৩০ সেপ, ২০২৩

উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস (১ম পর্ব)

বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে ইংরেজ শাসনের হাত ধরে। ইংরেজ শাসনের আগে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থাকলেও ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন হয়নি। এর বেসিক কারণ উচ্চশিক্ষা তখন কোনো বৈষয়িক লাভজনক কাজ ছিল না। শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন ও মানবসেবাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্র খুব এভেইলেবল ছিল না। অর্থনীতি ছিল কৃষি ও ব্যবসাভিত্তিক। আর এই দুই কাজের জন্যই উচ্চশিক্ষা প্রয়োজনীয় ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা শেষেই সাধারণত ছাত্ররা নিজ নিজ কর্মে আত্মনিয়োগ করতো।[১]

ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা উচ্চশিক্ষাকে লাভজনক ও অর্থ উপার্জনের নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, সরকারি চাকুরি, ব্যবসায়িক সুবিধা, ইংল্যান্ডে আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতছানি, জমিদারি, ভূমির অধিকারসহ প্রতিটি নাগরিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণকে শর্ত করে দেওয়া হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হয়। এটি আর আগের মতো মানবসেবা বা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে হয়নি। শিক্ষকরা তাদের স্বার্থের জন্য শিক্ষাদান করতো। ছাত্ররাও তাদের বৈষয়িক সুবিধা হাসিল করার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকে। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়। এর মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের দরকার হয় এবং ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।

বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। [২] এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা।

ভারতে মুসলিম শাসনামলে সাড়ে পাঁচশত বছরে উপমহাদেশে লাখো মাধ্যমিক মাদরাসা ও হাজার খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা। [৩]

১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়।

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল [৪]

(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning)

(৩) তাঁর মতে, ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।

(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।

মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।

এই ধরণের বস্তুবাদী শিক্ষা চালু করার ফলে এবং ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিতে শিক্ষা একটি বস্তুবাদী ও স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়। আগে যেভাবে শিক্ষকরাই ছাত্রদের অভিভাবক ও তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। এখন আর সেই ব্যবস্থা থাকে না। শিক্ষকরা তাদের জীবিকার অংশ হিসেবেই শিক্ষা দান করতেন। জাতি গঠনের মানসিকতা থেকে তাঁরা সরে আসেন। ছাত্ররা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়েই উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটে।    

সর্বপ্রথম ১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুরে ডেনমার্কের খ্রিস্টান মিশনারীদের সহায়তায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে 'শ্রীরামপুর কলেজ' প্রতিষ্ঠা হয়।[৫] এরপর ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজসহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ইংরেজরা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকার থেকে সরাসরি ভাতা পেতেন। তাই সুলতানী আমলের মতো ছাত্রদের প্রতি কেয়ারিং ছিলেন না। নতুন শহরে নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার জন্য একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সমিতি করে রাজনীতি শুরু করেন। যেমন নোয়াখালী-কুমিল্লা, হুগলি, বারাসাত, আসাম, বরিশাল, ঢাকা ইত্যাদি

১৯২৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রথম ছাত্র রাজনৈতিক দল যারা বিভিন্ন মাদরাসায় সক্রিয় ছিল। তবে এই ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখতো না। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধান ও ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্যেই এই ছাত্ররাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল।[৬]

১৮৮৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ১ম রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। ১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা হলেন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, দাদাভাই নওরোজি, দিনশ এদুলজি ওয়াচা, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন প্রমুখ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব দান করেছিল। এই রাজনৈতিক দল গঠিত হয় যাতে ভারতীয় এলিট সোসাইটি সরকার থেকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পেতে পারে। এর সাথে অল্প কিছু মুসলিমরাও যুক্ত ছিল। [৭]

কিন্তু যতই দিন গড়াতে থাকে ততই দেখা যায় কংগ্রেস মূলত ভারতীয় হিন্দুদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট। মুসলিমদের ব্যাপারে শুধু অনুৎসাহী নয়, মুসলিমদের সাথে বৈরি আচরণ শুরু করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস মুসলিমদের শত্রু বিবেচনা করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কংগ্রেসের বৈরি আচরণের প্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকায় একত্রিত হন। ঢাকায় উপমহাদেশের সকল মুসলিম নেতাদের সমাবেশ  থেকে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মুসলিমরা কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দিতে থাকেন।[৮]

উপমহাদেশের মানুষরা দুইটি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। মুসলিমরা মুসলিম লীগে ও হিন্দুরা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি এগিয়ে নেন। ইতোমধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩২ সালে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত করে মুসলিম লীগ। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান।

এটি ছিল জাতীয় রাজনীতিভিত্তিক উপমহাদেশের ১ম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠক। জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ মুসলিমলীগের রাজনীতিকে সহজ করে দেয়। সাধারণত ছাত্ররা কর্মতৎপর ও অনুগত হয়। মুসলিম লীগ সেই সুবিধাটি গ্রহণ করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সমগ্র মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলে ও তাদের নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করায় মুসলিম ছাত্ররা দ্রুতই জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে। 'অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের' মাধ্যমে মুসলিম লীগের সফলতা দেখে ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসপন্থী হিন্দু ছাত্রদের নিয়ে স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া গঠিত হয়।[১০] এভাবেই ১৯৩২ সাল থেকে মুসলিম লীগের হাত ধরে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির উত্থান হয় উপমহাদেশে।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৪০-১৪৪

২. শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা / বাংলাপিডিয়া /  মুয়াযযম হুসাইন খান / এশিয়াটিক সোসাইটি

৩. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ৫৯-৬৩

৪. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস / আব্বাস আলী খান / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃষ্ঠা ১৬০-১৭২

৫. শ্রীরামপুর কলেজ / বাংলাপিডিয়া /  প্রফুল্ল চক্রবর্তী / এশিয়াটিক সোসাইটি

৬. জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ৯৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কাল / দৈনিক ইনকিলাব / ২৩ নভেম্বর ২০২১

৭. The Nature and Dynamics of Factional Conflict/ P. N. Rastogi/ Macmillan Company/ p-69

৮. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আবদুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃষ্ঠা ১৪২

৯. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস( ১৮৩০-১৯৭১)/ ড. মোহাম্মদ হাননান/ আগামী প্রকাশন/ পৃষ্ঠা ৪১

১০. SFI: A Movement of Study, Struggle and Sacrifice For a Scientific, Secular Education/ Vikram Singh

 


২০ সেপ, ২০২৩

খালিস্তান আন্দোলন ও ভারত - কানাডার বিবাদ


শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের মাতৃভূমি 'খালিস্তান' বলে দাবি করেন। যার অর্থ 'বিশুদ্ধ দেশ'। তারা চান, এই রাষ্ট্র পাঞ্জাবে গড়ে তোলা হোক। ১৯৪৭ সাল থেকে তারা পাঞ্জাবে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই সূত্র ধরে ভারতীয় সরকারের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে।

সম্প্রতি খালিস্তানি তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডা সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে শীর্ষ শিখ নেতা ও কানাডীয় নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জর কানাডায় শিখ মন্দিরের সামনে খুন। অজ্ঞাত আততায়ী মাস্ক পরে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসে কানাডা। কানাডায় বহু আগ বহু খালিস্তানি নেতা রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন ও অনেকেই কানাডার নাগরিক হয়ে গিয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত, এমন অভিযোগ এনে সে দেশের এক কূটনীতিককে কানাডা সোমবার বহিষ্কার করেছে। কানাডার কাছে প্রমাণ রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র'-এর অপারেশনেই শিখ নেতা হরদীপ সিং খুন হয়েছেন। কানাডার পার্লামেন্টে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হরদীপ সিংকে খুনের পেছনে ভারতের হাত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ তার সরকারের কাছে রয়েছে। তাদের কাছে সেই প্রমাণ যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যও।

ট্রুডো বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে কানাডার মাটিতে এক নাগরিককে এভাবে হত্যা করা, বিদেশিদের এমন প্রত্যক্ষ যোগসাজশ কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। ওই অভিযোগের পরই কানাডায় অবস্থানরত এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি। কানাডা ভারতের দিকে ওই গুরুতর অভিযোগ তোলার পর যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে।

হরদীপ সিং হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে মোদি সরকার 'মনগড়া' এবং 'উদ্দেশ্য প্রণোদিত' বলে নাকচ করে দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী টুইট করে লিখেছেন, এই ধরণের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়া চলছে।

এর পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকে-কে ডেকে পাঠায়। কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়। ভারত ও কানাডার মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক নেই, তবুও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছে যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তবে খালিস্তানীদের ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত আর কানাডার মধ্যে বাক্য বিনিময় হচ্ছিল। ভারত বলে আসছে যে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্ম কানাডার প্রশ্রয়ে যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে গেছে।

খালিস্তান আন্দোলনের পত্তন হয় যেভাবে:
ভারতবর্ষ ভাগের পর শিখদের স্মৃতিবিজড়িত পাঞ্জাব প্রদেশ দুই ভাগ হয়ে যায়। এক অংশ ছিল ভারতে, আরেক অংশ পাকিস্তানে। পাকিস্তানে যে অংশটি ছিল, সেখান থেকে অসংখ্য শিখ ভারতের পাঞ্জাব অংশে চলে আসে, অপরদিকে পাকিস্তানে অবস্থানরত শিখরা সেদেশের পাঞ্জাব প্রদেশে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এছাড়াও ঐতিহাসিক পাঞ্জাব রাজ্যের লাহোর ও শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মস্থানও পাকিস্তানের সীমারেখায় রেখে দেয়া হয়।

এই ভাগকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। শিখরা এই ভাগের ফলে নিজেদের প্রতারিত ভাবতে শুরু করে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই শুরু হয় 'পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন'। এই আন্দোলনের দাবি ছিল পাঞ্জাবি ভাষার উপর ভিত্তি করে একটি আলাদা প্রদেশ তৈরি করতে হবে। প্রথমদিকে এই দাবিকে গুরুত্ব দেয়া না হলেও অব্যাহত প্রতিবাদের পর ১৯৬৬ সালে ভারতের 'স্টেটস রিকগনাইজেশন কমিশন' এই দাবি গ্রহণ করে। তবে এই দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমাচল ও হরিয়ানা নামে দুটো হিন্দিভাষী প্রদেশ তৈরি করা হয়েছিল।

'পাঞ্জাবি সুবাহ্ আন্দোলন' সফল হওয়ার পর প্রদেশটির রাজনৈতিক আকালি দলের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। এরপর তারা আরও বেশি জনসমর্থন গড়ে তোলার করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯৭৩ সালে খালসা মতাদর্শের জন্মস্থান আনন্দপুর সাহিবে দলের নেতারা একত্রিত হন এবং 'আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনা'র ঘোষণা দেন। এই প্রস্তাবে কিছু দিক ছিল খালিস্তান প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ। যেমন- অন্যান্য প্রদেশের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত একটি প্রদেশ গঠন এবং সেই প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে তারা। এছাড়া তারা নতুন প্রদেশের স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানায় সেই প্রস্তাবে।

এরপরই প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নামের এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের। তিনি আকালি দলের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে । অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিশাল সমর্থন গড়ে ওঠে। পাঞ্জাবের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মাঝে তার বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরি হয়।

১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে আকালি দলের নেতৃত্বের সমর্থনে জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একটি চরমপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলেন পাঞ্জাবে। তিনি নিজে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকেই পুলিশের সাথে তার অনুসারীদের সংঘাত ও দাবি আদায়ের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাবনায় যেসব প্রস্তাবের উল্লেখ করা হয়েছিল, সেগুলো মেনে নেয়ার দাবি জানানো হয় তার পক্ষ থেকে। সেই সাথে পাঞ্জাবের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। তার অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। জারনেইল শিং ভিন্দ্রানওয়ালে হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে অনেক স্পর্শকাতর মন্তব্য প্রচার করেন। ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই আন্দোলনকে 'দেশদ্রোহী' হিসেবে ঘোষণা দেয়।

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি আরও বাজে দিকে মোড় নেয়। জারনেইল সিং আন্দোলনরত শিখদের অস্ত্র হাতে নেয়ার আহ্বান জানান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র রূপ ধারণ করে। ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাবাহিনীকে শিখ উগ্রপন্থীদের হাত থেকে স্বর্ণমন্দির মুক্ত করা এবং জারনেইল সিংকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন।

সেনাবাহিনী 'অপারেশন ব্লু স্টার' হাত নেয়। শিখদের প্রতিরোধ এত বেশি ছিল যে, একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ট্যাংক ও বিমান থেকে গোলাবর্ষণের সহায়তা নেয়। এই সামরিক অভিযানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সরকারি হিসেবে বলা হয়েছিল, ৮৩ জন সেনাসদস্য নিহত এবং ২৪৯ জন সেনাসদস্য আহত হয় এই অভিযানে। শিখ উগ্রপন্থী এবং বেসামরিক মানুষের সংখ্যা দেখানো হয় ৪৯৩। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে দু'পক্ষ মিলিয়ে হতাহতের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে শিখদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হন। সে বছরেরই ৩১ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুজন শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়, যাতে প্রায় আট হাজার শিখ নিহত হন। এর পরের বছর কানাডাপ্রবাসী শিখরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বোমা বিস্ফোরণে বিমানে অবস্থানরত ৩২৯ জনের সবাই মৃত্যুবরণ করে। এই বিস্ফোরণের পেছনে যারা দায়ী ছিল, তারা তাদের নেতা জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে এই বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতা চলমান ছিল।

খালিস্তান আন্দোলন শিখদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি হলেও ক্রমাগত সহিংসতা ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণাসুলভ মনোভাব এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিশাল জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। খোদ পাঞ্জাবেই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের পর থেকে খালিস্তান আন্দোলনের মূল নেতারা ভারত থেকে পালিয়ে যান। ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় তারা রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব নিতে থাকেন। বর্তমানে খালিস্তান আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব কানাডা থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

১৪ সেপ, ২০২৩

আদালত এখন খুনীদের আশ্রয়স্থল


১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। পরবর্তীতে জনগণের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হয়।

বিএনপির এই দুর্বল সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী ও ভারতীয়দের একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় চলে আসে। তখন থেকেই তারা সারাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও এর বিপরীত কিছু ছিল না।

এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ২২ জুলাই সীতাকুণ্ড কলেজের ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগ ৪ জন ছাত্রকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। বলাবাহুল্য এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রাবাসের বৈধ ছাত্র ও ছাত্রশিবিরের কর্মী। ৪ টি সিট দখল করে তারা ছাত্রলীগের কিছু গুন্ডাকে হলে তুলে দেয়। ছাত্রশিবির এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত পুলিশ সাহস করেনি সরকারি দলের মাস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

পরবর্তীতে ছাত্রশিবিরের জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে এই ঘটনার মীমাংসা হয় এবং ছাত্রলীগ গুন্ডারা ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৪ জুলাই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মীমাংসিত ঘটনাকে পুনরায় চাঙ্গা করে সীতাকুণ্ড কলেজ ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। এতে আহত হয় ৪ জন শিবিরকর্মী।

২৪ জুলাই ১৯৯৬, সেদিন ছিল ৭ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর মাস রবিউল আউয়াল মাসকে স্বাগত জানিয়ে র‍্যালি করে ছাত্রশিবির। সেই সমাবেশেও গুলি করে ছাত্রলীগ। বেশ কয়েকজন আহত হয়। কিন্তু রক্তের নেশা মেটে না ছাত্রলীগের। সেদিন বিকেলে আলিয়া মাদরাসায় হামলা চালায় ও গুলি বর্ষণ করে ছাত্রলীগ। এবার আলিয়া মাদরাসা থেকে সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে ছাত্রশিবির বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রশিবিরের দৃঢ় অবস্থানে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকা থেকে ছাত্রলীগ পালিয়ে যায়।

২৫ জুলাই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে আহত করে শিবির কর্মী হেলাল উদ্দিনসহ ৩ জনকে। শিবির নেতৃবৃন্দ ঘটনা জানিয়ে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেও আওয়ামী সরকারের অশুভ ইশারায় পুলিশ উল্টো হানা দেয় সীতাকুণ্ড আলীয়া মাদরাসায়। শিবির কর্মীসহ ১৫ জন সাধারণ ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলক অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও বিষাক্ত ছাত্রলীগ সীতাকুণ্ড কলেজ থেকে ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে নি।

২৯ জুলাই ১৯৯৬। সেদিন ছিল ১২ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর ওফাতের দিন। বিকেল ৪ টায় সীতাকুণ্ড কলেজের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী মো. শাহজাহান তাঁর বন্ধু নুর হোসেনসহ কলেজসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে রিকশায় চড়ে তাদের বাসায় যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাঁদের দুইজনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর কলেজ সংলগ্ন মাঠে ইট, রড, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শাহজাহান ও নুর হোসেনের সমস্ত শরীর থেঁতলে দেয়। মারাত্মক আহত শাহজাহান পানি চাইলে খুনি দুলাল চন্দ্র দে তাঁর মুখে প্রস্রাব করে।

উপস্থিত জনগণ পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ আসেনি। খবর পেয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা একত্র হয়ে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। শাহজাহান ভাই ও নূর হোসেন ভাইকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নূর হোসেন ভাই জীবন ফিরে পেলেও আল্লাহ তায়ালা শাহজাহান ভাইকে কবুল করে নিয়েছিলেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শাহদাতবরণ করেন সীতাকুণ্ড কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী মুহাম্মদ শাহজাহান ভাই।

৩০ জুলাই চট্টগ্রাম লালদিঘীতে জানাযা ও পরে শহীদের ক্যাম্পাস সীতাকুণ্ড কলেজ মাঠে জানাজা হয়ে শহীদের মীরসরাইয়ে নিজ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়।

এই ঘটনায় মামলা হয়। মামলার বাদি ছিলেন শাহজাহান ভাইয়ের চাচাতো ভাই রায়হান উদ্দিন। সরাসরি যারা খুনের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মামলা করা হয়। তারা হলো, নুরুচ্ছাফা, বিজয় চক্রবর্তী, মো. শাহজাহান, রুহুল আমিন, দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, পাপন চন্দ্র দে ও আলাউদ্দিন।

তদন্ত শেষে সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হোসেন ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আসামীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়। আদালতের দীর্ঘসূত্রীতার সুবিধা নিয়ে বেশ কয়েকবছর জেলে থেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে খুনীরা। বিচার কাজ এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।

২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী সরকার হস্তক্ষেপ্ত করে এই মামলায়। এই মামলায় থাকা ৯ আসামীর মধ্যে ১ম সাত আসামীকে তারা নির্বাহী আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে চায়। এই ৭ জন খুনি এখন সীতাকুণ্ড উপজেলার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। বাকী দুইজন এখন আওয়ামী লীগ করে না বিধায় তাদের ব্যাপারে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই।

২০১৩ সাল থেকে এই প্রসেস শুরু হলেও এটি কার্যকর হয় ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই বিচার বিভাগের ওপর নজিরবিহীন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মামলা থেকে আসামীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, 'মামলাটি আগে চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। জেলা পিপি হিসেবে আমি আসামির নাম প্রত্যাহারের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।'

এই কেমন বিচারব্যবস্থা! বাদী অভিযোগ করেছে খুনীদের বিরুদ্ধে। অথচ সরকারের ইশারায় আদালত বিচার না করে, বাদীর সাথে আলোচনা না করে, খুনের মামলার মতো স্পর্শকাতর মামলার আসামীদের কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়।

অব্যাহতি পাওয়া এই খুনীরা হলো, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান, সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহসম্পাদক নুরুচ্ছাফা, সদস্য বিজয় চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের সদস্য রুহুল আমিন, যুবলীগের কর্মী দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন।

৩ সেপ, ২০২৩

মীর কাসেম ছিলেন সৎ ব্যবসায়ীর প্রতিচ্ছবি

 

আজ ৩ সেপ্টেম্বর। শহীদ মীর কাসেম আলীর ৭ম শাহদাতবার্ষিকী। জননেতা মীর কাসেম আলী মিন্টু ক্ষণজন্মা একজন প্রতিভাবান উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। যিনি এদেশের ছাত্র জনতার প্রিয় কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতি, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সংগঠক, শিল্প উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, জনকল্যাণ ও সমাজকল্যাণ মূলক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই সকলের নিকট পরিচিত ও সমাদৃত।

আমরা হাদিস থেকে জানি ৭ শ্রেণির লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। এরমধ্যে একশ্রেণির লোক হলো সৎ ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে বড় ব্যবসায়ী মানেই লুটেরা। এই লুটেরা সাম্রাজ্যের মধ্যেই সৎ ব্যবসায়ীর নজির স্থাপন করেছেন শহীদ মীর কাসেম আলী রহ.। শহীদ মীর কাসেম আলী যেন আরশের ছায়াতলে স্থান পাওয়া ব্যবসায়ীদের প্রতিচ্ছবি।

জনাব মীর কাসেম আলী প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে মেধা, যোগ্যতা দিয়ে সাধ্যমতো সাজানোর কারিগর হিসেবে ও নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদই নন, দেশে-বিদেশে তিনি একজন উদ্যোক্তা, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত। বিশেষ করে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি একটি সপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে দিন রাত পরিশ্রম করেছিলেন।

জাহেলিয়্যাতের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্টায় নিজেকে করেছিলেন আত্মনিয়োগ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা, পর্যটন শিল্প, আবাসন খাত, কৃষি, মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই তিনি ভূমিকা রেখেছেন স্বমহিমায় ও উজ্জ্বলতার সাথে। তিনি দেখিয়েছেন অমানবিক পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে ইসলামের অপার সৌন্দর্য।

কেউ বক্তব্য দেয়, কেউ থিউরি দেয়, কেউ আবার সেই থিউরি কপচায়, কেউ বলে এই করা দরকার, সেই করা দরকার, কেউ উপদেশ দেয়, কেউ আবার সেই উপদেশের ক্রিটিসিজম করে, কেউ সমালোচনা করে, কেউ সেই সমালোচনার সমালোচনা করে বিতর্কের হাট বসায়। মীর কাসেম আলী এসবের লোক নন। তিনি নীরবে কাজ করে যেতেন। যারা কাজ করেন তাদের উৎসাহ দিতেন। তিনি বলার চাইতে করতেন বেশী। জনশক্তিদের উপদেশ দিয়ে শেখানোর চাইতে কাজ করে উদাহরণ হওয়া ছিল তার পছন্দের।

জন্ম ও শিক্ষা
অসংখ্য গুণের অধিকারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার, হরিরামপুর থানার, সূতালরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত মীর তৈয়ব আলী ও মাতা মৃত রাবেয়া আখতার (ডলি বেগম)। পারিবারিকভাবে আদর করে তাঁকে পেয়ারু নামে ডাকতেন। ৪ ভাই ১ বোন। জনাব মীর কাসেম আলীর বাবা সরকারী চাকুরী করতেন বিধায় বরিশাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি তাঁর।

মীর কাশেম আলী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বরিশালে অবস্থিত আদর্শ বিদ্যালয়ে ১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া করে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে লেখাপড়া করে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে বিএসসি অনার্স প্রথম বর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের লেখাপড়া স্থগিত করেন। অতঃপর ১৯৭১-১৯৭২ শিক্ষাবর্ষের বিএ পাস কোর্সে সাবেক আদর্শ কলেজ বর্তমানে আইডিয়াল কলেজ, ৬৫ সেন্ট্রাল রোড ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে অধ্যয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সালের বিএ (পাশ) পরীক্ষা (১৯৭৪ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালের এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মে-জুন ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে এবং ১৯৭৫ সালে এমএ ফাইনাল পরীক্ষা (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর/১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

সাংগঠনিক জীবন
মানবতার কল্যাণে জীবন ব্যায়িত মীর কাসেম আলী ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ছিলেন প্রথম কাতারে। ১৯৬৬ সালে যোগদান করেন মেধাবীদের প্রিয় সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে প্রাদেশিক জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি একজন ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় সভাপতির। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। এরপর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পারিবারিক জীবন
শহীদ মীর কাসেম আলী ১৯৭৯ সালে খন্দকার আয়েশা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ২ ছেলে, ৩ মেয়ে। প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত।

রাজনৈতিক আন্দোলন
শহীদ মীর কাসেম আলী ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৪ সালের কেয়ারটেকার আন্দোলন, ১৯৯৮ সালের দেশবিরোধী পার্বত্য কালো চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।

সামাজিক আন্দোলন ও কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষে ও ছাত্রশিবির থেকে বিদায় নিয়ে শহীদ মীর কাসেম আলী দায়িত্ব নিলেন রাবেতা আলম আল ইসলামী (মুসলিম বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব) নামক একটি এনজিওতে যার অন্যতম কাজ স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে যেখানে মুসলমানরা নির্যাতিত। তখন সাল ছিল ১৯৭৯। বাংলাদেশে আগত বার্মার নির্যাতিত মুসলমান শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। কক্সবাজারের মরিচ্যাপালংএ গড়ে তুললেন রাবেতা হাসপাতাল। তার বড় ভাইসহ একদল সদ্যপাশ করা তরুন ডাক্তার আর নিবেদিত প্রাণ একঝাঁক যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেন এই প্রকল্প। সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কয়েকটি চেয়ার টেবিল দিয়ে শুরু। দেখতে দেখতে সেই হাসপাতালের বড় হলো, অনেক বড়। গড়ে উঠলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অপারেশন থিয়েটার (O.T), ফার্মেসী, ইনডোর- আউটডোর সার্ভিসসহ সার্বক্ষনিক ব্যবস্থাপনায় এক পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। স্থানীয় বাংলাদেশীদের চিকিৎসাও চললো পাশাপাশি । গড়ে উঠলো নিজস্ব বিল্ডিং, চালু হলো নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তৈরি হল আবাসিক হোস্টেল।

গ্রাম-বাংলার জনগন এর চাহিদাকে সামনে রেখে প্রবর্তন করা হলো ‘পল্লী চিকিৎসক প্রকল্প’। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকরা ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরপর শুরু হলো ইমামদের স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ, যার প্রধান অংশে রয়েছে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রশিক্ষণ। এভাবেই মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। মীর কাসেম এদেশের জনগণের উন্নতির জন্য যে চিন্তাভাবনা করেছেন তার বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে রাঙ্গামাটির পিছিয়ে পড়া পার্বত্য জনগন এর জন্য নির্মিত রাবেতা হাসপাতাল, মাইনিমুখ এর মাধ্যমে। এছাড়াও রয়েছে রাবেতা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স টেকনাফ এর উখিয়া ও হিলি, রংপুর এর মিঠাপুকুর সহ বিভিন্ন ছোটখাট স্বাস্থ্য প্রকল্পের মাধ্যমে। দিন রাত পড়ে থাকতেন আটকে পড়া রোহিঙ্গা, বিহারী, সাঁওতাল, চাকমা, মারমাসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সেবায়।

ঢাকায় আটকে পড়া বিহারীদের জন্য তৈরী করেছেন মুহাম্মদপুরে রাবেতা হাসপাতাল। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনাকে একটি ছোট্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বিরাট হাসপাতাল, ডি ল্যাব, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রি, ইমেজিং সেন্টার এবং ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ স্থাপন পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে থাকাকালীন তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইল, শাহজাহানপুর, বরিশাল, খুলনা, রংপুর এবং কমিউনিটি হাসপাতাল নামে মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে তুলেন হাসপাতাল। রাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ও মেডিকেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট মীর কাসেম আলীর একনিষ্ঠ শ্রমের ফসল। আর ফুয়াদ আল খাতিব হাসপাতাল ঢাকা ও কক্সবাজারে এক অতিপরিচিত নাম।

পেশাগত জীবন
শহীদ মীর কাসেম আলী বিভিন্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য হলো, মীর কাসেম আলী ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন। তিনি দিগন্ত মিডিয়া গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ছিলেন যেটি দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত টেলিভিশন পরিচালনা করে। এছাড়াও তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিশ্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও দাতব্য সংগঠন ‘রাবেতা আল-আলম আল ইসলামী’ এর এদেশীয় পরিচালক ছিলেন। এসবের বাইরে তিনি ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট অ্যান্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, কেয়ারি লিমিটেড, ফুয়াদ আল খতিব, আল্লামা ইকবাল সংসদ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর স্ট্রেটেজি ও পিস স্টাডিস সহ দেশে-বিদেশে মোট ৪০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।

শাহদাত
২০১২ সালের ১৭ জুন তাঁকে কথিত মানবতা বিরোধী মামলায় এরেস্ট করা হয়। এরপর সাজানো ও হাস্যকার বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁকে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে খুন করা হন। তাঁর শাহদাতের কয়েক সপ্তাহ আগে ৯ আগস্ট তাঁর আইনজীবী ও ছেলে ব্যারিস্টার আরমানকে হাসিনা সরকার তুলে নিয়ে যায়। আইনী প্রক্রিয়ায় পরাজিত হাসিনা সরকার বিচারকদের চাপ দিয়ে জোর করে ফাঁসীর করে ব্যবস্থা করে। মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যরিস্টার আরমানকে আজ পর্যন্ত গুম করে রেখেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার।

২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শহীদের জানাজায় যাওয়ার সময় ব্যাপক হয়রানি করে মীর কাসেম আলীর পরিবারকে। মানিকগঞ্জের নিজ গ্রামে শহীদ মীর কাসেম আলী শায়িত আছে। মহান রাব্বুল আলামীর তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন।