২৬ জানু, ২০২০

নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই, এক রশিতে ফাঁসী চাই


আমাদের দেশে নতুন এক ট্রেন্ড চালু হয়েছে। শেখ হাসিনা খারাপ হলেও জয় বাংলা ভালো, মুজিবতো অসাধারণ ভালো। মুজিবের মতো নেতাই হয় না। আগের আওয়ামীলীগ ভালো। এখনকার আওয়ামীলীগ খারাপ। কথিত স্বাধীনতার পর দেশে সোনালী যুগ নেমে আসছে। কোটা আন্দোলনের ছাত্রদেরও দেখেছি বলতে "মুজিবের বাংলায় বৈষম্য চলতে পারে না"। আজ আপনাদের মুজিবের একটি ঘটনা বলবো, যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার 'বঙ্গবন্ধু' ও 'জাতির পিতা' উপাধি প্রত্যাহার করা হয়েছে। একজন সন্ত্রাসী এবং স্বৈরাচার কখনোই জাতির সম্মানিত ব্যক্তি হতে পারে না।

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি, নববর্ষে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে নিহত হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদিরুল ইসলাম। আহত হন অনেক ছাত্র-ছাত্রী, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৪ বছরের স্কুলছাত্র পরাগ।

আজ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যিনি সভাপতি, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, তিনি ১৯৭৩ সালে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ‘ডাকসুর নির্বাচিত সহ-সভাপতি। সেদিন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ভিয়েতনামে মার্কিন হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকায় মার্কিন তথ্যকেন্দ্র’র সামনে বিক্ষোভ জানাতে গিয়েছিলেন।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ যেমনটি করছে আফগানিস্তানে কিংবা যেমনটি করেছে লিবিয়াতে ও ইরাকে, তেমনি ভিয়েতনামে চার দশক আগে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল নাপাম বোমার আঘাতে। লাখ-লাখ ভিয়েতনামী নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র আক্রমণে।

সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন কিশোর পরাগ। সেখান থেকে মিছিলের সঙ্গে গিয়েছিলেন বর্তমান ঢাকা প্রেসক্লাবের বিপরীতে অবস্থিত তকালীন ‘যুক্তরাষ্ট্র তথ্য কেন্দ্র’র সামনে। বাংলাদেশে বিক্ষোভের জবাবে মিলবে বুলেট-বৃষ্টি তাও বিক্ষোভ মার্কিনীদের বিপক্ষে এটা ধারণাই করতে পারেনি তৎকালীন ঢাবি ছাত্ররা।

শেখ মুজিবের মার্কিনীদের প্রতি টান ছিলো অন্যরকম। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের মার্কিন-সহযোগী অংশের নেতা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান। আর মার্কিন-বিরোধী ছিলেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৭ সালে মার্কিন চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বাক্ষর করা না-করা নিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরে চুক্তি-বিরোধীদের শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা করেননি। নির্মমভাবে পিটিয়েছিলেন পাক-মার্কিন চুক্তি-বিরোধী বামপন্থী আওয়ামী লীগ কর্মীদের। 

কাগমারি সম্মেলনে ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, ‘শহীদ, তুমি আজ আমাকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সমর্থন করতে বলছো। তুমি যদি আমাকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো, আমি বলবো, না। তুমি যদি আমাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো- আমি বলবো ‘না’! ‘না’! তুমি আমাকে যদি আমার কবরে গিয়েও জিজ্ঞাস করো সেখান থেকে আমি চিৎকার করে বলবো, ‘না’! ‘না’! ‘না’!

কোনো ব্যক্তিই তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর উত্তরসূরি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আদর্শিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো প্রয়োজন ছিল, ভিয়েতনাম প্রশ্নে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে পাকিস্তান আমলেও দাঁড়িয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ আমলেও দাঁড়াবেন। কারণ, তিনি সমর্থক ছিলেন সেই সিয়েটো চুক্তির, যে চুক্তিতে ভিয়েতনামকে রক্ষার নামে আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সিয়েটো চুক্তির উল্লেখ করেই ভিয়েতনামে মার্কিন অভিযানের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১৯৫৭ সালে নেতা হয়ে নিজদলের কর্মীদের মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করেননি, সেই তিনি ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্টদের মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করবেন, এটি হতেই পারে না। 

১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে নিহত হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদিরুল ইসলাম। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন অনেক ছাত্র-ছাত্রী।

ঢাবির ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নেতার উপর পুলিশের আক্রমণ দেখে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকেন। যে-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তাঁদের শান্তিপ্রিয়তার জন্য প্রায়শঃ ‘হারমোনিয়াম পার্টি’বলে উপহাসিত হয়ে থাকেন, সেই সংগঠনের কর্মীদের হটিয়ে দেবার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গুলিবর্ষণের হুকুম দিলো। প্রায় আধাঘন্টা টানা গুলিবর্ষণ হলো।

ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলিবর্ষণ করে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি তার পুরনো অবস্থান পরিবর্তন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সেই মার্কিন-আস্থা লাভ করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে গুলিতে নিহত দুইজনের লাশ সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘোষণা পাঠ করেন।

‘‘এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আজ সেই 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে তার বঙ্গবন্ধু বিশেষণ ব্যবহার করবেন না। 

একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা শেখ মুজিবকে 'জাতির পিতা' আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না। শেখ মুজিবুর রহমানকে একদিন ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হলো।’’ 
(৩ জানুয়ারী ১৯৭৩, দৈনিক সংবাদ)

সভাশেষে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মম গুলির শিকার মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদেরের লাশ নিয়ে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে শহরের প্রধান রাজপথগুলো প্রদক্ষিণ করে বায়তুল মোকাররমে এসে সমাপ্ত হয়। সেদিন বিক্ষোভ মিছিলে উচ্চারিত শ্লোগানগুলো হচ্ছে—

‘নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই,—এক রশিতে ফাঁসি চাই,’
'খুনিশাহী মুজিবশাহী, ধ্বংস হোক,ধ্বংস হোক'
'বাংলার মীরজাফর, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব' 

২৪ জানু, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৭ : রংপুরের নূরুলদীনের কৃষক বিদ্রোহ


রংপুরের বিখ্যাত 'জাগো বাহে, কুন্ঠে সবাই' স্লোগানের সাথে সারাদেশে সবাই পরিচিত। এই ডাক দিয়ে কৃষকদের জাগাতে চেয়েছেন রংপুরের এক প্রতিবাদী কৃষক নেতা নূর উদ্দিন। আঞ্চলিক ভাষায় তার পরিবর্তিত নাম নূরুলদীন। রংপুরের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নূরলদীন মাটির নবাব হিসেবে পরিচিত হয়েছেন কৃষকদের কাছে।  

পলাশীতে বিপর্যয়ের পর বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল একটি হাহাকারময় সময়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসন ও লুটপাটের ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সৃষ্ট ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ কোটি মানুষ মারা গেছে না খেয়ে। ইংরেজ শাসন ভারতের কৃষি-সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। রাজস্ব আদায় আগে হতো গ্রাম-সমাজ থেকে, কোনো ব্যক্তির নিকট নয়। ইংরেজ বেনিয়ারাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রচলন করাসহ রাজস্ব হিসাবে ফসলের বদলে মুদ্রাপ্রথা প্রচলন করে। তারা মোগল যুগের জমিদার বা রাজস্ব আদায়কারী গোমস্তাদের সরিয়ে প্রভাবশালী হিন্দুদের জমির মালিক বলে ঘোষণা করে। এরা কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছামতো খাজনা ও কর আদায় করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ইংরেজদের দিতো।

খেয়াল-খুশীমতো রাজস্ব আদায়ের ফলে বাংলা ও বিহারের রাজস্ব মোগলযুগের শেষ সময়ের রাজস্ব অপেক্ষা দ্বিগুণ হয়। ১৭৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্ব আদায় হয় এক কোটি ২৩ লাখ টাকা, ১৭৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দে যা বেড়ে হয় দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। ভূমি রাজস্ব, কর্মচারীদের উৎকোচগ্রহণ ও ব্যক্তিগত ব্যবসায় যে মুনাফা পেতো, তার পরিমাণও ছিল অবিশ্বাস্য। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল লুণ্ঠন। বাংলা ও বিহারের জনসাধারণের টাকায় নামমাত্র মূল্যে এ দেশের পণ্য ক্রয় করে ইউরোপের বাজারে অধিক মূল্যে বিক্রয় করা হতো। কার্ল মার্কস, রেজিনাল্ড রেনল্ডসের মতো লেখকরা এই ব্যবসাকে বলেছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’।

ইংরেজদের শাসন ও শোষণের মাত্রা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ফলে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ও বিহারে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছায়া। যার নিষ্ঠুর থাবায় অসংখ্য মানুষ নির্মম মৃত্যুর শিকার হন। ইংরেজ সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ ১৭৭৬ সালে মহাদুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে চাষিরা ক্ষুধার জ্বালায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কোথাও কোথাও জীবিত মানুষ মৃত মানুষের মাংস খেয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। নদীর তীর মৃত ও মুমূর্ষু মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হয়। মারা যাওয়ার আগেই মুমূর্ষু মানুষকে শিয়াল-কুকুরে খাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কোম্পানির অবস্থা তখন খুবই রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি  প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করে একজন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। দেবী সিংহ মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন সূদুর পানিপথ থেকে। মুর্শিদাবাদে এসে ডাকাতির মাধ্যমে প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। একারণে ছিলেন ব্রিটিশদের সুনজরে। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করার পর তার কঠোরতায় প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল। এরপর তিনি লাভ করেন পূর্ণিয়ার শাসন ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা। এখানেও তার অত্যাচার আর নিপীড়নে কৃষকরা একরকম বনে-জঙ্গলে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে হেস্টিংস নিজেই তাকে পদচ্যুত করেন। কিন্তু দেবীসিংহ ছিলেন খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। প্রচুর অর্থ উপঢৌকনের বিনিমেয়ে হেস্টিংসকে বাগে আনেন সহজেই। এবার তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদের প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ডের সহকারী কার্যাধক্ষ্যের পদে। এখানেও তিনি  প্রজাদের উপর নিপীড়ন অব্যাহত রাখেন। একসময় প্রচুর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। হেস্টিংস বাধ্য হন সেই রেভিনিউ বোর্ড ভেঙে দিতে।

নিখিলনাথ রায় তার মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে দেবী সিংহের অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন, “যদি কেহ অত্যাচারের বিভীষিকাময় মূর্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানবপ্রকৃতির মধ্যে শয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে একবার দেবী সিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন। দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। কত কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জ্জন  দিয়াছে। কত কত জমীদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে।...দেবী সিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমলহৃদয়া মহিলা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়েন। শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় লয়!"

নির্যাতন, নিপীড়ন আর অন্তহীন লুণ্ঠনে তখন সর্বশ্রান্ত উত্তরবঙ্গের কৃষককূল। প্রাণ যখন একেবারেই ওষ্ঠাগত, তখন এ মৃত্যুপুরী থেকে মুক্তির  স্বপ্ন তাদের এগিয়ে নিলো একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের দিকে। নিজের মাটি, ইজ্জত ও অস্তিত্ব রক্ষায় তারা ঘুরে দাঁড়ালেন একটি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। আর তখনই আবির্ভাব একজন নূরলদীনের। নূরলদীন একজন মানুষ ছিলেন । একজন কৃষক ছিলেন। একজন মহৎপ্রাণ কৃষক, যার নেতৃত্বে হাজারো কৃষক বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বিদ্রোহী হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। এর বেশি ইতিহাসে নূরলদীনের আর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। 

নূরুলদীন এক ঘোষণাপত্রে দেবী সিংহকে কর না দেওয়ার আদেশ দেন। বিদ্রোহের ব্যয় পরিচালনার জন্য ‘ডিংখরচা’ নামে চাঁদা আদায় করেন। এভাবে রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহারসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব কৃষক নূরুলউদ্দিনের নেতৃত্বে দেবী সিংহের বর্বর শোষণ-উৎপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণ ও এই অঞ্চল থেকে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রস্তুত হন।

১৭৮২ সালের শেষদিক থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের কণ্ঠ সোচ্চার হতে থাকে। যা দ্রুতই এগিয়ে যায় বিদ্রোহের দিকে। কাজিরহাট, কাকিনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলা অঞ্চলে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করলে কুচবিহার ও দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকরাও এই বিদ্রোহে শামিল হন। কৃষকগণ নূরলদীনকে তাদের 'নবাব' হিসেবে ঘোষণা দেন। দয়াশীল নামে আরেকজনকে নিযুক্ত করা হয় তার দেওয়ান হিসেবে। নবাব নূরলদীন কৃষকদের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর করে তোলেন। কৃষকরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নূরলদীনকে স্বতঃফূর্তভাবে সহায়তা করতে থাকেন। প্রথমদিকে নূরলদীন ও উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। তারা ভেবেছিলেন, ইংরেজ সরকার হয়েতো দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এ লক্ষ্যে তারা কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিবরণ তাদের সই সহ গুডল্যান্ডের নিকট পাঠান। এবং ব্যবস্থা নিতে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু গুডল্যান্ড নিজেই দেবী সিংহের সুবিধাভোগী ছিলেন। দেবী সিংহের লুটের টাকার বড় অংশ আসতো তার পকেটে। কাজেই তিনি এদিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। 

১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কৃষকেরা রংপুর থেকে দেবী সিংহের কর সংগ্রহকারীদের বিতাড়িত করে। টেপা, ফতেপুর ও বাকলায় বিদ্রোহ ভীষণ আকার ধারণ করে। টেপা জমিদারির নায়েব বিদ্রোহে বাধা দিতে এসে নিহত হন। কাকিনা, কাজিরহাট, ডিমলা এলাকায়ও একইরকম ঘটনা ঘটে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরীও বিদ্রোহী কৃষকদের বাধা দিতে এসে নিহত হন। বিদ্রোহীদের সাফল্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে দিনাজপুর, কুচবিহারের কৃষকেরাও ‘নবাব’ নূরুলদীনের বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে।

বিদ্রোহ যখন চরমে, তখন রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাড দেবী সিংহকে রক্ষায় ও কৃষকদের ন্যায্য দাবি পর্যুদস্ত করার জন্য কয়েক দল সিপাহি পাঠান, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড। লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড অবশ্য নূরলদীনের সাথে সম্মুখ সমরের দিকে গেলেন না। তিনি আশ্রয় নিলেন কূটকৌশলের। ছদ্মবেশ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে কৌশলে রাতের আধাঁরে ঘিরে ফেললেন বিদ্রোহীদের ঘাঁটি পাটগ্রাম। দিনটি ১৭৮৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি। অতি ভোরে ঘুমন্ত মুক্তিকামী কৃষকদের উপর ভারি অস্ত্রসহ হামলে পড়লেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড ও তার বাহিনী।

বিদ্রোহ দমনে ইংরেজরা বর্বরের ভূমিকায় অংশ নেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং মানুষ দেখামাত্রই পশুর মতো গুলি করে। বিদ্রোহের নায়ক ‘নবাব’ নূরুলদীন গুরুতর আহত হয়ে শত্রুদের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়াশীল নিহত হন। কিছুদিন পর নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে ‘নবাব’ নূরুলদীন মারা যান।

যুদ্ধে পরাজয় ও নূরলদীনের মৃত্যু কৃষকদের হতোদ্যম করলেও লড়াই থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। শহীদ নবাব নূরলদীনের আদেশকে মান্য করে তারা বন্ধ করে দেয় সকল প্রকার খাজনা প্রদান। প্রচুর টাকা খাজনা বাকি পড়লে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়ে। ঘটনা তদন্তে আসেন পিটারসন নামক ইংরেজ সেনা অফিসার। তিনি অবশ্য রেভিনিউ কমিটির কাছে নির্মোহভাবে কৃষকদের উপর নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। অতঃপর দেবী সিংহকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর কালেক্টর গুডল্যান্ডকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়।

২৩ জানু, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৬ : সন্দ্বীপে কৃষকদের তিন-তিনটি বিদ্রোহ


বঙ্গোপসাগরে তৎকালীন নোয়াখালীর অন্তর্গত সন্দ্বীপের মানুষ সবসময় স্বাধীনচেতা ছিলো। ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপ নোয়াখালী থেকে আলাদা হয় এবং চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়। 'সন্দ্বীপ বিদ্রোহ' হলো ১৭৬৭ সাল থেকে ১৮১৯ পর্যন্ত ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ওখানকার মানুষদের তিনটি বিদ্রোহ। তাদের বিদ্রোহের কারণ জানতে হলে একটু পেছন থেকে শুরু করা দরকার। তাদের স্বাধীন শাসক ছিলেন দেলওয়ার খাঁ যিনি দিলাল রাজা নামে বহুল পরিচিত। মুঘল আমলে শায়েস্তা খান যখন বাংলার সুবাদার হন তখন তিনি পর্তুগীজ দস্যুদের ও মগ দস্যুদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। আগের সুবাদাররা এই কাজে সুবিধে করতে পারেন নি কারণ তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিলো না। শায়েস্তা খান তার ছেলে বুজুর্গ উমেদ খাঁ-কে চট্টগ্রাম অধিকার করা ও দস্যুদের লুন্ঠন থেকে বাঁচানোর আদেশ করলেন।

উমেদ খাঁ নোয়াখালীতে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের চিন্তা করলেন। এজন্য তার নৌ-সেনাপতি আবুল হাসানকে এই কাজের দায়িত্ব দিলেন। তিনি নোয়াখালীর সন্দ্বীপে ঘাঁটি স্থাপনের চিন্তা করলেন। তাকে বাধা দেন দেলওয়ার খাঁ। মোগল সেনাপতি আবুল হাসান তাঁকে সপরিবারে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে যান। এই ঘটনাটি ঘটে ১৬৬৫ সালে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁ আবদুল করিম খাঁ নামক এক ব্যক্তিকে সন্দ্বীপের মোগল ফৌজদার নিযুক্ত হন। তখনকার দিনে ফৌজদারগণ বর্তমান সময়ের ম্যজিস্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালন করতেন। অবশ্য শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে তাঁদের অধীনে কিছু সৈন্য থাকতো। যেমন, সন্দ্বীপে ফৌজদারের নিয়ন্ত্রণে ১০০ অশ্বারোহী ও ৪০০ পদাতিক সৈন্য ছিলো। রাজস্ব আদায় কার্যে সুবিধার জন্য সন্দ্বীপে মোহাম্মদ কাশেম নামক একজন সুদক্ষ ও সুচতুর লোককে আহাদদার নিযুক্ত করা হয়। ‘আহাদদার’ অর্থ সচিব।

দেলওয়ার খাঁ প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল স্বাধীন নৃপতি হিসাবে সন্দ্বীপ শাসন করেন। বহিরাগত মোগল বাহিনীর হাতে তাঁর পরাজয় এবং সে সাথে দ্বীপটির স্বাধীন মর্যাদা বিলুপ্ত হওয়ায় স্বভাবতই স্থানীয় অধিবাসীরা বিক্ষুব্ধ ছিলো। কিন্তু মুঘল প্রশাসনের বিশেষ করে শায়েস্তা খানের সুশাসনে পরিস্থিতি মুঘলদের অনুকূলে চলে আসে। প্রথমত সেখানে ট্যাক্স ধার্য করা হয় দেলওয়ার খাঁর আমলের প্রায় অর্ধেক। দ্বিতীয়ত দেলওয়ার খাঁর আত্মীয় ও প্রভাবশালীদের ইজারা দেয়া হয়। এতে তারা সম্মান ও আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অল্প সময়ে সন্দ্বীপ মুঘলদের পূর্ণ আনুগত্য করতে থাকে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দিলাল জামাতা চাঁদ খাঁ'র কাছে সন্দ্বীপ ইজারা বন্দোবস্ত দেয়া হয়। চাঁদ খাঁ ইজারা বন্দোবস্ত নেয়ার পর বুঝতে পারেন যে, একা তাঁর পক্ষে সুবিস্তীর্ণ সন্দ্বীপ পরগণার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে না। উপর্যুক্ত বিবেচনা থেকেই তিনি তাঁর দু’আত্মীয় বক্তার মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ হানিফ এবং তখনকার কানুনগো দপ্তরের কর্মচারী বাকলা (চন্দ্রদ্বীপ) নিবাসী মধুসুদনকে বিভিন্ন অংশ ইজারা বন্দোবস্ত দেন। এটা ছিলো অনেকটা সাব-কন্ট্রাক্ট-এর মতো। বলাবাহুল্য, এই ইজারাদারগণই পরবর্তীকালে সন্দ্বীপের জমিদার হন।

১৬৯০ থেকে ১৭৩০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চাঁদ খাঁ’র দু’পুত্র জুনুদ খাঁ ও মুকিম খাঁ, মোহাম্মদ হানিফের পুত্র মোহাম্মদ মুকিম এবং মধুসুদনের পুত্র জনার্দন সন্দ্বীপের জমিদার ছিলেন। জুনুদ খাঁ ও মুকিম খাঁ ছিলেন অর্ধেকের বেশি জমিদারির মালিক। সে কারণে সন্দ্বীপের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ওদের হাতেই ছিলো বলে ধরে নেয়া যায়। আনুমানিক ১৭৩০ সাল থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত সন্দ্বীপের প্রভাবশালী জমিদারদের মধ্যে জুনুদ খাঁ ছেলে মোহাম্মদ রাজা, মুকিম খাঁ’র ছেলে মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ মুকিমের ছেলে বাখর মোহাম্মদ ও জাফর মোহাম্মদ এবং জনার্দনের ছেলে রামচন্দ্রের নাম উল্লেখযোগ্য। বাখর মোহাম্মদের নামানুসারে তাঁর জমিদারি বাখরপুর জমিদারি নামে পরিচিত ছিলো। মুকিম খাঁর ছেলে জমিদার মোহাম্মদ হোসেন মারা যান ১৭৪৩ সালে। তার থেকে জমিদারি পান তার ছেলে আবু তোরাব।

আবু তোরাব, মোহাম্মদ মুরাদ, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মোহাম্মদ ওয়াছিম, মোহাম্মদ আকবর, সূর্য নারায়ণ প্রমুখ ১৭৪৩ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে সন্দ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ওদের মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন আবু তোরাব। আনুমানিক ১৭৫০ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দাপটের সাথে সন্দ্বীপে জমিদারি পরিচালনা করেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলেস্ট নবাব মীর কাসেম খানের আদেশ বলে ১৭৬১ সালে চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ভেরেলেস্ট-এর প্রধান কার্যালয়ের কেরানী ছিলেন খিদিরপুরের ঘোষাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল ঘোষাল নামক একজন ধূর্ত ক্ষমতালোলুপ ব্যক্তি। তারই পরামর্শে ভেরেলেস্ট সন্দ্বীপকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন করেন। সন্দ্বীপের জমিদারদের সেই সক্ষমতা ছিলো না ইংরেজদের ঠেকাবে।

মুঘল নিয়মানুসারে শেষ ওয়াদাদার ওজাকুর মলকে অগ্রাহ্য করে ১৭৬৩ সালে ভেরেলেস্ট গোকুল ঘোষালকে বেনামীতে সন্দ্বীপের ওয়াদাদার নিযুক্ত করেন। তাঁর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী বিষ্ণুচরণ বসুর নামে ওয়াদাদারী নেন। কাজেই কাগজে কলমে এই বিষ্ণুচরণ ছিলেন সন্দ্বীপে বৃটিশ আমলের প্রথম ওয়াদাদার। তখন নায়েবে ওয়াদাদার নিযুক্ত হয়েছিলেন রাম কিশোর বাডুজেজ। বলাবাহুল্য, তখনকার প্রতাপশালী জমিদার আবু তোরাব চৌধুরী গোকুল ঘোষালের মতো ক্ষমতালোলুপ লোককে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেননি। নায়েবে ওয়াদাদার রাম কিশোর বাডুজ্জের সন্দ্বীপে আগমনের সাথে সাথেই আবু তোরাব প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।

গোকুল ঘোষাল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে আহাদদার হিসাবে রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্য সন্দ্বীপ আগমন করেন ১৭৬৩-৬৪ সালে। তার সাথে আবু তোরাবের বিরোধ চরমে পৌঁছে ১৭৬৭ সালে। জমিদার আবু তোরাব ইংরেজ ওয়াদদাদারের কাজে রাজস্ব জমা দেয়া থেকে পুরাপুরি বিরত থাকেন। তাছাড়া, গোকুল ঘোষালের প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বিতাড়ণের জন্য আবু তোরাব তাঁর সেনাপতি মালকামকে নির্দেশ প্রদান করেন।

অতঃপর মীর জাফরের জামাতা নবাব মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে নবাবের অনুগত একদল সৈন্য এসে তোরাব আলীর মুখোমুখি হয়। কিন্তু প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কিছুদিনের মধ্যে ওয়াদাদারের লোকজন সন্দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স এবং আরো কয়েকজন সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পার হয়ে সন্দ্বীপে পৌঁছায়। ১৭৬৭ সালের মধ্যভাগে সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চার আনি হাটের অদূরবর্তী কিল্লাবাড়িতে আবু তোরাব বাহিনীর সাথে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স-এর বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আবু তোরাব পরাজিত ও নিহত হন। আবু তোরাব চৌধুরী জমিদার হলেও সুশাসনের কারণে কৃষক প্রজারা তাঁকে ভালবাসতেন। এ করণে উপরিউক্ত যুদ্ধে সন্দ্বীপের কৃষকগণ আবু তোরাব চৌধুরীর পক্ষাবলম্বন করেন। ইতিহাসে এটি সন্দ্বীপের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ বলেও খ্যাত হয়।

আবু তোরাবের পতনের পরে সন্দ্বীপের অন্যান্য জমিদারগণ ইংরেজদের আনুগত্য মেনে নেন। জমিদারদের তাঁদের জমিদারি ফিরিয়ে দেয়া হয়। এদিকে গোকুল ঘোষাল আবু তোরাবের জমিদারি জনৈক ভবানীচরণ দাসের নামে বন্দোবস্ত করে নেন। গোকুল ঘোষাল সন্দ্বীপের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। জমিদারদের সাময়িকভাবে জমিদারি ফিরিয়ে দেয়া হলেও গোকুল ঘোষাল আবার তা কেড়ে নেয়। এরপর থেকে তিনি সন্দ্বীপের অধিবাসীদের ওপর অত্যাচার উৎপীড়ন শুরু করেন। কৃষকেরা তার বিরুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নালিশ করে। কিন্তু সেই কথা শোনার ইচ্ছে নেই ইংরেজ লুটেরাদের।

এদিকে সকল প্রকার আবেদন নিবেদন ব্যর্থ হলে সন্দ্বীপের কৃষকেরা বেপরোয়া হয়ে গোকুল ঘোষাল এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। প্রথমে তারা খাজনা প্রদান বন্ধ করে বিদ্রোহের সংকেত প্রদান করে। এদিকে গোকুল ঘোষাল ও সহজে দমবার পাত্র নন। জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের জন্য তিনি কৃষকদের ঘরে ঘরে পেয়াদা ও পুলিশ পাঠাতে শুরু করেন। তারা জবরদস্তিমূলকভাবে খাজনা আদায়- অন্যথায় প্রজাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকে। পরিণামে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। কৃষকগণ সম্মিলিত হয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে শুরু করে। ১৭৬৯ সালে এ নিয়ে সন্দ্বীপে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং এমনকি ব্যাপক সংঘর্ষ লেগে যায়। অসন্তুষ্ট, হৃতসর্বস্ব জমিদারগণ কৃষকদের পক্ষাবলম্বন করেন। অবশেষে গোকুলের আবেদন ক্রমে সে বছরের শেষের দিকে ইংরেজ সৈন্যদল সন্দ্বীপে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। এটি সন্দ্বীপের দ্বিতীয় বিদ্রোহ।

ইংরেজ শাসকেরা সন্দ্বীপের প্রজা বিদ্রোহ, কৃষক অসন্তোষ দমনে অত্যাচারী গোকুল ঘোষালের পক্ষাবলম্বন করলেও তারা বুঝতে পারে যে, একটা কিছু পরিবর্তন না আনলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টকর হবে। এমতাবস্থায় ১৭৭২-৭২ সালে সন্দ্বীপে ওয়াদাদারের পদ বিলুপ্ত করে একজন আমিন (ম্যাজিসট্রেট) নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন সত্ত্বেও কার্যতঃ গোকুল ঘোষালই সন্দ্বীপে কর্তৃত্ব করতে থাকেন। অবশেষে জমিদারগণ কোম্পানীর নিকট গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে বাধ্য হন। তারই ফলে ঢাকায় প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ ১৭৭৮ সালে ডানকান নামক একজন ইংরেজকে প্রকৃত পরিস্থিতি জানার জন্য সন্দ্বীপ পাঠায়। ১৭৮৩ সালে তাঁর হস্তক্ষেপে কোরেশা বানু এবং আরও দু’ একজন জমিদার তাঁদের জমিদারি ফিরে পান। কিন্তু আবু তোরাব চৌধুরীর জমিদারি তাঁর ছেলে আলী রাজাকে না দিয়ে ভবানী চরণ দাসের নামে গোকুল ঘোষাল অধিকার করেন।

এদিকে গোকুল ঘোষাল, ভবানীচরণ দাস প্রমুখ জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের স্থানীয় জমিদার, তালুকদার এবং কৃষকদের সংগ্রাম দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একই প্রেক্ষাপটে ১৮১৯ সালে সন্দ্বীপে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, স্বনামে বেনামে জমিদারির মালিকানা, দুর্নীতি, লুণ্ঠন দীর্ঘদিনের আহাদাদারি, লবণের ইজারা ইত্যাদি খাত থেকে গোকুল ঘোষাল বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন। সন্দ্বীপ থেকে উপার্জিত, লুণ্ঠিত সে সম্পদের দ্বারা কোলকাতার খিদিরপুরের ভুর্কেলাসের রাজপ্রাসাদের ঘোষাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গোকুল ঘোষালের নাম সন্দ্বীপের লোকেরা এখনো ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। ১৮১৯ সালের বিদ্রোহও দমন করে ইংরেজরা। তবে তারা এরপর গোকুলকে সরিয়ে দেয়। এই তিন বিদ্রোহে শত শত মুসলিম কৃষক শাহদাতবরণ করেন।

উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয় ও আমাদের করণীয়


আসুন আমরা কিছু সময়ের জন্য ফিরে যাই আল্লাহর রাসূল (সা) এর যুগে উহুদ যুদ্ধের সময়কালে। দিনটি ছিলো ৬২৫ সালের ১১ মার্চ। আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে ৩০০০ সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন মদিনা আক্রমণে। এই বাহিনীর সাথে ৩,০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার ১৫জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। কুরাইশ নেতাদের ধারণা ছিল যে নারীরা সাথে থাকলে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য বেশি আমরণ লড়াইয়ের উদ্দীপনা তৈরী হবে। তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে উহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে শিবির স্থাপন করে।

যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অনেকে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধের জন্য গ্রহণীয় পদক্ষেপ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় রাসূল (সা) নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন,
'আল্লাহর শপথ আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মে‌র মধ্যে ঢুকিয়েছি'। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন যে কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ালের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মে‌র অর্থ মদিনা শহর।

পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত আসে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও মুহাম্মাদ (সা) সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ছুড়তে পারত। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু বিজ্ঞ সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।

আলোচনার পর মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০জন বর্ম পরিহিত ছিল এবং ৫০জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মাদ (সা) মুসলিম বাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করেন। এগুলি হল, মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।

প্রায় ১,০০০ মুসলিমের বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। তারা শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর ইতিপূর্বে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানানো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। এর ফলে ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা উহুদের দিকে যাত্রা করে। এতে মুসলিম সেনাদলের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকের মনোবল ভেঙে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ তাঁর তিন হাজার ফেরেশতা নামিয়ে দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয়?

শুরুর দিকে মুসলিমরা এগিয়ে থাকলেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়োজিত তীরন্দাজদের ভুলে মুসলিম সেনাবাহিনী উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো। রাসূল (সা) মৃত্যুবরণ করেছেন, এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। এই খবর উহুদ ময়দান থেকে মদিনায়ও ছড়িয়ে গেলো।

এমন খবরে উহুদ ময়দান ও মদিনায় মানুষের মধ্যে তিনটি শ্রেণি তৈরি হলো।
১- মুনাফিক : এরা আল্লাহর রাসূল (সা)কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করলো। আল্লাহ ও ফেরেশতা নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। মুমিনদের তিরস্কার করতে লাগলো।

২- ব্যাধিগ্রস্থ মুমিন : এরা হতাশা প্রকাশ করতে থাকলো। বলতে লাগলো, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ঠিক ছিলো। রাসূলের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। তারা এও বলেছিলো মুহাম্মদ (সা) আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ আল্লাহ চাইলে ফেরেশতা পাঠিয়ে আমাদের বিজয় দিতে পারতো। তারা আল্লাহর রাসূলের নবুয়্যত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

৩- মুমিন : এই শ্রেণি আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। এদের মধ্যে যারা আল্লাহর রাসূলের কাছাকাছি ছিলো তারা মানববর্ম তৈরি করে রাসূল (সা)কে তীরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলো। যারা দূরে ছিলো তারা চিৎকার করে বললো আমি কেন মারা গেলাম না? আজ আমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব? তারা আল্লাহর রাসূলের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আবারো ঘুরে দাঁড়ালেন।

অবশেষে জানা গেলো আল্লাহর রাসূল (সা) শাহদাতবরণ করেননি। তিনি একটু সুস্থ হওয়ার পর মক্কার বাহিনীর পিছু ধাওয়া করার জন্য সেনাবাহিনীকে আবার একত্রিত করেন এবং প্রায় ৬০০ সৈন্যের সেনাবাহিনীকে পাঠান মক্কার বাহিনীকে ধাওয়া করার জন্য।

যাই হোক, উহুদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণে আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদি ও মুনাফিকদের স্পর্ধা ও দুঃসাহস বেড়ে গিয়েছিল। তাদের মনে আশা জেগেছিল, তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে। উহুদের পরে প্রথম বছরে যেসব ঘটনা ঘটে তা থেকেই তাদের এ ক্রমবর্ধমান স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য আন্দাজ করা যেতে পারে।

উহুদ যুদ্ধের পরে দু’মাসও অতিক্রান্ত হয়নি এমন সময় দেখা গেল যে, নজ‌দের বনী আসাদ গোত্র মদীনার ওপর আক্রমন করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু সালামার নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। সেখানেও মুসলিমদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে বনী আসাদ পালিয়ে যায়।

তারপর ৪ হিজরীর সফর মাসে আদাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় তাদের এলাকায় গিয়ে লোকদেরকে দীন ইসলামের শিক্ষা দেবার জন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন লোক চায়। নবী (সা) ছ’জন সাহাবীকে তাদের সংগে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাজী’ (জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে) নামক স্থানে পৌঁছে তারা হুযাইল গোত্রের কাফেরদেরকে এ নিরস্ত্র ইসলাম প্রচারকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তাঁদের মধ্য থেকে চারজনকে তারা হত্যা করে এবং দু’জনকে (হজরত খুবাইব ইবনে আদী ও হযরত যায়েদ ইবনে দাসিন্নাহ) নিয়ে মক্কায় শত্রুদের হাতে বিক্রি করে দেয়।

তারপর সেই সফর মাসেই আমের গোত্রের এক সরদারের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা) আরো একটি প্রচার দল পাঠান। এ দলে ছিলেন চল্লিশ জন (অথবা অন্য উক্তি মতে ৭০ জন) আনসারি যুবক। তাঁরা নজদের দিকে রওনা হন। কিন্তু তাদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। বনী সুলাইমের ‘উসাইয়া, বি’ল ও যাক্‌ওয়ান গোত্রত্রয় বি’রে মা’ঊনাহ নামক স্থানে অকস্মাত তাদেরকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে ফেলে।

এ সময় মদীনার বনী নাযীর ইহুদি গোত্রটি সাহসি হয়ে ওঠে এবং একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভংগ করতে থাকে। এমনকি চার হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তারা স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করে দেয়ার ষরযন্ত্র করে। তারপর ৪ হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে বনী গাত্‌ফানের দু’টি গোত্র বনু সা’লাবাহ ও বনু মাহারিব মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি চালায়। তাদের গতিরোধ করার জন্য স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই তাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। এভাবে উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মুসলমানদের ভাব মূর্তি ও প্রতাপে যে ধস নামে, ক্রমাগত সাত আট মাস ধরে তার আত্মপ্রকাশ হতে থাকে।

এই সময়েও সেই তিন শ্রেণি সক্রিয় থাকে মদিনায়
১- মুনাফিক : এরা মদিনা ধ্বংস করার ব্যাপারে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে। বিভিন্ন ইহুদী গোত্রকে মুহাম্মদ (সা) এর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য মন্ত্রনা দেয়। মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ও তাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। মুমিনদের তিরস্কার ও আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে কটূক্তি করতে থাকে।

২- ব্যাধিগ্রস্থ মুমিন : এরা হতাশা প্রকাশ করতে থাকে। আল্লাহর রাসূলের প্রতিটি কথাকে অবিশ্বাস করতে থাকে। নিজেদের সম্পদ পরিবার রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা মুহাম্মদকে প্রতারক পর্যন্ত বলেছে। আল্লাহর রাসূলের প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করতে থাকে। ৬ জন ও ৭০ জন দায়ি শাহদাতবরণের ঘটনায় তাঁকে অবিবেচক আখ্যা দেয়। তারা এও বলেছে, “আমাদের সাথে অংগীকার করা হয়েছিল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য জয় করা হবে কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে আমরা পেসাব পায়খানা করার জন্যও বের হতে পারছি না।”

৩- মুমিন : এরা সর্বাবস্থায় ইসলামের জন্য নিজেদের উতসর্গ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। আল্লাহর রাসূল (সা)কে অনুসরণ করেছিলো। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলো। বিপদে, মুশরিকদের আক্রমণে অবিচল থেকেছে ও সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছে। মুনাফিকদের তিরস্কার এবং ব্যাধিগ্রস্থ মুমিনদের আচরণে ধৈর্যধারণ করেছে।

উহুদের পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে অর্থাৎ উম্মাহর মধ্যে বার বার আসবে। আল্লাহ তায়ালা দেখতে চান কে সত্যিকারের ঈমানদার। আজ আমাদের বিবেচনার বিষয় আমি কোন শ্রেণিতে পড়েছি। আমার অবস্থান কোথায়? আমি কি ঈমানদারদের কাতারে আছি? এখন আত্মসমালোচনা করার সময়। ঈমানদার হিসেবে আমাদের উচিত ধৈর্যধারণ করা এবং হকের উপদেশ দেয়া। তাগুতের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকা ও নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকা। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাদের সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে রাখুন। আমাদের হিদায়াতের পথে রাখুন।

১৬ জানু, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৫ : মুশরিকদের বিরুদ্ধে মাওলানা তিতুমীরের জিহাদ


শহীদ মাওলানা তিতুমীরের পত্রবাহক আমিনুল্লাহর শাহদাতের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক জিহাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। অথচ মাওলানা তিতুমীর চেয়েছিলেন এই জিহাদ আরো কিছু সময় পরে শুরু করতে। কারণ বাংলার মুসলিমরা দীর্ঘদিনের নাসারা ও মুশরিকদের আগ্রাসনের কবলে পড়ে দূর্বল ঈমানদার হয়ে পড়েছিলো। অনেক শিরক ও বিদআত তাদের কর্ম, চিন্তা ও আচরণে পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। তাই মাওলানা তিতুমীর চেয়েছিলেন আগে মুসলিমদের আকিদা ঠিক করতে। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনে তিনি জিহাদে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন।  

কোলকাতায় জমিদারদের ষড়যন্ত্র সভা
তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের দমন করার উদ্দেশ্যে কোলকাতায় লাট বাবুর বাড়িতে এক সভায় হাজির হলেন, লাটু বাবু (কোলকাতা), গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়, গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নূরনগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদারের সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পুঁড়ার কৃষ্ণদেব রায়, বশীরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী, যদুর আটির দুর্গাচরণ চক্রবর্তী ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ।

সভায় সবাই একমত হলো যে, যেহেতু তিতুমীরকে দমন করতে না পারলে হিন্দুজাতির পতন অনিবার্য, সেজন্যে যে কোন প্রকারেই হোক তাদে শায়েস্তা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সকল জমিদারগণ সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবেন। ইংরেজ নীলকরদেরও সাহায্য গ্রহণ করা হবে বলে স্থির হলো। তাদেরকে বুঝানো হবে যে, তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম শুরু করেছেন। হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে এ কথা প্রচার করতে হবে যে তিতু গো-মাংস গুঁজে দিয়ে জাতি নাশ করেছেন। বশীরহাটের দারোগা চক্রবর্তীকে এ ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্য করার অনুরোধ জানানো হলো। কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যয় দারোগাকে বললেন, আপনি ব্রাহ্মণ, আমরাও ব্রাহ্মণ। তাছাড়া আপনি আমাদের আত্মীয়। আমাদের এ বিপদে আপনাকে সব দিক দিয়ে সাহায্য করতে হবে। দারোগা বললো, আমি আমার প্রাণ দিয়েও সাহায্য করব এবং তিতুমীরকে রাজদ্রোহী প্রমাণ করব।

কোলকাতার ষড়যন্ত্র সভার পর সরফরাজপুরের লোকদের নিকট থেকে দাড়ি-গোঁফের খাজনা এবং আরবী নামকরণের খারিজানা ফিস আদায়ের জন্যে কৃষ্ণদেব রায় লোক পাঠালো। কিন্তু তারা খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানালে জমিদারের কর্মচারী ফিরে এসে জমিদারকে এ বিষয়ে অবহিত করে। অতঃপর তিতুমীরকে ধরে আনার জন্যে বারোজন সশস্ত্র বরকন্দাজ পাঠানো হয়। কিন্তু তারা ধরে আনতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মাওলানা তিতুমীরের অনুসারীদের দ্বারা তাড়া খেয়েছে। 
অতঃপর কৃষ্ণদেব নিম্নের ব্যক্তিগণকে পরামর্শের জন্যে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেঃ
১। অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যয়কে গোবরডাঙায়,
২। খড়েশ্বর মুখোপাধ্যয়কে গোবরা-গোবিন্দপুরে,
৩। লাল বিহারী চট্টোপাধ্যয়কে সেরপুর নীলকুঠির মিঃ বেজামিনের কাছে,
৪। বনমালী মুখোপাধ্যয়কে হুগলী নীলকুঠিতে,
৫। লোকনাথ চক্রবর্তীকে বশীরহাট থানায়।
উল্লেখযোগ্য যে, লোকনাথ চক্রবর্তী বশীলহাটের দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি।

অতঃপর বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষ্ণদেবের সাহায্যার্থে সহস্রাধিক লাঠিয়াল, সড়কীওয়ালা ও ঢাল-তলোয়ারধারী বীর যোদ্ধা কৃষ্ণদেবের বাড়ি পুঁড়ায় পৌঁছে গেল। পরদিন শুক্রবার সরফরাজপুরে তিতুমীর ও তাঁর লোকজনদেরকে আক্রমণ করার আদেশ হলো। শুক্রবার সর্বাগ্রে ঘোড়ায় করে কৃষ্ণদেব রায় এবং তার পিছনে সশস্ত্র বাহিনী যখন সরফরাজপুর পৌঁছে, তখন জুমার খুৎবা শেষে মুসল্লীগণ নামাজে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণদেবের সৈন্যরা বিভিন্ন মুসলিম বিরোধী ধ্বনি সহকারে মসজিদ ঘিরে ফেলে আগুন লাগিয়ে দিল। অল্প বিস্তর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তিতুমীর এবং মুসল্লীগণ মসজিদের বাইরে এলে তাদেরকে আক্রমণ করা হলো। দু’জন বল্লমবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো এবং বহু আহত হলো।

অতঃপর মুসলমানগণ কলিঙ্গার পুলিশ ফাঁড়িতে কৃষ্ণদেব রায় ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে খুনজখম মারপিট প্রভৃতির মামলা দায়ের করলো। পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ইজাহার গ্রহণ করলো বটে। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হয়েই লাশ দাফন করার নির্দেশ দিল। J.R. Colvin-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, জমিদারের কর্মচারীগণ সরফরাজপুরে দাড়ি-গোঁফ ইত্যাদির খাজনা আদায় করতে গেলে তাদেরকে মারপিট করা হয় এবং একজনকে আটক করা হয়। তারপর কৃষ্ণদেব রায় সশস্ত্র বাহিনীসহ তাদেরকে আক্রমণ করে এবং মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়। (Board’s Collection 54222, p 405-6, Colvin’s Report-para 9, Dr. AR Mallick: British Policy & the Muslims in Bengal, p. 79)।

এই ঘটনার আঠারো দিন পর কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই বলে মামলা দায়ের করে যে, তারা তার লোকজনকে মারপিট করেছে এবং তাকে ফাঁসাবার জন্যে তারা নিজেরাই মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। (Bengal Criminal Judicial Consultations, 3 April 1832, No.6)। কৃষ্ণদেব রায় তার ইজাহারে আরও অভিযোগ করে যে, ‘নীলচাষদ্রোহী জমিদারদ্রোহী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীদ্রোহী তিতুমীর নামক ভীষণ প্রকৃতির এক ওহাবী মুসলমান এবং তার সহস্রাধিক শিষ্য পুঁড়ার জমিদার শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়ের দু’জন বরকন্দাজ ও একজন গোমস্তাকে অন্যায় ও বেআইনীভাবে কয়েদ করিয়া গুম করিয়াছে। বহু অনুসন্ধানেও আমরা তাহাদের পাইতেছিনা। আমাদের উক্ত পাইক ও গোমস্তা সরফরাজপুর মহলের প্রজাদের নিকট খাজান আদায়ের জন্য মহলে গিয়াছিল। খাজনার টাকা লেনদেন ও ওয়াশীল সম্বন্ধে প্রজাদের সহিত বচসা হওয়ায় তিতুমীরের হুকুম মতে তাহার দলের লোকেরা আমাদের গোমস্তা পাইকদিগকে জবরদস্তি করিয়া কোথায় কয়েদ করিয়াছে তাহা জানা যাইতেছে না। তিতুমীর দম্ভভরে প্রচার করিতেছে যে, সে এদেশের রাজা। সুতরাং খাজনা আর জমিদারকে দিতে হইবেনা’। (শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৬০)।

মামলার প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে কলিঙ্গা ফাঁড়ির জামাদার। তার রিপোর্টে বলা হয় যে, উভয় পক্ষের অভিযোগ অত্যন্ত সংগীন। সে আরও বলে, আমি মুসলমানদের অভিযোগের বহু আলামত দেখেছি। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নায়েব তিতুমীর ও তার দলের বিরুদ্ধে যে মোকাদ্দমা দায়ের করেছে সে সম্পর্কে তদন্ত করে জানা গেল যে, যেসব কর্মচারীর অপহরণের অভিযোগ করা হয়েছে তারা সকলেই নায়েবের সঙ্গেই আছে। নায়েবের জবাব এই যে, সে মফঃস্বলে যাওয়ার পর তিতুর লোকেরা তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার মতে এ জটিল মামলা দুটির তদন্ত ও ফাইনাল রিপোর্টের ভার বশীরহাটের অভিজ্ঞ দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর উপর অর্পণ করা হোক। ওদিকে বারসতের জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট কৃষ্ণদেব রায়কে কোর্টে তলব করে জামিন দেন এবং রামরাম চক্রবর্তীকে তদন্ত করে চূড়ান্ত রিপোর্টটি দেয়ার আদেশ দেন।

রামরাম চক্রবর্তী তদন্তের নাম করে সরফরাজপুর আগমন করে তিতুমীর ও গ্রামবাসীকে অকথ্যভাষায় গালাগালি ও মারপিট করে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ীতে কয়েকদিন জামাই আদরে কাটিয়ে যে রিপোর্ট দেয় তা নিম্নরূপঃ-
১। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের গোমস্তা ও পাইকারদেরকে তিতু ও তার লোকেরা বেআইনীভাবে কয়েদ করে রেখেছিল। পরে তারা কৌশলে পলায়ন করে আত্মগোপন করেছিল। পুলিশের আগমনের পর তারা আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং এ মামলা অচল ও বরখাস্তের যোগ্য।
২। তিতুমীর ও তার লাঠিয়ালেরা জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ও তার পাইক বরকন্দাজদের বিরুদ্ধে খুনজখম, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।
৩। তিতু ও তার লোকেরা নিজেরাই নামাজঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতএব এ মামলা চলতে পারে না।

ব্রিটিশদের আইন অনুসারেই অবৈধ খাজনা আদায়ের বিষয়টি হাকিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি যা ছিল সংঘর্ষের মূল কারণ। তার ফলে জমিদার শুধু মামলায় জয়লাভই করেনি, বরঞ্চ তার অবৈধ খাজনা আদায়ের কাজকে বৈধ করে দেয়া হলো। বিভাগীয় কমিশনার বলেন, জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট যে রায় দিলেন তার মধ্যে একদিকে জমিদারদের অবৈধ ও উৎপীড়নমূলক খাজনা বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিলনা, অপরদিকে প্রতিপক্ষের উত্তেজনাকর মনোভাব লাঘব করারও কিছু ছিল না। (Bengal Criminal Judicial Consultations, 3 April 1832, No.3; Commissioner to Deputy Secretary; 28 Nov. 1831. para 3)।

ম্যাজিস্ট্রেটের এ অবিচারমূলক রায়ের ফলে জমিদার প্রতারণামূলক ও উৎপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সাহসী হলো। ১৭৯৯ সালের ৭ নং রেগুলেশন অনুযায়ী বকেয়া খাজনার নাম করে প্রজাদেরকে ধরে এতে আটক করার ক্ষমতা লাভ করলো। এমনকি যারা জমিদারের প্রজা নয় অথচ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে তাদেরকে মিছিমিছি ৩৮ টাকা বকেয়া দেখিয়ে ধরে এনে আটক করা হলো এবং তাদেরকে নানাভাবে শারীরিক শাস্তি দেয়া হলো। অতঃপর বকেয়ার একাংশ আদায় করে বাকী অংশ দিবার প্রতিশ্রুতিতে তাদের কাছে মুচলেকা রিখে নেয়া হলো যাতে করে কোর্টের আশ্রয় নিতে না পারে। (Board’s Collection, 54222, Enclosure No 4, the Colvin’s Report; Also in Bengal Criminal Judicial Consultations, 3 April 1832 No.6)।

সরফরাজপুর গ্রামের মসজিদ ধ্বংস হলো, বহু লোক হতাহত হলো, হাবিবুল্লাহ, হাফিজুল্লাহ, গোলাম নবী, রমজান আলী ও রহমান বখশের বাড়িঘর ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হলো, বহু ধনসম্পদ ভস্মিভূত ও লুন্ঠিত হলো, কিন্তু ইংরেজ সরকার তার কোনই প্রতিকার করলো না। সরফরাজপুর গ্রামবাসীর এবং বিশেষ করে মাওলানা তিতুমীরের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল বলে সকলের পরামর্শে তিনি উপরোক্ত পাঁচজন গৃহহারাসহ সরফরাজপুর থেকে ১৭ই অক্টোবরে নারকেলবাড়িয়া গ্রামে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্থানাস্তরিত হলেন। সেখান থেকেই মাওলানা তিতুমীর তার প্রতিরোধ জিহাদের ঘোষণা দেন। ২৯ শে অক্টোবর ১৮৩১ সালে কৃষ্ণদেব রায় সহস্রাধিক লাঠিয়াল ও বিভিন্ন অস্ত্রধারী গুন্ডাবাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া গ্রাম আক্রমণ করে বহু নর-নারীকে মারমিট ও জখম করে। ৩০শে অক্টোবর পুলিশ ফাঁড়িতে ইজাহার হলো। কিন্তু কোনই ফল হলো না। কোন প্রকার তদন্তের জন্যেও পুলিশ এলো না।

জমিদার বাহিনীর আক্রমণে মুসলমানগণ দিশেহারা হয়ে পড়লো। তখন বাধ্য হয়ে তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হতে হলো। ৬ই নভেম্বর পুনরায় কৃষ্ণদেব রায় তার বাহিনীসহ মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং উভয়পক্ষে বহু লোক হতাহত হয়। এরপর কৃষ্ণদেব রায় চারদিকে হিন্দু সমাজে প্রচার করে দেয় যে, মুসলমানরা অকারণে হিন্দুদের উপরে নির্যাতন চালাচ্ছে। তার এ ধরনের প্রচারণায় হিন্দুদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মোল্লাআঁটি নীলকুঠির ম্যানেজার ডেভিসকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। ডেভিস প্রায় চার’শ হাবশী যোদ্ধা ও বিভিন্ন মারণাস্ত্রসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। এবারও উভয় পক্ষে বহু হতাহত হয়। ডেভিস পলায়ন করে। মুসলমানরা তার বজরা ধ্বংস করে দেয়। উক্ত ঘটনার কিছুদিন পরে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এক বিরাট বাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। প্রচন্ড যুদ্ধে দেবনাথ রায় বল্লমের আঘাতে নিহত হয়। 

উপরোক্ত ঘটনার পর চতুনার জমিদার মনোহর রায় পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট যে পত্র লিখেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেন, নীলচাষের মোহ আপনাদেরকে পেয়ে বসেছে। তার ফলেই আজ আমরা দেবনাথ রায়ের ন্যায় একজন বীর পুরুষকে হারালাম। এখনো সময় আছে। আর বাড়াবাড়ি না করে তিতুমীরকে তার কাজ করতে দিন আর আপনারা আপনাদের কাজ করুন। তিতুমীর তার ধর্ম প্রচার করছে, তাতে আপনারা জোট পাকিয়ে বাধা দিচ্ছেন কেন? নীলচাষের মোহে আপনারা ইংরেজ নীলকরদের সাথে এবং পাদ্রীদের সাথে একতাবদ্ধ হয় দেশবাসী ও কৃষক সম্প্রদায়ের যে সর্বনাশ করছেন তা তারা ভুলবে কি করে? আপনারা যদি এভাবে দেশবাসীর উপর গায়ে পড়ে অত্যাচার চালাতে থাকেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমি তিতুমীরের সাহায্যের জন্যে অগ্রসর হবো। আমি পুনরায় বলছি নীলচাষের জন্যে আপনারা দেশবাসীর অভিসম্পাত কুড়াবেন না।
-শ্রী মনোহর রায় ভূষণ (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দীকী পৃঃ ৭৯)।

১৮৩১ সালের ১৪ই নভেম্বর মিঃ আলেকজান্ডার একজন হাবিলদার, একজন জমাদার এবং পঞ্চাশজন বন্দুক ও তরবারিধারী সিপাহী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার তিনক্রোশ দূরে বাদুড়িয়া পৌছেন। বশিরহাটের দারোগা সিপাই-জমাদারসহ বাদুড়িয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। উভয়ের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল একশ’ বিশজন। অতঃপর যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় তাতে উভয়পক্ষের লোক হতাহত হয়, গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মুসলমানদের বীরত্ব দেখে আলেকজান্ডার বিস্মিত হন এবং দারোগা ও একজন জমাদার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। বেগতিক দেখে আলেকজান্ডার প্রাণরক্ষার্থে পলায়ন করেন। বন্দুক নিয়েও সে যাত্রায় জিততে পারেনি ব্রিটিশ এই ম্যাজিস্ট্রেট। উভয়ের পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষতক জান নিয়ে পালিয়ে যান আলেকজান্ডার। তিতুমীরের হাতে বন্দী হয় এক দারোগা ও জমাদ্দার। পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। 

জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার বারাসাত প্রত্যাবর্তন করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকটে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার আবেদন জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্ণেল স্টুয়ার্টকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করে তার অধীনে একশত ঘোড়-সওয়ার সৈন্য, তিনশত পদাতিক দেশীয় সৈন্য, দু’টি কামানসহ নারিকেলবাড়িয়ার অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। ১৯ নভেম্বর রাত্রে কোম্পানী সৈন্য নারিকেলবাড়িয়া পৌঁছে গ্রাম অবরোধ করে রাখলো।

শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মাওলানা তিতুমীর ও তাঁর লোকেরা মজবুত বাঁশের খুঁটি দিয়ে নারিকেলবাড়িয়া ঘিরে ফেলেছিলেন যা ইতিহাসে “তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা” বলে অভিহিত আছে। বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিতুমীর শাহাদত বরণ করেন। তাঁর মৃতদেহকে ইংরেজ সৈন্যরা অমানবিকভাবে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। তিতুমীর ও তাঁর শিষ্যদের বাড়ি-ঘর লুন্ঠন করে সেদিন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো। সেনাপতি গোলাম মাসুমকে সরকার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। তাছাড়া ১১ জনের যাবজ্জীবন এবং ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, ‘তিতুমীর তার অধিকৃত এলাকায় স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রজা আন্দোলন একটি গণবিপ্লব ছিলো। কৃষক ও তাঁতীরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদার ও নীকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। অত্যাচার, অবিচার ও অপমানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিতুমীরের নেতৃত্বে প্রজাগণ লড়াই করে আত্মসম্মান ও ন্যায় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলো।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে নারিকেলবেড়িয়ায় তিতুমীর শহীদ হয়েছেন। তবে মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, গোলাম মাসুম ও তাদের দলীয় লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে অথবা প্রতিপক্ষের কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত না করে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ধীরস্থির হয়ে যেভাবে শত্রুর মুকাবিলা করে শাহাদাতের অমৃত পান করেছেন তা একদিকে যেমন ইতিহাসের অক্ষয় কীর্তিরূপে চির বিরাজমান থাকবে, অপরদিকে অসত্য ও অন্যায় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রামের প্রেরণা ও চেতনা জাগ্রত রাখবে ভবিষ্যতের মানবগোষ্ঠীর জন্যে। ইতিহাস স্বীকার করতে বাধ্য যে, ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়ানো এবং উপমহাদেশে মুসলিমদের স্বাধীন ভূমি তিতুমীরদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। তিতুমীরেরা বাংলা ও ইসলামের জন্য এবং সর্বস্তরের মানুষের আত্মসম্মান-আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যুগে যুগে লড়াই করেছেন, রক্ত এবং প্রাণ দিয়েছেন। 

১৫ জানু, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৪ : বাংলার প্রথম প্রতিরোধ জিহাদের সূচনা হয় যেভাবে


মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) ১৮২১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ সফর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম মনীষীর সাথে সাক্ষাত এবং মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেশে ফিরে তিনি সাইয়েদ আহমদ শহীদের একজন খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় জিহাদ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের সমসাময়িককালে পরিচালিত তিতুমীরের আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি ছিল অভিন্ন।

মারাঠা-বর্গীদের দ্বারা লুণ্ঠিত পশ্চিমবাংলায় হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা নিষ্পেষিত জনগণ অথনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছিল। মুসলমানদের ওপর চেপে বসেছে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। তহবন্দ-এর পরিবর্তে ধুতি, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার, নামের আগে শ্রী ব্যবহার, মুসলমানী নাম রাখতে জমিদারের পূর্বনুমতি ও খারিজানা, হিন্দুদের পূজার জন্য পাঁঠা যোগানো ও চাঁদা দেওয়া, দাড়ির ওপর ট্যাক্স, মসজিদ তৈরি করলে নজরানা, গরু জবাই করলে ডান হাত কেটে নেওয়া প্রভৃতি জুলুম ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এই পটভূমেই জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত মাওলানা তিতুমীর কাজ শুরু করেন।

বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনগণকে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। ধর্মীয় আদেশ পূর্ণরূপে অনুসরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রেরণায় তিনি সকলকে উজ্জীবিত করেন। বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদসমূহ তিনি সংস্কারের ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রচলন করেন। তিনি পূজার চাঁদা দান বা তাতে অংশগ্রহণের মতো কাজ বন্ধ করেন। তিতুমীরের আন্দোলনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানগণ এবং বহু অমুসলমান কৃষক দ্রুত জোটবদ্ধ হলেন। তিতুমীরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক বিরাট ইসলামী জামাত। তিতুমীরের সংগ্রাম ছিল জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে। তাঁর স্লোগান ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। তাঁর বক্তব্য ছিল ‘প্রত্যেকের শ্রমের ফসল তাকে ভোগ করতে দিতে হবে’।

পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর এবং উনবিংশ শতকের পঞ্চম দশকের সমগ্র ভারতব্যাপী আযাদী সংগ্রামের (১৮৫৭) পঁচাত্তর বছর পূর্বে ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে সাইয়েন নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর (সাইয়েদ) হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ১)।
ইংরেজ ইতিহাস লেখকগণ অবজ্ঞাভরে এবং তিতুমীরকে ছোটো করে দেখাবার জন্যে তাঁকে এক অনুল্লেখযোগ্য কৃষক পরিবারের সন্তান বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রখ্যাত সাইয়েদ বংশে জন্মলাভ করেন। প্রাচীনকালে যে সকল ওলী-দরবেশ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করেন তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ শাহ হাসান রাজী ও সাইয়েদ শাহ জালাল রাজীর নাম পুরাতন দলীল দস্তাবেজে পাওয়া যায়। দুই সহোদর ভাই সাইয়েদ আব্বাস আলী ও সাইয়েদ শাহ শাহাদত আলী যথাক্রমে সাইয়েদ শাহ জালাল রাজী ও সাইয়েদ শাহ হাশমত আলীর ত্রিংশ অধস্তন পুরুষে জন্মগ্রহণ করেন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। (শহীদ তিতুমীর, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৩-৪)।

তৎকালীন মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তিতুমীরের বয়স যখন চার বছর, তখন তাঁর পিতা উস্তাদ মুন্সী লালমিয়াকে তার গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। আরবী, ফার্সী ও উর্দুভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে মুন্সী লালমিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতিও তাঁর পিতামাতা উদাসীন ছিলেন না মোটেই। সেজন্যে পার্শ্ববর্তী শেরপুর গ্রামের পন্ডিত রারকমল ভট্টাচার্যকে বাংলা, ধারাপাত, অংক ইত্যাদি শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত করা হয়। এ সময়ে বিহার শরীফ থেকে হাফেজ নিয়ামতুল্লা নামে জনৈক পারদর্শী শিক্ষাবিদ চাঁদপুর গ্রামে আগমন করলে, গ্রামের অভিভাবকগণ তাঁকে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করেন এবং তার কাছেই তিনি কোরআনের হাফেজ হন। উপরন্তু আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র, ফারায়েজ শাস্ত্র, হাদীস ও দর্শনশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, এবং আরবী-ফার্সী কাব্য ও সাহিত্যে বিশেষ পান্ডিত্য লাভ করেন। তিনি আরবী, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। যে যুগে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন, বাংলার কিশোর ও যুবকরা তখন নিয়মিত শরীরচর্চা করতো। চাঁদপুর ও হায়দারপুর গ্রামের মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা প্রাঙ্গনটি ছিল শরীরচর্চার উত্তম স্থান। হায়দারপুর নিবাসী শেখ মুহাম্মদ হানিফ শরীরচর্চা শিক্ষা দিতেন।

১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানেই সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এখানেই মীর নিসার আলী তাঁর হাতে জিহাদের শপথ নেন। হজ্জ্ব ও অন্যান্য কাজ শেষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী তাঁর খলিফা মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ও মওলানা ইসহাককে নিম্নরূপ নির্দেশ দেন, “তোমরা আপন আপন বাড়ী পৌঁছে দিন পনেরো বিশ্রাম নিবে। তারপর তোমরা বেরেলী পৌঁছুলে তোমাদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফর করব। পাটনায় কয়েকদিন বিশ্রামের পর কোলকাতা যাব।

বাংলাদেশের খলিফাগণের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল এমন, আমি পাটনায় পৌঁছে মওলানা আদুল বারী খাঁ (মওলানা আকরাম খাঁর পিতা), মওলানা মুহাম্মদ হোসেন, মওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর), মওলানা সুফী খোদাদাদ সিদ্দিকী ও মওলানা কারামত আলীকে খবর দিব। আমার কোলকাতা পৌঁছার দিন তারিখ তোমরা তাদের কাছে জানতে পারবে। কোলকাতায় আমাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তাতে আমাদের চূড়ান্ত কর্মসূচী গৃহীত হবে। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান)

অতঃপর সকলে মক্কা থেকে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা কোলকাতার শানসুন্নিসা খানমের বাগানবাড়ীতে সমবেত হন। আলোচনার পর স্থিরীকৃত হয় যে পাটনা মুজাহিদগণের কেন্দ্রীয় রাজধানী হবে এবং প্রত্যেক প্রদেশে হবে প্রাদেশিক রাজধানী। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে কেন্দ্রে জিহাদ পরিচালনার অর্থ প্রেরণ করা হবে।

এসব সিদ্ধান্তের পর মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর) উক্ত বৈঠকে যে ভাষণ দান করেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদেরকে খাঁটি মুসলমান না করা পর্যন্ত তাদেরকে জেহাদে পাঠানো বিপজ্জনক হবে। আমি তাদের মধ্যে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছাবার দায়িত্ব নিচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমি মনে করি, নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরাও আমাদের সংগ্রামে যোগদান করতে পারে।….কারণ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, ক্ষত্রিয় ও কায়স্থ জাতির উপর নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা সন্তুষ্ট নয়। আমরা যদি মুসলমানদেরকে পাকা মুসলমান বানিয়ে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে …কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কেন্দ্রকে সাহায্য করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে না।
পরামর্শ সভায় অতঃপর স্থির হলো, বাংলা কেন্দ্রকে অপর সকল বিষয়ে গোপনে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকাশ্যভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করবে না। তবে যাঁরা কেন্দ্রের সাথে যোগদান করার ইচ্ছা করবে, তাদেরকে বাধা দেয়া হবে না। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ২২-৩৭)।

তিতুমীর কোলকাতায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর পরামর্শ সভা সমাপ্তের পর নিজ গ্রাম চাঁদপুরে ফিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণের পর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তিতুমীরের দাওয়াতের মূলকথা ছিল ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজেকর্মে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন। হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার উৎপীড়নকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই বলেন যে, কৃষক সম্প্রদায়ের হিন্দুদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সারফরাজপুর নামক গ্রামবাসীর অনুরোধে তিনি তথাকার শাহী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচারের জন্যে তাঁর একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এখানে জুমার নামাজের পর তিনি সমবেত হিন্দু-মুসলমানকে আহবান করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন,
ইসলাম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নয় তাদের সাথে শুধু ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক বলে, বিবাদ বিসম্বাদ করা আল্লাহ ও তাঁর রসূল কিছুতেই পছন্দ করেন না। তবে ইসলাম এ কথা বলে যে, যদি কোন প্রবল শক্তিশালী অমুসলমান কোন দুর্বল মুসলমানের উপর অন্যায় উৎপীড়ন করে, তাহলে মুসলমানরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। তারা যদি অমুসলমানের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজকর্ম পছন্দ করে তাহলে শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে অমুসলমানদের সাথে স্থান দিবেন। তিতুমীর বলেন, ইসলামী আদর্শেই রয়েছে আমাদের ইহকাল পরকালের মুক্তি। এর প্রতি কেউ উপেক্ষা প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যারা অমুসলমানদের আদর্শে এসব পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন।

সরফরাজপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃসংস্কার, আবার জামায়াতে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা, নামাজান্তে সমবেত লোকদের সামনে তিতুমীরের জ্বালাময়ী ভাষণ –পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে সন্ত্রস্ত ও চঞ্চল করে তুলেছে। তিতুমীরের গতিবিধি ও প্রচার-প্রাচারণা সংবাদ সংগ্রহের ভার জমিদারের অনুগত ও বিশ্বস্ত মুসলমান পাইক মতির উপর অর্পিত হলো। জমিদার মতিকে বললো, তিতু ওহাবী ধর্মাবলস্বী। ওহাবীরা তোমাদের হযরত মুহাম্মদের ধর্মমতের পরম শত্রু। কিন্তু তারা এমন চালাক যে, কথার মধ্যে তাদেরকে ওহাবী বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমার মুসলমান প্রজাদেরকে বিপথগামী হতে দিতে পারি না। আজ থেকে তিতুর গতিবিধির দিকে নজর রাখবে এবং সব কথা আমাকে জানাবে। মুসলিমদের মধ্যে মাযহাবগত প্রার্থক্যের সুযোগ এখনো মুশরিকরা নিচ্ছে তখনও নিয়েছিলো।

অতঃপর কৃষ্ণদেব রায় গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিতুমীরের বিরুদ্ধে শাস্তিভংগের নালিশ করার জন্যে কিছু প্রজাকে প্রস্তুত করলো। তারপর জমিদারের আদেশে মতিউল্লাহ, তার চাচা গোপাল, জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে দিয়ে জমিদারের কাচারীতে উপস্থিত হয়ে নালিশ পেশ করলো। তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
চাঁদপুর নিবাসী তিতুমীর তার ওহাবী ধর্ম প্রচারের জন্যে আমাদের সরফরাজপুর গ্রামে এসে আখড়া গেড়েছে এবং আমাদেরকে ওহাবী ধর্মমতে দীক্ষিত করার জন্যে নানারূপ জুলুম জবরস্তি করছে। আমরা বংশানুক্রমে যেভাবে বাপদাদার ধর্ম পালন করে আসছি, তিতুমীর তাতে বাধা দান করছে। তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা যাতে সরফরাজপুরের জনগণের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে না পারে, জোর করে আমাদের দাড়ি রাখতে, গোঁফ ছাঁটতে, গোহত্যা করতে, আরব দেশের নাম রাখতে বাধ্য করতে না পারে, হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধাতে না পারে, হুজুরের দরবারে তার বিহিত ব্যবস্থার জন্যে আমাদের নালিশ। হুজুর আমাদের মনিব।

গোপাল, নেপাল, গোবর্ধনের টিপসইযুক্ত উক্ত দরখাস্ত পাওয়ার পর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হুকুম জারী করলো।
১। যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও গোঁফের ছাঁটার জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।
২। মসজিদ তৈরী করলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজরানা দিতে হবে।
৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।
৫। যে ওহাবী তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।

তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একটি পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল। তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া ছিলো এরকম...

পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের মাওলানা সাইয়েদ তিতুমীর সাহেবের নাম বলেন। তিতুমীরের নাম শুনতেই জমিদার ক্ষেপে যান। বাগান্বিত হয়ে বললেন, কে সেই ওহাবী তিতু? আর তুই ব্যাটা কে? উপস্থিত মুচিরাম ভান্ডারী বললো, ওর নাম আমন মন্ডল। বাপের নাম কামন মন্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।

পত্রবাহক বললো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।

কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সামর্থ ও সাক্ষী প্রমাণের অভাবে শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরবে ধৈর্য ধরেছেন। তবে শহীদ আমিনুল্লাহর শাহদাত তিতুমীরের দাওয়াতী প্রচেষ্টাকে খুব দ্রুতই সর্বাত্মক জিহাদে রূপান্তরিত করে। এভাবেই বাংলায় প্রথম প্রতিরোধ জিহাদের পটভূমি রচিত হয়।

১২ জানু, ২০২০

কমরেড সিরাজ সিকদারের সাতকাহন



সিরাজ সিকদার বাংলার রাজনীতিতে একজন আলোচিত ব্যক্তি। তিনি কারো মতে বাংলার চে গুয়েভারা। আবার কেউ তার মধ্যে একজন সন্ত্রাসবাদী ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাননি। তার অনেক কমরেডই তাকে একনায়ক হিসেবে আখ্যা করে দল ছেড়েছেন। অনেক প্রবীন নেতা তার কাজকর্মকে বলেছেন হটকারী, বলেছেন সিআইএর দালাল। তারপরও লাল বই পড়ে বিপ্লবী হতে চাওয়া নাদানদের কাছে সিরাজ সিকদার হিরো হয়েই আছেন।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব পরিচালিত রাষ্ট্র জানিয়েছে, জানুয়ারির ২ তারিখ গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাস্টোডি থেকে পালানোর সময় ক্রসফায়ারে নিহত হন সিরাজ সিকদার।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস জানিয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে গ্রেপ্তার করেন। আবার অন্য তথ্যমতে তিনি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। সেই দিনই তাকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে।

তার বোনজামাই জাকারিয়া চৌধুরী জানিয়েছে, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখবাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। আজকের এই দিনটিকে জাতীয় ক্রসফায়ার দিবস হিসেবে পালন করা যেতে পারে। এটাই বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ার হিসেবে জানি। বুয়েটের সাবেক ছাত্র জনাব সিকদার একজন মাওবাদী গেরিলা ছিলেন। সেসময় জনাব মুজিব তাকে বিনা বিচারে খুন করেন।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
সিরাজ সিকদার ১৯৫৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছাত্র অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির কংগ্রেসে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ঐ বছরই তিনি সরকারের নির্মাণ (সিঅ্যান্ডবি) বিভাগের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি টেকনাফের ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে যোগদান করেন।

বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস :
বামপন্থীদের মধ্যে সে সময় দুটো ধারা-রুশ ও চীনাপন্থী। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যেই তা প্রবল ছিলো। নেতা পর্যায়ে তা ছিলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ব্যানারে। কারণ পাকিস্তানে তখন কম্যুনিস্ট পার্টি ছিলো নিষিদ্ধ, অতএব গোপন। রুশপন্থীদের ঝামেলা কম। তারা কর্মীদের নানা ধরণের অসাম্প্রদায়িক গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত রাখে। সমাজতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরে বার্মা তাদের কাছে মডেল। শৃংখলা ভাঙ্গার সুযোগ তাই নেই। অন্যদিকে চীনাপন্থীরা সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কে বেশী সাম্রাজ্যবাদী, কাকে শ্রেনীশত্রু ও সংস্কারবাদী ধরা হবে এই নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত।

এই দশকের শেষ দিকে পশ্চিম বঙ্গ কাঁপিয়ে দিলেন চারু মজুমদার। নকশাল আন্দোলনের সেই জোয়ার পিকিং রিভিউর সৌজন্যে রোমাঞ্চিত করে তুললো চীনাপন্থী তরুণদের। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র সিরাজ শিকদার তাদের একজন। ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) লিয়াকত হল শাখার সভাপতি তিনি। মার্কসবাদ সম্পর্কে তার প্রচুর জ্ঞান। পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির (মার্কস-লেনিন) সদস্যপদও পেয়েছেন। নকশালবাড়ির আন্দোলনকে পার্টির নেতারা হঠকারিতা বলে রায় দিয়েছেন। আর এর প্রতিবাদে তরুণদের একটা দল বেরিয়ে এসে গঠন করলেন রেডগার্ড। ঢাকা শহরে চিকা পড়লো- বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস/ নকশালবাড়ী জিন্দাবাদ।

সিরাজ শিকদার তাদের অন্যতম। তার চোখে তখন মাও সেতুং হওয়ার স্বপ্ন জেঁকে বেসেছে। এমনিতে তার খুব বেশী বিলাসিতা ছিলো না বলেই জেনেছি শুধু ঐ সানগ্লাসটা ছাড়া। ধুমপানের বদভ্যাস ছিলো না, যা সাধারণত বাম বিপ্লবীদের ফ্যাশন। সে যুগের ট্রেন্ড অনুসরণ করে কৃষকদের জাগিয়ে তোলার জন্য গেলেন নিজের এলাকা মাদারীপুরের ডামুড্যায়। কিন্তু শ্রেনী সংগ্রামের বিভেদ বোঝাতে গিয়ে বিপাকে পড়লেন। সার্কেল অফিসারের ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার, পাত্রের বাজারে দাম লাখ টাকা। এক কৃষক তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন গরীবের প্রতি তার দরদ পরীক্ষায়। চ্যালেঞ্জ মেনে কৃষকের মেয়ে হাসিনাকে বিয়ে করলেন।

নকশাল আন্দোলন :
এটি একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের নাম। পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে শুরু হয়ে এটি ধীরে ধীরে ছত্তীসগঢ় এবং অন্ধ্র প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে এটি একটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। নকশাল বা নকশালবাদী বলতে উগ্র বামপন্থী মাওবাদী দলগুলোকে নির্দেশ করা হয়। এসব দলের জন্ম হয়েছিল চিন-সোভিয়েত ভাঙনের সময়। মতাদর্শগত ভাবে এরা মাও সে তুং-এর পদাঙ্ক অনুসরণকারী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সদর দপ্তর :
বিপ্লবের আরো প্রস্ততি হিসেবে মার্শাল আর্ট শেখা ধরলেন। এরপর ৭ সঙ্গী নিয়ে টেকনাফ হয়ে গেলেন বার্মা। সেখানকার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা থান-কিন-থাউর সঙ্গে দেখা করলেন নে-উইনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের স্বরূপ জানতে। এর মধ্যে রেডগার্ডের মাহবুবুল করিমকে চিঠি দিয়ে জানালেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় তিনি বিপ্লবীদের মূল ঘাঁটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আরো সদস্য পাঠাতে। আর বাকী কমরেডদের নিয়ে লেগে গেলেন পাহাড় কেটে সুরঙ্গ তৈরিতে। চীনা দুতাবাসে এর আগে টানেল ওয়ারফেয়ার নামে একটা তথ্যচিত্র দেখেছেন তারা। সে ধাঁচেই তৈরি হবে বিপ্লবী সদর। সঙ্গীরা সব অল্প বয়সী, কেউ ২০ পেরোয়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের আদুরে সন্তান। পাহাড়ের খাদে ওই খেয়ে না খেয়ে ঝড় বৃষ্টিতে মশার কামড় খাওয়া আর সাপের সঙ্গে শোয়া বিপ্লব তাদের সইলো না। ৭ জনের মধ্যে ৫ জন পালালেন। রেডগার্ড নেতা মাহবুবের ভাই মাহফুজ তাদের একজন। রয়ে গেলেন বিহারী দুই ভাই। এদের মধ্যে কায়েদ-ই আযম কলেজের বিএসসির ছাত্র সাইফুল্লাহ আজমী সিরাজ শিকদার অন্তপ্রাণ। তার স্বপ্ন লিন বিয়াও হওয়া। ক্ষুব্ধ সিরাজ তাকে ছেড়ে আসা ৫ জনের বিশ্বাসঘাতকতায় মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন। মাহবুব তার ভাইর পক্ষ নিলেন। সিরাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো রেডগার্ড।

মাও সেতুং থট রিসার্চ সেন্টার :
পুরো ঘটনাকাল ১৯৬৭-৬৮ সালের। এর মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিলো মাও সে তুং থট রিসার্চ সেন্টার বা মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র। সে বছরই মালিবাগে এটি প্রতিষ্ঠা করেন সিরাজ সিকদার। পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রকাশনা স্ফুলিংঙ্গের বিশেষ সংখ্যায় (১৯৮১) এই সময়কালের কথাই বলা হয়েছে। একই সময় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সিরাজ শিকদার পুর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ব্যানারে সর্বদলীয় এক বিপ্লবী ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। আর মাও থট সেন্টার ছিলো তার একটি ওপেন ফ্রন্ট। অন্যদিকে কমরেড রোকন তার স্মৃতিকথায় ব্যাপারটা উল্লেখ করেছেন অন্যভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এডভেঞ্চার শেষে ঢাকায় ফেরার পর খানিকটা হতাশ ছিলেন সিরাজ শিকদার। তার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার মতো কোনো ক্যাডার তখন ছিলো না। আর রেডগার্ডের সেই অংশ অর্থাৎ মাহফুজ, মাহবুব, নুরুল ইসলামসহ বাকিরা পূর্ব বাংলা বিপ্লবী কম্যুনিস্ট আন্দোলন নামে আলাদা সংগঠন গড়ে তোলেন। আর সেই ঘাটতি পূরণ করতেই মাও থট সেন্টারের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করার দায়িত্ব পান রোকন।

জাহানারা-সিরাজের দ্বৈরথ :
১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছেন সিরাজ। ন্যাপ ভাসানীর ছাত্র ফ্রন্টের বেশীরভাগ কর্মীই যোগ দিয়েছেন তার সাথে। এদেরই একজন রোকনউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ছাত্র। তার কাজিন জাহানারা। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার হাকিমের স্ত্রী। মহিলাদের পত্রিকা মাসিক বেগমে লেখালেখি করতেন। স্ত্রীর নারীবাদী চিন্তাভাবনা পছন্দ ছিলো না হাকিমের। তার চলাফেরার উপর তাই নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। দুই সন্তানের জননী জাহানারা রোকনউদ্দিনের সহয়তায় বাড়ি থেকে পালালেন। রোকন তাকে নিয়ে উঠলেন নেতা সিরাজ শিকদারের আস্তানায়। খালেদা ছদ্মনামে দয়াগঞ্জে এক শেলটারে রাখার ব্যবস্থা হলো তাকে। এনএসআইর একঝাঁক গোয়েন্দা নেমে পড়লো জাহানারার খোঁজে।

এদিকে বাংলার মাও সিরাজ সিকদার তার অর্ধশিক্ষিত স্ত্রী হাসিনার মাঝে যা পাননি, তা পেলেন জাহানারার মাঝে। জাহানারা আরেকটি ছদ্মনাম নিলেন রাহেলা। কারণ এনএসআই তার খালেদা নামের খোঁজ পেয়ে গেছে। আর অনেকটা মজা করেই সিরাজ নাম নিলেন হাকিম ভাই। সবুজবাগে একটা ভাড়া বাসায় দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। রাতে বেরোতেন একসঙ্গেই। পার্টি সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে কানাকানি এবং একসময় অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। চরমপন্থাতেই এই বিদ্রোহ দমন করলেন সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর এবং পেয়ারা বাগানে দুর্দান্ত যুদ্ধ করা সেলিম শাহনেওয়াজ খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হুমায়ুন কবিরকে মরতে হলো জাহানারা-সিরাজের সম্পর্কের বিরুদ্ধাচরণ করায়। তবে এসব স্বাধীনতার অনেক পরের ঘটনা। ১ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে সিরাজের সঙ্গেই গ্রেপ্তার হন জাহানারা ওরফে খালেদা ওরফে রাহেলা। তাকে কুমিল্লায় ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর দুজনের সন্তান অরুণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিরাজ শিকদারের পিতাকে।

সিরাজের মুক্তিযুদ্ধ :
১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারী পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়া এই পতাকায় সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য্য। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকারই অনুরূপ! সে বছর ৬ মে কার্লমার্ক্সের জন্মদিনে পাকিস্তান কাউন্সিলে দুটো হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, যা নিজেই ছুড়েছিলেন বলে দাবি করেছেন কমরেড রোকন। তার মতে পাকিস্তানের দুই অংশের যুবক যুবতীদের মধ্যে বিয়েকে উৎসাহিত করতে ৫০০ রূপী ভাতা চালু করেছিলো এই কাউন্সিল। স্মৃতিকথায় একই কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার সিরাজের নির্দেশে আরেকজন কমরেডকে পাঠান রোকন। তার একহাত পঙ্গু ছিলো। পাকিস্তান কাউন্সিলের চারপাশে কড়া পাহারা দেখে তিনি পাশের এক ডাস্টবিনে বোমা ফেলে দেন। আর তা কুড়িয়ে পেয়ে খোলার সময় বিস্ফোরণে মারা যায় দুটো অল্পবয়সী শিশু।

অক্টোবর নাগাদ ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন, আমেরিকান ইনফরমেশান সেন্টারসহ আরো বেশ কিছু জায়গায় বোমা হামলা চালায় সিরাজের দল, যাতে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে জাতীয় শত্রু খতম কর্মসূচী চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পার্টির স্বার্থবিরোধী এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিরোধীদের এই খতম তালিকায় রাখা হয়। পার্টির প্রথম খতমের শিকার হন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির এক চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার হারু বাবু। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডই ছিলো পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম খতম অভিযান।

আমাদের দেশে প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সিরাজের ঠাঁই হয় না, কারণ দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিজয় দিবসে হরতাল আহবান কিংবা মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অন্য পিকিংপন্থী কম্যুনিস্টদের আদলেই তার অবস্থান। নির্দিষ্ট করে বললে ৭১-এর অক্টোবরে সিরাজ সিকদার নতুন পরিকল্পনা দেন তার দলকে এবং আহবান জানান আওয়ামী লীগ, ভারতীয় বাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুগপত লড়াই চালাতে। তার দলের আক্রমণের শিকার হন মুক্তিযোদ্ধারাও।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সিরাজের রাজনীতি :
১৯৭২ সালের ১২ থেকে ১৬ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে নতুন রাজনৈতিক ধারার ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দেন সিরাজ। এতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, রুশ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তব্যবাদ এবং রুশ ভারতের দালালদের পূর্ব বাংলার জনগনের মূল শত্রু হিসেবে গণ্য করা হয়। সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করে "পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয় নি, পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান" নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল হাজির করেন। যেখানে আওয়ামী লীগকে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান হিসেবে উল্লেখ করে তাদের কে ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ এই দিনে দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হলে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে তা সমর্থন করেন। দেশব্যাপী গণভিত্তি সম্পন্ন পার্টি গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন। দিনে দিনে সিরাজ সিকদার এক জনপ্রিয় নেতা হয়ে ঊঠতে থাকেন। ছাত্র-তরুন'রা দলে দলে তার সংগঠনে যোগ দিয়ে লড়াই জারি রাখেন।

ভাঙন :
জাহানারার সঙ্গে সিরাজের অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে পার্টিতে শুরু হয় কলহ। এইসময় অভিযোগ ওঠে আজম, রিজভী ও মোহসিনসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে সঙ্গী করে সিরাজকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ নেন ফজলু ও সুলতান। এদের কুচক্রী হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৭২ সালের মে মাসে বহিস্কার করেন সিরাজ। জুনের প্রথম সপ্তাহে কাজী জাফর গ্রুপের কিলার খসরুকে দিয়ে সেলিম শাহনেওয়াজ ওরফে ফজলু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে হত্যা করা হয়। হুমায়ুন কবির হ্ত্যাকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে সিআইডি জেরা করে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফরহাদ মাজহারকে। এর মধ্যে মাহবুবুর রহমান ওরফে শহীদ গ্রেপ্তার হন পুলিশের হাতে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন এই সন্দেহে তাকে সেন্ট্রাল কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় ‘৭৩ সালের শুরুতে। এর মধ্যে পার্টি বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে সংশোধনের শিকার হতে হয় আরো অনেককে। বহিষ্কার এবং মৃত্যু দুটোই বরণ করতে হয় তাদের।

সিরাজের উত্থান :
১৯৭৩ সালকেই ধরা হয় সিরাজ সিকদারের উত্থানের সময়। এ সময়ই সরকারের প্রশাসনিক দূর্বলতা এবং বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষের আসন্ন ছায়াকে কাজে লাগিয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন তিনি। ভাবমূর্তি বলতে এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া এক মেহনতি মানুষের ভাব। এর মধ্যে ঢাকার অদূরে বৈদ্যেরবাজারসহ বেশ কটি ব্যাঙ্ক লুট করেন তারা। গল্প ছড়িয়ে পড়ে সিরাজ ব্যাঙ্ক লুট করে অভাবী মানুষকে খাবার দিচ্ছেন। দখল করা হয় ময়মনসিং মেডিকেল কলেজ, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও টাঙ্গাইলের পাথরাইল পুলিশ ফাড়ি। মাদারিপুরের এএসপি সামাদ মাতবর, মগবাজারের রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা ফজলুল হক, বরিশালে সাংসদ মুকিম, শেখ মুজিবর রহমানের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মহিউদ্দিন, টেকেরহাতের নেতা শাহজাহান সরদার, ভোলার রতন চৌধুরী, মাদারিপুরের নিরুসহ অনেকেই তাদের হাতে খুন হন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আবার হরতাল ডাকেন সিরাজ। বিজয় দিবসকে ঘোষণা করেন কালো দিবস হিসেবে। এবার নড়েচড়ে বসে মুজিব সরকার। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহ মাওবাদী চরমপন্থীদের অরাজকতার দোহাই দিয়ে সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেন।

সিরাজের বিরুদ্ধে লাগে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার ক্রমাগত তাড়া খেয়ে তখন কোথাও কয়েকঘণ্টার বেশী থাকার উপায় নেই তার এবং জাহানারার। এর সরকারের সাথে লুকোচুরি খেলার মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্ম নেয় দুজনের সন্তান অরুণ। আর দলের মধ্যে কলহ লেগেই আছে। পার্টির অনেক ক্যাডারই সিরাজের আনুগত্যের বাইরে যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছেমতো ডাকাতি করছে আর সম্পদ গড়তেছে। অনেকেই দলীয় আদর্শ ভুলে পেশাদার ডাকাতে পরিণত হয়েছে।

সেবছর ভারতীয় রাষ্ট্রপতি গিরির সফরের সময় হরতাল ডাকেন সিরাজ এবং বোমায় কাঁপে সারা দেশ। এ সময়টাতেই ভারতের মার্কসবাদীদের মুখপাত্র বলে কথিত সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ারে (২০ জুলাই, ১৯৭৪) সিরাজ শিকদারের দলের তীব্র সমালোচনা করে লেখা হয় যে চারু মজুমদার যা ভুলভ্রান্তি করেছেন তা সিরাজের নখের সমানও নয়। চীনা বিপ্লবের ভুল পাঠ নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি লুটপাটের মাধ্যমে সদস্যদের পকেটভর্তি এবং ব্ল্যাক মেইলের অভিযোগও ওঠে। এবং অন্য মাওবাদীরা তাকে সিআইএর এজেন্ট বলছেন এমন কথাও লেখা হয়। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে গোটা সময়টায় সিরাজ শিকদারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম। এই জহুরুল ইসলামের সাথে সিরাজের পরিচয় ঘটে সিএন্ডবিতে। ফেরারী অবস্থায় তার নাভানা মটরসই ছিলো সিরাজ ও জাহানারার নিরাপদ আশ্রয়।

গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ার :
১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ গ্রেপ্তার হন সিরাজ শিকদার। এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। বলা হয় তার ঘনিষ্ঠ কোনো কমরেডই বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দিয়েছেন তাকে। পাশাপাশি এও বলা হয় যে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা সফলভাবেই সর্বহারা গ্রুপে ইনফিলট্রেট করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় গ্রেপ্তার হন সিরাজ। এরপর তাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। কেউ কেউ বলে তাকে প্রাইভেট বিমানে করে উড়িয়ে আনা হয়েছে, কেউ বলেছেন হেলিকপ্টারে। বিমানের গল্পে সিরাজের চোখ বাঁধা, এটা দেখে পাইলটদের বিমান চালাতে অস্বীকৃতির অধ্যায় আছে। এয়ারপোর্টে সিরাজের পানি খেতে চাওয়া এবং তাকে কষে লাথি মারার গল্প আছে। এবং সবচেয়ে নাটকীয়টি হচ্ছে মুজিবের মুখোমুখি রক্তাক্ত সিরাজের উক্তি : বি কেয়ারফুল মুজিব, ইউ আর টকিং টু সিরাজ শিকদার। এরপর মুজিবের তাকে লাথি মারা। কিন্তু কোনটারই সত্যিকার অর্থে প্রমাণ দিতে পারেননি কেউই।

২ জানুয়ারী সাভারে নিহত হন সিরাজ শিকদার। সরকারী ভাষ্য গাড়ি থেকে পালানোর সময় গুলিতে নিহত হন তিনি। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের প্রথম উদাহরণ। এটাও ভারত থেকে আমদানী যা নকশালদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে খ্যাতিমান হয়ে গিয়েছিলেন সাব ইন্সপেক্টর রুনুগুহ নিয়োগী। তবে কমরেড রোকনের স্মৃতিকথায় একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনার উল্লেখ আছে। ১৯৭৩ সালে মাদারিপুরে একবার ধরা পড়েছিলেন সিরাজ শিকদার। কিন্তু দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা মোহসিন তাকে পালানোর সুযোগ দেন। কারণ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ক্ষিপ্ত ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন , স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে।…

এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের কঠোরনীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র– সে ইতিহাস সবার জানা। সর্বশেষ তাদের মধ্যে অনেকে ডাকাতি করতে গিয়ে মারা পড়ে আরেক জঙ্গী গোষ্ঠী জেএমবি'র বাংলা ভাইয়ের হাতে।

১১ জানু, ২০২০

কিয়ামতের দিন মানুষ কয়ভাগে বিভক্ত হবে?



কিয়ামতের দিন মানুষ কয়ভাগে ভাগ হবে এবং তাদের পরিণতি কী হবে এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা ওয়াকিয়াতে উল্লেখ করেছেন। সেদিন মানুষ প্রধানত তিনভাগে ভাগ হবে। 
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
সে সময় তোমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে৷ডান দিকের লোক। ডান দিকের লোকদের (সৌভাগ্যের) কথা আর কতটা বলা যাবে। বাম দিকের লোক, বাম দিকের লোকদের (দুর্ভাগ্যের) পরিণতি আর কি বলা যাবে। আর অগ্রগামীরা তো অগ্রগামীই।তারাই তো নৈকট্য লাভকারী। তারা নিয়ামতের ভরা জান্নাতে থাকবে।
- সূরা ওয়াকিয়া (৭-১২) 

আমরা এখানে তিনটি পেলাম। এর বাইরে সূরা আ'রাফে ৪৬ নং আয়াতে আরেকটি দলের কথা উল্লেখ রয়েছে। যারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝামাঝিতে অবস্থান করবে। হাদীস থেকে আমরা আরো একটি দলের সন্ধান পাই যারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করে জান্নাতে ফিরবে। তার মানে তারা বাম দিকের দল দুই ভাগ হবে। একদল চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আরেকদল জাহান্নাম থেকে শাস্তি শেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে। 

আমরা কুরআন হাদীস অনুসারে পাঁচটি দল পেলাম। 
১. অগ্রগামী 
২. ডান দিকের লোক 
৩. বাম দিকের লোক 
৪. আ'রাফবাসী 
৫. জাহান্নামী থেকে জান্নাতী 

১. অগ্রগামী হিসেবে বিবেচিত হবেন কারা? 
তারা হবেন বিশিষ্ট, আল্লাহর কাছাকাছি। তারা আসহাবুল ইয়ামীনের চেয়েও বেশী মর্যাদাবান ও নৈকট্য লাভকারী, তারা হবেন জান্নাতবাসীদের নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন নবী, রাসূল, সিদ্দীক ও শহীদগণ। ডান দিকের লোকদের চেয়ে তারা সংখ্যায় কম হবেন। তারা হিসেব ছাড়াই জান্নাতে যাবেন। তাদের পাপ-পূন্যের কোনো হিসেব হবে না। আল্লাহর রাসূল সা. হিসেব ছাড়া জান্নাতের জন্য দোয়া করতেন প্রতিনয়ত। 

সূরা ফাতিরের আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ “অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি; তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী।” (৩৫:৩২) সুতরাং এখানেও তিন শ্রেণী রয়েছে। এটা ঐ সময়, যখন (আরবী)-এর ঐ তাফসীর নেয়া হবে যা এটা অনুযায়ী হয়, অন্যথায় অন্য একটি উক্তি রয়েছে যা এই আয়াতের তাফসীরের স্থলে গত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজনও এটাই বলেছেন। দু'টি দল তো জান্নাতী এবং একটি দল জাহান্নামী।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়ার দিকে সর্বপ্রথম কোন্ লোকগুলো যাবে তা তোমরা জান কি?” সাহাবীগণ (রাঃ) উত্তর দেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন। তিনি তখন বললেনঃ “তারা হলো ঐ লোক যে, যখন তাদেরকে তাদের হক প্রদান করা হয় তখন তারা তা কবুল করে, তাদের উপর অন্যের হক থাকলে তা চাওয়া মাত্রই দিয়ে দেয় এবং তারা লোকদেরকে ঐ হুকুম করে যে হুকুম তাদের নিজেদেরকে করে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

সাবেকুন বা অগ্রবর্তী হবে কারা এ ব্যাপারে বহু উক্তি রয়েছে। যেমন নবীগণ, ইল্লীঈনবাসীগণ, হয়রত ইউশা ইবনে নুন যিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন, ঐ মুমিনরা যাদের বর্ণনা সূরায়ে ইয়াসীনে। রয়েছে, যারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর প্রথমে ঈমান এনেছিলেন, হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রতি অগ্রগামী ছিলেন, ঐ লোকগুলো, যারা দুই কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন, প্রত্যেক উম্মতের ঐ লোকগুলো যারা নিজ নিজ নবীর উপর পূর্বে ঈমান এনেছিলেন, ঐ লোকগুলো, যারা সর্বাগ্রে জিহাদে গমন করেন। প্রকৃতপক্ষে এই উক্তিগুলো সবই সঠিক অর্থাৎ এই লোকগুলোই অগ্রবর্তী। যারা আগে বেড়ে গিয়ে অন্যদের উপর অগ্রবর্তী হয়ে আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ কবুল করে থাকেন তারা সবাই সাবেকুনের অন্তর্ভুক্ত। 

যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, “তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়।” (৩:১৩৩) আর এক জায়গায় বলেন, “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে অগ্রগামী হও এবং এমন জান্নাতের দিকে যার প্রস্থ বা বিস্তৃতি আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তৃতির মত।” (৫৭:২১) সুতরাং এই দুনিয়ায় যে ব্যক্তি পুণ্যের কাজে অগ্রগামী হবে, সে আখিরাতে আল্লাহ তা'আলার নিয়ামতের দিকেও অগ্রবর্তীই থাকবে। প্রত্যেক আমলের প্রতিদান ঐ শ্রেণীরই হয়ে থাকে। যেমন সে আমল করে তেমনই সে ফল পায়। এ জন্যেই মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ তারাই নৈকট্য প্রাপ্ত, তারাই থাকবে জান্নাতুন নাঈমে।

মাওলানা মওদুদী বলেন,
সাবেকুন (অগ্রগামীগণ) অর্থ যারা সৎকাজ ও ন্যায়পরায়ণতায় সবাইকে অতিক্রম করেছে, প্রতিটি কল্যাণকর কাজে সবার আগে থেকেছে৷ আল্লাহ ও রসূলের আহবানে সবার আগে সাড়া দিয়েছে, জিহাদের ব্যাপারে হোক কিংবা আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে হোক কিংবা জনসেবার কাজে হোক কিংবা কল্যাণের পথে দাওয়াত কিংবা সত্যের পথে দাওয়াতের কাজে হোক মোট কথা পৃথিবীতে কল্যাণের প্রসার এবং অকল্যাণের উচ্ছেদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী এবং শ্রমদান জীবনপনের যে সুযোগই এসেছে তাতে সে -ই অগ্রগামী হয়ে কাজ করেছে৷ 

এ কারণে আখেরাতেও তাদেরকেই সবার আগে রাখা হবে৷ অর্থাৎ আখেরাতে আল্লাহ তা'আলার দরবারের চিত্র হবে এই যে, ডানে থাকবে 'সালেহীন' বা নেককারগণ, বাঁয়ে থাকবে ফাসেক বা পাপীরা এবং সবার আগে আল্লাহ তা'আলার দরবারের নিকটে থাকবেন 'সাবেকীন'গণ৷ হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো কিয়ামতের দিন কারা সর্বপ্রথম পৌছবে এবং আল্লাহর ছায়ায় স্থান লাভ করবে? সবাই বললেনঃ আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূলই ভাল জানেন৷ তিনি বললেন, "যাদের অবস্থা ছিল এই যে, তাদের সামনে যখনই সত্য পেশ করা হয়েছে, তা গ্রহণ করেছে৷ যখনই তাদের কাছে প্রাপ্য চাওয়া হয়েছে, তখনই তা দিয়ে দিয়েছে৷ আর তারা নিজেদের ব্যাপারে যে ফায়সালা করেছে অন্যদের ব্যাপারেও সেই ফায়সালা করেছে।" (মুসনাদে আহমাদ) ৷

২. ডান দিকের লোক যারা
যারা তাওহীদের সাক্ষ্য দিবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে। যাদের সওয়াবের পাল্লা গুনাহের পাল্লার চাইতে বেশি হবে তাঁরাই হবেন ডান দিকের লোক। কুরআন-হাদীসে যারা জান্নাতবাসী হবেন তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য ও কর্মের কথা উল্লেখ রয়েছে।
  
তাওহীদের সাক্ষ্য 
উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি ‘আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই’ এ কথা জানা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম ১৪৫, আহমাদ ৪৬৪নং)
মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বলেছেন, জান্নাতের চাবি হল, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ বলে সাক্ষ্য প্ৰদান করা।

নরম দিল হওয়া।
” জান্নাতে প্রবেশ করবে এমন ব্যক্তি যাদের অন্তরসমূহ হবে পাখির অন্তরের ন্যায়।”
( মুসলিম, জান্নাত ও তার নেয়ামত সমূহের বর্ণনা অধ্যায়, হাদিস নং: ২৮৪০)

দুর্বল অসহায় হওয়া।
” হারেসা ইবন ওহাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন: ” আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতি লোকদের গুণাবলীর কথা বলব না?
সাহাবাগণ বললেন: হ্যাঁ বলুন। তিনি বললেন: ” প্রত্যেক দুর্বল, লোক চোখে হেয়, কিন্তু সে যদি কোন বিষয়ে আল্লাহর নামে কসম করে তাহলে আল্লাহ তার কসম পূর্ণ করবেন।”
অতঃপর তিনি বললেন: আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামী লোকদের কথা বলব না?  তারা বললেন: বলুন। তিনি বললেন: ”প্রত্যেক ঝগড়াকারী, দুশ্চরিত্র, অহংকারী
ব্যক্তি।” (মুসলিম, হাদিস নং: ২৮৫৩)

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণকারী জান্নাতে যাবে।
” আমার সমস্ত উম্মত জান্নাতে যাবে তবে ঐ সমস্ত লোক ব্যতীত যারা অস্বীকার করে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসূল! কে অস্বীকার করে?
তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার নাফরমানী করে সে অস্বীকার করে।”
( বুখারি, কুরআন ও সুন্নাহকে আকড়ে ধরা বিষয় আলোচনা অধ্যায়, হাদিস নং: ৭২৮০)

সালাম দেওয়া, খাবার খাওয়ানো ও তাহাজ্জুদ আদায়কারী।
” হে লোক সকল, তোমরা সালামের প্রসার ঘটাবে, লোকদের খাদ্য দিবে, মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকবে (শেষ রাতে) তখন (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করবে। তাহেল তোমরা শান্তি ও নিরাপদে জান্নাতে দাখেল হতে পারবে।
(তিরমিযি (ইফাঃ) ২৪৮৭, ইবনু মাজাহ (ইফাঃ)১৩৩৪,৩২৫১)

ক্ষমাপ্রার্থীদের জন্য জান্নাত
যারা তাওবা করে, তাদের জন্য জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে কিংবা নিজের ওপর জুলুম করে, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃত কর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনেশুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৫)

আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ মান্যকারীদের জন্য জান্নাত
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সীমারেখা মেনে চলে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের আদেশমতো চলে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এটা বিরাট সাফল্য...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩-১৪)

ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য জান্নাত
ঈমানদার ও নেককারদের জন্য জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, অবশ্যই আমি তাদের প্রবিষ্ট করাব জান্নাতে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। সেখানে তাদের জন্য থাকবে পবিত্র স্ত্রী এবং তাদের আমি প্রবিষ্ট করাব ঘন ছায়ানীড়ে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৭)

নামাজি ও সচ্চরিত্রবানের জন্য জান্নাত
যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, দান-খয়রাত করে এবং সচ্চরিত্রের অধিকারী, তাদের জন্য জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা নামাজ আদায়কারী। যারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে। এবং যাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে যাচ্ঞাকারী ও বঞ্চিতের এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। এবং নিশ্চয়ই তাদের পালনকর্তার শাস্তি থেকে নিঃশঙ্ক থাকা যায় না। এবং যারা তাদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। কিন্তু তাদের স্ত্রী অথবা মালিকানাভুক্ত দাসীদের বেলায় তিরস্কৃত হবে না, অতএব যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমা লঙ্ঘনকারী। এবং যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং যারা তাদের সাক্ষ্যদানে নিষ্ঠাবান এবং যারা তাদের নামাজে যত্নবান তারাই জান্নাতে সম্মানিত হবে।’ (সুরা : আল-মাআরিজ, আয়াত : ২২-৩৫)

খোদাভীরু ও পরহেজগারদের জন্য জান্নাত
যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই খোদাভীরুরা থাকবে ছায়ায় ও প্রস্রবণসমূহে এবং তাদের বাঞ্ছিত ফলমূলের মধ্যে। বলা হবে, তোমরা যা করতে তার বিনিময় তৃপ্তির সঙ্গে পানাহার করো। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।’ (সুরা : মুরসালাত, আয়াত : ৪১-৪৪)

নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সবার জন্য জান্নাত
নিজ নিজ আমল অনুযায়ী নারী-পুরুষ সবাই জান্নাতে যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য করা হবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ, রোজা পালনকারী নারী, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী পুরুষ, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী নারী—তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৫)

মুমিনরা জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিয়েছে
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ। এর বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, অতঃপর মারে ও মরে। তাওরাত, ইনজিন ও কোরআনে এ বিষয়ে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে শ্রেষ্ঠ? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সঙ্গে। আর এ হলো মহান সাফল্য। তারা তাওবাকারী, ইবাদতকারী, শোকরগোজার, সিয়াম পালনকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্তকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। সুসংবাদ দাও ঈমানদারদের।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১১-১১২)

সাত ব্যক্তি আরশের ছায়ায় স্থান পাবে
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তাআলা সাত ধরনের মানুষকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন—১. ন্যায়পরায়ণ শাসক। ২. যে যৌবনে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে। ৩. যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। ৪. ওই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর উদ্দেশে পরস্পরকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্যই পরস্পর একত্র হয় এবং তাঁর জন্যই সম্পর্ক ছিন্ন করে। ৫. ওই ব্যক্তি, যাকে কোনো বংশীয়ভাবে মর্যাদাবান রূপসী নারী কুকর্মের প্রতি আহ্বান জানায়; কিন্তু সে এ কথা বলে তা প্রত্যাখ্যান করে যে আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. যে ব্যক্তি এমন গোপনে দান-সদকা করে যে তার ডান হাতে কী দান করেছে, বাম হাত তা জানে না। ৭. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাঁর ভয়ে চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৬০ মুসলিম, হাদিস : ১০৩১)

দৈনিক বারো রাকাত সালাত আদায়কারী
 “রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী উম্মে হাবীবা ˆরাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ফরয ব্যতীত বারো রাকাআত নফল সালাত আদায় করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। মুসলিম, মুসাফিরদের সালাত আদায় করা অধ্যায়। হাদীস নং ৭২৮।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে
“আবূ আয়্যুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। তিনি বললেন: আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না। সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ। যখন ঐ লোক ফিরে যেতে লাগল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাকে যা করতে বলা হল, যদি সে এর ওপর আমল করে তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। 
মুসলিম কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: যে ঈমান একজন মুমিনকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। হাদীস নং ১৩।

তাহাজ্জুদ আদায়কারী, রোজা পালনকারী ও অন্যকে খাদ্য দানকারী:
“আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জান্নাতে এমন কিছু ঘর আছে যার ভিতর থেকে বাহিরের সব কিছু দেখা যাবে। আবার বাহির থেকে ভিতরের সব কিছু দেখা যাবে। এক বেদুইন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ ঘর কার জন্য? তিনি বললেন: ঐ ব্যক্তির জন্য যে ভাল ও নরম কথা, বলে, অন্যকে আহার করায়, অধিক পরিমাণে নফল রোযা রাখে, আর যখন লোকেরা আরামে নিদ্রারত থাকে তখন উঠে সে সালাত আদায় করে। তিরমিযি, জান্নাতের আলোচনা। পরিচ্ছেদ: জান্নাতের কামরাসমূহের বৈশিষ্ট্য; ২/২০৫১, হাদীস নং ১৯৮৪।

ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ জান্নাতে যাবে:-
 “ইয়াদ্ব ইবন হিমার মাজাশে‘য়ী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তিন প্রকারের লোক জান্নাতে যাবে। এক- ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, সত্যবাদী, নেক আমলকারী। দুই- ঐ ব্যক্তি যে প্রত্যেক আত্মীয়ের সাথে এবং প্রত্যেক মুসলমানের সাথে দয়া করে। তিন-ঐ ব্যক্তি যে লজ্জা স্থানকে সংরক্ষণ করে এবং বিনা প্রয়োজনে কারো নিকট কোন কিছু চায় না।
মুসলিম, কিতাবুল জান্নাহ, পরিচ্ছেদ: জান্নাতী ও জাহান্নামীদের গুনাগুণের বিষয়ে আলোচনা, হাদীস নং ২৮৬৫।

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল এবং দ্বীনের প্রতি সন্তুষ্টি জ্ঞাপন
“আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি বলে যে আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নবী হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট। তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। 
আবু দাউদ, বিতির অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ইস্তেগফার বিষয়ে আলোচনা, ১/১৩৫৩, হাদীস নং ১৫২৯।

দুই বা দুইয়ের অধিক কন্যাকে লালন-পালন করা:-
“আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি দুইজন কন্যাকে তাদের প্রাপ্তবয়স্কা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করল, কিয়ামতের দিন আমি ও ঐ ব্যক্তি এক সাথে উপস্থিত হব। একথা বলে তিনি তাঁর দুই আঙ্গুলকে একত্রিত করে দেখালেন (যে এভাবে)
মুসলিম, কিতাবুল বির ওয়াস-সিলা, কন্যা সন্তানের প্রতি দয়া করা বিষয়ে আলোচনা, হাদীস নং ২৬৩১।

ওযুর পর দুইরাকাআত নফল সালাত (তাহিয়্যাতুল ওযু) রীতিমত আদায়কারীও জান্নাতি হবে।
 “আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন ফজরের নামাযের পর বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, হে বেলাল! ইসলাম গ্রহণের পর তোমার এমন কি আমল আছে যার বিনিময়ে তুমি পুরস্কৃত হওয়ার আশা রাখ? কেননা আজ রাতে আমি জান্নাতে আমার সামনে তোমার চলার শব্দ পেয়েছি। বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: আমি এর চেয়ে অধিক কোন আমল তো দেখছি না যে, দিনে বা রাতে যখনই আমি ওযু করি তখনই যতটুকু আল্লাহ তাওফিক দেন ততটুকু নফল সালাত আমি আদায় করি।
বুখারি ও মুসলিম, দেখুন সংক্ষিপ্ত মুসলিম, হাদিস নং- ১৬৮২

অপর একটি হাদিসে বর্ণিত-
 “উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, আমাদের উপর দায়িত্ব ছিল উট চরাবার। যখন আমার পালা আসল তখন আমি এক বিকালে সেগুলো ছেড়ে আসলাম। তখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম যে তিনি মানুষদের নিয়ে কথা বলছেন, তখন তার যে কথা আমি ধারণ করতে পেরেছি তার মধ্যে ছিল, “তোমাদের যে কেউ ওযু করল, আর সে তার ওযু সুন্দর করে সম্পন্ন করে, তারপর দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজুর দুই রাকাত সালাত ভালোভাবে আদায় করল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।
 মুসলিম, হাদিস: ১৪৪ ।”

যে নারীর মধ্যে হাদিস বর্ণিত পাঁচটি গুণ পাওয়া যাবে:-
“আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমযান মাসে রোযা রাখে, স্বীয় লজ্জা-স্থান সংরক্ষণ করে, স্বীয় স্বামীর অনুগত থাকে, কিয়ামতের দিন তাকে বলা হবে যে, জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর।
ইবনে হিব্বান, সহীহ জামে আসসগীর ১ম খণ্ড হাদিস নং-৬৭৩

শহীদ, নবজাত শিশু ও জীবন্ত প্রোথিত সন্তান:-
 “হাসনা বিনতে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাকে আমার চাচা এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছি যে, কোন ধরনের লোকেরা জান্নাতি হবে? তিনি বললেন: শহীদরা জান্নাতি। মৃত্যুবরণকারী নবজাতক শিশু জান্নাতি। (জাহিলিয়াতের যুগে) জীবন্ত প্রোথিত শিশু জান্নাতি।”
আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, হাদিস নং- ২/২২০০

-আল্লাহর পথের সৈনিক:
“মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ করেছে যতক্ষণ কোনো উটের দুধ দোহন করতে সময় লাগে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।
তিরমিযি, জিহাদের ফযিলত অধ্যায়, হাদিস নং-২/১৩৫৩

মুত্তাকী এবং চরিত্রবান লোক:
 “আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল কোন আমলের কারণে সর্বাধিক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে? তিনি বললেন: তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) ও উত্তম চরিত্র।
তিরমিযি, কিতাবুল বির ওয়াসসিলা, পরিচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র বিষয়ে আলোচনা

৩. বাম দিকের লোকদের বৈশিষ্ট্য
যারা তাওহীদকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা অবশ্যই জাহান্নামী হবে। এই ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ তায়ালা অনেকবার উল্লেখ করেছেন। যারা ঈমান আনবে তাদের মধ্যেও অনেকে পাপকাজে ডুবে থাকবে। যাদের পাপের পাল্লা পূন্যের পাল্লার চাইতে ভারী হবে তারাই হবেন বাম দিকের লোক।
 
শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি 
“নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৭২

ঋণগ্রস্থ 
হযরত আব্দুলাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ সা. বলেন, ‘একমাত্র ঋণ ছাড়া শহীদের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (মুসলিম)। হযরত আবু কাতাদাহ রা. বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : ‘ইয়া রাসুলালাহ! আপনি কি মনে করেন, যদি আমি আলাহর পথে অগ্রগামী অবস্থায় পশ্চাদপদ না হয়ে সওয়াবের আশায় দৃঢ়পদ থেকে শহীদ হই, তাহলে আলাহ আমার সব পাপ ক্ষমা করে দিবেন কী?’ রাসুলুলাহ সা. বলেন, ‘হ্যাঁ’। অতঃপর লোকটি চলে যেতে লাগলে তিনি পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, তবে ঋণ ব্যতিত।’ (মুসলিম)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী 
জুবাইর বিন মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বোখারি : ৫৫২৫)।

হারাম খাদ্য ভক্ষণকারী 
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা লালিত-পালিত হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বায়হাকি : ৫৫২০)।

মা-বাবার অবাধ্য সন্তান ও দাইয়ুস 
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন শ্রেণির লোক জান্নাতে যাবে না মা-বাবার অবাধ্য, দাইয়ুস (অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-বোন প্রমুখ অধীন নারীকে বেপর্দা চলাফেরায় বাধা দেয় না) এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলা।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ২২৬)।

প্রতিবেশীকে কষ্ট দানকারী 
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার অত্যাচার থেকে প্রতিবেশীরা নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ৬৬)।

অশ্লীলভাষী ও উগ্র মেজাজি 
হারেছা বিন ওহাব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অশ্লীলভাষী ও উগ্র মেজাজি ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।’ (আবু দাউদ : ৪১৬৮)।

প্রতারণাকারী শাসক 
মাকাল বিন ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘মুসলমানদের ওপর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক যদি এ অবস্থায় মারা যায় যে, সে তার অধীনদের ধোঁকা দিয়েছে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বোখারি : ৬৬১৮)।

অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী 
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কসম করে কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন এবং জান্নাত হারাম করেন। এক ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদিও সামান্য কোনো জিনিস হয়? তিনি বললেন, যদিও পিপুল গাছের একটি ছোট ডাল হোক না কেন।’ (মুসলিম : ১৯৬)।

খোঁটাদানকারী, অবাধ্য সন্তান ও মদ্যপ 
আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, সর্বদা মদপানকারী এই তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (নাসায়ি : ৫৫৭৭)।

চোগলখোর 
হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ১৫১)।

অন্য পিতার সঙ্গে সম্বন্ধকারী 
সা’দ ও আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজেকে অন্য পিতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে অর্থাৎ নিজেকে অন্য পিতার সন্তান বলে পরিচয় দেয়, তার জন্য জান্নাত হারাম।’ (বোখারি : ৬২৬৯)।

দুনিয়াবি উদ্দেশে ইলম অর্জনকারী 
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা হয় সে ইলম যে ব্যক্তি দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ-সম্পদ হাসিলের উদ্দেশে শিক্ষা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (আবু দাউদ : ৩১৭৯)।

গর্ব-অহংকারকারী 
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ১৩১)।

নবীজির নাফরমানি 
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার সব উম্মত জান্নাতে যাবে; কিন্তু সে ব্যক্তি নয়, যে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করেছে। সাহাবিরা আরজ করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কে অস্বীকার করেছে? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার নাফরমানি করে, সে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করেছে।’ (বোখারি : ৬৭৩৭)।

অকারণে তালাক কামনাকারী নারী 
সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে নারী তার স্বামীর কাছে অকারণে তালাক কামনা করে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।’ (তিরমিজি : ১১০৮)।

কালো কলপ ব্যবহারকারী 
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শেষ যুগে কিছু লোক কবুতরের সিনার মতো কালো কলপ ব্যবহার করবে। তারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (নাসায়ি : ৪৯৮৮)।

ওয়ারিশকে বঞ্চিতকারী 
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করল, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন।’ (মাজাহ : ২৬৯৪)।

লৌকিকতা প্রদর্শনকারী 
আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদকে ডাকা হবে। অতঃপর একজন কারিকে। তারপর একজন দানশীল ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। প্রত্যেককে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অতঃপর শহীদকে বাহাদুর খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করার অপরাধে, কারিকে বড় কারির খ্যাতি লাভের জন্য কেরাত শেখার অপরাধে এবং দানশীলকে বড় দাতা উপাধি লাভের নিয়তে দান-সদকা করার অপরাধে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ৩৫২৭)।

৪. আরাফবাসীদের অবস্থা 
যাদের পাপ-পূন্য সমান হবে তারা না যেতে পারবে জান্নাতে যা পড়বে জাহান্নামে। তারাই আরাফবাসী। 

জাহান্নাম ও জান্নাতের মধ্যভাগে একটা পর্দা থাকবে যা জাহান্নামীদের জন্যে জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধক হবে। যেমন, আল্লাহ পাক বলেনঃ “ও দু'টোর মাঝখানে একটি প্রাচীর স্থাপন করা হয়েছে, যার ভিতরের দিকে একটি দরজা আছে, যাতে রহমত রয়েছে এবং ওর বাইরের দিকে রয়েছে শাস্তি।” ওটাই হচ্ছে আরাফ। এর সম্পর্কেই বলা হয়েছে যে, আরাফের উপর কতকগুলো লোক থাকবে। সুদ্দীর (রঃ) বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহ পাকের “ও দু’টোর মাঝে একটি পর্দা রয়েছে”- এই উক্তিতে যে পর্দা কথাটি রয়েছে এটা দ্বারা আ'রাফকেই বুঝানো হয়েছে। 

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যভাগে একটি টিলা বা ছোট পাহাড় রয়েছে। সেখানেও মানুষ অবস্থান করবে। তারা। পাপী। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, আ'রাফে অবস্থানকারী লোকেরা নিজেদের লোকদেরকে চিনতে পারবে বলেই ঐ জায়গার নাম আ'রাফ রাখা হয়েছে। আরাফবাসীদের ব্যাপারে মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রূপ। সবগুলোরই অর্থ প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ তারা হচ্ছে ঐসব লোক যাদের পাপ ও পুণ্য সমান সমান। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- “যাদের পাপ ও পুণ্য সমান সমান হবে তারা কোথায় থাকবে?” উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ “এরাই হচ্ছে আরাফবাসী। তাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করা হবে না বটে, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশের আশা অবশ্যই করবে।” এই ধরনেরই আর একটি প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আরাফের এই অধিবাসীরা হচ্ছে ওরাই যারা পিতা মাতার অনুমতি ছাড়াই আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে বের হয়েছিল এবং শহীদ হয়েছিল। তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখার কারণ এই যে, তারা পিতা মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। আর জাহান্নাম থেকে এজন্যে বাঁচানো হয়েছে যে, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিল।” 

ইবনে কাসীরে আছে, আর একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এরা হচ্ছে ঐ সব লোক যাদের পুণ্য ও পাপ সমান সমান ছিল। পাপগুলো তাদের জান্নাতে প্রবেশের পথে প্রতিবন্ধক হয়েছে এবং পুণ্যগুলো জাহান্নাম হতে রক্ষা করেছে। এখন লোকগুলো সেই প্রাচীরের পার্শ্বেই অবস্থান করছে এবং আল্লাহ তা'আলার ফায়সালা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবে। তাদের দৃষ্টি যখন জাহান্নামবাসীদের উপর পড়বে তখন তারা বলবেঃ হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এই যালিমদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। এভাবেই তারা দু'আ করতে থাকবে। অবশেষে মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেনঃ আচ্ছা, যাও, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। 

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন- আরাফবাসীর ফায়সালা হবে সর্বশেষে। সমস্ত বান্দার ফায়সালা করার পর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সম্বোধন করে বলবেনঃ “হে আ'রাফবাসীগণ! তোমাদের পূণ্যগুলো তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তোমাদেরকে জান্নাতের অধিবাসী করতে পারেনি। এখন তোমরা আমার আযাদকৃত হয়ে যাও। যেভাবেই চাও জান্নাত দ্বারা উপকৃত হও।”

৫. জাহান্নাম থেকে জান্নাত 
কোনো ব্যক্তি যদি ঈমান আনার পর আমল না করে; বরং গুনাহর ভেতরে ডুবে থাকে তাহলে সে তাওবা করলে আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন আর তিনি ইচ্ছা করলে তাকে অপরাধ অনুপাতে শাস্তিও দিতে পারেন। হ্যাঁ, যদি সে শাস্তির উপযুক্ত হয় এবং জাহান্নামে যায় তাহলে সে অমুসলিমদের মত চিরকালের জন্য জাহান্নামে পড়ে থাকবে না। যেমন এ মর্মে হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

ঐ ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করে আনা হবে, যে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং তার অন্তরে একটি যবের পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট আছে। এরপর তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে, যে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং তার অন্তরে সামান্য একটি গমের পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট আছে। এরপর তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে, যে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই আর তার অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট আছে। (বুখারী ৬৮৬১ মুসলিম ২৮৫)

সহীহ হাদীসগুলোতে জান্নাত থেকে জাহান্নামে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে অনেক হাদীস উল্লেখ রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করুন। বিনা হিসেবী মানুষদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমিন।