৩০ মে, ২০২২

জিয়া হত্যাকাণ্ড ছিল ধারাবাহিকতার অংশ


পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের একাংশ ১৯৬৫ সাল থেকে ভারতীয় চক্রান্তের সাথে জড়িত হয় গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালিদের একটা অংশ জিয়ার আহ্বানে ক্যু করে। সেদিন জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে ক্যু হওয়ার মতো কিছু ঘটতো না। তাদের সাথে বাঙালি সৈনিকরা ক্যু করে। সেই যে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে তা জিয়া খুনের মাধ্যমে শেষ হয়েছে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হয় সেনাবাহিনীর একটি ক্যু এর মাধ্যমে। এরা ছিল সেই আগের ক্যু করা জাসদ প্রভাবিত বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার। সেসময় সেনাপ্রধান ছিল কে এম শফিউল্লাহ। ক্যু এর পর জিয়া সেনাপ্রধান হন। কিন্তু একচ্ছত্র ক্ষমতা তিনি পাননি। ক্যু কারীরাই ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। ওই সময় জাসদের প্রধান নেতারা হয় জেলে, নয়তো গা-ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে। তাহেরের হাতে জাসদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে যায়। তিনি অনেক বিষয়েই জাসদের রাজনৈতিক ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন।

৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর আওয়ামীলীগের প্রতি অনুগত অফিসাররা ক্যু করে। এই ক্যু হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। খালেদ মোশাররফের সাথে ঝামেলার মধ্যেই আওয়ামীলীগের চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে বাম সেনা অফিসাররা। সেনানিবাসগুলো অস্থির হয়ে পড়ে। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় বসলো জাসদের বিপ্লবী পার্টির ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা। হঠাৎ করেই সেখানে তাহের এসে উপস্থিত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসে নিজ গৃহে অন্তরীণ জিয়ার হাতের লেখা একটা চিরকুট পড়ে শোনান। চিরকুটটা ইংরেজিতে। বাংলা তরজমা করলে তার অর্থ হবে—আমি বন্দী, নেতৃত্ব দিতে পারছি না। আমার লোকেরা তৈরি। তুমি যদি নেতৃত্ব দাও, আমার লোকেরা তোমার সঙ্গে যোগ দেবে।

তাহের প্রস্তাব দেন, জিয়াকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় সভায় উপস্থিত জাসদ নেতারা বেশ বেকায়দায় ছিলেন। তাঁরা একপর্যায়ে তাহেরের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। অবশ্য তাহের জাসদ নেতাদের সম্মতির অপেক্ষায় থাকেননি। ওই দিন দুপুরেই তিনি সৈনিক সংস্থার সংগঠকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, মধ্যরাতে অভ্যুত্থান শুরু হবে।

অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য হলো
১. খালেদ মোশাররফের আওয়ামী চক্রকে উৎখাত করা;
২. বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করা;
৩. একটা বিপ্লবী মিলিটারি কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা;
৪. রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া;
৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা;
৬. বাকশাল বাদে অন্য সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন; এবং
৭. সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা।

রাত ১২টায় শুরু হয় অভ্যুত্থান। প্রথম প্রহরেই জিয়া মুক্ত হন। ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই জিয়া-তাহেরের সমীকরণ ভেঙে যায়। ভোরে বেতারের বুলেটিনে সবাই জানতে পারেন, সিপাহি বিপ্লব হয়েছে এবং জিয়া মুক্ত হয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক-লরি ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। আমজনতা পথের পাশে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে, হাততালি দেয় এবং অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো ট্যাংকে বা সেনাবাহিনীর ট্রাকে চড়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।

জনতা ও সৈনিকদের এমন সমর্থন পাওয়ার মূল কারণ ছিল মুজিবের ভয়ংকর দুঃশাসন। মানুষ সেই দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো, সেটা যেভাবেই হোক। খালেদ মোশাররফ মুজিবের পক্ষ হয়ে পাল্টা ক্যু করার কারণে মানুষ খালেদকে ঘৃণা করতে শুরু করে। রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনও অন্যতম কারণ ছিলো।

জাসদের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি যে ছিল না, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কয়েক শ সৈনিক ও জাসদ কর্মী একটি ট্যাংক নিয়ে ৭ নভেম্বর ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন জাসদ নেতা এম এ আউয়াল, মো. শাহজাহান ও মির্জা সুলতান রাজা। কারাগারে তখন শত শত জাসদ কর্মী। তাঁরা তিনজন সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখি।’ তাঁরা আর ফিরে আসেননি। ওই কর্মীরা অনেক দিন কারাবন্দী ছিলেন। কেউ দুই বছর, কেউ তিন বছর, কেউবা তার চেয়েও বেশি।

৭ নভেম্বর বহু খুনোখুনির মধ্যে তাহের-জিয়া পক্ষ টিকে যায়। খালেদ মোশাররফকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। জিয়া-তাহেরের এই ‘বিপ্লব’ ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর সকালে বন্দী অবস্থায় খালেদ নিহত হলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর দুজন সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও নিহত হন। এই তিনজনই ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের স্মরণে ওই দিনটি অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেন। অথচ তাদের যারা খুন করে তারাও ছিল মুক্তিযোদ্ধা।

ক্ষমতার ত্রিভুজ লড়াইয়ে জিয়া-তাহেরের সম্মিলিত শক্তির কাছে খালেদ হেরে গিয়েছিলেন। পরে জিয়া-তাহেরের মধ্যকার দ্বন্দ্বে তাহের ছিটকে পড়েন। ২১ জুলাই ১৯৭৬ দেশদ্রোহী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ক্ষমতার মূল লড়াইয়ে আবেগ বা মান-অভিমানের কোনো জায়গা নেই। হেরে গেলে মূল্য দিতে হয়, এটাই চরম সত্য।

সৈনিক সংস্থার সংগঠকেরা অনেকেই গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ আত্মগোপন করেন। এদের সামনের কাতারের নেতা করপোরাল আলতাফের অনুপস্থিতিতে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার একটা গ্রামে টাঙ্গাইলের গণবাহিনী কমান্ডার খন্দকার আবদুল বাতেনসহ একদল কৃষকের সঙ্গে সভা করার সময় পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে তিনি নিহত হন। খন্দকার বাতেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আলতাফের লাশ পাওয়া যায়নি। বাতেন পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছিলেন।

এতে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। ধারণা করা হয় ৭ই নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াউর রহমান শংকিত ছিলেন। আবার জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে তাহের চেয়েছে মূলত জাসদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে। সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগে তাই তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেতে হয়।

মুজিবের মত জিয়াও সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাস করতেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে তাই তিনি অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের (যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন) পদোন্নতি দেন। এর মূল কারণ তারা অনুগত থাকতো। মুক্তিযোদ্ধারা কেউই চেইন অব কমান্ড মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই কারণে জিয়া অমুক্তিযোদ্ধা সেনাদের ওপর নির্ভরশীল হন।
১৯৭৮ সালে অমুক্তিযোদ্ধা এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছিলেন এবং তাকে উপ-সেনাপ্রধান করেন।

মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মধ্যে মোটাদাগে দুপক্ষ ছিল। এক পক্ষ ছিল জাসদ প্রভাবিত বাম অন্যপক্ষ ভারতের একনিষ্ঠ দালাল আওয়ামী লীগের অনুসারী। জিয়া দুপক্ষেরই শত্রুতে পরিণত হন। ধারণা করা হয় জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হওয়ায় এরশাদেরও ইচ্ছে ছিল এভাবে ক্ষমতাবান হওয়ার। তাই এরশাদ কট্টর জিয়াবিরোধীদের নানান সময়ে পোস্টিং দিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একত্রিত করেন। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তিনিই জিয়া হত্যার প্লট তৈরি করেন।

জিয়ার আমলে ক্যু হয়েছে ২২ বার। এর মধ্যে ২১ বার তিনি তা ঠেকাতে পেরেছেন। ২২ তম ক্যু তে প্রাণ হারান। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই নিজেদের রক্ত পান করেছে প্রায় দশ বছর। ধারণা করা হয় এসব ক্যু'তে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুই সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য।

জিয়া তার রাজনৈতিক দল, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সংঘটিত একটি কোন্দলের সমঝোতা করতে চট্টগ্রামে যান। ৩০শে মে ভোরে জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৪টায় সেনাবাহিনীর অফিসারদের তিনটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে। এ আক্রমণে ১৬ জন অফিসার জড়িত ছিলেন। তাদের এগারটি সাবমেশিন গান, তিনটি রকেট লাঞ্চার এবং তিনটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ছিল।

আক্রমণকারী দলের মূল হোতা লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ, এবং লে. কর্নেল ফজলে হোসেন সার্কিট হাউজে রকেট নিক্ষেপ করে ভবনের দেয়ালে দুটি গর্ত সৃষ্টি করার মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করেন। এরপর অফিসাররা কক্ষগুলোতে জিয়াউর রহমানকে খুঁজতে থাকেন। মেজর মোজাফফর এবং ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন সর্বপ্রথম জিয়াকে খুঁজে পান। মোসলেহ উদ্দিন জিয়াকে জানান যে, তাকে তাদের সাথে সেনানিবাসে যেতে হবে। এরপর কর্নেল মতিউর রহমান আরেকটি দল নিয়ে উপস্থিত হন এবং জিয়াকে অনেক কাছ থেকে একটি এসএমজি দিয়ে গুলি করে।

আক্রমণকারীদের মধ্যে, লে. কর্নেল মতিউর রহমান এবং কর্নেল মাহবুবকে পলায়নরত অবস্থায় হত্যা করা হয়। মেজর খালেদ এবং মেজর মোজাফফর পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন গ্রেফতার হন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা লাভ করেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।

১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব আর্মি স্টাফ লে.জে.হু.মু. এরশাদ মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে সংগঠিত ক্যু দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। প্রথমেই কুমিল্লা সেনানিবাস মুভ করে চট্টগ্রাম দখলে নেওয়ার জন্য।

সরকার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে সময়সীমা প্রদান করে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অফিসাররা এবং অধিকাংশ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। নেতৃত্ব প্রদানকারী অফিসাররা সহ জিওসি মঞ্জুর পার্বত্য চট্টগ্রামে পালানোর চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে সরকার প্রেরিত বাহিনী কর্তৃক তারা গ্রেফতার হন। কর্নেল মতিউর রহমান এবং লে. কর্নেল মাহবুব (২১ ইস্ট বেঙ্গলের প্রধান, মঞ্জুরের ভাগ্নে) মেজর মান্নান (অমুক্তিযোদ্ধা) কর্তৃক নিহত হন।

জেনারেল মঞ্জুর তার স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ানো অবস্থায় ফটিকছড়ির একটি চা বাগানের জীর্ণ কুটিরে পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুসের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুস তাকে গ্রেফতার করে হাটহাজারী থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তিনি একজন আইনজীবীর জন্য আবেদন করলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। তিনি বারবার পুলিশের হেফাজতে থেকে চট্টগ্রামে জেলে প্রেরিত হওয়ার জন্য আবেদন করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশের হেফাজত থেকে নিষ্কৃতি পেলেই সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করবে। কিন্তু যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়, তখন সেনাবাহিনী একটি দল থানায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর ক্যাপ্টেন্ এমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে প্রায় টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। পরবর্তীতে কী ঘটেছিল তা সরকার কখনো প্রকাশ করেনি। তবে সরকারের রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষিত হয়- চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে জেনারেল মঞ্জুর নিহত হয়েছেন।

১২ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে জিয়া হত্যাকাণ্ডে ভূমিকার জন্য সামরিক আদালতে মাত্র ১৮ দিনের দ্রুত বিচারকার্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৩তম মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চট্টগ্রামে ৩০শে মের ঘটনাপ্রবাহে বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকায় দুই বছর পরে ফাঁসি দেওয়া হয়।

সামরিক ট্রাইবুনালে জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ১৮ জন অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয়। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে ১৩ জন মৃত্যদণ্ড এবং বাকি ৫ জন বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড লাভ করেন। এ অফিসারদের ১৯৮১ সালের ১-৩ জুনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অমুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৮ জুলাই ১৯৮১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলে সামরিক আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

রায় অনুযায়ী ১২ জন অফিসারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বিচারকারী অফিসার মেজর জেনারেল আবদুর রহমানকে পরবর্তীতে ১৯৮৩/৮৪ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানেই তিনি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল রহমানের পরিবারের দাবি, তার মৃত্যুর সাথে এরশাদ জড়িত।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ
কর্নেল এম আব্দুর রশীদ
লেঃ কর্নেল এওয়াইএম মাহফুজুর রহমান
লেঃ কর্নেল এম দেলোয়ার হোসেন
লেঃ কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেন
মেজর এজেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ
মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া
মেজর কাজী মোমিনুল হক
মেজর এম মজিবুর রহমান
ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুস সাত্তার
ক্যাপ্টেন জামিল হক
লেঃ রফিকুল হাসান খান

কারাদণ্ডপ্রাপ্ত
লেঃ মোসলেহ উদ্দীন। (যাবজ্জীবন কারাদন্ড)

বহিষ্কৃত অফিসারগণ
ব্রিগেডিয়ার আবু সৈয়দ মতিউল হান্নান শাহ
ব্রিগেডিয়ার একেএম আজিজুল ইসলাম
ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম)
ব্রিগেডিয়ার আবু জাফর আমিনুল হক (বীর বিক্রম)
কর্নেল মোঃ বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক)
লেঃ কর্নেল এএস এনামুল হক
লেঃ কর্নেল মোঃ জয়নাল আবেদিন
লেঃ কর্নেল মোঃ আব্দুল হান্নান (বীর প্রতিক)
মেজর মঞ্জুর আহমেদ (বীর প্রতিক)
মেজর ওয়াকার হাসান (বীর প্রতিক)
মেজর মোঃ আব্দুল জলিল
মেজর রফিকুল ইসলাম
মেজর মোঃ আব্দুস সালাম
মেজর একেএম রেজাউল ইসলাম (বীর প্রতিক)
মেজর মোঃ আসাদুজ্জামান
ক্যাপ্টেন জহিরুল হক খান (বীর প্রতিক)
ক্যাপ্টেন মাজহারুল হক
ক্যাপ্টেন এএসএম আব্দুল হাই
ক্যাপ্টেন ইলিয়াস
লেঃ আবুল হাসেম

জিয়া ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে ক্যু করে যে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছেন, জিয়া হত্যা ও এই বিচারের মধ্যে মধ্য দিয়ে সেই অস্থিরতার পরিসমাপ্তি ঘটে। কারণ এরপর আর মুক্তিযোদ্ধাদের (বাম ও লীগ) পক্ষ হয়ে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ অবশিষ্ট ছিল না।

খিলাফত পর্ব-২৫ : বিনা অনুমতিতে জিহাদ দোষনীয়

 


কাদেসিয়ার যুদ্ধ ও মাদায়েন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পার্সিয়ান সৈন্যদের আর কোনো আশা থাকলো না। তারা পাহাড়ে পালিয়ে গেল। আর এদিকে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-এর নেতৃত্বের পারস্যের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ন শহর মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। উমার রা.-এর নির্দেশে সা'দ রা. সেনাবাহিনীকে বিশ্রাম ও শহর গঠনে নিয়োজিত করেছিলেন। বহু মানুষ মুসলিম হচ্ছে। তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো। নতুন প্রাশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো। এদিকে এক পার্সিয়ান কমান্ডার হরমুজান রামহরমুজে পার্সিয়ান মুশরিকদের একত্রিত করেছে। সেখানে তারা পার্সিয়ান শাসন কায়েম করেছে। উমার রা.-এর নির্দেশে সা'দ রা. হরমুজানের বিরুদ্ধে নুমান ইবনে মুকরিনকে নেতা বানিয়ে বাহিনী পাঠালেন। অন্যদিকে উমার রা. বসরার প্রশাসক আবু মুসা আশআরি রা.-কে নির্দেশ দিলেন সাহল ইবনে আদির নেতৃত্বে একটি বাহিনী হরমুজানের বিরুদ্ধে প্রেরণ করতে। মুসলিম বাহিনীকে ঠেকাতে হরমুজান এগিয়ে এলো। তার সাথে নুমান ইবনে মুকরিনের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের বিজয় দান করেন। হরমুজান তুস্তার পালিয়ে যায়। নুমানের বাহিনী সাথে সাহলের বাহিনী এসে মিলিত হয়। মিলিত বাহিনীর নতুন কমান্ডার হন আবু সাবরা ইবনু আবি রুহম। তুস্তারে দীর্ঘদিন অবরোধ করে অবশেষে চূড়ান্ত লড়াইয়ে লিপ্ত হয় দুই পক্ষ। এই যুদ্ধে মুসলিমদের প্রসিদ্ধ বীর বা'রা ইবনু মালিক এবং মাজযাহ ইবনু সাওর হরমুজানের নিক্ষিপ্ত তীরে শাহদাতবরণ করেন। অবশেষে হরমুজানকে মুসলিমরা কোণঠাসা করে ফেলে। সে উমার রা.-এর সাথে দেখা করার বিনিময়ে আত্মসমর্পন করে লড়াই ছেড়ে দেবে বলে জানায়। আবু সাবরা রাজি হন। গণিমতসহ একটি প্রতিনিধি দলকে উমার রা.-এর নিকট মদিনায় পাঠানো হলো। তাদের সাথে হুরমুজানকেও পাঠানো হলো। মদিনায় প্রবেশ করে হরমুজান তার সেনা কমান্ডারের রাজকীয় পোষাক পরিধান করলো। অলংকারগুলো পরলো। আভিজাত্য নিয়ে সে উমার রা.-এর নিকট দেখা করতে চাইলো। ইরাক থেকে আগত প্রতিনিধিদল প্রথমে উমার রা.-কে তার বাড়িতে খোঁজ করলো। বাড়ি থেকে জানানো হলো তিনি কুফার প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার জন্য মসজিদে নববীতে অবস্থান করছেন। এরপর তারা মসজিদে গিয়েও উমার রা.-কে দেখতে পেলেন না। ইতোমধ্যে উমার রা. কুফার প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করে মসজিদের পাশে ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সামনে বাচ্চারা খেলা করছে দেখে তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা দেখিয়ে দিল উমার রা. পাশে ঘুমিয়ে আছেন। হরমুজান উমারের ঘর, মসজিদ ইত্যাদি দেখে ভীষণ অবাক হলো! যার নামে সারা দুনিয়া কাঁপছে সেই উমারের বাসা কিংবা দপ্তরের অবস্থা খুবই সাধারণ। হরমুজানকে নিয়ে প্রতিনিধি দল উমার রা.-এর সামনে পৌঁছলে হরমুজান অত্যন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো এটাই কি তোমাদের উমার? এতো মাটিতে শুয়ে আছে! হরমুজান অত্যন্ত অবাক হলো। লোকজনের কোলাহলে উমার রা.-এর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি উঠে বসলেন এবং বললেন, এই লোকটিই কি হরমুজান? প্রতিনিধিদল বললেন, হ্যাঁ। উমার রা. তাকে ভালোভাবে দেখলেন। আমি আল্লাহর কাছে আগুন থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং তারই কাছে সাহায্য চাই। আলহামদুলিল্লাহ্‌! যিনি ইসলামের মাধ্যমে এই লোককে ও তার সাহায্যকারীদের অপমানিত করেছেন। হরমুজানকে নিয়ে আসা লোকেরা উমার রা.-কে বললেন, সে পার্সিয়ান কমান্ডার। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছে। উমার রা. বললেন, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে কথা বলবো না যতক্ষণ না সে তার এসব সাজসজ্জা খুলে ফেলে। অবশেষে সে তার পোষাক ও অলংকার খুলে নিল। তাকে একটি সাধারণ পোষাক পরিয়ে আবার উমার রা.-এর সামনে আনা হলো। সে যুদ্ধের জন্য ইসলামকে দায়ি করে এবং তাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়ার আবেদন করলো। উমার রা. রেগে যান। এরপর সে চালাকির আশ্রয় নেয়। সে মনে করে নিয়েছে যে, তাকে এখন হত্যা করা হবে। তাই সে পানি চেয়েছে। পানি হাতে নিয়ে সে উমার রা.-এর দিকে তাকিয়ে বললো, আমার ভয় হচ্ছে আমি খেতে গেলে আপনি আমাকে হত্যা করবেন। উমার রা. বললেন, তুমি পানি খাও, পানি খাওয়ার আগে তোমাকে হত্যা করা হবে না। এটা শুনে সে পানি না খেয়ে রেখে দিল। সে আবারো উমার রা.-এর কাছে মুক্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। কিন্তু উমার রা. বললেন, আমি তো আমার বা'রা ও মাজযাহের খুনীকে কখনো নিরাপত্তা দিতে পারি না। এভাবে বহুক্ষণ চেষ্টা চালিয়েও যখন নিরাপত্তা পেল না তখন সে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এবার উমার রা. তাকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য হলেন। তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন ও মদিনায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই হরমুজানই পরে উমার রা. হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল এবং এই কারণে হরমুজানকে হত্যা করা হয়। এদিকে বাহরাইনের শাসক ছিলেন আ'লা ইবনে হাদরামি রা.। তার সাথে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-এর প্রতিযোগিতা ছিল। সা'দ রা. কাদেসিয়ার যুদ্ধ ও মাদায়েনের অভিযান দিয়ে বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তাঁর প্রশংসা সারা আরবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। আ'লা ইবনে হাদরামি রা. কাদেসিয়ার চাইতেও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছেন। যাতে তিনিও বড় বিজয়ের অংশীদার হন। এই লক্ষ্যে তিনি বাহরাইনে সৈন্য সমাবেশ করলেন। বাহরাইন থেকে নৌবাহিনী গঠন করে বিশাল সমুদ্র পার করে তাদের পারস্য পাঠালেন। এই অভিযানে সেনানায়ক ছিলেন খুলাইদ ইবনে মুনজির। এই অভিযানে উমার রা.-এর অনুমতি ছিল না। আরবদের সমুদ্রে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই বলে তিনি অভিযানের জন্য অনুমতি দেননি। কিন্তু আ'লা ইবনে হাদরামি রা. অনুমতি ছাড়াই অভিযান প্রেরণ করলেন। তিনি ভেবেছেন পার্সিয়ানরা এই আক্রমনের ব্যাপারে মোটেই প্রস্তুত নয়। অতএব তাদের বিরুদ্ধে অতর্কিত হামলা চালিয়ে তিনি বড় বিজয় অর্জন করলে উমার রা. খুশি হবেন। মুসলিমরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইরানের ইসতাখার গিয়ে পৌঁছালো। যা এখন সিরাজ নামে পরিচিত। পার্সিয়ানরা মুসলিমদের পেছনে গিয়ে তাদের সমস্ত নৌযান ধ্বংস করে দেয়। এতে বেকায়দায় পড়ে মুসলিমরা। সেনাপতি খুলাইদ জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন এবং ধৈর্য ও নামাজের সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে বলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও মুসলিমরা পার্সিয়ানদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। চারদিক থেকে ঘেরাও দিয়ে তারা সৈন্য সমাবেশ করলো। তাউসে আটকে পড়লো খুলাইদ ও তার বাহিনী। খলিফা উমার রা. এই অভিযানের ব্যাপারে অবগত হলেন। তিনি আ'লা ইবনে হাদরামি রা.-কে পদচ্যুত করলেন এবং তাঁকে কঠিন শাস্তি দিলেন। কঠিন শাস্তি হলো তাঁর প্রতিযোগী সা'দ রা.-এর অধীনে কাজ করার জন্য তাঁকে ইরাকে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। আর বসরার গভর্নরকে জানালেন, আ'লা ইবনে হাদরামি একদল সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হয়েছে। এই অভিযানে আমার অনুমোদন ছিল না। আমার মনে হয়, মহান আল্লাহও তাতে রাজি ছিলেন না। পার্সিয়ানরা ওই সেনাদলকে আটকে রেখেছে। আমার আশংকা হয়, কোনো সাহায্য না ফেলে তারা পরাজিত হবে ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আপনি তাড়াতাড়ি লোকজন নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। ওরা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই তাদের কাছে পৌঁছুন। নির্দেশ পেয়ে বসরার গভর্নর আবু সাবরার নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন। আবু সাবরা তার বাহিনী নিয়ে তাউসের দিকে অগ্রসর হলো। দ্রুত যাওয়ার ও সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য তারা শহর এলাকার মধ্যে দিয়ে না গিয়ে নদীর তীর দিয়ে গিয়েছিলেন। তারা কারো বাধা পাননি। অবশেষে তারা যখন তাউসে পৌঁছলেন তখন মুশরিকদের সব প্রস্তুতি শেষ। শুধু খুলাইদ ও তার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা বাকী ছিল। আবু সাবরার নেতৃত্বে প্রায় বার হাজার সৈন্য পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে হামলা করলো। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে বিজয় আসে মুসলিমদের। এই বিজয়ে খুলাইদ ও তার বাহিনী মুক্ত হয়।

২৭ মে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২৪ : মাদায়েনে এক বিস্ময়কর অভিযান!


মাদায়েন ছিল ইরাকের একটি শহর। এটি ছিল মুশরিক পার্সিয়ানদের রাজধানী। এখানে সম্রাটের সুরম্য শ্বেত পাথরের প্রাসাদ ছিল। বর্তমানে এই শহর তাক কাসরা নামে পরিচিত।

কাদেসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পর সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. বহুদিন অপেক্ষা করছিলেন উমার রা.-এর নির্দেশের অপেক্ষায়। উমার রা. প্রায় দু'মাস পর মাদায়েনে বাকী পার্সিয়ানদের দমন করার জন্য অনুমতি দিলেন। মহিলা ও শিশুদের রেখে উমার রা. রওনা হতে বলেছিলেন। অবশেষে প্রচুর সৈন্যকে মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তায় রেখে রওনা হলেন সা'দ রা.। উমার রা. নির্দেশ দিলেন, যেসব সৈন্য নিরাপত্তায় থেকে যাবে তারাও যেন গণিমতের ভাগ পায়।

পার্সিয়ান সৈন্যরা এই মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখী হতে রাজি ছিল না। তাই তারা মুসলিমদের আগমনের খবর শুনে পালাতে লাগলো। মুসলিমরা পর্যায়ক্রমে বুরস, ব্যবিলন, কুসি ও সাবাত শহর দখল করে। সাবাতের কিছু অংশ যুদ্ধের মাধ্যমে বাকী অংশ চুক্তির মাধ্যমে মুসলিমদের দখলে আসে। উমার রা. ইরাকের সাধারণ মানুষের সাথে ভালো আচরণের নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরাও নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করলেন। ইয়াকের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গেল। তারা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়ে মুসলিম সৈন্যরা তাদের কোনো সম্পদ কেড়ে নেয়নি বরং ভাই হিসেবে তাদের স্থান দিয়েছে। এটা তাদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটলো। তারা খাদ্য ও তথ্য দিয়ে মুসলিমদের সাহায্য করলো।

মুসলিমরা বাহরসীর নামে একটি শহর অবরুদ্ধ করে রাখলো। শত্রুরা দুর্গের ভেতর থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। মুসলিমরাও প্রায় দুইমাস দুর্গ ভাঙ্গতে সক্ষম হয়নি। এসময় মুসলিমদের পার্সিয়ান মিত্ররা ২০টি কামান তৈরি করে দেয় মুসলিমদের। মুসলিমরা কামান দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল বাহরসীরের দুর্গে। এতে ভেতরের সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা আত্মসমর্পন করে। বাহরসীরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে পার্সিয়ান সম্রাটের দূত মুসলিমদের কাছে আসে। দূত বললো, আমাদের সম্রাট জানতে চেয়েছেন, তোমাদের সাথে সমঝোতা বা শান্তিচুক্তি করার কী উপায় আছে? যার ফলে টাইগ্রিস নদীর ওপার থেকে পাহাড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করবো। আর তোমরা টাইগ্রিস পর্যন্ত রাজত্ব করবে।

কেউ কিছু বলার আগে মুসলিম কমান্ডার আবু মুকাররিন আসওয়াদ ইবনে কুতবা জবাব দিলেন। কিন্তু তিনি কী কথা বললেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন নি, অন্যান্য মুসলিমরাও বুঝতে পারেন নি। কিন্তু তার বক্তব্যের পর মুশরিকরা বাহারসীর ছেড়ে মাদায়েনের দিকে পালাতে লাগলো। মুসলিমরা আবু মুকাররিনকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি তাদের কী বলেছেন? তিনি বললেন, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি মুহাম্মদ সা.-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমি কী বলেছি, আমি নিজেই জানিনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি কল্যাণকর কথা বলেছি। আমার নিজের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করছি। সা'দ রা. ব্যাক্তিগতভাবে আবু মুকাররিনের তাঁবুতে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। কী এমন কথা বলেছেন যার জন্য তারা সদলবলে পালাতে লাগলো? আবু মুকাররিন একই কথা বললেন, আমি জানি না।

এরপর সা'দ রা. পুরো শহর অধিকার করলেন। এখান থেকে প্রচুর অস্ত্র ও ধনসম্পদ পাওয়া গেল। শহরে কোনো পার্সিয়ান সৈন্যকে পাওয়া গেল না। তারা সবাই মাদায়েনে পালিয়ে গেছে। দুর্গের মধ্যে কয়েকজন বন্দিকে পাওয়া গেল। তাদের জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের সৈন্যরা পালিয়ে গেল কেন? তারা বললো, আপনাদের কাছে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হলো। কিন্তু আপনারা বললেন, আমরা যতক্ষণ না কুসীর লেবুর সাথে আফরিজিন ফুলের মধু মিশিয়ে না খাবো ততক্ষণ তোমাদের সাথে কোনো সন্ধি হবে না। এই উত্তর শুনে আমাদের সম্রাট ইয়াজদিগার্দ বললেন, //হায়! হায়! ওদের মুখে ফেরেশতারা কথা বলছে! আরবদের পক্ষে ফেরেশতারা আমাদের উত্তর দিচ্ছে! আমাদের প্রত্যাখ্যান করছে। এই লোকটি যা বলছে এর মানে হলো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো// এই বলে তিনি সবাইকে দ্রুত মাদায়েন যাওয়ার নির্দেশ দেন।

বাহারশির ও মাদায়েনের মধ্যে ব্যবধান শুধু টাইগ্রিস নদী। বাহারশিরে এসে মুসলিম সৈন্যরা সম্রাটের শ্বেত প্রাসাদ দেখতে পেল। তারা বললো! আল্লাহু আকবার! এই সেই প্রাসাদ যা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে বাহারশির থেকে মাদায়েনে যাওয়ার সমস্ত নৌকা নিয়ে গেছে পার্সিয়ানরা। তখন টাইগ্রিস নদী ছিল পানিতে একেবারে পরিপূর্ণ। বিশাল জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। সা'দ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী টাইগ্রিস নদীর তীরে অসহায় হয়ে পড়লো। সম্রাট ইয়াজদিগার্দ মূলত নদীর এই প্রাকৃতিক সুরক্ষা পেতে যুদ্ধ না করেই বাহারশির ছেড়ে দিয়েছে। যখনই মুসলিমরা কেউ কেউ সাঁতরে পার হওয়ার স্টেপ নিচ্ছিল তখনই পার্সিয়ানরা তীর নিক্ষেপ করে তাদের ঠেকিয়ে দিচ্ছিল।

নদী পার হওয়া নিয়ে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. চিন্তা করছিলেন। এসময় মুসলিমদের মিত্র কিছু পার্সিয়ান নাগরিক সা'দ রা.-কে টাইগ্রিস নদীর সবচেয়ে কম দুরত্ব ও কম গভীরতার অংশের পথ বাতলে দিল। সা'দ রা. সেখানে গিয়ে বুঝলেন নদী পার হওয়ার মতো নয়। এসময় পানির আকার ও গতি বেড়ে গেল। প্রচণ্ড স্রোতের কারণে পানিতে প্রচুর ফেনা তৈরি হলো। চিন্তিত হয়ে পড়লেন সা'দ রা.। এই অবস্থায় তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। এসময় তিনি স্বপ্ন দেখলেন ঘোড়াগুলো নদী পার হয়ে যাচ্ছে। তার তন্দ্রা টুটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন এটা মহান সৃষ্টিকর্তার ইশারা।

তিনি সাহাবীদের ডাকলেন। একটি আবেগময় জিহাদি ভাষণ দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন আমরা ঘোড়া দিয়ে নদী পার হয়ে যাবো। তিনি তার দেখা স্বপ্নের কথাও বললেন। মুসলিম সৈন্যরা সমস্বরে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাকবির ধ্বনি দিল। এরপর তিনি সাহসী যোদ্ধাদের আহবান জানালেন যারা আগে নদী পার হতে আগ্রহী। আসিম ইবনে আমর তার সাহসী ছয়শত সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। আসিম ইবনে আমর তার ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালেন। এক অশ্বারোহী সৈন্য ঘোড়া হাঁকিয়ে সামনে এসে বললেন, আরে! এই পানির ফোঁটাকে আপনারা ভয় পাচ্ছেন? এরপর তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নং আয়াত পাঠ করলেন। //আল্লাহর অনুমতি ব্যাতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু মেয়াদ অবধারিত//।

এই কথা বলে তিনি ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। আসিম সবাইকে নদীতে নামতে নিষেধ করলেন। শুধু ৬০ জন সাহসীকে তার সাথে নদীতে নামতে নির্দেশ দিলেন। বাকীদের নির্দেশ দিলেন পাড়ের পার্সিয়ান সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে। ঘোড়াগুলো সাঁতরে পার হচ্ছিল বিধায় পার্সিয়ান সৈন্যরা আক্রমণ করলো। আসিমের নির্দেশে পাড়ের মুসলিম সৈন্যরা পার্সিয়ানদের ঘোড়াগুলোর চোখে তীর মারতে শুরু করলো। পার্সিয়ানরা নদীর তীর ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। আসিমরা আল্লাহর কুদরতে নিরাপদে নদী পার হয়ে গেলেন। পার হয়েই তিনি ও তার বাহিনী পার্সিয়ান মুশরিকদের ধাওয়া দিলেন।

এরপর আসিমের সব সৈন্য নদী পার হয়ে গেল। এরপর কা'কার দল নদী পার হয়ে গেল। এরপর যখন নদীর ওপাড়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো তখন বাকীসব সৈন্যকে নদী পার হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর সা'দ রা. ঘোড়া নিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়লেন। সকল মুজাহিদ খরস্রোতা টাইগ্রিস নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারা স্থলপথে যেভাবে রাস্তা অতিক্রম করে সেভাবেই নদী অতিক্রম করতে লাগলেন।

সা'দ রা. আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করলেন যাতে সবাই নিরাপদে পৌঁছে যায়। সবাই পৌঁছে গেলে সা'দ রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কারো কি কিছু হারিয়েছে? একজন সাহাবি অভিযোগ করলেন তার একটি বাটি হারিয়ে গেল। সা'দ রা. তখনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমার সাথীদের মধ্যে কারো যেন কোনো মালামাল না হারায়। পরে ঢেউয়ের ধাক্কায় বাটি তীরে এসে পৌঁছালো। এই দিনটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
এরপর সা'দ রা. তার বাহিনী নিয়ে পার্সিয়ানদের ধাওয়া করলেন। কিন্তু তার আগেই পার্সিয়ানরা পালিয়ে গেল তাদের ধন সম্পদ নিয়ে। তা সত্ত্বেও প্রচুর ধনসম্পদ থেকে গেল প্রাসাদে। সালমান ফারসি রা. তিনিদিন আহবান জানালেন, প্রাসাদে কেউ থাকলে যেন বেরিয়ে আসে। তিনদিনেও কেউ বেরিয়ে না আসলে মুজাহিদরা প্রবেশ করে এবং প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা পায়। এর পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা।

কোথাও কেউ ছিল না। সা'দ রা. সেই শ্বেত প্রাসাদকে নামাজের জায়গা হিসেবে নির্ধারণ করেন। এসময় তিনি সূরা দুখানের ২৫-২৯ নং আয়াত পাঠ করেন। //কত বাগ-বাগীচা, ঝর্ণাধারা, ফসল ও জমকালো প্রাসাদ তারা ছেড়ে গিয়েছে। তাদের পিছনে কত ভোগের উপকরণ পড়ে রইলো যা নিয়ে তারা ফুর্তিতে মেতে থাকতো। এই হয়েছে তাদের পরিণাম। আমি অন্যদেরকে এসব জিনিসের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছি। অতঃপর না আসমান তাদের জন্য কেঁদেছে না যমীন এবং সামান্যতম অবকাশও তাদের দেয়া হয়নি।//

এরপর সা'দ রা. আট রাকায়াত শোকরানা নামাজ আদায় করলেন। পরবর্তী জুমআর দিনে তিনি প্রাসাদে জুমআর নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি এখানে অবস্থান নেন এবং চারদিকে সৈন্য পাঠিয়ে আশে পাশের শহরগুলো দখল করেন। সেই সূত্রে ইরাকের জালুলা, তিকরিত ও মসুল জয় হয়।

উমার রা. এর কাছে পারস্যের বাজধানী বিজয়ের খবর পৌঁছলো। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। একইসাথে প্রচুর গনিমতের মালামাল আসলো। সম্রাটের ব্যবহার্য বহু দামী পোষাক ও অলংকার আসলো উমার রা.-এর কাছে। উমার রা. এগুলো মদিনাবাসীদের দেখালেন। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ছিল সুরাকা ইবনে মালিক। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। উমার রা. তাকে সব পোষাক, জুতো ও অলংকার পরতে বললেন। সুরাকা বলেন, আমি ভেবেছিলাম, এই সুন্দর জিনিসগুলো আমি পাব। আমি খুশি হয়ে পরে নিলাম।

এরপর উমার রা. তাকে সবার সামনে হাঁটতে বললেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটি কতই না উত্তম! মাদলাজ গোত্রের এক সাধারণ বেদুইনের গায়ে পারস্যের খসরুর পোষাক! এরপর বললেন, এগুলো খুলে ফেল।

এরপর বললেন, হে আল্লাহ! আপনার রাসূল ও নবীকে আপনি এত সম্পদ দেননি। তিনি আমার চেয়েও বহু সম্মানিত। আপনি এগুলো আবু বকরকেও দেননি। তিনিও আপনার নিকট আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় ও সম্মানিত। অথচ এগুলো আপনি আমাকে দিয়েছেন। যদি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে এত সম্পদ আমার কাছে অর্পন করেন তবে তা থেকে আমি আপনার নিকটই আশ্রয় চাই। তারপর তিনি এত কাঁদতে লাগলেন যে, উপস্থিত কারো আর এই সম্পদ ও অলংকারগুলোর প্রতি আগ্রহ থাকলো না। এরপর কাঁদতে থাকা উমার রা. আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.-কে বললেন, সন্ধ্যার আগেই এগুলো বিক্রি প্রাপ্ত অর্থ বিলিয়ে দেন।


২৪ মে, ২০২২

বদলে যাওয়া নায়ক মিঠুন

 


শেখ আবুল কাসেম মিঠুন। ছিলেন চলচ্চিত্রের অভিনেতা। ইসলামী আদর্শের দাওয়াত পেয়ে সেই পঙ্কিল জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপর তিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়। অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আজীবন সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক-এর মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতিক কেন্দ্র’র হাল ধরেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের উপ-পরিচালক। আজ ২৪ মে। শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মহান রাব্বুল আলামিন তার প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন। তাঁকে সম্মানিত করুন।

সুন্দরবনের লোনাপানিতে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি এক সময় বাংলাদেশের রূপালী পর্দা কাঁপালেও হেরার রশ্মি তাঁকে সেখানে টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ফিরে আসেন তাওহীদের পথে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। শুরু করেন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের নতুন জীবন। নিজ প্রতিভার গুণেই তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের বাংলা মিঠুন। সদালাপী মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। শুধু নায়ক বা অভিনেতা হিসেবেই নয়, তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির। এই সংগঠনের তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এফডিসি পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে কতটা জনপ্রিয় হতে হয়। পিতা মাতা প্রদত্ত নাম শেখ আবুল কাশেম। কিন্তু বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘মিঠু’ বলে। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে ‘মিঠু’ হয়ে যান ‘নায়ক মিঠুন’। এই নামটি শুনলেই বাংলাদেশের মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন।

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন ঘেষা আশাশুনি উপজেলার দরগাঁহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ আবুল হোসেন ও মা হাফেজা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। শেখ আবুল কাশেম মিঠুন সঙ্গীতা ও তরী নামের দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ থেকে আসেন। আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর এসে তিনি এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে তিনি এখানেই বসতি গড়ে তোলেন। দরগাহপুর গ্রামেই তাঁর দুই সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। উক্ত পুত্রদ্বয়ের বংশধরগণ দরগাহপুরের আদি অধিবাসী। শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী অন্যতম সপ্তম উত্তর পুরুষ মরহুম শেখ আব্দুল মতিন। শেখ আব্দুল মতিনের দৌহিত্র শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। পারিবারিকভাবেই শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ছিলেন অভিজাত ইসলামী পরিবারের সন্তান।

১৯৭২ সালে তিনি পাইকগাছা উপজেলা  হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে খুলনা সিটি কলেজে থেকে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। এ সময় তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কালান্তর’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘কালান্তর’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। সাংস্কৃতিক মনা শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। সেখানে বেশ সাফল্য পান।  ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপরও তিনি স্ক্রিপ রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়।

অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আমৃত্যু সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নৈতিকতাসম্পন্ন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়া যাবেনা । ২০১০ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, কবি ও গীতিকার, ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক ইন্তেকাল করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই নিরলস প্রচেষ্টায় সারা দেশে নতুন ধারার ইসলামী সঙ্গীত চর্চা শুরু হয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র’র হাল ধরেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ২০১৪ সালের মার্চে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। একটু সুস্থবোধ করলেই তিনি আবার শুরু করেন সংস্কৃতি চর্চা। রাজধানী ছেড়ে ছুটে বেড়ান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি যে কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার কথাবার্তায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি। 

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন কিডনি, লিভার, হার্ট ও লান্সের সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই ২০১৫ সালের ১১ মে তিনি তাঁর অসুস্থ মা হাফেজা খাতুনকে দেখতে খুলনায় যান। অসুস্থ মাকে দেখতে এসে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৪ মে বিকেলে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ মে পর্যন্ত তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ মে সকালে তাকে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. পিবি শুকলা এবং কোটারি হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শামীমুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটারি হাসপাতালে ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। 

“ হাজারো স্বপ্ন ছিল যে আমার জাহেলি জীবনে
অন্তর ছিল অস্থির আর অশান্ত অকারণে।
ধন, মান আর সম্পদ ঘিরে, স্বপ্নগুলো কিলবিল করে
নিশিদিন যেন রক্ত ঝরে, কাল সাপের দংশনে।”

তার এই গানটির হৃদয়গাহী আকুলতা প্রমাণ করে রূপালী পর্দা থেকে হেরার পথে চিত্রনায়ক আবুল কাশেম মিঠুনের ফিরে আসাটা ছিল অনিবার্য। এক সময়কার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মিঠুন ফিরে আসেন ইসলামী সংস্কৃতি ধারায়। এরপর তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে কাজ করে গেছেন। গানের পাখি ও চির সবুজের কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পথের পথিক হয়ে ২০১৫ সালের ২৪ মে দিবাগত রাত ২টায় চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সম্মানিত করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।