১৬ ফেব, ২০১৭

মিথ্যেবাদী বাবা

১। 
রাত দেড়টা। এপাশ ওপাশ করছেন আজমল সাহেব। চোখের দুই পাতা এক করতে পারছেন না। ঘুম তো দূরের কথা মাঝে মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। জেলখানায় এই বিষয়টা খুব সাধারণ হলেও আজমল সাহেবের জন্য মোটেই সাধারণ কোন ঘটনা নয়। খুব শক্ত মানসিকতার মানুষ তিনি। যখনই জেলখানায় কেউ ভেঙ্গে পড়ে তখন তিনি সান্ত্বনার হাত দিয়ে তাকে আগলে রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার বহু ছাত্র আটক হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে তারা যখনই তাদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ওনার কাছে আসতেন তখন আজমল সাহেবের দরদ মাখা হাত বুলানো আর উদ্দিপনামূলক বক্তব্য তাদের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। সেই আজমল সাহেব কান্না করছেন বিষয়টা সহজ কিছু নয়। 

অনেকক্ষণ ধরেই বিষয়টা লক্ষ্য করছে শাহেদ। সে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে আজমল সাহেবের কাছে আসলো। জেলখানায় রাতে জেগে থাকাটা অপরাধ। দশটায় সবাইকে ঘুমাতে হবে এটা বাধ্যতামূলক। ঘুম না এলেও শুয়ে থাকতে হয়। শাহেদ ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ। রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়া এখনকার ছাত্রদের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তাদের কত কাজ(!)। ফেসবুকিং, ব্লগিং, আড্ডা, গুল্প-গুজব ইত্যাদি করতে করতে কমসে কম দু’টা তো বাজেই। তাই শাহেদদের মত তরুণরা জেলখানার এই নিয়ম মেনে নিতে পারে না। দশটায় শুয়ে পড়লেও কিছুক্ষণ পর উঠে তারা গল্প-গুজবে মাতে। এর মধ্যে কারারক্ষীর হাতে ধরা পড়েছে বার পাঁচেক। জরিমানা গুনতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে রাত জাগা থেকে সে বিরত থাকতে পারেনি। অভ্যাস বলে কথা। অভ্যাসের দাম কোটি টাকা। 

তার বন্ধু সমাজ ইদানিং জেগে থাকার শক্তি পায় না। জেলখানার পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে সবাই নিজেদেরকে তাল মিলিয়ে নিচ্ছে। সেদিনও পঞ্চাশজনের পুরো ওয়ার্ডে সে আর আজমল সাহেব জেগে আছে। আজমল সাহেব কাঁদছেন আর সে বই পড়ছে। এই ওয়ার্ডের সবাই আজমল সাহেবের ভক্ত। এমনকি বিড়ালটা পর্যন্ত। আজমল সাহেবের বিষয়টা প্রথমে শাহেদ টের না পেলেও টের পায় বিড়ালটি। সেই ইশারা করে শাহেদকে দেখায় আজমল সাহেব কাঁদছে। বিড়ালটা শাহেদের খুব প্রিয়। নাদুস নুদুস সাদা বিড়াল। জেলখানায় মানুষগুলো লিকলিকে থাকলেও বিড়ালগুলো থাকে হৃষ্টপুষ্ট। মানুষের জন্য দেয়া খাদ্য নামের অখাদ্যগুলো বিড়ালদের জন্য অমৃত। 

আলতো করে একটি হাত রাখে শাহেদ আজমল সাহেবের কপালে। চমকে উঠে তাকায় আজমল সাহেব। এবার তাকে দেখে চমকে উঠে শাহেদ। চোখ দু’টি ভয়ানক ফোলা, রক্তাভ। স্যার কি হয়েছে আপনার? কিছু না বলে সামলানোর চেষ্টা করেন তিনি। উঠে বসলেন। হঠাত শাহেদকে জড়িয়ে ধরেন। কান্নার চাপে কেঁপে কেঁপে উঠছেন তিনি। শাহেদ প্রাণপণে চেপে ধরে রাখছে। জেলখানায় দুটো জিনিস সংক্রামক একটি হল চুলকানি অন্যটি কান্না। প্রত্যেকের হৃদয়ে থাকা দুঃখ আরেকজনের কান্না দেখলেই উথলে উঠে। শাহেদ নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চেপে রাখা কান্না যখন একবার তার বাঁধ ভেঙ্গে ফেলে তখন নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। এর মধ্যেই শাহেদ আবিষ্কার করে আজমল সাহেব হাতে চেপে আছে একটি কাগজ। 

পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়ে শাহেদ আজমল সাহেবের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নেয়। মেলে ধরে চোখের সামনে। ছোট কোন মানুষের হাতের লিখা। গোট গোট করে তাতে শিরোনাম দেয়া আমার প্রিয় মানুষ।
২। 
কলেজে তার চেয়ারে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছেন আজমল সাহেব। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে এবার বাসায় যাওয়ার পালা। হঠাত তিনটি পুলিশের গাড়ি বেশ সাড়াশব্দ করে ঢুকে পড়ে কলেজে। ঘিরে ফেলে আজমল সাহেবের কক্ষ। প্রায় উড়ে এসে তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে তার কক্ষেই শুইয়ে ফেলে। পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। মনে হচ্ছে যেন বিশাল কোন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে তারা ঘায়েল করেছে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো গাড়ির কাছে। ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলছে এমন সময় পুলিশের তিনটি গাড়ি ঘিরে ফেলে ছাত্র আর শিক্ষকরা। কলেজের পাশের মসজিদের বৃদ্ধ মুয়াজ্জিন দৌড়ে মসজিদে গিয়ে মাইকে বলতে থাকে ‘এলাকাবাসী বাইর হই আইয়্যেন, বাইর হই আইয়্যেন, হারামজাদারা আঙ্গো আজমল স্যাররে লই যার। ব্যাকে বাইর হই আইয়্যেন। 

ব্যাস! আর যায় কোথায়। মুহুর্তেই মফস্বল শহরের হাজারখানেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। পুলিশ বিপদ বুঝেই আজমল সাহেবের বাঁধন খুলে দেয়। বিচক্ষন আজমল সাহেব বুঝতে পারেন আজ যদি তাকে পুলিশ না নিয়ে যেতে পারে তবে বিপদ শুধু তার একার হবে না, পুরো এলাকাবাসী বিপদে পড়বে। তাই তিনি নিজেই পুলিশের ভ্যনে উঠে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিলেন। সবাই শান্ত থাকতে বললেন। আর বললেন আমার ছাত্ররা যে সত্যকে বুকে ধারণ করে জেলে যাচ্ছে সে সত্যের শিক্ষক হয়ে আমি কেন তাদের পাশে থাকবো না। আমি যাচ্ছি পুলিশের সাথে, তাদের সাথে আমার আলাপ আছে। ততক্ষনে পুলিশ অফিসার জনতাকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো, আপনারা যার যার যায়গায় ফিরে যান। আমরা স্যারের সাথে কিছু জরুরী কথা বলে স্যারকে আবার বাসায় পৌঁছে দেব। 

থানায় এসে আজমল সাহেব তার অপরাধ বুঝতে পারলেন। তার ছাত্রদের কাবু করার জন্য তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। রফিক আজমল সাহেবের প্রিয় ছাত্র। সে সংগ্রাম পরিষদের নেতা। দিন পনের আগে তাকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ রীতিমত অস্বীকার করে আসছে তারা রফিককে গ্রেফতার করে নি। তাকে দেখে চমকে উঠে আজমল সাহেব। পিটিয়ে কিছু রাখে নি। তবুও তার থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ চায় সে একটা ঘোষনা দিক যেখানে বলা থাকবে সংগ্রাম পরিষদ সব কার্যক্রম বন্ধ করছে সেই সাথে তারা আন্দোলন করে অন্যায় করেছে এমন একটি স্বীকারোক্তি থাকবে। আরো স্বীকারোক্তি তারা চায় এখন থেকে রফিক সরকারের সাথে কাজ করবে। এমন ঘোষণা দিলে তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে। সেই সাথে তাকে দেয়া হবে গাড়ি বাড়ি ইত্যাদি। রফিকের এক কথা, কোন মিথ্যে কথা আমার থেকে বলিয়ে নিতে পারবে না। কখনো না... 

রফিকের আঙ্গুলগুলো যখন থেতলে দেয়া হচ্ছিল, রফিক তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোন শব্দ করেনি। সব সহ্য করেছে। পরদিন তাকে থানা থেকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হলে একদিন তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। এরপর আবার শুরু হয় কথা আদায়। স্বীকারোক্তি আদায়। নির্যাতনের নতুন সব কলাকৌশল। কোন কিছুই নমনীয় করতে পারেনি রফিককে। এভাবে চলছে পনের দিন। এরপর তারা বুঝতে পারে তার শিক্ষক আজমল সাহেব থেকেই সবসময় সে বুদ্ধিপরামর্শ নেয়। আজমল স্যারকে সে ভালবাসে। আজমল সাহেবকে তারা রফিকের সাথে দর কষাকষির বস্তু বানাতে চায়। কথাবার্তা ছাড়া হঠাত মারতে থাকে আজমল সাহেবকে রফিকের সামনে। বহু নির্যাতনের ধকলে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়া রফিকের কোন বিষয়েই চাঞ্চল্য ছিল না। আজমল সাহেবের উপর নির্যাতনে সে চিৎকার করে উঠে। থাম! থাম!! তোরা সব থাম! তোদের যা ইচ্ছা লিখে দে আমি বলবো। সাবধান আমার স্যারের গায়ে হাত তুলবি না। 

আকস্মিক আক্রমনে হতচকিত আজমল সাহেব রফিকের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেলেন। মলিন অথচ আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে রফিককে শান্ত স্বরে বললেন “যে সত্যের দীক্ষা তুমি আমার কাছ থেকে পেয়েছ সেই শিক্ষার মর্মান্তিক মৃত্যু তুমি আমার সামনে ঘটাতে পারো না”। কপাল কেটে বেয়ে পড়া নোনা রক্ত শার্টের হাতা দিয়ে যেই মুছতে গেলেন তখনি হাত বাড়িয়ে দুই পা এগিয়ে গেল রফিক। আজমল স্যারের কপাল থেকে রক্ত নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে বললো শপথ করলাম স্যার, কোনদিন মিথ্যার সাথে আপোষ করবো না। কোনদিন না। আবার শুরু হল বেদম মার। দুইজনেই বেহুঁশ হয়ে পড়লো। 

জ্ঞান ফেরার পর থেকে আজমল সাহেব আর রফিককে দেখতে পাননি। বার বার জিজ্ঞাসা করেও কারো থেকে উত্তর পাননি। বাইরের লোকেরা এখনো জানে রফিক হারিয়ে গেছে। পুলিশের বরাবরের মত গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে যাচ্ছে। তিনদিন পর আজমল সাহেবকে কোর্টে তোলা হল। জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হল। কোর্টে তার নিকট আত্মীয়-স্বজনরা প্রায় সবাই এসেছে। শুধু আসেনি তার ছয় বছরের মেয়ে লুবনা। ধুলামলিন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত আজমল সাহেবকে দেখে সবাই কান্না-কাটি শুরু করলো। আজমল সাহেব স্ত্রীকে বললেন তার গ্রেপ্তারের কথা যাতে লুবনাকে বলা না হয় কারণ এতে তার ভয়ংকর মানসিক চাপ হতে পারে। তাই তিনি কিছু একটা বলে চালিয়ে নিতে বললেন। আরো বললেন বলবে আমার বাহিরে কাজ পড়েছে। নতুন অফিস হয়েছে। অফিসে অনেক কাজ তাই বাসায় যাওয়া হয় না। কয়েকদিন পর আমার সাথে দেখা করতে নিয়ে আসবে। সবাইকে সান্তনা দিয়ে তিনি কারাগারে চলে গেলেন। 

কারাগারে যাওয়ার তৃতীয়দিনেই পেলেন দুঃসংবাদটি। সেই গথবাঁধা গল্প। রাতের বেলা মটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছে রফিক। পুলিশ তাকে চেক করার জন্য থামতে বলে। সে তো থামেই নি বরং গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে পুলিশের দিকে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করে। গুলিতে নিহত হয় রফিক। সব পত্রিকা পুলিশের সাজানো এমন গল্পই ছাপে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আজমল সাহেব। সেই সাথে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রুজল। স্বগতোক্তির মত বলতে থাকেন হাসবুন আল্লাহ ওয়া নে’মাল ওয়াক্বীল নে’মাল মাওলা নে’মান নাসির। 

৩। 
বাংলা ক্লাস চলছে। আয়েশা করিম ক্লাসে সবাইকে রচনা লিখতে বলেছেন। রচনার নাম “আমার প্রিয় মানুষ” সবাই লিখছে, সেই সাথে লিখছে লুবনাও। ছোট ছোট মানুষগুলো লিখছে তাদের প্রিয় মানুষের কথা। লুবনা লিখছে তার বাবাকে নিয়ে। ছোট ছোট হাতে গোট গোট অক্ষরে লিখছে। সবাই একের পর এক তাদের লিখা জমা দিচ্ছে। আয়েশা করিম দেখলেন লুবনা তার খাতার উপর মাথা নামিয়ে দিয়ে আছে। তিনি ডাক দিলেন, লুবনা কি করছো তুমি? তোমার কি লিখা শেষ হয়েছে? ডাক শুনে লুবনা মাথা তুলতেই আয়েশা ম্যাম বুঝতে পারলেন এতক্ষন কাঁদছিল লুবনা। মামণি কি হয়েছে তোমার? একথা বলে তিনি দৌড়ে আসলেন। তাকে জড়িয়ে ধরলেন আর তার লিখা পড়তে লাগলেন। 

আমার প্রিয় মানুষ আমার আব্বু। আব্বু আমাকে গল্প শোনায়। আব্বু আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। আব্বু একটুও বকা দেয় না। আব্বু আমাকে খাইয়ে দেয়। রাতে আমি যখন শুয়ে পড়ি তখন আব্বু আমার কপালে চুমু দেয়। সে আমাকে স্কুলে নিয়ে আসে। আম্মু যখন আমাকে বকা দেয় তখন আব্বু আমাকে আদর করে। একবার আব্বুর সাথে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। অনেকক্ষণ ভিজেছি। পরে আমার জ্বর হয়। আব্বু সারারাত আমার পাশে বসে কাঁদছিল। আম্মু সেদিন আব্বুকে অনেক বকেছে। আসলে আব্বুর দোষ ছিল না। আমিই আব্বুকে বার বার বলে বিরক্ত করে ভিজেছি। 

আব্বু সবসময় বলতেন কাউকে কষ্ট না দিতে। দুঃখীকে সাহায্য করতে। বড়দের সম্মান করতে। ছোটদের আদর করতে। আব্বু সবসময় মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করতো। আর এখন আব্বু সমানে মিথ্যা কথা বলে। আব্বু বলেছিল নতুন অফিস থেকে এক সপ্তাহ পরে বাসায় আসবে। আসেনি। সে আমাকে এখন স্কুলে নিয়ে আসে না। আমি আর আম্মু যখন নতুন অফিসে দেখা গিয়েছি তখন আব্বু বলেছিল আমার ফার্স্ট টার্মের আগেই সে বাসায় আসবে। এখন ফাইনাল টার্ম চলে আসছে এখনো সে আসেনি। আমাকে সে সবসময় বলে অল্প কিছুদিন পরে সে বাসায় আসবে। কিন্তু সে আসেনা। সে বলেছে রোজার আগে আসবে। আসেনি। গতমাসে বলেছে ঈদের আগে আসবে। আমার মনে হয়েছে সে আসবে না। সত্যিই সে আসেনি। ঈদের দিন শুধু আমাকে নতুন অফিসে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আমিও কেঁদেছি। 

আব্বু মিথ্যা বলেছে। আসলে ওটা আব্বুর অফিস নয়। ওটা জেলখানা। আমাকে সামিহা বলেছে। ওখানে খারাপ মানুষ থাকে। আব্বু এখন মিথ্যাবাদী। আমি আর এখন আব্বুকে ভালবাসি না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন