২৫ ফেব, ২০২৩

খিলাফত পর্ব-৪৪ : আলী রা.-এর সময়ে প্রাদেশিক গভর্নরগণ

তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় প্রদেশগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে রাজ্য নিয়ন্ত্রণে থাকতো। তাই প্রদেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবপার ছিল। আলী রা. প্রাদেশিক গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। তিনি প্রায় সকল প্রদেশে রদবদল করে দিলেন। যাতে সবধরণের মতের মানুষ নিয়ন্ত্রণে থাকে। রাষ্ট্রের সংহতি থাকে। এখানে মূল সমস্যা হলো কিছু লোক উসমান রা.-এর রক্তের বদলা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছিলেন না। আবার কিছু লোক উসমান রা.-এর এতই ক্ষিপ্ত ছিল যে, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামান্য ক্ষতি হওয়ার আশংকাকেও সমস্যা হিসেবে দেখছিলো। দুই পক্ষের চরমপন্থীরা আলী রা.-কে সমস্যায় ফেলছিল। এজন্য আলী রা.-এর জন্য পথচলা কঠিন হয়ে পড়েছিল। গভর্নররা নিজ নিজ ইজতেহাদ ও রায় অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলেন। এই অবস্থায় আলী রা.-এর জন্য গভর্নর নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রাথমিক কাজ।

মক্কা :
উসমান ইবনু আফফানের শাহাদাতবরণের সময় খালিদ ইবনু সায়িদ ইবনুল আস রা. ছিলেন মক্কার গভর্নর। তিনি উসমান রা.-এর রক্তের বদলা নিতে আলী রা. বিরুদ্ধে গণজমায়েত তৈরি করেছিলেন। আলি রা. তাঁকে প্রত্যাহার করে আবু কাতাদা আনসারি রা.-কে মক্কার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে তাঁর গভর্নরির মেয়াদ ছিল সংক্ষিপ্ত। কারণ, আলি রা. যখন দারুল খিলাফত তথা রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন, তখন কুসাম ইবনু আব্বাস রা.-কে মক্কার গভর্নর বানানো হয় এবং আবু কাতাদা আনসারি রা.-কে প্রত্যাহার করে সেনা কমান্ডার করা হয়। কুসাম রা.-এর সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা সামনে আসেনি। আলি রা. তাঁকে একই সময়ে মক্কার পাশাপাশি তায়েফেরও দায়িত্ব অর্পণ করেন।

৩৯ হিজরিতে মুআবিয়া রা. সিরীয় নেতাদের একজনকে সিরিয়ার হাজিদের সঙ্গে পাঠান। তাঁকে নির্দেশ দেন মক্কায় পৌঁছে সকলের নেতৃত্ব দিতে। তিনি মক্কায় পৌঁছালে তাঁর এবং কুসাম ইবনু আব্বাস রা.-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ব্যাপারটি এতদূর গড়ায় যে, কিছু সাহাবি যদি এতে হস্তক্ষেপ করে মীমাংসা করে না দিতেন তাহলে যুদ্ধ বেধে যেত। বুসরা ইবনু আরতাআহ রা.-এর নেতৃত্বে মুআবিয়া রা.-এর বাহিনী মক্কায় অভিযান পরিচালনা করে। কুসাম রা. যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটেন। এভাবে সমাপ্তি ঘটে কুসাম রা.-এর গভর্নরির। মক্কার কর্তৃত্ব আলী রা.-এর হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর মক্কা পুনরুদ্ধারে আলী রা. তাঁর বাহিনী পাঠান। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন।

মদিনা মুনাওয়ারা :
নববি যুগ এবং তাঁর পরবর্তী তিন খলিফার শাসনামলে মদিনা ছিল ইসলামি সালতানাতের দারুল খিলাফাহ তথা রাজধানী। খলিফা এখানেই অবস্থান করতেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে রাষ্ট্রের সব কাজ নিজেই সামাল দিতেন। কোথাও সফরে গেলে কাউকে নিজের নায়েব নিযুক্ত করে যেতেন, যিনি সার্বিক অবস্থা দেখভাল করতেন; কিন্তু আলী রা.-এর শাসনামলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। উসমান রা.-এর শাহাদাতের পর রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা—বিশেষত তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা সিদ্দিকার উষ্ট্রের যুদ্ধের পূর্বে ইরাকগমন—আলী রা.-কে ইরাকে দারুল খিলাফত প্রতিষ্ঠায় বাধ্য করে।

আলী রা. মদিনা ছাড়ার সময় সাহল ইবনু হুনাইফ আনসারি রা.-কে এখানে তাঁর নায়েব নিযুক্ত করে যান। এখানে তাঁর গভর্নরির মেয়াদ এক বছরের কিছু বেশি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এরপর তাঁকে অপসারণ করে তাম্মাম ইবনু আব্বাস রা.-কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর তাঁকেও অপসারণ করে আবু আইয়ুব আনসারি রা.-কে গভর্নর বানানো হয়। আবু আইয়ুব আনসারি ৪০ হিজরি পর্যন্ত মদিনার গভর্নর ছিলেন। বুসর ইবনু আরতাআহ রা.-এর নেতৃত্বে মুআবিয়ার সিরীয় বাহিনী আক্রমণ করলে আবু আইয়ুব আনসারি মদিনা ছেড়ে কুফায় কাছে চলে যান। এভাবে মদিনাও আলীর শাসনক্ষমতা থেকে বেরিয়ে যায়।

বাহরাইন ও আম্মান :
উসমান রা. শাহাদাতের সময় বাহরাইন ছিল বসরার ইমারতের অধীনে। ইবনু আমির রা. সেখানে তাঁর কর্মকর্তাদের মধ্যে হতে কাউকে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করতেন। আলী রা.-এর শাসনকাল এলে তিনি বাহরাইনে কয়েকজন আমির নিযুক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন উমর ইবনু আবি সালামা রা.। যিনি মদিনা থেকে ইরাক সফরের সময় আলির সঙ্গে ছিলেন। আলি সেখানে পৌঁছে তাঁকে গভর্নর হিসেবে কিছুদিনের জন্য বাহরাইন পাঠান। এরপর নিজের কাছে রাখার জন্য তাঁকে ইরাকে ডেকে আনেন।
আলী রা.-এর পক্ষ থেকে বাহরাইনে নিযুক্ত অন্য গভর্নরদের মধ্যে রয়েছেন কুদামা ইবনু আজলান আনসারি, নুমান ইবনু আজলান আনসারি ও উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.। উল্লেখ্য যে, উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. প্রকৃতপক্ষে ইয়ামেনের গভর্নর ছিলেন। এখানে তাঁর গভর্নরির দায়িত্ব পালনকালে সম্ভবত বাহরাইন, আম্মান ও নাজদ ইয়ামেনের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।

ইয়েমেন :
আলী রা. খিলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর ইয়ামেনের গভর্নর হিসেবে উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-কে দায়িত্ব দেন। উবায়দুল্লাহ তখনো ইয়ামেনে পৌঁছুতে পারেননি, এমন সময়ে উসমানের গভর্নরও সেখান থেকে বের হয়ে যান। তাঁরা তালহা ইবনু উবায়দিল্লাহ ও জুবায়ের ইবনুল আওয়ামের সঙ্গে উষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইয়ামেনের রাজধানী সানআয় পৌঁছে উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্বাস গভর্নরের দায়িত্ব সামাল দেন। ইয়ামেনের সেনা-অধিনায়ক সায়িদ ইবনু সাআদ ইবনু উবাদা আনসারি রা. সহযোগী হিসেবে তাঁকে সঙ্গ দেন। উসমানের শাহাদাতে ইয়ামেনের অধিবাসীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও শোক দানা বাঁধে। হত্যাকারীদের এহেন অন্যায় তাঁদের জন্য ছিল কষ্টদায়ক। এ কারণে এখানকার কিছু লোক আলী রা.-এর খিলাফতে বায়আত করেনি। তারা হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাচ্ছিল।

যখন তারা আলির বিচার-কার্যক্রমে বিলম্ব দেখতে পাচ্ছিল, তখন সে-সকল লোক মুআবিয়া রা. সঙ্গে চিঠিপত্র আদান-প্রদান শুরু করে দিলো। এর জবাবে মুআবিয়া বুসর ইবনু আরতাআহকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাঠান। পরে ইয়ামেনের অভ্যন্তরের বিদ্রোহীদের সাহায্যে বুসর ইয়ামেনের ওপর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পান। তবে এই নিয়ন্ত্রণ ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। এর কিছুদিন পর আলী রা. মুআবিয়া রা. নিয়ন্ত্রণ থেকে ইয়ামেন মুক্ত করতে সক্ষম হন। উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্বাসকে পুনরায় গভর্নর হিসেবে সেখানে পাঠান। এরপর আলী রা.-এর শাহাদাতের পূর্বপর্যন্ত তিনি সেখানে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করে যান।

সিরিয়া
মুআবিয়া রা. উমর রা. ও উসমান রা.-এর সময় হতে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। আলী রা. যখন খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হলেন তখন তিনি উসমান রা.-এর হত্যার বদলা না নেওয়া বাইয়াত নিতে অস্বীকার করলেন। আলী রা. তাকে পত্র লিখলেন। কিন্তু সেগুলো কোনটাই কাজে আসেনি। বরং মুয়াবিয়া রা. আলী রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলেন। উটের যুদ্ধের আগে আলী রা. সিরিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আয়িশা রা. বসরায় দ্রুত সৈন্য সমাবেশ করায় আলী রা. সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বসরায় গেলেন। উটের যুদ্ধের পর মুয়াবিয়া রা.-কে বরখাস্ত করে তাঁর পরিবর্তে আবদুল্লাহ ইবনু উমরকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা. সিরিয়ার গভর্নর-পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক ও শ্বশুরালয়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার কথা উল্লেখ করে অপারগতা প্রকাশ করেন। আলী রা.-ও জোর না করে তাঁর অপারগতার বিষয়টি মেনে নেন।

আলী রা.-এর গোটা খিলাফতকালে মুআবিয়াই ছিলেন সিরিয়ার শাসক। আলী রা. কোনোভাবেই সিরিয়া তাঁর থেকে মুক্ত করতে কিংবা কোনো গভর্নর সেখানে নিযুক্ত করতে পারেননি। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সীমানায় উভয়পক্ষের বাহিনীর মধ্যে বেশকিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ৩৭ হিজরিতে সংঘটিত আলী ও মুআবিয়ার মধ্যকার সিফফিনযুদ্ধ।

জাজিরা
উসমান রা.-এর খিলাফতকালে জাজিরা সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছিল। কিন্তু তাঁর শাহাদাতের পর যখন সিরিয়া মুআবিয়ার কর্তৃত্বে এবং ইরাক আলির কর্তৃত্বে চলে গেল, তখন মধ্যখানে থাকা জাজিরা হয়ে গেল উভয় পক্ষের বিরোধপূর্ণ স্থান। কারণ, ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাজিরার এক প্রান্তে ছিল সিরিয়া অপর প্রান্তে ইরাক। ফলে উভয় পক্ষের জন্য জাজিরার নিয়ন্ত্রণ ছিল বাহ্যত সহজ। সেটার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে উভয় দলের সেনাদের মধ্যেই বেশ কয়েক বার তুমুল যুদ্ধও সংঘটিত হয়। আলী রা. সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং আশতার নাখয়িকে গভর্নর নিযুক্ত করেন।

আশতারই এখানকার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গভর্নর। কারণ, আলী রা. তাঁকে কয়েক বার সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি জাজিরার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অধিক অভিজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে ৩৮ হিজরিতে আলী তাঁকে মিসরের গভর্নরের দায়িত্ব দেন। এরপর জাজিরায় আবারও বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুআবিয়ার অনুসারীরা জাজিরার নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎপর হয়ে উঠলে উভয় দলের মাঝে বেশকিছু যুদ্ধও সংঘটিত হয়। ৩৯ হিজরির শেষ দিকে মুআবিয়া রা. একটি সীমানা পর্যন্ত জাজিরায় কর্তৃত্ব লাভ করতে সক্ষম হন। আলী রা. অভিযান চালিয়ে সেখানে আবারো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

যারা আলী ও মুআবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকতে চাইতেন, তারাও জাজিরায় আশ্রয় নিতেন। তাঁরা ছিলেন সে-সকল লোক, যাঁরা উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে আলীর নিকট বায়আত গ্রহণ করেননি। যেহেতু জায়গাটি উভয় পক্ষের মধ্যখানে অবস্থিত, তাই তাঁরা জাজিরাকেই আবাসস্থল হিসেবে মনোনীত করেন। কতেক বর্ণনায় জাজিরায় নিযুক্ত আলির দুজন গভর্নরের নাম রয়েছে। তাঁরা হলেন, আমির" এবং কামিল ইবনু জিয়াদ। সিরিয়া বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে তাঁরা উভয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এমনকি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে অগ্রসর হয়ে জাজিরার পক্ষ থেকে শামের ওপর আক্রমণেও তাঁরা বেশ সফল হন।

মিসর
উসমানের শাহাদাতকালে মিসরে জোরপূর্বক ক্ষমতায় ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু আবি হুজায়ফা। উসমান তাঁকে সেখানে নিয়োগ দেননি। উসমানের শাহাদাতের পর আলী রা. তাঁকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য গভর্নর হিসেবে সেখানে বহাল রাখেন; কিন্তু মুআবিয়া মিসর অভিমুখে সেনা-অভিযান পরিচালনা করে মুহাম্মাদ ইবনু আবি হুজায়ফাকে গ্রেফতার করেন। এরপর তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর আলী রা. কায়েস ইবনু সাআদ আনসারিকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেন।

কায়েস ইবনু সাআদ ফুসতাতে পৌঁছে মিম্বারে দাঁড়িয়ে মিসরবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি আলী রা. চিঠি পড়ে তাদের সামনে আলির পক্ষ থেকে বায়আতের দাবি করলেন। কিন্তু এই ভাষণের পর মিসরবাসী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল কায়েসের হাতে বায়আত হয়ে আলীর আনুগত্য প্রকাশ করে। আরেক দল বায়আত থেকে দূরে সরে থাকে। কায়েস ইবনু সাআদ উভয় দলের সঙ্গেই দূরদর্শী আচরণ করেন। যারা বায়আত হয়নি তাদের নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেননি। শুধু তাই নয়, তাদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও যেসব জায়গায় তারা অবস্থান করছিল সেসব স্থানে তাদের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার পাঠান। তাদের একটি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে এলে তাদেরও অনেক সম্মান জানান এবং দয়ার্দ্র আচরণ করেন।

কায়েস এই উত্তম আচরণ দ্বারা বিরোধীদের সঙ্গে যাবতীয় সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে সক্ষম হন। এতে করে মিসরে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে আসে। তিনি মিসরকে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর ব্যবস্থাপনায় সাজিয়ে তোলেন। বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। কর ও পুলিশ বিভাগের নিয়োগকার্যও সম্পন্ন করেন। এভাবেই তিনি মিসরের শাসনব্যবস্থা গুছিয়ে নিতে এবং সবার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হন।

অন্যদিকে কায়েস ইবনু সাআদের এমন অবস্থান সামরিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুআবিয়া রা. জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কেননা, একে তো সিরিয়া হলো মিসরের নিকটবর্তী এলাকা, অন্যদিকে কায়েসের মাধ্যমে মিসরের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রভূত উন্নতি করতে সক্ষম হন তিনি। এ ছাড়া কায়েস ইবনু সাআদের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার খ্যাতি তো ছিলই। তা ছাড়া মিসরীয় বাহিনীর প্রতিরোধমূলক সামরিক পদক্ষেপও মুআবিয়ার ভয়ের কারণ ছিল। এ জন্য তিনি কায়েস ইবনু সাআদকে হুমকিসংবলিত পত্র পাঠাতে থাকেন এবং পাশাপাশি তাঁকে নিজের দলে ভেড়াতে প্ররোচিত করেন। কায়েস ইবনু সাআদ এসব চিঠির এমন বুদ্ধিদীপ্ত জবাব প্রদান করতে থাকেন যাতে মুয়াবিয়া রা. তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য না করেন।

এতে কায়েসের বিরুদ্ধে প্রোপ্যাগান্ডা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত আলির কয়েকজন উপদেষ্টাও এ ব্যাপারে তাঁকে পরামর্শ দেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত প্রোপাগান্ডা সত্য মনে করেন। ফলে আলী রা. কায়েসের কাছে চিঠি লিখলেন, ‘আমি তোমাকে আমার কাছে রাখতে চাচ্ছি। সুতরাং তোমার অনুপস্থিতিতে আরেকজনকে নিয়োগ দিয়ে আমার নিকট চলে এসো। এরপর আলি তাঁর স্থানে আশতার নাখয়িকে মিসরের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি পথিমধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর আলী রা. মুহাম্মাদ ইবনু আবি বকর রা.-কে মিসরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। মুহাম্মাদ ইবনু আবি বকর বাকী সময় মিসরের গভর্নর ছিলেন। তাঁর সময়ে মুয়াবিয়া রা. বেশ কয়েকবার মিসরে আক্রমণ করেন। কিন্তু তা অধিকার করতে পারেন নি।

বসরা
আমিরুল মুমিনিন আলি রা. তাঁর শাসনামলে বসরার সাবেক গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনু আমির রা.-কে বরখাস্ত করেন। তিনি বসরা ছেড়ে চলে যান মক্কায়। তাঁর পরিবর্তে উসমান ইবনু হুনাইফ আনসারি রা.-কে বসরার গভর্নর হিসেবে পাঠান। উসমান ইবনু হুনাইফ সেই এলাকা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা ও দক্ষতা রাখতেন। কেননা, উমর রা. তাঁকে ভূমি জরিপ ও খারাজ উসুলের কাজে ইতিপূর্বে বসরায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। উসমান ইবনু হুনাইফ বসরার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। বসরাবাসী তখন তিন দলে বিভক্ত। একদল বায়আত হয়ে গোটা জামাআতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, আরেক দল—মদিনাবাসী কী করে, সেই ভাবনায় ছিল। আর তৃতীয় দল বায়আতকে সরাসরি অস্বীকৃতি জানাল।

উসমান ইবনু হুনাইফও বেশিদিন বসরার গভর্নর হিসেবে থাকতে পারেননি। উষ্ট্রের যুদ্ধের আগে তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা সিদ্দিকার সৈন্যবাহিনী বসরায় প্রবেশ করে। পরিস্থিতি বিবর্তিত হতে হতে একপর্যায়ে যা যুদ্ধে গিয়ে পৌঁছায়। উসমান ইবনু হুনাইফও চলে আসেন আলীর কাছে। উষ্ট্রের যুদ্ধের কদিন পূর্বেই বসরার পথে আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এভাবে শেষ হয় উসমান ইবনু হুনাইফের শাসনকাল। আলি রা. এ সময় বসরায় প্রবেশ করে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। উটের যুদ্ধের পর তিনি বসরা ত্যাগের মনস্থ করলে বিখ্যাত তাফসীরকারক আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-কে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং তাঁর সঙ্গে জিয়াদ ইবনু আবিহের হাতে খারাজ বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন। আলী রা. জিয়াদ ইবনু আবিহের কর্মদক্ষতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ব্যাপারটি জানতেন। তাই ইবনু আব্বাসকে বলেন, তিনি যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেন।

কুফা
উসমান রা.-এর শাহাদাতের সময় আবু মুসা আশআরি রা. তাঁর পক্ষ থেকে কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আলী রা. খলিফার পদে আসীন হলে তাঁকে সে পদেই বহাল রাখা হয়। তিনি আলির পক্ষ থেকে কুফাবাসীর কাছে খিলাফতের বায়আত গ্রহণ করেন এবং বায়আতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ও অধিকাংশের বায়আত কবুলের কথা জানিয়ে চিঠি পাঠান। আলি রা. ইরাকের উদ্দেশে মদিনাত্যাগের সময় আবু মুসা আশআরি সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আলি তার থেকে আবু মুসা আশআরি সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে সে বলল, ‘যদি আপনি সন্ধি ও মীমাংসা চান, তাহলে আবু মুসা আপনাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারবেন।

আর আপনি যদি যুদ্ধ করতে চান, তাহলে এ ব্যাপারে তিনি উপযুক্ত নন। এ কথা শুনে আলি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি তো কেবল সংশোধন চাই— যদি না কেউ আমাদের পথ আগলে না রাখে। শান্তি স্থাপন, সন্ধি এবং মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধে না জড়ানোর প্রতি আবু মুসা আশআরির অভিরুচি স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। মদিনা থেকে কুফায় রাজধানী স্থানান্তর হলে কুফার গভর্নরের পদ বিলুপ্ত হয়। আলী রা. নিজেই কুফার শাসক ছিলেন।

পারস্য
আলি রা. সাহল ইবনু হুনাইফ আনসারি রা.-কে পারস্যের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। একটি মেয়াদ তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন; কিন্তু এমন একটা সময় এলো যে, পারস্যবাসী তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। তারা ৩৭ হিজরির দিকে তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেয়। আলি এই পরিস্থিতি দেখে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পারস্য ইস্যুতে তাঁর সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে তাঁর অন্যতম সহযোগী জিয়াদ ইবনু আবি সুফিয়ানকে সেখানকার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পাঠিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, কেন্দ্রীয় রাজ্য বসরা এবং তাঁর অধীনস্থ রাজ্য পারস্যের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়া ইস্পাহানের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। এটি পারস্যের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। মুহাম্মাদ ইবনু সালিম ছিলেন এ অঞ্চলে আলীর পক্ষ থেকে নিযুক্ত শাসক। তাঁর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইস্পাহানের আরও একজন প্রসিদ্ধ শাসক হলেন উমর ইবনু সালামা। তিনি ইস্পাহান থেকে প্রচুর খাদ্য ও সম্পদ খিলাফতের রাজধানীতে নিয়ে আসেন। ২৯ হিজরিতে আলির শাসনামলে পারস্যের এই এলাকায় দিরহামের প্রচলন শুরু হয়। ইরাকের মিউজিয়ামে আরবিভাষ্য খুদাই করা সেই দিরহাম এখনো সংরক্ষিত আছে।

খোরাসান
খোরাসান ছিল পারস্যের একটি রাজ্য। খুলাফায়ে রাশিদিনের শাসনকালে খোরাসান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বসরার সঙ্গে কেন্দ্রীভূত ছিল। আলী রা.-এর খিলাফতকালে গভর্নর ও প্রশাসনিক বিষয়সহ এখানে সংঘটিত হয় বেশকিছু ঘটনা। এ ছাড়া কয়েকজন গভর্নর ও শহরের আমিরের নামও পাওয়া যায়। আবদুর রহমান ইবনু আবজা ছিলেন আলীর পক্ষ থেকে খোরাসানের প্রথম গভর্নর। এ ছাড়াও জাদাহ ইবনু হুবাইরা ইবনু আবি ওয়াহহাবও খোরাসানের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আলী ৩৭ হিজরিতে সিফফিন থেকে ফেরার পর তাঁকে খোরাসানের গভর্নর বানিয়ে পাঠান।

আজারবাইজান
উসমানের শাহাদাতের সময় আশআস ইবনু কায়েস রা. ছিলেন আজারবাইজানের গভর্নর। তিনি ভালো যোদ্ধা ছিলেন। আলী রা. যুদ্ধের প্রয়োজনে আশআস ইবনু কায়েসকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান। তিনি কুফায় এসে আলীর সঙ্গে মিলিত হন। সিফফিনযুদ্ধ এবং খারেজি দমন- অভিযানসহ বিভিন্ন ঘটনায় তিনি আলীর সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তিনি সায়িদ ইবনু সারিয়া খুজায়িকে আজারবাইজানের গভর্নর নিযুক্ত করেন আলী রা.। এরপর পুনরায় আশআসকে আজারবাইজানের গভর্নর নিযুক্ত করে আর্মেনিয়াকেও তাঁর অধীন করে দেন। আজারবাইজানের গভর্নর থাকাকালে আশআস ইবনু কায়েস সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেন। এর মধ্যে একটি হলো, তিনি আরদাবিলায় আরবদের জন্য বসতি স্থাপন এবং এটিকে মুসলিম নগরীতে রূপান্তর করেন। ইসলামের প্রসারের পর সেখানে নির্মাণ করা হয় বিশাল মসজিদ।

আলী রা.-এর ৫ বছরের শাসনামল প্রায় পুরোটায় গৃহযুদ্ধে কেটে গেছে। তাই এসময় নতুন অঞ্চল বিজয় করা সম্ভব হয়নি।

২৩ ফেব, ২০২৩

শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

১৯৩৫ সনে এই প্রশ্নটি বেশ জোরালোভাবেই উত্থাপিত হয়েছিল যে, মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নাস্তিক; নাস্তিকতা ভাবাপন্ন এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী ও তার প্রচারক এত অধিক সংখ্যায় বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ ছিলো, এখান থেকে সনদপ্রাপ্ত শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীই নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের পূজারী!


উপমহাদেশে মুসলিমদের নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রাক্কালে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ মাওলানা মওদূদী রহ. রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দিকে গভীর মনযোগ দেন। মুসলিমদের রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হতে পারে এর পাশাপাশি বর্তমান পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও মৌলিক ত্রুটি আলোচনা করেছেন। ইংরেজদের শিক্ষানীতির সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সমাধানমূলক অনেকগুলো বক্তব্য ও প্রবন্ধ লিখে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনা করেছেন মাওলানা মওদূদী। সেই বক্তব্য ও প্রবন্ধগুলো সংকলন করে একটি বই প্রস্তুত করা হয়েছে।    


অনেকটা শিক্ষা বোর্ডের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার কাজ হলো শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা ও সে অনুযায়ী পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা। সেই প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ 'ইসলামী এডুকেশন সোসাইটি' মাওলানা মওদূদীর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লেখা বইটি বাংলায় প্রকাশ করে। বইটির বাংলা নাম 'শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ'।

বইটি অনুবাদ করেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও হাফেজ আকরাম ফারুক। 


আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মাওলানা প্রথমেই আলোচনা করেন তৎকালীন ইংরেজ সরকারের আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটিগুলো কী কী? মুসলিমদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে এই বিচ্যুতির সয়লাব ঠেকাতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন। 


এরপর তিনি মুসলমানদের জন্য নতুন শিক্ষানীতি ও কর্মসূচীর ব্যাপার আলোকপাত করেন। এখানে তিনি যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেন তা হলো, 

(১) মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দী থেকে ফিরিংগীপনার মূলোৎপাটন একান্ত জরুরী।

(২) শিক্ষাঙ্গনে ইসলামী চেতনা ও প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি

(৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় আরবীকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।


এই অধ্যায়ে মাওলানা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ স্তরে পড়াশোনা কেমন হওয়া উচিত তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। 


এরপর মাওলানা প্রস্তাবিত ইসলামী শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নের পন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এই নিয়ে তিনি ৭ দফা পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। 


এরপর এই বইটিতে মাওলানার একটি সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মাওলানা মুসলিম হিসেবে ইসলামী জ্ঞানর্জনের জন্য তিনিটি পরামর্শ দেন। 

প্রথমতঃ আপনারা যতটা সম্ভব আরবী ভাষা শিখতে চেষ্টা করুন।

দ্বিতীয়তঃ পবিত্র কুরআন, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন কথা এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্র অধ্যয়ন করা ইসলামকে বুঝবার জন্য অপরিহার্য। 

তৃতীয়তঃ ইসলাম সম্পর্কে ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে পড়াশুনা করুন।


ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে মাওলানা লাহোরে বরকত আলী মোহামেডান হলে ছাত্রদের এক সমাবেশে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বক্তব্য দেন। সেখানে, প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও এর কুফল আলোচনা করার পর বলেন, 


আমাদের সত্যিই যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে কেবল জোড়াতালি ও মেরামত দ্বারা কার্যসিদ্ধি হবে না, বরং সেজন্য একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কথাটা উপলব্ধি করানোর জন্যই আমাদের এ আলোচনার অবতারণা। আসলে প্রচলিত দু’টো শিক্ষাকেই অর্থাৎ পুরনো ধর্মীয় শিক্ষা এবং বৃটিশ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকে বাতিল করে দেয়া এখন অপরিহার্য হয়ে ‍উঠেছে। এই উভয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা নতুন একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রচলিত দুটো শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত হতে হবে  এবং একটা মুসলিম স্বাধীন ও উন্নয়নকামী জাতি হিসেবে আমাদের যাবতীয় চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা তার আওতাভুক্ত থাকতে হবে। এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।


এ ব্যাপারে মাওলানা ৩ টি পয়েন্টে কথা বলেন, 

১. শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ 

২. ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য ঘোচাতে হবে

৩. চরিত্র গঠন


বইটির শেষভাগে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। সবশেষে নারী শিক্ষার ব্যাপারে মাওলানার একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করা হয়েছে। 


নারীর শিক্ষা পুরুষের মতই জরুরী। নারীদের অজ্ঞ ও অনগ্রসর রেখে পৃথিবীতে কোন জাতিই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য মুসলিম পুরুষদের মত মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্যও যতদূর সম্ভব উন্নত ব্যবস্থা করা উচিত। এমনকি তাদের সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা আমাদেরকে এমন সব অত্যাচারী  ও আধিপত্যবাদী জাতির সাথে পাল্লা দিয়ে থাকতে হচ্ছে, যারা মানবতার কোন সীমানা লংঘনেই সংকোচবোধ করে না। খোদা না করুন, তাদের সাথে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে গেলে তারা কি কি ধরনের বর্বরতার পরিচয় দিবে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কাজেই আমাদের কর্তব্য নারীদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত করা। 


তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলিম। সুতরাং আমরা যা কিছু করবো তা যেন আমাদের ঈমানের পরিপন্থী না হয় এবং যেসব মূল্যবোধ ও সভ্যজনোচিত বিধি-নিষেধ মানতে আমরা ইসলাম কর্তৃক আদিষ্ট, তারও খেলাফ না হয়।


পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আমাদের সভ্যতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সে কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। এ দুটোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য  এই যে, নারী যতক্ষণ পুরুষ সেজে পুরুষোচিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে, ততক্ষণ পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে সম্মান দেয় না এবং তার কোন অধিকার স্বীকার করে না। 


কিন্তু আমাদের সভ্যতা ও শিক্ষা নারীকে নারী রেখেই তার যথোচিত সম্মান ও অধিকার প্রদান করে। তার উপর শুধুমাত্র সেইসব সামাজিক দায়িত্বই অর্পণ করে যা স্বয়ং প্রকৃতি তার উপর স্বাভাবিক নিয়মে অর্পণ করেছে। সুতরাং আমাদের  নারীদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের স্বভাবের দাবী ও প্রয়োজন অনুসারে হতে হবে এবং পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্নস্তর থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কোথাও সহশিক্ষার প্রশ্নই উঠতে পারে না।


এ ছাড়া নারীদের শিক্ষায় এ কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, তাদের আসল ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা ও মানুষ গড়া, কৃষি খামার, কল-কারখানা, অফিস আদালত চালানো নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হবে নারী জাতিকে একটা সাচ্চা মুসলিম জাতি গঠনের যোগ্য করে তোলা যে জাতি দুনিয়ার সামনে স্রষ্টার রচিত কল্যাণকর ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।


১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দীর্ঘ মুসলিম শাসনেও আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামের আলোকে করতে সমর্থ হইনি। ইংরেজ আমল থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন ১৯৭১ সালের পর থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুয়ানী কালচার ঢুকে পড়েছে। 


যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মী তাদের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ জানা উচিত। আর এই জানার জন্য মাওলানা মওদূদীর এই বইটি বেশ সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। যদিও মাওলানা ইংরেজ আমলের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন তবুও এটি বর্তমান সময়ের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক। 


#বুক_রিভিউ

বই : শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

লেখক : সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী

অনুবাদক : মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও হাফেজ আকরাম ফারুক

প্রকাশনী : ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি

পৃষ্ঠা : ১১৯

মুদ্রিত মূল্য : ৬০

জনরা : শিক্ষা ও গবেষণা 

২২ ফেব, ২০২৩

ভাষা আন্দোলন ঠিক? নাকি বেঠিক?


ভাষা আন্দোলন কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন? নাকি এই আন্দোলন নিজেই অন্যায়? এটা উচিত ছিল? নাকি অনুচিত? এই আন্দোলন কি বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া ছিল? নাকি বাংলার মানুষ এই আন্দোলন চায়নি? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এই লেখায়।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তখন একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে, সে সিদ্ধান্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলোচনা চলাকালে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। তবে ১৯৩৭ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত ‘উর্দু’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, এটা সহজেই অনুমিত ছিল। উপমহাদেশের সকল মুসলিম এই লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কায় কথা বলতে ও বুঝতে পারতো। এর মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এর প্রতিবাদ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। এটাই ছিল ড. শহীদুল্লাহর একমাত্র যুক্তি। [১]

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত ছিল না কারণ বাংলা সবার জন্য বোধগম্য ছিল না। আবার শুধু পূর্বপাকিস্তান ও বাংলায় যদি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করা হয়, তবে সেটাও রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য হুমকি। যেমন পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাংলা’ অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে চালু হলে এখানে পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য বোধগম্য হবে না। এখানে তারা ব্যবসা ও পড়ালেখা করার জন্য আসবে না। যেটা এই অঞ্চলের মানুষের জন্যই ক্ষতিকর হবে। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র বিশ বছরের মধ্যে ঢাকা কলকাতা থেকেও সমৃদ্ধশালী হয়েছিল। এই বাংলাদেশের সবগুলো সূচক এগিয়ে এর অন্যতম কারণ ছিল এখানে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান থেকে বহু মুহাজির ব্যবসায়ী এসেছেন। ব্যবসা করেছেন ও শিল্প গড়েছেন। এজন্য বাংলার রাজনীতিবিদেরা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না।

আবার পূর্ব পাকিস্তানে অফিসিয়াল ভাষা বাংলা হলে পাকিস্তানের অন্যান্য গোষ্ঠী পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু, বেলুচরা তাদের নিজ নিজ প্রদেশে নিজ নিজ ভাষা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে এক অঞ্চলের মানুষ আরেক অঞ্চলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। একইসাথে রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট হবে। এজন্য লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে উর্দু ছিল পাকিস্তানের ভাষা হিসেবে সঠিক চয়েজ।

অন্যপক্ষে অবিভক্ত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দুদের হিন্দি-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের উর্দুর প্রতি একটা সহজাত দুর্বলতা ছিল। তা ছাড়া উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রাচীনপন্থি ও আধুনিকপন্থি উভয় ধরনের শীর্ষ শিক্ষাকেন্দ্র যথাক্রমে দেওবন্দ ও আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় উর্দুর প্রতি প্রাচীন ও আধুনিক উভয়পন্থী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে একটা সমীহ বোধ ছিল। উর্দু ছিল সকল মুসলিমের কাছে বোধগম্য একমাত্র ভাষা। যদিও পাকিস্তানে বাঙালি বেশি তবে বাঙালি ছাড়া আর কেউ বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত ছিল না। সুতরাং উর্দু রাষ্ট্রভাষা না হলে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ে যাবে।

বাংলাদেশের বহু অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান পরিবারে উর্দুতে কথাবার্তা বলা একটা আভিজাত্যের পরিচায়ক বলে মনে করা হতো। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর আদি অধিবাসীদের মধ্যে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত এক ভাষা বহুল প্রচলিত থাকায় তারাও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সুনজরে দেখেননি বরং মুশরিকদের ষড়যন্ত্র হিসেবেই গণ্য করেছে। এসব কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন মোটেই গণদাবি বা জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা পরে হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই এ নিয়ে আলোচনা, বাদ-প্রতিবাদ, লেখালেখি শুরু হয়। এসব বাদ-প্রতিবাদ ও লেখালেখিতে বাংলার পক্ষে অংশগ্রহণ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাবন্ধিক আবদুল হক, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ।[২]

অনেকে মনে করেন উর্দু পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা ছিল। না, উর্দু তাদের মাতৃভাষা না। পাকিস্তানের পাঁচ জাতির পাঁচটি আলাদা ভাষা। উর্দু কারো মাতৃভাষা ছিল না। বর্তমানে পাকিস্তানের মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ উর্দুকে মাতৃভাষা হিসবে ব্যবহার করে। আর এরা হলে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানে যাওয়া জনগণ।[৩] আপনি জেনে অবাক হবেন পাকিস্তানের চাইতেও ভারতে উর্দুভাষী বেশি। ভারতের প্রায় সকল মুসলিম (বাঙালি ছাড়া) উর্দুকে নিজেদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানে দেড় কোটির মতো মানুষের মাতৃভাষা উর্দু, আর ভারতে ১৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা উর্দু। মোদ্দা কথা হলো পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা উর্দু নয়। আমাদেরও উর্দু নয়। তবে উর্দু সকল মুসলিমেরই যোগাযোগের ভাষা ছিল। উর্দু ভারতের সব জাতি গোষ্ঠীর জন্যই কমন ও সবচেয়ে বোধগম্য ভাষা ছিল। যদিও সেটা কারো মাতৃভাষা ছিল না।

উর্দু একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তঃযোগাযোগীয় ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য এটাই জরুরি। প্রমিত বাংলা ভাষা আমাদের কারো মাতৃভাষা নয়।

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকতো। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খাড়ি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে।

উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে ওঠে। [৪]

মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর এটা মুসলিম তাদের ইশতেহারে এনেছিল সর্বপ্রথম ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে। হিন্দির বিপরীতে উর্দু তখন থেকেই রাজনৈতিক মর্যাদা পায়। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য।

শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভিন্ন দাবি করেছে আমাদের কিছু বাঙালি ছাত্র। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটা মোটেও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন অন্য কেউ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সর্বপ্রথম অফিসিয়ালি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তৎকালীন সকল বাঙালি সংসদ সদস্যরা ওনার বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃএব এটা বাংলার গণমানুষের দাবী এটা বলা অযৌক্তিক। [৫]

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার অযৌক্তিক ও পরিকল্পিত উদ্যোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করে তমুদ্দুনে মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরে। তমুদ্দুনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের মেনিফেস্টোরূপী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামের একটি ছোট বই। এই বইয়ে স্থান পায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল মনসুর আহমদ এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেমের তিনটি নিবন্ধ।

তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই পুস্তিকার প্রথম নিবন্ধই ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের। তমুদ্দুনের পক্ষ থেকে তার লিখিত “আমাদের প্রস্তাব” শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি উত্থাপিত হয় দুইটি। [৬]

১. বাংলা ভাষাই হবে –
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে আদালতের ভাষা
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।

২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি :
উর্দু ও বাংলা।

সমগ্র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই মূল দাবিতেই পরিচালিত হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম তার নিবন্ধে এক পর্যায়ে বলেন, "গণপরিষদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে তারা যেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মত দিয়ে বাঙালির আত্মহত্যার পথ সুগম না করেন, তা স্পষ্ট বুঝাতে হবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেন নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা।"

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক নূরুল হক ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, কবি জসীমউদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মওলানা আকরম খাঁসহ কয়েকশ চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরসহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

এর বিপরীতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী আন্দোলনও তখন জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে আবুল কাসেমই বলেন, "এদিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়ে উঠে। স্বনামখ্যাত মৌলানা দ্বীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহুস্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয়। এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক মেমোরেণ্ডাম পেশ করেন। পথেঘাটে ইস্টিমারে এ স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ চলে। স্বাক্ষর সংগ্রহের পর কয়েকজন নামকরা ব্যক্তি করাচীতে গিয়ে সরকারের কাছে পেশ করে আসেন।" [৭]

যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে ছিলেন তারা কেউ কিন্তু অবাঙালি ছিলেন না। তাদের যুক্তি হলো পূর্ব পাকিস্তানে যদি বাংলাকে অফিসিয়াল ভাষা করা হয় তবে অন্যান্য অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচ, কাশ্মীরে তাদের নিজস্ব ভাষা চালু হবে। এক্ষেত্রে বাঙালিদের সেসব অঞ্চলে কাজ করা ও শিক্ষাগ্রহণ করা কঠিন হবে। অন্যদিকে বাংলায় অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির পাকিস্তানীরা আসবে না। ফলে দীর্ঘদিনের ইংরেজ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শোষণের ফলে পিছিয়ে থাকা বাংলা আরো পিছিয়ে যাবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হবে।

১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। এ সময় পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ১৫ ডিসেম্বর এক সার্কুলারে বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ও উর্দুকে পরীক্ষার বিষয়ভুক্ত করায় তার বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম এক বিবৃতি দেন। আবুল কাসেম এমনভাবে বিবৃতি দেন যেন পাকিস্তানে বাঙালি বাদে আর কোনো জাতি গোষ্ঠী নেই। তার এই অনুচিত বিবৃতি ছাপে নি কোনো পত্রিকা।

আবুল কাসেম এই বিবৃতি ৩১ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে ছাপার ব্যবস্থা করেন। কলকাতার ঐ পত্রিকা এ বিষয়ে পাকিস্তানের কড়া সমালোচনা করে ও বাঙালি নির্যাতনের অভিযোগ এনে “অবিশ্বাস্য” শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই পত্রিকায় কপি ঢাকায় নিয়ে এসে প্রচারণা চালায় তমুদ্দুনে মজলিসের কর্মীরা। এই ঘটনা ঢাকাবাসীর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের আগের ধারণা সত্য হয়েছে বলে তারা মনে করেন। নতুন একটি ইসলামী ভাবধারার রাষ্ট্রে ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্যই মুশরিকরা কিছু ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছে। এরকমটাই ভাবতে থাকেন ঢাকাবাসী। তারা তমুদ্দুনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন। [৮] তমুদ্দুনের কর্মীদের ঢাকায় সাধারণ মানুষ ব্যাপক হেনস্তা করে। তমুদ্দুন কমিউনিস্ট ও মুশরিকদের দালাল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। একমাত্র চারজন হিন্দু ছাড়া আর কোনো পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য (এমপি) এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেননি। অর্থাৎ সমস্ত বাঙালি এমপি রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফরিদপুরের নেতা তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গণপরিষদের সকল বাঙালি নেতা একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক, আমরা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি চাই।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথের সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে বাতিল হয়ে যায়। [২৫৮]

গণপরিষদে বাংলার রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব বাতিল হওয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক অংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সংগঠন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক হওয়ায় পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর নির্বাচিত হন যুগপৎ মজলিস ও ছাত্রলীগের সদস্য তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামসুল আলম। তবে বাংলার একজন রাজনৈতিক নেতারও প্রত্যক্ষ সমর্থন না পাওয়াও ভাষা আন্দোলন গণভিত্তি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনকারীরা খুবই সহিংস হয়ে ওঠে। তারা সচিবালয়ে ঢুকে সরকারি কর্মকর্তাদের হেনস্তা করতে থাকে। এর প্রতিরোধে মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা রাস্তায় নামে। ফলে পালিয়ে যায় ভাষা আন্দোলনকারীরা। মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা ঢাকা মেডিকেল ও ঢাবির হলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে। পুলিশ দুই পক্ষের লোকদেরই ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।[৯]

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল-[১০]

১- ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।
২- পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
৩- বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
৪- সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৫- আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
৬- ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।
৭- পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।
৮- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন " রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই" এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"। এতে ভাষা আন্দোলনকারীরা ক্ষেপে যায় এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয়। তমুদ্দুনের নেতৃত্বে কিছু ছাত্র জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। জিন্নাহ তাদের বুঝান কেন একটি ভাষাই পাকিস্তানের সংহতির জন্য জরুরি। এরপর ২৪ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বক্তব্যে বলেন, “Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead the people is really the enemy of the state. Without one state language no state can remain tied up solidly together and function.”

Let me restate my views on the question of a state language for Pakistan. For official use in this province, the people of the province can choose any language they wish... There can, however, be one lingua franca, that is, the language for inter-communication between the various provinces of the state, and that language should be Urdu and cannot be any other...

The state language, therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this subcontinent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and, above all, a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the languages used in other Islamic countries. [১১]

তখন তার এই বক্তব্য করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় ছাত্ররা। প্রচলিত ইতিহাসে আমাদের জানানো হয়েছে ছাত্ররা ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো সে ‘নো নো’ শব্দ শোনা যায় নি। হতে পারে তারা সত্যই বলেছেন। কিছু ছাত্র হয়তো ‘নো’ বলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি ছাত্র করতালি দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। এই ব্যাপারটা আমাদের প্রচলিত ইতিহাসে অস্বীকার করা হয়েছে। [১২]

যাই হোক জিন্নাহ ভাষা আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী হন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। বৈঠকে জিন্নাহ একক রাষ্ট্রভাষার গুরুত্ব তুলে ধরেন, পাকিস্তান নিয়ে তার চিন্তা ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।

জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরি এবং এতেই কল্যাণ রয়েছে বাঙালিদের। প্রতিটা প্রদেশে আলাদা ভাষা থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাঙ্গালিরাই। কারণ বাঙালিরা রাজধানীতে অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। জিন্নাহ ছাত্রদের বুঝিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতারা জিন্নাহর যুক্তির কাছে হার মানে এবং আন্দোলন থেকে সরে আসার মৌখিক স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য জিন্নাহ তাদের কাছ থেকে লিখিত কোনো ডকুমেন্টস চাননি। তিনি আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে ছাত্রদের ভুল আন্দোলন থেকে ফিরতে বলেছেন।

ঢাকা ত্যাগের সময় তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে করা চুক্তির আর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে উল্লেখ করেন একইসাথে উর্দুর ব্যাপারে আবারো তার মতামত ব্যক্ত করেন। আন্দোলন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তমুদ্দুন মজলিস। দ্বিধান্বিত নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব কেড়ে নেয় বামাদর্শের ছাত্রনেতা কমরেড তোয়াহা এবং এই আন্দোলনকে বামদের আন্দোলনে পরিণত করেন। নেতৃত্ব হারানোর পর পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে। বলা চলে ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন বন্ধ থাকে।

১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই মিটিং-এ ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে প্রশংসা করে মানপত্র পাঠ করা হয়। সেই মানপত্র পাঠ করেন ডাকসুর জিএস গোলাম আযম। মানপত্রে তিনি বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। তবে লিয়াকত আলী খান এই ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।[১৩] ১৭ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করা হয় এবং সেটি ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি।

যদিও ভাষা আন্দোলন করেছে অল্প কিছু ছাত্র এবং এটি মোটেই গণভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়নি তথাপি পাঞ্জাবের নেতা লিয়াকত আলী খান এটিকে একেবারে উড়িয়ে দেননি। তিনি মনে করেছেন যেহেতু এই ভাষায়ই পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে এটা একসময় বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই তিনি এর কিছুদিন পর, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। এই জন্য বাংলা সমর্থক মাওলানা আকরম খাঁনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করেন লিয়াকত আলী খান। ভাষা কমিটিকেও এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেন। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে ও সমাধানে কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করে। ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালে ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে পাকিস্তানের মূল সমস্যা সংবিধান নিয়ে কথা বলেন। সেখানে পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা ইংরজি পরিবর্তন করে উর্দু করার কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, 'কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু'। এতে আবারো বামপন্থী ছাত্ররা নতুন করে সংগঠিত হয়। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। নতুন কর্মপরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। [১৪]

এবার আন্দোলন চাঙ্গা হয় কারণ এবার মুসলিম ভেঙে গঠিত হওয়া আওয়ামীলীগের একাংশের সাপোর্ট পায় ভাষা আন্দোলন। ভাসানীর সাপোর্টের মূল কারণ হলো নাজিমুদ্দিনের বিরোধীতা। সেসময় মুসলিম লীগের বিরোধীতা করাই ছিল আওয়ামীলীগের অন্যতম কাজ। যাই হোক ৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল করে ভাষা আন্দোলনকারীরা এবং প্রচুর ভায়োলেন্স করে। জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। এর অন্যতম কারণ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

৪ ফেব্রুয়ারির সহিংসতার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তান সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বাম ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে আলাদা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্তা পাঠিয়ে দেয়।

সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সমাবেশ চালাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। পুলিশের নমনীয় অবস্থান দেখে ছাত্রলীগ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সমাবেশে যোগ দেয়। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রলীগ যোগ দিলে সমাবেশের আকার বড় হয়ে যায়। তাই এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। অনেক ছাত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। পুলিশ পিছিয়ে আসে। [১৫]

পুলিশ পিছিয়ে গেলে ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এ সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এবার পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। দুপুরের দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ভাষা আন্দোলনকারীরা তাদের বাধা দেয়। অনেককে হেনস্তা করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।[১৬] কিন্তু পরিস্থিতির ভয়ানক পরিবর্তন ঘটে যখন ছাত্ররা দলবল নিয়ে আইনসভার দখল নিতে যায়। আইনসভার ওপর তারা ক্ষ্যাপা কারণ আইনসভার সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পছন্দ করেনি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এ সময় ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণে লুটিয়ে পড়ে সচিবালয়ের পিয়ন[১৪] আব্দুস সালাম। যাকে এখন ভাষা শহীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আইনসভার সদস্য নিরাপত্তায় গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ ফাঁকা গুলি চালায়। প্রচলিত ইতিহাসে বলা হয় পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া আবুল বরকত ও ওহিউল্লাহ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরেরদিন আবারো হত্যার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনকারীরা মিছিল বের করে। এখানেও পুলিশ গুলি করে। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন নিহত হন।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যারা মারা গিয়েছে তারা কেউ ভাষা আন্দোলন করেননি। মিছিলেও যোগ দেননি। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল ১৯৫২ সালের সেক্রেটারিয়েট ও আইনসভা [১৭]। সেখানে হামলা চালিয়েছে ভাষা আন্দোলনকারীরা। সেক্রেটারিয়েটের পিয়ন আব্দুস সালাম নিহত হওয়ার পর পুলিশ নিরাপত্তা রক্ষার্থে কাঁদানে গ্যাস ও গুলি চালায়। যারা সেসময় প্রমিনেন্ট ভাষা আন্দোলনকারী ও সামনের সারিতে ছিল তারা কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে প্রমাণ ইতিহাসে নেই। একাধিক ভাষা আন্দোলনকারীদের বয়ানে এটা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান শহীদ মিনার এলাকায় শুধুমাত্র সংঘর্ষ হয়। কিন্তু নিহত ব্যক্তিরা সংঘর্ষের স্থানে নিহত না হয়ে নিহত হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেলে।

আমরা যদি সেসময় খুন হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় নিতে চাই তাহলে আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে পুলিশের গুলিতে নয় বরং অজানা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন ২১ শে ফেব্রুয়ারির নিহতরা। প্রথমে খুন হন ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেলে খুন হন রফিক উদ্দিন। হোস্টেলের ভেতর গিয়ে পুলিশ গুলি চালিয়েছে এমন অভিযোগ কখনোই পাওয়া যায় নি। অভিযোগ ছিল পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়েছে। অথচ রাস্তায় মিছিলে থাকা কেউ গুলিবিদ্ধ হয়নি। রফিক ১৯৪৯ সালে বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পরে স্থানীয় দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন কিন্তু পড়ালেখা শেষ করেন নি। [১৮]

ঢাকায় এসে বাবার সাথে প্রেসের ব্যবসায়ে যুক্ত হন। তিনি ছাত্র ছিলেন না। তার ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার রেকর্ডও ছিল না। যদিও নতুনভাবে এই আওয়ামী সরকার আসার পর রফিককে জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ তার উচ্চ মাধ্যমিক পাশের খবর নেই।

এরপর আব্দুল জব্বারের লাশের খবর পাওয়া যায়। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন তার ক্যন্সার আক্রান্ত শাশুড়িকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। তিনি পাকিস্তান সরকারের আনসার বাহিনীতে চাকুরি করতেন। আনসার কমান্ডার আব্দুল জব্বার ঢাকা মেডিকেলে ছিলেন। তাকে সেখানেই কে বা কারা গুলি করে হত্যা করে। তার লাশ ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেলে পড়ে ছিল। সেখান থেকে জরুরি বিভাগে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। [১৯]

ময়মনসিংহ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সরকারি চাকুরে এই আব্দুল জব্বারের ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাকেও খুন হতে হলো অজানা কারনে সংঘর্ষের স্থান থেকে দূরে।

আবুল বরকত ছিলেন ২১ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়া একমাত্র ছাত্র। যিনি ঢাবিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। তিনি আমাদের দেশের মানুষ নন, মুহাজির ছিলেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ভাগ হলে তাঁর পরিবার ভারত থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। প্রচলিত ইতিহাস মতে তিনি ভাষা আন্দোলনকারী ছিলেন এবং পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু একাধিক ভাষা সৈনিকদের জবানিতে পাওয়া যায় তিনি ভাষা আন্দোলনবিরোধী ও পুলিশের ইনফর্মার ছিলেন।[২০][২১] এই দাবির পক্ষে প্রমিনেন্ট মানুষ হলেন দুইজন, ভাষা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা (সভাপতি, কমিউনিস্ট পার্টি) এবং ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। এই আবুল বরকতও ঘটনাস্থলে নিহত না হয়ে মেডিকেলের হোস্টেলে খুন হন।

যাই হোক সর্বশেষ ২১ ফেব্রুয়ারিতে খুন হন অহিউল্লাহ নামের একজন শিশু। বয়স আট কি নয় বছর। তার বাবা হাবিবুর রহমান পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ঢাকার নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে গুলিবিদ্ধ হয় নিষ্পাপ এ শিশুটি। ঘাতকের গুলি লাগে অহিউল্লাহর মাথায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ে অহিউল্লাহ। তার মৃত্যুর কারণও অজানা।

২১ শে ফেব্রুয়ারির খুনের মাধ্যমে শেষ হয়নি একুশের খুনীদের রক্তের লালসা। মিছিলে পুলিশের বাধার প্রতিবাদে পরেরদিন অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিও ভাষা আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। পুলিশ লাঠিচার্য করে সেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করে। সেদিনও খুন হন একজন। তিনিও আবুল বরকতের মতো এদেশের মানুষ নন। তিনি দেশভাগের জন্য ভারত থেকে আসা মুহাজির। তার নাম শফিউর রহমান।

শফিউর রহমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কোন্নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই.কম পাস করে তিনি চব্বিশ পরগনা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানি পদে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা হাইকোর্টের হিসাবরক্ষণ শাখায় কেরানির চাকরিতে যোগ দেন।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান তখন সাইকেল যোগে ঐ পথে অফিসে যাচ্ছিলেন। তখন কে বা কারা তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে। তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঐদিন সন্ধ্যা ৭টায় তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[২২] তিনি কখনো ভাষা আন্দোলন করেননি ও আন্দোলনকারীদের সাথে যুক্ত ছিলেন না।

কী এক আজিব অবস্থা! বর্তমান চালু ইতিহাসে পুলিশ মিছিলে গুলি করে। অথচ ভাষা আন্দোলনের সময় নিহত হওয়া কেউই মিছিলে ছিল না। কেউই ভাষা আন্দোলন করেননি। আর যারা মিছিলে ছিল তারা কেউই নিহত হওয়া তো দূরের কথা, গুলিবিদ্ধও হননি। যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নেতৃত্ব দিয়েছেন, মিছিল করেছেন, মিছিলের সামনে থেকেছেন তারা গ্রেপ্তার ও লাঠিচার্জের শিকার হলেও গুলির শিকার হননি।

খুন হওয়া মানুষদের পরিচিতি, অবস্থান, খুন হওয়ার স্থান নির্দেশ করে এরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে খুন হয়নি। ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগে কেউ তাদের খুন করেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নুরুল আমিন একজন বাঙালি ছিলেন। বাঙ্গালিদের প্রতি বিদ্বেষবশত তিনি খুনের নির্দেশ দিবেন এটা অমূলক ধারণা। ২১ ফেব্রুয়ারির মৃতরা কি আসলেই পুলিশের গুলিতে ইন্তেকাল করেছে? নাকি কমিউনিস্টরা পরিস্থিতি তাদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য কিছু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে? এই প্রশ্ন থেকেই গেল।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, আমাদের প্রচলিত ইতহাসে আমাদের জানানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার কারণে ১৯৫২ সালে বাঙালিরা প্রাণ দেয়। এটা সত্য নয় ১৯৫২ সালের ঘটনার সাথে কোনো অবাঙালি জড়িত নেই। যার উক্তি নিয়ে দাঙা-হাঙ্গামা হয় তিনি হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ঢাকার নেতা, ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য। তারা অন্তত চার পুরুষ ধরে ঢাকার স্থানীয়। একইসাথে তিনি পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সেসময় পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনিও বাঙালি। একইসাথে পুলিশ অফিসাররাও ছিলেন বাঙালি। এখানে কেউই অবাঙালি ছিলেন না।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর মুসলিম লীগের বিরোধীরা বিশেষত আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ১৯৫২ সালের আগে কোনো বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো নেতা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। স্বাধীন দেশে পুলিশের হাতে মানুষ খুন এটা সাধারণ মানুষের অনেকেই পছন্দ করেন নি। ঘটনার কিছুদিন পর সোহরাওয়ার্দি ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রচারপত্র বিতরণ করে ভাষা আন্দোলনকারীরা। এটা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন শেরে বাংলা। কারণ তিনি স্বাক্ষর দেননি। ভাষা আন্দোলনকারীরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। [২৩]

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বাঙালি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া এক সভায় সিদ্ধান্ত নেন বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি ওঠে। সিন্ধি ছাত্ররা করাচিতে সিন্ধি ভাষা চালুর জন্য আন্দোলন করতে থাকে। এর বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের আরেক মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হক প্রতিবাদ জানান। তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচিতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। এভাবে সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশ চলতে থাকে। সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এমন জটিল ও সহিংস পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী বগুড়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এটা মাতৃভাষা বিষয়ক আন্দোলন ছিল না। এমন কোনো কথা হয়নি যে, বাঙালিরা বা অন্য ভাষাভাষী জাতি গোষ্ঠী নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারবে না। এটাও বামপন্থী সন্ত্রাসীদের কূটচাল। ভাষা আন্দোলনের ফসল হিসেবে এক পর্যায়ে পাকিস্তান ভাঙ্গে। এরপর বামেরা নতুন বক্তব্য চালু করলো পাকিস্তানীরা নাকি ১৯৫২ সালে আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। এটা সর্বৈব মিথ্যা ও অপ্রাসঙ্গিক কথা। বাংলাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি বা এমন কোনো আলোচনাই তৈরি হয়নি। যে যার ইচ্ছেমতো কথা বলবে এখানে রাষ্ট্রের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। 

তথ্যসূত্র
১- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে ’৪৭ সালেই / আসিফুর রহমান সাগর / দৈনিক ইত্তেফাক / ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
২- যেভাবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় / মোহম্মদ আবদুল গফুর / দৈনিক ইনকিলাব / ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
৩- The World Factbook / Central Intelligence Agency / P. 264
৪- Urdu Literary Culture / Mehr Afshan Farooqi / P. 67
৫- পাক-গণপরিষদে বাংলাকে পরিষদের ভাষা করার দাবি / দৈনিক ইত্তেফাক / ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
৬- পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি / বদরুদ্দিন উমর / মাওলা ব্রাদার্স / পৃ. ১৪
৭- ভাষা আন্দোলন - সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোসতফা কামাল / বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. / পৃ. ৫৫
৮- ভাষা আন্দোলন ও ভারতীয় ষড়যন্ত্র / ফিরোজ মাহবুব কামাল / ৪ জানুয়ারী ২০২১ / https://bit.ly/2OMzjSp
৯- ভাষা আন্দোলন - সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোসতফা কামাল / বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. / পৃ. ৫৬
১০- ভাষা আন্দোলন - সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোসতফা কামাল / বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. / পৃ. ৫৮
১১- Bhasha Andolon (1947 - 1952) / http://www.londoni.co// https://bit.ly/2ZwM8m0 / অ্যাকসেস ইন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
১২- রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে জিন্নাহর বক্তব্য (১৯৪৮) / https://bit.ly/3u8bDIB
১৩- ভাষা আন্দোলন - সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোসতফা কামাল / বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. / পৃ. ১৫০
১৪- ভাষা আন্দোলন / বাংলাপিডিয়া / https://bit.ly/3bn79Fq / অ্যাকসেস ইন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
১৫- ১৪৪ ধারা ভঙ্গ / জাহীদ রেজা নূর / প্রথম আলো / ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১৬- পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি / ৩য় খন্ড / বদরুদ্দীন উমর / সূবর্ণ প্রকাশন / পৃ. ২৩৩
১৭- The All-Pakistan Legal Decisions. 1949. p. 6.
১৮- আহমদ, রফিক উদ্দিন / বাংলাপিডিয়া
১৯- জববার, আবদুল / বাংলাপিডিয়া
২০- ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোস্তফা কামাল/ পৃ.-৮১
২১- সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম/ https://arts.bdnews24.com/archives/2092
২২. রহমান, শফিউর / বাংলাপিডিয়া
২৩- আওয়ামীলীগ উথানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০ / মহিউদ্দিন আহমদ / প্রথমা প্রকাশন / পৃ. ৬১


৪ ফেব, ২০২৩

ওয়ালি-মুকাদ্দাস গুমের আদ্যপান্ত

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১.০০টায় ঢাকা জেলার সাভার থানার নবীনগর এলাকা থেকে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৪ (র‌্যাব) ও ডিবি পুলিশ (গোয়েন্দা শাখা) সদস্য পরিচয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকাহ্ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আল মুকাদ্দাস (২২) এবং দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মার্স্টাস পরীক্ষার্থী মোঃ ওয়ালিউল্লাহকে (২৩) ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁদের গুম হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আজ ১১ বছর তাদের কোনো খবর নেই। 


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারকে গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের তালিকা দেয়। ওই তালিকায় ওয়ালী উল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের নাম আছে। এই দুইজন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। 


এর প্রেক্ষিতে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি আকরাম হোসেন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করেন। আবেদনটি ১৩ই ও ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ শুনানি শেষে আদালত তা আমলে নেন। রিট পিটিশন নম্বর ১৫৩৫/২০১২।


গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ আদালত তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি, ডিসি ডিবিসহ মোট নয়জনকে কেন আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে তিন সপ্তাহের ভিতরে আদালতে হাজির করা হবে না, এই মর্মে জবাব দিতে বলে।


হেবিয়াস কর্পাস আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ আদালত তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি, ডিসি ডিবিসহ মোট নয়জনকে এ রুলের জবাব দিতে বলে। তিন সপ্তাহ পর উল্লেখিত নয়জনই আদালতে জানান, নিখোঁজদের ব্যাপারে তাঁরা কোন সন্ধান পাননি। আদালত তাঁদের জবাবে সন্তুষ্ট নয় বলে অধিকতর তদন্ত করতে আরো ৭দিন সময় বাড়িয়ে দেন। ৭দিন পর তাঁরা নয়জন আবার আদালতে হাজির হয়ে এই বিষয়ে তাঁদের অপারগতা প্রকাশ করেন। আদালত আবারও ৭দিনের সময় দিয়ে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের মোবাইল ফোনের কললিস্ট আদালতে হাজির করতে বলেন। ৭দিন পর তারা নয়জন হাতে লিখে কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর আদালতে উত্থাপন করলে বিজ্ঞ আদালত অরিজিনাল কললিস্ট নিয়ে ১৪/৪/২০১২ তারিখে হাজির হতে বলেন। ১৪/৪/২০১২ তাঁরা নয়জন অরিজিনাল কললিস্ট আদালতে জমা দিতে ব্যর্থ হন। এরপর আদালত আবার ১৮/৪/২০১২ তারিখে অরিজিনাল কললিস্টসহ তাঁদের নয় জনকে হাজির হতে বলেন। কিন্তু ১৮/৪/২০১২ তারিখে হরতাল থাকায় সেদিন আর শুনানী হয়নি। এরপর আদালত আর কোনো আদেশ দেয়নি। 


পিরোজপুর জেলার খানা কুনিয়ারী গ্রামের আব্দুল হালিম ও আয়েশা সিদ্দিকার ছেলে আল মুকাদ্দাস এবং ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া থানার পশ্চিম শৈল জালিয়া গ্রামের মোঃ ফজলুর রহমান ও আফিফা রহমানের ছেলে মোঃ ওয়ালিউল্লাহ। আল মুকাদ্দাস এবং মোঃ ওয়ালিউল্লাহ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তাঁরা একে অপরের বন্ধু ছিলেন। এছাড়া দুইজনই 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল' এর ২১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন।


গুম হওয়া আল মুকাদ্দাসের চাচা মুহাম্মদ আব্দুল হাই (৪১) জানান, তিনি ঢাকার মালিবাগের ৮/২ শান্তিবাগ এলাকায় থাকেন। ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১২ তাঁর সঙ্গে আল মুকাদ্দাসের মোবাইল ফোনে কথা হয়। আল মুকাদ্দাস ইসলামী বিশ্ববিদ্যাল ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় আসে। আল মুকাদ্দাস তাঁকে জানায়, একটি দেশাত্ববোধক গানের অ্যালবাম বের করার জন্য ঢাকায় দুইদিন থাকতে হবে। আল মুকাদ্দাস বাংলামোটরে জাফর নামে এক বন্ধুর বাসায় থেকে একটি স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতে থাকে। এছাড়া ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০১২ আল মুকাদ্দাসের আরেক বন্ধু মোঃ ওয়ালিউল্লাহ প্রিন্টিং প্রেসের কাজের জন্য ঢাকায় আসে এবং একই সঙ্গে তারা অবস্থান করে।


৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১২ আল মুকাদ্দাস তাঁর সঙ্গে ঢাকার পল্টন এলাকায় দেখা করে জানায় যে, গানের রেকডিং হয়েছে, পরে এডিট করে বাজারে ছাড়া হবে। আল মুকাদ্দাস এবং মোঃ ওয়ালিউল্লাহ রাতে ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে বলে তাঁকে জানায়।


৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ বিকাল আনুমানিক ৩.০০টায় আল মুকাদ্দাসের ছোট বোন তাঁকে মোবাইল ফোনে জানায়, আল মুকাদ্দাসের মোবাইল বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা বাড়ীতে কোথাও তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি তখন পল্টন থানায় যান এবং আল মুকাদ্দাস নিখোঁজ হয়েছে বলে একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন। তিনি আল মুকাদ্দাসের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। বাংলামোটর থেকে আল মুকাদ্দাসের বন্ধু জাফর তাঁকে মোবাইল ফোনে জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য রাতে আল মুকাদ্দাস ও মোঃ ওয়ালিউল্লাহকে সে কল্যাণপুরগামী বাসে তুলে দিয়েছে। আল মুকাদ্দাসের আরেক বন্ধু সাইয়েদ আহমেদ তাঁকে জানায়, আল মুকাদ্দাস এবং মোঃ ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে রাত ১০.৩২টায় মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। তখন আল মুকাদ্দাস সাইয়েদকে বলেছিল যে, তারা কল্যানপুর বাস কাউন্টার থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ পরিবহনে রাত ১১.৩০টায় ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আব্দুল হাই আরো বলেন, সাইয়েদ এর কাছ থেকে এ খবর পেয়ে তিনি ঢাকা মহানগরীর দারুস সালাম থানায় যান এবং সেখানে গিয়ে মোঃ ওয়ালিউল্লাহর ভাই মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহকে দেখতে পান। থানায় বসে আলোচনা করে খালিদ সাইফুল্লাহ দুইজনের নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন।


৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ তিনি খালিদ সাইফুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হানিফ এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারে যান এবং সুপারভাইজার মোঃ সুমন মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সুপারভাইজার সুমন মিয়া তাঁকে জানান, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাত আনুমানিক ১১.৩০টায় হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়ি নম্বর ৩৭৫০ কল্যাণপুর থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়িটি সাভারের নবীনগর এলাকায় পৌছালে রাত আনুমানিক ১২.৩০ টা থেকে ১.০০টার মধ্যে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে ৭/৮ জন লোক সেই গাড়ির কাছে আসে। কয়েকজন লোকের পরনে ছিল ডিবি পুলিশের জ্যাকেট। বাকীরা র‌্যাবের পোশাক পরা ছিল। ডিবি সদস্যরা গাড়ির ভেতরে ওঠে এবং সি-১ ও সি-২ সিটের যাত্রী মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসকে জোর করে নামিয়ে নিয়ে যায়। সুমন মিয়া ডিবি পুলিশ সদস্যদের কাছে জানতে চান, তাঁর যাত্রীদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এক ডিবি সদস্য তাঁকে বলেন, দুইজনের নামে অভিযোগ আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। এই কথা বলে দুইজনকে সেই সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়।


মুহাম্মদ আব্দুল হাই সুপারভাইজার সুমনের কাছে এ খবর শুনে আশুলিয়া থানায় যান এবং একটি জিডি করেন। যার নম্বর ৫২৫; তারিখ ৮/২/২০১২। পরে তিনি খালিদ সাইফুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর পাইকপাড়ায় র‌্যাব-৪ এর কার্যালয়ে যান। সেখানে কর্মরত একজন র‌্যাব কর্মকর্তা তাঁদের নবীনগর র‌্যাব ক্যাম্পে যেতে বলেন। তিনি নবীনগর র‌্যাব ক্যাম্পে গেলে মিজান নামে এক র‌্যাব কর্মকর্তা তাঁকে জানান, ঐ ক্যাম্পের সদস্যরা সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করেননি।


অবশেষে ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।


ওয়ালিউল্লাহার ভাই মোহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ (৩২) জানান, তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে থাকেন। ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০১২ মোঃ ওয়ালিউল্লাহ মোবাইল ফোনে তাঁকে বলেন, সে কুষ্টিয়া থেকে প্রয়োজনীয় কাজে ঢাকায় এসেছে এবং এক বন্ধু আল মুকাদ্দাসের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাস এক সঙ্গে বাংলামোটরে তাঁদের আরেক বন্ধু জাফরের বাসায় থাকবে এবং কাজ শেষে কুষ্টিয়া ফিরে যাবে। ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ বিকাল আনুমানিক ৩.০০টায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোঃ ওয়ালিউল্লাহর এক সহপাঠী তাঁকে জানান, মোঃ ওয়ালিউল্লাহর মোবাইল নম্বর বন্ধ এবং ঢাকা থেকে সে ক্যাম্পাসে তখনও ফেরেনি। তিনি তখন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর করেন এবং জাফরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন।


জাফর তাঁকেও জানায় যে, মোঃ ওয়ালিউল্লাহ এবং আল মুকাদ্দাসকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্য বাসে তুলে দেয়। মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ তখন দারুস সালাম থানায় যান। তিনি সেখানে আল মুকাদ্দাসের চাচা আব্দুল হাই এর দেখা পান। তিনি একটি জিডি করেন।


পরে তিনি আব্দুল হাইকে সঙ্গে নিয়ে আশুলিয়া থানায় যান এবং একটি জিডি করেন।


গুম হওয়া আল মুকাদ্দাসের বন্ধু সাইয়েদ আহমেদ (২৩) জানান, তিনি ঢাকায় সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়াশুনা করেন। আল মুকাদ্দাস তাঁর এলাকার ছেলে এবং পরিচিত। আল মুকাদ্দাস একটি গানের এ্যালবাম বের করার জন্য এবং মোঃ ওয়ালিউল্লাহ প্রিন্টিংয়ের কাজ করতে ঢাকায় এসেছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে আল মুকাদ্দাস এর গান রেকর্ডিংয়ের সময় তিনি একটি স্টুডিওতে একই সঙ্গে ছিলেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তাঁরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার জন্য সেখান থেকে বেরিয়ে যান। রাত ১০.৩২ মিনিটে আল মুকাদ্দাসের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। আল মুকাদ্দাস তাঁকে জানান যে, তাঁরা কল্যাণপুর থেকে রাত ১১.৩০টার গাড়িতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রওনা দিবেন। এরপর তাঁর সঙ্গে আর কোন কথা হয়নি।


হানিফ এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের সুপারভাইজার সুমন মিয়া (৩২) জানান, গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাত আনুমানিক ১১.৩০টায় ৩৭৫০ নম্বর গাড়িতে তিনি ডিউটি করছিলেন। তাঁদের গাড়ি কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাত আনুমানিক ১২.৩০ থেকে ১.০০টার মধ্যে ঢাকা জেলার সাভার থানার নবীনগর এলাকায় পৌঁছায়। রাস্তায় জ্যাম থাকায় গাড়ি থেমেছিল। এমন সময় একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে গাড়ির বামপাশে থামে এবং মাইক্রোবাস থেকে ৭/৮জন লোক নামে। কয়েকজনের পরনে ছিল ডিবি পুলিশের জ্যাকেট এবং বাকি লোকদের পরনে ছিল র‌্যাবের পোশাক। তারা র‌্যাব-৪ ও ডিবি পুলিশের সদস্য বলে পরিচয় দেয়। তল্লাশির নামে তারা কয়েকজন গাড়ির ভেতরে ওঠে এবং একজন লোক সি-১ ও সি-২ সিটের যাত্রী মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসকে তাদের সঙ্গে নেমে যেতে বলে। তিনি তখন র‌্যাব ও ডিবি সদস্যদের বলেন, এঁরা তাঁর যাত্রী। এঁদের কোথায় নেয়া হবে? এমন সময় ডিবির এক সদস্য তাঁকে জানায়, মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের নামে অভিযোগ আছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। তারা যাত্রী ২ জনকে নিয়ে সেই সাদা মাইক্রোবাসে তোলে এবং তাঁকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে। তিনি তখন গাড়ি নিয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে চলে যান।


আশুলিয়া থানার সাব ইন্সপেক্টর খায়রুল আলম জানান, ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের আত্মীয়স্বজনরা থানায় আসেন এবং দুইজনকে র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে বলে একটি জিডি করেন। তিনি জানান, জিডির ভিত্তিতে প্রথমে তদন্ত করেন এসআই তৌহিদুল ইসলাম। এসআই তৌহিদুল ইসলাম হঠাৎ বদলি হওয়ায় জিডির তদন্ত কাজ চালান এসআই খায়রুল ইসলাম। এসআই খায়রুল ইসলামও পরে বদলি হওয়ার কারণে জিডি তদন্তের দায়িত্ব পান এসআই জাকারিয়া।


পরে এসআই জাকারিয়া নিজেই বাদী হয়ে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর-৬১; তারিখঃ ২৩/০২/২০১২। ধারা-৩৬৪/১৭১/৩৪ দ-বিধি। এছাড়া বাদী নিজেই মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তদন্ত চালিয়ে যান।


দারুস সালাম থানার এসআই সারোয়ার আলম জানান, ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ নিখোঁজ মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের পরিবারের সদস্যরা রাত ১০.৪৫টায় থানায় আসেন এবং ঐ দুইজনের শারীরিক গঠন, গায়ের রঙের বর্ণনা সম্বলিত নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে একটি জিডি করেন। যার নম্বর ৩১৭; তারিখঃ ৬/০২/২০১২। তিনি নিজেই জিডিটি তদন্ত করছেন।


ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ ওহিদুজ্জামান জানান, ডিবি পুলিশ সদস্যরা ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে নবীনগর এলাকা থেকে মোঃ ওয়ালিউল্লাহ এবং আল মুকাদ্দাস নামে কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।


র‌্যাব-৪ এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ্ ইবনে জায়েদ জানান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে হেবিয়াস কর্পাস দরখাস্ত দাখিল করার পরে আদালত র‌্যাব এবং পুলিশসহ নয়জনকে জবাব দিতে রুল জারি করেছেন। র‍্যাব সদর দপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা আদালতকে দিয়েছে।  


আজ ৪ ফেব্রুয়ারি। ১১ বছর হয়ে গেলেও এই গুমের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ওয়ালিউল্লাহ ও মুকাদ্দাসের স্বজনরা এখনো অপেক্ষা করছে। কবে ফিরবে তারা? আদৌ কী তারা ফিরবে?  

২ ফেব, ২০২৩

শিক্ষা সন্ত্রাস ও জামায়াতে ইসলামী

শিক্ষা সন্ত্রাসের মূল প্রস্তাবক লর্ড মেকলে

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান হয় ও ইংরেজদের বর্বর শাসন শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করেই ইংরেজরা দীর্ঘ ৫৫০ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বাংলার দুইটি বিষয়ের ব্যাপারে তারা খুবই কনসার্ন ছিল। এক বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা, দুই বাংলার শিল্প। 

তারা ক্ষমতা দখল করেই এই দুটি সেগমেন্ট তারা বন্ধ করে দেয়। সকল শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টেক্সটাইল, জাহাজ শিল্প ও যুদ্ধাস্ত্র। শুধু শিল্প কারখানা বন্ধ নয়, শিল্প কারখানা যাতে আর কোনোদিন গড়ে না ওঠে এজন্য সকল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। বস্ত্র শিল্প ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য হুমকি। এদেশের ভালো কাপড়ের বিপরীতে ব্রিটিশদের নিন্মমানের কাপড় চালানোর জন্য তারা বস্ত্রশিল্পকে একেবারে নির্মূল করে দিয়েছে। 

যারা তাঁতের ইঞ্জিনিয়ার/ কারিগর ছিল তাদের প্রতি হুমকি ছিল তারা যাতে মেশিন তৈরি না করে। আর যারা লুকিয়ে মেশিন তৈরি ও এর আপগ্রেডেশনের সাথে যুক্ত ছিল তাদের হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে বাংলার সকল শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের পণ্য এদেশে চালু হতে শুরু করে। বাংলার ইতিহাস থেকে শিল্প কারখানা ও শিল্প গবেষণা হারিয়ে গেছে। আর অন্যদিকে ইউরোপে শিল্প গবেষণা এগিয়ে যায়। আমাদের এখানে লুটপাট ও মনোপলি বিজনেস করে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়।    

এদেশের মানুষ যাতে পিছিয়ে থাকে ও সভ্যতার বিকাশ না ঘটে সেজন্যে ব্রিটিশরা এখানের সকল উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কোনো জাতির মধ্যে শিক্ষা না থাকলে প্রথমত তারা সভ্যতার বিকাশে অংশ নিতে না পারায় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ভুলে অন্য জাতির গোলামীর পথ ধরে। বাংলায় এই ব্যাপারটাই হয়েছে। 

যতদূর জানা যায় এই বাংলায় সভ্যতার বিকাশ হয়েছে দ্রাবিঢ় জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। তারা ছিল নূহ আ.-এর সরাসরি বংশধর ও একেশ্বরবাদী। সেসময় গোত্রভিত্তিক মানুষ বসবাস করতো। প্রতিটা গোত্রে কয়েকজন পণ্ডিত মানুষ থাকতেন। তাদের বাড়িই ছিল জ্ঞানর্জনের কেন্দ্র। প্রাথমিক লেখাপড়া সবাই করতো। এর মধ্যে যারা সক্ষম ছিল তারাই জ্ঞানের ধারাকে এগিয়ে নিতেন। জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা সীমিত ছিল বিধায় একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি সকল বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। যেমন কৃষি, শিল্প, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান সব বিষয়েই তারা পারদর্শী ছিলেন। 

এরপর ইরান থেকে বহুঈশ্বরবাদী আর্যরা এসেছে এখানে ও উপমহাদেশের উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে দখলে নেয়। বাংলার দ্রাবিঢ়রা দীর্ঘদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখলেও এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা পরাজিত হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারের শিকার হয় এখানকার জ্ঞানী সমাজ ও পন্ডিত ব্যাক্তিরা। ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতায় জ্ঞানর্জন শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আর কিছু প্রাথমিক জ্ঞান ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরা পেত। শুদ্র ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের জন্য জ্ঞানর্জন নিষিদ্ধ ছিল। 

একেশ্বরবাদী বুদ্ধের আগমনের পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হন। বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ধারা শুরু হয় বিহার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গুপ্ত আমলে আর্যরা বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করে। বিহারগুলো ধ্বংস করে। আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই অঞ্চলের শিক্ষা। 

বৌদ্ধরা আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ওপর বিজয়ী হয়। পাল আমলে আবারো বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা চালু হয়।  পাল আমলে মুসলিমরা সারা বিশ্বে মাদরাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সে সময়ে সভ্যতায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাগদাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলায়ও মুসলিমরা আসতে শুরু করেছে ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গেছে। বহুঈশ্বরবাদীদের মধ্যে যারা নিন্ম বর্ণের ছিল তারা ও বৌদ্ধরা দ্রুতগতিতে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। মুসলিমরা পাড়াভিত্তিক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে। এই নিয়ে হিন্দু/ আর্য জমিদারদের সাথে প্রায়ই বিবাদে লিপ্ত হতে হতো। বিহার বা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষাও হতো। ফলে দেখা যায় উচ্চশিক্ষার জন্য সকল ধর্মের (হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম) লোকেরা বৌদ্ধবিহারে যেতেন। 

এরপর আসে সেন আমল অর্থাৎ আর্য হিন্দুদের আমল। এবার তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার প্রতিষ্ঠান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তবে সেগুলো ছিল উচ্চ বর্ণের মানুষদের জন্য। বিহারগুলোর সাথে অসহযোগিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধ করে দিত। বেশিরভাগ সমস্যা হতো মুসলিমদের মাদরাসার সাথে। বাংলার বৌদ্ধরা ও মুসলিমরা বর্বর সেনদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দিল্লির সুলতান, সিন্ধের মুসলিম শাসকদের কাছে প্রায়ই আবেদন করতেন। 

কিন্তু বাংলায় রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা ও স্থল যোগাযোগের সুবিধা বেশি না থাকায় মুসলিমরা শাসকরা বাংলা কন্ট্রোলে আনতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে ১২০৫ সালে আমাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আসেন আফগানিস্তানের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। তাঁর হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর ধরে চলে মুসলিম শাসন। বাংলার শাসন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সভ্যতার উৎকর্ষ, বস্ত্র ও জাহাজ শিল্পের উন্মেষ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবই হয় ৫৫০ বছরে। অনেক পর্যটক এই বাংলাকে পৃথিবীর জান্নাতের সাথে তুলনা করেছেন। এখানের প্রাচুর্য ও এখানের মাটিতে সারাবছর কৃষি কাজ করা যায় বিধায় এখানের মানুষ অভাবে পড়তেন না। যারা এখানে ব্যবসা ও ধর্মপ্রচারে এসেছেন তাদের সিংহভাগ এত সুন্দর পরিবেশ দেখে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। আমার পূর্বপুরুষরাও এভাবে এই অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে যান। 

বাংলায় সুলতানী আমলে শিল্পের বিপ্লবের মূলে ছিল এখানের বড় বড় মাদরাসাগুলো। বাংলার মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই পাড়া ও মহল্লাভিত্তিক মাদরাসা, মসজিদভিত্তিক মক্তব চালু হয়ে যায়। মুসলিম সন্তানদের পাশাপাশি সকল ধর্মের মানুষ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিতেন। তখন সেক্যুলার শিক্ষা ছিল না। মাদরাসাগুলোতেই ইতিহাস, রাজনীতি, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কবিতা, ভাষাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান সবই পড়ানো হতো। পাশাপাশি ফিকহ, হাদীস, তাফসীরও পড়ানো হতো। 

বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা। 

সাড়ে পাঁচশত বছরে বাংলায় হাজার হাজার মাধ্যমিক মাদরাসা ও শ'খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা। 

১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। 

১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়। 

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল –

(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে ‘দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা’ বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning”)।
(৩) তাঁর মতে, “ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।
(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ‘ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা “রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”

মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।

নানা ঘটনা ও উপ-ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকেরা পূর্বের মিথ্যা ও ফাঁকা বুলি সর্বস্ব শিক্ষানীতিকে পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয় নি। পাকিস্তান আমলে পূর্বের পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে কিছু ধর্মীয় শিক্ষা যুক্ত হয়েছে ও ইতিহাসে মুসলিম শাসনকে পুনরায় আলোকজ্জল হিসেবে দেখানো ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব কাটানো যায় নি। ইংরেজি সভ্যতা, তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও তাদের আইন দিয়ে বিচার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হয়। এটিও হয়েছে পাশ্চত্য শিক্ষানীতির জন্য।

১৯৭১ সালে আমরা পুনরায় স্বাধীন হই। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৭ টি শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে। প্রথমটি ছিল শেখ মুজিবের সময়কালে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন। এই কমিশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক গলদ ঢুকিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদ প্রবেশ করানো হয়। এরপরে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে তার কোনোটাই পাশ্চাত্য ও সেক্যুলার শিক্ষানীতি থেকে বের হতে পারেনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে এই হিন্দুত্ববাদ কিছুটা দূর হলেও ২০০৯ সালে কবির চৌধুরীর শিক্ষানীতি পুনরায় হিন্দুত্ববাদ ঢুকিয়ে মুসলিম পরিচয়কে মুছে দিতে চাইছে।  

এদেশের মুসলিমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেও এখন পর্যন্ত ১৭৫৭ সালের পরাজয়ের গ্লানি টেনে বেড়াচ্ছে। দেশের সীমারেখা পরিবর্তন হয়েছে, উপনিবেশিক ও অত্যাচারী এদেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশী ও মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্র শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হইনি। ইংরেজদের পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির সাথে হিন্দুত্ববাদ যুক্ত করে এক আত্মঘাতী জগাখিচুড়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বাংলাদেশে। 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান আমল থেকেই সেক্যুলার শিক্ষা বাদ দিয়ে বাংলার স্বর্ণযুগ মুসলিম শাসনামলের মতো জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে সমন্বিত শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের চেষ্টা চালান। শিক্ষা কীরূপ হবে এই নিয়ে ঢাবিতে একটি বিতর্কসভার আয়োজন করা হয়। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আব্দুল মালেক ইসলামের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য বলিষ্ঠভাবে বক্তব্য রাখেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে সেক্যুলার শিক্ষার পক্ষে থাকা লোকদের বক্তব্যগুলো অসার ও অবৈজ্ঞানিক প্রমাণিত হয়। এই বক্তব্য দেয়ার অপরাধে ঢাবির প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্র আব্দুল মালেককে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ঢাবি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।

আমরা এখনো সেই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় থাকায় আমাদের জাতি গঠনে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের সন্তানেরা ইউরোপে যাওয়াটাকেই সফলতা জ্ঞান করে। একটা গোলামী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পড়ালেখার উদ্দেশ্য হয়েছে চাকুরি করা ও যেকোনো ভাবে টাকা উপার্জন। গবেষণা উঠেই গেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে পশ্চাতপদ মনে করে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। শিক্ষিতদের অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেক্যুলার শিক্ষা আমাদের ভালো মানুষ হতে শেখায় না। যা আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ডকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে টু দ্য পয়েন্ট প্রস্তাবনা সব শিক্ষা কমিশনকেই দিয়েছে। এই নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও একটি প্যারালাল একটি শিক্ষা বোর্ড চালু করেছে জামায়াত। শুধু তাই নয়, জামায়াতের শিক্ষা বোর্ড প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের আলোকে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে। এসব সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তককে ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য জেলাভিত্তিক স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কুল ও মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের সমন্বয় করছে। আলোকিত মানুষ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় উদ্যোগটি এখনো পাইলট প্রকল্প হিসেবেই চালু আছে। এর মধ্যে আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো গত এক দশকে এই সকল স্কুলের প্রায় সবই সরকার দখল করে নেয়।