৮ এপ্রি, ২০২৩

খিলাফত পর্ব-৪৬ : আলী রা. হেরে গেলেন বিশ্বাসভঙ্গ ও নিন্দনীয় কূটচালের কাছে

 


হেরে যাওয়ার মুহূর্তে মুয়াবিয়া রা. ও আমর ইবনুল আস রা. বুদ্ধি করে বর্শার আগায় কুরআন গেঁথে যুদ্ধ থামিয়ে দিল। অথচ যতক্ষণ তাদের শক্তি ছিল ততক্ষণ তারা কোনো সমঝোতায় তারা রাজি ছিল না। তাদের প্রস্তাব ছিল দুইটি হয় আলী রা.-কে ক্ষমতা ত্যাগ করে মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নতুবা আম্মার রা., মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সহ মিশরের গোত্রপ্রধানদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

তারা এদের হত্যা করবে। যেটা আলী রা. মোটেই সঠিক বলে মনে করেননি। কারণ প্রসিদ্ধ এসব সাহাবী যদিও উসমান রা.-এর বিভিন্ন পদক্ষেপ ও মারওয়ান ইবনে হাকামের অসদাচরণের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন কিন্তু তারা উসমান রা.-কে হত্যা করেননি বা করতে চাননি। এদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রা. শুধুমাত্র উসমান রা.-এর সাথে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। বাকীরা তাও করেননি। বিশৃঙ্খলার মধ্যে সন্ত্রাসী কেউ কেউ উসমান রা.-কে হত্যা করে ফেলে, যাদের শনাক্ত করা যায় নি।

যাই হোক, সিফফিনের যুদ্ধে যখন মুয়াবিয়া রা. পরাজিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে তখন তারা কৌশল করে যুদ্ধ বন্ধ করে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। সমঝোতা কীভাবে হবে এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে থাকে। দীর্ঘ আলোচনা, পর্যালোচনা ও নীতিমালা লিখিত হওয়ার পর উভয় পক্ষ সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়। আলোচনায় নির্ধারণ হয় যে, আলী রা. ও মু'আবিয়া রা. নিজ নিজ পক্ষ হতে একজন করে বিচারক নিযুক্ত করবেন। বিচারকদ্বয় ঐকমত্য হয়ে এমন একটি ব্যবস্থা খুঁজে বের করবেন, যা সমস্ত মুসলমানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। সে মতে মু'আবিয়া রা. তার পক্ষ হতে আমর ইব্ন আসকে বিচারক নিয়োগ করেন। হযরত আলী রা. তাঁর পক্ষ হতে আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রা.-কে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়া রা. তা মানতে রাজি হন নাই।

আলী রা. আরো কিছু নাম প্রস্তাব করলেও মুয়াবিয়া রা. তা মানতে রাজি ছিলেন না। মুয়াবিয়া রা. নিজ দলের সেকেন্ড কমান্ডারকেই বিচারক হিসেবে মেনে নিলেন। অথচ আলী রা.-কে নিজ প্রস্তাবনায় বিচারক নিতে দিচ্ছিলেন না। আলী রা. বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গীদের বললেন তোমরা যা ইচ্ছা তা করো! অবশেষে আশ'আছ ইব্‌ন কাইস রা. আবু মুসা আশআরী রা.-এর নাম প্রস্তাব করেন। এবার মুয়াবিয়া রা. ওনাকে আলী রা.-এর বিচারক মানতে রাজি হন।

আবু মুসা আশাআরি রা. কোনো দলের লোক ছিলেন না। তিনি ফিতনার ভয়ে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তার দলের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন। আমরা এ কাজে আবূ মূসা আশ'আরী রা. ব্যতীত অন্য কাউকে নিয়োগ করতে রাজী নই। অথচ কথা ছিল উভয় পক্ষ নিজ নিজ পক্ষের বিচারক নির্ধারণ করবে। আলী রা. বাধ্য হয়ে আবু মূসা আশআরি রা.-কে নিজ পক্ষের বিচারক মানতে রাজি হন।

এই সময় আহনাফ রা. হযরত আলীকে সম্বোধন করে বললো, আপনি নিশ্চিতভাবে প্রতারিত হতে যাচ্ছেন। জড় পাথরের ন্যায় এক ব্যক্তিকে আপনার বিচারক নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষের সাথে বুঝাপড়া করতে সক্ষম হবে। কাজেই আমাকে যদি আপনি বিচারক নিয়োগ করতে নাও চান, তবে আমাকে অন্তত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিযুক্ত করুন। তাদের যে কোন মারপ্যাচ আমি বুঝতে ও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো, কিন্তু আমি আপনার পক্ষে যে প্যাচ দিব তা যদি ওরা খুলতে সক্ষম হয় তবে সাথে সাথে অনুরূপ কিংবা তার চেয়ে অধিক সূক্ষ্ম আরো প্যাঁচ দিয়ে তাদেরকে কাবু করে ফেলবো। কিন্তু বিপরীত পক্ষ থেকে আবু মূসা আশআরি রা.-কে ছাড়া অন্য কাউকে মানতে রাজি ছিল না।

অবশেষে আবূ মূসা আশ'আরীই আলী রা.-এর পক্ষে বিচারক নিযুক্ত হলেন। ঐ সময় তিনি দূরে নির্বাসন জীবন-যাপন করছিলেন। তাকে নিয়ে আসার জন্যে দূত প্রেরণ করা হলো। দূত তাকে সংবাদ জানালো যে, জনগণ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় একমত হয়েছে। এ সংবাদ শুনে তিনি বলে উঠলেন 'আল-হামদুলিল্লাহ'। কিন্তু এরপরই যখন জানানো হলো যে, আপনাকে বিচারক নিযুক্ত করা হয়েছে, তখন তিনি বললেন- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।' দূতগণ তাকে নিয়ে এসে হযরত আলীর কাছে হাজির করলেন। অতঃপর উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নলিখিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রথমে লেখা হয়, এই চুক্তিপত্র যা আমীরুল মু'মিনীন আলী ইব্‌ন আবূ তালিব কর্তৃক সম্পাদিত হলো। এটুকু লেখা হলে আমর ইব্ন আস রা. প্রতিবাদ করে লেখককে বলেন, আমীরুল মু'মিনীন শব্দ লেখা যাবে না। শুধু আলী ও তার পিতার নাম লিখুন। তিনি আপনাদের আমীর হতে পারেন। আমাদের আমীর নন। মুয়াবিয়া রা. বলেন, আলী যদি আমীরুল মু'মিনীন হয়, তাহলে তো আমরা তার সাথে যুদ্ধই করতাম না। অথচ তারা যুদ্ধের আগে বলেছিল আলী রা.-কে নেতা মানতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। শুধু কয়েকজনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

আহনাফ রা. বললেন, তা হবে না। আমীরুল মু'মিনীন লেখতেই হবে। আলী রা. সমঝোতার স্বার্থে এটাও মেনে নিলেন। হযরত আলী রা. বললেন, আমীরুল মু'মিনীন শব্দটি কেটে দাও এবং শুধু আলী ইবন আবূ তালিব লিখ। এ কথা বলে তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। সে দিন সন্ধি পত্রে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্' লেখা হলে পবিত্র মক্কাবাসীরা আপত্তি করে বলেছিল 'মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্' লেখা যাবে না, বরং লেখতে হবে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ।

এরপর চুক্তিপত্রে লেখা হলো, এই চুক্তিপত্র আলী ইবনে আবূ তালিব ও মু'আবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ানের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে লিখিত হলো। আলী রা. ইরাকবাসী ও তাদের সমর্থক মুসলমানদের পক্ষ হতে বিচারক নিযুক্ত করলেন। আর মু'আবিয়া সিরিয়াবাসী ও তার অনুগামী মু'মিন মুসলমানদের পক্ষ হতে বিচারক নিয়োগ করলেন। আমরা অবশ্যই মহান আল্লাহর হুকুম ও তাঁর কিতাবের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। আমরা তাই বাঁচিয়ে রাখবো যা আল্লাহ পাক বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং তাই খতম করবো যা আল্লাহ্ পাক খতম করে দিয়েছেন। বিচারকদ্বয় অর্থাৎ আবূ মূসা আশ'আরী ও আমর ইবনুল আস মহান আল্লাহর কিতাবে যা পাবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। আর যদি মহান আল্লাহর কিতাবে পাওয়া না যায়, তবে সুন্নাতে রাসূলের সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যা আমাদের মাঝে ন্যায়-নীতির মাধ্যমে ঐকমত্য সৃষ্টি করবে ও বিভক্তি এনে দিবে না ।

এরপর উভয় বিচারক তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে ও পরিবারবর্গের জন্যে আলী, মু'আবিয়া এবং উভয়ের সৈন্যবাহিনীর নিকট থেকে নিরাপত্তার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে। তারা আরও প্রতিশ্রুতি নেয় যে, সকল উম্মত তাদেরকে বিচার কাজে সহযোগিতা করবে। দুই পক্ষের সকল মু'মিন মুসলমান চুক্তি অনুযায়ী চলতে বাধ্য থাকবে। আগামী রমাদান মাস পর্যন্ত বিচারের সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে বিচারকদ্বয় যদি প্রয়োজন মনে করেন এবং একমত হয়ে সময় আরও কিছু বাড়াতে চান, তা পারবেন।

হিজরী ৩৭ সালের সফর মাসের ১৩ তারিখ বুধবারে এ চুক্তিনামা লেখা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, সালিস বিচারের জন্যে আলী রা. ও মুআবিয়া রা. রমজান মাসে 'দুমাতুল জানদাল' নামক স্থানে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রত্যেক বিচারকের সাথে নিজ নিজ পক্ষের চারশ করে লোক থাকবে। আগামী রমজানে যদি দুমাতুল জানদালে বিচারকদ্বয় বসতে না পারেন, তা হলে পরের বছর যে কোন সময় তারা আরাহ্ নামক স্থানে বসে সালিসির কাজ সম্পন্ন করবেন।

চুক্তিপত্র লেখা শেষ হলে আশআছ ইবনে কাইস তা জনগণের সামনে পড়ে শুনান এবং উভয় পক্ষের কাছে পেশ করেন। এরপর লোকজন নিজ নিজ পক্ষের মৃতদের কবর দেওয়ার কাজ শুরু করেন। একেক কবরে পঞ্চাশ করে লাশ দাফন করা হয়। এ যুদ্ধে আলী রা.-এর হাতে সিরিয়ার বহু সৈন্য বন্দী হয়। যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি এদেরকে মুক্ত করে দেন। এদের সমপরিমাণ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক ইরাকী সৈন্যও মু'আবিয়া রা.-এর হাতে বন্দী হয়। সিরীয় বন্দীদের হত্যা করা হয়েছে ধারণা করে মু'আবিয়া এদেরকে হত্যা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তারা যখন মুক্ত হয়ে ফিরে আসলো তখন মু'আবিয়াও এদেরকে ছেড়ে দেন।

উভয় পক্ষের শর্ত অনুযায়ী রমজান মাসে উভয় বিচারক দুমাতুল জানদালে উপস্থিত হয়। হযরত আলী রা. রমযান মাসের শুরুতে শুরাইহ্ ইব্‌ন হানীর নেতৃত্বে চারশ' অশ্বারোহীর সাথে আবূ মূসা আশ'আরী রা.-কে প্রেরণ করেন। প্রখ্যাত তাফসীরকারক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে সবকিছু পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে একই সাথে পাঠান। অপর দিকে মু'আবিয়া রা.-ও সিরিয়ার চারশ অশ্বারোহী সংগে দিয়ে আমর ইবনে আসকে প্রেরণ করেন।

উভয় দল দুমাতুল জানদাল নামক স্থানে একত্রিত হয়। এ স্থানটি কুফা ও সিরিয়া থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত। সালিস কার্য দেখার জন্যে মুসলিম সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তথায় উপস্থিত ছিলেন। যেমন আবদুল্লাহ্ ইবন উমর রা., আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা., মুগীরাহ্ ইবন শু'বাহ্ রা., আবদুর রহমান ইবন হারিছ রা., আবদুর রহমান ইবন আবদে ইয়াগুছ যুহরী এবং আবূ জাহাম ইবন হুযাইফাহ।

এরপর বিচারকদ্বয় মুসলমানদের মধ্যে শান্তি-নিরাপত্তা পুনঃ প্রতিষ্ঠার উপায় নির্ধারণকল্পে সংলাপ শুরু করে। অবশেষে তারা এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছে যে, তারা দুজনেই আলী রা. ও মু'আবিয়া রা.-কে অপসারণ করবে। তারপরে খলীফা নির্বাচনের বিষয়টি মুসলমানদের মতামতের উপর ছেড়ে দিবে। মুসলিমগণ একমত হয়ে ইচ্ছা করলে এ দুজনের মধ্যে যিনি অধিক যোগ্য তাকে অথবা এ দু'জকে বাদ দিয়ে তৃতীয় কাউকে খলীফা নির্বাচিত করবে। আবূ মূসা আশ'আরী এ পদের জন্যে আবদুল্লাহ ইবন উমরের নাম প্রস্তাব করলে আমর ইবনে আস রা. নিজের পুত্রের নাম উল্লেখ করে বলেন, আমার পুত্র আবদুল্লাহকেই খলীফা মনোনীত করুন। সেও তো ইলম, আমল ও সত্য সাধনায় আবদুল্লাহ ইবন উমর ইবনে খাত্তাবের কাছাকাছি। জবাবে আবু মূসা বলেন, কিন্তু তুমি যে তাকে ফিতনার মধ্যে তোমার সাথে কাজে লাগিয়েছ। এতদসত্ত্বেও সে একজন সত্যপন্থী লোক কীভাবে হবে?

আমর ইবনুল আস বলেন, খিলাফতের এ পদ এমন লোককেই দেওয়া উচিত যার মাড়ির দাঁত আছে যা দিয়ে সে নিজেও খেতে পারে, অপরকেও খাওয়াতে পারে (অর্থাৎ অভিজ্ঞ)। কিন্তু ইবনে উমরের মধ্যে কিছুটা উদাসীনতার ভাব আছে। ইবন যুবাইর তাকে বললেন, তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সজাগ। ইবনে উমর বললেন, না, আল্লাহর কসম! আমি এ পদের জন্য যোগ্য না।

ইবনে উমরের এই বক্তব্যের পর আমর ইবনুল আস রা. আবূ মূসা আশআরি রা.-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মু'আবিয়াকে খলীফা বানাবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবূ মূসা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এরপর তিনি নিজ পুত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে আমরকে খলীফা পদের জন্যে প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু আবূ মূসা এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।

অবশেষে তারা এই সিদ্ধান্তে একমত হয় যে, তারা দু'জনেই মু'আবিয়া ও আলীকে পদচ্যুত করে খলীফা নির্বাচনের ভার জনগণের উপর ছেড়ে দিবে। তারা পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দ মত কাউকে খলীফা নির্বাচিত করবে। এরপর বিচারকদ্বয় জনগণের সামনে আসেন। আমর ইবনুল আস আবূ মূসাকে বললেন, আপনি অগ্রসর হোন এবং যে ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য হয়েছি তা লোকদের অবহিত করুন।

আবূ মূসা জনসম্মুখে এসে প্রথমে মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর ওপর দুরূদ পড়েন। এরপর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, হে জনমণ্ডলী! আমরা দুজনে এ উম্মতের কল্যাণের বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। মুসলমানদের এই দুঃখজনক বিভক্তি দেখে সংশোধনের একটি পথ ছাড়া অন্য কোন উপায় খুঁজে পাইনি। আমি ও আমর একটি বিষয়ে একমত হয়েছি। তা হলো, আমরা আলী ও মু'আবিয়াকে অপসারণ করবো এবং নিষ্পত্তির বিষয়টি শূরার ওপর ছেড়ে দিব। মুসলিম উম্মাহ্ যাকে পছন্দ করে তাকেই নিজেদের শাসক বানাবে। সুতরাং আমি আলী ও মু'আবিয়াকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করলাম।

এ ঘোষণা দিয়ে তিনি স্থান ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান। আমর ইবনুল আস রা. এসে ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে বললেন, এই ব্যক্তি এতক্ষণে যা কিছু বলেছেন, আপনারা তা শুনেছেন। তিনি তাঁর লোককে (আলীকে) অপসারণ করেছেন। তদ্রূপ আমিও তাকে অপসারণের ঘোষণা দিলাম। কিন্তু আমি আমার লোক মু'আবিয়াকে স্বপদে বহাল রাখলাম। কারণ তিনি খলীফা উসমান ইব্ন আফফানের নিকটাত্মীয় এবং তাঁর খুনের বিচারপ্রার্থী। আর এই পদের জন্যে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি।

আমর ইবনুল আসের বিশ্বাসভঙ্গ দেখে মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আবু মুসা আশআরী রা.। এদিকে সালিশে জয়লাভ করে মুয়াবিয়ার লোকেরা উল্লাসধ্বনি দিতে লাগলো। আর আলীর পক্ষের লোকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ইবন জারীর লিখেছেন, হযরত আলীর একজন কমান্ডার শুরাইহ্ ইব্‌ন হানী আমর ইবনে আসের ওপর হামলে পড়েন এবং তাকে বেত্রাঘাত করেন। আমরের এক ছেলে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে বাধা দিতে গেলে তাকেও বেত্রাঘাত করেন। আবূ মূসা রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে প্রতারক বলে অত্যন্ত কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রতি উত্তরে ইবন আসও আবূ মূসাকে অনুরূপ কড়া কথা বলেন। নতুন করে আবার ফিতনা শুরু হয়। সালিশ পণ্ড হয়ে গেল।

দুমাতুল জান্দাল থেকে দুই পক্ষ নিজ নিজ রাজধানী ফিরে গেল। আমর ইবনুল আস ও তার সংগীরা মু'আবিয়ার কাছে পৌঁছে তাকে মুয়াবিয়া রা.-এর বানানো খিলাফতের রাজকীয় মুকুট পরিয়ে দেয়। খুলাফায়ে রাশেদিন কখনোই কায়সার ও কিসরার মতো মুকুট পরতেন না। এদিকে আবু মুসা লজ্জায় আলী রা.-এর কাছে যাননি। তিনি মক্কায় চলে যায়।

আলী রা. সব শুনে ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুয়াবিয়া রা.-এর বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেননি। এই দিন থেকে মূলত ইসলামী রাষ্ট্র দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। আলী রা. বুঝলেন যুদ্ধ থামিয়ে সালিসের ব্যবস্থা করা ছিল মূলত মুয়াবিয়া রা. ও আমর রা.-এর কূটকৌশল ও বিশ্বাসহীনতা। তারা কুরআনের দোহাই দিয়ে এই বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। আলী রা. নৈতিকতা, চুক্তি রক্ষা, জনগণের রায় ও পেশী শক্তি সব বিষয়ে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু পরাজিত হয়েছেন বিশ্বাসভঙ্গ ও কূটচালের কাছে, যা মুসলিম ভাইদের থেকেই সংঘটিত হয়েছে।

বর্শার আগায় কুরআন লাগিয়ে যুদ্ধ থামানো ছিল তাদের বিশ্বাসভঙ্গের অংশ। তারা আসলে কুরআন থেকে সমাধান নিতে চাননি। তারা যেটা চেয়েছেন তা হলো পরাজয় থেকে বাঁচা ও আমীরুল মু'মিনিন আলী রা.-এর সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ ঘটানো। বর্শায় কুরআন গেঁথে নেয়ার আগে আমর রা. মু'আবিয়া রা.-কে বললেন, আমি একটি বুদ্ধি ঠিক করেছি যা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দলের সমন্বিত হওয়ার অধিক সুযোগ সৃষ্টি করতে এবং ওদের বিভক্তি বাড়িয়ে দিবে। বস্তুত তাই হয়েছে। নিশ্চিত বিজয়ী হওয়া যুদ্ধ থামিয়ে সন্ধি করায় আলী রা.-এর দলের মধ্য থেকে একদল প্রান্তিক লোক বের হয়ে যায় এবং আলী রা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা খারেজি হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে আলী রা. পুরো যুদ্ধেই উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে বুঝানোর জন্য প্রায় আট মাস সময় নিয়েছেন। মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে যখন পানির দখল ছিল তখন মুয়াবিয়া রা. আলীর দলকে পানি নিতে দেয়নি। অথচ আলী রা. যখন যুদ্ধ করে পানির দখল নিলেন তখন তাদেরকে পানি বিনা শর্তে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। বার বার যুদ্ধে এগিয়ে থেকেও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেননি। আমর ইবনুল আসকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছেন। হত্যা করেন নি। জেতা যুদ্ধ তাদের আহবানে বন্ধ করে দিয়ে সন্ধি করলেন। অবশেষে সেখানেও তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। অথচ কুরআনে সূরা আনফালের ৭২ নং আয়াতে কাফিরদের সাথেও 'চুক্তি ভঙ্গ' না করার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা আছে।

খুলাফায়ে রাশিদার ধারাবাহিক ইতিহাস #রাশিদুন_খিলাফত : পর্ব-৪৬

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন