প্রায় বিনা বাধায় মক্কা বিজয়ের পর আরবে মুসলিমরা বাধাপ্রাপ্ত হবে এমন ধারণা মুসলিমরা করতে পারেননি। অথচ প্রায় ১২ হাজারের বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হুনাইনের প্রান্তরে মুসলিমরা ধাক্কা খেয়েছে। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে বিজয় এসেছে। হুনাইনের বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী মুহাম্মদ সা.-এর নেতৃত্বে তাইফ অভিমুখে রওনা হলেন।
এ যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে হুনাইন যুদ্ধেরই অংশ। হাওয়াজেন গোত্রের পরাজিত লোকদের অধিকাংশই তাদের নেতা মালিক ইবনে আওফের সাথে তাইফে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো। আর সেখানে সাকিফ গোত্র তো আছেই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তাই মুহাম্মদ সা. তাইফ অভিযানে যাত্রা শুরু করলেন।
প্রথমে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয় তাইফের উদ্দেশ্যে। এরপর রাসূল সা. নিজে রওয়ান হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালিক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। সেই দুর্গ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তাইফ পৌঁছে মুসলিম বাহিনী। বনু সাকিফ তাইফ দুর্গে অবস্থান নেয়। মুসলিমরা তাদের দুর্গের কাছাকাছি হলেই বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করে।
বনু সাকিফ ও হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা ছিল দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ। হুনাইনের প্রান্তরেও মুসলিমরা এই তীরের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। মুহাম্মদ সা. তাইফ দুর্গ চারদিক থেকে ঘিরে অবরোধ করেন। অবরোধ ৪০ দিনের মতো দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানদের অবরোধকালে তাদের ওপর দুর্গ থেকে লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশি তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে বহু মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।
এর পরিস্থিতি মোকাবেলায় মুসলিমরা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করেন এবং দূর্গ লক্ষ্যে করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতেও কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।
মুহাম্মদ সা. শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত সাকিফ গোত্র আল্লাহর দোহাই এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালে মুহাম্মদ সা. তা মঞ্জুর করেন।
অবরোধের শেষ দিকে মুহাম্মদ সা. ঘোষণা করলেন যারা তাইফ দুর্গ থেকে বের হয়ে আসবে তা মুক্ত বলে বিবেচিত হবে। তারা যদি ক্রীতদাসও হয় তবেও তারা স্বাধীন হয়ে যাবে। এই ঘোষণায় তিরিশজন আত্মসমর্পন করে দুর্গ থেকে নেমে আসে। মুহাম্মদ সা. তাদের অভ্যর্থনা জানান।
প্রায় ৪০ দিন অবরোধ হয়ে গেলো। শত্রুদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা এক বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় মুহাম্মদ সা. নওফেল বিন মাবিয়া রা.-এর সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বলেন, শিয়াল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন। আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে মুহাম্মদ সা. অবরোধ তুলে নেওয়ার ও ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত উমার রা. সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা করে দিলেন, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাবো।
সাহাবাদের একটি বড় অংশ এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিরে যাবো? অবশেষে মুহাম্মদ সা. সাহাবাদের ভিন্নমত শুনে সেই মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন, আচ্ছা কাল সকালে যুদ্ধে করবো ইনশাআল্লাহ। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু ভয়ংকর তীরের আঘাত খেয়ে পিছু হটলেন। এরপর রাসূল সা. বললেন, ইনশাআল্লাহ আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন।
তায়েফ থেকে অবরোধ তুলে আসার পরও রাসূল সা. গনিমতের সম্পদ ভাগ বাটোয়ারা করা থেকে বিরত থাকলেন। হুনাইন থেকে পাওয়া গনিমত ও ফাই ছিল অনেক বেশি। এ দেরির কারণ ছিলো তিনি চাচ্ছিলেন, হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা ফিরে এসে তওবা করলে তিনি তাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু অপেক্ষা করার পরও কেউ আসলো না। এরপর মুহাম্মদ সা. গনিমতের মাল বন্টন করতে শুরু করলেন। নতুন মুসলমান হওয়া বিভিন্ন গোত্রের সর্দার এবং মক্কার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ গনিমতের সম্পদ পাওয়ার আশায় উন্মুখ ছিলেন। মুহাম্মদ সা. এ সকল নতুন মুসলমানদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গনিমতের সম্পদ প্রদান করলেন।
আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে ৪০ উকিয়া অর্থাৎ প্রায় ৬ কেজি রূপা অর্থাৎ চাঁদি এবং একশত উট দেয়া হলো। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র ইয়াজিদ? মুহাম্মদ সা. ইয়াজিদকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র মুয়াবিয়া? মুহাম্মদ সা. তাকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। মোটকথা একমাত্র আবু সুফিয়ান এবং তার দুই পুত্রকে প্রদান করা হলো ১৮ কিলোগ্রাম রূপা এবং তিনশত উট।
হারিস ইবনে কালদাকে একশত উট দেয়া হল। কুরায়শ এবং কুরায়শ নয় এমন সকল গোত্রীয় নেতাকে কাউকে একশত, কাউকে পঞ্চাশ এবং কাউকে চল্লিশটি করে উট দেওয়া হলো। লোকদের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মদ সা. এতো এতো দান করেন যে, তিনি দারিদ্রের আশঙ্কা করেন না। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেদুইনরা এসে আল্লাহর রাসূল সা.-কে ঘিরে ধরলো এবং কিছু পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করলো। তাদের ভীড়ের চোটে রাসূল সা.-এর গায়ের চাদর পড়ে গেলো।
এরপর মুহাম্মদ সা. তাঁর নিজের উটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার কয়েকটি লোম তুলে নিয়ে দেখিয়ে বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের ‘ফাই’ মালামালের মধ্যে থেকে আমার জন্যে কিছু নেই। এমনকি এই যে উটের পশম দেখছো, এই পরিমাণও নেই।
এরপর মুহাম্মদ সা. সৈন্যদের দিকে নজর করলেন। জায়েদ বিন সাবেত রা.-কে হিসাব করতে বললেন, তিনি হিসাব করে সৈন্যদের মধ্যে গনিমতের সম্পদ ভাগ করে দিলেন। এতে প্রত্যেক সৈন্যের ভাগে চারটি উট এবং ৪০টি বকরি পড়লো। বিশিষ্ট যোদ্ধা যাদের অবদান বেশি তারা পেলেন ১২টি করে উট এবং ১২টি করে বকরি।
এ বন্টনে মুহাম্মদ সা. বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। কেননা, পৃথিবীতে বহু লোক এমন রয়েছে যারা নিজের বিবেকের পথে নয় বরং পেটের পথে চলে। পশুর সামনে একমুঠো তাজা ঘাস ঝুলিয়ে পিছনে সরে গিয়ে তাকে যেমন নিরাপদ ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া যায় তেমনি উল্লিখিত সম্পদ বন্টনের দ্বারা নবদীক্ষিত মুসলমানদের মন জয়ের চেষ্ট করা হয়েছে। যাতে তারা ঈমান শেখার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রতি তাদের ভালোবাসা জাগ্রত হয়। কারণ তারা বাধ্য হয়ে ও বেকায়দায় পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। মুহাম্মদ সা. সম্পদের বন্টন করলেও বন্দি বন্টন করেন নি।
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিতরণে মুহাম্মদ সা.-এর এই রাজনৈতিক কৌশল সাহাবারা বুঝতে পারেনি। মুহাজির সাহাবাদের এই নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। রাসূল সা. যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতেই তারা কল্যাণ মনে করেছেন। আনসার সাহাবারা এতে মনেকষ্ট পেয়েছেন। তারা বলাবলি করছেন মুহাম্মদ সা. তার আত্মীয়দের মধ্যে বেশিরভাগ সম্পদ বন্টন করে দিয়েছেন। যারা মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন তারা হলেন তুলাকা সাহাবি। তুলাকা সাহাবিরা তো খুশিতে ডগমগ। তারা অনেক বেশি সম্পদ পেয়েছেন। মুহাম্মদ সা.-এর এই দান দেখে যেসব বেদুইন ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং হুনাইনের যুদ্ধে আটক বন্দীদের মধ্যে যারা মুসলিম হয়েছে তারা হলেন উতাকা সাহাবী। উতাকা সাহাবিরাও সম্পদ ও মুক্তি পেয়ে খুশি।
জারির বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত তুলাকা ও উতাকা সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করে নবীজী সা. বলেন, “কেয়ামত পর্যন্ত মুহাজির ও আনসারগণ একে অপরের বন্ধু হিসেবে থাকবে। অনুরূপ কুরাইশের (মক্কার) তুলাকা ও সাকীফের (তায়েফের) উতাকারাও পরস্পরের বন্ধু হিসেবে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।” [মুসনদে আহমদ (১৯২৩৫, ১৯২৩৮)]
মুহাম্মদ সা. যখন কুরাইশ এবং আরবের গোত্রীয় নেতাদের অধিক দান করলেন অথচ মুহাজির ও আনসারদের সে অনুযায়ী কিছুই দিলেন না, তখন আনসারদের মন খারাপ হয়ে গেলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু করলেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, আল্লাহর কসম! রাসূল সা. তাঁর জাতির সাথে মিশে গেছেন। সা’দ ইবনে উবাদা রা. রাসূল সা.-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে রাসূল সা.! যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে আপনি যেভাবে বন্টন করেছেন, এতে আনসাররা খুশি হয়নি। তারা সমালোচনা করছে। তারা বলছে, আপনি শুধু নিজের কওমের মধ্যেই সম্পদ বন্টন করেছেন। আবর গোত্রদের বিশেষভাবে দান করেছেন। অথচ আনসারদের কিছুই দেননি।
- হে সা’দ, এ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
- হে রাসূল সা., আমিও তো আমার জাতিরই একজন।
- যাও, তোমার কওমের লোকদের এক জায়গায় একত্রিত করো।
সা'দ রা.-এর আহ্বানে মদিনার আনসাররা এক জায়গায় আলাদাভাবে একত্রিত হলো। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুহাজির সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর বাকী মুহাজির, তুলাকা ও উতাকা সাহাবীদের এখান থেকে সরিয়ে দিলেন মুহাম্মদ সা.।
প্রিয় নবী বক্তব্যের শুরুতে হামদ পাঠ করলেন। এরপর বললেন, ‘হে আনসাররা! তোমাদের অসন্তোষ ও তোমাদের সমালোচনার কারণ কি?
আমি কি তোমদের কাছে এমন অবস্থায় যাইনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? আল্লাহ তায়ালা এরপর তোমাদের হিদায়াত দিলেন। তোমরা ছিলে পরমুখাপেক্ষি, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন। তোমাদের পরস্পর অন্তর জোড়া লাগিয়ে দিয়েছেন। এসব কি ঠিক নয়?
তারা বললেন, হ্যাঁ, হে রাসূল সা., আপনি ঠিক বলেছেন। আমাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল সা.-এর অনেক দয়া।
তিনি বললেন, আনসাররা জবাব দিচ্ছ না কেন? কেন তোমরা অসন্তুষ্ট?
তারা বললেন, আমরা কী জবাব দেবো? আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলের অনেক বড় দয়া আমাদের ওপর।
মুহাম্মদ সা. আবার বলতে শুরু করলেন, যদি তোমরা ইচ্ছা করো তবে একথা বলতে পারো যে, আপনি আমাদের কাছে এমন সময়ে এসেছিলেন যখন আপনাকে অবিশ্বাস করা হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনাকে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। আপনাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল, আমরা আপনাকে ঠিকানা দিয়েছি। আপনি নিরুপায় ছিলেন, আমরা আপনার দুঃখ লাঘব করেছি।
হে আনসাররা, তোমরা দুনিয়ায় তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্যে মনে মনে নাখোশ হয়েছো। সেই জিনিসের মাধ্যমে আমি কিছু লোকের মনে প্রবোধ দিয়েছি, যেন তারা মুসলমান হয়ে যায়। তোমাদেরকে তোমাদের গৃহীত ইসলামের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। হে আনসাররা, তোমরা কি এতে খুশি নও যে, অন্যরা উট বকরি নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা রাসূল সা.-কে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরবে? সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি আমাকে হিজরত করতে না হতো, তবে আমিও একজন আনসার হতাম। যদি সব লোক এক পথে চলে, আর আনসাররা অন্য পথে চলে, তবে আমি আনসারদের পথেই চলবো। হে আল্লাহ তায়ালা! আনসারদের ওপর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং তাদের পৌত্র-পোত্রীদের প্রতি রহমত করুন।
এভাবে মুহাম্মদ সা. আরো কিছুক্ষণ আবেগঘন বক্তব্য রাখলেন। আনসাররা বুঝতে পারলো তাদের উঁচু মর্যাদার কথা। তাদের অসন্তোষের জন্য তারা লজ্জিত হলো। অতঃপর মুহাম্মদ সা.-এর ভাষণ শুনে আনসাররা এতো বেশি কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাঁড়ি ভিজে গেলো। তারা বলতে লাগলেন, আমাদের কাছে রাসূল সা. থাকবেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা আর কিছু চাই না। এরপর রাসূল সা. নিজ তাঁবুতে ফিরে গেলেন এবং সাহবারা নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন।
সব বিলি বন্টনের পর হাওয়াজেন গোত্রের একদল প্রতিনিধি মুহাম্মদ সা.-এর কাছে আসলেন। তারা ছিলেন চৌদ্দজন। জুহাইর ইবনে সুরাদ ছিলেন তাদের নেতা। তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, সকলের মন নরম হয়ে গেলো। তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, বাইয়াত করেন এবং আল্লাহ-রসূলের সাথে কথা বলেন। তারা বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি যাদের বন্দী করেছেন, এদের মধ্যে আমাদের মা বোন রয়েছেন, ফুফু খালা রয়েছেন। এটা আমাদের কওমের জন্যে অবমননাকর। তারা রাসূল সা.-এর সাথে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে সম্পদ ও বন্দীদের ফেরত চাইলো। মুহাম্মদ সা. বললেন, সত্যি করে বলো, তোমরা নিজের সন্তান-সন্তনিকে বেশি ভালোবাসো নাকি ধন-সম্পদ?
তারা বললেন, পারিবারিক মর্যাদার মূ্ল্যই আমাদের কাছে বেশি। এর মধ্যে যোহরের নামাজের সময় হলো। নামাজ শেষে সাহাবাদের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ সা. বললেন, দেখো ওরা মুসলমান হয়ে এসেছে। এ কারণে আমি তাদের বন্দীদের বন্টনে দেরি করেছি। কাজেই যাদের কাছে বন্দী রয়েছে তারা যেন ফিরিয়ে দেয়। এটা খুব ভালো হবে। যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য অংশ রাখতে চায়, সেও যেন কয়েদীদের ফিরিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে যখন ‘ফাঈ’- এর মাল পাওয়া যাবে, এর বিনিময়ে তাদের ছয়গুণ দেওয়া হবে। লোকেরা বললো, আমরা রাসূল সা.-এর জন্য সব কিছু সানন্দে দিতে রাজি আছি। এরপর সাহাবারা বন্দী শিশু ও মহিলাদের ফেরত দিলেন।
এরপর নবম হিজরির শুরুতে মুহাম্মদ সা. মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। এই যাত্রা আর আট বছর আগের যাত্রার মধ্যে কত তফাৎ! আট বছর আগে গিয়েছেন পালিয়ে। আর আজ যাচ্ছেন বিজয়ীর বেশে। পুরো আরব কার্যত এখন মুহাম্মদ সা.-এর করতলে। মদিনার প্রবেশের সময় মুহাম্মদ সা. সেই সংবর্ধনা ও অভিনন্দন পেলেন আট বছর আগেও যা পেয়েছিলেন। মদিনাবাসী আনসাররা নিঃস্ব ও বিজয়ী উভয় অবস্থায়ই মুহাম্মদ সা.কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মুহাম্মদ সা. বিজয়ীর বেশে মদিনায় প্রবেশের সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সফল মক্কা বিজয় শেষ করে ফিরেছেন তিনি। মদিনায় প্রবেশ করেই সিজদায় লুটিয়ে পড়েন আমাদের নেতা মুহাম্মদ সা.। শুকরানা সালাত আদায় করেন তিনি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন