৭ জানু, ২০২০

নেতৃত্ব তৈরির কারিগর এ কে এম নাজির আহমদ



কিছু মানুষ আছেন যারা সামনে আসেন না, কিন্তু সামনে থাকা মানুষদের তৈরি করেন এমনই একজন হলেন নাজির আহমদ। লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্র, শিক্ষক তথা সর্বস্তরের মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটানোই যার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য, দুনিয়ার লোভনীয় বৈষয়িক আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে যিনি সদা সচেষ্ট, কুরআন হাদীস তথা ইসলামী সাহিত্যে যার রয়েছে গভীর পান্ডিত্য, যিনি দুনিয়ার ঝামেলায় মোটেই নিজেকে জড়াতে চান না, প্রতিনিয়ত যিনি নিজেকে গর্হিত কাজ থেকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেন এবং আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, কথা ও কাজে মিল রেখে জীবনযাপন করছেন তিনি হলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক নাজির আহমদ। কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করে যারা নির্লোভ, নিরহংকার, গোপনে থেকে আল্লাহ প্রদত্ত মেধা, যোগ্যতা, সততা ও শ্রম দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এই বাগানকে গড়ার কাজেই রত থাকেন। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা ইসলামী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক একেএম নাজির আহমেদ।

আল্লাহভীরু নেতা জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দিয়েছিলেন অক্ষরে-অক্ষরে। তাঁর দারসুল কুরআন এবং আসহাবে রাসূলের জীবনের উপরে আলোচনা সত্যিই ছিল ব্যতিক্রম। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকেই ছিলেন তাঁরই হাতে গড়া মানুষ।

শৈশব ও শিক্ষা 
অধ্যাপক একেএম নাজির আহমদ ১৯৩৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানার অন্তর্গত আড্ডা ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম- ওমর আলী ভূঁঞা এবং মাতার নাম- গোলাপ জাহান। তিনি নিজ গ্রামে পিতৃগৃহে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর স্থানীয় আড্ডা হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। বরাবরই তিনি ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯৫৭ সালে প্রথম বিভাগেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর ১৯৫৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. অনার্স ও ৬৩ সালে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. পাস করেন। তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন।

ইসলামী আন্দোলনে পদচারণা
সমাজের মাঝে ইসলামের সুমহান আদর্শ পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি অগ্রভাগে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন। নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন ছাত্রনেতা তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রিয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি মুসলিম ছাত্র মজলিসের সভাপতি এ.কে.এম. হাবীবুর রহমান ও জেনারেল সেক্রেটারী শাহ আবদুল হান্নানের নিকট ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান। অতঃপর অধ্যাপক সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন। উল্লেখ্য সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী তদানিন্তন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। উল্লেখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তার জীবনে সাইয়্যেদ সাহেব এক বিরাট প্রভাব ফেলেন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। মূলত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী ছিলেন তার ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের শিক্ষাগুরু। প্রথমতঃ তিনি ১৯৬০ সালে মুসলিম ছাত্র মজলিসে যোগদান করেন, পরে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ‘৬২ সালে ছাত্র সংঘের সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় ছাত্র অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্র হিসাবে আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৫ সালের শেষ দিকে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং’৬৬ সালেই সদস্য পদ লাভ করেন। অতপর ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর কুমিল্লা জিলার আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। 

বৈবাহিক জীবন 
১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর বরুড়া থানার অর্জুনতলার মিঞা বাড়ীতে তিনি বিবাহ করেন। তার স্ত্রীর নাম মনোয়ারা বেগম। তাদের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে।

কর্মজীবন 
ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর তিনি নিজেকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত করেন এবং ’৭৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন। কর্মজীবনে তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা কলেজ ও আবুজার গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৯ সালের শেষভাগে ইসলামী গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন এবং ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে সুষ্ঠুভাবে উক্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

সাংগঠনিক জীবন 
তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নায়েবে আমীর এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য। ১৯৬০ সালে ছাত্র জীবনেই ইসলামী আন্দোলনে জড়িত হন। তিনি ১৯৬৫ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৬৭ সালে কুমিল্লা জেলা জামায়াতের আমীর নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সর্বশেষে ২০০৯ সাল থেকে নায়েবে আমীর হিসেবে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে বরুড়া থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন প্রচার বিমুখ ব্যক্তি, বর্হিমুখী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজের চেয়ে আদর্শ মানুষ গড়ার কাজে স্বীয় চিন্তা ও যাবতীয় কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন বেশি।

ইসলামী আন্দোলনের কঠিন সময়ে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আওয়ামী সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যখন কারাগারে বাকী নেতৃবৃন্দ যখন মামলা-হামলার কারণে প্রকাশ্য ময়দানে আসতে পারছে না তখন মাঠে থেকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সম্মানে ইফতার মাহফিল, কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে জামায়াতে ইসলামী মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বক্তব্যের ভাষা ছিল সংক্ষিপ্ত, প্রচন্ড শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত ও নেতা-কর্মীদের জন্য প্রেরণাদায়ক।

সাহিত্যকর্ম 
মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করে আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ গড়ার লক্ষ্যে তিনি অনকগুলো বই লিখেছেন। অধ্যাপক একেএম নাজির আহমদ ইসলামী সাহিত্যের অনবদ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। বড় বড় ইতিহাস ও জ্ঞানগর্ভ বিষয়সমূহ তিনি অতি সংক্ষেপে লিখেছেন। এটা তার বিরাট কৃতিত্ব যে, তিনি অতি বড় জিনিসও সংক্ষেপে পেশ করতে ও লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন। তাঁর লিখিত বইগুলো পড়লেই তা সহজে বুঝা যায়। বইগুলো হৃদয়গ্রাহী এবং চিন্তার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক ও উপযোগী। তাঁর ছোট ছোট বিষয় ভিত্তিক বইগুলো পাঠকদের কাছে শিক্ষকের মত ভূমিকা রাখে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত বই সংখ্যা ৩৬টি। তাঁর লিখিত বই সারা বিশ্বে ইসলামী আন্দোলনের পাঠকদের কাছে সমাদৃত। পাশাপাশি তিনি হাদীসগ্রন্থ, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরিফ, নাসাঈ শরীফ ও রিয়াদুস সালেহীন সহ বিভিন্ন উৎস গ্রন্থ বিশুদ্ধ বাংলায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর অনুবাদ ইসলামী সাহিত্যাঙ্গনকে করেছে সমৃদ্ধ। 

তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হলো- আল্লাহর দিকে আহবান, ইসলামী সংগঠন, আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা.), মহানবীর মহান আন্দোলন, যুগে যুগে ইসলামী জাগরণ, ইসলামী জাগরণের তিন পথিকৃত, বাংলাদেশের ইসলামের আগমন, আল্লাহর পরিচয়, দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, দ্বীন প্রতিষ্ঠার সঠিক পদ্ধতি, ইসলামের সোনালী যুগ, উসমানী খিলাফতের ইতিহাস ও সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। এছাড়া তিনি বেশ কিছু বই অনুবাদ করেছেন।- কালজয়ী আদর্শ ইসলাম (সাইয়েদ কুতুব), অনাগত মানব সভ্যতা ও ইসলাম (সাইয়েদ কুতুব), পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎস (আবদুল হামীদ সিদ্দিকী), ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি (অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ) ইত্যাদি। এদিকে তিনি ইসলামিক সেন্টারের গবেষণা সেলের মাধ্যমে সমসাময়িক বিষয়ের উপর দেশে খ্যাতনাম লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে অসংখ্য গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। দেশে-বিদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে পুরাতন ও ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা পত্রিকা ‘মাসিক পৃথিবী’ সর্বাধিক প্রচারিত ও সমাদৃত। ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কলম’ তাঁর অবদানের সাক্ষর হয়ে আছে। শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সব মিলিয়ে তাঁর লিখিত মৌলিক গ্রন্থ-পুস্তিকা প্রায় শতাধিক। ইসলামী আন্দোলনের এই মহান দিকপাল তাঁর রচিত সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের মাঝে জাগরুক থাকবেন শতাব্দী থেকে শতাব্দীকাল। মুসলিম উম্মাহর জন্য তিনি হয়ে থাকবেন প্রেরণার বাতিঘর। আল্লাহভীরু নেতা জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দিয়েছিলেন অক্ষরে-অক্ষরে। তাঁর দারসুল কুরআন এবং আসহাবে রাসূলের জীবনের উপরে আলোচনা সত্যিই ছিল ব্যতিক্রম। 


মৃত্যু 
২০১৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁর ছেলের গ্রেফতারের সংবাদ শুনে তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন। তাঁকে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দশদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ৭ জানুয়ারি ২০১৪, মঙ্গলবার রাত ১১টা ১০ মিনিটে এ নির্মোহ জ্ঞানসাধক মহান মনিবের দরবারে হাজির হন। পরদিন বাদ জোহর মিরপুর বায়তুল আমান জামে মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের জ্যেষ্ঠ জামাতা জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম। অতঃপর মিরপুর-১১ কবরস্থানে অন্তিম শয়ানে সমাহিত করা হয় আল্লাহর এই গোলামকে।

- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইট থেকে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন