২৩ জানু, ২০২১

ওহে মুমিনরা! স্মরণ করো হুনাইনের কথা!



মক্কা বিজয়ের ১৮ তম দিন। রাসূল সা. তখন বিজয়ীর বেশে। মক্কা পুনর্গঠিত করছেন, নিজের মতো করে সাজাচ্ছেন। এমন সময় খবর এলো বনু হাওয়াজেন ও বনু সাকীফ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি সহকারে। এই নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ সৃষ্টি হলে আল্লাহর রাসূল সা. স্মিত হেসে বললেন, ইনশাআল্লাহ্‌ তাদের প্রস্তুত সামান আমাদের গনিমত হবে। 


মহানবী সা. কালবিলম্ব না করেই পরদিন অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের ১৯ তম দিনে রওনা হয়ে গেলেন হুনাইনের দিকে। যেখানে বনু হাওয়াজেনের অবস্থান। হুনাইন হচ্ছে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। মহানবী সা. দ্রুত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাতে তারা সংগঠিত হওয়ার আগেই মোকাবিলা করা যায়। এই সিদ্ধান্ত কাজে দিয়েছে। তায়েফ থেকে তখনো বনু সাকীফ হুনাইনে পৌঁছাতে সক্ষম হয় নি।   

 

আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা থেকে ১০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে এসেছেন। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান রা. ও তার ছেলে মুয়াবিয়া রা.-সহ নতুন দুই হাজার মুসলিম সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়। কয়েকটি কারনে মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস চরমে পৌঁছে যায়। প্রথমত বনু সাকীফের সাহায্য আসে নি। দ্বিতীয়ত রাসূল সা. বলেছেন, তাদের মাল-সামান আমাদের গনিমত হবে। তৃতীয়ত ঐ সময় মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো বিপুল আর তাদের যুদ্ধ-সরঞ্জামও ছিলো প্রচুর।  এটা দেখেই তাদের মনে পূর্ণ প্রত্যয় জন্মালো যে, দুশমনরা তাদের মুকাবিলা করতে কিছুতেই সমর্থ হবে না। বরং অচিরেই তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এমন কি, কোনো কোনো মুসলমানের মুখ থেকে এ উক্তি পর্যন্ত বেরিয়ে পড়লো, ‘আজ আর আমাদের ওপর কে জয়লাভ করতে পারে'! 


কিন্তু এরূপ ধারণা মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কিছুমাত্রও সামঞ্জস্যশীল ছিল না। কারণ মুসলিমদের বিজয় তাদের দুনিয়াবি শক্তি সামর্থের ওপর নির্ভর করে না। মুসলিমদের বিজয় আসে আল্লাহর ইচ্ছেয় ও আল্লাহর সাহায্যে। এজন্য মুসলিমদের আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমানদার হতে হয়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হয়। বিজয়ের শর্ত এটাই। এই ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনে নির্দেশ করেছেন। মুসলিমদের কখনো আপন শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভরসা করা উচিত নয়। তাদের শক্তি হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার দয়া ও করুণা। 


মুসলমানরা হুনাইনের প্রান্তরে আসা মাত্র বনু হাওয়াজেন মৃদু প্রতিরোধ করলো ও পিছু হটতে লাগলো। এটা ছিল একটি ফাঁদ। নির্দিষ্ট স্থানে মুসলিম বাহিনীকে এনে তারা কিছু মালামাল ফেলে পালিয়ে গেল। মুসলিমরা যুদ্ধ শেষ ভেবে মালামাল কুড়াতে লাগলো। এমন সময় শত্রুরা আশ-পাশের পাহাড় থেকে উপুর্যপুরি তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলো।


এ পরিস্থিতির জন্যে মুসলমানরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের সৈন্যদলে বিশৃংখলা দেখা দিলো এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা ময়দান ত্যাগ করলো। অনেক বেদুইন গোত্র ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল সবেমাত্র ঈমান এনেছে এবং পূর্ণ প্রশিক্ষণ পায়নি এমন নও-মুসলিম। আবু সুফিয়ান রা. ভয় পেয়ে বললেন, ওরা সমুদ্রের পাড়ে না গিয়ে থামবে না। আরেক নতুন সাহাবী বললেন, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে।  


এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে আমাদের নেতা মুহাম্মদ সা. অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রশান্ত চিত্তে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুশমনদের মুকাবিলা করা ও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানাতে লাগলেন। 


সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সা. আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল! তোমরা আমার দিকে এসো, আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সেই সময় রসূল সা.এর কাছে কয়েকজন মুহাজির এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় এই সংখ্যা মাত্র ৮০ জনের কাছাকাছি। ১২০০০ সেনার মধ্যে মাত্র ৮০ জনকে পাওয়া গেল যারা তীর বৃষ্টির মধ্যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে তীর ঠেকাচ্ছিলেন। এরাই মুহাজির। এরাই সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। 


রাসূল সা. শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাজিব!  অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই। এরপর রসূল সা. তাঁর চাচা হযরত আব্বাস রা.-কে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করেন। হযরত আব্বাস রা.-এর ছিলো দরাজ গলা। তিনি বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, 

কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা? কোথায় বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা? 


পলায়নপর সাহাবারা হঠাত থমকে দাঁড়ালেন। হুনাইয়ের উপত্যাকায় রব উঠে গেল। সাহাবারা চিৎকার করে বলতে লাগলেন আমরা আছি! আমরা আসছি! সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলেন। আব্বাস রা. বলেন, সাহাবার আমার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়াজ শুনে বাছুর ছুটে আসে। রাসূল সা. আবার সাহাবাদের সংগঠিত করে যুদ্ধ শুরু করলেন। সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। 


দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। দু'পক্ষই মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। রাসূল সা. সাহাবাদের নিষ্ঠা দেখে সন্তুষ্ট হলেন। এরপর রাসূল সা. রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ‍ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো। আল্লাহর সাহায্যে হুনায়েনের প্রান্তরে বিজয় আসলো। মুশরিকদের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত এবং সহস্রাধিক লোক বন্দী হলো।


এই প্রসঙ্গ আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষার জন্য কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মহান রব সূরা তাওবায় ২৫ ও ২৬ আয়াতে উল্লেখ করেন, 

‘হুনাইনের দিনকে স্মরণ করো, যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্যতে তুষ্ট ছিলে; কিন্তু তাতে তোমাদের কোনো কাজ হয়নি; বরং জমিন প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়েছিলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের ওপর নিজের তরফ থেকে সান্ত্বনা ও প্রশান্তির ভাবধারা নাযিল করলেন এবং তোমরা দেখতে পাওনি এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শাস্তি দিলেন। কাফিরদের জন্যে এমনি শাস্তিই নির্ধারিত।’


নবী করীম (স) এবং তার সাহাবীদের এই ধৈর্য ও দৃঢ়তাকেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ সান্ত্বনা ও প্রশান্তির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে অদেখা সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো এবং মুসলমানরা পুরোপুরি জয়লাভ করলো। আল্লাহু আকবার। 


আমার এই লেখা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের জন্য। আমরা আজকে আমাদের কাঙ্খিত বিজয় না আসার জন্যে নানান বিষয় আমাদের বিবেচনায় আনি। এই বিবেচনা ও পর্যালোচনায় আমরা লোকে কী বলবে? অমুককে কীভাবে বোঝাবো? কীভাবে আমরা সংখ্যাধিক্যে পৌঁছাবো? এসব বেশি পর্যালোচনায় আনি। যে বিষয়টা পর্যালোচনায় আনি না তা হলো কীভাবে আমরা আরো ভালো ঈমানদার হবো? আমরা কীভাবে আরো বেশি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করবো এই চিন্তা আমাদের মধ্যে কমে গেছে। আমরা সাহাবা ও আল্লাহর ওলিদের ফানাফিল্লাহকে গালগল্প বানিয়ে ফেলেছি। আমরা বৈষয়িক উপায় উপকরণকে বিজয়ের মূল উপজীব্য করে নিয়েছি। 


আমরা আমাদের বিজয়ের জন্য অনুসরণ করছি কীভাবে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করেছে? আমরা বারাক ওবামার থিম নেওয়ারও চেষ্টা করি অথচ আমাদের উচিত নবীর দেখানো পথ। সাহাবাদের দেখানো পথ। ক্ষমা করবেন। উপায় উপরকণকে আমি অস্বীকার করি না বরং মনে করি পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রযুক্তি আমাদের থাকা উচিত। এটা সহায়ক শক্তি। তবে এটা মূল উপজীব্য হতে পারবে না। আল্লাহ আমাদের বিজয়ের জন্য শর্ত দিয়েছেন "আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান"। মহান রব বলেন, তোমরা হতাশ হয়োনা, চিন্তিত হয়োনা, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও” (সূরা আলে ইমরান-১৩৯)


আত্মার ভাইয়েরা! যে পথে আওয়ামী লীগ, জো বাইডেন, বিজেপি, কংগ্রেসের বিজয় আসবে সে পথে ইসলামের বিজয় আসবে না। ইসলামের বিজয় আসবে আল্লাহর ইচ্ছেয় ও সাহায্যে। যেভাবে হুনায়েনের প্রান্তরে এসেছিলো। এটাই সূরা তাওবার ২৫-২৬ আয়াতের শিক্ষা। 


মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের জন্য সব বিষয় উল্লেখ করে রেখেছেন। আসুন আমরা আল্লাহর দিকে নিজেকে সমর্পন করি।

১৬ জানু, ২০২১

আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে কেন নবী করে পাঠিয়েছেন?


আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে আমাদের নিকট নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন কেন এই ব্যাপারে তিনি কিছু নিদর্শন বা আয়াত কুরআনে নাজিল করেছেন। আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। এর কারণ আমরা অনেকেই রাসূলের সীরাত বা জীবনী পাঠ করি। এই জীবনী পড়ে আমরা আপ্লুত হই, অনুপ্রেরণা পাই। কিন্তু জীবনী পড়ার জন্য যদি আপনি মূল টার্গেট নির্ধারণ না করেন তবে জীবনী পড়াটা আবেগে আপ্লুত হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাই আমাদের প্রথমে জানতে হবে কেন আল্লাহ রাসূল সা.-কে পাঠিয়েছেন। কী ছিল তার কাজ? যদি আমরা এটা জানতে পারি তারপর আমাদের পক্ষে রাসূলের অনুসরণ করা সহজ হবে। 

প্রথমত উসওয়াতুন হাসান বা উত্তম আদর্শ 
আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে বলেন, "অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।" 

আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে আমাদের মডেল বা আদর্শ তৈরি করেছেন। যাতে আমরা তাঁকে অনুসরণ করতে পারি। আল্লাহর আদেশের বাস্তবায়ন নিজের ইচ্ছেমত না হয়ে রাসূল সা.-এর পদ্ধতি অনুসরণ করেই করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত রাহমাতুল্লিল আলামীন বা দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত
আল্লাহ তায়ালা সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে বলেন, (হে মুহাম্মাদ) আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।

নবী সা.-এর আগমন আসলে মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ। কারণ, তিনি এসে গাফলতিতে ডুবে থাকা দুনিয়াকে জাগিয়ে দিয়েছেন। তাকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক করার জ্ঞান দিয়েছেন। দ্বিধাহীন ও সংশয় বিমুক্ত পদ্ধতিতে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য ধ্বংসের পথ কোনটি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পথ কোনটি। মক্কার কাফেররা নবী সা.-এর আগমনকে তাদের জন্য বিপদ ও দুঃখের কারণ মনে করতো। তারা বলতো, এ ব্যক্তি আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, নখ থেকে গোশত আলাদা করে রেখে দিয়েছে। তাদের একথার জবাবে বলা হয়েছে, অজ্ঞের দল! তোমরা যাকে দুঃখ ও কষ্ট মনে করো তা আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রহমত। তাকে অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত, নাজাত ও মুক্তি হাসিল হবে।

তৃতীয়ত মুয়াল্লিম বা শিক্ষক 
আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১২৯ নং আয়াতে ইবরাহিম ও ইসমাঈল আ.-এর দোয়া উদ্ধৃত করেন। সেখানে তারা বলেন, হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে (নিজেদের বংশধর) তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।

হজরত ইবিরাহিম আ. ও ইসমাঈল আ. যখন কাবার দেয়াল তৈরি করছিলেন তখন তারা তাদের বংশধরদের জন্য আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং তাদের সন্তানদের মধ্য থেকে মুহাম্মদ সা.-কে মানবজাতির শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেন।

চতুর্থত মুবাশ্বির ও নাজির বা সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী
আল্লাহ তায়াল সূরা বনী ইসরাইলের ১০৫ নং আয়াতে বলেন, আমি তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। একই কথা আল্লাহ তায়ালা রিপিট করেছে সূরা ফুরকানের ৫৬ নং আয়াতে, সূরা সাবা'র ২৮ নং আয়াতে ও সূরা ফাতিরের ২৪ নং আয়াতে। 

অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল সা.-কে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে যাতে তিনি মানবজাতিকে আখিরাতের ব্যাপারে সুসংবাদ ও সতর্ক করেন। তিনি জান্নাতের সুসংবাদ দিবেন এবং জাহান্নাম ও বিচারের ব্যাপারে সতর্ক করবেন। কী কী কাজ করলে জান্নাত পাওয়া যাবে এবং কী কাজ করলে জাহান্নামে যেতে সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিবেন। কোনো ঈমানদারকে ঈমানের পুরস্কার এবং কোন অস্বীকারকারীকে শাস্তি দেয়া নবীর কাজ নয়। কাউকে জোর করে ঈমানের দিকে টেনে আনা এবং কাউকে জবরদস্তি অস্বীকার করা থেকে দূরে রাখার কাজেও নিবী নিযুক্ত হননি। যে ব্যক্তি সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ করবে তাকে শুভ পরিণামের সুসংবাদ দেবে এবং যে ব্যক্তি নিজের কু পথে অবিচল থাকবে তাকে আল্লাহর পাকড়াও ও শাস্তির ভয় দেখাবে।

পঞ্চমত শহীদ বা সাক্ষ্যদাতা
সূরা আহযাবের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে নবী, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। একই কথা রিপিট করেছেন সূরা ফাতহ-এর ৮ নং আয়াতে। এখানে শহীদ মানে সাক্ষ্যদাতা। নবী সা.-কে সাক্ষী করার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। এই সাক্ষ্য তিন ধরনের হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত মুফাসসির সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী।

এক- মৌখিক সাক্ষ্যদান। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন যেসব সত্য ও মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নবী তার সত্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন এবং দুনিয়াবাসীকে পরিষ্কার বলে দেবেন, এটিই সত্য এবং এর বিরুদ্ধে যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, অহী নাযিল হওয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অনিবার্যতা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকাশ, দুনিয়া বাসীদের কাছে যতই অদ্ভূত মনে হোক না কেন এবং তারা একথাগুলোর বক্তাকে যতই বিদ্রূপ করুক বা তাকে পাগল বলুক না কেন, নবী কারো পরোয়া না করেই দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সোচ্চার কন্ঠে বলে দেবেন, এসব কিছুই সত্য এবং যারা এসব মানে না তারা পথভ্রষ্ট। 

দুই- কর্মের সাক্ষ্য। অর্থাৎ দুনিয়ার সামনে যে মতবাদ পেশ করার জন্য নবী সা.-এর আবির্ভাব হয়েছে তিনি নিজের জীবনের সমগ্র কার্মকান্ডের মাধ্যমে তার প্রদর্শনী করবেন। যে জিনিসকে তিনি মন্দ বলেন তাঁর জীবন তার সকল প্রকার গন্ধমুক্ত হবে। যে জিনিসকে তিনি ভালো বলেন তাঁর চরিত্রে তা পূর্ণমাত্রায় আলোকজ্জল হবে। যে জিনিসকে তিনি ফরয বলেন তা পালন করার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে অগ্রণী হবেন। যে জিনিসকে তিনি গোনাহ বলেন তা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে কেউ তাঁর সমান হবে না। যে জীবন বিধানকে তিনি আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন বিধান বলেন তাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি করবেন না। 

তিন- পরকালীন সাক্ষ্য। অর্থাৎ আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে তখন নবী এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন, তাঁকে যে পয়গাম দেয়া হয়েছিল তা তিনি কোন প্রকার কাটছাঁট ও কমবেশী না করে হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সামনে নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার ব্যাপারে সামান্যতম ত্রুটি করেননি। এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাঁর বাণী মান্যকারী কি পুরস্কার পাবে এবং অমান্যকারী কোন ধরনের শাস্তির অধিকারী হবে তার ফায়সালা করা হবে।

ষষ্ঠত ইকামাতে দ্বীন অথবা দ্বীন বিজয় 
আল্লাহ তায়ালা সূরা আত তাওবার ৩৩ নং আয়াতে বলেন, তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে। এই একই কথা রিপিট করেন সূরা ফাতহ'র ২৮ নং আয়াতে ও সূরা সফের ৯ নং আয়াতে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ইকামতে দ্বীনের বিষয়ে সূরা আশ শুরার ১৩ নং আয়াতে বলেন, 

তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো, তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন। 

আল্লাহ তায়ালা এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মুহাম্মাদ সা. কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। নবী-রসূলদের মধ্যে কেউই কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। প্রথম থেকেই সমস্ত নবী-রসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে একই দ্বীন পেশ করে আসছেন। মুহাম্মাদ সা.ও সেই একই দ্বীন পেশ করছেন। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম হযরত নূহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের পর তিনিই ছিলেন বর্তমান মানব গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম পয়গস্বর। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি শেষ নবী। তারপর হযরত ইবরাহীমের (আ) নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আরবের লোকেরা যাঁকে তাদের নেতা বলে মানতো। 

সর্বশেষে হযরত মুসা এবং ঈসার কথা বলা হয়েছে যাঁদের সাথে ইহুদী ও খৃস্টানরা তাদের ধর্মকে সম্পর্কিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু এই পাঁচজন নবীকেই উক্ত দ্বীনের হিদায়াত দান করা হয়েছিলো। বরং একথা বলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য যে, পৃথিবীতে যত নবী-রসূলই আগমন করেছেন তাঁরা সবাই একই দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নমুনা হিসেবে এমন পাঁচজন মহান নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁদের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ সুবিখ্যাত আসমানী শরীয়তসমূহ লাভ করেছে। এই আয়াত দ্বারা এটাই নির্দেশ করছে যে, যুগে যুগে নবীদের দ্বীন কায়েমের জন্যই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে এবং এটাই তাদের মূল মিশন। যেহেতু নবী আর আসবেন না তাই দ্বীন কায়েমের দায়িত্ব আমাদের। আর আমরা দ্বীন কায়েমের পদ্ধতি হিসেবে আল্লাহর রাসূল সা.-এর অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণ করবো। 

আমরা কুরআন থেকে মোটাদাগে দেখতে পাই, ৬টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নবী সা.-কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল এজেন্ডা হলো ইকামাতে দ্বীন। এই দ্বীন কায়েমের জন্যই উপরোক্ত বাকী উদ্দেশ্যগুলো ফাংশনাল হয়। আল্লাহর রাসূলের দ্বীন কায়েমের পদ্ধতি হলো উসওয়াতুল হাসানা বা উত্তম আদর্শ। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাসূল সা.-এর দেখানো পন্থা ছাড়া অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যাবে না। আমাদের তাই আল্লাহর রাসূলের জীবনী বা সিরাত অধ্যয়ন করতে হবে এই নিয়তে যে, তিনি কীভাবে দ্বীন কায়েম করেছেন তা জানার চেষ্টা করা। 

দ্বীন কায়েম যে মূল এজেন্ডা ছিল তা আমরা জানতে পারি সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াত থেকে। সেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম; আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” 

এই আয়াত যখন নাজিল হয়েছে সেই দিনটি ছিল ‘আরাফাতের দিন। আর তা ছিল বিদায় হজের সময়কার জুম‘আর দিন। এই আয়াতটি ঐ দিন বিকাল বেলায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালীন সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে। আর এই আয়াতটি অবতীর্ণের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাশি দিন জীবিত ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি আমাদের জন্য আমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি কখনও তার মধ্যে কমতি করবেন না এবং কখনও বৃদ্ধিরও প্রয়োজন হবে না। আর এই জন্যই তিনি আমাদের নবীর মাধ্যমে নবীদের আগমনের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। 

এই আয়াত নাজিলের পর সকল সাহাবী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু জ্ঞানী সাহাবী হজরত আবু বকর রা. কেঁদে ফেলেছেন। কারণ তিনি বুঝে নিয়েছেন আল্লাহর রাসূল সা.-কে যে এজেন্ডা দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা হাসিল হয়েছে। অতএব আল্লাহর রাসূল সা. আর বেশিদিন দুনিয়ায় থাকবেন না। হয়েছেও তাই। এর অল্প দিন পরই আল্লাহর রাসূল সা. অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইন্তেকাল করেন। এই ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট যে দ্বীন কায়েমই আল্লাহর রাসূলের মূল এজেন্ডা ছিল। 

৫ জানু, ২০২১

বঙ্গকথা পর্ব-৭৬ : মেজর জিয়াউর রহমান ও গণহত্যা প্রসঙ্গ



১৯৭১ সালে মার্চের শুরু থেকেই ঢাকার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে চট্টগ্রামে। এর কারণ চট্টগ্রামে ছোট বড় প্রচুর কারখানা। আর এসব কারখানায় কাজ করে হাজার হাজার ভারত থেকে আসা অবাঙালি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এসব বিহারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৪ মার্চ থেকে শুরু হয় লীগ কর্তৃক অবাঙালি গণহত্যা এবং সেটা কন্টিনিউ করে।  

সেনাবাহিনীকে কোথাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় তারা ঘটনার সাথে যুক্ত ছিল না। জিয়া চট্টগ্রামের উপঅধিনায়ক হলেও তার সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা, নিউক্লিয়াসদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। এজন্য তিনি ঢাকার খবর, বিদ্রোহের নির্দেশনার জন্য ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। [১]

চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার আগে মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন খলিকুজ্জামানের কাছে পরিস্থিতি ও নির্দেশনা কিছু জানলে তাকে জানাতে বলেছেন। [২]  
ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সকাল থেকে আব্দুর রশিদ জানজুয়ার নির্দেশে মেজর মীর শওকত আলী এক কোম্পানি সেনা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত' জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার আনসারিও সেখানে ছিলেন। সন্ধ্যার পর রশিদ জানজুয়া ও শওকত শহরে রেজিমেন্টের ইউনিট লাইনে ফিরে আসেন। এই পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের বর্ণনায়। সেদিনের বিদ্রোহীদের মধ্যে তিনিও একজন। 

//জানজুয়া আমাকে ডাকলেন। বললেন, 'খালেক, ইউ হ্যাভ টু গো টু দ্য পোর্ট টু টেক ওভার কমান্ড অব দ্য এরিয়া।' এমন সময় মেজর জিয়া সেখানে উপস্থিত হন। জিয়াকে দেখেই জানজুয়া বললেন, 'জিয়া, ইউ গো ফার্স্ট, খালেক উইল ফলো ইউ। জিয়া উঠলেন। সঙ্গে দুজন অবাঙালি অফিসার, সে. লে. হুমায়ুন আর সে. লে. আজম। আমি ওপাশে গেলাম। জিয়া বললেন, ‘খালেকুজ্জামান, কিছু শুনলে জানিয়ো।'

গাড়ি চলে গেল । জানজুয়া তার বাসা আলহামরা বিল্ডিংয়ে চলে গেলেন। মীর শওকত চলে গেলেন মেসে। ডিউটি অফিসার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ চলে গেল ওপরে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন অলি ওপর থেকে বলল, স্যার, আপনার একটা ফোন আসছে। আমি গেলাম । বাই দ্যাট টাইম অলি হ্যাজ টড। উনি ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক মি. কাদের (আবদুল কাদের)। 

অলির সঙ্গে কী কথা হয়েছে জানি না। বললেন, ‘ঢাকায় তো ইপিআরের ওখানে ফায়ারিং শুরু হয়ে গেছে। আর্মি হ্যাজ রেইডেড ক্যাম্পস। তোমরা কী করছ?’ আরও কিছু বললেন। আমাকে এক্সাইটেড করলেন। আমি অলিকে বললাম, তোমাকে কী বলেছে জানি না । ডিউটি করো ওখানে। কিপ আ ট্র্যাক অন দিস। আই অ্যাম গোয়িং টু গেট ব্যাক আওয়ার বস জিয়া।
পিক আপ এল । আমি কয়েকজন গার্ড নিলাম। জিয়াকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের সামনে পেলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড ছিল। ওখানে আল্লাহর রহমতে ওইটা (ব্যারিকেড) ছিল। জিয়া, লাইক আ ড্যান্ডি ম্যান, স্মার্ট, হাতে ফিল্টার উইলস, দ্যাট ফেমাস উইলস। সিগারেট খাচ্ছেন। বললেন, ইয়েস খালেক, হোয়াট হ্যাপেনড? আই সেইড, ফায়ারিং হজ স্টার্টেড।

 ইপিআর ক্যাম্প হ্যাজ বিন অ্যাটাকড... ব্লা ব্লা ব্লা। উনি তখন চিৎকার করে বললেন,
- হোয়াট শ্যাল উই ডু? 
- ইউ নো বেটার।
- ইন দ্যাট কেস, উই রিভোল্ট অ্যান্ড শো আওয়ার এলিজিয়েন্স টু দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ।
ইউনিট লাইনে ফিরে আসার পর ল্যান্স নায়েক শফির হাত থেকে রাইফেলটা হাতে নিয়ে বললেন, হুমায়ুন, আজম (জুনিয়র অবাঙালি অফিসার) কাম এলংগ। শফি, তোমার স্যারদের কোয়ার্টার গার্ডের ভেতর নিয়ে যাও।' দে অয়ার স্টান্ট। কোয়ার্টার গার্ডের ভেতরে নিয়ে গেল। জিয়া বললেন, ‘খালেক, লেট মি গো অ্যান্ড গেট দিস বাস্টার্ড (জানজুয়া)।' 
জিপে করে আলহামরা বিল্ডিংয়ে গেলেন। জানজুয়া কেইম আউট। জিয়া জানজুয়াকে বললেন :
খালেক অ্যান্ড অলি উড লাইক টু টক টু ইউ। ইউ কাম টু দ্য ইউনিট লাইন। দে আর ওয়েটিং ফর ইউ টু টক।
চলো, চলতা হু।

জানজুয়াকে গাড়িতে বসালেন। জিয়া গাড়ি চালালেন । পেছনে যে সিপাই ছিল, সে বন্দুক ধরে রেখেছিল, সো দ্যাট হি ডাজ নট রান অ্যাওয়ে । (ইউনিট লাইনে) নামার সঙ্গে সঙ্গে জিয়া এক আজব কাণ্ড করলেন। ওখানে শফি ছিল । তার হাত থেকে রাইফেলটা নিলেন, পয়েন্টেড দ্য ব্যারেল অ্যাট হিম। বললেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।' জানজুয়া হতভম্ব হয়ে গেছে। 
(জিয়া) বললেন, ‘খালেক, টেক হিম। আমি জানজুয়াকে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে গেলাম। বাই দ্যাট টাইম কোয়ার্টার গার্ডের মধ্যে সে, লে. আজম, সে. লে. হুমায়ুন, আহমেদ দ্বীন বলে একজন ক্যাপ্টেন, পাঞ্জাবি অফিসার। আজম, হুমায়ুন, আহমদ দ্বীন অয়ার টেকেন আপ। অ্যান্ড দে অয়ার এলিমিনেটেড ইন দ্য মেলু।

মেজর জিয়া সার্বিক পরিস্থিতি বলে সবার কাছ থেকে আনুগত্য চাইলেন, তোমরা কি আমার সঙ্গে আছ'? সবাই এক আওয়াজে বলেছিল, আমরা আছি।'
জিয়া শওকতকে বলেছিলেন, একটি গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে মাইক দিয়ে বলে দাও যে আমরা, এইট বেঙ্গল হ্যাজ রিভোল্টেড ফর দ্য কজ অব বাংলাদেশ।' বিফিটিং ল্যাঙ্গুয়েজে বলার জন্য। হি ডিড দ্যাট। জিয়া অফিসে বসে...হি ওয়াজ রিংগিং আপ-এমপি, ডেপুটি কমিশনার আর যাদের ফোন করে পায় নাই, অপারেটরকে বলেছেন, সবাইকে বলে দিন এইট বেঙ্গল রিভোল্ট করেছে বাংলাদেশের পক্ষে।'

তারপর আমরা ইউনিট লাইন থেকে বেরিয়ে গেলাম। তখন রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে গেছে। আমরা পটিয়া পর্যন্ত যাই। তখন কিছু কিছু অফিসার ডেপ্লয়েড হয়ে গেছেন। পটিয়া যেহেতু অলির জায়গা, তিনি সবকিছু চিনতেন। এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। বন্দোবস্তটা উনি ভালোভাবেই করে রেখেছিলেন। সেখান থেকে আমাদের বলে দেওয়া হলো, পজিশন, কে কোথায় যাবেন। আমাকে বলা হলো রেডিও স্টেশনটা প্রটেকশন দেওয়ার জন্য, রেডিও স্টেশন থেকে কর্ণফুলীর পূর্বপার পর্যন্ত। [৩]

আমার অনুমান কর্ণেল অলি নিউক্লিয়াস অথবা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। কারণ জিয়াকে তিনিই বিদ্রোহ করতে উস্কে দিয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আব্দুল কাদেরের বরাত দিয়ে। এরপর আরেকটি কথা বলে জিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন কক্সবাজার। অলির কাছে তথ্য ছিল, বিদ্রোহ শুরু হলে কক্সবাজারে অবস্থানরত ৭ম নৌবহরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। 

মার্কিনীদের সহায়তা পাওয়ার জন্য অলি ও জিয়া একটি জিপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। এখানেও অলি একজন আওয়ামী নেতা সরোয়ার আলমকে তাদের সাথে যুক্ত করে নেন যাতে জিয়া স্বাধীন সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন। সরোয়ার আলম ছিলেন কক্সবাজারের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। 

এদিকে কর্নেল অলির সাথে যোগাযোগ রাখেন মাহমুদ নামের এক ভারতীয়। সম্ভবত মাহমুদ হোসেন তার ছদ্ম নাম। মাহমুদ পরিচয় দিতেন তিনি ভারতের বিজেপি নেতা মোরারজি দেশাই-এর ভাইজি জামাই। বাংলাদেশে তার আগমন লোকসংগীত কালেকশনে। এই পরিচয়ে তিনি চট্টগ্রামের বহু গণ্যমান্য মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বাঙালিদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলে তার রাজনৈতিক পরিচয় বের হয়ে আসে। তিনি কর্নেল অলি থেকে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে আগেই কক্সবাজার রওনা হন। 
মাহমুদ হোসেনই জিয়াকে মার্কিনীদের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মাহমুদ হোসেন ও তার সাথে সৈন্যদের পাক সেনা মনে করে পিটিয়ে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে।[৪] 

মেজর জিয়া ও অলি আহমেদ কক্সবাজার গিয়ে যার বাসায় যাওয়ার কথা সেখানে গিয়ে কাউকে পান নি। মাহমুদের করুণ পরিণতি দেখে তারা অত্যন্ত দুঃখিত হন। এদিকে তারা খবর নিয়ে জানতে পারেন আশে পাশে বা কাছাকাছি কোথাও মার্কিন ৭ম নৌ-বহর নেই। ব্যর্থ মনোরথে তারা চট্টগ্রামের পটিয়ায় ফিরে এলেন। 

এর মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী নেতাদের সাথে মিটিং হয় তার। অতঃপর ৩০ মার্চ আবার কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে এসে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এবার শেখ মুজিবের নামে ঘোষণা করেন। এভাবে তিনি চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। [৫]

মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার আগে চট্টগ্রামে ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম আগেই বিদ্রোহ করেন। ঢাকায় রাত ১০টা থেকে ইপিআরের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের দায়িত্বমুক্ত ও নিরস্ত্র করে ব্যারাকে অবস্থান করার জন্য নির্দেশ আসে। ইপিআর কন্ট্রোল রুম থেকে মেজর দেলোয়ার ও কুতুবউদ্দিন ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠাতে থাকে তোমরা যে যেখানে আছো একশনে যাও। 

'নিরস্ত্র করার সংবাদ' গুজব সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে হত্যা করার সংবাদে পরিণত হয়। সাড়ে দশটার পর মেজর দেলোয়ার আর কুতুবুদ্দিনের বার্তা পাওয়া যায়নি। অতএব তাদেরকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হলো। চট্টগ্রামে ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ঢাকার বার্তা পেয়ে বিদ্রোহ শুরু করেন। এরপর তিনি তার অধীনস্থ অফিসার ও সৈনিকদের কাছে বার্তা পাঠান 'ব্রিং সাম উড ফর মি'। এতে তার অধীনে থাকা সব বাঙালি সেনাসদস্য বিদ্রোহ করে। এরপর তিনি অবাঙালি প্লাটুন কমান্ডার হায়াতকে এরেস্ট করেন। [৬][৭] 

সমশের মুবিন চৌধুরি বলেন, রফিকুল ইসলামের বার্তা পেয়ে কাপ্তাইতে দায়িত্বরত ইপিআরের ক্যাপ্টেন হারুন ৬৫ জন সেনা নিয়ে বিদ্রোহ করলেন এবং মেজর জিয়ার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করলেন। জিয়া তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ২৯ মার্চ সমশের ও হারুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে চকবাজারে এক খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন। 
[৮][৯]

গণহত্যা প্রসঙ্গ 
চট্টগ্রামে দুই ধাপে গণহত্যা হয়। প্রথমত হয় মার্চে মূলত শহর এলাকায়। দ্বিতীয়ত হয় এপ্রিল ও মে মাসে শহরের বাইরে। শহর এলাকায় হয় মার্চ মাসে। হালিশহর, পাহাড়তলী, আগ্রাবাদ, বায়েজিদ, শেরশাহ কলোনী, ওয়্যারলেস রেলগেইট, কালুরঘাট ইত্যাদি স্থানে গণহত্যা হয়। ২৬ মার্চ থেকে সেনাবাহিনী শহর দখল নিতে থাকলে চটগ্রাম শহরে অবাঙালিদের নিরাপত্তা জোরদার হতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে সারা মার্চ জুড়ে হাজার হাজার বেসামরিক বিহারি খুন হতে থাকে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় কুতুবউদ্দিন আজিজের লেখা 'ব্লাড এন্ড টিয়ার্স' বইতে। এখানে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সারাদেশের বিহারী হত্যা একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। [১০] 

চট্টগ্রামে দ্বিতীয় ধাপের অবাঙালি গণহত্যা শুরু হয় চট্টগ্রাম শহরের বাইরে। এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন মেজর জিয়ার কাছে আনুগত্যের শপথ করা বিদ্রোহী বাঙালি সেনাসদস্যেরা। এর মেয়াদকাল প্রায় দুই মাস। যতক্ষণ না পুরো দেশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না আসে। রাঙামাটির কাপ্তাইতে ইপিআর ক্যাপ্টেন হারুন তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে অবাঙালি ইপিআর সদস্য এবং তাদের পরিবারের ওপর গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চের পরের দুই সপ্তাহ ছিল ভয়াবহ। যেখানেই অবাঙালিদের দেখা মিলছিল, সেখানেই তাদের ঘিরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল। ইপিআর ও পুলিশের কিছু লোক এই হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় কিছু লোক। [১১]

ফারুক আজিজ খান আর বলেন, রাঙামাটি থেকে দিনে ও রাতে বাস বোঝাই করে ইপিআরের সদস্যদের সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অবাঙালি ইপিআরের সদস্যরা ও তাদের পরিবার তাদেরই বাঙালি সহকর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে থাকে। অনেককে হাত-পা বেঁধে খাদের পানিতে ফেলে দেওয়া হয় বলেও শুনতে পাই। রাতে যখন তারা বাস-ট্রাকে চেপে চট্টগ্রামে রওনা হতো, তখন যে আওয়াজ হতো, তা ছিল রীতিমতো রোমহর্ষক। অবাঙালিদের হত্যা করার পর আমাদের নৈতিক শক্তিও ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেককেই আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। [১২]

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও আশপাশের অবাঙালিরা প্রায় সবাই ইপিআরের লোকজন ও তাদের সহযোগীদের কব্জায় চলে আসে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই অবাঙালিদের হত্যা করা হতো। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা ঘটে ২৬-৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। কর্নফুলী পেপার ও রেয়ন মিলস, চন্দ্রঘোনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করার পর তারা অবর্ণনীয় ধর্ষণ ও বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে। হতাহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। একইসাথে রাঙামাটি শহরেও মেজর জিয়ার কাছে আনুগত্যের শপথ নেওয়া বাঙালি সৈনিকেরা বেসামরিক অবাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। সেখানে প্রায় ৫০০ অবাঙালি খুন হন। [১৩][১৪]

রাঙামাটির পাশাপাশি মেজর জিয়ার অধিনস্থ সৈনিকেরা এপ্রিল মাসেও শহরের কিছু কিছু স্থানে বেসামরিক নিরীহ মানুষ খুন করে। ১৯৭১ সালের মে মাসে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। তারা ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে লিখেন  “বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি জুট মিলের বিনোদন ক্লাবে কাপড়ের স্তুপের ভেতর রক্তমাখা একটি পুতুল গড়াগড়ি খাচ্ছিল। 

এ ক্লাবে বাঙালিরা ১৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। বাঙালিরা দেশপ্রেমের উত্তেজনায় মত্ত হয়ে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিকে হত্যা করে। বাঙালি বেসামরিক লোক ও মুক্তিফৌজ (জিয়ার সৈনিক) ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আগত (ভারতীয় অভিবাসী) বিহারীদের গণহত্যায় লিপ্ত হয় এবং হাটবাজার ও বসতবাড়ি তছনছ করে, ছুরিকাঘাত, গুলিবর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে। কখনো কখনো ধর্ষণ ও লুটপাটেও লিপ্ত হয় ৷"

১৯৭১ সালের ১২ মে আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপি প্রেরিত একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে আরো বলা হয়। “গতকাল গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দর নগরী সফরকারী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন যে, তারা ব্যাপক গোলা ও গুলিবর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির এবং বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার প্রমাণ দেখতে পেয়েছেন। 

প্রভাবশালী ইস্পাহানি পরিবারের মালিকানাধীন জুট মিলগুলোতে সাংবাদিকরা মিলের ক্লাবে গত মাসে (এপ্রিলে) বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত ১৫২ জন অবাঙালি মহিলা ও শিশুর গণকবর দেখতে পেয়েছেন। বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত এ ক্লাবের মেঝেতে এখনো রক্তমাখা জামা-কাপড় ও খেলনা পড়ে রয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানি ও ভারতীয় অভিবাসীদের (১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী মুসলমান) হত্যা করা হয়েছে। অধিবাসীরা একটি ভস্মীভূত ডিপার্টমেন্ট ভবন দেখিয়ে বলেছে, সেখানে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে তিন শ' পাঠানকে হত্যা করেছে।"

এন্থনি মাসকারেনহাস এপ্রিলে সময়গুলোতে চট্টগ্রামে ছিলেন। তিনি লন্ডনের সানডে টাইমসের পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি। ১৯৭১ সালের ২ মে সানডে টাইমসে এন্থনি মাসকারেনহাস প্রেরিত এক রিপোর্টে বলা হয়: "চট্টগ্রামে মিলিটারি একাডেমির কর্নেল কমান্ডিংকে হত্যা করা হয়। এসময় তার আট মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তলপেটে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। 

চট্টগ্রামের আরেকটি অংশে জীবন্ত অবস্থায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন অফিসারের চামড়া ছিলে ফেলা হয়। তার দু'পুত্রের শিরচ্ছেদ করা হয়। তার স্ত্রীর তলপেটে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে তার উন্মুক্ত শরীরের ওপর পুত্রদের মাথা রেখে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো বাঁশ দিয়ে জরায়ু বিদীর্ণ বহু যুবতী মেয়ের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম এবং খুলনা ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সমবেত হয়েছিল।" [১৫]

মেজর জিয়া ও তার নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও গণধর্ষণের সবচেয়ে লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলামের বর্ণনায়। তিনি তার স্মৃতিচারণে বলেন, তিনি এবং তার ছাত্রলীগের বন্ধুরা মেজর জিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রামগড় ক্যাম্পে ছিলেন। একদিন বাঙালি সেনা অফিসাররা জিয়ার নেতৃত্বে সীতাকুন্ডের হাফিজ জুটমিলে অভিযান চালায়। সেখানে নিরীহ সকল অবাঙালি পুরুষ শ্রমিকদের হত্যা করে। এরপর সেখানে থাকা নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকদের স্ত্রী কন্যাদের রামগড় ক্যাম্পে নিয়ে আসেন এবং দিনের পর দিন তাদের নির্যাতন করেন। এরপর যখন দেশের সেনাবাহিনী রামগড় ক্যাম্প দখলে নিতে আসে তখন জিয়া বুঝতে পারেন তিনি সেনাবাহিনীর সাথে পেরে ওঠবেন না তাই তিনি দলবল নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। ভারতে যাওয়ার আগে বাঙালি সেনা অফিসাররা রামগড় ক্যাম্পে থাকা সকল অবাঙালি নারীদের হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে যান। ভিডিও দেখুন [১৬]  

মেজর জিয়া কি গণহত্যায় জড়িত ছিলেন? 
যে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন হয়েছে তাতে নিশ্চিত করা বলা যায় রামগড়, রাঙামাটি, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও চট্টগ্রাম শহরে মেজর জিয়ার অনুগত বিদ্রোহী সেনারাই এই অবাঙালি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন মেজর জিয়ার সমর্থকেরা যারা তাকে ভালোবাসেন তারা বলতে পারেন জিয়া কি তাদের গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছেন? এর কী প্রমাণ আছে। আমি তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই জিয়া কী গণহত্যাকারী তার অধীনস্থ সেনাদের শাস্তি দিয়েছেন? যদি না দিয়ে থাকেন তবে এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ মেজর জিয়ারই প্রত্যক্ষ মদদেই হয়েছে। একজন সেনানায়ক হিসেবে জিয়া তার অধীনস্থদের সকল কৃতিত্ব বহন করতে বাধ্য। 

মেজর জিয়া কী খুনি চরিত্র লালন করতেন?  
একজন সেনানায়ক যুদ্ধে কঠোর হবেন। তিনি শত্রুদের খুন করবেন এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা দোষে অস্ত্র উত্তোলন এবং নির্বিচার খুন জিয়ার চরিত্রে আছে। এবং তিনি তা দেখিয়েছেন। খালেকুজ্জামানের বর্ণনা থেকে যা বুঝতে পারি তাতে তার সিনিয়র অফিসার জানজুয়া তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বন্দর নিয়ন্ত্রণে পাঠিয়েছে তা একেবারে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। কারণ জানজুয়া প্রথমে খালেককে পাঠিয়েছেন। জিয়া এসে পড়ায় তিনি তাকে যেতে বলেছেন। তার মানে টার্গেট জিয়া ছিল না। 

ক্যাপ্টেন খালেকের বর্ণনা অনুসারে অলি ঢাকার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন। জিয়াকে খুন করার কোনো ব্যাপার সেখানে ছিল না। আর যেহেতু এই সংবাদ খালেক নিজেই জিয়াকে দিয়েছেন তাই এখানে মিসিং ইনফো নেই। খালেক তাকে শুধু ঢাকার ইপিআরের কথাই বলেছেন। তার মানে জিয়ার সাথে জানজুয়ার কোনো খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয় নি। একইসাথে জিয়ার অধীনে থাকা নবীন অবাঙালি অফিসাররা জিয়ার একনিষ্ঠ অনুগত ছিল। কিন্তু জিয়া তার অফিসার জানজুয়া, তার অবাঙালি সহকর্মী ও তার অনুগত অবাঙালি শিষ্যদের একত্র করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার নির্দেশ দেন। অতঃপর তাদের হত্যা করা হয়। এই ঘটনাই মেজর জিয়ার খুনী চরিত্রকে ফোকাস করে। 

মেজর জিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী ছিল? 
মেজর জিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না একথা জোর করে বলা যায় না। তিনি ভাসানী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহচর মশিউর রহমান যাদু মিয়া বলেছেন, পাকিস্তান আমলে মেজর জিয়া মেজর কমল নামধারণ করে ভাসানীর সাথে গোপনে দেখা করতেন ও আলাপ আলোচনা করতেন। [১৭]

 এ থেকে বোঝা একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রবল আগ্রহ জিয়ার ছিল নইলে এতো বড় রিস্ক তার মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষ নিতেন না। এরপর জিয়ার ক্ষমতার সময়ে ভাসানী কর্তৃক জিয়াকে একনিষ্ঠ সমর্থন দানও তার রাজনৈতিক আদর্শকে ইঙ্গিত করে। ভাসানীর ইন্তেকালের পর মেজর জিয়া তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ব্যবহার করেই বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করেন। চীনপন্থী বাম ন্যাপের যাদুমিয়াকেই তিনি প্রথমে তার প্রধানমন্ত্রী করে নেন। বিএনপি'র বর্তমান অনেক নেতা প্রকাশ্যেই বলে থাকেন জিয়া ভাসানীর আদর্শ লালন করতেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তেমনাটাই বলেছেন। [১৮]

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বলেছেন ভাসানীর আদর্শেই বিএনপি গঠিত হয়েছে। [১৯]  অতএব এটা অনুমান করা যায় মেজর জিয়াউর রহমান মাওলানা ভাসানীর মতো পিকিংপন্থী বামাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি ভাসানীর দলের প্রতীক নিজের দলের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

তথ্যসূত্র
১. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮৩
২. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৭৯
৩. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৭৯-৮০
৪. মহিউদ্দিন আহমেদের কাছে কর্নেল অলির সাক্ষাৎকার 
৫. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮২-৮৩
৬. ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন / আমীন আহমেদ চৌধুরী/ পৃষ্ঠা ২১-২৮
৭. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে/ মেজর রফিকুল ইসলাম/ পৃষ্ঠা ১২০ 
৮. মহিউদ্দিন আহমেদের কাছে সমশের মুবিনের সাক্ষাৎকার
৯. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮৩
১০. ব্লাড এন্ড টিয়ার্স/ কুতুবুদ্দিন আজিজ/ পৃষ্ঠা ৩৫-৭৮
১১. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৪৭
১২. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৫০
১৩. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৫১
১৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর/ পৃষ্ঠা ১৪৩
১৫. ব্লাড এন্ড টিয়ার্স/ কুতুবুদ্দিন আজিজ/ পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭ 
১৬. https://youtu.be/fOfaYa48_4I 
১৭. মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম/ পৃষ্ঠা ২২
১৮. ভাসানী রাজনীতি নির্মাণ করতেন: ফখরুল/ প্রথম আলো/ ২০/১১/২০১৬
১৯. ভাসানীর আদর্শে গড়া দল বিএনপি: বরকতুল্লাহ বুলু/ বাংলা ট্রিবিউন/ ১৭/১১/২০২০