৩ জুল, ২০২১

পর্ব : ২১ - উহুদ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি যেভাবে হলো


উহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন তীরন্দাজরা তাদের দায়িত্ব থেকে সরে এসেছিলো তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ তার ঘোড়সওয়ার বাহিনী দিয়ে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে মুসলিমদের বেকায়দায় ফেলে দিল। রাসূল সা. অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এসময় তাঁর সাথে ছিল মাত্র ৯ জন। এরপর কতিপয় সাহাবার মরণপণ যুদ্ধে ও আল্লাহর সাহায্যে রাসূল সা. কাফেরদের আক্রমণ থেকে প্রাণে বাঁচলেন। আবু বকর রা., উমার রা. ও আলী রা.-এর পাল্টা বীরবিক্রম যুদ্ধে মুহাম্মদ সা. অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হয়ে মুসলিমদের মূল দলের সাথে মিলিত হতে পেরেছেন।

রাসূল সা. যখন মূল দলের সাথে একত্রিত হয়েছেন তখন মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান আর যুদ্ধ করতে চাইলো না। সে আগামী বছর একই সময়ে আবারো যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে চলে গেল। মুশরিকরা চলে যাওয়ার পর মুসলমানরা শহীদ এবং আহতদের খোঁজ নিতে শুরু করলেন।

যায়েদ ইবনে সাবেত রা. বলেন, মুহাম্মদ সা. আমাকে সা’দ ইবনে রাবি রা.-এর খোঁজ নিতে পাঠালেন। আমাকে বলে দিলেন যে, যদি সা’দকে পাওয়া যায় তবে তাকে আমার সালাম জানাবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, সে এখন কেমন বোধ করছে? আমি শহীদদের লাশের মধ্যে খুঁজে খুঁজে তাকে বের করলাম। কাছে গিয়ে দেখি মুমূর্ষ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর দেহে বর্শা, তীর ও তলোয়ারে সত্তরটি আঘাত লেগেছিলো। আমি বললাম, হে সা’দ, রাসূল সা. আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনি কেমন অনুভব করছেন সেকথা জানতে চেয়েছেন।

উত্তরে সা’দ ইবনে রাবি রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল সা.-কে আমার সালাম। তাঁর কাছে বলবে যে, আমি জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি। আমার আনসার ভাইদের বলবে যে, যদি তোমাদের একটি চোখের স্পন্দন বাকি থাকতেও শত্রুরা আল্লাহর রসূলের কাছে পৌঁছুতে পারে, তবে আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন ওজর আপত্তি কাজে আসবে না। একথা বলার পরপরই তিনি শাহদাতবরণ করলেন।

আহতদের মধ্যে উসাইরামকেও দেখা গেলো। তখনো তাঁর প্রাণ-স্পন্দন অবশিষ্ট ছিলো। ইতোপূর্বে তাকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সে দাওয়াত গ্রহণ করেননি। অনেকে অবাক হয়ে বললেন, উসাইরাম এখানে এলো কীভাবে? আমরা তাকে তো ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু তিনি তো গ্রহণ করেননি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, আপনি কিভাবে এখানে এলেন? ইসলামের প্রতি ভালোবাসায় নাকি স্বজাতীয়দের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে? তিনি বললেন, ইসলামের প্রতি ভালোবাসায় এসেছি।

আমি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর প্রিয় রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং রাসূল সা.-এর সমর্থনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। বর্তমানে যে অবস্থায় আছি, সেটা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। এরপরই তিনি ইন্তেকাল করলেন। তার সম্পর্কে রাসূল সা. বললেন, সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত। আবু হুরাইরা রা. বলেন, সে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েই জান্নাতি হয়ে গেল।

এ সময় রাসূল সা. নিজেও শহীদদের লাশ ও আহতদের অবস্থা পরিদর্শন করলেন এবং বললেন, আমি এদের জন্যে সাক্ষী থাকব। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় ওঠাবেন যে, তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সেই রক্তের রং তো রক্তের মতোই হবে, কিন্তু সেই রক্ত থেকে কস্তুরীর সুবাস নির্গত হবে।

কয়েকজন সাহাবা তাদের ঘনিষ্ঠ শহীদ সাহাবাদের লাশ মদীনায় স্থানান্তর করতে চাইলেন। একদিকে বিপর্যস্ত ও ক্লান্ত বাহিনী অন্যদিকে এতগুলো লাশ মদিনায় নিয়ে কষ্টকর হবে, তাই মুহাম্মদ সা. সব শহীদের লাশ শাহাদাতবরণের জায়গাতেই দাফন করার নির্দেশ দিলেন। তিনি কাজ কমানোর জন্য শহীদদের অস্ত্র এবং পুস্তিনের পোশাক খুলে নিয়ে তাদেরকে বিনা গোসলে দাফন করতে নির্দেশ দিলেন। শুধু তাই নয়, একই কবরে কয়েকজনের লাশ দাফনের অনুমতি দিলেন।

হানযালা রা.-এর লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। সন্ধান করার পর এক জায়গায় পাওয়া গেলো, তার লাশ থেকে পানি ঝরছিলো। লাশ ছিলো মাটি থেকে কিছুটা উপরে ঝুলছিলো। রাসূল সা. সাহাবাদের বললেন, ফেরেশতাগণ তাকে গোসল করাচ্ছেন। এরপর বললেন, তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করো ব্যাপারটা কি? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানালেন তার গোসল ফরজ ছিলো।

মুহাম্মদ সা. নিজে চাচা হামজা রা.-এর লাশের সন্ধানে বের হলেন। তাঁকে প্রান্তরের মধ্যস্থলে পেলেন। দেখলেন, তার পেট চিরে কলিজা বের করা হয়েছে এবং নাক কান কেটে তাঁর লাশ বিকৃত করা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা. বললেন, “সাফিয়া (হামজার বোন ও রাসূলের ফুফু) যদি দুঃখ না পেতো এবং একটা চিরস্থায়ী রীতির জন্ম হওয়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে আমি হামজাকে এখানেই রেখে চলে যেতাম এবং তার লাশ পশু পক্ষিকে খেতে দিতাম। আর আল্লাহ যদি আর একটি রণাঙ্গনেও আমাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করে তাহলে আমি প্রতিশোধ হিসেবে তাদের ত্রিশ জনের লাশকে এভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত করবো।”

মুসলমানরা যখন রাসূল সা.-কে নিদারুণ মর্মাহত ও চাচার প্রতি পাশবিক আচরণে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত দেখলো, তখন তাঁরাও প্রতিজ্ঞা করলো কোনো সময় কুরাইশদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তাদের লাশ এমনভাবে বিকৃত করবে যার কোন নজীর আরবের ইতিহাসে নেই।

আল্লাহ তায়ালা এই প্রেক্ষিতে সূরা নাহলের ১২৬ ও ১২৭ নয় আয়াত নাজিল করলেন। আল্লাহ বলেন,
“তোমরা যদি কাউকে শাস্তি দাও তাহলে তাদের পক্ষ থেকে যেমন শাস্তি তোমরা পেয়েছিলে তার সমপরিমাণ শাস্তি দাও। আর যদি সহিষ্ণুতার পরিচয় দাও তাহলে (জেনে রাখ) ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। তুমি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর। তেমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। তাদের আচরণে মর্মাহত হয়ো না এবং তাদের দুরভিসন্ধিতে মনকে সংকীর্ণ করো না।”

এ আয়াত দুইটি নাজিলের ফলে মুহাম্মদ সা. লাশ বিকৃত করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বললেন। অতঃপর রাসূল সা. হামজার লাশ একটি চাদরে আবৃত করলেন। তারপর জানাজার নামায আদায় করলেন। তারপর অন্যান্য লাশের পাশে এনে রাখা হলো এবং প্রত্যেকের জন্য তিনি জানাজা পড়লেন। এভাবে হামজার জন্য বাহাত্তর বার জানাজা পড়া হলো। রাসূল সা. হামজা রা. এর সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা.-কে একসাথে একই কবরে দাফন করলেন। তিনি একইসাথে হামজা রা.-এর ভাতিজা ও দুধভাই ছিলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূল সা. শহীদ হামজা রা.-এর জন্যে যেভাবে কেঁদেছিলেন, তাঁকে অন্য কোন সময়ই ওরকম কাঁদতে দেখা যায়নি। নবী সা. শহীদ হামজা রা.-কে কেবলার দিকে রাখলেন এরপর তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে কাঁদলেন যে, আমরা তাঁর কান্নার হু হু শব্দ শুনতে পেলাম।

শহীদদের অবস্থা ছিলো বড়ই হৃদয়বিদারক। তাদের সবার জন্য কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করা যায় নি। খাব্বাব রা. জন্যে কালো পাড় বিশিষ্ট একটি চাদর ছানা অন্য কোন কাফন পাওয়া যায়নি। এই চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢাকা গেল না। শেষ পর্যন্ত পা খালি রেখে ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দেয়া হয়। একই ঘটনা আরো অনেক শহীদ সাহাবীর ক্ষেত্রে ঘটলো।

শহীদদের দাফন ও আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাসূল সা. উহুদের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সাহাবাদের সাথে নিয়ে দোয়া করলেন। তিনি বললেন,

//হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, সকল প্রশংসা তোমারই জন্যে। তুমি যা প্রশস্ত করে দাও, তা কেউ সংকীর্ণ করতে পারে না। তুমি যা সংকীর্ণ করে দাও, কেউ তা প্রশস্ত করতে পারে না। তুমি যাকে পথভ্রষ্ট করে দাও, কেউ তাকে হেদায়াত করতে পারে না, পক্ষান্তরে তুমি যাকে হেদায়াত দাও, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। যে জিনিস তুমি আটক করে দাও, সে জিনিস কেউ দিতে পারে না। পক্ষান্তরে যে জিনিস তুমি দাও, কেউ তা আটক করতে পারে না। যে জিনিস তুমি দূরে সরিয়ে দাও, সে জিনিস কাছে আনতে পারে না পক্ষান্তরে যে জিনিস তুমি কাছে এনে দাও, সে জিনিস কেউ দূরে সরিয়ে দিতে পারে না।

হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, আমাদের ওপর তোমার বরকত, রহমত, ফযল ও রিজিক প্রশস্ত করো।

হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে স্থায়ী নিয়ামতের জন্যে আবেদন করছি, যে নিয়ামত কখনো শেষ হবে না। হে আল্লাহ তায়ালা, আমি তোমার কাছে দারিদ্রের দিনে সাহায্য এবং ভয়ের দিনে নিরাপত্তার আবেদন জানাচ্ছি। হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছো, তার মন্দ থেকে, আর যা কিছু দাওনি তারও মন্দ থেকে আমরা তোমার কাছে পানাহ চাই।

হে আল্লাহ আমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দাও এবং আমাদের অন্তরকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে দাও। কুফুরি, ফাসেকি এবং নাফরমানী আমরা যেন পছন্দ না করি, সেই ব্যবস্থা করো এবং আমাদেরকে হেদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে দাও।

হে আল্লাহ, আমাদের মুসলমান থাকা অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং মুসলমান অবস্থায় পরকালে জীবিত করো। অবমাননা ও ফিতনা-ফাসাদ থেকে আমাদের দূরে রেখো। তোমার সালেহীন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে দাও।

হে আল্লাহ, তুমি যেসকল কাফেরকে মেরে ফেলো, তাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করো ও আযাবে নিক্ষেপ করো, যারা তোমার পয়গাম্বরকে মিথ্যাবাদী বলে এবং তোমার পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে। হে আল্লাহ, সেসব কাফেরকেও মারো, যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে।//

দোয়া শেষে রাসূল সা. সাহাবাদের নিয়ে মদিনার দিকে রওনা হলেন। উহুদের যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হয়েছেন। বর্ণনাকারীদের অধিকাংশই এই সংখ্যার ব্যাপারে একমত। শহীদদের মধ্যে ৬৫ জন ছিলেন আনসার। এদের মধ্যে ৪১ জন খাযরাজ গোত্র এবং ২৪ জন আওস গোত্র থেকে শহীদ হন। একজন ইহুদীও নিহত হয়েছিলো আবু সালামা গোত্রের। আর মুহাজির শহীদ ছিলেন মাত্র চারজন। আর মুশরিকদের মৃত সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ আছে। ইবনে ইসহাকের মতে ২২ জন নিহত হয়েছিলো। কিন্তু অনেকের বর্ণনায় ৩৭ জন পর্যন্ত হিসাব পাওয়া যায়।

মদিনায় এসেই মুহাম্মদ সা. জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কারণ নবী সা. আবু সুফিয়ানের আবারো ফিরে আসার আশংকা করছিলেন। সাহাবারা সকলেই রণক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও সারারাত মদীনার পথে পথে এবং মদীনার প্রবেশপথসমূহে পাহারায় কাটিয়ে দেন। মুহাম্মদ সা. আশঙ্কা করছিলেন, যদি শত্রুরা এরূপ ভেবে থাকে যে, যুদ্ধের ময়দানে সংখ্যায় বেশী হয়েও আমরা কোন ফায়দা অর্জন করতে পারিনি, তবে নিশ্চয়ই তারা লজ্জিত হবে। এর ফলে তারা মক্কার পথ থেকে ফিরে এসে মদিনায় হামলা করতে পারে। এ কারণে মুহাম্মদ সা. সিদ্ধান্ত নিলেন মক্কার সৈন্যদের অনুসরণ করতে হবে।

যুদ্ধের পরদিন অর্থাৎ তৃতীয় হিজরির ৮ শাওয়াল সকালে মুহাম্মদ সা. ঘোষণা করলেন, শত্রুদের মোকাবেলার জন্যে রওয়ানা হতে হবে, তবে শর্ত জুড়ে দেন কেবল ওহুদের যুদ্ধে যারা শরিক হয়েছিলো তারাই শুধু আমাদের সাথে যেতে পারবে। সম্ভবত এর কারণ রাসূল সা. চাননি কোনো দুর্বল ঈমানের লোক অভিযানে শরিক হয়ে আবার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাবে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অনুমতি চাইলো, রাসূল সা.-এর সাথে অভিযানে শরিক হওয়ার জন্য। কিন্তু নবী সা. তাকে অনুমতি দিলেন না। তবে অল্প কিছু সাহাবা যারা পরিবারের শরয়ি কারণে রাসূল সা.-এর অনুমতিক্রমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা অভিযানে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন।

মুহাম্মদ সা. নিজের গোয়েন্দা মা'বাদ রা.-কে আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠালেন। মা'বাদ রা.-এর ইসলাম গ্রহণ গোপন ছিল। আবু সুফিয়ান তাকে মুশরিক হিসেবেই জানতো। মহানবী সা. তাকে মুশরিকদের কাছে পাঠিয়ে বললেন, আবু সুফিয়ানের কাছে যাও এবং তার উদ্যম নষ্ট করে তাকে নিরুৎসাহিত করো।

এদিকে নবী সা. যে আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই সত্য হলো। মদীনা থেকে ছত্রিশ মাইল দূরবর্তী রওহা নামক জায়গায় পৌঁছে মুশরিকরা একে অন্যকে দোষারোপ করতে লাগলো। তারা একদল অন্য দলকে বলছিলো, তোমরা কিছুই করোনি। ওদের শক্তিহীন করার পরও আমরা তাদের ছেড়ে দিয়েছি। ওদের এতো বেশি মাথা এখনো বিদ্যমান রয়েছে, যা কিনা পুনরায় তোমাদের মাথা ব্যথার কারণ হবে। চলো ফিরে যাই, ওদেরকে সমূলে উৎপাটন করি।

সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এই অভিমতের বিরোধিতা করে বললো, তোমরা অমন করো না। আমি আশঙ্কা করছি যে, যে সকল মুসলমান উহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়নি. এবার তারাও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কাজেই জয়লাভ আমরাই করেছি এরূপ আত্মপ্রসাদ নিয়ে মক্কায় ফিরে চলো। অন্যথায় মদিনায় হামলা করলে বিপদে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু অধিকাংশ মুশরিক এ মতামত গ্রহণ করলো না এবং তারা মদিনার ওপর হামলা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো।

তারা মদিনা অভিমুখে যাত্রা করার আগেই মা’বাদ রা. সেখানে পৌঁছুলেন। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলো, মা’বাদ, পেছনের খবর কী? মা’বাদ বললেন, মুহাম্মদকে দেখেছি তার সঙ্গীদের নিয়ে তোমাদের অনুসরণে বেরিয়ে পড়েছেন। তারা সংখ্যায় এত বেশী যে, এতো বড় সৈন্যদল এর আগে আমি কখনো দেখিনি। সবাই তোমাদের বিরুদ্ধে ক্রোধে জ্বলছে। উহুদের যুদ্ধে যারা যোগদান করেনি, এবার তারাও যোগদান করেছে। তারা যুদ্ধে যা কিছু হারিয়েছে, সে জন্যে লজ্জিত। বর্তমানে তোমাদের বিরুদ্ধে এমন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে যে, আমি এ রকম ক্রোধের উদাহরণ আগে দেখিনি।

আবু সুফিয়ান বললো, আরে ভাই, তুমি এসব কী বলছো!

মা’বাদ বললেন, হাঁ, সত্যি বলছি। আমার ধারণা তোমরা এখান থেকে চলে যাওয়ার আগেই ওদের ঘোড়ার দলটি দেখতে পাবে। সৈন্যদের অগ্রবর্তী দল এই টিলার পেছনে থেকে বেরিয়ে আসবে।

আবু সুফিয়ান বললো, আল্লাহর শপথ! আমরা শপথ নিয়েছি, ওদের ওপর পাল্টা হামলা করে তাদের নির্মূল করে দেবো।

মা’বাদ বললেন, অমন করো না। আমি তোমাদের ভালোর জন্যে বলছি। মক্কার দিকে ফিরে যাও।

এসব কথা শুনে কাফেরদের মনোবল ভেঙ্গে গেলো। তারা মক্কায় ফিরে যাওয়াই কল্যাণকর মনে করলো। তবে আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করতে এবং তাদের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে একটা কৌশল অবলম্বন করলো।

মদিনার দিকে পথচলা বনু আবদে কায়সের একটি কাফেলার লোকদের ডেকে আবু সুফিয়ান বললো, আপনারা কি মুহাম্মদের কাছে আমার একটি পয়গাম পৌঁছে দিতে পারবেন? যদি পৌঁছে দেন, তবে আমি কথা দিচ্ছি যে, আপনারা মক্কায় এলে ওকাযের বাজারে আপনাদের এতো বেশী কিসমিস দেবো, যতোটা এই উটনী বহন করতে পারে।

বনু আবদে কায়েসের লোকেরা আবু সুঠিয়ানের অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো।

আবু সুফিয়ান বললো, আপনারা মোহাম্মদকে বলবেন যে, আমরা তাকে এবং তার সঙ্গীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে পাল্টা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আবু সুফিয়ান ভেবেছে এই খবর পেয়ে মুসলিমরা ভয়ে ফিরে যাবে। কিন্তু কাফেলার লোকদের কাছে এই খবর পেয়ে মুসলমানদের ঈমান আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলো। তারা বললো, আল্লাহ তায়ালাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী।

এদিকে আবু সুফিয়ানের গোয়েন্দারাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের খবর ও মা'বাদের খবর মিলে যাওয়ায় এবং মুসলিমদের উৎসাহ দেখে আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। নবী সা. হামরাউল আসাদে ঘাঁটি স্থাপন করলেন এবং এখানে তিন দিন অর্থাৎ ৯ থেকে ১১ শাওয়াল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। এরপর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। মদিনায় আসার আগেই আবু আযযা জুমাই ও মুয়াবিয়া ইবনে মুগিরা নামে দুইজন মুশরিক গুপ্তচরকে আটক করেন সাহাবারা।

আবু আযযা বদরের যুদ্ধে আটক হয়েছিল। মহানবী সা. তার ঋণ ও কণ্যা সন্তানদের কথা বিবেচনা করে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল সে আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কবিতা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু উহুদের প্রাক্কালে কবিতা লিখে মুশরিকদের উদ্দীপ্ত করেছে এবং যুদ্ধেও যুক্ত হয়েছে। সে মহানবী সা.-এর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো। কিন্তু নবী সা. বলেন, এখন আর এটা হতে পারে না। তুমি মক্কায় গিয়ে মুখমন্ডলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে, মুহাম্মদকে আমি দ্বিতীয়বার ধোঁকা দিয়েছি। মুমিন এক গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না। এরপর তিনি তার মৃত্যদণ্ড ঘোষণা করলেন।

অন্য গুপ্তচর ছিল মুয়াবিয়া ইবনে মুগিরা ছিল উসমান রা. চাচাতো ভাই। সে মুহাম্মদ সা. কাছ থেকে উসমান রা.-এর রেফারেন্সে তিনদিনের আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলো। শর্ত ছিলো তিনদিনের মধ্যেই সে মদিনা ত্যাগ করবে। কিন্তু সে মদিনা ত্যাগ না করে মুসলিম বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখছিলো। তার গুপ্তচরবৃত্তি প্রমাণিত হলে মুহাম্মদ সা. তারও মৃত্যদণ্ড দেন।

উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিপর্যস্ত হলেও পরাজয় হয়েছে এই কথা বলা যায় না। কারণ মুসলিমরা তাদের অবস্থানে অত্যান্ত দৃঢ় ছিলেন। কয়েকটি বিষয় খেয়াল করুন।

১. মুশরিকরা মুসলমানদের ঘাঁটি দখল করে নিতে পারেনি
২. মুসলিমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেনি। বরং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুশরিকরা আগে গিয়েছে, মুসলিমরা দাফন শেষে গিয়েছে।
৩. মুশরিকরা একজন মুসলিমকেও বন্দি করতে সক্ষম হয়নি
৪. মুশরিকরা কোনো গনিমতের মালও হস্তগত করতে পারেনি।
৫. সেসময়ে যুদ্ধ জয়ের নিদর্শন হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনদিন অবস্থানের রেওয়াজ ছিল। তারা সেটা করেনি। উল্টো মুহাম্মদ সা. তাদের ধাওয়া দিয়ে তিনদিন অবস্থান করেছেন।
৬. তৃতীয় দফা শুরু না করে আবু সুফিয়ানের মক্কার পথে দ্রুত পলায়ন দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সে আশঙ্কা করছিলো যে, পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে তার সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অবধারিত।

উভয় পক্ষই নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে লাভবান ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন না করে এবং এবং নিজেদের শিবির শত্রুদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে না রেখে যুদ্ধ বন্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের যুদ্ধকেই বলা হয় অমীমাংসিত যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার দীর্ঘ পর্যালোচনা রয়েছে। সূরা ইমরানের প্রায় ৫০ টি আয়াত উহুদ যুদ্ধের পর্যালোচনায় নাজিল হয়েছে। এখান থেকে মুসলিমদের, যাদের দায়িত্ব দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা তাদের অনেক শিক্ষা রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন