৯ নভে, ২০২৩

আল্লামা ইকবাল ভার্সেস হুসাইন মাদানী


মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি। এ তত্ত্ব আধুনিক যুগের কোন আবিষ্কার নয়। দুনিয়ার প্রথম মানুষ একজন মুসলমান, আল্লাহর নবী ও খলিফা ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে অগাধ জ্ঞান ভান্ডার দান করেন। তাঁর থেকে ইসলাম ও ইসলামী জাতীয়তার সূচনা। উপমহাদেশে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এ তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক ও স্বাধীন আবাসভূমি দাবী করা হয়েছিল। এ জাতীয়তা ইসলামের শাশ্বত 'থিওরি' বা মতবাদ। 


হিন্দু প্রধান দল কংগ্রেস উপমহাদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানের উপর সংখ্যাগুরু হিন্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে এক জাতীয়তার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন এক প্রখ্যাত আলেম, দেওবন্দের শায়খুল হাদীস মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী। তিনি কংগ্রেসের সুরে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করেন একই ভৌগোলিক সীমারেখার ভিতরে বসবাসকারী মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে মিলে এক জাতি। এই বিষয়ে তিনি বইও লিখেন। তিনি দেওবন্দভিত্তিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর সভাপতি ছিলেন। 

মুসলিম লীগ উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের (মুসলিম ও মুশরিক দুই জাতি) ভিত্তিতেই পাকিস্তানের দাবী করে। মাওলানা মাদানীর উপরোক্ত ঘোষণায় শুধু মুসলিম লীগ নয়, আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলমান বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তখনো পাকিস্তান দাবী উত্থাপিত না হলেও মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি এ সত্যটি সকলের জানা ছিল এবং বারবার এ কথা বিভিন্ন সময়ে ঘোষণা করা হয়।

মাওলানা মাদানীর উক্ত ঘোষণা পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালকে অবহিত করা হয়। তিনি ছিলেন রোগশয্যায় শায়িত। তিনি ধীরে ধীরে কম্পিত কলেবরে শয্যার উপর উঠে বসেন এবং স্বভাব কবি রোগযন্ত্রণার মধ্যেও কয়েকছত্র কবিতার সুরে মাদানী সাহেবের উক্তির তীব্র সমালোচনা করেন— 

আজম হনুয্ নাদানিস্ত রমূ যে দ্বীন ওয়ার না,
যে দেওবন্দ্ হুসাইন আহমদ ইচেবুল্‌ আজবীস্ত্। 
সরুদে বর সরে মেম্বর কে মিল্লাত আহ্ ওতনস্ত্, 
চে বেখবর আয্ মকামে মুহাম্মদে আরবীস্ত্। 
বমুস্তাফা বরে সাঁ খেশরা কে দ্বীন হুমাউস্ত, 
আগার বাউ নারসীদী তামামে বু লাহাবীস্ত্।
- (আল্লামা ইকবাল : আরমগানে হেজায, পৃঃ ২৭৮)

অর্থ :
আজমবাসী দ্বীনের মর্ম বুঝেনি মোটে,
তাই দেওবন্দের হুসাইন আহমদ কন আজব কথা ।
মিম্বর থেকে ঘোষণা করেন, 'ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়' 
মুহাম্মদ আল আরাবীর মর্যাদা থেকে বেখবর তিনি।
পৌঁছিয়ে দাও নিজেকে মুস্তাফার কাছে,
এসেছে গোটা দ্বীন তাঁর থেকে,
পৌঁছাতে না পার যদি, সবই হবে বৃথা!

আল্লামা ইকবাল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন রাসূল সা.-এর কথা। মিল্লাত বা জাতীয়তা হবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে, ভূমির ভিত্তিতে নয়। মুসলিমরা ভাই ভাই, তারা এক জাতি। এখানে বাঙালি, আর্, তুর্কি আর হিন্দুস্তানীর কোনো স্থান নেই। আবার দু'জন বাঙালির একজন মুসলিম ও একজন মুশরিক হলে তারা কখনো জাতিভাই হতে পারে না।    

ড. ইকবালের কয়েক ছত্র কবিতা যদিও মাওলানা মাদানী সাহেবের মতবাদ খন্ডন করলো, তথাপি তা এক জাতীয়তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট ছিলনা। আল্লামা ইকবাল এই বিষয়ে মাওলানা মওদূদীকে লিখতে অনুরোধ করেন। 

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী উপমহাদেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির চুলচেরা পর্যালোচনা করে তাঁর সম্পাদিত মাসিক তর্জুমানুল কুরআনে ধারাবাহিকভাবে 'মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসি কাশমাকাশ' নামে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন।

এই লেখাগুলো একত্র করে বইও প্রকাশিত হয়। মাওলানা মওদূদীর এই বই মুসলিম সমাজে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। দেওবন্দী ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতি মুসলিমদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। 

শুধু তাই নয়, এই বইয়ের প্রভাবে জমিয়তে উলামায় হিন্দ থেকে বের হয়ে আসেন মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে একটি দল। তারা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে নতুন দল করেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবিও এই নতুন দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।  


৭ নভে, ২০২৩

গুপ্তহত্যা কি তবে গুম-খুনের নতুন ভার্সন?

ছবি - নিহত জামায়াত নেতা মাহবুবার রহমান (বামে) ও তার খুনী (ডানে)


বাংলাদেশে রাজনীতির কারণে খুন করে ফেলা এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এই খুনোখুনীর বিষয়টা এসেছে বামপন্থী রাজনীতির হাত ধরে। বিশেষভাবে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের মধ্যে যারা বামপন্থী ছিল তাদের হাত ধরেই খুনের রাজনীতি শুরু হয়। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের হাত ধরে সৃষ্টি হয় গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস। 


বাংলাদেশে প্রতিপক্ষদের টার্গেট করে খুন করার প্রচলন এই নিউক্লিয়াস তথা ছাত্রলীগ শুরু করে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে তারা বহু রাজনীতিবিদদের হত্যা করে। এরপর বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় হাজার হাজার বিহারী ও পাকিস্তানপন্থী সাধারণ জনগণকে তারা হত্যা করে। আলেম ওলামা, মসজিদ্গুলোর ইমাম, ডানপন্থী রাজনীতিবিদ, ডানপন্থী পেশাজীবী তাদের টার্গেট। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার রাজনীতিও তাদের হাত ধরে শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে এনএসএফ নেতা সাইদুর রহমান ঢাবি ক্যম্পাসে হত্যা করে ছাত্রখুনের রাজনীতি ওপেন করে ছাত্রলীগ। 


বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে আওয়ামীলীগ থেকে বামপন্থীরা বেরিয়ে যায় ও জাসদ গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ ও জাসদ পরস্পরকে খুনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। জাসদ গুপ্তহত্যা করে আওয়ামী নেতাদের হত্যা করতে থাকে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ জাসদ নেতাদের ধরে ক্রসফায়ার দিতে থাকে। কাউকে কাউকে গুম করতে থাকে। 


২০০৯ সালে শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আবারো তাদের ঐতিহ্য অনুসারে গুম খুন শুরু করে। হাসিনার আমলে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ৬১৪। ক্রসফায়ারে খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৮৭৩। 


২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাওকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। এই ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ওসি প্রদীপের সাজা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রসফায়ারের হার অনেক কমে যায়। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় নি। 


২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র‌্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হয়। এর প্রেক্ষিতে ক্রসফায়ার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হাসিনার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা বাড়তে থাকে। এর কারনে শেখ হাসিনা আগের মতো ক্রসফায়ার ও গুম খুন চালাতে পারছে না। 


মার্কিন ভিসানীতির সুযোগ নিয়ে ২০২৩ সালের ১০ জুন প্রকাশ্যে সমাবেশ করে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ শাখা। এর মাধ্যমে মেইনস্ট্রিমের রাজনীতিতে আবারো প্রভাব তৈরি করে জামায়াত। এর ধারাবাহিকতায় জামায়াত আলোচনায় আসে। কিন্ত তারপরও কয়েকমাস সভা-সমাবেশ করার বৈধ অধিকার হাসিল করতে পারেনি জামায়াত। সব শেষে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে লাখো জনতাকে হাজির করে জামায়াত অনেকটা জোর করে আরামবাগে বিশাল সমাবেশ করে। 


আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় শেখ হাসিনা। কিন্তু ভিসানীতির কারণে তার হাত বাঁধা। আগের মতো খুন করতে পারছে না। গত ১৫ বছরে জামায়াতের ২৪৬ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামীলীগ। এর মধ্যে ক্রসফায়ারের নামে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে ৮৬ জনকে। গুম করেছে জামায়াতের ২৫ জনকে। এর মধ্যে ৫ জন এখনো নিখোঁজ। বাকীদের মধ্যে কয়েকজনকে ফেরত পাওয়া গেছে, অন্যদের লাশ সনাক্ত করা গেছে। 


জামায়াত নেতা-কর্মীদের রিমান্ডের নামে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের রিমান্ডের দিন যোগ করলে তা হয় ৯৬৩৬৭ দিন। বছরের হিসেবে তা ২৬৮ বছর! পুলিশের নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছেন জামায়াতের ৫২০৪ জন নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়েছেন (যাদের হাসপাতালে থাকতে হয়েছে) ৭৫১৮৯ জন। 


জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১০৪৭২ জন নেতা কর্মী। এর মধ্যে নারী রয়েছেন ১৭৬৩ জন। জামায়াতের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে ও জামায়াতের প্রথম সারির প্রায় ১১ নেতাকে হত্যা করে আওয়ামীলীগ চেয়েছিলো দলটিকে গায়েব করে দিতে। কিন্তু জামায়াত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে জানান দিয়েছে তারা হারিয়ে যায় নি বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। 


পশ্চিমা চাপে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে পুলিশ দিয়ে গুম খুন করতে না পেরে এখন শেখ হাসিনা গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। যাতে এই হত্যার দায় সরকারের ওপর না পড়ে। জামায়াত বাংলাদেশের তৃণমূলে শক্তিশালী হওয়ায় তারা রাজধানীর বাইরে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা শুরু করেছে।  


২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই ৭ দিনে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১১ জন জামায়াত ১ জন বিএনপির নেতা কর্মী। এর মধ্যে ৭ জন মারাত্মক আহত হলেও কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যান। ৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ২৯ অক্টোবর রাজশাহীতে এরশাদ আলী দুলাল ও গোলাম কাজেম আলী খুন হন অজ্ঞাত আততায়ী দ্বারা। এরশাদ আলী দুলাল পল্লী চিকিতসক। গোলাম কাজেম আলী রাজশাহী মেডিকেলের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। দুই জনেই জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।


৩০ অক্টোবর জামায়াত কর্মী ও শ্রমিক মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় ভোলার অটোচালক শফিকুল ইসলামকেও একই কায়দায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ৩ নভেম্বর নাটোরের যুবদল কর্মী মাসুদ রানাকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। 


৫ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি জামায়াতের মনোনীত ও নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। জনপ্রিয় এই জামায়াত নেতাকে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। 


এছাড়া নাটোরের নলডাঙ্গায় আরো চারটি অজ্ঞাত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকটি ঘটনায় ভিকটিম ছিল জামায়াত নেতা। দুইটি ঘটনা ঘটে রাজশাহীতে সেখানেও ভিকটিম জামায়াত কর্মী। জামায়াতের নেতার ওপর একটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে নোয়াখালীতে। এই সাতজন ভিকটিম মারাত্মক আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। 


শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার বিরোধী মত দমনের জন্য ঘৃণ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর কোনোটাই কাজে আসবে না। প্রতিটি অমানবিক ও নোংরা পদক্ষেপ বুমেরাং হবে জালিমদের প্রতি। জামায়াত এদেশের জাতিসত্তার শিকড়। শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না।   

২৫ অক্টো, ২০২৩

সতর্ক হোন, প্রতিবাদ করুন, নতুবা জাহান্নামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন

একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহ বা পাপকাজ দুই প্রকার। ১- কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ। ২- ছগিরা গুনাহ বা ছোট গুনাহ।

কবিরা গুনাহের মধ্যেও সিরিয়াল আছে। একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো শির্কের গুনাহ।

আল্লাহ তা'আলা সূরা নিসায় ৪৮ ও ১১৬ নং আয়াতে বলেন, আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না। এছাড়া অন্যান্য যত গোনাহ হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন।

অর্থাৎ এই একমাত্র গুনাহ যা আল্লাহ সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন। এখানে আল্লাহর সাথে বেয়াদবি করা হয়। আল্লাহর মর্যাদার সাথে সমন্বয় করে অন্য কাউকে একই মর্যাদা দেওয়া হয়।

লুকমান আ. তাঁর ছেলেকে দেওয়া উপদেশে বলেছেন, প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হলো বড়ো জুলুম। আল্লাহ তায়ালা এই উপদেশকে পছন্দ করে তা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন।

আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না। এই আয়াতের শানে নুজুল হলো, মদিনায় ইহুদিরা বসবাস করতো। তারা আহলে কিতাব ছিল। সেই হিসেবে তারা শিরক থেকে দূরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো তারা নিজেরা শিরকি কার্যক্রমে যুক্ত ছিল এবং যারা শিরকে যুক্ত ছিল না তারা তাদের জাতিকে শিরক থেকে দূরে রাখার ব্যাপারে কাজ করেনি।

মাওলানা মওদূদী রহ. বলেন, //"আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না। এছাড়া অন্যান্য যত গোনাহ হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন"। এই আয়াতের অর্থ এই নয় যে, মানুষ কেবলমাত্র শিরক করবে না এবং বাদবাকি গোনাহ করে যেতে থাকবে প্রাণ খুলে।

বরং এ থেকে একথা বুঝানো হয়েছে যে, শিরকের গোনাহকে ইহুদিরা মামুলি গোনাহ মনে করে এসেছে। অথচ এটিই সবচেয়ে বড় গোনাহ। এমন কি অন্য সমস্ত গোনাহ মাফ হতে পারে কিন্তু এই গোনাহটি মাফ করা হবে না। ইহুদী আলেমরা শরীয়াতের ছোট ছোট বিধি-নিষেধ পালনের ওপর বড় বেশী গুরুত্ব দিতেন। বরং তাদের সমস্ত সময় এসব ছোটখাটো বিধানের পর্যালোচনা ও যাচাই বাছাইয়ে অতিবাহিত হতো। তাদের ফকীহগণ এই খুঁটিনাটি বিধানগুলো বের করেছিলেন ইজতিহাদের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের চোখে শিরক ছিল একটি হালকা ও ছোট গোনাহ। তাই এই গোনাহটির হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা কোন প্রকার চিন্তা ও প্রচেষ্টা চালাননি। নিজেদের জাতিকে মুশরিকী কার্যকলাপ থেকে বাঁচাবার জন্য কোন উদ্যোগও তারা নেননি। মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতাও তাদের কাছে ক্ষতিকর মনে হয়নি।//

কুরআন আমাদের হিদায়াতের জন্য এসেছে। ইহুদী আলেমরা শিরকের গুনাহকে ছোট করে দেখতো বলে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত আমাদের জন্য নাজিল করেছেন যাতে আমরা তাদের মতো ভুল না করি।

কিন্তু দূর্ভাগ্য যে, আমরা ইহুদীদের পদাংক অনুসরণ করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরের মধ্যে অন্তত দশবছর বলে যাচ্ছে, দুর্গাপূজা নাকি শুধু হিন্দুদের উৎসব নয়, এটা সমস্ত বাঙালির উৎসব। গতকালও সে এই কথা বলেছে। সে আরো শিরকি কথা বলে, যেমন দূর্গা এবার এই বাহনে করে এসেছে অতএব, ফসল ভালো হবে/ বৃষ্টি ভালো হবে। ইত্যাদি।

আমাদের ফকীহ, মুফতিদের দিকে যদি তাকাই তাহলে ইহুদি আলেমদের চিত্রই আমাদের সামনে ফুটে উঠবে। তারা নানান বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারো আকিদা খারাপ বলছে, ভিন্ন মতের আলেমদের বিদআতী বলছে, ঈমানহারা বলছে। অথচ শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগের প্রায় সব সিনিয়র নেতা সকল পূজাকে আমাদের উৎসব বলে চালিয়ে যাচ্ছে। এই শিরকি বিষয়ে কোনো ফতওয়া নেই আলেমদের। কাউকে বলতে শুনিনি শেখ হাসিনা শিরকি কথা বলেছেন তার আকিদা খারাপ। অথচ আমরা শুনেছি, মাসজিদুল আকসা বিজয়ী মহাবীর সালাউদ্দিন আইয়ুবির আকিদা খারাপ!

ভাইয়েরা! যার যার হিসেব সেই দিবে। আমাদের হিসেব আমাদেরই দিতে হবে। আমরা যদি শেখ হাসিনার কথার প্রতিবাদ না করি তাহলে এর জন্য আল্লাহর কাছে কী জবাব দিব?

জেনে রাখবেন, এই পৃথিবী শুরু হয়েছে বিশ্বাসী মানুষদের দিয়েই। আদম আ. ও হাওয়া আ. -এর বিশ্বাসী সন্তানেরাই একটা পর্যায়ে মুশরিকে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো,
১। শয়তানের প্ররোচনা
২। অসৎ শাসক
৩। ঈমানদারদের নিষ্ক্রিয়তা

হিন্দুদের মতে দুর্গা হলো "যে দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করে"। তারা দুর্গাকে পূজা করে যাতে দুর্গা খুশি হয়ে তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করে। তারা দুর্গার কাছে সাহায্য চায় যাতে দুর্গা তাদের বিপদে সহায় হয়। এই আকিদা বা বিশ্বাস স্পষ্ট ও প্রকাশ্য শিরক। এখানে আল্লাহর ক্ষমতার সাথে দুর্গাকে অংশী করা হয়েছে। এখানে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খাটো করেছে মুশরিকরা।

আল্লাহ তায়ালা এসব শিরকি অনুষ্ঠানে অত্যান্ত ক্রোধান্বিত হন। এই অনুষ্ঠানকে যারা সার্বজনীন অনুষ্ঠান বলবে তারা অবশ্যই কবিরা গুনাহ করবে। আর এমন কবিরা গুনাহ যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এই কবিরা গুনাহ করলে মুসলিম থাকা যায় না। এর জন্য প্রকাশ্যে ঈমান নবায়ন করতে হয়।

আমি দুর্গাপূজা নিয়ে হাসিনার করা মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ঈমান নবায়ন করার পরামর্শ দিচ্ছি। মুসলিম প্রধান দেশে এরকম কুফরি ও শিরকি আকিদার কোনো শাসক আমাদের ওপর চেপে বসা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুদের আহ্বান জানাচ্ছি হাসিনার শিরকি আক্বিদার প্রতিবাদ করুন। নইলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্রোধের মুখোমুখি হতে হবে।

এই কথাগুলো যারা বলবে ও বিশ্বাস করবে তারা প্রত্যেকে ঈমানহারা হয়ে যাবে। প্রকাশ্যে তওবা করে ঈমান নবায়ন না করলে মুসলিম হওয়া যাবে না। 

শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন এসব কুফরি বাক্য প্রচলনের মাধ্যমে এদেশের মানুষকে ঈমানহারা করার ইজারা শয়তান থেকে নিয়েছে। 

সতর্ক হোন, প্রতিবাদ করুন, নতুবা জাহান্নামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন।


দ্রষ্টব্য : আমি দূর্গাপূজার বলার বিরোধীতা করেছি। এর মানে এই না যে, আমরা দূর্গাপূজা হতে দেব না বা তাদের মন্দিরে আক্রমণ চালাবো। ইসলামী রাষ্ট্রে বিধর্মীরা তাদের পূজা করতে পারবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মুসলিম শাসকরা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।

ইসলাম কাউকে জোর করে মুসলিম বানাতে আগ্রহী না।

২২ অক্টো, ২০২৩

অক্টোবরের সেই আটাশ এই আটাশ!


২৮ অক্টোবর শুনলেই আমাদের চোখে বিভীষিকাময় দিনের কথা ভেসে ওঠে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। ওই দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ইস্তফাপত্র দেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকার কাদের নিয়ে গঠিত হবে, সে বিষয়টির ফয়সালা হয়নি।


সংবিধান অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা সেটি মেনে নেবে না। তাদের আপত্তির কারণ, কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করতেই সরকার বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল। কে এম হা্সান একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  


আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে। সেই বার ২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ঢাকা শহরে ছিল টানটান উত্তেজনা। আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং নেতা–কর্মীদের লগি–বৈঠা নিয়ে আসতে বলে। বিএনপি ওই দিন নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ও জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের কর্মসূচি নেয়। দুই পক্ষের রণপ্রস্তুতিতে সংঘাতের আশঙ্কা করা হয়েছিল। 


শেখ হাসিনার নির্দেশে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, লগি বৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগ ঢাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আওয়ামী লীগ বিনা প্রয়োজনে জামায়াতের সমাবেশের ওপর হামলা চালায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও জামায়াত–শিবিরের নেতা–কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় বায়তুল মোকাররম এলাকায়। আওয়ামী হামলা ঠেকিয়ে সেদিন জামায়াত যদিও তাদের সমাবেশ বাস্তবায়ন করতে পারে কিন্তু এতে প্রাণ যায় ৬ জন জামায়াত-শিবির কর্মীর। ওই দিন সারা দেশে ১১ জন নিহত হন।


আওয়ামী লীগ একটি শান্ত পরিবেশকে হঠাৎ অশান্ত হিসেবে দেখাতে সক্ষম হয়। ১১ টি লাশের বিনিময়ে তারা পৃথিবীবাসীকে দেখাতে সক্ষম হয় এখানে কোনো নির্বাচনের পরিবেশ নেই। যেখানে খুনোখুনি হয় সেখানে নির্বাচন কীভাবে হবে? আওয়ামী লীগকে তাই রাজনৈতিক দল বলাটাই অসুবিধা। এটা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা অবলীলায় খুনোখুনি করতে পারে। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে তাদের সেই কর্মপন্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। জামায়াত-বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল।  


২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের সেই সংঘাতের উপলক্ষ ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কে এম হাসান শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেননি। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ অন্যান্য বিকল্প বিবেচনায় না এনে নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলেন।


এবারের সমস্যাটি আরও গভীর ও জটিল। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক সুরক্ষা ছিল। এবার সেটি নেই। আওয়ামী লীগ সংবিধান চেইঞ্জ করে ফেলেছে। এখন আবার তারা খুব সাংবিধানিক(!) দলে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের ভেতরে থেকে তারা নির্বাচন করতে চায়। বিএনপি ফের তত্ত্বাধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অনড়। যেমন ১৯৯৫–৯৬ সালে আওয়ামী লীগও অনড় ছিল।


প্রায় দেড় যুগ পর ২০২৩ এর ২৮ অক্টোবর ঘিরে ফের দুই পক্ষ মুখোমুখি। ওই সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল। এবার বিএনপি বিরোধী দলে। জনমনে নানা জল্পনা চলছে। কী হবে ২৮ অক্টোবর? কেন বিএনপি ২৮ অক্টোবরকে বেছে নিল? ১৭ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি এবার?


ওই সময় আওয়ামী লীগের এক দফা দাবি ছিল—কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা যাবে না। এবার বিএনপির দাবি, নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে।


বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকদের অনেকে তাঁদের সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে ওই মহাসমাবেশকে বিএনপির মরণ কামড়ের শুরু হিসেবে দেখছেন। এ জন্য বিএনপির এই সমাবেশে চাপ প্রয়োগ করে জমায়েত ছোট করা, এমনকি হতে না দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।


আওয়ামী লীগ বছরখানেক ধরেই বিএনপিকে পাহারায় রাখছে। পাহারা হলো—বিএনপি যেন এককভাবে মাঠ দখলে নিতে না পারে। বিএনপিও নানা কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিও আওয়ামী লীগকে একধরনের পাহারায় রাখছে। দুই পক্ষই ভাবছে, যারা মাঠ দখলে রাখতে পারবে, তারাই জয়ী হবে। আওয়ামীলীগ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। জনগণের ওপর তারা নির্ভরশীল নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তারা তাদের ইচ্ছেমতো আসন দখল করে নিয়েছে।        


আওয়ামী লীগের নেতারা গত বছর ১০ ডিসেম্বরের কথা বিএনপিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ওই দিন বিএনপি ঢাকা শহরে বড় জমায়েত করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। দলীয় অফিসের সামনেই সমাবেশ করার ব্যাপারে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।অন্যদিকে সরকার কিছুতেই দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করতে দেবে না। এ নিয়ে দুই পক্ষের বাদানুবাদ চলতে থাকে। সমাবেশস্থল নিয়ে চলে রশি টানাটানি। সরকার এক মাঠের প্রস্তাব দেয়, বিএনপি রাজি হয় না। এরই মধ্যে পুলিশ বাড়িতে মধ্যরাতে হানা দিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে।


২৮ অক্টোবর কী হবে? 

বিএনপিকে যদি সমাবেশ করতে বাধা দেওয়া না হয় হয়তো কিছুই হবে না। তারা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। নতুন চরমপত্র থাকবে। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, তারা কর্মসূচিটি ৭ নভেম্বর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে ইচ্ছুক, যদি এরই মধ্যে তফসিল ঘোষণা না করা হয়। ৭ নভেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে গেলে, তারা রাজনৈতিক সুবিধা পাবেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় এসেছিলেন 'সিপাহি বিপ্লবের' মধ্য দিয়ে।


অবশ্য আওয়ামী লীগ আছে উভয় সংকটে। বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলে তারা যদি লাগাতার কর্মসূচির নামে মাঠের রাজনীতি দখল করে ফেলে তাহলেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে পারে আওয়ামী লীগ। আর যদি সমাবেশ না করতে দিয়ে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয় তবে এটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য আরো ক্ষতিকর। তবে এর জন্য বিএনপকে অনড় থেকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দেশ অশান্ত হলে পরিস্থিতি বিএনপির দিকেই ঘুরে যাবে। 


৫ অক্টো, ২০২৩

উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস (২য় পর্ব)

উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। গত পর্বে আমরা উল্লেখ করেছি কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির উত্থান হয়েছিল এবং কীভাবে উপমহাদেশে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির সূচনা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এই পর্বের আলোচনা করবো। 


ইসলামী জমিয়তে তলাবা 

১৯৪১ সালে ২৬ আগস্ট উপমহাদেশে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জাগরণী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর জন্ম হয় পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও সংগঠক মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ.-এর হাত ধরে।[১] অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিমদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। বহু জিন্দাদিল মুসলিম এমন একটি সংগঠন ও নেতার জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা তাদের প্রাণের কাফেলায় যোগদান করে। এই সংগঠনে উল্লেখযোগ্য ছাত্র ও তরুণ যুক্ত হয়। 


কয়েকবছর পর দেখা গেল ছাত্র ও যুবকদের গতির সাথে বয়স্করা পেরে উঠছেন না। তাই ছাত্র ও তরুণদের গতি অটুট রাখার জন্য জামায়তে ইসলামীর মজলিশে শুরা ১৯৪৭ সালে ছাত্র ও তরুণদের জন্য একই আদর্শের পৃথক সংগঠন অনুমোদন করে। নতুন সংগঠনের নাম রাখা হয় ইসলামী জমিয়তে তালাবা (ইসলামী ছাত্রসংঘ)। ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা দ্বীন কায়েমের ফরজ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ইসলামী জমিয়তে তলাবাই উপমহাদেশের ১ম ছাত্র সংগঠন।


গত পর্বে আমরা দুইটি ছাত্র সংগঠনের কথা উল্লেখ করেছি। অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ ও স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া। এই দুইটি সংগঠন যতটা না ছাত্রদের অধিকার আদায়ে তৈরি হয়েছে তার চাইতে বেশি জোর ছিল তাদের মূল সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। ইসলামী জমিয়তে তলাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 


ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী স্টেট কায়েমের জজবা ও দায়িত্ব উপলব্দি করানোই ছিল জমিয়তে তলাবার মূল লক্ষ্য। ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর লাহোরে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। [২]  ইসলামী জমিয়তে তালাবার ১ম কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন জাফরুল্লাহ খান। বাংলাদেশের শহীদ মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন ইসলামী জমিয়তে তালাবার ১৩ তম কেন্দ্রীয় সভাপতি। বৃটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গঠিত হওয়া প্রথম ছাত্র রাজনৈতিক দল ইসলামী জমিয়তে তলাবা।   


ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ

গত পর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করেন। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান। বৃটিশ শাসনামলে অনুষ্ঠিত ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দলটি তিন মুসলিম নেতার অনুসারীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কলকাতা, হুগলি তথা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীক প্রাধান্য থাকে সোহরাওয়ার্দি ও শেরে বাংলার স্টুডেন্টস লীগ। আবার ঢাকায় থাকে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্টুডেন্টস লীগ। 


সেসময় স্টুডেন্টস লীগের সভাপতি পদ ছাত্রদের কাছে থাকতো না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। সেক্রেটারি হতো মূল ছাত্রদের নেতা। এখন যেরকম ডাকসুতে হয়। ডাকসুর সভাপতি হন ইউনিভার্সিটির ভিসি। আর ভিপি বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হলো ছাত্রদের মূল নেতা। ১৯৪৫ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ তথা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। তিনি পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ৫ম প্রধানমন্ত্রী হন। [৩]


১৯৪৭ সালেও অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। এদিকে শেখ মুজিব ছাত্রলীগে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। তিনি মূল সংগঠন মুসলিম লীগে সক্রিয় ছিলেন সোহরাওয়ার্দির অনুসারী হিসেবে। শাহ আজিজ সত্যিকার অর্থেই ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা হয় নি। ঢাবি'র ছাত্ররা স্বভাবতই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সম্মান করতো। ঢাবির শিক্ষকদের একটি বড় অংশ কলকাতা থেকেই এসেছিল।  


১৯৪৭ সালে কলকাতা যাতে পাকিস্তানের অংশ হয় এজন্য সোহরাওয়ার্দি চেষ্টা করেছিলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবও একই পক্ষে ছিলেন। কারণ তারা কলকাতার নেতা। ঢাকায় তাদের অবস্থান দুর্বল। অন্যদিকে কংগ্রেস, হিন্দু নেতা, কলকাতার এলিট শ্রেণি ও দেওবন্দী আলেমদের প্রচেষ্টায় কলকাতা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। অবশেষে মুসলিমদের একটি শহর হিন্দুদের কাছে চলে গেলো। কলকাতাকে মুসলিমদের শহর বলেছি কলকাতার পৌর নির্বাচন থেকে শুরু করে আইন পরিষদের নির্বাচন সব নির্বাচনে মুসলিমরা অধিকাংশবার বিজয়ী হয়েছে। ১৯৩৫ সালে কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন শেরে বাংলা ফজলুল হক।  


১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। কলকাতা হয়ে হিন্দুস্থানের অংশ। কলকাতার মুসলিম নেতারা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসলো। সোহরাওয়ার্দি তার অধীনস্ত দুই নেতা শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবকে তিনি ঢাকায় পাঠান। শাহ আজিজ যেহেতু পুরো ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি দ্রুতই ঢাকার ছাত্রদের নেতা হয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঢাকার ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ শুরু করলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিব একই নেতার অনুসারী হলেও তারা পরষ্পরের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ ছিলেন না। শাহ আজিজ ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শেখ মুজিব মারদাঙ্গা অর্থাৎ সোহওয়ার্দির পেয়াদা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। বিশেষত কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিনি মুসলিমদের পক্ষে ভূমিকা রেখে নাম করেন। 


শেখ মুজিব শাহ আজিজের এই উত্থান মেনে নিতে পারেনি। শাহ আজিজের মতো তিনিও ঢাবিতে ভর্তি হন। এরপর ফজলুল হক হলে তার মতো মারদাঙ্গাদের একত্র করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, যেহেতু পাকিস্তান গঠন হয়েছে। বাংলা ভাগ হয়ে গেছে। তাই আমরা এখন আর অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ দলের নাম থাকতে পারে না। আমাদের দলের নাম হবে ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হলো। [৪]


নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হলেও শেখ মুজিবই ছিলেন নতুন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্রনেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ। হয়তো সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি।


আমরা এখন যে ছাত্রলীগের সাথে পরিচিত তার প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বলা হলেও এটি ছিল মূলত অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট লীগের ভাঙন। এই দিন মূল ছাত্রলীগ থেকে উগ্র ও কমিউনিস্ট ভাবাপন্নরা আলাদা হয়েছিল। শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে শাহ আজিজের ছাত্রলীগের সাথে টেক্কা দিতে পারেনি। তারা কয়েকটি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যুক্ত হয়ে পড়ে এবং মুজিবসহ সবাই এরেস্ট হয়। 


কিন্তু তার পরের বছর মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হয় তখন শেখ মুজিবের ছাত্রলীগের সুদিন ফিরে আসে। শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ আওয়ামী মুসলিম লীগের লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। ফলে শাহ আজিজের ছাত্রলীগ বাংলায় আর ভালো করতে পারেনি। মুজিবের ছাত্রলীগই মূল ছাত্রলীগে পরিণত হয়। 


ছাত্র ইউনিয়ন 

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট ছাত্রদের সংগঠন। এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি ছাত্র সংগঠন। সংগঠনটি ১৯৫২ সালের ২৬শে এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সংগঠনের মাদার পলেটিক্যাল পার্টি ছিল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টি ছিল গোপন সংগঠন। তাই এদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ছিল। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা প্রকাশ্যে ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিল এবং ছাত্রলীগের সিদ্ধান্তকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করতো। ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে কমিউনিস্টরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।


ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় কমিউনিস্টরা সাফল্য পেলে ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় একটি প্রাদেশিক সম্মেলন করে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্ররা। যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীদের একতাবদ্ধ করতে পারে এমন একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও কম্যুনিজম রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ গণ ছাত্র সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি -এ চার মূলনীতিকে ভিত্তি করে ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। [৫]


জন্মলগ্নে এ-ই সংগঠনের যুগ্ন আহ্বায়ক ছিলেন কাজী আনোয়ারুল আজিম ও সৈয়দ আব্দুস সাত্তার। এরপর ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সম্মেলনে মোহাম্মদ সুলতান সভাপতি ও মোহাম্মদ ইলিয়াস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এই সম্মেলনেই সংগঠনের ঘোষনাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। 


স্টুডেন্ট ফোর্স 

পাকিস্তান গঠনের সাথে সাথেই কিছু অপরিণামদর্শি মুসলিম বুদ্ধিজীবী সাম্যবাদকে ইসলামেরই অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। তারা ইসলামী কমিউনিজমের প্রচার করেন। এমন একটি ভ্রান্ত মুসলিমরা মিলে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেন। এদের কাজ ছিল কম্যুনিস্টরা যা করে তারাও তাই করবে শুধু আল্লাহর নাম নিয়ে করবে। গান-বাজনা, থিয়েটার, পথনাটক, সভা, পাঠচক্র ইত্যাদি ছিল তাদের কাজ। এক পর্যায়ে তারা ইসলামের সংস্কারে লেগে পড়েন। তারা বলতে চান ১৪০০ বছর আগের নিয়ম এখন আর কার্যকর নয়। কিছু কিছু সংস্কার করলেই ইসলাম হয়ে উঠবে যুগপোযোগী। এজন্য নারী-পুরুষে সমান অধিকার ও কর্ম, পর্দার শিথিলতা, ইসলামকে ব্যক্তিপর্যায়ে সীমিত করা ইত্যাদি প্রজেক্ট তারা হাতে নেয়।   


এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে সেই অতিবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা গঠন করে তমদ্দুনে মজলিশ। ইসলামী সাম্যবাদ আদর্শাশ্রয়ী একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর নামকরণ হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ। তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক আবুল কাশেমের অগ্রণী সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক এ.এস.এম নূরুল হক ভূঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরুদ্দীন উমর, হাসান ইকবাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সিনিয়র ছাত্র। [৬]


প্রফেসর আবুল কাশেম ছিলেন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৯ সালে মজলিশের সভাপতি নির্বাচিত হন। তমদ্দুনের লোকেরাই পরে খেলাফতে রব্বানী নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলের ছাত্র সংগঠনের নামম স্টুডেন্ট ফোর্স। ১৯৫৪ সালে স্টুডেন্ট ফোর্স গঠিত হয়। 


তথ্যসূত্র: 

১. জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী - ১ম খন্ড / আবদুল মান্নান তালিব / বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী / পৃষ্ঠা ৮-১২ 

২. A BRIEF HISTORY OF ISLAMI  JAMIAT-E-TALABA PAKISTAN / https://jamiat.org.pk/our-history/

৩. বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী / মুনিবুর রহমান / একাত্তর প্রকাশনী / পৃষ্ঠা ৭০ 

৪. ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা / প্রথম আলো / ১৬ মার্চ ২০২০

৫. ছাত্র ইউনিয়ন কি এবং কেন? / বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন / পৃষ্ঠা ১ 

৬. একটি পুস্তিকার প্রকাশ ও ভাষা আন্দোলনে আবুল কাসেম / মোস্তফা কামাল / বণিক বার্তা / ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২


১ অক্টো, ২০২৩

মালদ্বীপে কেন 'ইন্ডিয়া আউট' আন্দোলন জনপ্রিয় হলো?

 



মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দিয়ে যে জাহাজ চলাচলের রুট বা শিপিং লাইনগুলো আছে, তার মাঝামাঝি খুব স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। ভারত সাগরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় স্বভাবতই এই রাষ্ট্রের দিকে আঞ্চলিক পরাশক্তিদের নজর থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। এখানে প্রভাব বলয় তৈরি করার জন্য মরিয়া চীন ও ভারত। মালদ্বীপে তাই দুই টাইপের জনগণ তৈরি হয়েছে। একপক্ষ ভারতের পক্ষে, অন্যপক্ষ চীনের।

কিন্তু ভারতের আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি ভারতকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে মালদ্বীপে। ২০১৮ সালে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মালডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা ইব্রাহিম মুহাম্মদ সোলিহ্ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ শক্তিশালী করেছেন। ভারতের সঙ্গে তার দেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও খুব শক্তিশালী করেছেন।

মালদ্বীপ আসলে দীর্ঘকাল ধরেই ভারতের প্রভাব বলয়ে ছিল। সাবেক স্বৈরশাসক মামুন আব্দুল গাইয়ুমকে ভারত টিকিয়ে রেখেছিল বহুদিন থেকে। প্রেসিডেন্ট সোলিহ'র বিরুদ্ধে একটা বড় সমালোচনা হল তার প্রশাসন দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার দিকেই ঝুঁকেছে – যে নীতিকে বলা হয় ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি। মালদ্বীপে ভারতের উপস্থিতি থাকার ফলে দিল্লিও ভারত মহাসাগরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে তাদের নজরদারি বা মনিটরিং জারি রাখতে পেরেছে। সম্প্রতি তারা তাদের নজরদারির সীমা ছাড়িয়েছে।

২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবদুল্লাহ ইয়ামিন, যার আমলে মালদ্বীপ ক্রমশ চীনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সে সময় মালদ্বীপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’ যোগ দেয়, যে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল চীনের সঙ্গে সারা বিশ্বের রেল, সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ গড়ে তোলা। ইয়ামিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলো তখন মালদ্বীপকে ঋণ সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল। তিনি তখন চীনের শরণাপন্ন হন এবং বেইজিং কোনও শর্ত ছাড়াই মালদ্বীপে অর্থ ঢালতে থাকে।

২০২১ সালে মালদ্বীপে 'ইন্ডিয়া আউট' আন্দোলন শুরু করে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও মালের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মইজ্জু। তিনি আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের দলের ডেপুটি নেতা। 'ইন্ডিয়া আউট' আন্দোলনের মূল কারণ ইন্ডিয়ার মালদ্বীপে গোয়ান্দা কার্যক্রম। ২০১০ ও ২০১৩ সালে ভারত মালদ্বীপকে দুটি হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিল। এরপর ২০২০ সালে তাদের একটি ছোট এয়ারক্র্যাফট-ও দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, মালদ্বীপে উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান চালাতে এবং আপদকালীন মেডিকেল ইভ্যাকুয়েশনে এগুলো ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ২০২১ সালে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে ভারতের দেওয়া বিমান চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ৭৫জন ভারতীয় সেনা সদস্য সে দেশে অবস্থান করছেন।

ক্ষমতাসীন ভারতপন্থীদের যোগসাজশে ভারত মালদ্বীপে গোপনে সেনা ক্যাম্প গড়ে তুলেছে, এই খবর স্বাধীনচেতা মালদ্বীপের মানুষকে আহত করে। মালদ্বীপের পক্ষ থেকে প্রথমে অস্বীকার করা হলেও পরে তারা ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি স্বীকার করে নেয়। জানানো হয়, “সামরিকভাবে সক্রিয় কোনও বিদেশি সেনা সদস্য মালদ্বীপে মোতায়েন নেই।” “ভারতের যে সেনা সদস্যরা এই মুহূর্তে মালদ্বীপে রয়েছেন তারা সকলেই মালদ্বীপের ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের অপারেশনাল কমান্ডের অধীন”।

এই ঘটনায় মোহাম্মদ মইজ্জু 'ইন্ডিয়া আউট' আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে মালদ্বীপবাসীর ব্যাপক সমর্থন পান মোহাম্মদ মইজ্জু। এবারের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে এর প্রভাব পড়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে চীন ও ভারত সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত কোনো প্রার্থী ৫০ ভাগের বেশি ভোট পাননি। ফলে ভোট গড়িয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ এই নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বিরোধী দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের (পিএনএস) প্রার্থী মইজ্জু ভোট পেয়েছেন ৪৬ ভাগ। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পেয়েছেন ৩৯ ভাগ ভোট। নির্বাচনে আরও ছয়জন প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে বাকি ১৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন। প্রথম দফার এই ফল থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত পিএনএসের মোহাম্মদ মুইজজু ও এমডিপির সলিহের মধ্যে।

দ্বিতীয় দফায় মোহাম্মদ মুইজ্জু পেয়েছেন ৫৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট। আগামী ১৭ নভেম্বর দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন তিনি। এর আগ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন মোহাম্মদ সলিহ।

আদালতের দণ্ডের কারণে আবদুল্লাহ ইয়ামিন যেমন প্রার্থী হতে পারেননি, তেমনি এমডিপি থেকে নাশিদকে প্রার্থী হতে দেননি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহ। এর ফল হয়েছে দুটি। নাশিদ এমডিপি ছেড়ে দিয়েছেন। আর বিরোধী পক্ষ ইয়ামিনের বিকল্প হিসেবে মুইজ্জুকে প্রার্থী করে। মুইজ্জু প্রার্থী হয়েছেন দুটি বিরোধী দলের জোট প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স থেকে। এই জোটে আছে দুটি বিরোধী দল—পিপিএম এবং পিএনসি। এর মধ্যে প্রথমটি দেশের মূল বিরোধী দল।

নির্বাচনকালে সাম্প্রতিক সংবাদগুলোতে ভারতীয় অনেক প্রচারমাধ্যম মুইজ্জুকে চীনের ‘প্রক্সি প্রার্থী’ বলেও উল্লেখ করেছে। এ রকম অভিমত যে সলিহের পক্ষে যায়নি, সেটা ভোটের ফল থেকেই স্পষ্ট। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে তিনি ৫৪ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। অথচ এবার ৯ ভাগ কমে গেল। এ থেকে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে, তার সরকারের ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি মালদ্বীপের মুসলমানেরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি।

ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র নীতি সবচেয়ে বাজে দিক হলো তারা কোনো রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন না করে ঐ দেশের কোনো গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে। যেমন বাংলাদেশে তারা আওয়ামী লীগকে সকল বৈধ-অবৈধ সুবিধা দেয় কিন্তু বাংলাদেশ উন্নতি হবে এমন সহায়তা তারা করে না। মালদ্বীপেও তারা একই কাজ করেছে। সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে, সুবিধা দিয়েছে সোলিহ ও তার দলকে বিনিময়ে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বকে।

৩০ সেপ, ২০২৩

উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস (১ম পর্ব)

বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে ইংরেজ শাসনের হাত ধরে। ইংরেজ শাসনের আগে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থাকলেও ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন হয়নি। এর বেসিক কারণ উচ্চশিক্ষা তখন কোনো বৈষয়িক লাভজনক কাজ ছিল না। শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন ও মানবসেবাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্র খুব এভেইলেবল ছিল না। অর্থনীতি ছিল কৃষি ও ব্যবসাভিত্তিক। আর এই দুই কাজের জন্যই উচ্চশিক্ষা প্রয়োজনীয় ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা শেষেই সাধারণত ছাত্ররা নিজ নিজ কর্মে আত্মনিয়োগ করতো।[১]

ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা উচ্চশিক্ষাকে লাভজনক ও অর্থ উপার্জনের নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, সরকারি চাকুরি, ব্যবসায়িক সুবিধা, ইংল্যান্ডে আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতছানি, জমিদারি, ভূমির অধিকারসহ প্রতিটি নাগরিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণকে শর্ত করে দেওয়া হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হয়। এটি আর আগের মতো মানবসেবা বা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে হয়নি। শিক্ষকরা তাদের স্বার্থের জন্য শিক্ষাদান করতো। ছাত্ররাও তাদের বৈষয়িক সুবিধা হাসিল করার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকে। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়। এর মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের দরকার হয় এবং ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।

বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। [২] এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা।

ভারতে মুসলিম শাসনামলে সাড়ে পাঁচশত বছরে উপমহাদেশে লাখো মাধ্যমিক মাদরাসা ও হাজার খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা। [৩]

১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়।

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল [৪]

(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning)

(৩) তাঁর মতে, ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।

(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।

মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।

এই ধরণের বস্তুবাদী শিক্ষা চালু করার ফলে এবং ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিতে শিক্ষা একটি বস্তুবাদী ও স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়। আগে যেভাবে শিক্ষকরাই ছাত্রদের অভিভাবক ও তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। এখন আর সেই ব্যবস্থা থাকে না। শিক্ষকরা তাদের জীবিকার অংশ হিসেবেই শিক্ষা দান করতেন। জাতি গঠনের মানসিকতা থেকে তাঁরা সরে আসেন। ছাত্ররা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়েই উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।    

সর্বপ্রথম ১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুরে ডেনমার্কের খ্রিস্টান মিশনারীদের সহায়তায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে 'শ্রীরামপুর কলেজ' প্রতিষ্ঠা হয়।[৫] এরপর ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজসহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ইংরেজরা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকার থেকে সরাসরি ভাতা পেতেন। তাই সুলতানী আমলের মতো ছাত্রদের প্রতি কেয়ারিং ছিলেন না। নতুন শহরে নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার জন্য একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সমিতি করে রাজনীতি শুরু করেন। যেমন নোয়াখালী-কুমিল্লা, হুগলি, বারাসাত, আসাম, বরিশাল, ঢাকা ইত্যাদি

১৯২৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রথম ছাত্র রাজনৈতিক দল যারা বিভিন্ন মাদরাসায় সক্রিয় ছিল। তবে এই ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখতো না। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধান ও ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্যেই এই ছাত্ররাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল।[৬]

১৮৮৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ১ম রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। ১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা হলেন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, দাদাভাই নওরোজি, দিনশ এদুলজি ওয়াচা, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন প্রমুখ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব দান করেছিল। এই রাজনৈতিক দল গঠিত হয় যাতে ভারতীয় এলিট সোসাইটি সরকার থেকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পেতে পারে। এর সাথে অল্প কিছু মুসলিমরাও যুক্ত ছিল। [৭]

কিন্তু যতই দিন গড়াতে থাকে ততই দেখা যায় কংগ্রেস মূলত ভারতীয় হিন্দুদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট। মুসলিমদের ব্যাপারে শুধু অনুৎসাহী নয়, মুসলিমদের সাথে বৈরি আচরণ শুরু করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস মুসলিমদের শত্রু বিবেচনা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কংগ্রেসের বৈরি আচরণের প্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকায় একত্রিত হন। ঢাকায় উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতাদের সমাবেশ  থেকে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মুসলিমরা কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দিতে থাকেন।[৮]

উপমহাদেশের মানুষরা দুইটি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। মুসলিমরা মুসলিম লীগে ও হিন্দুরা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি এগিয়ে নেন। ইতোমধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩২ সালে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত করে মুসলিম লীগ। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান।

এটি ছিল জাতীয় রাজনীতিভিত্তিক উপমহাদেশের ১ম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠক। জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ মুসলিমলীগের রাজনীতিকে সহজ করে দেয়। সাধারণত ছাত্ররা কর্মতৎপর ও অনুগত হয়। মুসলিম লীগ সেই সুবিধাটি গ্রহণ করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সমগ্র মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলে ও তাদের নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করায় মুসলিম ছাত্ররা দ্রুতই জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে। 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের' মাধ্যমে মুসলিম লীগের সফলতা দেখে ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসপন্থী হিন্দু ছাত্রদের নিয়ে স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া গঠিত হয়।[১০] এভাবেই ১৯৩২ সাল থেকে মুসলিম লীগের হাত ধরে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির উত্থান হয় উপমহাদেশে।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৪০-১৪৪

২. শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা / বাংলাপিডিয়া /  মুয়াযযম হুসাইন খান / এশিয়াটিক সোসাইটি

৩. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ৫৯-৬৩

৪. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৬০-১৭২

৫. শ্রীরামপুর কলেজ / বাংলাপিডিয়া /  প্রফুল্ল চক্রবর্তী / এশিয়াটিক সোসাইটি

৬. জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ৯৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কাল / দৈনিক ইনকিলাব / ২৩ নভেম্বর ২০২১

৭. The Nature and Dynamics of Factional Conflict/ P. N. Rastogi/ Macmillan Company/ p-69

৮. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ১৪২

৯. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস( ১৮৩০-১৯৭১)/ ড. মোহাম্মদ হাননান/ আগামী প্রকাশন/ পৃষ্ঠা ৪১

১০. SFI: A Movement of Study, Struggle and Sacrifice For a Scientific, Secular Education/ Vikram Singh