২৯ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৯ - মুনাফিকদের সর্বশেষ কার্যকর আক্রমণ ও আল্লাহর সাহায্য


বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার সময় আমাদের মা আয়িশা রা.-এর জীবনে একটি ছোট দুর্ঘটনা ঘটে। এটি মুনাফিকেরা বড় করে ফেলে। এবং এর ফলে মুহাম্মদ সা. ও আয়িশা রা. এর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর মুমিনরা এই ধরণের ফিতনায় বেশ বিব্রত হয়ে পড়েন। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে এই বিপদ কেটে যায়।

আসুন আমরা সেই ঘটনা ভিকটিমের মুখেই শুনি। আয়িশা রা. বলেন,
সফরে যাওয়ার সময় তিনি (রাসূল সা.) তাঁর স্ত্রীদের নামে লটারী ফেলতেন। লটারীতে যার নাম উঠতো তাকে তিনি সাথে নিয়ে যেতেন। ঘটনাক্রমে বনু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমনের সময় লটারীতে আমার নাম ওঠে। আমি তাঁর সাথে গমন করি। আমি আমার পালকিতে বসে থাকতাম। যখন কাফেলা কোনো জায়গায় অবতরণ করতো তখন আমার পালকি নামিয়ে নেওয়া হতো। আমি পালকিতেই থাকতাম। আবার যখন কাফেলা চলতে শুরু করতো তখন আমার পালকি উটের ওপর উঠিয়ে দেয়া হতো।

যাই হোক যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর আমরা মদিনার পথে ফিরতে শুরু করি। আমরা মদীনার নিকটবর্তী এক স্থানে পৌঁছলে রাত্রে যাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ভোরে আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি এবং সেনাবাহিনীর তাবু থেকে বহু দূরে চলে যাই। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করে আমি আবার ফিরে আসি। সেনাবাহিনীর তাঁবুর নিকটবর্তী হয়ে আমি গলায় হাত দিয়ে দেখি যে, গলায় হার নেই। আমি তখন হার খুঁজবার জন্যে আবার ফিরে যাই এবং হার খুঁজতে থাকি।

এদিকে সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে দিলো। যে লোকগুলো আমার পালকি উঠিয়ে দিতো তারা মনে করলো যে, আমি পালকির মধ্যেই রয়েছি, তাই তারা আমার পালকিটি উটের পিঠে উঠিয়ে দিলো এবং চলতে শুরু করলো। এখানে উল্লেখ্য যে, আমি খুবই শীর্ণকায় ও হালকা ছিলাম। তাই আমাকে বহনকারীরা পালকির মধ্যে আমার থাকা বা না থাকার বিষয়টি টেরই পেলো না। তাছাড়া আমি ছিলাম ঐ সময় খুবই অল্প বয়সের মেয়ে।

দীর্ঘক্ষণ পর আমি আমার হারানো হারটি খুঁজে পেলাম। সেনাবাহিনীর বিশ্রামস্থলে এসে আমি কোন মানুষের নাম নিশানাও পেলাম না। আমার চিহ্ন অনুযায়ী আমি ঐ জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে আমার উটটি বসা ছিল। সেখানে আমি এ অপেক্ষায় বসে পড়লাম যে, তিনি (রাসূল সা.) ও সেনাবাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে যখন আমার না থাকার খবর পাবেন তখন অবশ্যই এখানে লোক পাঠাবেন। বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম এসে যায়।

হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. যিনি মূল কাফেলা থেকে পিছনে ছিলেন এবং তার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া কিছু থাকলে নিয়ে আসা। তিনি যখন একজন আসলেন তখন আমাকে দেখতে পেলেন। পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন বলে দেখামাত্রই চিনে ফেলেন এবং উচ্চ স্বরে বললেন, ইন্নালিল্লাহ। তার এ শব্দ শোনা মাত্রই আমার চক্ষু খুলে যায় এবং আমি চাদর দিয়ে আমার মুখটা ঢেকে ফেলে নিজেকে সামলিয়ে নিই।

তৎক্ষণাৎ তিনি তার উটটি বসিয়ে দেন এবং আমাকে উটে উঠতে বলেন। আমি উঠে উটের উপর সওয়ার হয়ে যাই। তিনি উটকে উঠিয়ে চালাতে শুরু করেন। আল্লাহর শপথ! তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি এবং আমিও তার সাথে কোন কথা বলিনি। প্রায় দুপুর বেলায় আমরা আমাদের যাত্রীদলের সাথে মিলিত হই। এটুকু ঘটনাকে কেন্দ্র করেই অভিশপ্তরা তিলকে তাল করে প্রচার শুরু করে দেয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা রচনাকারী ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।

মদীনায় এসেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং এক মাস পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকি। এই সময়ে বাড়িতেই অবস্থান করি। এই সময়ের মধ্যে আমি নিজেও কিছু শুনিনি এবং কেউ আমাকে কোনো কথা বলেওনি। আলোচনা সমালোচনা যা কিছু হচ্ছিল তা লোকদের মধ্যেই হচ্ছিল। আমি ছিলাম এ থেকে সম্পূর্ণরূপে বে-খবর। তবে মাঝে মাঝে এরূপ ধারণা আমার মনে জেগে উঠতো যে, আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ সা.-এর যে প্রেম ও ভালবাসা ছিল তা কমে যাওয়ার কারণ কি! অন্যান্য সময় আমি রোগাক্রান্ত হলে তিনি আমার প্রতি যে ভালোবাসা দেখাতেন, এই রোগের অবস্থায় আমি তা পেতাম না। এজন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখ হতাম, কিন্তু এর কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। তিনি আমার কাছে আসতেন, সালাম দিতেন এবং অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া তিনি আর কিছু বলতেন না। এতে আমি অত্যন্ত দুঃখ পেতাম। কিন্তু অপবাদদাতাদের অপবাদ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।

ঐ সময় পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ওয়াশরুম নির্মিত হয়নি এবং আরবদের প্রাচীন অভ্যাসমত আমরা আমাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে দূরের মাঠে গমন করতাম। স্ত্রী-লোকেরা সাধারণত রাত্রেই যেতো। বাড়িতে পায়খানা তৈরি করতে মানুষ সাধারণভাবে ঘৃণাবোধ করতো। অভ্যাসমত আমি উম্মে মিসতাহ'র সাথে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে গমন করি। ঐ সময় আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এই উম্মে মিসতাহ আমার আব্বার খালা ছিলেন।

আমরা যখন বাড়ি ফিরতেছিলাম তখন হযরত উম্মে মিসতাহর পা তার চাদরের আঁচলে জড়িয়ে পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে যে, মিসতাহ্ ধ্বংস হোক। এটা আমার কাছে খুবই খারাপবোধ হয়। আমি তাকে বলি, তুমি খুব খারাপ কথা উচ্চারণ করেছ, সুতরাং তাওবা কর। তুমি এমন লোককে গালি দিলে যে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তখন উম্মে মিসতাহ বলে, “হে সরলমনা মেয়ে! তুমি কি কিছুই খবর রাখো না?”

আমি বলি, ব্যাপার কী? সে উত্তরে বলে, “যারা আপনার উপর অপবাদ আরোপ করেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। তার একথায় আমি খুবই বিস্ময়বোধ করি এবং তাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি খুলে বলতে অনুরোধ করি। সে তখন অপবাদদাতাদের সমস্ত কার্যকলাপ আমার কাছে খুলে বলে। এতে আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার উপর দুঃখ ও চিন্তার পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। এই চিন্তার ফলে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বাবার বাড়ি গিয়ে খবরটা ভালোভাবে জানবো। সত্যিই কি আমার বিরুদ্ধে এসব গুজব রটে গেছে! কি কি খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা আমি সঠিকভাবে জানতে চাই। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সা. আমার নিকট আগমন করেন এবং সালাম দিয়ে আমার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। আমি তাঁকে বললাম, আমাকে আপনি আমার পিতার বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিন! তিনি অনুমতি দিলেন এবং আমি পিতার বাড়ি চলে গেলাম।

বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মাজান! লোকদের মধ্যে আমার সম্পর্কে কি কথা ছড়িয়ে পড়েছে? উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আমার কলিজার টুকরো! এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। এতে তোমার মন খারাপ করার কোনই কারণ নেই। যে স্বামীর কাছে তার কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে কোন একজন স্ত্রী খুবই প্রিয় হয় সেখানে এরূপ ঘটনা ঘটে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।”

তখন আমি শোকে ও দুঃখে এতো মুষড়ে পড়ি যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখন থেকে যে আমার কান্না শুরু হয়, তা ক্ষণেকের জন্যেও বন্ধ হয়নি। আমি মাথা নীচু করে শুধু কাঁদতেই থাকি। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি রাসূল সা.-এর আচরণ পরিবর্তন করার কারণ অভিশপ্তদের অপবাদ। পানাহার, শোয়া, বসা, কথা বলা সবকিছুই বাদ দিয়ে আমার একমাত্র কাজ হয় চিন্তা করা, আর না হয় কাঁদা। সারারাত এভাবেই কেটে যায়। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার অশ্রু বন্ধ হয়নি। দিনেও ঐ একই অবস্থা।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ওহি আসতে বিলম্ব হয়। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। তাই তিনি পরামর্শ করার জন্য হযরত আলী রা. ও হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠান। তিনি আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবেন তার ব্যাপারে এ দু’জনের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত উসামা রা. স্পষ্টভাবে বলে দেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনার এ স্ত্রীর কোনো মন্দগুণ আমার জানা নেই। আমাদের হৃদয় তাঁর মহব্বত, মর্যাদা ও তার সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে সদাবিদ্যমান রয়েছে।

তবে হযরত আলী রা. বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আপনার ওপর কোন সংকীর্ণতা নেই। তিনি ছাড়া আরও বহু স্ত্রীলোক রয়েছে। আপনি তাঁকে তালাক দিয়ে অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। (হযরত আলী রা.-এর এই মন্তব্য এজন্য নয় যে, তিনি আয়িশা রা.-কে সন্দেহ করেছেন। বরং এজন্য যে, তাঁকে নিয়ে ব্যাপক কথা হচ্ছে। এজন্য রাসূল সা. বিচলিত হয়ে আছেন। এমতাবস্থায় তাঁকে তালাক দিয়ে রাসূল সা. যাতে এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারেন। কিছু উগ্রপন্থী শিয়ারা আলী রা.-এর এই মন্তব্যকে পুঁজি করে আয়িশা রা.-কে এখনো অপবাদ দেন। এটা সুস্পষ্ট কুফুরি। কারণ আয়িশা রা. চরিত্রের নিষ্কলুষতা কুরআন দ্বারা স্বীকৃত)

আলী রা. রাসূল সা.-কে আরো বলেন, আপনার বাড়ির চাকরানীকে জিজ্ঞেস করলে তার (আয়িশা) সম্পর্কে আপনি সঠিক তথ্য জানতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ সা. তৎক্ষণাৎ বাড়ির চাকরানী বুরাইরা রা.-কে ডেকে পাঠান। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার সামনে আয়েশা রা.-এর এমন কোনো কাজ কি প্রকাশ পেয়েছে যা তোমাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলেছে? উত্তরে বুরাইরা রা. বলেন, “আল্লাহর শপথ! তার এ ধরনের কোনো কাজ আমি কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, তবে এটুকু শুধু দেখেছি যে, তাঁর বয়স অল্প হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে আটা মাখাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং এই সুযোগে বকরি এসে ঐ আটা খেয়ে নেয়। এছাড়া তাঁর অন্য কোনো ত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়েনি।

এ ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না বলে ঐ দিনই রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরে ওঠে জনগণকে সম্বোধন করে বলেন, “কে এমন আছে। যে আমাকে ঐ ব্যক্তির অনিষ্ট ও কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারে যে আমাকে কষ্ট দিতে দিতে ঐ কষ্ট আমার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে শুরু করেছে? আল্লাহর শপথ! আমার জানামতে আমার এ পত্নীর মধ্যে ভাল গুণ ছাড়া মন্দ গুণ কিছুই নেই। তার সাথে যে ব্যক্তিকে তারা এ কাজে জড়িয়ে ফেলেছে তার মধ্যেও সততা ছাড়া আমি কিছুই দেখিনি। সে আমার সাথেই আমার বাড়ীতে প্রবেশ করতো।”

রাসূলুল্লাহ সা.-এর একথা শুনে হযরত সা'দ ইবনে মুয়াজ রা. দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমি প্রস্তুত রয়েছি। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তবে এখনই আমি তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। আর যদি সে আমাদের খাযরাজী ভাইদের মধ্যকার লোক হয় তবে আপনি নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ পালনে মোটেই ত্রুটি করবো না।”

তার একথা শুনে হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা. দাড়িয়ে যান। তিনি খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি খুবই সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু হযরত সা'দ বিন মুয়াজের রা.-এর ঐ সময়ের ঐ উক্তির কারণে তার গোত্রীয় মর্যাদায় আঘাত লাগে। তাই তিনি হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রা.-কে সম্বোধন করে বলেনঃ “তুমি মিথ্যা বললে। না তুমি তাকে (আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই) হত্যা করবে, না তুমি তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে। সে যদি তোমার গোত্রের লোক হতো তবে তুমি তার নিহত হওয়া কখনো পছন্দ করতে না।”

তাঁর একথা শুনে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের রা. দাড়িয়ে যান। তিনি ছিলেন হযরত সা'দ ইবনে মুআয রা.-এর ভাতুস্পুত্র। তিনি বলতে শুরু করেনঃ “হে সা’দ ইবনে উবাদা। আপনি মিথ্যা বললেন। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। আপনি মুনাফিক বলেই মুনাফিকদের পক্ষপাতিত্ব করছেন। এভাবে পাল্টাপাল্টি কথাবার্তায় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরের ওপর থেকেই তাদের থামিয়ে দেন। অবশেষে উভয় দল নীরব হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও নীরবতা অবলম্বন করেন।

আর এদিকে আমার অবস্থা এই ছিল যে, সারাদিন আমার কান্নাতেই কেটে যায়। আমার পিতা-মাতা ধারণা করলেন যে, এ কান্না আমার কলেজা ফেড়েই ফেলবে। বিষণ্ণ মনে আমার পিতা-মাতা আমার নিকট বসেছিলেন এবং আমি কাঁদছিলাম। এমন সময় আনসারের একজন স্ত্রীলোক আমাদের নিকট আগমন করে এবং সেও আমার সাথে কাঁদতে শুরু করে। আমরা সবাই এভাবেই বসেছিলাম এমতাবস্থায় অকস্মাৎ রাসূলুল্লাহ সা.-এর সেখানে আগমন ঘটে। তিনি সালাম দিয়ে আমার পাশে বসে পড়েন।

আল্লাহর কসম! যখন থেকে এই অপবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকে নিয়ে ঐ দিনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমার পাশে বসেননি। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অবস্থা ঐরূপই ছিল। এ সময়ের মধ্যে তাঁর ওপর কোনো ওহী অবতীর্ণ হয়নি। কাজেই কোনো সিদ্ধান্তেই তিনি পৌঁছতে পারেননি। বসেই তিনি তাশাহহুদ পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “হে আয়েশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এ খবর পৌঁছেছে। যদি তুমি সত্যিই সতী-সাধ্বী থেকে থাকো তবে আল্লাহ তা'আলা তোমার পবিত্রতা ও সতীত্বের কথা প্রকাশ করে দিবেন। আর যদি প্রকৃতই তুমি কোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে থাকো তবে আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাওবা করো। কারণ বান্দা যখন কোন পাপ কার্যে লিপ্ত হবার পর তা স্বীকার করে নিয়ে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও তাঁর কাছে ক্ষমা চায় তখন তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন।”

রাসূলুল্লাহ সা. এটুকু বলার পর নীরব হয়ে যান। তাঁর একথা শুনেই আমার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। অশ্রু শুকিয়ে যায়। এমন কি এক ফোঁটা অশ্রুও চোখে ছিল না। প্রথমে আমি আমার পিতাকে বললাম যে, তিনি যেন আমার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সা.-কে জবাব দেন। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি তাঁকে কী জবাব দেবো তা বুঝতে পারছি না।” তখন আমি আমার মাতাকে লক্ষ্য করে বলি, আপনি আমার পক্ষ থেকে তাঁকে উত্তর দিন। কিন্তু তিনিও বলেন, “আমি তাঁকে কী উত্তর দেবো, তা খুঁজে পাচ্ছি না।

তখন আমি নিজেই জবাব দিতে শুরু করলাম। আমার বয়সতো তেমন বেশী ছিল না এবং কুরআনও আমার বেশি মুখস্ত ছিল না। আমি বললাম, আপনারা সবাই একটা কথা শুনেছেন এবং মনে স্থান দিয়েছেন। আর হয়তো ওটা সত্য বলেই মনে করেছেন। এখন আমি যদি বলি যে, আমি এই বেহায়াপনা কাজ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আল্লাহ তা'আলা খুব ভাল জানেন যে, আমি আসলেও এ পাপ থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত, কিন্তু আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। অথচ আল্লাহ তা'আলা খুব ভালো করে জানেন যে, আমি সম্পূর্ণরূপে নিষ্পাপ। আল্লাহ বললেই আপনারা আমার কথা মেনে নিবেন।

এখন আমার ও আপনাদের দৃষ্টান্ত তো সম্পূর্ণরূপে আবু ইউসুফের (হযরত ইউসুফের আ. পিতা হযরত ইয়াকুবের আ.) মতো। তিনি বলেছেন, ‘সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছে সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল।" (১২:১৮)। এটুকু বলেই আমি পার্শ্ব পরিবর্তন করি এবং আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি।

আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু আমি পবিত্র ও দোষমুক্ত, সেহেতু আল্লাহ তা'আলা আমার দোষমুক্ত থাকার কথা রাসূল সা.-কে অবহিত করবেন। কিন্তু আমি এটা কল্পনাও করিনি যে, আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হবে। তবে আমার ধারণা এরূপ হতো যে, আল্লাহ নবী সা.-কে হয়তো স্বপ্নযোগে আমার দোষমুক্ত হওয়ার কথা জানিয়ে দিবেন।

আল্লাহর শপথ! তখনও রাসূলুল্লাহ সা. নিজের জায়গা থেকে সরেননি এবং বাড়ির কোন লোকও বাড়ি হতে বের হননি এমতাবস্থায় তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হতে শুরু হয়ে যায়। তাঁর মুখমণ্ডলে ঐসব নিদর্শন প্রকাশ পায় যা ওহীর সময় প্রকাশিত হয়ে থাকে। ওহী অবতীর্ণ হওয়া শেষ হলে আমরা দেখতে পাই যে, তার চেহারা মুবারক খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সর্বপ্রথম তিনি আমার দিকে চেয়ে বলেন,

“হে আয়েশা! তুমি খুশি হও। কারণ মহান আল্লাহ তোমার দোষমুক্ত হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।” তৎক্ষণাৎ আমার মা আমাকে বলেন, “হে আমার প্রিয় কন্যা! আল্লাহর রাসূল সা.-এর সামনে দাঁড়িয়ে যাও।” আমি উত্তরে বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর সামনে দাঁড়াবো না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবো না। তিনিই আমার দোষমুক্তি ও পবিত্রতার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।

আমার এই ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর স্ত্রী হযরত যয়নব রা.-কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর সমস্ত স্ত্রীর মধ্যে হযরত যয়নব রা. আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু তার আল্লাহর ভীতির কারণে তিনি আমার প্রতি কলংক আরোপ করা হতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমি আমার কর্ণ ও চক্ষুকে রক্ষিত রাখছি, আল্লাহর কসম! আমি তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না।”

অথচ তার বোন হিমনাহ বিনতে জাহাশ আমার সম্পর্কে বহুকিছু বলেছিল এবং আমার বিরুদ্ধে তার বোনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল। তারপরও হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ রা. আমার সম্পর্কে একটিও মন্দ কথা উচ্চারণ করেননি। তবে তার ভগ্নী আমার অপবাদ রচনায় বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল এবং সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।”

এভাবেই আমাদের মা আয়িশা রা. তার ওপর আরোপিত অপবাদের ঘটনার বর্ণনা দেন। বনু মুস্তালিক অভিযান শেষে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় মুনাফিকরা ক্ষেপে ছিল। এর মধ্যে তারা যখন দেখলো আয়িশা রা. কাফেলার সাথে না ফিরে এক রাত পরে সাফওয়ান রা.-এর সাথে ফিরলেন তখন তারা সাফওয়ান রা. ও আয়িশা রা.-এর বিরুদ্ধে জেনার অভিযোগ আনে।

মদিনার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয় এই অপবাদ। রাসূল সা. মুষড়ে পড়েন। তিনি সাফওয়ান রা. থেকে ঘটনা জেনে নেন। তিনি প্রাথমিকভাবে আস্থা রাখলেও অপবাদকারীদের অব্যাহত নানান রটনায় বিচলিত হয়ে পড়েন। অপবাদের শিকার দুইজন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ এর সাক্ষী না থাকায় তাদের পক্ষেও বক্তব্য রাখা যাচ্ছিল না।

মহান রাব্বুল আলামীন এই ব্যাপারে সূরা নূরের ১১ নং আয়াতে বলেন,
//যারা এ মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ। এ ঘটনাকে নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই। যে এর মধ্যে যতটা অংশ নিয়েছে সে ততটাই গুনাহ কামাই করেছে আর যে ব্যক্তি এর দায়-দায়িত্বের বড় অংশ নিজের মাথায় নিয়েছে তার জন্য তো রয়েছে মহাশাস্তি।//

হাদীসে মাত্র কয়েকজন লোকের নাম পাওয়া যায়। তারা এ গুজবটি ছড়াচ্ছিল। তারা হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই, যায়েদ ইবনে রিফা’আহ, মিস্‌তাহ ইবনে উসামাহ, হাস্‌সান ইবনে সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ। এর মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল মুনাফিক এবং বাকি তিনজন মু’মিন। মু’মিন তিন জন বিভ্রান্তি ও দুর্বলতার কারণে এ চক্রান্তের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরা ছাড়া আর যারা কমবেশী এ গোনাহে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের নাম হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে পাওয়া যায় না।

এই ধরনের অপবাদ ছড়ানো এবং কেউ ছড়ালে মুমিন কী করা উচিত তা নিয়ে সূরা নূরের ১২ থেকে ২১ আয়াতে বলেন,
//যখন তোমরা এটা শুনলে, তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা তাদের নিজদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করলো না এবং বলল কেন না, ‘এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ’? তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী নিয়ে আসল না? সুতরাং যখন তারা সাক্ষী নিয়ে আসেনি, তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী।আর যদি দুনিয়া ও আখেরাতে তোমাদের উপর আল্লাহর দয়া ও তাঁর অনুগ্রহ না থাকত, তবে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে, তার জন্য তোমাদেরকে অবশ্যই কঠিন আযাব স্পর্শ করত।

যখন এটা তোমরা তোমাদের মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং তোমরা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে, যাতে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিল না; আর তোমরা এটাকে খুবই তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর নিকট খুবই গুরুতর। আর তোমরা যখন এটা শুনলে, তখন তোমরা কেন বললে না যে, ‘এ নিয়ে কথা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি অতি পবিত্র মহান, এটা এক গুরুতর অপবাদ’।

আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন যে, যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে আর কখনো এর পুনরাবৃত্তি করবে না। আর আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছেন এবং আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, (তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে) আর নিশ্চয় আল্লাহ বড় মেহেরবান, পরম দয়ালু।

হে মুমিনগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে। আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারত না; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, পবিত্র করেন। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।//

এই পুরো ঘটনায় যে লোকটি লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে গিয়েছেন তিনি হলেন আমাদের মা হযরত আয়িশা রা.-এর পিতা আবু বকর রা.। সাহাবারা এমনকি তাঁর আত্মীয়রাও যখন এসব নিয়ে কথা বলছে তখন তিনি নীরবে চোখের পানি ফেলতেন। এরমধ্যে মিস্‌তাহ ইবনে উসামাহ ছিল অপবাদকারীদের মধ্যে অন্যতম। অথচ এই মিসতাহ আবু বকর রা.-এর আত্মীয় এবং তাঁর অনুগ্রহে জীবিকা নির্বাহ করেন। আল্লাহর ঘোষণার মাধ্যমে মিসতাহ মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হওয়ায় আবু বকর রা. তাকে যে সাহায্য করে আসছিলেন এবং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছিলেন তা বন্ধ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন।

এই ঘোষণার কারনে আল্লাহ তায়ালা পরে আরেকটি আয়াত অর্থাৎ সূরা নূরের ২২ নং আয়াত নাজিল করেন। সেখানে তিনি বলেন, //আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।//

তাঁর কসমের প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয়েছে শুনেই হযরত আবু বকর রা. সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, ‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আমরা চাই, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করে দিবেন।’ কাজেই তিনি আবার মিসতাহকে সাহায্য করতে থাকেন এবং এবার আগের চেয়ে বেশি করে করতে থাকেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, হযরত আবু বকর রা. ছাড়াও আরো কয়েকজন সাহাবীও এ কসম করেছিলেন যে, যারা মিথ্যা অপবাদ ছড়াতে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে তাঁরা আর কোনো সাহায্য-সহায়তা দেবেন না। এ আয়াতটি নাযিল হবার পর তারা সবাই নিজেদের কসম ভেঙ্গে ফেলেন। এভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইসহ মুনাফিক দ্বারা সৃষ্ট এ ফিতনার ফলে মুসলিম সমাজে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তা এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল সা. কখনোই কোন মুহাজির সাহাবী দ্বারা কষ্ট পাননি ব্যতিক্রম শুধু এই ঘটনা। এখানে একজন মুহাজির পুরুষ ও একজন মুহাজির মহিলা আল্লাহর রাসূল সা.-কে কষ্ট দিয়েছেন।

কুরআনের আয়াত নাজিল হওয়ার পর আপবাদের সাথে কম-বেশি জড়িত থাকা সাহাবারা আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি সবাইকে আশি বেত্রাঘাত দেওয়ার আদেশ দেন। মুনাফিকরা নিজেদের সমর্পন করে নি, তাই তারা শাস্তিও পায়নি। তাদের শাস্তি পরকালের জন্য সংরক্ষিত থাকলো।

এই ঘটনার পর মুনাফিকরা আর বড় কোনো ফিতনা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় আল্লাহর রাসূলের সাথে আব্দুল্লাহ বিন উবাইও ছিল। তাবুক যুদ্ধে যোগ দিয়ে আবার অসুস্থতার জন্য আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ফিরে আসে। তাবুক যুদ্ধ শেষে যারা অনুমতি ছাড়া জিহাদে যোগ দেয়নি তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হলে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের পক্ষ হয়ে ওকালতি করে।

তাবুক থেকে ফিরে আসার পর ৬৩১ সালে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যায়। তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ রাসূল সা.-এর কাছে হাজির হয়ে তার জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। তাকে যাতে আল্লাহ ক্ষমা করেন এজন্য রাসূলের একটি জামা চেয়ে নেন কাফনে ব্যবহারের জন্য। মুহাম্মদ সা. জানাজা পড়ানোর জন্য যেতে উদ্যত হলে উমার ফারুক রা. এর বিরোধীতা করেন। আল্লাহর রাসূল সা. উমার রা.-কে কিছু না বলে মুচকি হাসলেন ও আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর জন্য মাগফিরাতের দোয়া করলেন। এরপর মুহাম্মাদ তার জানাজার সালাত আদায় করেন।

জানাজার সালাতের কিছুক্ষণ পরেই সুরা সুরা তওবার ৮৪ নং আয়াত নাজিল হলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আর আগামীতে তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা গেলে তার জানাযার নামাযও তুমি কখনো পড়বে না এবং কখনো তাদের কবরের পাশে দাঁড়াবে না। কারণ তারা আল্লাহ‌ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে ফাসিক অবস্থায়।

এ আয়াত নাজিল হবার পর নবী সা. আর কোনো চিহ্নিত মুনাফিকের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন নি। তিনি নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে, কোনো জানাজার শরিক হবার জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, সে কেমন ছিলো? যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পারো।

আল্লাহর রাসুল সা. মুনাফিক সর্দারের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছিলেন আল্লাহ তায়ালা সেটি অপছন্দ করেছেন এবং নিষেধ করেছেন। এখান থেকে দ্বীন কায়েমের দায়িত্বশীলদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। আমরা অনেক সময় জালিম ও দ্বীন কায়েমের পথে বাধা সৃষ্টিকারী খ্যাতিমান লোকেরা মৃত্যুবরণ করলে আমরা শোক প্রকাশ করি, মাগফিরাতের দোয়া করি, এগুলো সুস্পষ্ট হারাম। আল্লাহ নিষেধ করেছেন। দ্বীন কায়েমের পথে জিহাদরত দায়িত্বশীলদের এসব ঘটনা থেকে গুরুত্বের সাথে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।

২৮ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৮ - মুনাফিক প্রতিরোধ ও রাষ্ট্রের সম্প্রীতি রক্ষায় মুহাম্মদ সা.

 

মদিনা রাষ্ট্র গঠনের পর যারা এর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মুনাফিক গোষ্ঠী। মুহাম্মদ সা. অন্যান্য গোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিলেও অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। 

মুনাফিকরা একদিনে হুট করে তৈরি হয়নি। এর রয়েছে ধারাবাহিক পরিক্রমা। যখনই ইসলামের অবস্থা একটু ব্যাকফুটে থাকে তখন তাদের দৌরাত্ম দেখা যায়। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, কটূক্তি, আনুগত্যহীনতা এবং ফিতনা তৈরি করে। বার বার আল্লাহর রাসূল সা.-কে তারা বিপদগ্রস্থ করে তুলেছিলো। তারপরও আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত তাদেরকে কন্ট্রোলে রেখে সহবস্থানে বাধ্য করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে যতই ইসলামের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছিল ততই মুনাফিকরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। রাসূল সা. শেষদিকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো।      

মদিনায় রাসূল সা.-এর আগমনের পূর্বেই বিবদমান আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি আর কেউ নয় তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। 

এই পরিস্থিতিতে ইসলামের সুমহান দাওয়াত মদিনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় রাসূল সা.-কে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা রা. এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরি করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয়। সে যেন রাসূল সা.-এর প্রতিদ্বন্দ্বি না হয়। এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের পঁচাত্তর ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী সা.-কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। 

এরপর নবী সা. যখন মদীনায় পৌঁছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের পর সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও অনুসারিদের নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতা পর্যায়ের লোকেরা ছিল। 

মদিনায় ইসলামের প্রসারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তরজ্বালা ও দুঃখ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সা. তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দুঃখ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকলো। একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সা. যখন খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন।“ 

সে এমন ঘোষণা দিয়ে নিজেকে খাঁটি ঈমানদার বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো। অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সা. এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে। একবার নবী সা. কোনো এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন । এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি খাজরাজ গোত্রের আরেক নেতা সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন।“

বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ সা. তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর সা. বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে, আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। পরে আল্লাহর রাসূল সা. আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা আংশিকভাবে মেনে নেন। বনু কাইনুকার ইহুদীদের বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। 

উহুদ যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীরা তাদের সর্বোচ্চ মুনাফেকী প্রদর্শন করেন। তারা সরাসরি ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধ কোথা থেকে করা হবে এই নিয়ে পরামর্শ সভায় মতরিরোধ তৈরি হয়। আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়। কিন্তু পরে যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে থেকে ফিরে এসেছে। কী মারাত্মক বিপদে পড়েছেন রাসূল সা. এটা সহজেই অনুমেয়। মুসলিমদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সা. মাত্র একহাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও মুনাফিকরা আলাদা হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী সা.-কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো।

উহুদের ঘটনার পর এটা সমস্ত মুসলিমদের কাছে নিশ্চিত ছিল যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার দল সত্যিকারের মুসলিম নন। নইলে আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথে বিদ্রোহ করে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যেতে পারে না। এতে মুসলিমদের সুবিধে হলো তারা মুনাফিক সর্দার ও তার অনুসারীদের চিহ্নিত করার সুযোগ পেল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবী সা. খুতবা দেয়ার পূর্বে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল, “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও। মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে তাকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার সাহাবী তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সা. কাছে আবেদন করো।“ এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”। 

হিজরী ৪র্থ সনে বনু নাদির যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় বিন উবাই ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে। একদিকে রসূলুল্লাহ সা. এবং তাঁর সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও । আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরে আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। 

মুনাফিকদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সা. তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে গিয়েছেন। কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক চতুর্থাংশ ছিল তার অনুসারী। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী সা. দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবী অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন। 

অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করতো অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা ছিল। সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসতো, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবী করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না। 

নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব যুক্তি দিয়ে তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো । এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দাল ও ফাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না। 

খন্দকের যুদ্ধের সময় তারা মদিনার বিপদের জন্য মুহাম্মদ সা.-কে দায়ি করে ঝামেলা তৈরি করে। যুদ্ধের পরে মুসলিমদের শক্তি দারুণভাবে বৃদ্ধি পেল। এরপর বনু কুরাইজার প্রায় ৭০০ যুদ্ধাপরাধী ও বিশ্বাসঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এতো বড় ঘটনায় কাফির মুশরিকদের কেউই বনু কুরাইজার পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। এরপর রাসূল সা. নজদের মুশরিক গোত্র বনু গাতফান বিরুদ্ধে কয়েকটি ছোট ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে তাদের সংহতি নষ্ট করে  দিয়ে মদিনার বিরুদ্ধে আক্রমণের শাস্তি দেন। এরপর মুনাফিকদের দৌরাত্ম্য কমে যায়। 

মুনাফিকরা নিজেদেরকে মুসলিমদের সাথে মিশিয়ে ফেলে। খন্দক যুদ্ধের পরের বছর বেশ ভালোভাবেই কাটিয়েছে মুসলিমরা। এর মধ্যে রাসূল সা. গোয়েন্দা মারফত খবর পেলেন বনু মুসতালিক মদিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই খবরে তিনি খুব দ্রুতই সেনাবাহিনী প্রস্তুত করে বনু মুসতালিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।  

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার অনুসারী মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে বনু মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতো। কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সা.এর পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথাসময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা মুনাফিকুনে। 

মুনাফিকরা মোটাদাগে ৪টি ইস্যুতে ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে 
১- উহুদের বিপর্যয়সহ আরো কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে তারা মুহাম্মদ সা. নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে শহীদ পরিবার ও দুর্বল চিত্তের মুসলিমদের উস্কে দেয়।  
২- খন্দকের যুদ্ধে আরবের বিশাল সম্মিলিত মুশরিকদের কাছে যখন মদিনা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও মদিনার নিরাপত্তা বিনষ্ট করার জন্য মুহাম্মদ সা. ও ইসলামকে দায়ি করে ফিতনা তৈরি করে। শত্রুদের ব্যাপারে ভয় দেখিয়ে মদিনার দুর্বল চিত্তের মুসলিমদের হতাশ করে তোলে। 
৩- বনু মুস্তালিকের যুদ্ধে আনসার ও মুহাজির অর্থাৎ মক্কা ও মদিনার বাসিন্দাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জাহেলিয়াত জাগ্রত করে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করার চেষ্টা চালায়। 
৪- আয়িশা রা.-এর একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহাম্মদ সা.-এর পারিবারিক জীবনকে অস্থির করে তুলে। 

চারটি ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে মুসলিমদের সতর্ক করেছেন মুনাফিকদের ব্যাপারে।    

যাই হোক, বনু মুসতালিকদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়নি। তারা মুহাম্মদ সা.-এর অভিযান দেখে আত্মসমর্পন করে। মুসলিমরা প্রচুর গনিমত লাভ করে। বনু মুস্তালিককে পরাস্ত করার পর ইসলামী সেনাবাহিনী তখনও মুরাইসী নামক কূপের আশেপাশের জনবসতিতে অবস্থান করেছিল। ইতোমধ্যে হঠাৎ পানি নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা হয়। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জাহ্জাহ্ ইবনে মাসউদ। তিনি ছিলেন হযরত উমর রা.-এর কর্মচারী। তিনি তাঁর ঘোড়ার দেখাশোনা করতেন। অন্যজন ছিলেন সিনান ইবনে ওয়াবার ইল জুহানী। তাঁর গোত্র খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। মৌখিক বাদানুবাদ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং জাহজাহ সিনানকে একটি লাথি মারে। এতে সিনান সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে আহবান জানায় এবং জাহজাহও মুহাজিরদের আহবান জানায়। 

এই ঝগড়ার খবর শোনামাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উত্তেজিত করতে শুরু করে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে দ্রুত এসো, নিজের মিত্রদের সাহায্য করো। অপরদিকে থেকে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো। তাই আনসার ও মুহাজিরগণ সম্মিলিতভাবে সবেমাত্র যে স্থানটিতে এক দুশমন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং তখনও তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন সে স্থানটিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লিপ্ত হয়ে পড়তেন। 

কিন্তু শোরগোল শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “কী ব্যাপার! জাহেলিয়াতের আহবান শুনতে পাচ্ছি কেন? জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? এসব ছেড়ে দাও, এগুলো দুর্গন্ধময় নোংরা জিনিস। এতে উভয়পক্ষের সৎ ও নেককার লোকজন অগ্রসর হয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে দিলেন এবং সিনান জাহজাহকে মাফ করে আপোষ করে নিলেন। 

এখানে এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে আল্লাহর রাসূল সা. জাহেলিয়্যাত বলেছেন। মদিনাবাসী ও মক্কাবাসী একে অপরের বিরুদ্ধে নিজের জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিলো। অথচ মুসলিমরা নিজেদের ভাইদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করবে। কেউ কোন অপরাধ করলে নিজের জাতির লোক বলে তাকে সাপোর্ট করবে না। আবার অন্য জাতির কেউ অপরাধ করলে পুরো জাতিকে দোষারোপ করা যাবে না। এভাবে এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্থান ইসলামে নেই। এটা হারাম।  

যাই হোক, এই মীমাংসার পর যাদের অন্তরে মুনাফিকী ছিল তারা সবাই এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে সমবেত হয়ে তাকে বললো, “এতদিন আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি প্রতিরোধও করে আসছিলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এসব কাঙাল ও নিঃস্বদের (মুহাজির) সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছো!“ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগে থেকেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একথা শুনে সে আরো জ্বলে উঠল। সে বলতে শুরু করল, এসব তোমাদের নিজেদেরই কাজের ফল। তোমরা এসব লোককে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছো, নিজেদের অর্থ-সম্পদ তাদের বন্টন করে দিয়েছো। এখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং আমাদেরই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং কুরাইশদের এই কাঙালদের অবস্থা বুঝাতে একটি উপমা হুবহু প্রযোজ্য। উপমাটি হলো, তুমি নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করো, যাতে তা একদিন তোমাকেই ছিঁড়ে ফেঁড়ে খেতে পারে। তোমরা যদি তাদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তাহলে তারা কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর শপথ, মদীনায় ফিরে গিয়ে আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান লোক তারা হীন ও লাঞ্ছিত লোকদের বের করে দেবে।“

এ বৈঠকে ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি একজন কম বয়স্ক বালক ছিলেন। এসব কথা শোনার পর তিনি তাঁর চাচার কাছে তা বলে দেন। তাঁর চাচা ছিলেন আনসারদের একজন নেতা। তিনি রসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে গিয়ে সব বলে দেন। নবী সা. যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা শুনেছিলেন আদ্যপান্ত খুলে বললেন। নবী সা. বললেন, তুমি বোধহয় ইবনে উবাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। সম্ভবত তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। ইবনে উবাই একথা বলছে বলে হয়তো তোমার সন্দেহ হয়েছে। 

কিন্তু যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! তা নয়। আল্লাহর শপথ আমি নিজে তাকে এসব কথা বলতে শুনেছি। অতঃপর নবী সা. আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে সরাসরি অস্বীকার করলো। সে বারবার শপথ করে বলতে লাগলো আমি একথা কখনো বলি নাই। আনসারদের লোকজনও বললেন, হে আল্লাহর নবী! এতো একজন ছেলে মানুষের কথা, হয়তো তার ভুল হয়েছে।

তিনি আমাদের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার কথার চেয়ে একজন বালকের কথার প্রতি বেশী আস্থাশীল হবেন না। বিভিন্ন গোত্রের প্রবীণ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও যায়েদকে তিরস্কার করলো। বেচারা যায়েদ এতে দুঃখিত ও মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকলেন। কিন্তু নবী সা. প্রকৃত ব্যাপার কী তা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলেন।

উমর রা. এ বিষয়টি জানতে পেরে নবী সা.-এর কাছে এসে বললেন, “আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। কিন্তু নবী সা. বললেন, “এ কাজ করো না। ধৈর্য ধরো। লোকে বলবে, মুহাম্মাদ সা. নিজের সংগী-সাথীদেরকেই হত্যা করেছে”। উমার রা. আরো প্রস্তাব করলেন, যেহেতু আমি মুহাজির আমি হত্যা করলে নানান কথা উঠবে, তাহলে আপনি কোনো আনসার দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিন। নবী করিম সা. এবারো তাঁকে নিভৃত করলেন। ধৈর্যধারণ করতে বললেন।

এরপর  এরপর নবী সা. তৎক্ষনাৎ যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। ক্রমাগত ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকলো। এমন কি লোকজন ক্লান্তিতে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়লো। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন মাটিতে পিঠ ঠেকানো মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। এ কাজ রাসূল সা. এ জন্য করলেন যাতে, মুরাইসি কূপের পাশে যে ঘটনা ঘটেছিল মানুষের মন-মগজ থেকে তা মুছে যায়। কিন্তু রাসূল সা.-এর ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যে মন্তব্য করেছিলো তা ধীরে ধীরে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আনসার সাহাবীদের অনেকেই তাকে রাসূল সা.-এর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে তা করেনি। তার বেপরোয়া আচরণে সাহাবীদের মধ্যে তার সম্পর্কে আরো বিরূপ ধারণা তৈরি হয়।    

এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা মুনাফিকুনে মুনাফিকদের আচরণের সাথে মুসলিমদের পরিচয় করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 

// যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা নিজদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। তারা যা করছে, নিশ্চিয় তা কতইনা মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।

আর যখন তুমি তাদের প্রতি তাকিয়ে দেখবে তখন তাদের শরীর তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে তুমি তাদের কথা (আগ্রহ নিয়ে) শুনবে। তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতই। তারা মনে করে প্রতিটি আওয়াজই তাদের বিরুদ্ধে। এরাই শত্রু, অতএব এদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস করুন। তারা কিভাবে সত্য থেকে ফিরে যাচ্ছে! 

আর তাদেরকে যখন বলা হয় এসো, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নেড়ে অস্বীকার করে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে। তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।

তারা বলে, যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু সকল মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।//

উস্তাদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ. বলেন, এ ঘটনা থেকে শরীয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়। 

১. ইবনে উবাই যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিল এবং যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম মিল্লাতের অন্তরভুক্ত থেকে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে সে হত্যা যোগ্য অপরাধী। 

২. শুধু আইনের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি হত্যার উপযুক্ত হলেই যে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে তা জরুরি নয়। এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেখতে হবে, তাকে হত্যা করার ফলে কোন বড় ধরনের ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কিনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে আইনের প্রয়োগ কোন কোন সময় আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ফলাফল নিয়ে আসে। যদি একজন মুনাফিক ও ফিতনাবাজের পেছনে কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দিয়ে আরো বেশি ফিতনাকে মাথাচড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার চেয়ে উত্তম হচ্ছে, যে রাজনৈতিক শক্তির জোরে সে দুষ্কর্ম করছে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার মূলোৎপটন করা। 

এই সুদূর প্রসারী লক্ষ্যেই নবী করিম সা. তখনো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি দেননি যখন তিনি তাকে শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। বরং তার সাথে সবসময় নম্র আচরণ করেছেন ও তার ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তিন বছরের মধ্যেই মদীনায় মুনাফিকদের শক্তি চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে গেল।  

সত্যিকারের মুনাফিক এখন আর নেই যারা ঈমান গোপন করে মুসলিম সমাজে বসবাস করে আসছে। তা আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বাকী আছে যারা মুসলিম তবে আচরণ মুনাফিকের মতো। যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের যথাযথভাবে এই পাঠ নেওয়া দরকার কীভাবে মুনাফিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। আর এই পাঠ নিতে হবে রাসূল সা.-এর কর্মকৌশল থেকেই। 


২৫ জুল, ২০২১

নির্বংশ আবতারদের পরিণতি



কাসিম ছিল মুহাম্মদ সা.-এর বড় ছেলের নাম। একইসাথে তিনি সবচেয়ে বড় সন্তানও ছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। তার জীবনকাল ছিল ১ সপ্তাহের কাছাকাছি। এরপর রাসূল সা.-এর চার মেয়ে জন্ম নেন। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর ১ম সন্তান কাসিমকে খুবই ভালোবাসতেন। কেউ যদি তাঁকে আবুল কাসিম বলে ডাকতেন তবে তিনি খুশি হতেন।

রাসূল সা. চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়্যত পেলেন। এরপর থেকে তিনি গোপনে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিন বছর গোপন দাওয়াতের পর তিনি যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন তিনি মক্কার মানুষের কাছ বিশেষত আত্মীয়দের কাছ থেকে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হলেন। আর এই বিরোধীতার মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল আল্লাহর রাসূল সা.-এর প্রতিবেশী ও আপন চাচা 'আবু লাহাব'।

নবুয়্যতের ৩য় বছরে আল্লাহর রাসূল সা. ২য় পুত্র সন্তানের পিতা হন। মুহাম্মদ সা. ও খাদিজা রা. তাদের পুত্র সন্তানের নাম রাখেন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ। নবুয়্যতের ৫ম বছরে অর্থাৎ আব্দুল্লাহর বয়স যখন দুই বছর তখন একদিন তিনি ইন্তেকাল করেন। আব্দুল্লাহর ইন্তেকালে মুহাম্মদ সা. মুষড়ে পড়েন। খুবই ব্যথিত হন।

এদিকে প্রতিবেশী হওয়ায় চাচা 'আবু লাহাব' খবর পেয়েছে সবার আগে। সে চিৎকার করে, আনন্দ করে মক্কায় অলিতে গলিতে মৃত্যুর খবর প্রচার করতে লাগলো। মুহাম্মদের বংশ শেষ। তার একমাত্র পুত্র মারা গেছে। এটা নিয়ে ইসলামের শত্রুরা বেশ উল্লাস প্রকাশ করে।

বিদ্যুৎ গতিতে এই খবর মদিনায় চলে গেল। মদিনায় থাকা ইহুদিরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে বেশ তীক্ষ্ণভাবেই অবজার্ভ করছিল। কারণ তারা ভেবেছিল এই শেষ নবী তাদের বংশ থেকে আসবে। যেহেতু আসে নি তাই তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরোধীতা শুরু করে এবং তাঁকে মিথ্যা দাবীদার হিসেবে অবহিত করে।

যাই হোক আব্দুল্লাহ'র মৃত্যুর খবর ইহুদিদের কাছে পৌঁছলে তারাও উল্লাস করে। ইহুদি গোত্র বনু নাদিরের নেতা ও কবি কা'ব বিন আশরাফ তখন খুশি হয়ে রাসূল সা.-কে অপমান করে একটি কবিতা রচনা করে। সেখানে সে মুহাম্মদ সা.-কে উদ্দেশ্য করে একটি শব্দ ব্যবহার করে যেটি হলো, 'আবতার'। আবতার শব্দ একটি বাগধারা টাইপ শব্দ, যার অর্থ লেজ কাটা, গোড়া কাটা, শেকড় কাটা, নির্বংশ, আত্মীয় থেকে বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি বুঝায়।

কা'ব বিন আশরাফ তার কবিতায় বুঝাতে চেয়েছে মুহাম্মদ সা. আবতার। তার কোনো ছেলে সন্তান নেই। অবএব সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার মতো কেউ থাকবে না। তার জন্য লড়াই করার কেউ নেই। সে আত্মীয়দের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও অবাঞ্ছিত।

আল্লাহর রাসূল সা. মদিনায় রাষ্ট্র কায়েমের পর এই কা'ব বিন আশরাফ সেই ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। মক্কার লোকদের সাথে চুক্তি করে সে মদিনা বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য আবু সুফিয়ানকে উস্কে দেয়। আল্লাহর রাসূল সা. এই অপরাধে ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

মক্কার মুশরিকরা ইহুদি কবি কা'বের এই শব্দে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছে। তারা মুহাম্মদ সা.-কে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করতে লাগলো। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালা ওহি নাজিল করলেন মুহাম্মদ সা.-কে সান্তনা দিয়ে। এটি ছিল কুরআনের সবচেয়ে ছোট সূরা। সূরা কাওসার।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
নিশ্চয় আমি তোমাকে আল-কাওসার দান করেছি।
কাজেই তোমার রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড়ো এবং কুরবানী করো।
নিশ্চয়ই তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণকারীই আবতার (নির্বংশ)।

এই ওহি নাজিল হওয়ার পর মুসলিমরা অত্যন্ত খুশি হলো। আলী রা. এই সূরা লিখে কাবা'র দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন।

এখানে আল্লাহ তায়ালা একটি সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূল সা.-কে কাওসার দান করলেন। কাওসার শব্দের অর্থ অনেক কল্যাণ। অনেকে কাওসার বলতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ধরে নিলেও পরবর্তীতে অনেক হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয় এটি একটি প্রবাহিত নহর। যা কিয়ামতের কঠিন সময়ে আল্লাহর রাসূল সা.-এর জিম্মাদারীতে দেওয়া হবে। যারা এর পানি আল্লাহর রাসূল সা. থেকে পাবেন তারা আর কখনো পিপাসার্ত হবেন না।

আল্লাহর রাসূল সা. মিরাজের সময় এই কাওসারকে দেখেছেন। তিনি জিব্রাঈল আ.-কে জিজ্ঞাসা করলেন এটি কি? উত্তরে জিব্রাঈল আ. বললেন, এটি হলো সেই প্রতিশ্রুত কাওসার, যা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন।

এই কাওসারের পানি কেমন হবে তা নিয়ে অনেক হাদিস আছে। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো কারা এই পানি পাবে। আর কারা পাবে না। এই ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সা. সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল (বিদআতের প্রচলন) করবে তাদেরকে এ কাওসারের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, তখন আমি বলবো, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মাতের লোক। জবাবে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পরে এরা কী কী পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল। তখন আমিও তাদেরকে দূর করে দেবো এবং তাদেরকে কাওসারের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না।

অর্থাৎ কাওসারের পানি পেতে হলে আমাদের রাসূলের পথে চলতে হবে। মনগড়া পথ চললে হবে না। আল্লাহর রাসূল সা. যেভাবে দ্বীন কায়েমের পথে সক্রিয় ছিলেন সেভাবে আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে।

২য় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন কাজেই তোমার রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড়ো এবং কুরবানী করো। অর্থাৎ যখন দ্বীনের ব্যাপারে সুসংবাদ আসবে তখন সালাত ও পশু কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সালাত ও কুরবানীর বিধান নাজিল করলেন। সালাত ও কুরবানী আগে থেকেই মক্কায় প্রচলিত ছিল। তারা আল্লাহ ছাড়াও দেব দেবীর উদ্দেশ্যে সালাত ও কুরবানী আদায় করতো। ইসলাম এসে নির্দিষ্ট করেছে সালাত ও কুরবানী আল্লাহকে উদ্দেশ্য করা ছাড়া আদায় করা যাবে না।

এখানে শিক্ষা হলো দুইটি। এক- খুশির প্রকাশ হবে সালাত ও পশু কুরবানীর মাধ্যমে। দুই- সালাত ও পশু কুরবানী হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আল্লাহর রাসূল সা. যখন মদিনায় স্টেট কায়েম করেছেন তখন দুটি রাষ্ট্রীয় খুশির দিন অর্থাৎ ঈদের দিন ঘোষণা করলেন। একটি রমজানের প্রশিক্ষণের পর পুরস্কারের দিন যা ঈদুল ফিতর হিসেবে খ্যাত। অন্যটি হজ্বের সাথে মিল রেখে যা ঈদুল আযহা হিসেবে খ্যাত।

ঈদুল আযহায় সালাতের আগে কুরবানী করলে তা আদায় হবে না। এই মাসয়ালাটি মুহাম্মদ সা. সূরা কাওসারের ২য় আয়াত থেকে নিয়েছেন। কারণ আগে সালাত ও পরে পশু কুরবানীর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন ঈদুল আযহায় পশু কুরবানী করে তার গোশত খাওয়া দিয়ে সেই দিনের খাবার শুরু করতে। এই আদেশ শুনে একজন সাহাবী ঈদের সালাতের আগেই পশু কুরবানী করে ফেলেছেন। মুহাম্মদ সা. তাকে আবারো কুরবানী করার জন্য বলেছেন এবং আগের কুরবানী বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন।

যেহেতু স্টেট কায়েমের খুশির সাথে ঈদের ঘোষণা এসেছে তাই বহু ফিকহবিদ মনে করেন ঈদ উদযাপন কেবল দারুল ইসলামের মুসলিমরা করবে। যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা নেই সেখানে ঈদ উদযাপন করা যাবে না। অনেকে বলেছেন শুধুমাত্র সেসব স্থানে ঈদ উদযাপন করা যাবে যেখানের শাসক মুসলিম। অমুসলিম শাসকের অধীনে থেকে ঈদ উদযাপন অনেকেই জরুরি মনে করেন না।

৩য় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.-এর সাথে শত্রুতা পোষণকারীদের আবতার বা শিকড়কাটা বলেছেন। তারা রাসূল সা. সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছে এগুলো তাদের ব্যাপারেই ফলেছে। আজকে বিদ্রূপকারীদের কেউই সম্মান করে না। কেউ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে না। তাদের পরিচয় তাদের সন্তানরা দিতে লজ্জাবোধ করতো। শুধু তাই নয়, বিদ্রূপকারীদের সন্তানেরাই আল্লাহর রাসূল সা.-কে শ্রদ্ধাভরে সম্মান করেছেন। আজকে মুহাম্মদ সা.-এর অনেক শিষ্য। তারা শেকড়কাটা। তাদের কিছু নেই।

২৪ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৭ - বনু কুরাইজা যেভাবে বেঈমানীর শাস্তি পেল



খন্দকের যুদ্ধের সময় বহুদিন আবু সুফিয়ানের বাহিনী মদিনা অবরোধ করে রাখে। কিন্তু খন্দক থাকায় তা পেরিয়ে মদিনায় প্রবেশ করতে পারছিলো না। এমতাবস্থায় এক রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সেনাবাহিনী পাঠালেন। ভীষণ ধুলি ঝড়ে উড়ে গেল মুশরিকদের সম্মিলিত বাহিনীর তাঁবু ও পশু। তারা হাল ছেড়ে দিল। এর আগের কিছু ঘটনা ও ধূলিঝড় তাদের মনোবল পুরো ভেঙে দিয়েছে। খন্দকের যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ বিপদ আপতিত হয়। একের পর এক বিপদে অনেক মুসলিম উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারা আল্লাহর রাসূল সা. ও নিষ্ঠাবান মুসলিমদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এই ব্যাপারে সূরা আহযাবের ১২- ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিস্তারিত বলেছেন।

বিপদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিপদ হলো ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজার চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা। তারা মদিনা সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মিত্র শক্তি ছিল। যখন মুসলিমদের ওপর আরবদের সম্মিলিত বিশাল বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলো তখন তারা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের দিক থেকে আক্রমণের আশংকা করেন নাই বিধায় পূর্ণ শক্তি কুরাইশের বিরুদ্ধে মজুদ রেখেছিলেন। এমনিতেই মুসলিমদের শক্তি ছিল অপ্রতুল এর মধ্যে বনু কুরাইজাকে ঠেকানোর জন্য তিনশত সাহাবীর একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। এরপর আল্লাহর রাসূল কূটনৈতিক চাল চাললেন। এতে মুশরিকদের ঐক্য নষ্ট হয়ে পড়ে। একইসাথে বনু কুরাইজার সাথেও তাদের চুক্তি নষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে শেষ পর্যন্ত বনু কুরাইজা আক্রমণের সাহস পায়নি। আর আল্লাহ তায়ালা ধূলিঝড় দিয়ে আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে লণ্ডভণ্ড করে দেন।
 
আরব মুশরিকরা ব্যর্থ হয়ে চলে যাওয়ার পর যোহরের সময় আল্লাহর রাসূল সা. বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করলেন। তার শরীর ছিল ধূলোমলিন এবং এবং তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি অস্ত্র রেখে দিলেন ও পাক সাফ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন সময় জিবরীল আ. রাসূল সা. কাছে মানুষের বেশে আসলেন। তার মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত একটি খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বললেন,
- হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?
- হ্যাঁ
- কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইজার বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইজার এলাকায় গিয়ে আছরের নামাজ পড়ে।”

মুহাম্মদ সা. আলীকে রা.-কে পতাকা নিয়ে বনু কুরাইজার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী রা. রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিরুদ্ধে একটা জঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। কিছুক্ষণ পর রাসূল সা. উপস্থিত হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোনো কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী রা. বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।”
 
রাসূলুল্লাহ সা. বনু কুরাইজার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন বনু কুরাইজার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য তাঁদেরকে তিরস্কার করা হয়নি। আল্লাহর রাসূল সা. যাত্রাপথে যারা নামাজ পড়েছে ও যারা নামাজ পড়ে নাই উভয় দলকেই অনুমোদন করেছেন।
 
মুহাম্মদ সা. বনু কুরাইজাকে অবরোধ করলেন। তাদেরকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের আদেশ দিলেন। কিন্তু তারা আত্মসমর্পন করতে রাজি হয়নি। ইতোমধ্যে দুর্গের ভেতর থেকে এক নারী পাথর মেরে এক আনসার সাহাবীকে হত্যা করেছে। রাসূল সা. তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।

বনু কুরাইজার সাথে বনু নাদিরের নেতা ও খন্দক যুদ্ধের মূল পরিকল্পনাকারী হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইজার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইজাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইজা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন গোত্রপ্রধান কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো,
 
“হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যেকোনো একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো,
প্রথমত; মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগ্রন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানদের জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।”
 
তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।”
 
দ্বিতীয়ত; এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সবাইকে হত্যা করি। তারপর তরবারি নিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুন করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।”
 
সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?”
 
তৃতীয়ত “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবত, মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীরা আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে। কারণ তারা জানে ইহুদিরা শনিবারে যুদ্ধ করে না। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।”
 
তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।”
 
সর্বশেষ কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারাজীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”

তারপর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা মুহাম্মদ সা.-এর নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, আপনি আমাদের মিত্র আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সা. তাকে পাঠিয়ে দিলেন।
 
আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। মুহাম্মদ সা.-এর প্রস্তুতি দেখে তিনি এটা ভেবে নিলেন।
 
তিনি ইশারায় ইহুদিদের বুঝিয়ে দিলেন, রাসূল সা. তোমাদের হত্যা করবে। এই তথ্য বলে দেওয়ার পর তার উপলব্ধি হলো, তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে ফেলেছেন।
 
ভুল বুঝতে পেরে আবু লুবাবা পরক্ষণেই কুরাইজার দূর্গ থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে প্রতিজ্ঞা করলেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেওয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।”
 
রাসূলুল্লাহ সা. অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি তাকে মুক্ত করতে পারি না।”

প্রায় ছয় রাত আবু লুবাবা রা. নিজেকে বন্দি রাখলেন। কেবল নামাজের সময় হলে তার স্ত্রী বাঁধন খুলে দিতেন। এসময় তিনি ওজু করে নামাজ পড়তেন। সাত দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা আবু লুবাবা রা.-এর তওবা কবুল করলেন। এই প্রসঙ্গে সূরা তাওবার ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, //আর অপর কতক লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তারা এক সৎকর্মের সাথে অসৎকর্ম মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাক্ষমাশীল পরম দয়ালু।//
 
এই আয়াত নাজিলের পর আম্মাজান উম্মে সালামা রা. বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “জানাতে পারো।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আবু লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা রা. বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেকে মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে মহানবী সা. তার বাঁধন খুলে দিলেন।

এখনো বনু কুরাইজা নিজেদেরকে সমর্পন করতে রাজি হয়নি। আবু লুবাবা রা.-এর ক্ষমা ঘোষণা হওয়ার পরদিন তারা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিল। কারণ ততদিনে তাদের রসদ ফুরিয়ে গেছে। বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সা.-এর ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আউস গোত্রের লোকরা যারা এই ইহুদী গোত্রের প্রতি দরদী ছিল তারা মুহাম্মদ সা.-এর নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইজা আগে আমাদের মিত্র ছিল। খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা আমাদের সহায়তা করতো।
 
আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আউস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’
 
অতঃপর বনু আউসের অনুরোধে হযরত মুহাম্মদ সা. তাদের গোত্রের পণ্ডিত ব্যক্তি সাদ ইবনে মুয়াজ রা.-কে বনু কুরাইজার বিচারের জন্য নিযুক্ত করেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় সাদ রা. আহত হয়েছিলেন। এসময় তীরের আঘাতে তার হাতের শিরা কেটে যায়। যুদ্ধাহত অবস্থায় তাকে বিচারের জন্য নিয়ে আসা হয়। সা’দ রা. রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, মুহাম্মদ সা. আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।”
 
সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবে। তোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বনু কুরাইজাকে জিজ্ঞাসা করেন তারা তার ব্যাপারে ও তাওরাতের ব্যাপারে আস্থাশীল কিনা। তারা তাতে সায় দিলো। সা'দ রা. সেসময় ঘোষণা দেন বনু কুরাইজার বিচার তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত অনুসারে হবে। সা'দ তাওরাত থেকে পাঠ করতে থাকেন।
 
//যখন তোমরা কোনো শহর আক্রমণ করতে যাবে, তখন প্রথমে সেখানকার লোকদের শান্তির আবেদন জানাবে। যদি তারা তোমাদের প্রস্তাব স্বীকার করে এবং দরজা খুলে দেয়, তাহলে সেই শহরের সমস্ত লোকেরা তোমাদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে এবং তোমাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু যদি শহরের লোকেরা তোমাদের শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে তাহলে তোমরা অবশ্যই শহরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। এবং যখন শহরটিকে অধিগ্রহণ করতে প্রভু তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের সাহায্য করবেন, তখন তোমরা অবশ্যই সেখানকার সমস্ত পুরুষদের হত্যা করবে। কিন্তু তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য স্ত্রীলকদের, শিশুদের, গবাদিপশু ও শহরের যাবতীয় জিনিস নিতে পার। তোমরা এই সমস্ত জিনিসগুলি ব্যবহার করতে পার। প্রভু তোমাদের ঈশ্বর, তোমাদের এই জিনিসগুলি দিয়েছেন।//

এরপর সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইজার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”

মুহাম্মদ সা. সা’দ রা.-কে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”

এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে বলেন, //কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফেরদের পৃষ্টপোষকতা করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা একদলকে হত্যা করেছো এবং একদলকে বন্দী করেছো। তিনি তোমাদেরকে তাদের ভূমির, ঘর-বাড়ীর, ধন-সম্পদের এবং এমন এক ভূ-খন্ডের মালিক করে দিয়েছেন, যেখানে তোমরা যুদ্ধ করোনি। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।//

সা'দের সিদ্ধান্ত সকলে মেনে নিতে বাধ্য হলো। বন্দীদেরকে বনু নাজ্জার গোত্রের নারী কাইস বিনতে হারিসার বাড়িতে রাখা হয়। এরপর মদিনার বাজারে গর্ত খুড়ে ৬০০ মতান্তরে ৭০০ বন্দীর শিরচ্ছেদ করা হয়। বনু কুরাইজাকে প্ররোচনা দানকারী হুয়াই বিন আখতাবকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ইতিপূর্বে বনু কুরাইজাকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বনু কুরাইজার ভাগ্য বরণের জন্য হুয়াই তাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। তার পোষাক যাতে কেউ নিতে না পারে সেজন্য তিনি তার বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র করে রেখেছিলেন।
 
মুসলিমরা তাকে চিনতে পেরে মহানবী সা.-এর কাছে নিয়ে আসার পর সে হযরত মুহাম্মদ সা.-কে উদ্দেশ্য করে বললো, "আপনার সাথে শত্রুতার জন্য আমি নিজেকে নিন্দা করি না। কিন্তু যে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ সে পরাজিত হয়।" এরপর ইহুদী লোকেদের সম্বোধন করে বলেন, "লোকেরা, আল্লাহর ফয়সালায় কোনো অসুবিধা নেই। এটা ভাগ্যের লিখিত ব্যাপার। এটি এমন হত্যাকাণ্ড যা বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন।" এরপর হুয়াই বসে পড়েন ও তার শিরচ্ছেদ করা হয়। ইহুদিরা জেনে বুঝেই আল্লাহর সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয়।
 
পুরুষদের সাথে এক নারীকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। এই নারী কাল্লাদ বিন সুয়াইদ রা.-এর ওপর পাথর ছুড়ে মেরে তাকে হত্যা করেছিল। তাকে হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বন্দী নারী ও শিশুসহ যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়। তবে মুসলিমদের অনুরোধে বেশ কয়েকজন নিরীহ ইহুদিকে ক্ষমা করা হয়। এছাড়াও বনু কুরাইজার কিছু লোক আত্মসমর্পনের পূর্বে দুর্গ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরকেও পরিবারসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বনু কুরাইজার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন।

২৩ জুল, ২০২১

ইহুদি আলিম ও মুসলিম আলিম


মদিনায় রাষ্ট্রগঠন করার পর হযরত মুহাম্মদ সা. ইহুদী গোত্রগুলোর সঙ্গে নানারূপ চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন এবং তাদের জান-মালের কোনো ক্ষতি না করার ও তাদেরকে সর্বপ্রকার ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তারপরও ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে ইহুদি আলিমগণ বিশেষভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলো।

প্রথমত তারা নিশ্চিত জানতো মুহাম্মদ সা. যা বলছেন তা সত্য। এর সত্যতা তারা তাদের আসমানী কিতাব তাওরাতেই পেয়েছে। সেখানে মুহাম্মদ সা.-এর সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল। যেহেতু তারা আশা ও ধারণা করেছিলো শেষ নবী তাদের বংশ থেকেই আসবে, কিন্তু সেটা না হওয়াতে তারা মুহাম্মদ সা. মেনে নিতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত নবী আসার ধারাবাহিকতার জন্য তাদের বংশ অর্থাৎ বনী ইসরাইল অত্যন্ত সুপরিচিত, এজন্য তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতো। এই বংশে বেশিরভাগ নবী এসেছেন। এজন্য তাদের বংশীয় অহমিকা ছিল ব্যাপক। মুহাম্মদ সা. নবী হিসেবে আসার আবির্ভাব হওয়ার পর তাদের বংশের মর্যাদা কমে গেল। তাই তারা মুহাম্মদ সা.-কে সত্য নবী জেনেও বিরোধীতা করতে থাকে।

তৃতীয়ত ধর্মীয় দিক থেকে এ পর্যন্ত ইহুদীদের এক প্রকার অহমিকা ছিলো। আল্লাহর বিশেষ বান্দা ও দ্বীনদারির দিক দিয়ে সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধার পাত্র বলে গণ্য করতো। তারা নিজেদেরকে সাধারণ জনগণ ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করতো। আল্লাহর কাছে ইহুদি আলেমদের সুপারিশ পাওয়ার আশায় জনগণ তাদের কথা শুনতে ও মানতে বাধ্য হতো। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রসারের ফলে তাদের এই ভ্রান্ত ধার্মিকতা ও পেশাদারীর মুখোশ খসে পড়লো। সত্যিকার ধার্মিকতা কাকে বলে এবং যথার্থ তাকওয়ার তাৎপর্য কী, মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য শুনে লোকেরা তা জানতে পরলো। ফলে ইহুদি আলিমদের পুরোহিত তন্ত্র ও ধর্ম ব্যবসায়ে মন্দাভাব দেখা দিলো।

ইহুদি আলেমদের এই সকল সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তারা জোরালোভাবে মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকে। তাঁকে মিথ্যা নবী দাবীদার হিসেবে সাব্যস্ত করে। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ করে তারা সমাজে ফিতনা তৈরি করছিল। ইহুদিদের মিথ্যা প্রচারণায় মদিনার মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদারেররাও প্রভাবিত হয়।

তাদের মিথ্যা প্রচারণার জবাবে আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদা, সূরা নিসা, সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরানে ইহুদিদের সমালোচনা করেছেন ও তাদের বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরেছেন। আর তাদের আলিমদের জন্য তিনটি বিশেষ আয়াত নাজিল করেছেন সূরা বাকারাহ'র ১৭৪-১৭৬ নং আয়াতে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, //নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে সমস্ত বিধান অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো যারা গোপন করে এবং কিতাবের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই খায় না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

তারাই হিদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা এবং মাগফিরাতের পরিবর্তে আজাব ক্রয় করেছে। আগুনের উপর তারা কতই না ধৈর্যশীল। তা এই কারণে যে, আল্লাহ যথার্থরূপে কিতাব নাযিল করেছেন। আর নিশ্চয়ই যারা কিতাবে মতবিরোধ উদ্ভাবন করেছে, তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।//

অর্থাৎ তাওরাতের মধ্যে মুহাম্মদ সা.-এর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কিত যেসব আয়াত রয়েছে সেগুলো যেসব ইহুদি আলিম তাদের শ্রেষ্ঠত্ব চলে যাওয়ার ভয়ে গোপন করে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং ঐ আলিম নামধারীরা সাধারণ আরবদের নিকট হতে হাদিয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করতো আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার জন্য, দোয়া করার জন্য তাদের এই বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দুনিয়ায় অর্থ লাভ ও প্রভাবের জন্য আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করতো এবং তাদের ইচ্ছেমত আয়াত তারা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতো। অর্থাৎ যেসব আয়াত উল্লেখ করলে বা প্রচার হলে তাদের সমস্যা হবে সেসব আয়াত তারা গোপন রাখতো। সাধারণ জনগণকে তাওরাত পড়তে দিত না।

এখানেও এও বলা হয়েছে আল্লাহর কথা ব্যবহার করে ও আল্লাহর ভয় দেখিয়ে তারা যে অর্থ উপার্জন করছে তা প্রকৃতপক্ষে আগুনের অঙ্গার দ্বারা তারা তাদের পেট পূর্ণ করছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তাদের সাথে কথা পর্যন্ত বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না বরং তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে পতিত হবে। কেননা, তাদের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ ও অভিশাপ তাদের উপরে বর্ষিত হয়েছে এবং আজ তাদের উপর হতে আল্লাহর করুণা দৃষ্টি অপসারিত হয়েছে।

এই আয়াতের প্রসঙ্গে উস্তাদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ. বলেন, "এখানে যেসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মিথ্যা দাবি করে এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা চালায় এখানে আসলে তাদের সমস্ত দাবি ও প্রচারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজেদের পূত-পবিত্র সত্তার অধিকারী হবার এবং যে ব্যক্তি তাদের পেছনে চলবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার সুপারিশ করে তার গোনাহ খাতা মাফ করিয়ে নেয়ার ধারণা জনগনের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করে এবং জনগণও তাদের একথায় বিশ্বাস করে।

জবাবে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, আমি তাদের সাথে কথাই বলবো না এবং তাদের পবিত্রতার ঘোষণাও দেবো না"।

মওদূদী রহ. আরো বলেন, "সাধারণ লোকদের মধ্যে যত প্রকার বিভ্রান্তিকর কুসংস্কার প্রচলিত আছে এবং বাতিল রীতিনীতি ও অর্থহীন বিধি-নিষেধের যেসব নতুন নতুন শরিয়ত তৈরি হয়েছে ও বিদয়াত চালু হয়েছে এগুলোর জন্য দায়ি হচ্ছে সেই আলিম সমাজ, যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ছিল কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি। তারপর অজ্ঞতার কারণে লোকদের মধ্যে যখন ভুল পদ্ধতির প্রচলন হতে থাকে তখনো ঐ জালেম গোষ্ঠী মুখ বন্ধ করে বসে থেকেছে তাদের অর্থনৈতিক লাভের জন্য। তারা আল্লাহর কিতাবের বিধানের ওপর আবরণ পড়ে থাকাটাই নিজেদের জন্য লাভজনক বলে তাদের অনেকেই মনে করেছে। এদেরকেই এই আয়াতগুলোতে হুমকি দেওয়া হয়েছে"।

এবার আসুন, ঐ সময়ের ইহুদি আলিমদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল সেগুলো এখন মুসলিম আলিমদের মধ্যে দেখা যায় কিনা? ইহুদি আলিম আর মুসলিম আলিম নামধারীদের মধ্যে মিল রয়েছে কিনা?

এর উত্তর হবে বেশিরভাগ আলিম নামধারীরার এইসব দোষে দুষ্ট। তারা তাদের প্রয়োজনমতো কুরআন-হাদিস ও ইসলামকে ব্যবহার করে। জালিম শাসকের জুলুমকে বৈধতা দেয়। কুরআনের দাওয়াত দেওয়াকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে। মোটা অংকের টাকা দাবি করে কুরআনের তাফসির করে। অথচ এই কাজটা ফরজ। ফরজ ইবাদতের জন্য তারা টাকা দাবি করে জনগণের কাছে।

আমাদের কিছু মুসলিম আলিমদের মধ্যে ইহুদিদের মতো মিথ্যা অহমিকা দেখা যায়। এক আলিম ওপর আলিমের সাথে বাহাস করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এক ঘরানার আলিম অন্য ঘরানার আলিমদের মুর্খ হিসেবে অভিহিত করে। আবার যারা নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে নি তাদের ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার ও দাওয়াত দেওয়ার অধিকার দিতে রাজি হয় না মিথ্যা অহমিকার জন্য।

সবচেয়ে খারাপ কথা হলো তারা প্রতি কথায় উঠতে বসতে মতবিরোধ করে। মতবিরোধের জেরে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। এভাবে মুসলিমদের ঐক্যের সাথে থাকার, জামায়াতবদ্ধ থাকার ফরজ নির্দেশকে তারা উপেক্ষা করেন। এদের জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা মতবিরোধের উদ্ভব ঘটিয়ে সত্য থেকে বহুদূরে চলে গেছে।

এদেশের বেশিরভাগ আলিম নামধারীরা কোনো মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিনিময়ে টাকা নেয় ও দাবি করে। কেউ কেউ তো কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার ধৃষ্টতাও দেখায়! কী ভয়ংকর! সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে যেখানে মুহাম্মদ সা. বিচলিত, সেখানে কীভাবে তারা সুপারিশ করার ধৃষ্টতা দেখায় ইহুদিদের মতো!

আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াতে সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছেন, আর আমি যে কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন। সামান্য দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না এবং আমাকে ভয় করো।

আল্লাহ তায়ালার এই নিষেধ সত্ত্বেও এদেশের আলিম নামের লোকেরা মোটা অংকের বিনিময়ে মাহফিল করে। এডভান্স নেয়। ফুল পেমেন্ট না করলে মাহফিলে যায় না। আবার নিজেদেরকে দ্বীনের দাঈও মনে করে। কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলে বলে, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ারদের, উকিল এদের উদাহরণ টানে। বলে, তাদের থেকে টাকা দিয়ে পরামর্শ নিলে আলিমদের থেকে নিতে কী সমস্যা?

সমস্যা যে কী তা তো আল্লাহই বলে দিয়েছেন। উপরোক্ত লোকেরা কেউই আখিরাতের অংশ পাওয়ার জন্য এই কাজ করেন না। যেসব আলিম দ্বীনের দাওয়াত ও নসিহতকে অন্যান্য পেশার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন তারা নিজেকে দাঈ বলা থেকে বিরত হন। নিজেকে মোটিবেশনাল বক্তা হিসেবে পরিচিত করুন। কেউ কেউ তো নিজেদেরকে কনসার্টের আর্টিস্টদের সাথেও তুলনা করেন। ভালো কথা! আপনারা নিজেদেরকে কনসার্ট/ যাত্রার বিনোদন কর্মী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করুন। এই পরিচয়ে পরিচিত হলে আমাদের কোনো কথা নাই।

নিজেদের আলিম দাবি করবেন, মুফাসসির, মুফতি, মুহাদ্দিস, ইসলামিক স্কলার এসবে পরিচিত হবেন আর আয়াত বেচে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন তা হতে দেয়া ঠিক হবে না।

ওয়াজের মৌসুম আসছে। এখন শুরু হবে আলেম নামধারী বহু লোকের ইহুদী আচরণ। তাদের ব্যপারে সাবধান থাকুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এদের থেকে হিফাজত করুন। ইহুদি কালচার থেকে আমাদের আলিমদের হিফাজত করুন। আল্লাহর আয়াত বেচা জাহান্নামের আগুন খাওয়া লোকদের থেকে ইলম অর্জন করতে যাবেন না।

আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন।

১৮ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৬ - খন্দকের যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতি ও আল্লাহর সাহায্য

 


উহুদ যুদ্ধের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্র রাসূল সা. কৌশলে ও সামরিক তৎপরতা চালানোর মাধ্যমে কন্ট্রোল করেন। ফলে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চারিদিকে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে। এই সময়ে ইহুদিরা তাদের ঘৃণ্য আচরণ, ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতরা কারণে নানা ধরনের অবমাননা ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়।

ইহুদি গোত্র বনু নাদিরকে বহিষ্কার করার পর তারা খায়বারে থাকা ইহুদিদের কাছে আশ্রয় নেয়। তারা যখন দেখলো আবু সুফিয়ান নিজে চ্যালেঞ্জ দিয়েও সেই প্রতিশ্রুত যুদ্ধ করেনি। নজদের বনু গাতফান ভয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তখন তারা মরণ কামড় দেওয়ার পরিকল্পনা করলো। আবার তারা দেখলো যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই মুসলিমদের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে, তাই তারা সময় ক্ষেপন করতে রাজি ছিল না। 

বনু নাদিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাবের নেতৃত্বে ইহুদিরা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। মুসলনাদের ওপর সর্বশেষে আঘাত হানার জন্যে তারা প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তারা ভালো করে জানে তারা যুদ্ধে ভালো নয়, তাই তারা সব পক্ষকে একত্র করে যুদ্ধে নামানোর ষড়যন্ত্র শুরু করলো।  

বনু নাদিরের ২০ জন সর্দার ও নেতা মক্কায় কুরাইশদের কাছে হাজির হলো। তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মুশরিকদের উদ্বুদ্ধ করে বললো যে, তারাও সর্বাত্মক সাহায্য করবে এবং খরচের একটি বড় অংশ বহন করবে। মক্কার মুশরিকরা রাজি হয়ে গেলো। কুরাইশদের একটি দল প্রতিশ্রুত যুদ্ধ করতে পারে নি বলে লজ্জিত ছিল। তারা ইহুদিদের এই অফারকে লুফে নিল। 

ইহুদি প্রতিনিধিদল এরপর বনু গাতফানের কাছে গিয়ে তাদেরও মুক্কার মুশরিকদের মতোই যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করলো। তারাও প্রস্তুত হয়ে গেলো। এরপর ইহুদিদের এই প্রতিনিধিরা আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ঘুরে ঘুরে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে লাগলো এবং একটি সমন্বিত যুদ্ধের জন্যে আহ্বান জানালো। এতে বহু লোক যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলো। মোটকথা, ইহুদি রাজনীতিকরা সফলতার সাথে কাফেরদেরকে একত্র করতে সক্ষম হলো এবং বহু লোককে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করলো।

এরপর পরিকল্পিত কর্মসূচী অনুযায়ী দক্ষিণ দিক থেকে কুরাইশ, কেনানা এবং তোহামায় বসবাসকারী অন্যান্য নিত্র গোত্র মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এদের অধিনায়ক ছিলো মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান। সম্মিলিত সৈন্য সংখ্যা ছিলো ৪ হাজার। সফরকালে বনু সালিম গোত্রের লোকেরাও তাদের সাথে শামিল হলো। একই সময়ে পূর্ব দিকে থেকে গাতফান গোত্র, ফাজরাহ, মাররা এবং আশজাআ রওয়ানা হলো।

নির্দিষ্ট দিনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে সবাই মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। অল্পদিনের মধ্যেই মদিনার চারপাশে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সমবেত হলো। এই সৈন্য সংখ্যা হিসাব করলে এতো বড় ছিলো যে, মদীনার নারী শিশুসহ মোট জনসংখ্যাও তাদের সমান ছিলো না। এ বিরাট সেনাদল যদি হঠাৎ করে মদীনায় গিয়ে চড়াও হতো, তবে মুসলমানদের জন্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। এটাও বিচিত্র ছিলো না যে, মুসলমানদের তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতো।

যদিও আরবের পরিস্থিতি শান্ত ছিল ও মুসলিমদের অনুকূলে ছিল তবুও রাসূল সা. সক্রিয় ছিলেন। তিনি গোয়েন্দাদের থেকে নিয়মিত তথ্য পাচ্ছিলেন। আরবের মুশরিকরা খুব দ্রুতই একত্রিত হয়েছিল। আর এই খবর পাওয়া মাত্র মুহাম্মদ সা. মজলিসে শুরার বৈঠক ডাকলেন। সেখানে সবাই মদিনার প্রতিরক্ষা নিয়ে কথা বলছিলেন। যেহেতু মুশরিকরা সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে আসছিলো তাই মদিনা থেকে বের হয়ে তাদের কোন একটি প্রান্তরে আটকানোর সুযোগ ছিল না।  

ইরানের সাহাবি সালমান ফারসি রা. বললেন, ইরানে যখন অবরুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন সেখানে পরিখা বা গর্ত খনন করা হয়। আমরা যদি মদিনার উত্তর পাশে (অন্য সবদিকে পাহাড় ও বনভূমি) পরিখা খনন করি তাহলে শত্রুরা মদিনায় ঢুকতে পারবে না। যেহেতু শত্রুদের গতিরোধ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল তাই শুরায় সালমান রা.-এর প্রস্তাবটি পাশ হয়।  

এটা ছিলো একটি সুচিন্তিত প্রতিরক্ষা প্রস্তাব। আরবের জনগণ এ ধরনের কৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিলো না। মুহাম্মদ সা. এ প্রস্তাব অনুমোদন করে অবিলম্বে খনন কাজ শুরু করলেন। রাসূল সা. নিজেই এ কাজ দেখা শোনা করতেন। তিনি নিজেও পরিখা খননে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় মদিনায় অভাব চলছিল। সাহাবারা ও রাসূল ক্ষুদার্ত থেকে এই কাজ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সা. ক্ষুদায় পেটের সাথে পাথর বেঁধেছেন।  

পরিখা খননের সময় একটি বিরাট পাথর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালা। কোদাল দিয়ে আঘাত করলে কোদাল ফিরে আসছিলো। এ ব্যাপারটি মুহাম্মদ সা.-কে জানানো হলে তিনি কোদাল হাতে নিয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে আঘাত করলেন। পাথরের একাংশ ভেঙ্গে গেলো। ভেঙে যাওয়া দেখে তিনি বললেন, ‘আল্লাহু আকবর! আমাকে শাম দেশের (সিরিয়া) চাবি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি এখন সেখানে লাল মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপর দ্বিতীয় আঘাত করলেন। আরো একটি টুকরো বের হলো। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি এখন মাদায়েনের শ্বেত মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপার তৃতীয় আঘাত করলেন। এতে পাথরের বাকি অংশ কেটে গেলো। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে ইয়েমেনের চাবি দেয়া হয়েছে। আমি এখন সানআর ফটক দেখতে পাচ্ছি।

মদীনা শহর উত্তর দিকে খোলা, অন্য তিনদিকে পাহাড় পর্বত এবং খেজুর বাগানে ঘেরা। একটি বড় অংশ খনন করতে হয়েছে বিধায় প্রতিজন সাহাবীর ওপর চল্লিশ হাত পরিখা খনন করার দায়িত্ব পড়ে। মুসলমানরা পরিখা খননের কাজ সমভাবে চালিয়ে যান। সারাদিন তারা খনন কাজ করনে, সন্ধায় ঘরে ফিরে যেতেন। এসময় খনন কাজ যাতে দ্রুত হয় এবং শত্রুরা আসার আগেই যাতে তা শেষ হয় সেজন্য মুসলিমরা নামাজ কাজা করেছেন। তারা ফজর নামাজ পড়ে কাজ শুরু করতেন। একেবারে অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত খনন করতেন। এরপর একসাথে চার নামাজগুলো পড়তেন। আল্লাহর রহমতে শত্রু বাহিনীর মদিনার কাছাকাছি আসার আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিখা খননের কাজ শেষ হয়ে যায়।

মদিনার মুনাফিকরা ভীত হয়ে পড়লো। তাদের প্ররোচনায় দুর্বল ঈমানের মুসলিমরাও ভীত হয়ে উঠলো। তারা যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পাচ্ছিল। তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, মুশরিকরা যদি মদিনায় ঢুকে পড়ে তবে তারা মুশরিকদের সাহায্য করবে এবং তাদেরই দলভুক্ত হয়ে যাবে। 

আল্লাহর রাসূল সা. মদিনার সকল সামর্থবানকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও মদিনা রক্ষার জন্য নির্দেশ দিলেন। মহিলাদেরও প্রস্তুত থাকতে বললেন। নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সুরক্ষিত বাড়ি ও দুর্গে রাখা হলো। মদিনা শাসনের ভার আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের হাতে ন্যস্ত করে মুহাম্মদ সা. যুদ্ধের সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন।  

মুশরিকরা মদিনায় অতর্কিত হামলা করতে এসে পরিখা দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। এমন একটি অপরিচিত বাধার মুখে পড়ে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা পরিখার বাইরে মদিনা অবরোধ করে পড়ে থাকলো। এই বাধা মুকাবিলা করার প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এ কারণে মুশরিকরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।

এদিকে মুসলমানরা কাফেরদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে এবং তাদেরকে পরিখার ধারে কাছে আসতে দিচ্ছিলো না। কাছে এলে তীর নিক্ষেপ করছিলো। ফলে বিধর্মীরা দারুণ বেকায়দায় পড়লো। তাছাড়া পরিখাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাই গণহারে পরিখায় নামা এবং পরিখার কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলো না। মাটি ফেলে পরিখা ভরাট করাও ছিলো অচিন্তনীয়।

মক্কার মুশরিকদের কয়েকটি সাহসী গ্রুপ জীবন বাজি রেখে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করে। তারা কয়েকজন পরিখায় নেমে মাথার ওপরে ঢাল দিয়ে রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করলো। সেই রাস্তায় আমর ইবনে আব্দে ইকরামাসহ কয়েকজন ঘোড়া দিয়ে অতিক্রম করার চেষ্টা করলো। আলী রা. কয়েকজন সাহাবাকে নিয়ে তাদের চেষ্টা নস্যাৎ করে দিলেন এবং পরিখার নিরাপত্তা জোরদার করলেন। এর মধ্যে আমর আলী রা.-এর সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ হারায়। আবু জাহলের পুত্র ইকরামা তার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে গেল।     

মুশরিকরা পরিখা অতিক্রম করা অথবা পরিখা ভরাট করে রাস্তা তৈরির সব রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদেরকে পরিখার কাছে আসতে দিচ্ছিলেন না। তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ অথবা বর্শা তাক করে এমনভাবে প্রতিহত করলেন যে, তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

মুশরিকরা পরিখা অতিক্রম করে মদীনায় হামলা করতে কয়েকদিন যাবত প্রাণপণ চেষ্ট করছিলো এবং মুসলমানরা সে চেষ্টা প্রতিহত করছিলেন। উভয় দলের মাঝখানে পরিখা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ কারণে মুখোমুখি রক্তাক্ত সংঘর্ষের সুযোগ হয়নি। বরং পরস্পরের প্রতি তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তীর নিক্ষেপে উভয় পক্ষে কয়েকজন নিহত হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো দশ। নিহত পৌত্তলিকদের মধ্যে দুই জন কি একজন তলোয়ারের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে।

যেহেতু পরিখা বা খন্দক খনন করে প্রতিরক্ষা দেওয়া হয়েছে তাই এই যুদ্ধ খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এছাড়া কুরআনে এটিকে আহযাবের যুদ্ধ বলেও উদ্ধৃত করা হয়েছে। আহযাব মানে সম্মিলিত বাহিনী। যেহেতু মুশরিকরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেছে তাই এটি আহযাবের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। মদিনায় তখন একটি মাত্র ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা ছিল। তারা যাতে কোনো ষড়যন্ত্রে যুক্ত না হয় এজন্য আহযাবের যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূল সা. তাদের কাছ থেকে পুনরায় অঙ্গীকার নিলেন, যুদ্ধের সময় তারা মদিনা রাষ্ট্রকে সাহায্য করবে, শত্রুদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ থেকে দূরে থাকবে। এটা একাধারে চুক্তি ও হুমকি দুইটাই ছিল। যদি তারা মদিনা সনদের চুক্তি অগ্রাহ্য করে তবে তাদের পরিণতি বনু কাইনুকা ও বনু নাদিরের মতো হবে। 

এদিকে অবরোধের দিন সংখ্যা বাড়ছে। মুশরিকদের বিশাল সেনাবাহিনীর খাবার ও অন্যান্য রশদ ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে। যুদ্ধের মূল অণুঘটক বনু নাদিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব বিচলিত হয়ে পড়লো। কোনোভাবেই বিশাল সেনাবাহিনী পরিখা অতিক্রম করতে পারছে না। পুরো আরবের সম্মিলিত বাহিনী পরিখার সামনে অসহায় হয়ে পড়ে আছে। তাই সে নতুন পরিকল্পনা করলো, মদিনার দক্ষিণে থাকা বনু কুরাইজা যদি মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করে তবে উত্তরে থাকা বিশাল সেনাবাহিনী সহজেই পরিখা অতিক্রম করতে পারবে। মুসলিমরা দুইদিক থেকে আক্রমণের শিকার হলে সহজেই ধ্বসে যাবে। 

হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইজা গোত্রের লোকদের কাছে এসে তাদের সর্দার কা‘ব ইবনে আসাদের কাছে হাজির হলো। হুয়াই এসে কা‘ব-এর দরজায় নক করলো। হুয়াইকে দেখামাত্র কা‘ব দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলার পর হুয়াই বললো, হে কা’ব, আমি তোমার জন্যে পৃথিবীর সম্মান এবং উত্তাল সমুদ্র নিয়ে এসেছি। আমি সব কুরাইশ সর্দারসহ সব কুরাইশকে রুমার মাজউল আসওয়ালে এনে সমবেত করেছি। বনু গাতফান গোত্রের লোকদেরকে তাদের সব সর্দারসহ উহুদের কাছে একত্রিত করেছি। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের পুরোপুরি নির্মুল না করে তারা সেই স্থান ত্যাগ করবে না।

কা’ব বললো, আল্লাহর কসম! তুমি আমার কাছে যুগের অপমান এবং বৃষ্টিবর্ষণকারী মেঘ নিয়ে হাজির হয়েছ। সেই মেঘ থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন বেরোচ্ছে। কিন্তু ওতে ভালো কিছু অবশিষ্ট নেই। হুয়াই, তোমার জন্যে আফসোস, আমাকে আমার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। আমি মোহাম্মদের মধ্যে সত্য এবং আনুগত্য ব্যতীত অন্য কিছু দেখিনি। 

কিন্তু হুয়াই কা’ব এর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাতে লাগলো। এক পর্যায়ে মুসলিমদের ওপর আক্রমণের ব্যাপারে তাকে রাজি করিয়ে ফেললো। তবে এজন্য হুয়াইকে এ অঙ্গীকার করতে হলো যে, কুরাইশ যদি মুহাম্মদকে খতম না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তবে আমিও তোমার সাথে তোমার দুর্গে প্রবেশ করবো। এরপর তোমার যে পরিণাম হবে আমি সেই পরিণাম মেনে নেব। হুয়াই এর এই ওয়াদার পর কা’ব ইবনে আসাদ ও তার গোত্র বনু কুরাইজা মুহাম্মদ সা.-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে তাদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলো।

এরপর বনু কুরাইজার ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। এমন সময় এক ইহুদি মুসলিম নারী ও শিশুদের দুর্গের চারপাশে টহল দিচ্ছিল এবং ইহুদীদের ঐ দুর্গ আক্রমণের জন্য উস্কে দিচ্ছিল। এটা দেখে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে রাসূল সা.-এর ফুফু সাফিয়্যা রা. খঞ্জর দিয়ে ঐ ইহুদিকে হত্যা করে ফেলেন। মুসলমান নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় রাসূল সা.-এর ফুফুর এই বীরত্বপূর্ণ কাজ দারুণ প্রভাব পড়লো। ইহুদীরা মনে করলো যে, দুর্গের ভেতর মুসলমানদের সহায়ক সেনা ইউনিট রয়েছে। ইহুদীরা এ কারণে সেই দুর্গের কাছে অন্য কউকে পাঠাতে সাহসী হয়নি। অথচ সেখানে কোনো সৈন্যই ছিলো না। কবি হাসান বিন সাবিত রা. শুধু সেখানে ছিলেন। যিনি যুদ্ধের জন্য নিজেকে ফিট মনে করতেন না।  

যদিও বনু কুরাইজার ইহুদিরা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণে ভয় পাচ্ছিল তবে তারা মক্কার কুরায়শ সৈন্যদের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশের প্রমাণ দেওয়ার জন্যে তারা তাদেরকে নিয়মিতভাবে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছিলো। এক পর্যায়ে মুসলমানরা সেই রসদের মধ্য থেকে ২০টি উট কেড়ে নেয়।

বনু কুরাইজার এই চুক্তিভঙ্গের কথা হযরত মুহাম্মাদ সা. জানতে পারেন। তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি শঙ্কিত হন। মদিনা সনদ অনুযায়ী বনু কুরাইজার ইহুদিরা মুসলিমদের মিত্র ছিল তাই তাদের এলাকার দিকে মুসলিমরা কোনো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। হযরত মুহাম্মাদ সা. প্রকৃত খবর সংগ্রহের জন্য সাহাবি সাদ বিন মুয়াজ, সাদ বিন উবাদা, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা ও খাওয়াত বিন জুবায়েরকে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের বলেন যে বনু কুরাইজা যদি মিত্রতা বহাল রাখে তবে তা যেন প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় যাতে মুসলিম সৈনিকদের মনোবল বজায় থাকে। কিন্তু মনোবল হ্রাসের আশঙ্কা থাকায় সম্ভাব্য চুক্তি লঙ্ঘনের সংবাদ ইঙ্গিতে তাকে জানানোর নির্দেশ দেন।

প্রেরিত সাহাবিরা বনু কুরাইজার দুর্গে গিয়ে দেখতে পান তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বনু কুরাইজা প্রতিনিধি দলের কাছে চুক্তি লঙ্ঘন ঘোষণা দিয়েছে। কুরাইজার লোকেরা শত্রুতা প্রদর্শন করে বলে যে মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে তাদের কোনো চুক্তি হয়নি। রাজির ঘটনার আদাল ও কারাহ গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অনুসারে প্রতিনিধি দল মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এসে শুধু বলেন আদাল ও কারাহ। এতে রাসূল সা. বুঝে যান, ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্য মুসলিমরা সবাই জেনে যায় বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এতে মুসলিমদের মনোবল নষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে সূরা আহযাবের ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

// যখন তারা তোমাদের ওপর দিক থেকে এবং তোমাদের নিম্ন দিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছিল, এবং যখন তোমাদের চক্ষু বিস্ফোরিত হয়েছিল, প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকম ধারণা করতে শুরু করেছিলে।//  

এখানে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের দূরাবস্থার কথা প্রকাশ করেন। চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এছাড়া মুসলিমদের সাথে মুনাফিকরা তো ছিলই। তারাও মনোবল ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত ছিল। অনেকেই আসন্ন পরাজয় দেখে আল্লাহর রাসূলের প্রতি ও আল্লাহর প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে।

আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. ও মুসলিমদের কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়ে পরীক্ষা করলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ১১ নং আয়াতে বলেন, 

// তখন মু’মিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল।//

একইসাথে আল্লাহ তায়ালা সেসময় মদিনায় থাকা মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন সূরা আহযাবের ১১-২০ নং আয়াতে। মুনাফিকদের সম্পর্কে তিনি ১২-১৩ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। 

//আর যখন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে তারা বলেছিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর স্মরণ করো! যখন তাদের মধ্য থেকে এক দল বলেছিল: হে ইয়াসরিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, অতএব তোমরা ফিরে যাও আর তাদের মধ্যে এক দল নবীর কাছে অব্যাহতি চেয়ে বলেছিল, আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত। প্রকৃতপক্ষে তা অরক্ষিত ছিল না। বরং তাদের পালাবারই ইচ্ছা ছিল।//

মুনাফিকরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে প্রতারক বলেছিল। তারা ভয় পেয়ে যুদ্ধ থেকে পালানোর অজুহাত খুঁজে বের করেছে। তারা মুসলিমদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে মুসলিমদের কাবু করতে চেয়েছে এবং আগের জাহেলি ধর্মে ফিরে যেতে চেয়েছে। 

এরপর আল্লাহ তায়ালা ১৪ নং আয়াতে বলেন, // আর যদি শত্রুরা নগরীর চারদিক থেকে প্রবেশ করে কুফরীর জন্য তাদেরকে প্ররোচিত করতো, তবে তারা তৎক্ষণাৎ তাই করতো; এবং তারা সেথায় খুব অল্পই বিলম্ব করতো।// 

যদি আবু সুফিয়ান বাহিনী মদিনায় প্রবেশ করতো তবে তারা সবাই কাফের হয়ে যেত। 

১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, //অথচ এরাই পূর্বে আল্লাহর সাথে শপথ করেছিল যে, তারা পিছু হটে ফিরে যাবে না। অবশ্যই আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারের জবাবদিহি করতেই হবে তাদেরকে।//

তারপর নবী সা.-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ ১৬-১৭ নং আয়াতে বলেন, //তুমি বলে দাও, তোমরা যদি মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পালায়ন করো, তবে পলায়ন তোমাদের কোনই উপকারে আসবে না এবং তখন তোমাদেরকে অল্পই ভোগ করতে দেয়া হবে। আরো বলে দাও সে কে, যে তোমাদেরকে আল্লাহর (শাস্তি) থেকে রক্ষা করতে পারে, যদি তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদের কোন ক্ষতি করতে? অথবা (সে কে, যে রোধ করতে পারে তাঁর অনুগ্রহকে,) যদি তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন? আর তারা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের জন্য কোন বন্ধু ও কোন সাহায্যকারী পাবে না।//

তাদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ ১৯ নং আয়াতে বলেন, //তারা তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে। আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে তোমার দিকে তাকায়। অতঃপর যখন সে ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। আর এরূপ করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।//

অর্থাৎ তারা যুদ্ধের সময় দানের ক্ষেত্রে খুব দান করবে। মুসলিমরা যখন যুদ্ধের মুখোমুখি তারা তারা অচেতন ব্যাক্তির মতো চোখ উল্টিয়ে যুদ্ধ থেকে পালাতে চাইবে। কিন্তু যখন যুদ্ধ জয় হবে তখন গনিমতের সম্পদ পাবার ক্ষেত্রে তাদের দাবি খুব উচ্চস্বরে করবে। সেক্ষেত্রে মুসলিমদের আক্রমণ করবে। 

আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২১-২৪ নং আয়াতে মুমিনদের কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৩ নং আয়াতে বলেন, //মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক এমনও আছে যারা আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে; তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাহাদাতবরণ করেছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষায় রয়েছে। তারা স্বীয় সংকল্প একটুও পরিবর্তন করেনি//

হযরত মুহাম্মদ সা. বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার কথা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বনু কুরাইজার দিক থেকে মদিনার উপর আক্রমণ আসবে দ্রুত এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য হযরত মুহাম্মদ সা. প্রথমে সামরিক পদক্ষেপ নেন। প্রথমে নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য শহরের ভেতরের দিকে ১০০ জন সেনা প্রেরণ করা হয়। এরপর আরো ৩০০ অশ্বারোহী প্রেরণ করা হয়। তারপর তিনি তার কূটনৈতিক পদক্ষেপ শুরু করেন। তিনি মুশরিকদের সম্মিলিত জোটের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চেয়েছেন যাতে তাদের মনোবল দুর্বল হয়। 

প্রথমে রাসূল সা. বনু গাতাফানদের দুই নেতা উয়াইনা বিন হিসন ও হারিস বিন আউফের কাছে বার্তা পাঠান। সেখানে উল্লেখ করেন, তারা যদি জোট বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করলে মদিনায় উৎপন্ন খেজুরের এক তৃতীয়াংশ তাদের দেয়া হবে। তারা এই শর্তে সন্ধিতে রাজি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে তিনি সাদ ইবনে মুয়াজ ও সাদ বিন উবাদার কাছে তাদের পরামর্শ চান। তারা জানান যে যদি এটি আল্লাহর নির্দেশ হয় তবে তাদের আপত্তি নেই কিন্তু যদি মদিনাবাসীর দুরবস্থার কথা চিন্তা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে তার প্রয়োজন নেই। হযরত মুহাম্মদ সা. জানান যে সমগ্র আরব অস্ত্র ধারণ করেছে বলে তিনি তাদের জন্যই এই পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। অভিজ্ঞ সাহাবীরা নিষেধ করায় তিনি এ বিষয়ে আর আগান নি।

এই অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ সা. তার গোয়েন্দা নুয়াইম ইবনে মাসুদ রা.-কে গোপনে ডেকে পাঠান। তিনি ছিলেন গাতফানের একজন নেতা ও জোটবাহিনীর কাছে সম্মানিত। তিনি মুসলিম ছিলেন তবে ছিল গোপন। আল্লাহর রাসূল সা. তাকে জোট ভাঙার দায়িত্ব দেন যাতে তারা পরস্পরের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। 

নুয়াইম রা. এরপর একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তার সাথে বনু কুরাইজার সুসম্পর্ক ছিল। তাই তিনি প্রথমে বনু কুরাইজার কাছে যান এবং জোটের বাকিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের সতর্ক করেন। তিনি তাদের বলেন বনু কুরাইজার সাথে কুরাইশ ও গাতাফানের পরিস্থতির কোনো মিল নেই। এখানে দুই গোত্রের ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ বলতে কিছু নেই। তারা তাদের স্বার্থ দেখলে গ্রহণ করবে, আর না দেখলে চলে যাবে। কিন্তু এই এলাকা বনু কুরাইজার নিজস্ব, যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন তাদেরকে এখানেই থাকতে হবে এবং যদি তারা মুসলিমদের শত্রুর সাথে হাত মেলায় তবে অবশ্যই মুসলিমরা এর প্রতিশোধ নেবে। এই কথা শোনার পর বনু কুরাইজা ভীত হয়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়। নুয়াইম রা. মত দেন যে যতক্ষণ কুরাইশদের মধ্য থেকে কিছু লোককে জামিন হিসেবে বনু কুরাইজার জিম্মায় না দেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যাতে তাদের সহায়তা করা না হয়।

এরপর নুয়াইম রা. কুরাইশদের শিবিরে যান। তিনি বলেন যে ইহুদিরা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে লজ্জিত। তাই তারা কুরাইশদের কিছু লোককে জামিন হিসেবে গ্রহণ করে মুসলিমদের সমর্পণ করতে চায় যাতে অঙ্গীকার ভঙ্গের ক্ষতি পূরণ হয়। তাই ইহুদিরা যদি জামিন হিসেবে কিছু লোক চায় তবে তা যাতে মেনে নেয়া না হয়। নুয়াইম একইভাবে বনু গাতাফানের কাছে গিয়ে একই বার্তা দেন। 

নুয়াইম রা.-এর কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়। তার পরামর্শের পর কুরাইশ নেতারা বনু কুরাইজার নিকট বার্তা পাঠিয়ে জানায় যে তাদের নিজেদের অবস্থা প্রতিকূল। উট ও ঘোড়াগুলিও মারা যাচ্ছে। তাই যাতে দক্ষিণ দিক থেকে বনু কুরাইজা এবং উত্তর দিক থেকে জোট বাহিনী আক্রমণ করে। কিন্তু এসময় শনিবার ছিল বিধায় ইহুদিরা জানায় যে এই দিনে যুদ্ধ করা তাদের ধর্মবিরুদ্ধ এবং ইতোপূর্বে তাদের পূর্বপুরুষদের যারা এই নির্দেশ অমান্য করেছিল তাদের ভয়াবহ পরিণতি হয়। তাছাড়া কুরাইশ পক্ষের কিছু লোককে জামিন হিসেবে বনু কুরাইজার জিম্মায় না দেয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধে অংশ নেবে না। এর ফলে কুরাইশ ও গাতাফানরা নুয়াইমের কথার সত্যতা পায় এবং জামিন হিসেবে লোক প্রেরণের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ফলে কুরাইশ ও গাতাফানের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কুরাইজাও নুয়াইমের কথার সত্যতা পেয়ে শঙ্কিত হয়। ফলে জোটে ভাঙ্গন ধরে যায়। সবাই সবার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকে।  

আবু সুফিয়ানের বাহিনী প্রায় একমাস ধরে অবরোধ অব্যাহত রাখলো মদিনার উত্তর দিকে। যদিও মুশরিকরা খন্দক অতিক্রম করতে সক্ষম হলো না তবে তারা মাসাধিককাল ধরে মুসলমাদেরকে ঘিরে বসে থাকলো। এতে মুসলমানরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। 

অতঃপর আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে ভীষণ বেগে ঝড় তুফান ও ঘূর্ণিবার্তা প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এর ফলে কাফিরদের সমস্ত তাঁবু মূলোৎপাটিত হলো। কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। অগ্নি জ্বালানো কঠিন হয়ে গেল। কোন আশ্রয়স্থল তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ৯ নং আয়াতে বলেন, 

//হে মুমিনগণ, তোমরা স্মরণ করো! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে। যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছিল, তখন আমি তাদের ওপর প্রেরণ করেছিলাম এক প্রচণ্ড বায়ু এবং এমন এক সৈন্যদল যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখেন।// 

সেই রাতের বর্ণনা দেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা.। তিনি বলেন, “আমার মামা হযরত উসমান ইবনে মাযউন রা. খন্দকের যুদ্ধের রাত্রে কঠিন শীত ও প্রচণ্ড বাতাসের সময় খাদ্য ও কম্বল আনার জন্যে আমাকে শহরে প্রেরণ করেন। ভীষণ জোরে বাতাস বইতেছিল। বাতাস আমার ঢালে ধাক্কা দিচ্ছিল এবং আমি তাতে আঘাত পাচ্ছিলাম। এমনকি ঢাল থেকে লোহা খুলে আমার পায়ে পড়ে গেল। আমি ওটাকে ফেলে দিয়ে চলে গেলাম। 

এই ভয়ংকর অবস্থায় আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সকলকে সম্বোধন করে বললেন, হে কুরাইশের দল! আল্লাহর কসম, আমাদের আর কোথাও দাঁড়াবার স্থান নেই। আমাদের গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুগুলো এবং আমাদের উটগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বনু কুরাইজা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা আমাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছে। অতঃপর এই ঝড়ো হাওয়া আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আমরা রান্না করে খেতে পারছি না। তাঁবু ও থাকার স্থান আমরা ঠিক রাখতে পারছি না। তোমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আমি তো ফিরে যাবার কথা চিন্তা করছি। আমি তোমাদের সকলকেই ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছি।” এ কথা বলেই পাশে যে উটটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল তার উপর তিনি উঠে বসলেন। 

কুরাইশদের ফিরে যাবার পর বনু গাতফানও বিনা বাক্য ব্যয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে চলে গেলো। খন্দকের যুদ্ধ বা আহযাবের যুদ্ধে লড়াই ছাড়াই পরাজয় হলো সম্মিলিত জোট বাহিনীর।