২ জুল, ২০২৫

নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ৩)

 ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে ১৫ দল থেকে পাঁচটি বামদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে, আওয়ামী লীগ ৭৬ আসনে ও জামায়াত ১০ আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে এরশাদ ঢালাওভাবে ডাকাতি না করে জেনারেল জিয়াকে অনুসরণ করেছিলেন। কোন কোন আসন জাতীয় পার্টিকে জয়ী করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। জামায়াতের রংপুরের এক প্রার্থী শাহ রুহুল ইসলামকে জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই আসনের সকল ব্যালট বাক্স সেনাবাহিনী সেনানিবাসে নিয়ে এসে ফলাফল ঘোষণা দেয়।


জামায়াত নির্বাচনে সন্তুষ্ট না হলেও রাজনৈতিক টার্গেট পূরণ হয়। পার্লামেন্টারিয়ান দলে পরিণত হয়। মার্কা হিসেবে দাড়িপাল্লাও বৈধতা পায়। নির্বাচনের শুরুতে এই নিয়ে ঝামেলা হয়। এটা সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক হিসেবে জামায়াতকে পাল্লা মার্কার বরাদ্দ দিতে চায়নি নির্বাচন কমিশন। পরে ১৯৭০ এর নির্বাচনের নথিপত্র দেখিয়ে এই বৈধতা অর্জন করে।

১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ে উঠে। '৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় তারাই এ আন্দোলনে অধিকতর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দলগুলো সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সংসদ থেকে গণ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ১০ সদস্য- বিশিষ্ট সংসদীয় দল তাদের নেতা অধ্যাপক মুজীবুর রহমানের নেতৃত্বে স্পীকার জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর নিকট যেয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন।

আওয়ামী লীগ বিবিসি'কে পদত্যাগ করবেন বলে জানানো সত্ত্বেও বিদেশে অবস্থানকারী নেত্রীর সম্মতির অভাবে দোদুল্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। আওয়ামী লীগ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এরশাদ সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়।

প্রধান দুই দলের সমন্বয়ের অভাবে যুগপৎ আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় ঐ অনুকূল পরিবেশটিকেও কাজে লাগনো গেল না। ফলে এরশাদ '৮৮ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কয়েকটি বাম দল ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের সকল দলই ঐ নির্বাচন বয়কট করে । প্রহসনমূলক এবং ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো সোচ্চার হতে থাকে। এরশাদের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙ্গে দেবার দাবীতে আন্দোলন ঢিমে তালে চলতে থাকে ।

১৯৮৯ সালের অক্টোবরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জামায়াত প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারে সম্মত হয়। এবার সব বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিন্ন দাবীর কারণে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাংগা হয়ে উঠে। কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সুনির্দিষ্ট দাবী সর্বমহলে সহজে বোধগম্য হওয়ায় স্বৈরশাসনের অবসানের পথ সুগম হয়।

কীভাবে সরকার পরিবর্তন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দাবী উত্থাপিত হওয়ায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার হয়। কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেওয়া ফর্মূলা অনুযায়ীই ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় জোটের নামে একটা রূপরেখা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির হাতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত (মন্ত্রীর মর্যাদায়) উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এ নবগঠিত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন।

এবার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হলো এবং জনগণ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলো। ঠিক ঐ পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। সরকারের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে জনগণ ময়দানে নেমে এলো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো। বাধ্য হয়ে এরশাদ ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯০) পদত্যাগ করলো।

কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলন সফল হলো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হলেন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে জেনারেল এরশাদের সংলাপের সময় যদি কেয়ারটেকার সরকার দাবীটি সবাই একসাথে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি '৯০ সাল পর্যন্ত বিলম্বিত হতো না ।

প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে সমস্যা দেখা দিল। ঘটনাক্রমে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৮টি আসনের অধিকারী জামায়াতে ইসলামীর হাতে 'ব্যালেন্স অব পাওয়ার' এসে পড়লো। জামায়াত ক্ষমতায় অংশীদার না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে বিএনপি'কে সরকার গঠনে সাহায্য করলো। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।

জুন মাসে বাজেট সেশনেই জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করার জন্য একটি বিল জমা দেন। পরে ঐ বছরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এ বিষয়ে মোটেই গ্রাহ্য করলো না।

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন যদি জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে নিশ্চয়ই বিএনপি ক্ষমতাসীন হতে পারতো না। বিএনপি সরকার কেয়ারটেকার সরকারেরই ফসল। ভবিষ্যতে যাতে এ পদ্ধতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য দেশের শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে একটি আইনের সংযোজন করাই সবচাইতে যুক্তিসংগত। এ পদ্ধতিতেই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিশ্চিত হয়।

দুঃখের বিষয় খালেদা জিয়া সংসদে 'কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি' সম্পর্কিত বিল আলোচনার সুযোগই দিতে রাজি হলো না। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার দাবী নিয়ে ১০ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) আন্দোলন করেছে। '৯০ সালে বিএনপিও এ আন্দোলনে শরীক ছিল। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুবাদেই তাঁরা ক্ষমতায় গেলেন। অথচ এ পদ্ধতিটি সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দিলেন না। তাঁরা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় স্থায়ী হবার অবৈধ উদ্দেশ্য না থাকলে এমন স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারতো না।

১৯৯১ সালের আগে বাংলাদেশে ৪ টি সাধারণ নির্বাচন হয় মুজিব, জিয়া ও এরশাদের আমলে। প্রত্যেকটি নির্বাচন ছিল 'জোর যার মুল্লুক তার' সিস্টেমে। ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। ২০২৫ সালে এখন যেমন বিএনপি'ই সরকার গঠন করবে এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে তেমনি ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতে যাবে এমন একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী নেতাদের কে কোন মন্ত্রী হবে তা নিয়ে দর কষাকষি তৈরি হয়। কিন্তু নির্বাচনের পরে দেখা জিতে গেল বিএনপি।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আহত নিহত হওয়া শত শত মানুষের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে খালেদা জিয়া কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি মেনে নিতে রাজি হয় নাই। তদুপরি ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে মাগুরা জেলার একটি আসনে উপনির্বাচন হয়। এটি আওয়ামী লীগের আসন ছিল। বিএনপি'র খালেদা সরকার মুজিব মডেল অনুসরণ করে একচেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী দিয়ে সকল কেন্দ্র করে নেয়। এভাবে নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে নেবার পর আওয়ামী লীগ ঘোষণা করল যে কেয়ারটেকার সরকার কায়েম না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না। নতুন করে আবার শুরু হলো কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন।

চলবে...

নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ২)

 ১৯৮২ সালে জিয়ার মৃত্যু ও এরশাদের সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা পর্দার আড়ালে চলে যায়। জামায়াত দুইটা প্রস্তাবনা নিয়ে ১৯৮৪ সালে আবারো রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালায়।

১. নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার
২. আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি (পিআর পদ্ধতি)

দুইটা পদ্ধতিই বাংলাদেশের জন্য নতুন। বাংলাদেশে ১৯৩৭ সালের ইংরেজদের দেখানো পদ্ধতিতে অর্থাৎ First-past-the-post voting পদ্ধতিতে ইলেকশন হয়ে আসছে। নতুন পদ্ধতিতে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি দল অর্থাৎ এরশাদের জাতীয় পার্টির তো একমত হওয়ার প্রয়োজন নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী দলগুলোও এই বিষয়ে একমত হয়নি।

এদিকে এরশাদ ১৯৮৬ সালে বিরোধীদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি নির্বাচন করার পরিকল্পনা করে। দেশে বিরোধীদের মধ্যে স্পষ্টত দুইটা জোট বিদ্যমান ছিল। একটি আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন।

রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছিল। বড় দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা না বলায় পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল। এ পরিবেশে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে দলীয় জনসভায় বলেন, এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের গদি মযবুত করবে তারা 'জাতীয় বেঈমান' হিসেবে গণ্য হবে।

অথচ ময়দানে গুজব রটেছে যে, ১৫ দলীয় জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে আসন দাবি করে রীতিমতো দর কষাকষি চালাচ্ছে। তখন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল মুস্তাফিজ ও জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকাদি চললো। প্রথমে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে মাত্র ২০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের দর কষাকষির পর কর্নেল মুস্তাফিজ ৫০টি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দিতে সম্মত হলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তা মেনে নেয়।

পরে জানা গেল, জামায়াতকে এত বেশি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ায় নিজ দলীয় বৈঠকে কর্নেল মুস্তাফিজ নাজেহাল হন। খালেদা জিয়া তাকে রীতিমত অপমান করেন এবং জামায়াতের সাথে আলোচনা বন্ধ করে দেন। ফলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার চুক্তি হলেও খালেদা জিয়া সেই প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দেন কোনো ঘোষণা না দিয়েই।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা না হওয়ায় এরশাদ ঘোষণা করলো, ১৯ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ২০ মার্চ জাতির উদ্দেশে সে নির্বাচন সম্পর্কে ভাষণ দেবে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদেরকে নির্বাচনবিরোধী কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর সে হয়তো জানতো। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধী কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ময়দানে না থাকায় এরশাদ পূর্ণ আস্থার সাথেই ঐ সতর্কবাণী উচারণ করলো।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে বৈঠকে বসবে বলে গণমাধ্যমকে জানালো। জামায়াতও ঐ একই তারিখে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিল। জামায়াতের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল দুই জোটের কোনো একজন নির্বাচনে অংশ নিলে জামায়াতও নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে নামকাওয়াস্তে হলেও সেনা শাসককে জনগণের মুখোমুখি করা। যাতে এরশাদের স্বৈরাচারী মনোভাবে কমে আসে।

জামায়াত ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলো। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। জামায়াতের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় পাঠানোর পূর্ণ প্রস্তুতি সত্ত্বেও ঐ দুই দলের সিদ্ধান্ত না জানা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলো। রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত জানা গেল না।

আসলে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ উভয় দলই বুঝতে পেরেছে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রহসন হবে। তাই তারা কেউ আগ বাড়িয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারছিল না। আবার নির্বাচনে যুক্ত হলে কিছু সংসদ সদস্য পাওয়া যাবে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অংশ হওয়া যাবে, এই ব্যাপারটাও বড় দুই দল হাতছাড়া করতে চাইছিল না।

দৈনিক সংগ্রামের দুজন সাংবাদিক ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বিএনপির খবর মুজাহিদ সাহেব ফোনে নিচ্ছিলেন। রাত ২টার সময় দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিকদ্বয় মোটর সাইকেলে খবর নিয়ে এলেন। খবর এল যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে; কিন্তু বিএনপি তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌছেনি।

বিএনপির তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল ওবায়দুর রহমানের সাথে মুজাহিদ সাহেব অব্যাহতভাবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। রাত তিনটায় ওবায়েদ সাহেব মুজাহিদ সাহেবকে জানালেন, একটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেব। আপনাদের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় দিয়ে দিন।

অর্থাৎ বিএনপি'র গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই জামায়াত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২০ মার্চ (১৯৮৬) বড় বড় হেডিং-এ পত্রিকায় খবর বের হলো, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

বিএনপির টেকনিক্যাল কারণটি কী?

বিএনপির প্রথম সারির আট/দশজন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারাবদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও একজন।

বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও এরশাদ করেছিলেন। তবে তা গোপনে। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পূরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল।

বিএনপি আশা করেছিলো পরের দিন এরশাদ তার কথা রাখবে। ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারল, এরশাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছে। বিরোধীদের মধ্যে বিএনপিই সবচেয়ে পপুলার দল ছিল। তাই শেষ সময়ে এরশাদ এই দলকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এরশাদের সাথে করা গোপন চুক্তি এরশাদ রাখে নি। তাই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল খালেদা জিয়া। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে হাসিনার দেওয়া 'জাতীয় বেঈমান' উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল বিএনপি। আসল যে কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারল না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা চলে না। তাই তারা এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য না দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে আখ্যা দিলো। বিএনপি এই ঘটনায় নিজেদের নেতা খালেদা জিয়াকে "আপোষহীন নেত্রী" ঘোষণা করলো।

এরশাদ সফলভাবে বিরোধীদলগুলোর মধ্যে অনৈক্য তৈরি করতে সক্ষম হলো। অতিকথক হাসিনা নিজের গালি নিজেই খেলো। 'জাতীয় বেঈমান' গালি খেয়ে আওয়ামী লীগ দাবি করল, বিএনপি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা আরো দাবি করল, বিএনপির সাথে তাদের নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকার বিনিময়ও হয়েছে।

জামায়াত তার বিবৃতিতে বিএনপির সাথে এবং তাদের সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবর পত্রিকায় পরিবেশন করেছে। তাই জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। জামায়াত তো নিশ্চিতই ছিল যে, বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

যাই হোক টেকনিক্যাল কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও বাংলাদেশের বাকী সব রাজনৈতিক দল (২৮টি) ১৯৮৬ সালের ৩য় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনও কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল না। তবে এটি মুজিবের কেন্দ্র দখল মডেল নয়, জিয়ার প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো রেজাল্ট ঘোষণার মডেল ছিল। এরশাদ শুধু যতটুকু হলে তার সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট হবে ততটুকুই নিয়েছে। অর্থাৎ ১৫৩ আসন নিয়েছে। জিয়া'র মডেলে ১০ টি রাজনৈতিক দলকে আসন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

এই নির্বাচনের পরে আবারো জামায়াত বুঝাতে চেষ্টা করে সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে, এভাবে নির্বাচন হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচন হতে হলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার লাগবে। কেয়ারটেকার সরকার বুঝাতে হাসিনা ও খালেদাকে প্রায় ৩ বছর লেগে যায় জামায়াতের। ১৯৮৯ সালে সকল বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে একমত হয় এবং এই দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। বরাবরের মতোই যারা সরকারে থাকে তাদের কেয়ারটেকার সরকারের দরকার হয় না।

এরশাদ এই ব্যবস্থাকে পাগলের প্রলাপ ও আজগুবি পদ্ধতি বলে উল্লেখ করে। কেয়ারটেকারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে পিআর পদ্ধতি।

-- চলবে

নির্বাচন, পিআর, খালেদা জিয়া ইত্যাদি (পর্ব ০১)

 এদেশে নির্বাচন ব্যবস্থাকে চূড়ান্তরূপে ধ্বংস করে দেয় আওয়ামী লীগ। আরেকটু প্রিসাইজলি বলতে গেলে আওয়ামীলীগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সিরাজুল আলম খানের গোপন সংগঠন 'নিউক্লিয়াস' এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা জানতোই না যে, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়ে জেতা যায়। এই ধরণের প্র্যাকটিস সেসময় ছিল না, যা এখন আছে।


১৯৭০ সালে সভ্যতাকে বিসর্জন দিয়ে অসভ্যের মতো ছাত্রলীগের কর্মীরা কেন্দ্র দখল করে প্রায় সব আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই আনফেয়ার ইলেকশনটিকে পরোয়া না করে অসভ্য শেখ মুজিবকে বিজয়ী ঘোষণা করে। শেখ মুজিব ও তার দলের টার্গেট ছিল জাল ভোট দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া। কিন্তু মুসলিম লীগের প্রার্থীদের অপ্রস্তুতি ও ইয়াহিয়া সরকারের অদক্ষতায় শেখ মুজিব শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, পুরো পাকিস্তানেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। অথচ আওয়ামী লীগ বাংলা ছাড়া অন্য চার প্রদেশে কাউকে নমিনেশন পর্যন্ত দেয়নি।

যাই হোক এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বি জাসদ। জাসদ ছিল তারা, যারা আগে আওয়ামী লীগে আড়ালে নিউক্লিয়াস করতো। জাসদ ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই জানে কীভাবে কেন্দ্র দখল করে জিততে হয়। উভয়ই মারামারি খুনোখুনি করে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফ্যাসিস্ট মুজিব ছিল তাই জাসদকে খুবই হতাশাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১ আসন পায় জাসদ। পায় বলা ঠিক হবে না, ১ টি আসন দেওয়া হয় জাসদকে। সেই ইলেকশনে মুজিব হেলিকপ্টার দিয়ে ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে এসে খন্দকার মুশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করেন।

এরপর ১৯৭৭ সালে একটি প্রেসিডেন্ট জিয়া একটি গণভোট করেন। ভোটারদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল?

এই ইলেকশনে ৯৮.৯% মানুষ হ্যাঁ ভোট দেয়। এই ইলেকশন ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নেই। জোরপূর্বক ভোট দেওয়া হয়নি। তবে কথিত আছে এখানে কারচুপি করা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত প্রিসাইডিং অফিসার দ্বারা।

একই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল দুই তৃতীয়াংশ আসনেরও বেশি দখল করে। আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে আই.ডি.এল (ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ) নামে নির্বাচনে ১৮ টি আসন পায়।

এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলেও ৭৩ এর নির্বাচনের মতো একচেটিয়া সীট দখলের অপচেষ্টা করা হয়নি। শেখ মুজিবের নগ্ন ডাকাতি এখানে হয়নি। তবে জিয়াউর রহমান কূটকৌশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নির্বাচনে যত দল যোগদান করেছে সে সব দলের প্রধানগণ যাতে সংসদে আসেন সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। ৭৭ সালের মতো নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত ফলাফল নিয়ে এসেছেন।

এই প্রসঙ্গে শহীদ গোলাম আযম বলেন, //জিয়ার শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজীজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়ার ছিলেন। সমসাময়িক হিসাবে কিছুটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যোগাযোগ ও সাক্ষাত হতো। তাঁর কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পলিসি সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি।

তিনি জিয়ার নির্বাচনী পলিসির প্রশংসা করতে গিয়ে জানালেন যে, দলীয় প্রধানগণ যাতে সংসদের বাইরে আন্দোলন করা প্রয়োজন মনে না করেন সে উদ্দেশ্যে তাদেরকে নির্বাচিত হবার সুযোগ দিয়েছেন। সর্বহারা দলের তোয়াহা প্রথম ভোট গণনায় পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয় । এ দ্বারা বুঝা গেল যে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো বিজয়ী হওয়া সম্ভব হয়নি।//

গোলাম আযম আশা করেছিলেন জিয়া যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী হবেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি হতাশ হলেন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, রাজনীতি ও নির্বাচনকে বাকশালী স্বেচ্ছাচারে পরিণত করলো। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়নি। গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। তা না হলে নির্বাচন নিতান্তই প্রহসন মাত্র।//

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম তখন থেকেই বিকল্প পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা ভাবতে থাকলেন। গবেষণা করতে থাকলেন। প্রতিটি সম্ভাবনার সাইড ইফেক্ট চিন্তা করলেন। এরপর তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার কথা ভাবলেন। এরপর এটি তিনি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদে উত্থাপন করেন। দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর জামায়াত সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে।

অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ও কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাই এই বিষয়ে তাঁর একাডেমিক পদচারণা ছিল। একইসাথে তিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় বিষয়টি তাঁর জন্য সুবিধা হয়েছে।

কেয়ারটেকার শব্দটি কীভাবে এসেছে এই নিয়ে তিনি বলেন, //গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকারই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় নেতা হওয়ায় সরকার পরিচালনার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার সম্ভাবনা থাকে। বৃটেনে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে এমন সুযোগ গ্রহণ না করলেও আমাদের দেশে অবশ্যই আছে। এ ভাবনা থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি “কেয়ারটেকার সরকার” পরিভাষার আবিষ্কারক নই। এ পরিভাষা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেই আমি পেয়েছি। আমার প্রস্তাবে শুধু 'নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সরকারের' পরিচালনার কথাটুকুই নতুন সংযোজন বলা যায়।//

অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার মডেলের মূলকথা ছিল,
“নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত (অবসরপ্রাপ্ত নয়) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এমন লোকদেরকে নিয়োগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। এ সরকার দলনিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ সরকার কায়েম থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি নিজ পদে প্রত্যাবর্তন করবেন।”

গোলাম আযম সাহেব বলেন, //মূল প্রস্তাবে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রধান করার কথা এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তিনি নির্বাচনের পরই পূর্বপদে ফিরে যাবেন বিধায় তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সুযোগ কম থাকবে। এ অবস্থায় তাঁর কোন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কোন আশংকা থাকবে না।//

১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে রমনায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান সর্বপ্রথম জামায়াতের পক্ষ থেকে এ দাবীটি উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিহত করার ফলে ঐ বছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের ধারা স্তব্ধ করে দেন।

চলবে...

১৭ জুন, ২০২৫

শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার : আমাদের মহানায়ক


হামাসের নাম তো আমরা সবাই জানি। হামাসের ওপর ভিত্তি করেই এখন টিকে আছে ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর হামাস বহুদিন ধরে সারভাইভ করে যাচ্ছে 'আল মাজদ' বাহিনীর সহায়তায়। হামাস হলো সামগ্রিক সংগঠন। এর যোদ্ধা শাখা হলো আল কাসসাম ব্রিগেড। আল কাসসাম ব্রিগেডের নাম সবাই জানলেও 'আল মাজদ' অনেকটাই আড়ালের সংগঠন।  

হামাসের আল-মাজদ বাহিনী হলো ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শাখা, যা মূলত গোয়েন্দা ও পাল্টা-গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত। এই শাখাটি হামাসের সামরিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলা যায় এটা হামাসের গোয়েন্দা বাহিনী।

আল-মাজদ বাহিনী ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে গঠিত হয় বলে জানা যায়, যখন হামাস নিজেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি শক্তিশালী শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছিল। হামাস প্রতিষ্ঠাতা শায়খ ইয়াসিনের নির্দেশে ইয়াহিয়া সিনওয়ার হাত ধরে এই বাহিনী যাত্রা শুরু করে। আল-মাজদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ইসরায়েলি গুপ্তচর এবং ফিলিস্তিনি সহযোগীদের (যারা ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করে বলে সন্দেহ করা হয়) শনাক্ত ও নির্মূল করা। এছাড়া, এই বাহিনী হামাসের সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের গোপনীয়তা রক্ষা এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ট্র্যাক করার কাজে নিয়োজিত। 

আল-মাজদ সন্দেহভাজন ইসরায়েলি এজেন্টদের তদন্ত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এই বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং সংগঠনের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। হামাসের শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গাজায় সংগঠনের অভিযানের গোপনীয়তা রক্ষা করা এই শাখার অন্যতম দায়িত্ব। তারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পাল্টা-গোয়েন্দা অভিযান চালায়।

আল-মাজদ সন্দেহভাজন সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করে, প্রয়োজনে তারা মৃত্যুদণ্ডও দিয়ে থাকে। আল-মাজদ হামাসের সামরিক শাখা ইজ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড থেকে আলাদা, যদিও উভয় শাখা পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। আল-মাজদের কার্যক্রম বেশি গোপনীয় এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার উপর কেন্দ্রীভূত। ইয়াহিয়া সিনওয়ার এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে আল-মাজদ হামাসের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। 

আমাদের আজকের আলোচনা আল মাজদের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নিয়ে। ১৯৮৭ সালে শায়খ আহমাদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠার অল্প সময় পর দলটির অন্যতম নেতা হিসেবে যোগ দেন সিনওয়ার। তিনি শুরু থেকেই আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দেন। তাঁর ভাষ্য ছিল আমাদের সব অগ্রগতি নিমিষেই ব্যর্থ হবে যদি আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী না করি। আমাদেরকে আমাদের নিজের মধ্যেই গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে হবে। শায়খ আহমাদ ইয়াসিন ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ওপর আস্থা রেখেই আল মাজদ বাহিনী গড়ে তুলেছেন।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই একটি শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন। এটা হামাসকে যেমন শক্তিশালী করে তেমনি দুর্বল করেছে ইসরাঈলকে। ইসরাঈল ক্রমাগতভাবে ফিলিস্তিনীদের খবরাখবর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আল মাজদ অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিমদের মধ্যে থাকা ইসরাঈলী গুপ্তচরদের হামাস ও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কার করতে শুরু করেছিল। এই আল মাজদের ওপর ভরসা করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে হামাস। এদিকে মোসাদ ও শিন বেতের মূল শত্রু হয়ে ওঠে আল মাজদের কমান্ডিং অফিসার ইয়াহিয়া সিনওয়ার।

জন্ম ও শৈশবঃ

ইয়াহিয়া সিনওয়ারে পুরো নাম ইয়াহিয়া ইবরাহিম হাসান সিনওয়ার। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের একজন গোয়েন্দা, রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, লেখক এবং সর্বশেষ হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান। তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উপর হামাসের হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মাজদাল আসকালান (বর্তমানে ইসরায়েলের অংশ) থেকে বিতাড়িত হয়ে গাজায় উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। তার বাবা-মায়ের বিষয়ে বিশদ তথ্য জানা যায় না, তবে জানা যায় তার তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। তার এক ভাই, মোহাম্মদ সিনওয়ার, হামাসের শীর্ষ নেতা এবং আরেক ভাই, যাকারিয়া সিনওয়ার, ফিলিস্তিনের একজন খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ও একাডেমিশিয়ান।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে কঠিন পরিবেশে বড় হন। ১৯৪৮ সালে তার পরিবারের বাস্তুচ্যুতির কারণে তাদের জীবন ছিল দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। এই পরিবেশ তাকে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং তার রাজনৈতিক ও সামরিক জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। সিনওয়ার খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার শিক্ষাগত জীবন তাকে ফিলিস্তিনি আন্দোলনের প্রতি আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে এবং তিনি ছাত্রজীবন থেকেই হামাসের সঙ্গে জড়িত হন। যেহেতু তিনি ও তার পরিবার ইসারাইলি আগ্রাসনে উদ্বাস্তু হয়েছেন তাই ফিলিস্তিনের ভূমি উদ্ধারে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। 

ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৮৭ সালে হামাসের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি দুজন ইসরায়েলি সেনা এবং ১২ জন ফিলিস্তিনি (যাদের ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ছিল) হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনায় তাকে চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ২০১১ সালে গিলাদ শালিত বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে মুক্তি পান, যেখানে ১০২৭ ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময়ে একজন ইসরায়েলি সেনাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তিনি দ্রুত হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসেন এবং ২০১৭ সালে গাজায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের আগস্টে ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর তিনি হামাসের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সাংগঠনিক ও কারাজীবন:

হামাস গঠিত হওয়ার আগে থেকেই ইয়াহিয়া সিনওয়ার ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। তিনি কিশোর বয়স থেকে ইখওয়ানুল মুসলেমিনের সাথে যুক্ত ছিলেন। খান ইউনিসে মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি বিশাল আস্তানা ছিল। শরণার্থী শিবিরের দরিদ্র যুবকদের মসজিদে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এই সংগঠনটি। পরে স্থানটি হামাসের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়। এর অন্যতম মধ্যমণি ছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার।

১৯৮২ সালে ২০ বছর বয়সে তিনি প্রথম ইসরাঈলি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাকে চার মাসের প্রশাসনিক আটকাবস্থায় রাখা হয়। মুক্তির পর মাত্র এক সপ্তাহ পরে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিনা বিচারে ছয় মাস কারাগারে রাখা হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন এবং আট মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই সময়েই তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেন। তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেন, তারা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সাথে এই সম্পর্ক পরে সিনওয়ারকে আন্দোলনের মধ্যে একটি "বিশেষ মর্যাদা" দেয়। হামাস ও আল মাজদের নেতা হিসেবে তিনি ১৯৮৮ সালে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। এবার আর সাধারণ বিক্ষোভকারী হিসেবে নয়, গোয়েন্দা হিসেবে গ্রেপ্তার হন। 

দুই ইসরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ ও হত্যার পাশাপাশি ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা করার সন্দেহে ১২ ফিলিস্তিনিকে (ইসরাঈলিদের গোয়েন্দা) হত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তার বিচার করা হয়। এ মামলায় তাকে চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাবাসের সময় সিনওয়ার ইসরাঈলি কারাগারে হামাস বন্দীদের সুপ্রিম লিডারশিপ কমিটির নেতৃত্ব দেন। কারাগারকে ইয়াহিয়া সিনওয়ার বানিয়ে ফেলেন হামাস যোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট ও টেনিং-এর মোক্ষম স্থান। মাঝে কারাগারে বিভিন্ন দাবী দাওয়ায় অনশন ও কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেন তিনি। সিনওয়ার দুইবার কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু উভয় প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। 

ইয়াহিয়া সিনওয়ার তার কারাজীবনের সময় বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেছেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো উপন্যাস আশ-শাওক ওয়াল কারানফুল (কাঁটা ও ফুল), যা ২০০৪ সালে বিরশেবা কারাগারে লেখা। এই উপন্যাসে তিনি ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন। তিনি দাবি করেন, উপন্যাসটি তার নিজের গল্প নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের সম্মিলিত কাহিনী। বইটি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়া তিনি দুটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন।

সিনওয়ার তার কারাজীবনকে পড়া-লেখাসহ হিব্রু শেখার কাজেও ব্যবহার করেন। ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের দুই প্রধানের লেখা তিনটি বই তিনি হিব্রু থেকে আরবিতে অনুবাদ করেন। এ সময় ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নেন তিনি।

২০১১ সালে একটি চুক্তির অংশ হিসেবে সিনওয়ারকে মুক্তি দেওয়া হয়, যেখানে একজন ইসরায়েলি জিম্মি, আইডিএফ সৈন্য গিলাদ শালিতের বিনিময়ে ১,০২৭ জন ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি আরব বন্দীকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। শালিতকে পাঁচ বছর ধরে অপহরণ করে রাখা হয়েছিল এবং অপহরণকারীদের মধ্যে সিনওয়ারের ভাইও ছিলেন, যিনি হামাসের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার।

ফিলিস্তিনের নেতা সিনওয়ারঃ

ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসার পর গাজার মুসলিমরা তাকে নিয়ে উৎসব করতে থাকে। এর মূল কারণ ছিল হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তার বিশেষ মর্যাদা এবং ইসরায়েলি কারাগারে তার জীবনের অনেকগুলো বছর উৎসর্গ করা।

২০১২ সালে হামাসের রাজনৈতিক শাখায় যোগ দেন সিনওয়ার। এ সময় কাসসাম ব্রিগেডের সঙ্গে সমন্বয় অব্যাহত রাখেন তিনি। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের সাত সপ্তাহের আগ্রাসনের সময় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করেন সিনওয়ার। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী' হিসেবে অপবাদ দেয়। ২০১৭ সালে ইসমাঈল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলে সিনওয়ারকে গাজায় হামাস প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার ২০১২ সাল থেকেই আল মাজদকে আরো ফাংশনাল করেন। তিনি গাজার অভ্যন্তরে টানেল নেটওয়ার্ক একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যান। এই টানেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হামাস যোদ্ধারা ইসরাঈলে ও মিশরে যাতায়াত করতে পারতো। ইয়াহিয়া সিনওয়ারের আরেকটি বড় সাফল্য ছিলো তিনি ইরানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেন। ইরানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আল কাসসাম ব্রিগেডকে শক্তিশালী করেন। টানেলে অস্ত্র কারখানা গড়ে তুলেন। মিশর থেকে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সহায়তায় খাবার, পোশাক, চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তার দ্বার উন্মূক্ত করেন। গাজার মেধাবী ছাত্রদের তিনি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। কয়েক বছরের মধ্যে গাজার চেহারাই তিনি পালটে দেন।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার কখনোই আপোষকামী মনোভাবের মানসিকতা লালন করতেন না। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তিনি কোনোভাবেই ভয় পেতেন না। কবি কাজী নজরুল যেমন বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন "আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি" এই কথাটির সাথে আমি কেবল ইয়াহিয়া সিনওয়ারকেই সম্পর্কিত করতে পারি। তিনি তার কিশোর বয়স থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন।   

শাহদাতঃ

১৬ অক্টোবর ২০২৪। আনুমানিক ১০টায় ইসরাঈলি সন্ত্রাসী আইডিএফ সৈন্যরা একজন ব্যক্তিকে একটি ভবনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। বিকাল ৩টায়, একটি আইডিএফ ড্রোন তিনজন ব্যক্তিকে ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে, দু'জন কম্বলে ঢাকা এবং তৃতীয় জনের জন্য পথ পরিষ্কার করছিল। সৈন্যরা গুলি চালায় এবং দলটি আলাদা হয়ে যায়, দু'জন একটি ভবনে প্রবেশ করে এবং তৃতীয়জন (সিনওয়ার) আরেকটি ভবনে প্রবেশ করেন এবং দ্বিতীয় তলায় উঠে যান।

গোলাগুলির এক পর্যায়ে একজন আইডিএফ সৈন্য গুরুতর আহত হয়। একটি ট্যাঙ্ক সিনওয়ারের অবস্থানে একটি শেল নিক্ষেপ করে এবং অন্য সৈন্যরা ভবনের পাশে অবস্থান নেয়। সিনওয়ার তাদের লক্ষ্য করে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে; একটি বিস্ফোরিত হয়। সন্ত্রাসী ইহুদী সৈন্যরা পিছু হটে এবং একটি ড্রোন পাঠিয়ে দেয় যা একটি আহত ব্যক্তিকে সনাক্ত করে যার মুখ ঢাকা তিনি একটি লাঠি দিয়ে ড্রোনটিকে আঘাত করার চেষ্টা করেন। মুখোশধারী ব্যক্তিটি সিনওয়ার কিনা তা সে সময় জানা যায়নি।

ঘটনার পরের দিন সৈন্যরা একটি মৃতদেহ দেখতে পায় যা সিনওয়ারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, সামরিক ভেস্ট পরিহিত, একটি গ্রেনেড এবং একটি বন্দুক, ৪০,০০০ শেকেল (ইসরাঈলি মুদ্রা), একটি লাইটার, একটি ইসরাঈলি পাসপোর্ট। সেখান থেকে আরো দুইজনের লাশ উদ্ধার করা হয় নগদ টাকা, অস্ত্র ও ভুয়া পরিচয়পত্রসহ। ডিএনএ পরীক্ষা, দাঁতের রেকর্ড এবং আঙুলের ছাপের মাধ্যমে ইসরাঈলিরা নিশ্চিত হয় তিনি ছিলেন আমাদের বীর যোদ্ধা, আমাদের নেতা শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার। 

ইয়াহইয়া সিনওয়ার আমাদের জীবদ্দশায় ঐতিহাসিক হক ও বাতিলের লড়াইয়ের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। অমর মহানায়ক। মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কেউ কেউ (শাহাদাত বরণ করে) তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে। আবার কেউ কেউ (শাহাদাত বরণের) প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (তাদের সংকল্পে) কোনো পরিবর্তন করেনি। (সূরা আহযাব, আয়াত-২৩)

ধারাবাহিকভাবে হামাস নেতাদের শাহাদাতের ঘটনায় কবি আল মাহমুদ এর লেখা আমাদের মিছিল কবিতার কথা বাববার মনে করিয়ে দেয়,

‘‘আমরা তো শাহাদাতের জন্যই
মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে পা রেখেছি।
কেউ পাথরে, কেউ তাঁবুর ছায়ায়
কেউ মরুভূমির উষ্মবালু কিংবা সবুজ কোনো ঘাসের দেশে
আমরা আজন্ম মিছিলেই আছি, এর আদি বা অন্ত নেই।’’

জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম


জাতীয়তাবাদ কী?

জাতীয়তাবাদ হলো একটি মতাদর্শ বা আন্দোলন, যা কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক পরিচিতির প্রতি আনুগত্য ও গর্ব প্রকাশ করে। এটি জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা, এবং স্ব-শাসনের ওপর জোর দেয়। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়, যেমন:

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ: জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রচার।

রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ: স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ: জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা।

মুসলিম জাতীয়তাবাদ কী?

মুসলিম জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি ধারণা, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচিতি (ইসলাম) এবং সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় পরিচয় গঠন করা হয়। এটি প্রায়শই ধর্মীয় ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদাহরণ হলো দ্বি-জাতি তত্ত্ব, যা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রচার করেছিল। এই তত্ত্বে বলা হয়েছিল যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি, যাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনধারা ভিন্ন। এর ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি (১৯৪৭) হয়, যা মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক প্রকাশ ছিল।

ইসলাম কি মুসলিম জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে?

না। ইসলাম কোনো জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না। ইসলাম শুধু ইসলামকেই সাপোর্ট করে। এক ইহুদী ও সাহাবীর ঘটনা। রাসূল সা. এর বিচার মানেনি সাহাবী। উমার রা.-এর কাছে গেলে উমার রা. সাহাবীকে হত্যা করেন।

ইসলাম কেন জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে?

১. মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্যঃ

জাতীয়তাবাদ উম্মাহর ঐক্যকে খণ্ডিত করতে পারে এবং জাতিগত বা ভৌগোলিক বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে ইসলাম সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের কথা বলে। কুরআনের সূরা হুজুরাত (৪৯:১৩) বলে: হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হলো সবচেয়ে ধার্মিক। এই আয়াত জাতীয় বা গোত্রভিত্তিক বিভেদের পরিবর্তে ঐক্যের ওপর জোর দেয়।

জাতীয়তাবাদ জাতিগত বা জাতীয় পরিচয়কে ধর্মীয় ঐক্যের উপরে স্থান দিয়ে উম্মাহর ঐক্যকে দুর্বল করতে পারে। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যেমন জামালুদ্দিন আফগানি জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন, কারণ এটি মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করে। তবে, কিছু প্রেক্ষাপটে, যেমন পাকিস্তানের সৃষ্টি, মুসলিম জাতীয়তাবাদ ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে।

২. জাতীয়তাবাদ একটি জাহেলিয়্যাত

ইসলামী শিক্ষা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে, বিশেষ করে যখন এটি গোত্রবাদ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদের রূপ নেয়। কুরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে, সকল মানুষ সমান, এবং শ্রেষ্ঠত্ব শুধুমাত্র ধার্মিকতার ভিত্তিতে। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস (৪৫৬১) বলে, গোত্রের পতাকার অধীনে যুদ্ধ করা জাহিলিয়াতে মৃত্যুর সমান। সুনান আবি দাউদের হাদিস (৫১০২) বলে, যে ব্যক্তি গোত্রবাদের ডাক দেয়, গোত্রবাদের জন্য লড়াই করে বা গোত্রবাদের জন্য মরে, সে আমাদের মধ্যে নয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলেছেন, এটি ছেড়ে দাও, এটি পচা। মুসনাদ আহমদের হাদিস (৩৭৮৪) বলে, গুরাবা (অপরিচিত) হলো তারা যারা গোত্রীয় আনুগত্য থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে। এই শিক্ষাগুলো জাতীয়তাবাদকে প্রাক-ইসলামী অজ্ঞতা (জাহিলিয়া) হিসেবে দেখে, যা ইসলাম নিষিদ্ধ করে।

৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বনাম জাতীয় সার্বভৌমত্ব

ইসলাম: সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র জন্য সংরক্ষিত। আইন ও মূল্যবোধের উৎস হলো আল্লাহ্র বিধান (শরীয়া)। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: "আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেয়ার অধিকার নেই" (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)।

জাতীয়তাবাদ: সার্বভৌমত্ব "জাতির" হাতে ন্যস্ত করে এবং মানবরচিত সংবিধান/আইনকে সর্বোচ্চ মনে করে।

৪. ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি: ঈমান বনাম জাতীয়তা

ইসলাম: মুসলিমদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ভিত্তি হলো ঈমান (বিশ্বাস)। কুরআন নির্দেশ দেয়:

"মুমিনগণ যেন অপর মুমিনকে ছেড়ে কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে" (সূরা আল-ইমরান, ৩:২৮)।

জাতীয়তাবাদ: সম্প্রীতি বা শত্রুতার ভিত্তি হলো জাতীয় স্বার্থ, যা অনেক সময় ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

৫. ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত: উম্মাহর ধারণা

প্রাথমিক ইসলামে, নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় একটি বহুজাতিক, বহুধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ("মদিনা সনদ")। সেখানে পরিচয়ের ভিত্তি ছিল বিশ্বাস, জাতীয়তা নয়।ইসলামী খিলাফত মডেল (যেমন উসমানীয় সাম্রাজ্য) জাতীয়তাবাদকে দমন করেছিল, কেননা তা উম্মাহর ঐক্যকে বিপন্ন করত।

৬. জাতীয়তাবাদের বিপদ: বিভাজন ও সংঘাত

ইসলামী স্কলারগণ (যেমন সাইয়েদ কুতুব, মাওলানা মওদুদী) যুক্তি দেন যে জাতীয়তাবাদ: মুসলিম বিশ্বকে দুর্বল করে (যেমন: উসমানীয় খিলাফতের পতনের পর জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সংঘাত)। গোত্রপ্রীতি (আসাবিয়্যাহ) তৈরি করে, যা নবী (সা.) নিষিদ্ধ করেছিলেন: "যে ব্যক্তি আসাবিয়্যাহের ডাক দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়" (সুনান আবু দাউদ)।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে সমালোচনা:

১. বিভ্রান্তিকর আনুগত্য: জাতীয়তাবাদ আল্লাহ্র পরিবর্তে জাতির প্রতি আনুগত্য চায়।

২. উম্মাহর বিভক্তি: মুসলিম বিশ্বকে ৫০টিরও বেশি জাতি-রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছে।

৩. সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার: ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করে মুসলিম ভূখণ্ড বিভক্ত করেছে।

৭. ব্যতিক্রম: "দেশপ্রেম" বনাম "জাতীয়তাবাদ"

ইসলাম দেশপ্রেম (ওয়াতানিয়্যাহ) বা স্বদেশের কল্যাণ কামনাকে সমর্থন করে, তবে তা শর্তসাপেক্ষ:

তা যেন ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী না হয়। তা যেন উম্মাহর ঐক্যকে ক্ষুণ্ন না করে। উদাহরণ: ফিলিস্তিন, কাশ্মীরের মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে "ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ" হিসেবে দেখা হয়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে নয়।

জাতীয়তাবাদ / জাতিবাদ / গোত্রবাদের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য

এক.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য হতে বের হয়ে যায় এবং মুসলিমদের দল ত্যাগ করে, আর এই অবস্থায় মারা যায়, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে ভাল-মন্দ নির্বিচারে হত্যা করে এবং মুসলিমকেও ছাড়ে না; আর যার সাথে যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তার অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার সাথে আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে, আর লোকদেরকে জাতিয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে এবং তার ক্রোধ জাতিয়তাবাদের জন্যই হয়, পরে সে নিহত হয়; তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে।

সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১১৪

দুই.

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লোকেদেরকে গোত্রবাদের দিকে আহবান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো।

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৯৪৮

ফাসীলাহ্ বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! কোন ব্যক্তির নিজের গোত্রকে ভালোবাসা কি আসাবিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ না; বরং আসাবিয়্যাত হলো কোন ব্যক্তির নিজের গোত্রকে যুলমে সাহায্য করা। (আহমাদ ও ইবনু মাজাহ)

ইসলাম একে জাহেলিয়াত বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামে আরব অনারব, সাদা কালো, দেশি বিদেশি সকল মুসলিমকেই সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি মুসলিম হয় তাহলে সে ভারতীয়, পাকিস্থানি অথবা অন্য যে কোন দেশের নাগরিক হোক না কেন, সে আমাদের দ্বীনি ভাই। মুসলিমদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের পার্থক্য হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে, জাতীয়তা কিংবা দেশীয় নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নয়। কেউ যদি ইসলামের বিরোধীতা করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করে তাহলে সে স্বদেশী হলেও সে আর আমি এক জাতি নই।

তিন.

জাতীয়তাবাদ, গোত্র প্রীতি, বংশীয় আভিজাত্য ও অহংকারবোধকে আরবী পরিভাষায় আসাবিয়্যাহ বলা হয়। এই আসাবিয়্যাহ এর কুফল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর দিকে আহ্বান করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে যুদ্ধ করে। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৫১২১]

চার.

জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেনঃ হে লোক সকল শোনো, তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল তাকওয়ার কারণেই। [ইমাম আহমাদ, আল মুসনাদ, হাদিস নং ২৩৪৮৯]

কেন জাতীয়তাবাদ ক্ষতিকর?  

এক.

ইসলামের একটি মূলনীতি হলো আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ। জাতীয়তাবাদের ফলে এই মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়। 'আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা। একজন মুসলিমের প্রতি আরেকজন মুসলিমের ভালোবাসা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কাফির মুনাফিকদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। কোন পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের এই সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়। ভিনদেশের মুসলিমকে তখন আর আপন ভাবা যায় না। অন্যদিকে নিজ দেশের আল্লাহদ্রোহীর প্রতিও সহানুভূতি চলে আসে।

দুই.

জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে সমস্ত পৃথিবীর মুসলিমের অন্তরে কষ্ট অনুভূত হবে, এটিই ইসলামের শিক্ষা। অথচ জাতীয়তাবাদ আমাদের সেই অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছে। নিজ দেশের কিংবা নিজ জাতির মানুষ সুখে থাকলেই আমরা খুশি। আর এরূপ স্বার্থপরতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মূল শিক্ষা। বিংশ শতকের শুরুতে জাতীরাষ্ট্র ধারণা থেকেই আমাদের উম্মাহ চেতনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমরা আরব-তুর্কি, আরব-আফ্রিকান, তুর্কি-হিন্দুস্তানী এসব ভাবে ভাগ যুদ্ধ শুরু করেছি। সেই উম্মাহ ভেঙ্গে এখন বাঙালি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি জাতিতে ভাগ হয়ে গিয়েছি। 

তিন.

জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়। ইসলামে নিজ জাতিকে নিয়ে অহংকার কিংবা বংশ মর্যাদার গৌরব চরম নিন্দনীয়। ইসলাম এরূপ কর্মকে জাহেলি যুগের কর্ম বলে উল্লেখ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হলো তাকওয়া। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ, বংশ, জাতি, ভাষা, ভূখণ্ড ইত্যাদি মূল্যহীন। আল্লাহর রাসূল বিদায় হজ্বের ভাষণেও এই ধরণের জাতিভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।  

চার.

জাতীয়তাবাদ ন্যায় অন্যায় বোধকে নষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদের দাবিই হলো নিজের স্বজাতিকে সাহায্য করা হবে যদিও সে অন্যায় করে এবং অন্য জাতিকে সাহায্য করা হবে না যদিও তারা নিরপরাধ হয়। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা হবে, যদিও সে নিজ সম্প্রদায় কিংবা নিজ দেশের নাগরিক হয়।

বনু মুস্তালিকের যুদ্ধে এক মুহাজির ও এক আনসার সাহাবীর মধ্যে বিতর্ক শুরু হলে উভয়ই তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়কে ডেকে মারামারি করার জন্য উদ্ধত হলো। মুহাম্মদ সা. এই ধরণের কাজের কঠোর নিন্দা করেছেন এবং এই কাজকে জাহেলি দুর্গন্ধময় কাজ বলেছেন।

পলাশী ট্রাজেডি ও এর আফটারম্যাথ

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ও তার ধারাবাহিকতায় ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের রাজনীতি, আমাদের জাতিসত্তা ও আমাদের ইতিহাসকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। আমাদেরকে হীনমন্য করে তোলা হয়েছে। পলাশীর ট্র্যাজেডির ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের সম্মান, ডিগনিটি হারিয়ে একটি পরাজিত জাতিগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছি। দীর্ঘসময় ইংরেজদের শাসনে থাকায় আমরা নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে পশ্চিমাদের প্রজাতে পরিণত হয়েছি।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

পলাশীর যুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতা, ব্রিটিশদের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সর্বোপরি এক গভীর ষড়যন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, যা বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্তমিত করে দেয়।

১. হিন্দুস্থানের কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা

ü  হিন্দুস্থানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আওরঙ্গজেব পর্যন্ত শক্তিশালী ছিল। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলা আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে বাংলায় স্বাধীন নবাবী আমল শুরু হয়। নবাবী আমলে মূলত বাংলা রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হতে থাকে।

ü  মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন মোঘল শাসকদের সুবাদার (প্রশাসক)। তিনি নিজেকে ১৭১৭ সালে স্বাধীন নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা বা তথাকথিত স্বাধীনতাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। উম্মাহ চেতনা ধারণ না করে অহেতুক স্বাধীনতা ঘোষণাই মূলত পলাশী ট্র্যাজেডির মূল কারণ। 

ü  কেন্দ্রীয় শাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাধীন নবাবেরা ইংরেজ, ফরাসি, জগতশেঠ, মুশরিক সম্প্রদায় ইত্যাদি গোষ্ঠীদের সাহায্য নিতে থাকে, বিনিময়ে নিজের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করে।  

২. রাজনৈতিক পটভূমি:

ü  নবাবের শাসন: ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন আলিবর্দী খাঁর নাতি এবং তরুণ, উচ্চাভিলাষী শাসক। তাঁর শাসনকালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অর্থনীতি সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল।

ü  ইউরোপীয় প্রভাব: এ সময় ব্রিটিশ ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করছিল। ব্রিটিশরা কলকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দননগরে তাদের কুঠি স্থাপন করেছিল।

৩. নবাব ও ব্রিটিশদের মধ্যে উত্তেজনা:

ü  কলকাতার দুর্গ নির্মাণ: ব্রিটিশরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে শক্তিশালী করতে শুরু করে, যা নবাবের অনুমতি ছাড়াই করা হয়েছিল। এটি সিরাজউদ্দৌলার কাছে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি করে।

ü  বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব: ব্রিটিশরা নবাবের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ বাণিজ্য করছিল, যা নবাবের রাজস্বের উপর প্রভাব ফেলছিল।

ü  ফরাসিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ইউরোপে চলমান সাত বছরের যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) ভারতে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছিল। সিরাজউদ্দৌলা ফরাসিদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, যা ব্রিটিশদের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল।

৪. কালো কারাগারের ঘটনা:

ü  ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দখল করেন। এই সময় "কালো কারাগার" ঘটনা ঘটে, যেখানে ব্রিটিশ বন্দীদের একটি ছোট কারাগারে আটকে রাখা হয়, ফলে অনেকের মৃত্যু হয়। এটি ব্রিটিশদের মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা জাগায়।

৫. ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা:

ü  অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: সিরাজউদ্দৌলার শাসনের প্রতি বাংলার অভিজাত শ্রেণি, যেমন জগৎ শেঠ, মীর জাফর, রায় দুর্লভ প্রমুখ অসন্তুষ্ট ছিলেন। নবাবের তরুণ বয়স, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কঠোর নীতির কারণে তারা বিরক্ত হন।

ü  ব্রিটিশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র: ব্রিটিশরা, বিশেষ করে রবার্ট ক্লাইভ এবং ওয়াটসন, এই অসন্তোষকে কাজে লাগান। তারা মীর জাফরের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন, যিনি নবাবের সেনাপতি ছিলেন। মীর জাফরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করলে তিনি নতুন নবাব হবেন।

৬. যুদ্ধের প্রস্তুতি:

ü  ব্রিটিশ প্রতিশোধ: কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী ১৭৫৭ সালে বাংলায় ফিরে আসে। তারা চন্দননগরে ফরাসিদের পরাজিত করে এবং পলাশীর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

ü  নবাবের বাহিনী: সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল (প্রায় ৫০,০০০), কিন্তু তারা অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দুর্বল ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী ছিল মাত্র ৩,০০০ এর মতো, কিন্তু তারা সুশৃঙ্খল ও কৌশলগতভাবে প্রস্তুত ছিল।

৭. পলাশী যুদ্ধ (২৩ জুন, ১৭৫৭):

ü  যুদ্ধটি মুর্শিদাবাদের নিকট পলাশী গ্রামে সংঘটিত হয়। মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও অন্যান্য সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের বাহিনী কার্যকরভাবে যুদ্ধ করতে পারেনি। মীর জাফরের নেতৃত্বাধীন একটি বড় অংশ যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

ü  ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের কৌশলগত দক্ষতা ও আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই জয়লাভ করে।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাণী এলিজাবেথের রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে বণিকদের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল এবং এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়, যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই কোম্পানি গঠিত হয় পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলায় বৃটিশদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।

১. প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া:

ü  রাণী এলিজাবেথের রয়্যাল চার্টার: ৩১ ডিসেম্বর, ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ একটি রয়্যাল চার্টার জারি করেন। এই চার্টারের মাধ্যমে "The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies" নামে কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্টারটি কোম্পানিকে ১৫ বছরের জন্য পূর্ব ভারত (ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং অন্যান্য অঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে।

ü  প্রাথমিক কাঠামো: কোম্পানিটি একটি যৌথ-মূলধনী (joint-stock) প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত হয়। লন্ডনের ধনী বণিক ও অভিজাতরা এতে বিনিয়োগ করেন। একজন গভর্নর এবং ২৪ জন সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ (Court of Directors) দ্বারা কোম্পানি পরিচালিত হতো।

ü  মূলধন সংগ্রহ: প্রাথমিকভাবে ৭২,০০০ পাউন্ড মূলধন সংগ্রহ করা হয়, যা সে সময়ের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছিল। এই অর্থ বাণিজ্যিক অভিযানের জন্য জাহাজ, পণ্য এবং কর্মচারী নিয়োগে ব্যবহৃত হয়।

২. উদ্দেশ্য:

ü  মূলত বাংলা দখল করা

ü  মশলা (গোলমরিচ, লবঙ্গ, জায়ফল), রেশম, তুলা, নীল, চা এবং অন্যান্য পণ্য ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে আমদানি করা।

ü  ইউরোপীয় বাজারে এই পণ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন।

ü  পর্তুগিজ ও ডাচদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা।

৩. প্রাথমিক কার্যক্রম:

ü  প্রথম অভিযান: ১৬০১ সালে কোম্পানির প্রথম জাহাজ, স্যার জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের নেতৃত্বে, ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা করে। তারা ইন্দোনেশিয়ার মশলা দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্য শুরু করে।

ü  বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন: ১৬১২ সালে ভারতের সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি (factory) স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে মাদ্রাজ (১৬৩৯), বোম্বে (১৬৬৮), এবং কলকাতায় (১৬৯০) কুঠি স্থাপিত হয়।

ü  মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক: ১৬১৫ সালে স্যার থমাস রো মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে গিয়ে বাণিজ্যের অনুমতি পান, যা কোম্পানির জন্য ভারতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি করে।  

৪. বিকাশ ও ক্ষমতার বিস্তার:

ü  সামরিক শক্তি: প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও, কোম্পানি ধীরে ধীরে সামরিক শক্তি গড়ে তোলে। তারা নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ও জাহাজ তৈরি করে এবং দুর্গ নির্মাণ করে।

ü  রাজনৈতিক প্রভাব: পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)-এর পর কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে তারা রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার পায়।

 

পলাশীর যুদ্ধ

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম বাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেয়। এটি ছিল একটি যুদ্ধ, যা অস্ত্রের শক্তির চেয়েও বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিচে তুলে ধরা হলো:

নবাবের জন্য চ্যালেঞ্জ

১. নবাব পরিবারে একতা ছিল না। নবাবের নিজ পরিবারের একটি অংশ প্রকাশ্যেই তার বিরোধী ছিলো।

২. ইংরেজরা তাদের ১৫০ দেড় শতাধিক বছরের মিশন বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো।

৩. সিরাজের সেনাবাহিনী পুরোপুরি তার অনুগত ছিল না

৪. মুশরিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইংরেজদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছে

৫. হিন্দু আমলারাও ইংরেজদের সহায়তা করেছে 

যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি ও সৈন্য সমাবেশ

ü  নবাবের শিবির: নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য (৩৫,০০০ পদাতিক এবং ১৫,০০০ অশ্বারোহী), ৪০টির বেশি কামান এবং কিছু ফরাসি গোলন্দাজ সৈন্য নিয়ে পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর আলী খান। এছাড়া তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন মীর মদন এবং মোহনলাল।

ü  ব্রিটিশ শিবির: অন্যদিকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিলেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল নিতান্তই কমমাত্র ৩,০০০, যার মধ্যে প্রায় ৮০০ ইউরোপীয় এবং ২২০০ দেশীয় সিপাহী ছিল। তাদের সামান্য কয়েকটি কামান ছিল, তবে সেগুলো ছিল বেশ আধুনিক ও উন্নত।

ü  ক্লাইভের মূল শক্তি ছিল তার সামরিক কৌশল এবং নবাবের শিবিরের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস। তিনি আগেই নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফ খানের সাথে এক গোপন চুক্তি করেছিলেন।

যুদ্ধের দিন (২৩শে জুন, ১৭৫৭)

ü  সকালের সূচনা:

যুদ্ধ শুরু হয় সকাল ৮টার দিকে। নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদনের নেতৃত্বে নবাবের বাহিনী ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তাদের তীব্র আক্রমণে ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ক্লাইভ তার সৈন্যদের আমবাগানের আড়ালে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেন। মোহনলালের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যরাও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছিল।

ü  যুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা:

দুপুরের দিকে যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলেই ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী প্রাথমিক আক্রমণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু দুটি ঘটনা যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেয়:

১. মীর মদনের মৃত্যু: দুপুর নাগাদ হঠাৎ এক গোলার আঘাতে নবাবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং দক্ষ সেনাপতি মীর মদন নিহত হন। এই ঘটনা নবাবের সৈন্যদের মনোবলে প্রচণ্ড আঘাত হানে এবং তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

২. মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা: সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যুর পর নবাব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং মীরজাফরের পরামর্শ চান। মীরজাফর নবাবকে ধোঁকা দিয়ে দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। তিনি নবাবকে বোঝান যে, সৈন্যরা ক্লান্ত এবং পরদিন সকালে নতুন করে আক্রমণ করা যাবে। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। নবাব তার প্রধান সেনাপতির কথায় বিশ্বাস করে যুদ্ধ থামাতে রাজি হন। 

ü  চূড়ান্ত আক্রমণ ও পরাজয়:

নবাবের আদেশে তাঁর সৈন্যরা যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের শিবিরে ফিরে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লাইভ তার সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিষ্ক্রিয় নবাব বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মীরজাফর, রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের অধীনস্থ নবাবের সেনাবাহিনীর একটি বিশাল অংশ কোনো প্রতিরোধ না করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।

কেবলমাত্র মোহনলালের অধীনস্থ ক্ষুদ্র একটি সেনাদল শেষ পর্যন্ত বীরের মতো লড়াই চালিয়ে যায়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার সামনে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। নবাবের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে। 

ü  নবাবের পলায়ন ও পরিণতি:

বিকেল ৫টার দিকে যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের পরাজয় আসন্ন দেখে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রায় ২,০০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে পালিয়ে যান। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিমের নির্দেশে তাকে ধরা হয় এবং ২রা জুলাই মোহাম্মদী বেগ নামক এক ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

পলাশী যুদ্ধের ফলাফল

ü  পরাজয় ও মৃত্যু: নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শোচনীয় পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে।

ü  ক্ষমতা দখল: চুক্তি অনুযায়ী, রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলার মসনদে বসান। মীরজাফর "বিশ্বাসঘাতক" হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেন।

ü  ব্রিটিশ শাসনের সূচনা: এই যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা নামে নবাবকে সিংহাসনে বসালেও প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতেই চলে যায়।

ü  অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশরা মীরজাফরের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ লাভ করে এবং বাংলায় অবাধে বাণিজ্যিক শোষণের পথ খুলে যায়, যা পরবর্তীতে "কোম্পানির রাজ" বা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

ü  পলাশীর যুদ্ধকে তাই কেবল একটি যুদ্ধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি ছিল একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, যা ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ওপর ভিত্তি করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত করে দিয়েছিল।

যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর যা করেছে ইংরেজরা

১. পাপেট নবাব তৈরি করেছে

২. উচ্চ করআরোপ করে জাতিকে দারিদ্রতা ও দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি করেছে 

৩. সকল কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে

৪. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে

৫. অন্যান্য বিদেশী ব্যসায়ীদের বাংলা ছাড়া করেছে

৬. ইংরেজরা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।

(টেক্সটাইল, জাহাজ, যুদ্ধাস্ত্র, কৃষি ভিত্তিক শিল্প (শোরা, লবণ, চিনি, চাল))

৭. শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস (উচ্চশিক্ষা বন্ধ, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, শিক্ষকদের হত্যা, শ্রমিক ও কৃষিতে বাধ্য করা, লর্ড মেকলের পাশ্চাত্য শিক্ষা, সেক্যুলার শিক্ষা, আলিয়া, দেওবন্দ)

৮. সকল কৃষি ও বস্ত্র ব্যবসাতে আধিপত্য তৈরি করেছে

পলাশী ট্র্যাজেডির কারণ

১. উম্মাহ চেতনা বাদ দিয়ে স্বাধীনতার অহেতুক নেশা

২. মুশরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় একীভূত করা

৩. বিদেশীদের অনুপ্রবেশ করানো

৪. ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম

৫. সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন