১৪ মে, ২০১৬

মাওলানা নিজামীকে হত্যার প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার নিন্দা জানায় সারা মুসলিম বিশ্ব। তারই কিছু সংকলন করা হয়েছে এখানে।

* ফিলিস্তিনের হামাস: Hamas mourns Jamaat-e-Islami leader Nizami
* ফিলিস্তিনী উলামা পরিষদ: Palestine Scholars Association
* মিসরের ইখওয়ান: Muslim Brotherhood Condemns Execution of Bangladesh Jamaat-e-Islami leader Rahman Nizami
* কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদীন সভাপতি সালাহ উদ্দিন: Moulana Nizami was a real Islamic leader
* কাশ্মীরের দুখতারান-এ-মিল্লাত প্রধান আছিয়া আন্দ্রাবি:
Toughen stand against Bangla govt.
* জামায়াতে ইসলামী হিন্দ: JIH President condemns the hanging of Bangladesh
* জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান: Ulema condole Nizami’s martyrdom
 Dhaka regime afraid of JI popularity
JI urges raising BD trials, executions with Muslim states
Thousands join funeral for JI BD leader
* পাকিস্তান সরকার: Ministry of Foreign Affairs Government of Pakistan
Pakistan parliament condemns Nizami hanging
* তুরস্কের সর্ববৃহৎ ইসলামী ছাত্র সংগঠন এনাতোলিয়ান ইয়ুথ এসোসিয়েশন: Bangladeshi Jamaat-e-Islami party leader Nizami's execution protested in Turkey
* মালেশিয়ান ইসলামিক ইউথ মুভমেন্ট (আবিম): Execution Of Sheikh Nizami As Wake Up Call For Human Rights In Bangladesh
* মালয়েশিয়ার পাস পার্টি: PAS Kecam Hukuman Mati Yang Telah Dijatuhkan Ke Atas Amir Jamaat-E-Islami Bangladesh
* তুরস্ক প্রেসিডেন্ট এরদোগান: I condemn the mentality that sentences a mujahid to death
* এবং এর প্রতিবাদে তাদের রাস্ট্রদূত প্রত্যাহার: নিজামীর ফাঁসি: বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলো তুরস্ক
Turkey withdraws Bangladesh ambassador after execution of Islamist: Erdogan
Nizami’s death penalty not fair governance: Erdoğan
* ইসলামী সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা Execution of Maulana Nizami Strongly Condemned by ICNA
* কুয়েতের ওলামা পরিষদ
جمعية الإصلاح تنعى أمير الجماعة الإسلامية في بنجلاديش
* ইরানের ইসলামি মাজহাব বিষয়ক বিশ্ব সংহতি সংস্থা নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে ইরানের বিশ্ব সংহতি সংস্থার নিন্দা
* ড. তারিক রামাদান: Bangladesh a pendu Motiur Rahman Nizami
* ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলারস(IUMS) এর প্রধান ড. ইউসুফ আল-কারযাবি: ইউসুফ আল কারযাভীর ওয়েবসাইট
* পাকিস্তানের মুফতি ত্বাকী ওসমানী মুফতি ত্বাকী ওসমানীর টুইটার
* ওমর সুলাইমান ফেসবুক পোস্ট
* সা’দ ইবনে ঘোনাইমের অভিমত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শায়খ নিজামীর ফাঁসি একটি জঘন্য অপরাধ এবং রাজনৈতিক অধিকারের লঙ্ঘন।
* সৌদী কূটনীতিবিদ আলী আল গামাদি For what sin was Maulana Nizami executed? 

১৩ মে, ২০১৬

শরীয়তের মানদন্ডে গায়েবানা জানাযা



-প্রফেসর ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী

মৃতদেহ সামনে না রেখে জানাযা পড়াই হচ্ছে গায়েবানা জানাযা। বিভিন্ন রেওয়ায়েতে দেখা যায়, রাসূল (স.) একাধিকবার গায়েবানা জানাযা পড়েছেন। তবে একটি রেওয়ায়েত ছাড়া বাকীগুলো বিশুদ্ধ সনদে পাওয়া যায় না। সেটি হচ্ছে, আবেসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা। ইমাম বুখারী ও মুসলিম এ মর্মে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, 
أن رسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ نعى النجاشي في اليوم الذي مات فيه، وخرج بهم إلى المصلى ، فصف بهم، وكبر عليه أربع تكبيرات. (متفق عليه). 
“যে দিন নাজ্জাশী মারা গেলেন, সে দিনই রাসূল (স.) তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে জানাযার মাঠে হাজির হলেন এবং তাদেরকে কাতারবন্দী করলেন। তারপর চার তাকবীর দিলেন”। 
এই ঘটনা সকলের কাছেই একটি সুবিদীত ও স্বীকৃত বিষয়। তা সত্বেও ইসলামী শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ গায়েবানা জানাযার ব্যাপারে একাধিক মত পোষণ করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সকলের মূল 
প্রমাণই কিন্তু রাসূল (স.) কর্তৃক নাজ্জাশীর জানাযা পড়ানোর ঘটনা সম্বলিত এই হাদীসটি। তারতম্য শুধু হাদীসটি বিশ্লেষণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। তাদের অভিমতগুলোকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথম অভিমত: গায়েবান জানাযা সর্বাবস্থাতেই বৈধ। পূর্বে তার জানাযা হোক বা না হোক। মুসলিম জনপদে মারা যাক বা কাফির জনপদে মারা যাক।

যুক্তি-প্রমাণ:
ক. বুখারী-মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত উপরিল্লিখিত হযরত আবু হুরায়ার হাদীস। যাতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (স.) নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছেন। অতএব, গায়েবানা জানাযা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই। 
এ ছাড়া অন্যান্য সাহাবী থেকেও হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে সমর্থ শব্দে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম ইবনু হাযম (রা.) বলেন: 
ويصلى على الميت الغائب، وقد صلى رسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ على النجاشي وصلى معه أصحابه صفوفا، وهذا إجماع منهم لايجوو تعديه.

“অনুপস্থিত মৃতের জানাযা পড়া যাবে। রাসূল (স.) নাজ্জাশীর জানাযা পড়েছিলেন। তাঁর সাথে কাতারবন্দী হয়ে সাহাবীরাও পড়েছিলেন। এটা হচ্ছে তাদের এমন ইজমা (ঐকমত্য) যা এড়িয়ে যাওয়া বৈধ নয়।”
রাসূূল নিজে পড়েছেন। সাহাবীদের পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা উল্লেখ করে ইবনু হাযম আরো বলেন: “ 
فهذا أمر رسول الله وعمله وعمل جميع أصحابه ، فلا إجماع أصح من هذا.

“এটি হচ্ছে রাসূলের নির্দেশ, তার আমল এবং সমস্ত সাহাবীর আমল। এর চেয়ে বিশুদ্ধ কোন ইজমা হতে পারে না”।

খ. গায়েবানা জানাযার উদ্দেশ্য হলো, মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ ও ইস্তেগফার করা। যেমনটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে হযরত আবু হুরায়রা থেকে নাজ্জাশীর জানাযা সংক্রান্ত ঘটনায় বর্ণনা করেন। 
نعى رسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ النجاشي لأصحابه، ثم قال: استغفروا له
“রাসূল (স.) নাজ্জাশীর মৃত সংবাদ দিয়ে সাহাবীদেরকে বললেন: তোমরা তাঁর জন্য ইস্তেগফার কর”। 
এ কথা সুবিদিত, দু‘আ ও ইস্তেগফার লাশ সামনে থাকলে যেমন করা যায়; লাশ না থাকলেও করা যায়।

দ্বিতীয় অভিমত: গায়েবানা জানাযা কোন অবস্থাতেই বৈধ নয়। 

যুক্তি-প্রমাণ: 
রাসূল (স.) কর্তৃক নাজ্জাশীর জানাযা, এটি শুধু তাঁর জন্যই বৈধ ছিলো। যা রাসূল (স.) এর একক বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ইহা রাসূলের সাথেই খাস। তিনি জীবনে শুধু একবারই তা করেছেন। এই খুসুসিয়্যাতের দলীল হলো:

ক. রাসূলের জীবদ্দশায় অনেক সাহাবী বিভিন্ন স্থানে মারা গেছেন। কিন্তু রাসূল আর কখনোই কারো গায়েবানা জানাযা পড়েন নি। 

খ. রাসূল (স.) এর ইনতেকালের সময় সাহাবীরা বিভিন্ন স্থানে ছিলেন। রাসূল (স.) তাদের কাছে সর্বাধিক প্রিয় হওয়া সত্বেও কোন সাহাবী রাসূলের (স.) গায়েবানা জানাযা পড়েন নি। যদি পড়তেন, তাহলে তা বর্ণিত হতো । 

গ. খুলাফায়ে রাশেদীনের মৃত্যুর পরও তাদের গায়েবানা জানাযা হয়েছে বলে কোন প্রমাণ নেই। 
আর মূলনীতি হলো: 
كل ما تركه الرسول وأصحابه من البعادات مع وجود المقتضي للفعل وزوال المانع فإنه واجب الترك وفعله بدعة
“রাসূল (স.) ও তাঁর সাহাবারা যে সমস্ত ইবাদাত ছেড়ে দিয়েছেন কাজটি করার যুক্তি ও সুযোগ থাকা সত্বেও, তা বর্জন করা ওয়াজিব এবং তা করা বিদআত”। 

ঘ. তদুপরি হতে পারে এটা রাসূলের জন্য গায়েবানা জানাযা ছিলো না। বরং নাজ্জাশীর মৃতদেহ তার সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমনটি তুলে ধরা হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাস ইসরা ও মিরাজের ঘটনায়। এটি রাসূলের একটি মুজেযা। যা অন্য কারো জন্য হবে না। যেমনটি বলছেন ইবনু আবেদীন (র.) 
قال ابن عابدين: [لأنه رفع سريره - أي النجاشي- حتى رآه عليه الصلاة والسلام بحضرته فتكون صلاة من خلفه على ميت يراه الإمام وبحضرته دون المأمومين وغير مانع من الإقتداء] حاشية ابن عابدين ২/
“কারণ, নাজ্জাশীর কফিন রাসূলের (স.) উত্তোলন করা হয়েছিল এমনভাবে যে , তিনি তাকে তাঁর সামনেই দেখতে পেয়েছিলেন। সুতরাং যারা তাঁর পেছনে ছিলেন তাদের নামায এমন মৃত ব্যক্তির জন্য ছিলো যাকে ইমাম তাঁর সামনে দেখতে পাচ্ছে। মুক্তাদীরা দেখতে পাচ্ছে না। এটা ইমামের অনুসরণের পথে কোন বাধা নয়”। 

প্রমাণস্বরূপ যে বর্ণনাগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়, সেগুলো হচ্ছে: 
ক. ইবনু হিব্বান কর্তৃক সহীহ সনদে বর্নিত এ হাদীসটি: 
وأيدوا قولهم بما ورد من حديث عمران بن حصين رضي الله عنه أن النبي - صلى الله عليه وسلم - قال: (إن أخاكم النجاشي توفي فقوموا فصلوا عليه فقام رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وصفوا خلفه فكبر أربعاً وهم لا يظنون إلا أن جنازته بين يديه) رواه ابن حبان وإسناده صحيح كما قال الشيخ الأرناؤوط، صحيح ابن حبان ৭/ ৩৬৯.
“হযরত ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেন, “তোমাদের ভাই নাজ্জাশী মারা গেছেন। দাঁড়াও এবং তার জন্য নামায পড়। অতঃপর রাসূল (স.) দাঁড়ালেন এবং তারা তাঁর পেছনে কাতারবন্দী হয়ে গেলেন। তিনি চার তাকবীর দিলেন। তারা শুধু এমনটি ধারণা করছিলেন যে, তার মৃতলাশ রাসূলের সামনেই রয়েছে”।

খ. কোন কোন হাদীসে পাওয়া যায়, أنه قد سويت له أعلام الأرض حتى كان يبصر مكانه 
“রাসূলের (স.) জন্য ভূ-পৃষ্ঠের উপরিস্থিত সবকিছু সমতল করে দেয়া হলো এবং তিনি তার (নাজ্জাশীর) অবস্থান দেখতে পেয়েছিলেন”।

তৃতীয়ত অভিমত: গায়েবানা জানাযা শুধু একটি অবস্থায় বৈধ। তা হচ্ছে: যদি কেউ এমন জায়গায় মারা যায় যেখানে তার জানাযা পড়ার কেউ নেই। যেমন, অমুসলিম জনপদ। 
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ ও ইবনুল কায়্যিম এই মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। 

যুক্তি-প্রমাণ: 

ক. রাসূল (স.) নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন। এর কারণ ছিলো, নাজ্জাশী তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন কাফেরদের দ্বারা বেষ্টিত। সেখানে তার জানাযা পড়ার কেউ ছিল না। অথচ কোন মুসলমান মারা গেলে তার জানাযা পড়া অন্য মুসলিমদের উপর ফরযে কিফায়াহ হয়ে যায়। এজন্যই রাসূল (স.) তার জানাযা পড়েছিলেন। এরই ভিত্তিতে, কোন মুসলিম যদি এমন কোন স্থানে মারা যায় যেথায় জানাযা হয়নি, তাহলে অন্য মুসলিমদের উপর তার জানাযা পড়া অবধারিত হয়ে যায়।

খ. রাসূলের (স.) যুগে ও তাঁর পরবর্তী যুগে কত সাহাবা কত দূরে দূরে মৃত বরণ করেছন। কিন্তু তাদের গায়েবানা জানাযা পড়া হয়নি। কারণ ঐ সব জায়গায় তাদের জানাযা পড়া হয়েছিলো। 
ইবনুল কায়্যীম এ মর্মে বলেন: 
ولم يكن من هديه وسنته الصلاة على كل ميت غائب، فقد مات خلق كثير من المسلمين من الصحابة وغيرهم، وهم غيب، فلم يصل عليهم. 
“প্রত্যেক মৃত্যুর গায়েবানা জানাযা পড়াটা রাসূলের কর্মপন্থা ও নীতি ছিল না। সাহাবীসহ কত মুসলমান মৃত বরণ করেছেন দূরে বসে। কিন্তু তিনি তাদের কারো গায়েবানা জানাযা পড়েন নি”। 
ইবনু তাইমিয়াহ থেকে ইবনুল কায়্যীম বর্ণনা করেন যে, 
الصواب أن الغائب إذا مات ببلد لم يصل عليه فيه، صلي عليه صلاة الغائب، كما صلى النبي على النجاشي؛ لأنه مات بين الكفار ولم يصل عليه، وإن صلى عليه حيث مات، لم يصل عليه صلاة الغائب؛ لأن الفرض قد سقط بصلاة المسليمن عليه.

সঠিক কথা হলো অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি এমন জায়গায় মারা যায় যেখানে তার জানাযা হয় নি, তার উপর গায়েবানা জানাযা পড়া হবে। যেমন, রাসূল (স.) নাজ্জাশীর জানাযা পড়েছিলেন। কারণ তিনি কাফেরদের মাঝে থাকার কারণে তার জানাযা পড়া হয়নি। আর যদি কেউ এমন জায়গায় মারা যায়, যেখানে তার জানাযা হয়েছে, তার গায়েবানা জানাযা পড়া হবে না। কারণ ঐ জানাযার মাধ্যমে ফরজ আদায় হয়ে গেছে।

চতুর্থ অভিমত: বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির গাযেবানা জানাযা পড়া যাবে। সমাজ ও মানবতার জন্য যাদের অবদান আছে। যেমন, কোন নেককার ব্যক্তি, ভালো ব্যবসায়ী, আলেম, ধর্মীয় নেতা। 

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল থেকে এমন একটি অভিমত উল্লেখ করেছেন ইবনু তাইমিয়াহ তাঁর আল-ফাতওয়া আল-কুবরাতে। যেখানে ইমাম বলছেন: إذا مات رجل صالح صلي عليه“কোন নেককার ব্যক্তি মারা গেলে তার গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে”। সমকালীন সময়ের অন্যতম ফিকহবিদ শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায ও শায়ক সা‘আদী এই মতটি গ্রহণ করেছেন।

যুক্তি ও প্রমাণ:
রাসূল (স.) নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা এ জন্য পড়েন নি যে, সেখানে কেউ তার জানাযা পড়ার ছিলো না। কারণ, রাজা-বাদশাহ ও উচ্চ নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে অনুসারীদের কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ করে থাকে। তাই নাজ্জাশীর জানাযা পড়ার মত সেখানে একজন মানুষও ছিল না; বা কেউই তার জানাযা পড়ে নি, এটা অসম্ভব ব্যাপার। হতেই পারে না। তাই এ দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। বরং মূলকথা হলো, নাজ্জাশী ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। মুসলিম মুহাজিরদের প্রতি তার রয়েছে বিরাট অবদান। তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ও অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে রাসূল (স.) তার গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন। অতএব, যে কোন মুসলিম এ ধরনের অবদান রাখবেন ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য তার জন্যই গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে।

কোন মতটিকে প্রনিধানযোগ্য মনে হয়?
উপরিউক্ত আলোচনার পরে আমার কাছে গায়েবানা জানাযা বৈধ; বিশেষ করে যদি মৃত ব্যক্তি এমন হয় যে, মুসলিম উম্মাহর জন্য যার রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান , এ মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়। কারণ: 

১. গায়েবানা জানাযা রাসূল (স.) এর সাথেই খাস, এ দাবীটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, لأن الأصل عدم الخصوصية রাসূলের সাথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত না হওয়াটাই হচ্ছে মৌলিক অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة“তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ”। রাসূল (স.) বলেন: صلوا كما رأيتموني أصلي“আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ, তোমরা ঠিক সেভাবেই নামায পড়”। আমরা দেখেছি, তিনি সাহাবীদেরকে নিয়ে নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছেন। অতএব, গায়েবানা জানাযা বৈধ।

এ মর্মে ইমাম খাত্তাবী বলেন: 
قال الإمام الخطابي: [وزعموا أن النبي - صلى الله عليه وسلم - كان مخصوصاً بهذا الفعل إذ كان في حكم المشاهدين للنجاشي لما روي في بعض الأخبار أنه قد سويت له أعلام الأرض حتى كان يبصر مكانه. وهذا تأويل فاسد لأن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - إذا فعل شيئاً من افعاله الشريفة كان علينا متابعته والإيتساء به والتخصيص لا يعلم إلا بدليل. ومما يبين ذلك أنه - صلى الله عليه وسلم - خرج بالناس إلى المصلى فصف بهم فصلوا معه فعلمت ان هذا التأويل فاسد] معالم السنن ১/ ২৭০ - ২৭১.   

“তারা ধারণা করছে যে, রাসূল (স.) এই কাজটির সাথে বিশেষভাবে জড়িত। অন্যরা নয়; কারণ, তিনি নাজ্জাশীকে প্রত্যÿকারীদের মধ্যে গণ্য। যেমনটি কোন কোন হাদীসে রয়েছে, “ভূ-পৃষ্ঠের উপরিস্থিত সবকিছু তাঁর জন্য সমতল করে দেয়া হলো এবং তিনি নাজ্জাশীর অবস্থান দেখতে পেয়েছিলেন”। এটি একটি অশুদ্ধ ব্যাখ্যা। কারণ, রাসূল (স.) যখন কোন একটি কাজ করেন তখন তাকে সে ক্ষেত্রে অনুসরণ করা ও সে কাজটি করা আমাদের জন্য অনিবার্য হয়ে যায়। আর তার সাথে কোন কাজকে একান্তুভাবে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি দলীল ছাড়া জানা যায় না। এখানেতো এমন কোন দলীল নেই। এটি যে একটি অশুদ্ধ ব্যাখ্যা তার বিবরণ হলো, রাসূল (স.) লোকদেরকে নিয়ে জানাযার মাঠে গেলেন এবং তাদেরকে কাতারবন্দী করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন। সুতরাং বোঝা গেল এটি শুধু তার সাথেই খাস/বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয়। (অন্যথায়, সাহাবীদেরকে পড়তে বলতেন না)। 

ইমমা বগভী (র.) এ মর্মে বলেন: 
وقال الإمام البغوي: [وزعموا أن النبي - صلى الله عليه وسلم - كان مخصوصاً به، وهذا ضعيف لأن الإقتداء به في أفعاله واجب على الكافة ما لم يقم دليل التخصيص ولا تجوز دعوى التخصيص هاهنا لأن النبي - صلى الله عليه وسلم - لم يصل عليه وحده إنما صلى مع الناس] شرح السنة ৫/ ৩৪১ - ৩৪২.
“যারা ধারণা করছে যে, বিষয়টি শুধু রাসূলের জন্যই খাস, তাদের এই অবস্থানটি দুর্বল। কারণ, রাসূল (স.) এর সমস্ত কর্মকান্ডে তাঁর ইকতেদা/অনুসরণ করা সকলের উপর ওয়াজিব যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে খাস হওয়ার দলীল না পাওয়া যায়। এখানে খাস হওয়ার দাবীটা ঠিক নয়; কারণ তিনিতো শুধু একাই গায়েবানা জানাযা পড়েন নি; বরং তার সাথে লোকেরাও পড়েছে।”।

আওনুল মাবুদ গ্রন্থকার বলেন: 
وقال صاحب عون المعبود: [قلت دعوى الخصوصية ليس عليها دليل ولا برهان بل قوله - صلى الله عليه وسلم -: (فهلموا فصلوا عليه) وقوله: (فقوموا فصلوا عليه) وقول جابر: (فصففنا خلفه فصلى عليه ونحن صفوف) وقول أبي هريرة: (ثم قال: استغفروا له ثم خرج بأصحابه فصلى بهم كما يصلى على الجنازة) وقول عمران: (فقمنا فصففنا عليه كما يصف على الميت وصلينا عليه كما يصلى على الميت) وتقدم هذه الروايات يبطل دعوى الخصوصية لأن صلاة الغائب إن كان خاصة بالنبي - صلى الله عليه وسلم - فلا معنى لأمره - صلى الله عليه وسلم - بتلك الصلاة بل نهى عنها لأن ما كان خاصاً به - صلى الله عليه وسلم - لا يجوز فعله لأمته. ألا ترى صوم الوصال لم يرخص لهم به مع شدة حرصهم لأدائه والأصل في كل أمر من الأمور الشرعية عدم الخصوصية حتى يقوم الدليل عليها وليس هنا دليل على الخصوصية بل قام الدليل على عدمها] عون المعبود ৯/ ৯.

“রাসূল (স.) এর বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত করার দাবীটির স্বপক্ষে এখানে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। কারণ, সংশ্লিষ্ট ঘটনায় রাসূল (স.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়েত এর বিপরীত। সেগুলো হচ্ছে : রাসূলের বাণী: “চলো তার জানাযা পড়তে”, “তোমরা দাঁড়াও এবং নামায পড়”। জাবিরের কথা: “আমরা রাসূলের পেছনে কাতারবন্দী হলাম। অতঃপর তিনি নামায পড়লেন আর আমরা কাতারে ছিলাম”। হযরত আবু হুরাইরার কথা “অতঃপর রাসূল (স.) বললেন: “তোমরা তার জন্য ইস্তেগফার করো। তারপর তিনি সাহাবীদের নিয়ে বের হলেন এবং যেভাবে জানাযার নামায পড়েন সেভাবে নামায পড়লেন”। হযর ইমরান বিন হুসাইন এর কথা: “অতঃপর আমরা দাঁড়ালাম এবং কাতারবন্দী হলাম যেমন জানাযার কাতারবন্দী হয় এবং নামায পড়লাম ঠিক যেভাবে জানাযার নামায পড়া হয়”। এ সব রেওয়ায়েত দ্বারা বিশেষত্বের দাবী বাতিল হয়ে যায়। কারণ, তা যদি রাসূলের বিশেষত্ব হতো, তাহলে সাহাবীদেরকে তা করার আদেশ কোন অর্থই হয় না। বরং তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করাই ছিল বাঞ্জনীয়। কারণ, যা কিছু নবীর বিশেষত্ব তউম্মতের জন্য তা বৈধ নয়: যেমন: একাধারে রোজা (সওমে ভেসালের) বিষয়টি। সাহাবীদের প্রবল আগ্রহ সত্বেও রাসূল (স.) তাদেরকে এ মর্মে অনুমতি দেন নি। শরীয়তের সমস্ত বিষয়ে মূলনীতি হলো, দলীল ব্যতীত কোন কিছুকেই বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত না করা। এখানে এর কোন দলীলতো নাইই; বরং এর বিপরীতে দলীল রয়েছে।”

২. রাসূল (স.) এর সামনে নাজ্জাশীর লাশ তুলে ধরা হয়েছিল, এ কথাটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এ মর্মে শামসুল হক আযীম আবাদী বলেন, 
أن الله تبارك وتعالى لقادر عليه وأن محمداً - صلى الله عليه وسلم - لأهل لذلك لكن لم يثبت ذلك في حديث النجاشي بسند صحيح أو حسن وإنما ذكره الواحدي عن إبن عباس بلا سند فلا يحتج به. ولهذا قال ابن العربي: ولا تحدثوا إلا بالثابتات ودعوا الضعاف.
“আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা এমনটি করার ক্ষমতা রাখেন এবং মুহাম্মাদ (স.) এর যোগ্য। তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে নাজ্জাশীর হাদীসে এ রকম কিছু ছহীহ বা হাসান সনদ দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। বরং ইবুন আব্বাস (রা.) এর সূত্রে ওয়াহেদী সনদ ব্যতীত এ রকম কিছু উল্লেখ করেছেন, যা প্রমাণ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এজন্যই ইবনুল আরাবী বলেছেন, যা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তা বলো না। দুর্বল রেওয়াযেতগুলো ছেড়ে দাও”।
ইবনু হিব্বান কর্তৃক ইমরান বিন হুসাইনের হাদীসের জবাবে আওনুল মাবুদ গ্রন্থকার বলেন: 
ومعنى هذا القول أنا صلينا عليه خلف النبي - صلى الله عليه وسلم - كما يصلي على الميت والحال أنا لم نر الميت لكن صففنا عليه كما يصف على الميت كأن الميت قدَّامنا ونظن أن جنازته بين يدي - صلى الله عليه وسلم - لصلاته - صلى الله عليه وسلم - كعلى الحاضر المشاهد ..ويؤيد هذا المعنى حديث مجمع عند الطبراني " فصففنا خلفه صفين وما نرى شيئا "] عون المعبود ৯/ ৯ - ১০.
এ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় না যে, নাজ্জাশীর মৃতদেহ তাঁদের সামনে ছিলো। বরং এর অর্থ হলো, আমরা রাসূলের পেছনে ঐ ভাবে নামায পড়েছি যেভাবে মুতব্যক্তির উপর নামায পড়া হয়। অর্থাৎ জানাযার মত করেই। আর আমাাদের অবস্থাটা এমন ছিল যে, আমরা মৃতকে দেখছি না। তবুও এমনভাবে কাতারবন্দী হলাম ঠিক যেভাবে উপস্থিত লাশের সামনে কাতারবন্দী হতে হয়। যেমন মৃতব্যক্তি আমাদের সামনেই রয়েছে। রাসূল (স.) যেন উপস্থিত দৃশ্যমান ব্যক্তির জানাযাই পড়ছেন। ইমাম তবারানী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে: “আমরা রাসূলের পিছনে দুই কাতারে দাঁড়ালাম। আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না”। (আওনুল মাবুদ ৯/৯-১০)।

৩. রাসূল (স. ) কিংবা সাহাবায়ে কেরাম নাজ্জাশী ছাড়া অন্য কারো গায়েবানা জানাযা পড়েন নি। এ কথা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, গায়েবানা জানাযা অবৈধ। কারণ, রাসূলের একবার করাই এর বৈধতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। গায়েবানা জানাযা পড়া ওয়াজিব,না পড়লে গুনাহ হবে। বিষয়টিতো এমন নয়। যেহেতু, এতে কোন বাধ্য বাধকতা নেই, তাই কেউ তা না করলেও তাকে সেজন্য ভর্ৎসনা করা যায় না। অবশ্য তৃতীয় অভিমতঅনুযায়ী, তা ওয়াজিবের পর্যায়ে পরে। যদি ইতোপূর্বে তার জানাযা না হয়ে থাকে। 
মোটামুটি কথা হলো, যে মতটিকে আমরা প্রণিধানযোগ্য মনে করছি, তাই যে শেষ কথা তা নয়। বরং যদি কেউ মনে করে অন্য কোন মত তার কাছে অধিক যুক্তিসঙ্গত, তা হলে সে তাই মানতে পারে। কারণ, এ সব ইজতিহাদী বিষয়ে মনে রাখতে হবে, “ইজতিহাদকে অনুরূপ ইজতিহাদ দিয়ে খন্ডন করা যায় না”। আমরা আলেমদের গবেষণা ও যুক্তিভিত্তিক সকল মতকেই শ্রদ্ধা করি। তবে বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না। অন্ধভাবে কাউকে মেনে নিতেই হবে। যদিও অন্য কারো যুক্তি অধিক প্রবল। এমন সাম্প্রদায়িক চিন্তা আমরা সমর্থন করি না। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার তাওফীক দান করুন।

সেদিন কেবল গাড়ি-ঘোড়া নয়, মহানন্দার বুকে কোন নৌকাও চলেনি


আল কুরআনকে ভালোবেসে
প্রাণ দিয়েছিল যারা
আজকে দেখো সামনে এসে
রক্ত মাখা শহীদ বেশে
ফের দাঁড়িয়েছে তারা…….

১৯৮৫ সালের সেই শহীদেরা বারবারই প্রতিভাত হন আমাদের সামনে আর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে যান আমাদের দায়িত্বের কথা। এদেশে কুরআনের রাজ প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্বের কথা। ভারতে যখন কুরআন বাজেয়াপ্ত করার ঘোষনা দেয়া হয় তখন ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে এদেশের মানুষের ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফুঁসে উঠে পুরো মুসলিম বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বৈরশাসক ও তার দোসররা এই বিক্ষোভ ঠেকানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। মুসলিম নামধারী কিছু নরপশু বিক্ষোভ করতে দেবে না বলে চাপাইনবাবগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করে। কুরআন প্রেমিক মানুষ প্রশাসনের এমন অযৌক্তিক আচরণকে মেনে নিতে পারেনি। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সমাবেশ স্থলের উদ্দেশ্যে। নরঘাতক, কুরআন বিদ্বেষী এবং ইসলাম বিদ্বেষী তৎকালীন মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে পুলিশ গুলি চালায় সাধারন মানুষের উপর। সেই থেকে ১১ মে কুরআন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ। 

ঘটনার সূত্রপাত ভারতে ১৯৮৫ সালের ১০ই এপ্রিল। পৃথিবীর ইতিহাসে সেটি ছিল এক জঘন্যতম ঘটনা। ভারতীয় দু’জন উগ্রবাদী হিন্দু নাগরিক পদ্মমল চেপারা ও শীতল শিং আদালতে কোরআন বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। তারা কোরআনের উল্লেখিত সূরা বাকারার ১৯১নং আয়াত ও সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। কোরআন যেহেতু কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের হত্যা করার কথা বলেছে সেহেতু কোরআন একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানী দাতা গ্রন্থ।(নাউযুবিল্লাহ) তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নং ধারা সি আর পিসি ১১৫(ক) ও ২৯৯ (ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আল কোরআনকে ভারতীয় সংবিধান বিরোধী বলে উল্লেখ করে।

বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীর ভারতীয় সংবিধানে ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে যে বক্তব্য রযেছে তা হজম করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ই এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় গোটা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। যার উত্তাল তরঙ্গের জলরাশি আছড়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে পুলিশ ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতার মিছিলে অত্যাচার নিপীড়নও চালায়।

১০ মে ১৯৮৫ সালে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ করে। সেই সতঃস্ফুর্ত সমাবেশে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে স্বৈরশাসক এরশাদের পুলিশ। কী ভয়াবহ দুঃসাহস! সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান! তারই সূত্র ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব হোসাইন আহমদ একটি সভার আহবান করেন। সেই সভা থেকে ১১ই মে ঈদগাহ ময়দানে বিকেল ৩টায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সভার প্রস্তুতির জন্য পুরো জেলাতে লিফলেট ও মাইকিং করা হয়। এর পূর্বের দিন শুক্রবার মসজিদে জুমআর খুৎবায় এবং নামাজ শেষে ইমাম সাহেবেরা পরের দিন সামবেশে অংশ গ্রহণের জন্য আহবান জানান। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনা বইতে থাকে। আবাল-বৃদ্ধ সবাই সেই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু ১১ই মে হঠাৎ করে তৎকালীন পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন এবং মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে ব্যপক পুলিশ মোতায়েন করে। পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। ওয়াহিদুজ্জামান দম্ভ করে চেঁচিয়ে ওঠে বলে “এই মহুর্তে স্থান ত্যাগ করতে হবে নইলে গুলির আদেশ দিব, শালা মৌলবাদীদের সাফ করে দিবো”। কুরআন প্রেমিক জনতা চলে গেল না। তারা জানিয়ে দিলেন, গুলির ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করা মানেই আল কোরআনের অপমান, আমরা এস্থান ত্যাগ করবো না।

জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিলের মাধ্যমে কুরআনপ্রেমী মানুষ ঈদগাহ ময়দানে জমায়েত হয়। এক পর্যায়ে মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান বিনা উস্কানিতে গুলির নির্দেশ দেয়। পুলিশ একনাগাড়ে প্রায় পনের মিনিট পর্যন্ত গুলি রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লো পনের বছরের কিশোর স্কুলছাত্র আবদুল মতিন। পুলিশের গুলিতে একে একে শাহাদাৎ বরণ করলেন কৃষক আলতাফুর রহমান, রিক্সা চালক মোক্তার হোসেন, দশম শ্রেণীর ছাত্র রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শীষ মোহাম্মদ ও সেলিম এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দৌলা। আহত হয় শামীম, গোলাম আযম বুলু, শরীফুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, রায়হান, এনামুল হক, মাহবুব, রেজাউল, শাহজাহান, রাজুসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। লাশ আর আহতদের স্তুপে ভরে গেল ঈদগাহ ময়দান। সেদিন টুপি, পাঞ্জাবি, দাঁড়ি দেখলেই নির্মমভাবে তাদের উপর আক্রমন চালায় নরপশু ওয়াহিদুজ্জামানের সাঙ্গপাঙ্গরা।

আহতদের রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো দুটো মিনিবাসে করে। দেড়ঘন্টা পর যখন মিনিবাস থানা পার হচ্ছিল কুখ্যাত মেজিষ্ট্রেট আবারো গাড়ি থামিয়ে গুলির নির্দেশ দেয়। এতে আহত হয় গাড়ীর হেলপার, মারা যায় কাপড় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। আহতদের নামিয়ে দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় এবং নিখোঁজ হয় কয়েকজন আহত ব্যক্তি। কেবল হত্যা ও জখম করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ হতাহতদের গুম করে ফেলেছিল সেই দিন। জানাজার মুহুর্তে লাশ কেড়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। এটি ছিল চাঁপাইবাসীদের জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দিন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেদিন বর্বর পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন ২০ এর অধিক। নিখোঁজ সংখ্যা ৮ জন।

এতো রক্ত, এতো গুলি, এতো আহত এতো তান্ডব- তারপরও পরবর্তী দিনগলোতে সাহসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসী। পুলিশের গুলির মুখে নারায়ে তাকবীর ধ্বনি তুলে ছুটে আসেন তারা ঈদগাহ ময়দানে, কারফিউ উপেক্ষা মিছিল আর শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে ছোট্ট শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১২ই মে পরদিন হরতাল আহবান করা হয়। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাজারে ও মসজিদে লিফলেট দেয়া হয়। গভীর রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে সাইকলে চড়ে মোল্লার ফাঁসির দাবিতে পোস্টারিং করা হয়। পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী যে অভূতপূর্ব হরতাল পালন করেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেদিন কেবল গাড়ি-ঘোড়া বা রিক্সাই নয়, মহানন্দার বুকে কোন নৌকাও চলেনি। এভাবেই মানুষ প্রকাশ করেছে কুরআনের প্রতি ভালোবাসা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

ছবিঃ ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা

বাংলাদেশের এ ঘটনার ফলে সারা বিশ্বে একটি জনমত সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৩ ই মে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি বাসক বামনের আদালতে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেয়। সেই থেকেই বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ ১১ মে'র সেই দিনকে স্মরণ করে “কোরআন দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে।

১৯৮৫ সালের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই নরঘাতক, ইসলাম বিদ্বেষী ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিচার তো এদেশে হয়ই নি বরং সে দিনকে দিন তার অন্যায় দূর্ণিতি চালিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে সে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফের খবরের শিরোনামে এসেছে সে। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। যুদ্ধ না করেই মুক্তিযুদ্ধের জাল সনদ গ্রহণ করে। সে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকুরি নিয়ে এই ধরণের অন্যায় দূর্ণিতিতে অংশ নেই। দুদকের অফিসে তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেকগুলো দূর্ণিতির ফিরিস্তি।

১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিচার এখনো হয়নি। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের অভিযোগের তীর মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে হলেও বিগত ৩০ বছর বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো তাকে তিরস্কার না করে বিভিন্ন মেয়াদে পুরস্কৃত করেছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে দীর্ঘ সময় ধরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর ২০১৪ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য এখনো আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় আছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। ৩০ বছর পার হয়ে গেলেও বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়কদের শাস্তির দাবি থেকে সরে আসেনি নিহতদের স্বজনরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদাগাহ মাঠে যেন আজো শোনা যাচ্ছে কিশোর শীষ মোহাম্মদের আর্তনাদ, শহীদ রফিকুলের করুন আহাজারী। আব্দুল মতিন ও সেলিমের আর্তচিৎকারে শহীদ সবুর ও নজরুলের বুক ফাটা কান্না। আজো বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লাদের বিচার দুনিয়ার জমিনে না হলেও আখিরাতে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে এই বিচার আমরা পাবো এবং এই বাংলায় কুরআনের শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই আমরা উত্তম প্রতিশোধ গ্রহন করবো সেদিনের নির্মমতার। ইনশাআল্লাহ।