাকর-বাকর, ক্রীতদাসী, সুশ্রী যুবকবৃন্দ ও গাধাগুলোকে নিজের কাজে লাগাবে এবং তোমাদের ছাগল-ভেড়াগুলোর এক দশমাংশ নেবে। সুতরাং তোমরা তার দাসে পরিণত হবে। 

সেদিন তোমাদের এই বাদশাহ, যাকে তোমরা নিজেদের জন্য নির্বাচিত করবে তার কারণে তোমরা ফরিয়াদ করবে কিন্তু সেদিন আল্লাহ তোমাদের কোনো জবাব দেবেন না। তবুও লোকেরা সামুয়েলের কথা শোনেনি। তারা বলতে থাকে, না আমরা বাদশাহ চাই, যে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। তাহলে আমরাও অন্য জাতিদের মতো হবো। আমাদের বাদশাহ আমাদের মধ্যে সুবিচার করবে, আমাদের আগে আগে চলবে এবং আমাদের জন্য যুদ্ধ করবে।// 

সামুয়েল আ. তাদেরকে আরেকটি বিষয়ে সাবধান করেছিলেন যে, যদি বাদশাহ তাদের জিহাদ করতে বলে তবে কি তারা জিহাদ থেকে পালিয়ে যাবে? মূলত বনী ইসরাইলের বেশিরভাগ লোক যুদ্ধ না করেই আমালিকদের (আমুন মুর্তির পূজারী) হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। ওরা ভেবেছিল একজন বাদশাহ তাদের ওপর নিযুক্ত করলে সে তার সৈন্যবাহিনী দিয়ে তাদের উদ্ধার করবে। 

নবী সামুয়েলের প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেছিল, আমাদের সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং আমাদের সন্তানাদিকে বন্দী করা হয়েছে। আমরা কি এতই কাপুরুষ যে তবুও আমরা মৃত্যুর ভয়ে জিহাদ হতে মুখ ফিরিয়ে নেবো? তখন জিহাদ ফরয করে দেওয়া হলো এবং তাদেরকে  বাদশাহর সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করতে বলা হলো। 

আল্লাহর নবীকে রেখে তারা অন্য কাউকে নেতা হিসেবে চাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাদের পরীক্ষাকে আরো কঠিন করে দেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে নবী সামুয়েল আ. একজন সাধারণ সৈনিক অথচ ঈমানদারকে (তালুত)তাদের সামনে বাদশাহরূপে পেশ করলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন না বরং একজন সৈনিক ছিলেন। ইয়াহূদার সন্তানেরা ছিল সম্ভ্রান্ত লোক এবং তালুত এদের মধ্যে ছিলেন না। তাই ইহুদীরা প্রতিবাদ করে বললো যে, তার অপেক্ষা তারাই রাজত্বের দাবীদার বেশী। দ্বিতীয় কথা এই যে, তিনি দরিদ্র ব্যক্তি। তাঁর কোন ধন-মাল নেই। 

নবীর আদেশের সামনে তাদের এই প্রতিবাদ ছিল প্রথম বিরোধিতা। নবী আঃ উত্তর দিলেন, এই নির্বাচন আমার পক্ষ হতে হয়নি যে, আমি পুনর্বিবেচনা করবো। বরং এটা তো স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ। সুতরাং এই নির্দেশ পালন করা অবশ্য কর্তব্য। তাছাড়া এটাতো প্রকাশমান যে, তিনি তোমাদের মধ্যে একজন বড় আলেম, তার দেহ সুঠাম ও সবল, তিনি একজন বীর পুরুষ এবং যুদ্ধ বিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা রয়েছে।

সামুয়েল আ. আরো বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই হচ্ছেন মহাবিজ্ঞ এবং সাম্রাজ্যের প্রকৃত অধিকর্তা তিনিই। সুতরাং তিনি যাকে ইচ্ছে করেন তাকেই রাজত্ব প্রদান করে থাকেন। তিনি হচ্ছেন সর্বজ্ঞাতা ও মহাবিজ্ঞানময়। কার এই ক্ষমতা রয়েছে যে, তার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করে! তিনি যাকে চান নিজের নিয়ামত দ্বারা নির্দিষ্ট করে থাকেন, তিনি মহাজ্ঞানী। সুতরাং কে কোন জিনিসের যোগ্য এবং কোন জিনিসের অযোগ্য এটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন।

নবী আ. তাদেরকে বলেন- 'তালূতের রাজত্বের প্রথম বরকতের নিদর্শন এই যে, সেই সিন্ধুকটি তোমরা ফিরিয়ে পাবে, যার মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী। যার ভিতরে রয়েছে পদমর্যাদা, সম্মান, মহিমা, স্নেহ, ও করুণা। তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নিদর্শনাবলী যা তোমরা ভালভাবেই জান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই হারানো সিন্ধুক নব নিযুক্ত বাদশাহ তালুতের কাছে চলে এলো। এতে বনী ইসরাঈলের লোকেরা তালুতের আনুগত্য মেনে নিলো। 

 যখন লোকেরা তালূতকে বাদশাহ বলে মেনে নিলো তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে যুদ্ধে বের হলেন। তালূত তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। হযরত ইবনে আব্বাসের রাঃ উক্তি অনুসারে এই নদীটি উরদুন ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত ছিল। ঐ নদীটির নাম ছিল 'নাহরুশ শারীআহ। তালুত তাদেরকে সতর্ক করে দেন যে, কেউ যেন ঐ নদীর পানি পান না করে। যারা পান করবে তারা যেন আমার সাথে না যায়। এক আধ চুমুক যদি কেউ পান করে নেয় তবে কোন দোষ নেই। কিন্তু তথায় পৌঁছে গিয়ে তারা অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। কাজেই তারা পেট পুরে পানি পান করে নেয়। কিন্তু অল্প কয়েকজন অত্যন্ত পাকা ঈমানদার লোক ছিলেন। তাঁরা এক চুমুক ব্যতীত পান করলেন না।

হযরত ইবনে আব্বাসের রা. উক্তি অনুযায়ী ঐ এক চুমুকেই ঈমানদারদের পিপাসা মিটে যায় এবং তারা জিহাদেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যারা পূর্ণভাবে পান করেছিল তাদের পিপাসাও নিবৃত্ত হয়নি এবং তারা জিহাদের উপযুক্ত বলেও গণ্য হয়নি। যারা নদীর পরীক্ষায় পাশ করেছে তালুত তাদের নিয়ে নদী পার হলেন এবং মূর্তি পূজারীদের নেতা জালুতের মুখোমুখি হলেন। 

জালুতের বীরত্বের কথা ও তার বিশাল সেনাবাহিনীর কথা জেনে বনী ইসরাঈলের লোকেরা আবারো ভীত হয়ে পড়লো। তারা যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা কাপুরুষতার সাথে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বসলো। শত্রু সৈন্যদের সংখ্যা বেশী শুনে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সুতরাং তারা স্পষ্টভাবে বলে ফেললো, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।'  

তাদের মধ্যে যারা আলেম ছিলেন তারা তাদেরকে বহুরকম করে বুঝিয়ে বললেন, বিজয় লাভ সৈন্যদের আধিক্যের উপর নির্ভর করে না। ধৈর্যশীলদের উপর আল্লাহ তা'আলার সাহায্য এসে থাকে। বহুবার এরূপ ঘটেছে যে, মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকে বিরাট দলকে পরাজিত করেছে। সুতরাং তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহ তা'আলার অঙ্গীকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ কর। এই ধৈর্যের বিনিময়ে আল্লাহ তোমাদের সহায় হবেন। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও তাদের মৃত অন্তরে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো না এবং তাদের ভীরুতা দূর হলো না।

মূলত আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে প্রার্থক্য স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। বস্তুত দেখা গেল যারা বাদশাহ চেয়েছিল তারা কেউ আর জিহাদে নেই। এমন আশংকা নবী সামুয়েল আ. আগেই করেছিলেন। যাই হোক অতঃপর সেনাপ্রধান তালুত অল্প কিছু ঈমানদারকে সাথে নিয়ে জালুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। যুদ্ধের প্রাক্কালে তালুত ও ঈমানদারগণ একটি দোয়া করলেন। এই দু'আ আল্লাহ তায়ালা খুব পছন্দ করলেন। মূলত এই দু'আর প্রেক্ষাপট লেখার জন্যই এই ইতিহাস বর্ণনা করলাম। 

তালুত ও তার অনুসারী হাত তুলে কায়মনোবাক্যে বললেন, رَبَّنَآ اَفۡرِغۡ عَلَيۡنَا صَبۡرًا وَّثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَانصُرۡنَا عَلَى الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِيۡنَ﴿٢٥٠﴾
রব্বানা আফরিঘ আলাইনা সাব-রান ওয়া থাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা আলাল-কাউমিল-কাফিরিন
অর্থ: "হে আল্লাহ! আমাদের ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে দাও, এবং আমাদেরকে অবিচল রাখো এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিজয় দান করো।" [সূরা আল-বাক্বারাহ:২৫০]

দোয়া করা শেষে তালুত বনী ইসরাঈলের মধ্যে একজন সাহসী সামনে আসতে বললেন যিনি আক্রমণের অগ্রভাগে থাকবেন। দাউদ আ. এ সময় ছিলেন একজন কম বয়সী যুবক। তিনি তালুতের আহবানে সামনে এলেন। মুশরিকদের বাদশাহ জালুত দ্বন্দ্বযুদ্ধে একজন আহবান করলো। দাউদ আ. নির্ভয়ে জালুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং জালুতকে হত্যা করলেন। এই ঘটনায় মুশরিক বাহিনীর মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে তাদের বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়।  

এ ঘটনায় দাউদ আ. হয়ে উঠলেন ইসরাঈলীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তালুত নিজের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবুয়্যত দান করলেন। অবশেষে তিনিই হলেন ইসরাঈলীদের শাসক।

এই ঘটনায় আমরা যে শিক্ষা পাই, 
১. মুশরিকদের সাময়িক জয়ে আমরা যেন ধৈর্যহারা না হয়ে পড়ি। 
২. আল্লাহ তায়ালা ও নবী সা.-এর সিদ্ধান্তের বাইরে বাদশাহ হওয়া ও বাদশাহীর অনুসরণ যেন না কামনা করি।
৩. যুদ্ধ জয়ের জন্য মুসলিমদের বেশি লোকের প্রয়োজন নেই। দরকার অবিচল ঈমান।
৪. দলে মুনাফিক থাকলে যুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন। তাই মুনাফিক ছাঁটাই জরুরি। 
৫. বিজয় আল্লাহর সাহায্যে হবে, তাই জয়ী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে হবে।

#রব্বানা

দুনিয়া ও আখিরাত প্রাপ্তির দু'আ

ইবরাহীম আ. যখন হজ্ব চালু করলেন তখন সেই সময়ের একটি পদ্ধতিতে হজ্ব পালন করা হতো। যত দিন গেল তত বিকৃতি প্রবেশ করতে থাকলো। একটা সময়ে ইসলাম বিরুদ্ধ পদ্ধতি চালু হয়ে গেল হজ্বের রীতিনীতিতে। তাই আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে জানানোর মাধ্যমে আমাদের হজ্ব পালনের নিয়মকানুন শিখিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতে বলেন, //আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যখন হজ্জ ও উমরাহ করার নিয়ত করো তখন তা পূর্ণ করো। আর যদি কোথাও আটকা পড়ো তাহলে যে কুরবানী তোমাদের আয়ত্বাধীন হয় তাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে পেশ করো। আর কুরবানী তার নিজের জায়গায় পৌঁছে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা নিজেদের মাথা মুণ্ডন করো না। তবে যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় অথবা যার মাথায় কোন কষ্ট থাকে এবং সেজন্য মাথা মুণ্ডন করে তাহলে তার ফিদিয়া হিসেবে রোযা রাখা বা সাদকা দেয়া অথবা কুরবানী করা উচিত। তারপর যদি তোমাদের নিরাপত্তা অর্জিত হয় (এবং তোমরা হজ্জের আগে মক্কায় পৌঁছে যাও) তাহলে তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি হজ্জ্বের সময় আসা পর্যন্ত উমরাহ্‌র সুযোগ লাভ করে সে যেন সামর্থ অনুযায়ী কুরবানী করে। আর যদি কুরবানীর যোগাড় না হয়, তাহলে হজ্জ্বের যামানায় তিনটি রোযা এবং সাতটি রোযা ঘরে ফিরে গিয়ে, এভাবে পুরো দশটি রোযা যেন রাখে। এই সুবিধে তাদের জন্য যাদের বাড়ী-ঘর মসজিদে হারামের কাছাকাছি নয়। আল্লাহর এ সমস্ত বিধানের বিরোধিতা করা থেকে দূরে থাকো এবং ভালোভাবে জেনে নাও আল্লাহ‌ কঠিন শাস্তি প্রদানকারী।//

এই আয়াত থেকে জানা গেলো,
১. হজ্ব বা উমরার নিয়ত করলে আমরা যেন তা পূর্ণ করি।

২. যদি এমন কোন কারণ দেখা দেয় যার ফলে সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পথেই থেমে যেতে হয়, মক্কায় না যাওয়া যায় তবে উট, গরু, ছাগলের মধ্য থেকে যে পশুটি পাওয়া সম্ভব হয় সেটি আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে হবে।

৩. কুরবানী না হওয়া পর্যন্ত মাথার চুল চেঁছে ফেলতে পারবে না।

৪. যদি কেউ রোগের কারণে বা অন্য প্রয়োজনে আগেই মাথা মুন্ডন করবে তারা ফিদিয়া দিবে। তিন দিন রোযা রাখা বা ছয় জন মিসকিনকে আহার করানো অথবা কমপক্ষে একটি ছাগল যবেহ করবে। এটা রাসূল সা.-এর নির্দেশ।

৫. জাহেলী যুদ্ধে আরবের লোকেরা ধারণা করতো, একই সফরে হজ্জ ও উমরাহ দু'টো সম্পন্ন করা মহাপাপ। তাদের মনগড়া শরীয়াতী বিধান অনুযায়ী হজ্জের জন্য একটি সফর এবং উমরাহর জন্য আর একটি সফল করা অপরিহার্য ছিল। মহান আল্লাহ‌ তাদের আরোপিত এই বাধ্য-বাধকতা দূর করে দেন এবং বাইরে থেকে আগমনকারীদেরকে এক সফরে হজ্জ ও উমরাহ করার সুবিধা দান করেন। তবে যারা মক্কার আশেপাশের মীকাতের (যে স্থান থেক হজ্জযাত্রীকে ইহরাম বাঁধতে হয়) সীমার মধ্যে অবস্থান করে তাদেরকে এই সুযোগ দেয়া হয়নি। কারণ তাদের পক্ষে হজ্জ ও উমরাহর জন্য পৃথক পৃথক সফর করা মোটেই কঠিন কাজ নয়।

৬. হজ্জের সময় আসা পর্যন্ত উমরাহর সুযোগ লাভ করার অর্থ হচ্ছে, উমরাহ সম্পন্ন করে ইহরাম খুলে ফেলতে হবে এবং ইহরাম থাকা অবস্থায় যেসব বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হচ্ছিল সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তারপর হজ্জের সময় এলে আবার নতুন করে ইহরাম বেঁধে নেবে।

আল্লাহ তায়ালা ১৯৭ নং আয়াতে বলেন, //হজ্জের মাসগুলো সবার জানা। যে ব্যক্তি এই নির্দিষ্ট মাসগুলোতে হজ্জ করার নিয়ত করে, তার জেনে রাখা উচিত, হজ্জের সময়ে সে যেন যৌন সম্ভোগ, দুষ্কর্ম ও ঝগড়া –বিবাদে লিপ্ত না হয়। আর যা কিছু সৎকাজ তোমরা করবে আল্লাহ‌ তা জানেন। হজ্জ সফরের জন্য পাথেয় সঙ্গে নিয়ে যাও আর সবচেয়ে ভালো পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। কাজেই হে বুদ্ধিমানেরা! আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকো।//

এই আয়াত থেকে জানা গেলো
১. ইহরাম বাঁধা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কই নিষিদ্ধ।

২. যদিও সাধারণ অবস্থায়ই যে কোন গোনাহের কাজ করা অবৈধ কিন্তু ইহরাম বাঁধা অবস্থায় অন্যায় কাজ সংঘটিত হলে তার গোনাহের মাত্রা অনেক বেশী কঠিন হয়ে পড়ে।

৩. ঝগড়া বিবাদ লিপ্ত হওয়া তো বিপজ্জনক। চাকরকে ধমক দেয়াও জায়েয নয়।

৪. জাহেলী যুগে হজ্জের জন্য পাথেয় সঙ্গে করে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়াকে দুনিয়াদারীর কাজ বা গর্হিত কাজ মনে করা হতো। একজন ধর্মীয় ব্যক্তি সম্পর্কে আশা করা হতো সে দুনিয়ার কোন সম্বল না নিয়ে আল্লাহর ঘরের দিকে রওয়ানা হবে। এ আয়াতে তাদের এ ভুল চিন্তার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, পাথেয় না নিয়ে সফর করার মধ্যে মাহাত্ম্য নেই। আসল মাহাত্ম্য হচ্ছে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হওয়া, তাঁর বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকা এবং জীবনকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও কলুষ মুক্ত করা। যে ব্যক্তি সৎ চারিত্রিক গুণাবলী নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে সে অনুযায়ী নিজের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রিত করেনি এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত না হয়ে অসৎকাজ করতে থাকে, সে যদি পাথেয় সঙ্গে না নিয়ে নিছক বাহ্যিক ফকীরী ও দরবেশী প্রদর্শনী করে বেড়ায়, তাহলে তাতে তার কোন লাভ নেই। আল্লাহ‌ ও বান্দা উভয়ের দৃষ্টিতে সে লাঞ্ছিত হবে। যে ধর্মীয় কাজটি সম্পন্ন করার জন্য সে সফর করছে তাকেও লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু তার মনে যদি আল্লাহর প্রতি ভয় জাগরুক থাকে এবং তার চরিত্র নিষ্কলুষ হয় তাহলে আল্লাহর ওখানে সে মর্যাদার অধিকারী হবে এবং মানুষও তাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখবে। তার খাবারের থলিতে খাবার ভরা থাকলেও তার এ মর্যাদার কোন কম-বেশী হবে না।

এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১৯৮ ও ১৯৯ নং আয়াতে বলেন,
//আর হজ্জের সাথে সাথে তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহের সন্ধান করতে থাকো তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। তারপর আরাফাত থেকে অগ্রসর হয়ে 'মাশআরুল হারাম' (মুয্‌দালিফা) এর কাছে থেমে আল্লাহ‌কে স্মরণ করো এবং এমনভাবে স্মরণ করো যেভাবে স্মরণ করার জন্য তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নয়তো ইতিপূর্বে তোমরা তো ছিলে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর যেখান থেকে আর সবাই ফিরে আসে তোমরাও সেখান থেকে ফিরে এসো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়//

এই দুইটি আয়াত থেকে আমরা যা জানতে পারি,

১. আরবে আগে হজ্জ সফরকালে অর্থ উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করাকে খারাপ মনে করা হতো। কারণ তাদের মতে, অর্থ উপার্জন করা একটি দুনিয়াদারীর কাজ। কাজেই হজ্জের মতো একটি ধর্মীয় কাজের মধ্যে এ দুনিয়াদারীর কাজটি করা তাদের চোখে নিন্দনীয়ই ছিল। কুরআন এ ধারণার প্রতিবাদ করছে এবং তাদের জানিয়ে দিচ্ছে, একজন আল্লাহ‌ বিশ্বাসী ব্যক্তি যখন আল্লাহর আইনের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করে নিজেদের অর্থ উপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালায় তখন আসলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করে। কাজেই এক্ষেত্রে সে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সফর করতে গিয়ে তার মাঝখানে তাঁর অনুগ্রহের সন্ধানও করে ফেরে, তাহলে তার কোন গোনাহ হবে না।

২. ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.-এর সময় আরবে হজ্জের সাধারণ প্রচলিত পদ্ধতি ছিল এই যে, ৯ই যিলহজ্জ তারা মিনা থেকে আরাফাত যেতো এবং ১০ তারিখের সকালে সেখান থেকে ফিরে এসে মুযদালিফায় অবস্থান করতো। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন ধীরে ধীরে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের মতো আরবে কুরাইশদের ধর্মীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন তারা বললো, আমরা হারাম শরীফের অধিবাসী, সাধারণ আরবদের সাথে আমরা আরাফাত পর্যন্ত যাবো, এটা আমাদের জন্য মর্যাদাহানিকর।

কাজেই তারা নিজেদের জন্য পৃথক মর্যাদাজনক ব্যবস্থার প্রচলন করলো। তারা মুযদালিফা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসতো এবং সাধারণ লোকদের আরাফাত পর্যন্ত যাবার জন্য ছেড়ে দিতো। পরে বনী খুযাআ ও বনী কিনানা গোত্রদ্বয় এবং কুরাইশদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য গোত্রও এই পৃথক অভিজাতমূলক ব্যবস্থার অধিকারী হলো। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর মর্যাদাও সাধারণ আরবদের তুলনায় অনেক উঁচু হলে গেলো। তারাও আরাফাতে যাওয়া বন্ধ করে দিল।

এ গর্ব ও অহংকারের বিষয়টিকে এই আয়াতে রহিত করে দেওয়া হয়েছে। এ আয়াতে বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে কুরাইশ, তাদের আত্মীয় ও চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোকে এবং সাধারণভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এমন সব লোকদেরকে যারা আগামীতে কখনো নিজেদের জন্য এ ধরনের পৃথক ব্যবস্থা প্রচলনের আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ করে। তাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, সবাই যতদূর পর্যন্ত যায় তোমরাও তাদের সাথে ততদূর যাও, তাদের সাথে অবস্থান করো, তাদের সাথে ফিরে এসো এবং এ পর্যন্ত জাহেলী অহংকার ও আত্মম্ভিরতার কারণে, তোমরা সুন্নাতে ইবরাহিমীর যে বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছো সেজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।

সবশেষে আল্লাহ তায়ালা ২০০ থেকে ২০২ নং আয়াতে বলেন,
অতঃপর যখন তোমরা নিজেদের হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করবে তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে যেমন ইতিপূর্বে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে স্মরণ করতে বরং তার চেয়ে অনেক বেশী করে স্মরণ করবে (আল্লাহকে)। তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে যে বলে, হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় সবকিছু দিয়ে দাও। এই ধরনের লোকের জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। আবার কেউ বলে, হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও। এই ধরনের লোকেরা নিজেদের উপার্জন অনুযায়ী (উভয় স্থানে) অংশ পাবে। মূলত হিসেব সম্পন্ন করতে আল্লাহর একটুও বিলন্ব হয় না।

এই আয়াতগুলো থেকে আমরা জানতে পারি,

১. আরবের লোকেরা হজ্জ শেষ করার পর পরই মিনায় সভা করতো। সেখানে প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা তাদের বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব আলোচনা করতো। গর্ব ও অহংকারের সাথে এবং এভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করতো। তাদের এ কার্যকলাপের ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, এসব জাহেলী কথাবার্তা বন্ধ করো, ইতিপূর্বে আজেবাজে কথা বলে যে সময় নষ্ট করতে এখন আল্লাহর স্মরণে ও তাঁর যিকিরে তা অতিবাহিত করো।

২. আবার যারা আল্লাহকে স্মরণ করতো তাদের মধ্যে দুইটি দল ছিল একদল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো,
رَبَّنَآ اٰتِنَا فِىۡ الدُّنۡيَا
অর্থাৎ হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় সবকিছু দিয়ে দাও।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হজ্বে এসে যারা আল্লাহর কাছে শুধু দুনিয়ার জন্য চাইবে তাদের জন্য আখিরাতে কোনো কিছু থাকবে না।

৩. আরেক দল লোক হজ্বে এসে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো,
رَبَّنَآ اٰتِنَا فِىۡ الدُّنۡيَا حَسَنَةً وَّفِىۡ الۡاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থাৎ হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও।
আল্লাহ তায়ালা এই দোয়াকে পছন্দ করেছেন। তাই তিনি আমরা যাতে এই দোয়া করি সেজন্য কুরআনে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এই দোয়াকারীরা দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় অংশেই তারা নিজ নিজ আমল অনুযায়ী প্রতিদান পাবেন। আল্লাহর রাসূল সা. এই প্রতিদনই করতেন।

শুধু হজ্ব নয়, রাসূল সা. ও সাহাবা রা.-গণ সবসময় এই দোয়া করতেন। আসুন আমরাও আল্লাহর কাছে এই অতি পরিচিত দোয়া সবসময় করতে থাকি।

#রব্বানা