১৮ ফেব, ২০১৯

বরং অপবাদের জন্য ক্ষমা চাওয়াটাই অপরাধ




গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, আপনারা তা জানেন। আমাদের সম্মানিত নেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে মূলত দুটো বিষয়কে সামনে এনেছেন। 

১- একাত্তরের জন্য ক্ষমা চাওয়া। 
২- জামায়াতের পরিচালনা পদ্ধতি ও তত্ত্বে সংস্কার করা। 

আমরা এখানে মূলত প্রথম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।

একাত্তর ইস্যুতে ক্ষমা চাওয়া হবে কি হবে না তার আগে এটা ফাইনাল করা দরকার জামায়াত কি অপরাধ করেছে? ৭১-এ জামায়াত ভারতের সহায়তা ও সমাজতন্ত্রীদের বিপ্লবে পাকিস্তান ভাঙার বিপক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। শুধু জামায়াত কেন সকল তাওহীদবাদী মানুষ সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এটাও শুধু নয় এদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দেশের অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই বিষয়ে জানতে পড়ুন, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান : পর্ব-০১পর্ব-০২ 

৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো। সেই সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কথা বলেছে জামায়াত। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দেশ ভাঙার মধ্যে দিয়ে হয় না। তার উপর সেই দেশ ভাঙা হয়েছে মুশরিকদের সহায়তায়।

আজকের বাংলাদেশে ৭১ এর চেয়েও বেশি রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজ করছে। পুলিশ, র‍্যাব, আর্মিসহ সবাই জামায়াত ও জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর খড়গ ও নির্যাতন চালিয়েছে। দখল করে নিয়েছে। এর মানে এই নয় যে জামায়াত বাংলাদেশকে ভেঙে দিবে বিদেশী কোন ষড়যন্ত্রে। এমনকি আরেক নির্যাতিত দল বিএনপিও যদি দেশ ভাঙতে চায় জামায়াত রাজনৈতিকভাবে এর বিরোধীতা করবে। দেশভাঙার ষড়যন্ত্রে জামায়াত কখনোই নিজেকে সম্পৃক্ত করবে না, করতে পারে না। 

জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমানের ভূমিকা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী আপোসহীন। দুনিয়ার কোনো স্বার্থে জামায়াত কখনও আদর্শ বা নীতির বিসর্জন দেয়নি। এটুকু মূলকথা যারা উপলব্ধি করে, তাদের পক্ষে ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। 

জামায়াত কেন সে সময় পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষ নিয়েছে তা নিয়ে জামায়াত বহুবার তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম ও সাবেক আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বিভিন্ন বক্তব্যে এই বিষয়ে দলের অবস্থান জানিয়েছেন দেশবাসীকে। এই বিষয় পরিষ্কার করার দরকার পড়েনি ৭১ এর সমসাময়িক সময়ে। আমরা যারা একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের জন্যই বেশি প্রয়োজন ৭১ এর অবস্থানের ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যই অধ্যাপক গোলাম আযম পলাশী থেকে বাংলাদেশ নামক ছোট বইটি লিখেছেন। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা তুলে ধরতে চাই।  

প্রথমত
মানুষের বেঁচে থাকার, বিশ্বাস অনুযায়ী চলার, পছন্দমত কাজ করার এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বাধীনতাই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তখন অন্য অনেকের মতই জামায়াতে ইসলামীও চিন্তা করেছিল এই সংগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আনার পরিবর্তে বিশ্বাস ও কাজের যতটুকু স্বাধীনতা ৪৭ এর পাকিস্তান অর্জনের মাধ্যমে এসেছিল, তাও হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা। এই আশংকা থেকেই জামায়াত ওই সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেনি। শুধু জামায়াত নয়, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ অনেক দল এবং জনগণের বড় একটি অংশও স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারেনি। বলাই বাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত সে সময় অতি ক্ষুদ্র একটি দল ছিল।

দ্বিতীয়ত
বস্তুত বাংলাদেশ নামক যে জনপদে বর্তমানে আমরা বাস করছি, এই জনপদকে শুধু ১৯৭১ থেকে চিন্তা করলে হবেনা, এর ইতিহাস হাজার বছরের। সেই আর্য, পাল, সেন, সুলতানী, শাহী থেকে শুরু করে শায়েস্তা খান, ইসলাম খান, সিরাজুদ্দৌলা, ইংরেজ অতঃপর ৪৭ এর পাকিস্তান হয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ। এর প্রতিটি ধাপেই বহুবার এই ভূখন্ডের মানচিত্র পরিবর্তন হয়েছে, নামের পরিবর্তন হয়েছে, শাসকের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ কখনো স্বাধীনতা পেয়েছে, কখোনো বঞ্চিত হয়েছে।
৪৭ এর পাকিস্তান-ভারত বিভাজনের আগে এই অঞ্চলের মানুষগুলো চরমভাবে নিষ্পেষিত ছিল ব্রিটিশ শাসক আর হিন্দু শেঠ ও জমিদারদের হাতে। ৭১ এ বহু মানুষ বেঁচে ছিলেন যাদের স্মৃতিতে তখনও বৃটিশ-হিন্দুদের নিষ্পেষণ জ্বলজলে ছিল। ৭১ এ ভারতের সহায়তায় যুদ্ধ করে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দূর্বল পূর্ব পাকিস্তান আদৌ পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারবে নাকি ভারতের মত চানক্যবাদী রাষ্ট্রের করাল গ্রাসে বিলিন হতে হবে তা নিয়ে আশংকা ছিল সচেতন মানুষের মনে।

জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ ৪৭ এর অর্জন নস্যাত হয়ে ভারতের গোলামীতে পুনরায় ফিরে যাবার আশংকা থেকেই ৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে পারেনি। যে ইসলামী আন্দোলন এ ভূখন্ডে ইসলামী রাষ্ট্র দেখতে চায় তা ব্রাহ্মণবাদী ভারতের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

তৃতীয়ত
জামায়াত মনে করেছিল শেখ মুজিব যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি তেমনি ভূট্টোও পূর্ব পাকিস্তানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং সমগ্র পাকিস্থানের একক কোন গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি না থাকায় দুই দেশ পার্লামেন্টের মাধ্যমে এমনিতেই ভাগ হয়ে যেত। অনেক দেশই শান্তিপূর্নভাবে যুদ্ধ ছাড়াই স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। ভারত-পাকিস্থান তার প্রকৃত উদাহরণ। জামায়াত মূলত এটাই চেয়েছিল। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল ভারতের সহায়তায় এদেশ স্বাধীন হলে এদেশ অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ভারতের বাজারে পরিণত হবে যাকে কখনোই প্রকৃত স্বাধীন বলা যাবে না। এ কারনেই কিছুদিন আগে কাদের সিদ্দিকী বলেছেন “জামায়াত যে আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি, দেশ এখন সেদিকেই যাচ্ছে।”

চতুর্থত 
আদর্শগত কারণেই জামায়াতের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহকগণের সহযোগী হওয়া সম্ভব ছিল না। যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান বলে সচেতনভাবে বিশ্বাস করে, তারা এ দুটো মতবাদকে তাদের ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী মনে করতে বাধ্য। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস দলের আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই এ মতবাদের অসারতা বলিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে যারা ভাঙ্গনের পক্ষে কাজ করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহক। আর সমাজতন্ত্রের ভিত্তিই হলো ধর্মহীনতা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হয়েছে। এর যা কুফল দেখা তার চাইতেও বেশি ক্ষতি ইসলামের হতে পারতো যদি জামায়াত জীবন বাজী রেখে আবারো এই দেশে কাজ শুরু না করতো। 

পঞ্চমত 
পাকিস্তানের প্রতি ভারত সরকারের অতীত আচরণ থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে এদেশের এবং মুসলিম জনগণের বন্ধু মনে করাও কঠিন ছিল। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সঙ্গত কারণেই তাদের যে আধিপত্য সৃষ্টি হবে এর পরিণাম মংগলজনক হতে পারে না বলেই জামায়াতের প্রবল আশংকা ছিল।

ষষ্ঠত 
জামায়াত একথা বিশ্বাস করত যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলে গোটা পাকিস্তানে এ অঞ্চলের প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে। তাই জনগণের হাতে ক্ষমতা বহাল করার আন্দোলনের মাধ্যমেই জামায়াত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন করতে চেয়েছিল।

সপ্তমত 
জামায়াত বিশ্বাস করত যে, প্রতিবেশী সম্প্রসারণবাদী দেশটির বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্রভুক্ত থাকাই সুবিধাজনক। আলাদা হয়ে গেলে ভারত সরকারের আধিপত্য রোধ করা পূর্বাঞ্চলের একার পক্ষে বেশি কঠিন হবে। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগলিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং ভারত দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় এ অঞ্চলের নিরপত্তা প্রশ্নটি জামায়াতের নিকট উদ্বেগের বিষয় ছিল।

অষ্টমত 
জামায়াত একথা মনে করত যে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে ভারতের সাথে সমমর্যাদায় লেনদেন সম্ভব হবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব জিনিস এখানে আমদানি করা হতো, আলাদা হবার পর সে সব ভারত থেকে নিতে হবে। কিন্তু এর বদলে ভারত আমাদের জিনিস সমপরিমাণে নিতে পারবে না। কারণ রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের আমাদের প্রয়োজন নেই। ফলে আমরা অসম বাণিজ্যের সমস্যায় পড়ব এবং এদেশ কার্যত ভারতের বাজারে পরিণত হবে।

নবমত 
জামায়াত পূর্ণাংগ ইসলামী সমাজ কায়েমের মাধ্যমেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা এবং সকল বৈষম্যের অবসান করতে চেয়েছিল। জামায়াতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে,আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম হলে বে-ইনসাফী, যুলুম ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের সত্যিকার মুক্তি আসবে।

এসব কারণে জামায়াতে ইসলামী তখন আলাদা হবার পক্ষে ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এদেশে যারাই জামায়াতের সাথে জড়িত ছিল, তারা বাস্তত সত্য হিসাবে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়েছে। যে জামায়াত বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য, বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য, ইসলামের আদর্শকে উচ্চকিত রাখার জন্য পাকিস্তান ভাঙ্গনের বিরোধীতা করেছে সে জামায়াত কখনোই বাংলাদেশবিরোধী হতে পারে না। এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে জামায়াত। এই ভূখণ্ডকে সব ধরণের অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য জামায়াতের কর্মীরা জীবনবাজী রাখতে প্রস্তুত। 

স্বাধীনতার বিরোধিতা আর যুদ্ধাপরাধ এক জিনিস নয়
মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা আর যুদ্ধের সময় অপরাধ করা এক জিনিস নয়। যে কোন একটি কাজের বিরোধিতা করার অধিকার সকলেরই আছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু পাকিস্তান হয়ে যাবার পর তা মেনে নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তারা পাকিস্তানের শাষন ক্ষমতায়ও এসেছেন, তারা মনে করেছিলেন পাকিস্তান ভাগ না হওয়াটাই ভাল হবে। এ ধরণের বিরোধিতা চিন্তা ও মত প্রকাশ স্বাধীনতারই অংশ। শেরে বাংলা লাহোর প্রস্তাব করলেও ৪৬ এর নির্বাচনে পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন, পরবর্তীতে সেই পাকিস্তানেরই মন্ত্রী হয়েছেন।

জনাব সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে যখন বঙ্গদেশ ও আসামকে মিলিয়ে “গ্রেটার বেংগল” গঠন করার উদ্দেশ্যে তিনি শরৎ বসুর সাথে মিলে চেষ্টা করেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো না। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। পশ্চিমবঙ্গের বিপুল সংখ্যক মুসলমানের স্বার্থরক্ষা এবং কোলকাতা মহানগরীকে এককভাবে হিন্দুদের হাতে তুলে না দিয়ে বাংলা ও আসামের মুসলমানদের প্রাধান্য রক্ষাই হয়তো তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল। কিন্তু পরে যখন তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন, তখন তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে পাকিস্তানের দুশমন বলে ঘোষণা করা হয় এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তিনিই পরে পাকিস্তানের উজিরে আযম (প্রধানমন্ত্রী) হবারও সুযোগ লাভ করেন। বলিষ্ঠ ও যোগ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার প্রয়োজনে দুর্বল নেতারা এ ধরনের রাজনৈতিক গালির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের গালি দ্বারা কোন দেশপ্রেমিক জননেতার জনপ্রিয়তা খতম করা সম্ভব হয়নি।

তাই ’৭১-এর ভূমিকাকে ভিত্তি করে যে সব নেতা ও দলকে “স্বাধীনতার দুশমন” ও “বাংলাদেশের শত্রু” বলে গালি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যতই বিষেদাগার করা হোক, তাদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও জনপ্রিয়তা ম্লান করা সম্ভব হবে না। এদেশের ইসলামপন্থী মানুষের ভালোবাসার জায়গা জামায়াতে ইসলামী। শুধু তাই নয়, গত কয়েকবছরে অব্যাহত মিডিয়ার অপপ্রচারেও জামায়াত উপজেলা নির্বাচনে কোটি কোটি ভোট পেয়ে নিশ্চিত করেছে স্বৈরাচারী সরকারের বিপরীতে মানুষের আস্থার জায়গা জামায়াত।

যুদ্ধাপরাধী হলো যারা যুদ্ধ চলাকালীন বেসামরিক হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত ছিলো। জামায়াত কোনো সশস্ত্র সংগঠন নয়, জামায়াত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। জামায়াত দেশভাগ চায়নি কিন্তু জামায়াত যুদ্ধেও জড়িত হয়নি। আর এই ধরণের অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এই ধরণের অপরাধে যারা জড়িত হয়েছিলো তাদের অধিকাংশরাই যুদ্ধের পরপরই শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। তৎকালীন শেখ মুজিব সরকার তাদের বিচারও করেছে। সেসময়ে অপরাধী সাব্যস্থ হওয়াদের মধ্যে একজন জামায়াত নেতাও নেই। আজ এত বছর পরে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ একান্তই ভারতকে খুশি করার উদ্দেশ্যে। 

জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়
ভুল করলে কেউ ক্ষমা চাইতে পারে। কিন্তু ভুল না করে ক্ষমা কেন চাইবে? সাধারণত কোনো জয়ী হয়ে গেলে দুনিয়ার দৃষ্টিতে তাদের সফল ও শুদ্ধ ভাবা হয়। কিন্তু সত্য বিষয়টা আলাদা। সত্য মিথ্যার সাথে হেরে গেলেও সত্য সত্যই থাকে। জামায়াত তাই সত্যের সাথেই থাকবে।  

তিতুমীর, ফকীর বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ প্রতিটি আন্দোলন পরাজিত হওয়ার পর এদেশের মানুষ তাদের অবিবেচক বলেছে, খারাপ বলেছে। বিশেষ করে তিতুমীরের বিরুদ্ধে মুসলিমরাও ক্ষেপে উঠেছিলো। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী তিতুমীর আজ আমাদের জাতীয় নায়ক।

তাই জামায়াতের সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক এই বিচার হওয়া উচিত জামায়াতের উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড দিয়ে। জামায়াত যুদ্ধের বিপক্ষে ও দেশ ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দেশকে সেক্যুলার ও কমিউনিস্টদের হাতে তুলে দেয়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছে। জামায়াত যতটা না পাকিস্তানপন্থি হয়ে ৭১ এ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো, তার চেয়ে বেশি একটি গ্রেটার মুসলিম সভেরিন এন্টিটির বিভাজনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের চাইতে জামায়াত এই আদর্শিক জায়গাটাকেই মৌলিক হিসেবে দেখে।
জামায়াতের প্রতিটি আশংকা আজ সত্য হয়েছে। যারা সরাসরি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে এমন লোকদের দল বিএনপি। তারা দেখেছে ৭১ এ যে ভোটের অধিকার বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়নি, আজ ৪৭ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলেছে।

জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধের নামে দেশকে ভারতের করায়ত্বে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হয়নি। দেশকে ভারতের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আজকে বাংলাদেশের নামে যতটুকু স্বাধীন আছে ততটুকুও বলা চলে জামায়াতের অবদান। সর্বশেষ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান করতে পারে নি ভারত জামায়াতের শক্তিশালী বিরোধীতার জন্য। জামায়াত এদেশের মানুষকে ভারতের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে।

জামায়াতকে ক্ষমা চাইতে বলা মানুষগুলো মূলত জামায়াতের শত্রু। শুধু জামায়াত নয় তারা বাংলাদেশেরও শত্রু। তারা এর মাধ্যমে জামায়াতের উপর ৭১-এ ঘটে যাওয়া সবগুলো অন্যায় কাজের দায় মাথায় তুলে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। এদেশে বহু মানুষ জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই বিষয়টা এখন যেমন আওয়ামীলীগের কাদের প্রতিদিন বিএনপিকে পরামর্শ দেয় সেরকম। 

জামায়াত একাত্তরের জন্য ক্ষমা চাওয়া মানে তাদের রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেকটুকু মেরে দেওয়া। এতটুকু বুঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর এই চাওয়াটা মূলত ভারতপন্থীদের। ভারত বাংলাদেশে তাদের আগ্রাসনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে জামায়াতকে। এজন্য তারা এদেশের রাজনীতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে জামায়াত কোনোভাবে ক্ষমতার অংশীদার না হতে পারে।

ক্ষমা চাওয়ানোর মাধ্যমে ভারতপন্থী মানুষগুলো চায় জামায়াত বিলুপ্ত হয়ে যাক, নিঃশেষ হয়ে যাক। তবেই এদেশে আর ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলার ও সচেতন করার কেউ থাকবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য আওয়ামী ভারতপন্থীদের মিষ্টি কথায় ও হুমকি-ধামকিতে প্রভাবিত হয়েছে অনেকে। এর মধ্যে আমাদের প্রিয় নেতা থাকবেন আমরা তা ভাবতে পারি না। আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন এবং নিজের বক্তব্যের অযৌক্তিকতা ও অসারতা তিনি খুব দ্রুতই অনুধাবন করতে পারবেন।

৭১-এ ঘটে যাওয়া অনেক হত্যা, গণহত্যার ও ধর্ষনের অভিযোগ জামায়াত নেতাদের উপর চাপিয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার। অন্যায় বিচার প্রক্রিয়ায় এই পর্যন্ত খুন করা হয়েছে পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে হত্যা করা হয়েছে এসব অভিযোগ জনগণ বিশ্বাস করা তো দূরের বিষয় খোদ আওয়ামীলীগাররাও বিশ্বাস করে না।

এমন অবস্থায় এসব অপবাদের জন্য ক্ষমা চাওয়ার অর্থ মিথ্যা অভিযোগগুলো সত্য বলে স্বীকার করে নেয়া, জামায়াতকে ধ্বংস করা, সত্যকে মিথ্যার কাছে পরাস্ত করা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভারতীয় মুশরিকদের কর্তৃত্ব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা। তাই মিথ্যা অভিযোগের জন্য ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না বরং অপবাদের জন্য ক্ষমা চাওয়াটাই অপরাধ। জামায়াত নিশ্চয়ই এই অপরাধ করবে না ইনশাআল্লাহ।