১৫ জুল, ২০২৪

কোটা, কোটা আন্দোলন ও এর ইতিহাস

কোটা বলতে কোনো কিছুর নির্দিষ্ট একটি অংশকে বোঝায় যা সাধারণত একটি গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকে। মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর মানুষগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পড়াশোনা, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে। সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে কোটা বাতিল করে কেবল 'অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ রেখে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী- এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল।

কোটার ইতিহাস
কোটা ব্যবস্থা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এটা পাকিস্তান আমল তথা ১৯৪৯ সাল থেকে চালু হয়ে এসেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেখলেন পাঞ্জাবের মানুষরা যেমন শিক্ষিত ও স্মার্ট অন্য জাতিরা তা নয়। বিশেষ করে বাঙালিরা হলো পাকিস্তানের মেজরিটি। কিন্তু তারা পড়াশোনা ও চাকুরিতে বেশ পিছিয়ে।  

এছাড়াও পাঞ্জাবে বসতি গড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম মুহাজিররা ছিল পূর্ব বাংলা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগোষ্ঠীর চাইতে পড়ালেখায় অনেক অগ্রসর। এই জনগোষ্ঠীর তুলনামূলক অনগ্রসতার কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং কিছুটা সামাজিক। তখন থেকেই তিনি সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর জাতি গোষ্ঠীগুলোর জন্য কোটার ব্যবস্থা করার কথা ভাবছিলেন। 

১৯৪৮ সালের শুরুতেই পাকিস্তান পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের (বাংলাদেশে বিসিএস নামে পরিচিত) পরীক্ষা হয়। সেই ১ম শ্রেণির চাকুরির পরীক্ষায় মেজরিটি বাঙালিরা খুবই কম অংশ নিয়েছে। কৃতকার্যও হয়েছে অনেক কম। এই পরিস্থিতিতে কোটা সিস্টেম চালু করার সিদ্ধান্ত নেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি যে ধারণা দেন তা হলো মেধার ভিত্তিতে ২০% চাকুরি পাবে। আর বাকী ৮০% বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। 

 ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোটা সিস্টেম চালু হয়। এখানে ২০% ছিল মেধার ভিত্তিতে, ৪০% ছিল বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ, পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুরের জন্য ২৩%, সিন্ধ, বেলুচ ও সীমান্ত প্রদেশের জন্য ১৫% ও করাচির জন্য ২% চাকুরি বরাদ্দ থাকে।  আওয়ামীলীগের বর্তমান এমপি ও সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান ছিলেন ৪০% কোটায় চাকুরি পাওয়া বাঙালি সিভিল অফিসার। তার ভাষ্যমতে মেধা কোটায় কখনোই বাঙালিরা চাকুরি পেত না। ঐ ৪০% সিট যদি বরাদ্দ না রাখা হতো তবে তাদের ১ম শ্রেণির অফিসার হওয়া দূরহ হতো। জিন্নাহসহ পাকিস্তানের অবাঙ্গালি শাসকেরা পিছিয়ে পড়া বাঙ্গালিদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেন।  

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের আমলে চালু হওয়া প্রথম কোটা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের অনুসরণ করে। অর্থাৎ ২০% মেধা আর বাকীটা জেলা কোটা। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশন ও দফতরে নিয়োগ এবং কোটা বণ্টনের বিষয়ে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অর্থাৎ কোটার বড় একটি অংশই বরাদ্দ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো কোটা বণ্টনে পরিবর্তন আনে জিয়াউর রহমান। এ সময় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং শুধু নারীদের জন্য আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা হয়। সেসময়ে মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ কেবলই জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।

১৯৮৫ সালে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে আবারো কোটা সংস্কার করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে ১৯৮৫ সালে কোটা পদ্ধতির সংশোধন আনা হয়। এতে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদসমূহের জন্য মেধাভিত্তিক কোটা হইবে ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হইবে ৫৫ শতাংশ। এই জেলাভিত্তিক কোটার মধ্য হইতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, নারীদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য পাঁচ শতাংশ পদ সমন্বয় করিতে হইবে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা চাকুরি পাওয়ার সুযোগ থাকে না ৯০ সাল থেকে। তখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের যেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরির ব্যবস্থা করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯৯৭ সালে। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যার জন্য তা বরাদ্দের আদেশ জারি করা হয়। এর কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কোটার পরিমাণ অনুযায়ী চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছেন না মর্মেও বেশ কয়েকটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। 

২০০২ সালে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে আরেকটি পরিপত্র জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটা বণ্টনের বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র বাতিল করা হয়। 

২০০২ বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটা অন্য প্রার্থী দ্বারা পূরণ না করে সংরক্ষণ করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, তা সংশোধনক্রমে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে ২১তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত কোটার শূন্যপদগুলো (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) মেধাভিত্তিক তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদেরকে দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার প্রার্থী থেকে নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে ২০০৯ সালে এই নির্দেশনা বাতিল করে। একইসাথে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কোটায় পরবর্তী পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবশেষ ২০১২ সালে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

যেভাবে শুরু হয় কোটা আন্দোলন!
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রশিবির সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে কোটাসংস্কার দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অংশ নেওয়ার মতো কোনো প্রার্থী ছিল না তাই ছাত্রশিবির ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে তা মেধা কোটায় যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। ২০০২ সালে ছাত্রশিবিরের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে খালেদা নেতৃত্বাধীন জোট সরকার কোটা প্রথা কিছুটা সংস্কার করে। 

এরপর ২০০৮ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন করে। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩য় প্রজন্মকেও কোটায় অন্তর্ভুক্ত করলে ছাত্রশিবির কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রশিবিরের ওপরে ম্যাসাকারের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতে হয় কটা সংস্কারের দাবি উত্থাপনের অভিযোগে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের এই দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণদাবিতে পরিণত হয়।

কোটা সংস্কার কেন জরুরি?
প্রথমত কোটার বড় অংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা দাবী করার জন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা অবশিষ্ট নেই। তাদের নাতিপুতিদের জন্য এই কোটা বরাদ্দ রেখে সারাদেশের ছাত্রদের বঞ্চিত করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ, অর্থাৎ এক হাজার মানুষের মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১.২ জন বা ১.৫ জন। যা সমগ্র জনসংখ্যার ০.১২/০.১৫ শতাংশ। ০.১২ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। যা হাজারে রূপান্তর করলে দেখা যায়, এক হাজার জনতার মাঝে ১ থেকে ১.৫ (দেড়) জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০০। এর মতো বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে! 

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। তবে নিয়ম অনুসারে এসব কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদ সমূহে চাকুরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% বরাদ্দ রেখে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে। 

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোটা রাখতে হয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য। অথচ জন্ম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। একজন ব্যক্তি হাসপাতাল, ট্রেন, বাস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পেয়ে আসছে। সে কীভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হয়!

১৮ সালের আন্দোলন:
সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি থাকায় এটি নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের দাবীকে সামনে রেখে ছাত্রশিবির বেশ কয়েকবারই কোটা সংস্কার আন্দোলন করে। তবে তা ছিল সীমিত আকারে। কোটা আন্দোলন প্রথমবারের মতো বড় আকারে রূপ নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল এবং এর পুর্নমূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক।

এতে কোটা পদ্ধতিকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মার্চ মাসে এসে ওই রিটটি খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে আদালতে রিট করার পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে 'কোটা সংস্কার চাই' নামে একটি পেইজ খোলা হয় এবং শাহবাগকে কেন্দ্র করে তাতে মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া শুরু হয়। এর মাধ্যমেই মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

এ সময় কোটা সংস্কারের উদ্দেশ্যে 'বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ' নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গঠন করা হয়। রিট খারিজ হওয়ার পর কোটা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন করা হবে না মর্মে আদেশ জারি করা হয়। তবে কোটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনে সরকার। জনপ্রশাসন থেকে জারি করা ওই আদেশে বলা হয়, 'সব ধরনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দিয়ে সেসব পদ পূরণ করা হবে।' এটা ছিল ২০০২ সালে ছাত্রশিবিরের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জোট সরকারের সময়কার সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ ২০০২ সালে আদেশের মাধ্যমে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখার কথা বলা হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার এবং মেধা তালিকা থেকে নিয়োগের কথা জানায়।

তবে দাবি আদায়ে অনড় থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল ৫ টি। 

১. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা।

২. কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।

৩. সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ।

৪. কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা।

৫. চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।

এ সময় আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে টিয়ারগ্যাস ও ফাঁকা গুলি চালানোসহ কয়েকজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছর এপ্রিলে এই আন্দোলন সর্বব্যাপী রূপ লাভ করে। শাহবাগ থেকে ডাকা আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারাদেশেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলন কর্মসূচির মুখে ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় আরো পরে- অক্টোবর মাসে।

এ সময় নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৪তম থেকে ২০তম অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথাও জানানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণার পর থেকে পরিপত্র জারি করা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের ওপর হামলা ও গ্রেফতারের বেশ কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে আসে।

২৪ সালের আন্দোলন:
কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। গত ৫ জুন ২০২৪ তারিখে তাদের পক্ষে রায় আসে, অর্থাৎ আগের মতো কোটা বহাল হবে বলে জানান আদালত। এদিকে হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। সেই আবেদন গত ৪ জুলাই শুনানির জন্য এলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। এরই মধ্যে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। 'বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে' এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।



১৩ জুন, ২০২৪

সফলতার জন্য যে দোয়া আপনাকে পড়তেই হবে!


বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় ছিল আকস্মিক ঘটনা। এই ঘটনার পর মক্কার কাফির, মদিনার ইহুদি ও মুনাফিক এবং মরুভূমির বেদুইনরা উদীয়মান শক্তি মুসলিমদের উড়িয়ে দেওয়ার উঠে পড়ে লেগেছে। মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। কারণ পরাজিতের ছোবল মারাত্মক হয়।

মাওলানা মওদূদী রহ. সেই পরিস্থিতিকে এভাবে চিত্রিত করেন, বদর যুদ্ধে ঈমানদারগণ বিজয় লাভ করলেও এ যুদ্ধটি যেন ছিল ভীমরুলের চাকে ঢিল মারার মতো ব্যাপার। এ প্রথম সশস্ত্র সংঘর্ষটি আরবের এমন সব শক্তিগুলোকে অকস্মাত নাড়া দিয়েছিল যারা এ নতুন আন্দোলনের সাথে শত্রুতা পোষণ করতো। সবদিকে ফুটে উঠছিল ঝড়ের আলামত। মুসলমানদের ওপর একটি নিরন্তর ভীতি ও অস্থিরতার অবস্থা বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের সারা দুনিয়ার আক্রমণের শিকার মদীনার এ ক্ষুদ্র জনবসতিটিকে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে ফেলে দেয়া হবে। মদীনার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর এ পরিস্থিতির অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। মদিনা ছিল তো একটি ছোট্ট মফস্বল শহর। জনবসতি কয়েক হাজার ঘরের বেশী ছিল না। সেখানে হঠাৎ বিপুল সংখ্যক মুহাজিরের আগমন। ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য তো এমনিতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর আবার এই যুদ্ধাবস্থার কারণে বাড়তি বিপদ দেখা দিল।

মুসলিমরা ভাবতে থাকলো, মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদি ও মরুভূমির বেদুইনদের যেমন লোকবল তেমনি ছিল ধন-সম্পদ। এর মোকাবেলায় মুসলিমরা ছিল দুর্বল। জনবল ও সম্পদ উভয় দিকেই দুর্বল ছিল। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আল্লাহ তায়ালা সূরা ইমরানের ১০-১৪ নং আয়াতে বলেন,

(১০) যারা কুফরী নীতি অবলম্বন করেছে, তাদের না ধন–সম্পদ, না সন্তান–সন্ততি আল্লাহ‌র মোকাবিলায় কোন কাজে লাগবে। তারা দোজখের ইন্ধনে পরিণত হবেই।
(১১) তাদের পরিণাম ঠিক তেমনি হবে যেমন ফেরাউনের সাথী ও তার আগের নাফরমানদের হয়ে গেছে। তারা আল্লাহ‌র আয়াতের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে, ফলে আল্লাহ‌ তাদের গোনাহের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছেন। আর যথার্থই আল্লাহ‌ কঠোর শাস্তিদানকারী।
(১২) কাজেই হে মুহাম্মাদ! যারা তোমরা দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো, তাদের বলে দাও, সেই সময় নিকটবর্তী যখন তোমরা পরাজিত হবে এবং তোমাদের জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, আর জাহান্নাম বড়ই খারাপ আবাস।
(১৩) তোমাদের জন্য সেই দু'টি দলের মধ্যে একটি শিক্ষার নিদর্শন ছিল যারা (বদরে) পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একটি দল আল্লাহ‌র পথে যুদ্ধ করছিল এবং অন্য দলটি ছিল কাফের। চোখের দেখায় লোকেরা দেখছিল, কাফেররা মু'মিনদের দ্বিগুণ। কিন্তু ফলাফল (প্রমাণ করলো যে) আল্লাহ‌ তাঁর বিজয় ও সাহায্য দিয়ে যাকে ইচ্ছা সহায়তা দান করেছেন। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য এর মধ্যে বড়ই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
(১৪) মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু ও কৃষি ক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহ‌র কাছে।

এখানে আল্লাহ তায়ালা আমাদের স্পষ্ট করেছেন কাফেরদের অনেক সম্পত্তি ও জাঁকজমক দেখে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই, বরং আমরা যেন আল্লাহর ওপর আস্থা রাখি। আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধের উদাহরণ টেনে বলেছেন, বিজয় একমাত্র আল্লাহর সাহায্যেই আসে। আর আমরা যেগুলোকে সফলতা মনে করি এগুলো দুনিয়ার সুশোভিত বস্তু। এগুলো অর্জন করা যেতে পারে কিন্তু এগুলো যেন মূল লক্ষ্য না হয়ে যায়। মূল লক্ষ্য হবে আখিরাতের সাফল্য। দুনিয়া তো মুসাফিরের মতো অবস্থান করার জায়গা।

আমরা এমন এক সময়ে জন্ম নিয়েছি পৃথিবীতে যখন মুসলিমরা সারাবিশ্ব জুড়ে মার খেয়ে যাচ্ছে। আমাদের হতাশ হওয়ার অনেক উপাদান আছে। কিন্তু আমাদের হতাশ না হয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে। আল্লাহর দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

দুনিয়ার এই জাঁকজমকের বিপরীতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য যা উত্তম সে সম্পর্কে বলেছেন, পরবর্তী তিন আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা সূরা ইমরানের ১৫-১৭ আয়াতে বলেন,

(১৫) বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, ওগুলোর চাইতে ভালো জিনিস কি? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে। পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সঙ্গিনী এবং তারা লাভ করবে আল্লাহ‌র সন্তুষ্টি। আল্লাহ‌ তার বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর ও প্রখর দৃষ্টি রাখেন।
(১৬) এ লোকেরাই বলেঃ 'হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের গোনাহখাতা মাফ করে দাও এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের বাঁচাও।
(১৭) তারা ধৈর্যশীল, সত্যনিষ্ঠ, অনুগত, দানশীল এবং রাতের শেষভাগে আল্লাহ‌র কাছে গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করে থাকে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আসল সফলতা সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন এবং এর জন্য করণীয় উল্লেখ করে দিয়েছেন। আমাদের ধৈর্য ধরে ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত থাকতে হবে, হক কথা বলতে হবে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মুশরিকদের শেখানো কথা বলা যাবে না। আমাদের উলিল আমরের প্রতি (ইসলামী আন্দোলনের নেতা) অনুগত হতে হবে, দ্বীন কায়েমের পথে টাকা খরচ করতে হবে। যখনই আন্দোলনের জন্য সম্পদ চাওয়া হবে বিনা দ্বিধায় দান করতে হবে। এই দানকে আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে কর্জে হাসানা বলেছেন। এই ঋণ আল্লাহকে দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ এই দানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে ফেরত দিবেন। সর্বশেষ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন রাতের শেষভাগে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য চাইতে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের দোয়াও শিখিয়ে দিয়েছেন। সূরা ইমরানের ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ দোয়াটি উল্লেখ করেন।

رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
রব্বানা ইন্নানা আ-মান্না-ফাগফিরলানা-যুনূবানা-ওয়াকিনা আযা-বান্না-র।

হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা ঈমান আনলাম। অতএব, আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।

আসুন আমরা হতাশ না হয়ে ইকামাতে দ্বীনের কাজ করি। আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং দায়িত্বশীলের আনুগত্য করি। আর আল্লাহর শিখিয়ে দেওয়া দোয়া বার বার পড়তে থাকি, বিশেষ করে শেষ রাতে।

#রব্বানা

২২ মে, ২০২৪

গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড এমপি আনোয়ারুল আজিমের খণ্ড বিখন্ড লাশ উদ্ধার



২০১৬ সালে ঘটনার সূত্রপাত। ঝিনাইদহে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির উদ্দিন মণ্ডল ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে কাজ করছিলেন। কে বা কারা ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি তার চেম্বারে রোগী সেজে তাকে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটে ঝিনাইদহ সদরের কালুহাটি গ্রামের বেলেখাল বাজারে।

ওইদিন রাতেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) 'ধর্মান্তরিত হওয়ায়' সমিরকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দেয় জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট 'সাইট ইনটিলেজেন্স গ্রুপ'। সমির উদ্দিন ২০০১ সালে স্থানীয় 'ওয়ানওয়ে চার্চ বাংলাদেশ' এর মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন বলে দাবি করেন চার্চের ঝিনাইদহ এলাকার কো-অর্ডিনেটর হারুন অর রশিদ। হারুন আরো বলেন, "সমির খ্রিস্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। জঙ্গিরা এ কারণেই তাকে হত্যা করেছে।"

বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে জোর গলায় আইএসের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। তারা তাদের এই কথাকে সত্য প্রমাণ করতে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র শুরু করে। মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া সমিরের খুনের দায় তারা জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। খুনীদের ধরার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টা দেখা যায় না বরং তারা কীভাবে এর দায় জামায়াত-শিবিরের ওপরে চাপিয়ে দেবে সেই প্রচেষ্টা বেশ লক্ষ্যণীয়।

বাংলাদেশ পুলিশ তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য একে একে খুন করে ১৪ জন মানুষকে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কয়েকজনকে সমির হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করে। যে কয়েকজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে তারা বেঁচে আছেন। যারা শত নির্যাতনেও স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে। এই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড হলো স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।

মাঠ পর্যায়ে এই গণহত্যা কার্যক্রম পরিচালনা করে ঝিনাইদহের তৎকালীন এএসপি আজবাহার আলী শেখ, সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান, হরিণাকুণ্ড থানার ওসি মাহাতাব উদ্দীন, মহেশপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম, কালিগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান।

গণহত্যার প্রথম শিকার জামায়াত কর্মী ও মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হুরাইরা মালিথা। তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শৈলমারী বাজার সংলগ্ন কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে আবু হুরাইরা মালিথাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায়।

ঝিনাইদহ পুলিশের ২য় শিকার হলেন ঝিনাইদহ আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র ও শিবির নেতা হাফেজ জসিম উদ্দীন। ঝিনাইদহে আনোয়ারুল আজিম গং-দের ৩য় ও ৪র্থ শিকার হলেন আবু যর গিফারী ও শামীম হোসেন। ৫ম শিকার ছিল উচ্চ মাধ্যমিকের কিশোর ছাত্র ও শিবির কর্মী মহিউদ্দিন সোহান।

সোহানের মা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি আনোয়ারুল আজিমের কাছে যান ছেলেকে বাঁচাতে। আনোয়ারুল আজিম তাকে তাড়িয়ে দেন। এরপর প্রায় ৩০০ গ্রামবাসী মিলে এমপির কাছে গিয়ে অনুরোধ করে পুলিশের কাছ থেকে সোহানকে ছাড়িয়ে আনতে। তারা এও বলে, আগামী দিন থেকে সোহান ও সোহানদের পরিবারসহ সবাই আওয়ামী লীগ করবে।

আনোয়ারুল আজিম তাদের বলে, তোদের আওয়ামীলীগ করা লাগবে না। আওয়ামী লীগ করার জন্য লোকের অভাব হবে না। এরপর ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে কালীগঞ্জ থেকে প্রায় ৫০ কি.মি. দূরে চুয়াডাঙ্গায় সোহানের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভুলাটিয়ার মাঠে ডান হাত ভাঙ্গা, বাম চোখ উপড়ানো মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় শহীদ মহিউদ্দীন সোহানের।

এভাবে আনোয়ারুল আজিম গং খুন করতে থাকে ছাত্রশিবির নেতা শহিদ আল মাহমুদ, আনিসুর রহমান ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা ইবনুল ইসলাম পারভেজকে।

এরপর একে একে খুন হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রশিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুন, রমজান আলী, শরিফুল ইসলাম, হোসেন আলী আলিম মাদরাসার শিক্ষক ও মহিষগাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা ইদ্রিস আলী ওরফে পান্না হুজুর।

আনোয়ারুল আজিম ও আসাদুজ্জামান খান কামাল দ্বারা সংঘটিত পরিকল্পিত গণহত্যার ১৩ তম শিকার ছিলেন ঝিনাইদহ পৌরসভা জামায়াতের আমীর জহুরুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ শহরের দিশারি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। এই ঘটনার ৬ দিন পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ শহরে বাড়ির পাশ থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় ডা. তারিক হাসান সজিবকে। ডা. সজিব ঝিনাইদহ গণহত্যার ১৪ তম শিকার।

দীর্ঘদিন পাওয়া যায়নি জহুরুল ইসলাম ও ডা. তারিক হাসান সজিবকে। এরপর ২৬ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ প্রচার করে। জনপ্রিয় জামায়াত নেতা জহুরুল ইসলামকে ৪৮ দিন গুম করে রেখে নির্মম নির্যাতনের পর ঠাণ্ডা মাথায় গুলী করে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছে পুলিশ। একইসাথে মেধাবী ছাত্রনেতা ডা. তারিক হাসান সজিবকে ৪২ দিন গুম রেখে নির্যাতন করে খুন করে পুলিশ।

আজকে ২২ মে ২০২৪। আজ সকালে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে ঝিনাইদহ গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড আনোয়ারুল আজিমের খন্ডবিখন্ড মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

আওয়ামী লীগের এমপি আনোয়ারুল আজিম চোরাচালান, মাদক কারবার ও হুণ্ডি সিন্ডিকেটের অন্যতম মূল হোতা ছিল। ধারণা করা যাচ্ছে চোরাচালান সংশ্লিষ্টতার জন্যই মাফিয়া গ্যাং-দের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে আনয়ারুল আজিম। ফলশ্রুতিতে তাকে খুন হতে হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, আনোয়ারুল আজিম ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৬ সালে গণহত্যা সংঘটিত করার পর চোরাচালান ও মাফিয়া গ্রুপদের সাথে সংশ্লিষ্টতা বেড়ে যায়। ২০২৩ সালে তার দেওয়া হলফ নামায় দেখা যায় ৫ বছরে তার সম্পত্তি বেড়েছে ২২২ গুণ। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় আনোয়ারুল আজিম।

১৫ মে, ২০২৪

অন্তরের বক্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া



বাংলাদেশে আলেম নামধারী কিছু লোক অনলাইনে বিতর্কের হাট বসিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি। 

একবার রাসূল সা. দেখলেন সাহাবাদের একটি গ্রুপ কুরআনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে পরস্পরে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কুরআনের এক আয়াতকে অন্য আয়াতের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে বিতর্ক করছিলেন তাঁরা। এটা দেখে রাসূল সা. বললেন, তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারা আল্লাহ্‌র কিতাবের একাংশকে অপর অংশের বিপরীতে ব্যবহার করত। আল্লাহ্‌র কুরআন তো এ জন্যই নাযিল হয়েছিল যে, এর একাংশ অপর অংশের সত্যয়ণ করবে। সুতরাং তোমরা এর একাংশকে অপর অংশের কারণে মিথ্যারোপ করো না। এর যে অংশের অর্থ তোমরা জানবে সেটা বলবে, আর যে অংশের অর্থ জানবে না সেটা আলেম বা যারা জানে তাদের কাছে সোপর্দ করো।  [মুসনাদে আহমাদ ২/১৮৫, নং ৬৭৪১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহ ১১/২১৬২১৭, হাদীস নং ২৩৭০]

আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কুরআন নাজিল করেছেন। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাই যেন হয় আমাদের উদ্দেশ্য। কুরআনে দুই ধরণের আয়াত রয়েছে। একটা প্রকার হলো মুহকামাত। আরেক প্রকার হলো মুতাশাবিয়াত। 

মুহকাম পাকাপোক্ত জিনিসকে বলা হয়। এর বহুবচন 'মুহকামাত'। 'মুহকামাত আয়াত' বলতে এমন সব আয়াত বুঝায় যেগুলোর ভাষা একেবারেই সুস্পষ্ট, যেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করার ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয়-সন্দেহে অবকাশ থাকে না, যে শব্দগুলো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং যেগুলোর অর্থ বিকৃত করার সুযোগ লাভ করা বড়ই কঠিন। যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে এ আয়াতগুলো সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করে। এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে দুনিয়াবাসীকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো হয়েছে। এগুলোতেই শিক্ষা ও উপদেশের কথা বর্ণিত হয়েছে। ভ্রষ্টতার গলদ তুলে ধরে সত্য-সঠিক পথের চেহারা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। দ্বীনের মূলনীতি এবং আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, চরিত্রনীতি, দায়িত্ব-কর্তব্য ও আদেশ-নিষেধের বিধান এ আয়াতগুলোতেই বর্ণিত হয়েছে। কাজেই কোন সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি কোন্ পথে চলবে এবং কোন্ পথে চলবে না একথা জানার জন্য যখন কুরআনের শরণাপন্ন হয় তখন 'মুহকাম' আয়াতগুলোই তার পথপ্রদর্শন করে। স্বাভাবিকভাবে এগুলোর প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ হয় এবং এগুলো থেকে উপকৃত হবার জন্য সে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।

আর 'মুতাশাবিহাত' অর্থ যেসব আয়াতের অর্থ গ্রহণে সন্দেহ-সংশয়ের ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দেওয়ার অবকাশ রয়েছে। বিশ্ব-জাহানের অন্তর্নিহিত সত্য ও তাৎপর্য, তার সূচনা ও পরিণতি, সেখানে মানুষের অবস্থান, মর্যাদা ও ভূমিকা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বনিম্ন অপরিহার্য তথ্যাবলী মানুষকে সরবরাহ না করা পর্যন্ত মানুষের জীবন পথে চলার জন্য কোন পথনির্দেশ দেয়া যেতে পারে না, এটি একটি সর্বজনবিদিত সত্য। আবার একথাও সত্য, মানবিক ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাইরের বস্তু-বিষয়গুলো, যেগুলো মানবিক জ্ঞানের আওতায় কখনো আসেনি এবং আসতেও পারে না, যেগুলোকে সে কখনো দেখেনি, স্পর্শ করেনি এবং যেগুলোর স্বাদও গ্রহণ করেনি, সেগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষার ভাণ্ডারে কোন শব্দও রচিত হয়নি এবং প্রত্যেক শ্রোতার মনে তাদের নির্ভুল ছবি অংকিত করার মতো কোন পরিচিত বর্ণনা পদ্ধতিও পাওয়া যায় না। 

কাজেই এ ধরনের বিষয় বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেগুলো প্রকৃত সত্যের সাথে নিকটতর সাদৃশ্যের অধিকারী অনুভবযোগ্য জিনিসগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষায় পাওয়া যায়। এ জন্য অতি প্রাকৃতিক তথা মানবিক জ্ঞানের ঊর্ধ্বের ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়গুলো বুঝাবার জন্য কুরআন মজীদে এ ধরনের শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব আয়াতে এ ধরনের ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকেই 'মুতাশাবিহাত' বলা হয়।

দ্বিতীয় প্রকার আয়াতের অর্থ  আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে এগুলো সম্পর্কে বিশুদ্ধ পন্থা হল, এসব আয়াতকে প্রথম প্রকার আয়াতের আলোকে দেখা। 

 উদাহরণতঃ ঈসা আ. সম্পর্কে কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তি এরূপ

(اِنْ هُوَ اِلَّا عَبْدٌ اَنْعَمْنَا عَلَيْهِ)

অর্থাৎ "সে আমার নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দা ছাড়া অন্য কেউ নয়।  [সূরা আয-যুখরুফ  ৫৯] 

অন্যত্র বলা হয়েছে,

(اِنَّ مَثَلَ عِيْسٰى عِنْدَ اللّٰهِ كَمَثَلِ اٰدَمَ ۭخَلَقَهٗ مِنْ تُرَابٍ)

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌র কাছে ঈসার উদাহরণ হচ্ছে আদমের অনুরূপ আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা থেকে।" [সূরা আলে-ইমরানঃ ৫৯]

এসব আয়াত এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, ঈসা আ. আল্লাহ্ তা'আলার মনোনীত এবং তাঁর সৃষ্ট। অতএব তিনি উপাস্য, তিনি আল্লাহ্‌র পুত্র-নাসারাদের এসব দাবী সম্পূর্ণ বানোয়াট। তারা যদি (كَلِمَةُ اللّٰهِ) 'আল্লাহ্‌র কালেমা' বা (رُوْحٌ مِنْهُ); ‘তাঁর পক্ষ থেকে রূহ’ শব্দদ্বয় দ্বারা দলীল নেয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের বলতে হবে যে, পূর্বে বর্ণিত আয়াতসমূহের আলোকেই এশব্দদ্বয়কে বুঝতে হবে। সে আলোকে উপরোক্ত (كَلِمَةُ اللّٰهِ I رُوْحٌ مِنْهُ) শব্দদ্বয় সম্পর্কে এটাই বলতে হয় যে, ঈসা আ. আল্লাহ্‌র নির্দেশে সৃষ্ট হয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি রূহ। 

এরকম আরো বহু আয়াত রয়েছে যা দ্বারা আমরা নানান অর্থ করতে পারি। তবে সে অর্থই সঠিক যে অর্থ মুহকামাত আয়াত দ্বারা সাব্যস্থ। 

এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আমাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, তিনি সূরা ইমরানের ৭ও ৮ নং আয়াতে বলেন,

তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবে দুই ধরনের আয়াত আছে। এক হচ্ছে, মুহকামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত। যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ জানে না। বিপরীত পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলে, 'আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে'। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তারা আল্লাহ‌র কাছে দোয়া করতে থাকে, 'হে আমাদের রব! যখন তুমি আমাদের সোজা পথে চালিয়েছো তখন আর আমাদের অন্তরকে বক্রতায় আচ্ছন্ন করে দিয়ো না, তোমার দান ভাণ্ডার থেকে আমাদের জন্য রহমত দান করো কেননা তুমিই আসল দাতা।

ইদানিং দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে আলেম নামধারী কিছু লোক এসব মুতাশাবিয়াত আয়াত ও শব্দ নিয়ে বিতর্কের হাট বসিয়ে দিচ্ছেন। একজন আরেকজনকে বিদয়াতি, মুশরিক, ভ্রান্ত ইত্যাদি উপাধি প্রয়োগ করছেন। বস্তুত উভয় পক্ষই কুরআনের নির্দেশনা পরিপন্থী আচরণ করছেন। যারা এসব মুতাশাবিয়াতের চর্চা করে কুরআনে আল্লাহ  
তাদের অন্তর বক্র বলে উল্লেখ করেছেন। এটা করা যাবে না। 

এর জন্য পানাহ চাইতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এসব বক্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। আমরা নিজেরা তো অবশ্যই মুতাশাবিহাতের চর্চা করবো না। যারা এসব চর্চা করে বিতর্কের হাট বসিয়ে দিচ্ছে এবং কুরআনের এক আয়াতকে দিয়ে অন্য আয়াতকে খন্ডন করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। এই বিতর্কে কোনোভাবেই অংশ নেওয়া যাবে না। 

আর পাশাপাশি এসব বক্রতা ও ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর শিখিয়ে দেওয়া দোয়া বারংবার পড়তে হবে। 

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
রব্বানা-লা-তুঝিগ কুলূবানা-বা'দা ইয হাদাইতানা -ওয়াহাবলানা-মিল্লা দুনকা রাহমাতান ইন্নাকা আনতাল ওয়াহহা-ব।

হে আমাদের রব, আপনি হিদায়াত দেয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।
(সূরা আল-ইমরানঃ ৩:৮)

#রব্বানা



১০ মে, ২০২৪

আদর্শ রাষ্ট্র, পর্ব -০৩ : আদর্শ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কী হবে?



আদর্শ রাষ্ট্র তথা ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা এবং তিনি সর্বোচ্চ শাসক। সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব কেবল তারই। মানুষের মর্যাদা হলো, সে সর্বোচ্চ শাসকের প্রতিনিধি এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে শাসকের আইনের অনুগামী। প্রতিনিধির কাজ হলো, শাসকের আইনকে তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যকর করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করা। 


১. শাসন ক্ষমতার কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহরই

আল্লাহ তায়ালা ইউসুফ আ.এর ঘটনা উল্লেখ করেন সূরা ইউসুফে। ইউসুফ আ. বলেন, 'হে জেলখানার সাথীরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দিখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ যিনি সবার ওপর বিজয়ী। তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের গোলামী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাঠাননি। শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম হলো, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর দাসত্ব করবেনা। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানেনা।'[সূরা ইউসূফঃ ৩৯-৪০]

এটি ইউসুফ আ.-এর ভাষণের একটি অংশ। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদের ব্যাপারে এটি সর্বোত্তম ভাষণসমূহের একটি। এতে হযরত ইউসুফ আ. শ্রোতাদের সামনে দ্বীনের এমন একটি সুচনা বিন্দু তুলে ধরেন যেখানে থেকে সত্যপন্থী ও মিথ্যাবাদীদের পথ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি তাওহীদ শিরকের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। আবার এ পার্থক্যকে এমন যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট করেছেন, যার ফলে সাধারণ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তিই তা অনুভব না করে পারেননা। বিশেষ করে সে সময় যাদেরকে সম্বোধন করে তিনি একথা বলছিলেন তাদের মন মস্তিষ্কে তীরের মতো একথা গেঁথে গিয়ে থাকবে। কারণ তারা ছিলো কর্মজীবি গোলাম। নিজেদের মনের গভীর তারা একথা ভালোভাবে অনুভব করতো যে, একজন প্রভুর গোলাম হওয়া ভালো, না একাধিক প্রভুর গোলাম হওয়া? 

আর সারা দুনিয়ার একক প্রভু যিনি, তার দাসত্ব করা ভালো, না তার দাসদের দাসত্ব করা? তারপর তিনি একথাও বলেননি যে, তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করো এবং আমার দ্বীন গ্রহণ করো। বরং চমৎকার কৌশল বলছেন, আল্লাহর কতোবড় মেহেরবানী, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারো দাস হিসেবে পয়দা করেননি , অথচ অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা বরং অনর্থক নিজেরাই মনগড়া প্রভু তৈরী করে তাদের পূজা ও দাসত্ব করছে। তারপর তিনি শ্রোতাদের অনুসৃত ধর্মের সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে এবং কোনো প্রকার মনোকষ্ট না দিয়ে। 

২. ফেরাউনও নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করতো

আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, 'আর ফেরাউন বললো, হে সভাসদবর্গ! আমি তো আমাকে ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ আছে বলে জানিনা।' [সূরা আল কাসাসঃ ৩৮]

এ উক্তির মাধ্যমে ফেরাউন যে বক্তব্য পেশ করেছে তার অর্থ এ ছিলোনা যে, আমিই তোমাদের এবং পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। কারণ কেবলমাত্র কোনো পাগলের মুখ দিয়েই এমন কথা বের হতে পারতো। অনুরূপভাবে এর অর্থ এও ছিলোনা আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। কারণ মিসরবাসীরা বহু দেবতার পূজা করতো এবং স্বয়ং ফেরাউনকেই যেভাবে উপাস্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিলো তাও শুধুমাত্র এই ছিলো যে, তাকে সূর্য দেবতার অবতার হিসেবে স্বীকার করা হতো। সবচেয়ে বড় সাক্ষী কুরআন মজীদ নিজেই। কুরআনে বলা হয়েছে ফেরাউন নিজে বহু দেবতার পূজারী ছিলো।

তাহলে ফেরাউনের ব্যবহৃত 'ইলাহ' মানে কী? এই 'ইলাহ' মানে হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তথা আদেশ ও নিষেধের কর্তা ফেরাউন। ফেরাউন নিজেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বভৌম মনে করতো। যারা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের দাবীদার, তাদের সাথে ফেরাউনের কোনো পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের নির্বোধ লোকেরা একদিকে ফেরাউনকে অভিসম্পাত করতে থাকে, অন্যদিকে ফেরাউন রীতিনীতির অনুসারী এসব শাসককে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। 

৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্বে কারো কোনো অংশীদারত্ব নেই

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তিনি হলেন সেই সত্ত্বা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের মালিক। তিনি কাউকেও পুত্র বানাননা। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশীদার নেই। প্রতিটি জিনিস তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর একটি তাকদীর নির্ধারণ করেছেন।' [সূরা আল ফুরকানঃ ২]

মহান আল্লাহই এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। মূলকথা এই যে, তিনি ছাড়া আর কোনো মা'বুদ নেই। কারণ, মানুষ যাকেই মা'বুদে পরিণত করে একথা মনে করেই করে যে, তার কাছে কোনো শক্তি আছে, যে কারণে সে আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে এবং আমাদের ভাগ্যের ওপর ভালো মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। জনগণ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্যও চাইবে না। 


৪. আল্লাহর কাছেই সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে 

যিনি সার্বভৌমত্বের মালিক, তার কাছেই সকল কর্মকান্ডের জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তোমাদের অন্তরে যা কিছু আছে তা প্রকাশ কারো কিংবা গোপন রাখো সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ সেগুলোর হিসেবে নেবেন। অতপর তিনি যাকে চাইবেন ক্ষমা করে দেবেন, আর যাকে চাইবেন শাস্তি দেবেন, তিনি সবকিছু কারতে সক্ষম।' [সূরা আল বাকারাঃ ২৮৪] 

আল্লাহ এই পৃথিবীর ও আকাশ সমূহের মালিক। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁর একক মালিকানাধীন, প্রকৃতপক্ষে এই মৌলিক সত্যের ভিত্তিতেই মানুষের জন্য আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নতো করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কর্মপদ্ধতি বৈধ ও সঠিক হতে পারেনা।
এই বাক্যটিতে আরো দুটি কথা বলা হয়েছে। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে এবং এককভাবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। দুই, পৃথিবী ও আকাশের যে একচ্ছত্র অধিপতির কাছে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে তিনি অদৃশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞান রাখেন। এমনকি লোকদের গোপন সংকল্প এবং তাদের মনের সংগোপনে যেসব চিন্তা জাগে সেগুলিও তাঁর কাছে গোপন নয়।

আল্লাহর ওপর কোনো আইনের বাঁধন নেই। কোনো বিশেষ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি বাধ্য নন। বরং তিনি সর্বময় ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। শাস্তি দেয়ার এবং মাফ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তাঁর রয়েছে।


৫. বৈধ ও অবৈধ নির্ধারণের মালিক আল্লাহ তায়ালা 

ঈশা আ.-এর দাওয়াতের কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেন। ঈশা আ. বলেন, 'আমি সেই শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার যুগে তাওরাতে আছে। আর তোমাদের জন্য যেসব জিনিস হারাম ছিলো তার কতকগুলি হালাল করার জন্য আমি এসেছি। দেখো, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আমি নিশানী নিয়ে এসেছি। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব। কাজেই তোমরা তাঁর দাসত্ব করো। এটিই সোজাপথ।' [সূরা আল ইমরানঃ ৫০-৫১]

মানুষের জীবনকে হালাল ও হারাম এবং বৈধতা ও অবৈধতার বিধি-নিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহ দান করবেন। অন্যদের চাপানো সমস্ত আইন ও বিধি নিষেধ বাতিল করতে হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কোনটি বৈধ বা কোনটি অবৈধ হবে তা নির্ধারণ হবে আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী। 

৬. সৃষ্টি যার, আইন চলবে তার  

এটাই আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। এখানের স্রষ্টার আইন কার্যকর হবে। স্রষ্ট্রার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সব কিছুই বাতিল বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে আসে। তিনি সূর্য ও চন্দ্র ও তারকারাজী সৃষ্টি করেছেন। সবাই তাঁর নির্দেশের অনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তাঁরই এবং নির্দেশও তাঁরই। আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক।' [সূরা আ'রাফঃ ৫৪]

স্রষ্টা ও সৃষ্টির ম্যধকার সম্পর্ক সুস্পস্ট করার জন্য কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এমনসব শব্দ, পরিভাষা, উপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজত্ব ও শাসনের সাথে সম্পর্ক রাখে। এ বর্ণনাভংগী কুরআনে এতো বেশী স্পষ্ট যে, অর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যেকোনো ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেননা। 

ভূমন্ডলে ও নভোমন্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। সার্বভৌমত্ব [Sovereignty] বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিকার ও বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও। তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বের সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামতো চলার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি। 

বরং কার্যত সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভুত রয়েছে। দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছেনা। বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে। তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আবার যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন। সূর্য, চন্দ্র, তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোনো শক্তির অধিকারী নয়। বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরা একান্ত অনুগত দাসের মতো সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন।

আর ভূপৃষ্ঠে শুধু নিজেদেরকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চলার সামান্য আংশিক ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে। এটাও আল্লাহর ইচ্ছা ও পরীক্ষা। তারাই সফলকাম হবে যারা আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবে ও আল্লাহর আইনের কাছে আর্ত্মসমর্পন করবে।   


৭. আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক  

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন।[সূরা মায়েদাঃ ১] অর্থাৎ আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো হুকুম দেবার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার মানুষের নেই। তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসংগত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করেনা বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তাঁর আনুগত্য করে। 

যে জিনিসটি তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা কেবল তাঁর হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেবে গণ্য। আর ঠিক তেমনি যে জিনিসটি তিনি হালাল করে দিয়েছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলেই এটি হালাল। 

তাই কুরআন মজীদ সর্বোচ্চ বলিষ্ঠতা সহকারে এ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোনো বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভিত্তিরে আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এছাড়া মানুষের জন্য কোনো কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোনো মানদন্ড নেই।

৮. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বৈধ কিংবা অবৈধ ঘোষণার অধিকার নেই। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর তোমাদের কণ্ঠ ভূয়া হুকুম জারী করে বলতে থাকে এটি হালাল এবং ওটি হারাম, এভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করোনা। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবেনা। [সূরা আন নাহলঃ ১১৬]

এ আয়াতটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হালাল ও হারাম করার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। অথবা অন্য কাথায়, একমাত্র আল্লাহই আইন প্রণেতা। অন্য যে ব্যক্তিই বৈধতা ও অবৈধতার ফয়সালা করার ধৃষ্টতা দেখাবে, সে নিজের সীমা লংঘন করবে। আদর্শ রাষ্ট্রে এই ধরণের সীমা লংঘণের কোনো এখতিয়ার কারো থাকবে না। 

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, 'হে নবী তাদের বলো, তোমরা কি কখনো একথা চিন্তা করেছো যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিযিক অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্য থেকে তোমরা নিজেরাই কোনোটাকে হারাম ও কোনোটাকে হালাল করে নিয়েছো? নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছো?' [সূরা ইউনুসঃ ৫৯]


৯. যারা আল্লাহর আইন মানে না কাফির, ফাসিক ও জালিম। 

আদর্শ রাষ্ট্র আল্লাহর আইন অনুযায়ী চলবে। যারা আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না তারা হয় ফাসিক নয়তো জালিম অথবা কাফির। এই মুহুর্তে প্রায় সবক'টি মুসলিম রাষ্ট্রেই শাসকগণ আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করেনা তারাই কাফির / জালিম / ফাসিক' [সূরা মায়েদাঃ ৪৪-৪৭]

যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুম ও তাঁর নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফয়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি সুবিচার ও ভারসাম্যনীতের বিরোধী। কারণ, আল্লাহ্ সর্বোচ্চ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করলো তখন সে আসলে জুলুম করলো। তৃতীয়ত, দাস হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে পা রাখলো। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসিকী। 

যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফালসালা করে, সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, জুলুম ও ফাসিকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে। আদর্শ রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা থাকায় আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে ফয়সালা করার কোনো সুযোগ থাকবে না। 

১০. তাগুতই কেবল আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে। 

'প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রাসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাগুতের বন্দেগি পরিহার করো।' (সূরা নাহল-৩৬)

এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে 'তাগুত' বলা হবে, যে নিজের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে। কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক দাসকে বলা হয়, যে দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু ও খোদা হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের দাসত্বে নিযুক্ত করে। 

তাগুতের ৩ টি পর্যায় 
ক. প্রথম পর্যায় হলো বান্দা নীতিগতভাবে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করে। একে বলা হয় ফাসেকী। 
খ. দ্বিতীয় পর্যায়ে সে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় কুফরী। 
গ.তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে। 

কোনো ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোনো দিন সঠিক অর্থে আল্লাহর মুমিন বান্দা হতে পারেনা।

অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
'হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেইসব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছেলো; কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহের ভায়সালা করার জন্য 'তাগুতে'র দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছিলো তাগুতকে অস্বীকার করার।' [সূরা আন নিসাঃ ৬০]

আল্লাহর তায়ালার এই কথা আমাদের বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য। এখানে 'তাগুত' বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোনো আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং এমন বিচার ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করেনা।

কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, নিজের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তার কাছে উপস্থিত হওয়া যে একটি ঈমান বিরোধী কাজ , এ ব্যাপারে এ আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর আল্লাহ্ ও তাঁর কিতাবের ওপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবী অনুযায়ী এই ধরনের আদালতকে বৈধ আদালত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানোই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। 

কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাগুতকে অস্বীকার কার, এদু'টি বিষয় পরস্পরের সাথে অংগাংগীভাবে সংযুক্ত এবং এদের একটি অন্যটির অনিবার্য পরিণতি। আল্লাহ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নতো করাই হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফিকী।

আমাদের আজকের এই আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া ঈমানের দাবী। সার্বভৌমত্বে মানুষের বিন্দুমাত্র অংশ থাকতে পারেনা। একইসাথে আল্লাহ ও জনগণের সার্বভৌমত্ব অথবা কোনো শাসকের সার্বভৌমত্ব মানার কোনো সুযোগ নেই। আদর্শ রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর। 


৩০ এপ্রি, ২০২৪

আদর্শ রাষ্ট্র, পর্ব -০২ : রাষ্ট্র ও রাজনীতি সাথে ইসলামের সম্পর্ক


পৃথিবীর মুসলিমদের কাছে ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতোই একটি ধর্ম মাত্র। মুসলিমদের বেশিরভাগ অংশ মনে করে ইসলামী শরীয়ত কেবলমাত্র নৈতিক চরিত্র ও আল্লাহর সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক স্থাপনের বিধিবিধানই পেশ করে। এছাড়া মানব জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামের কিছুই বলার নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে ইসলাম একেবারেই নীরব এবং সে পর্যায়ে মুসলমানরা যে কোনো নীতি বা আদর্শ গ্রহণে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ইসলামের পূর্নাঙ্গ বিধান এ ধারণার তীব্র প্রতিবাদ করে। 

ইসলাম তার গোটা ইতিহাসে কখনো রাষ্ট্রের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেনি। আম্বিয়ায়ে করাম আলাইহিমুস সালাম তাঁদের স্ব স্ব সময়কালের সামাজিক ও সামষ্টিক শক্তিকে ইসলামের অনুগত ও অনুসারী বানাবার চেষ্টা সংগ্রাম করেছেন। তাদের গোটা দাওয়াতী মিশনের কেন্দ্রবিন্দু এই ধারণার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো যে, ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাবে এবং শিরক তা গোপন ও প্রকাশ্য যে রূপেই বর্তমান থাকুকনা কেনো তাকে খতম করে দেওয়া হবে। তাঁদের প্রত্যেকের এই একই আহবান ছিলো,

হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই। [সূরা আরাফঃ ৬৫] 
তোমার আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো। [সূরা আশ শুয়ারাঃ ১৬৩]

আল্লাহর এই প্রেরিত বান্দারা মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগকে পরিশুদ্ধ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা সংগ্রাম করেছেন, যাতে করে আল্লাহর যমীনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর আইন ও বিধান চালু এবং কার্যকর হয়। তাঁদের এই প্রাণন্তকর চেষ্টা সংগ্রাম ছিলো পূর্ণাংগ জীবনের সংশোধনের জন্যে। আর রাষ্ট্রের সংশোধন ছিলো সেই সংশোধনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। 

ইউসূফ আ., মূসা আ., দাউদ আ., সুলাইমান আ. এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তা আদর্শিক মানে পরিচালনা করেছিলেন। বনী ইসরাইলের অন্যান্য নবীগণও রাষ্ট্র সংস্থার সংশোধনের চেষ্টা করেছেন এবং ভ্রান্ত, স্বৈরাচারী, আল্লাহদ্রোহী ও অবৈধ নেতৃত্বের অবাধ সমালোচনা করেছেন। ইসলামী চিন্তাধারায় রাষ্ট্র যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই বিষয়টি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, স্বয়ং আসমান ও যমীনের স্রষ্টাই তাঁর নবী সা.-কে এরূপ দোয়া করতে শিখিয়ে দেন,
'আর তুমি দোয়া করো: হে প্রভু, আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে সত্যতা সহকারে নিয়ে যাও আর যেখান থেকেই বের করবে সত্যতা সহকারে বের করো, আর তোমার নিকট থেকে একটি সার্বভৌম শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও। [সূরা বনী ইসরাইলঃ ৮০]

ইসলাম পৃথিবীতে যে সংশোধন ও সংস্কার চায় তা শুধুমাত্র ওয়াজ নসীহত দ্বারা সম্ভব নয়, বরঞ্চ তা কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা অপরিহার্য। তাছাড়া আল্লাহ তা'য়ালাই যখন তাঁর নবী সা.-কে এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, তখন তা থেকে এ জিনিসটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, শরীয়াহ কার্যকর করা এবং আল্লাহর আইন জারি করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা চাওয়া এবং তা লাভ করার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম চালানো শুধু বৈধই নয়, বরঞ্চ তা একান্ত কাম্য ও বাঞ্চনীয়। যারা এই কাজকে দুনিয়াদারীর কাজ বলে ব্যাখ্যা করেন তারা সাংঘাতিক ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায় তবে সেটা দুনিয়াদারীর কাজ হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া দুনিয়াদারী নয়, বরং আল্লাহর আনুগত্যের অনিবার্য দাবী। 
[তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনী ইসরাইল টিকাঃ ১০০]

রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা নিয়ে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনাগুলো নিন্মরূপ:
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর লোহা নাযিল করেছি যার মধ্যে বিরাট শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে। এটা করা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিতে চান কে তাঁকে না দেখেই তাঁকে ও তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী। 
[সূরা আল হাদীদ : ২৫]

তিনিই [আল্লাহ তা’য়ালা] তো সেই সত্তা যিনি রাসূলকে হিদায়াত এবং সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যেনো সে তাকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেয়। তা মুশরিকদের জন্যে সহ্য করা যতোই কঠিন হোক না কেনো। 
[সূরা আসসফ: ৯]

আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুযায়ী ফয়সালা করেনা তারা কাফির। 
[সূরা আল মায়িদা : ৪৪]

নবী করিম সা. বলেছেন,
ইসলাম এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দুই সহোদর ভাই। তাদের একজন অপরজনকে ছাড়া সংশোধন হতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলাম হচ্ছে কোনো অট্টালিকার ভিত আর রাষ্ট্র ক্ষমতা হচ্ছে তার পাহারাদার। যে অট্টালিকার ভিত নেই তা যেমন পড়ে যেতে বাধ্য, তেমনি যার পাহারাদার ও রক্ষক নেই তাও ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য। [কানযুল উম্মাল]

মুসলমানরা সবসময় চালিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রকে ইসলামের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, ফলে ইসলামী দর্শনে ধর্ম ও রাজনীতি দুটি আলাদা জিনিস হবার কোনো সুযোগ বা অবকাশ নেই। এই চেষ্টা সংগ্রাম তাদের দ্বীন ও ঈমানের দাবী। তারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যেমন উত্তম চরিত্র এবং সদাচারের শিক্ষালাভ করে, তেমনি সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনীতির বিধানও তা থেকেই গ্রহণ করে। এই শেষোক্ত অংশের উপর আমল করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র অপরিহার্য। এই অংশের উপর আমল করা নাহলে শরীয়তের একটি অংশ বাদ পড়ে যায় এবং কুরআন চিত্রিত সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবে রূপলাভ করেনা। এ কারণেই উম্মতের ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম [রাষ্ট্র প্রধান] নির্বাচিত করাকে ফরয বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে অসতর্কতা প্রদর্শনকে তাঁরা দ্বীনি বিধান বাস্তবায়নে অসতর্কতা বলে গন্য করেছেন। 

আল্লামা ইবনে হাযম তাঁর 'আল ফাসলু বাইনাল মিলাল ওয়ান নাহল' গ্রন্থে লিখেছেনঃ
গোটা আহলে সুন্নাত, মারজিয়া, শীয়া এবং খারেজীগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কাউকে ইমাম নির্বাচন করা ওয়াজিব এবং উম্মতের উপর এরূপ ন্যায় পরায়ণ ইমামের আনুগত্য করা ফরয, যিনি আল্লাহ তা'য়ালার বিধান কায়েম করবেন এবং সেই শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেবেন, যা নিয়ে এসেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.। [ইবনে হাযমঃ ৪র্থ পৃষ্ঠাটঃ ৮৭]

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
'এই মুসলমানরাই সেই লোক, আমরা যদি পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা দান করি [অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি তারা কর্তৃত্ব পায়] তবে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সততার নির্দেশ দেবে, অন্যায় অপকর্মে বাধা দেবে। আর সকল বিষয়ের পরিণাম ফল তো আল্লাহরই হাতে।' [সূরা হজ্জঃ ৪১]

ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী শরীয়তে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ এবং সকল কাজ ও ব্যাপার সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন ও বিধান। জীবনের এমন কোনো দিক ও বিভাগের উল্লেখ করা যেতে পারে না, যে বিষয়ে ইসলামী শরীয়তে কোনো নির্দেশ পাওয়া যায় না। ইসলামের পূর্নাঙ্গ ব্যবস্থায় রয়েছে ইবাদাত, নৈতিক চরিত্র, আকীদা-বিশ্বাস এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাজকর্ম এবং লেনদেন পর্যায়ে সুস্পষ্ট বিধান। এর প্রত্যেকটি বিষয়ই ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। মানব সমাজের ব্যক্তি ও সমষ্টি-স্বতন্ত্রভাবে এক একজন ব্যক্তি অথবা সমষ্টিগতভাবে গোটা সমাজ সম্পর্কেই আইন-বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়তে। 

ইসলামী শরীয়তের বিধানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়েই আইন-বিধান দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি, তার পরামর্শভিত্তিক তথা গণতান্ত্রিক হওয়া, শাসন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা, ন্যায়সঙ্গত কাজে তাদের আনুগত্য, যুদ্ধ, সন্ধি, চুক্তি প্রভৃতি সর্ববিষয়ে অকাট্য বিধান রয়েছে ইসলামী শরীয়তে। আর তা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তাই নয়, রসূলে করীম স.-এর সুন্নাতেও রয়েছে তার ব্যাখ্যা ও বাস্তবরূপ সংক্রান্ত বিধান। কুরআন-হাদীসে আমীর, ইমাম ও সুলতান প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দগুলো বুঝায় সেই ব্যক্তিকে যার হাতে রয়েছে সার্বভৌমত্ব, শাসন ও আইন রচনার ক্ষমতা। আধুনিক পরিভাষায় তাই হলো সরকার বা গভর্নমেন্ট। সরকার বা গভর্নমেন্ট হলো রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই যেসব আয়াত এবং হাদীসের যেসব উক্তিতে এ পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা একান্তই জরুরী। কেননা, এগুলো শুধু পড়া বা মুখে উচ্চারণের জন্যেই বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে এজন্যে যে, তা যেমন পড়া হবে তেমনি তাকে কার্যকরী করাও হবে। আর এগুলো কার্যকরী করতে হলে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী পূর্নাঙ্গ রাষ্ট্র কায়েম করা অপরিহার্য।

শরীয়তের এমন অনেকগুলো আইন-বিধান রয়েছে যা কার্যকরী করতে হলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে সেগুলোর বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভবপর নয়। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের পরস্পরের বিচার-ফায়সালা করার এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে কুরআন-হাদীসে। কিন্তু রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ না করবে ততক্ষণ কোনো ব্যক্তি বা সমাজের সাধারণ মানুষের পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না। এজন্যেই জনগণের উপর কোনো কিছু কার্যকরী করার ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা একান্তই জরুরী। এ পর্যায়ের যাবতীয় হুকুম-বিধানের প্রকৃতিই এমনি। 

একথাটি বোঝাবার জন্যেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ
জনগণের যাবতীয় ব্যাপার সুসম্পন্ন করা-রাষ্ট্র কায়েম করা দীনের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। বরং রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠা হতেই পারে না। আল্লাহ তায়ালা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং নিপীড়িতদের সাহায্য করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি জিহাদ, ইনসাফ ও আইন-শাসন প্রভৃতি যেসব কাজ ওয়াজিব করে দিয়েছেন তা রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কর্তৃত্ব ছাড়া কিছুতেই সম্পন্ন হতে পারে না।
-আস-সিযাসাতুশ শরইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-১৭২-১৭৩।

অতএব শরীয়তের আইন-বিধান জারী ও কার্যকরী করার জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা একটি অপরিহার্য জরুরী কর্তব্য। আল্লাহর ইবাদাতের দায়িত্ব পালনের জন্যেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে তাঁরই ইবাদাত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের গোটা সমাজ ও পরিবেশকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে ইবাদত করা সহজ-সাধ্য হয়ে উঠে। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যেই যাপিত হয় মানুষের জীবন আর মানুষ যে সমাজ পরিবেশে বসবাস করে তার দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়াই হচ্ছে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি। এ প্রভাব স্বীকৃতির ফলেই মানুষ যেমন ভালো হয় তেমন মন্দও হয়। যেমন হয় হেদায়েতের পথের পথিক তেমনি হয় গোমরাহীর আঁধার পথের যাত্রী। সহীহ হাদীস থেকে সমাজ-পরিবেশের এ অনস্বীকার্য প্রভাবের কথা সমর্থিত। 

নবী করীম স. ইরশাদ করেছেনঃ
প্রত্যেকটি সন্তানই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাধীন জন্মগত প্রকৃতিতে ভূমিষ্ঠ হয়। অতঃপর তার পিতামাতা হয় তাদের ইহুদী বানিয়ে দেয়, নয় খৃষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক। ঠিক যেমন করে পশু প্রসব করে তার পূর্নাঙ্গ শাবক। তাতে তোমরা কোনো খুঁত দেখতে পাও কি, যতক্ষণ না তোমরা নিজেরা তাতে খুঁত সৃষ্টি করে দাও?- আল মুনতাখাব মিনাস সুন্নাহ, ৩৯১ পৃষ্ঠা।

রাষ্ট্রে যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকে তাহলে একটি শিশু ছোট অবস্থা থেকেই সুদ, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, অবিচার খোদাদ্রোহীতা, মূর্তিপূজা দেখে বড় হবে। আমাদের সমাজেও আমরা এসবে অভ্যস্থ হচ্ছি। অবস্থা এমন যে, সুদের ব্যবসায়ী ব্যাংকারেরা আজ আমাদের মাথার তাজ হয়ে উঠছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা সুদকে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার শামিল বলে গণ্য করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র না হওয়ায় আজ বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ অনৈসলামিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে।    

আল্লাহর রাসূল সা.-এর সীরাত থেকেও রাষ্ট্র গঠনের কর্মসূচি পেয়ে থাকি। রসূলে করীম সা. রাষ্ট্র কায়েমের জন্য মক্কায় থাকাবস্থায়-ই বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আর তার সূচনা হয়েছিল আকাবার দ্বিতীয়বারের শপথ কালে এবং মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করার পূর্বেই এ প্রচেষ্টা সম্পূর্ণতা লাভ করেছিলো। মদীনার মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল মক্কা শরীফে এক গোপন স্থানে রসূলে করীম স.-এর সাথে মিলিত হয়। পুরুষ ও নারী মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ছিলো তিয়াত্তর জন। এ গোপন বৈঠকে রসূলে করীম স. তাদের সামনে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করার দাওয়াত পেশ করেন। 

এ দাওয়াত পেশ করার পর প্রতিনিধি দলের একজন বলেনঃ হে রসূল! আপনার হাতে বাইয়াত করবো কোন কথার ওপর? রসূলে করীম স. বলেনঃ তোমরা আমার হাতে এই বলে বাইয়াত করবে যে, তোমরা ভালো ও মন্দ উভয় অবস্থাতেই আমার কথা শুনতে ও মেনে চলতে প্রস্তুত থাকবে, তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে লোকদের নিষেধ করবে-বিরত রাখবে। আর তোমরা আল্লাহর কথা বলবে, কিন্তু তাতে কোনো উৎপীড়কের ভয় করবে না। আর তোমাদের বাইয়াত হবে একথার ওপর যে, তোমরা আমার সার্বিক সাহায্য করবে। আর আমি যখন তোমাদের মাঝে এসে বসবাস করতে থাকবো তখন যেসব ব্যাপার থেকে তোমরা নিজেদেরকে, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে রক্ষা করো তা থেকে তোমরা আমাকেও রক্ষা করবে। আর এর বিনিময়ে তোমাদের জন্যে জান্নাত নির্দিষ্ট থাকবে। 

এরপর মুসলিমরা বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াতের মাধ্যমেই আল্লাহর রাসূল সা. কর্তৃক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।     


২৯ এপ্রি, ২০২৪

আদর্শ রাষ্ট্র, পর্ব -০১ : আদর্শ রাষ্ট্র ও আদর্শ মুসলিম!


আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা যার যার আদর্শ অনুযায়ী হবে। আমরা যেহেতু মুসলিম আমাদের আদর্শ রাষ্ট্র হলো সেই রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র ইসলামী আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আরেকটু ব্যাখ্যা করে যদি বলতে হয় তবে বলা যায়, আদর্শ রাষ্ট্র হলো সেই রাষ্ট্র যা ইসলামী আকিদা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

ইসলামী আকিদা হলো 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'। কালেমা তাইয়্যেবার বেসিক কথা হলো সকল বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনিই সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আর যেহেতু আল্লাহর মনোনীত রাসূল হলেন মুহাম্মদ সা.। সুতরাং তাঁর কথা ও কর্মকে অনুসরণ করতে হবে।

কালিমা তাইয়্যেবাকে মেনে নেওয়া মানে নিচের বিষয়গুলোও মেনে নেওয়া।

১- আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সাহায্যকারী, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা মনে না করা।
২- আল্লাহ ছাড়া কাউকে কল্যাণের কারণ ও আল্লাহ ছাড়া কাউকে বিপদদাতা মনে না করা।
৩- আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট দোয়া, প্রার্থনা ও আশ্রয় খোঁজা যাবে না।
৪- আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করা যাবে না।
৫- আল্লাহ ছাড়া কারো কাউকে সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করা যাবে না।
৬- মুহাম্মদ সা. থেকে প্রামাণ্যসূত্রে প্রাপ্ত সকল বিধান দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে হবে।
৭- আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা. থেকে প্রাপ্ত আদেশ ও নিষেধকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে।
৮- আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা. ছাড়া অন্য কারো নিরঙ্কুশ আনুগত্য করা যাবে না। বরং অন্য যে কাউকেই শরিয়ত দিয়ে বিচার করতে হবে।
৯- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার চাইতে অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসা যাবে না।
১০- মুহাম্মদ সা. ছাড়া অন্য কারো আনুগত্যের ব্যাপারে এমন মর্যাদা পোষণ না করা যে, তার আনুগত্য করার সাথে ঈমান ও কুফর ফয়সালা জড়িত।

অতএব যে রাষ্ট্রের আকিদা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' সেই রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হলো মুহাম্মদ সা. ও খুলাফায়ে রাশিদা শাসিত চল্লিশ বছর। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা পুরো মুসলিম উম্মাহকে ধারণ করতে পারে নি। সেই থেকে বিভিন্নভাবে আদর্শ মুসলিমরা বিভিন্ন পথে চেষ্টা করে যাচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য।

কারো কর্মপন্থা রাসূল সা. এর মতো হচ্ছে কিছু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নি। কেউ কেউ রাষ্ট্র গঠন করতে পেরেছে অথচ তাদের কর্মপন্থা রাসূল সা.-এর মতো নয়। কারো সফল হওয়ার সাথে সাথে কর্মপন্থাও সঠিক। কেউ সঠিক কর্মপন্থা ও সফলতা কোনোটারই দেখা পায় নি।

আমি সচেতনভাবে 'আদর্শ মুসলিম' শব্দটা ব্যবহার করেছি। এর একটি দুঃখজনক কারণ রয়েছে। বেশীরভাগ মুসলিমই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগী নয়। উদ্যোগী তো দূরের কথা অনেক মুসলিম ইসলামী আকিদা সম্পন্ন রাষ্ট্র গঠন করতে ইচ্ছুকই নয়। আবার কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র তথা আদর্শ রাষ্ট্রের বিরোধীতা করে যাচ্ছে। অথচ সবপক্ষই নিজেদের মুসলিম দাবি করে যাচ্ছে। যারা আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাদের জন্যই আমি 'আদর্শ মুসলিম' শব্দটা ব্যবহার করতে চাই।

আমি মনে করি যে বা যারা আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবে না তারা আদর্শ মুসলিম হওয়াটা দূরহ। কিন্তু সমাজে এমন মুসলিম খুবই এভেইলেবল যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অনৈসলামিক নিয়ম কানুন দেখে, কিন্তু তাদের শরীরে জ্বালাপোড়া করে না। সমাজের অনাচার দেখে তাদের কষ্ট হয় না। শিরক, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাভিচার দেখেও তাদের কষ্ট লাগে না। এই সমাজ পরিবর্তনে তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে চায় না। তারা মনে করে নিজে নামাজ পড়লে ও রোজা রাখলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।

আবার কেউ কেউ বলতে চায়, রাজনীতি নোংরা জায়গা। এখানে ইসলামকে এনে ইসলামকে কলুষিত করার কোনো মানে হয় না। ইসলাম ও রাজনীতি আলাদা। আমাদের খ্রিস্টান, মুশরিক ও ইয়াহুদী শত্রুরা আমাদের এভাবেই দেখতে চায়। যাতে করে আমরা রাজনীতি থেকে দূরে চলে যাই আর তারা আমাদের ওপর রাজত্ব করতে পারে। মুসলিমদের একটি বড় অংশ বুঝে কিংবা না বুঝে ইসলাম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতে চায়। তারা কীভাবে আদর্শ মুসলিম হতে পারে!

মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে 'আদর্শ রাষ্ট্র' নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করেছি। এই পরিকল্পনা অবশ্য বিগত বছরের। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় লেখালেখি ও পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। একটি ভূখণ্ডে যারা আদর্শিক রাজনীতি করতে চায় তাদের কয়েকটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক বলে মনে করি।

১. ঐ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস
২. যে আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করবে সে আদর্শ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান
৩. আদর্শ বাস্তবায়িত হয়েছে এমন কোনো প্রায়োগিক রাষ্ট্রের উদাহরণ পর্যালোচনা
৪. বর্তমান পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা

১ম অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে আমি একটি বই লিখেছি 'বঙ্গকথা' নামে, যা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ২য় অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা.' নামে একটি ধারাবাহিক লেখা লিখেছি। ৩য় অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'রাশিদুন খিলাফত' নামে ধারাবাহিক লেখা তৈরি করেছি। সর্বশেষ অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'আদর্শ রাষ্ট্র' নামে ধারাবাহিক লেখা আজ শুরু করলাম। সাথে থাকুন। আপনাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে সমৃদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা #আদর্শ_রাষ্ট্র : পর্ব-০১

আগের লেখাগুলোর লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া হয়েছে।

২৫ এপ্রি, ২০২৪

যে দোয়া আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন!


একবার রাসূলুল্লাহ সা. একজন বেদুঈনের নিকট হতে একটি ঘোড়া ক্রয় করেন। রাসূল সা.-এর হাতে ঐ সময় পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তিনি বিক্রেতা লোকটিকে তার সাথে ঘোড়ার মূল্য নেওয়ার জন্য বাড়িতে আসতে বলেন।  বেদুঈন মূল্য নেয়ার উদ্দেশ্যে রাসূল সা.-এর পিছনে পিছনে তার বাড়ীর দিকে আসতে থাকে। 

মহাম্মদ সা. খুব দ্রুত চলছিলেন এবং বেদুঈনটি ধীরে ধীরে চলছিল। ঘোড়াটি যে বিক্রি হয়ে গেছে এ সংবাদ জনগণ জানতো না বলে তারা ঐ ঘোড়ার দাম করতে থাকে। বিক্রেতার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। সে কাউকে বলছে না ঘোড়াটি বিক্রি হয়ে গেছে। 

বিক্রেতা লোকটি ঘোড়াটি দাম দর করতে থাকে। এক পর্যায়ে  এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট ঘোড়াটি যে দামে বিক্রি করেছিল তার চেয়ে বেশী দাম নির্ধারণ হয়ে যায়। বেদুঈন নিয়্যত পরিবর্তন করে রাসূলুল্লাহ সা.-কে ডাক দিয়ে বলে, আপনি হয় ঘোড়াটি এখনই ক্রয় করুন, না হয় আমি অন্যের হাতে বিক্রি করে দেই।' 

একথা শুনে নবী সা. থেমে যান এবং বলেন- 'তুমি তো ঘোড়াটি আমার হাতে বিক্রি করেই ফেলেছো; সুতরাং এখন আবার কি বলছো? বেদুঈনটি তখন বলে, 'আল্লাহর শপথ! আমি বিক্রি করিনি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার ও আমার মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় হয়ে গেছে। ঐ ব্যাক্তি তখন বলে, আমি আপনার নিকট বিক্রি করেছি তার পক্ষে সাক্ষী আনয়ন করুন। মুসলমানগণ তাকে বারবার বলে, ওরে হতভাগা! তিনি তো আল্লাহর রাসূল, তার মুখ দিয়ে শুধু সত্য কথাই বের হয়। 

কিন্তু তার এই একই কথা-সাক্ষ্য আনয়ন করুন। এমন সময় হযরত খুযাইমা রা. এসে পড়েন এবং বেদুঈনের কথা শুনে বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ঘোড়াটি বিক্রি করেছ। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে বলেন, তুমি কি করে সাক্ষ্য দিচ্ছ? তিনি বলেন, আপনার সত্যবাদিতার উপর ভিত্তি করে। 

এই ঘটনার মতো আরো ঘটনা, লেনদেনে ও ঋণ চুক্তিতে ফাসাদের খবর পাওয়া যায় মদিনাতে। তাই আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারায় ১৮২ নং আয়াতে চুক্তি, ঋণ ইত্যাদি বিষয়ে নীতিমালা নাজিল করেছেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, হযরত আদম আ. স্বয়ং অস্বীকারকারী। সুতরাং তার সন্তানেরা অস্বীকার করবেই। তাই আল্লাহ তায়ালা এই গাইডলাইন নাজিল করেছেন। 

আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে দেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর যতগুলো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সবাই বেরিয়ে আসে। হযরত আদম আ. তাঁর সন্তানদেরকে স্বচক্ষে দেখতে পান। একজনকে অত্যন্ত হৃষ্ট পুষ্ট ও ঔজ্জ্বল্যময় দেখে জিজ্ঞেস করেন,
- হে আল্লাহ! এর নাম কি? 
- এটা তোমার সন্তান দাউদ। 
- তার বয়স কত হবে? 
- ষাট বছর। 
- তার বয়স কিছুদিন বাড়িয়ে দিন! 
- না, তা হবে না। তবে তুমি যদি তোমার বয়সের মধ্য হতে তাকে কিছু দিতে চাও তবে দিতে পার। 
- ইয়া আল্লাহ! আমার বয়সের মধ্য হতে চল্লিশ বছর তাকে দেওয়া হোক। 

সুতরাং তা দেয়া হয়। হযরত আদম আ. এর প্রকৃত বয়স ছিল এক হাজার বছর। বয়সের এই আদান-প্রদান লিখে নেয়া হয় এবং ফেরেশতাদেরকে ওর উপর সাক্ষী রাখা হয়। 

হযরত আদমের আ.-এর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমার বয়সের এখনও তো চল্লিশ বছর অবশিষ্ট রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তখন বলেন, 'তুমি তোমার সন্তান দাউদকে চল্লিশ বছর দান করেছ। 

হযরত আদম আ. তা অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে ঐ লিখা দেখানো হয় এবং ফেরেশতাগণ সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে মুহাম্মদ সা. বলেন, অস্বীকার করা, ভুলে যাওয়া আদম সন্তানদের বৈশিষ্ট্য। 

চুক্তির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
১. হে ঈমানদারগণ! যখন কোন নির্ধারিত সময়ের জন্য তোমরা পরস্পরে মধ্যে ঋণের লেনদেন করো তখন লিখে রাখো। 

২. উভয় পক্ষের মধ্যে ইনসাফ সহকারে এক ব্যক্তি দলীল লিখে দেবে। আল্লাহ‌ যাকে লেখাপড়ার যোগ্যতা দিয়েছেন তার লিখতে অস্বীকার করা উচিত নয়। সে লিখবে এবং লেখার বিষয়বস্তু বলে দেবে সেই ব্যক্তি যার ওপর ঋণ চাপছে (অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা)। তার রব আল্লাহ‌কে তার ভয় করা উচিত। যে বিষয় স্থিরীকৃত হয়েছে তার থেকে যেন কোন কিছুর কম বেশি না করা হয়। 

৩. কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি বুদ্ধিহীন বা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে, তাহলে তার অভিভাবক ইনসাফ সহকারে লেখার বিষয়বস্তু বলে দেবে। 

৪. তারপর নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তিকে তার স্বাক্ষী রাখো। আর যদি দু'জন পুরুষ না পাওয়া যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দু'জন মহিলা সাক্ষী হবে, যাতে একজন ভুলে গেলে অন্যজন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। এসব সাক্ষী এমন লোকদের মধ্য থেকে হতে হবে যাদের সাক্ষ্য তোমাদের কাছে গ্রহণীয়। 

৫. সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেবার জন্য বললে তারা যেন অস্বীকার না করে। 

৬. ব্যাপার ছোট হোক বা বড়, সময়সীমা নির্ধারণ সহকারে দলীল লেখাবার ব্যাপারে তোমরা গড়িমসি করো না। 

৭. আল্লাহ‌র কাছে তোমাদের জন্য এই পদ্ধতি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত, এর সাহায্যে সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা বেশী সহজ হয় এবং তোমাদের সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। 

৮. তবে যেসব ব্যবসায়িক লেনদেন তোমরা পরস্পরের মধ্যে হাতে হাতে করে থাকো, সেগুলো না লিখলে কোন ক্ষতি নেই।

৯. কিন্তু ব্যবসায়িক বিষয়গুলো স্থিরীকৃত করার সময় সাক্ষী রাখো। লেখক ও সাক্ষীকে কষ্ট দিয়ো না। এমনটি করলে গোনাহের কাজ করবে। 

১০. আল্লাহ‌র গযব থেকে আত্মরক্ষা করো। তিনি তোমাদের সঠিক কর্মপদ্ধতি শিক্ষা দান করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন। 

মহান রাব্বুল আলামীন এই গাইডলাইন দিয়েছে সূরা বাকারের ২৮২ নং আয়াতে। 

এর পর ২৮৩ নং আয়াতে সফরকালীন বিশেষ অবস্থার গাইডলাইন দিয়েছেন। 

১. যদি তোমরা সফরে থাকো এবং এ অবস্থায় দলীল লেখার জন্য কোন লেখক না পাও, তাহলে বন্ধক রেখে কাজ সম্পন্ন করো। 

২. যদি তোমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি অন্যের ওপর ভরসা করে তার সাথে কোন কাজ কারবার করে, তাহলে যার ওপর ভরসা করা হয়েছে সে যেন তার আমানত যথাযথরূপে আদায় করে এবং নিজের রব আল্লাহকে ভয় করে। আর সাক্ষ্য কোনোক্রমেই গোপন করো না।

৩. যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করে তার হৃদয় গোনাহর সংস্পর্শে কলুষিত। আর আল্লাহ‌ তোমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বেখবর নন।

এরপর ২৮৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হুমকি দিলেন যারা চুক্তি পরিপালন করবে না তাদের ব্যাপারে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
১. আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর। 
২. তোমরা নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করো বা লুকিয়ে রাখো, আল্লাহ‌ অবশ্যি তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
৩. তারপর তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন, এটা তাঁর এখতিয়ারাধীন। 
৪. তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তি খাটাবার অধিকারী।

এই আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম অস্থির হয়ে গেলেন এবং রাসূল সা.-এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতদিন আমরা মনে করতাম যে, আমাদের ইচ্ছাকৃত কাজেরই হিসাব হবে। মনে যেসব অনিচ্ছাকৃত কল্পনা আসে, সেগুলোর হিসাব হবে না। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিটি কল্পনারও হিসাব হবে। এতে তো শাস্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সাংঘাতিক কঠিন মনে হয়। 

মহানবী রাসূল সা. নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা সমীচীন মনে করলেন না বরং ওহীর অপেক্ষায় রইলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে আপাততঃ আদেশ দিলেন যে, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে যে নির্দেশ আসে, তা সহজ হোক কিংবা কঠিন - মুমিনের কাজ হলো তা মেনে নেয়া। 

সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা.-এর নির্দেশমত কাজ করলেন; যদিও তাদের মনে এ সংশয় ছিল যে, অনিচ্ছাকৃত কল্পনা ও কু-চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা'আলা প্রথমে মুসলিমদের আনুগত্যের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ ভঙ্গিতে ঐ সন্দেহের নিরসন করে ২৮৬ নং আয়াতে বলেন, আল্লাহ তা'আলা কাউকে তার সাধ্যের বহির্ভূত কোন কাজের নির্দেশ দেন না। 

কাজেই অনিচ্ছাকৃতভাবে যেসব কল্পনা ও কু-চিন্তা অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এরপর সেগুলো কার্যে পরিণত করা না হয়, সেসব আল্লাহ্‌ তা'আলার কাছে মাফযোগ্য। যেসব কাজ ইচ্ছে করে করা হয়, শুধু সেগুলোরই হিসাব হবে। কুরআনে বর্ণিত এ ব্যাখ্যার ফলে সাহাবায়ে কেরামের মানসিক উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।

এরপর আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদেরকে ২৮৬ নং আয়াতেই কয়েকটি বিশেষ দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে বলা হয়েছে।

১. رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
রব্বানা-লা-তু আ-খিযনা ইন নাছীনা-আও আখত'না

হে আমাদের রব! আমরা যদি ভুলে যাই, অথবা ভুল করি তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না।

২. رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا

রব্বানা ওয়ালা-তাহমিল আলাইনা ইসরান কামা-হামালতাহূ আলাল্লাযীনা মিন কাবলিনা

হে আমাদের রব, আমাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।

৩. رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

রব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা-মা-লা-তা-কাতা লানা-বিহী ওয়া'ফু'আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা আনতা মাওলা-না-ফানসুরনা আলাল কাওমিল কা-ফিরীন।

হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না, যার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমাদের প্রতি কোমল হন, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি করুণা করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। কাফেরদের মোকাবিলায় আপনি আমাদের সাহায্য করুন।

#রব্বানা