২৫ ফেব, ২০১৮

পিলখানা ট্রাজেডিঃ বাংলাদেশ যেদিন হেরে গেল



২০০৯ সালে ঢাকার পিলখানায় দেশের ৫৭ জন চৌকস সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যা কি শুধুমাত্র  বিডিআর জওয়ানদের ডাল ভাত কর্মসূচীর অপ্রাপ্তি থেকে তাৎক্ষনিক ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ? এটা কি স্রেফ একটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? নাকি অতীতের কোনো ঘটনার যোগসূত্র থেকে এই নির্মম ট্রাজেডির প্রকাশ্য দিবালোকে মঞ্চায়ন? এতদিনেও এসব প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়নি অথবা কোন গোষ্ঠীর কারণে সুরাহা করা হয়নি।

এই ঘটনার পর তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ওইসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জাতিকে জানানো হয়নি। তবে ওই তিনটি কমিটির একটি কমিটির সুপারিশে রাতারাতি একটি ঐতিহ্যবাহী আধা সামরিক বাহিনীর পোশাক এবং নাম পাল্টে ফেলা হয়। আর কোনো দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আমরা দেখিনি। অথচ ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের ওই ঘটনা ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্যতম, নির্মম, নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও সেনাবাহিনীর এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা নিহত হননি। অথচ এক সকালেই আমরা হারালাম আমাদের সেনাবাহিনীর ৫৭জন চৌকস এবং মেধাবী কর্মকর্তাকে। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হল সেনাবাহিনীর।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআরে কর্মরত কর্মকর্তারা কারো জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কি না অথবা কারও জন্য হুমকি ছিল কি না সেটা তাৎক্ষণিক ও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যেকোনো হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেহেতু উদ্দেশ্য (মোটিভ) থাকতে বাধ্য, তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে কার পক্ষ থেকে কী মোটিভ থাকতে পারে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। এখানে কিছু অফিসার ছিলেন যাদের সাথে বিডিআরের বিক্ষোভের কোন কারণ ছিল না। এমন একজন ছিলেন কর্নেল গুলজার। অথচ তাদের উপর ক্ষোভ ঝাড়া হয়েছে অনেক বেশি। তার দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তার চেহারা বিকৃত করে ফেলা হয়েছে।   

সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের এতগুলো কর্মকর্তাকে একসাথে হত্যা কোনো কাকতালীয় ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। ৬৩জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেধা ও সক্ষমতাকে করা হয়েছে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ। পিলখানার ঘটনা যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেবার জন্যই যে ঘটানো হয়েছিল তা আজ দিবালোকের মতই স্পষ্ট। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্র। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে এটা এক ধরণের প্রতিশোধও বটে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধে ১৫০ জন বিএসএফ নিহত হয়। এর আগে পাদুয়ায় নিহত হয় ১৫ বিএসএফ। বিডিআর সেই সময়ের ডিজি মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানের নির্দেশে ঐ যুদ্ধে অংশ নেয় বিডিআর জওয়ানরা।

ওই ঘটনার পর ভারতের সেই সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান, ‘এ ঘটনার বদলা নেয়া হবে।’ এই বদলা কি সেই বদলা কিনা তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ওই ঘটনা দমনে কেন সেনাবাহিনী ডাকা হলো না এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। অনেক সাবেক সমর বিশেষজ্ঞ তখন বলেছিলেন, সেনাবাহিনী সেখানে মুভ করা হলে প্রাণহানির মত ঘটনা আরো কমানো যেত। কিন্তু সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সেই সময়ের আলোচিত সেনা প্রধান মইন উ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তখন তিনি নাকি নিজের ইচ্ছায় চাইলেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাহলে ইচ্ছাটা কার ছিল? এটাও একটা বড় প্রশ্ন হিসেবেই থেকে গেল।  

সম্প্রতি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির লিখা একটা বইতে তিনি বলেছেন, জেনারেল মঈনকে হাসিনার নিরাপত্তা ও মুক্তি দিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি বিনিময়ে তার জীবনের ও চাকরীর জিম্মাদার হওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। এই সব ঘটনা একত্র করলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।   

ওই ঘটনায় সেনা কর্মকতাদের যেভাবে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা দেখে যে কারো মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে জওয়ানরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন অফিসারদের প্রতি। কিন্তু দীঘদিনের একটা পেশাদার ও শৃঙ্খল বাহিনীর জওয়ানরা যতই কথিত বৈষ্যম্যের স্বীকার হলেও এভাবে তাদের অফিসারদের প্রতি জিঘাংসা চরিতার্থ করবে এটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয় ঘটনা। শুধু কি তাই! পিলখানায় তখন অবস্থান করা অনেক নারী শিশুই সেদিন পাশবিকতার শিকারও হয়েছিলেন। একটি প্রচলিত বাহিনীর একজন সৈনিক দ্বারা ঘটা একেবারেই ব্যতিক্রম প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ কি জওয়ানরা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল?
দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান একজন জেনারেল সহ একাধিক ব্রিগেডিয়ার, কর্ণেল, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদবীর অফিসারকে হত্যা করা সত্বেও উক্ত হত্যাকারীরা সরকারের তরফ থেকে সাধারন ক্ষমা লাভ করে। সরকারের হাতে সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার কমান্ডো, ট্যাংক, এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ইত্যাদি মজুদ থাকা সত্বেও রহস্যজনক কারনে সেনাবাহিনীর এতগুলো অফিসারকে রক্ষা করার জন্য কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা না করা কতখানি যৌক্তিক বা সঠিক হয়েছে তা অনেক বড় প্রশ্ন হিসেবেই থাকছে। 

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল তা যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর চরম আঘাত তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। ওইদিন বিডিআর সদর দফতরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে যে বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে ত সহজে পূরণ হবার নয়। পিলখানার মত সুরক্ষিত এলাকায় নির্মমভাবে প্রাণ হারালেন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। 

শুধুই ডাল-ভাতের জন্য বিডিআর জওয়ানরা এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল,  এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। জওয়ানরা ছিল নিমিত্ত মাত্র। এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে দেশি- বিদেশী চক্রান্ত কাজ করেছে। ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এমনটা ইংগিত করা হয়েছে। 

সেদিন যা ঘটেছিল? 
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল নয়টায় সদর দপ্তরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ৫৬০ জন।

দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে সকাল নয়টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।

এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তাঁরা মাইকে জানায়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।

আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তাঁরা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।

২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।

মামলার বিচার
পিলখানা বিদ্রোহের পর বদলে গেছে অনেক কিছু-বাহিনীর নাম, পোশাক, আইন। ১৭ হাজারের বেশি জওয়ানের সাজা হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন সাড়ে ১৪ হাজার। হত্যা মামলায় আসামি করা হয় ৮৫০ জনকে। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় এই হত্যা মামলার বিচার শেষে বিচারিক আদালত রায় দেন ২০১৩ সালে।
এরপর হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর হাইকোর্ট রায় দেন গত বছরের নভেম্বরে। তাতে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদুল আলমসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ১৮৫ আসামিকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যাঁদের মধ্যে ৩১ জন বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস পেয়েছিলেন। হাইকোর্টের রায়ে ৪৫ জন সাজা থেকে খালাস পান। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল ও দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় আরও ২০০ আসামিকে।

এর মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। তবে হত্যা মামলার বিচার এগোলেও ওই ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলাটির বিচার এখনো শেষ হয়নি। এটি এখন সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে।

হত্যা মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম জাহিদ সারওয়ার বলেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন থেকে খালাস পাওয়া আসামিদের ক্ষেত্রে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৪ আসামি পলাতক রয়েছেন। ৫৮৮ আসামি কারাগারে আছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের সাজা হয় বাহিনীর নিজস্ব আইনে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রত্যেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর বেকসুর খালাস পাওয়া ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন।

বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বলেন, এই বিদ্রোহের পেছনে আসলে কারা ছিল, কারা এসব করল-তা এত দিনে মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়নি। তিনি বলেন, শুধু কি জওয়ানেরা গুলি করেছিল? কারা তাদের পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়ল? এসব নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। তা যদি ভুল হয় তা হলে সরকারের দায়িত্ব সেই ভুল সংশোধন করে দেওয়া। তা না হলে দিনে দিনে সেই ভুলই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর পুরো বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়। বিডিআর নাম পাল্টে করা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সরকারি সহায়তাও পায় নিহত কর্মকর্তাদের পরিবার। তারপরও স্বজনহারাদের মনের ক্ষত কোনো দিন মুছে যাওয়ার নয়।

এক নজরে বিচারিক আদালতের রায়
ঘটনা: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিহত: ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন 
রায়: ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর 
দণ্ড: ১৫২ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ১৬১ জনের। ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা ২৫৬ জনের। খালাস ২৭৮ জন। সর্বমোট সাজা ৫৬৮ জনের।

নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে, ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। হাইকোর্ট ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিনে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

একনজরে হাইকোর্টের রায়

রায়: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ 
দণ্ড: ফাঁসি বহাল ১৩৯ জনের, যাবজ্জীবন ১৮৫ জনের, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস ৪৫ জন।

যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও মেলেনি 
১- ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল আটটায়। কিন্তু কেন দরবার এক ঘণ্টা পিছিয়ে সকাল নয়টায় করা হয়, তা আজও অজানা।

২- ঘটনার সময় দরবারে থাকা একটি ভিডিও ক্যামেরার কথা সাংবাদিকদের বলেছিলেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু ক্যামেরাটি উদ্ধার হয়নি।

৩-বিদ্রোহের সময় প্রথম যে অস্ত্রটি নিয়ে সিপাহি মঈন দরবারে এসেছিল, তা শনাক্ত হয়নি।

৪-বিদ্রোহের সময় সেনা সদস্যরা পিলখানায় এসে গুলি ছুড়েছিলেন বলে সেনাবাহিনীর তদন্তে বলা হয়েছিল। কিন্তু মামলার তদন্তে তা আসেনি।

৫-তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সাক্ষ্য দেননি।

৬-অনেক সেনা কর্মকর্তা ঘটনার পর গণমাধ্যমের সামনে নানা বিষয়ে কথা বললেও তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি

৭- ঘটনা ঘটার পর প্রায় ১০০ জন সেনা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কেন? 

৮- ২৫ ফেবু্রয়ারি সকালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি গোয়েন্দা তথ্য পাঠানো হয়েছিল? এই ঘটনার আভাস কি ডিজিএফআই পায় নি?

৯- বিডিআরের প্রয়াত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ কি কথা হয়েছিল? 

১০- প্রধানমন্ত্রী কেন ২৬ ফেবু্রয়ারির ডিনারে যেতে অস্বীকার করেছিলেন? 

১১- ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি কার নির্দেশে বিডিআর হেডকোয়ার্টারের আশপাশের লোকজনকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়েছিল? 

১২- ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কেন লে. কর্নেল মুকিত বিডিআর সদর দফতর থেকে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়েছিলেন?

১৩- বিডিআর সদর দফতরের ৫ নম্বর গেটে সেদিন কেন পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়নি? 

১৪- প্রধানমন্ত্রী কেন ঘটনা জানার ৪ ঘণ্টা পর নানক এবং আজমকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন? অথচ এটা কোন রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না। এটা ছিল একটা সামরিক সমস্যা।

১৫- বিডিআর বিদ্রোহীদের যে প্রতিনিধিদলটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তাদের নাম-ঠিকানা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢোকার সময় কেন সংরক্ষণ করা হয়নি? 

১৬- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিদ্রোহীদের নেতা ডিএডি তৌহিদ জানিয়েছিলেন বিডিআর ডিজিসহ কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে-এ বিষয়টি কেন ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত গোপন করা হলো? 

১৭- বাংলাদেশ টেলিভিশন সেদিন বিদ্রোহের ঘটনা কেন প্রচার করেনি? কার নির্দেশে?

১৮- বিদ্রোহীরা কেন প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের নেত্রী বলে উল্লেখ করেছিল?

১৯- কিছু বিদ্রোহী কেন আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান 'জয় বাংলা' বলে স্নোগান দিয়েছিল?

২০- প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ২৭ ফেবু্রয়ারি কেন পালিয়ে যাওয়া কিছু বিদ্রোহীর সঙ্গে দেখা করতে দুবাই এসেছিলেন? 

২১- আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জয় কেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করলেন? 

২২- প্রধানমন্ত্রী বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিলেন না? 

২৩- ২৬ মার্চ আত্মসমর্পণের পর রাতের অন্ধকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য নেতা কেন বিডিআর সদর দফতরে গিয়েছিলেন?

২৪- ঘটনার দিন সকাল ১০টায় র‍্যাব ও সেনাবাহিনী পিলখানা গেইটে গেলেও কেনো তাদের অপারেশনের অনুমতি দেওয়া হয়নি?

২৫- বিকালবেলা আর্মি এবং এয়ারফোর্স ধানমন্ডি অবস্থান করলেও কেনো তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়? অথচ তখনো অপারেশন চালানো হলে কিছু অফিসার রক্ষা পেত। আর না হলেও অন্তত মূল অপরাধীদের সনাক্ত করা যেত। 

২৬- তৎকালীন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ভুমিকা কি ছিল? সারাদিন কোন ভূমিকা না নিলেও কেনো সন্ধার পর বাতি নিভিয়ে কালোগ্লাসের বুলেটপ্রুফ গাড়ী আর মেডিক্যাল টিম নিয়ে প্রবেশ করেন? 

২৭- কেন এতগুলো চৌকস অফিসারকে একসাথে এখানে জড়ো করা হলো? জেনারেল মঈনের অপকর্মের সাক্ষী অফিসারগুলিকে একসাথে গণকবর দিতেই কি এই উদ্যোগ? 

২৮- শেখ হাসিনার যখন সেনা অফিসাররা যখন মুখোমুখি হয়েছিল তখন কর্নেল জামান বলেছিলেন, “১৬৮আর্মি অফিসার
বেরিয়ে আসতে পারলাম না, ৯ হাজার বিডিয়ার সৈন্য আপনাদের পাহারা থেকে বেরিয়ে আসলো কিভাবে”?-

এতগুলো অসঙ্গতি থাকায় এই মামলা ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে এর সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশ এবং সরকারের একটা অংশ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার সার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি কখনোই হয়নি। আজও সরকার এই ট্রাজেডিকে নিয়ে একেবারে নীরব। কথা বলেও দায়সারাভাবে। তবে জনগণ মনে করে সরকারের পরিবর্তন হলে এই ট্রাজেডির ধোঁয়াশা কেটে যাবে। সত্য উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশ তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে পারবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন