২৭ মে, ২০১৯

ইসলামী রাষ্ট্র কেন অত্যাবশ্যকীয়?



আজকাল অনেক মুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই নিয়ে তারা সমাজে নানান বিভ্রান্তি তৈরি করছেন। তাই আজকের আলোচনা ইসলামী রাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন? মুসলমানরা যদি মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের গোটা জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সকল বিষয়ের ফয়সালা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন ও শরীয়াহ মোতাবেক করতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। 

প্রথমত :
আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান পোষণ করার ঘোষণা করবেন আর জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি পরিচালনা করবেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলাম কোনো অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। এর চাইতে বড় স্ববিরোধিতা আর কিছু হতে পারেনা। এই স্ববিরোধিতাকে বরদাশত করার জন্যে নয়, নির্মূল করার জন্যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা যে ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র দাবী করছি, তার পেছনে এই অনুভূতিই কাজ করছে যে, মুসলমান যদি আল্লাহর আইনই মেনে না চলে, তবে তো তার মুসলমান হবার দাবীই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। গোটা কুরআনই এই নির্জলা সত্য কথাটির সাক্ষ্য দিচ্ছে। 

কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহই সমস্ত জগত ও সাম্রাজ্যের মালিক। তিনি স্রষ্টা, সৃষ্টিজগত তাঁর। তাই স্বাভাবিকভাবেই শাসনের অধিকার কেবল তাঁরই থাকা উচিত। তাঁর রাজ্যে তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর ছাড়া অপর কারো শাসন সার্বভৌমত্ব চলা মূলতই ভ্রান্ত। সঠিক পন্থা কেবল একটিই। তাহলো, তাঁর খলীফা ও প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর প্রদত্ত আইন ও বিধান অনুযায়ী শাসন পরিচালিত হবে এবং কার্যসম্পাদিত হবে। তাঁর অকাট্য ঘোষণা হলো : 

ক. বলোঃ হে সাম্রাজ্য ও সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে চাও রাজ্যক্ষমতা দান করো। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। [সূরা আলে ইমরানঃ ২৬]
খ. তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রভূ প্রতিপালক। গোটা সাম্রাজ্য তাঁর। [সূরা ফাতিরঃ ১৩]
গ. রাজত্বে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১১১]
ঘ. সুতরাং সমস্ত কর্তৃত্ব সমুচ্চ মহান আল্লাহর। [সূরা আল মুমিনঃ ১২]
ঙ. তিনি তাঁর কর্তৃত্বে কাউকেও অংশীদার বানাননা। [সূরা আল কাহাফঃ ২৬]
চ. সাবধান! সৃষ্টি তার, কর্তৃত্বও তাঁর। [সূরা আ’রাফঃ ৫৪]
ছ. ওরা জিজ্ঞেস করছেঃ কর্তৃত্বে আমাদেরও অংশ আছে কি? বলোঃ কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। [সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৪]

দ্বিতীয়ত :
এই মূলনীতির ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের অধিকার মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারণ, মানুষ তো হলো আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর রাজত্বের প্রজা। তাঁর দাস এবং তাঁর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধীন। তাই মানুষের কাজ হলো কেবল তার স্রষ্টা রাজাধিকারাজের আইন মেনে চলা। এক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত আইনের সীমার মধ্যে অবস্থান করে ইজতিহাদ ও গবেষণার মাধ্যমে প্রাসংগিক বিধি প্রণয়নের নিয়ন্ত্রিত অধিকারই কেবল মানুষের রয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা. যেসব বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি কোনো হুকুম প্রদান করেননি, সেসব ক্ষেত্রেও শরীয়তের প্রাণসত্তা এবং ইসলামের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধি প্রণয়নের অধিকারও মুমিনদের দেয়া হয়েছে। কেননা এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রসূলের সরাসরি কোনো বক্তব্য না থাকাটাই একথার প্রমাণ যে এসব ক্ষেত্রে নিয়ম বিধি প্রণয়নের আইনগত অধিকার মুমিনদের দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে মৌলিক কথাটি স্পষ্ট থাকতে হবে, তা হলো, আল্লাহ প্রদত্ত আইনের সীমারেখার আওতামুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি বা সংস্থা নিজেই স্বাধীনভাবে কোনো আইন প্রণয়ন করবে, কিংবা অপর কারো রচিত আইন মেনে চলবে, সে তাগুত, বিদ্রোহী এবং খোদার আনুগত্য থেকে বিচ্যুত। আর এমন ব্যক্তির কাছে যে-ই ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত চাইবে এবং তার প্রদত্ত ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত মেনে নেবে সেও বিদ্রোহের অপরাধে অপরাধী। 

এসব ফায়সালা স্বয়ং আল্লাহরঃ
ক. আর তোমাদের মুখ যেসব জিনিসের কথা উচ্চারণ করে, সেসব বিষয় তোমরা মনগড়াভাবে বলোনা যে, এটা হালাল আর এটা হারাম। [সূরা আন নহলঃ ১১৬]
খ. তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তারই অনুসরণ করো। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো [মনগড়া] কর্তা ও পৃষ্ঠপোষকের অনুসরণ করো না। [সূরা আ’রাফঃ ৩]
গ. আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী যারা ফায়সালা করেনা, তারা কাফির। [সূরা আল মায়িদাঃ ৪৪]
ঘ. হে নবী! তুমি সেইসব লোকদের দেখনি যারা হিদায়াতের প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে যা তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে? কিন্তু তারা নিজেদের যাবতীয় বিষয়ে ফায়সালা করিয়ে নিতে চায় তাগুতদের দিয়ে। অথচ তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তাগুতকে অস্বীকার করতে। শয়তান চায় তাদের বিভ্রান্ত করতে [সূরা আন নিসাঃ ৬০]

তৃতীয়ত : 
বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহ তা’য়ালার এই পৃথিবীতে সঠিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা কেবল সেটাই, যা তাঁর নবী রসূলদের মাধ্যমে প্রেরিত আইনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এর নাম হলো, খিলাফত। 

কুরআন এই প্রসঙ্গে যা বলে- 
ক. আমি যে রসূলকেই পাঠিয়েছি, এজন্যেই পাঠিয়েছি, যেনো আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতে তার আনুগত্য করা হয়। [সূরা আন নিসাঃ ৬৪]
খ. হে নবী! পূর্ণ সত্যতার সাথে আমরা এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে করে আল্লাহর দেখানো সত্যালোকের মাধ্যমে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করতে পারো। [সূরা আন নিসাঃ ১০৫]
গ. আর আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী তুমি তাদের মাঝে ফায়সালা করো। তাদের ইচ্ছা বাসনার অনুসরণ করো না। সাবধান থেকো, তারা যেনো তোমাকে ফিতনার নিমজ্জিত করে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান থেকে এক বিন্দুও বিভ্রান্ত করতে না পারে। [সূরা আল মায়িদাঃ ৪৯]
ঘ. তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?। [সূরা আল মায়িদাঃ ৫০]
ঙ. হে দাউদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি লোকদের মধ্যে সত্যের ভিত্তিতে শাসন চালাও। ইচ্ছা বাসনার অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। [সূরা সোয়াদঃ ২৬]

চতুর্থত : 
যে কোনো ধরণের শাসনব্যবস্থাই বাতিল যদি সেসব ব্যবস্থা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী না হয়। এসব শাসনব্যবস্থার ধরন ও  প্রকৃতির মধ্যে যতোই বিভিন্নতা থাকুকনা কেনো, তাতে কিছু যায় আসেনা। এগুলোর সমস্ত কর্মকান্ড ভিত্তিহীন, বৈষম্যপূর্ণ ও ভ্রান্ত। শাসন পরিচালনা এবং রায় প্রদানের মূলত তাদের কোনো বৈধ ভিত্তি নেই। 

মুসলিমরা নিজেদের প্রকৃত মালিক আল্লাহর বিদ্রোহীদের আনুগত্য করা এবং তাদের কাছে নিজেদের বিষয়াদির ফায়সালা চাওয়া মুমিনদের কাজ নয়। যদি কেউ এমনটি করে, তাবে নিজেকে মুমিন ও মুসলিম দাবী করা সত্ত্বেও সে আল্লাহর অনুগতদের দল থেকে বিচ্যুত। একথা সরাসরি বিবেক বুদ্ধির সাথেও সাংঘর্ষিক যে, কোনো সরকার একটি গোষ্ঠীকে বিদ্রোহী বলেও আখ্যায়িত করবে, আবার স্বীয় প্রজাদের উপর সেই বিদ্রোহীদের কর্তাগিরি করাকেও বৈধ বলে মেনে নেবে এবং প্রজাদের তাদের শাসন মেনে চালারও অনুমতি দেবে। 

দেখুন কুরআন কি বলে : 
ক. হে নবী, তাদের বলোঃ আমরা কি তোমাদের বলবো, নিজেদের আমলের দিক থেকে সবচেয়ে ব্যর্থ ও অসফল লোক কারা? তারা হলো সেইসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনা বিপথগামী হয়েছে। [অর্থাৎ মানুষের চেষ্টাসাধনার মূল উদ্দেশ্য হাসিলের পথে ধাবিত হয়েছে।] অথচ, তারা মনে করছে যে তারা দারুণ ভালো কাজ করছে। এরা হলো সেইসব লোক, যারা তাদের মালিকের আয়াতসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর নিকট উপস্থিত হবার বিষয়টিও বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের যাবতীয় আমল নিষ্ফল [শূণ্য] হয়ে গেলো। কিয়ামতের দিন আমরা তাদের কোনো গুরুত্বই দেব না। [সূরা আল কাহাফঃ ৩-৫]
খ. এ হচ্ছে আ’দ [জাতি], যারা তাদের প্রভুর বিধান মানতে অস্বীকার করেছিলো এবং তাঁর রাসূলদের আনুগত্য পরিহার করেছিলো আর অনুগামী হয়েছিলো সত্যদ্বীন অমান্যকারী প্রত্যেক দাম্ভিক দুর্দন্ড দুশমনের। [সূরা হুদঃ ৫৯]
গ. আমরা আমাদের নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ মূসাকে ফিরাউন আর তার রাজন্যবর্গের প্রতি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা ফিরাউনের নির্দেশেরই অনুগামী হলো, অথচ ফিরাউনের নির্দেশ সঠিক ছিলোনা । [সূরা হুদঃ ৯২]
ঘ. এমন কোনো ব্যক্তির আনুগত্য করোনা, যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে স্বীয় কামনা বাসনার অনুগামী হবার নীতি গ্রহণ করেছে আর যার কর্মনীতিই সীমালংঘমূলক। [সূরা আল কাহাফঃ ২৮]
ঙ. হে মুহাম্মদ! বলো, আমার প্রভু অশ্লীলতাকে তার গোপনীয় ও প্রকাশ্য সকল দিক সমেত, পাপ কাজকে, অন্যায়ভাবে পরস্পরের প্রতি বাড়াবাড়ি করাকে এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রমাণ ছাড়াই কাউকেও আল্লাহর  প্রতিপক্ষ বানানোকে হারাম করে দিয়েছেন। [সূরা আল আ’রাফঃ ৩৩]
চ. সার্বভৌম ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহর। তাঁর নির্দেশ হলো, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো গোলামী করোনা। [ সূরা ইউসূফঃ ৪০]
ছ. সঠিক পথ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেবার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের সা. সাথে বিরোধ করবে এবং মুমিনদের নীতি আদর্শের বিপরীত পথে চলবে, তাকে আমরা সেদিকে চালাবো, যেদিকে সে নিজেই মোড় নিয়েছে। আর তাকে আমরা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো, যা খুবই নিকৃষ্ট স্থান। [সূরা আন নিসাঃ ১১৫]

এগুলো হলো কুরআনের অকাট্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলী। এরকম আয়াত আরো রয়েছে। এগুলোতে সন্দেহ সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। 

পঞ্চমত : 
মুসলমানরা ততক্ষন পর্যন্ত তাদের ঈমানের দাবী পূরণ করতে পারেনা, যতক্ষণ না তারা ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। আল্লাহর আইনের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুসলমানরা পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে পারেনা। তাই তাদের দ্বীন ও ঈমানের দাবীই হলো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজেদের যাবতীয় বিষয়াদি আল্লাহর আইনের ভিত্তিতে মীমাংসা ও পরিচালিত করা। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যেই নবীগণ প্রেরিত হয়েছেন। 

সে জন্যেই তো হিজরতের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানীতে এই দোয়া করানো হয়েছে :
“প্রার্থনা করোঃ প্রভূ, আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে সত্যতার সাথে নিয়ে যেয়ো। আর যেখানে থেকেই বের করবে সত্যতার সাথেই বের করো। আর তোমার পক্ষ থেকে একটি ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮০]

অর্থাৎ, হয় আমাকেই ক্ষমতা দান করো, নয়তো অপর কোনো রাষ্ট্রকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যেনো আমি তার ক্ষমতার সাহায্য নিয়ে বিশ্বের এই মহাবিপর্যয়কে প্রতিরোধ ও সংশোধন করতে পারি। যেনো অশ্লীলতা ও পাপের এই প্লাবনের মোকাবিলা করতে পারি। যেনো তোমার সুবিচারপূর্ণ আইনকে কার্যকর করতে পারি। হাসান বসরী এবং কাতাদা (র) এ আয়াতের এই তাফসীরই করেছেন। ইবনে কাসীর এবং ইবনে জরীরের মতো মর্যাদাবান মুফাসসিরগণও এ মতই প্রকাশ করেছেন।  

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন এদেরকে যদি আমি পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করি, তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ হতে লোকদের বিরত রাখবে।” [সূরা আল হাজ্জ: ৪১]

এ থেকে প্রমাণ হলো, ইসলাম বিশ্বে যে সংস্কার সংশোধন চায়, তা শুধুমাত্র উপদেশ নসীহতের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারেনা। তা কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্রক্ষমতাও অপরিহার্য। তাছাড়া আল্লাহ নিজেই যখন তার নবীকে এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, তখন তা থেকে তো একথা পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ হয় যে, আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা, তাঁর শরীয়াকে কার্যকর করা এবং তার আইন ও বিধানকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া এবং তা পাওয়ার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম করা যে শুধু জায়েয তাই নয়, বরঞ্চ অত্যাবশ্যকীয়। 

যারা এই কাজকে দুনিয়া পূজা বা দুনিয়াদারী বলে মনে করে, তারা সাংঘাতিক ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত। তবে একথা সত্য, যদি কেউ নিজের জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায়, তবে তা নিসন্দেহে দুনিয়া পূজা। কিন্তু ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া কোনোক্রমেই দুনিয়া পূজা হতে পারেনা। বরং আল্লাহর গোলামী করার প্রকৃত দাবীই এটা।

বি. দ্র. : এখানে অনেকগুলো কুরআনের আয়াত সংকলন করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরো আয়াত তুলে ধরা যায়নি প্রবন্ধের আকার বড় হওয়ার আশংকায়। আপনারা মেহেরবানি করে কুরআন থেকে আয়াতগুলো পড়ে নিবেন। বেশ চমৎকৃত হবেন একথা নিশ্চিত।

২৩ মে, ২০১৯

একনজরে বদর যুদ্ধের ঘটনাবলি



আজ ১৭ রমজান। মহান বদর দিবস। বদরের যুদ্ধ ২ হিজরির ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রধান যুদ্ধ। এতে জয়ের ফলে মুসলিমদের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। ইসলামী হুকুমাত হিসেবে মদিনা স্বীকৃতি লাভ করে। 

যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। বদর ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধে সুসংগঠিত মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ আবু জাহল নিহত হয়। মুসলিমদের বিজয়ের অন্যদের কাছে বার্তা পৌছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এর ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ (সা) এর অবস্থান সুদৃঢ় হয়।

যুদ্ধের কারণ : 
ইসলাম প্রচার শুরু করার পর মুহাম্মাদ (সা) মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে বিরোধীতার সম্মুখীন হন। মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করে। মুহাম্মাদ (সা) নিজেও এক পর্যায়ে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের পরে অবতীর্ণ সূরা হজ্জে ৩৯ নং আয়াতে মুসলিমদেরকে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেয়া হয়। “যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ।" মদিনায় আসার পর মুহাম্মাদ (সা) তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। 
প্রথমত, মদিনার গোত্রগুলির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করা হয়; 
দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়; 
তৃতীয়ত, মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো হয়। এরপর সিরিয়ার পথে যাতায়াত করা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলির উপর বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

৬২৩ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে মুহাম্মাদ (সা) সিরিয়া অভিমুখী মক্কার একটি বড় বাণিজ্যিক কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এই কাফেলায় কুরাইশদের অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিল। মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিল ১৫০ থেকে ২০০ জন এবং আরোহণের উট ছিল ৩০টি। মুহাম্মাদ (সা) তাদের নিয়ে যুল উশাইরাহ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমরা পৌছানোর কয়েকদিন পূর্বে কুরাইশরা সে পথ অতিক্রম করে চলে যাওয়ার কারণে মুসলিমরা তাদের পথরোধ করতে পারেনি। এই অভিযানটি গাজওয়ায়ে উশাইরা নামে পরিচিত। ইবনে ইসহাকের মতে এই অভিযানের জন্য মুহাম্মাদ (সা) ২ হিজরির জামাদিউল আওয়াল মাসের শেষে বের হয়ে জামাদিউল আখির মাসের শুরুতে ফিরে এসেছিলেন।

৬২৪ সালের জানুয়ারিতে (২ হিজরির রজম মাস) মুহাম্মাদ (সা) বারো জন মুহাজিরকে অভিযানে পাঠান। বাহিনীর প্রতি দুইজনের আরোহণের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। মুহাম্মাদ (সা) বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহশকে একটি চিঠি দিয়ে বলেন যাতে দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পর এই চিঠি পড়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক দুইদিনের পথ অতিক্রম করার আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ চিঠি পড়েন। এতে নির্দেশ দেয়া হয় যে চিঠি পড়ার পর যাতে তারা অগ্রসর হয়ে মক্কা ও তাইফের মধ্যবর্তী নাখলায় পৌছায়। এরপর কুরাইশ কাফেলার আগমনের অপেক্ষা করে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে মদিনায় অবহিত করা হয়। চিঠির নির্দেশ পড়ার পর তারা অগ্রসর হন। তবে পথিমধ্যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ানের উট হারিয়ে যায় ফলে তারা পিছিয়ে পড়েন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ তার বাহিনীকে নিয়ে নাখলা পৌঁছে একটি কুরাইশ কাফেলা দেখতে পান। এতে আবদুল্লাহ ইবনে মুগিরার দুই ছেলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ এবং মুগিরার মুক্তপ্রাপ্ত দাস আমর ইবনে হাদরামি ও হাকিম ইবনে কাইসান ছিলেন। এই দিনটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। রজব যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস ছিল তাই আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে মাস শেষ হওয়ার সময় দিলে কাফেলাটি মক্কার হারাম সীমানায় প্রবেশ করবে ফলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বাহিনীটি কাফেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের শুরুতে তীরের আঘাতে আমর ইবনে হাদরামি নিহত হন। মুসলিমরা উসমান ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকিম ইবনে কাইসানকে গ্রেপ্তার করে। নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

রজব মাসে আক্রমণ করার কারণে মুসলিম দলটি ফিরে আসার পর মুহাম্মাদ (সা) ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তিনি তাদের হারাম মাসে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তিনি কাফেলা থেকে অর্জিত সম্পদ এবং বন্দীদের গ্রহণে অসম্মতি জানান। অন্যদিকে রজব মাসে আক্রমণের কারণে কুরাইশরাও মুসলিমদের কটুক্তি করতে শুরু করে। এরপর আল্লাহ জানান পবিত্র মাস লঙ্ঘন করার চেয়ে মক্কার লোকেদের অত্যাচার আরো বেশি নিকৃষ্ট। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মুহাম্মাদ (সা) কাফেলা ও বন্দীদেরকে গ্রহণ করেন। উসমান ও হাকিমের মুক্তি চেয়ে কুরাইশরা বার্তা পাঠায় এবং বিনিময় হিসেবে পণ্য প্রদানের কথা বলে। কিন্তু ইতিপূর্বে নিখোঁজ হওয়া সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ান তখনও ফিরে আসেননি। কুরাইশদের হাতে তাদের জীবনের আশঙ্কা থাকায় তিনি সেসময় প্রস্তাবে রাজি হননি। এরপর তারা দুইজন ফিরে আসেন এবং পণ্য গ্রহণ করে বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। বন্দীদের মধ্যে হাকিম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় থেকে যান। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যান।

ইতিপূর্বে গাজওয়ায়ে উশাইরা থেকে বেঁচে যাওয়া কুরাইশ কাফেলাটি সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার সময় মুহাম্মাদ (সা) তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও সাইদ ইবনে জাইদকে উত্তরে প্রেরণ করেন। তারা হাওরা নামক স্থানে পৌছে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকেন এবং কাফেলা এই স্থান অতিক্রমের সময় তারা মদিনায় ফিরে ঘটনা অবহিত করেন। কাফেলাটিতে একহাজার উট এবং এসব উটে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মালামাল ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলায় রক্ষী ছিল ৪০জন।

এই কাফেলায় আক্রমণের জন্য মুহাম্মাদ (সা) মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে পরবর্তীতে বৃহদাকার কুরাইশ বাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা তখনও ছিল না তাই তিনি এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক মুসলিম মদিনায় থেকে যায়। ঘোষণার পর মুহাম্মদ (সা) বদরের দিকে যাত্রা করেন।

যুদ্ধের বর্ণনা :
মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আবু যার আল-গিফারী। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে উসমান ইবনে আফফান যুদ্ধে যেতে পারেননি। সালমান ফারসি এসময় অন্যের দাস ছিলেন তাই তিনিও যুদ্ধে অংশ নেননি। বাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২ জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০ জন। মুসলিমদের সাথে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। ফলে তাদের সামনে পায়ে হেঁটে যাওয়া বা প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। একটি উটে পালাক্রমে দুই বা তিনজন আরোহণ করতেন। এই ব্যবস্থায় মুহাম্মাদ (সা), আলী ইবনে আবি তালিব ও মারসাদ ইবনে আবি মারসাদের জন্য একটি উট বরাদ্দ হয়েছিল।

মুহাম্মাদ (সা) সার্বিক নেতৃত্বের জন্য মুসআব ইবনে উমাইরকে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। মুহাজিরদের ও আনসারদের জন্য একটি করে কালো পতাকা যথাক্রমে আলি ইবনে আবি তালিব এবং সাদ ইবনে মুয়াজকে প্রদান করা হয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ ইবনে আমরকে নিযুক্ত করা হয়। মুসলিম বাহিনীতে থাকা দুইটি ঘোড়ায় তারা আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে কাইস ইবনে আবিকে নিয়োগ দেয়া হয়। মুহাম্মাদ (সা) সমগ্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

কুরাইশ কাফেলা : 
আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলির কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের আক্রমণের খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে যাচ্ছে। 

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।

আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

অন্যদিকে আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন। বদরের নিকটে পৌঁছার পর মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয়। তাকে তিনি মদিনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাজদি স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তবে জানান যে দুইজন উষ্ট্রারোহীকে তিনি টিলার পাশে উট বসিয়ে মশকে পানি পূর্ণ করতে দেখেছেন। তাই আবু সুফিয়ান সতর্কতা হিসেবে সেখানে যান এবং উটের গোবর ভেঙে দেখেন। গোবর থেকে প্রাপ্ত খেজুরের বিচি দেখে বুঝতে পারেন এগুলি মদিনার খেজুর ফলে মুসলিমদের আগমনের ব্যাপারে তিনি সন্দেহমুক্ত হন। এরপর তিনি কাফেলাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলের দিকে ইয়ানবুতে চলে যান। মক্কার বাহিনী জুহফা নামক স্থানে পৌছার পর আবু সুফিয়ানের প্রেরিত বার্তা বাহক এসে জানায় যে কাফেলা নিরাপদ আছে তাই আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনীর অধিকাংশ ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু বাহিনীর প্রধান আবু জাহল যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে অসম্মতি দেখান। এরপর বনু জুহরা গোত্রের মিত্র ও গোত্রটির সেনাপ্রধান আখনাস ইবনে শারিক ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ তার পক্ষে সায় না দেয়ায় তিনি বনু জুহরা গোত্রের ৩০০ সদস্য নিয়ে মক্কা ফিরে আসেন। এর ফলে মক্কার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,০০০। পরবর্তীতে বনু জুহরা গোত্রের সদস্যরা আখনাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

একইভাবে বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আবু জাহলের জেদের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। মক্কার বাহিনী অগ্রসর হয়ে বদর উপত্যকার একটি টিলার পেছনে আশ্রয় নেয়।

মুসলিমদের পরিকল্পনা : 
আর স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে। অথচ তোমরা চাইছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তে আসুক, আর আল্লাহ চাইছিলেন সত্যকে তার বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে।
-সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৭

মুসলিমরা মক্কার বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পায়। মুসলিম বাহিনীটি মূলত কাফেলা আক্রমণের জন্য গঠিত হয়েছিল, ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। মুসলিমরা এসময় কুরাইশদের মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারত কিন্তু এর ফলে কুরাইশদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেত এবং তারা অগ্রসর হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে পারত। অন্যদিকে বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মদিনার আনসাররা আকাবার বাইয়াত অনুযায়ী মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য ছিল না এবং অভিযানের ব্যয়ভার তাদের উপর বেশি ছিল। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য মুহাম্মাদ (সা) যুদ্ধসভার আহ্বান করেন। সভায় মুহাজির, আনসার সকলেই কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়। তারা বহুদিনের নির্যাতনের প্রতিবিধানের জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। এরপর মুসলিমরা অগ্রসর হয়ে বদরের নিকটে পৌঁছায়।

এখানে পৌঁছার পর মুহাম্মাদ (সা) ও আবু বকর প্রতিপক্ষের খবর সংগ্রহের জন্য বের হন। এসময় এক বৃদ্ধ লোককে তারা দেখতে পান। মুহাম্মাদ (সা) তাকে মুসলিম ও কুরাইশ উভয় বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। ঐ ব্যক্তি দুই বাহিনী সম্পর্কেই সঠিক তথ্য দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আলি ইবনে আবি তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা বদরের কূয়ায় দুইজন পানি সংগ্রহরত ব্যক্তিকে বন্দী করেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা জানায় যে তারা মক্কার বাহিনীর সদস্য এবং বাহিনীর জন্য পানি সংগ্রহ করছিল। মুহাম্মাদ (সা) এসময় নামাজরত ছিলেন। উপস্থিত মুসলিমরা তার কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তাই তারা তাদের মারধর করে পুনরায় একই প্রশ্ন করে। এরপর তারা জবাব দেয় যে তারা কুরাইশ বাহিনীর নয় বরং আবু সুফিয়ানের কাফেলার লোক।

একথা জানতে পেরে মুহাম্মাদ (সা) ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তারা সত্যই বলছিল অথচ এরপরও তাদের মারধর করা হয়েছে। এরপর তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা উপত্যকার শেষ প্রান্তের টিলা দেখিয়ে বলে যে কুরাইশরা তার পেছনে অবস্থান করছে এবং প্রতিদিন নয় বা দশটি উট তাদের জন্য জবাই করা হয়। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ (সা) বলেন যে তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১,০০০ হবে। এরপর বন্দীরা বাহিনীতে আগত সম্ভ্রান্ত কুরাইশ নেতাদের নাম বলে।

প্রতিপক্ষের আগেই বদরে পৌঁছানোর জন্য মুহাম্মাদ (সা) দ্রুত বদরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। তার লক্ষ্য ছিল যাতে কুরাইশরা কূয়ার দখল নিতে না পারে। রাতে মুসলিমরা বদরের নিকট থামে। এসময় হুবাব ইবনে মুনজির বলেন যে এটি যদি আল্লাহর নির্দেশ হয় তবে তা যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যদি মুহাম্মাদ (সা) কৌশল হিসেবে এখানে থেমে থাকেন তবে তার মত হল যাতে এখানে অবস্থান না করে কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে অবস্থান নিয়ে বাকি সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নিজেদের কূয়ার উপর চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি জমা করা হয়। এর ফলে মুসলিমরা পানি পেলেও কুরাইশরা পানি থেকে বঞ্চিত হবে। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ (সা) পরামর্শ মেনে নিয়ে নির্দেশ দেন যাতে রাত অর্ধেক পার হওয়ার পূর্বেই কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হয়। এরপর সেখানে পৌছে চৌবাচ্চা তৈরী করে অবশিষ্ট সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয়।

মুসলিমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কূয়া দখল করার পর সাদ ইবনে মুয়াজের পরামর্শক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তরপূর্বের টিলার উপর মুহাম্মাদ (সা) এর জন্য একটি তাবু নির্মিত হয়। এখান থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেত।

কুরাইশদের মতপার্থক্য : 
যুদ্ধের দিন কুরাইশরা শিবির ভেঙে বদরের দিকে রওয়ানা হয়। বদরে পৌঁছে তারা উমাইর ইবনে ওয়াহাবকে মুসলিমদের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠায়। উমাইর এসে জানান যে মুসলিমদের বাহিনী ছোট এবং সাহায্যের জন্য নতুন সেনাদল আসার সম্ভাবনাও নেই। তবে তিনি একইসাথে বলেন তারা সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে আছে এবং তারা কুরাইশদের বিশেষ লোকদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে। এভাবে তিনি কুরাইশদের পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করেন। আরব যুদ্ধে হতাহতের পরিমাণ বেশি হত না তাই একথা শোনার ফলে কুরাইশদের মনোবল হ্রাস পায়। তারা পুনরায় তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকিম ইবনে হিজাম আরেক নেতা উতবা ইবনে রাবিয়াকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়। জবাবে উতবা বলেন যে তিনি ফিরে যেতে রাজি আছেন এবং নাখলায় নিহত আমর ইবনে হাদরামির রক্তপণ পরিশোধ করতেও তিনি রাজি। কিন্তু আবু জাহল রাজি নয় বলে তিনি হাকিমকে বলেন যাতে তাকে রাজি করানো হয়। এরপর উতবা উপস্থিত কুরাইশদের উদ্দেশ্য বলেন যে এই যুদ্ধে তাদের হাতে হয়ত নিজেদের ভাইয়েরাই নিহত হবে তাই যুদ্ধে বিজয়ী হলেও নিহতদের লাশ দেখতে তারা পছন্দ করবে না এবং তারা আত্মীয় হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত হবে। তাই তার পরামর্শ ছিল যাতে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায় এবং মুহাম্মাদ (সা)কে অন্য আরব গোত্রসমূহের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। যদি তারা তাকে হত্যা করে তবে কুরাইশদের উদ্দেশ্যও সফল হবে এবং এর ফলে মুহাম্মদ (সা) এর কাছে তারা নির্দোষ থাকবে।

হাকিম ইবনে হিজাম এসময় আবু জাহলের কাছে গিয়ে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু জাহল কঠোরভাবে বলেন যে যুদ্ধ না করে তিনি ফিরে যাবেন না। সেসাথে উতবার ফিরে যাওয়ার পরামর্শকে ধিক্কার দিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবার ছেলে মুসলিমদের দলে রয়েছে বলে উতবা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, উতবার ছেলে আবু হুজাইফা ইবনে উতবা ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক যুগে মুসলিম হয়েছিলেন। হাকিমের কাছে এ কথা জানতে পেরে উতবা বিব্রত হন এবং বলেন যে তিনি কাপুরুষ নন এবং মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে চূড়ান্ত বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাবেন না ঘোষণা করেন। অন্যদিকে আবু জাহল নাখলায় নিহত আমরের ভাই আমির ইবনে হাদরামির কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যেতে চায় তাই তার ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেয়া সম্ভব হবে না। একথা শোনার পর আমির সারা শরীরে ধূলো মেখে কাপড় ছিড়তে ছিড়তে নিহত ভাইয়ের জন্য মাতম করতে থাকে। এসবের ফলে যুদ্ধ বন্ধের জন্য হাকিমের সব তৎপরতা ব্যর্থ হয়।

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কুরাইশদের আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি এগিয়ে এসে মুসলিমদের পানির জলাধার দখল করে নেবে নাহয় এজন্য জীবন দেবে বলে ঘোষণা দেয়। এরপর হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব অগ্রসর হয়ে তার সাথে লড়াই করেন। লড়াইয়ে আসওয়াদের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত অবস্থা আসওয়াদ চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য চৌবাচ্চার সীমানার ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর হামজা তাকে হত্যা করেন। এটি ছিল বদরের প্রথম মৃত্যু।

যুদ্ধ শুরু :
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে রাসূল (সা.) আল্লাহর দরবারে বার বার দোয়া করছিলেন : হে আল্লাহ্ ! তুমি আমার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছো তা পূর্ণ করো, হে রাব্বুল আলামিন আজ যদি এই মুষ্টিমেয় লোকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার ইবাদত করবার কেউ থাকবে না। এরপর তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। কুরাইশদের মধ্য থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া ও ওয়ালিদ ইবনে উতবা লড়াইয়ের জন্য অগ্রসর হন। তাদের লড়াইয়ের আহ্বান শুনে আনসারদের মধ্য থেকে আওফ ইবনে হারিস, মুয়াব্বিজ ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এগিয়ে আসেন। কিন্তু কুরাইশ যোদ্ধারা তাদেরকে কটাক্ষ করে বলেন যে তারা তাদের যোগ্য না এবং যেন কুরাইশদের সমশ্রেণীর কাউকে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর তাদের বদলে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, উবাইদা ইবনে হারিস ও আলি ইবনে আবি তালিবকে পাঠানো হয়। হামজার সাথে শাইবা, আলির সাথে ওয়ালিদ ও উবাইদার সাথে উতবা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কুরাইশ পক্ষের তিনজনই লড়াইয়ে নিহত হয়। লড়াইয়ে উবাইদা আহত হন তাই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধের কয়েকদিন পর তার মৃত্যু হয়। তিনজন নেতৃস্থানীয় যোদ্ধার মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মনোবলে ফাটল ধরে।

দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর কুরাইশরা মুসলিমদের উপর আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধের পূর্বে মুহাম্মাদ (সা) নির্দেশ দেন শত্রুরা বেশি সংখ্যায় কাছে এলেই যাতে তীর চালানো হয়। মুসলিমরা তাকবির স্লোগান দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুয়াজ ইবনে আমর ও মুয়াজ ইবনে আফরা কুরাইশ পক্ষের সর্বাধিনায়ক আবু জাহলকে হত্যা করেন। বিলালের হাতে তার সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ নিহত হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব তার মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলিমদের সহায়তার জন্য এসেছিল। কুরআনে উল্লেখ আছে, স্মরণ করো, তোমরা তোমাদের রবের নিকট সাহায্যের জন্য দোয়া করেছিলে। তিনি তা কবুল করেন এবং বলেন : আমি তোমাদের সাহায্য করবো সহস্র ফেরেশতা দ্বারা যারা একের পর এক আসবে। (সূরা আন্ ফাল : আয়াত ৯)।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিহত মুসলিমদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়। নিহত কুরাইশদের লাশ ময়দানের একটি কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এসময় চব্বিশজন প্রধান কুরাইশ নেতার লাশ কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আরবের রীতি অনুযায়ী মুসলিমরা তিনদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করার পর মদিনায় ফিরে আসে।

বদর যুদ্ধে শহীদ : 
বদরের যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিচয় হল, 
১. হযরত ওবায়দা ইবনে হারিছ (রা) - মুহাজির।
২. হযরত ওমায়ের ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) - মুহাজির।
৩. হযরত যুশ-শিমালাইন (রা) - মুহাজির।
৪. হযরত আকিল ইবনে বুকাইল (রা) - মুহাজির।
৫. হযরত মাহজা ইবনে সালেহ (রা)- মুহাজির। তিনি ছিলেন হযরত ওমর (রাঃ) এর আযাদকৃত ক্রীতদাস।
৬. হযরত সাফওয়ান ইবনে বায়দা (রা) - মুহাজির।
৭. হযরত সাদ ইবনে খায়সামা (রা) - আনসার।
৮. হযরত মুবাশ্বর ইবনে আবদুল মুনযির (রা) - আনসার।
৯. হযরত ওমায়ের ইবনে হুমাম (রা) - আনসার।
১০. হযরত ইয়াযিদ ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।
১১. হযরত রাফি ইবনে মুয়াল্লাহ (রা) - আনসার।
১২. হযরত হারিছা ইবনে সুরাকা (রা) - আনসার।
১৩. হযরত আওফ ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।
১৪. হযরত মুআওবিয ইবনে হারিছ (রা) - আনসার।

যুদ্ধবন্দী : 
যুদ্ধের পর মুসলিমরা মদিনায় ফিরে আসে। এতে কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ ৭০ জন বন্দী হয়। বন্দীদের সাথে মানবিক আচরণ করা হয়েছিল। মুসলিমরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খেতে দেয়। বদর যুদ্ধের পর নবীজির (সা.) অবস্থান ছিল পরাজিত আত্মসমর্পণকারীদের হত্যা না করা ও কষ্ট না দেওয়া। যুদ্ধ শেষে নবীজি (সা.) প্রথম ঘোষণা করলেন: ‘তাদের হত্যা কোরো না।’ বদরের বন্দিদের প্রতি রাসূল (সা.)  যে আদর্শ ব্যবহার দেখালেন, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। তাঁর আদেশে মদিনায় আনসার এবং মুহাজিররা সাধ্যানুসারে বন্দিদেরকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে আপন আপন গৃহে স্থান দিলেন এবং আত্মীয়-স্বজনের মতোই তাদের সঙ্গে করেন। বন্দীদের স্বগতোক্তি ছিল—‘মদিনাবাসীদের ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হোক। তারা আমাদের উটে চড়তে দিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে গেছে, নিজেরা শুষ্ক খেজুর খেয়ে আমাদের রুটি খেতে দিয়েছে।

বন্দীদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ (সা) নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। সভায় আবু বকর মত দেন যে বন্দীদের সবাই মুসলিমদেরই ভাই, একই বংশের সদস্য অথবা আত্মীয়। তাই তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া উচিত যাতে মুসলিমদের তহবিলে অর্থ সঞ্চিত হয় এবং বন্দীরা ভবিষ্যতে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ পায়। উমর ইবনুল খাত্তাবের মত ছিল বন্দীদের প্রতি কোনো প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শন না করে মুসলিমদের প্রত্যেকে বন্দীদের মধ্যে নিজ নিজ আত্মীয়কে হত্যা করে যাতে এটা প্রমাণ হয় যে মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলিমদের মনে কোনো দুর্বলতা নেই। 

মুহাম্মাদ (সা) আবু বকরের মত মেনে নিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফি ইবনে আবি রিফায়া ও আবু ইজজা জুমাহিসহ কয়েকজন বন্দীকে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। শেষোক্ত দুইজন পরবর্তী উহুদের যুদ্ধে নিহত হয়। এছাড়া যারা পড়ালেখা জানত তারা ১০জন নিরক্ষর মুসলিমদেরকে শিক্ষা দিলে তা মুক্তিপণ হিসেবে গৃহীত হবে ঘোষণা করা হয়। বন্দীদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা) এর মেয়ে জয়নব বিনতে মুহাম্মাদের স্বামী আবুল আসও ছিল। জয়নবকে মদিনা আসতে বাঁধা দেবে না এই শর্তে আবুল আসকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। বন্দীদের মধ্যে মক্কার সুবক্তা সুহাইল ইবনে আমরও ছিলেন। উমর সুহাইলের সামনের দুইটি দাঁত ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে তিনি আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা নিতে না পারেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সুহাইল মক্কার পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। আরও পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

মৃত্যুদন্ড :
দুইজন যুদ্ধবন্দীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। এরা হলেন নাদার ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবু মুয়াইত। বদর থেকে ফেরার সময় সাফরা উপত্যকায় নাদার ইবনুল হারিস এবং ইরকুজ জুবয়া নামক স্থানে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকে হত্যা করা হয়।

প্রভাব : 
কুরাইশদের পরাজয়ের খবর হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কায় নিয়ে আসে। নিহতদের শোকে মক্কায় মাতম শুরু হয়। কিন্তু এরপর তারা সংযত হয় যাতে তাদের মাতমে মুসলিমরা আনন্দিত না হয়। তাছাড়া মুক্তিপণ নিয়ে তাড়াহুড়া না করতে বলা হয়। কুরাইশরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরের বছর দুই বাহিনী উহুদের যুদ্ধে পুনরায় মুখোমুখি হয়।

বদরের যুদ্ধ সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ (সা) এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অন্য আরব গোত্রগুলি মুসলিমদেরকে নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। মদিনার অনেকে এসময় ইসলাম গ্রহণ করে। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদেরকে খুবই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অন্যদিকে যুদ্ধে আবু জাহলসহ মক্কার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে আবু সুফিয়ান নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তিনি কুরাইশদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিম হওয়ার পর আবু সুফিয়ান মুসলিম সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। 

১৫ মে, ২০১৯

নারী নির্যাতন রোধে করণীয়



আমাকে কারাগারে প্রথম নিয়ে যে ভবনে রাখা হয় তাকে 'আমদানি' বলা হয়। আমদানি ভবন থাকলেও সেখানে রপ্তানি ভবন ছিল না। যাদের বের করা হবে তাদেরও আমদানিতেই রাখা হয়। আমদানিতে ভদ্র চেহারার বা দেখতে ছাত্রের মত কাউকে দেখলেই অন্যরা জিজ্ঞাসা করতেন কি মামলা? শিবির মামলা নাকি? আর সকল মাদক মামলার নাম ছিল 'বাবা'।

জেলখানায় আলাদা আলাদা পরিভাষা ছিল প্রায় সবগুলো বিষয়ের। যেমন রান্নাঘরকে বলা হত 'চৌকা'। মামলাগুলোর নামও ছিল আলাদা আলাদা। যেমন আমাদের সংগঠনের যে কেউ ভাংচুর, বিস্ফোরক, অস্ত্র যে মামলায় এরেস্ট হোক না কেন তার মামলার নাম ছিল শিবির মামলা।

যাই হোক, সেখানে 'খাট ভাঙ্গা কেইস' নামে একটা কেইস আছে। প্রথমে বুঝতে পারতাম না 'খাট ভাঙ্গা কেইস' এটা কী জিনিস? পরে জানতে পারলাম নারী নির্যাতন কেইস। বর্তমানে এটা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। মহামারী আকার লাভ করেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে মানুষ এক লাইনে সমাধান টানতে চাইছেন। ব্যাপারটা মোটেই এরকম কিছু নয়। এটা এক লাইনে সমাধানে আসার মত কিছু নয়। এটা একটা টোটাল সমাজব্যবস্থার ব্যাপার। সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপার।

কারাগারে আমি বিভিন্ন আসামীদের সাথে আলোচনা করতাম। তাদের সাইকোলজি বুঝার চেষ্টা করতাম। বেশ কয়েকজন ধর্ষকের সাথে আমার কথা হয়েছে। একজন বলেছেন স্রেফ প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে ধর্ষণ করেছে। মেয়েটির ভাই তার বন্ধু ছিল। সেই বন্ধু তার লাখখানেক টাকা মেরে দিয়েছে। টাকা দিতে না পেরে উল্টো বোনকে উত্যক্ত করে বলে অভিযোগ দিয়ে সামাজিকভাবে অপমান করেছে। বিনিময়ে সে প্রতিশোধ নিয়েছে।

আরেকজনকে পেয়েছি সে মধ্যবয়স্ক। একটি বাড়ির দারোয়ান ছিলেন। তার কথা হলো ধনীরা খারাপ। গবীরদের সম্পত্তি লুট করা ছাড়া কেউ ধনী হতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সে ধনীদের ক্ষতি করবে। তার এই চিন্তার প্রতিফলন আমি কারাগারেই দেখেছি। সে পয়সাওয়ালা বন্দিদের বিরুদ্ধে লেগেই থাকতো। প্রায়ই প্রশাসনের কাছে তাদের নামে অভিযোগ করতো কারাবিধি লঙ্ঘনের।

একজনকে পেয়েছি টেম্পো চালক। সে বলেছে প্রতিদিন সিনেমা না দেখলে আমার ঘুম আসে না। আর প্রতিটা সিনেমা শেষেই তার এমন আচরণ করতে ইচ্ছে হয়। সে আরো বলেছে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে কত রঙঢং দেখি। আমারও কি এমন করতে ইচ্ছে করে না? সে সেদিন আমার কাছে প্রশ্ন করেছে।

আরেক গ্রুপ পেয়েছি। তারা মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। তিনজন। বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিতে দিতে নির্যাতন করেছে। গ্রুপ স্টাডির নাম করে একজনের বাসায় বান্ধবীদেরও ডাকে। তাদের দাবী বিষয়টা মিউচুয়াল ছিল। তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম তারা ইংলিশ, হিন্দি ও নীল ছবি আসক্ত।

আরেকটা ছিল পারিবারিক পর্দা না থাকার কারণে। বউয়ের ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল তার চাকুরীর ইন্টারভিউ এর জন্য। ব্যাস... শয়তান জয়ী হয়েছে।

আমি কয়েকটা কেইস স্টাডি উল্লেখ করেছি। এখানে নানান বিষয় উঠে এসেছে। পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করতে পারবেন। বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

আবার আসুন এবার সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলি। যেমন ছাত্রশিবির আটাশ বছর চট্টগ্রাম কলেজে প্রাভাবশালী ছিল। সেখানে নারী নির্যাতন তো অনেক দূরের বিষয় তার কাছাকাছি বিষয়ও হয়নি। কিন্তু ছাত্রশিবিরের প্রভাব নষ্ট হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে।

এর কারণ কী?

এর কারণ হলো যারা ক্ষমতাসীন তারাই বিকৃত মানসিকতার। সুতরাং তাদের এই গর্হিত কাজের শাস্তির বিধান কার্যকর হবে না। আগে যে কোন কারণে (সিনেমা, নীল ছবি, নারীদের রঙ-ঢং, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত) বিকৃত হয়ে যাওয়া পুরুষরা এই কাজে সাহস পেতো না কারণ তারা জানতো এর শক্ত বিচার হবে।

আর এখন চট্টগ্রাম কলেজের বিকৃতরা জানে ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারলে তার অপরাধের বিচার হবে না। তাহলে সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ন সমাজব্যবস্থা না থাকা ধর্ষণের সবচেয়ে বড় কারণ।
আমি মোটাদাগে ধর্ষণের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে চাই 
১- সমাজের সীমাহীন বৈষম্য ও অপরাধের বিস্তার 
২- উপযুক্ত ও নৈতিক শিক্ষার অভাব
৩- অপসংস্কৃতির প্রভাব
৪- ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পর্দার বাস্তবায়ন না থাকা
৫- বিয়ে কঠিন হওয়া এবং জেনা সহজ হওয়া
৬- সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা না থাকা।

অশালীন পোষাক কি সমস্যা?

জ্বি অশালীন পোষাক সমস্যা। তবে পোষাক একমাত্র সমস্যা না। অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি। আমিও পুরুষ। আমি জানি অশালীন পোষাক আমার মধ্যে সুড়সুড়ি তৈরী করে। উদ্বুদ্ধ করে অন্যায় কাজের। যেখানে ছোট শিশু ধর্ষণের শিকার হয় সেখানে হয়তো পোষাক ভূমিকা রাখে না, আবার রাখে।

যেমন কেউ সামাজিকভাবে পর্দা প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে বিকৃত হয়ে গেছে। এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়, যাকে দেখে সে উত্তেজিত হয়েছে তা তার নাগালের বাইরে তখন নাগালের মধ্যে থাকা শিশু অথবা অন্য কেউ তার জঘন্য আচরণের শিকার হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিকৃতদের মানসিকতা নষ্ট হয় সিনেমার নায়িকাদের দেখে। শুধু দেশী নয়, বিদেশী নায়িকারাও এর মধ্যে আছেন। কিন্তু ধর্ষকরা তাদের নাগালে পায় না। নাগালে যাকে পায় তাকেই নির্যাতন করে।

আমাদের একটা ব্যাপার হলো আমরা ইফেক্ট নিয়ে আলোচনা করি। কারণ অনুসন্ধান করি না। কারণ অনুসন্ধান করলে ধর্ষণ শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব।

তাহলে করণীয় কী?

করনীয় দুই ধরণের এক. ব্যাক্তিগতভাবে, দুই. সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে

ব্যক্তিগতভাবে করণীয় :

১- পর্দার ব্যবস্থা করা। এই পর্দা শুধু সতর ঢাকা নয়। পর্দার বিধান মেনে নেয়া। ১৪ শ্রেণীর মাহরাম ছাড়া কারো সাথে (পুরুষ এবং নারী) দেখা না দেয়া। পরিবারে ও ব্যাক্তিগতভাবে পর্দা মেইন্টেইন করা। অবৈধ কোন কিছু না দেখা। পরিবারের সদস্যদের শালীন পোষাকে অভ্যস্ত করা। এতে সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়।

২- ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় সন্তানদের সুশিক্ষিত করা।

৩- অপসংস্কৃতি থেকে নিজে ও পরিবারকে রক্ষা করে সেখানে সুস্থ সংস্কৃতির বিস্তার করা। সন্তানরা কার সাথে মিশছে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে এগুলো খেয়াল করা। অসৎ সঙ্গ থেকে সন্তানকে রক্ষা করা। শুধু পড়ালেখা নয় অন্য কোন এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজে সন্তানদের আগ্রহী করা ও ব্যস্ত রাখা।

৪- ইন্টারনেট কানেকশনে প্যারেন্টিং সফটওয়্যার ইউজ করা।

রাষ্ট্রীয়ভাবে করণীয় :

আপনি ব্যাক্তিগতভাবে যত পদক্ষেপই নেন না কেন তা কেবল সামান্যই ভূমিকা রাখবে। বলা চলে আপনি কিছুটা হিফাযত হবেন। কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান কোনভাবেই হবে না। সমস্যার সমাধান হতে পারে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত পদক্ষেপে।

১- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে  ধর্মীয় অনুশাসন কার্যকর করতে হবে। 
২- বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা পরিহার করে নৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। 
৩- বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 
৪- নারী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। 
৫- অশ্লীল ও উদ্দেশ্যহীন টিভি সিরিয়াল, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি বন্ধ করে শিক্ষামূলক বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। 
৬- অশ্লীল বিদেশী সিনেমা ও সিরিয়াল নিষিদ্ধ করতে হবে। 
৭- পুরুষ ও নারী উভয়কে পর্দার বিধান জানা ও মানার ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলতে হবে। 
৮- বিয়ে সহজ করে তুলতে হবে এবং বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 
৯- নারীদের সম্পদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 
১০- যৌতুক বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 
১১- ইন্টারনেট থেকে অশ্লীল কন্টেন্ট মুছে ফেলতে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 
১৩- নারী নির্যাতন বন্ধে ধর্মীয় ইমামদের নিয়মিত নসিহত করতে হবে। 
১৪- স্কুল ও মাদ্রাসায় সহশিক্ষা বন্ধ করতে হবে। 
১৫- নারীদের জন্য আলাদা ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। 
১৬- পুরুষ ও নারী উভয়কে উগ্র ও আঁটোসাঁটো পোশাক পরিহার করে শালীন ও মার্জিত পোশাক পরিধান করতে হবে।  
১৭-  বেকার যুবক ও বখাটেদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। 
১৮- নারী নির্যাতনকারীদের সঠিক শিক্ষা, চিকিৎসা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে হবে। 
১৯- নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারকে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। 
২০- তামাক ও মাদক নির্মূলে সরকারকে আরো কঠোরভাবে আইনপ্রয়োগ করতে হবে।

এক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারলে শাস্তি দেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইনশাআল্লাহ।

যদি একলাইনে সমাধান চান তবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেই এর সমাধান সম্ভব। আসুন বিচ্ছিন্ন কথা না বলি, বিচ্ছিন্ন কাজ না করি। সবাই মিলে ইকামাতে দ্বীনের কাজ করি। আমরা আমাদের জাতিকে এই ভয়ানক ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।

৯ মে, ২০১৯

ফিলিস্তিন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাঈলের করা চুক্তি ফাঁস



গত কয়েকবছরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরায়েল ঘেঁষা শান্তি পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নানা সময়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রমজানের পর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার কথা রয়েছে। তবে তার আগেই মঙ্গলবার ইসরায়েলের একটি সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমে ওই পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন। দুই দেশের পক্ষ থেকে এর নাম দেওয়া হয়েছে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি।

এই অন্যায় চুক্তি মেনে নেয়ার জন্য অব্যাহত চাপ আছে ফিলিস্তিনের পিএলও ও হামাসের উপরে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে সাথে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে অব্যাহত চাপ দিয়ে আসছে সৌদি আরবও।

চুক্তিটি এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে চুক্তিটি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তরফে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত চুক্তিটির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। নিচে ট্রাম্পের কথিত ওই শান্তি পরিকল্পনার কয়েকটি মৌলিক বিষয় তুলে ধরা হলো।

০১. চুক্তি
ইসরায়েল, পিএলও এবং হামাসের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ফিলিস্তিন নামে কোনও দেশ থাকবে না। চুক্তি অনুযায়ী, নতুন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের নাম হবে নিউ প্যালেস্টাইন। গাজা উপত্যকা, যিহূদিয়া পার্বত্য এলাকা এবং পশ্চিম তীরের সামারিয়া এলাকা নিয়ে গঠিত হবে নিউ প্যালেস্টাইন। তবে পশ্চিম  তীরের ইসরায়েলি বসতিগুলোর ওপর তার কোনও সার্বভৌমত্ব থাকবে না। এসব বসতির সার্বভৌমত্ব থাকবে ইসরায়েলের হাতে।

০২. জেরুজালেম
জেরুজালেম নগরী নিয়ে কোনও ভাগাভাগি হবে না। বরং এটি হবে নিউ প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল উভয় দেশের রাজধানী। নগরীর আরব বাসিন্দারা নিউ প্যালেস্টাইনের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর ইহুদিরা ইসরায়েলি নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করবেন। ইহুদিরা আরবদের ঘরবাড়ি কিনতে পারবে না। আরবরাও ইহুদিদের বাড়িঘর কিনতে পারবে না। জেরুজালেমে নতুন আর কোনও এলাকা দখল করা হবে না। পবিত্র স্থানগুলোর বিদ্যমান অবস্থা বজায় থাকবে।


০৩. জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ
উভয় দেশের অখণ্ড রাজধানী জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের জেরুজালেম পৌরসভার হাতে। তবে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে। ইসরায়েলের জেরুজালেম পৌরসভার কাছে ট্যাক্স ও পানির বিল সরবরাহ করবে নিউ প্যালেস্টাইন।

০৪. গাজা
ফিলিস্তিনে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য মিসর নতুন জমি দেবে। কলকারখানা নির্মাণ, বাণিজ্যিক ও কৃষি খাতে ব্যবহারের জন্যও নতুন ভূখণ্ড দেবে মিসর। তবে ফিলিস্তিনিরা এখানে বসবাসের সুযোগ পাবে না। লিজ বাবদ মিসরকে মূল্য পরিশোধ করবে নিউ ফিলিস্তিন। লিজ বাবদ ঠিক কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হবে তা নির্ধারণ করে দেবে মধ্যস্থতাকারী ও সহযোগী দেশগুলো।

০৫. আন্তর্জাতিক সহযোগী
চুক্তি বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো। নিউ প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন প্রকল্পে পাঁচ বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে তারা। এর আওতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে থাকা ইহুদি বসতিগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগীরা যে অর্থ সহায়তা দেবে তার ২০ শতাংশ দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেবে ১০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ তহবিলের যোগান দেবে। তেল বিক্রির অর্থ থেকে তারা এ সহায়তা দেবে। চুক্তি বাস্তবায়নের আর্থিক বোঝা তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোকেই বইতে হবে। কেননা, এ চুক্তিতে তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।

০৬. সামরিক বাহিনী
নিউ প্যালেস্টাইনকে কোনও সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হবে না। একমাত্র পুলিশকে হালকা অস্ত্র বহনের সুযোগ দেওয়া হবে। নিউ প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি সুরক্ষা চুক্তি সম্পাদিত হবে। এর আওতায় বিদেশি আগ্রাসন থেকে দেশ রক্ষায় ইসরায়েলকে অর্থ দেবে ফিলিস্তিন। মধ্যস্থতাকারী সহযোগী দেশগুলোকে নিয়ে এ অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।

০৭. হামাস
চুক্তি স্বাক্ষরকালে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস তার সব অস্ত্র মিসরের কাছে জমা দেবে। ব্যক্তিগত অস্ত্রও এর আওতায় পড়বে। সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত হামাসের নেতাকর্মীরা সহযোগী দেশগুলোর কাছ থেকে বেতন পাবে।

০৮. নিউ প্যালেস্টাইনে নির্বাচন
রাষ্ট্র গঠনের এক বছরের মাথায় নিউ প্যালেস্টাইনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের প্রত্যেক নাগরিক এতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে।

০৯. উন্মুক্ত সীমান্ত
বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে নিউ প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের সীমান্ত জনগণের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

১০. পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে সংযোগ স্থাপন
নিউ প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে একটি মহাসড়ক নির্মাণ করা হবে। এর অর্ধেক খরচ বহন করবে চীন। ১০ শতাংশ করে বাকি ৫০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

১১. ফিলিস্তিনকে হুঁশিয়ারি
ফিলিস্তিনের হামাস এবং পিএলও যদি এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে দেশটিকে দেওয়া সব মার্কিন সহায়তা বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে এটিও নিশ্চিত করা হবে যেন অন্য কোনও দেশও তাদের অর্থ সহায়তা দিতে না পারে।

১২. যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ নেবে যুক্তরাষ্ট্র
ফিলিস্তিনের ক্ষমতাসীন দল পিএলও যদি এ চুক্তি মেনে নেয় এবং হামাস ও ইসলামিক জিহাদ যদি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে দল দুটির নেতারাই এর জন্য দায়ী থাকবে। এই নেতাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে ইসরায়েল। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ নেবে যুক্তরাষ্ট্র।

এমন সময়ে ট্রাম্পের কথিত এ শান্তি পরিকল্পনা ফাঁস হলো যখন ওই চুক্তি মেনে নিতে ফিলিস্তিনকে সৌদি আরব চাপ দিচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। মিডল ইস্ট মনিটরের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে নিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে ১০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তবে তার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন।

মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, এর আগে ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নিতে না পারলে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হাওম ডেইলি জানিয়েছে, সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের চারটি দেশ ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামের ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছে। বাকি দেশগুলো হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও জর্ডান। চার দেশের কর্মকর্তারাই হাওম ডেইলি’কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কর্মকর্তারা জানান, সৌদি আরব, আমিরাত, মিসর ও জর্ডান ট্রাম্পের জামাতা ইহুদি ধর্মাবলম্বী জ্যারেড কুশনার’কে এই পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ কুশনার হোয়াইট হাউসের সিনিয়র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দূত হিসেবে নিয়োজিত জেসন গ্রিনব্লাটের কাছে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়েছে চার আরব দেশ। জ্যারেড কুশনার এবং জেসন গ্রিনব্লাট কাতারের সঙ্গেও এ ইস্যুতে আলোচনা করেছেন। তবে দেশটি থেকে তারা দৃশ্যত কোনও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।

ট্রাম্প প্রশাসনের শান্তি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনীহারও সমালোচনা করেন চার আরব দেশের কর্মকর্তারা। হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্য ওসামা হামদান আল জাজিরা’কে বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনকে চাপ দিতে আরব দেশগুলোকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা যে সমাধানের কথা বলছে সেটা আসলে ইসরায়েলের স্বার্থ সংরক্ষণ করে।

ঐতিহাসিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরায়েল-ঘেঁষা। তবে ওবামা প্রশাসন পর্যন্ত তারা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিল। বিগত মার্কিন প্রশাসনগুলো চাইতো, দুই দেশের মধ্যকার সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হোক। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধের পাশাপাশি ১৯৬৭ সালের প্রস্তাবিত সীমানা অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষেই অবস্থান ছিল তাদের। তবে ট্রাম্প সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে সেই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন। নির্বাচনি প্রচারণার সময় থেকেই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নীতির সমালোচনা করে আসা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপরই নতুন শান্তি প্রস্তাব তৈরির কথা জানান। 

সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, মিডল ইস্ট মনিটর।

৮ মে, ২০১৯

যে খাতে দান না করলে আপনার টুঁটি চেপে ধরা হবে!



রমাদান মাস চলছে। দান সদকার মওসুম। ফরজ সাদকা থেকে শুরু করে নফল সাদকা, এই মাসে আমাদের সবার দান করার পরিকল্পনা আছে। প্রশ্ন হলো কাকে দান করবেন? কোন খাতে দান করবেন? কোন খাতে দান না করলে আল্লাহ আপনার টুঁটি চেপে ধরবেন? আজ আমরা ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ নিয়ে আলোচনা করবো। 

আল্লাহ বলেন,
কী ব্যাপার? তোমরা আল্লাহর পথে কেন খরচ করছো না? অথচ যমীন ও আসমান সব তাঁরই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় করবে ও জিহাদ করবে তারা কখনো সেসব ভাগ্যবানের সমকক্ষ হতে পারবে না যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। বিজয়ের পরে ব্যয়কারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা অনেক বেশী। যদিও আল্লাহ উভয়কে ভাল প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। 

এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ঋণ দিতে পারে? উত্তম ঋণ! যাতে আল্লাহ তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেন। আর সেদিন তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম প্রতিদান। এই কথাগুলো প্রভুর কথা। তিনি এগুলো বলেছেন সূরা হাদীদের ১০ ও ১১ নং আয়াতে। 

তিনি আরো বলেন, “যারা সোনা-রূপা সঞ্চয় করে রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় তা খরচ করে না; অতএব, আপনি তাদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন, অতি যন্ত্রণাময় শাস্তির। যা সেদিন ঘটবে। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর সেগুলো দ্বারা তাদের ললাটসমূহে এবং তাদের পার্শ্বদেশসমূহে এবং তাদের পৃষ্ঠসমূহে দাগ দেয়া হবে, এটা তাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে, সুতরাং এখন স্বাদ গ্রহণ কর নিজেদের সঞ্চয়ের”। (আত-তওবাঃ ৩৪-৩৫)

আপনি এই মাসে যেকোনো খাতে দান করতে পারেন। তবে জিহাদের জন্য যারা দান করবেন তারা আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় বলে গণ্য হবেন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায়, তাওহীদ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জিহাদে অর্থ ব্যয় করুন। এই খাতে ব্যয় না করলে আল্লাহর পাকড়াওয়ের মুখোমুখি হতে হবে। 

জিহাদের জন্য জীবন ও সম্পদ বাজি রেখে কাজ করার জন্য অনেক আয়াত নাজিল করেছেন আল্লাহ তায়ালা। তাই আসুন রমাদানে আমরা জিহাদের জন্য সবচেয়ে বেশি খরচ করি। এতে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। আজকাল বাংলাদেশে জিহাদি বইয়ের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, জিহাদের জন্য ভয়ংকর নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়। জেনে রাখবেন আল্লাহ জিহাদকে ভালোবাসেন, যারা জিহাদ করে তাদের ভালোবাসেন, যারা জিহাদে অর্থব্যয় করেন তাদের ভালোবাসেন। আরো জেনে রাখবেন এই জিহাদের কথা বলার জন্য, জিহাদ করার জন্য ও জিহাদে অর্থব্যয় করার জন্য যদি আপনি নির্যাতিত হন ও শাহদাতবরণ করেন তবে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ। আসুন দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে অংশগ্রহন করি। 

যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে,তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত,যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল,সর্বজ্ঞ। যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, আর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না,তাদেরই জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশংকা নেই,তারা চিন্তিতও হবে না। (সূরা বাকারা: (২৬১-২৬২)

দান করতে হবে সচ্ছল অসচ্ছল সর্বাবস্থায়। আল্লাহ বলেন, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন,যা তৈরী করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য।যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে,যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন। (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৪)

সূরা আলে ইমরানের ৯২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন, ‘তোমরা প্রকৃত পুণ্য লাভ করতে পারবে না যেই পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে।’ এই সব আয়াতের দাবি পূরণের জন্য খাঁটি মুমিনগণ অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে থাকেন। সূরা আল আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন তাঁদেরকে,اَلْمُصَدِّقِيْنَ وَالْمُصَدِّقَاتِ (ইনফাককারী পুরুষ ও ইনফাককারী মহিলা) বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেন। সমাজের অভাবী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। আর আল্লাহর দ্বীনের আওয়াজ বুলন্দ করার কাজে তাঁরা উদারভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকেন।

দান সাদকা গুনাহ মিটিয়ে দেয়। রাসূল (সা.) বলেন, দান-সাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে। (সহীহুল জামে/৫১৩৬)

আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে হবে বিশুদ্ধ নিয়তে। খালেস নিয়তে, দায়িত্ব মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যদি দান করা হয়, তাহলে তার ব্যাপক ফযীলত রয়েছে। এসব ফযীলতের কিছুটা পার্থিব এই পৃথিবীতেও লক্ষ্য করা যায়, তবে বেশিরভাগ ফযীলতই পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে জমা থাকে। এছাড়াও এ জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পাবেন দানকারীরা। এ কারণেই দয়াময় আল্লাহ কুরআনে কারিমে দান-খয়রাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দানের ব্যাপারে নিয়তের স্বচ্ছতার কথা বলেছেন। কেউ যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে দান করে তবে তার জন্য আখিরাতে কিছুই থাকবে না কঠিন শাস্তি ছাড়া। 

দান করতে হবে শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য নয়। দান-খয়রাত করে ভবিষ্যতে কোনো স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা যাবে না। আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্য কৃত দানকে নিকৃষ্টতম দান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ইসলামে। এছাড়া যাকে দান করা হলো তার কাছ থেকে এর বিনিময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করা যাবে না। 

ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই দাওয়াতী কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামের হেফাজতের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়ে আসছে। এই জন্য স্বয়ং রাসূল (সা.) তাবুকের যুদ্ধের জন্য সাহাবীদের কাছ থেকে দান নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাসুল (সা.) সাহাবিদেরকে দান করতে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি খেজুরের এক টুকরা দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে বলেছেন। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনি যাকে ইচ্ছা উহা প্রদান করে থাকেন। এজন্য এ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। সৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎ পথে উহা ব্যয় করা হলেই তার হিসাব প্রদান করা সহজ হবে। কিয়ামতের দিন যে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোন মানুষ সামনে যেতে পারবে না, তন্মধ্যে দুটি প্রশ্নই ধন-সম্পদ বিষয়ক। প্রশ্ন করা হবে, কোন পথে সম্পদ উপার্জন করেছ এবং কোন পথে উহা ব্যয় করেছ।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেনঃ মানুষ বলে আমার সম্পদ! আমার সম্পদ!! অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার। ১) যা খেয়ে শেষ করেছে, ২)যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং ৩)যা দান করে জমা করেছে- তাই শুধু তার। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে। (মুসলিম)

আল্লাহর রাস্তায় দান খয়রাত করলে ৭০০ গুণ সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয়: এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেনঃ مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللهِ كَانَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ)

সহানুভূতি ও দান খয়রাত করা উত্তম চরিত্রে বহিঃপ্রকাশ: স্বাভাবিকভাবে এটি উত্তম গুণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আম্বিয়াকেরামদেরকে এই বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। এবং আমাদেরকেও পবিত্র কুরআন উদ্ভুদ্ধ করেছেন। এবং এটি ঈমানদার হওয়ার একটি প্রমাণও। দান ও সহানুভূমি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। (সূরা বাকারা: ২৫৪)

রাসূলে কারীম (সা.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ দাতা,তিনি দাতাকে ভালোবাসেন। এবং উন্নত চরিত্রকে ভালোবাসেন। এবং মন্দ চরিত্রকে ঘৃণা করেন।

আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য দু’আ করে বল, اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا “হে আল্লাহ দানকারীর মালে বিনিময় দান কর। (বিনিময় সম্পদ বৃদ্ধি কর)” আর দ্বিতীয়জন কৃপণের জন্য বদ দু’আ করে বলেন, اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا “হে আল্লাহ কৃপণের মালে ধ্বংস দাও।” (বুখারী ও মুসলিম)

আল্লাহ বলেন: ”যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকীর-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে এটা বেশী উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” (সূরা বকারা- ২৭১)

“যে ব্যক্তি হালাল কামাই থেকে একটি খেজুর সমপরিমাণ সদকা করবে (আর আল্লাহ তা‘আলা তো একমাত্র হালাল বস্তুই গ্রহণ করে থাকেন) আল্লাহ তা‘আলা তা ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তা তার কল্যাণেই বর্ধিত করবেন যেমনিভাবে তোমাদের কেউ একটি ঘোড়ার বাচ্চাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করে বর্ধিত করে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা পরিশেষে সে খেজুর সমপরিমাণ বস্তুটিকে একটি পাহাড় সমপরিমাণ বানিয়ে দেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১০)

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পথে সর্বদা সদকা-খয়রাতকারীর কোনো ভয়-ভীতি থাকবে না। 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যারা নিজেদের ধন-সম্পদগুলো আল্লাহ তা‘আলার পথেই রাত-দিন প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে দান করবে তাদের প্রতিদান সমূহ তাদের প্রভুর নিকটই রক্ষিত থাকবে। কিয়ামতের দিন তাদের কোনো ভয়-ভীতি থাকবে না এবং তারা কখনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৪)

যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে সর্বদা সদকা-খয়রাত করেন তাঁরা প্রকৃত ঈমানদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সত্যিকারের মু’মিন ওরাই যাদের সামনে আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ করা হলে তাদের অন্তরগুলো ভয়ে কেঁপে উঠে, তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হলে তাদের ঈমান আরো বেড়ে যায়, উপরন্তু তারা সর্বদা নিজ প্রভুর উপর নির্ভরশীল থাকে। যারা সালাত কায়েম করে এবং তাঁর দেওয়া সম্পদ থেকে তাঁর পথে সদকা করে। তারাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানদার। তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রভুর নিকট সুউচ্চ আসন, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২-৪]

আল্লাহ তা‘আলার পথে সর্বদা সদকা-খয়রাত সদকাকারীকে সকল প্রকারের গুনাহ্ ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “(হে নবী!) তুমি তাদের সম্পদ থেকে সদকা-খয়রাত নিয়ে তাদেরকে পাক ও পবিত্র করো এবং তাদের জন্য দো‘আ করো। নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্য শান্তিস্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলা তো সবই শোনেন এবং সবই জানেন। তারা কি এ ব্যাপারে অবগত নয় যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং তাদের দান-খয়রাত গ্রহণ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবুলকারী অতীব দয়ালু”। সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৩-১০৪]

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁরই দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং মানবতার কল্যাণে যথাসাধ্য ব্যয় করার তাওফীক দান করুন। আমীন, সুম্মা আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।

৭ মে, ২০১৯

হালাল উপার্জন কেন জরুরী?



আমরা যারা ইনকাম করি এটা তাদের জন্য একটি বিশাল চিন্তার বিষয়। আচ্ছা চিন্তা করে দেখুন আপনার প্রিয় স্ত্রী, আপনার কলিজার টুকরা সন্তান, আপনার মাথার তাজ পিতামাতা, আপনার স্নেহের ভাই-বোন যদি বলে উঠে তোমার উপার্জন অবৈধ, তোমার সাথে আমরা নেই কেমন লাগবে? সহ্য করতে পারবেন?

শুধু কি আপনার নিকটজন? আপনার প্রভূর কথা কি চিন্তা করেছেন? তিনি আপনাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার নামাজ, রোজা, দান, সাদকা, এগুলোর কোনো মূল্যই তাঁর কাছে নেই। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি একটি মহাশূন্যে পরিণত হচ্ছেন হারাম উপার্জনের মাধ্যমে।

কিছু হারাম উপার্জন আছে যা সহজে বুঝা যায়, যেমন : সুদ, ঘুষ, হারাম খাবার ভক্ষণ (মদ, শূকরের গোস্ত ইত্যাদি)। আবার কিছু উপার্জন আছে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না যেমন : কাজে ফাঁকি দেয়া, পণ্যের দোষ না বলে দেয়া ইত্যাদি।

আপনারা যারা সুদী লেনদেন করেন তাদের সময় এসেছে সাবধান হওয়ার। সুদ হারাম প্রত্যেকের জন্য যারা সুদে টাকা ধার দেয়, যারা সুদে টাকা ধার নেয়, যারা সুদের হিসেব রাখে, যারা সুদের কারবারে সাক্ষী থাকে। সুতরাং সুদী ব্যাংকে কাজ করা হারাম। আপনারা যারা সুদী ব্যাংকে চাকরি করেন তারা বিকল্প চিন্তা করুন এখনই। যত কষ্ট হোক চাকুরি ছেড়ে দিন।

ঘুষ খাওয়া তো ভয়ংকর অপরাধ। অনেকে আছেন নিজে ঘুষ খাননা কিন্তু সিস্টেমের কারণে ঘুষের ভাগ পান। সেদিন আমার এক প্রিয় ভাই তিনি একটি ইসলামী শরিয়ত মেনে চলা ব্যাংকের গার্ড। উনি আর ওনার অফিসার অন্য একটি ব্যাংক থেকে টাকা আনতে গেলেন। খরচ হয়েছে রিকশায় তিরিশ টাকা। কিন্তু অফিসার ব্যাংককে খরচ দেখিয়েছেন ১৭০ টাকা। এর মধ্যে ৫০ টাকা ঐ গার্ড ভাইকে দিয়েছেন। তিনি নিতে না চাইলে তাকে চাকরির হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। এই পঞ্চাশ টাকা অবৈধ উপার্জন। বহু মানুষ এমন উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকে। আমার প্রিয় ঐ গার্ড ভাই আরো কিছু কারণ যোগ করে ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এর বিনিময়ে যে চাকরি পেয়েছেন তা তাঁর আগের বেতনের অর্ধেক। আল্লাহ ওনাকে বরকত দান করুন।

অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। যেমন খাবারের মান মনিটর করার কিছু প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে তাদের উপার্জন হালাল হবে না। এভাবে আমরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করি আমাদের সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। আমরা অনেকে অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করি, পরিজনের সাথে ফোনে গল্প করি। এটা হারাম। আপনি যে বেতন নেন তার প্রাপ্য হিস্যা প্রতিষ্ঠানের মালিককে বুঝিয়ে দিতে হবে। ফাঁকিবাজি করলে আয় হালাল হবে না।

অনেক ব্যবসায়ি পণ্যের দোষ প্রকাশ করেন না শুধু গুনগুলো প্রকাশ করেন সেক্ষেত্রে আয় অবৈধ হবে। আর যদি প্রতারণা করে মিথ্যা বলে পণ্য বিক্রি করেন তাহলে সেটা তো আরো বড় অপরাধ। ব্যবসায়ীরা যে কোনো পণ্যের খারাপ দিক থাকলে অবশ্যই তা ক্রেতার নিকট বিক্রয় করার আগে প্রকাশ করতে হবে। না হলে তার আয় হালাল হবে না বলেছেন মুহাম্মদ সা.।

অনেক ব্যবসায়ি মজুতদারি করেন যাতে দাম বাড়ানো যায়। রাসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে কঠোরসব কথা বলেছেন। আসলে আমরা সবাই জানি কী হালাল, কী হারাম! আমাদের সবার বিবেক আছে। আমরা ভালো এবং খারাপ আলাদা করতে পারি। তাই আসুন আমরা আমাদের উপার্জন হালাল করি।

আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য-অগণিত নিয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন আমাদের। খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস, জীবন-জীবিকা সবই তিনি আমাদের দিয়েছেন সুচারুরূপে। একজন মানুষ জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতে লালিত-পালিত হয়; যার সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়। জীবনধারণের উপকরণ সন্ধান করা ইসলামি শরিয়তের একটি স্পষ্ট নির্দেশ। মানবআত্মা প্রকৃতিগতভাবে রিজিক অন্বেষণের পেছনে ছুটে চলে। আর আল্লাহ তায়ালা দিনকে করেছেন জীবিকা অর্জনের সময়কাল এবং রাতে বানিয়েছন বিশ্রামের সশয় হিসেবে। তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করতে এবং তার দেয়া রিজিক ভোগ করতে। হালাল রিজিক উপার্জন করে মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার থেকে বেঁচে থাকাই বিশাল সম্মান ও মর্যাদার বিষয়।

আল-কোরানে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ : 
এক. ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে।'[সুরা-হুদ, আয়াত-৬]

দুই. আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর,তোমরা সফলকাম হবে।' [সুরা-আল-জুমা, আয়াত-১০]

তিন. আল্লাহ বলেন, হে বিশ্ববাসীগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সুদের যা বকেয়া আছে তা পরিহার করো; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’ [সুরা বাকারা-২৭৯]

চার. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভালো বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞাত। [সুরা আল-মুমিনুন :৫১]

পাঁচ. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তারই ইবাদত কর। [সুরা বাকারা:১৭২]

আল-হাদিসে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ :  
এক. ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিজিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোনো জীবজন্তুই মারা যায় না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা কর। রিজিক প্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের তা উপার্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা কেবল তার আনুগত্যের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। [ইবনে মাজাহ]

দুই. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত নবী [সা.] ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে, তা থেকে দান-খয়রাত করলে তা কবুল করা হবে না এবং সে তার এ সম্পদে বরকত প্রাপ্ত হবে এরূপ কখনো হতে পারে না। তার পরিত্যক্ত হারাম মাল কেবল তার জন্য দোজখের পাথেয় হতে পারে (তা দিয়ে আখেরাতের সৌভাগ্য ও সাফল্য অর্জন করা যায় না)। আল্লাহতায়ালার নিয়ম হচ্ছে, তিনি মন্দের দ্বারা মন্দকে নিশ্চিহ্ন করেন না (হারাম মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন না)। বরং ভালো দ্বারা মন্দ নিশ্চিহ্ন করেন (হালাল মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন। নাপাক দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় না। (মুসনাদে আহমাদ)।

তিন. নবী আকরাম [সা.] একটি হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করে এবং সে কাজে লক্ষ্য থেকে আল্লাহর সন্তুটি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত হজরত মুসা আ:-এর মায়ের মতো। তিনি নিজেরই সন্তানকে দুধ পান করান আবার তার বিনিময় লাভ করেন।

চার. শরিয়তের দৃষ্টিতে রিজিক অন্বেষণে শ্রম ব্যয়ের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবিজি [সা.] বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য সর্বোত্তম খাদ্য’।

পাঁচ. রাসুলে করিম [সা.] হাদিসে পাকে ইরশাদ করেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ আদায়ের পর আরেক ফরজ। [তিবরানি ও বায়হাকি শরিফ]

হালাল রিজিক অন্বেষণ করাও একটি ইবাদত : 
আল্লাহই রিজিকের মালিক। কে কী উপার্জন করবে তা আল্লাহতায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। বান্দার উচিত হবে বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জন করার প্রয়াসে নিয়োজিত থাকা। হালাল এবং হারামের পার্থক্য সম্পর্কে সতর্ক থাকা। কোনোভাবেই হারাম পথে প্রলুব্ধ না হওয়া। হারাম পন্থায় জীবিকা উপার্জনের দ্বারা কোনো ইবাদাত কবুল হবে না। বিষয়টিকে আমাদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো, আমরা যা উপার্জন করছি তা পবিত্র কি-না, হালাল কি-না। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা পবিত্র ও হালাল কেবল তাই ভক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

হালাল রিজিক অন্বেষণ করা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয় :
পবিত্র ও হালাল রিজিক অন্বেষণ-উপার্জন করা আদৌ কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয় রবং টি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কারণ কেয়ামতের ময়দানে বান্দাকে তার জায়গা থেকে এক চুল পরিমাণও নড়তে দেয়া হবে না যতক্ষণ না সে এই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে পারবে যে, সে তার জীবিকা কীভাবে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য হলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যে, সে তার জীবিকা কীভাবে উপার্জন করছে! সে যা উপার্জন করছে তা হালাল কি-না, পবিত্র কি-না তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে।

ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রিজিক :
প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ [রা.] বলেন, মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- ১. হালাল খাওয়া ২. ফরজ আদায় করা এবং ৩. রাসুলে করিম [সা.]-এর সুন্নতগুলোর আনুগত্য বা অনুসরণ করা। হালাল খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-খয়রাত, লেনদেনসহ যাবতীয় নেক আমল কবুল হওয়ার সমূহ আশা বিদ্যমান এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার প্রবল আশঙ্কাই রয়েছে। এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করতে রাসুল [সা.] ইরশাদ করেন, ‘বহু লোক এমন দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকে, হে পরওয়ারদেগার! রব! কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহারসামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় তার ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা কী করে কবুল হতে পারে?’ অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হারাম মালের এক লোকমা তার পেটে ঢুকাবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি কবুল হবে না
[তিরবানি শরিফ]

৬ মে, ২০১৯

শাহবাগ, হেফাযত ও জামায়াত : কিছু কথা, কিছু উপলব্ধি



অনেকে মনে করেন এবং অনেককে বলতে শুনেছি জামায়াত নাকি হেফাযত সৃষ্টি করেছে। বিএনপি জামায়াত নাকি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হেফাযতকে মাঠে নামিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রটেকশন দেয় নি।

অনেকে মনে করেন শাহবাগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই হেফাযতের সৃষ্টি হয়েছে। এটাও শুদ্ধ কথা নয়। তবে শাহবাগীদের কাউন্টার হিসেবে হেফাযতের উত্থান হয়েছে, পরিচিতি পেয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করলেও হেফাযত গঠিত হয়েছে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় তখন শাহবাগে জামায়াতের বিরুদ্ধে ফাঁসী চাই আন্দোলন শুরু হয়। আমার কাছে প্রমাণ চাইলে আমি দিতে পারবো না, তবে আমার নিশ্চিত অনুমান এর পেছনে র' জড়িত। এই দেশে ভারত সরকারের একমাত্র শত্রু জামায়াত। এটা কেন সেটা সবাই জানে। প্রতিটা নির্বাচনে জামায়াত যাতে কোনোভাবে সরকারে না আসতে পারে সেজন্য ভারত সরকার বাংলাদেশের ছোট-বড় সবক'টি রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ করে।

শাহবাগ আন্দোলনের মতো আগেও আরেকটি আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে '৯২ সালে। সেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো 'ঘাদানিক'। ঘাদানিক আন্দোলন শাহবাগের আন্দোলনের চাইতেও অনেক বেশি জোরালো ছিলো। তারা বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো উপজেলায় কমিটি দিতে পেরেছিলো। তাদের হামলায় জামায়াত- শিবিরের বহু মানুষ খুন হয়েছে। সময়ের স্রোতে ঘাদানিক হারিয়ে গেলো। ঘাদানিক হারিয়ে যেতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর। '৯৫ সালে জামায়াত প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর আন্দোলনে যখন দেশবাসী একত্র হয়ে গেলো তখন ঘাদানিক সেই আন্দোলনের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলো।

জামায়াতের বিরুদ্ধে শাহবাগে যখন ইসলামবিরোধীরা একত্র হয়েছে তখন জামায়াতের বাহিরে থেকে শুধুমাত্র একজন মানুষ কন্ঠ উচ্চ করে এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন এটা ফ্যাসিবাদ। বিচার নয়, ফাঁসী চাই এটা ফ্যাসিবাদী আন্দোলন। তার নাম মাহমুদুর রহমান।

আমার জানামতে বাংলাদেশে শুধুমাত্র ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াত কর্মীরা নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন হওয়া শুরু হয়েছে। এর আগে অনেকবার জামায়াত কোণঠাসা হয়েছে কিন্তু কখনো তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয়নি।

বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের মূল নাটের গুরু যে র' এটা জানে না এমন কেউ নেই। এদেশের সব জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ হয় ভারতে। অস্ত্র আসে ভারত থেকে। ব্লগার রাজিব নামে এক লোক জঙ্গিদের হাতে খুন হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। যেসব জঙ্গীরা রাজীবকে খুন করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে তারা কেউই জামায়াতের সাথে যুক্ত নয়।

আমার কাছে প্রমাণ চাইলে আমি দিতে পারবো না, তবে আমার নিশ্চিত অনুমান এই হত্যাকাণ্ড র'-এর পরিকল্পনা ছিলো। যে কোনো আন্দোলনে রক্ত ঝরলে তার যৌক্তিকতা বেড়ে যায়। এজন্য তারা এক নিরীহ নাস্তিক ব্লগারকে টার্গেট করে তাদের বি টিম জঙ্গীদের দিয়ে রাজিবকে খুন করিয়েছে। এতে করে জামায়াতের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থানে যেতে পারবে সরকার। মানুষের ঘৃণাও বাড়বে জামায়াতের বিরুদ্ধে।

ব্লগার রাজিবকে নিরীহ বলেছি সে কোনো ভালো মানের নাস্তিক ছিলো না। তার লেখার হাতও ভালো ছিলো না। আমি ব্লগিং জগতে ২০০৯ সাল থেকে বিচরণ করেছি। কিন্তু তাকে চিনতাম না। অথচ তখন আমি জনা পঞ্চাশেক নাস্তিক ব্লগারের লেখা পড়েছি ও তাদের যুক্তির কাউন্টার যুক্তি দিয়েছি। তারা খুন করার জন্য একজন নন প্রোডাক্টিব নাস্তিককে খুঁজে বের করেছে।

রাজিব হত্যা নিয়ে র' এর পরিকল্পনা যেভাবে ছিলো ঘটনা তা-ই ঘটছিলো। কিন্তু এর মধ্যে অন্য একটি ব্যাপার সামনে চলে এলো। ব্লগার রাজিব বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা.-কে নিয়ে কুৎসিত সব কথা ও গালি দিয়ে কমেন্ট করেছিলো। সেই বিষয়টা গবেষণা করে উদ্ধার করেছে মাহমুদুর রহমানের 'দৈনিক আমার দেশ'।

মাহমুদুর রহমান বিএনপিসহ সব ডানমনা দলকে এটা বুঝাতে চেয়েছিলেন এই আন্দোলন শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধে এটা মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে। আসলেও তাই। শাহবাগে প্রতিদিন ইসলামকে নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যঙ্গ করা হচ্ছিলো। কিন্তু তিনি ততটা সফল হননি। যখন সারাদেশের সকল মিডিয়া রাজিবকে নিয়ে কাঁদছিল আর জামায়াতের পিণ্ডি চটকাচ্ছিল তখন আমার দেশ ও নয়া দিগন্তের ভিন্ন উপস্থাপনা এদেশবাসীকে আবারো ভিন্ন চিন্তা করতে শিখিয়েছে।

আমার দেশ বিজ্ঞাপন আকারে ব্লগার রাজিবের উক্তিগুলো প্রচার করেছে আর মুসলিমদের এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান করেছিলো। আমার যতদূর মনে পড়ে মাহমুদুর রহমান চট্টগ্রামের কওমী মাদ্রাসাগুলো সফর করেছেন রুখে দাঁড়ানোর জন্য। যেদিন শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয় সেদিনই আমি চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ ও এরেস্ট হই। আহত হওয়ার সুবাদে আমাকে কারাগারে সাথে সাথেই যেতে হয়নি। চিকিতসাধীন ছিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন টেলিভিশন না দেখতে পারলেও নিয়মিত তিনটি পত্রিকা পড়তাম।

ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে ২০১০ এর ১৯ জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের প্রায় একশোটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়ে হেফাযতে ইসলাম গঠিত হয়। এর মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ইযহারুল ইসলাম। হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফীকে এই সংগঠনের প্রধান করা হয়। ২০১১ সালে তারা বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতি (২০০৯) এর কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে।

কওমী আলেমরা বুঝতে পারেন শাহবাগ আন্দোলন মূলত ইসলামবিরোধী আন্দোলন। এরপর তারা হেফাযতে ইসলামের ব্যানারে শাহবাগের বিরোধীতা করতে থাকেন। এবার জামায়াতের নেতা-কর্মীরা হালে পানি পায়। তারা হেফাযতের নেতৃত্বে শাহবাগবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। মুহুর্তেই হেফাযত শক্তিশালী হয়ে উঠে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শাহবাগের দর্প চূর্ণ করে দেয় অল্প দিনের মধ্যেই। চট্টগ্রাম থেকে সকল শাহবাগীদের উচ্ছেদ করে। এরপর ঢাকামুখী অগ্রযাত্রা শুরু হয় তাদের। ঢাকায়ও তারা বিভিন্ন স্থানে বড় বড় মিছিল করে। এসব মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে সকল পর্যায়ের মুসলিম। তারা সবাই আহত হয়েছে রাজিবের আল্লাহ-রাসূল সা. বিরোধী উক্তিতে।

শাহবাগ ক্রমেই জনসম্পৃক্ততা হারায়। কালক্রমে এখন শাহবাগী একটি গালিতে পরিণত হয়। জামায়াত তার হারানো নৈতিক শক্তি ফিরে পায় এক মাসের মধ্যেই। হঠাত বিশাল সাফল্য কওমী নেতাদের বেপরোয়া করে তোলে। আমার জানামতে একমাত্র মুফতি ইযহার ছাড়া আর কেউ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করতে পর্যন্ত রাজি ছিল না। ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে হেফাযতের সমাবেশগুলোতে মঞ্চে কোনো রাজনৈতিক নেতাদের তারা উঠতে দেয় নি। জামায়াত তো বহু দূরের কথা। তবে জামায়াত কর্মীরা হেফাযতকে আশ্রয় করে শাহবাগ ঠেকাতে চেয়েছে এবং সেটায় তারা সফল হয়েছে।

৫ মে মহাসমাবেশে সারাদেশ থেকে জামায়াত তাদের কর্মীদের জড়ো করেছে ঢাকায়। যাতে ইসলামী গনজাগরণ স্পষ্ট হয়। দিগন্ত টেলিভিশন বহুস্থানে তাদের ক্যামেরা স্থাপন করে এই সমাবেশকে জাতির সামনে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছে। সারা দেশের জনগণ পানি ও খাবার নিয়ে সমাবেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর সকাল থেকে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা পুলিশকে ঠেকিয়ে রেখেছে যাতে সমাবেশ চলতে পারে। হেফাযত নেতারা কোনো কর্মপরিকল্পনা দিতে পারছিলেন না। সরকার শফি হুজুরকে হুমকির উপর রেখেছিলো।

যারা বলে থাকেন, খালেদা জিয়া হেফাযতের গণঅভ্যুত্থান দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বসেছিলেন, তাদের দাবি মোটেই সত্য নয়। বিএনপি এই সমাবেশে যাস্ট নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এর বেশি কিছু নয়। আর তাছাড়া হেফাযত নেতারাও খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ আলোচনা করে আন্দোলন করেনি। এটা ঠিক যে বিএনপি'র একজন উপদেষ্টা হেফাযতকে মাঠে নামিয়েছেন। কিন্তু এটা সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিলো না। এটা ছিলো শাহবাগ বিরোধী আন্দোলন। হেফাযতে ইসলামের দাবি থেকেই তা অনেকটা পরিষ্কার।

হেফাযতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি :

১- সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।

২- আল্লাহ্, রাসুল ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।

৩- শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসুল এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।

৪- ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

৫- ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।

৬- সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।

৭- মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।

৮- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।

৯- রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।

১০- পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।

১১- রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র রাসুলপ্রেমিক জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।

১২- সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।

১৩- অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও রাসুলপ্রেমিক জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান।

আল্লাহর পরিকল্পনা বড় পরিকল্পনা। র' চেয়েছিলো রাজিবকে খুন করে শাহবাগ আন্দোলনকে আরো চাঙ্গা করবে, জামায়াতকে ঘৃণার বস্তু বানাবে। নিশ্চিহ্ন করে দিবে। কিন্তু এর মাধ্যমে তাদের আন্দোলন বানচাল হয়ে গেছে। জামায়াত সবল হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা জামায়াতকে এমন একটি শক্তি দিয়ে উদ্ধার করেছেন যারা জামায়াতের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে এসেছে। তাদের কাফের ফতোয়া দিয়েছে। আল্লাহু আকবার।

হেফাযতের উত্থানে মানুষ শাহবাগীদের ঘৃণা করেছে। এদেশে শাহবাগীদের খুবই নিকৃষ্ট ও অপমানজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। জনমানুষের ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে হেফাযতে ইসলামের একটি দাবিও সরকার রাখে নি। স্বৈরাচারী সরকার হুমকি ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে তাদের কেনা গোলামে পরিণত করেছে।

তাদের সনদ দেয়ার অনুষ্ঠানে সরকারের এক কর্তাব্যক্তি তার বক্তব্যে বলেছেন ৫ মে মতিঝিলে একজন মানুষও মৃত্যুবরণ করেনি। হাজার হাজার কওমী আলেম সেখানে বলে হাততালি দিয়েছে। মুফতি শফি তার এক বক্তব্যে বলেছেন আওয়ামীলীগ অনেক ভালো, তারা আমাদের মোটা অংকের টাকা দেয়। আজ হেফাযতে ইসলামও জনমানুষের ঘৃণার মুখোমুখি।

আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত করেছেন জামায়াতে ইসলামীকে। এই পুরো ঘটনা প্রবাহে জামায়াতের কারিশমা নেই বললেই চলে। তবে তাদের একটা কারিশমা আছে সেটা হলো আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাস তাদেরকে কোনো পরিস্থিতিতেই মাথানত হতে দেয়নি। মুসলিমদের এটা বড় শক্তি। জামায়াত যেদিন এই শক্তি হারাবে সেদিন তারাও আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাদের জন্য থাকবে না আল্লাহর কোনো সাহায্য।

৪ মে, ২০১৯

মুসলিম কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না



মুসলিম মানে আত্মসমর্পনকারী। সে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালার কাছে আত্মসমর্পন করেছে। তার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল সা.-ই শেষ কথা। একজন মুসলিম মাত্রই তাকে আল্লাহ ও তার রাসূল সা.-এর পূর্ণ আনুগত্য করতে হবে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কুরআনে ও রাসূল সা. এর সীরাত থেকে। আমরা এই আলোচনায় বুঝার চেষ্টা করবো কেন একজন মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার মতবাদে বিশ্বাসী হতে পারে না।    

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা দুধরণের, এক শ্রেণিকে ধূর্ত ও চালাক বলা চলে এবং আর এক শ্রেণির উপযুক্ত পরিচয় দিতে গেলে ‘বোকা অথবা বিভ্রান্ত’ বলাই সমীচীন। ধূর্ত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পরিচয় অত্যন্ত স্পষ্ট। তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে প্রচার করে বটে, কিন্তু তাদের অনেকেরই ব্যক্তি জীবনে ধর্মের কোন গন্ধ ও পাওয়া যায় না। তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্মকে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলে মনে করে, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক সুবিধা ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনের তাকিদে ধর্মকে মৌখিক স্বীকৃতি দান করে।

বিভ্রান্ত বা বোকা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা নিতান্তই করুণার পাত্র। তারা নামায, রোযা, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ যিকর ইত্যাদি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আদায় করে, কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানকে মেনে চলার কোন তাকিদই অনুভব করে না। আল্লাহর কিতাবকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ না করে যারা শুধু ইসলামের কতিপয় অনুষ্ঠান নিয়েই সন্তুষ্ট, তাদের প্রতি কুরআন যে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে, তা যে কোন সত্যিকার মুসলমানের অন্তরকেই কাঁপিয়ে তুলবার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহপাক বলেন, “তোমরা কি কিতাবের কতক অংশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছ এবং আর কতক অংশকে অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে তাদের জন্য এ দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ছাড়া আর কি বদলাই বা থাকতে পারে। আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। ”

প্রথমত :
সুরা আলে ইমরানের ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, "নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য জীবন বিধান একমাত্র ইসলাম। এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশত, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত।" এখানে খেয়াল করে দেখলে বুঝবেন আল্লাহ তায়ালা শ্রেষ্ঠ জীবন বিধান বলেননি বলেছেন একমাত্র জীবন বিধান। অর্থাৎ একজন মুসলিম ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবন বিধানকে মেনে নিতে পারে না। ইসলামই শেষ কথা। মুসলিমরা অন্য বিধর্মীদের সাথে আচরণ করবে সেভাবে যেভাবে ইসলাম নির্দেশ করে। একজন সেক্যুলার সকল ধর্মকে একইরূপে ট্রিট করে যেটা ইসলামসম্মত নয়। কোনো মুসলিম তা পারে না।

দ্বিতীয়ত :  
সেক্যুলাররা আল্লাহকে বিশ্বাস করে তবে আল্লাহর নিয়ম রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে নারাজ। এ বিশ্বের যদি কোন স্রষ্টা থাকেন এবং সমগ্র বস্তুজগতে যদি তার দেয়া প্রাকৃতিক বিধানসমূহ কার্যকর বলে স্বীকৃত হয়, তাহলে সেই মহাশক্তিশালী স্রষ্টাকে মানুষের জীবনে একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি করার কি কারণ থাকতে পারে? প্রাকৃতিক জগতে কোন ক্ষুদ্রতম বিধানকে বদলীয়ে দেবার ক্ষমতা মানুষের নেই। এমনকি মানুষ তার আপন শারীরিক বিধিও ইচ্ছা মত পরিবর্তন করে সুস্থ থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় মানব জীবনে সামঞ্জস্য ও শৃংখলা বিধানের জন্য কোন বিধি ব্যবস্থা বিশ্ব স্রষ্টার নিকট থেকে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে কিরূপে যুক্তিভিত্তিক বলে মেনে নেয়া যায়? যিনি জীব জগৎ, উদ্ভিত জগৎ ও সৌরমন্ডলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিধান দিয়েছেন তাঁকে মানব জাতির জন্য বিধানদাতা হিসাবে স্বীকার করায় আপত্তি কেন? 
আল্লাহকে  বিধানদাতা মনে করতে না পারলে মুসলিম আর মুসলিম থাকে না। 

তৃতীয়ত :
আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারায় বলেন “হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর”। যারা কুরআনের কিছু বিধান গ্রহণ করে আবার কিছু বিধান ত্যাগ করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা শাস্তির ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন,“তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফেল নন”। [সূরা বাক্বারা, আয়াত ৮৫]। 

তাহলে যে আল্লাহকে আপনি ব্যক্তিজীবনে আনুগত্য করবেন। তার নিয়মে কেন রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন না? সূরা হজ্বের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা শাসকদের উদ্দেশ্যে ৪ টি দায়িত্বের কথা বলেছেন, সালাত প্রতিষ্ঠিত করা, যাকাত আদায় করা, সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখা। কোনটা সৎকাজ আর কোনটা মন্দকাজ এটিও নির্ধারিত হবে ইসলাম অনুযায়ী। কোনো শাসক বা কোনো শাসনব্যবস্থায় যদি উপরোক্ত দায়িত্ব পালনের ব্যপারে কঠোরতা আরোপ না করে তবে সে শাসনব্যবস্থা কোনোভাবেই বৈধ তো নয়ই উপরন্তু এটি আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার শামিল। 

চতুর্থত :
প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। মুসলিম সমাজে ‘আল্লাহ নেই’ বলে ঘোষণা করবার দুঃসাহস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় মনে করেই তারা ধূর্ততার বক্রপথ অবলম্বন করে থাকে। বাস্তব ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক শাসনকর্তার ( Constitutional head) ন্যায় প্রভাবহীন এক দুর্বল সত্তা হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করে তারা স্রষ্টার বিশ্বাসীদেরকে ধোঁকা দেবার অপরূপ কৌশল ফেঁদেছে। এ পন্থায় বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মে তুষ্ট এক শ্রেণীর ভীরু লোক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে স্বীকার করেও আল্লাহকে খুশী করা যায় বলে বিশ্বাস করে। আর শাসন শক্তির ধারক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এ ভীরু ধার্মিকদের সমর্থনেই টিকে থাকার চেষ্টা করে। এ সমর্থনটুকুর জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শাসকরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করলেও মুখে স্বীকার করে থাকে।

পঞ্চমত :
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আল্লাহকে ব্যক্তিগত জীবনে আনুগত্যের অধিকারী বলে স্বীকার করে এবং সমাজ জীবনে আল্লাহ ও ধর্মকে মানার প্রয়োজন নেই বলে ঘোষণা করে। এখানে প্রশ্ন হল, কোন দলিলের ভিত্তিতে তারা আল্লাহর মতকে ব্যক্তিগত এলাকায় সীমাবব্ধ করেন? আল্লাহ কি কোথাও এ বিষয় কোন ইঙ্গিত দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিছু ইবাদত ও নামায রোযার অনুষ্ঠান পালন করলেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজ বুদ্ধি অনুযায়ী যার যেরূপ খুশী জীবন যাপন করলেও আল্লাহর কোন আপত্তি নেই বলে কোন নবীর নিকট ওহী নাযিল হয়েছে কি? আল্লাহ যদি নিজে তাঁর আনুগত্যের দাবীকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ করে না থাকেন তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পরামর্শে আল্লাহকে সমাজ জীবনে অমান্য করা কি কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ কাজ হবে?

ষষ্ঠত : 
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের মধ্যে যে ব্যবধানের উল্লেখ করেন তা সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে চরম অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। নিতান্তই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এ বিজ্ঞান বিরোধী মতবাদ পোষণ করে থাকেন। মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের মাঝখানে ব্যবধানের সীমারেখাটি কোথায়? সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের ব্যক্তি জীবন সমাজ থেকে কী প্রকারে পৃথক হতে পারে?

ধর্মীয় কারণে যে ব্যক্তি সত্যবাদী সে তার সত্যবাদিতা সমাজ জীবনেই প্রয়োগ করবে। কিন্তু অপর ব্যক্তির সাথে সামাজিক জীবন যাপনের বেলায় মিথ্যুক বলে সাব্যস্ত হলে ব্যক্তিগতভাবে সত্যবাদী হওয়ার উপায় কি? ব্যক্তি জীবনে চরিত্রবান ও চরিত্রহীন হওয়ার কোন উপায় নেই। কেউ ব্যক্তি জীবনে গুন্ডা হয়েও রাজনৈতিক জীবনে সৎ হতে পারবে কি? সমাজ জীবনে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি জীবনে ধার্মিক বলে স্বীকৃত হতে পারে কি? প্রত্যেকটি মানুষই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত। তার জীবনে এমন কোন ব্যাপারই থাকতে পারে না যা অন্য কোন মানুষের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না।

সপ্তমত :
মানুষ এমন এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীব যে, তাকে সকল বিষয়েই নিজের ভাল মন্দ বাছাই করার ঝামেলা পোহাতে হয়। অন্যসব জীবের ন্যায় তার পরিপূর্ণ বিকাশ আপনা আপনিই হতে পারে না। সুতরাং আদর্শের সন্ধান করা ছাড়া মানুষের কোন উপায় নেই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যখন মানুষকে আদর্শহীন করে অনিশ্চিত পথে ছেড়ে দেয় তখন তার জীবনে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার পক্ষে আদর্শ শূণ্য অবস্থায় জীবনযাপন করা বাস্তবক্ষেত্রে অসম্ভব। ফলে এ শূন্যতাকে পূরণ করার জণ্য তার সামনে অনেক বিচিত্র ও বিপরীতমুখী আদর্শের আবির্ভাব ঘটে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও অন্যান্য দিকে মানুষ তখন আদর্শের সন্ধান করতে বাধ্য হয়।

প্রয়োজনের তাগিদে যখন মানুষ আদর্শ খুঁজতে থাকে, তখন বিভিন্ন চিন্তাশীল মানুষ পৃথক পৃথকভাবে বিচিত্র রকমের আদর্শ আবিস্কার করে। একই মানুষের পক্ষে মানব জীবনের সর্বদিক ও বিভাগের উপযোগী সামঞ্জস্যশীল পূর্ণাঙ্গ আদর্শ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না বলে বাধ্য হয়েই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য বিভিন্ন মানুষের রচিত আদর্শ গ্রহন করতে হয়। এমতাবস্থায় সামঞ্জস্যময় জীবন কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না। একজন মুসলিম এই গোঁজামিলের আদর্শ গ্রহণ করতে পারে না। 

অষ্টমত : 
শাসন শক্তি এমন এক হাতিয়ার যা দ্বারা জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের সুযোগও পেতে পারে আবার চরমভাবে নির্যাতিতও হতে পারে। যে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকগণই রাষ্ট্রের সকল ধন-সম্পদের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এমতাবস্থায় শাসক সম্প্রদায় আল্লাহর দাসত্ব ও ধর্মের বন্ধন থেকে যদি মুক্ত হয়, বিশ্ব স্রষ্টার নিকট যদি জওয়াবদিহিতার অনুভূতি শূন্য হয় এবং আখিরাতে পুরস্কার ও শাস্তির প্রতি যদি অবিশ্বাসী হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা সুবিধাবাদী নীতি অনুসরণ করে চলবে। তাদের চরিত্র কিছুতেই নির্ভরযোগ্য হবে না।

তারা নিজেদের পার্থিব লাভ লোকসানের ভিত্তিতে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। গদি রক্ষার জন্য তারা যে কোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত হবে। আত্ম-প্রতিষ্ঠার জন্য এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য তারা শাসনযন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার করবে। তাদের গোটা চরিত্র মানুষের খিদমতের জন্য নিয়োজিত না হয়ে নিজেদের খিদমতেই নিযুক্ত হবে। শুধু গণ-বিপ্লব এড়াবার জন্য এবং জনসমর্থন থেকে বঞ্চিত হবার ভয়েই তারা জনসেবা করবে। এখানেও চরম উদ্দেশ্য আপন স্বার্থ।

নবমত :
আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস যাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের শাসন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর শাসনে যে বিরাট পার্থক্য আছে তা যেমন যুক্তিসম্মত, তেমনি তা ঐতিহাসিক সত্য। যারা ধর্মকে বাস্তবজীবনে গ্রহণ করেছে তাদের শাসন ধর্মহীনদের শাসন থেকে স্বাভাবিকভাবেই আলাদা ধরনের হবে। এমনকি মুসলিম শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসেও ধার্মিক এবং অধার্মিক শাসকদের যুগে জনগণের জীবনে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। শাসন ব্যক্তিই সমাজের সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও সবল শক্তি। এ বিপুল শক্তিকে একমাত্র আল্লাহ ও আখিরাতের ভয়, আল্লাহ ও রাসূলের আইন এবং ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তদুপরি জনমতও আংশিকভাবে শাসন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের আচরণ একমাত্র জনমত দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ফলে তারা প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে এবং ক্ষমতার যাদুমন্ত্রে জনমতকে কলুষিত করে অনেক সময়ই অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দিতে পারে। তাই ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় থাকার সাধনাই করে। একজন মুসলিম এমন শাসন ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারে না। 

দশমত : 
আল্লাহ তায়ালা তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার জন্য এমন এক পুর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিহীন জীবনব্যবস্থা বাস্তবরূপে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছেন যার ঐতিহাসিক সত্যতা অস্বীকার করা কোন পথই অবশিষ্ট নেই। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলাম যে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন বিধান পরিবেশন করেছে তা কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে আজও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। চৌদ্দশত বছরেও কুরআনের মধ্যে কোন কৃত্রিমতা অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। সর্বকালে ও সর্বদেশেই এ কুরআন মানুষকে পথপ্রদর্শন করতে সক্ষম বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহর দেয়া বিধানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জীবন বিধি রচনা করা কোন কালেই সম্ভব নয় বলে কুরআন বারবার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। কোনো মুসলিম ইসলামের বিধানের বাইরে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে গ্রহণ করার অর্থ আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। 

একাদশত :
আপনি যখন আপনার আদর্শ হিসেবে ইসলামকে চিহ্নিত না করে অন্য কিছুকে নির্দিষ্ট করবেন অথবা কোনো কিছুই নির্দিষ্ট করবেন না তখন এটা সুস্পষ্ট যে আপনি ইসলাম ও আল্লাহর বিধানের উপর আস্থাশীল নন। আপনার আস্থা ইসলাম ভিন্ন অন্য কিছুতে অথবা কিছুতেই না। এর মানে আপনি শিরকে আকবরের সাথে যুক্ত। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা আল্লাহর আইনের সাথে মনগড়া আইনকে শরীক করে। 

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ সম্বন্ধে উপরোক্ত আলোচনার পর একথা সহজে অনুমেয় যে, ইসলাম বিশ্বাসী কোন মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী থাকা স্বাভাবিক নয়। মুসলমান নাস্তিক কথাটা যেমন হাস্যকর ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান কথাটাও তেমনি কৌতুকপ্রদ। তবু একজন অমুসলিম যে পরিমাণে ধর্মনিরপেক্ষ, সে পরিমাণ ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলিম নামধারী ব্যক্তি একমাত্র নামের জোরেই মুসলিম হিসাবে পরিচিত হয়। একইসাথে তারা মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দিন। আমাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করুন।