৩১ জানু, ২০২২

খিলাফত পর্ব-১৮ : শির্ক ও বিদয়াতের ব্যপারে উমার রা.-এর কঠোর অবস্থান

মিশরের সভ্যতা বহু দিনের সভ্যতা। এখানে জাদুমন্ত্রের ব্যবহার ছিল দীর্ঘদিনের। জাদুকররা সাধারণ মানুষের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তারে নানাবিধ বর্বর প্রথা চালু করেছিল। জাদুবিদ্যার ভেলকি দেখে তাদের ভয় পেত মানুষেরা। সেই ভয় থেকে জন্ম নিয়েছে নানান কুসংস্কার। এমনি একটি কুসংস্কার ছিল এরকম, বছরের শেষ মাসে একটি কুমারী নারীকে বিসর্জন দেওয়া হবে নীল নদে। তাহলে নীল নদে পানি আসবে নইলে পানি আসবে না। এই নারীকে তারা বলতো নীল নদের বউ। প্রতি বছর একজন বাবা-মার সাথে মিশরের শাসক চুক্তি করে অনেক টাকা পয়সা দেয়। বিনিময়ে তারা তাদের মেয়েকে নীলনদের বউ বানায়। 


উমার রা.-এর শাসনামলে মিশর অধিকার করেন আমর ইবনুল আস রা.। অতঃপর তাঁকে সেখানে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কুমারী নারী বিসর্জনের সময় আসলে মিশরবাসী আমর ইবনুল আসের কাছে এই প্রথার কথা জানায়। আমর ইবনুল আস রা. এই কথা শুনেই প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে এইধরণের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। 


এর কিছুদিন পর দেখা গেল নীল নদের পানি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। নীলনদ প্রায় শুকিয়ে গেল। মিসরবাসী আবারো আমর রা.-এর কাছে এসে নদীতে একটি কুমারীকে ফেলে দেওয়ার আবেদন করলো। আমর ইবনুল আস রা. নদীর এই আচরণ দেখে বিচলিত হয়ে গেলেন। তিনি অপেক্ষা করছিলেন, কিছুদিনের মধ্যে হয়তো পানি চলে আসবে। কিন্তু পানি আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। 


এদিকে নীলনদের পানিও ওপর নির্ভরশীল কৃষক ও অন্যান্য মানুষেরা হতাশ হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চিন্তা করছে। এই পরিস্থিতিতে আমর ইবনুল আস রা. সব বৃত্তান্ত উল্লেখ করে উমার রা.-এর কাছে চিঠি লিখলেন। চিঠি পেয়ে দ্রুত পাল্টা চিঠি লিখলেন উমার রা.। একটা চিঠি আমর রা.-এর উদ্দেশ্যে অন্য চিঠি নীলনদের উদ্দেশ্যে লিখলেন। 


আমর রা.-কে লিখলেন চিঠির খামের মধ্যে এক টুকরো কাগজ আছে এটা নীলনদের মধ্যে ফেলে দিও। আর নীলনদকে লিখলেন, 


আল্লাহর গোলাম ও আমীরুল মু'মিনীনের পক্ষ থেকে মিশরের নীলনদের কাছে, 

নদীর পানি প্রবাহের সিদ্ধান্ত যদি তোমার ইচ্ছেতে হয়, তাহলে আর প্রবাহিত হয়ো না। আমাদের আর তোমাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু তুমি যদি এক আল্লাহ ও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী আল্লাহর হুকুমে প্রবাহিত হও তবে আল্লাহর কাছে চাই তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন। 


এই চিঠিটি আমর রা. নদীতে ফেলে দেন। পরদিন সকালে মিসরবাসী দেখলো নদীতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা উমার রা.-এর মাধ্যমে মিশরের দীর্ঘদিনের এক বর্বর কু-প্রথার অবসান ঘটালেন এবং মিশরবাসীর মনে এই ধারণা স্ট্রংলি প্রতিষ্ঠিত করলেন, নীলনদ নিজের ইচ্ছের চলে না। আল্লাহর আদেশক্রমেই প্রবাহিত হয়। 


তাওহীদের ব্যাপারে উমার রা. অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি ব্যাক্তি ও বস্তুকে বিশেষত্ব দিতেন না। ঠিক এজন্যই তিনি প্রথমে খালিদ রা.-কে সিরিয়ার গভর্নর পদ থেকে অপসারণ করিয়ে আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রা.-এর অধীন করে দেন। যাতে মুসলিম ও অমুসলিম সবার এই ভুল ধারণার অপনোদন হয়, 'খালিদই বিজয়ের কারণ'। মূলত মুসলিমদের বিজয় আসে আল্লাহর ইচ্ছেয়। আর এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি খালিদ রা.-কে গভর্নর থেকে দায়িত্ব পরিবর্তন করে দেন। 


উমার রা. একদিন কাবার কালো পাথরে চুমু খেতে গিয়ে বলেন, আমি জানি, তুমি একটা জড় পাথর ছাড়া আর কিছু নও। কারো উপকার বা ক্ষতি করার বিন্দুমাত্র সামর্থ তোমার নেই। যদি না দেখতাম নবী সা. তোমাকে চুমু খাচ্ছেন তাহলে কখনোই তোমাকে চুমু খেতাম না।       


এই কথাগুলা উমার রা. এজন্য বলতেন যে, মাত্র কিছুদিন আগে আরবের লোকেরা মূর্তিপূজা ছেড়েছে। এখন এভাবে পাথরে চুমু খাওয়া দেখে অজ্ঞরা ভেবে বসতে পারে এটা পাথর পূজার একটি ধরণ। তারা পাথরের কাছে ক্ষমতা আছে ভেবে বসতে পারে। তাই তাদের সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তিনি এসব বলেছেন।


আবু মুসা আশআরি রা. যুদ্ধ করে ইরানের দিকে যাওয়ার সময় তুস্তারে (বর্তমান নাম সুসা) দানিয়েল নবীর কবর খুঁজে পান। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে উমার রা.-কে চিঠি লিখেন। উত্তরে উমার রা. বলেন, দিনের বেলায় তেরো স্থানে তেরোটি কবর খুঁড়বে। এরপর রাতের বেলায় গোপনে একটিতে ওনাকে দাফন করবে। বাকিগুলোও বন্ধ করে দিবে। তাহলে লোকজন বুঝতে পারবে না আসল কবর কোনটা! আর পুরাতনটা মাটির সাথে মিশিয়ে দাও। এভাবে সঠিক কবর খুঁজে না পেয়ে মানুষের কৌতুহল নষ্ট হয়ে যাবে। তারা ফিতনা থেকে বেঁচে যাবে। 


নাফি ইবনে সা'দ রা. বলেছেন, উমার রা. একবার শুনলেন কিছু লোক বাইয়াতে রিদওয়ান যেখানে হয়েছিল সেখানে রিদওয়ান গাছের নিচে সালাত আদায় করা শুরু করলো। তারা নাকি সেই বাইয়াতকে স্মরণ করে এই কাজ করেছিল। উমার রা. তাদের নিষেধ করে দিলেন। এরপরও একই অভিযোগ আসায় তিনি গাছ কেটে ফেলেন  এবং চিহ্নও মুছে ফেলেন। বিদআতকে নির্মূল করতেই তিনি এই কাজ করেন। 


এক ভাষণে উমার রা. বলেন, যারা নিজেদের মনগড়া মতামত অনুসরণ করে তারা সুন্নাহর শত্রু। তারা হাদিস মুখস্ত করতে পারেনি বিধায় নিজেদের মনমতো ফতওয়া দেয়। তারা নিজেরা তো বিপথে গেছেই, অন্যদেরও বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সুন্নাহ অনুসরণ করি। নতুন কিছু সংযোজন করি না। যতক্ষণ আমরা সুন্নাহ মেনে চলবো ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবো না। 


এক লোক মাদায়েন বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি একটি বই নিয়ে বেশ উচ্চসিত প্রশংসা করে বললেন, আমিরুল মু'মিনীন! মাদায়েন বিজয়ের পর একটা বই পেয়েছি। তাতে অনেক চমৎকার কথা লিখা রয়েছে। উমার রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কুরআনের চেয়েও চমৎকার? লোকটি বললো, না। এরপর উমার রা. সূরা ইউসুফের ১ম তিন আয়াত তিলওয়াত করলেন। 


//আলিফ-লাম-রা। এগুলো এমন কিতাবের আয়াত যা নিজের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে। আমি আরবি ভাষায় কুরআন নাজিল করেছি, যাতে তোমরা (আরববাসীরা) একে ভালোভাবে বুঝতে পারো। আমি এ কুরআনকে তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়ে উত্তম পদ্ধতিতে ঘটনাবলী ও তত্ত্বকথা তোমার কাছে বর্ণনা করছি। নয়তো ইতিপূর্বে তুমি (এসব জিনিস থেকে) একেবারেই বেখবর ছিলে।// 

-সূরা ইউসুফ (১-৩)


এরপর খলিফা উমার রা. বলতে লাগলেন, তোমাদের আগেরকার লোকেরা তাওরাত, ইঞ্জিল বাদ দিয়ে তাদের পাদ্রী আর যাজকদের বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলো। এক পর্যায়ে তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলকেও উপেক্ষা করেছিলো তখন এসবের আসল জ্ঞানও হারিয়ে যায়। 


1 টি মন্তব্য: