১৮ জানু, ২০১৮

মেরুদন্ড


চিৎকার করে সাহায্য চাইতে লাগলো আসিফ। স্যার আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। স্যার দেখুন স্যার, স্যার... ... ... স্যা...র...। ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান ড. বদরুদ্দোজার কিছুই করার নেই। চিৎকার শুনে অন্যান্য স্যারদের সাথে তিনিও বেরিয়েছেন। কিন্তু অপহরণকারীদের দেখে তিনি চুপসে গেলেন। তার কিছুই করার নেই। এমনকি পুলিশ ডাকারও। একবার পুলিশ ডেকে ভয়ংকর হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। আর পুলিশ ডাকলে সমস্যা আরো বাড়বে বৈ কমবে না। পুলিশ অপহরনকারীদের কিছুই বলবে না উল্টো আসিফকেই এরেস্ট করবে। রিমান্ডে নিবে, এমনকি মেরেও ফেলতে পারে! 

নিজের রুমে প্রবেশ করলেন ড. বদরুদ্দোজা। মাঝে মাঝে তার খুব মনে হয় এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। কিন্তু উপায় নাই, কারণ এসব অপহরণকারীদের তিনি এবং তার মতো শিক্ষকরাই তৈরী করেছেন। তাদের দ্বারা একের পর এক অবৈধ কাজ করিয়ে তাদের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি সরকারপন্থী শিক্ষক। ক্ষমতাবান। আর এই ক্ষমতার অবৈধ প্রয়োগ তিনি করেছেন এদের দ্বারাই। 

ড. বদরুদ্দোজার মানসপটে ভেসে উঠে ড. শাহিদুলের কথা। তার সিনিয়র স্যার। সরকারপন্থী ছাত্রদের দ্বারা অপমানিত করেছেন তিনি। তার করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় চাকরি হারিয়েছেন। কিছুদিন আগেই অবশ্য শাহিদুল সাহেবের সাথে দেখা হয়েছে। যেন কিছুই হয়নি তার! স্বভাবসুলভ একগাল হাসি দিয়ে বললেন, আরে! বদরুদ্দোজা সাহেব যে, কেমন আছেন? 

এখন একটা স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হারিয়ে স্কুলের টিচার! কোথায় তিনি আপসেট বা হতাশ থাকার কথা! কিন্তু তার চোখে মুখে এক অভাবনীয় ঔজ্জ্বল্য। বদরুদ্দোজা সাহেবকে বললেন, আপনার ক্যাম্পাস কেমন আছে? ছাত্ররা সবাই ভালো আছে? পড়ালেখা করছে? সদা হাস্যোজ্জ্বল শাহিদুল সাহেবের কথার কী জবাব দেবেন তা চিন্তা করতে করতেই শাহিদুল সাহেব আবারো বলে উঠলেন, জানেন বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। ক্যাম্পাসের ঐসব হানাহানি দেখতে একদম ভালো লাগে না। আপনি আমাকে সরিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন। এখন বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে থাকি। ঝামেলা ছাড়া। 

মুখের আলো নিভে গিয়েছে বদরুদ্দোজা সাহেবের। নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকলো। কোনরকম বিদায় নিয়ে আসলেন শাহিদুল সাহেবের কাছ থেকে। সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাহিদুল সাহেবের চাকরীচ্যুত করার পেছনে যে তার ভূমিকা আছে সেটা ভালোভাবেই মনে রেখেছেন শাহিদুল সাহেব। কাজটা তিনি করেছেন কৌশলে। তার এই তৎপরতা শাহীদুল সাহেবের কাছে পরিষ্কার। আজ আসিফের অপহরণের ঘটনায় শাহীদুল সাহেবের কথাগুলো মনে পড়ছে তার। 

শাহীদুল সাহেব ক্যাম্পাস ছেড়েছেন দুইবছর হলো, আসিফ এসেছিল সেদিন। শাহীদুল সাহেবের হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিল। বললো স্যার ইয়াতিম হয়ে গেলাম! কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল আসিফ। কিন্তু ধোপে টিকেনি। সরকার সমর্থিত ছাত্ররা তাদের পিটিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। কোন কিছু করতে না পেরে সবশেষ আসিফ ছুটে এসেছিল বদরুদ্দোজা সাহেবের অফিসে। চিৎকার করে বলেছিল স্যার শাহীদুল স্যারকে ঠেকান! স্যারকে ক্যাম্পাসে রাখেন। স্যার যদি ক্যাম্পাসে না থাকেন তবে এই ক্যাম্পাস অভিশপ্ত হয়ে যাবে। অভিশপ্ত, অভিশপ্ত হয়ে যাবে!

আজ বদরুদ্দোজা সাহেবের খুব মনে হচ্ছে ক্যাম্পাসটা আসলেই অভিশপ্ত হয়ে গেছে। সরকারি দলের ছাত্রদের ইচ্ছাই আইন। তারা পরীক্ষা দিতে বললে পরীক্ষা হবে। তারা পরীক্ষা বন্ধ করতে বললে পরীক্ষা বন্ধ হবে। তাদের নকল করতে দিতে হবে। শিক্ষকরা যে কোন অনুষ্ঠানে কী কথা বলবে তা নির্ধারন করে দিবে তারাই। নিজের ব্যাক্তিত্ব বলে কিছু নেই শিক্ষকদের। ছাত্ররা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাচ্ছে। মেরুদন্ড সোজা করতে গেলেই বিপদ। শিক্ষকদের মেরুদন্ড বলে কিছু নেই। যারাই মেরুদন্ড টান করেছে তারা সবাই বহিষ্কৃত হয়েছেন ক্যাম্পাস থেকে। মাঝে মাঝে বদরুদ্দোজা সাহেবেরও খুব ইচ্ছে হয় মেরুদন্ড সোজা করতে। কিন্তু পরিণতির কথা ভেবে আর কিছু করার সাহস পান না। 

আসিফ তার ইচ্ছেমত পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পেরেছে। আনন্দের তার সীমা নেই। কে জানতো এই আনন্দই তার জীবনে সবচেয়ে বেশি নিরানন্দ হয়ে ধরা দিবে। হলে উঠার তৃতীয় দিনেই তাকেসহ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের অশ্লীল র‍্যাগের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবাই নীরবে হজম করলেও হজম করেনি আসিফ। সে সিনিয়রদের তোয়াক্কা না করে সেদিন ঝগড়া করেছিল। 

বিপত্তি সেদিন থেকেই। সবাই বুঝেছিল এটা সহজ জাতের না। এ ঝামেলা করবেই। আসলেই তাই। আসিফ কোন অন্যায়কে সহজভাবে চলতে দেয়নি। এই অন্যায় কোন শিক্ষক করুক বা কোন ছাত্র করুক! আসিফ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তার এই কাজে সবচেয়ে বড় সহযোগী হিসেবে পেয়েছে শাহীদুল স্যারকে। যেদিন শাহীদুল স্যার চলে যান সেদিন আসিফ বুঝেছিল তার পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে। এই ক্যম্পাসে তার অনেক বন্ধু থাকলেও তার সহযোগী হয়ে অন্যায় রুখবে এমন কেউ আর রইলো না। 

অল্প দিনের মধ্যেই সরকার দলীয় ছাত্ররা তাকে আক্রমণ করতে গেল। হলের সকল কর্মচারীই ভীষণ ভালবাসে আসিফকে। একজন তাকে মারা হবে এটা বুঝতে পেরে তাকে ফোন করে সতর্ক করে দেয়। অল্পের জন্য জানে রক্ষা পায় আসিফ। সেদিন তার বিছানা, বই-পত্র, ল্যাপটপ সব হারিয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে রুমে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

বস্তুত আসিফ সেদিন থেকেই ক্যাম্পাস ছাড়া। তখন সে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সে বছর আর ক্যাম্পাসে আসতে পারে নি। পড়াশোনা এক বছর বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে সে স্যারদের সাথে যোগাযোগ করে শুধু পরীক্ষা দেয়। ক্লাস করা ছাড়াই পরের বছর সে পরীক্ষা দেয়। শিক্ষকরা তার দুরাবস্থা দেখে তাকে সাহায্য করে। কোনরকম সে অনার্স শেষ করে। এর মধ্যে ক্যাম্পাসের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। সন্ত্রাসীরাই এখন ক্যাম্পাসের হর্তাকর্তা। ভালো ছাত্রদের সরকারদলীয়দের নির্দেশে সকল অন্যায় মেনে নিয়েই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করতে হয়। এভাবেই চলছে সব। 

অনার্স শেষ করে আরো একবছর গ্যাপ দেয় সে। ইতোমধ্যে কিছু সরকারদলীয় ছাত্র পাশ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছে। এতে মনে সাহস পায় আসিফ। মাস্টার্সে ভর্তি হয় সে। লুকিয়ে ছাপিয়ে ক্লাস করে। আগের মত প্রতিবাদী রূপ নেই তার। এর মধ্যেই একদিন সে ধরা পড়ে যায় সরকারী গুন্ডাদের চোখে। দৌড়ে পালিয়ে বাঁচে। তাদের কথা একটাই, তুই সরকার বিরোধী, তোর পড়ালেখার কোন অধিকার নেই। তুই ক্যাম্পাসে আসতে পারবি না। 

আবার লুকিয়ে যায় আসিফ। তিন বছরে লুকিয়ে ছাপিয়ে কোনরকম শুধু পরীক্ষাগুলোতে এটেইন করে সে তার মাস্টার্স শেষ করে। থিসিস পেপার জমা দেয়া বাকী শুধু। যেদিন সে ক্যাম্পাসে যাবে সেদিন আগে থেকেই ভার্সিটির কর্মচারীদের থেকে ইনফরমেশন নিয়ে ক্যাম্পাসে যায়। যাতে বিপদ এড়ানো। এভাবে তার থিসিসও শেষ হল। ইতোমধ্যে তার ধারণা হল যেহেতু এতদিনে তার সাথে যাদের শত্রুতা ছিল তারা সবাই ক্যাম্পাস ছেড়েছে তাই আপাতত ক্যম্পাসে তার বিপদ নেই। কারণ নতুন গুন্ডারা অনেক জুনিয়র। তারা তাকে ওভাবে চিনে না। সে এখন থিসিসের কাজে তার সুপারভাইজারের সাথে দেখা করার জন্য নিয়মিত আসতে শুরু করে। 

অবশেষে তার থিসিস প্রেজেন্টেশনের ডেট এল। সকল প্রস্তুতি শেষ। সেদিন একটু আগেই সে ক্যাম্পাসে এসেছে। সুপারভাইজারের রুমের সামনে পায়চারি করছে এমন সময় কয়েকটি ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করলো। আরে! আপনি আসিফ ভাই না? আসিফ হ্যাঁ সূচক উপরে নিচে মাথা নাড়ে। আপনার বাড়ি খুলনা না? আসিফ এবারও মাথা নাড়ে। একজন হঠাৎ করেই ঘুষি মেরে বসে ‘শালা তুই শিবির’ বলে। তুলে নিয়ে যায় তারা আসিফকে। আসিফের ডাকে সারা ক্যাম্পাসের মানুষ বের হয়ে আসে। নীরবে তাকিয়ে থাকে। কিছুই করার নাই তাদের। মেরুদন্ড তারা বহু আগেই হারিয়েছে। 

আসিফের যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালে। ধীরে ধীরে মনে করার চেষ্টা করে কী হয়েছিল। পূর্ণ চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সবাই অপরিচিত। তাকে ঘিরে আছে পুলিশ। পা’টা নাড়াতেই গিয়ে বুঝতে পারে তা তার আওতার বাইরে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে সে। দূরে সে দেখতে পায় তার এক সহকর্মী। চোখে চোখে কথা হয়। প্রশান্তি অনুভব করে আসিফ। নীরবে আবার সে চোখ বুঁজে। 

মনে আসতে থাকে তার সব কথা। ঐ ছেলেটার নাম সুদীপ্ত। বাড়ি তারই এলাকা খুলনায়। সে যখন প্রথম ইউনিভার্সিটিতে আসে তখন খুলনার কোন বড় ভাইকে খুঁজছিল। সহজেই পেয়ে যায় ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ আসিফকে। আসিফ তাকে হলে উঠার ব্যাপারে সহায়তা করে। নতুন শহরে আত্মবিশ্বাস পাওয়ার জন্য যতটা সাহস দেয়ার দরকার সবটাই তাকে দিয়েছে। এরপর বহুদিন তার সময় নিয়ে দেখা বা কথা হয়নি। মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো হয়েছে। 

সেদিন সেই ছেলেটাই আক্রমণ করেছে তার উপর। সে এখন সরকার দলীয় পাণ্ডা। সে এবং তার সহকারীরা তাকে হলের একটা রুমে নিয়ে যায়। প্রথমে কোন কথাবার্তা ছাড়াই প্রায় আধাঘন্টা ধরে চললো মারপিট। অপরাধ একটাই সে বিরোধী দলীয় রাজনীতি করে। বিরোধী দলীয় রাজনীতি যারা করবে তাদের কোন অধিকার নেই ক্লাস করার বা পড়ালেখা করার। এরপর তার থেকে জানতে চাওয়া হয় তার অন্যান্য সঙ্গীদের। তারা সবাইকে খুঁজে বের করে মারবে। 

আসিফ আল্লাহকে ডাকা ছাড়া অন্য কোন কথা বলে না। এক পর্যায়ে তারা কিছুটা বিরতি দেয়। বিরতি দেয়ার কারণ তারা মারতে মারতে ক্লান্ত হয়েছে। একজনের হাত কিছুটা কেটে গিয়েছে লোহার খোঁচায়। তার হাত ব্যান্ডেজের প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে আসিফ একনজর নিজের শরীরের তাকিয়ে দেখলো। লোহার আঘাতে হাত-পায়ের সমস্ত পেশী ফেটে রক্তাক্ত হয়েছে সারা দেহ। 

সুদীপ্ত আবারো এলো জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তুই সম্বোধন করে বললো, বল তোর সঙ্গীরা কই থাকে? বল তাদের ঠিকানা। তোদের সবাইকে একসাথে পুঁতে ফেলবো। আসিফ ক্লান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, সুদীপ্ত তুমি আমাকে তুই করে কথা বলছো! তোমার কি মনে আছে যেদিন তুমি প্রথম ভার্সিটিতে এসেছিলে সেদিনের কথা? সেদিনের সেই সুদীপ্ত এত কৃতঘ্ন হবে চিন্তা করতে পারিনি। আমার সাথে তোমার কী সমস্যা? আমি কী ক্ষতি করেছি তোমার? 

সুদীপ্ত একটু পিছিয়ে এসে ভয়ানক গতিতে একটি আঘাত করে আসিফের মুখে। এরপর আর কিছু মনে নেই তার। হাসপাতালে তার দেহ নিয়ে ডাক্তাররা পরীক্ষা নীরিক্ষা চালাচ্ছে। জানা গেল দুই পায়ে চারটি স্থানে ভেঙে গিয়েছে। বাম হাত গেঙ্গে গিয়েছে। ডান হাতের পেশী ফেটে গিয়েছে। সেলাই দিতে হবে। মাথা থেতলে গিয়েছে, সেখানেও সেলাই লাগবে। আসিফের মনে হলো তার পুরো শরীর একটি বিষের টুকরো। 

সেদিন তাড়াতাড়িই ঘরে ফিরলেন ড. শাহীদুল। তার প্রতিষ্ঠানে সেদিন কাজ খুব একটা ছিল না। শরীরটাও ভালো লাগছে না। বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া সবে মাত্র গা’টা এলিয়ে দিয়েছেন অমনি একটি ফোন এল। অজানা কারণের বুকটা কেঁপে উঠলো তার। কেন জানি মনে হল কোন এক দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসছে এই কলটি। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন নাম্বারটা অপরিচিত। রিসিভ করতেই শুনলেন একজন লোক কেঁদে কেঁদে বলছে, 

- স্যার আমনে কই? আমনে কই স্যার। আসিফ বাইরে মারি হালাইছে। এতক্ষনে মনে অয় আর বাঁচি নাই।

- তুমি কে? 

- আমি রফিক স্যার, রফিক। বাবুর্চি। 

চিনতে পেরেছেন শাহিদুল সাহেব। পুরো ঘটনা জেনে নিলেন রফিকের কাছ থেকে। ভয় পেতে শুরু করলেন তিনি, এতক্ষনে চার ঘন্টা হয়ে গেছে। আল্লাহই জানেন বেঁচে আছে কিনা। 

সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেননি শাহীদুল সাহেব। যত যাই হোক সে পরে দেখা যাবে। আগে পুলিশ দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হবে। তিনি এবং তার আরো কিছু কলিগ দিয়ে থানায় ফোন করলেন। দ্রুত উদ্ধার করার জন্য বললেন। পুলিশের যেতে দেরী হওয়ায় শাহীদুল সাহেব নিজেই থানায় গেলেন। পুলিশকে বার বার রিকোয়েস্ট করলেন। সরকার দলীয় লোকদের শিকারকে ধরতে রাজি হয় না পুলিশ। অবশেষে ঘুষের অফার দিয়ে পুলিশ পাঠালেন শাহীদুল সাহেব। 

অবশেষে পুলিশ আসিফকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসলো। তাকে গ্রেপ্তার দেখালো। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করলো পুলিশ। শাহীদুল সাহেব তারপরও খুশি। অন্তত বেঁচে তো ফিরতে পেরেছে। 

চিকিৎসা চলছে মোটামুটি ভালোভাবেই। যে ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে সে ওয়ার্ডের ডিউটি ডক্টর তারই বন্ধু। আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলো সে। দুই পা এক হাত প্লাস্টার করা, অচল একটা মানুষ। এর মধ্যেও তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে হাসপাতালের বেডের সাথে। কেমন অমানবিক! এই দৃশ্য দেখে ড. শাহীদুল মন্তব্য করলেন, এদেশ থেকে মানবতা বহু আগেই চলে গিয়েছে। আজ তার ফিরে আসার পথ রুদ্ধ হলো। এর প্রতিশোধ হবে। শোধ- প্রতিশোধ আগুনে পুড়ে খাক হবে বাংলাদেশ। 

অসুস্থ পঙ্গু এই মানুষটার বাঁধন খুলে দেয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে লাগলেন। বার বার রিকোয়েস্ট করছেন পুলিশ সদস্যদের। উপস্থিত পুলিশরা তাদের অপারগতা স্বীকার করলো। এক পর্যায়ে উচ্চপদস্থ পুলিশ এলো। শাহীদুল সাহেব তাকে রিকোয়েস্ট করলো। সে রিকোয়েস্ট আমলে নেয়া তো দূরের কথা উল্টো একজন আসামীর জন্য তদবির করায় অপমান করতে লাগলেন। হুমকি দিলেন তাকেও গ্রেপ্তার করার। 

আসিফ কথা বলে উঠলো। বললো, স্যার আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি তো এমনিতেই নড়তে পারি না। বাঁধলে কি না বাঁধলেও কি? হাল ছেড়ে দিয়ে ড. শাহীদুল দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন আসিফের দিকে। দুই চোখে ঝরছে অবিরল ধারা। 

একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন। উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একবার ক্ষেপে গেল আসিফ। বললো আপনারা আমার পরিচয় নিচ্ছেন, ঠিকানা নিচ্ছেন। আমি কি করি জানতে চাইছেন। একবারও কি আমাকে প্রশ্ন করেছেন কারা তোমাকে মেরেছে? তাদের বাড়ি কই? তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন? মার খেলাম আমি। গ্রেপ্তার করলেন আমাকেই। অথচ যারা আমাকে মারলো তাদের ব্যাপারে আপনাদের কোন জিজ্ঞাসা নাই। এটা কেমন বিচার আপনাদের? 

পুলিশ কর্মকর্তা জবাব দিল, এটাই বিচার। এটা আমাদের দেশ। এখানে তোদের স্থান নেই। তোরা হয় মরে যাবি না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবি অথবা জেলে থাকবি। 

সাত মাস পরের কথা। সবে কারাগার থেকে বের হলো আসিফ। মোটামুটি সুস্থ হয়েছে সে। শাহীদুল সাহেব তাকে সোজা নিয়ে আসলেন তার বাসায়। বললেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা আপাতত বাদ দাও। তুমি আমাদের স্কুলে বাচ্চাদের পড়াও। একদিন তারা দুজনে বের হলেন স্কুলের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলেন বদরুদ্দোজা সাহেবকে। কিছুক্ষণ পর পর পিঠে হাত দিচ্ছেন আর বলছেন মেরুদন্ড নাই। নাই, মেরুদন্ড নাই। 

অবাক দৃষ্টিতে আসিফ তাকালো শাহীদুল স্যারের দিকে। স্যার বললেন প্রচন্ড মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে গেছেন। 

- মানসিক চাপ? কেন? 

তুমি এরেস্ট হওয়ার পনের-বিশ দিন পরের কথা। সুদীপ্ত আর কিছু ছেলে মিলে তুলে নিয়ে যায় তার মেয়েকে। লাঞ্ছিত করা হয়। বোনকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিহত হয় তার একমাত্র ছেলে।