১৫ আগ, ২০১৮

শেখ মুজিব হত্যার পরদিন কেমন ছিল মিডিয়ার ভূমিকা?


সারমেয়রা কোনোদিন মানুষ হয়ে উঠে না। বলছি মিডিয়ার সারমেয়দের কথা। মুজিব যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন মুজিবের স্তুতি করে তার পা চাটতে পছন্দ করতো কিছু মিডিয়া। তখন মিডিয়া বলতে শুধুমাত্র প্রিন্ট মিডিয়া মানে সংবাদপত্র। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে মুজিব তার পা চাটা ৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। সেই চারটি সংবাদপত্র হলো ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, অবজারভার আর বাংলাদেশ টাইমস।

এখন যেভাবে আমারদেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, পিস টিভি, একুশেসহ অনেকগুলো মিডিয়া দখল করা হয়েছে ঠিক তেমনি মুজিবও চারটি বাদে সব বন্ধ করে দিয়েছিলো। আর এই চারটি মিডিয়াতে কোন সাংবাদিক কাজ করতো না। কাজ করতো সারমেয়রা। যাই হোক সেই সারমেয়দের ভূমিকা কেমন ছিল তা একটু দেখা যেতে পারে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনামেও আসেনি। একই চিত্র ছিল তখন বাংলাদেশের অন্য তিনটি সংবাদপত্রগুলোতেও।

দৈনিক ইত্তেফাক
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে বাজারে আসা ওই সময়কার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের ৬ কলামের শিরোনাম ছিল- ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’।

এই প্রতিবেদনের ‘ইন্ট্রো’ বা সংবাদ সূচনাতেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ‘গ্রহণ’ই প্রাধান্য পেয়েছিল। সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনের শুরুটা হয়েছিল এভাবে, “রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।”

এরপর লেখা হয়েছিল, “শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।” ছয় কলামের এই সংবাদটির পাশেই দৈনিক ইত্তেফাক দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
ওই সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী; বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাফউদ্দৌলা রেজা। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাককে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবেই মনে করতেন পাঠকরা।

১৬ আগস্টের ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় আরও কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘অচল নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত’, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’, ‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’, ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’, ‘বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন’, ‘বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকিবে’, ‘বি এ সিদ্দিকী রেডক্রসের চেয়ারম্যান’ ইত্যাদি।



দৈনিক বাংলা
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন এনে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর ইত্তেফাকসহ চারটি দৈনিক পত্রিকাই তখন প্রকাশ হচ্ছিল। এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত ১৬ আগস্টের দৈনিক বাংলার আট কলামের শিরোনাম ছিল- “খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি।”

প্রধান এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা হয়েছে, “শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ নামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়।

শীর্ষ দৈনিকটির প্রথম পাতার অন্যান্য সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই’, ‘জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে: রাষ্ট্রপতি’, ‘দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে’, ‘অচল শতকী নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য ফেরত দেয়া হবে’, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত’। ইত্তেফাকের মতোই দৈনিক বাংলাতেও প্রধান সংবাদের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।



দ্য বাংলাদেশ টাইমস
দ্য বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুসতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’। এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি: মুজিব কিলড’।

মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল; যার শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’।

আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্যান্য শিরোনামগুলো ছিল, “পিপল থ্যাঙ্ক আর্মড ফোর্সেস’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, “ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়ার্ন ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপরাস কান্ট্রি’। প্রধান খবরে সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।



দ্য বাংলাদেশ অবজারভার
ওবায়দুল হক সম্পাদিত সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের ১৬ অগাস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘মুশতাক বিকামস প্রেসিডেন্ট’। শিরোনামের শোল্ডার ছিল- ‘আর্মড ফোর্সেস টেক ওভার: মার্শাল ল প্রোক্লেইমড: কারফিউ ইমপোজড’। সাভেডিং এ লেখা ছিল, ‘মুজিব কিলড: সিচুয়েশন রিমেইনস কাম’। আট কলামের প্রধান শিরোনামের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছিল।

প্রধান সংবাদের নিচে ‘হিস্টরিক্যাল নেসেসিটি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়। তার পাশের দুটি সংবাদের শিরোনাম, ‘স্পেশাল প্রেয়ার্স’, ‘মুশতাক কলস ফর কো-অপারেশন’।

পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্য শিরোনামগুলো ছিল, ‘পিপল হেইল টেক-ওভার’, ‘পাকিস্তান অ্যাকর্ডস রেকগনিশন’, ‘ইনভায়োবিলিটি অব ফরেন মিশনস অ্যাশিউরড’, ‘জাস্টিস মাস্ট বি এসটাব্লিশড: প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক হার্ড টু ইমপ্রুভ কনডিশন কুইকলি’, ‘ইউএস রেডি টু কনডাক্ট নরম্যাল ডিপ্লোম্যাটিক বিজনেস’, ‘কারফিউ রিল্যাক্সড ফর জুম্মা প্রেয়ার্স’।

যাস্ট একটু চিন্তা করুন, যারা এতদিন মুজিবের দালালি করেছিলো তারাই হুট করে উল্টে গিয়ে মুজিবের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখে বসলো। মাত্র একদিনে এত বিশাল পরিবর্তন! আজকে যারা হাসিনার পদলেহন করতে গিয়ে জিহ্বা ক্ষয় করে ফেলছে কালকে পটপরিবর্তন হলে তারাই সবার আগে হাসিনার চরিত্র হনন করবে। স্বৈরাচারীদের এটাই পরিণতি।

1 টি মন্তব্য: