আলী রা. যখন শাহদাত বরণ করেন তখন পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন তাঁরই ছেলে হাসান বিন আলী রা.। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব নিলে তৎকালীন আরবের লেবান্ট অঞ্চলের (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন) শাসক মুয়াবিয়া রা. পূর্বের মতোই বিদ্রোহ করেন। তখন খিলাফতের রাজধানী ছিল ইরাকে। মুয়াবিয়া রা. ইরাক অভিমুখে সেনা পরিচালনা করলে হাসান রা.ও তার সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন।
তবে হাসান রা. যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন বলে মনে হয় না। মুয়াবিয়া রা.-এর পক্ষ থেকে আপোষ প্রস্তাব এলে তিনি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তাতে রাজি হয়ে যান। যদিও তার ছোট ভাই হুসাইন রা. ও সেনারা এটা সহজে মানতে পারেন নি। যাই হোক, যেহেতু খলিফা হাসান রা. মুয়াবিয়া রা.-এর পক্ষে নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন তাই না মেনে আর উপায় ছিল না। এরপর মুয়াবিয়া রা. কুফা অর্থাৎ রাজধানীতে প্রবেশ করলেন ও জনগণের সামনে ভাষণ দিলেন।
এসময় আমর ইবনুল আস রা. মুয়াবিয়া রা.-কে ইশারা করলেন যাতে হাসান রা.-কে বক্তব্যের সুযোগ দেওয়া হয়। মুয়াবিয়া রা. হাসান রা.-এর নাম ঘোষণা করলেন। আমর ইবনুল আস রা. ও মুয়াবিয়া রা.-এর আশা ছিল হাসান রা. জনগণকে মুয়াবিয়া রা.-এর আনুগত্যের দিকে আহ্বান জানাবেন। হাসান রা. জনগণকে বললেন, আমরা রক্তপাত বন্ধ করেছি। যুদ্ধ থেকে নিজেদের বাঁচিয়েছি। দুনিয়া খুব অল্প সময়ের। আল্লাহ তায়ালা এসময়ে মানুষকে নানানভাবে পরীক্ষা করেন। কাউকে ক্ষমতা দিয়ে কাউকে ক্ষমতা না দিয়ে। এরপর তিনি সূরা আম্বিয়ার ১১১ নং আয়াত তিলওয়াত করেন।
এতটুকু বক্তব্যেই ক্ষেপে যান মুয়াবিয়া রা.। তিনি ধমক দিয়ে হাসান রা.-কে বসিয়ে দেন। এরপর হাসান রা.-এর অনুসারীরা আরো নিশ্চিত হলো মুয়াবিয়া রা. চুক্তি রক্ষা করবেন না। হলোও তাই। হাসান রা. খুব সহজে সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে সন্ধির চুক্তিগুলোও লিপিবদ্ধ হয়নি। চুক্তি প্রতিপালন তো দূরের কথা। এই ব্যাপার নিয়ে হাসান রা. তার অনুসারীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছেন। যদিও হাসান রা.-এর সিদ্ধান্তে উম্মাহ রক্তপাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তারপরও তার অনুগতরাই তাকে মুমিনের মুখে কালিমা লেপনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হাসান রা. তখন নবিজীর একটি হাদিসের কথা উল্লেখ করে আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন। একবার রাসূল সা. স্বপ্নযোগে দেখতে পেলেন তাঁর জন্য স্থাপিত মিম্বরে উঠে গেছে উমাইয়া বংশের লোকেরা। তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। এটা সেসময়ের ঘটনা যখন মুহাম্মদ সা. রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। তিনি তখনো মক্কায়। মুহাম্মদ সা. বুঝতে পারলেন তাঁর স্থাপিত ইসলামী রাষ্ট্র একটি বংশের কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। তিনি দুঃখ পেলেন। একইসাথে এও জানতে পারলেন এই বংশ ১০০০ মাস রাজত্ব করবে।
স্বপ্ন দেখার পর বিষণ্ণ মুহাম্মদ সা.-কে পুরস্কার দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। তিনি সূরা কদর নাজিল করে জানালেন, আর মহিমান্বিত রাত প্রসঙ্গে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস হতেও উত্তম”।
হাসান রা. মুআবিয়া রা.-এর নিকট বাই’আত গ্রহণের পর তাঁর সামনে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি (মুআবিয়ার নিকট বায়’আত গ্রহণ করে) মু’মিনদের চেহারা কলঙ্কিত করেছেন। এতে তিনি বললেন, তুমি আমাকে অভিযুক্ত করো না। আল্লাহ তা’আলা তোমার প্রতি রহমত করুন।
যেহেতু রাসূলুল্লাহ সা.-কে স্বপ্নে উমাইয়্যা বংশীয়দেরকে তাঁর মিম্বারের ওপর দেখানো হয়েছে। বিষয়টি তাঁর নিকট খারাপ লাগে। তখন অবতীর্ণ হয়, “আমি অবশ্যই তোমাকে কাওসার (ঝরণা) দান করেছি” (সূরাঃ আল-কাওসার-১) অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! আমি জান্নাতে তোমাকে কাওসার নামক ঝরণা দান করেছি। আরো অবতীর্ণ হয়, “নিশ্চয় আমি এ কুরআন মহিমান্বিত রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর মহিমান্বিত রাত প্রসঙ্গে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস হতেও উত্তম” (সূরাঃ আল-ক্বাদর-১-৩)।
হাসান রা. বুঝাতে চেয়েছেন, উমাইয়ারা ক্ষমতা দখল করবে এটা নির্ধারিত, তাই সন্ধি করে আমি রক্তপাত বন্ধ করতে চেয়েছি।
যাই হোক হাসান রা. ও মুয়াবিয়া রা.-এর মধ্যে চুক্তি লিখিত না হওয়ায় এর সঠিক শব্দগুলো পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা যায় তা হলো,
১. মুয়াবিয়া রা.-কে হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপবাদ ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।
২. মুয়াবিয়া রা.-কে বাদশাহী আচার-আচরণ পরিহার করতে হবে।
৩. জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোকে অর্থ সাহায্য দিতে হবে।
৪. মুয়াবিয়া রা. কোনো ব্যক্তিকেই (খেলাফতের জন্য) নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করতে পারবেন না। পরবর্তী খলিফা নির্ধারিত হবে শুরা কর্তৃক নির্বাচিত।
৫. মুয়াবিয়া রা.-এর মৃত্যুকালে হাসান রা. জীবিত থাকলে খেলাফতের উত্তরসূরি হবেন হাসান রা.।
আমরা ইতিহাস থেকে দেখতে পাই মুয়াবিয়া রা. কর্তৃক এই চুক্তিগুলোর মধ্যে ৩ নং ছাড়া কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। ইমাম হাসান তিনবার বিষপ্রয়োগের শিকার হলেন। প্রথম দুইবার সুস্থ হলেও তৃতীয়বারে তিনি শহীদ হন। প্রায়ই জুমুআর খুতবায় আলী রা.-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ও অভিশম্পাত করা হতো। এর বিরুদ্ধে কথা বলায় হুজর বিন আদি রা.-কে খুন করেন। একই ঘটনায় আলী রা.-এর ভাই আকিল রা.-কেও হত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি এক গুহায় মৃত্যবরণ করলে মুয়াবিয়া রা.-এর সৈন্যরা তাঁর মাথা কেটে মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে পাঠিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া রা. আকিল রা.-এর মাথা সিরিয়ার রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শনী করেন। এরপর বন্দি থাকা আকিল রা.-এর স্ত্রীর কাছে তা প্রেরণ করেন।
শর্ত ছিল বাদশাহী আচরণ পরিহার করার। মুয়াবিয়া রা. নিজেকে ইসলামের প্রথম বাদশাহ হিসেবে দাবি করতেন। এর আগেও উমার রা.-এর খিলাফতকালে এই আচরণের জন্য তাকে বেত্রাঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তার জীবদ্দশায় তারই পুত্র ইয়াজিদকে খেলাফতের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নেতাদের কাছ থেকে ইয়াজিদের পক্ষে বাইয়াত আদায় করেন। ৫ম শর্ত কার্যকর করার সুযোগ ছিল না কারণ তার আগেই হাসান রা. শাহদাতবরণ করেন। হাসান রা.-এর শাহদাতের ব্যাপারে উমাইয়াদের অনেকে দায়ি করলেও সুনির্দিষ্ট প্রমান হাজির করতে পারে নি।
ইয়াজিদ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি খলিফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। শুরা দ্বারা খলিফা নির্বাচনের ব্যাপার হলে তার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হতো না। তিনি ইসলামের বেসিক জ্ঞান, ইনসাফ ও আদল তো দূরের কথা তিনি নামাজ ছেড়ে দিতেন। মদ পান করতেন ও প্রেমাসক্ত কবিতা লিখতেন। হাসান বসরি রহ. চার কারণে মুয়াবিয়া রা. এর শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করতেন। ১. খলিফা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তথা হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ২. হুজর বিন আদি রা.-কে খুন ৩. জিয়াদ বিন আবিহকে নিজের পিতার ঔরশভুক্ত করে নেওয়া (যা হারাম করা হয়েছে সূরা আহজাবের ৫ নং আয়াতে)। ৪. নিজের মদ্যপায়ী সন্তানের অনুকূলে খলিফা হিসেবে বাইয়াত নেওয়া।
এখানে একটা বিষয় দ্রষ্টব্য যে, যে কারনে মুয়াবিয়া রা. ইসলামের ৪র্থ খলিফা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল সে কারণটা তার পুরো শাসনামলে উপেক্ষিত ছিল। তিনি বিশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরমধ্যে তিনি একবারও ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান বিন আফফান রা.-এর হত্যার বিচারে উদ্যোগী হননি।
কারবালার ঘটনার জন্য সবচেয়ে গুরুতর দায়ী ব্যাপার হলো ইয়াজিদকে ক্ষমতার উত্তরাধিকার করে যাওয়া। এই ব্যাপারে মুগিরা বিন শু'বা রা.-এর ভূমিকা রয়েছে। মুআবিয়া রা. তাকে কুফার গভর্নরের পদ থেকে বরখাস্ত করার কথা চিন্তা করছিলেন। তিনি এ বিষয়ে অবহিত হলেন। তৎক্ষণাৎ কুফা থেকে দামেশকে পৌঁছে ইয়াজিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘শীর্ষ স্থানীয় সাহাবী এবং কুরাইশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি বুঝতে পারছি না আমীরুল মুমিনীন তোমার পক্ষে বায়আত গ্রহণের কেন বিলম্ব করছেন!’ ইয়াজীদ তাঁর পিতার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।
মুয়াবিয়া রা. মুগিরা রা.-কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ইয়াজিদকে কী বলেছো? মুগিরা রা. জবাব দেন, ‘আমিরুল মুমিনীন! হযরত ওসমান রা.-এর হত্যার পর যত মতবিরোধ এবং খুন-খারাবী হয়েছে, তা আপনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। কাজেই এখন আপনার জীবদ্দশায়ই ইয়াজীদকে স্থলাভিষিক্ত করে বাইয়াত গ্রহণ করাই আপনার জন্য উত্তম। ফলে আল্লাহ না করুন যদি আপনার কখনো কিছু হয়ে যায়, তাহলে অন্তত মতবিরোধ দেখা দেবে না।’
মুয়াবিয়া রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কাজ করার দায়িত্ব কে নেবে? জবাবে তিনি বললেন, আমি কুফারবাসীদের সামলাবো; আর জিয়াদ বসরাবাসীদেরকে। এরপর বিরোধিতা করার আর কেউ থাকবে না।’ এ কথা বলে মুগিরা রা. কুফা গমন করেন এবং দশজন লোককে ৩০ হাজার দিরহাম দিয়ে একটি প্রতিনিধি দলের আকারে মুয়াবিয়া রা.-এর নিকট গমন করে ইয়াজীদের স্থলাভিষিক্তের জন্য তাঁকে বলতে সম্মত করেন। মুগিরা রা.-এর পুত্র মুসা ইবনে মুগিরার নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দল দামেস্কে গমন করে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে। পরে মুয়াবিয়া রা. মুসাকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার পিতা এদের নিকট থেকে কত মূল্যে এদের ধর্ম ক্রয় করেছেন? তিনি বললেন ৩০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে। মুয়াবিয়া রা. বলেন, তাহলে তো এদের ধর্ম এদের দৃষ্টিতে নিতান্ত নগণ্য।
অতঃপর মুআবিয়া রা. বসরার গভর্নর যিয়াদকে লিখেন, এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী? তিনি ওবায়েদ ইবনে কাআবকে ডেকে বলেন, আমিরুল মুমিনীন এ ব্যাপারে আমাকে লিখেছেন। আমার মতে ইয়াজীদের মধ্যে অনেকগুলো দুর্বলতা রয়েছে। তিনি দুর্বলতাগুলো উল্লেখ করেন। অতঃপর বলেন, তুমি আমীরুল মুমিনীনের কাছে গিয়ে বলো যে, এ ব্যাপারে যেন তাড়াহুড়ো না করা হয়।
ওবায়েদ বলেন, আপনি মুআবিয়া রা.-এর ইচ্ছের বিরোধীতা করবেন না। আমি গিয়ে ইয়াজিদকে বলবো যে, আমীরুল মুমিনীন এ ব্যাপারে আমীর যিয়াদের পরামর্শ চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, জনগণ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে। কারণ, তোমার কোনো কোনো আচার-আচরণ জনগণ পছন্দ করে না। তাই আমীর যিয়াদের পরামর্শ এই যে, তমি এ সব বিষয় সংশোধন করে নাও, যাতে কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে। যিয়াদ এ মত পছন্দ করেন। ওবায়েদ দামেস্ক গমন করে এক দিকে ইয়াজীদকে তাঁর ব্যক্তিগত আচার-আচরণ সংশোধনের পরামর্শ দেন আর অপর দিকে হযরত মুআবিয়া রা.-কে বলেন, আপনি এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না।
বসরার গভর্নর জিয়াদের মৃত্যুর পর মুআবিয়া রা. ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রভাবশালী লোকদের সমর্থন লাভের চেষ্টা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা.-এর নিকট এক লক্ষ দিরহাম পাঠিয়ে ইয়াজিদের বাইয়াতের জন্য তাঁকে সম্মত করাবার চেষ্টা করেন। আব্দুল্লাহ রা. বলেনঃ ‘ওহো, এ উদ্দেশ্যে আমার জন্য এ টাকা পাঠানো হয়েছে। তা হলে তো আমার দ্বীন আমার জন্য খুবই সস্তা।’ এ বলে তিনি টাকা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
এরপর হযরত মুআবিয়া রা. মদিনার গভর্নর মারওয়ান ইবনুল হাকামকে লিখেন, ‘আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার জীবদ্দশায়ই কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতে চাই। মারওয়ান বিষয়টি মদিনাবাসীদের সামনে উত্থাপন করে মসজিদে নববীতে ভাষণ দান করেন। তিনি বলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন তোমাদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি সন্ধান করার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করেননি। তিনি নিজে পুত্র ইয়াজিদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এটা একটা চমৎকার সিদ্ধান্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি নিজ পুত্রকে স্থলাভিষিক্ত করেছেন, এটা কোন নতুন কথা নয়। আবুবকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)-ও স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেছিলেন।’
এতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. উঠে দাঁড়িয়ে বলেনঃ ‘মারওয়ান! তুমি মিথ্যা বলেছো। আর মিথ্যা বলেছে মুআবিয়াও। তোমরা কখনো উম্মাতে মুহাম্মদীয়ার কল্যাণের কথা চিন্তা করোনি। তোমরা একে ‘কায়সারতন্ত্রে’ রূপান্তিরত করতে চাও। একজন কায়সর মারা গেলে তার পুত্র তার স্থান দখল করে। এটা আবুবকর ও ওমরের নীতি নয়। তাঁরা আপন সন্তানকে স্থলাভিষিক্ত করেননি।’ মারওয়ান বলেনঃ ‘ধরো একে’। এ ব্যক্তি সম্পর্কেই তো কুরআনে বলা হয়েছে, وَالَّذِى قَالَ لِوٰلِدَيْهِ أُفٍّ لَّكُمَآ (যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে বলেছে, অভিশাপ তোমাদের জন্য।)
আব্দুর রহমান রা. মসজিদে নববি থেকে উঠে গিয়ে বোন আয়িশা রা.-এর ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত আয়েশা রা.ও বলেন, ‘মিথ্যা বলেছে মারওয়ান। আমাদের খান্দানের কারো প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। বরং যার প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আমি ইচ্ছা করলে তার নাম বলতে পারি। অবশ্য মারওয়ান যখন পিতার ঔরসে, তখন রাসুলুল্লাহ সা. তার পিতার ওপর অভিশাপ দিয়েছেন।’
মজলিসে উপস্থিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আবদুর রহমান ইবনে আবুবকর রা.-এর মতো হুসাইন ইবনে আলী রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. ইয়াজিদের খলিফার উত্তরাধিকার মেনে নিতে অস্বীকার করেন।
এ সময়ে মুআবিয়া রা. বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের তলব করে বিষয়টি তাদের সামনে উত্থাপন করেন। জবাবে সকলেই তোষামোদমূলক বক্তব্য পেশ করে। কিন্তু আহনাফ ইবনে কায়েস রা. নীরব থাকেন। মুয়াবিয়া রা. জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আবু বাহর, তোমার কী মত?’ তিনি বলেনঃ ‘সত্য বললে আপনার ভয়, আর মিথ্যা বললে আল্লার ভয়। আমীরুল মুমিনীন, আপনি ইয়াজীদের দিন-রাত্রির চলাফেরা ওঠা-বসা, তার ভিতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে ভালভাবেই জানেন। আল্লাহ এবং এ উম্মতের জন্য সত্যিই তাকে পসন্দ করে থাকলে এ ব্যাপারে আর কারো পরামর্শ নেবেন না। আর যদি তাকে এর বিপরীত মনে করে থাকেন, তাহলে আখেরাতের পথে পাড়ি দেবার আগে দুনিয়া তার হাতে দিয়ে যাবেন না। আর বাকী রইলো আমাদের ব্যাপার; যা কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়, তা শোনা এবং মেনে নেয়াইতো আমাদের কাজ।’
ইরাক, শাম এবং অন্যান্য এলাকা থেকে বায়আত গ্রহণ করে হযরত মুআবিয়া রা. মদিনায় যান। মুসলিম জাহানের যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিরোধিতার আশংকা ছিল, তাঁরা সকলেই ছিলেন সেখানে। মদিনায় হযরত হুসাইন রা., হযরত ইবনে যুবায়ের রা., হযরত ইবনে ওমর রা. এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
মুআবিয়া রা. তাদের সাথে এমন কঠোর আচরণ করেন যে, তাঁরা শহর ত্যাগ করে মক্কা চলে যান। এভাবে মদিনার ব্যাপারটি সহজ হয়ে যায়। এরপর তিনি মক্কা গমন করে তাদেরকে শহরের বাইরে ডেকে এনে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। এবারের আচরণ ছিল আগের থেকে ভিন্ন। তাঁদেরকে সাথে নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। অতঃপর তাঁদেরকে একান্তে ডেকে ইয়াজীদের বাইআতে তাদেরকে রাজি করাবার চেষ্টা করেন।
হযরত আবুদল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. জবাবে বলেন, ‘আপনি তিনটি কাজের যে কোনো একটি করুন। হয় নবী করীম সা.-এর মতো কাউকে স্থলাভিষিক্ত-ই করবেন না, জনগণ নিজেরাই কাউকে খলীফা বানাবে, যেমন বানিয়েছিল হযরত আবুবকর রা.-কে। অথবা আবুবকর রা. যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন সে পন্থা অবলম্বন করুন। তিনি স্থলাভিষিক্তের জন্য উমার রা.-এর মতো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনীত করেছিলেন, যাঁর সাথে তাঁর দূরতম কোন আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল না। অথবা হযরত ওমর রা.-এর পন্থা অবলম্বন করুন। তিনি ৬ ব্যক্তির পরামর্শ সভার প্রস্তাব দেন। এ পরামর্শ সভায় তাঁর সন্তানদের কেউ ছিলেন না।’
হযরত মুআবিয়া রা. অবশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা কি বলেন?’ তাঁরা বলেন, ‘ইবনে যুবায়ের যা বলেছেন, আমাদের বক্তব্যও তাই।’ এরপর হযরত মুআবিয়া রা. বলেন, এতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে এসেছি। এবার আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, ‘আমার কথার জবাবে তোমাদের কেউ যদি একটি কথাও বলে, তাবে তার মুখ থেকে পরবর্তী শব্দটি প্রকাশ করার অবকাশ দেওয়া হবে না। সবার আগে তার মাথায় তরবারী পড়বে।’
অতঃপর মুয়াবিয়া রা. তার রক্ষীবাহিনীর প্রধান কর্মকর্তাকে ডেকে নির্দেশ দেন, ‘এদের প্রত্যেকের জন্য একজন লোক নিয়োগ করে তাকে বলে দাও যে, এদের কেউ আমার মতের বিপক্ষে মুখ খুললে তার মস্তক যেন নামিয়ে দেওয়া হয়।’ তারপর তিনি তাদেরকে নিয়ে কা'বার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘এরা মুসলমানদের স্থলাভিষিক্তে সন্তুষ্ট এবং এরা বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করেছেন। সুতরাং তোমরাও বাইয়াত করো।’ এক্ষেত্রে লোকদের পক্ষে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ ছিল না। কাজেই মক্কাবাসীরাও সবাই ইয়াজিদের অনুকূলে বাইয়াত করে।
মুআবিয়া রা. যথার্থই বিপুল গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সাহাবী হওয়ার মর্যাদাও অতীব সম্মানিত। অবশ্য তিনি মক্কা বিজয়ের পর তার পিতা আবু সুফিয়ান ও মা হিন্দার সাথে মুসলিম হন। মক্কা বিজয়ের পরের সাহাবি হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার যোগ্যতার বলে দ্রুতই ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসীন হন। তিনি মুসিলিম জাহানকে পুনরায় এক পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিশ্বে ইসলামের বিজয়ের গতি পূর্বের চাইতেও দ্রুত করতে সক্ষম হন। তাঁর এসব খেদমতও অনস্বীকার্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন