১ আগ, ২০১৯

ইরান ও বিশ্বসন্ত্রাসীদের লড়াই

ইরানের হামলায় ভূপাতিত মার্কিন ড্রোন
ইরানের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের সন্ত্রাসীদের লড়াই ভালোই মোকাবেলা করছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে ধীরে ধীরে যুদ্ধের পথে ঠেলে দেবে, এমনটাই ছিলো সন্ত্রাসীদের ইচ্ছে। তবে ইরানের অনমনীয় আচরণ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে দূরে ঠেলে দেবে বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আরো কঠোর হয়েছে। যারাই ইরানের সাথে বাণিজ্য করছে সবাইকে কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে তারা। এই কারণে ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, পানামা, লাইবেরিয়াসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের বিরোধ তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি ইংল্যান্ড আরব উপসাগরে আরো একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে ইরানকে মোকাবিলা করার জন্য।  

ড্রোন যুদ্ধ :
ইরান তার সীমানার ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থানে আছে। আমেরিকার ড্রোন বার বার তাদের সীমানা অতিক্রম করলে প্রথমে ইরান কয়েকবার সতর্ক করে। এরপর গুলি করে নামিয়ে ফেলে। এতে ট্রাম্প ক্ষেপে যায়। মনে হচ্ছিল এই ঘটনাকে পুঁজি করে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত হুমকি ও যুদ্ধের ঘোষণাকে ইরান খুব হালকাভাবে উড়িয়ে দিচ্ছিল। ইরান হরমুজ প্রণালীতে তাদের টহল আরো জোরদার করে। এক পর্যায়ে ট্রাম্প প্রশাসন ইরান আক্রমণ স্থগিত ঘোষণা করে। এর কিছুদিন পর ট্রাম্পের একটি টুইটের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারলো ইরানের একটি ড্রোন নাকি আমেরিকা নামিয়ে ফেলেছে। 

ইরান এই ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে। তারা জানায় তাদের কোনো ড্রোন হারানোর খবর তাদের কাছে নেই। আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমগুলো এই খবর আরো বেশি করে প্রচার করলে ইরান বিষয়টাকে ভালোভাবে খেলিয়ে তোলে। তারা আমেরিকার কাছে ড্রোনের ছবি দাবি করে। আমেরিকার এতে ব্যর্থ হয়। ইরান এরপর তাদের ড্রোন থেকে আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ নজরদারির ভিডিও সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটে অনেকটা ভারতের মতো। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে ভারত এমন অলিক দাবি করে পরে পিছু হটেছে। 

ইরানি তেলবাহী সুপার ট্যাংকার গ্রেস-১ আটক করে ব্রিটেন
পাল্টাপাল্টি ট্যাংকার জব্দ : 
উত্তেজনা নতুন করে মোড় নেয় জুলাইয়ের শুরুতে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়া একটি ইরানী তেলের ট্যাংকার আটক করে ইংল্যান্ড। ইরান কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইইউ-এর নিষেধাজ্ঞার ইস্যু তুলে ব্রিটিশরা ইরানের উদ্যোগকে পাত্তাই দিলো না। এরপর ইরান সামরিক চেষ্টা শুরু করলো। তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়ে অভিযানে নেমেছে। 

তারা একটি ব্রিটিশ তেল ট্যাংকারকে ধাওয়া করলো কিন্তু ধরতে পারেনি। এর পরদিনই পানামার পতাকাবাহী আরব আমিরাতের একটি জাহাজ আটক করে ইরান। তার কিছুদিন পর ব্রিটিশ পতাকাবাহী আরেকটি জাহাজ আটক করে ইরান। এই আটকের দুঃসাহসিক ভিডিও তারা গণমাধ্যমে প্রচার করে। এর একদিন পরই লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী আরেকটি জাহাজ তারা আটক করেছে। এখন সন্ত্রাসীরা সবাই নড়েচড়ে বসেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে জাহাজ বিনিময়ের খবর প্রকাশ হলে ইরান কড়া প্রতিবাদ করে। 

ইরানের কাছে আটক ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ স্টেনা ইমপেরো
লন্ডনে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হামিদ বায়িদিনেজাদ বলেছেন, ইরানে আটক ব্রিটিশ পতাকাবাহী তেল ট্যাংকার এবং জিব্রাল্টার প্রণালীতে আটক ইরানি সুপার তেল ট্যাংকার বিনিময় অসম্ভব। টুইটার বার্তায় তিনি আরও বলেছেন, ব্রিটিশরা ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আটক করেছে। কিন্তু হরমুজ প্রণালীতে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্রিটিশ ট্যাংকার জব্দ করা হয়েছে। কাজেই দু’টি ভিন্ন কারণে আটক জাহাজের মধ্যে বিনিময় সম্ভব নয়। 

এদিকে ব্রাজিল ইরানি জাহাজকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় আমেরিকার নির্দেশে। এর ফলে প্রায় মাস দুয়েক আটকে থাকে ইরানি দুটি জাহাজ। ইরানের বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে সে দেশের হাইকোর্ট ইরানী জাহাজকে জ্বালানি সরবরাহ করতে নির্দেশ দেয়। ইরানের সেই দুটি জাহাজ এখন জ্বালানি নিয়ে ইরানের পথে। এই উত্তেজনার মধ্যে হপ্তাখানেক আগে সৌদি তাদের কাছে থাকা একটি ইরানী জাহাজ হ্যাপিনেস-১ ছেড়ে দিয়েছে। এটি এপ্রিলের শেষ দিকে যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়লে সৌদি নৌবাহিনী সহযোগিতার নাম করে আটক করে ফেলে। 

সম্প্রতি সৌদির ছেড়ে দেওয়া ইরানি জাহাজ হ্যাপিনেস-১
হরমুজ প্রণালী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
যেখানে এই ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথ। এই পথটি হরমুজ প্রণালী হিসেবে পরিচিত। পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে হরমুজ প্রণালী৷ বিশ্বের অন্যতম বড় কয়েকটি অশোধিত তেল উৎপাদক দেশ এই পানিপথ দিয়েই তাদের তেল রপ্তানি করে থাকে৷ এসব দেশের মধ্যে রয়েছে কুয়েত, বাহরাইন, ইরান, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটি উনিশ কিলোমিটার প্রশস্ত৷ আর এই প্রণালীর শিপিং লেন তিন কিলোমিটার প্রশস্ত। 

যেহেতু শীর্ষ পাঁচ তেল রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে, সেহেতু হরমুজ প্রণালী থেকে তেল পরিবহনের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। সমুদ্রপথে বিশ্বের যে পরিমাণ তেল পরিবহণ করা হয়, তার এক তৃতীয়াংশই এই প্রণালী ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়। আর কাতার যেহেতু বিশ্বের অন্যতম বড় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) উৎপাদক, সেহেতু ওই গ্যাসের প্রায় পুরোটাই হরমুজ প্রণালী দিয়ে বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করা হয়।


বিশ্ব অর্থনীতি যতদিন তেলের উপর নির্ভরশীল থাকবে, ততদিন এই প্রণালী থেকে তেল পরিবহনে কিছুটা বা অল্পসময়ের জন্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের বাজারে সেটির ভয়াবহ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কেননা এতে কুয়েত, বাহরাইন, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর সৌদি আরব তখন শুধুমাত্র লোহিত সাগরে থাকা সমুদ্রবন্দর থেকে তেল রপ্তানি করতে বাধ্য হবে।

ইরান কি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে?
১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশন অনুযায়ী একটি দেশের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল অবধি সেই দেশের সমুদ্রসীমা হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন পারস্য উপসাগরে যেতে যেসব সমুদ্রযান উত্তর এবং দক্ষিণ রুট ব্যবহারে বাধ্য হয় সেগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী বাধা দিতে পারে ইরান।

তবে জাতিসংঘের এসংক্রান্ত কনভেনশনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেটি কখনোই সেদেশের সংসদে অনুমোদিত হয়নি। তাছাড়া পানিপথটি ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তাঁর প্রতিবেশী তেল রপ্তানিকারী দেশগুলো, এবং তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করতে সক্ষম হলেও নিজেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেননা, প্রণালীর কিছু অংশ তখন সেদেশও ব্যবহার করতে পারবে না। আর, তেহরান শুধু এখনই নয়, অতীতেও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। সম্ভবত হরমুজ প্রণালীকে স্বাভাবিক রাখতেই বিশ্বসন্ত্রাসীরা একটু পিছু হটেছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন