১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ও তার ধারাবাহিকতায় ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের রাজনীতি, আমাদের জাতিসত্তা ও আমাদের ইতিহাসকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। আমাদেরকে হীনমন্য করে তোলা হয়েছে। পলাশীর ট্র্যাজেডির ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের সম্মান, ডিগনিটি হারিয়ে একটি পরাজিত জাতিগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছি। দীর্ঘসময় ইংরেজদের শাসনে থাকায় আমরা নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে পশ্চিমাদের প্রজাতে পরিণত হয়েছি।
১৭৫৭ সালের পলাশী
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
পলাশীর যুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতা, ব্রিটিশদের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সর্বোপরি এক গভীর ষড়যন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, যা বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্তমিত করে দেয়।
১. হিন্দুস্থানের কেন্দ্রীয়
শাসনের দুর্বলতা
ü
হিন্দুস্থানের
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আওরঙ্গজেব পর্যন্ত শক্তিশালী ছিল। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর
পর বাংলা আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে বাংলায় স্বাধীন নবাবী আমল শুরু হয়। নবাবী আমলে মূলত
বাংলা রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হতে থাকে।
ü মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন মোঘল শাসকদের সুবাদার (প্রশাসক)। তিনি নিজেকে ১৭১৭ সালে স্বাধীন নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা বা তথাকথিত স্বাধীনতাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। উম্মাহ চেতনা ধারণ না করে অহেতুক স্বাধীনতা ঘোষণাই মূলত পলাশী ট্র্যাজেডির মূল কারণ।
ü কেন্দ্রীয় শাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাধীন নবাবেরা ইংরেজ, ফরাসি, জগতশেঠ, মুশরিক সম্প্রদায় ইত্যাদি গোষ্ঠীদের সাহায্য নিতে থাকে, বিনিময়ে নিজের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করে।
২. রাজনৈতিক পটভূমি:
ü
নবাবের শাসন:
১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন আলিবর্দী খাঁর নাতি এবং তরুণ, উচ্চাভিলাষী
শাসক। তাঁর শাসনকালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অর্থনীতি সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক
অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
ü ইউরোপীয় প্রভাব: এ সময় ব্রিটিশ ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করছিল। ব্রিটিশরা কলকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দননগরে তাদের কুঠি স্থাপন করেছিল।
৩. নবাব ও ব্রিটিশদের
মধ্যে উত্তেজনা:
ü
কলকাতার দুর্গ
নির্মাণ: ব্রিটিশরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে শক্তিশালী করতে শুরু করে, যা নবাবের অনুমতি
ছাড়াই করা হয়েছিল। এটি সিরাজউদ্দৌলার কাছে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি
করে।
ü
বাণিজ্যিক
দ্বন্দ্ব: ব্রিটিশরা নবাবের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ বাণিজ্য করছিল, যা নবাবের রাজস্বের
উপর প্রভাব ফেলছিল।
ü ফরাসিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ইউরোপে চলমান সাত বছরের যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) ভারতে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছিল। সিরাজউদ্দৌলা ফরাসিদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, যা ব্রিটিশদের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল।
৪. কালো কারাগারের ঘটনা:
ü ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দখল করেন। এই সময় "কালো কারাগার" ঘটনা ঘটে, যেখানে ব্রিটিশ বন্দীদের একটি ছোট কারাগারে আটকে রাখা হয়, ফলে অনেকের মৃত্যু হয়। এটি ব্রিটিশদের মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা জাগায়।
৫. ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা:
ü
অভ্যন্তরীণ
দ্বন্দ্ব: সিরাজউদ্দৌলার শাসনের প্রতি বাংলার অভিজাত শ্রেণি, যেমন জগৎ শেঠ, মীর জাফর,
রায় দুর্লভ প্রমুখ অসন্তুষ্ট ছিলেন। নবাবের তরুণ বয়স, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং
কঠোর নীতির কারণে তারা বিরক্ত হন।
ü ব্রিটিশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র: ব্রিটিশরা, বিশেষ করে রবার্ট ক্লাইভ এবং ওয়াটসন, এই অসন্তোষকে কাজে লাগান। তারা মীর জাফরের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন, যিনি নবাবের সেনাপতি ছিলেন। মীর জাফরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করলে তিনি নতুন নবাব হবেন।
৬. যুদ্ধের প্রস্তুতি:
ü
ব্রিটিশ প্রতিশোধ:
কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী
১৭৫৭ সালে বাংলায় ফিরে আসে। তারা চন্দননগরে ফরাসিদের পরাজিত করে এবং পলাশীর যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুতি নেয়।
ü নবাবের বাহিনী: সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল (প্রায় ৫০,০০০), কিন্তু তারা অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দুর্বল ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী ছিল মাত্র ৩,০০০ এর মতো, কিন্তু তারা সুশৃঙ্খল ও কৌশলগতভাবে প্রস্তুত ছিল।
৭. পলাশী যুদ্ধ (২৩
জুন, ১৭৫৭):
ü
যুদ্ধটি মুর্শিদাবাদের
নিকট পলাশী গ্রামে সংঘটিত হয়। মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও অন্যান্য সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার
কারণে নবাবের বাহিনী কার্যকরভাবে যুদ্ধ করতে পারেনি। মীর জাফরের নেতৃত্বাধীন একটি বড়
অংশ যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
ü
ব্রিটিশ বাহিনী
ক্লাইভের কৌশলগত দক্ষতা ও আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই জয়লাভ করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাণী এলিজাবেথের রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে বণিকদের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল এবং এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়, যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই কোম্পানি গঠিত হয় পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলায় বৃটিশদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।
১. প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া:
ü
রাণী এলিজাবেথের
রয়্যাল চার্টার: ৩১ ডিসেম্বর, ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ একটি রয়্যাল
চার্টার জারি করেন। এই চার্টারের মাধ্যমে "The Governor and Company of
Merchants of London Trading into the East Indies" নামে কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে
প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্টারটি কোম্পানিকে ১৫ বছরের জন্য পূর্ব ভারত (ভারতীয় উপমহাদেশ
ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং অন্যান্য অঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে।
ü
প্রাথমিক কাঠামো:
কোম্পানিটি একটি যৌথ-মূলধনী (joint-stock) প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত হয়। লন্ডনের ধনী
বণিক ও অভিজাতরা এতে বিনিয়োগ করেন। একজন গভর্নর এবং ২৪ জন সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ
(Court of Directors) দ্বারা কোম্পানি পরিচালিত হতো।
ü মূলধন সংগ্রহ: প্রাথমিকভাবে ৭২,০০০ পাউন্ড মূলধন সংগ্রহ করা হয়, যা সে সময়ের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছিল। এই অর্থ বাণিজ্যিক অভিযানের জন্য জাহাজ, পণ্য এবং কর্মচারী নিয়োগে ব্যবহৃত হয়।
২. উদ্দেশ্য:
ü
মূলত বাংলা
দখল করা
ü
মশলা (গোলমরিচ,
লবঙ্গ, জায়ফল), রেশম, তুলা, নীল, চা এবং অন্যান্য পণ্য ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য
এশীয় দেশ থেকে আমদানি করা।
ü
ইউরোপীয় বাজারে
এই পণ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন।
ü পর্তুগিজ ও ডাচদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা।
৩. প্রাথমিক কার্যক্রম:
ü
প্রথম অভিযান:
১৬০১ সালে কোম্পানির প্রথম জাহাজ, স্যার জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের নেতৃত্বে, ভারত মহাসাগরের
দিকে যাত্রা করে। তারা ইন্দোনেশিয়ার মশলা দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্য শুরু করে।
ü
বাণিজ্য কেন্দ্র
স্থাপন: ১৬১২ সালে ভারতের সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি (factory) স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে
মাদ্রাজ (১৬৩৯), বোম্বে (১৬৬৮), এবং কলকাতায় (১৬৯০) কুঠি স্থাপিত হয়।
ü মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক: ১৬১৫ সালে স্যার থমাস রো মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে গিয়ে বাণিজ্যের অনুমতি পান, যা কোম্পানির জন্য ভারতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি করে।
৪. বিকাশ ও ক্ষমতার
বিস্তার:
ü
সামরিক শক্তি:
প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও, কোম্পানি ধীরে ধীরে সামরিক শক্তি গড়ে তোলে।
তারা নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ও জাহাজ তৈরি করে এবং দুর্গ নির্মাণ করে।
ü
রাজনৈতিক প্রভাব:
পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)-এর পর কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায়
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভের
মাধ্যমে তারা রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার পায়।
পলাশীর যুদ্ধ
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম বাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেয়। এটি ছিল একটি যুদ্ধ, যা অস্ত্রের শক্তির চেয়েও বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিচে তুলে ধরা হলো:
নবাবের জন্য চ্যালেঞ্জ
১. নবাব পরিবারে একতা
ছিল না। নবাবের নিজ পরিবারের একটি অংশ প্রকাশ্যেই তার বিরোধী ছিলো।
২. ইংরেজরা তাদের ১৫০
দেড় শতাধিক বছরের মিশন বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো।
৩. সিরাজের সেনাবাহিনী
পুরোপুরি তার অনুগত ছিল না
৪. মুশরিক ব্যবসায়ী
গোষ্ঠী ইংরেজদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছে
৫. হিন্দু আমলারাও ইংরেজদের সহায়তা করেছে
যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি
ও সৈন্য সমাবেশ
ü
নবাবের শিবির:
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য (৩৫,০০০ পদাতিক এবং ১৫,০০০ অশ্বারোহী), ৪০টির
বেশি কামান এবং কিছু ফরাসি গোলন্দাজ সৈন্য নিয়ে পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন।
তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর আলী খান। এছাড়া তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে
ছিলেন মীর মদন এবং মোহনলাল।
ü
ব্রিটিশ শিবির:
অন্যদিকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিলেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। তাঁর
সৈন্য সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম—মাত্র ৩,০০০, যার মধ্যে প্রায় ৮০০ ইউরোপীয় এবং
২২০০ দেশীয় সিপাহী ছিল। তাদের সামান্য কয়েকটি কামান ছিল, তবে সেগুলো ছিল বেশ আধুনিক
ও উন্নত।
ü ক্লাইভের মূল শক্তি ছিল তার সামরিক কৌশল এবং নবাবের শিবিরের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস। তিনি আগেই নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফ খানের সাথে এক গোপন চুক্তি করেছিলেন।
যুদ্ধের দিন (২৩শে জুন,
১৭৫৭)
ü
সকালের সূচনা:
যুদ্ধ শুরু হয় সকাল ৮টার দিকে। নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদনের নেতৃত্বে নবাবের বাহিনী ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তাদের তীব্র আক্রমণে ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ক্লাইভ তার সৈন্যদের আমবাগানের আড়ালে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেন। মোহনলালের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যরাও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছিল।
ü
যুদ্ধের মোড়
পরিবর্তনকারী ঘটনা:
দুপুরের দিকে যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলেই ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী প্রাথমিক আক্রমণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু দুটি ঘটনা যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেয়:
১. মীর মদনের মৃত্যু: দুপুর নাগাদ হঠাৎ এক গোলার আঘাতে নবাবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং দক্ষ সেনাপতি মীর মদন নিহত হন। এই ঘটনা নবাবের সৈন্যদের মনোবলে প্রচণ্ড আঘাত হানে এবং তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
২. মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা: সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যুর পর নবাব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং মীরজাফরের পরামর্শ চান। মীরজাফর নবাবকে ধোঁকা দিয়ে দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। তিনি নবাবকে বোঝান যে, সৈন্যরা ক্লান্ত এবং পরদিন সকালে নতুন করে আক্রমণ করা যাবে। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। নবাব তার প্রধান সেনাপতির কথায় বিশ্বাস করে যুদ্ধ থামাতে রাজি হন।
ü
চূড়ান্ত আক্রমণ
ও পরাজয়:
নবাবের আদেশে তাঁর সৈন্যরা যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের শিবিরে ফিরে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লাইভ তার সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিষ্ক্রিয় নবাব বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মীরজাফর, রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের অধীনস্থ নবাবের সেনাবাহিনীর একটি বিশাল অংশ কোনো প্রতিরোধ না করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
কেবলমাত্র মোহনলালের অধীনস্থ ক্ষুদ্র একটি সেনাদল শেষ পর্যন্ত বীরের মতো লড়াই চালিয়ে যায়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার সামনে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। নবাবের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
ü
নবাবের পলায়ন
ও পরিণতি:
বিকেল ৫টার দিকে যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের পরাজয় আসন্ন দেখে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা প্রায় ২,০০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে পালিয়ে যান। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিমের নির্দেশে তাকে ধরা হয় এবং ২রা জুলাই মোহাম্মদী বেগ নামক এক ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পলাশী যুদ্ধের ফলাফল
ü
পরাজয় ও মৃত্যু:
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শোচনীয় পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে।
ü
ক্ষমতা দখল:
চুক্তি অনুযায়ী, রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে বাংলার মসনদে বসান। মীরজাফর "বিশ্বাসঘাতক"
হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেন।
ü
ব্রিটিশ শাসনের
সূচনা: এই যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের রাজনৈতিক
আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা নামে নবাবকে সিংহাসনে বসালেও প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতেই
চলে যায়।
ü
অর্থনৈতিক
শোষণ: ব্রিটিশরা মীরজাফরের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ লাভ করে এবং বাংলায়
অবাধে বাণিজ্যিক শোষণের পথ খুলে যায়, যা পরবর্তীতে "কোম্পানির রাজ" বা ছিয়াত্তরের
মন্বন্তরের মতো ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
ü পলাশীর যুদ্ধকে তাই কেবল একটি যুদ্ধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি ছিল একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, যা ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ওপর ভিত্তি করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত করে দিয়েছিল।
যুদ্ধে জয়ী হওয়ার
পর যা করেছে ইংরেজরা
১. পাপেট নবাব তৈরি
করেছে
২. উচ্চ করআরোপ করে
জাতিকে দারিদ্রতা ও দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি করেছে
৩. সকল কারখানা বন্ধ
করে দিয়েছে
৪. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
বন্ধ করে দিয়েছে
৫. অন্যান্য বিদেশী
ব্যসায়ীদের বাংলা ছাড়া করেছে
৬. ইংরেজরা দীর্ঘমেয়াদে
আমাদের শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
(টেক্সটাইল, জাহাজ,
যুদ্ধাস্ত্র, কৃষি ভিত্তিক শিল্প (শোরা, লবণ, চিনি, চাল))
৭. শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস
(উচ্চশিক্ষা বন্ধ, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, শিক্ষকদের
হত্যা, শ্রমিক ও কৃষিতে বাধ্য করা, লর্ড মেকলের পাশ্চাত্য শিক্ষা, সেক্যুলার শিক্ষা,
আলিয়া, দেওবন্দ)
৮. সকল কৃষি ও বস্ত্র ব্যবসাতে আধিপত্য তৈরি করেছে
পলাশী ট্র্যাজেডির
কারণ
১. উম্মাহ চেতনা বাদ
দিয়ে স্বাধীনতার অহেতুক নেশা
২. মুশরিকদের রাষ্ট্র
পরিচালনায় একীভূত করা
৩. বিদেশীদের অনুপ্রবেশ
করানো
৪. ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম
৫. সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন
এখানে যেই আদর্শের কারণে র্ধমনিরপেক্ষতাবাদের সাথে আপনারা একমত হতে পারেননি বাংলার স্বাধীনতা যুদ্বের সাথে সহমত পোষন করতে পারেননি সেখানে কিভাবে গনতান্ত্রিক মতবাদকে গ্রহন করলেন। আদর্শিক দিক দিয়ে কি গণতন্ত্র আপনাদের সাথে যায়।??
উত্তরমুছুন