২৯ আগ, ২০১৮

একনজরে সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ


অনেকে আগের কথা। হাইস্কুলে উঠেছি মাত্র। তখন বাবার লাইব্রেরীতে পেয়েছিলাম একটি বই 'কারাগারে রাতদিন'। জয়নব আল গাজালীর সেই বই পড়ে কিশোর মনে হাহাকার শুরু হয়েছে। সেই বইতে পরিচিত হয়েছি সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের সাথে। এরপর ফি যিলালিল কুরআন পড়ে তো আরো মুগ্ধ হলাম। সেই থেকে ভালোবাসা শুরু এই মহান মানুষের সাথে। ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট সুবহে সাদিকের সময় এই মহান মানুষ শাহদাতবরণ করেন। চলে যান প্রিয় রবের সান্নিধ্যে। ফাঁসীর সংবাদে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে 
"আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনিও আমার প্রতি সন্তুষ্ট।"

জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সাইয়েদ কুতুবের মূল নাম হলো সাইয়েদ; কুতুব তার বংশীয় উপাধি। তিনি ১৯০৬ সালে মিসরের উসইউত জিলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তার পিতার নাম হাজী ইবরাহীম কুতুব। তিনি চাষাবাদ করতেন। তার মাতার নাম ফাতিমা হোসাইন উসমান, যিনি অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন। তারা মোট দুই ভাই এবং তিন বোন ছিলেন। ভাইরা হলেন সাইয়েদ কুতুব এবং মুহাম্মাদ কুতুব। আর বোনেরা হলেন হামিদা কুতুব এবং আমিনা কুতুব। পঞ্চম বোনের নাম জানা যায়নি। সাইয়েদ কুতুব ছিলেন সবার বড়। তারা সব ভাই-বোনই উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য প্রভূত ত্যাগ স্বীকার করেন।

কর্মজীবন
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কোরআন হেফয করেন। পরবর্তীকালে তার পিতা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরুকরেন। সাইয়েদ তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদরাসা থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। মিসরে ওই পদটিকে অত্যন্ত সম্মানজনক বিবেচনা করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাকে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি পড়াশোনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

তিনি দু’বছরের কোর্স শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকায় থাকাকালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানবসমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।
আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি ইখওয়ানুল মুসলেমিন দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি যাচাই করতে শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ওই দলের সদস্য হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরকে স্বাধীনতাদানের ওয়াদা করেন। 

যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইখওয়ান ব্রিটিশের মিসর ত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে এ দলের সক্রিয় কর্মীসংখ্যা পঁচিশ লাখে পৌঁছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। ব্রিটিশ ও স্বৈরাচারী মিসর সরকার ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পড়ে এবং এ দলের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

গ্রেফতার ও নির্যাতন
১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। কারণ, ওই বছর মিসর সরকার ব্রিটিশের সঙ্গে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করে, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের ওপর নির্যাতন শুরু করে। একটি বানোয়াট হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করে। তার হাতে-পায়ে শিকল পরানো হয়। শুধু তা-ই নয়, সাইয়েদ কুতুবকে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় জেল পর্যন্ত হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। পথে কয়েকবার বেহুঁশ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলতেন— আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

জেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই জেল কর্মচারীরা তাকে মারপিট করতে শুরু করে এবং দু’ঘণ্টা পর্যন্ত এ নির্যাতন চলতে থাকে। তারপর একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়। কুকুর তার পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়ায়। এ প্রাথমিক ‘অভ্যর্থনা’ জানানোর পর একটানা সাত ঘণ্টা তাকে জেরা করা হয়। তার স্বাস্থ্য এসব নির্যাতন সহ্য করার আর যোগ্য ছিল না। কিন্তু তার সুদৃঢ় ঈমানের বলে পাষাণ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে : আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
জেলের অন্ধকার কুঠরী রাতে তালাবদ্ধ করা হতো। আর দিনের বেলা তাকে রীতিমত প্যারেড করানো হতো। 

তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বক্ষপীড়া, হৃদপিন্ডের দুর্বলতা ও সর্বাঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। তবু তার গায়ে আগুনের ছেঁকা দেয়া হতে থাকে। পুলিশের কুকুর তার শরীরে নখ ও দাঁতের আঁচড় কাটে। তার মাথায় খুব গরম পানি এবং পরক্ষণেই বেশি ঠাণ্ডা পানি ঢালা হতে থাকে। লাথি, কিল, ঘুষি, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল ইত্যাদি তো ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার।

১৯৫৫ সালের ১৩ জুলাই, গণআদালতের বিচারে তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। অসুস্থতার দরুন তিনি আদালতে হাজির হতে পারেননি। তার এক বছর কারাভোগের পর নাসের সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করলে তাকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, 
‘আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মজলুমকে জালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।’ 
পরবর্তীকালে তাকে যতবার ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি একই কথা বলেছেন : ‘যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব না।’

১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাকে মুক্তি দিয়ে তারই বাসভবনে অন্তরীণ করেন। এক বছর যেতে না যেতেই তাকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন। শুধু তিনি নন, তার ভাই মুহাম্মাদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রায় সাতশ’ ছিলেন মহিলা।

১৯৬৫ সালে কর্নেল নাসের মস্কো সফরে থাকাকালীন এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমিন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সারা মিসরে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক ধরপকড় শুরু হয়। ১৯৬৪-র ২৬ মার্চ জারিকৃত একটি নতুন আইনের বলে প্রেসিডেন্টকে যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি দণ্ডবিধির অধিকার প্রদান করা হয়। তার জন্য কোনো আদালতে প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলেও ঘোষণা করা হয়।

কিছুকাল পর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। প্রথমত ঘোষণা করা হয় যে, টেলিভিশনে ওই বিচারানুষ্ঠানের দৃশ্য প্রচার করা হবে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অপরাধ স্বীকার করতে অস্বীকার এবং তাদের প্রতি দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করায় টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার চলতে থাকে। আসামিদের পক্ষে কোনো উকিল ছিল না।

অন্য দেশ থেকে আইনজীবীরা আসামি পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফরাসি বার অ্যাসোসিয়েশনের ভূতপূর্ব সভাপতি উইলিয়াম ও মরোক্কোর দু’জন আইনজীবী আসামি পক্ষ সমর্থনের জন্য রীতিমত আবেদন করেন। কিন্তু তা নামঞ্জুর করা হয়। সুদানের দু’জন আইনজীবী কায়রো পৌঁছে তথাকার বার অ্যাসোসিয়েশনে নাম রেজিস্ট্রি করে আদালতে হাজির হন। পুলিশ তাদের আদালত থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে।

সাইয়েদ কুতুব ও অন্য আসামিরা ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, অপরাধ স্বীকার করার জন্য তাদের ওপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ট্রাইব্যুনালের সভাপতি আসামিদের কোনো কথার প্রতিই কান দেননি। ইংরেজি ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে সাইয়েদ কুতুব ও তার দু’জন সঙ্গীকে সামরিক ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনানো হয়। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট ওই দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। আমাদের প্রিয় নেতা চলে যান রবের সান্নিধ্যে যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন।

জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা
সাইয়েদ কুতুব মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যিকদের অন্যতম। শিশুসাহিত্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা। ছোটদের জন্য আকর্ষণীয় ভাষায় নবীদের কাহিনী লিখে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। শিশুদের মনে ইসলামী ভাবধারা জাগানোর জন্য এবং তাদের চারিত্রিক মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি গল্প লিখেন। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাটা) নামে ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট একখানা উপন্যাস রচনাকরেন। পরে ওই ধরনের আরও দুটি উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘তিফলে মিনাল কস্ফারীয়া’ (গ্রামের ছেলে) ও অন্যটি ‘মদিনাতুল মাসহুর’ (যাদুর শহর)। 

তার রচিত গ্রন্থাবলির বিবরণ নিম্নরূপ :
  • মুশাহিদুল ক্বিয়ামাহ ফিল ক্বুরআন (কুরআনের আঁকা কেয়ামতের দৃশ্য);
  • আত্ তাসবিরূল ফান্নি ফিল ক্বুরআন (কুরআনের আলঙ্কারিক চিত্র);
  • আল আদালাতুল ইজতিমাঈয়া ফিল ইসলাম (ইসলামের সামাজিক সুবিচার);
  • ফি যিলালিল কুরআন (কুরআনের ছায়াতলে) - কুরআনের তাফসীর;
  • ইসলাম ও পূজিবাদের দ্বন্দ্ব;
  • বিশ্বশান্তি ও ইসলাম;
  • দারাসাতিল ইসলাম (ইসলামী রচনাবলী);
  • "ভবিষ্যৎ সংস্কৃতি" নামক পুস্তকের সমালোচনা;
  • কুতুব ওয়া শাখসিয়াত( গ্রন্থাবলি ও ব্যক্তিত্ব);
  • ইসলামী সমাজের চিত্র;
  • আমি যে আমেরিকা দেখেছি;
  • চার ভাই বোনের চিন্তাধারা: সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, আমিনা কুতুব ও হামিদা কুতুব;
  • আশাতিল মাজহুল (কবিতগুচ্ছ);
  • জীবনে কবির আসল কাজ;
  • ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা (মা'অালিম ফিত তারিক্ব);
  • আন নাক্বদুল আদাবি উসুলিহি ওয়া মানাহিযিহি (সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি);
  • নবীদের কাহিনী।
এই বইগুলোর মধ্যে 'ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা' বইটি লেখার জন্যই মিসর সরকার সাইয়েদ কুতুবকে অভিযুক্ত করেন এবং ওই অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। বইটি ইংরেজিতে মাইলস্টোন নামে অনূদিত হয়েছে এবং বেশ জনপ্রিয় বই হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা এই মহান মানুষকে আখিরাতে সম্মানিত করবেন ইনশাআল্লাহ। 

১৫ আগ, ২০১৮

শেখ মুজিব হত্যার পরদিন কেমন ছিল মিডিয়ার ভূমিকা?


সারমেয়রা কোনোদিন মানুষ হয়ে উঠে না। বলছি মিডিয়ার সারমেয়দের কথা। মুজিব যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন মুজিবের স্তুতি করে তার পা চাটতে পছন্দ করতো কিছু মিডিয়া। তখন মিডিয়া বলতে শুধুমাত্র প্রিন্ট মিডিয়া মানে সংবাদপত্র। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে মুজিব তার পা চাটা ৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। সেই চারটি সংবাদপত্র হলো ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, অবজারভার আর বাংলাদেশ টাইমস।

এখন যেভাবে আমারদেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, পিস টিভি, একুশেসহ অনেকগুলো মিডিয়া দখল করা হয়েছে ঠিক তেমনি মুজিবও চারটি বাদে সব বন্ধ করে দিয়েছিলো। আর এই চারটি মিডিয়াতে কোন সাংবাদিক কাজ করতো না। কাজ করতো সারমেয়রা। যাই হোক সেই সারমেয়দের ভূমিকা কেমন ছিল তা একটু দেখা যেতে পারে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনামেও আসেনি। একই চিত্র ছিল তখন বাংলাদেশের অন্য তিনটি সংবাদপত্রগুলোতেও।

দৈনিক ইত্তেফাক
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে বাজারে আসা ওই সময়কার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের ৬ কলামের শিরোনাম ছিল- ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’।

এই প্রতিবেদনের ‘ইন্ট্রো’ বা সংবাদ সূচনাতেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ‘গ্রহণ’ই প্রাধান্য পেয়েছিল। সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনের শুরুটা হয়েছিল এভাবে, “রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।”

এরপর লেখা হয়েছিল, “শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।” ছয় কলামের এই সংবাদটির পাশেই দৈনিক ইত্তেফাক দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
ওই সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী; বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাফউদ্দৌলা রেজা। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাককে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবেই মনে করতেন পাঠকরা।

১৬ আগস্টের ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় আরও কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘অচল নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত’, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’, ‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’, ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’, ‘বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন’, ‘বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকিবে’, ‘বি এ সিদ্দিকী রেডক্রসের চেয়ারম্যান’ ইত্যাদি।



দৈনিক বাংলা
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন এনে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর ইত্তেফাকসহ চারটি দৈনিক পত্রিকাই তখন প্রকাশ হচ্ছিল। এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত ১৬ আগস্টের দৈনিক বাংলার আট কলামের শিরোনাম ছিল- “খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি।”

প্রধান এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা হয়েছে, “শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ নামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়।

শীর্ষ দৈনিকটির প্রথম পাতার অন্যান্য সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই’, ‘জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে: রাষ্ট্রপতি’, ‘দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে’, ‘অচল শতকী নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য ফেরত দেয়া হবে’, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত’। ইত্তেফাকের মতোই দৈনিক বাংলাতেও প্রধান সংবাদের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।



দ্য বাংলাদেশ টাইমস
দ্য বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুসতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’। এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি: মুজিব কিলড’।

মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল; যার শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’।

আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্যান্য শিরোনামগুলো ছিল, “পিপল থ্যাঙ্ক আর্মড ফোর্সেস’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, “ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়ার্ন ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপরাস কান্ট্রি’। প্রধান খবরে সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।



দ্য বাংলাদেশ অবজারভার
ওবায়দুল হক সম্পাদিত সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের ১৬ অগাস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘মুশতাক বিকামস প্রেসিডেন্ট’। শিরোনামের শোল্ডার ছিল- ‘আর্মড ফোর্সেস টেক ওভার: মার্শাল ল প্রোক্লেইমড: কারফিউ ইমপোজড’। সাভেডিং এ লেখা ছিল, ‘মুজিব কিলড: সিচুয়েশন রিমেইনস কাম’। আট কলামের প্রধান শিরোনামের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছিল।

প্রধান সংবাদের নিচে ‘হিস্টরিক্যাল নেসেসিটি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়। তার পাশের দুটি সংবাদের শিরোনাম, ‘স্পেশাল প্রেয়ার্স’, ‘মুশতাক কলস ফর কো-অপারেশন’।

পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্য শিরোনামগুলো ছিল, ‘পিপল হেইল টেক-ওভার’, ‘পাকিস্তান অ্যাকর্ডস রেকগনিশন’, ‘ইনভায়োবিলিটি অব ফরেন মিশনস অ্যাশিউরড’, ‘জাস্টিস মাস্ট বি এসটাব্লিশড: প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক হার্ড টু ইমপ্রুভ কনডিশন কুইকলি’, ‘ইউএস রেডি টু কনডাক্ট নরম্যাল ডিপ্লোম্যাটিক বিজনেস’, ‘কারফিউ রিল্যাক্সড ফর জুম্মা প্রেয়ার্স’।

যাস্ট একটু চিন্তা করুন, যারা এতদিন মুজিবের দালালি করেছিলো তারাই হুট করে উল্টে গিয়ে মুজিবের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখে বসলো। মাত্র একদিনে এত বিশাল পরিবর্তন! আজকে যারা হাসিনার পদলেহন করতে গিয়ে জিহ্বা ক্ষয় করে ফেলছে কালকে পটপরিবর্তন হলে তারাই সবার আগে হাসিনার চরিত্র হনন করবে। স্বৈরাচারীদের এটাই পরিণতি।

১৪ আগ, ২০১৮

বাংলা বিহার উড়িষ্যার ১ম নবাবের তৈরি মসজিদের গল্প

করতলব খানের মসজিদ

একের পর এক রিকশাওয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছে আমাদের। কেউ চিনে না সেই মসজিদ। ঘটনা কি? ভাবলাম ভুল নাম বলছি কি না। আবারো গুগুল মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম। না ঠিকই তো আছে। মসজিদের নাম করতলব খানের মসজিদ। পুরান ঢাকার বেগমবাজারে। 

এক রিকশাওয়ালা মামা বললেন পুরানা মসজিদ মানে কি চকবাজার শাহী মসজিদের কথা বলছেন? 
-আরে না চকবাজার না। বেগমবাজারে। আমি আসলে তখনো জানতাম না বেগমবাজার আর চকবাজার যে কাছাকাছি।  

যাই হোক এক প্রায় বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা মামা আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন। আমাদের তিনজনেরই সাইজ খারাপ না। জিজ্ঞাসা করলাম মামা পারবেন তো? তিনি বললেন এই রিকশায় দশ মণ অনায়াসে পার করি। আপনারা তিনজন কিছু না। এবার আমরা আমাদের তিনজনের ওজন যোগ করে দেখলাম মোটে সাত। দশ মণ হতে ঢের বাকী। 

যাই হোক, আমরা চলতে শুরু করলাম। রিকশাওয়ালা মামা যতটা সহজ মনে করেছিলেন আসলে ততটা ছিল না। বেশ কয়েকটি উঁচু নিচু স্থানে আমরা নেমে ওনার বোঝা হালকা করেছি। 

পুরনো দিনের ছবি


বেগমবাজার জেল রোডে এসে গেলাম। পুরাতন কেন্দ্রীয় জেলখানার সামনে। এখানে এখন একজন মাত্র বন্দি। বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। খালেদার জন্য আফসোস করছি, এমন সময়ে গলির ফাঁক দিয়ে ধরা পড়লো সেই মসজিদ। গুগলে যেরকম ছবি দেখেছি সেরকম। ব্যস ব্যাপারটা  সহজ হয়ে গেলো। 

আসলেই সহজ হলো। এই মসজিদটির নাম করতলব খান মসজিদ হলেও স্থানীয়রা একে বেগমবাজার মসজিদ নামেই চিনে। করতলব খান করতে করতে জীবনপাত করলেও মনে হয় মসজিদ বের করতে পারতাম না। আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়লাম। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগের আকার নেই। সংস্কার হয়েছে। মসজিদ বড়ও হয়েছে। 

এ পর্যন্ত যত মসজিদ দেখেছি এর মধ্যে এটাকে বেশ ভালোই লেগেছে কারণ এর সংস্কারের মধ্যে পুরোনোর আভিজাত্য রয়েছে। 

করতলব খাঁ কে ছিলেন? 
করতলব খাঁ এই নামটা আমি প্রথম পেয়েছি মসজিদ খোঁজ করতে গিয়েই। গুগোলে সার্চ করলাম ঢাকার পুরোনো মসজিদ লিখে। অনেক মসজিদের পাশে এই মসজিদের নাম পেলাম। করতলব খান মসজিদ। যদিও করতলব খান নামটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল আসলে তিনি কিন্তু অপরিচিত নন। 



তিনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার প্রথন স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খান। এই সিলসিলার শেষ নবাব হলেন সিরাজ উদ দৌলা।  

মুর্শিদকুলি খান ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। আসলে তিনি নবাব ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুঘলদের দেওয়ান প্রশাসক। আওরঙ্গজেব তাকে বাংলায় নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেবের ছেলেরা ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে বাংলায় তাদের আর প্রভাব থাকে না। কেন্দ্রীয় শাসন নষ্ট হয়ে যায়। সেই সুবাধে মুর্শিদকুলি খান হয়ে উঠেন স্বাধীন নবাব। 

মুর্শিদকুলি খানকে হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি তার যোগ্যতা ও ইসলামপ্রিয়তার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেন।  

১৭০০-১৭০৪ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। দিল্লির তুলনায় ঢাকা সেসময় ছিল অজগাঁ। তিনি এখানে নিজেকে ইসলামের প্রসারে নিয়োজিত করেন। দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন মুসলিমদের মধ্যে। ঢাকায় তিনি মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি তার নামে প্রথমে মুর্শিদকুলি খাঁ নাম হয়। পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব তরুণ মুর্শিদকুলী খাঁকে ১৭১৭ সালে সম্মানসূচক করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে দেওয়ান হিসেবে বাংলায় পাঠান। 

এরপর এই মসজিদের নাম হয়ে যায় করতলব খান মসজিদ। স্থানীয়রা মসজিদটিকে বেগমবাজার মসজিদ নামে চেনে। সময়ের পরিক্রমায় ১৭৩৯-৪০ সালে ঢাকার নায়েবে নাজিম সরফরাজ খাঁর কন্যা লাভলি বেগমের নাম থেকে মাছপ্রধান এই এলাকার বড় বাজারের নাম হয় বেগমবাজার। 

এই বাজারটি মূলত স্থাপন করা হয়েছিল পাঁচ গম্বুজ মসজিদটির ব্যয় নির্বাহ করার জন্য। সময়ের কালস্রোতে, লোকজনের সহজ পরিচিতির জন্য এক সময় বেগম বাজারের নাম জুড়ে দিয়ে মসজিদটির নাম হয়ে যায় বেগম বাজার মসজিদ। যা এখনও চলছে। ধারণা করা হয়, এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর অববাহিকা এই মসজিদের কোল ঘেষে প্রবাহিত হত । পরে নদীর গতি পথ পরিবর্তিত হয়ে প্রায় দেড় কি.মি. দূরে চলে যায়। 

সে সময়কার অন্যান্য মসজিদের মতো করতলব খান মসজিদটিও উঁচু ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের উত্তরদিকে একটি কক্ষের মতো বর্ধিত দোচালা রয়েছে। সংযোজিত দোচালা অংশসহ মসজিদটি একটি উঁচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে। প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি বাব বা বাউলি (ধাপকৃত কুয়া)। উত্তর-দক্ষিণে ৩৯.৬২ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩.৪১ মি প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্ত খিলানাকৃতির। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। 

নামাজ পড়ে বের হয়েই আহা! বিরিয়ানীর গন্ধে মৌ মৌ করছিলো চারদিক। এই এলাকায় আসলে আপনি পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সব খাবারও পেয়েও যাবেন। ভুরিভোজ করার উৎকৃষ্ট সময় তো এখনই...। 

১০ আগ, ২০১৮

মুশরিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন হুজুরের(!) কথা

ভারতীয় হাইকমিশনারের দাওয়াতে হুজুর(!)

একজন হুজুর(!) বই লিখেছেন। ফতওয়ার বই। জিহাদবিরোধী ফতওয়া। কেন জিহাদ করা যাবে না? কেন একজন অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবেনা? কেন ভারতের আধিপত্য মেনে নেয়া আমাদের উচিত? ইত্যাদি বিষয়ে সেখানে দারুণ আলাপ আছে নাকি। আমি পড়িনি। তাই নিশ্চিত করতে পারছি না।

আপনারা আবার এটা বলে বসবেন না, একজন মানুষের বিরুদ্ধে নিশ্চিত না জেনে অভিযোগ করা ঠিক না। আসলে রুচি হয়নি ঐ হুজুরের বই পড়তে। যে হুজুর শাহবাগে নাস্তিকদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে তার বই আমাকে পড়তে হবে এতটা দৈন্যতা আমাকে এখনো পেয়ে বসে নি।

তাহলে কেন এই পোস্ট? সে কথা একটু পরে বলছি।

তুরিন আফরোজের সাথে বেশ সখ্যতা ছিল হুজুরের(!)

গতকাল দেখলাম সেই হুজুরকে পার্শ্ববর্তী মুশরিকদের দপ্তরে তার দুই সন্তানসহ। কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। ভাবলাম এটা আবার গুজব কিনা? কারণ আজকাল গুজবের শেষ নাই। যে কেউ এডিট করে অনেক কিছু তৈরি করতে পারে। যেহেতু মুশরিকদের হাইকমিশনারকে দেখা যাচ্ছে তখন বুঝে নিলাম এটা এডিটেড না হয়ে যদি সত্য হয় তবে হাইকমিশনের ফেসবুক পেইজে সেই ছবি থাকবে।

কথা ঠিক পেয়ে গেলাম আমাদের হুজুর(!)কে সেখানে। তাহলে ঘটনা সত্য। কেউ ভারতীয় দূতের সাথে মিটিং করলেই বাতিল হয়ে যায় না। এটা আমি জানি। তাই জানার চেষ্টা করলাম আমাদের হুজুর(!) কেন সেখানে গেলেন? কোন রাজনৈতিক আলাপ? দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়?

হুজুর(!) একটা ক্রেস্ট দিচ্ছেন। ক্রেস্টে লিখা রয়েছে বড় করে 'ফতওয়া'। বাকীটুকু পড়ার আর সুযোগ নেই। অন্তত আমার নেই। কারণ বয়স হয়েছে। চোখ এতো সুক্ষ জিনিস ধরতে পারে না। খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম, ব্যাপারখানা কী? জানা গেলো ঐ যে শুরুতে বললাম হুজুর(!) একখানা বই লিখেছেন। সেটাসহ নানান ব্যাপার।

দ্বীন এ ইলাহীর মতো সর্বধর্ম প্রার্থনা করতেন সেই হুজুর(!)

মুশরিকরা হুজুর(!) এর বই পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছেন। তাই তাকে স্বাগত জানিয়েছেন হাইকমিশনে। সুযোগ পেয়ে হুজুর(!) একখানা ক্রেস্ট বানিয়ে নিয়ে গেলেন। সাথে তার গুণধর দুই পুত্রকেও নিয়ে গেলেন।

এই হুজুর(!) এর আরো ব্যাপার রয়েছে। তিনি ভারত স্পন্সরড মুসলিম সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের একজন সদস্য ছিলেন। ২০০১ থেকে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুশরিকরা এই সরকারকে হটানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে আওয়ামীলীগের তৎকালীন সেক্রেটারি আব্দুল জলিল ৩০ এপ্রিল ২০০৪ একটি ডেডলাইন দিয়েছিল।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সেই ষড়যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ১৭ মে ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা করে জেএমবি। তারা প্রায় তিন মাস সরকারকে নাজেহাল করে ফেলে। এটাও জোট সরকার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ও সারাদেশে এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরি করে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়। আমার মনে আছে বাংলাদেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে জেএমবির বিরুদ্ধে মিছিল বের হয়েছিলো।

নাস্তিকদের সাথে তার সখ্যতা রাজনীতির মাঠ ছাড়িয়ে ড্রয়িং রুম পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এভাবেই আড্ডা দিতেন তিনি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই চৌকস সেনা অফিসারদের এই ভারত আওয়ামীলীগের সহায়তায় হত্যা করে বিডিয়ার বিদ্রোহের নামে। মুশরিকরা প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক মুশরিকরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এদেশের ঈমানদারদের হত্যা করিয়েছে। সেই ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল শাহবাগে নাস্তিকদের আন্দোলন।

যাই হোক আমরা আবার ফিরে আসি হুজুর(!) এর প্রসঙ্গে। এই হুজুর(!) জেএমবির একজন সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন। পরে অপরাধের ভয়াবহতা প্রমাণ হয়নি বিধায় মুক্তিও মিলেছে। আমি জেএমবির প্রসঙ্গ এইজন্যেই টেনেছিলাম। হুজুর(!) জেএমবিতেও ছিলেন শাহবাগেও ছিলেন। এটা অনেকে মিলাতে পারেন না। অথচ মিলটা কত সোজা! দুইটাই তো মুশরিকদের প্রজেক্ট। হুজুর(!) ভালো খেলেছেন। দুইদিকেই ছিলেন।

শাহবাগে গিয়ে তিনি নাকি সবচেয়ে বড় নেককাজ করেছেন!

কেন এই পোস্ট?
এই পোস্টটা হলো হুজুরকে চিনে রাখার জন্য। আসলে বর্তমান সময়ের জন্য এই পোস্ট নয়। এখনকার বেশিরভাগ মুসলিম তাকে অপছন্দ করে। কিন্তু বাঙালি গোল্ডফিস মেমোরি। কিছু সময় অতিবাহিত হলে পরে সব ভুলে বসে থাকে।

বাংলাদেশে যখন ৭১ এর গণ্ডগোল হয়েছিলো তখন বেশিরভাগ হুজুর এর বিরোধী ছিল। অন্তত ৮০ সাল পর্যন্ত মানুষ একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা করতো এখন যেভাবে শাহবাগীদের ঘৃণা করে। কিন্তু ধীরে ধীরে একাত্তর এখন মহান চেতনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কালক্রমে সব হুজুর(!) এখন একাত্তরকে মহান বলে। অনেকে তো একধাপ এগিয়ে নিজেদেরই মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে। এরপর পিনাকী বই লিখে 'মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম'। সেখানে দেখানো হয় একাত্তর ইসলামিস্টদেরই অবদান। একাত্তর মানেই ইসলাম, একাত্তর মানেই মুসলিম। আর এই বই দেখে বাংলার মুসলিম সমাজ হইচই করে উঠে। আসলেই তো...

মুশরিক ও শাহবাগী পিনাকী ভট্টাচার্যের লিখা "মুক্তিযুদ্ধে হুজুরদের মহান ভূমিকা" শীর্ষক বই 

এমন ভয়ংকর কাজ যাতে আমাদের পঞ্চাশ বছর পরে না হয়, তার জন্যই এই পোস্ট। এখন তো শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলো জানলে মুসলিম পরিবারে বিবাহই হয় না। কিন্তু এখন থেকে ৫০ বছর পর যদি শাহবাগ আন্দোলন কোন কারণে মহান কিছু হয়ে যায় তখন কেউ যাতে এই ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে দেখিয়ে বলতে না পারে শাহবাগ মুসলিমদের আন্দোলন ছিল।

মৃত্যু হুট করে চলে আসবে। আমাদের সন্তানদের হয়তো সবকিছু বলে যেতে পারবো না। কিন্তু তারা যাতে ভুল পথে পা না বাড়ায়, বিভ্রান্ত না হয়, সেজন্য এই পোস্ট। আমি দুনিয়া থেকে চলে গেলেও আমাদের সন্তানেরা এই লিখা পড়বে, জানবে। ইনশাআল্লাহ।

জিহাদের সাথে তার ছিল আজন্ম শত্রুতা

এই হুজুর(!) ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করে না। সে মুশরিকদের প্রতিনিধিত্বকারী। অতএব সাবধান থাকুন। তার কথায় বিভ্রান্ত হবেন না। এদেশের কওমীদের ভয় আর টাকার লোভ একসাথে দেখালে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে সময় নেয় না। 

ফরিদ উদ্দিন মাসউদ হাসিনাকে বুঝিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী দেয়ার লোভ দেখিয়ে অলরেডি কওমীদের হাত করে ফেলেছে। আগে যেভাবে মাসউদকে অগ্রাহ্য করতো এখন এতটা করেনা। কওমীরা ইতিমধ্যে ভুলে গিয়েছে ৫ মে ২০১৩ রাতে তাদের উপর ম্যসাকার চালানোতেও ভূমিকা ছিল এই হুজুরের(!)। সত্যিকারের ইসলামপন্থীরা ভুল করবে না এটাই আশাবাদ থাকলো।