২৭ মে, ২০২১

ঢাকায় মোসাদের কার্যক্রম



ঢাকা বিমানবন্দর। নভেম্বর ২০০৩। একটি বিমান ছেড়ে যাবে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। সব কিছু ঠিকঠাক। এর মধ্যে বিমানে ঘটাঘট উঠে পড়লেন সিকিউরিটি অফিসাররা। ইনকিলাব পত্রিকার এক সাংবাদিক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরিকে তল্লাশি করা শুরু করলেন। তারপর নিশ্চিত হয়ে তাকে নিয়ে নেমে গেলেন বিমান থেকে। ইনকিলাব পত্রিকা এদেশের হুজুরবান্ধব পত্রিকা। এই পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরি।

গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে ডিবি তাকে এরেস্ট করে। পরে তার কাছে তল্লাশি করে সে তথ্যের সত্যতা পায়। শোয়েব চৌধুরির কাছে তেলআভিভে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র পাওয়া যায়। শোয়েব ব্যাংকক হয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ইসরাঈলের রাজধানী তেলআভিভে যাওয়ার কথা স্বীকার করে। তাকে নিয়ে বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়ে সরকার। তাকে নিয়ে তদন্ত ও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তেল আভিভে যে সেমিনারটিতে সে জয়েন করার কথা তা ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের ১-৩ তারিখ হয়েছিল।

'এডুকেশন টুয়ার্ডস কালচার অব পিস’ শীর্ষক ঐ কনফারেন্সে উপস্থাপনের জন্য একটি ভাষণের কপি ও সিডি শোয়েবের কাছে পাওয়া যায়। সেখানে সে বাংলাদেশের মসজিদ্গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। অথচ ইনকিলাবের সাংবাদিক হিসেবে শোয়েব প্রায়ই ইসলাম ও ইসলামী জাতিয়তাবাদের পক্ষে লেখালেখি করতো।

সেসময় তার কাছে একটি প্রজেক্ট প্রোফাইল পাওয়া যায়, যাতে ইসরাইলের কাছে তিনটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য ১২ কোটি টাকার চাহিদাপত্র ছিল। এই প্রকাশিতব্য পত্রিকাগুলোর নাম ছিল দৈনিক সোনালী দিন, দৈনিক রূপান্তর, দৈনিক পরিবর্তন। তার প্রজেক্ট প্রোফাইলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়, যেখানে সে ইসরাইলী বন্ধুদের মুসলিম প্রধান দেশে মিডিয়া গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, "কোটি কোটি ডলার খরচ করে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চেয়ে মিডিয়া সৃষ্টি করুন, এতে ইসরাইল বেশি লাভবান হবে।" শোয়েবের কাছে প্রাপ্ত নথিপত্র ও তার ইমেইল ঘেঁটে জানা যায়, বাংলাদেশ নাকি অচিরেই জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং আফগানিস্তানের মতো তালেবান রাষ্ট্র হবে। কিন্তু তখনো বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।

পুলিশ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে ২৪ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাকে আটক করে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। শোয়েবকে মুক্ত করতে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন ও ই ইউ থেকে বেশ চাপ প্রয়োগ করা হয়। মাত্র ১ বছর তাকে আটক রাখা গেছে। ২০০৫ সালের ২৯ এপ্রিল শোয়েবকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয় সরকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে বর্তমান মার্কিন সিনেটর ও তখনকার কংগ্রেসম্যান মার্ক স্টিভেন কির্ক ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর চাপ প্রয়োগ করায় সে জামিনে মুক্ত হয়েছে। সালাউদ্দিন শোয়েবের মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসে ২০০৭ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি একটি প্রস্তাবও পাস হয়।

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ২০০৬ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাক্ষাৎকারে শোয়েব বলে, //আমি যখন প্রথম সাপ্তাহিক ব্লিতস (weekly blitz) প্রকাশ করি তখন সিদ্ধান্ত নেই ইহুদী খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে বিশেষত ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে সংঘবদ্ধ প্রচারনা চলছে তার অবসান ঘটাতে। বাংলাদেশে শুক্রবারের খুতবায় মোল্লারা মূলত জিহাদের বাণী প্রচার করে এবং ইহুদী খ্রীস্টানদের হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি এর অবসান চেয়েছি।//

মোসাদ কানেক্টেড প্রমাণিত হওয়ার পরও থেমে থাকে নি শোয়েবের পথচলা। সে ইসরাঈলভিত্তিক সংগঠন ইফলাক (IFLAC, international forum for literature and culture for peace)এর সদস্য এবং ইসরাইল-ইসলাম বন্ধুত্বের একজন উপদেষ্টা। তার জেলমুক্তির জন্য জোর লবিং চালাতে এগিয়ে আসেন মার্কিন ইহুদী মানবাধিকার কর্মী ড. রিচার্ড বেনকিন। পরবর্তিতে বেনকিন দৈনিক আমাদের সময়ের আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ও বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে যুক্ত থাকেন। বেনকিন ও সালাউদ্দীন শোয়েব চৌধুরী মিলে ইন্টার*ফেইথ কার্যক্রম চালানো শুরু করে।

এই ইন্টার*ফেইথের বেসিক হলো, সব ধর্মই সঠিক এবং ভালো কথা বলে। অতএব সব ধর্মকেই আমরা মেনে নিবো। অন্য ধর্মের মানুষদের আহ্বান করবো না। সবাই যার যার ধর্ম নিয়ে থাকবো। প্রয়োজনে একে অন্যের ধর্মীয় প্রার্থনা ও উৎসবে যোগদান করবো। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কয়েকটি ইন্টারফেইথ ডায়ালগের আয়োজন হয়েছে এমনকি খ্রিস্টানদের পোপ বাংলাদেশে আসলে সর্বধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিলো। তাদের এই কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে কওমি আলেমদের মধ্য থেকে ফরিদ উদ্দিন মাসুদ এবং জামায়াতঘেঁষা বুদ্ধিজীবী ও সাবেক প্রধান বিচারপতি আব্দুর রউফ।

বেনকিন ও শোয়েবের ইন্টারফেইথ সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। এসময় শোয়েব অনেক কাজ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কারণ তখন রাষ্ট্রের পরিচালক ফখরুদ্দিন-মঈনরা বিদেশীদের ক্রীয়ানক ছিল। শোয়েব ইসরাঈল পাসপোর্ট নিয়ে টঙ্গি ইজতেমায় যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে নেয়। একই বছর সে জোট আমলে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে হুজি প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে।

২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদনে থেকে পাওয়া যায়, আইডিপি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী বলে, আইডিপির আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন রাজনীতির জন্ম হলো। আইডিপির সঙ্গে হরকাতুল জিহাদের নাম জড়িত। অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী বলেন, ‘আফগানফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মূলধারার সদস্যরা আইডিপি গঠন করেছে। পরিচয়সূত্রে আমি এদের সঙ্গে অনেক কাজ একত্রে করেছি। আমরা এই অনুষ্ঠান আরো আগে করতাম, কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনুমতি পেতে দেরি হয়েছে। ২০০৩ সালে যার নথিপত্রে তালেবান নিয়ে ভবিষ্যতবাণী পাওয়া গেছে সেই ব্যক্তিই জেএমবি’র পতনের প্রেক্ষাপটে আবার ২০০৮ সালে জঙ্গীদের সংগঠিত করেছে।

এই সঞ্জিব চৌধুরী একজন হিন্দু, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। অথচ হরকাতুল জিহাদ ও আইডিপি গঠনের নায়ক সে! কী বিচিত্র ঘটনা!

আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারি। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কলকাতা থেকে ঢাকা আসার জন্য প্রস্তুত। এমন সময় ভারতীয় গোয়েন্দারা ১১ জন বিভিন্ন দেশের নাগরিককে আটক করে সন্দেহজনক বিমান ছিনতাইকারী হিসেবে। তারা সবাই গত দু'মাস ধরে ভারতে তাবলীগ জামায়াতের কাজ করছিল। এখন তারা বাংলাদেশে টঙ্গীর ইজতেমাতে জয়েন করতে যাচ্ছে বলে জানায়। ভারতীয়রা যাচাই বাছাই করে তাদের ছেড়ে দেয়।

এদিকে ঘটনা জানাজানি হলে বাংলাদেশ তাদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে অবতরণের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তাদের কারো কাছেই বাংলাদেশের ভিসা ছিল না। হয়তো ঢাকার কোনো চ্যানেলে তারা বাংলাদেশে ঢুকে যেত। অথবা তাবলীগের মুসল্লি বিবেচনায় তারা ঢাকায় প্রবেশ করতে পারতো। কিন্তু সন্দেহভাজন আটক হওয়াতে বাংলাদেশ তাদের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করে। ভারতীয় গোয়েন্দারা তাদের পিছু ছাড়ে না। অধিকতর তল্লাশি চালিয়ে তাদের প্রত্যেকের কাছে ইসরাঈলি পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এটা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বেশ জোরালো আলোচনার জন্ম দেয়। পরে ইসরাইলি চাপের মুখে ভারত তাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে তেল-আভিভ ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

বর্তমান সময়ে যাকে নিয়ে বেশ শোরগোল হচ্ছে সে অনন্ত জলিলও তাবলীগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে জড়িত। এদেশের এখন পর্যন্ত যাদেরকে ইসরাইলি দূত হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে তারা ডান ও জাতীয়তাবাদী ধারার সাথে জড়িত। ২০১৬ সালে বিএনপি নেতা আসলাম এক ইহুদি নেতার সাথে ভারতে বৈঠক করে পত্রিকার শিরোনাম হয়ে এখন জেলে আছে। শোয়েব চৌধুরীও বহুদিন জেলে ছিল। ২০১৪ সালে ১০ বছর আগের সেই মামলায় তার ৭ বছরের জেল হয়েছিল।

এই ডান বলয়ের বাইরে শুধু প্রকাশ্যে একজনকে দেখা যায় যে দায়িত্ব নিয়ে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছে সে হলো সাংবাদিক আনিস আলমগীর। তার যুক্তির ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালে ইসরাঈল আমাদের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। ইসরাঈলের টেকনোলজি ও ইন্টারন্যশনাল কানেকশন ভালো। অতএব আমাদের উচিত ইসরাঈলের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করা। বিভিন্ন লেখায় সে ইনিয়ে বিনিয়ে এগুলোই বলতে চায়।

আর গোপনে কে কীভাবে কাজ করছে তা জানিনা। যতটুকু প্রকাশ হয়েছে ততটুকুই কেবল জানতে পারি। তবে আমার দেখায় এখন পর্যন্ত মোসাদ-ইসরাঈল বাংলাদেশে কাজ করছে ডান ধারার লোকদের নিয়ে। তারা এদের মাধ্যমেই এদেশে প্রভাব রাখতে চায়। এদেশে জঙ্গী তৈরি তাদেরই এজেন্ডা। শোয়েব চৌধুরির আরেকটা এজেন্ডার কথা মিস হয়ে গেছে। সে এদেশের নাটক সিনেমায় পয়সা ইনভেস্ট করে।

তবে আমি মনে করি সম্প্রতি বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে Except Israel বাদ দেওয়া আগের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নয়। এটি হলো ট্রাম্পের জেরুজালের শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ। সৌদি ও আমেরিকার চাপে এই কাজ হয়েছে ৮ - ১০ মাস আগে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়ে প্রকাশিত হয়েছে এখন।

সাম্প্রতিক হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধে এই শান্তি প্রক্রিয়া নস্যাত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। যারা এবং যেসব রাষ্ট্র ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিয়েছে তারাও সেখান থেকে সরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

২৫ মে, ২০২১

পর্ব : ১৯ - মুশরিকদের প্রতিশোধ মিশন ও মুনাফিকদের পরিচয় উন্মোচন


বদরের যুদ্ধে মক্কার মুশরিকদের পরাজয় ও অবমাননা এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকের নিহত হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিলো। এ কারণে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু নিহতদের জন্যে শোক প্রকাশ ও আহাজারি করা নিষিদ্ধ করে দেয় মুশরিকদের নেতা আবু সুফিয়ান। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ পরিশোধেও তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করা হয়। তাদের কষ্ট তারা মুসলিমদের জানাতে চাইছিল না।

বদরের যুদ্ধের পর মুশরিকরা সম্মিলিতভাবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ করে তারা নিজেদের মনের জ্বালা জুড়াবে। এই যুদ্ধে তাদের ক্রোধও প্রশমিত হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলো। কোরায়শ নেতাদের মধ্যে এ যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ইকরামা ইবনে আবি জেহেল, সফওয়ান ইবনে উমাইয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হরব এবং আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ছিলো অগ্রগণ্য।

আবু সুফিয়ানের যে বাণিজ্যিক কাফেলাকে কেন্দ্র করে বদর যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই কাফেলার সমুদয় মালামাল পরবর্তী যুদ্ধের জন্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। মালামালের মালিকদের বলা হয় যে, কুরাইশ বংশের লোকেরা, শোনো! মুহাম্মদ তোমাদেরকে কঠিন আঘাত হেনেছে। কাজেই তার সাথে যুদ্ধ করতে তোমরা তোমাদের এই মালামাল দিয়ে সহায়তা করো। তোমাদের নির্বাচিত সর্দারদের ওরা হত্যা করেছে। পুনরায় যুদ্ধ করলে হয়তো প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হবো। কুরাইশরা এ আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজেদের সমুদয় মাল যুদ্ধের জন্যে দান করতে রাজি হয়। সেই মালামালের পরিমাণ ছিলো এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার দীনার। যুদ্ধের প্রস্ততির জন্যে উটগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ইস্যুতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত্ত করার জন্যে কাফেররা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে। অতঃপর সেটা তাদের অনুতাপের কারণ হবে। এরপর তারা পরাভূত হবে এবং যারা কুফুরি করে, তাদের জাহান্নামে একত্র করা হবে।’ ( সূরা আনফাল, ৩৬)

এরপর মুশরিকরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানালো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের উদ্বুদ্ধ করা হলো। সবাইকে কুরাইশদের পতাকাতলে সমবেত হতে বললো। নানা প্রকার লোভও দেখানো হলো। আবু উজ্জা নামের একজন কবি বদরের যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলো। নবী সা. তাকে বিনা মুক্তিপণেই মুক্তি দিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিলো যে, সে ভবিষ্যতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না। কিন্তু মক্কায় ফিরে আসার পর সফওয়ান ইবনে উমাইয়া তাকে বুঝালো যে, তুমি বিভিন্ন গোত্রের লোকদের কাছে যাও, তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষার কবিতার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তোলো।

আমি যদি যুদ্ধ থেকে ভালোভাবে ফিরে আসতে পারি তবে তোমাকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দেবো অথবা তোমার কন্যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করবো। এ প্রলোভনে গলে গিয়ে আবু উজ্জা রাসূল সা.-এর সাথে করা ওয়াদা ভেঙ্গে ফেললো। বিভিন্ন গোত্রে গিয়ে সে লোকদের কবিতার মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললো। এমনিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কাফেরদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে চললো।

বছর পূর্ণ হতেই মুশরিকদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। তারা তিনহাজারের একটি বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করলো। কুরাইশ নেতারা কিছু সংখ্যক সুন্দরী মহিলাকেও যুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলো। সে অনুযায়ী ১৫ জন নারীকেও যুদ্ধেক্ষেত্রে নেওয়া হলো। এদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেয়ার যুক্তি দেখানো হলো, এদের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার প্রেরণায় যুদ্ধে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মানসিকতা বেশী কাজ করবে। যুদ্ধে তিন হাজার উট এবং দু’শো ঘোড়া নেয়ার জন্যে প্রস্তুত করা হলো। ঘোড়াগুলোকে অধিকতর সক্রিয় রাখতে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পুরো পথ তাদের পিঠে কাউকে আরোহণ করানো হয়নি। এছাড়া নিরাপত্তামূলক অস্ত্রের মধ্যে তিন হাজার বর্মও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

আবু সুফিয়ান ছিলো প্রধান সেনাপতি। খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিল ঘোড় সওয়ার বাহিনীর নেতৃত্বে। ইকরামা বিন আবু জাহলকে তার সহকারী নিযুক্ত করা হলো। এরপর তারা মদিনা অভিমুখে রওনা হলো।

এদিকে মুশরিকদের এই তৎপরতা দেখেই মুহাম্মদ সা.-এর চাচা আব্বাস রা. সমস্ত বিবরণ জানিয়ে মদিনায় রাসূল সা.-এর কাছে দূত পাঠালেন। আব্বাস রা.-এর প্রেরিত দূত মক্কা ও মদিনার বিশাল পথের দূরত্ব মাত্র তিন দিনে অতিক্রম করলেন। মদিনায় পৌঁছেই তিনি রাসূল সা.-এর কাছে আব্বাস রা.-এর চিঠি প্রদান করলেন। আল্লাহর রাসূল সা. পড়তে পারতেন না। তাই তিনি উবাই বিন কা'ব রা.-কে বললেন পড়ে শোনাতে।

চিঠির বক্তব্য শুনে উবাই রা.-কে এই তথ্য গোপন রাখার নির্দেশ দিয়ে নবী সা. আনসার ও মুহাজের নেতাদের সাথে জরুরি পরামর্শ করলেন। এরপর মদিনায় জরুরি অবস্থা জারি করলেন। সাহাবাদের সাথে সবসময় অস্ত্র রাখার নির্দেশ দিলেন। আনসারদের একটি দল সার্বক্ষণিক আল্লাহর রাসূল সা.-এর নিরাপত্তায় নিযুক্ত হলেন। মদিনার বিভিন্ন প্রবেশ পথেও বেশ কয়েকজন মুসলিমকে নিয়োগ করা হল। যে কোনো ধরনের আকস্মিক হামলা মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুত রাখা হয়। ছোট ছোট কয়েকটি বাহিনীকে শত্রুদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে মদিনার বাইরের রাস্তায়ও নিযুক্ত করা হলো।

এদিকে মক্কার কুরাইশরা মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মদিনার কাছে পৌঁছে আকিক প্রান্তর অতিক্রম করলো। এরপর কিছুটা ডানে গিয়ে ওহুদ পর্বতের নিকটবর্তী আইনাইন নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করলো। আইনাইন মদীনার উত্তরে কানাত প্রান্তরের কাছে এটি উর্বর ভূমি।

মুশরিকদের গতিবিধির সব খবর আল্লাহর রাসূল সা.-এর গোয়েন্দারা মদিনায় পৌঁছে দিচ্ছিলেন। তাদের অবস্থান গ্রহণের খবরও মদিনায় পৌঁছে গেলো। সেই সময় রাসূল সা. মজলিসে শুরার বৈঠক আহ্বান করলেন। সেই বৈঠকে মদীনার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চিন্তা করা হচ্ছিলো। মিটিং-এর শুরুতে রাসূল সা. তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা শুরা সদস্যদের জানালেন।

মুহাম্মদ সা. বললেন, আল্লাহর শপথ আমি একটা ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখলাম কিছুসংখ্যক গাভীকে যবাই করা হচ্ছে। আমি দেখলাম আমার তরবারির ওপর পরাজয়ের কিছু চিহ্ন। আমি আরো দেখলাম যে, আমি আমার হাত একটি বর্মের ভেতর প্রবেশ করিয়েছি। অতঃপর নবী সা. এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বলেন, গাভী জবাই করা হচ্ছে মানে কয়েকজন সাহাবা শহীদ হবেন। তলোয়ারে পরাজয়ের চিহ্ন মেনে আমার পরিবারের কোনো একজন শহীদ হবেন। নিরাপদ বর্মের অর্থ হচ্ছে মদীনা শহর।

এরপর মুশরিকদের মোকাবিলা করার জন্য রাসূল সা. আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে মতামত দিলেন, মুসলমানরা শহর থেকে বের হবে না। তারা মদিনার ভেতরেই অবস্থান করবে। কাফেররা তাদের তাঁবুতে অবস্থান করতে থাকুক। যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে মুসলমানরা মদীনার অলিগলিতে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। মহিলারা ছাদের উপর থেকে তাদের ওপর আঘাত হানবে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এই অভিমতের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বদর যুদ্ধের পর ঈমান গ্রহণ করে। যেহেতু সে খাজরাজ গোত্রের নেতা ছিল তাই সে মজলিশে শুরার সদস্য হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত ছিল।

নবী সা.-এর অভিমতের সাথে এই মুনাফিক ঐকমত্য প্রকাশের কারণ এটা নয় যে, মুহাম্মদ সা.-এর অভিমত ও প্রতিরক্ষা কৌশল তার পছন্দ হয়েছিলো। বরং সে এ কারণেই পছন্দ করেছিলো যে, এতে একদিকে সে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে, অথচ কেউ সেটা বুঝতেও পারবে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিলো অন্যরকম। তিনি চেয়েছিলেন, মুনাফিকরা যাতে চিহ্নিত হয়।

এদিকে রাসূল সা.-এর চাচা হামজা রা. প্রস্তাব করলেন, ময়দানে গিয়েই মোকাবিলা করা হবে সবচাইতে ভালো। কারণ তাতে মদিনা সুরক্ষিত থাকবে। যুদ্ধে যদি আমাদের কোনো সমস্যাও হয় তবে মদিনায় থাকা নারী ও শিশুরা রক্ষা পাবে। আমাদের শহর রক্ষা হবে। যুদ্ধের বিষয়ে অভিজ্ঞ সাহাবারা তাদের মতামত দিতে থাকলেন। অধিকাংশ সাহাবা মদিনার বাইরে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে মতামত দিলেন। সবার পরামর্শ শুনে মুহাম্মদ সা. মদিনার বাইরে যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিলেন ও নিজের মতামত উইথড্র করলেন। সেদিন ছিল জুমাবার। রাসূল সা. জুম'আর খুতবায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। মুসলিমরা সবাই নামাজ পড়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের এভাবে তিনভাগে ভাগ করলেন। মুহাজির বাহিনী, আওস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। মুসলমদের সৈন্য ছিলো সর্বসাকুল্যে এক হাজার। এদের মধ্যে একশত জন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশজন ঘোড় সওয়ার ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে মদিনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.-এর ওপর। এরপর আল্লাহর রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম সৈন্যরা উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেন।

সানিয়াতুল বি'দা নামক স্থানে ভালো অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত একদল ইহুদীর সাথে দেখা হলো। তারা তাদের পরিচয় দিল খাজরাজ গোত্রের মিত্র হিসেবে। আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের দাবির সত্যতা নিশ্চিত করলেন। তারা জানালো, তারা মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করতে চায়। তাদের মুসলমান হওয়ার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা জানায়, তারা মুসলমান হয়নি এবং হওয়ার ইচ্ছাও নেই। আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের দলে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করলেন। নবী সা. মুশরিকদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন।

শাইখান নামক স্থানে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। সারূল সা. সেখানে মাগরিব এবং ইশার নামায আদায় করে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত করলেন। মুসলমানদের তাঁবুর চারদিকে একদল পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়। সাফওয়ান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে কয়েস রা. নবী সা. পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন।

সম্ভবত ঐ ইহুদী যোদ্ধাদল ও আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সাথে কোনো পরিকল্পনায় সম্পর্কযুক্ত ছিল। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের গ্রহণ না করায় সে খুবই বিরক্ত হলো। অবশেষে সে রাসূল সা. বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো, মুহাম্মদ সা. অযথা মুসলিমদের রক্ত ঝরানোর জন্য উহুদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মদিনায় থেকে যুদ্ধ করাই ছিল বেশি যুক্তিযুক্ত এবং তিনি বিনা শর্তে সাহায্যকারীদেরও দলে নিলেন না। তাই সে মুসলিম সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানায় তারা যাতে তার সাথে মদিনায় ফেরত যায়। মুনাফিক সর্দারের আহ্বানে প্রায় ৩০০ সাহাবী যুদ্ধ করা ফিরে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করে।

আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার গোত্রের মুনাফিক ও দুর্বল চিত্তের মুসলিমদের সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তদের পিছু পিছু গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাদেরকে দোহাই দিচ্ছি। তোমাদের মুসলমান ভাইদেরকে এবং আল্লাহর নবীকে উপস্থিত শত্রুর হামলার মুখে ফেলে যেও না।” তারা বললো যদি লড়াই হতো তবে আমরা থাকতাম। তারা যখন কিছুতেই রণাঙ্গনে ফিরে আসতে রাজি হলো না তখন আবদুল্লাহ বিন আমর বললেন, “হে আল্লাহর দুশমনরা, আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে দিন। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের মুখাপেক্ষী রাখবেন না। আল্লাহই তাঁর জন্য যথেষ্ট।”

এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৬৭ নং আয়াতে বলেন, আর যাতে তিনি জেনে নেন মুনাফিকদেরকে। আর তাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘এসো, আল্লাহর পথে লড়াই কর অথবা প্রতিরোধ কর’। তারা বলেছিল, ‘যদি আমরা লড়াই হবে জানতাম, তবে অবশ্যই তোমাদেরকে অনুসরণ করতাম’। সেদিন তারা কুফরীর বেশি কাছাকাছি ছিল তাদের ঈমানের তুলনায়। তারা তাদের মুখে বলে, যা তাদের অন্তরসমূহে নেই। আর তারা যা গোপন করে সে সম্পর্কে আল্লাহ অধিক অবগত।

মুনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর দুরভিসন্ধি সফল হওয়ার কাছাকাছি ছিলো। তার ও তার সঙ্গীদের পিছুটান দেখে আওস গোত্রের বনু হারেসা এবং খাযরাজ গোত্রের বনু সালমার দলও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলো। তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই দুই গোত্রের লোকদের মনে ঈমানী চেতনা জাগ্রত করে দেয়ায় তারা যুদ্ধের জন্যে সংকল্পে অটল রইলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, মুনাফিকরা কখনোই ইসলামের রুকন নিয়ে বিরোধীতা করে না। তারা নামাজী, রোজাদার ও দানশীল। তারা বিরোধীতা করবে রাজনৈতিক পদক্ষেপে। জিহাদের ময়দানে। তারা ভীরুতা অবলম্বন করবে। ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে পারবে না। খেয়াল করে দেখুন, মদিনার ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা বা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই। মজলিশে শুরায় যে কোন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারতো। যেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হোক না কেন সেই সিদ্ধান্তে ইস্তেকামাত থাকা ও সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হলো ফরজ।

এখান থেকে আমাদের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো মুসলিমদের মজলিশে শুরার সিদ্ধান্ত হবে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে। এরপর সবার মতামতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত হবে সবার সিদ্ধান্ত। যারা অনুমোদিত সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিল তারাও সেই সিদ্ধান্ত বিনা শর্তে ও পূর্ণ আন্তরিকতা দিয়ে পালন করবে। অনুমোদিত সিদ্ধান্তের পালন না করে তার বিরোধীতা করলে মুনাফিক ও রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে আল্লাহর কাছে বিবেচিত হবে।

এখান থেকে আমরা আরো শিক্ষা পাই রাষ্ট্রের নায়ক যদি নবীও হন তাহলেও সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে মজলিশে শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। যেহেতু এটা মুসলিমদের মজলিশ তাই এখানে অবশ্যই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাইরে কোনো আলোচনা হবে না। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে এখানে সদস্যরা রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নিবেন। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়। আল্লাহর রাসূল সা. থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী চার নায়ক এই নিয়মে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।

২১ মে, ২০২১

এক নজরে ফিলিস্তিন সংকটের ইতিহাস




যদিও ইহুদীরা ছিল মুসলিম অস্তিত্বের শত্রু তবে মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের একবারই মুখোমুখি যুদ্ধ হয়েছিল, আর সেটা রাসূল সা.-এর সময়ে। মদিনার বনু কাইনুকা, বনু নাদির ও বনু কুরাইজা রাসূল সা.-এর সাথে শত্রুতা করলেও যুদ্ধ করার সাহস করেনি। খাইবারে ইহুদীদের সম্মলিত শক্তির সাথে রাসূল সা.-এর ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং মুসলিমরা এতে বিজয়ী হয়।

তারপর থেকে বহু শতাব্দি ইহুদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেও সরাসরি সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়নি। অবশ্য সে সুযোগও তাদের ছিল না। তারা কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তি হাসিল করতে সক্ষম হয়নি।

আমাদের আজকের আলোচনা আনুমানিক ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করা যেতে পারে। তখন ইহুদীরা বেশি ছিল রাশিয়া, জার্মানী ও পোল্যান্ডে। আর পুরো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে তারা ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব রাষ্ট্রেই কমবেশি তারা নির্যাতিত হতো। তখন পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার ছিল ব্রিটেন ও উসমানীয় সালতানাত। নির্যাতিত ইহুদীরা এই দুই রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে থাকে। ব্রিটেন শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে না চাইলে সবাই একযোগে তুর্কি অঞ্চলে আসতে থাকে। তুর্কি সালতানাত তখন বিশাল। ইহুদী শরনার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে তুর্কি সালতানাতে প্রবেশ করে এবং যার যেখানে সুবিধা সেখানে বসবাস শুরু করে।

ইহুদীদের এই দুরবস্থা নিয়ে তাদের মধ্যে থাকা পণ্ডিতেরা কাজ শুরু করে। অনেকেই কাজ করেন, তবে এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন থিয়োডোর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার পুস্তিকা 'ডের জুডেনস্টাটে' তিনি ২০শ শতাব্দীতে একটি ভবিষ্যৎ স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন এবং এর জন্য তিনি স্থান নির্ধারণ করেন জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনকে।

তার এই পুস্তক ইহুদীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে কিছু ইহুদী এর বিরোধীতা করে। তাদের ধর্মীয় বিবেচনায় তাদের রাষ্ট্রগঠন তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। এই গ্রুপ ছোট হলেও তারা এখনো বিদ্যমান। আবার কিছু ইহুদী রাষ্ট্রগঠনের বিরোধী ছিল এই মর্মে যে, তুর্কি খলিফা এই রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াতে রাগান্বিত হয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে এবং তুর্কি থেকে উচ্ছেদ করবে এই ভয়ে। সেসময় ফিলিস্তিন অঞ্চল তুর্কি সালতানাতের মধ্যে অবস্থিত ছিল।

সব বাধা উপেক্ষা করে হার্জেল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ ছিল। ১৮৯৭ সে সর্বপ্রথম ইহুদী সমাবেশ করে এবং তার ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। তার এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা জায়নবাদ নামে পরিচিত হয়। হিব্রু ভাষায় জায়ন মানে জেরুজালেম। শুরুতে শুধু ইহুদীরাই শুধু জায়নবাদী থাকলেও এখন যারা ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান করে তারা সবাই জায়নবাদী হিসেবে পরিচিত। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে যারা মনে করে (সে যে ধর্মেরই হোক না কেন) জেরুজালেম ইহুদীদের অধিকারে থাকবে তারাই জায়নবাদী।

এই জায়নবাদীদের একটি কুমিরের সাথে তুলনা করে সাবেক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান বলেন, জায়নবাদ হল একটি কুমিরের মত।এর উপরের চোয়াল হল আমেরিকা আর নিচের চোয়াল হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর জিহ্বা আর দাঁত হল ইসরাঈল। এবং এর শরীর সহ অন্যান্য অঙ্গসমূহ হল মুসলিমদেশ সমূহ সহ অন্যান্য রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী, মিডিয়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন।

থিওডোর হার্জেল ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য কলোনী বা আবাসভূমি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ সানির সাথে দেখা করে। বিনিময়ে উসমানীয় সালতানাতের একটি বড় ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। আব্দুল হামিদ তাতে রাজি হননি এবং তাদের দেশ দখলের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে জেরুজালেম ও তার আশে পাশে জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন।

১৯০৪ সালে হার্জেলের মৃত্যুর পর জায়নবাদকে নেতৃত্ব দেন ইহুদী ধনকুবের ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তক ব্যারন রথচাইল্ড। এদিকে উসমানীয় সালতানাত ভাঙতে মরিয়া ছিল ব্রিটেন। মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট করে তারা। সালতানাতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করে। তাদেরকে বুঝানো হয় অনারব তুর্কি ছোট জাত। তাদের অধিকার নেই আরব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার। আরবদের কাছেই নবী এসেছে তাই আরবরাই মহান। নেতৃত্বের হকদার তারা। ব্রিটেন আরব নেতাদের মুসলিম বিশ্বের নেতা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

অন্যদিকে উসমানীয় ভূমি দখলের পর ভাগ বাটোয়ারা করে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে রিভাল চুক্তির মাধ্যমে। আর ইহুদীদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে তাদেরকে একটি রাষ্ট্র তৈরিতে সাহায্য করবে। এই বিষয়ে ব্রিটেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেলফোর জায়নবাদী নেতা রথচাইল্ডকে একটি পত্র দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।

মোটকথা ব্রিটেন আরব নিয়ে একইসাথে তিন পক্ষের সাথে তিনটি চুক্তি করে
(ক) বৃটেন আরবদেরকে আশ্বাস দিল, তারা কুরাইশ বংশের শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে।
(খ) ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো, ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নিবে। সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান পাবে ফ্রান্স অন্যদিকে হেজাজ, ফিলিস্তিন, জেরুজালেমসহ বাকী আরব ব্রিটেন পাবে।
(গ) জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ইহুদীদের একটি রাষ্ট্রগঠনের সুযোগ দেওয়া হবে।

১ম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ব্রিটেনকে সাপোর্ট করে। তাদের সহায়তায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স সহজে মধ্যপ্রাচ্য দখল করে। উসমানীয় সৈন্যরা পরাজিত হয়ে চলে যায়। অন্যদিকে ইহুদীরা চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনকে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও গোয়েন্দা সুবিধা দেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি উসমানীয় সরকারে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদী গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় তথ্য ব্রিটেনের কাছে চলে যেত। ১ম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সেনাদের পরাজয়ে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ও ইহুদীরা ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাই এই ফ্রন্টে সহজেই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনারা জয়লাভ করে।

১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইহুদীদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিবে। সেজন্য ইহুদীরা কাজ করতে থাকে। সারাবিশ্ব থেকে চাঁদা তুলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনের গরিব মুসলিমদের থেকে জমি ক্রয় করা শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে জোর করেও দখল নিতে থাকে। সারা পৃথিবীকে উদ্বাস্তু ইহুদীদের ফিলিস্তিনে আনা হয় ও তাদের পুনর্বাসন করা হয়।

সিরিয়া থেকে আসা উসমানীয় সেনা কমান্ডার ইজেদ্দিন আল কাসসাম ব্রিটেন ও ইহুদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পরে সশস্ত্র আন্দোলন করেন। তিনি মুসলিমদের জমি বিক্রয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করেন। 

১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে জাহাজে করে সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

ইহুদীবাদীদের তিনটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। আল কাসসাম তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৩৫ সালে এক খন্ডযুদ্ধে আল কাসসামকে খুন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।

আল কাসসামের শাহদাতের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের টনক নড়ে। ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে ফিলিস্তিনী আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা।

বরাবরের মতো ব্রিটেন আরব এবং ইহুদী- দু'পক্ষকেই হাতে রাখতে চেয়েছে। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদীরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে।

১৯৪০ সালে ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত ছিল। সেই ইহুদি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন ইহুদীদের সব দাবি মেনে নিয়ে আপাতত বিদ্রোহ থামায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা বহু ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন পৃথিবীতে তার একক কতৃত্ব হারায়। নতুন পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার উত্থান হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে।

ব্রিটেনের গড়িমসি দেখে ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার-হাজার ইহুদিদের বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর বাধ্য হয়ে ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অবশেষে ইহুদিরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেল। কিন্তু আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইহুদিদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। এর বিপরীতে আরবদের কোন নেতৃত্ব ছিলনা। ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল ইহুদীরা। জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বেধে যায়। যেহেতু আরবদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না সেজন্য ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয়। ইহুদিদের ক্রমাগত এবং জোরালো হামলার মুখে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনীরা। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে।

তখন ফিলিস্তিনের একজন নেতা আল-হুসেইনি সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র সহায়তার জন্য। কিন্তু তিনি সাহায্য পাননি। এদিকে সিরিয়া, হেজাজ, মিশর, জর্ডান, লেবানন, ইরাক ইত্যাদি আরব অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা রাষ্ট্রগঠন করেছে ব্রিটেনের গোলাম হয়ে। জেরুজালেমে চলা দাঙ্গার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন আমেরিকা জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে।

যুদ্ধবিরতির সময় দু'পক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু ইসরায়েল বেশি সুবিধা পেয়েছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধবিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাঈলী বাহিনী। একর পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদীরা। তেল আবিব এবং জেরুজালেমের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। রাষ্ট্র গঠনের সময় জাতিসংঘ ইসরাঈলকে ফিলিস্তিনের ৫০% জমি দিলেও ইহুদীরা ক্রমাগত তাদের জমি বাড়াতে থাকে। যুদ্ধ হলে ভূমি বাড়ানোর প্রক্রিয়া কিছুদিন বন্ধ থাকে। আর পরিস্থিতি শান্ত হলে ভূমি অধিগ্রহণ বাড়াতে থাকে।

ইসরাঈল রাষ্ট্রগঠন করতে সক্ষম হলেও ফিলিস্তিনে কোনো রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। ফিলিস্তিনে কোনো নেতা ছিল না যার মাধ্যমে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করবে। ৪৮, ৫৬, ৬৭ ও ৭৩ সালে আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইসরাঈলের যুদ্ধ হয়। ১৯৫৯ সালে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে ফাতাহ নামে। এটাই ছিল মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। ইয়াসির আরাফাতসহ অন্যান্য নেতারা এটি গঠন করেন।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দুটি রাষ্ট্র ঘোষিত হলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠন করতে সক্ষম হয়নি। জাতিয়তাবাদী নেতারা যারা ব্রিটেনকে ডেকে এনে তাদের স্বাধীনতা নষ্ট করেছে তারা পরস্পর বিরোধ তৈরি করার মাধ্যমে কেবল ইহুদীদেরই স্বার্থ রক্ষা করেছে। ৬৭ সালে যুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হারের পর ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী দল ফাতাহর নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে PLO নামে গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন গঠিত হয়। তারা ইসরাঈলীদের সীমানা বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় কারণ PLO-এর বহু নেতা ইসরাঈলী অর্থ, নারী ও সুযোগ সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

ইহুদী চক্রান্ত ও প্রলোভনে আরাফাত ও তার দল বার বার পর্যদস্তু হলে ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। এরা মিশরের ইসলাম্পন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা সংগঠিত হয়। হামাস দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলামপন্থী হামাসের উত্থান দেখে ইসরাঈল ফাতাহকে সমর্থন দেয়। তাদেরকে সরকার গঠন করার সুযোগ দেয়। প্রায় ৪১ বছর পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয়। ১৯৯৩ সালে অস্ত্র সমর্পন করে PLO। বিনিময়ে তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ইসরাঈল আমেরিকা সহ সকল জায়নবাদীদের থেকে সুবিধা পায়। এদিকে ইসরাঈল তার এলাকা দখল বন্ধ রাখেনি। তারা ধীরে ধীরে মুসলিমদের উচ্ছেদ করেই যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র আরাফাতের দল কিছুই করতে পারছিল না। হামাস তার সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ফলে হামাস জনপ্রিয় হয়ে যায়।

২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় হামাস। কিন্তু সরকার গঠন করার পর আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ফাতাহ হামাসের সাথে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়। অবশেষে ২০০৭ সালে হামাস মুসলিমদের রক্তক্ষয় এড়াতে গাজার একক নিয়ন্ত্রণ নেয় ও পশ্চিম তীর ফাতাহকে ছেড়ে দেয়। এরপর কার্যত ফিলিস্তিন দুইভাগ হয়ে পড়ে।

আমরা ফিলিস্তিনী যাদেরকে ইট পাথর নিক্ষেপ করতে দেখি তারা মূলত পশ্চিম তীরের জনগণ। তাদের কাছে অস্ত্র নেই। সেই অঞ্চলে প্রায়ই মুসলিমরা উচ্ছেদের শিকার হয়। অন্যদিকে গাজার লোকেরা অবরুদ্ধ হলেও গাজার অভ্যন্তরে ইসরাঈলীদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। তারা সেখানে ভূমি দখল বা বসতি স্থাপন করতে পারে না। হামাস ধীরে ধীরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। ২০১৪ সাল ও ২০২১ সালে তারা সরাসরি যুদ্ধ করে ইসরাঈলকে ভালো জবাব দিতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ইসোরাঈলের সীমানা বাড়ানোর প্রচেষ্টা রুখে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে হামাস যদি পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পায় তবে ইসরাঈলকে দমন করা সহজ হবে।

বস্তুত ইসরাঈল একটি দখলদার রাষ্ট্র। এর নাগরিকরা বহিরাগত। তাদের থাকার অধিকারের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তবে তারা থাকবে জার্মানীতে নতুবা রাশিয়ায়। সেখানে তাদের আদি নিবাস। আর আমেরিকার যদি এতই দরদ থাকে ইহুদীদের প্রতি তবে তাদের দেশেই হোক ইসরাঈল।

আমার বিবেচনায় ফিলিস্তিন সমস্যার তিন কারণ

১. তুর্কি সালতানাতে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ইহুদী ও গাদ্দার মুসলিমদের আধিক্য।
২. ফিলিস্তিনসহ আরব মুসলিমদের মধ্যে উম্মাহ চেতনার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী অথবা গোত্রবাদী চেতনার উদ্ভব।
৩. জাগতিক লোভ ও সুযোগ সুবিধার জন্য ইহুদীদের কাছে জমি বিক্রয় করা।

এই সমস্যাগুলো শুধু আরব মুসলিমদের মধ্যে হয়েছে তা নয়, আমাদের মধ্যেও হয়েছে। ১৯৪৭ সালে মুসলিম উম্মাহ চেতনা নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম করে বাংলাদেশকে ভারতীয় মুশরিকদের করদ রাজ্য বানিয়ে নিয়েছি।  এই নিয়ে আমি আমার দীর্ঘ সিরিজ বঙ্গকথা লিখেছি বিস্তারিতভাবে।

খেয়াল করে দেখুন শুধুমাত্র মোদির আগমনের বিরোধীতা করায় আজকে হেফাজতে ইসলামের বহু নেতাকর্মী জেলে। ২২ জনকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। সোনারগাঁও থানার আমীরকে নির্যাতন করে কারাগারে খুন করা হয়েছে। এদেশে ভারতীয়দের ইচ্ছে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।

১৯ মে, ২০২১

চলমান হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধে বড় প্রাপ্তি তিনটি




আমার বিবেচনায় চলমান হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধে বড় প্রাপ্তি তিনটি

১. ট্রাম্পের 'জেরুজালেম শান্তি প্রক্রিয়া' অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া।

ট্রাম্প তার শাসনামলের শুরু থেকেই জেরুজালেম শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। এই কাজ করার মানে হলো ইসরাঈলকে সুবিধা দেওয়া ও ফিলিস্তিন তথা হামাসকে নিরস্ত্র করা। এই শান্তি প্রক্রিয়ার ধারাগুলো জনগণের কাছে গোপন রেখে ট্রাম্প চেয়েছিলো আরব রাষ্ট্রপ্রধানদের একমত করতে।

সৌদি, মিশর, জর্ডান, আরব আমিরাত রাজি হয়ে গিয়েছিল। বাকী ছিল সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনী দলগুলো। সিরিয়ায় ইরান ব্লকের আসাদ জিতে যাওয়ায় সিরিয়ার সমর্থন পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

লেবাননের সা'দ হারিরিকে সৌদির এমবিএস আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাকে গৃহবন্দী করে তার থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা ও লেবাননে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ট্রাম্প ও এমবিএস। তবে লেবাননের সব পক্ষ (শিয়া, সুন্নি ও খৃস্টান) তাদের সেই চেষ্টাকে ব্যাহত করে দেয়।

ফিলিস্তিনের মাহমুদ আব্বাসকে রাজি করাতে চাপ দেয় ট্রাম্প ও এমবিএস। তাকেও সা'দের মতো আটকানোর চেষ্টা করে। তবে মাহমুদ আব্বাস দৃঢ়ভাবে তা মুকাবিলা করে। মাহমুদ আব্বাস রাজি না হওয়ায় হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় নি।

এই প্রক্রিয়া দ্রুত আগাচ্ছিল। এর সূত্র ধরে তুরস্ক, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর চাপ আসে যাতে তারা ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দেয়। চাপটা পাকিস্তানের ওপর বেশি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সৌদি-পাকিস্তানের সম্পর্কও বারবার বিনষ্ট হচ্ছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের সৌদি নির্ভরতার সুযোগ নিতে চেয়েছিলো এমবিএস। সেটা সফল হতে যাচ্ছিল।

এই প্রক্রিয়া কন্টিনিউ হলে সব মুসলিম রাষ্ট্র ধীরে ধীরে ইসরাঈলকে বৈধতা দিত এবং সেইদিকেই আগাচ্ছিল। চলমান যুদ্ধে এই প্রক্রিয়া শুধু থেমে যাবে না বরং যারা আগে শান্তি প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলো তারা তা উইথড্রো করবে।

কমেন্টে ট্রাম্পের শান্তি প্রক্তিয়ার ধারাগুলো দেওয়া হবে।

২. আয়রন ডোমের জারিজুরি ফাঁস

২০০৬ সাল থেকে ইসরাঈল তাদের আকাশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আয়রন ডোম নামে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দাঁড় করায়। ২০১১ সালে তারা এর মাধ্যমে পুরো ইসরাঈলের আকাশ সীমার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইসরাঈলকে সুপার পাওয়ারে পরিণত করে। কোনো মিসাইল ইসরাঈলের অভ্যন্তরে আর আঘাত হানতে পারবে না।

এটি কাজ করতো এমনভাবে, কোনো মিসাইল যখন ইসরাঈলের আকাশের দিকে আসতো তখনই রাডার তা ডিটেক্ট করতো। সেই মিসাইলের গতি ও অবস্থান নির্ণয় করে আয়রন ডোম নিজেই একটা মিসাইল ছুঁড়ে ঐ মিসাইলকে আকাশে বিস্ফোরিত করে দিত।

এই প্রযুক্তির ফলে হামাসের স্বল্প পাল্লার রকেটগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। হামাস এতে হতাশ না হয়ে তাদের রকেটের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। কারণ হামাস উপলব্ধি করেছে এই আয়রন ডোম পরিচালনা বাবদ ইসরাঈলকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে।

আগে হামাসের রকেটগুলো লক্ষ্যভেদ হতো না, সমুদ্রে পড়তো, নানানভাবে নষ্ট হতো। কিন্তু এখন হামাসের প্রতিটি রকেটের পেছনে ইসরাঈলের একটি মিসাইল ধ্বংস হয়। হামাসের রকেটের ব্যয় সর্বোচ্চ ৮০০ ডলার। অন্যদিকে ইসরাঈলের প্রতিটি মিসাইলের ব্যয় ৫০০০০ ডলার। এখন দেখা যাচ্ছে হামাসের রকেট যেগুলো আয়রন ডোম ভেদ করে আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছে সেগুলো যত ক্ষতি করছে তার চাইতে বেশি ক্ষতি হচ্ছে যেগুলো আয়রন ডোম আটকে দিচ্ছে। হামাসের একটি রকেটেও বৃথা যাচ্ছে না।

হামাসের এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে যে, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে আয়রন ডোম চালাতে সক্ষম হবে না ইসরাঈল। এই প্রসঙ্গে ইসরাঈলী নীতি নির্ধারকেরাও ইতোমধ্যে একই কথা বলেছে।

৩. সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া মুক্তি নেই, এই উপলব্ধি।

ফিলিস্তিনের মুসলিমরা নানান দলে বিভক্ত। এর মধ্যে অনেকেই ভাবতো রাজনৈতিকভাবেই ইসরাঈলের সাথে মীমাংসা হতে পারে। এটা যে হবে না, সেই উপলব্ধি এখন সবার হয়েছে। এবার যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সব পক্ষই জয়েন করেছে। ইসরাঈল গাজা ও হামাস নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার সুবিধা নিয়ে পশ্চিম তীরের গ্রুপগুলো ইসরাঈলের সীমানাবর্তী শহরগুলোতে মহড়া চালাচ্ছে। আর হামাসও তার দূরপাল্লার রকেটগুলো পরীক্ষা চালাচ্ছে।

১৮ মে, ২০২১

কে ছিলেন ফিলিস্তিনের 'আল কাসসাম'?



বর্তমান ফিলিস্তিন সংকটে এই নামটা বেশ আলোচিত হচ্ছে। দখলদার ইসরাঈলের বিরুদ্ধে হামাস লড়াই করে যাচ্ছে। হামাস হলো ফিলিস্তিনের ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংগঠন। যার পূর্ণরূপ হচ্ছে – ‘হারাকাতু মুকাওয়ামাতিল ইসলামিয়্যাহ’ বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শায়খ আহমদ ইয়াসিন রহ.।

হামাসের সামরিক শাখার নাম আল কাসসাম ব্রিগেড। যার নামে এই নামকরণ তাঁর পূর্ণ নাম হলো ইজ্জউদ্দিন আবদুল কাদির ইবনে মুস্তাফা ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ আল-কাসসাম। সংক্ষেপে ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম। হামাসের বহুল আলোচিত রকেটের নামও আল কাসসাম রকেট। 

আমি যদিও শিরোনামে ফিলিস্তিনের আল কাসসাম বলেছি। তবে তিনি প্রকৃত ফিলিস্তিনি নন। তিনি সিরিয়ার মানুষ। তবে ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে ইহুদীবাদ ও ব্রিটিশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেন। অবশেষে তিনি শাহদাতবরণ করেন এবং তাঁর প্রচেষ্টা দৃশ্যত ব্যর্থ হয়। কিন্তু প্রকৃতভাবে তিনি ব্যর্থ হন নি। দলমত নির্বিশেষে ফিলিস্তিনের সকল মুসলিম তাঁকে বীর হিসেবে স্মরণ করেন। ফিলিস্তিনীদের মরণপণ সংগ্রামের তিনিই প্রেরণাদাতা। 

আল্লাহ যেমন বলেছেন শহীদেরা মরেন না, ঠিক তেমনি আল কাসসাম রহ.-কে বিবেচনা করলে আপনি সেই কথাই প্রমাণ পাবেন। আল কাসসাম রহ. প্রায় ৮৫ পূর্বে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অথচ তিনি এখনো ফিলিস্তিনী মুসলিমদের জিহাদে উজ্জীবিত করে চলেছেন।   

জন্ম ও শিক্ষা দীক্ষা 
শহীদ আল-কাসসাম রহ. ১৮৮২ সালে সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমে জাবলাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার জন্মের সময় এটি ছিল উসমানিয় শাসনের অধীনে। তাঁর বাবা আবদুল কাদির ছিলেন উসমানীয় যুগে শরিয়া আদালতের একজন কর্মকর্তা এবং কাদেরিয়া তরিকার একজন স্থানীয় নেতা। তার দাদা কাদেরিয়া তরিকার একজন প্রধান শাইখ ছিলেন। পারিবারিকভাবে আল কাসসাম কাদেরিয়া তরিকার সুফি হিসেবে গড়ে উঠেন। এরপর তিনি জাবলাহ থেকে ইরাক চলে এসেছিলেন। সেখানে তিনি ইরাকের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। 

এরপর ১৯০২ সালে আল-কাসসাম আল-আজহার মসজিদে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কায়রোতে যান। সেখানে তিনি দেখা পান ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত ও আধুনিক ইসলামী সংগঠনের রূপকার জামাল আল দ্বীন আফগানীর প্রধান অনুসারী মুহাম্মদ আবদুহুর সাথে। আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালে আল-কাসসাম রহ. সুফিবাদের সাথে জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত হন।    

পেশা ও আন্দোলন 
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলেম হিসেবে জন্মস্থান জাবলাহ ফিরে আসেন এবং একটি কাদেরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাদেরিয়া তরিকা এবং কুরআনের আইনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ইবরাহিম ইবনে আদহাম মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

জাবলাহতে ফিরে এসে আল-কাসসাম রহ. জামালুদ্দিন আফগানী ধারণা অনুসারে নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামি পুনর্জা‌গরণ কর্মসূচি শুরু করেন। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ফরজিয়াত পালনের ব্যাপারে তিনি তাকিদ করেন। নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন এবং জুয়া ও মদ্যপান বন্ধ করাও তার কার্যক্রমের অংশ ছিল। আল-কাসসামের কার্যক্রম জাবলাহতে প্রভাব ফেলে এবং স্থানীয় জনগণ তার সংস্কার গ্রহণ করে। তখন আরবদের মধ্যে গড়ে ওঠা আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং উসমানীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশদের মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি সোচ্চার থাকেন। 

১৯১১ সালে ইতালি উসমানিয়দের কাছ থেকে লিবিয়া দখল করলে তিনি এর প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। তিনি সিরিয়ায় লিবিয়ার যোদ্ধাদের জন্য অর্থ কালেকশন করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ আছে এমন স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে তিনি লিবিয়ায় প্রেরণ করেন। 

সিরিয়ায় ফরাসি-বিরোধী প্রতিরোধ
১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আল-কাসসাম রহ. উসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়েন। ফ্রান্স দামেস্ক দখল করে নেয়। যুদ্ধে উসমানীয় সেনাবাহিনী হেরে যায়। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি জাবলাহতে ফিরে আসেন ও জাবলাহ রক্ষার চেষ্টা চালান। উসমানীয় শাসক পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাই তারা আল-কাসসাম রহ.-কে সহায়তা করতে পারেনি। তিনি একটি নিজস্ব বাহিনী গঠন করেন। 

১৯১৯ সালে ফরাসিরা উত্তর সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। তাদের সহায়তায় প্রথম ফয়সাল স্বাধীন আরব রাষ্ট্র হিসেবে রাজতান্ত্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসময় আল-কাসসামের বাহিনী রাজতন্ত্রের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। তবে ফরাসি সৈন্যরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সংহত করার পর আল-কাসসাম বাহিনীর সাথে তীব্র যুদ্ধ হয়। বছরখানেক ধরে তিনি ফরাসিদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ফরাসিদের অব্যাহত বিজয়ে আল-কাসসাম বাহিনী রসদ সংকটে পড়ে যায়। কোণঠাসা হয়ে আল কাসসাম রহ. সিরিয়া ত্যাগ করেন ও ফিলিস্তিনে চলে যান।   

ফিলিস্তিনে আল কাসসাম রহ. 
সিরিয়াতে বিপর্যন্ত হওয়ার পর আল কাসসাম রহ. প্রথমে লেবাননের বৈরুতে যান পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের হাইফাতে যান। তার পরিবারও তার সাথে ফিলিস্তিনে এক্ত্র হয়। তিনি ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন করেন এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। এসময় ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অধীনে ছিল। তিনি ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মধ্যে বিদআতি ও শিরকি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেন। খিজিরের মাজারে সন্তান চাওয়া, নৃত্য ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে তাদের সতর্ক করেন। তিনি তাদের সঠিক ইসলামের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার আকর্ষণীয় বক্তব্যে মানুষ ভুল পথ পরিত্যগ করে।   

পাশাপাশি আল-কাসসাম রহ. গরিব মানুষদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।। তিনি শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং ইমাম হিসেবে প্রথমে জেরিনি মসজিদ ও পরে ইসতিকলাল মসজিদে তাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাদের তিনি রাস্তা, পতিতালয় ও হাশিশের আড্ডায় খোঁজ করতেন। এই গরিব কৃষকরা তাদের জমি ইহুদিদের কাছে বিক্রয় করতো। ইহুদিরা তাদের মাদকে অভ্যস্ত করতো, এবং একসময় মাদকের টাকা যোগাতে তারা জমি বিক্রয় করতো। এভাবে মুসলিম গরিব কৃষকরা উদ্বাস্তু হতে থাকলো।

এভাবে উদ্বাস্তু হয়ে হাইফা আসা ভূমিহীন কৃষকদের মধ্য থেকে অধিকাংশ তাঁর অনুসারী হয়। উত্তর ফিলিস্তিনের দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে আল-কাসসাম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯২৯ সালে আল-কাসসাম সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল কর্তৃক হাইফার শরিয়া আদালতে বিয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত হন। এই দায়িত্বের কারণে তাকে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে সফরে যেতে হত। তিনি সেখানকার বাসিন্দাদেরকে কৃষি সমবায় গড়তে উৎসাহিত করেন। তার সফরের সময় তিনি গ্রামবাসীদেরকে তার তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করতেন।

সশস্ত্র সংগ্রাম 
১৯৩০ সাল থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আল কাসসাম রহ. সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এর জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জায়নবাদি বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আল-কাসসাম রহ. উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদিদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম রহ. নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন।

যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সময় আল-কাসসাম উন্নত চরিত্রের উপর জোর দিতেন। তাদেরকে অসহায়, অসুস্থদের সেবা, পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়তে বলা হত। শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সাহসী যোদ্ধা হতে এসকল গুণের প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং ইসলামে অনৈতিক বলে বিবেচিত কাজে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বিয়েকে তরুণদের নৈতিক অধঃপতন বন্ধের উপায় হিসেবে দেখতেন। অনেক সহায়হীন সমর্থকদের বিয়েতে তিনি খরচ জুগিয়েছেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। 

তিনি ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। তার বাধার ফলে ইহুদিরা বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। কিছু স্থান থেকে তারা পালিয়ে যায়। ফলে অবধারিতভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে তার সংঘর্ষ শুরু হয়। 

১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল কাসসাম রহ.-সহ তাঁর কিছু সহকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। ফলে আল-কাসসাম ও তাঁর বারোজন অনুসারী আত্মগোপনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা জেনিন ও নাবলুসের মধ্যের পাহাড় দিয়ে হাইফা ত্যাগ করেন। শাইখ জাইদের গ্রামে একটি গুহায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ২০ নভেম্বর এখানে সংঘটিত দীর্ঘ লড়াইয়ে আল-কাসসাম ও তার তিন অনুসারী নিহত হন এবং পাঁচজন বন্দী হন।

জেরিনি মসজিদে আল-কাসসামের জানাজায় প্রচুর মানুষ সমবেত হয়, এদের অধিকাংশ ছিল কৃষক ও শ্রমজীবী। আল-কাসসামের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় হাইফাসহ বেশ কিছু ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। আল-কাসসাম রহ.-কে সাবেক ফিলিস্তিনি গ্রাম বালাদ আল-শাইখে দাফন করা হয়। যা এখন ইসরাঈলের শহর নেশ নামে পরিচিত। 

আল কাসসাম রহ.-এর সংগ্রাম এখনো চলমান
আল-কাসসামের আন্দোলনের সদস্যরা "কাসসামিয়ুন" নামে পরিচিত ছিল। তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে তার দলের এক কর্মী ফারহান আল-সাদির নেতৃত্বে দুইজন ইহুদি সন্ত্রাসীকে হত্যা করেন। এটি আরব বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কাসসামিয়ুনদের নেতৃত্বে কৃষক ও শহুরে গেরিলারা দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

আল-কাসসামের কারণে ফিলিস্তিনীরা সশস্ত্র জিহাদের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। ১৯৬০ এর দশকে সৃষ্ট ফিলিস্তিনি ফিদাইন যোদ্ধারা আল-কাসসাম রহ.-কে নিজেদের প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখত। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র আন্দোলন ফাতাহের প্রতিষ্ঠাতারা প্রথমে নিজেদের দলকে "কাসাসামিয়ুন" বলে ডাকতেন। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের পরিচিত সদস্য লাইলা খালিদ তার সংগঠন সম্পর্কে বলেছেন যে আল-কাসসামের সমাপ্তির স্থান থেকে তার সংগঠন শুরু হয়েছে এবং আল-কাসসামের প্রজন্ম যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা সমাপ্ত করতে সংকল্পবদ্ধ। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও কাসসাম রকেট রেখেছে।

মোটকথা ফিলিস্তিনের সকল যোদ্ধাদের কাছেই আল কাসসাম রহ. হলেন প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক।