১৯ এপ্রি, ২০১৯

আবার কেন গৃহযুদ্ধ জেগে উঠেছে লিবিয়াতে?



২০১১ সালে যখন পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহীদের হাতে স্বৈরাচারী কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। তারপর থেকে লিবিয়ায় চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য এবং অরাজকতা। রাজধানী ত্রিপলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন নতুন করে শুরু হয়েছে লড়াই। ফলে লিবিয়া পুনর্গঠনের জন্য এমাসে একটি জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ যেটা আছে তা ভেস্তে যেতে পারে। এই ভেস্তে যাওয়ার পেছনে আমেরিকার হাত থাকলেও প্রকাশ্যে উস্কানিতে লিপ্ত রয়েছে সৌদির মুহাম্মদ বিন সালমান। খলিফা হাফতার রিয়াদ থেকে তহবিল গ্রহণ করেই ত্রিপলিতে হামলা চালিয়েছে। 

লিবিয়ায় এখন নানা মত ও পথের অসংখ্য সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী তৎপর। দেশের পূর্বে এবং পশ্চিমে রয়েছে দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক শাসন কেন্দ্র । কিছু মিলিশিয়া দল পূর্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুগত, কিছু আবার সমর্থন করে পশ্চিমের অর্থাৎ ত্রিপলি নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনকে। মোটাদাগে দুটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত আছে। 

জাতীয় ঐক্যমতের সরকার : 
রাজধানী ত্রিপলি নিয়ন্ত্রণ করছে যে সরকার সেটি জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার (Government of National Accord) নামে পরিচিত। জাতিসংঘ এই সরকারকে লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফায়েজ সারাজ নামে একজন প্রকৌশলী এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার গঠনে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি চুক্তির চার মাস পর ২০১৬ সালের মার্চে তিনি ত্রিপলিতে আসেন। গত তিন বছর ধরে মি সারাজ বিভিন্ন মিলিশিয়া এবং রাজনীতিকদের সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু পুরো দেশের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি তার প্রশাসনের যে সেনাবাহিনী রয়েছে, তার ওপরও তার পূর্ণ কর্তৃত্ব নেই।

তবরুক সরকার : 
২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের পর যে পার্লামেন্ট গঠিত হয় তাদের নিয়ে শুরু হয় এই সরকার। কিন্তু সেসময় যারা রাজধানী ত্রিপলি নিয়ন্ত্রণ করছিল তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ এমপিরা তখন ১০০০ কিলোমিটার দূরে বন্দর শহর তবরুকে চলে যান। ২০১৫ সালে এই এমপিদের কেউ কেউ জাতিসংঘের উদ্যোগে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের চুক্তি সমর্থন করেন। কিন্তু তবরুক পার্লামেন্ট এখন পর্যন্ত ঐ সরকারকে সমর্থন দেয়নি।

এই সংসদ নতুন একটি নির্বাচনের প্রস্তাবও মানতে চাইছে না, কারণ তারা নিশ্চয়তা চাইছে যে ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এনএলএ নামের মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধান জেনারেল খালিফা হাফতারকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে হবে। ঐ সংসদের এমপিদের অনেকেই খোলাখুলি বলেন যে জেনারেল হাফতারকেই ক্ষমতা দিতে হবে।

লিবিয়াতে এখন যার হাতে যত বেশি অস্ত্র , তার শক্তি এবং প্রভাবও তত বেশি। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন লিবিয়া এখন অস্ত্রের বাজারে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফি সরকারের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে লুট হওয়া অস্ত্রে ছেয়ে গেছে লিবিয়া। আশপাশের একেকটি দেশ একেকটি যোদ্ধা গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে, অস্ত্র যোগাচ্ছে। এসব যোদ্ধারা নিজেদের সুবিধামত সময়ে সময়ে আনুগত্য পরিবর্তন করছে।

যখন এসব যোদ্ধাগোষ্ঠী গাদ্দাফির বিরোধিতা করেছিলো তখন গাদ্দাফির পতন ইস্যুতে এই যোদ্ধারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু আর কোনো কিছুতেই তাদের মধ্যে মতের মিল ছিলনা। গাদ্দাফিকে হঠানোর লড়াইও কোনো একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে হয়নি। একেকটি শহরে ছিল একেক বাহিনী। তারা তাদের নিজের নিজের স্বার্থ রক্ষায় লড়াই করছিলো। স্বার্থ ছাড়াও আদর্শগতভাবেও তারা বিভক্ত ছিল - কেউ কেউ ছিল কট্টর ইসলামপন্থী, কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী, কেউ ছিল রাজতন্ত্রের পক্ষে, আবার কেউ ছিল রাজনৈতিকভাবে উদারপন্থী।

এসব যোদ্ধাদের কোনো কোনোটির কাছে আবার নেহাতই আঞ্চলিক এবং জাতি ও গোষ্ঠী-গত স্বার্থ রক্ষাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সব মিলিয়ে জটিল এক জালে জড়িয়ে গেছে লিবিয়া। দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের পতন হলেও গত আট বছরে গণতন্ত্রের মুখ দেখেনি লিবিয়ার মানুষ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণাও খুবই কম সেখানে।

কে এই জেনারেল হাফতার ?
১৯৬৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানে কর্নেল গাদ্দাফিকে সমর্থন করেছিলেন জেনারেল খালিফা হাফতার। । কিন্তু চাদে অভিযান নিয়ে ১৯৮০র দশকে এসে তার সাথে গাদ্দাফির সম্পর্ক চটে গেলে, তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। এরপর গাদ্দাফিকে উৎখাতের জন্য লড়াই শুরু হওয়ার পর তিনি দেশে এসে বিদ্রোহে যোগ দেন। শুরুতে তিনি আইএস-কে সমর্থন দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। পরে আইএস-কে হটিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দখলে নিয়ে নেন। 

বেনগাজি দখলের পর তিনি লিবিয়ার সর্বেসর্বা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু বিরোধ তৈরি হয় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তির একটি শর্ত নিয়ে যাতে বলা হয়েছে কোনো সামরিক ব্যক্তিত্বকে সরকারের উঁচু পদে নিয়োগ করা যাবেনা। তবে জাতীয় ঐক্যের ঐ চুক্তির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেন না জেনারেল হাফতার। জানুয়ারিতে তার অনুগত বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলের দুটো তেলক্ষেত্র দখল করে নেয়। বলা হয়, লিবিয়ার তেলের খনিগুলোর সিংহভাগই এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন জেনারেল হাফতার।

বহুদিন আমেরিকায় নির্বাসনে থাকা ও সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে থাকা হাফতার পশ্চিমা সমর্থন পাচ্ছে জোরালোভাবে। মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত অনেকদিন ধরেই জেনারেল হাফতারকে সমর্থন করছে। এ মাসে ত্রিপলি দখলের অভিযান শুরুর এক সপ্তাহ আগে তিনি সৌদি আরব সফর করে এসেছেন। সেখানে যুবরাজ বিন সালমান তাকে প্রকাশ্য সমর্থন দেন এবং যুদ্ধ করার জন্য কোটি কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। 

এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি কয়েকবার রাশিয়ায় গেছেন। লিবিয়ার উপকূলের কাছে একটি রুশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে তাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ মাসেই ত্রিপলিতে অভিযানের নিন্দা করে নিরাপত্তা পরিষদে এক প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্র প্রথম কোনো পশ্চিমা নেতা যিনি জেনারেল হাফতারকে লিবিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান। ফেব্রুয়ারিতে তার বাহিনীর সমর্থনে লিবিয়ায় বিমান হামলা চালায় ফ্রান্স।

তবে লিবিয়ার অধিকাংশ গোষ্ঠী ও জনগণ হাফতারের বিপক্ষে। কারণ তারা মনে করে খলিফা হাফতার পশ্চিমাদের গুটি এবং স্বৈরাচার হিসেবে তার মধ্যে আর গাদ্দাফির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই জেনারেল হাফতারকে প্রতিহত করতে অনেক যোদ্ধা গোষ্ঠী জড় হচ্ছে ত্রিপলিতে। 

লিবিয়ার প্রধান প্রধান যোদ্ধা গোষ্ঠী : 
জেনারেল হাফতারের স্বঘোষিত লিবিয়া ন্যাশনাল আর্মি (এনএলএ) বর্তমানে লিবিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর মিলিশিয়া গোষ্ঠী। পশ্চিমা সামরিক সাহায্য ও মধ্যপ্রাচ্যের অর্থ সাহায্য প্রকট হওয়ায় তারা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এছাড়াও লিবিয়ার সাবেক সেনাবাহিনীর বেশ কিছু ইউনিট রয়েছে এই বাহিনীতে। একমাত্র এদেরই যোদ্ধাদেরই যুদ্ধবিমান রয়েছে। তবরুক-ভিত্তিক সরকার এনএলএ-কে সমর্থন করে। এই বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজিতে। দক্ষিণের বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠী এবং রক্ষণশীল সালাফি যোদ্ধাদের সমর্থন পাচ্ছে তারা।

ত্রিপলিতে তৎপর মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ত্রিপলি প্রটেকশন ফোর্স। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রধানত চারটি যোদ্ধা গোষ্ঠী মিলে এটি তৈরি হয়েছে : ত্রিপলি রেভল্যুশনারি, আবু সালিম সেন্ট্রাল সিকিউরিটি ফোর্সেস, নাওয়াসি ব্যাটালিয়ন এবং স্পেশাল ডেটারেন্স ফোর্সেস। ত্রিপলি-ভিত্তিক সব গোষ্ঠীই সেখানকার বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেনা। তাদের একটি সালাহ আল-বুরকি ব্রিগেড। তবে তারা জেনারেল হাফতারের ঘোরতর বিরোধী।

মিসরাতা কেন্দ্রিক ৩১০তম ব্রিগেড- যারা কর্নেল গাদ্দাফি এবং পরবর্তীতে আইএসকে উৎখাতের লড়াইতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল- তারা জেনারেল হাফতারের এলএনএ-কে ঠেকানোর জন্য ত্রিপলিতে যোদ্ধা পাঠিয়েছে। ত্রিপলির আশপাশের শহরগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই ভিন্ন ভিন্ন মিলিশিয়া দল রয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর হচ্ছে তারহুনা সেভেনথ ব্রিগেড। তারাই এলএনএ-র হাতে ত্রিপলির পতন ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে এবং এলএনএ বিরোধী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমন্বয় করছে।

লিবিয়ায় ধীরে ধীরে যোদ্ধা গোষ্ঠিগুলো নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে এনেছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধবাজ বিন সালমান ও পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা লিবিয়াকে আবারো ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সিরিয়ায় যুদ্ধ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় তাদের রক্তের নেশা চরিতার্থ করতে তারা আবারো লিবিয়ার দিকে নজর দিয়েছে।