১৯ অক্টো, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২৮ : আমীরুল মু'মিনিন উমার রা.-এর শাহদাত

আমাদের নেতা উমার রা. আগে থেকে জানতেন তিনি শাহদাতবরণ করবেন, অর্থাৎ তাঁকে খুন করা হবে। আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন, “আল্লাহর রাসূল সা. আবু বকর রা., উমার রা. ও উসমান রা.-কে সাথে নিয়ে একদিন উহুদ পর্বতে আরোহণ করলেন। পাহাড়টি কেঁপে উঠলে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘স্থির হও, হে উহুদ। তোমার ওপরে একজন রাসূল, একজন সিদ্দীক ও দুইজন শহিদ রয়েছেন।” তখন থেকেই উমার রা. ও উসমান রা. জানতেন তাঁরা শহীদ হবেন।


শুধু জেনে ক্ষান্ত ছিলেন শাহদাতের মৃত্যুর জন্য উমার রা. দোয়া করতেন। যাইদ ইবনু আসলাম রা. বলেন, ২৩ হিজরিতে হজ্জের সময় উমার রা. বলেছেন, “হে আল্লাহ! তোমার পথে আমাকে শাহাদাহ দিয়ে ধন্য করো; আর আমার মৃত্যু তোমার নবীর শহরে দান করো।” তিনি প্রায়ই বলতেন, “হে আল্লাহ! তোমার পথে শাহাদাহ, তোমার নবির শহরে আমার মৃত্যু দাও।” এটা অনেকটা প্যারাডক্সিকেল দোয়া ছিল, কারণ মদিনার মতো নিরাপদ শহরে কে আসবে উমার রা.-কে খুন করার জন্য। সারা পৃথিবী যেখানে উমার রা.-এর করতলে এমন শাসককে কারা এসে মদিনা আক্রমণ করে মারবে এটা বোধগম্য ছিল না। উমার রা.-এর এই দোয়াতে সাহাবারা বলতে এটা কীভাবে সম্ভব? মদিনায় কীভাবে আপনি শহীদ হবেন? তিনি বলতেন, আল্লাহ চাইলে সম্ভব।

আউফ ইবনু মালিক রা. বলেন, “আবু বকরের খিলাফাতের সময় আমি এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম আকাশ থেকে একটি রশি ঝুলে আছে। মানুষেরা সেটি ধরার চেষ্টা করছে। উমার ছিলেন অন্য সবার চেয়ে তিন হাত বেশি লম্বা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেন? লোকেরা বলল, কারণ, তিনি হলেন পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাদের একজন। তিনি কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করেন না এবং তিনি শহিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন।

পরদিন সকালে আমি আবু বকরের কাছে গিয়ে তাকে এ সম্পর্কে জানালাম। তিনি বললেন, হে আল্লাহর বান্দা, আবু হাফসার (উমার রা.) কাছে যাও, তাকে ডেকে নিয়ে এসো। যখন তিনি আসলেন আবু বকর আমায় বললেন, “হে ‘আউফ! তুমি যা স্বপ্নে দেখেছ তা বলো। যখন আমি ‘উমারকে বললাম, তিনি আল্লাহর খলীফাদের একজন। উমার বললেন, একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি কি সবকিছু দেখে? আবু বকর তাকে বললেন, ‘তাকে সবকিছু জানাও। উমার শুনতে চাইলেন না, এসব কথা কারো কাছে বলতেও নিষেধ করেন।

এরপর যখন ‘উমার সত্যিই খিলাফাতের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন তিনি একবার সিরিয়ার জাবিয়াতে আসলেন। সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং পাশে বসতে বললেন। বক্তৃতা শেষ হওয়া পর বললেন, তোমার সেই স্বপ্নের কথাটা আবার একটু বলো। আমি বললাম, আপনি তো আমাকে এ সম্পর্কে কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বললেন, “আমি কিন্তু সেটা বোঝাইনি। বরং আমি আবু বকরের (জীবিত থাকা অবস্থায় তার সামনে খিলাফাত-সংক্রান্ত কথা বলার) ব্যাপারে লজ্জাবোধ করছিলাম।' তারপর তাকে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করার পর তিনি বললেন, ‘খিলাফাতের ব্যাপারে যা তুমি দেখেছ তা আমাকে ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় না করার ব্যাপারে বলবো, আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাই না। আমি আশা করি, আমার এ কথা সঠিক। আর শহিদ হওয়া ব্যাপারে বলবো, আরব উপদ্বীপে থাকা অবস্থাতেই আমি শাহাদাহ লাভ করব।”

উমার রা. তার শেষ জুমআর খুতবায় বলেছিলেন, “আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি, আমার মনে হয় এ স্বপ্ন আমার মৃত্যুর ইঙ্গিত বহন করছে। আমাকে একটি মোরগ দুবার ঠোকর দিচ্ছে এবং মানুষেরা নতুন খলীফা নিযুক্ত করতে বলছে। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বা তাঁর খিলাফাতকে ধ্বংস হতে দেবেন না, আবার তিনি আর কোনো নবিও প্রেরণ করবেন না। যদি আমি মারা যাই, খলীফা নিযুক্ত হবে এই ছয় সদস্যের পরামর্শ পরিষদের মাধ্যমে। তাদের ওপর রাসূল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন।” উমার রা. বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। খিলাফতের ব্যপারে তিনি চিন্তা ও গবেষণা করতেন। রাষ্ট্রের নেতা নির্বাচনকে রাসূল সা.-এর মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তিনি একটি কাঠামো বা সিস্টেম তৈরি করেছিলেন। তিনি এই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। যেহেতু তিনি শাহদাতের কথা জানতেন এবং মৃত্যুর ব্যপারে ইঙ্গিত পেয়েছেন তাই তিনি পরবর্তী শাসক নির্বাচনের রূপরেখাও তৈরি করে ফেলেছেন।

যুদ্ধবন্দিদের মাদীনায় বসবাসের ব্যাপারে উমার রা. পছন্দ করতেন না। এটা মদিনার নিরাপত্তার জন্যই। বিজিত রাষ্ট্র থেকে যেসব বন্দি এসেছিল, খিলাফাতের রাজধানী মাদীনাতে তাদেরকে রাখার ব্যাপারে খলীফা উমার রা. নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ইরাক ও পারস্যের অগ্নি-উপাসক, সিরিয়া ও মিসরের খ্রিষ্টানদেরকেও মাদীনায় থাকার অনুমতি উমার রা. দেননি। কেবল ইসলাম গ্রহণ করলেই তারা মদিনাতে অবস্থান করতে পারত। খলীফার এ সিদ্ধান্ত তার প্রশাসনিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে। কারণ পরাজয় বরণ করা এ মানুষগুলোর মধ্যে ইসলামের প্রতি ছিল ঘৃণা। তাই স্বাভাবিক কারণেই তারা মুসলিমদের মধ্যে থেকেও তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতো। তার এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত মুসলিমদের অনেক অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

তবে কোনো কোনো সাহাবির অধীনে খ্রিষ্টান ও অগ্নি-উপাসকদের মধ্য থেকে আসা কিছু দাস ছিল। তাই সাহাবাদের কেউ কেউ এ দাসদের মাদীনায় থাকার ব্যাপারে ‘উমারকে অনুমতি দিতে বলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘উমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের কাউকে কাউকে থাকার অনুমতি দেন। ফলে তিনি যা ভেবেছিলেন ও যে সম্পর্কে আশঙ্কা করেছিলেন সেই পরিস্থিতির মুখোমুখিই উমার রা.-কেই হতে হয়েছে। এক অমুসলিম দাস আবু লু'লু উমার রা.-এর প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে নামাজের মধ্যে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে।

উমার রা. সেদিন ফজরের নামাজে দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করছিলেন। এমন সময়ে কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা আবু লু'লু হঠাত চড়াও হয়ে ছুরি দিয়ে উমার রা.-কে আঘাত করতে থাকে। উমার রা. চিৎকার করে বললেন, কুকুরটা আমাকে মেরে ফেললআক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই তিনি এ কথা বলে উঠলেন। ঘাতক অগ্নিপূজক পালানোর চেষ্টা করছিল। তার সাথে থাকা দু-পাশ ধারালো খঞ্জর দিয়ে সে যাকেই সামনে পাচ্ছিল তাকেই আঘাত করছিল। একে একে সে তেরো জনকে ছুরিকাঘাত করে, তার মধ্যে সাতজনই মৃত্যুবরণ করেন।

একজন মুসলিম এই বেগতিক অবস্থা দেখে তার দিকে বড় একটি কাপড় ছুড়ে দিয়ে তাকে ঢেকে ফেলল। যখন সে বুঝতে পারল যে, সে ধরা পড়ে গিয়েছে, তখন সে আত্মহত্যা করল। ‘উমার রা. ‘আবদুর-রাহমান ইবনু আউফের হাত ধরে তাকে ইমামের স্থানে এগিয়ে দিলেন সালাত পড়ানোর জন্য। যারা ‘উমার রা.-এর কাছের কাতারগুলোতে ছিলেন, কী ঘটছে তারা তা চোখেই দেখেছিলেন, কিন্তু যারা দূরের কাতারে ছিলেন তারা বুঝতে পারছিলেন না কী হচ্ছে! ‘উমারের তিলাওয়াতও তারা শুনতে পারছিলেন না। তাই তারা ‘সুবহান আল্লাহ’ বলছিলেন। আবদুর-রাহমান খুব সংক্ষেপে সালাত শেষ করেন।

উমার বললেন, “হে ইবনু আব্বাস, দেখে এসো তো কে আমাকে আঘাত করেছে। তিনি দেখে এসে বললেন, ‘মুগীরার দাস। “উমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই কারিগর?’ তিনি বললেন, হ্যাঁ। উমার বললেন, তার ওপর আল্লাহর লানত। আমি তার মনিবকে বলেছিলাম যেন তার জন্য ভালো ব্যবস্থা করে। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাকে মুসলিম দাবিদার কারও হাতে মৃত্যু দেননি। তুমি ও তোমার বাবা (মানে ‘আব্বাস ও তার ছেলে আবদুল্লাহ) বেশি বেশি বিধর্মীকে মাদীনায় আনতে চেয়েছিলে!

আবু লু'লু ছিল মুগীরা ইবনু শু’বার দাস। সে জাঁতা তৈরি করতো। মুগীরা প্রতিদিন তার থেকে চার দিরহাম করে আদায় করতেন। এটা আবু লু'লু'র কাছে জুলুম মনে হয়েছে। তাই সে উমার রা.-এর সাথে দেখা করে বলেছিল, হে আমীরুল মু'মিনীন, মুগীরা আমার ওপর অনেক বেশি ধার্য করেছে। তাকে কমাতে বলুন। উমার তাকে বললেন, আল্লাহকে ভয় করো, তোমার মনিবের প্রতি বিশ্বস্ত হও।' এই কথা বলে তাকে বিদায় দিয়ে উমার রা. মুগীরা রা.-এর সাথে কথা বলে এটা কমানোর জন্য বলেছেন।

এদিকে আবু লুলু রেগে গেল। সে বলল, “আমি ছাড়া সবার সাথে সে (“উমার) ন্যায়বিচার করতে পারে। তার এই রাগকে কাজে লাগিয়েছে বাধ্য হয়ে মুসলিম হওয়া সাবেক পার্সিয়ান কমান্ডার হরমুজান। সে আবু লু'লুর রাগকে উস্কে দিয়ে উমার রা.-কে হত্যা করার প্ল্যান তার মাথায় ঢুকিয়ে দিল। আবু লু'লু দুই দিকে ধারালো একটি ছুরি তৈরি করে তাতে বিষ মাখাল। হরমুজানকে দেখিয়ে বলল, এটা কেমন? সে বলল, যাকে এটা দিয়ে আঘাত করা হবে, সে অবশ্যই মারা যাবে। হরমুজান তাকে সাহস দিল। হরমুজানের কথা ২৫ নং পর্বে আলোচনা করেছি।

এরপর উমার রা.-কে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে কিছু খাদ্য দেওয়া হলো, তিনি তা পান করলেন, কিন্তু তা তার উদর থেকে বেরিয়ে এল। তাকে কিছু দুধ এনে দেওয়া হলো, তা পান করলেন কিন্তু তাও তার ক্ষতস্থান দিয়ে বেরিয়ে এল। সবাই বুঝতে পারল, তিনি অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর মুখোমুখি হবেন। আমরা তার ঘরে প্রবেশ করলাম, অন্যরাও তার ঘরে প্রবেশ করল এবং তার প্রশংসা করতে লাগলো। উমার রা. তার ছেলে আবদুল্লাহকে বললেন, ‘আবদুল্লাহ, দেখো তো, আমার কত ঋণ আছে। তারা হিসাব করে দেখলেন মোট ৮৬ হাজার দিরহামের মতো। উমার বললেন, যদি আমার পরিবার এ ঋণ শোধ করার সামর্থ্য রাখে, তবে তাদের থেকে যা পাবে তা দিয়ে শোধ করবে। না হলে বানু উদাই ইবনু কা'বের কাছে চাইবে। তাও যদি বাকি থাকে তবে কুরাইশদের থেকে চাইবে। তবে এরপর আর কারও কাছে চাইবে না। আমার পক্ষ থেকে দ্রুত এ ঋণগুলো পরিশোধ করে দাও।

আব্দুল্লাহকে আরো নির্দেশ দিলেন, উম্মুল-মু'মিনীন আয়িশা রা.-এর কাছে যাও, তাকে বলবে, “উমার আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। আমীরুল-মু'মিনীন’ বলবে না। কারণ, আজ থেকে আমি আর আমীরুল মু'মিনীন নই। তাকে বলবে, “উমার ইবনুল-খাত্তাব তার দুই সঙ্গীর সাথে থাকার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু উমার ‘আয়িশাকে সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তিনি দেখলেন “আয়িশা কাঁদছেন। তিনি বললেন, ‘উমার ইবনু খাত্তাব আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং তার দুইজন সঙ্গীর পাশে তাকে শায়িত করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন।

“আয়িশা বললেন, ‘জায়গাটা আমি আমার জন্য রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি আজ তাকে আমার ওপর প্রাধান্য দিলাম। আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার ফিরে এসে বললেন, ‘হে আমীরুল-মু'মিনীন, আপনি যা চেয়েছেন সেরূপ অনুমতি তিনি দিয়েছেন। ‘উমার বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর, এ বিষয় নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলাম। যখন আমি মারা যাবো তখন তোমরা আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বলবে, “উমার ইবনুল-খাত্তাব প্রবেশের জন্য অনুমতি চাচ্ছেন। অনুমতি দিলেই কেবল আমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। আর না দিলে আমাকে মুসলিমদের (সাধারণ) কবরস্থানে নিয়ে যাবে। এরপর উমার রা. নতুন শাসক নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন।

উমার রা. ইন্তেকাল করার পর জানাযা শেষে মুসলিমরা তার মৃতদেহ নিয়ে আয়িশা রা.-এর ঘরে উপস্থিত হলেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু উমার সালাম দিয়ে বললেন, উমার ইবনুল-খাত্তাব প্রবেশের অনুমতি চাচ্ছেন। আয়িশা বললেন, তাকে ভেতরে নিয়ে আসুন। তাকে ভেতরে আনা হলো এবং তার দুইজন প্রিয় সঙ্গী মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর রা.-এর পাশে তাকে কবর দেওয়া হলো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন