২৫ জুন, ২০২৩

গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ যেভাবে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়!

ছবি: বাম থেকে শেখ মুজিব, শামসুল হক, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। ঘটনাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু'জনেই টাঙ্গাইলের। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন ঢাবিতে ভাংচুর চালানোর অপরাধে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে শামসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। অধিকাংশ ইতিহাস লেখক বলেছেন, ১৯৫৩ সালে কারামুক্তির পর ঘরোয়া ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করে; যার ফলশ্রুতিতে তিনি চিরকালের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ষড়যন্ত্রটি কী ছিলো তা বেশিরভাগ লেখক এড়িয়ে যান। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে কেউ ছিলো ইসলামপন্থী, কেউ ছিলো বামপন্থী আবার কেউ ছিলো সেক্যুলার। আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি মুসলিম দল থেকে সেক্যুলার দলে পরিণত করার ক্ষেত্রে একজন বাধা ছিলেন শামসুল হক।

শামসুল হক কারাগারে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব প্রচার করতে থাকেন শামসুল হক পাগল হয়ে গেছেন। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্থ। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করা। এটা ছিলো একটা মোক্ষম ফাঁদ। সকলে গিয়ে শামসুল হকের সাথে দেখা করেন এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলেই তিনি কারাগারে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন।

ভাসানীও এই ঘটনার ফায়দা নিতে থাকেন। তিনি মৌখিকভাবে শামসুক হককে বহিষ্কার করেন। তাহলে দলকে সেক্যুলার/বামপন্থী করার পথে বাধা আর থাকবে না। কারণ শামসুল হক অনেকটা ইসলামপন্থী ছিলেন। কারামুক্তির পর তার স্ত্রী আফিয়া সবার অব্যাহত প্ররোচনায় তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে শামসুল হক অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হন। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরে। ঘরে-বাইরে কাউকে বিশ্বাস না করে সব ছেড়েছুড়ে শামসুল হক নিরুদ্দেশ হন। এক পর্যায়ে সত্যিই তার মানসিক বিকার লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারে অনেক লেখক সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এই বিষয়ে সাংবাদিক গোলাম মহিউদ্দিন তার মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস বইতে বলেছেন,
কারামুক্ত শেখ মুজিব তখন কারাবাসী মওলানা ভাসানীর নিকট হতে নাকি অনুমোদন অর্জন করে আওয়ামী লীগের কর্ণধার হয়ে (সেক্রেটারীর পদে) বসেছেন। তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (টাঙ্গাইলবাসী) শামসুল হক নাকি তার মস্তিষ্ক বিকৃতির তথাকথিত রোগটির কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিলেন না। তাই তখন শেখ মুজিবকেই নাকি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো।

শেখ মুজিবের সেই কর্মতৎপর দিনগুলোতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নাকি অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় নিখোঁজ হন। জনাব শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুন এরপর হতে দেশে বিদেশে তার স্বামীর (শামসুল হকের) অন্তর্ধানের পিছনে শেখ মুজিবেরও কালো হাত রয়েছে বলে সারা জীবনকাল ধরে অভিযোগ করেছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কাজে আমরা যখন দেশে-বিদেশে সক্রিয় ছিলাম তখন ভারতের নয়া দিল্লীস্থ গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন হোস্টেলে আমাদের অস্থায়ী আবাসস্থলে মার্কিন মুল্লুকের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ভারতীয় বাঙালী হিন্দু অধ্যাপক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের কাজে সস্ত্রীক এসে আমাদের সঙ্গে ক'দিন ছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত বাঙালী সাংবাদিক-ব্রডকাস্টার প্রসুন মিত্রও আমাদের সঙ্গে সেখানে ছিলেন। সর্বপ্রথমের 'জয়বাংলা' (নওগাঁ) পত্রিকার প্রকাশক (আসলে ব্যাংকার) রহমতুল্লাহও তার কয়েক সপ্তাহের দিল্লীবাসকালে সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন।

উপরোক্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী অধ্যাপক বাবু প্রায়ই নিখোঁজ শামসুল হকের স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনের কথা আমাদের সামনে তুলতেন। উক্ত মিসেস আফিয়া খাতুনও তখনকার দিনে মার্কিন মুল্লুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার কাজে ছিলেন। সেখানেও তিনি তার স্বামী শামসুল হকের অন্তর্ধানের পেছনে শেখ মুজিবের কালো হাত থাকবার কথা উপরোক্তদের সবার নিকটেই বিশেষ জোরের সঙ্গেই বলে বেড়াতেন, হার্ভার্ড অধ্যাপকদের মুখে আমরা সবাই তা শুনতাম। এতে সেসব দেশে তাদের মুজিবকে হিরো বানাবার প্রয়াস নাকি বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, অধ্যাপক বাবু দু:খ করে বলতেন।

১৯৬৫ সালে তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছে বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। তার মৃত্যু কীভাবে ও কোথায় হয়েছে এই ব্যাপারে কেউ জানে না। সম্প্রতি কেউ কেউ বলছেন তার মৃত্যু ও কবর নাকি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে রয়েছে।

ভাসানী আওয়ামী লীগকে ধীরে ধীরে বামপন্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছিলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ডানপন্থীদের সাথে প্রায়ই তার মতবিরোধ দেখা দিতো। এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান।

একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর ১৩-১৪ জুন লীগের বিশেষ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব।

এরপর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব আইয়ুবের ষড়যন্ত্রে পড়ে ৬ দফা উত্থাপন করেন। তার এই ৬ দফার বিষয়টি কেউ জানতো না। সে আওয়ামী লীগের কারো সাথেই আলোচনা না করে ৬ দফা উত্থাপন করে। মূলত সে লাহোরে যায় আইয়ুবের তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর একটি মিটিং-এ যোগ দিতে। কিন্তু সেখানে তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে কথা না বলে মুজিব ৬ দফা উত্থাপন করে মূলত ঐ মিটিংটা ভেস্তে দিতে চেয়েছিলো।

আওয়ামী লীগের অধিকাংশই ৬ দফা মানে নি। দফাগুলোর সাথে তাদের বিরোধ অতটা না হলেও তাদের মূল বিরোধ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবের কারো সাথে পরামর্শ না করে এধরণের ঘোষণা কেউ মেনে নিতে পারে নি। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। এতে অন্যান্য মেম্বার সহ লীগ সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবল আপত্তির মুখে মুজিব ছয় দফা পাশ করাতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে ছয় দফার সাথে আওয়ামী লীগের লীগের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। হতাশ মুজিব তার শেষ অস্ত্র হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন।

এই প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সেসময় দুঃখভরা মন নিয়ে শেখ মুজিব আমাদের (ছাত্রলীগ) ডাকলেন। বললেন, আমি তো বিপদে পড়ে গেছি। আমারে তোরা কি সাহায্য করবি না? ছয় দফা বলার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আমার অপর এটাক আসছে। আমার তো এখন ঘরে বাইরে শত্রু। আমরা তখন বললাম নিশ্চয়ই আপনার পাশে থাকবো।

অবশেষে ফ্যাসিবাদী মুজিব ছাত্রলীগের গুন্ডাদের সহযোগিতায় সভাপতি তর্কবাগীশকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ছাত্রলীগের গুন্ডারা চ্যালাকাঠ নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস থেকে সভাপতি তর্কবাগীশ ও তার অনুসারীদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এরপর শেখ মুজিব নিজে নিজেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষণা করেন।

এরপর শেখ মুজিব নিজের দক্ষতায় ছয় দফাকে আওয়ামীলীগের মধ্যে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হন। একইসাথে নিজের ব্র্যান্ডিংটাও ভালোভাবে করতে পারেন। এভাবে তিনি আওয়ামীলীগের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। জোর করে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করার পর শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় আর কখনোই কাউন্সিল হয়নি।

আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের সমার্থক। এখানে মুজিব যা বলবে তা-ই আইন। শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেয়ার পরেও একই ঘটনা ঘটতে থাকে। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় শেখ মুজিবের জমিদারি। এখানে তার বংশের লোকই শেষ কথা। দলীয় প্রধান হাসিনার কথাই আইন।

মুসলিম লীগ ভেঙ্গে ইসলামবিরোধী আওয়ামী লীগের উত্থান

পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার কালে মোটাদাগে বাংলায় রাজনৈতিক দল ছিল দুইটি। এক মুসলিম লীগ, দুই কৃষক প্রজা পার্টি। ১৯৪৫-৪৬ সালের পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি অস্তিত্ব হারিয়েছে হিন্দুদের সাথে মিলিত হওয়ার দায়ে। একইসাথে বাংলার মানুষের কাছে ফজলুল হক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আইন পেশায় সময় দিতে থাকেন।

সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে নবগঠিত পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কারো প্রভাব ধর্তব্য ছিল না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। তাদের প্রভাবে দলের মধ্যে প্রায় কোণঠাসা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারীরা।
মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে ছিল মুসলিম লীগের একটি অফিস। সোহরাওয়ার্দিপন্থীরা দখল করে সেখানে আড্ডা দিত। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নির্দেশে তার অনুগত শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে এসে তাদের সাথে যুক্ত হন।

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে তারা প্রাথমিক সফলতা পায়। ছাত্রলীগে সোহরাওয়ার্দির অনুগতরা নেতৃত্ব পায়। শেখ মুজিব দক্ষতার পরিচয় দিয়ে অল্প সময়ে সব জেলাগুলোতে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে বাংলায় সোহরাওয়ার্দির ভিত্তি মজবুত হয়।

এদিকে ভাসানী এবং তার অনুসারীরা মুসলিম লীগকে সমাজতান্ত্রিক বামধারায় রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইসলামী চেতনাধারীদের তোপের মুখে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর কর্মস্থল আসাম ভারতের অধীনে হওয়ায় তিনিও ঢাকায় অনেকটা প্রভাবহীন অবস্থায় ছিলেন। তখন ভাসানী মুসলিম লীগ ছেড়ে অন্য দল তৈরি করার কথা ভাবছিলেন। ভাসানী টাঙ্গাইলের আরেক মুসলিম লীগ নেতা শামসুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বুঝান এবং তাকে সাথে রাখেন। ভাসানী আদর্শিক বিষয় গোপন রেখে বাঙালিদের নিয়ে আলাদা দল গঠনের উদ্যোগ নিতে থাকেন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সোহরাওয়ার্দির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা সবাই মিলে একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি হন ভাসানী আর সেক্রেটারি শামসুল হক। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। ঢাবিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভার্সিটিতে ভাংচুর করায় ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সেক্রেটারি জেনারেল হন মাহমুদুল হক ওসমানী। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত চারটি কাউন্সিলে পূর্ব পাকিস্তানের সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

আর দ্বিতীয় কাউন্সিল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে আবারো সভাপতি হন মওলানা ভাসানী ও সেক্রেটারি হন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা মূলত বাঙালিদের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এভাবেই ভাসানীর প্রত্যক্ষ প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মুসলিম চেতনা বিলুপ্ত করে বাঙালী জাতীয়তার বীজ রোপিত হয় এবং ফ্যাসীবাদী দল আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।

ভাসানী এই দলটিকে মুসলিম লীগ বিরোধী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা বাঙালিদের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করে। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশে আওয়ামী যুবলীগ সকল বিরোধীদলের ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরুতেই ‘গণতান্ত্রিক দল’ ও ‘আওয়ামী লীগ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দও মুসলিম লীগ বিরোধী জোটের জন্য কাজ করতে থাকে।

যেহেতু অনেক মুসলিম লীগ এমপি দল পরিবর্তন করে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছে তাই পূর্বপাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন ভাসানী। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলেও তার সাথে ভাসানী-শেখ মুজিবের দন্দ্বে প্রাদেশিক সরকার টিকে নি। বার বার মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে ও ভেঙে পড়েছে।

১৯৫৫ সালের কাউন্সিলের অনেক আগ থেকেই মওলানা ভাসানী চাচ্ছিলেন দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে। কিন্তু এতে সম্মত ছিলেন না দলের কেন্দ্রীয় প্রধান বা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এবিষয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসিকে বলেন, ”মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য জোর দিচ্ছিলেন, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুন। কারণ তার ভয় ছিল, এটা বাদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে”। অবশেষে ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ভাসানী ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়।

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন করে। এতে কেন্দ্রীয় সংসদে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এর মাধ্যমে ভাসানীর দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে ক্ষমতার শীর্ষে চলে যায়। সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। মাওলানা ভাসানী সোহরাওয়ার্দিকে আমেরিকাকে বন্ধু না বানিয়ে চীনকে বন্ধু বানানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ আওয়ামীলীগ ও পাকিস্তানী রাজনীতিবিদেরা কম্যুনিস্টদের অপছন্দ করতো বিধায় সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। মাওলানা ভাসানী নিজ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। বলাবাহুল্য আওয়ামী লীগে ভাসানীর চাইতে সোহরাওয়ার্দির প্রভাব বেশি ছিল।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। যদিও এই আন্দোলনে তার দলের সাপোর্ট তিনি ভালোভাবে পাননি। মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় ইসলামী রিপাবলিকের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।

একইসঙ্গে কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগ অল্প সময়ের সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামল শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে পার্টির অভ্যন্তরে কোন্দল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় থেকেই অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী এই পার্টিতে ঢুকে পড়ে। পার্টির এই অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করে। মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে তা পার্টির মেনিফেস্টো বিরোধী। এভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্নমতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়।

এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় ভাসানী বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে।

এই সালাম নিয়ে আমাদের দেশে জনপ্রিয় কথা চালু আছে ভাসানী নাকি পাকিস্তানী শাসকদের সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়েছেন। আসলে এই কথাটি তিনি বাঙালি ও নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। এই কথাটি যখন তিনি বলেন তখন পাকিস্তান কেন্দ্রের সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল। ভাসানী ক্ষমতাসীন দলের ২য় প্রভাবশালী নেতা। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাওয়ার্দি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছে এটা হচ্ছে ভাসানীর রাজনৈতিক মিথ্যে কথা। সে এর মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি বিশেষত আওয়ামীলীগের লোকদেরকে সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে চেয়েছিলো।

মূলত কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। এই চুক্তিতে চীন নাখোশ হয়েছে। চীনের খুশি বা অখুশিই ভাসানীর খুশি বা অখুশি। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইসলামিক রিপাবলিকের ব্যাপারেও ভাসানীর আপত্তি ছিলো। এতে সংখ্যালঘুদের অধিকারহরণ হবে বলে তিনি মনে করতেন। ভাসানী তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ভাসানী কাগমারি সম্মেলন করেছে মূলত চীনের চাপে।

কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী মাসখানেক পরে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। ন্যাপ গঠনের পর প্রাদেশিক পরিষদের ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে ন্যাপে যোগ দেন।

১৯৬৩-র মার্চ মাসে ভাসানী আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। তিনি আইয়ুব ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ভাসানী ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর সাথে যুক্ত থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ও আইয়ুবকে জিতিয়ে দেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের চীন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।

যেভাবে আওয়ামীলীগ সৃষ্টি হয়!


২৩ জুন আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এটা ছিল বাঙালি জাতির জন্য ট্রাজেডি। এর ২৬৬ বছর আগেই একই দিনে আরেকটি ট্রাজেডি ঘটে মুর্শিদাবাদে। এদিন বাংলা পলাশীর যুদ্ধ জিতে বাংলা দখলে নেয় ইংরেজরা। সেই থেকে আমাদের জিল্লতি শুরু। আজ আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবো।

আওয়ামী লীগ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ছাত্রলীগ গঠন। তাই প্রথমে সেই বিষয়টিই সামনে আনি। ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর দেশে একটিই ছিল উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। আর সেটা মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের বাংলা অংশের দুই শীর্ষ নেতা হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকার নেতা আর সোহরাওয়ার্দি কলকাতার নেতা। হিন্দুস্থান ভাগ হলে কলকাতা ভারতের অংশে পড়ে। ফলশ্রুতিতে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। ঢাকায় তার প্রভাব তেমনটা ছিল না।

যেহেতু তিনি ছিলেন বাঙালি তাই তিনি বাংলায় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। সেজন্য তিনি তার অনুগত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কলকাতার ছাত্রদের একটা অংশকে ঢাকায় অবস্থান নিতে বলেন। বাংলায় তথা উপমহাদেশে মুসলিমদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির গোড়া পত্তন করেন জিন্নাহ।

১৯৩২ সালে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত করে মুসলিম লীগ। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর এবং জিন্নাহর নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম লীগের বিস্তার ঘটলে ছাত্ররা মুসলিম লীগ নেতাদের অনুগামী হয়ে ওঠে। কলকাতায় ইস্পাহানি ও ঢাকায় খাজাদের ভবনগুলি ছাত্রদের ওপর মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পূর্ববাংলার মুসলিম ছাত্রদের ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। ঢাকার নবাব ছিলেন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক। মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক যোগদান নিশ্চিত করেছিল।

স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। এর নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। শেখ মুজিবরা ছাত্রদের ওপর থেকে শাহ আজিজের প্রভাব কাটাতে চেয়েছেন। তাই তারা এই দল ভেঙে আরেকটি ছাত্রসংগঠন করার কথা ভাবছিল। এখানে আদর্শের কোনো ইস্যু ছিল না। বরং সোহরাওয়ার্দি ও খাজা নাজিমুদ্দের দন্দ্ব কাজ করেছে। অন্যদিকে তখন কমিউনিস্টদের ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বাংলায় ছাত্রদের মধ্যে এর ভালো বিস্তার হয়েছিল। তারাও চেয়েছে আরেকটি সংগঠন করতে। বামরা আগে থেকেই সংগঠিত হতে চেষ্টা করেছিল। এদের গুরু ছিল লাল মাওলানা হামিদ খান ভাসানী ও কলকাতার আবুল হাশিম।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিম লীগের বামধারার কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় ‘গণআজাদী লীগ' নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এ সংগঠনের আহ্বায়ক মনোনীত হয় ঢাকার মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কর্মী কামরুদ্দিন আহমদ। এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। তারা মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন এবং এ দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার চিন্তা করেছিলেন।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী কাজ কী হবে তা আলোচনার জন্য কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে সমবেত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ। তারা পাকিস্তানে বাম সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার জন্য উপযুক্ত সংগঠন তৈরি করা দরকার বলে একমত হন। ঢাকায় এসে তারা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, তসন্দুক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নূরুদ্দীন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য একটি সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে একমত হন।

ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি বাম সংগঠন তখনো ছিল। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে মুসলমান ছাত্ররা তাতে যোগ দিতে চাইতেন না।

মুসলমান ছাত্ররা অনেকেই এত দিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নেন। সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের অনুসারী ছিলেন। কাউন্সিল সভার মাধ্যমে এই সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। কারণ বেশিরভাগই ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের অনুসারী। কলকাতার মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের অনুসারী তরুণ ও ছাত্ররা নতুন একটি ছাত্রসংগঠন তৈরির কথা ভাবলেন। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে একটি ছাত্র-কর্মী সভা ডাকেন।

ঘটনাচক্রে ওই দিন ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমুল করিম সেখানে উপস্থিত হলে তাকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হয়। সবাই একমত হয়ে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মানে আগের দলের অল বেঙ্গল নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করেছে মাত্র। দুই দলেরই কমন নাম মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। রাজশাহী থেকে আসা নইমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়।

সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রথম কমিটির অন্যতম সদস্য অলি আহাদের ভাষ্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকায় ছিলেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সাংগঠনিক কমিটিতে তাহার অন্তর্ভুক্তি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিবেন এবং তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা অনীহা প্রকাশ না করিয়া বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন উল্লেখ্য যে অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। বলিয়া প্রচার করিতেছেন ইহা ইতিহাসের বিকৃতি মাত্র। ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের তরুণ কর্মীরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প' করেছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস করা হলো এখানেই। শেখ মুজিব কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে এখানেই থাকতেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে : ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভেতর আমি প্রায় সব জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমুদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সবকিছুই আমাকেই করতে হতো। নতুন একটি ছাত্র সংগঠন তৈরির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে ১৯৪৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন শিরোনামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির ১৪ সদস্যের নামে প্রকাশিত প্রচারপত্রে ধারণা দেওয়া হয়, ছাত্রসংগঠনে কোনো অছাত্র থাকতে পারবে না এবং ছাত্রসংগঠন দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেবে না।”

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করার সময় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ মুসলিম শব্দটি সংগঠনের নামের সঙ্গে ব্যবহার করার বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম' শব্দটি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ওই মুহূর্তে এটা রাখা দরকার। তা না হলে মুসলিম লীগ সরকার তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে। এ জন্য কেউ কেউ শেখ মুজিবকে সাম্প্রদায়িক বানানোরও চেষ্টা করেছেন। যদিও শেখ মুজিব এটা কৌশল হিসেবেই নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিল : এখনো সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই যায়-আসে না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।”

এভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে শুরু থেকেই এলাকাগত দ্বন্দ্ব ও বামাদর্শের লোকেরা জাতিকে বিভক্ত করতে থাকে। এর প্রাথমিক কার্যক্রম হিসেবে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন হয়। সারাদেশে বাঙালির স্বার্থ দেখা ও মুসলিমদের উম্মাহ চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগে উগ্র জাতিবাদী ও কমিউনিস্টদের সম্মিলন হতে থাকে।

ছাত্রলীগ ভেঙে সফলতা পাওয়ায় মুসলিম লীগের বড় নেতারা এবার নিজেরাই মুসলিম লীগ ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে। অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম ও হামিদ খান ভাসানী এবার মুসলিম লীগ ভাঙার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ১৯২৪ সালে মুসলিম উম্মাহর আবেগের স্থান ও উম্মাহ চেতনার কেন্দ্রবিন্দু তুর্কি খিলাফত ভেঙ্গে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার একই চেতনার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান গঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতাবাদী, জাতিবাদী ও কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় সেই উম্মাহ চেতনার বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। এই বিকৃতির অগ্রনায়ক ছিল সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম ও হামিদ খান ভাসানী। আর তাদের পাইলট প্রজেক্ট ছিল ছাত্রলীগ।

২২ জুন, ২০২৩

"অতএব পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না"


আমরা যারা ইসলামী আন্দোলন করি, আমরা নঈম সিদ্দিকীর 'চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান' প্রবন্ধটি পড়েই বড় হয়েছি। এখানে লেখক জোর দিয়েছেন কীভাবে আমরা আমাদের চরিত্র ঠিক রাখবো। আর চরিত্র ঠিক রাখা মানে হলো ইসলামী আন্দোলনে টিকে থাকা বা ইসলামকে গালিব করার জন্য কাজ করা। 

চরিত্র নষ্ট বলতে লেখক বুঝিয়েছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হওয়া। উনি যেসময় লেখাটি লিখেছিলেন তখন ওনার দৃষ্টিতে দুটি কারণ ধরা পড়ে চরিত্র নষ্ট হওয়া তথা হকের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার। 

উনি বলতে চেয়েছেন যখন কোনো মানুষ ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে তখন শয়তান ঐ মানুষের প্রতি তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তাকে দুইভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। 

প্রথমত তাকে দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লোভ দেখায়। যেটাকে নঈম সিদ্দিকী বলেছেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপূজারী সভ্যতার হামলা। 

দ্বিতীয়ত তাকে সাম্যবাদী সমাজের নামে ইসলামবিমুখ করার চেষ্টা করে। যেটাকে লেখক বলেছেন সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা। 

বইটি লেখার প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমান সমাজে শয়তানের এই দুটি আক্রমণের মধ্যে ১ম টি প্রবলভাবে অব্যাহত আছে এবং এটি আজীবন থাকবে বলে মনে করি। কারণ এর মাধ্যমে বেশিরভাগ ঘায়েল হয়েছে ও হচ্ছে। মানুষ বরাবরই সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতার কাঙ্গাল। এটি মানুষের কমন ফিতরাত। নফসের চাহিদাও তাই। ফলে বেশিরভাগ মানুষ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শয়তানের ধোঁকায় পড়ে। 
 
সমাজতন্ত্র সেসময় ট্রেন্ডি আদর্শ ছিল। মুসলিম যুবকরা কম্যুনিস্টদের কবলে পড়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তারা কিন্তু আদর্শের জন্য ডেডিকেটেড ছিল। যেহেতু তারা আদর্শের জন্য উন্মূখ ছিল তাই ওদের চেয়ে ভালো আদর্শ উপস্থাপন করতে পারলেই সমস্যা কেটে যাবে। জামায়াতে ইসলাম উপমহাদেশে সেই ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামকে সঠিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছে। ফলে বহু কমিউনিস্ট নেতা তওবা করে সঠিক মুসলমান হয়েছে। 

কমিউনিস্টদের আদর্শ বিশ্বব্যাপী মার খাওয়ায় সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা ষাটের দশকের চেয়ে অনেক অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু এই স্থান দখল করে নিয়েছে সেক্যুলারিজম। তারা ইসলাম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে দিয়েছে। ফলে একশ্রেণির মুসলিম তৈরি হচ্ছে যারা পার্সোনালি ইসলামকে ভালোবাসে। নামাজ রোজা করে কিন্তু রাষ্ট্র থেকে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করতে সচেষ্ট তো থাকেই না। উল্টো রাষ্ট্রকে ইসলামী কানুন থেকে আলাদা রাখতে চায়। 

আজকে আমার আলোচনা আমাদের চারিত্রিক পুঁজিকে কেন্দ্র করে। নঈম সিদ্দিকীর লেখা থেকে বুঝতে পারি, সেসময় এক টাইপের মুসলিম পাওয়া যেত, যারা চরিত্র নষ্ট হওয়ার ভয়ে রাজনীতি করতেন না, দাওয়াতী কাজ করতেন না। নিজের যৎসামান্য ঈমানের পুঁজি নিয়ে নিজের মধ্যেই আবদ্ধ থাকতেন। 

তাদের ব্যাপারে নঈম সিদ্দিকী বলেন, চরিত্রের যে ‘মূলধন’কে ক্ষতির আশঙ্কায় হামেশা সিন্দুকের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় এবং যা হামেশা অনুৎপাদক (Unproductive) অবস্থায় বিরাজিত থাকে, সমাজ জীবনের জন্যে তার থাকা বা না থাকা সমান। 

মুসলমান নারী-পুরুষ এবং মুসলিম দলের নিকট চরিত্র ও ঈমানের কিছু ‘মূলধন’ থাকলে তাকে বাজারে আবর্তন (Circulation) করার জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারপর মূলধন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যোগ্যতা থাকলে সে মূলধন লাভসহ ফিরে আসবে, আর অযোগ্য হলে লাভ তো দূরের কথা আসল পুঁজিও মারা পড়বে। কিন্তু বাজারে আবর্তিত হতে থাকার মধ্যেই পুঁজির স্বার্থকতা। অন্যথায় যত অধিক পরিমাণ পুঁজিই জমা করা হোক না কেন তা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য।

বাজারে আবর্তন করেই পুঁজি বিকিয়ে দেওয়া যাতে না হয় সেজন্য তিনি বলেছেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ যখন তাদের চরিত্র ও ঈমানের ন্যূনতম পুঁজি এ পথে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তখন একে কেবল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই নয়, বরং দেশ ও জাতির এবং আমাদের নিজেদেরকেও এ থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

যাই হোক, তত্ত্বগত আলোচনা বাদ দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল কিছু কথা বলি। 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় পুঁজি কী?
জামায়াতের ধর্মীয় পুঁজি হলো, এদেশে আল্লাহর আইন কায়েম করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে গালিব করা, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের জনপ্রিয় স্লোগান হলো,
আল্লাহর আইন চাই
সৎ লোকের শাসন চাই 

জনগণ আমাদেরকে এই কারণে পছন্দ করবে যে, আমরা ইসলামকে বিজয়ী করার জন্যই কাজ করছি। আমরা যদি ইসলামের চাইতে অন্যান্য বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেই তবে আমরা পুঁজি হারাবো। সেটা যতই ভালো কাজ হোক না কেন! যেমন আপনি মানুষকে যদি বলেন, জামায়াতে যোগ দিন, জামায়াত দেশ শাসন করলে প্রচুর উন্নয়ন করে দেশকে উন্নত রাষ্ট্র করে দিবে। আপনাদের পয়সাওয়ালা বানিয়ে দেবে। 

উন্নয়ন করা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি চান বা না চান এটা হবেই। মানুষ এই কারণে জামায়াতকে গ্রহণ করবে না। যদি উন্নয়নই শেষ কথা হয়, তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিই করা উচিত। জামায়াতের দরকার নেই। 

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি থাইল্যান্ডের কথা। থাইল্যান্ড পর্যটন শিল্পকে তাদের প্রধান রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস বানিয়েছে। মদ, ক্যাসিনো, পতিতাবৃত্তিসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে তারা পর্যটকদের কাছে টানে। এর মাধ্যমে তারা সম্পদশালীও হয়েছে। 

জামায়াতের কাছে যদি বস্তুগত উন্নয়নই শেষ কথা হয় তবে নঈম সিদ্দিকীর ভাষ্যমতে আমরা চরিত্রহীন হয়ে পড়বো। অতএব জামায়াতের প্রথম ও প্রধান পুঁজি ইসলাম প্রতিষ্ঠা। আমরা যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কম বলে উন্নয়নের কথা বেশি বলি তবে বুঝতে বাজারে আমাদের পুঁজি মাঠে মারা যাবে। বেশি লাভ করতে যেয়ে আমরা যাতে পুঁজি হারিয়ে না বসি। 

আপনি যদি জনগণকে উন্নয়ন শেখান তবে সে এর জন্য জামায়াতের কাছে আসবে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াতের রাজনৈতিক পুঁজি হলো ভারত তথা মুশরিকদের বিরোধীতা। 

এই অঞ্চলে ইসলামপন্থী/ তাওহীদপন্থী রাজনীতির এটাই হলো বেসিক কথা। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস হলো একত্ববাদ ও বহুঈশ্বরবাদের দ্বন্দ্ব। সেই দ্রাবিড় ও আর্যদের দ্বন্দ্ব। 

বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সমর্থন দেবে এইজন্য যে, আমরা মুশরিকদের সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যবাদীতা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করবো। যদি আমরা ভারত ও ভারতীয় এজেন্ডাকে ঔন করি, তাদের এজেন্ডাকে নিজেদের এজেন্ডা মনে করি তবে জামায়াতের এই দেশে দরকার নেই। 

কারণ ভারত ও ভারতের এজেন্ডার পক্ষে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ আছে। ভারতীয় এজেন্ডার জন্য আওয়ামী লীগ হচ্ছে উত্তম চয়েস। জামায়াত যদি ভারত বিরোধীতা ছেড়ে দেয় তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত অপ্রাসঙ্গিক। দরকার নেই।   

অতএব, জামায়াতের নেতা কর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান। পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না। আপনি কী পুঁজি নিয়ে নামছেন তা আপনার জানা থাকা দরকার। আপনি যদি মনে করেন, আপনার পুঁজি দিয়ে কাজ হবে না। আওয়ামীলীগের পুঁজি ধার করতে হবে তবে আমার বিনীত অনুরোধ, ভালো হয় আপনি আওয়ামী লীগ করেন। জামায়াত করার দরকার নেই। 

আন নাহদা পার্টির কথাই ধরুন। জনপ্রিয় হয়ে ক্ষমতায় আসলো। পশ্চিমা সুশীল সমাজ তাদের বিভিন্ন ইস্যুতে সমালোচনা করলো। বিরোধীরা তাদের সেকেলে বললো। অমনি তারা নিজের পুঁজির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললো। ধার করলো সেক্যুলারদের পুঁজি। এখন ক্ষমতাও হারালো, জনসমর্থনও হারালো।

জামায়াত এতো এতো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদালত থেকে রায় নিয়ে নিকৃষ্ট সব অভিযোগে ফাঁসি দিয়েছে জামায়াত নেতাদের। অনেকে ভেবেছে এর ফলে জামায়াতের সমর্থকরা লজ্জায় জামায়াত ছেড়ে দেব। কিন্তু দেখুন, জামায়াত মোটেই তার সমর্থন হারায়নি। বরং সিম্প্যাথি নিয়ে জনসমর্থন গেইন করেছে। এর বড় কারণ তারা পুঁজি ধরে রেখেছে। 

এখন যদি বহিঃবিশ্বের সুবিধা হাসিল করার জন্য নিজের পুঁজি বিকিয়ে দেয় তবে জামায়াত সব হারাবে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, আল্লাহ তায়ালা জামায়াতকে বহুবার মর্যাদার সাথে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে সবসময় বাঁচাবে। জামায়াত যদি নিজেদের চরিত্র নষ্ট করে, নিজেদের পুঁজি বিকিয়ে দেয়, তবে বাংলাদেশে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই অন্য আরেকটি তাজদিদি দল প্রতিষ্ঠা করবেন। 

এটা আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা। তিনি সূরা তাওবার ৩৯ নং আয়াতে এই ওয়াদা করেছেন। অতএব পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না। চরিত্র নষ্ট করবেন না।


২১ জুন, ২০২৩

অলি আহমদ থেকে রেজা কিবরিয়া : কে এই মাসুদ করিম


সম্প্রতি আমেরিকার ভিসা নীতি ঘোষণা হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতি দ্রুতই বাঁক নিচ্ছে। ভিসা নীতিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত একটি সফল সমাবেশ করে জানান দিলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। গত ডিসেম্বর থেকে বিএনপি একরকম প্রকাশ্যই জামায়াতকে বর্জন করে চলেছে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে জামায়াত যোগ দিতে চাইলেও বিএনপি নিষেধ করে। শুধু প্রকাশ্য সমাবেশ নয়, ঘরোয়া মিটিংগুলোতেও জামায়াতের সাথে সব রকম সম্পর্ক অস্বীকার করে বিএনপি। 

জামায়াত এই বছরের শুরুর অন্তত দুই মাস বিএনপির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিএনপি পাত্তা দেয় না জামায়াতকে। জামায়াতকে ব্রাত্য করে রাখার একটি অপপ্রয়াস চালায় বিএনপি। এর নেপথ্যে কে বা কারা কাজ করছে তা বলা মুশকিল। তবে আমার জানা মতে ও বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে বিএনপির মধ্যে থাকা বামপন্থীরা মূলত এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দিয়ে তদস্থলে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদকে কাছে টানার চেষ্টা করে। মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রচেষ্টার একজন গুরুত্বপূর্ণ হোতা বলে মনে করা হচ্ছে।  

জামায়াতের ১০ জুনের সমাবেশ জামায়াতকে আবার রাজনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনে। জামায়াত আবারো প্রাসঙ্গিকতা পায়। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি উভয়েই এই ফ্যাক্টর কাজে লাগাতে চাইছে। জামায়াত নিয়ে তাই মিডিয়া পাড়াতে হইচই পড়ে যায়। এই হইচই-এর মাঝে নতুন করে আলচনার জন্ম দেয় গণঅধিকার পরিষদ। সেখানে রেজা কিবরিয়া ও নূরুল হক নূরু পরস্পরকে বহিষ্কার করে।  

এর নেপথ্যে কী? 
এর নেপথ্যে বিএনপি। বিএনপি'র চাপে গণঅধিকার পরিষদ থেকে রেজা কিবরিয়াকে বের করে দেওয়া হয়। প্রথমত রেজা কিবরিয়া আওয়ামী লীগ থেকে আসা। দ্বিতীয়ত তিনি ডিজিএফআই-এর সোর্স মাসুদ করিমের সাথে সম্পৃক্ত। এই পর্যন্ত বিএনপি তাদের মধ্যেকার যারাই মাসুদ করিমের সাথে সম্পর্ক রেখেছে তাদের বহিষ্কার করেছে। সমমনা অর্থাৎ আওয়ামী বিরোধীদের মধ্যে যারা মাসুদ করিমের সাথে যুক্ত থেকেছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকেছে। 

এর শুরুটা হয়েছে অলি আহমদ থেকে। ২০১৮ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে বিদেশের মাটিতে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। বিনা ভোটে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় তৎপর বিভিন্ন দলের প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা এসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করছেন। পত্র-পত্রিকায় অংশগ্রহণকারীদের নাম প্রকাশ পেলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।  

বিদেশে এসব বৈঠক আয়োজনের নেপথ্য কারিগর হলেন মাসুদ করিম নামের লন্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশী। তার সাথে পশ্চিমা একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সখ্য রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়। তার আরেক নাম এনায়েত করিম। তিনি একসময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরে বিএনপি সরকারের আমলেই জেল খাটেন। একসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা ছিলেন। মাসুদ করিমের সাথে নেপাল-থাইল্যান্ডে এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদের একাধিক বৈঠক হওয়ার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। 

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করে হঠাৎ তৎপর হয়েছিলেন অলি আহমেদ। এর নেপথ্যেও ছিল মাসুদ করিম। তিনি অলি আহমদসহ বিএনপির একাধিক নেতাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তনের স্বপ্ন দেখান। মাসুদ করিম তাঁদের কাছে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী সংস্থার লোক বলে পরিচয় দেন।

মাসুদ করিমের নেপথ্য তৎপরতায় অলি আহমদ জাতীয় মুক্তি মঞ্চ গঠন করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। তখন মাসুদ করিমের সঙ্গে ব্যাংকক ও নেপালে একাধিক বৈঠকও করেন তিনি। ওই সব বৈঠকে বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতা অংশ নেন।

তার এই আন্দোলনের সময় জামায়াতকে তিনি তার সাথে নেন। জামায়াত যখন বুঝতে পারে এর ফান্ডিং বাইরে থেকে আসছে তখন জামায়াত সতর্ক হয় ও সরে আসে। 

একপর্যায়ে অলি আহমদ নিজ দল এলডিপির কেন্দ্রীয় এক নেতার সঙ্গে মাসুদ করিমের পরিচয় করিয়ে দেন। ওই নেতা তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী। অলি আহমদ তাঁকে বলেন, মাসুদ করিম প্রভাবশালী ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি শাখার সঙ্গে তাঁর সখ্য আছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য কিছু নির্দিষ্ট পোশাকের অর্ডার পেতে মাসুদ করিম তাঁকে সহায়তা করতে চান। কিন্তু এর জন্য আগে কারখানাকে তালিকাভুক্ত হতে হয়। জামানত হিসেবে জমা দিতে হয় এক লাখ মার্কিন ডলার। ওই ব্যবসায়ী এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান। একপর্যায়ে মাসুদ করিম নিজে ৫০ হাজার ডলার দেবেন এবং বাকি ৫০ হাজার ডলার ওই ব্যবসায়ী থেকে নিয়ে তালিকাভুক্ত করানোর প্রস্তাব দেন।

তিনি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে অলি আহমদকে ৫০ হাজার ডলার সমপরিমাণ ৪৩ লাখ ১০ হাজার টাকা দেন। অলি আহমদ সেই টাকা মাসুদ করিমকে পাঠান। কিন্তু পোশাকের কোনো অর্ডার তিনি পাননি। পরে তিনি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য অলি আহমদকে চাপ দেন। একপর্যায়ে তিন চেকে টাকা ফেরত দেন অলি আহমদ। এ নিয়ে তিক্ততায় ওই ব্যবসায়ী এলডিপি ছেড়ে দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওই ঘটনার পর অলি আহমদ চুপসে গেছেন।

গত সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি যখন রাজনীতিতে পর্যুদস্ত, তখন ২০১৯ সালের জুনে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করে অলি আহমদ মধ্যবর্তী নির্বাচন ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তোলেন। দুটি দাবিই বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয়। কিন্তু বক্তৃতা-বিবৃতিতে অলি আহমদ বিএনপির নেতৃত্বের সমালোচনা শুরু করলে নেতারা সতর্ক হন। একপর্যায়ে দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির মঞ্চের কর্মসূচি এড়িয়ে চলতে বলা হয়। 

মাসুদ করিম যখন দেখলো বিএনপি ও অলি আহমেদের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি হয়েছে তখন অলি আহমেদকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় মাসুদ করিম। এটাই ছিল মাসুদের এসাইনমেন্ট।  

২০১৯ ও ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আচমকা দুটি বড় জমায়েত করা হয়। দুটি কর্মসূচিতে হঠাৎ রাস্তা অবরোধ করে কয়েক হাজার লোক বিক্ষোভ শুরু করে। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সামনের বিক্ষোভে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানানো হয়। গত ১৩ ডিসেম্বরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভের সুর ছিল সরকারের পতন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দুটি বিক্ষোভের সংগঠকেরা কর্মীদের ধারণা দিয়েছিলেন, এই বিক্ষোভে বিভিন্ন দিক থেকে লাখো মানুষ যুক্ত হবে। সেখান থেকেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা হবে।

এই দুই কর্মসূচির পেছনে বিএনপির একাধিক নেতার যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এতে আর্থিক সহায়তা দেন বিএনপির সাবেক ধনাঢ্য এক নেতা। যিনি ২০১৯ সালের শেষ দিকে বিএনপি থেকে ইস্তফা দেন। এই দুই কর্মসূচির সঙ্গেও মাসুদ করিম এবং দেশের বাইরের একটি মহলের যুক্ততা ছিল বলে জানা যায়। এর রেশ ধরেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে নোটিশ দেওয়া হয়। এর সুত্র ধরে শওকত মাহমুদ এখন বহিষ্কৃত।  

শওকত মাহমুদ বলেন, তিনি মাসুদ করিমকে চেনেন। মাসুদ করিম একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাঁর ভালো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে। ঢাকায় বড় ধরনের বিক্ষোভ আয়োজনের লক্ষ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি বৈঠকে অংশ নেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মনির হোসেন কাসেমী। তিনি গত জাতীয় সংসদে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম থেকে ২০–দলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন।

প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে মনির হোসেন কাসেমী বলেন, ‘আমি হুজুরের (প্রয়াত নূর হোসাইন কাসেমী) নির্দেশনায় ব্যাংককে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর এটাকে আমার কাছে কার্যকরী কিছু মনে হয়নি।’ 

রাজপথে যখন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পুলিশ একবারেই দাঁড়াতে দিচ্ছিল না ঠিক তখন কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে হাইকোর্টের সামনে কয়েক শ’ লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এতে আদালতসংলগ্ন এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। নজিরবিহীনভাবে দায়িত্বরত পুলিশ নীরব ছিল। 

একইভাবে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্টন মোড়-মুক্তাঙ্গন এলাকায় সহস্রাধিক লোকের আকস্মিক অবস্থান গ্রহণ এবং সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ডাক দেয়া হয়। চলতি বছরের ২৭ মার্চ পেশাজীবী সমাজের ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েক হাজার লোক দিনব্যাপী অবস্থান গ্রহণ করলে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। 
হাইকমান্ডের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই বিএনপির কিছু নেতা এই কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। অপর দিকে, হাই কমান্ড নিজস্ব দলীয় চ্যানেলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এসব কর্মসূচি বর্জনের নির্দেশ দেয়। উল্লিখিত সব কর্মসূচিই ছিল মারমুখী। কিন্তু রহস্যের ব্যাপার হলো, পুলিশ একটি কর্মসূচিতেও বাধা দেয়নি, কাউকে গ্রেফতার কিংবা কারো বিরুদ্ধে মামলাও করেনি।

উল্লিখিত কঠোর কর্মসূচিগুলো সফলভাবে পালনের ফলে এক শ্রেণীর বিএনপি নেতা-কর্মীর মধ্যে সরকার পতন আন্দোলনের ব্যাপারে মূল নেতৃত্বের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ব্যাপারে সংশয় ও দোদুল্যমানতা দেখা দেয়। তবে দলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি পালনকারী বিএনপি নেতাদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে হাইকমান্ড। 

বিএনপি নেতৃত্বের দৃঢ়বিশ্বাস সরকার ও সরকারের সমর্থক গোষ্ঠী তাদের দূর থেকে মদদ দিচ্ছে। এই মহলটি দীর্ঘদিন যাবৎ জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে সংশয়, অবিশ্বাস ও বিভাজন সৃষ্টিতে তৎপর। এদের মূল লক্ষ্য সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন। তাই তারা কৌশলে সরকারের পক্ষ হয়ে সরকার হঠানোর নামে মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

মাসুদ করিমের উদ্দেশ্য হলো, বিরোধী দলগুলো বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত করে মূলত সরকারের হাতকেই শক্তিশালী করা। এজন্য অলি আহমদ, বিএনপির কয়েক ডজন নেতা, হেফাজতে ইসলাম ও সর্বশেষ রেজা কিবরিয়াকে হাত করে মাসুদ করিম। 

মাসুদ করিম নামের ঐ প্রবাসী আমেরিকান বাংলাদেশী ব্যাংককে ও কাঠমান্ডুতে বেশ কয়েকটি সম্মেলন আয়োজন করেছিল। তিনি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার পরিচয় দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতাদের বিভ্রান্ত করলেও মাসুদ করিম ওরফে এনায়েত করিম আসলে বাংলাদেশের সরকারী গোয়েন্দা সংস্খা ডিজিএফআইর পেইড এজেন্ট। মেজর জেনারেল খালেদ মামুন শেখ হাসিনা সরকারের ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক থাকতে মাসুদ করিমকে রিক্রুট করা হয়। 

এরপর থেকে মাসুদ করিম সিএইএর পরিচয় দিয়ে বিএনপির ওপরে কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে তাদেরকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে, সিআইএকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে দখলদার হাসিনা সরকারের পতন ঘটাকে সক্ষম হবেন। সরকার নামানোর কথা বলে মাসুদ প্রায়শই বাংলাদেশী কিছু পলিটিশিয়ানদের নিয়ে দেশে বিদেশে মিটিং করেন। অনেককে টাকা পয়সা ও বিমানের টিকেটও দেন। 

এই বিষয়টি বিএনপি'র হাইকমান্ড উপলব্ধি করতে পারেন এবং এর ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেন। দলের যেসব নেতা মাসুদের সাথে সম্পর্ক রেখেছিল তাদের দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। রেজা কিবরিয়ার ব্যাপারেও একই কাজ করে বিএনপি। 

নূরুল হক নূরুদের বিনএপি বুঝাতে সক্ষম হয় যে, মাসুদ করিম একজন সরকারি গোয়েন্দা। বিরোধী দলকে মিসগাইড করাই তার কাজ। এই কারণে রেজা কিবরিয়াকে সতর্ক করতে বলে নূরুদের। নূররা রেজা কিবরিয়ার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে রেজা কিবরিয়া বিষয়টি এড়িয়ে যান। এরই প্রেক্ষিতে বিএনপির পরামর্শে রেজা কিবরিয়াকে দল থেকে সরিয়ে দেয় গণঅধিকার পরিষদ।