৩০ মার্চ, ২০১৭

সোনালী সূর্যোদয়


১। 
তাহমিদ। খুব ভালো একজন কণ্ঠশিল্পী। একটু পরেই তার স্টেজ পারফর্মেন্স। আজ কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তার নেতৃত্বে কয়েকটি দলবদ্ধ গান গাওয়া হবে। এছাড়া তার একক পরিবেশনাও আছে। সব মিলিয়ে আজ সে খুব ব্যস্ত। ইতোমধ্যে সবাইকে নিয়ে কয়েকবার রিহার্সেল হয়ে গেছে। তারপরও তার একটু নার্ভাস লাগছে। নিজের জন্য আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই তার। কিন্তু সমবেত গানের অন্যরা কেউ নিয়মিত শিল্পী বা গায়ক না। বছরে দু’একটা অনুষ্ঠানে গান গায় সখের বশে এমন। তাহমিদের গান শেখা ও গাওয়ার নিয়মিত চর্চা কলেজে হয় না। সে কলেজের বাইরে একটা সংগীত দলে গান গায়। ঐ দলের সবাইকে নিয়ে গাইলে আজ এ টেনশন থাকতো না। তারা সবাই নিয়মিত গান করে। কিন্তু কলেজে যাদের নিয়ে গান গাইবে তারা নিয়মিত না হওয়ায় এটা সেটা ভুল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তাই সে চিন্তায় ঘামতে শুরু করেছে। বার বার সবাইকে নির্দেশনা দিচ্ছে যাতে ভুল না হয়। যত বেশি সম্ভব রিহার্সেল করে ভুল টুল কমানো দরকার।

এমন সময় একটা ফোন আসলো। আজ বিকেলে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল হবে। তার বন্ধু আজমল জানিয়েছে। আরো জানিয়েছে আজকে গণ্ডগোল হওয়ার বেশ সম্ভাবনা আছে। তাহমিদের অবশ্য মিছিলে যাওয়া বারণ। ওদের সবার নেতা শফিক ভাই সবসময় বলেন আন্দোলনের প্রতিটি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ। যারা যে বিষয়ে দক্ষ তারা সে বিষয়ে কাজ করবে। তাই সংগীত শিল্পীরা গান রচনা করবে, গান করবে, অন্দোলনের কর্মীদের উৎসাহ দেবে। তাদের মিছিলে যাওয়ার দরকার নেই। তাই সাধারণত তাহমিদ এবং তার মতো অন্য যারা গান অথবা অভিনয়ে দক্ষ তারা মিছিলে যাওয়ার তেমন একটা সুযোগ পায় না। কিন্তু সে যখনই মিছিলের খবর পায় তখনই তার মনের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়। তার মনে হয় মিছিলের স্লোগানই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কবিতা, মিছিলের স্লোগানের মতো রক্তে আলোড়ন তোলা গান আর কি আছে! আর সে মিছিল যদি হয় প্রতিবাদী মিছিল, সে মিছিল যদি হয় দেশ রক্ষার মিছিল তবে তো কথাই নেই। 

ফোনে খবরটা পাওয়ার পর থেকে তাহমিদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ সে মিছিলে যাবেই। কলেজের অনুষ্ঠানে আর সে মনযোগী হতে পারে না। তার চিন্তা জুড়ে কেবলই বিকেলের মিছিল। অনুষ্ঠান নিয়ে আগের সে টেনশন আর থাকেনা। মোটামুটি ভালোভাবে অনুষ্ঠানের সব কিছু শেষ হয়ে যায়। তার গানের দলের পারফর্মেন্সও খারাপ হয়নি। তবে তার মাথায় ঘুরছে বিকেলে কথা। কোন রকমে অনুষ্ঠান শেষ করেই সে বাসায় ফিরে যায়। খাওয়া দাওয়া করে মিছিলের প্রস্তুতি নেয়। একটা পতাকা সবসময় সে সাথে রাখে। মিছিলে গেলেই সেটা মাথায় বেঁধে বের হয়। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মিছিল শুরু হওয়ার কিছুটা আগেই সে সভার জায়গাতে হাজির হয়ে যায়। 

নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার। রক্তে আলোড়ন তোলা সে চিরপরিচিত শ্লোগানে শুরু হয় মিছিল। তাকবীর দেয়ার সাথে সাথেই ভীমরুলের মত হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-শ্রমিক মিছিলে শরিক হয়। জনা বিশেক পুলিশ অস্ত্র হাতে আগে থেকেই সেখানে প্রস্তুত ছিল। তারা ভাবতে পারেনি এত মানুষ হবে। যখন মিছিল শুরু হয় তখন তারা অস্ত্র বাগিয়ে তেড়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু যখনই চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে থাকে তখন মানুষের ঢল দেখে তারা পিছিয়ে যায়। মিছিল থেকে দুই তিনজন নেতা এগিয়ে গিয়ে পুলিশদের বলে তারা শুধু শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে চায়। কোন ধরণের সহিংসতা কিংবা গোলমালের কোন চিন্তা তাদের নেই। মিছিল করা প্রতিবাদ করা নিশ্চয় আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এসব শুনে পুলিশ দলের অফিসাররা চুপ করে থাকে। তারা কোন উত্তর দেয় না।

ফ্যাসিবাদের লাঠিয়াল পুলিশরা অবস্থা বেগতিক দেখে সাময়িক চুপ করে থাকলেও আসলে তারা ওয়ারলেসে আশেপাশের থানাগুলো থেকে জরুরী অতিরিক্ত পুলিশ এবং রিজার্ভ ফোর্স কল করে। মিছিল শুরু হওয়ার দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই চারপাশ থেকে পঙ্গপালের মতো বিপুল সংখ্যক পুলিশ এসে সবাইকে ঘিরে ফেলে। 

ছাত্রনেতারা মাইকে আহবান করেন পুলিশদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে সরে দাঁড়াতে। কিন্তু উত্তরে পুলিশরা আচমকা টিয়ারশেল এবং গুলির বন্যা বইয়ে দেয়। হাজার হাজার মানুষ আটকে পড়ে রাস্তায়। পুলিশ নিরস্ত্র মানুষের প্রতিবাদে আগ্রাসী ভূমিকায় হামলে পড়ে। প্রথমে একটু হতচকিত এবং ছত্রভঙ্গ হলেও তাহমিদরা অল্পসময়ের মধ্যেই ইটপাটকেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে করেই হোক ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে। যেদিকে পুলিশের অবস্থান দূর্বল সেদিকে তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে হবে। পুলিশের গুলিতে একের পর এক প্রতিবাদকারী গুলি খেয়ে আহত হচ্ছে। এরই মাঝে তাহমিদরা একটি পথে পুলিশকে পিছু হটতে বাধ্য করে।

এর মধ্যে হঠাৎ করেই বুকটা যেন একটু চিনচিন করে উঠে তাহমিদের। তার মনে হয় এক সাগর পিপাসা লেগেছে। সে পাশের একটি টং দোকানে পানি খাওয়ার জন্য যায়। টং দোকানদার বহু আগেই দোকান ছেড়ে পালিয়েছে। বোতল মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে পানি ঢালতেই একটু শান্তি লাগলো। কিন্তু তৃষ্ণা কমছেই না। এসময় হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতেই চমকে উঠে তাহমিদ। রক্তে ভেসে গেছে বুক। শার্টের নিচে হাত চালান করে বুঝতে পারলো বুকে কয়েকটা গুলি লেগেছে। শর্টগানের গুলি। কখন যে গুলি লেগেছে টেরই পায়নি সে। বুক চেপে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে সে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ। আশেপাশে সাহায্যের আশায় তাকায়। সহকর্মীরা সবাই ইট-পাটকেল নিয়ে পুলিশের আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত। কাউকে বিরক্ত না করে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছে। সব রাস্তা বন্ধ। কোথাও গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। তবে সবার আগে এখান থেকে বেরুতে হবে। কিন্তু বেরুনোর কোন উপায় দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটা বস্তিতে ঢুকে পড়ে সে। একটু সাহায্যের আশায় সে একের পর এক দরজায় নক করতে থাকে। প্রতিটি দরজা তার অবস্থা দেখেই তার মুখের উপর বন্ধ হয়ে যায়।

২।
জামিল। তাহমিদ যে গানের দলে গান শিখে সে দলের পরিচালক। ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে অলসভাবে টিভি দেখছিল। হঠাত টিভির স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ লিখা উঠছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। বহু হতাহত। জামিল তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। তাহমিদ তার অচেনা নয়। তার দলের মধ্যে একমাত্র তাহমিদই সবসময় একটু বেশি বেয়াড়া ধরণের। সে সাধারণত এই ধরনের মিছিলে না গিয়ে থাকে না। ফোন তুলে নিয়ে জামিল ডায়াল করে তাহমিদের নাম্বারে। কল যায়। কিন্তু রিসিভ করার কেউ নাই। বার বার সে ফোন করতেই থাকে। তাহমিদের বন্ধু আজমলকেও চিনে জামিল। তাকেও ফোন দিল। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার...। চতুর্থবারে ফোন রিসিভ করে আজমল। প্রচুর শব্দ, চিৎকার। জামিল বুঝতে পারে সে ঘটনাস্থলেই আছে। 

আজমলের সাথে কথা বলে জামিল জানতে পারলো তাহমিদও ওখানে ছিলো। তবে তাকে এখন আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। ওরা একসাথে মিছিলে গিয়েছিল কিন্তু সংঘর্ষ শুরু হওয়ার একটু পর সে হারিয়ে গেছে। একে একে অনেককেই ফোন করে জামিল। না, কোথাও তাহমিদের হদিস নেই। এবার সে ফোন দেয় সাদমানকে। সাদমানও তাদের দলের ছেলে। সে অভিনয় শিল্পী। তাহমিদের সাথে তার বেশ ভাব। জামিল সাদমানকে বাসা থেকে বের হতে বলে। ওরা তাহমিদকে খুঁজে বের করবে। অজানা আশংকায় সবারই বুক কাঁপছে। 

জামিল আর সাদমান প্রথমে তাহমিদের বাসায় এল। সব খুলে বললো। তাহমিদের বাসায় জানেনা সে কোথায় গিয়েছে। কান্নার রোল পড়ে যায় তাহমিদের বাসায়। ওর মা ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে ওনাকে আটকানো হল। ওরা তাহমিদের বাসায় থাকতেই আজমল ফোন দেয়। ততক্ষণে সে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পেরেছে। জামিল ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করে, না জানি কি খবর দেয় আজমল। কিন্তু কিছুই জানাতে পারেনা সে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। অনেককে ফোন দিয়েছে। কোথাও তার খোঁজ জানা যায় নি। 

জামিল আর সাদমান তাহমিদদের বাসা থেকে বের হলো। হাসপাতালে গেল। অনেক খুঁজলো। না, কোথাও নেই। যারা এরেস্ট হয়েছে তাদের নাম সংগ্রহ করলো আজমল। সেখানেও নাম নেই তাহমিদের। তাহলে তাহমিদ কোথায়? চারদিকে অনেকেই বের হয়েছে তাহমিদকে খোঁজার জন্য। এরমধ্যে পুলিশের টহলতো আছেই। যারা পরিচিত আন্দোলনকারী তারা পুলিশের তৎপরতার কারণে রাস্তায় বের হতে পারছে না। যাদের সে সমস্যা নেই তারা বের হয়েছে তাহমিদকে খুঁজতে। প্রায় বিশজন লোক এখন তাহমিদকে খুঁজছে। 

এ সময় হঠাৎ কল আসলো জামিলের মোবাইল ফোনে। অপরিচিত নাম্বার।ফোন রিসিভ করতেই তাহমিদের কণ্ঠ। বড় দুর্বল সে কণ্ঠ। জানালো তার আহত হওয়ার কথা, একটা ঠিকানা দিল। কলটা কেটে গেল। জামিল চিৎকার করে উঠলো। তাহমিদ, তাহমিদের ফোন। বলেই আবার কল দিল সেই নাম্বারে। এবার শোনা গেল একটা পুরুষ কণ্ঠ। তার থেকেই জানা গেল তাহমিদ গুলিবিদ্ধ। যে সে জায়গায় নয়, একেবারে বুকে গুলি লেগেছে। ঠিকানা আরেকটু বিস্তারিত জানালো লোকটা। সব শুনে বিষাদগ্রস্থ হয়ে গেল জামিলের মুখ। একটা সিএনজিতে করে রওনা হলো তারা। কথা নাই দুজনের। কেবল বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া কষ্টগুলো জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে চারটি চোখ জুড়ে। এক পর্যায়ে জামিল সাদমানের পিঠে হাত রেখে শক্ত হতে বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু শক্ত হতে কি বলবে! নিজেরইতো গলা কাঁপছে। 

৩।
আশ্রয়ের জন্য একের পর এক দুয়ারে করাঘাত করে যাচ্ছে তাহমিদ। না, আজ তার কোন আশ্রয় নেই। এমন রক্তাক্ত কাউকে বাড়িতে জায়গা দিয়ে কেউ স্বৈরাচারী পুলিশের শত্রু হতে চায় না। বস্তির গরীব মানুষ তারা, পুলিশের অত্যাচার সামলাতে পারবে না। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে তাহমিদ। চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করেছে। পা দুটো টলছে। আশ্রয় তাকে পেতে হবেই। অবশেষে একটা দরজা খুলে গেল। ছেলে হারানো এক মা। বহুক্ষন ধরেই তাহমিদের ছোটাছুটি দেখছেন। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে দরজা খুললেন। তাহমিদকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। একটু দুধ গরম করে খেতে দিলেন। তাহমিদ খেতে চাইলো না। কিন্তু তিনি জোর করে খাইয়ে দিলেন।

এর মধ্যে সমস্যা হয়ে দেখা দিল মমতাময়ী সে মহিলার স্বামী। তিনি আসন্ন বিপদের কথা ভেবে বার বার বলছেন ছেলেটিকে যাতে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু মহিলা বার বার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছেন, এতটুকু ছেলের গুলি লেগেছে। পুলিশ গুলি করেছে, এখন সে কই যাবে? উত্তরে তিনি বললেন, যে ছেলের জন্য মায়া দেখাচ্ছ সে ছেলের জন্যই আমাদের সবাইকে জেলে যেতে হবে। সে এখানে থাকলে পুলিশ ওর সাথে আমাদেরও জেলে নিয়ে যাবে। আর সে গুলি খেয়েছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারে। তখন একে খুন করার দায়ে পুলিশ আমাদের নিয়ে যাবে। ফাঁসীতে ঝুলাবে। এসব শুনে কিছুটা দমে গেলেন মহিলা। 

তাহমিদও ভাসাভাসা শুনতে পাচ্ছিলো তাদের কথাবার্তা। একটু পর সে নিজেই চলে যাবার জন্য উঠে বসতে চেষ্টা করে। উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার অবস্থা খুব খারাপ। শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দ্রুত। কথা বলতে গিয়ে দেখে কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শব্দ কমে নির্জীব হয়ে এসেছে কণ্ঠ। আস্তে আস্তে কথা বলতে হচ্ছে। তবু্ও সে এসময় উঠে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে। ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে এমন সময় সে মহিলা তার রক্তমাখা শার্ট বদলিয়ে তাকে আরেকটি শার্ট পরিয়ে দেন। তারপর একটা কাঁথা জড়িয়ে দেন তার গায়ে। 

টলতে টলতে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। এখন তার অবস্থা ভীষণ খারাপ। আগে তো সে বিভিন্ন দরজায় নক করেছিলো, এখন নক করার মতো শক্তিও আর নেই তার। টলতে টলতে একসময় সে একটা ঘরের সামনে লুটিয়ে পড়ে। ওর লুটিয়ে পড়া দেখে সে ঘরের সবাই বের হয়ে এলো। ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল ঘরে। পানি খেতে দিল। ঘরের কর্তা তাহমিদকে জিজ্ঞাসা করলো ওর ফোন কই। তাহমিদ কাঁপা হাতে পকেটে হাত দিয়ে দেখে ফোন নেই। তখন তারা তাহমিদকে অভিভাবক কারো মোবাইল নাম্বার জিজ্ঞাসা করলো। তাহমিদ এক ঝলক চিন্তা করে জামিলের নাম্বারই দিল। জামিলকে তাহমিদ নিজের অভিভাবকই মনে করে। জামিলকে ফোন দিয়েই উপস্থিত সবাই তাহমিদের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এদিকে তাহমিদ ক্রমেই তার কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। চোখ খুলে রাখাও তার জন্য কষ্ট হয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে সে কেবলই আল্লাহকে ডাকছে। এতটাই কাঁপছে যে তার মনে হচ্ছে সে বিছানা থেকে পড়ে যাবে। এমন সময়ে কেউ একজন তার হাত শক্ত করে ধরলো। তার মনে হলো পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় কেউ যেন তার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করছে। সেও শক্ত করে সেই হাতটি চেপে ধরলো। চোখ খুললো তাহমিদ। অন্য কারো হাত নয়। তার অভিভাবক জামিলেরই হাত। ডুকরে কেঁদে উঠলো তাহমিদ। 

৪।
দেরী করেনি জামিল। পাঁজাকোলে করে তাকে সিএনজিতে তুললো। সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রওনা হয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। একের পর এক পুলিশের চেক এড়িয়ে যাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। এর মধ্যে একটা চেকপোস্টে গাড়ি থামাতে হলো। জিজ্ঞাসা করলো পুলিশ, কই যাও? হাসপাতালে। আমার ছোট ভাই। খুব জ্বর। আচ্ছা। ছেড়ে দিল পুলিশ। আবার চলতে শুরু করলো। হাসপাতাল আর মাত্র একশ গজ দূরে। আবারো চেকের সম্মুখীন। কি হয়েছে এর? দুদিন ধরে জ্বর, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ ভালো করে দেখলো। তাহমিদের রক্ত কিছুটা কাঁথার উপরে উঠে এসেছে। রক্ত দেখেই পুলিশের সন্দেহ হয়। কাঁথা সরাতে বলে। জামিল বিপদ বুঝতে পেরে কৌশল করে একটু খুললো। দুজন পুলিশ কাঁথা টানটানি করে সরিয়ে ফেললো। রক্তাক্ত তাহমিদকে দেখে তারা বুকে হাত দেয়। বুঝতে দেরী হয় না পুলিশের। এরা প্রতিবাদকারী ছাত্র। 

সিএনজি ড্রাইভারকে থানার দিকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। জামিল মিনতি করতে থাকে। বার বার বলে, অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর। এখনই চিকিৎসা করাতে হবে। নইলে মারা যাবে। প্লিজ আমাদের এরেস্ট করেন। যা ইচ্ছা তাই করেন। শুধু এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। একজন পুলিশ সিএনজিতে উঠলো। আর অন্যরা গাড়ি নিয়ে সিএনজির পেছনে আসতে শুরু করলো। জামিল-সাদমানের আর্তনাদ, কাকুতি-মিনতি কোন কিছুকেই পাত্তা দিল না তারা। চলছে গাড়ি থানার দিকে। 

থানায় জামিল আর সাদমানকে নামানো হল। পরে তাহমিদকেও নামানো হল। তারা সেকেন্ড অফিসারের রুমে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাত তিনজন এসে শুরু করলো লাঠি দিয়ে বেদম মার। মারের চোটে তিনজনই পড়ে গেল। জামিল চিৎকার করতে লাগলো ওকে মারবেন না, ও গুলিবিদ্ধ। কে শুনে কার কথা। জামিল প্রথমে তাহমিদকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তাকে আড়াল করে তার মারগুলো নিজের পিঠে নিয়েছে। কিন্তু তা অল্প কতক্ষন। পুলিশের হিংস্রতায় সে নিজেই দিশেহারা। লুটিয়ে পড়েছে এক পাশে। একের পর এক লাঠি ভাংছে। আবার নতুন লাঠি এনে মারা হচ্ছে তিনজনকে। রক্তাক্ত হয়ে পড়েছে সবাই। এভাবে চললো আধঘন্টা। একে একে সব পুলিশ ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তারা একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। সাদমান এই ফাঁকে একটু মাথা উঁচু করে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ চোখ উলটে পড়ে আছে। জামিল ভাই, তাহমিদ আর নেই বলে আর্তনাদ করে উঠলো। জামিলও উঠে এল। সাদমান চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। জামিল নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো এখনো প্রাণ আছে। এবার সে পুলিশদের পায়ে ধরে মিনতি করতে লাগলো ওকে যাতে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে নিষ্ঠুর লোকগুলোর মন একটু গলে। তারা তাহমিদকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সাদমান-জামিল পরষ্পরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তারা নিশ্চিত তারা হারাতে যাচ্ছে তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুকে। 
রাতে সাদমান-জামিলের উপর নেমে আসলো আগের চেয়েও ভয়াবহ নির্যাতন। ওরা কি তার বন্ধুর জন্য চিন্তা করবে, না নিজের কথা চিন্তা করবে কোন কিছুর কূল পায় না। একের পর এক লাঠির আঘাত এবং লাথি আছড়ে পড়ছে তাদের উপর। বাসায় কেউ জানে না। কোন খবর পাঠাতে পারেনি। এদিকে তাহমিদের খবরও পাঠাতে পারেনি তার বাসায়। সব মিলিয়ে তাদের পুরো পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায় এ হাজতখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। রাত তিনটার দিকে তাদেরকে মারা বন্ধ হলো। রক্তাক্ত নিথর দুটো দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। একটু নড়ার সামর্থ্য নেই কারো। মাঝে মাঝে কেবল যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে তারা। আর আল্লাহকে ডাকছে বার বার। হঠাৎ আজানের ধ্বনি। ফজরের আজান। হৃদয় নাড়া দেয়া চিরপরিচিত সুর। সারাজীবন আজান শুনে আসছে, কিন্তু আজ যেন প্রতিটা ধ্বনি হৃদয়ে এক অচেনা শান্তির প্রলেপ আর আশ্বাস যোগালো। আজান শুনে মনে সাহস পেল দুজনই। ধীরে ধীরে এক সময় উঠে বসলো তারা। সে রক্তাক্ত অবস্থাতেই তায়াম্মুম করে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে বসে থেকে জামিল ছাদের কাছাকাছি থানার গরাদের একচিলতে জানালার ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাদমান জিজ্ঞাসা করলো, ভাই কি দেখেন? জামিল আপনমনে উত্তর দিলো, সূর্যোদয় দেখি। সোনালী সূর্যোদয়। একদিন এদেশে সত্যিকারের সূর্যোদয় হবে। সেদিন এ জনপদে আর কোন অত্যাচারী স্বৈরাচারের কালো থাবা আমাদের স্বপ্নময় ভবিষ্যতকে আড়াল করে রাখতে পারবে না।

২৫ মার্চ, ২০১৭

কালো পঁচিশ কি আসলেই কালো?


২৫ মার্চের আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনারা জানেন চট্টগ্রামে ছাত্রশিবির এবং জামায়াতের ব্যপক প্রভাব। চট্টগ্রামের আ. লীগ সভাপতি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন প্রায়ই এই বিষয়টাকে সামনে এনে বলেন একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চট্টগ্রামের কয়েকটি অঞ্চল আমরা স্বাধীন করতে পারিনি। যাই হোক মনে করুন, জামায়াত যেহেতু সারাদেশে ক্ষমতায় আসা কঠিন মনে করে সে প্রেক্ষাপটে তারা চিন্তা করলো তারা চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করবে তাদের মত করে। এই উপলক্ষে তারা বাইরের কোন রাষ্ট্রের অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে খবর আসলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরো খবর আসলো বাংলাদেশপন্থী মানে বাংলাদেশে ভাঙ্গুক চান না এমন কিছু সাধারণ মানুষকে আটকে/জিম্মী করে রেখেছে ছাত্রশিবির। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি হবে? 

আসুন আরেকটি সিচুয়েশন কল্পনা করি। আপনার জানেন পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক পাহাড়ি স্বাধীনতা চায়। এজন্য তারা কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপও তৈরী করে। একই কারণে সমগ্র পাহাড়ীদের প্রতি বাঙ্গালীদের অবিশ্বাস তৈরী হয়। অবিশ্বাস থেকেই সেখানে সেনা শাসনের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সব সরকারই সেখানে সেনা শাসন সৃষ্টি করে রেখেছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য। মনে করুন সেনাবাহিনীর কাছে খবর এল পাহাড়িরা একটা গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আরো খবর এল তারা কিছু বাঙ্গালীকে জিম্মী করে রেখেছে এবং আরো কিছু বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি হবে? 

এখন আপনারা যারা মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচিত কোন অভিযানে না নেমে নিরাপদে দেশ ভাংতে দেয়া, বাংলাদেশের অখন্ডতার পক্ষাবলম্বনকারীদের উপর স্বাধীনতাকামীদের নির্যাতনে চুপ করে থাকা, যারা মনে করেন সেনাবাহিনীর কাজ দেশরক্ষা নয়, শোকেসে সাজিয়ে রাখার মত সেজে থাকা তবে আপনাদের জন্য আমার এই পোস্ট নয়। 

আমাদের শেখানো হয়েছে, জানানো হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঢাকায় তারা জনসাধারণের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে পালিয়েছে। অনেকেই মারা পড়েছে। ঘুমন্ত মানুষের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। এজন্য ২৫ মার্চকে কালো রাত বলা হয়। এই বছর মন্ত্রীসভায় পাশ হয়েছে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। 

যাই হোক আমরা একটু জানার চেষ্টা করবো যুদ্ধ কারা চেয়েছিল? কাদের প্রয়োজন ছিল যুদ্ধের? আমরা অনেকেই মনে করি যুদ্ধ ১৯৭১ সালের ইস্যু। আদতে সেটা ঠিক নয়। রুশপন্থী বামেরা একটা সফল বিপ্লবের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল যেখানে তাদের আদর্শ তারা বাস্তবায়ন করবে। এদিকে র’ গঠিত হওয়ার পর তাদের ১ম প্রজেক্ট হলো পাকিস্তান আলাদা করা। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের মধ্যে একটি গোপন সংগঠন সৃষ্টি হয় যার নাম নিউক্লিয়াস। র’ এর পক্ষ থেকে চিত্তরঞ্জন, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে এই আন্দোলন অত্যন্ত গোপনে চলতে থাকে। ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের আস্তে আস্তে গোপন সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরাই মূলত বাংলাদেশ নাম ঠিক করে, পতাকা ঠিক করে, সংগীত ঠিক করে ১৯৬৮ সালে। [১,২]

অপরদিকে মাওবাদীরা মানে চীনপন্থী বামেরাও এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতো তবে তাদের গুরুদের কাছ থেকে আশা না পাওয়ায় তারা একটু পিছিয়ে থাকে। ভাসানী নিউক্লিয়াস সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু চীন পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্র হওয়ায় ভাসানীর বহিঃবিশ্বের সাপোর্ট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও সে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে দেয়। এই ঘোষনাই তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ার শেষ করে দেয়। কারণ এদেশের পাঁচ শতাংশ মানুষও এমনকি ভাসানীর দল ন্যাপ যারা করে তারাও স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। [২]

র’ আর নিউক্লিয়াসের লোকজন গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন ছিল কোন একটা গন্ডগোলের উসিলায় দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া। বাকী কাজ ভারত করবে। এটা ছাড়া তাদের একজন নেতাও দরকার ছিল। তারা মুজিবকে নানানভাবে প্ররোচিত করেন। মুজিব তাদের প্ররোচনায় কান দেন নি। আসলে কান দেয়ার কোন প্রয়োজনই মুজিবের পড়েনি। মুজিব যেখানে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে সেখানে কেন সে শুধু শুধু দেশ ভাগ করে একটা ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে? আবার ভাগ হয়ে গেলে সেই দেশটা ভারতের পেটের ভেতর ঢুকে যাবে! আ স ম রব সহ ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থী নেতারা ৭১ এর ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা মুজিবের বাড়ির সামনে উত্তোলন করেন। মুজিব অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং নিজেই পতাকা ছিড়ে ফেলেন। তারপরও থেমে থাকে নি তারা, গনহত্যা চালাতে শুরু করে। [১]

৩ ও ৪ মার্চ চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ কলোনীতে ও ওয়্যারলেস কলোনীতে প্রায় ৭০০ অবাঙ্গালীদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এখানে বসবাসকারী বহু শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়। সে সময় সরকারি হিসেবে ৩০০ লাশ দাফন করা হয়। [২,৩,৪,৫,৬]

দ্যা টাইমস অফ লন্ডন ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল রিপোর্ট করেছিলো, হাজার হাজার সহায় সম্বলহীন মুসলিম উদ্বাস্তু যারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় গ্রহন করে তারা গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালীদের দ্বারা ধ্বংসাত্মক আক্রমনের শিকার হয়। বিহারী মুসলিম উদ্বাস্তু যারা সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং ভারতে প্রবেশকারী একজন বৃটিশ টেকনিশিয়ান এই খবর নিশ্চিত করেন। উত্তর পূর্ব শহর দিনাজপুরে শত শত অবাঙ্গালী মুসলিম মারা গিয়েছে। [২,৭]

খুলনায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৪ মার্চ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়, ৫ মার্চ খালিশপুর ও দৌলতপুরে ৫৭ জনকে অবাঙ্গালীকে ছোরা দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীর কঠোর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাসও স্বীকার করেছেন অবাঙ্গালীদের এই অসহায়ত্বের কথা। অবাঙ্গালীদের জান মাল রক্ষায় শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে বাহ্যত নির্দেশ থাকলেও কোন কার্যকর উদ্যোগ ছিলনা। আওয়ামীলীগের কর্মীরা অদৃশ্য ইঙ্গিতে হত্যা খুন লুটতরাজ করে যাচ্ছিল অবারিতভাবে। সারাদেশেই চলছিল নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। সেই হিসেবে ঢাকা অনেক ভালো ছিল। [২,৭,৮] 

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসসহ অনেক দূতাবাসে হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। ১২ মার্চ ও ১৫ মার্চ মার্কিন কনসুলেট লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও গুলি করা হয়। ১৯ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনালে বোমা হামলা ও গুলি করে বিদ্রোহীরা। এগুলো ছিল শান্তি আলোচনার জন্য বড় অন্তরায়। তারপরও বলা চলে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিব আলোচনা ফলপ্রসুই হতে যাচ্ছিল। পরিস্থিতির উপর মুজিবসহ কারোই নিয়ন্ত্রণে ছিলনা। সেনাবাহিনীও সরকারি আদেশের বাইরে কোন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছিল না। [২,৮]

আর এদিকে RAW, এদেশীয় বাম ও আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা সমাজতন্ত্রবাদীরা এদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের আলোচনাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য একের পর এক অবাঙ্গালী গণহত্যা চালিয়েছে, সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অনেক বিহারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে বিশেষ করে জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। [২,৭]

সারাদেশে সেনাবাহিনীর উপর বিনা উস্কানীতে আক্রমন করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে জয়দেবপুরে। গাজিপুরে সমরাস্ত্র কারখানার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সেখানে পৌঁছানোর আগে আওয়ামীলীগ কর্মীরা জয়দেবপুরে ব্যরিকেড সৃষ্টি করে। ব্যরিকেডের জন্য তারা একটি ট্রেনের বগি ব্যবহার করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জাহানজেবের নেতৃত্বে সৈন্যদল। তারা ব্যরিকেড সরিয়ে সেখানে পৌঁছায়। নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখে জাহানজেব আরবাব আবার যখন হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন বিশৃংখলাকারীরা সৈন্যদলকে আবারো ঘিরে ফেলে। বন্দুক, শর্টগান, লাঠি, বোমা ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায়। জাহানজেব বাঙ্গালী অফিসার লে. ক. মাসুদকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিলেন। মাসুদ ইতস্তত করলে অপর বাঙ্গালী অফিসার মঈন তার সৈন্যদের নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালালে কিছু মানুষ নিহত হয় বাকীরা পালিয়ে যায়। মাসুদকে পরে ঢাকায় এসে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক বাঙ্গালী অফিসার কে এম সফিউল্লাহকে। [২,৮] 

এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ১৯ মার্চ সকাল দশটায় তার ইউনিটকে জানানো হয় ব্রিগেড কমান্ডার মধ্যহ্নভোজে আসছেন এবং নিকটবর্তী গাজিপুর সমরাস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করবেন। কিন্তু জনতা প্রায় ৫০০ ব্যরিকেড বসিয়ে সৈন্যদের আটকে দেয়। এগুলো সরিয়ে তারা আসলেও ফিরে যাওয়ার সময় জয়দেবপুরে মজবুত ব্যরিকেড সৃষ্টি করলে লে. ক. মাসুদ তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। এমন সময় দুজন বাঙ্গালী সৈনিক জাহানজেবকে জানায় তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে, অস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়েছে। এবার জাহানজেব গুলি করার নির্দেশ দিলে মঈন তার সৈন্যদের গুলি করতে বলে। তবে বাংলায় বলে দেয় ফাঁকা গুলি করার জন্য। এরপরও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রনে না এলে এবার জাহানজেব কার্যকরভাবে গুলি করার নির্দেশ দেন। তারাও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। দু’জন নিহত হয়। সফিউল্লাহ আরো জানান, গাজিপুরের পরিস্থিতিও ছিল উত্তেজনাকর। রাস্তায় ব্যরিকেড দেয়া হয়েছিল। সমরাস্ত্র কারখানার আবাসিক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাকে আটকে ফেলে বাঙ্গালীরা। আবাসিক পরিচালককে উদ্ধার করতে আমরা সেনা প্রেরণ করেছিলাম। [৮]

এভাবে সারাদেশে সেনাবাহিনীকে নানাভাবে উস্কে দিয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। ইয়াহিয়া বিদ্রোহ দমন করার জন্য টিক্কা খানকে এদেশে আনলেও সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র আক্রান্ত হওয়া ছাড়া কোন ভূমিকা নিতে বারণ করেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই ধৈর্য্যের প্রশংসা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাস। এসব ঘটনায় মুজিব বেশ চাপ পড়েছিলেন। সমঝোতাও পড়েছিলো হুমকির মুখে। তারপরও হয়তো সমঝোতা হত। কিন্তু একটা ছবি যা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো এরপর আর কোন আলোচনাতে অংশ নিতে রাজি হয়নি ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো। সেটি ছিল ঢাকা ভার্সিটি এলাকায় যুবক ছেলে মেয়েদের যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মার্চপাস্টের ছবি। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো একথা মনে করেই নিয়েছেন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করে মূলত মুজিব ভারতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

শফিউদ্দিন তালুকদার তার বইতে বলেছেন, সিরাজগঞ্জ সদরের রেলওয়ে কলোনীর বিহারী পট্টির হত্যাকান্ডটি ইতিহাসের একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। যে ঘটনাটি অনাকাঙ্খিত অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। অত্যন্ত রোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক। উনিশ'শ একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদ্বীপ্ত ও ঐতিহাসিক ভাষণের পর ২৬ মার্চের কয়েক দিন আগে সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটায়।

সিরাজগঞ্জের মানুষের এমন ধারণার উদ্রেক হয়েছিল যে, রেলওয়ে কলোনিতে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের শত্রু, তারা বাংলাদেশকে সমর্থন করতে পারে না, তারা পাকিস্তানকেই সমর্থন করবে আর যেহেতু তারা অধিকাংশই উর্দু ভাষাভাষি সেহেতু পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানিরাও তাদের শত্রু - এসব ধারণার বশবর্তী হয়ে জনগণ স্বত:স্ফূর্তভাবে সিরাজগঞ্জের রেলওয়ে কলোনির বিহারী পট্টিতে হামলা চালায় এবং তিনশ থেকে চারশ লোককে বিনা দোষে নৃশংসভাবে হত্যা করে। [৯]

২৩শে মার্চ থেকেই শুরু হয় পাবনায় বাঙ্গালীর হত্যাযজ্ঞ। বাঙ্গালীরা ২৫০ জন পুরুষ, নারী ও শিশুকে একটা দালানে ঢুকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। কলোনীর ভেতরে যারা ছিলো তাদের সকলকেই এভাবে ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়॥" [১০]

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা রইসউদ্দিন আরিফ তার বইতে বলেন ... রানু (প্রয়াত কমরেড রাশিদা) গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলো শহরে পাঞ্জাবী সেনাদের আগমনের আগেই। ২৫শে মার্চের পর পাঞ্জাবী সেনাদের হাতে জান খোয়ানোর চেয়েও বেশি, ইজ্জত খোয়ানোর ভয়ে শহর থেকে সব মেয়েমানুষ দলে দলে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছিলো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রানুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ভিন্নতর। আসলে রানু নিজের আজন্মলালিত শহরটিকে ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো আর দশটি মেয়েমানুষের মতো যতটা না পাঞ্জাবীদের ভয়ে,. তার চেয়েও বেশি অন্য এক বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐ বিশেষ ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর এ শহরের বাতাস যেনো পাথর হয়ে চেপে বসেছিলো ওর বুকে।

'ক্রাকডাউনের' পর ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী সেনাদের আগমনের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের এ মফস্বল শহরটি ছিলো পুরোপুরি মুক্ত এলাকা। বিশেষ করে ২৭-২৮ মার্চে শহরতলী এলাকায় অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পের সব অবাঙালি অফিসার-জওয়ান বউ-বাচ্চা সহকারে খতম হওয়ার পর গোটা শহর তখন পুরোপুরি শত্রুমুক্ত। এক অভাবিত মুক্তির স্বাদে কয়টা দিন শহরের অলিতে গলিতে আর ঘরে ঘরে আপাতমুক্তির আনন্দ-উল্লাসের কী যে জোয়ার বয়েছিল, তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যায় না। রানুর মনেও আনন্দ-উল্লাসের হয়তো কমতি ছিলো না।

কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ এক সকালে 'স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান চেতনা' হুমড়ি খেয়ে পড়লো শহরের বিহারী কলোনীগুলোর ওপর। হৈ হৈ রৈ রৈ করে রীতিমতো কুরুক্ষেত্র আর লংকাকান্ড চললো পুরো তিন দিন। বিহারী ছেলে, বুড়ো ও নারী-পুরুষের রক্তের স্রোত বয়ে গেলো কলোনীগুলোর ওপর। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, নিষ্ক্রিয়, অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুর ওপর একতরফা হত্যাযজ্ঞ চললো পুরো তিনটে দিন।

রানু এই চরম লোমহর্ষক বর্বর মুহুর্তেও কাউকে না জানিয়ে একাকী কলোনীতে দৌড়ে গিয়েছিলো। তাহমিনাদের ঘরের আঙীনায় পৌঁছে ওর বাবা-মা'র লাশ দেখে আৎকে উঠলেও সে পিছ-পা হয়নি। প্রিয়তমা বান্ধবীকে উদ্ধারের আশায় অতি দু:সাহসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে তাহমিনাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিলো এবং ঢুকেই আর্তচিৎকারে কলোনীর আকাশ প্রকম্পিত করে দিয়েছিলো। রানুর চোখের সামনে এক বীভৎস দৃশ্যের নিস্তব্ধতা। মেঝেতে তাহমিনার লাশ পড়ে আছে চিৎ হয়ে, পরনে ওর একটি সুতোও নেই। রক্তে সারা ঘর ভাসছে।

তার পরদিনই রানু শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। 'মুক্তিযুদ্ধের' পুরো ৯টি মাস রানুকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হই। ওর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় ৭১-এ এই দেশের মাটিতে অসহায় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, অবলা নারীর ওপর বলাৎকার ইত্যকার পাশবিক কার্যকলাপ প্রথম নাকি শুরু করে একশ্রেণীর বাঙালিরাই। রানুকে যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব দেয়া যেতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিশ্চয়ই শুরু হতো এই কলংকময় অধ্যায় দিয়ে। [১১]

যশোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন সেখানে বাঙ্গালীরা প্রায় দুইশত বিহারীরে হত্যা করে। [১২]

"যশোর। ২৯-৩০শে মার্চ, ১৯৭১। ঝুমঝুমপুর কলোনী। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র বিহারী জনগণকে সাধারণভাবে হত্যা করে। মেয়ে ও শিশুদের টেনেহিঁচড়ে নড়াইলের দিকে নিয়ে যায়। ৪০০ থেকে ৫০০'র মতো মেয়েকে অপহরণ করে নদীপথে হিন্দুস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের কংকাল ও দেহের অন্যান্য অংশ সমস্ত এলাকায় ছড়ানো রয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। (প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়। ২ হাজার লোকের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।)

২৯-৩০শে মার্চ, ১৯৭১। রামনগর কলোনী। ঝুমঝুমপুর কলোনীর লোকেরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। এই কলোনীতেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। (১৫০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয় ৪৪৮ জন)।

৩০শে মার্চ, ১৯৭১। তারাগঞ্জ কলোনী। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র কলোনীতে বেপরোয়া হত্যাকান্ড চালিয়ে যায়। খুব কম লোকই বেঁচেছিল। সমস্ত বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। (৫শ'র মতো লোক নিহত হয়। নিখোঁজ লোকের সংখ্যা ৪শ'।)

৩০শে মার্চ-৫ই এপ্রিল, ১৯৭১। হামিদপুর, আমবাগান, বাকাচর এবং যশোর শহরের পুরাতন কসবা। এই এলাকার অধিকাংশ জনগণকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। ঘরবাড়ি প্রথমে লুঠ এবম পরে তা ধ্বংস করা হয়। (প্রায় ১ হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ হয়। ১৭৫ জন হাসপাতালে যায় এবং ১৭২ জন দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয়। [১৩]

জাফর ইকবাল বলেন, মধুপুরের গড়ে যখন প্রায় প্রত্যেকদিন হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে চলছিলো ঠিক তখন ময়মনসিংহ শহরে বসবাসরত অবাঙালীরা এবং স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ময়মনসিংহ পতনের চেষ্টা চালায়। জনগণ এটাকে সুস্থভাবে গ্রহণ করেনি বলেই তাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেয়। এতে কয়েকশ' লোক নিহত হয়। এ সময় শহরে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা॥" [১৪]

ময়মনসিংহের ছত্রপুর এলাকার রেল কলোনীতে অনেক বিহারী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে কলোনীতে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে পুড়ে মরে শিশু, নারী ও পুরুষ। আগুন-নেভার পর কোন কোন ঘরে পুড়ে যাওয়া আদম সন্তানের বিকৃত ও বীভৎস চেহারা দেখে চমকে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল এক মানুষ অন্য মানুষকে কি করে এত নিষ্ঠুরভাবে মারে॥" [১৫]

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১১ই এপ্রিল সকালেই পাকশীতে বসবাসরত সকল বিহারিকে পরিবার-পরিজনসহ পাকশীর একমাত্র উর্দু মিডিয়াম মুসলিম হাইস্কুলে সমবেত হওয়ার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়। তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয় যে, সকল বিহারির নিরাপত্তার জন্যই এটা করা হচ্ছে এবং এখানে জমায়েত হলে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই আশ্বাসের পর প্রায় চার-পাঁচশ বিহারি নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এসে অল্পক্ষণের মধ্যেই জমায়েত হয়েছিল মুসলিম স্কুল প্রাঙ্গণে।

এরপর দুপুর নাগাদ নারী ও শিশুদের স্কুলের একটি বড় কক্ষে ঢোকানো হয় এবং অন্যদের তিন-চার লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ঘরের ভেতরে বন্দি নারী-শিশুদেরও জানালা দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। [১৬] 

বদরুদ্দিন ওমর তার স্মৃতিচারণ গ্রন্থে বলেন, ... আমরা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল আড়িয়াল খাঁ অনেক চওড়া হয়েছে। এক সময় মাঝি বললো সামনে একটা বাজার আছে। আমরা রান্নার জিনিসপত্র কিনতে চাইলে সে নৌকো ভিড়াবে। আমাদের কথায় সে নদীর ডানদিকে এক জায়গায় নিয়ে আমাদের নামালো। সেটা কোন ঘাট নয়। তবে নৌকো থেকে নেমে ডাঙ্গায় যাওয়া সহজ। মাঝি বললো বাজারের জন্য একটু ভিতরে যেতে হবে। তার কথামত এগিয়ে গিয়ে আমরা বাজার পেলাম। এক দোকানে চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলা, আলু কিনে আমরা নৌকোয় ফিরলাম।

কাঠের ব্যবস্থা নৌকোতেই ছিল। মাঝ নদীতে গিয়ে ভাল করে হাঁড়ি ধুয়ে খিচুড়ি চড়িয়ে দেওয়া হলো। কাঠের চুলোয় নৌকার ওপর রান্নার অসুবিধে হলো না। দুটো মাটির শানকি ছিল। সেগুলো ভালোভাবে ধুঁয়ে আমরা খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। এমন সময় নদীর বাঁ দিকে দেখলাম, পাড় থেকে নেমে কয়েকটা লোক কি যেন টানাটানি করছে। একটু লক্ষ করতেই বোঝা গেল, সেটা একটি মেয়ের লাশ। লোকদের কাজকর্ম দেখে মনে হলো, লাশ থেকে তারা কিছু নেওয়ার চেষ্টা করছে। মাঝি বললো, তারা লাশটির শরীর থেকে গয়নাগাটি খুলে নিচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখতে থাকার সময় হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়ায় দেখা গেল এক ভয়াবহ দৃশ্য। একসাথে অনেকগুলো মেয়ের লাশ নদীর ওপর ভাসছে। সকলের পরনে শালোয়ার কামিজ। বোঝার অসুবিধা নেই, সেগুলো অবাঙালি মেয়েদের লাশ। সেই মেয়েদের লাশের সাথে বাচ্চাদের লাশও দেখা গেল। নৌকো লাশগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেও লাশ কাতারবন্দী হয়ে আরও দেখা গেল। বোঝা গেল, সামনে বড় আকারে কোথাও অবাঙালী নিধন হয়েছে। আমরা খেতে বসার সময় এভাবে ভাসমান লাশগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার প্রবৃত্তি আর থাকলো না। আমরা দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর সেই লাশের মিছিল শেষ হলো। আমরা খেতে বসলাম। খেতে তো হবেই। কোন রকমে খেলাম, মাঝিও আমাদের সঙ্গে খেলো, মনে হয় সোজা হাঁড়ি থেকেই।

লাশগুলো আসছিল টেকেরহাটের দিক থেকে। পরে আমরা শুনেছিলাম যে, ঐ এলাকার কাছাকাছি এক জায়গায় দুটি লঞ্চ দাঁড় করিয়ে তার যাত্রী বিহারী মেয়ে ও তাদের বাচ্চাদের বাঙালীরা খুন করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। ঐ মেয়েরা আসছিল যশোরের নড়াইল শহর থেকে। তখন সেখানে এসডিও ছিল কামাল সিদ্দিকী। চারিদিকে বাঙালীরা খুন খারাবী করতে থাকার সময় প্রথম চোটে পুরুষদের মেরে ফেলেছিল। মেয়েদেরকে আটক করে পরে খুন করার ব্যবস্থা করেছিল। সে সময় কামাল সিদ্দিকী, যে আমার পরিচিত ও ছাত্র স্থানীয় ছিল, তাড়াতাড়ি দুটি লঞ্চ ভাড়া করে মেয়েদেরকে বরিশালের দিকে পাঠিয়ে সেখান থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার, হতে পারে ভারতের দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার কোন ব্যবস্থা করছিল। পথে বাঙালীরা লঞ্চ দুটি আটক করে সেই নৃশংস হত্যাকান্ড করে। সেই নৃশংসতার বিবরণ টেকেরহাটেই শুনেছিলাম। কামাল সিদ্দিকী এরপর কলকাতায় চলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের পর আমার সাথে ঢাকায় দেখা হয়েছিল।

আমরা টেকেরহাট পৌঁছালাম। তখন বিকেল চারটের মত হবে। দেখলাম ঘাটে কতকগুলো লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম একটা লঞ্চ বড়দিয়া যাবে। বড়দিয়া খুলনা যশোরের বর্ডারের কাছে মধুমতী নদীর ওপর। সেটা একটা বড় মোকাম এবং নদী বন্দরও বটে। আমরা লঞ্চটিতে উঠে বসলাম। লঞ্চ ছাড়ার কথা পাঁচটার দিকে। লঞ্চ ঘাটের কাছে নদীটা তেমন চওড়া নয়। লঞ্চে বসে দেখা গেল নদীর অন্য তীরে পানিতে লাশ ভাসছে। এমনকি আমাদের লঞ্চের গায়েও দুই একটা লাশ এসে লেগেছিল। ঢেউয়ের ধাক্কায় দোলা খাচ্ছিলো। সদ্য খুন করা লাশের ছড়াছড়ি এভাবে আগে কোনদিন দেখিনি।

জীবনে মানুষের করুণ মৃত্যুর অনেক চেহারা আমি দেখেছি। একেবারে প্রথম সেই ছেলেবেলায় ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, তারপর কলকাতায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, ১৯৭০ সালে দক্ষিণ বাঙলায় সাইক্লোন ও জলোচ্ছাস। তারপর ১৯৭১ সালের এই সব মৃত্যু। পরে আরও দেখেছি, ঢাকায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর থেকে করুণ আর কোন মৃত্যু নেই। আর গণহত্যা ও দাঙ্গায় মৃত্যুর থেকে মানুষের সামষ্টিক অমানুষিকতার বড় দৃষ্টান্ত মনে হয় আর নেই। মার্চের ২৫ তারিখ থেকে এই অমানুষিকতার সাথেই আমরা বসবাস করছিলাম॥" [১৭]

ঢাকাসহ সারাদেশে এমন অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে এদেশের কিছু সন্ত্রাসী যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে। এবার আসুন আমরা আবার ঢাকা ভার্সিটির পরিবেশে ফিরে আসি। কেন সেখানে সেনা অভিযান অবধারিত ছিল? জগন্নাথ হলে সেদিনের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কালীরঞ্জন শীল উল্লেখ করেন ৭ মার্চের পর থেকেই তারা ঢাবির জিমন্যাসিয়ামে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তিনি নিজেও সেই প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। কয়েকদিন পর যখন তাদের ও মেয়েদের একটা গ্রুপের প্রশিক্ষণ শেষ হয় তখন তারা রাস্তায় বের হয় এবং মার্চ পাস্ট করেন। সেটা বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকায় ছাপা হয়। সারা পৃথিবীকে জানানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন ঢাবির হলগুলোতে বহিরাগত ব্যক্তি ও ছাত্ররাও প্রশিক্ষণ নিত। [১৮]

২৫ মার্চ কি এক পক্ষের হত্যাযজ্ঞ ছিল নাকি উভয় পক্ষের গোলাগুলি ছিল এটা আমরা সহজেই এখান থেকে অনুমান করতে পারি। ৭ মার্চ এবং তার আগে থেকেই বাঙ্গালির কিছু অংশ উস্কানীমূলক স্লোগান দিত যা ছিল স্পষ্টত রাষ্ট্রবিরোধী। যেমন "বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর"। ঢাবির অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা যিনি ছাত্রদের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে উস্কানী দিতেন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন তার স্ত্রীর লেখায় পাওয়া যায় ঢাকা ভার্সিটির কিছু ছাত্র রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতেন। বাসন্তি গুহ ঠাকুরতা বলেন, আমি প্রায় রাত সাড়ে বারোটা বা একটার দিকে গুলির শব্দে জেগে উঠি। আমি আমার স্বামীকে জাগিয়ে জিজ্ঞাসা করি যুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল নাকি? তিনি বললেন, ও কিছু না, ছাত্ররা প্র্যাক্টিস করছে মাত্র। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার এই কথা প্রমাণ করে ছাত্রদের কাছে যে রাইফেল রয়েছে এটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। [১৯]

ঢাকা ভার্সিটিতে অনেকগুলো হল থাকলেও মূলত যুদ্ধ হয়েছে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে। অন্য সব হলের ছাত্ররা নিরাপদে ছিল। ইকবাল হল এখন যেটা জহুরুল হক হল নামে পরিচিত তার ঠিক উল্টোদিকেই মহসিন হল। ইকবাল হলে ঝামেলা হলো অথচ মহসিন হলে কিছুই হয় নি। শুধু মহসিন হল নয়, দুটি হল বাদে বাকী সব হল ছিল নিরাপদ। কারণ সেখানে কোনো অস্ত্রধারী ব্যক্তি বা ছাত্র ছিলো না। এটা দ্বারাও স্পষ্ট হয় ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট নিরস্ত্র ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছিল না এবং এটা কোনো নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ছিলো না, গণহত্যা তো মোটেই না। এটা শুধুমাত্র একটা জঙ্গীবিরোধী অভিযান ছিল যা দেশরক্ষায় অত্যাবশ্যকীয় ছিল।

তবে আমার মনে হয় সেসময় ঢাবির ছাত্রদের ক্ষুদ্রাংশ যারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে তারা ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ছিল না। সেক্ষেত্রে তারা ছাত্রদের হত্যা না করে গ্রেপ্তার করতে পারতো। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা আরো সহজ হতো। কিন্তু তাই বলে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট অযৌক্তিক বা ঘুমন্ত-নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা এটা বলা মোটেই যৌক্তিক নয়। বরং সারাদেশে বিহারীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে পাপ করেছে সে তুলনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক সহনশীল আচরণ করেছে। ঢাকায় ২৫ মার্চ আরেকটি স্থানে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হয় সেটা হল শাঁখারিবাজার। আর্মিদের কাছে রিপোর্ট ছিল সেখানে অস্ত্র তৈরি করা ও অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। সেনাবাহিনী সেখানেও অভিযান চালায় এবং সেখানে অস্ত্র উদ্ধার করে। শাঁখারীবাজারেও সেনাবাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেখানেও সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয় ১৫-১৬ জনের মত। 

তথ্যসূত্র 
১- দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ
২- বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধঃ বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, এম আই হোসেন। 
৩- দ্যা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, আর্চার ব্লাড
৪- The 1971 Indo-Pak war, A soldier's Narrative, Hakim Arshad Koreshi
৫- The Crisis in East Pakistan, Govt of Pakistan, 5 August, 1971.
৬- Anatomy Of Violence, Sarmila Bose
৭-The event in East Pakistan, 1971- International Commission of Jurists, Geneva.
৮- ডেড রেকনিং, শর্মিলা বসু
৯- শফিউদ্দিন তালুকদার / একাত্তরের গণহত্যা : যমুনার পূর্ব-পশ্চিম ॥ [ কথাপ্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১১ । পৃ: ৭৪-৭৬ ]
১০- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / সম্পা : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ॥ [ আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ১৪৭
১১- রইসউদ্দিন আরিফ (সাবেক সম্পাদক, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) / আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্র ॥ [ পাঠক সমাবেশ - ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ । পৃ: ১১৯ / ১২৪-১২৫ ]
১২- ড. মো. আনোয়ার হোসেন / বৃহত্তর যশোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ॥ [ গতিধারা - ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ১৮০-১৮১ ]
১৩- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / সম্পা : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ॥ [ আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ১৪২-১৪৩ ] 
১৪- জাফর ইকবাল / ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধ [ ভোরের কাগজ - ১৬.১২.১৯৯২ ] স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি / সম্পা : ফরিদ কবির ॥ [ মাওলা ব্রাদার্স - জানুয়ারি, ১৯৯৪ । পৃ: ৯৩-৯৪ ]
১৫- শামসুজ্জামান খান / দিনলিপি ॥ [ অন্বেষা - ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ১৩৬ ]
১৬- কামাল আহমেদ / '৭১ চেতনায় অম্লান ॥ [ র‍্যামন পাবলিশার্স - ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ । পৃ: ৯২-৯৪]
১৭- বদরুদ্দীন উমর / আমার জীবন (তৃতীয় খন্ড) ॥ [ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ - জুন, ২০০৯ । পৃ: ১৭০-১৭৩]
১৮- ডেড রেকনিং/ শর্মিলা বসু পৃঃ ৫৮
১৯- ডেড রেকনিং/ শর্মিলা বসু পৃঃ ৬১