২১ নভে, ২০১৯

শহীদ মুজাহিদের কালজয়ী কিছু উক্তি



আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একজন কবি। অমর কবি। কালজয়ী কবি। লিখে গিয়েছেন তিনি সাবলীল ভঙ্গীতে রাজনীতির কবিতা, বিপ্লবের কবিতা। একটি আন্দোলন, একটি সংগঠন, একটি ইতিহাস, একটি আপসহীন সংগ্রামের কবিতা। এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, জাতির উত্থান-পতন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে জনাব মুজাহিদ একটি অকুতোভয় নাম। ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর মধ্যরাতে তাকে প্রহসনের মাধ্যমে খুন করে ভারতের পা-চাটা স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার।

শহীদ মুজাহিদ তার দুনিয়াবী জীবনের শেষদিকে কিছু কালজয়ী উক্তি করেছেন। সেগুলো উল্লেখ করা হল।

১- সবার ভাগ্যে শাহদাতের মৃত্যু জোটে না। আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে পছন্দ করেন এবং শহীদি মৃত্যু দেন সে মৃত্যু আলিঙ্গনের জন্য আমি প্রস্তুত আছি।

Shahadat is not in the fate of everyone. If Allah loves me and gives martyr death, I am ready to embrace death.

২- আমার স্পষ্ট ঘোষণা ছিল যেদিন আমার মন্ত্রীত্ব দুর্নীতির সাথে আপোষ করবে বা আমাকে নীতিচ্যুত করবে সেদিন মন্ত্রীত্বকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিব।

I had a clear declaration that if the day my ministerial compromise with corruption or dislocated me, I would throw cabinet minister into dustbin.

৩- আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কুরবান করার জন্য সবসময় প্রস্তুত আছি।

I am always ready to sacrifice my life for the sake of Allah

৪- আমি দরখাস্ত করে মন্ত্রী হইনি। মন্ত্রী থাকার জন্য তোষামদির রাস্তাও গ্রহণ করিনি বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

I have never desired to be minister. I have never chosen the path of flattery and indulgence to remain minister. I took the responsibility as a big challenge

৫- মন্ত্রিত্বের জন্য আমি আমার চিরস্থায়ী জীবন আখিরাতকে বরবাদ করতে পারিনা। আমার এই ঘোষণা ও ভূমিকা খুবই স্পষ্ট ছিল। তাই অন্যায় আবদার নিয়ে কেউ আমার মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করতে পারেনি।

I can't ruin my everlasting hereafter for the job of a minister. my such declaration was very specific, obvious and bold. So nobody did have that dare to enter into my room with illegal demands

৬- এই জালিম সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আমি নির্দোষ, নির্দোষ এবং নির্দোষ।

There is no ground of seeking mercy from this tyrannical government. I am innocent, innocent and innocent

৭- আমার জানামতে শহীদের মৃত্যুতে কষ্টের হয়না। তোমরা দোয়া করবে যাতে আমার মৃত্যু আসানের সাথে হয়। আমাকে যেন আল্লাহর ফেরেশতারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যান।

As per as I know, the martyr does not suffer during his death. All of you pray for me, so that I can embrace death with compassion and tenderness. May the angels of Almighty Allah take me in escort

৮- আমার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুইজন ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র। তারা মূলত অভাবের তাড়নায় এবং বিপদে পড়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম।

Whoever have given testimony, except two of them, rest of the witnesses are poor and impoverished. They became compelled to give false testimonies because of their extreme poverty and security threat. I am forgiving them all.

৯- আমার শাহাদাত এই দেশে ইসলামী আন্দোলনকে সহস্রগুন বেগবান করবে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।

My martyrdom will mobilize and facilitate the Islamic movement in this country and simultaneously it will bring positive changes in our lives from national perspective

১০- আজ আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর এই অন্যায় বিচারিক প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার আল্লাহর দরবারে শুরু হয়ে যাবে, বিচার শুরু হয়ে গেছে।

Who were involved with this unjustifiable trial process, their trial will begin in the court of Almighty Allah immediate after my execution

১১- আজ যদি আমার ফাঁসি কার্যকর করা হয় তাহলে তা হবে ঠান্ডা মাথায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা।

If I am executed today, it would be similar to murder an innocent man

১২- কত বড় স্পর্ধা তাদের যে তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করার দাবী করে। অথচ তাদের নিজেদের ভেতর মানবতা নেই।

How dare they are! They are claiming to carry out the trial of crimes against humanity, but actually they don’t have minimum level of humanity within themselves

১৩- শহীদ মুজাহিদের পরিবারের প্রতি শেষ ওসিয়ত
- নামাজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস থাকবে
- সব সময় হালাল রুজির উপর থাকবে
- আত্মীয়দের হক আদায় করবে
- প্রতিবেশীর হক আদায় করবে
- বেশী বেশী করে রাসুল (সা) এর জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী পড়বে

Last advices of Shaheed Mujaheed to his family:
-Be serious about Salat (prayer)
-Always be firm about honest income
-Try to secure the rights of your relatives
-Try to secure the rights of your neighbours.
-Try to read the Sirat books, the life of the holy Prophet (pbuH) and His companions regularly

১৪- ফাঁসী দেয়া হোক আর যাই হোক বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন চলবে এবং এদেশে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হবেই ইনশাআল্লাহ্‌।

If there is a hanging me or not, Islamic movement will continue in Bangladesh and in this country Islamic movement will be victorious InshaAllah.

৯ নভে, ২০১৯

উপমহাদেশের মুসলিমদের কাণ্ডারি জ্ঞানতাপস আল্লামা ইকবাল


ইসলামের কাণ্ডারি হিসেবে যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র মুসলিম জাতীয়তাবাদের কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড। মুসলিমদের একটি ভূখণ্ড দরকার এর প্রয়োজনীয়তা বুঝা ও রূপরেখা দাঁড় করানোর মতো জটিল ও সদূরপ্রসারী চিন্তা ও কাজ করেছেন আল্লামা ইকবাল। আল্লামা ইকবালের সেই চিন্তা আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। 

প্রখ্যাত এই মুসলিম মনীষী ও জ্ঞানতাপস যে সময়টাতে জন্মগ্রহণ করেছিল সে সময়টা ছিল মুসলিম মিল্লাতের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। পাক ভারত উপমহাদেশের রাজত্ব মুসলমানদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়ার পর মুসলিম সমাজ যখন অধঃপতনের শিকার হচ্ছিল ঠিক সেসময় আল্লামা ইকবাল অধঃপতিত এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোর দিশা দেখাতে কলম ধরেন। ইকবাল শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি মানবতার কবি তথা বিশ্বমানবের কবি ছিলেন। বাংলাদেশ তথাকথিত স্বাধীন হওয়ার পর মহান কবি আল্লামা ইকবালকে অন্ধকারে পাঠিয়ে দেয়। যেসব স্থাপনার নাম আল্লামার নামে ছিলো তা সব পরিবর্তন করে ফেলা হয়। তার জীবনী ও কর্ম পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন : 
১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ নূর মুহাম্মদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা ইমাম বিবি ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী পরহেযগার মহিলা। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু ইকবাল সৈয়দ মীর হাসানের কাছে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণ হন এবং মেডেল বৃত্তি লাভ করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৯৫ সালে ইন্টারমেডিয়েট পাস করে লাহোর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৭ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আরবিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি দর্শনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯০৫ সালে বৃত্তি লাভের পর লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৭ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯০৮ সালে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছরে লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারী এবং আরবিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার জন্যে শিয়ালকোটের নাগরিক সমাজ তাঁকে বিশাল সংবর্ধনা দেন। পাঞ্জাব কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ১৯০৯ সালের মে মাসে তিনি লাহোর সরকারি কলেজে দর্শনের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৩৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনিই একমাত্র প্রথম ভারতীয় ব্যক্তি যাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। শিক্ষকতা ও আইন ব্যবসা ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। সর্বোপরি তিনি একজন বিখ্যাত মানবতার কবি ছিলেন। 

রাজনীতিতে ভূমিকা : 
আল্লামা ইকবাল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পুরোপুরি পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু ১৯২৬ এর পরবর্তী সময়ে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনে এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। কবি আল্লামা ইকবালের অনেক পরিচয়, সবগুলো পরিচয়ে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। ইসলামের একজন দায়ী হিসেবে লিখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম করেছেন। মুসলিম উম্মাকে উজ্জীবিত করার জন্য আসরারে খুদি বা খুদির দর্শন জাতিকে উপহার দিয়েছেন। ইকবালের রাজনৈতিক দর্শন মানুষ খেয়াল না করলেও উপমহাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে তাঁর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে ইকবালের অবদান খুবই প্রণিধানযোগ্য। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মূল প্রতিষ্ঠান ছিল। ইকবাল তদানীন্তন মুসলিম লীগে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সাধ্যমতো কাজ করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম লীগ ভারতীয় রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভারতের রাজনৈতিক বিবর্তনে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি ইসলামের ভাবধারা ও চেতনার সাথে আধুনিক জাতীয়তার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তাঁর অপরিসীম ত্যাগ ও কোরবানীর স্বীকৃতি দিতে গিয়ে মরহুম কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি সেই বিরল মনীষার অন্তর্গত যার মনন ও বুদ্ধিবৃত্তি উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ইসলামী আবাসভূমির রূপরেখা বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু সেকুলার গণতন্ত্রকে পছন্দ করতে না। ইসলামভিত্তিক গণতন্ত্রকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলে মনে করতেন; যেখানে আইন হবে মহান আরশের মালিকের আর শাসন হবে মানুষের। 

১৯০৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে ইকবালের ভূমিকা স্বল্পকালীন হলেও বিভিন্ন দিক দিয়ে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য ভক্ত ও অনুরাগীরা পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কিন্তু তাঁর পুরনো বন্ধু মিয়া আব্দুল আজিজের সাথে নির্বাচনী যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯২৬ সালে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন এবং লাহোরের জনগণের সমর্থন ও ঐকান্তিক সহযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী খান বাহাদুর মালিক মোহাম্মদ দীনকে তিন হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ১৯২৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ভূমি রাজস্বের উপর আয়কর উসুল করার প্রস্তাবের উপর পাঞ্জাব আইন সভায় ভাষণ দেন। ১৯২৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত All Party Muslim Conference-এ ভাষণে মুসলমানদের স্বতন্ত্র কার্যক্রম গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ম্যালকম হেইলি স্যার ফজলে হোসেনের মাধ্যমে ইকবালকে হাইকোর্টের বিচারপতি বানানোর প্রস্তাব পাঠানো হলে ইকবাল তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৫ জুলাই ১৯২৭ সালে আল্লামা ইকবাল পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। 

এক. নবী করিম (সাঃ) কে অবমাননার পথ রুদ্ধ করার জন্য আইন জারি করার দাবি উত্থাপন করেন। 
দুই. পাঞ্জাবে মদ পান বন্ধের জন্য আইন প্রণয়নের দাবি করেন। 
তিন. একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে বলেন, আমি ভারত ও ইসলাম দুয়েরই বৃহত্তর স্বার্থে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করি।

ইসলামী আন্দোলনে ভূমিকা : 
ইকবাল তাঁর লেখনীতে মুসলমানদের গৌরবময় যুগের কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এমন একটা সময় তো ছিল যখন মুসলমানেরা সংখ্যায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার বাণীকে বহন করিবার জন্য তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করিতে প্রস্তুত ছিল। হককে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে তারা জীবনের রক্তটুকু বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। ইকবাল আফসোস করে বলেছিলেন,আধুনিক কালে মুসলমানেরা এই মিল্লাতের ঐক্যকে নিঃশেষ করেছে এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আকাংখাকে হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে মুসলমানদের উপর বাতিল পন্থীদের জুলুমের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তিনি মুসলিম বিশ্বকে একই সুতায় গাঁথার জন্য আমৃত্যু একজন কলম যোদ্ধা হিসেবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ইকবালের প্রত্যাশা ছিল ইসলাম একদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই। মহান আরশের মালিক যেন কালেমার পতাকে বিশ্বব্যাপী উড্ডীন করেন। আল্লামা ইকবাল একটি নিরেট ইসলামী আদর্শ বহনকারী রাজনৈতিক দলের স্বপ্ন দেখতেন। এজন্য তিনি মাওলানা মওদুদীর চিন্তাগুলোকে খুব এপ্রিশিয়েট করতেন। মাওলানা মওদুদীর চিন্তা তাঁকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। কবি ইকবাল জামায়াতে ইসলামী গঠনে মাওলান মওদূদীকে বহু সহযোগিতা করেন। তার সহযোগিতায়ই মাওলানা মওদুদী দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠন করতে সক্ষম হন। তবে জামায়াত গঠনের আগেই কবি ইন্তেকাল করেন। 

ইকবালের রচনাবলী : 
কবি আল্লামা ইকবাল গদ্য-পদ্য উভয় রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। তিনি ছিলেন মুক্তছন্দ কবি ও লেখক। তিনি লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। অর্থনীতির মত জটিল বিষয় থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতার মতো বিমূর্ত বিষয় পর্যন্ত উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। গ্রন্থ রচনা ছাড়াও তিনি বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন। ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও পন্ডিতদের সাথে আজীবন চিঠিপত্র বিনিময় করেছেন তিনি। আল্লামা ইকবাল তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রচনা করেন মাত্র ২৪টি কবিতা। তাও এর অধিকাংশই তার বন্ধু “মাখজান” সম্পাদক আব্দুল কাদিরের অনুরোধে। কবি-জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ইকবাল উপর উর্দু কবি “দাগ”-এর প্রভাব ছিল প্রবল। পরবর্তীতে “কবি গালিব” ও “কবি হালী”-এর প্রভাবে গতানুগতিকা ছেড়ে তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ নতুন খাতে প্রবাহিত হয়। 

আল্লামা ইকবাল সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে লাহোরে “আঞ্জুমানে হিমায়াতে ইসলাম”-এর বার্ষিক সভায় জনসম্মুখে কবিতা পাঠ করেন। কবিতার শিরোনাম ছিল “নালায়ে ইয়াতিম” (অনাথের আর্তনাদ)। ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে একই সংগঠনের বার্ষিক সভায় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী খন্ডকাব্য “শিকওয়া” পাঠ করেন। এর প্রভাবে আল্লামা ইকবালের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এরই প্রেক্ষিতে অনেক দেওবন্দি আলেম তাকে কাফের ঘোষণা করে। এরপর তিনি রচনা করেন আরেকটি যুগান্তকারী খন্ডকাব্য “জাওয়াবে শিকওয়া”। এর মাধ্যমে কাফের ঘোষণাকারীরা তাদের ভুল বুঝতে পারে। এরপর একে রচনা করতে থাকেন অসংখ্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমেই পাওয়া যায় তার চিন্তা-ধারার প্রকৃত পরিচয়। তার রচিত গ্রন্থাবলী হচ্ছে-

(১) ইলমুল ইকতিসাদ
অর্থনীতির উপর লেখা উর্দুভাষার প্রথম পুস্তক। তিনি এটি লাহোর সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক থাকাকালীন সময়ে রচনা করেন।

(২) তারিখ-ই-হিন্দ
এটি ইতিহাস বিষয়ক বই। এর একটি সংস্করণ অমৃতসর থেকে প্রকাশিত হয়।

(৩) আসরার-ই-খুদী
আল্লামা ইকবালের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে এই “আসরার-ই-খুদী”। এটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বই প্রকাশের পর সাড়া পড়ে যায় সর্বত্র। কিন্তু সূফী তরীকার অনুসারীরা এই পুস্তক প্রকাশকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে গ্রহণ করেননি। কেননা ইকবাল এই গ্রন্থে সূফী কবি হাফিজ শিরাজীর তীব্র সমালোচনা করে ৩৫টি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তেজনা এতই চরম আকার ধারণ করেছিল যে, ইকবালের চিন্তাধারার সমালোচনা করে খান বাহাদুর পীরজাদা মোজাফফর আহমদ ‘ফজলে রাজ-ই-বেখুদী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেন। ইকবাল পরবর্তী সংস্করনে উল্লেখিত ৩৫টি কবিতা বাদ দিয়ে দেন। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ আর,এ, নিকলসন ১৯২০ সালে এর ইংরেজী তরজমা করেন প্রকাশ করেন।

(৪) রমুযে বেখূদী
প্রকৃতপক্ষে আসরার-ই-খূদীরই ক্রম সম্প্রসারিত এই সংকলনটি ১৯১৮ সালে রমুযে বেখুদী নামে প্রকাশিত হয়। আর্থার জন আর্বারী এটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন।

(৫) পায়াম-ই-মাশারিক
এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩। এ সময়ে ইকবাল কবি হিসেবে অর্জন করেছেন সর্বজন স্বীকৃতি। তাঁর কবিতা এগিয়ে চলেছে পূর্ণ-পরিনতির দিকে। তিনি এ কাব্যে পাশ্চাত্য দর্শনের পাশাপাশি প্রাচ্যের কোরআনী চিন্তার ফসলকেও তুলে এনেছেন। এই কাব্যাটি গ্যাটের চিন্তাধারার অনুসরণে রচনা করেন। এতে মোট আশিটি কবিতা সংকলিত হয়েছে।

(৬) বাঙ্গ-ই-দারা
ইকবালের কবি জীবনের শুরু উর্দু কবিতার হাত ধরে। আর এই কাব্যটি উর্দু কবিতা সংকলন। উর্দুতেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক এবং জনচিত্তে আগুন ধরানো কবিতাসমূহ। ১৯২৪ সালে তিনি বাঙ্গ-ই-দারা নামে এ সকল উর্দু কবিতার সংকলনটি প্রকাশ করেন। এ কাব্যের কবিতাগুলো দেশাত্ববোধক, প্রকৃতি প্রীতি ও ইসলামী অনুভূতি এই তিনটি অংশে বিভক্ত।

(৭) যবুর-ই-আযম
ইকবালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফার্সী কবিতা সংকলন যবুর-ই-আযম। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। এর দুটি অংশের প্রথম অংশে ক্ষুদ্র কবিতা ও গীত এবং দ্বিতীয় অংশের নাম গুলশান-ই-রাজ-ই-জাদীদ। এখানে ইকবাল তার বিশিষ্ট দার্শনিক ভঙ্গিতে বর্তমান পৃথিবীর সমস্যাবলীর বর্ণনা ও সমাধান উল্লেখ করেন। 

ইকবালের মৃত্যু : 
১৯৩৪ সালের জানুয়ারী মাসে তার গলায় এক অজানা রোগ হয়। লাহোর ও দিল্লীতে এ রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। তার শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে ১৯৩৪ সালে আইন ব্যবসা বন্ধ করে দেন। কয়েক বছর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কাটানোর পর ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল ভোরে চতুর্দিকে যখন মসজিদের মিনার হতে ফজরের আযান হচ্ছিল ঠিক সে সময় তিনি মহান প্রভুর ডাকে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কয়েকদফা জানাযার পর লাখো ভক্ত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে রাত পৌনে দশটার দিকে লাহোর দুর্গ ও বাদশাহী মসজিদের প্রবেশদ্বারের মাঝখানে হাজুরিবাগে তাকে কবর দেয়া হয়।

৫ নভে, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-২১ : ইংরেজ বেনিয়াদের লুটপাট ও বাঙালি মুসলিমদের দুর্দশা



১৫৯৯ সালে কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ী মাত্র ৩০ হাজার পাউন্ডের ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তৎকালীন মুদ্রামান অনুযায়ী, তা ২৫ হাজার ভারতীয় রুপির চেয়েও কম ছিল। এর পরের বছর রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভারতের সাথে তারা বাণিজ্য শুরু করে। ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে তৎকালীন ভারতের প্রধান সমুদ্র বন্দর সুরাটে (ভারতীয় রাজ্য গুজরাটের একটি শহর) বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তারা। সুরাটে তখন আরও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের একেকজনের মূলধন পুরো ইংরেজ কোম্পানীর চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি ছিল। 

ইংরেজদের দৈন্যদশা দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং তাদের মোটেও গুরুত্ববহ মনে করতেন না। এই গুরুত্বহীন, করুণার পাত্র, নামমাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজরা একসময় পুরো উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পুরো ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে ইংরেজরা। তারা প্রলুব্ধ হয়েছিল শুধুমাত্র এদেশের সম্পদ দ্বারা। আর তাই সুদীর্ঘকালের শাসনামলে ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে যায় তারা।

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী মঞ্জুর করার পর এ অঞ্চলের উপরে তাদের আইনগত অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলার যে চিত্র ফুটে উঠে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর প্রভৃতি নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়স্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে।

পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে রাজকোষ ও রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠিত হয়, সরকার দেউলিয়া হয়ে পড়ে। হিন্দু জমিদার ও চাকলাদারদের অর্থে তখন সরকার পরিচালিত হতো। গদি লাভের জন্য ইংরেজদের দাবি অনুযায়ী ঘুষ সংগ্রহ করার জন্য মীর জাফর ও মীর কাসিম রাজস্ব বাড়িয়ে দেন। নবাবের এসব রাজস্ব বৃদ্ধির অজুহাতে জমিদাররা প্রান্তিক মুসলিম প্রজা ও রায়তদের উপর বহুগুণে খাজনা বাড়িয়ে দেয়। সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের দেয়া সম্পত্তি ও ভাতা বাজেয়াপ্ত হয়। দেশব্যাপী শুরু হয় অরাজকতা। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে দেখা দেয় অস্থিতিশীল অবস্থা। একইসাথে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য বিদেশি বণিকদের বাংলাছাড়া করে ইংরেজরা রেশম, মসলিন, সুতি কাপড়, চিনি, চাল, আফিম, সল্টপিটার প্রভৃতি পণ্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বাজার কুক্ষিগত করে এরা এসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক রকম নামিয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রন্তিক চাষী, তাঁতী ও জেলেরা। 

ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো –সুপরিকল্পিত শোষণের হৃদয়বিদারক ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয়েছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। 

ইংরেজদের লুণ্ঠন সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেন, “নবাবের সিংহাসন নিয়ে চক্রান্ত করে, জমিদারী বন্দোবস্ত ও রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ব্যক্তিগত ও অবৈধ বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করে এবং আরও নানা উপায়ে উৎকোচ-উপঢৌকন নিয়ে চার্ণক, হেজেস, ক্লাইভ, হেষ্টিংস, কর্নওয়ালিসৈর আমলের কোম্পানির কর্মচারীরা যে কি পরিমাণ বিত্ত সঞ্চায় করেছিলেন তা কল্পনা করা যায় না। …. দেখতে দেখতে প্রচুর অর্থ ও নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কোম্পানি সাহেবরা সত্যি সত্যি নবাব বনে গেলেন। তাদের মেজাজ ও চালচলন সবই দিন দিন নবাবের মতো হয়ে উঠতে লাগল”। (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৫)

মুর্শিদাবাদের কোষাগার থেকে নিয়ে গেলো পনের লক্ষ পাউন্ডের সমমানের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমাণিক্যসহ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেলো চার লক্ষ পাউন্ড। সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড। কাউন্সিল মেম্বররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড। আর খোদ ক্লাইভ পেলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড। 

অবশ্য পলাশী বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় ‘তিনি এতো সংযম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য’। মীর কাসিম দিয়েছেন নগদ দু’লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্যে। মীর জাফর নন্দন নাজিমউদ্দৌলা দিয়েছেন এক লক্ষ উনচল্লিশ হাজার পাউন্ড। এছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। ইংরেজ গবেষক জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে বাইশ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে। এ থেকেই অনুমেয়, কোম্পানীর কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন। তারা এ দেশে কোম্পানী রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর হোমে প্রত্যাগত হয়ে এরূপ রাজসিক হালে বাস করতেন যে, তাঁরা ‘ইন্ডিয়ান নেবাবস’ রূপে আখ্যাত হতেন।

…ক্লাইভ নিজেই স্বীকার করেছেন, “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক সম্পদাহরণের পাশবিক চিত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি”। অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণ যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদুদ, পৃঃ ৬০-৬২)।

পলাশী যুদ্ধের পর টাকার অবমূল্যায়ন ও পাউন্ডের অধিমূল্যায়ন করা হয়। মুর্শিদ কুলি খাঁর চাইতে মীর জাফরের সময় বত্রিশগুণ বেশি কর ও খাজনা আদায় করা হয়। জমিদাররা এক কোটি ত্রিশ লাখ পাউন্ড খাজনা আদায় করে কোম্পানিকে দেয় আটত্রিশ লাখ পাউন্ড। অতিরিক্ত রাজস্ব ও খাজনার চাপে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে উৎপাদক গোষ্ঠী। খাজনা আদায়ের ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্য ইংরেজরা পরগনা নিলামে চড়াতে শুরু করে। নব্য হিন্দু কোটিপতিরা ইজারা দিয়ে বিঘাপ্রতি দু’টাকা বারো আনা খাজনা ধার্য করে। আলীবর্দি খানের সময় এই খাজনা ছিল মাত্র আট আনা। এভাবে ১৬৬০ পরগনার মধ্যে ১০০০ পরগনা হিন্দুদের হাতে দেয়া হয়। 

অত্যাচার-নিপীড়ন আর আর্থিক মন্দার কারণে চাষীরা এমনিই চাষ ছেড়ে দিয়েছিল, এর মধ্যে অনাবৃষ্টি আর খরায় ফসল এসেছিল কমে। এছাড়া খাদ্যশস্য উৎপাদনের ভূমিতে জোর করে অত্যধিক লাভজনক ব্যবসাপণ্য আফিম ও নীল চাষ করানোর কারণেও অনেক জমি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। আফিম যেত চীন ও জাপানে, আর ইউরোপে সেই সময় শিল্প বিপ্লব ঘটায় তুঙ্গে ছিল নীলের চাহিদা। 

এমন অবস্থায় ১৭৭০ সালের মাঘ মাসে সারাদেশে ধান কিনে গুদামজাত করা শুরু হলে জন্ম নেয় দুর্ভিক্ষ। বাংলা ১৭৭৬ সালের এ মহাদুর্ভিক্ষ ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। মানব ইতিহাসে এমন ভয়াবহ এবং পুরোপুরি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কথা আর জানা নেই। বিশ্বের অন্যতম শস্যভাণ্ডার খ্যাত জনপদটির এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। যারা বেঁচে থাকে, তাদের হাল হয় আরও খারাপ। কারণ এত বড় দুর্যোগেও ইংরেজরা কোনো সাহায্য না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, এমনকি খাজনা হ্রাসেরও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বাংলার ধনিক কৃষক সমাজ এ দুর্ভিক্ষের ফলে সর্বহারা, দুর্গত এক শ্রেণীতে পরিণত হয়। ধনী হিন্দুরা নৌকা বোঝাই করে দুর্ভিক্ষের অনাথ বালকদের কলকাতায় এনে জড়ো করতো। সেখান থেকে ইংরেজরা তাদের ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপে চালান করে দিতো।

ইংরেজ আমলে বাংলার মুসলিম সমাজের চিত্র ছিলো অত্যন্ত খারাপ। মুসলিমরা তিনটি অংশে অবস্থান করেছিলো। নবাব, সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত মুসলিম এবং সাধারণ শ্রেণি। পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার হয়ে পড়েছিলেন কোম্পানীর হাতের পুতুল। চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদেরকে একচেটিয়া অধিকার দেয়া হয়। উপরন্তু কোম্পানী ও তাদের সাদা-কালো কর্মচারীদেরকে মোটা উপঢৌকনাদি দিতে হতো। এই অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে নবাবরা সাধারণ মানুষের উপর চড়া কর ধার্য করতো। এই কারণে নবাবরা বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত আলেম ও শিক্ষাকেন্দ্রে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। 

সম্ভ্রান্ত মুসলিম হলেন তারা যারা বিজয়ীর বেশে অথবা দুঃসাহসী ভাগ্যন্বেষী হিসাবে বিভিন্ন সময়ে এ দেশে আগমন করেন। অতঃপর এ দেশেকে তাঁরা মনেপ্রাণে ভালোবেসে এটাকেই তাঁদের চিরদিনের আবাসভূমিরূপে গ্রহণ করেন। বিজয়ী হিসাবে স্বভাবতঃই তাঁরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার রাখতেন। হান্টার বলেন, একটি সম্ভান্ত মুসলমান পরিবার তিনটি প্রধান সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ করতো –সামরিক বিভাগের নেতৃত্ব ও চাকুরি, রাজস্ব আদায় এবং বিচার বিভাগ ও প্রশাসন ক্ষেত্রে চাকুরি।

এই তিনটি চাকুরির সবগুলোই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। লাখ লাখ পরিবার মুহুর্তেই দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই পেশাগুলোতে হিন্দুদের নিয়োগ বাধ্যতামূলক ছিলো। মুসলিম নবাবরাও হিন্দুদের সেনাবাহিনীতে ও রাজস্ব আদায়ে নিয়োগ দিতে বাধ্য ছিলেন। আবহমান কাল থেকে বাংলার মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। সেসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইংরেজ সরকার। একইসাথে সকল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, মক্তব, খানকাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। যারা গোপনে শিক্ষা-দীক্ষার কাজ চালাতেন তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে ইংরেজরা। ইংরেজ আমলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত মুসলিমরা। 

সাধারণ মুসলিমরা তিনটি পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতো। কৃষক, তাঁতী এবং জেলে। তাদের উপরে যে জুলুম নাজিল হয়েছে তা হলো চড়া খাজনা। ইংরেজদের কোষাগার সমৃদ্ধ করার জন্য তাদের উতপাদিত প্রায় সকল সম্পদই জমা দিতে হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ এভাবেই ডেকে এনেছে বর্বর ইংরেজ গোষ্ঠী। শোষণ-নিষ্পেষণের মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হলো এই যে, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ বাংলার লোক মরেছে তিনভাগের একভাগ, চরম অবনতি ঘটেছে চাষবাসের। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস হিসাব কষে ও কড়া চাপে নির্ধারিত রাজস্বেরও বেশী টাকা আদায় করেছেন, অথচ মুমূর্ষু কৃষকদের দুঃখ মোচনের জন্যে কানাকড়িও খরচ করেননি। বরঞ্চ বাখরগঞ্জ জেলার ৩৩,৯১৩ মণ চাউল বিক্রয় ক’রে ৬৭,৫৯৩ টাকা মুনাফা লুটেছে। ঢাকার ৪০,০০০ মণ চাউল বাঁকীপুরের সেনানিবাসে গুদামজাত করেছে। 

এমন অমানবিক ও বর্বর শাসন দুনিয়ার ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। মাত্র ১৩ বছরের শাসনে পৃথিবীর তৎকালীন সমৃদ্ধ একটি জনপদ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যেভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, তা নেহাত শাসকশ্রেণির লুটপাটের মানসিকতা ও খামখেয়ালীর ফল। যারা সেই সময়টায় জীবিত ছিল, শুধু তারাই জানে আসলেই কতটা ভয়ানক ছিল সেই নারকীয় অভিজ্ঞতা। এই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের পথ ধরেই একসময় ভারতবাসীর মনে দানা বাঁধে স্বাধিকারের সাধ, আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন।