৩০ মে, ২০১৮

তারা মসজিদের আঙিনা থেকে



ঢাকা মসজিদের শহর। একথা কে না জানে? কিন্তু ঢাকা লিখে গুগোলে ইমেজ সার্চ করলে কিন্তু সেকথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনো বিদেশি যদি ঢাকা নিয়ে জানতে চায় ইমেজের মাধ্যমে তবে বুঝতেই পারবে না ঢাকা মুসলিমদের শহর। মসজিদের শহর তো পরের কথা।

আমার কাছের একজন শখের ফটোগ্রাফার এই নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বললেন, ভাই সুযোগ করে আমরা একেকদিন একেক মসজিদে জুমার নামাজ পড়বো। এতে মসজিদগুলোর সাথে পরিচিত হবো। সাথে কিছু ছবিও তুলে নিতে পারবো। এরপর তার নাকি সেই ছবিগুলো নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা আছে।

সে যাকগে, আমার এত পরিকল্পনা নাই। আমি যাই তার সাথে। ঘুরতে আমার ভালোই লাগে। তবে সমস্যা হলো বেকার মানুষ তো, তেরো কোম্পানির কাজ করতে হয়। তাই অবসর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারপরও চেষ্টা করি।

কয়েক দিন আগে প্ল্যান করেছি তারা মসজিদে যাব। ঢাকার তারা মসজিদ। অনেক পুরনো। উইকি-টুইকি সার্চ করে করে কিছু ইনফো জেনে নিলাম। গুগোল ম্যাপ থেকে জেনে নিলাম ঠিকানা। ব্যাস সব প্রস্তুতি শেষ। এবার মানিব্যাগে ঢুঁ মেরে দেখে নিলাম কী অবস্থা। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সিকি আধুলি সব মিলে একশ বিশ টাকা। এটা দিয়ে তো হবে না। কারণ সুন্দর করে মাঞ্জা মেরে বের হবো ভাবছি।

এখন যদি লোকাল বাসে যাই তবে ফিটফাট পোশাকের বারোটা বেজে যাবে। তাহলে? যাই হোক যেতে হবে। কারণ আমার কাছে টাকা পয়সার চাইতে সময় আরো দুর্লভ। তাই দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম। মনে মনে ভাবছি আরেকজনের পকেটের কুরবানী করে আজ পার হয়ে যাবো।

শুনেছি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পরবর্তিতে কিছু বিজ্ঞ গবেষক জানালেন না, তা নয়, শেষ স্বাধীন নবাব হলেন মীর কাসিম। তিনি স্বাধীনভাবে চলতে গিয়ে ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে উপনীত হন। অবশেষে মারা পড়েন। কিন্তু আমি জানি এসব কিছুই সঠিক নয়। বাংলার স্বাধীন নবাবরা আজো আছেন। বীর বিক্রমে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ান। তারা হলেন সিএনজি ড্রাইভার। আপনি যেখানেই যাবেন তারা তাদের ইচ্ছেমত ভাড়া দাবী করে নবাবী হালে উদাস হয়ে চেয়ে থাকবেন। আপনার ইচ্ছে হলে যাবেন না হলে হাঁটবেন।

নিজের পকেটের যা অবস্থা তা দিয়ে নবাবের গাড়িতে উঠাতো দূরস্থান, নবাবের পায়ের ধূলোও কিনতে পারবো না। ইঙ্গিতে বুঝালাম সঙ্গীদের আমার অবস্থা সঙিন।

আমরা মোটে তিনজন। সবাই হাঁটছি। হঠাৎ বৃষ্টির দেখা পেলাম। সবাই তো খুব অবাক। যদিও কিছুদিন ধরে বৃষ্টিকে কামনা করছিলাম। কিন্তু তাই বলে এখন পবিত্র হয়ে মসজিদে যাচ্ছি। এখন তো তার আসা উচিত হয়নি। মুখটা পাংশু করে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু জানেনইতো আমার ভারী শরীর। এই নিয়ে পালানো সহজসাধ্য নয়।

বৃষ্টির অত্যাচারে বিশ মিনিট ধরে আটকে আছি। সঙ্গীদের একজনকে দেখলাম মোবাইল গুতাচ্ছে। বললো উবার কল করতেছি। আজকে গাড়িতে করে যাবো। আমি দরিদ্র মানুষ। গাড়ি টাড়ি দেখলে কী করতে গিয়ে কী করে ফেলি এই ভয়ে এসব উবার টুবারে কাছে ঘেঁষি না।

বললাম ভাই আমারে বেচলেও গাড়ি ভাড়া হবে না। বাদ দেন। সে আমার মতন ভীরু কিসিমের না। সাহসী মানুষ। বললো, আরে দেখেন না কারবার! দেখতে দেখতে বৃষ্টির মধ্যে একটি গাড়ি এসে হাজির। ঝটপট উঠে পড়লাম। আমাদের মত অনেকেই বৃষ্টির ভয়ে আড়াল হয়ে ছিল। গটাগট করে তিনজন গাড়িতে উঠতে দেখে মুখটা করুণ হয়ে গেলো অনেকের।

বেশ ভাব নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মানুষ দরিদ্র হলে কী হবে! ভাবের কমতি নেই। গাড়িতে উঠার পর বৃষ্টির তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। ভাব-সাব বাদ দিয়ে নাকটা গুঁজে দিলাম গাড়ির কাঁচে। আহা কী শান্তি বৃষ্টি যেন এসে পড়ছে আমার মুখে।

অপর সঙ্গীদ্বয় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি ছবি-টবি ভালো তুলতে পারিনা। তাই ওসবে নাই আমি। আমি বৃষ্টি উপভোগ করছি গাড়িতে বসে। গাড়ি এগিয়ে চললো গুলিস্তান-বংশাল হয়ে তারা মসজিদ পানে।

বেশ উপভোগ করে এলাম। কিন্তু এখন গাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় হয়েছে। আমি ভাবতেছি না জানি কত টাকা বিল এসেছে। দেখলাম আমার সঙ্গী মাত্র ৬০ টাকা দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আমি হা করে রইলাম!

সে বললো উবার ৭০% ডিসকাউন্ট দিয়েছে। তাইতো অভাবের দিনে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াই। মনে মনে খুশি হলাম। যাক এবার তাহলে বিদেশী বেনিয়া উবার ঠিকই দেশীয় স্বাধীন নবাবদের নবাবী ছুটিয়ে দিবে। বুঝলাম এমনই কোন কারণে হয়তো মুর্শিদাবাদের জনগণ সিরাজের পতন উপভোগ করেছিলো।

মসজিদে ঢুকেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কী সুন্দর উঠান। সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো। সেখানে বড় করে একটি কংক্রিটের তারা অবস্থান করছে। লোকজন চাইলে সেখানে বসে বিশ্রামও করতে পারে। মসজিদের বাইরের চাইতেও ভিতরের কারুকাজ আমাকে বিমোহিত করেছে। খুব বড় মসজিদ নয়। তবে যত আগের মসজিদ তত আগে এই মসজিদই যে সবচেয়ে বিশাল স্থাপনা ছিল সেটা সহজেই অনুমেয়।

সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। বিভিন্ন সুত্র থেকে ইতিহাসবিদেরা অনুমান করেন, আঠারো শতকে ঢাকার 'মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ'-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর। যার আসল নাম মির্যা আহমদ জান। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ‌মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে।

পুরাতন তারা মসজিদ বর্তমান তারা মসজিদের ন্যায় নকশালংকারে সমৃদ্ধ ছিল না। মসজিদের পিছনের ভগ্ন ও নগ্ন দেয়াল সেই সাক্ষ্য বহন করছে। এ মসজিদের দরজাগুলির মধ্যে দক্ষিণ দিকের তিনটি দরজাই প্রাচীন। ১৯২৬ সালে আলীজান ব্যাপারী বহু অর্থ ব্যয় করে মসজিদটির পূর্বপার্শ্বে বারান্দা সংযুক্ত করে মসজিদের আকৃতি বৃদ্ধি করেন। এতে কেবল প্রস্থের দিক বর্ধিত হয়। চারটি স্তম্ভ ও পাঁচটি খিলানে মসজিদের সম্মুখভাগ গঠিত হয় এবং প্রস্থে ৩.৯৯ মিটার সম্প্রসারিত করায় তারা মসজিদের প্রস্থ দাঁড়ায় একেবারে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭.৯৮ মিটার। এ সময়ের সম্প্রসারণে মসজিদের মূল ভূমিনকশায় কোনোরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে বিভিন্ন নকশার রঙিন চকচকে টালির সংযোজন করা হয়।

১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজের তারা মসজিদকে পাঁচ গম্বুজের মসজিদে রূপান্তর করা হলে মসজিদটি দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য প্রস্থে কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয় নি। বর্তমানে সম্প্রসারিত মসজিদের দৈর্ঘ্য ২১.৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৯৮ মিটার। পাঁচ গম্বুজের মসজিদে পরিবর্তন করার প্রয়োজনে একটি মিহরাব ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং দুটি নতুন গম্বুজ ও তিনটি নতুন মিহরাব যুক্ত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্ট করা হয়েছে। এ খিলানগুলি বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ হতে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা।

মসজিদের গায়ে চিনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহূত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরী’বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের দেয়ালকে অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। প্রায় বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলিতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।

জুমার নামাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন বার বার ফিরে তাকিয়েছি। ছেড়ে যেতে একদম ইচ্ছে করছিলো না। তারা মসজিদ আমার মন কেড়েছে। আমি নিশ্চিত আপনাদেরও মন কাড়বে।

কীভাবে যাবেন? 
ভ্রমণ বর্ণনা লিখলে একথা অবশ্যই লিখতে হয় সেখানে কীভাবে যেতে হবে? তবে এসব ধারণা পুরাতন হয়ে গেছে। এখন এগুলোর প্রয়োজন পড়ে না। আপনি গুগোল ম্যাপে যাবেন। তারা মসজিদ লিখে সার্চ করবেন। আপনাকে দেখিয়ে দিবে আপনার বাসা থেকে আপনি কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে সেখানে যাবেন। সুতরাং এসব কথা বলে লিখার দৈর্ঘ্য আর বাড়াতে চাই না।

২৭ মে, ২০১৮

শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী: উম্মাহর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান



আজ উপমহাদেশের একজন শহীদের কথা বলবো। তার নাম বুরহান। বুরহান মানে প্রমাণ, দলিল। পুরো নাম বুরহান উদ্দিন। দ্বীনের প্রমাণ। নিজের জীবন দিয়ে ইসলামের জন্য নিজেকে প্রমাণ করলেন প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানী।

আফগানিস্থানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাদাখশানে মুহাম্মদ ইউসুফের ঘর আলো করে ১৯৪০ সালে জন্ম হয় বুরহানউদ্দিন রব্বানীর। আফগানিস্তানে ভাষাভিত্তিক দুটো বড় জাতি রয়েছে। এক পশতুন, দুই তাজিক। বুরহানউদ্দিন রব্বানী ছিলেন তাজিক ভাষাভাষী মানুষ।

বুরহানউদ্দিন রব্বানী তার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা তার প্রদেশেই শেষ করেন। এরপর তিনি পড়াশোনা করেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে ইসলামিক আইন ও ধর্মতত্ত্বে তার গ্রেজুয়েশন শেষ করেন। এরপর তিনি আরো উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্য চলে যান মিশরে, কায়রো আল আযহার ইউনিভার্সিটি। সেখানে তিনি পরিচিত হন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে। কাজ করতে থাকেন তাদের সাথে। সেই সাথে ইসলামিক দর্শনের উপর মাস্টার্স কমপ্লিট করেন।

এটা সেই সময়ের কথা যখন এই উপমহাদেশে কমিউনিস্টদের উত্থান হচ্ছিল। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত সব স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ মেধাবী ছাত্ররা এদের ফাঁদে পা দেয়। পাকিস্তানে কমিউনিস্টরা নিষিদ্ধ থাকলেও তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আড়ালে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। সবচেয়ে বেশি কমিউনিস্ট ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগে। ভাসানী, তাজউদ্দিন এসব নেতারা ছিল ছদ্মবেশি কমিউনিস্ট।

সেসময় কমিউনিস্টরা ইসলামপন্থীদেরও বেশ ভালোভাবে বিভ্রান্ত করেছে। পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরা ইসলামী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠা করে খেলাফতে রব্বানী নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাদেরই সাংস্কৃতিক উইং এর নাম তমুদ্দুনে মজলিস।

যাই হোক সেই সময়ে বুরহানউদ্দিন রব্বানী তার কলম ধরেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। তখন রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় ছিল। আর রাশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি। আফগানিস্তানের পাশেই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের প্রভাবে আফগানিস্তানের যুব সমাজ কমিউনিস্ট হতে শুরু করেছে দেদারছে। তখন বুরহানউদ্দিন আফগানিস্তানে মানুষ ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। লেখালিখি করেন। কমিউনিস্টদের প্রকৃত রূপও তিনি আফগানিস্তানের মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। সেই থেকে তিনি কমিউনিস্টদের শত্রুতে পরিণত হন।

তিনি এর জন্য মিশরের আরবী ইসলামী সাহিত্যগুলো ফার্সি ভাষায় রূপান্তর করতে শুরু করেন। তিনি প্রথন ব্যক্তি যিনি ফি যিলালিল কুরআনসহ সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের সমস্ত কাজ ফার্সিতে ভাষান্তর করেন। যাতে ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মুসলিমরা ইসলামের সঠিক রূপ অনুধাবন করতে পারেন।

তিনি পিএইচডি করার জন্য আবারো মিশরে যান। তিনি গবেষণা করেন ফার্সি কবি জামিকে নিয়ে। বুরহানউদ্দিন রব্বানীর পিএইচডি'র শিরোনাম ছিল, "The Philosophy and Teachings of Abd al-Rahman Muhammad Jami."

ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে ইসলামপন্থীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলেন শতাব্দির অন্যতম মুজাদ্দিদ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী। বুরহানউদ্দিন নিজেও ভক্ত হয়ে পড়েন। তিনি দেখা করেন মাওলানা মওদুদীর সাথে।

১৯৬৮ সালে বুরহানউদ্দিন রব্বানী আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। তখন মাওলানা মওদুদী তাঁকে আফগানিস্তানের ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব দেন। একই সাথে তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেন। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট বিরোধী লেখালিখি ও বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান হয়ে উঠেন। চার বছরের মাথায় বুরহানউদ্দিন রব্বানী মোটামুটি একটি বড় মুসলিম কমিউনিটিকে একত্রিত করতে সক্ষম হন।

১৯৭২ সালে জমিয়তে ইসলামী আফগানিস্তান গঠন করা হয় তাঁর নেতৃত্বে। আফগানিস্তানের উচ্চারণে সেটা জামায়াতে ইসলামী জমিয়তে ইসলামী হয়ে যায়। আফগানিস্তান জামায়াতের প্রথম আমীর বুরহানউদ্দিন রব্বানী, সেক্রেটারি সাইয়্যেদ নুরুল্লাহ ইমাদ। আরো গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন, উস্তাদ যাবিউল্লাহ, আহমদ শাহ মাসউদ, ইসমাইল খান, আতা মুহাম্মদ নূর, মোল্লা নকীব, ড. ফজলুল্লাহ, গুলুবুদ্দিন হেকমতিয়ার প্রমুখ।

১৯৭৩ সালে আফগানিস্তানের রাজা ছিলেন জহির শাহ। সেসময়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণমানুষের ক্ষোভ দেখা যায়। এই গণবিক্ষোভ মূলত কমিউনিস্টদের সৃষ্টি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর দাউদ খান ১৯৭৩ সালে ক্যু করেন এবং রাজতন্ত্রের অবসান ঘটান।

১৯৭৪ সালে মুসলিমদের সংগঠিত করার অপরাধে বুরহানউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে দাউদ খান। দাউদ খানের আমলে আসলে আফগানিস্তানের কেউ খুশি হতে পারেনি। সে একই সাথে বামপন্থী ও ইসলামপন্থীদের নির্যাতন করে। সে ছিল স্বৈরাচার।

১৯৭৫ সালে জামায়াতের পশতুন নেতা গুলুবুদ্দিন হেকমতিয়ার পশতুন নেতাদের নিয়ে জামায়াত ত্যাগ করে। জাতিগত কোন্দল করে বেরিয়ে পড়েন তিনি। মূলত তার কোন্দল হয় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন সয্‌মান-ই জোওয়ানান-ই মুসলমান (Organization of Muslim Youth)- এর সভাপতি আহমদ শাহ মাসউদের সাথে। তাকে হত্যারও চেষ্টা করেন গুলুবুদ্দিন। অবশেষে তিনি হিজবে ইসলাম নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে আরেকটি ক্যু হয়। সেই ক্যু এর ফলে ক্ষমতায় চলে আসে বামপন্থীরা। বামপন্থী নেতা ড. নাজিবুল্লাহ ক্ষমতায় আসেন। নাজিবুল্লাহ ক্ষমতায় এসেই ইসলামপন্থীদের উপর দমন পীড়ন শুরু করে।

নাজিবুল্লাহ সমাজতন্ত্রের বিস্তার এবং সেভাবে নীতি নির্ধারণ করতে চাইলে দেশের ইসলামি দলগুলোর সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ-সময় সমাজতন্ত্রী সেনাদের হাতে সারাদেশ পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ নিহত হয়। ১৯৭৯ সালে ২৪ টি প্রদেশে সংঘাত শুরু হয়। অর্ধেকের বেশি সৈনিক সেনাবাহিনীর থেকে পালিয়ে যায়। ৬ই জুলাই বুরহান উদ্দিনের নির্দেশে আহমদ শাহ মাসউদ পানশিরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সম্মুখ যুদ্ধে সফল না হয়ে তারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এ-বছরেই ২৪ শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সেনা প্রেরণ করে। সরকারবিরোধীদের তারা নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে।

জমিয়তের নেতৃত্বে মুজাহিদিন গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজাহিদিন গ্রুপের প্রধান আহমদ শাহ মাসউদ সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেন। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করে। তারপরও নাজিবুল্লার সরকার মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। আহমদ শাহ সরকারবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখেন। দেশে চরম দুরাবস্থা বিরাজমান রেখে ১৯৯২ সালে ১৭ই এপ্রিল এ-সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করে। ২৮ এপ্রিল অন্তবর্তীকালীন ইসলামিক সরকারের প্রধান হন সিবঘাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী।

২৪ শে এপ্রিল পেশোয়ারে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় সমাজতন্ত্রবিরোধী দলগুলোর মধ্যে শান্তি ও ক্ষমতাবন্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়। দলগুলো হলো জমিয়তে ইসলামী (বুরহান উদ্দীন রব্বানী), হিজব-ই-ইসলামী (গুলবুদ্দীন হিকমতিয়ার), হিজব-ই-ইসলামী (ইউনুস খালিস), ইত্তেহাদ-ই-ইসলামী [ইসলামিক এলায়েন্স (রাসূল সায়েফ)], মিল্লি ইসলামী মাহাজ (আহমদ গিলারু), জাজহা সিহাত-ই-মিল্লি (সিবঘাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী) ও হারাকাত-ই-ইসলামী (নবী মোহাম্মদ)।

এ-চুক্তিতে বুরহান উদ্দিন রব্বানী প্রেসিডেন্ট, আহমদ শাহ মাসউদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গুল্বুদ্দিন হেকমতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু হেকমতিয়ার এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত তাকে রাজি করান উসামা বিন লাদেন। কারণ লাদেন বুঝতে পেরেছিল এখন যদি গুলুবুদ্দিন চুক্তি না মানে তাহলে তার সাথে মাসউদের যুদ্ধ অনিবার্য। অন্যদিকে মাসউদও চাইছিলেন যুদ্ধ করে হিজবে ইসলামকে পরাজিত করতে।

কিন্তু বাধ সাধেন বুরহানউদ্দিন রব্বানী। তার এক কথা। জমিয়তের হাত কখনোই মুসলিমের রক্তে রঞ্জিত হবেনা। মাসউদকে যুদ্ধ থেকে নিভৃত করেন তিনি।

অবশেষে গুলুবুদ্দিন সিআইএ সৃষ্ট আল কায়েদার প্রধান বিন লাদেনের পরামর্শক্রমে চুক্তিতে রাজি হন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বিন লাদেনের পরামর্শ এবং সাহায্যে কোন কারণ ছাড়াই মাত্র ছয় মাসের মাথায় ইসলামী রিপাবলিক অব আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

বুরহানউদ্দিন রব্বানী চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে হেকমতিয়ারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন। হেকমতিয়ারের দাবী ছিল তার অধীনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও দিতে হবে এবং আফগান সেনাবাহিনী তার নেতৃত্বে থাকবে। এটা মেনে নেয়া ছিল বুরহানউদ্দিন রব্বানীর জন্য আত্মহত্যার শামিল। তিনি হিজবে ইসলামের সকল যোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এরপরও শান্তিতে রাজি ছিলেন না হেকমতিয়ার। গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেন।

সরকারি সুবিধা নিয়ে হেকমতিয়ার বিদ্রোহ করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। চরম গোলযোগের মধ্যে আমেরিকার মদদপুষ্ট আল কায়েদা ও পাকিস্তান সরকার হেকমতিয়ারের অনুসারীদের মধ্য থেকে নতুন গোষ্ঠী তৈরি করে। এদের নাম তালিবান। এদের উত্থান হয় বিদেশী শক্তির মদদে। ১৯৯৬ সালে ২৭শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে তালেবান ক্ষমতা দখল করে। হেকমতিয়ার এবং আহমদ শাহ মাসউদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। বুরহানউদ্দিন রব্বানী তালিবান বিরোধী জোট গঠন করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। আহমদ শাহ মাসউদ ছিলেন জামিয়াতে ইসলামীর সামরিক শাখার প্রধান।

বুরহানউদ্দিন রব্বানী, যিনি আফগানিস্তান থেকে কমিউনিস্ট ও রুশদের তাড়াতে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করেছিলেন তাকেই তালেবানরা হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে। তারপরও হাল ছাড়েননি তিনি। আমেরিকার ষড়যন্ত্র ও তালেবানদের সম্পর্কে সজাগ করেছিলেন আফগানিস্তানের মানুষকে। তালেবান শাসনামলে জামিয়তে ইসলামী দশ শতাংশ আফগানিস্তানের শাসক ছিল।

২০০১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর (টুইন টাওয়ারে হামলার মাত্র দুই দিন আগে) উত্তর আফগানিস্তানর তাখার প্রদেশে খাজা বাহাউদ্দিন এলাকায় আল কায়েদা আত্মঘাতি হামলায় আহমদ শাহ মাসউদকে হত্যা করে। ওসামা বিন লাদেন শুরু থেকেই জমিয়তের বিরুদ্ধাচরন করে যাচ্ছিল। এর আগে বহুবার কেজিবি, আইএসআই আফগান কমিউনিস্ট কেএইচএডি, তালেবান ও আল-কায়েদা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করে । কিন্তু তাদের সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁর জন্মস্থান বাজারাকেই তাঁকে দাফন করা হয়।

শহীদ বুরহানউদ্দিন রব্বানী চাইলে সমাজতন্ত্রীদের পতনের পর হেকমতিয়ারকে উড়িয়ে দিতে পারতেন। তাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালাতে পারতেন রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে। কিন্তু এই মহান মানুষ কখনোই ভ্রাতৃঘাতি কার্যক্রমের পক্ষে ছিলেন না। তিনি সব মুসলিম ভাইকে নিয়ে আফগানিস্তানকে সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হেকমতিয়ারের একগুঁয়েমির কারণে সব ভেস্তে যায়। তার অসদাচারনের জন্য বিদেশী শক্তি আসে আল কায়েদা ও তালিবানের নাম করে। তিনি তালিবানের বিপক্ষেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাননি। কিন্তু পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রনে শেষ পর্যন্ত ছিল না।

২০০১ সালে আমেরিকা সরাসরি আক্রমণ করে আফগানিস্তান দখল করে। এই দখলের জন্যই আল কায়েদা ও তালেবানের সৃষ্টি। তার চেয়ে বড় কথা হলো আফগানিস্তানে জমিয়ত ক্ষমতায় আসায় তা মাথাব্যাথার কারণ হয় আমেরিকার। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে ইসলামপন্থীদের বড় বিজয়ের পরও তা হাতছাড়া হয়ে যায় কিছু হটকারি জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতার জন্য।

শহীদ বুরহানউদ্দিন রব্বানী আফগানিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সহ্য করতে পারছিলেন না। এদিকে তালেবান দমন না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকা তাদের সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হচ্ছে না। আমেরিকা সারা দেশ থেকে তালেবানদের হটালেও কান্দাহার ও হেলমান্দ প্রদেশ থেকে তাদের তাড়াতে পারছে না। এটা মূলত ছিল আমেরিকানদের কৌশল। তারা চায় তালেবান টিকে থাকুক। তাহলে তারাও আফগানিস্তানে ঘাঁটি করে থাকতে পারবে।

২০১১ সালে তিনি কাবুল সরকার, তালিবান এবং মার্কিনিদের মধ্যে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়ে উঠেন এই তিন বাহিনীর মধ্যস্থতাকারী। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছেন। মুসলিম রক্ত নিয়ে মুসলিমরাই রক্ত উৎসব শুরু করেছিল। তিনি এটা বন্ধ করতে চেয়েছেন।

তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিল বারাক ওবামা। তিনি বিষয়টাকে মুখে মুখে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কথা ছিলো যদি যুদ্ধ বন্ধ হয় তাহলে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করা হবে। বারাক ওবামা নিজেকে ষড়যন্ত্রের বাইরে রাখার জন্য ও শান্তিতে আমেরিকা বিশ্বাসী এটা প্রমাণ করার জন্য কয়েক ব্রিগেড সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

শান্তিচুক্তি অনুসারে আফগানিস্তানে কান্দাহার ও হেলমান্দ শাসন করবে তালেবানরা। আফগান সরকার তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। বিনিময়ে তারা শুধু ট্যাক্স প্রধান করবে। শান্তি চুক্তি হলে আমেরিকার সৈন্য আফগানিস্তান ছাড়বে। এই চুক্তি সব পক্ষের জন্য ভালো হলেও খারাপ হবে শুধু আমেরিকার জন্য।

তারা যে উদ্দেশ্যে আফগানিস্তানে ঘাঁটি তৈরি করেছে তা ব্যহত হবে। শান্তিচুক্তির কয়েকদিন আগে তালেবানের পক্ষ থেকে জানানো হয় তাদের আর কিছু কথা আছে। তারা আফগান হাই পিস কাউন্সিলের প্রধান বুরহানউদ্দিন রব্বানীর সাথে চুক্তি বিষয়ে কথা বলতে চায়। বুরহানউদ্দিন রব্বানী তাদের সাথে কথা বলার তারিখ দেন ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ সাল। তালিবানের পক্ষ থেকে আলোচনার নাম করে দু'জন এসে আত্মঘাতী হামলা করে। এতে শাহদাত বরণ করেন আফগানিস্তানের শান্তি রক্ষায় ও বিদেশী শক্তি থেকে দেশ উদ্ধারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বুরহানউদ্দিন রব্বানী।

বুরহানউদ্দিন রব্বানীকে খুন করে তালেবানরা আমেরিকার স্বার্থ উদ্ধার করলো। এই ঘটনার পর ষড়যন্ত্রকারী বারাক ওবামা কপট দুঃখ প্রকাশ করে আরো প্রচুর সেনাসদস্যদের আফগানিস্তানে পাঠায়। ভেস্তে যায় শান্তি আলোচনা। 

১৯ মে, ২০১৮

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একটুখানি...



সাত বছরেও সিরিয়া সংকট শেষ হয়নি। এর মধ্যে পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হয়েছে বেশ। প্রথমে আসাদ বিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ডিরেক্ট সহায়তা করেছে তুরস্ক ও আমেরিকা। এরপর আমেরিকা দেখলো যুদ্ধ অনেকদিন স্থায়ী হয়ে গেলো তখন আমেরিকা নতুন পক্ষ নামিয়েছে আফগানিস্তানের মত। আর সেটা ক্যান্সার হয়ে গেলো পুরো পৃথিবীতে।

আমেরিকা 'ধরি মাছ না ছুই পানি' পদ্ধতি অবলম্বন করে স্থায়িত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল যুদ্ধকে।

অপরপক্ষে আসাদ সরকারকে একচেটিয়া মরিয়া হয়ে সাহায্য করে গিয়েছে ইরান। ইরান আসাদের পক্ষে যাওয়ার মোটা দাগে কারণ তিনটি।

১- আসাদ দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে ছিল। জাতিসংঘ ও আমেরিকার অবরোধকে উপেক্ষা করে আসাদ ইরানের পাশে ছিল। কৃতজ্ঞতা হতে পারে।

২- ব্যক্তিগতভাবে আসাদ সেক্যুলার হলেও সে শিয়া পরিবার থেকেই আসা। তাই সে শিয়াদের স্বার্থ ও ইরানের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং করবে।

৩- ইরান কখনোই চায় না তার ঘাড়ের উপর আমেরিকা ও ইসরাঈল একসঙ্গে নিঃশ্বাস ছাড়ুক। ইরানে ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইরানকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই আমেরিকাকে। সিরিয়া পরাজিত হলে ইরানের মিত্র রাষ্ট্র আর একটিও থাকবে না। তাই আসাদকে ওখানে জিততেই হবে। নইলে ইসরাঈল চলে আসবে সিরিয়ায়। ইরান অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এমনিতেই ইরান তার চারপাশ থেকে আমেরিকার ঘাঁটি দ্বারা আবদ্ধ।

যাই হোক যুদ্ধে অনেকটা বিব্রত ছিল সৌদী। তারা কী করবে বুঝতে পারছিল না। আসাদকে সহায়তা করার প্রশ্নই আসে না। আসাদ ও ইরানকেই সৌদী তার একমাত্র শত্রু মনে করে। আবার ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে সহায়তা করতে পারছিল না। কারণ এই আরব বসন্ত তার দেশেও আগুন ছড়াতে পারে। বরং তাদের নিজ দেশে শিয়াদের চাইতে এদেরই ভয় বেশি।

যুদ্ধে আসাদ বিরোধীদের অবস্থান ছিল ভালোই। সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল তারা নিজেদের করে নিয়েছে। এই অবস্থায় ইরান ডেকে নিয়েছে তার আরেক মিত্র রাশিয়াকে। আমার আজকের লিখা এই রাশিয়ার ভূমিকাকে কেন্দ্র করেই।

রাশিয়া ও ইরানের যৌথ আক্রমনে পিছু হটলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। আসলে মূলত পিছনে হটলো তুরস্ক। রাশিয়ার একটি বিমান ভূপাতিত করলো তুরস্ক। এই নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়া মুখোমুখি।

হঠাৎ পটপরিবর্তন। তুরস্কে এক ব্যর্থ ক্যু হলো। তুরস্ক এর জন্য দায়ি করলো আমেরিকাকে। ব্যস, আমেরিকা ও তুরস্কের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে গেল।

সিরিয়া যুদ্ধও অন্যদিকে মোড় নিলো। তুরস্ক নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাশিয়ার সাথে তিক্ততা দূর করলো। রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক বন্ধু হয়ে গেলো। চরম ধরা খেলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। কারণ এখন আর তুরস্ক সেই অর্থে সাহায্য করছে না তাদের।

রাশিয়ার বিমান হামলা, ইরান ও হিজবুল্লাহর সরাসরি অংশগ্রহণ আসাদ বাহিনীকে বিজয়ী করে তুলেছে। যুদ্ধ এখন আসাদের নিয়ন্ত্রণে। আসাদের পরাজয় আর হচ্ছে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এমতাবস্থায় ইসরাঈলের আতঙ্ক বেড়ে যায়। এই যুদ্ধে ইরান জয়ী হওয়া মানে ইসরাঈলের ঘুম হারাম।

একই সাথে সৌদী আরবেরও কলিজায় কামড়। কারণ সৌদী কাতার ও ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে সুন্নী দেশগুলোরও সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে অনেকটা। তার উপরে আবার তুরস্ক ও ইরানের মিত্রতা সৌদী আরবকে পাগল করে তুলেছে। মুসলিম বিশ্বে ইরানের প্রভাব বেড়ে যাবে এই আশঙ্কায় গোপন চুক্তিতে মিলিত হয় সৌদী, আমেরিকা ও ইসরাঈল।

সেই সূত্র ধরে আমরা একদিন জানলাম ইসরাঈলের সাথে যুদ্ধ করা অন্যায় বলে ফতোয়া দিয়েছে সৌদী গ্র্যান্ড মুফতি। আরেকদিন জানলাম ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ডেকে মোহাম্মদ বিন সালমান বললেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হতে। কিন্তু তিনি হননি। কী প্রস্তাব সেটা আমরা ক্লিয়ার ছিলাম না।

আরেকদিন হুট করে জানতে পারলাম লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সা'দ হারিরি সৌদীতে এসে পদত্যাগ করেছেন। অভিযোগ করেছেন তিনি নাকি হিজবুল্লাহ দ্বারা আক্রান্ত।

এরপর আমাদের কাছে অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যায় কী ছিল সৌদী, আমেরিকা ও ইসরাঈলের চুক্তি? ইরানকে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে ব্যস্ত থাকতে হবে ইসরাঈলকে। আর ইসরাঈলকে ব্যস্ত করে রেখেছে একদিকে হামাস এবং অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ।

এই কথা ইসরাঈল যেমন জানে তেমনি জানে ইরানও। তাই ইরান সবসময় নিজেদের স্বার্থে এই দুই গোষ্ঠীকে ছায়া দিয়ে আসছে। এই দুই গোষ্ঠী ব্যর্থ হলে ইসরাইল ও আমেরিকা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সাহস পাবে ইরানে।

তাই তারা চেয়েছিলো সৌদীকে দিয়ে দুটি কাজ করতে 
১- ফিলিস্তিন সরকারের সাথে কিছু বিষয়ে সমঝোতা করে ইসরাঈল-ফিলিস্তিন(ফাতাহ) সন্ধি করবে। স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করবে। একে অপরকে স্বীকৃতি দিবে। বিনিময়ে জেরুজালেম ও বায়তুল আকসা ইসরাঈলকে দিয়ে দিতে হবে। এরপর ফিলিস্তিনের ফাতাহ ও ইসরাঈল মিলে হামাসকে শেষ করে দিবে এবং হামাসকে ফিলিস্তিনের শান্তির অন্তরায় হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।

২- লেবাননে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষ লাগাবে। হিজবুল্লাহকে একদিক থেকে ইসরাঈল অন্যদিক থেকে সূন্নীদের সহায়তা করার নাম করে সৌদী আমেরিকা চেপে ধরবে। হিজবুল্লাহ শেষ হয়ে গেলে ইসরাঈলের আর কোন সমস্যা থাকবে না।

এরপর তিনদেশের অভিন্ন শত্রু ইরান ও সিরিয়াকে কন্ট্রোল করা ইজি হয়ে যাবে। কিন্তু সৌদী বাদশার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান সবকিছুতেই ব্যর্থ হলো। ফাতাহ কোনভাবেই রাজি হয়নি। কারণ তারা যেমনিভাবে ইসরাঈলকে বিশ্বাস করে না তেমনি সৌদীকেও নয়। বরং বিশ্বাসযোগ্যতায় হামাস এই দুই দেশের চাইতে এগিয়ে। তদুপরি তারা জেরুজালেম ছাড়তেও রাজি নয়।

আবার সা'দ হারিরিকে নিয়ে করা ষড়যন্ত্র খুব সুন্দরভাবে ট্যাকল দিয়েছে হিজবুল্লাহ। সা'দের মন্ত্রীদের সাথে এবং লেবাননের সুন্নী নেতাদের সাথে নিয়ে সৌদি গংদের ষড়যন্ত্র ক্লিয়ার করেছে। সব মিলিয়ে সেখানে দারুণ ব্যাপার হয়েছে। প্রায় নিশ্চিত এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গিয়েছে লেবানন। সা'দও পরে দেশে এসে সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে।

এতকিছু ইরানের পক্ষে থাকলেও এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে আরেকটি ঘটনা। হুট করেই নেতানিয়াহুর সাথে পুতিনের গোপন কিছু একটা হয়ে গেল। সাথে সাথে চাপে পড়ে গেলো ইরান।

৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাশিয়া সফরে গেল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। রাশিয়া ত্যাগ করার পূর্বে সাংবাদিকদের সাথে দেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু বলেছিল, এটা মনে করার কোনো ভিত্তি নেই যে, সিরিয়াতে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপে রাশিয়া বাধার সৃষ্টি করবে।

ওই দিন রাতেই দেখা গেল সেই কথার সত্যতা। সেদিন রাত ১টার সময় ইসরায়েল তার বিমানবাহিনীর ২৮টি এফ-১৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান থেকে সিরিয়ার ভূমিতে অন্তত ৬০টি মিসাইল নিক্ষেপ করে। গোলান মালভূমি থেকে নিক্ষেপ করে আরো ১০টি স্থল থেকে স্থল মিসাইল। সেগুলো আঘাত হানে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের প্রায় ৫০টি সামরিক স্থাপনার উপর। নিহত হয় অন্তত ২৭ জন, যাদের মধ্যে ছিল এগারো জন ইরানী এবং ছয় জন সিরীয় সেনা।

রাশিয়ার আচরণ এবং ইসরাঈলের আচরণ দেখে একথা বলা যায় যে ইরানের উপর ইসরাঈলের এই হামলায় রাশিয়ার সমর্থন ছিল। কিন্তু কেন?

কারণ হতে পারে তিনটি। 
১- সিরিয়াতে অবস্থানকারী দুই বিজয়ী পক্ষ রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এগিয়ে যাবার জন্য।

২- সিরিয়াতে রাশিয়ার অর্জনগুলোর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের যে একটিমাত্র রাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই ইসরায়েলের সাথে তারা সুসম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে উত্তেজনা প্রশমিত করার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে।

৩- মধ্যপ্রাচ্যে যাতে ইরানের আধিপত্য এমনভাবে সৃষ্টি না হয় যাতে করে ইরান পরাশক্তিতে রুপান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে ইরান বহুদিন আমেরিকা ও জাতিসংঘের অবরোধের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা দেখিয়েছে বেশ।

যাই হোক আমার মনে হচ্ছে ইরান বিচক্ষণতার সাথেই মোকাবিলা করবে। সেই সাথে টিকে থাকবে হামাস ও হিজবুল্লাহ। বায়তুল আকসা আবারো আমাদের হবে।

১৬ মে, ২০১৮

হুট করে পরিচিত হলাম উমেদ খাঁর সাথে



কিছুদিন আগে প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরাতন একটি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছি। সাথের সঙ্গীরা পুরাতন সেই মসজিদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি ওর মধ্যে নেই। আর তাছাড়া আমি ভাল ছবিও তুলতে পারি না। আমি ইতিহাসের ছাত্র। তাই খুঁজতে গেলাম কীভাবে এই মসজিদটি স্থাপিত হলো? এর ইতিহাসই বা কী?

মসজিদটি হলো সাত গম্বুজ মসজিদ। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই। আমি খুঁজতে লাগলাম কোন মুরব্বী শ্রেণির মানুষ পাই কিনা? পেয়েও গেলাম কয়েকজনকে। তাদের সাথে গল্প করতে লাগলাম এই ঐতিহাসিক মসজিদের ইতিহাস নিয়ে।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবরে কে না চিনে? তার মত ধার্মিক ও ক্ষমতাশালী সম্রাট মুঘলদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। তার আমলেই মুঘলরা চট্টগ্রাম থেকে কাবুল পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। ফতোয়ায়ে আলমগীরী সুন্নী হানাফী মাযহাবের একটি অসাধারণ সংকলিত আইনের বই।

আওরঙ্গজেব প্রায় ৫০০ আলেম নিয়োগ করেছেন এই ফতোয়ার বইকে সমৃদ্ধ ও নির্ভুল করার জন্য। উনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই বই থেকেই সাহায্য নিতেন।

আলমগীর/ আওরঙ্গজেব ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় চট্টগ্রাম বাংলার সাথে ছিল না। এটা শাসন করতো আরাকনীরা। আবার সেখানে ছিল পর্তুগীজদের উৎপাত। এই দুই দস্যু প্রজাতির মানুষের শাসনের ফলে সেখানের মানুষরা অবর্ণনীয় জুলুমের মধ্যে ছিল।

দিল্লিতে মুঘল শাসকদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সুযোগে বাংলায়ও মুঘল শাসন শক্তিশালী ছিল না। তখন বাংলায় স্বাধীন নবাবদের উত্থান হয়। চট্টগ্রামের মানুষরা বিশেষত মুসলিমরা নবাবদের কাছে তাদের উদ্ধারের আহবান জানান। তারা আরাকানদের সাথে লড়ে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল আরাকানীদের শক্তিশালী নৌবাহিনী। অন্যদিকে বাংলার শাসকরা নদীপথের যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন না।

যাই হোক বাংলার এহেন দুর্দশায় আওরঙ্গজেব সুবেদার হিসেবে থাকা মীর জুমলাকে প্রত্যাহার করে নেন। এবং সেখানে নতুন দায়িত্ব দেন মীর্যা আবু তালিবকে।

মীর্যা আবু তালিব তার মূল নাম হলেও তিনি এই নামে পরিচিত নন। তিনি পরিচিত তার উপাধি দিয়ে। তার উপাধি ছিল শায়েস্তা খাঁ। এই উপাধি তাকে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তার এই উপাধি ছিল সরকারি কাজে তার নিষ্ঠা ও যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের জন্য। শায়েস্তা খাঁ ভালো শাসকের পাশাপাশি ছিলেন একজন ভালো মুসলিমও।

যাই হোক তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন ঢাকার মানুষ খুব খুশি হন। শায়েস্তা খাঁর নাম ডাক ইতিমধ্যে ঢাকায়ও প্রচার হয়েছিল। ঢাকার সবাই তার কাছে বিভিন্ন আবদার নিয়ে আসলো।

এমনি কিছু আবদার নিয়ে এলো মোহাম্মদপুরের মানুষরা। তখন তার নাম মোহাম্মদপুর ছিল না। বলতে গেলে এটা ছিল ঢাকার অনেক বাইরে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি, নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা ইত্যাদি দাবী নিয়ে এসেছিল তারা।

শায়েস্তা খাঁ এই বিষয়ে দায়িত্ব দিলেন তাঁর ছেলে উমেদ খাঁকে। উমেদ খাঁ এসে দেখলেন এখানে মুসলিম নেই বললেই চলে। মাত্র চারটি পরিবার। উমেদ খাঁ তাদের প্রয়োজনমত এবং রাজ্যের সাধ্যমত সমস্যাগুলোর সমাধান করলেন।

তারপর তিনি মুসলিমদের বললেন তিনি এখানে একটি মসজিদ করতে চান। মুসলিমরা বললো এখানে তো মুসলিম খুব বেশি নেই। আমরা মাত্র চার পরিবার।

তখন তিনি বললেন এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ হবে। এই মসজিদ থেকেই এই এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম হবে। বিচার সালিশ হবে। এখানে ধ্বনিত হবে পাঁচবার আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। এখানকার মানুষ এই মসজিদের প্রভাবে মুসলিম হয়ে যাবে।

সেসময়ের মুসলিমরা বুঝতে পারেনি। কিন্তু উমেদ খাঁ ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। মাত্র বিশজন মুসলিমের জন্য তিনি বানিয়েছেন ২০০ মুসল্লি ধারণ ক্ষমতার এই সাত গম্বুজ মসজিদ। মুসলিমরা তো অবাক। এতবড় মসজিদ দিয়ে তারা কী করবে? উমেদ খাঁ বললেন, তোমরা যদি ন্যায়নিষ্ঠ হও আর তোমাদের মধ্যে যদি সাহাবাদের চরিত্র থাকে তবে তোমরা দেখবে এই এলাকায় এত মুসল্লি হবে যে, তোমরা মসজিদে জায়গা দিতে পারবে না।

উমেদ খাঁ এই এলাকার নাম রাখলেন মোহাম্মদপুর। সত্যিই সেদিনের সেই অল্প কয়জন মুসলিমের প্রভাবে ও সুবেদার শায়েস্তা খাঁর ন্যায় বিচারে পাল্টে গেলো মোহাম্মদপুরের চিত্র।

আমি উমেদ খাঁর নাম সেদিনই মোহাম্মদপুরের মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনলাম। বাসায় এসে তাঁকে নিয়ে পড়তে বসলাম। অবাক হলাম। আসলেই তিনি ছিলেন দাওয়াতী চরিত্রের মানুষ।

শুধু মোহাম্মদপুর নয় পুরো বাংলায় বহু স্থানে তিনি তাঁর মিশনারি কার্যক্রমের স্বাক্ষর রেখেছেন। সেসময়ে মানুষ তাকে বলতো বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

চট্টগ্রামের মুসলিমদের উদ্ধারে শায়েস্তা খাঁ তাঁর ছেলে উমেদ খাঁকেই পাঠিয়েছেন। তিনি শক্তিশালী আরাকানীদের পরাজিত করেন শুধু অস্ত্রের জোরে নয়। বুদ্ধি, কূটনীতি, উদারতা সবকিছু দিয়েই তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন।

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ তাঁর তৈরী। এটাকে আগে পর্তুগিজরা ও আরাকানীরা যুদ্ধের দূর্গ হিসেবে ব্যবহার করতো। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে কিল্লাতেই মসজিদ নির্মাণ করেন উমেদ খাঁ।

এই মসজিদ থেকেই চট্টগ্রামে ইসলামের প্রচার প্রশাসনিকভাবে শুরু হয়। এখানে উমেদ খাঁ মসজিদ, সরাইখানা, বিশ্রামাগার, লাইব্রেরি, গবেষণাগার ইত্যাদি তৈরী করেন। পাশাপাশি এই মসজিদ চট্টগ্রামের নিরাপত্তার জন্য দূর্গ হিসেবেও ব্যবহার হয়।

ইংরেজরা এই দূর্গ দখল করতে অনেক বেগ পেতে হয়। তাই তারা আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ দখল করেই নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়। এখানে তারা অস্ত্রের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করে। পরে ১৮৮৫ সালে সালে তা আবার মুসলিমরা উদ্ধার করে নামাজ পড়া শুরু করে।

উমেদ খাঁ সম্পর্কে আরেকটি কাহিনী আমি জানতে পেরেছি। উমেদ খাঁ চট্টগ্রাম অধিকার করার পর হিঁদু জমিদার শ্যাম রায় তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। শ্যাম রায় তার সাথে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

সেসময় উমেদ খাঁ শ্যাম রায়ের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের পরিচয় পান। তিনি তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক সৃষ্টি করেন এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। শ্যাম রায় প্রথমে অস্বীকার করে। হাল না ছেড়ে এবং ক্ষুব্দ না হয়ে ধীরে ধীরে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন উমেদ খাঁ।

একপর্যায়ে উমেদ খাঁ জয়ী হন। শ্যাম রায়ের মন বিগলিত হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। উমেদ খাঁ অত্যন্ত খুশি হন এতে। তিনি শ্যাম রায়ের কাছে তার বোন বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে যান পিতা শায়েস্তা খাঁয়ের কাছে। শায়েস্তা খাঁ রাজি হন।

দেওয়ান মনোহরের (শ্যাম রায়) সাথে চট্টগ্রামের একটি বৃহত হিঁদু সমাজ ইসলামে ছায়াতলে এসে পড়েন। সেই থেকে চট্টগ্রাম ইসলামী ভাবধারার শহরে পরিণত হয়। আওরঙ্গজেবের পরামর্শে উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ।

আফসোস হয়, সেসময়ের মুসলিম ও মুসলিম নেতারা ছিলেন মিশনারি চরিত্রের। তাঁরা কাফির-মুশরিকদের মুসলিম বানাতেন। আর এখনকার মুসলিমদের মধ্যে সেই বিখ্যাত হয় যে ফিরকাবাজ ও ফিতনাবাজ। আমাদের দেশে এখন সেই বড় মুসলিম নেতা যে কথায় কথায় মুসলিমদের কাফির-মুশরিক বানায়।

আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।