১৭ এপ্রি, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৮ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!



বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত। 
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব 
২. আদল ও ইনসাফ 
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র) 
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা 
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা 

আমরা গত তিন পর্বে ১ থেকে ৪ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৫ নং মূলনীতি 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা' নিয়ে আলোচনা করবো। 

রাষ্ট্র পরিচালনা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহীতা না থাকা মানে শাসক স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তাই শাসককে স্বৈরাচার হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য জবাবদিহীতা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল জবাবদিহিতার অনুভূতির দুর্বলতা। 

১. আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে (ক্বিয়ামতের দিন) দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। আখেরাতে কঠিন শাস্তির ভয়ে সে সদা কম্পবান থাকে। কেননা সে জানে যে, সেদিন ‘যার ওযনের পাল্লা হালকা হবে’, ‘তার ঠিকানা হবে ‘হাভিয়াহ’। ‘তুমি কি জানো তা কি?’ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি’ (ক্বারে‘আহ ১০১/৮-১১)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন ওযনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই হযরত ওমর (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে বলতে গেলে ঘুমাতেন না। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহ’লে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহ’লে প্রজাদের ধ্বংস করলাম। কেননা আমি তাদের উপর দায়িত্বশীল।  (মাক্বরীযী, আল-খুত্বাত্ব ১/৩০৮)। 

২. জবাবদিহিতার অনুভূতি ও দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। একদিন তিনি প্রচন্ড সূর্যতাপে ছাদাক্বার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামীমের নেতা আহনাফ বিন ক্বায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আসেন। যখন তারা নিকটবর্তী হ’লেন, তখন খলীফা ওমর আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় ছেড়ে দ্রুত এস এবং এই উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। কেননা এগুলি ছাদাক্বার উট। এর মধ্যে ইয়াতীম-মিসকীন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি ছাদাক্বা খাতের কোন একজন গোলামকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, আমার চাইতে ও আহনাফের চাইতে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন দায়িত্বে থাকে তার উপরে ঐরূপভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে একজন মনিবের প্রতি গোলামের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব’ (ইবনুল জাওযী, তারীখু ওমর ৮৯ পৃ.)।

৩. ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে যে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হ’ল এই যে, তার জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? তার যৌবন সে কোন কাজে জীর্ণ করেছে? সে কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? সে যা ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না?’ (তিরমিযী হা/২৪১৬)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে যদি প্রজাদের উপরে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তাদের উপর খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (বুঃ মুঃ)। কেবল শাসকই নন, বরং যেকোন দায়িত্বশীলের জন্য একই হুকুম।

৪.  রাসূল (সা.) বলেন, ‘মনে রেখ তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের উপরে দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। সে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃ মুঃ)। 

৫. আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তাদের কৃতকর্ম বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের যবান এবং তাদের হাত ও পা’ (নূর ২৪/২৪)। এমনকি প্রত্যেকের দেহচর্ম ও ত্বক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)। অতএব হে মানুষ! অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীদের থেকে সাবধান হও। হে দায়িত্বশীলগণ! ক্বিয়ামতের দিন নিজের আমলনামা নিজে পাঠ করার জন্য প্রস্ত্তত হও (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৪)। 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম ইসলামে জবাবদিহীতার গুরুত্ব কতটা বেশি!। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে আমরা তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা যুক্ত করতে চাই। সংবিধানের মূলনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা থাকা মানে হলো, 
১. সরকারপ্রধান তার সকল কাজ, সিদ্ধান্ত ও চুক্তির বিষয়ে জনগণের সামনে স্বচ্চ থাকবে। 
২. যে কোনো সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডের ব্যাপারে জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য থাকবে। 
৩. সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় জনগণের সামনে উন্মূক্ত থাকবে।  
৪. সরকার ও সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সংবিধান এমন কোনো স্বাধীনতা দিবে না যে, তারা যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
৫. রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন ব্যাক্তিগণ নিজেকে জনগণের সেবক ভাবতে বাধ্য থাকবেন। 
৬. দুর্নীতির সয়লাব বন্ধ হবে। 
৭. স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। 



১৬ এপ্রি, ২০২৫

ভারতের ওয়াকফ সংশোধনী বিল ও বিজেপি'র ষড়যন্ত্র


ভারতের পার্লামেন্টে সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ নিয়ে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি খোদ ভারতের বিরোধী দলের নেতারাও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। বলা হচ্ছে, এ আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রের মতো ধর্মীয় সম্পদগুলোয় সরকারি হস্তক্ষেপ ও দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতের লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, লোকসভায় পাসকৃত বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানা ও অধিকার হরণে বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টারই আরেকটি বহিঃপ্রকাশ।

ওয়াকফ সম্পত্তি কী?
মুসলিমদের কল্যাণে মুসলিমদের বরাদ্দ করা সম্পত্তিকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিজমি, দালানকোঠা, দরগাহ/মাজার ও কবরস্থান, ইদগাহ, খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ, প্লট, পুকুর, স্কুল, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ওয়াকফের প্রচলন ১২শ শতকে শুরু হয়, যখন মুসলিম শাসক মুহাম্মদ ঘোরি হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দুটি গ্রাম ওয়াকফ হিসেবে একটি লিখিত অনুদানের মাধ্যমে দান করেন। দিল্লি সালতানাতের শাসনামলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। যেখানে ইলতুতমিশ, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ও আলাউদ্দিন খলজি ওয়াকফ সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সময় ওয়াকফ ব্যবস্থার আরও প্রসার ঘটে।
আকবর ও শাহজাহান গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি ওয়াকফ করেন, যার মধ্যে তাজমহলও রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসার ও ধর্মান্তরের ফলে এই ব্যবস্থার বিস্তার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াকফের জন্য অর্থায়ন মূলত ওয়াকফকৃত গ্রামের রাজস্ব থেকে আসত, যা প্রায়ই হিন্দুপ্রধান গ্রাম ছিল এবং এই অর্থ মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য ব্যবহার করা হতো।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও সংগঠিত ও আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়, যা বর্তমান ভারতীয় আইনের অধীন এখনো প্রযোজ্য। ১৯১৩ সালে ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়, এবং ১৯২৩ সালে "মুসলমান ওয়াকফ আইন" প্রণয়ন করা হয়, যা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলোর কার্যক্রম ও সুষ্ঠু প্রশাসনের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করত। ওয়াকফ হল মুসলিম আইনে স্বীকৃত একটি স্থায়ী দান, যেখানে অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করা হয়। এই অনুদানকে "মুশরুত-উল-খিদমত" বলা হয়, এবং যিনি এই দান করেন তাকে "ওয়াকিফ" বলা হয়।

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫
ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ ভারতীয় লোক সভায় ২০২৪ সালে ৮ই আগস্ট পেশ করা হয়। এই বিলে ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওয়াকফ বোর্ড কতটুকু জমি আছে?
হিন্দুস্থানে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি আছে। ৯.৪ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে ওয়াকফ। যার আনুমানিক মূল্য ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ওয়াকফ বোর্ড ভারতীয় রেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরে তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক। মূলত এটাই বিজেপির মাথাব্যাথার কারণ। মুসলিমদের কল্যাণে ব্যবহার হওয়া এই বিপুল সম্পত্তি হস্তগত ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য ওয়াকফ সংশোধনী বিল আনা হয়েছে।

বিজেপি সরকার কেন ওয়াকফ আইন সংশোধন করছে?
১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিলে বলা হয়েছিল, ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের সম্পত্তি জেলা কালেক্টরদের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে, যাতে তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন নিশ্চিত হয়। বর্তমানে, ওয়াকফ বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হন, তবে নতুন বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পরে সমস্ত সদস্যকে সরকার মনোনীত করবে। আশঙ্কা রয়েছে যে এই বিধানটি ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বোর্ডের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে। নতুন বিলে বলা হয়েছে, একজন অমুসলিমও সিইও হতে পারবেন এবং কমপক্ষে দুজন সদস্য অমুসলিম হতে হবে।

বর্তমান ওয়াকফ বিলের ৪০ নম্বর ধারার আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের দখল করা সম্পত্তি বা জমিতে কোনো রকম সরকারি পর্যালোচনা বা রিভিউ করা যায় না। পর্যালোচনা ছাড়াই ওয়াকফ বোর্ড সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো সম্পত্তি নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ওয়াকফ বোর্ডের আইনি বিবাদ চললেও তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার। সংশোধিত বিলে সরকার মূলত ওয়াকফ অধিকার খর্ব করতে চাইছে। বিতর্কিত কোনো সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তাও খতিয়ে দেখার আইনি এক্তিয়ার সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে।

এর মাধ্যমে একাধিক ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করা হতে পারে। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনো অফিসারের হাতে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব। পুরোনো আইন অনুযায়ী কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করলে চিরদিনের জন্য সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবেই থেকে যেত। নতুন বিল পাস হলে এবার সেটাকেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ফলে যে সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের বলে ঘোষণা করে, তাতে ইসলামিক ধর্মস্থান বা অন্য কোনো ইসলামিক প্রার্থনাস্থল তৈরি হলেও সেটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করা যেতে পারে।

সমালোচকরা বলছেন, নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের (মূলত হিন্দুদের) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে কোনটা হবে না সরকারকে তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ ওয়াকফকৃত সম্পদ পরিচালনা ও ভোগের একমাত্র হকদার মুসলমানরা। এই বিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওয়াকফ আইনকে দুর্বল করে দেওয়া এবং ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও দখল করার আইনি পথ তৈরি করা।


৫ এপ্রি, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৭ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!

বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

আমরা গত দুই পর্বে ১ থেকে ৩ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৪ নং মূলনীতি 'মানবতা' নিয়ে আলোচনা করবো।

মানবতা মানে হলো একজন মানুষ পৃথিবীতে মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা। মানুষের জন্য সংবিধান কখনোই মানবতা বা ইনসানিয়াতের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।

১। জীবনের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকার

কুরআন মজীদে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি ছিলো মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম দুঃখজনক ঘটনা। সেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথম বারের মতো তখনই প্রয়োজন দেখা দেয় মানুষকে মানুষের প্রাণের মর্যাদা শেখানোর এবং একথা বলে দেয়ার যে, প্রত্যেক মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ ঘটনার উল্লেখ করার পর কুরআন বলছেঃ

“কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো গোটা মানব জাতিকে বাঁচালো।” (আল মায়েদাঃ আয়াত-৩২)

কুরআন মজীদ এ আয়াতে একজন মানুষের অন্যায় হত্যাকে গোটা মানব জাতির হত্যা বলে উল্লেখ করেছে। আবার একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে।

অন্য কথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে গোটা মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে। এ ধরনের প্রচেষ্টা এতো বড় কল্যাণের কাজ যে, এটাকে গোটা মানবতাকে জীবিত করার সমান গণ্য করা হয়েছে। কেবল দু’টি অবস্থায় এ নীতির ব্যতিক্রম করা যাবেঃ

একঃ কোনো ব্যক্তি হত্যার অপরাধে অপরাধী হলে কিসাস নেয়ার জন্য (বিচারের মাধ্যমে) তাকে হত্যা করা যাবে।

দুইঃ কোনো ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করলে তাকেও হত্যা করা যাবে (বিচারের মাধ্যমে)।

এ দু’টি ব্যতিক্রমী অবস্থা ছাড়া আর কোনো অবস্থায়ই মানুষ হত্যা করা যাবে না।

মানব ইতিহাসের প্রাথমিক যুগেই মহান আল্লাহ মানব জীবনের নিরাপত্তা বিধানের এ নীতি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন। অসভ্যতার অন্ধকারের মধ্যে মানুষের জন্ম, এমন ধারণা পোষণ করা ভুল। মানুষ তার আপন প্রজাতি অর্থাৎ অন্য মানুষকে হত্যা করতে করতে কোনো এক পর্যায়ে পৌছে চিন্তা করে যে, মানুষকে হত্যা করা ঠিক নয়, এ ধারণাও একেবারেই ভ্রান্ত। এটা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত। কুরআন আমাদের বলে, মহান আল্লাহ প্রথম থেকেই মানুষকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে মানুষের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

২। নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন এবং রসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে স্পষ্ট জানা যায়ঃ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও অসুস্থ মানুষ নিজ জাতির লোক হোক কিংবা শত্রু কওমের লোক, কোনো অবস্থায়ই তাদের উপর আঘাত করা বৈধ নয়। তবে তারা যুদ্ধরত থাকলে ভিন্ন কথা। তা না হলে অন্য যে কোনো অবস্থায়ই তাদেরকে আঘাত করা নিষিদ্ধ। এ নীতি শুধু নিজ জাতির জন্য নয়। বরং গোটা মানবতার জন্যেই এ নীতি প্রযোজ্য।

মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন শত্রুর বিরুদ্ধে কোনো সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় গোটা সেনাদলকে সম্বোধন করে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতেনঃ ‘শত্রুর উপর আক্রমণের সময় কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, আহত, পঙ্গু ও রুগ্ন ব্যক্তিকে আঘাত করবে না।’

শুধু তাই নয়, আল্লাহ তায়ালা মু'মিনদের নির্দেশ দিয়েছেন অসহায় মানুষদের উদ্ধার করার জন্য। তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। (সূরা নিসাঃ৭৫)

৩। মহিলাদের মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন মজিদ থেকে আরো একটি মৌলিক অধিকারের কথা জানা যায়। এটি সম্পর্কে হাদিসেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সেটি হলো, নারীদের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সর্বাবস্থায় অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ ক্ষেত্রেও যদি শত্রু কওমের নারীরা মুসলমান সৈনিকদের হস্তগত হয় তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা কোনো মুসলমান সৈনিকের জন্যে বৈধ নয়। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যে কোনো নারীর সাথে ব্যভিচার হারাম। সে নারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম। স্বজাতির হোক বা বিজাতির। বন্ধু দেশের হোক বা শত্রু দেশের-তাতে কিছু আসে যায় না।

৪। ন্যায় আচরণ লাভের অধিকার
কুরআন মজীদ একটি অলংঘণীয় নীতি প্রদান করেছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ
“কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা দলের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যোনো তাদের প্রতি বে-ইনসাফী করতে উৎসাহিত না করে। ইনসাফ করো এটি তাকওয়ার সর্বাধিক নিকটবর্তী।” (সুরা ৫ মায়েদাঃ আয়াত ৮)

এ আয়াতটিতে ইসলাম একটি নীতি ঠিক করে দিয়েছে। তাহলো, মানুষের সাথে-সে ব্যক্তি হোক বা গোষ্ঠী, সর্বাবস্থায় ইনসাফ করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ নীতি মোটেই ঠিক নয় যে, আমরা বন্ধুদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ করবো আর শত্রুর সাথে আচরণের ক্ষেত্রে এ নীতি পরিহার করবো।

৫। ভালো কাজে সহযোগিতা এবং মন্দ কাজে অসহযোগিতা
কুরআন আরো একটি মূলনীতি দিয়েছে। তা হলো, ভালো ও ন্যায়ের কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করা এবং অন্যায় ও যুলুমের কাজে কারো সাথে সহযোগিতা না করা। ভাইও যদি মন্দ কাজ করে তাহলে আমরা তার সাথেও সহযোগিতা করবো না। আর কল্যাণের কাজ যদি শত্রুও করে তাহলে তাকেও সহযোগিতা করবো। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“কল্যাণমূলক কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং পাপ কাজে কারো সাথে সহযোগিতা করোনা” ( আল কুরআন, সূরা ৫: আয়াত ২)

৬। সমতার অধিকার
আরেকটি নীতি কুরআন মজীদ অত্যন্ত জোরালোভাবে বলে দিয়েছে। নীতিটি হলো, সমস্ত মানুষ সমান। কেউ মর্যাদা লাভ করলে তা করবে উত্তম নৈতিক চরিত্রের কারণে। এ ব্যাপারে কুরআন ঘোষণা করেছেঃ
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি - যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি আল্লাহভীরু সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান।” (সুরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১৩)

এ আয়াতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো সমস্ত মানুষের জন্ম-উৎস এক। ভিন্ন ভিন্ন বংশধারা, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রকৃতপক্ষে মানব বিশ্বকে বিভক্ত করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হতে পারেনা।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হলো, ‘আমি মানব সমাজকে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি শুধু তাদের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য।’ অন্য কথায় একটি গোষ্ঠী, একটি জাতি এবং একটি গোত্রের অন্যদের উপর মর্যাদা ও গৌরবের এমন কিছু নেই যে, তা নিজেদের অধিকার বাড়িয়ে দেবে এবং অন্যদের কমিয়ে দেবে।

আল্লাহ তা’য়ালা যে সব পার্থক্য করেছেন অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দান করেছেন এবং পরস্পরের ভাষা আলাদা করেছেন, এসব পার্থক্য গর্ব প্রকাশ করার জন্যে নয়। বরং এ জন্যে করেছেন যাতে করে পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ের পার্থক্য করা যায়। যদি সব মানুষ একই রকম হতো তাহলে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা যেতো না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ বিভক্তি স্বাভাবিক। তবে এটা অন্যের অধিকার নস্যাত করা এবং বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে নয়। মর্যাদা ও গৌরবের ভিত্তি হলো উন্নত নৈতিক চরিত্র। এ বিষয়টি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলে দেনঃ

“কোনো আরবের কোনো অনারবের উপর এবং কোনো অনারব কোনো আরবের উপর এবং কোনো সাদা বর্ণের কোনো কালো বর্ণের মানুষের উপর এবং কোনো কালো বর্ণের কোনো সাদা বর্ণের মানুষের উপর কোনো প্রকার মর্যাদা নেই একমাত্র তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি ছাড়া। বংশের ভিত্তিতে কারো কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।”

অর্থাৎ- মর্যাদার ভিত্তি শুধু উন্নত নৈতিক চরিত্র এবং আল্লাহভীতি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, কোনো মানুষকে রৌপ্য, কোনো মানুষকে পাথর আবার কোনো মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বরং সমস্ত মানুষ পরস্পর সমান।

৭। রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের অধিকার

মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সমূহের মধ্যে ইসলাম একটি বড় অধিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাহলো সমাজের সমস্ত মানুষের রাজনৈতিক ও সরকারী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণের অধিকার। ইসলাম কোনো সমাজের মানুষকে উচু ও নীচু বা শাসক ও শাসিত হিসেবে বিভক্ত করার পক্ষপাতি নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষের পরামর্শক্রমে সরকার গঠিত হবে। কুরআন বলেছেঃ
لِـيَـسـتَـخـلِـفَـنَّـهُـم فِـى اَلارضِ
‘আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে-অর্থাৎ ঈমানদারদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন।’ (আল কুরআন, সূরা নূর, আয়াত-৫৫) এখানে আল্ল্লাহ বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন আমি কিছু সংখ্যক লোককে নয় বরং গোটা জাতিকে খিলাফত দান করবো। সরকার শুধু এক ব্যক্তির, এক পরিবারের কিংবা একটি শ্রেণীর হবে না। বরং তা হবে গোটা জাতির এবং সব লোকের পরামর্শের ভিত্তিতে তা অস্তিত্ব লাভ করবে। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ
شُـورى بَـيـنَـهُـم وَاَمـرُهُـم
অর্থাৎ ‘এ সরকার সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করবে।’ (আল-কুরআন, সূরা শুরাঃ আয়াত-৩৮। এ ছাড়া দেখুন- সূরা নিসাঃ আয়াত-১৫৯)

এ ব্যাপারে হযরত উমর রা· -এর সুস্পষ্ট মতামত বিদ্যমান। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া তাদের সরকার পরিচালনা বা তাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার কারো নেই। মুসলমানরা সম্মত হলে তাদের সরকার পরিচালনা করা যাবে। তারা সম্মত না হলে তা করা যাবে না। এ বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ও পরামর্শ ভিত্তিক সরকার গঠনের নীতি অনুমোদন করে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের ঘাড়ে রাজতন্ত্র চেপে বসেছিল।

৮। ব্যক্তি মালিকানার নিরাপত্তা
আর একটি মৌলিক অধিকার হলো মানুষের ব্যক্তি মালিকানার অধিকার। এ ব্যাপারে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করেছে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেনঃ وَلا تَـا كُـلُـوا اَمـوَالَـكُـم بَـيـنَـكُـم بِـالـبَـاطِـلِ ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের অর্থ-সম্পদ ভোগ দখল করো না।’ (সূরা ১ আল বাকারাঃ আয়াত ১৮৮)

কুরআন, হাদিস ও ফিক্‌হ অধ্যয়ন করলে অপরের অর্থ সম্পদ ভোগের অন্যায় পন্থা কি কি তা জানা যায়। এসব অবৈধ পন্থা ইসলাম অস্পষ্ট রেখে দেয়নি। এ নীতি অনুসারে কোনো ব্যক্তির সম্পদ অবৈধভাবে হস্তগত করা যায় না।

স্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে ইসলাম সম্পদ লাভের যেসব নিয়ম-নীতি ও পন্থা-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তা ভংগ করে কারো ব্যক্তি মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা সরকারের নেই।

৯। মান-সম্মানের নিরাপত্তার অধিকার

মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভ করাও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ অধিকার সম্পর্কে কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলছেনঃ

একঃ لا يَـسـخَـر قَـومٌ مّـن قَـومِ 'তোমাদের মধ্যকার একদল যেন আরেক দলকে নিয়ে হাসি-তামাশা বিদ্রুপ না করে।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
দুইঃ وَلا تَـنَـابَـزُوا بِـالالـقَابِ ‘তোমরা একজন অন্যজনকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
তিনঃ وَلا يَـغـتَـب بَـعـضُـكُـم بَـعـضًا ‘তোমরা একে অপরের নিন্দা (অসাক্ষাতে) করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১২)

অর্থাৎ মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের উপর আক্রমণ করার যতো উপায় ও পন্থা হতে পারে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, কোনো মানুষ সে সামনে উপস্থিত থাক বা না থাক তাকে নিয়ে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশা করা যাবে না, তাকে মন্দ নামে আখ্যায়িত করা যাবে না এবং তার নিন্দাবাদও করা যাবে না। কেও কারো মর্যাদার উপর আঘাত করবেনা। হাত ও মুখের দ্বারা কারো উপর কোনো প্রকার যুলুম করবে না। এটা প্রতিটি মানুষের আইনগত অধিকার।

১০। ব্যক্তিগত জীবনে গোপনীয়তার নিরাপত্তা

ইসলামের দেয়া মৌলিক অধিকার অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যক্তিগত জীবনকে নিরাপদ রাখার অধিকার রাখে। এ ব্যাপারে কুরআনে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।
‘তোমাদের নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করোনা যতোক্ষণ না তাদের সাগ্রহ সম্মতি পাও।’( আল কুরআন, সূরা ২৪ নূরঃ আয়াত-২৭)

কুরআনে বলা হয়েছে لا تَـجَـسَّـسُـو অর্থাৎ- অপরের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১২) নবী সা· বলেছেনঃ ‘নিজের ঘর থেকেও অন্যের ঘরে উঁকি দেয়ার অধিকার কারো নেই।’

নিজের ঘরে বসে অন্য কোনো লোকের শোর-গোল, উঁকি-ঝুঁকি ও হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকার পূর্ণ আইনগত অধিকার যে কোনো মানুষের আছে। যে কোনো ব্যক্তির খোলামেলা পারিবারিক পরিবেশ ও গোপনীয়তা বজায় থাকার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া কারো চিঠি-পত্র পড়াতো দূরের কথা উপর থেকে দৃষ্টি দিয়ে দেখার অধিকারও কারোর নেই। ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার পুরোপুরি নিরাপত্তা দেয় এবং অন্যের ঘরে উঁকি-ঝুঁকি মারতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করে। একইভাবে ডাকে আসা কারো জিনিস পত্রও দেখা যাবে না। তবে কারো ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় যে, সে বিপজ্জনক কাজ-কর্মে লিপ্ত আছে তা হলে ভিন্ন কথা। কারো দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয়।

১১. স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার

মানুষের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার (Freedom of expressian) অধিকার। কুরআন এটাকে বলেছে, ‘আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার (امـر بـالـمـعـروف ونـهـى عـن الـمـنـكر)’। এটা মানুষের শুধু অধিকারই নয় বরং এটা তার জন্য কুরআন ও হাদিস উভয়ের নির্দেশ অনুসারেই ফরয।(কুরআন বলেঃ كُـنـتُـم خَـيـرَ اُمَّـةٍ اُخـرِجَـت لِلـنَّـاسِ تَـامُـرُونَ بِـالـمَـعـرُوفِ وَتَـنـهَـونَ عَـنِ الـمُـنـكَـرِ- النساء:110 ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাহ। মানবতার কল্যাণের জন্যে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা মারূফ (ভালো) কাজের আদেশ করবে এবং মুনকার (মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে।’) মানুষের জন্য ফরয (কর্তব্য) হলো সে অন্য মানুষকে ভালো বা কল্যাণের কাজের জন্য আহবান জানাবে এবং মন্দ বা অকল্যাণের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।

কোনো মন্দ বা অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে থাকলে তার বিরুদ্ধে সে শুধু সোচ্চারই হবে না, বরং তা বন্ধ করার চেষ্টা করাও তার জন্য ফরয। এ ধরনের কাজের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রতিবাদ না করা হয় এবং বন্ধ করার জন্য চিন্তা-ভাবনা না করা হয় তা হলে অপরাধ হবে। ইসলামী সমাজকে পূত-পবিত্র রাখা মুসলমানের কর্তব্য। এ ব্যাপারে মুসলমানদের কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর নেই।

কেউ যদি কোনো কল্যাণমূলক কাজে বাধা দেয় তাহলে সে শুধু একটি মৌলিক অধিকারকেই হরণ করলো না, বরং একটি ফরয পালনেও বাধার সৃষ্টি করলো। সমাজ দেহের সুস্থতা বজায় রাখতে একজন মানুষের সর্বাবস্থায় এ অধিকার থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন ইসরাঈলীদের পতনের যেসব কারণ বর্ণনা করেছে তার মধ্যে একটি হলো, তারা একে অপরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতো না। (আল কুরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত-৭৯)

১২. স্বাধীন বিবেক ও বিশ্বাসের অধিকার
ইসলাম দিয়েছে لا اِكـرَاهَ فِـى الـدّيـنِ (দীনের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তির অবকাশ নেই) -এর নীতি। এ নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি কুফরি বা ঈমান এ দু’টি পথের যে কোনোটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা রাখে। বিবেক ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন থাকলে দু’টি ক্ষেত্রেই তা আছে।

একঃ ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও তার স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবিলার ক্ষেত্রে এবং
দুইঃ আইন-শৃঙ্খলা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য অপরাধ ও ফিৎনা-ফাসাদ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে।

১৩. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত থেকে বাঁচার অধিকার
বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করুক এবং একে অপরের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করুক ইসলাম তার পক্ষপাতী নয়। কুরআন প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস এবং তার ধর্মীয় নেতাদের মর্যাদা দিতে শিখিয়েছে। কুরআন বলেঃ وَلا تَـسُـبُّـوا الَّـذِيـنَ يَـدعُـونَ مِـن دُونِ الـلّهِ ‘তারা আল্লাহ ছাড়া আর যেসব বস্তুকে উপাস্য বানিয়ে ডাকে তোমরা তাদের (সেসব উপাস্যকে) গাল মন্দ করো না।’ (আল কুরআন, সূরা ৬ আল আনআম। আয়াতঃ ১০৮)

অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কথা বলা এবং তার যুক্তিসংগত সমালোচনা করা অথবা মতানৈক্য প্রকাশ করা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার জন্য কটুক্তি বা গাল-মন্দ করা অন্যায়।

১৪. অপরের কর্মকান্ডের দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির অধিকার
ইসলাম বলে, মানুষ শুধু নিজের কাজকর্ম এবং নিজের কৃত অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্য কারো অপরাধ বা কৃতকর্মের জন্য তাকে পাকড়াও করা যাবেনা।
কুরআন প্রদত্ত মৌলনীতি হলোঃ
وّزرَ اُخـرَى. الانـعام : 164 وَلا تَـزِرُ وَازِرَةٌ
“কোনো বোঝা বহনকারী অন্য কারো বোঝা বহন করবে না” (সুরা ৬ আল আন’আমঃ আয়াত ১৬৪)। ইসলামী আইনে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।

১৫. সন্দেহের শিকার হওয়া থেকে মুক্ত থাকার অধিকার
নিরঙ্কুশভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে সন্দেহ বশতঃ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এ ব্যাপারে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ হলো, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখো। অজ্ঞতা প্রসূত কোনো ব্যবস্থা যেনো তার বিরুদ্ধে গ্রহণ না করো। কুরআন নির্দেশ দেয়ঃ
اَجـتَـنِـبُـوا كَـثِـيـرًا مّـن الـظَّـنّ
অর্থঃ ‘ধারণা প্রসূত বেশিরভাগ বিষয় থেকে বিরত থেকো।’ (সূরা ৪৯ আল হুজুরাতঃ আয়াত ১২)

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে মানবতা থাকার মানে হলো
১. মানুষের অধিকার নষ্ট হয় এমন কোনো আইন বা বিধান সংবিধানে অন্তঃর্ভুক্ত হবে না।
২. মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো বিধান বাতিল হবে
৩. মানুষ তার মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে এদেশে বসবাস করতে পারবে।


২৫ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৬ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!



বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

আমরা গতকাল ১ নং ও ২ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৩ নং অর্থাৎ শুরাভিত্তিক শাসন নিয়ে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। শুরাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা অনেকটা গণতন্ত্রের অনুরূপ।

রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি হলো পরামর্শ এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘আর মুসলমানদের কাজকর্ম [সম্পন্ন হয়] পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’’[সূরা শুরাঃ ৩৮] ‘‘হে নবী! কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’[সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯]

হযরত আলী রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-কে জিজ্ঞাসা করি, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোনে বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো? তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে দ্বীনের জ্ঞানসম্পন্ন এবং আবেদ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করো এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবে না।’’ হযরত উমর রা. বলেন, ‘‘মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের [ইমারাত] প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭।

হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির জোর পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্মক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মতের উচিত নয়।] অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তি বর্ণিত আছে, ‘‘পরামর্শ ব্যতীত কোনো খেলাফত নেই।’’[২৪. কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩৫৪।]

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদিও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পরামর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও আল্লাহ তাআলা আমাকে পরামর্শের নির্দেশ দিয়েছেন, এতে বহু রহমত ও বরকত রয়েছে। যারা পরামর্শ করে কাজ করবে, তারা কখনো উত্তম দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত থাকবে না। আর যারা পরামর্শ করে কাজ করবে না, তারা কখনো ভ্রান্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।’ (বায়হাকি)

আল্লাহর নবী (সা.) তাঁর জীবনে শুরা বা পরামর্শের নীতি গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর চেয়ে নিজ সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে অধিক পরামর্শকারী আমি আর কাউকে দেখিনি।’ (ফাতহুল করীম ফী সিয়ামাতিন নাবিয়্যিল আমিন : পৃষ্ঠা ২৪)

মহানবী (সা.)-এর পর খলিফারা পরামর্শের ভিত্তিতে খেলাফত পরিচালনা করেছেন এবং দেশের সংকটকালে জ্ঞানী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ফকিহদের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠক করতেন। হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে আনসার ও মুহাজির সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করতেন। এসব বৈঠকে হজরত ওমর (রা.), ওসমান (রা.), আলী (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.) প্রমুখ সাহাবিরা উপস্থিত থাকতেন।

হজরত ওমর (রা.)-এর সময় রাষ্ট্রের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রথমে মজলিসে শুরায় উপস্থাপিত হতো। এখানে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘পরামর্শ ছাড়া খেলাফত ব্যবস্থা চলতে পারে না।’ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে ওই সব লোকের সঙ্গে পরামর্শ করবে, যারা আল্লাহকে ভয় করে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)

ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে না। যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার হল- নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না। ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট কোন ব্যক্তির ইমামতির জন্য অনুসারী বা জনগনের ভোট বা সমর্থন জরুরী। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমামতি তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান।

ইসলামে পরামর্শের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। আমাদের রাসূল সা: নিজের সিদ্ধান্ত কখনোই চাপিয়ে দিতেন না। সাহাবাদের মধ্যে তিনি যাদের গুরুত্বপূর্ণ ও যোগ্য মনে করতেন তাদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করতেন। আযান কীরূপ হবে এটা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছিলেন, বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের সাথে কী আচরণ করা হবে এই নিয়েও তিনি আলোচনা করেছিলেন। এভাবে সব বিষয়ে তিনি সাহাবাদের সাথে আলোচনা করতেন।

খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের বিষয়টা পরামর্শের মাধ্যমে উঠে এসেছে এবং বেশিরভাগ সাহাবা এতে রায় দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে দুটো প্রস্তাব এসেছিলো। আল্লাহর রাসূল সা: চেয়েছিলেন তাদের থেকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে দিতে। ঊমার রা: চেয়েছিলেন তাদের হত্যা করতে। সাহাবারা আল্লাহর রাসূলের মতামতকে বেশি ভোট দিয়েছেন তাই তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে।

ওহুদ যুদ্ধ মদিনার ভেতরে নাকি বাইরে গিয়ে করা হবে এই সিদ্ধান্তও এসেছে পরামর্শ ও অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে। এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মদিনার ভেতরে কিংবা বাইরে যেখান থেকেই যুদ্ধ করা হোক এর সাথে ইসলামের মূলনীতির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু যখন এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, তখন সে মুনাফিক উপাধি পেয়েছে। কারণ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সামষ্টিক সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এভাবে আল্লাহর রাসূল সা. ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র বা শুরাভিত্তিক শাসন থাকার অর্থ হলো,

১. বাংলাদেশের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে কারো একক সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাংলাদেশের নেতৃত্ব নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে। জনগণই নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে।
৩. কেউ একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা সংবিধান পরিপন্থী হবে।
৪. সাংবিধানিকভাবে স্বৈরাচারের উত্থান রহিত হবে।
৫. বিচার ও আইনের উর্ধ্বে কেউ থাকবে না।

 

২৩ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৫ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!

 

বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।

১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মূল কথা হলো আল্লাহ তা'য়ালাই একমাত্র ইলাহ এবং আল্লাহ তা'য়ালা ব্যতীত অন্য কারো ইলাহ না হওয়া। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর মধ্যে যাহা কিছু আছে সেই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, মা'বুদ এবং প্রাকৃতিক ও বিধিগত সার্বভৌম সত্তা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা। এই সবের কোন এক দিক দিয়াও কেহই তাঁহার সহিত শরীক নাই।

আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব মানে হলো আল্লাহকে পৃষ্ঠপোষক, কার্য সম্পাদনকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণ ও গ্রহণকারী এবং সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করা হবে। কেননা তিনি ব্যতীত আর কাহারও নিকট কোন ক্ষমতা নাই।

আল্লাহ তা'য়ালা ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া নেওয়া যাবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ তা'য়ালা ব্যতীত অপর কাহারও নাই।

আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ৩ নং পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে এটা আলোচনা করা হয়নি।

বাংলাদেশের সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের প্রকৃত ব্যাপার হলো,
১. যেসব বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সা. সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেসব বিষয় হুবুহু বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
২. বাংলাদেশে সংবিধানসহ যে কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই করতে হবে তা ইসলাম দ্বারা সমর্থিত কিনা!
৩. সংবিধানের কোনো ধারাই আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে যাবে না।
৪. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর অবমাননা হয়, এমন কথা আচরণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকবে।

২. আদল ও ইনসাফ
'আদল' ও 'ইনসাফ' আরবি থেকে আগত শব্দ। এই শব্দদ্বয় খুবই কাছাকাছি। বাংলায় ন্যয়বিচার ও সমতা/ নায্যতা বুঝায়।

যার যা হক্ব ও অধিকার আছে, তা আদায়ের সুষ্ঠু নীতিমালা ও সুব্যবস্থা করার নীতিই আদল, যাকে ইনসাফও বলা হয়। পার্থিব জীবনের সর্বত্র ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কেননা আদল ছাড়া ব্যক্তিগত জীবন হতে জাতীয়, আন্তর্জাতিক কোন জীবনই শান্তি-শৃংঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিরা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কর্ম জীবন ও পেশাগত জীবন নির্বাহ করে। কাজেই কারো প্রতি যাতে জুলুম না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর একমাত্র আল্লাহর বিধানই মানুষের সমাজ জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ ٱللَّهَ يَأْمُرُ بِٱلْعَدْلِ وَٱلإحْسَانِ وَإِيتَآءِ ذِي ٱلْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ ٱلْفَحْشَاءِ وَٱلْمُنْكَرِ وَٱلْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থাৎঃ “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমারেকে ন্যায়বিচার ও সদাচারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।” (সূরা নাহাল:৯০)।
দেশের শাসন ব্যবস্থা যদি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, তবে জাতীয় জীবনে অশান্তি, বিশৃংঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়।

আদল বা ন্যায়বিচারের বিপরীত হল যুলুম। যা ইনসাফের খেলাফ। যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো যুলুম। একে অবিচারও বলা হয়। অবিচার হল বড় যুলুম। অবিচারের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এটা কোন সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট হতে পারে না। সুতরাং জাতীয় জীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থাৎঃ “ হে ঈমানদারগণ! সত্যের উপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোন দলের শত্রুতা তোমারেকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয় যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা কর। এটি আল্লাহ ভীতির সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় কর! কারণ, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন। (সূরা আল-মায়েদাঃ৮)

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা বিচারকের দায়িত্ব।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ۚ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا
অর্থাৎঃ “ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে কত উত্তম উপদেশই না দিচ্ছেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। (সূরা নিসাঃ৫৮)

তিনি আরো বলেন:
وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
অর্থাৎঃ “আর যখন তুমি বিচার করবে, তখন লোকদের মাঝে ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা মায়েদা :৪২)

আদল বা ন্যায়বিচার একটি মহৎ গুণ। পারস্পরিক সম্পর্ক সামাজিক বা শান্তি-শৃংঙ্খলা ও সুশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল ন্যায়বিচার। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
অর্থাৎঃ “ আমি আমার রসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও (সত্য মিথ্যার) মানদন্ড যাতে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। (সূরা হাদীদঃ ২৫)

তিনি আরো বলেন:
فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ
অর্থাৎঃ হে নাবী! তাদেরকে আহ্বান কর (দ্বীনের প্রতি), আর তোমাকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তুমি তার প্রতি সুদৃঢ় থাক, আর তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না। আর বল, আল্লাহ যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। তোমাদের মাঝে ইনসাফ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরও প্রতিপালক, তোমাদেরও প্রতিপালক। (সূরা আশ-শূরাঃ১৫)

ন্যায়বিচারের ব্যপারে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, যেই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ন্যায়ের মানদন্ড অবশ্যই কায়েম রাখতে হবে। এখানে কোন হেরফের করা যাবে না। এ ব্যাপারে আল্লাহর কঠোর নির্দেশ রয়েছেঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوْ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
অর্থাৎঃ হে ঈমানদারগণ! ন্যায়ের প্রতি সুপ্রতিষ্ঠ ও আল্লাহ্র জন্য সাক্ষ্যদাতা হও যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা মাতা-পিতা এবং আত্মীয়গণের বিরুদ্ধে হয়, কেউ ধনী হোক বা দরিদ্র হোক, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যাতে তোমরা ন্যায়বিচার করতে পার এবং যদি তোমরা বক্রভাবে কথা বল কিংবা সত্যকে এড়িয়ে যাও তবে নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত।(সূরা আন-নিসাঃ ১৩৫)

তিনি আরও বলেনঃ
وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ
অর্থাৎঃ “আল্লাহ আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়ামায়া তোমাদেরকে যেন প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক।(সূরা আন-নূরঃ২)

আর যে বিচারক ন্যায়বিচারকার্য সম্পদন করবেন তার জন্য মহা খুশির সংবাদ হল; যে দিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তার ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদেও একজন হল; ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা শাসক।

সুতরাং বিচারকগণ যেন কোন অবস্থাতেই নিজের অথবা অন্যদের খেয়াল খুশিমত বিচারকার্য সম্পাদন না করেন। তাহলে কিন্তু এই সুসংবাদের বিপরীতে তাদেও জন্য রয়েছে দু:সংবাদ।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ
অর্থাৎঃ আর তুমি তাদের মধ্যে বিচার ফয়সালা কর তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ না করে। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক তারা যেন আল্লাহ তোমার প্রতি যা নাযিল করেছেন তার কোন কিছু থেকে তোমাকে ফেতনায় ফেলে বিভ্রান্ত করতে না পারে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ, আল্লাহ তাদের কোন কোন পাপের কারণে তাদেরকে শাস্তি দিতে চান, মানুষদের অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে সত্য ত্যাগী। (সূরা মায়েদাঃ ৪৯)

আয়েশা রা. আনহা হতে বর্ণিত, একবার কুরাইশের মাখযূমী বংশের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে, তার হাত কাটার নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘব করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করা হলে তিনি বলেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কোন সাধারণ লোক অন্যায় করলে, তার শাস্তি হতো। অথচ কোন মর্যাদাবান লোক অন্যায় করলে, তার শাস্তি হতো না। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও যদি এ কাজ করত, তবুও আমি তার হাত কাটার নির্দেশ দিতাম। (বুখারী ও মুসলিম)

সংবিধানের মূলনীতিতে আদল ও ইনসাফ যুক্ত করার মানে হলো
১. সংবিধানের কোনো ধারা উপধারা ইনসাফের বিপরীত হবে না।
২. সকল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আদল ও ইনসাফের আলোকে হবে।
৩. আদল ও ইনসাফের বিপরীতে সব সিদ্ধান্ত বাতিল বলে গণ্য হবে।
৪. রাষ্ট্রে জুলুমের প্র্যাকটিস বন্ধ হবে।

২২ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৪ : সংবিধান থেকে ইসলামবিরোধী সমাজতন্ত্র বাদ দিতে হবে


জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির চারটি মৌলিক নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র অন্যতম। এটি প্রস্তাবনাতেও উল্লেখ করা হয়েছে। "সমাজতন্ত্র"কে সংবিধানে "একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উপকরণ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আদতে সমাজতন্ত্র নিজেই শোষণের বড় হাতিয়ার। এই ব্যবস্থায় যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকেন তারাই রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদের মালিক বনে যান।

বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানায় সম্পদের মালিকানা ও সমবায়কে সমর্থন করে। সংবিধান বাংলাদেশকে একটি গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং কৃষক ও শ্রমিকদের মুক্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাঁদের অবস্থার সুরক্ষা ও উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার করে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র যুক্ত থাকলেও সমাজতন্ত্র ফলো করা হয় না। তবে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক সংবিধানের মতোই, বাংলাদেশের সংবিধানও বিনামূল্য ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ঘোষণা দেয়।

১৯৭১ সালে দেশভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আকার ধারণ করে। তবে এর ফলে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরণ ঘটে। সম্পদ জাতীয়করণের নামে ব্যাপক লুটপাট শুরু করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তন হয় এবং দেশে শুধুমাত্র একটি নেতৃত্বস্থানীয় রাজনৈতিক দল বিদ্যমান থেকে যায়।

৭৫ এর আগস্ট বিপ্লবের পর স্বৈরাচার মুজিবের পতনের পর দেশ শাসনব্যবস্থার একটি পরিবর্তন দেখে এবং অবশেষে ১৯৭৯ সালে সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র অপসারণ করা হয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করা হয়। ২০১১ সালে ৭২ এর সমাজতান্ত্রিক সংবিধান ফিরিয়ে আনার নিমিত্তে "সমাজতন্ত্র" ও "সমাজতান্ত্রিক" শব্দদ্বয় পুনরায় যুক্ত করা হয়, কিন্তু দেশ একটি মুক্তবাজার মিশ্র অর্থনীতি হিসেবেই রয়ে গেছে।

সমাজতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য
১. দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
২. ধর্মের উৎখাত
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতার উচ্ছেদ
৪. নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি
৫. রাষ্ট্রীয় নিরংকুশ মালিকানা
৬. চিন্তার পরাধীনতা
৭. সর্বহারা নামে একদলীয় শাসন
৮. তাত্ত্বিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হলেও বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদী।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নেওয়া মানে হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থনৈতিকব্যবস্থাকে অস্বীকার করা। আল্লাহর সার্বভোমত্ব মানা মানে হলো আল্লাহর আইন মেনে নেওয়া। অন্য কোনো ব্যবস্থায় আস্থা রাখা মানে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এই বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা আগের পর্বগুলোতে আলোচনা করেছি।

অতএব প্রস্তাবনা হলো সংবিধান থেকে ইসলামবিরোধী সমাজতন্ত্র অপসারণ করতে হবে। নতুবা এই মতবাদ আবারো মুজিবের মতো রক্তপিপাসু স্বৈরাচার তৈরি করবে।

২১ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৩ : সংবিধানে গণতন্ত্রের পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে।


গণতন্ত্র কি মতবাদ নাকি সিদ্ধান্ত অথবা নির্বাচনের টুলস এটা পরিষ্কার হওয়া জরুরি। গণতন্ত্র যদি মতবাদ হয় তবে অধিকাংশ মানুষই সার্বভৌমত্বের অধিকারী বা মালিক, যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। আর যদি গণতন্ত্র নির্বাচনী টুলস হয় তবে তার সাথে ইসলামের সাথে বিরোধ নেই। 

বর্তমান বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসাথে ইসলামফোবিক ও সন্ত্রাসীদের সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান চার মূলনীতিকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে উপস্থাপন করে সংবিধানের মূলনীতি থেকে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' বাদ দিয়ে দিয়েছে। 

আবার সংবিধানের ২য় ভাগে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে'। এই বক্তব্য ইসলামবিরোধী তো নয়ই বরং ইসলামের বিধানই এটা। 

এদিকে জামায়াতে ইসলামী তার গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করেছে সার্বভৌমত্বের মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে আওয়ামী সরকার জামায়াতের নিবন্ধন বাদ দেয় এই কথা বলে যে, জামায়াত সংবিধানের মূলনীতি 'গণতন্ত্রে' বিশ্বাস করে না। সুতরাং গণতন্ত্র ইস্যুতে বর্তমান সংবিধানের ক্লিয়ার স্ট্যান্ড নেই। 

সংবিধান সংস্কারের ব্যাপারে আমার চাওয়া হলো গণতন্ত্রের ব্যাপারে ক্লিয়ার ব্যাখ্যা থাকতে হবে, বলতে হবে গণতন্ত্র হলো নির্বাচন ও মতদ্বৈততা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যম। গণতন্ত্র বলতে যদি মনে করা হয় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী তবে তা ইসলাম বিরুদ্ধ। ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার হকদার একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। যেসব বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ও রাসূল সা. ফয়সালা দিয়েছেন সেই সিদ্ধান্তই শেষ কথা। সেসব বিষয়ে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।  

নির্বাচনী ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী কী? 

ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে না। যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার হল- নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না। ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)

উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট কোন ব্যক্তির ইমামতির জন্য অনুসারী বা জনগনের ভোট বা সমর্থন জরুরী। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমামতি তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান।

ইসলামে পরামর্শের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। আমাদের রাসূল সা: নিজের সিদ্ধান্ত কখনোই চাপিয়ে দিতেন না। সাহাবাদের মধ্যে তিনি যাদের গুরত্বপূর্ণ ও যোগ্য মনে করতেন তাদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করতেন। আযান কীরূপ হবে এটা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছিলেন, বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের সাথে কী আচরণ করা হবে এই নিয়েও তিনি আলোচনা করেছিলেন। এভাবে সব বিষয়ে তিনি সাহাবাদের সাথে আলোচনা করতেন।

খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের বিষয়টা পরামর্শের মাধ্যমে উঠে এসেছে এবং বেশিরভাগ সাহাবা এতে রায় দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে দুটো প্রস্তাব এসেছিলো। আল্লাহর রাসূল সা: চেয়েছিলেন তাদের থেকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে দিতে। ঊমার রা: চেয়েছিলেন তাদের হত্যা করতে। সাহাবারা আল্লাহর রাসূলের মতামতকে বেশি ভোট দিয়েছেন তাই তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে। ওহুদ যুদ্ধ মদিনার ভেতরে নাকি বাইরে গিয়ে করা হবে এই সিদ্ধান্তও এসেছে পরামর্শ ও অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে। এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মদিনার ভেতরে কিংবা বাইরে যেখান থেকেই যুদ্ধ করা হোক এর সাথে ইসলামের মূলনীতির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু যখন এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, তখন সে মুনাফিক উপাধি পেয়েছে। কারণ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সামষ্টিক সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এভাবে আল্লাহর রাসূল সা. ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। 

   
সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী কী? 
ইসলামে সার্বভৌমত্ব নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য স্বীকৃত। 

১. إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ-‘‘ শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার (অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা) আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জন্যই নয়। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও বন্দেগী করা যাবে না। এটিই হল সঠিক জীবনপদ্ধতি। অথচ অধিকাংশ লোকই তা জানে না।’’ এটি হযরত ইউসূফ (‘আলাইহিস সালাম)-এর ভাষণের একটি অংশ। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদের ব্যাপারে এটি সর্বোত্তম ভাষণসমূহের অন্যতম। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আসল মালিক ও প্রভু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি সার্বভৌমত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা নিজের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তাঁরই আদেশ হচ্ছে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না। (সূরা ইউসুফ: ৪০)

২. إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ -‘‘ শাসনের অধিকার অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই। তিনিই সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই হলেন সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।’’ (সূরা আনআম: ৫৭) 

৩. وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا-‘‘ তিনি তাঁর শাসন-কর্তৃত্বে কাউকেও অংশীদার রূপে গ্রহণ করেন না।’’ (সূরা কাহাফ: ২৬)

৪. أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ-‘‘ সাবধান! সৃষ্টি তারই এবং এর ওপর প্রভুত্ব চালাবার, একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।’’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা এ বিশ্ব জগত সৃষ্টি করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি; বরং তিনিই সৃষ্টির ছোট-বড় প্রত্যেকটি বস্ত্তর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন-কর্তৃতেবর যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্ত্ত তাঁর নির্দেশের অনুগত। অতি ক্ষুদ্র অণু-পরমাণুও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَمَنْ زَعَمَ أنَّ اللهَ جَعَلَ لِلْعِبَادِ مِنَ الْأمْرِ شَيْئًا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أنْزَلَ اللهُ عَلَى أنْبِيَائِهِ؛ لِقَوْلِهِ: { أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالأمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ }. -‘‘যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহদের জন্যও কিছু মাত্র শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার দান করেছে,তা হলে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর নাবীগণের প্রতি অবতীর্ণ বাণীর সাথে কুফরী করেছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘ সাবধান! সৃষ্টি তারই এবং এর ওপর প্রভুত্ব চালাবার, একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।...’’ (সূরা আরাফ: ৫৪ )

৫. يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ -‘‘তারা বলে, আমাদের হাতে কি কোনো কর্তৃত্ব আছে? তুমি বলে দাও, সকল কর্তৃত্বই আল্লাহর হাতে।’’ (সূরা ইমরান: ১৫৪) 

৬. وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ. ... فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ. ... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ -‘‘যে সব লোক আল্লাহর অবতীর্ণ আইনে শাসন কার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির, ..তারা যালিম..তারা ফাসিক..।’’ এ আয়াতগুলোতে যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য তিনটি উক্তি করেছেন। এক. তারা কাফির, দুই. তারা যালিম, তিন. তারা ফাসিক। এর সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকম ও তাঁর অবতীর্ণ আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিকে ফায়সালা করে সে আসলে তিনটি মারাত্মক অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটা কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি সুবিচারের পরিপন্থী। কেননা কেবল আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিধানগুলোই হল পুরোপুরি ইনসাফ ও ন্যায়ভিত্তিক। কাজেই তাঁর হুকম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করল, সে আসলে যুলম করল। তৃতীয়ত বান্দাহ হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করল, তখনই সে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে পা রাখল। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসিকী। এ কুফরী, যুলম ও ফাসিকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে আল্লাহর হুকম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। 

৭. أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا-‘‘আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো শাসককে খুঁজবো? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন বিস্তারিত বিধিসহকারে।’’ (সূরা আনআম: ১১৪)

৮. وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا.-‘‘ যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো ফায়সালা দেবে, তাতে কোনো মু’মিন নর-নারীর জন্য এ ইখতিয়ার নেই যে, সে তা লঙ্ঘন করবে। আর যে এ রূপ করবে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হবে।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করার ঘোষণা করবে আর জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি পরিচালনা করবে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশাবলীকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলাম কোনো অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্ত্তত নয়। এর চেয়ে বড় স্ববিরোধিতা আর কিছু হতে পারে না। (সূরা আহযাব: ৩৬)

৯. أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ-‘‘ তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহর। আর তিনি ভিন্ন পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী আর কেউ নেই।’’ এখানে আল্লাহর জন্য ‘মুলক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি বাদশাহী, রাজত্ব, সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অর্থে বলা হয়ে থাকে। এ আয়াতের মর্ম হচ্ছে, মহান আল্লাহই এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। (সূরা বাকারা ১০৭)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, গণতন্ত্রের এক ব্যাখ্যায় এটা শুধু বৈধ নয়, নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটাই ইসলামসম্মত পদ্ধতি। আর যদি গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা হয় জনগণের সার্বভৌমত্ব, তবে তা কুফুরি। তাই সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, গণতন্ত্রের পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। 

গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলতে হবে, 'বাংলাদেশে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে, নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে। গণতন্ত্র মানে জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়, সার্বভৌমত্ব কেবল মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার জন্যই সংরক্ষিত থাকবে'।

১৯ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০২ : সংবিধানের মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ থাকা যাবে না



বর্তমান বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রয়েছে, সংবিধানের মূলনীতি হবে চারটি, এর একটি হলো জাতীয়তাবাদ। সংবিধানের এই মূলনীতি ইসলামবিরুদ্ধ। এই মূলনীতি মুসলিমদের সংবিধানে থাকতে পারে না।

জাতীয়তাবাদ সাধারণত একটি সুস্থ ও নিষ্পাপ ভাবধারা থেকে সৃষ্টি হয়। আর সেটি হলো এক সমষ্টির মানুষ নিজেদের মিলিত স্বার্থ ও কল্যাণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্মিলিতভাবে কাজ করবে এবং সামাজিক ও সামগ্রিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যে এক জাতি হয়ে জীবন যাপন করবে।

জাতি গঠনের মূলে এটাই হয় প্রথম উদ্দেশ্য। কিন্তু একটি জাতি গঠিত হওয়ার পর জাতীয় বিদ্বেষ ভাবের প্রচণ্ড প্রভাব তার উপর অনিবার্য রূপেই আবর্তিত হয়ে থাকে। এমনকি, এ জাতীয়তা ক্রমশ যতোই কঠিন ও সুদৃঢ় হয়ে উঠে, জাতীয়তার বিদ্বেষ ভাব এবং পার্থক্যবোধও ততোই প্রচণ্ড হয়ে উঠে।

একটি জাতি যখন নিজের স্বার্থ লাভের এবং নিজেদের কল্যাণ ব্যবস্থা সংরক্ষণের জন্যে নিজেদেরকে পরস্পর ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে নেয়-অন্য কথায় নিজেদের চতুঃসীমায় জাতীয়তার দুর্ভেদ্য প্রাচীর স্থাপিত করে তখন উক্ত প্রাচীরের আভ্যন্তরীণ ও বহিরস্থ লোকদের পরস্পরের মধ্যে ‘আপন’ ও ‘পর’ বলে অবশ্যম্ভাবীরূপে পার্থক্য করবেই। প্রত্যেক ব্যাপারেই নিজেদেরকে অপরের উপর প্রাধান্য ও গুরুত্ব দিবেই। অপরের মুকাবিলায় নিজের প্রতিরক্ষা করবেই।

উল্লিখিত ‘আপন’ ও ‘পরের’ পারস্পারিক স্বার্থে যদি কখনো সংঘাতের সৃষ্টি হয়, তখন এই জাতীয়তা নিজের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্যে প্রাণপন চেষ্টা করবে-অন্যের স্বার্থ বলি দিতেও তা বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হবে না। এসব কারণেই সেসবের মধ্যে যুদ্ধ হবে-সন্ধি হবে, কিন্তু এ শান্তি ও সংগ্রাম-উভয় অবস্থায়ই উভয়ের মধ্যে পর্বত সমান পার্থক্যসূচক প্রাচীর মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর জাতীয়তার ভিত্তিতে এসব কার্যক্রম সবই হারাম।

কোন ব্যক্তি যখন শুধুমাত্র নিজের জাতির (এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক) ভাষা কিংবা পতাকা নিয়ে গর্ব বোধ করে, অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করে, অন্য জাতিকে ঘৃণা করে যদিও তারা মুসলিম হয়, অন্যান্য দেশ ও জাতির তুলনায় নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তখন তার সেই মনোভাব বা আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়।

জাতীয়তাবাদ / জাতিবাদ / গোত্রবাদের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য

এক.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য হতে বের হয়ে যায় এবং মুসলিমদের দল ত্যাগ করে, আর এই অবস্থায় মারা যায়, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। যে ব্যক্তি আমার উম্মতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে ভাল-মন্দ নির্বিচারে হত্যা করে এবং মুসলিমকেও ছাড়ে না; আর যার সাথে যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তার অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার সাথে আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে, আর লোকদেরকে জাতিয়তাবাদের দিকে আহ্বান করে এবং তার ক্রোধ জাতিয়তাবাদের জন্যই হয়, পরে সে নিহত হয়; তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে।
সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১১৪

দুই.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লোকেদেরকে গোত্রবাদের দিকে আহবান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো।
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৯৪৮

ফাসীলাহ্ বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! কোন ব্যক্তির নিজের গোত্রকে ভালোবাসা কি ’আসাবিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ না; বরং ’আসাবিয়্যাত হলো কোন ব্যক্তির নিজের গোত্রকে যুলমে সাহায্য করা। (আহমাদ ও ইবনু মাজাহ)

ইসলাম একে জাহেলিয়াত বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামে আরব অনারব, সাদা কালো, দেশি বিদেশি সকল মুসলিমকেই সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি মুসলিম হয় তাহলে সে ভারতীয়, পাকিস্থানি অথবা অন্য যে কোন দেশের নাগরিক হোক না কেন, সে আমাদের দ্বীনি ভাই। মুসলিমদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের পার্থক্য হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে, জাতীয়তা কিংবা দেশীয় নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নয়। কেউ যদি ইসলামের বিরোধীতা করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করে তাহলে সে স্বদেশী হলেও সে আর আমি এক জাতি নই।

তিন.
জাতীয়তাবাদ, গোত্র প্রীতি, বংশীয় আভিজাত্য ও অহংকারবোধকে আরবী পরিভাষায় আসাবিয়্যাহ বলা হয়। এই আসাবিয়্যাহ এর কুফল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর দিকে আহ্বান করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে যুদ্ধ করে। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৫১২১]

চার.
জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেনঃ হে লোক সকল শোনো, তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল তাকওয়ার কারণেই। [ইমাম আহমাদ, আল মুসনাদ, হাদিস নং ২৩৪৮৯]

কেন জাতীয়তাবাদ ক্ষতিকর?

এক.
ইসলামের একটি মূলনীতি হলো “আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ”। জাতীয়তাবাদের ফলে এই মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়। 'আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা। একজন মুসলিমের প্রতি আরেকজন মুসলিমের ভালোবাসা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কাফির মুনাফিকদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। কোন পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের এই সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়। ভিনদেশের মুসলিমকে তখন আর আপন ভাবা যায় না। অন্যদিকে নিজ দেশের আল্লাহদ্রোহীর প্রতিও সহানুভূতি চলে আসে।

দুই.
জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে সমস্ত পৃথিবীর মুসলিমের অন্তরে কষ্ট অনুভূত হবে, এটিই ইসলামের শিক্ষা। অথচ জাতীয়তাবাদ আমাদের সেই অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছে। নিজ দেশের কিংবা নিজ জাতির মানুষ সুখে থাকলেই আমরা খুশি। আর এরূপ স্বার্থপরতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মূল শিক্ষা। বিংশ শতকের শুরুতে জাতীরাষ্ট্র ধারণা থেকেই আমাদের উম্মাহ চেতনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমরা আরব-তুর্কি, আরব-আফ্রিকান, তুর্কি-হিন্দুস্তানী এসব ভাবে ভাগ যুদ্ধ শুরু করেছি। সেই উম্মাহ ভেঙ্গে এখন বাঙালি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি জাতিতে ভাগ হয়ে গিয়েছি।

তিন.
জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়। ইসলামে নিজ জাতিকে নিয়ে অহংকার কিংবা বংশ মর্যাদার গৌরব চরম নিন্দনীয়। ইসলাম এরূপ কর্মকে জাহেলি যুগের কর্ম বলে উল্লেখ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হলো তাকওয়া। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ, বংশ, জাতি, ভাষা, ভূখণ্ড ইত্যাদি মূল্যহীন। আল্লাহর রাসূল বিদায় হজ্বের ভাষণেও এই ধরণের জাতিভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

চার.
জাতীয়তাবাদ ন্যায় অন্যায় বোধকে নষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদের দাবিই হলো নিজের স্বজাতিকে সাহায্য করা হবে যদিও সে অন্যায় করে এবং অন্য জাতিকে সাহায্য করা হবে না যদিও তারা নিরপরাধ হয়। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা হবে, যদিও সে নিজ সম্প্রদায় কিংবা নিজ দেশের নাগরিক হয়।

বনু মুস্তালিকের যুদ্ধে এক মুহাজির ও এক আনসার সাহাবীর মধ্যে বিতর্ক শুরু হলে উভয়ই তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়কে ডেকে মারামারি করার জন্য উদ্ধত হলো। মুহাম্মদ সা. এই ধরণের কাজের কঠোর নিন্দা করেছেন এবং এই কাজকে জাহেলি দুর্গন্ধময় কাজ বলেছেন।

অতএব যে সংবিধানের মূলনীতিতে জাতিয়তাবাদ থাকবে তা জাতিকে ভুল পথে, জাহেলিয়্যাতের পথে পরিচালিত করবে।