২৯ এপ্রি, ২০২৩

জামায়াত ছিল এই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রহরী

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় জামায়াত।


সেসময় এই ব্যাপার নিয়ে বাম পাড়া ও মিডিয়া পাড়ায় জামায়াতের ব্যাপক সমালোচনা হয়। তারা বলতে চেয়েছে বহু রাষ্ট্র শুধুমাত্র ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বিপুল অর্থ আয় করেছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহার করতে দিলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে।


জামায়াত যেসব পয়েন্টে এই ট্রান্সশিপমেন্টের বিরোধীতা করেছে তা হলো,


১। ভারত তাদের বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ বাফার স্টেটে পরিণত হবে। ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবে।


২। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ভারতকে সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমনিতেই জাহাজ খালাস করতে ৬ দিনের জট থাকে। ভারতের মালামালের অতিরিক্ত চাপ দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। বিশেষ করে পোষাক খাতে আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়বো।


৩। ভারতীয় মাদকের বিস্তার ও চোরাচালানের অবাধ সুযোগ তৈরি হবে।


৪। বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ভারতের প্রশ্রয়ে আবারো চাঙ্গা হবে।


৫। বন্দরের নিরাপত্তার নামে ভারত বন্দর ও আমাদের নিয়ন্ত্রিত সমুদ্র তাদের দখলে রাখবে।


জামায়াত সবগুলো বিভাগীয় শহরে বিশাল সমাবেশ করে। মানুষকে সচেতন করে। অনেকক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক নেতাদের বুঝাতে সক্ষম হয়। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর যাতে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ না দেওয়া হয় এজন্য চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনকে রাজি করায়। মহিউদ্দিন ২০১০ সালে এই বিষয়ে কথা বলে।


কিন্তু জামায়াতের কথায় তো আর আওয়ামীলীগ বসে থাকবে না। থাকেও নি। ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের অধীনে ২০১০ সালে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পণ্যের কাস্টমস ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১০’ শীর্ষক ওই বিধিমালায় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।


বিধিমালায় বলা হয়, সড়ক বা রেলপথে প্রতি টিইইউ কনটেইনারের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি প্রযোজ্য হবে। সড়কপথে কাভার্ড ভ্যান বা কাভার্ড ট্রাকে পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে ১ হাজার টাকা। আর নন-কনটেইনার জাহাজ বা রেলপথে পরিবহনের জন্য প্রতি টন বাল্ক পণ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে ১ হাজার টাকা। এছাড়া ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট পণ্যের জন্য বিমা কাভারেজ বাধ্যতামূলক বলা হয়। আর কনটেইনার স্ক্যানিং চার্জ শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত হবে।


কিন্তু ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মামা বাড়ির আবদার করে। তারা কোনো ট্রান্সশিপমেন্ট ফি রাজি নেই। বাংলাদেশের জাহাজ যেভাবে শুল্ক আদায় করে তারা সেভাবেই ট্যাক্স দেবে বলে জানায়। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে যায়।


শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনা করে ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা পিছিয়েছে বিষয়টা এমন নয়, বরং সে এই ব্যাপারটাকে পূঁজি করে রাখে যাতে বেকায়দা অবস্থা থেকে সে মুক্তি পেতে পারে।


২০১৬ সালে পিআইডব্লিউটিটির আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার শুরু করে ভারত। এতে বন্দর থেকে আখাউড়া দিয়ে ভারতে যায় পণ্যবাহী ট্রাক। সে বছর প্রতি টনে মাত্র ১৩০ টাকা মাশুল নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতি টনে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ১০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা ও সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কনটেইনারে (২৫ টন) ট্রান্সশিপমেন্ট ফি পড়বে ৫০০ টাকা। আর চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নির্ধারিত মাশুলেও প্রতি কনটেইনারের ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৫০০ টাকা। ২০১০ সালের নির্ধারিত ফি থেকে কমিয়ে প্রায় বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়।


সম্প্রতি ২০২৩ সালে ২৪ এপ্রিল দেওয়া রাজস্ব বোর্ডের নতুন আদেশ অনুযায়ী, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি মেট্রিক টনের জন্য ২০ টাকা, অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ১০০০ টাকা। এছাড়া ডকুমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ ফি প্রতি চালানোর জন্য ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট চার্জ প্রতি কন্টেইনার বা ট্রাক ৮৫ টাকা, বিবিধ প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা। যাও একেবারেই নামমাত্র।


২৫ টন করে পণ্য বহনকারী ২০ ফুটের (টিইইউ) প্রতিটি কনটেইনারের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা হারে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হবে ভারতকে। যদিও ২০১০ সালে এ হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১০-এর নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ ধার্য হয়েছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নামমাত্র মূল্যে বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের আয় তো হবেই না বরং এই ট্রানজিট সুবিধা দিতে গিতে যে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা করতে হবে তার খরচও উঠবে না।


হাসিনা ভারতের মামাবাড়ির আবদার এতদিন কেয়ার করে নি। এখন এসে আবদার মেনে নিচ্ছে কারণ আমেরিকা তার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হাসিনা ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। আর এই জন্যই ভারতকে বিনামূল্যে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে।


এদিকে ভারত স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও ট্রানজিট সুবিধা পেলেও বাংলাদেশের দাবির বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ভারতকে স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও শত শত কিলোমিটার ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছে ৮ টি রুটে। পক্ষান্তরে মাত্র একটি রুটে ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ভারত স্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দেয় না। তাদের ইচ্ছেনুযায়ী ও অল্প কিছু নির্দিষ্ট পণ্যে শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়।


২০১০ সালের মার খাওয়ার আগের জামায়াত আর ২০২৩ সালের মার খাওয়ার পরের জামায়াত এক নয়। তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ভারতের এই আগ্রাসী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার মতো, জনমত গঠন করার মতো কেউ অবশিষ্ট রইলো না। উল্লেখ্য ২০০৯ সালে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে জামায়াতের দূর্বার আন্দোলন ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে এই বাঁধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিল।


আজকে যদি জামায়াত নেতারা সক্রিয় থাকতেন তবে ভারত বিনামূল্যে আমাদের বন্দর নিয়ে যেতে পারতো না। আফসোস! ছবিতে থাকা সামনের সারির প্রত্যেকে হয় কবরে নয়তো কারাগারে!


৮ এপ্রি, ২০২৩

খিলাফত পর্ব-৪৭ : আলী রা.-এর শাসনামলে খারেজি সমস্যা

 


আলী রা. ব্যাপক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। উটের যুদ্ধ ও সিফফিনের যুদ্ধের পর আরেকটি বড় পরীক্ষা ছিল 'খারেজি সমস্যা'। সিফফীনের ঘটনার পরে হযরত আলী সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করে কুফায় চলে আসেন। তিনি যখন কুফায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর বাহিনীর একটি অংশ পৃথক হয়ে যায়। কারও মতে তাদের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার, কারও মতে বার হাজার। কারও মতে বার হাজারের কম। এরা হযরত আলীর পক্ষ ত্যাগ করে পৃথক হয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ এনে তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

আলী রা. কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোনায় ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না’ স্লোগানে তারা মসজিদ প্রকম্পিত করে তুলে। তারা আলী রা.-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে, আপনি বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! অথচ বিচারের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। আপনি সূরা আন‘আমের ৫৭নং আয়াত (ان الحكم الا لله) ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো ফায়সালা গ্রহণযোগ্য নয়’-এর হুকুম ভঙ্গ করেছেন। আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্য আপনি মুশরিক হয়ে গেছেন ইত্যাদি। তাদের মতে আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আসসহ সালিশ সমর্থনকারী সকল সাহাবী কুফরী করেছেন এবং কাফের হয়ে গেছেন। অথচ সত্য হ’ল, মানুষের বিচারের জন্য মানুষকেই বিচারক হতে হবে। আর বিচার হবে আল্লাহর আইন অনুসারে।

আলী রা. তাদের কাছে গেলে তারা তাঁকে তিরস্কার করে বলতে থাকে মহান আল্লাহ্ আপনাকে যে জামা পরিধান করিয়েছিলেন, আপনি সে জামা খুলে ফেলেছেন। যে উপাধিতে মহান আল্লাহ্ আপনাকে ভূষিত করেছিলেন আপনি সে উপাধি প্রত্যাহার করেছেন। এরপর আপনি আরও অগ্রসর হয়ে মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে সালিস নিযুক্ত করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারও ফয়সালা করার অধিকার নেই।

আমীরুল মু'মিনীন আলী রা. পবিত্র কুরআনের একটি কপি এনে সবার সম্মুখে রাখলেন। এরপর তিনি হাতের আংগুল দ্বারা পবিত্র কুরআনের ওপর টোকা মেরে বললেন, ওহে কুরআন! তুমি লোকদেরকে তোমার কথা জানাও। উপস্থিত লোকজন আলীকে বললো, হে আমীরুল মু'মিনীন! আপনি পবিত্র কুরআনের কপির কাছে এ কি জিজ্ঞেস করছেন? ও তো কাগজ আর কালি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা তো ওর মধ্যে যা দেখি তা নিয়ে কথা বলছি। তা হলে এরূপ করায় আপনার উদ্দেশ্য কি?

তিনি জবাবে বললেন, তোমাদের ঐসব সাথী যারা আমার থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান নিয়েছে, তাদের ও আমার মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে একজন পুরুষ ও একজন নারীর ব্যাপারে বলেছেন,
তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিস নিযুক্ত করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন (নিসা : ৩৫)।

সে ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ-এর সমস্ত উম্মতের রক্ত ও সম্মান একজন নারী ও একজন পুরুষের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো আমি তো রক্তপাত বন্ধ করে সালিশি পন্থায় অগ্রসর হয়েছি।

তারা আমার উপর আরও অভিযোগ এনেছে যে, আমি মু'আবিয়াকে যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছি, তাতে লিখেছি আলী ইবনে আবূ তালিব। আমিরুল মুমিনিন লিখি নি। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহাইল ইব্‌ন আমর যখন নিজ কওমের সাথে সন্ধিপত্র লেখেন, তখন আমরা তথায় উপস্থিত প্রথমে লেখলেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

সুহাইল আপত্তি জানিয়ে বললো, আমি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিখতে রাজি নই। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তা হলে কীভাবে লিখবো? সুহাইল বললো, লিখবো বিছমিকা আল্লাহুম্মা। রাসূলুল্লাহ্ বললেন, তাই লিখ। সুহাইল সেভাবেই লিখল। রাসূলুল্লাহ্ বললেন, এখন লিখ- 'এই সন্ধিপত্র, যা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সম্পাদন করলেন। সুহাইল বলল, আমি যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তা হলে তো আপনার সাথে আমার কোন বিরোধই থাকতো না । অবশেষে লেখা হলো, এই সন্ধিপত্র যা আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ কুরাইশদের সাথে সম্পাদন করলেন।

মহান আল্লাহ্ বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতকে ভয় করে তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ -এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ (আহযাব : ২১)। আমি তো রাসূল সা.এর পন্থাই অনুসুরণ করেছি।

এরপর হযরত আলী তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আব্বাসকে প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আব্বাস তিনদিন পর্যন্ত সেখানে তাদের সাথে আলোচনা ও মত বিনিময় করেন। অবশেষে তাদের মধ্য থেকে চার হাজার লোক তওবা করে ফিরে আসে। ইব্‌ন আব্বাস এদেরকে হযরত আলী রা.-এর কাছে কুফায় নিয়ে আসেন। অবশিষ্ট লোকদের কাছে হযরত আলী বার্তা পাঠিয়ে জানান যে, তোমরা আমাদের ও অন্যদের কর্মনীতি দেখেছ। কাজেই তোমরা যেথায় ইচ্ছা অবস্থান কর। উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হোক। আর তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত থাকলো যে, তোমরা অন্যায়ভাবে কারও রক্তপাত ঘটাবে না। ডাকাতি, রাহাজানি করবে না এবং যিম্মীদের উপর অত্যাচার চালাবে না । যদি এর কোনটিতে লিপ্ত হয়ে পড়ো তবে তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো। আল্লাহ্ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদেরকে পছন্দ করেন না (আনফাল : ৫৮)।

খারেজীরা নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতাকে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে রূপ দান করে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। আলী (রা.) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১. তোমাদেরকে মসজিদে আসতে আমরা নিষেধ করব না ২. রাষ্ট্রীয় সম্পদ হ’তে আমরা তোমাদের বঞ্চিত করব না ৩. তোমরা আগে ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।

প্রথমে দলত্যাগকারীদের মূল সংখ্যা ছিল আট হাজার। এরা প্রায় সবাই ছিল কারী (হাফিজে কুরআন)। তাদের দাওয়াতে অন্যান্য লোক এসে তাদের পথ গ্রহণ করায় সংখ্যা বেড়ে ১৫/১৬ হাজারে উন্নীত হয়। ইবনে আব্বাস তাদের সাথে আলোচনা করার ফলে তাদের থেকে ৪/৫ হাজার লোক ফিরে আসে এবং অবশিষ্টরা স্ব-মতে বহাল থাকে। ইতিহাসে এই লোকদের খারেজি বলা হয়ে থাকে। খারেজিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এরা নিজেদের দল ছাড়া বাকীদের তাকফির করে। অর্থাৎ কাফির ঘোষণা করে।

শাব্দিক অর্থে ‘খারেজী’ শব্দটি আরবী ‘খুরূজ’ (الخروج) শব্দ হ’তে এসেছে, যার অর্থ ‘বের হওয়া বা বেরিয়ে যাওয়া’। বহুবচনে ‘খাওয়ারিজ’ ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক খারেজী হ’ল- ‘এমন ব্যক্তি বা দল যে বা যারা এমন হক ইমামের (শাসক) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাকে লোকেরা ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহ.)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা চতুর্থ খলীফা আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মতামত কিংবা তাদের রায় অবলম্বনকারী, তা যেকোন যুগেই হোক না কেন’।

তাকফির করা ছাড়াও খারেজীদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে রাসূল সা. যা বলেছেন :
‘আলী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি যে, শেষ যামানায় এমন একদল মানুষের আবির্ভাব হবে, যারা হবে কমবয়স্ক এবং যাদের বুদ্ধি হবে স্বল্প। ভাল ভাল কথা বলবে, কিন্তু তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান গলার নিচে পৌঁছবে না। (বুখারী- ৫০৫৭)

১- বয়স কম।
২- প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও হিকমাহ থাকবে না।
৩- উত্তম কথা বলবে, হক কথা বলবে।
৪- তারা পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না। তারা কিছু অংশ মানবে কিছু মানবে না।

আবূ সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি, ভবিষ্যতে এমন সব লোকের আগমন ঘটবে, যাদের সলাতের তুলনায় তোমাদের সলাতকে, তাদের সওমের তুলনায় তোমাদের সওমকে এবং তাদের ‘আমালের তুলনায় তোমাদের ‘আমালকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে (অর্থাৎ অন্তরে) প্রবেশ করবে না। এরা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। (বুখারী-৫০৫৮)
এখানে কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।

৫- তাদের সালাত ও সিয়াম সুন্দর হবে। তারা ইবাদতে খুব নিষ্ঠাবান হবে।
৬- তারা কুরআন পাঠকারী হবে, তবে কুরআন বুঝতে তারা সক্ষম হবে না। ইলমগত দৈন্যতা থাকবে।

আবূ সা’ঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসূল সা. কিছু গনিমতের মাল বন্টন করছিলেন। তখন এক ব্যক্তি এসে বললো, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। ইনসাফ করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফারমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। [আবূ সা’ঈদ (রাঃ) বলেন] আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রাঃ) বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী‎ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নিষেধ করলেন।

অতঃপর অভিযোগকারী লোকটি যখন ফিরে গেল, তখন নবী‎ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বেরিয়ে পড়বে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে (মুসলিমদেরকে) হত্যা করবে আর মূর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা হতে বাদ দেবে। আমি যদি তাদের পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম। (বুখারী- ৩৩৪৪)

ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেনঃ খারেজীদের সবচেয়ে মারাত্মক যে দোষ মহানবী (সা) বর্ণনা করেছেন তা হলো তারা ইসলাম পন্থীদের হত্যা করবে, এবং মূর্তিপূজকদের ছেড়ে কথা কথা বলবে। (মাজমূ’, ২৮/৫২৮) ইমাম কুরতবী বলেনঃ তারা মুসলিমদের কাফির সাব্যস্ত করে যখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাদের রক্ত তখন তারা হালাল মনে করবে, আর ঐ দেশের কাফির জনশক্তিকে ছেড়ে দেবে। (আল মুফহিম, ৩/১১৪)

৭- তাদের আদব জ্ঞান থাকবে না। যার তার ভুল ধরবে অযথা। সবসময় নিজেদের মতকে সহীহ মনে করবে। অন্যদের বাতিল মনে করবে।
৮- তারা ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। মুরশিকদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য থাকবে না।

আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, শেষ যমানায় এ উম্মাতের মধ্যে একটি সম্প্রদায় আবির্ভূত হবে, যারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে যাবে না। তাদের চিহ্ন হবে মুণ্ডিত মাথা। ইবনে মাজাহ- ১৭৫

৯- তাদের অনেকের মাথা মুন্ডানো থাকবে।

মহানবী (সঃ) বলেছেনঃ এরা এমন হবে যে মানুষদের বিস্মিত করাবে, এবং তারা নিজদের নিয়েই গর্ব বোধ করবে। (আহমাদ, ১২৯৭২, আলবানী হাদীসকে সাহীহ বলেছেন)।

১০- তাদের মধ্যে ইবাদতের অহংকার থাকবে।

আল্লাহর রাসূলের ভাষা অনুসারে এখানে প্রায় দশটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এখানে কিছু ভালো গুণ রয়েছে। এর মানে এই না যে আমরা ভালো গুণগুলো অর্জন করবো না। ইসলামের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও নির্বুদ্ধিতা ও গোঁড়ামীর ফলে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।

খিলাফত পর্ব-৪৬ : আলী রা. হেরে গেলেন বিশ্বাসভঙ্গ ও নিন্দনীয় কূটচালের কাছে

 


হেরে যাওয়ার মুহূর্তে মুয়াবিয়া রা. ও আমর ইবনুল আস রা. বুদ্ধি করে বর্শার আগায় কুরআন গেঁথে যুদ্ধ থামিয়ে দিল। অথচ যতক্ষণ তাদের শক্তি ছিল ততক্ষণ তারা কোনো সমঝোতায় তারা রাজি ছিল না। তাদের প্রস্তাব ছিল দুইটি হয় আলী রা.-কে ক্ষমতা ত্যাগ করে মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নতুবা আম্মার রা., মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সহ মিশরের গোত্রপ্রধানদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

তারা এদের হত্যা করবে। যেটা আলী রা. মোটেই সঠিক বলে মনে করেননি। কারণ প্রসিদ্ধ এসব সাহাবী যদিও উসমান রা.-এর বিভিন্ন পদক্ষেপ ও মারওয়ান ইবনে হাকামের অসদাচরণের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন কিন্তু তারা উসমান রা.-কে হত্যা করেননি বা করতে চাননি। এদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রা. শুধুমাত্র উসমান রা.-এর সাথে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। বাকীরা তাও করেননি। বিশৃঙ্খলার মধ্যে সন্ত্রাসী কেউ কেউ উসমান রা.-কে হত্যা করে ফেলে, যাদের শনাক্ত করা যায় নি।

যাই হোক, সিফফিনের যুদ্ধে যখন মুয়াবিয়া রা. পরাজিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে তখন তারা কৌশল করে যুদ্ধ বন্ধ করে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। সমঝোতা কীভাবে হবে এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে থাকে। দীর্ঘ আলোচনা, পর্যালোচনা ও নীতিমালা লিখিত হওয়ার পর উভয় পক্ষ সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়। আলোচনায় নির্ধারণ হয় যে, আলী রা. ও মু'আবিয়া রা. নিজ নিজ পক্ষ হতে একজন করে বিচারক নিযুক্ত করবেন। বিচারকদ্বয় ঐকমত্য হয়ে এমন একটি ব্যবস্থা খুঁজে বের করবেন, যা সমস্ত মুসলমানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। সে মতে মু'আবিয়া রা. তার পক্ষ হতে আমর ইব্ন আসকে বিচারক নিয়োগ করেন। হযরত আলী রা. তাঁর পক্ষ হতে আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রা.-কে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়া রা. তা মানতে রাজি হন নাই।

আলী রা. আরো কিছু নাম প্রস্তাব করলেও মুয়াবিয়া রা. তা মানতে রাজি ছিলেন না। মুয়াবিয়া রা. নিজ দলের সেকেন্ড কমান্ডারকেই বিচারক হিসেবে মেনে নিলেন। অথচ আলী রা.-কে নিজ প্রস্তাবনায় বিচারক নিতে দিচ্ছিলেন না। আলী রা. বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গীদের বললেন তোমরা যা ইচ্ছা তা করো! অবশেষে আশ'আছ ইব্‌ন কাইস রা. আবু মুসা আশআরী রা.-এর নাম প্রস্তাব করেন। এবার মুয়াবিয়া রা. ওনাকে আলী রা.-এর বিচারক মানতে রাজি হন।

আবু মুসা আশাআরি রা. কোনো দলের লোক ছিলেন না। তিনি ফিতনার ভয়ে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তার দলের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন। আমরা এ কাজে আবূ মূসা আশ'আরী রা. ব্যতীত অন্য কাউকে নিয়োগ করতে রাজী নই। অথচ কথা ছিল উভয় পক্ষ নিজ নিজ পক্ষের বিচারক নির্ধারণ করবে। আলী রা. বাধ্য হয়ে আবু মূসা আশআরি রা.-কে নিজ পক্ষের বিচারক মানতে রাজি হন।

এই সময় আহনাফ রা. হযরত আলীকে সম্বোধন করে বললো, আপনি নিশ্চিতভাবে প্রতারিত হতে যাচ্ছেন। জড় পাথরের ন্যায় এক ব্যক্তিকে আপনার বিচারক নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষের সাথে বুঝাপড়া করতে সক্ষম হবে। কাজেই আমাকে যদি আপনি বিচারক নিয়োগ করতে নাও চান, তবে আমাকে অন্তত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিযুক্ত করুন। তাদের যে কোন মারপ্যাচ আমি বুঝতে ও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো, কিন্তু আমি আপনার পক্ষে যে প্যাচ দিব তা যদি ওরা খুলতে সক্ষম হয় তবে সাথে সাথে অনুরূপ কিংবা তার চেয়ে অধিক সূক্ষ্ম আরো প্যাঁচ দিয়ে তাদেরকে কাবু করে ফেলবো। কিন্তু বিপরীত পক্ষ থেকে আবু মূসা আশআরি রা.-কে ছাড়া অন্য কাউকে মানতে রাজি ছিল না।

অবশেষে আবূ মূসা আশ'আরীই আলী রা.-এর পক্ষে বিচারক নিযুক্ত হলেন। ঐ সময় তিনি দূরে নির্বাসন জীবন-যাপন করছিলেন। তাকে নিয়ে আসার জন্যে দূত প্রেরণ করা হলো। দূত তাকে সংবাদ জানালো যে, জনগণ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় একমত হয়েছে। এ সংবাদ শুনে তিনি বলে উঠলেন 'আল-হামদুলিল্লাহ'। কিন্তু এরপরই যখন জানানো হলো যে, আপনাকে বিচারক নিযুক্ত করা হয়েছে, তখন তিনি বললেন- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।' দূতগণ তাকে নিয়ে এসে হযরত আলীর কাছে হাজির করলেন। অতঃপর উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নলিখিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রথমে লেখা হয়, এই চুক্তিপত্র যা আমীরুল মু'মিনীন আলী ইব্‌ন আবূ তালিব কর্তৃক সম্পাদিত হলো। এটুকু লেখা হলে আমর ইব্ন আস রা. প্রতিবাদ করে লেখককে বলেন, আমীরুল মু'মিনীন শব্দ লেখা যাবে না। শুধু আলী ও তার পিতার নাম লিখুন। তিনি আপনাদের আমীর হতে পারেন। আমাদের আমীর নন। মুয়াবিয়া রা. বলেন, আলী যদি আমীরুল মু'মিনীন হয়, তাহলে তো আমরা তার সাথে যুদ্ধই করতাম না। অথচ তারা যুদ্ধের আগে বলেছিল আলী রা.-কে নেতা মানতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। শুধু কয়েকজনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

আহনাফ রা. বললেন, তা হবে না। আমীরুল মু'মিনীন লেখতেই হবে। আলী রা. সমঝোতার স্বার্থে এটাও মেনে নিলেন। হযরত আলী রা. বললেন, আমীরুল মু'মিনীন শব্দটি কেটে দাও এবং শুধু আলী ইবন আবূ তালিব লিখ। এ কথা বলে তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। সে দিন সন্ধি পত্রে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্' লেখা হলে পবিত্র মক্কাবাসীরা আপত্তি করে বলেছিল 'মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্' লেখা যাবে না, বরং লেখতে হবে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ।

এরপর চুক্তিপত্রে লেখা হলো, এই চুক্তিপত্র আলী ইবনে আবূ তালিব ও মু'আবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ানের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে লিখিত হলো। আলী রা. ইরাকবাসী ও তাদের সমর্থক মুসলমানদের পক্ষ হতে বিচারক নিযুক্ত করলেন। আর মু'আবিয়া সিরিয়াবাসী ও তার অনুগামী মু'মিন মুসলমানদের পক্ষ হতে বিচারক নিয়োগ করলেন। আমরা অবশ্যই মহান আল্লাহর হুকুম ও তাঁর কিতাবের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। আমরা তাই বাঁচিয়ে রাখবো যা আল্লাহ পাক বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং তাই খতম করবো যা আল্লাহ্ পাক খতম করে দিয়েছেন। বিচারকদ্বয় অর্থাৎ আবূ মূসা আশ'আরী ও আমর ইবনুল আস মহান আল্লাহর কিতাবে যা পাবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। আর যদি মহান আল্লাহর কিতাবে পাওয়া না যায়, তবে সুন্নাতে রাসূলের সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যা আমাদের মাঝে ন্যায়-নীতির মাধ্যমে ঐকমত্য সৃষ্টি করবে ও বিভক্তি এনে দিবে না ।

এরপর উভয় বিচারক তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে ও পরিবারবর্গের জন্যে আলী, মু'আবিয়া এবং উভয়ের সৈন্যবাহিনীর নিকট থেকে নিরাপত্তার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে। তারা আরও প্রতিশ্রুতি নেয় যে, সকল উম্মত তাদেরকে বিচার কাজে সহযোগিতা করবে। দুই পক্ষের সকল মু'মিন মুসলমান চুক্তি অনুযায়ী চলতে বাধ্য থাকবে। আগামী রমাদান মাস পর্যন্ত বিচারের সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে বিচারকদ্বয় যদি প্রয়োজন মনে করেন এবং একমত হয়ে সময় আরও কিছু বাড়াতে চান, তা পারবেন।

হিজরী ৩৭ সালের সফর মাসের ১৩ তারিখ বুধবারে এ চুক্তিনামা লেখা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, সালিস বিচারের জন্যে আলী রা. ও মুআবিয়া রা. রমজান মাসে 'দুমাতুল জানদাল' নামক স্থানে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রত্যেক বিচারকের সাথে নিজ নিজ পক্ষের চারশ করে লোক থাকবে। আগামী রমজানে যদি দুমাতুল জানদালে বিচারকদ্বয় বসতে না পারেন, তা হলে পরের বছর যে কোন সময় তারা আরাহ্ নামক স্থানে বসে সালিসির কাজ সম্পন্ন করবেন।

চুক্তিপত্র লেখা শেষ হলে আশআছ ইবনে কাইস তা জনগণের সামনে পড়ে শুনান এবং উভয় পক্ষের কাছে পেশ করেন। এরপর লোকজন নিজ নিজ পক্ষের মৃতদের কবর দেওয়ার কাজ শুরু করেন। একেক কবরে পঞ্চাশ করে লাশ দাফন করা হয়। এ যুদ্ধে আলী রা.-এর হাতে সিরিয়ার বহু সৈন্য বন্দী হয়। যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি এদেরকে মুক্ত করে দেন। এদের সমপরিমাণ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক ইরাকী সৈন্যও মু'আবিয়া রা.-এর হাতে বন্দী হয়। সিরীয় বন্দীদের হত্যা করা হয়েছে ধারণা করে মু'আবিয়া এদেরকে হত্যা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তারা যখন মুক্ত হয়ে ফিরে আসলো তখন মু'আবিয়াও এদেরকে ছেড়ে দেন।

উভয় পক্ষের শর্ত অনুযায়ী রমজান মাসে উভয় বিচারক দুমাতুল জানদালে উপস্থিত হয়। হযরত আলী রা. রমযান মাসের শুরুতে শুরাইহ্ ইব্‌ন হানীর নেতৃত্বে চারশ' অশ্বারোহীর সাথে আবূ মূসা আশ'আরী রা.-কে প্রেরণ করেন। প্রখ্যাত তাফসীরকারক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে সবকিছু পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে একই সাথে পাঠান। অপর দিকে মু'আবিয়া রা.-ও সিরিয়ার চারশ অশ্বারোহী সংগে দিয়ে আমর ইবনে আসকে প্রেরণ করেন।

উভয় দল দুমাতুল জানদাল নামক স্থানে একত্রিত হয়। এ স্থানটি কুফা ও সিরিয়া থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত। সালিস কার্য দেখার জন্যে মুসলিম সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তথায় উপস্থিত ছিলেন। যেমন আবদুল্লাহ্ ইবন উমর রা., আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা., মুগীরাহ্ ইবন শু'বাহ্ রা., আবদুর রহমান ইবন হারিছ রা., আবদুর রহমান ইবন আবদে ইয়াগুছ যুহরী এবং আবূ জাহাম ইবন হুযাইফাহ।

এরপর বিচারকদ্বয় মুসলমানদের মধ্যে শান্তি-নিরাপত্তা পুনঃ প্রতিষ্ঠার উপায় নির্ধারণকল্পে সংলাপ শুরু করে। অবশেষে তারা এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছে যে, তারা দুজনেই আলী রা. ও মু'আবিয়া রা.-কে অপসারণ করবে। তারপরে খলীফা নির্বাচনের বিষয়টি মুসলমানদের মতামতের উপর ছেড়ে দিবে। মুসলিমগণ একমত হয়ে ইচ্ছা করলে এ দুজনের মধ্যে যিনি অধিক যোগ্য তাকে অথবা এ দু'জকে বাদ দিয়ে তৃতীয় কাউকে খলীফা নির্বাচিত করবে। আবূ মূসা আশ'আরী এ পদের জন্যে আবদুল্লাহ ইবন উমরের নাম প্রস্তাব করলে আমর ইবনে আস রা. নিজের পুত্রের নাম উল্লেখ করে বলেন, আমার পুত্র আবদুল্লাহকেই খলীফা মনোনীত করুন। সেও তো ইলম, আমল ও সত্য সাধনায় আবদুল্লাহ ইবন উমর ইবনে খাত্তাবের কাছাকাছি। জবাবে আবু মূসা বলেন, কিন্তু তুমি যে তাকে ফিতনার মধ্যে তোমার সাথে কাজে লাগিয়েছ। এতদসত্ত্বেও সে একজন সত্যপন্থী লোক কীভাবে হবে?

আমর ইবনুল আস বলেন, খিলাফতের এ পদ এমন লোককেই দেওয়া উচিত যার মাড়ির দাঁত আছে যা দিয়ে সে নিজেও খেতে পারে, অপরকেও খাওয়াতে পারে (অর্থাৎ অভিজ্ঞ)। কিন্তু ইবনে উমরের মধ্যে কিছুটা উদাসীনতার ভাব আছে। ইবন যুবাইর তাকে বললেন, তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সজাগ। ইবনে উমর বললেন, না, আল্লাহর কসম! আমি এ পদের জন্য যোগ্য না।

ইবনে উমরের এই বক্তব্যের পর আমর ইবনুল আস রা. আবূ মূসা আশআরি রা.-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মু'আবিয়াকে খলীফা বানাবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবূ মূসা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এরপর তিনি নিজ পুত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে আমরকে খলীফা পদের জন্যে প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু আবূ মূসা এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।

অবশেষে তারা এই সিদ্ধান্তে একমত হয় যে, তারা দু'জনেই মু'আবিয়া ও আলীকে পদচ্যুত করে খলীফা নির্বাচনের ভার জনগণের উপর ছেড়ে দিবে। তারা পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দ মত কাউকে খলীফা নির্বাচিত করবে। এরপর বিচারকদ্বয় জনগণের সামনে আসেন। আমর ইবনুল আস আবূ মূসাকে বললেন, আপনি অগ্রসর হোন এবং যে ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য হয়েছি তা লোকদের অবহিত করুন।

আবূ মূসা জনসম্মুখে এসে প্রথমে মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর ওপর দুরূদ পড়েন। এরপর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, হে জনমণ্ডলী! আমরা দুজনে এ উম্মতের কল্যাণের বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। মুসলমানদের এই দুঃখজনক বিভক্তি দেখে সংশোধনের একটি পথ ছাড়া অন্য কোন উপায় খুঁজে পাইনি। আমি ও আমর একটি বিষয়ে একমত হয়েছি। তা হলো, আমরা আলী ও মু'আবিয়াকে অপসারণ করবো এবং নিষ্পত্তির বিষয়টি শূরার ওপর ছেড়ে দিব। মুসলিম উম্মাহ্ যাকে পছন্দ করে তাকেই নিজেদের শাসক বানাবে। সুতরাং আমি আলী ও মু'আবিয়াকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করলাম।

এ ঘোষণা দিয়ে তিনি স্থান ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান। আমর ইবনুল আস রা. এসে ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে বললেন, এই ব্যক্তি এতক্ষণে যা কিছু বলেছেন, আপনারা তা শুনেছেন। তিনি তাঁর লোককে (আলীকে) অপসারণ করেছেন। তদ্রূপ আমিও তাকে অপসারণের ঘোষণা দিলাম। কিন্তু আমি আমার লোক মু'আবিয়াকে স্বপদে বহাল রাখলাম। কারণ তিনি খলীফা উসমান ইব্ন আফফানের নিকটাত্মীয় এবং তাঁর খুনের বিচারপ্রার্থী। আর এই পদের জন্যে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি।

আমর ইবনুল আসের বিশ্বাসভঙ্গ দেখে মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আবু মুসা আশআরী রা.। এদিকে সালিশে জয়লাভ করে মুয়াবিয়ার লোকেরা উল্লাসধ্বনি দিতে লাগলো। আর আলীর পক্ষের লোকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ইবন জারীর লিখেছেন, হযরত আলীর একজন কমান্ডার শুরাইহ্ ইব্‌ন হানী আমর ইবনে আসের ওপর হামলে পড়েন এবং তাকে বেত্রাঘাত করেন। আমরের এক ছেলে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে বাধা দিতে গেলে তাকেও বেত্রাঘাত করেন। আবূ মূসা রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে প্রতারক বলে অত্যন্ত কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রতি উত্তরে ইবন আসও আবূ মূসাকে অনুরূপ কড়া কথা বলেন। নতুন করে আবার ফিতনা শুরু হয়। সালিশ পণ্ড হয়ে গেল।

দুমাতুল জান্দাল থেকে দুই পক্ষ নিজ নিজ রাজধানী ফিরে গেল। আমর ইবনুল আস ও তার সংগীরা মু'আবিয়ার কাছে পৌঁছে তাকে মুয়াবিয়া রা.-এর বানানো খিলাফতের রাজকীয় মুকুট পরিয়ে দেয়। খুলাফায়ে রাশেদিন কখনোই কায়সার ও কিসরার মতো মুকুট পরতেন না। এদিকে আবু মুসা লজ্জায় আলী রা.-এর কাছে যাননি। তিনি মক্কায় চলে যায়।

আলী রা. সব শুনে ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুয়াবিয়া রা.-এর বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেননি। এই দিন থেকে মূলত ইসলামী রাষ্ট্র দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। আলী রা. বুঝলেন যুদ্ধ থামিয়ে সালিসের ব্যবস্থা করা ছিল মূলত মুয়াবিয়া রা. ও আমর রা.-এর কূটকৌশল ও বিশ্বাসহীনতা। তারা কুরআনের দোহাই দিয়ে এই বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। আলী রা. নৈতিকতা, চুক্তি রক্ষা, জনগণের রায় ও পেশী শক্তি সব বিষয়ে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু পরাজিত হয়েছেন বিশ্বাসভঙ্গ ও কূটচালের কাছে, যা মুসলিম ভাইদের থেকেই সংঘটিত হয়েছে।

বর্শার আগায় কুরআন লাগিয়ে যুদ্ধ থামানো ছিল তাদের বিশ্বাসভঙ্গের অংশ। তারা আসলে কুরআন থেকে সমাধান নিতে চাননি। তারা যেটা চেয়েছেন তা হলো পরাজয় থেকে বাঁচা ও আমীরুল মু'মিনিন আলী রা.-এর সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ ঘটানো। বর্শায় কুরআন গেঁথে নেয়ার আগে আমর রা. মু'আবিয়া রা.-কে বললেন, আমি একটি বুদ্ধি ঠিক করেছি যা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দলের সমন্বিত হওয়ার অধিক সুযোগ সৃষ্টি করতে এবং ওদের বিভক্তি বাড়িয়ে দিবে। বস্তুত তাই হয়েছে। নিশ্চিত বিজয়ী হওয়া যুদ্ধ থামিয়ে সন্ধি করায় আলী রা.-এর দলের মধ্য থেকে একদল প্রান্তিক লোক বের হয়ে যায় এবং আলী রা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা খারেজি হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে আলী রা. পুরো যুদ্ধেই উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে বুঝানোর জন্য প্রায় আট মাস সময় নিয়েছেন। মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে যখন পানির দখল ছিল তখন মুয়াবিয়া রা. আলীর দলকে পানি নিতে দেয়নি। অথচ আলী রা. যখন যুদ্ধ করে পানির দখল নিলেন তখন তাদেরকে পানি বিনা শর্তে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। বার বার যুদ্ধে এগিয়ে থেকেও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেননি। আমর ইবনুল আসকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছেন। হত্যা করেন নি। জেতা যুদ্ধ তাদের আহবানে বন্ধ করে দিয়ে সন্ধি করলেন। অবশেষে সেখানেও তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। অথচ কুরআনে সূরা আনফালের ৭২ নং আয়াতে কাফিরদের সাথেও 'চুক্তি ভঙ্গ' না করার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা আছে।

খুলাফায়ে রাশিদার ধারাবাহিক ইতিহাস #রাশিদুন_খিলাফত : পর্ব-৪৬

৭ এপ্রি, ২০২৩

বঙ্গবাজারে আগুন! দায়ী কে?

বঙ্গবাজার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর দায় কার? আমার হিসেবে এর দায় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতি, হাইকোর্টের বিচারপতি ও জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে। 

ফুলবাড়িয়ায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় পড়েছে। পাশাপাশি লাগোয়া চারটি বিপণিবিতানের সমন্বিত নাম বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। এর মালিকানায় রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, টিন-কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে দোকানের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার করপোরেশনের কাগজপত্রে এই বিপণিবিতান দোতলা। কিন্তু কমপ্লেক্সের কিছু অংশ তিনতলা। এই বিপণিবিতানের মালিক সমিতির নেতারা যে যার সুবিধামতো দোকান বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কমপ্লেক্সের কিছু তৈরি করে নিয়েছিলেন। 

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের দূর্বলতা ভীষণভাবে ফুটে ওঠে। একইসাথে ভবনগুলো রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশিকা মেনে তৈরি হয়নি এই বিষয়টিও প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। মিডিয়ায় রাজউক, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে ব্যাপক কথাবার্তা হয়। এর প্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিস নড়ে চড়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্স ও বিপণিবিতানে অনুসন্ধান চালায়। 

যেগুলো আগুনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোর তালিকা করে ও তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। আর কিছু বিপণিবিতানকে খুবই ঝুঁকিপূর্ন হিসেবে চিহ্নিত করে ও ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ন ছিল বঙ্গবাজার। বঙ্গবাজারের দোকান মালিক সমিতি ফায়ার সার্ভিসের এই সতর্কতাকে থোড়াই কেয়ার করে। ফায়ার সার্ভিস বার বার তাদের নোটিশ দেয়। বঙ্গবাজারের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ব্যানার টানিয়ে দেয়। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না দোকান মালিক সমিতি। ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজারকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এই অগ্নিকাণ্ডের প্রথমত দায় দোকান মালিক সমিতির।  

অবশেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবনটি ভাঙার ও এই স্থানে দশতলা বহুতল ভবন করার জন্য উদ্যোগ নেয়। এই ব্যাপারে তারা দোকান মালিক সমিতির সহায়তা চায়। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির বাধার মুখে  বাধার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ টিনের ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দোকান মালিকদের প্রণোদনা ও ভবন তৈরির সময়ে অন্য কোথাও বসার ব্যবস্থাও মেনে নেয়নি দোকান মালিক সমিতি। তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে।  

সিটি কর্পোরেশন বসে থাকে নি। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটিকে স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে ১০ তলা করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই কাজ করতে ঠিকাদারকে কার্যাদেশও (ভবন নির্মাণের অনুমতিপত্র) দেওয়া হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশনের অগ্রগতি ঠেকাতে দোকান মালিক সমিতির নেতারা উচ্চ আদালতে গিয়ে নির্মাণকাজের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এই অগ্নিকান্ডের দ্বিতীয়ত দায় উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্টের। ফায়ার সার্ভিসের উচ্চঝুঁকি ঘোষিত মার্কেটে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি মালিক সমিতিকে দেয় হাইকোর্ট। 

সিটি কর্পোরেশন আপাত দৃষ্টিতে দমে যায়। এবার সিটি কর্পোরেশন, সরকার, ফায়ার সার্ভিস একজোট হয়ে ভিন্ন চিন্তা করে। আর এই ভিন্ন চিন্তা হলো বরাবরের মতো একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া। এটা হুট করে হবে না। বরং সরকার যখন কোনো ইস্যুতে বেকায়দা অবস্থায় থাকবে তখনই একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বেকায়দা অবস্থা কাটিয়ে ওঠবে। অনির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকার হলে যা হয়! দুই জন ব্যাক্তি মোটর সাইকেলযোগে এসে সকাল বেলা আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। কাছে থাকা ফায়ার সার্ভির নির্লিপ্ত থাকে আগুনকে প্রশ্রয় দেয় যাতে পুরো মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়।     

অগ্নিকাণ্ডের তৃতীয়ত কিন্তু প্রধান দায় সরকারের। এখানে সরকার বলতে শেখ হাসিনা, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস। তাদের নতুন ভবন করতে আর বাধা থাকলো না। যদিও নতুন ভবন করাটা যৌক্তিক কিন্তু তাদের উচ্ছেদ পলিসি অত্যন্ত ষড়যন্ত্রমূলক, হটকারী। এর মাধ্যমে হাজার হাজার ব্যবসায়ী অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।  

দোকান মালিক সমিতির কিছু নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা ও স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংস পরিকল্পনায় হাজার হাজার পরিবার আজ পথে বসলো। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঝুঁকিপূর্ণ, এটি বিবেচনায় নিয়েই সেখানে আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াল, তারা সবাই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কাজটি তারা করেছিল শুধু নিজেদের স্বার্থে, টাকার লোভে।

অগ্নিকাণ্ডের চতুর্থত ও পরোক্ষ দায় জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের। সরকার পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে কোনো সময় আগুন লাগাবে। কিন্তু সেই সময়টা এখন হতো না যদি DW র‍্যাব নিয়ে তাদের প্রতিবেদনটি পাবলিশ না করতো। DW র‍্যাবের নৃশংসতা নিয়ে তথ্যচিত্র পাবলিশ করলো। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে হইচই লেগে গেল। অমনি স্বৈরাচারী হাসিনা ইস্যু ঢাকতে এখনই অগ্নিকাণ্ড লাগিয়ে দিল। ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পূর্ণ অর্থ বিনিয়োগ করে ঈদের প্রাক্কালে পোশাক মজুদ করেছে। আর হাসিনা আগুন লাগিয়ে তা মুহূর্তেই ছাইয়ে পরিণত করলো। 

অগ্নিকাণ্ডের বেসিক দায় সরকারের মানে হাসিনার। আর এর বাইরে বঙ্গবাজার মালিক সমিতি, নালায়েক হাইকোর্টের বিচারকরাও কমদায়ী নয়।

হাসিনার নির্দেশেই গুম খুন করে র‍্যাব

গতকাল জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচেভেলে ও নেত্রনিউজের যৌথ অনুসন্ধানে র‍্যাবের বিষয়ে ‘ডেথ স্কোয়াড’ নামে তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এখানে কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক হত্যা ও র‍্যাবের অন্যান্য বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি দেখুন।

সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত র‍্যাবকে নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ডয়চে ভেলের ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট এবং সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ যৌথ অনুসন্ধান চালিয়েছে৷ প্রতিষ্ঠার দুই দশক পর এই প্রথম এই বাহিনীতে কাজ করা দুই সদস্য এই ‘ডেথ স্কোয়াড’ এর ভেতরের তথ্য জানালেন৷

র‍্যাবের একজন অফিসার জানিয়েছেন, ব়্যাব যদি জানতে পারে যে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাহলে তিনি যে বাহিনীতে কাজ করেছেন সেই বাহিনীই তাকে মেরে ফেলতে পারে৷ডয়চে ভেলে তাদের স্বীকারোক্তির সত্যতা যাচাই করেছে এবং বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী এবং অন্যান্য সূত্র যেমন পুলিশ এবং পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন, বিভিন্ন মামলার তথ্যভাণ্ডার এবং একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ড যাচাই করার মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে৷

ডয়চে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেয়া দুই ব্যক্তিই দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক স্বার্থে এই এলিট বাহিনীকে ব্যবহার করেন৷ অভিযোগ রয়েছে, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে এসবের অনুমোদনও দেয়া হয়৷লক্ষ্যবস্তু যদি রাজনৈতিক ব্যক্তি হয় তাহলে কেবল উচ্চপর্যায়ের সুস্পষ্ট অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতেই এটি বাস্তবায়ন করা হয়৷ সাক্ষাৎকার দেয়া এক ব্যক্তি বলেন, এসব ক্ষেত্রে ‘‘সিদ্ধান্ত সর্বনিম্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসবে৷ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আদেশটা প্রদান করে থাকেন৷”

অন্য সাক্ষাৎকারদাতা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোনো নির্দেশ দেন না৷”

ডয়চে ভেলে এবং নেত্র নিউজ এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং এসব অভিযোগকে ‘‘বিভ্রান্তিকর এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত‘‘ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ ডয়চে ভেলেকে ‘‘দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী প্রচার” না করার বিষয়ে সতর্কও করেছে মন্ত্রণালয়৷ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কোনো উত্তর দেয়া হয়নি৷

‘‘ডেথ স্কোয়াড” নিয়ে অনুসন্ধানে যা জানা যায়,

কোনো টার্গেটকে যখন মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন বেশ কিছু পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়৷

প্রথমত একটি স্থান নির্ধারণ করা হয়৷ লোকচক্ষুর আড়ালের একটি স্থান বেছে নেয়া হয়, যাতে কোনো সম্ভাব্য সাক্ষী না থাকে৷ ঢাকায় এমন এক জায়গা হচ্ছে শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া দূষিত তুরাগ নদীর তীর৷ আরেকটি হচ্ছে কক্সবাজার এবং টেকনাফের মধ্যকার ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভের কিনারা৷

এরপর, সাধারণত গভীর রাতে, যখন রাস্তা জনমানবশূন্য থাকে এবং দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়, কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে টার্গেটকে আটকে চোখ বেঁধে একটি বেসামরিক গাড়িতে তুলে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়৷

এরপর টার্গেটকে গুলি করে তার রক্তক্ষরণে মৃত্যু হওয়া অবধি অপেক্ষা করা হয়৷ যখন তাদের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়, তাদের চোখের কাপড় খুলে ফেলা হয়৷ কোনো চিহ্ন না রাখার জন্য চোখ বাঁধা হয় নরম কাপড় দিয়ে৷ এরপর তাদের হাতের বাঁধনও খুলে ফেলা হয়। এরপর দৃশ্যপট সাজানো হয়৷ কী গল্প বলা হবে, তার ওপর নির্ভর করে নিহতের শরীরে নানা প্রমাণ সাজিয়ে রাখা হয়৷

যদি গল্পটি দুই গ্যাং এর মধ্যে মারামারির হয়, তাহলে মাদক এবং ইয়াবা মৃতের সঙ্গে রাখা হয়৷ সন্দেহভাজন জিহাদী হলে তার শরীরের পাশে ধর্মীয় কাগজপত্র রেখে দেয়া হয়৷উভয় ক্ষেত্রেই টার্গেটের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে দেয়া হয়৷ তিনি জানান, এইসব অস্ত্র অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারত থেকে পাচার করে আনা হয়৷ এরপর ফাঁকা গুলি করে বুলেটের খোসা মাটিতে ফেলে রাখা হয়৷

কিন্তু কিছু বিরল ক্ষেত্রে ব়্যাব একেবারেই নীরবে কাজ করে৷ ভিকটিমদের তুলে নিয়ে কোনো চিহ্ন রাখা হয় না৷ কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না৷ এইসব ঘটনাকে ‘‘গুম” বলে উল্লেখ করা হয়৷বাংলাদেশজুড়ে এখনও শত শত মানুষ এভাবেই নিখোঁজ রয়েছেন৷

বছরের পর বছর ধরে র‌্যাবের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও৷ র‌্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা শত শত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বেসামরিক ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে, যারা আর ফিরে আসেনি, জানান এসব ঘটনার দিকে নজর রাখা অ্যাক্টিভিস্টরা৷

র‍্যাবের ব্যাপারে এমন অনুসন্ধান এর আগে করেছিল সুইডিশ রেডিও ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে। যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে খুনী বানায় তাদের একটি প্রশিক্ষণের অডিও রেকর্ড পেয়েছে সুইডিশ রেডিও। যার খুব অল্প অংশ তারা প্রচার করেছে। তারা বলেছে যে ব্যক্তি এই রেকর্ড ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারবার সে প্যানেল থেকে বের হয়ে পানি খাচ্ছিল।

অডিওতে র‌্যাবের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, “তোমরা যদি তাকে(টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে) খুঁজে পাও, শুট এন্ড কিল হিম(গুলি করো এবং হত্যা করো), যেখানেই থাকুক। এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও।”

বিচারবহির্ভুত হত্যার এমন রোমহর্ষক নির্দেশ দেয়ার পর পুলিশের এলিট ফোর্স কিভাবে কাকে হত্যা করবে এসব তালিকা কিভাবে নির্বাচন করে এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এমনকি এই কর্মকর্তা নিজেই যে অসংখ্য হত্যার সাথে জড়িত তা নিজেই উল্লেখ করে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বর্ণনা করেন কীভাবে পুলিশ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। এমনকি তারা অবৈধ অস্ত্র কিনে মানুষকে খুন করে সেই অস্ত্র তার পাশেই রেখে দেয়। আসলে সাধারন মানুষ কখনো অবৈধ অস্ত্র রাখে না। কিন্ত পুলিশ যাকে হত্যা করছে তারও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের বিষয় প্রমানের জন্য, বলতে গেলে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছোড়ল, এই বক্তব্যের যথার্থতার জন্য নিহতের পাশে অস্ত্র রেখে দেয়া হয়।

দুইঘণ্টাব্যাপী এই গোপন রেকর্ডিং-এ র‌্যাব যে হত্যা এবং জোরপূর্বক গুম করে এই বিষয়টি এই কর্মকর্তা তার বক্তব্যে বার বার উল্লেখ করেন।

গুমের ক্ষেত্রে তিন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে থাকেন-

(১) টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অপহরন

(২) তাকে হত্যা করা

(৩) তার লাশ চিরতরে গুম করে ফেলা।

আলাপকালে তিনি বলেন, কোন লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে তারা লাশের সাথে ভারি ইট বেঁধে দেয়। সেই কর্মকর্তা আরো কথা বলে যা অনেকেটা সিনেমার মত- যেসব অফিসার এই ধরনের অপারেশনে যায়,তারা অনেকে নিখুঁতভাবে এই কাজ করে। এটাও সত্য গুম এরপর হত্যা, এই ধরনের কাজে সব পুলিশ দক্ষ না। তাই এই ধরনের অপারেশনে কোন প্রকার ক্লু বা সামান্য চিহ্নও যাতে না থাকে, এমনকি আমাদের আইডিকার্ড, আমাদের গ্লাভস পরতে হয় যাতে আংগুলের ছাপ পাওয়া না যায়। এমনকি জুতার মধ্যেও আলাদা আবরন লাগানো হয়।

ওই কর্মকর্তার মতে, রাজনীতিতে বিরোধীদলের বিশাল একটা অংশকে নিশ্চিহ্ন করাই এই ধরনের অপারেশনের লক্ষ্য। এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, আসলে র‌্যাব যাদেরকে ধরে নিয়ে আসে, তাদের ভাগ্য আসলে উপরের নির্দেশের উপর নির্ভর করে। তিনি এই গোপন রেকর্ডিংয়ে গুমকৃত ব্যক্তিদের উপর কিভাবে অত্যাচার করা হয় এই বিষয়গুলোও বলেন। আসলে একটা অন্ধকার কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটি হালকা আলোর বাতি দিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নগ্ন অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা হয়, আর তার অন্ডকোষে ইট বেঁধে দেয়া হয়। ইটের ওজনের কারনে তার অন্ডকোষ অনেকেটা মুছড়িয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে এই ধরনের ব্যক্তি অবচেতন হয়ে যায়, আর বুঝাই যায় না সে কি মৃত না জীবিত।

ফাঁস হওয়া অডিওটি শুনতে ও তাদের প্রতিবেদন পড়তে সুইডিশ রেডিওর ওয়েবসাইট দেখুন।

এখন র‍্যাবের একটাই পরিচয় সারা দেশে “র‍্যাব একটি সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনী”। না এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বেই তাদের এই পরিচয়। আগে র‍্যাব ছিল সন্ত্রাসীদের মূর্তিমান আতঙ্ক, আর এখন সাধারণ মানুষদের।