আদর্শ রাষ্ট্র তথা ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা এবং তিনি সর্বোচ্চ শাসক। সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব কেবল তারই। মানুষের মর্যাদা হলো, সে সর্বোচ্চ শাসকের প্রতিনিধি এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে শাসকের আইনের অনুগামী। প্রতিনিধির কাজ হলো, শাসকের আইনকে তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যকর করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করা।
১. শাসন ক্ষমতার কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহরই
আল্লাহ তায়ালা ইউসুফ আ.এর ঘটনা উল্লেখ করেন সূরা ইউসুফে। ইউসুফ আ. বলেন, 'হে জেলখানার সাথীরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দিখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ যিনি সবার ওপর বিজয়ী। তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের গোলামী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাঠাননি। শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম হলো, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর দাসত্ব করবেনা। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানেনা।'[সূরা ইউসূফঃ ৩৯-৪০]
এটি ইউসুফ আ.-এর ভাষণের একটি অংশ। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদের ব্যাপারে এটি সর্বোত্তম ভাষণসমূহের একটি। এতে হযরত ইউসুফ আ. শ্রোতাদের সামনে দ্বীনের এমন একটি সুচনা বিন্দু তুলে ধরেন যেখানে থেকে সত্যপন্থী ও মিথ্যাবাদীদের পথ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি তাওহীদ শিরকের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। আবার এ পার্থক্যকে এমন যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট করেছেন, যার ফলে সাধারণ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তিই তা অনুভব না করে পারেননা। বিশেষ করে সে সময় যাদেরকে সম্বোধন করে তিনি একথা বলছিলেন তাদের মন মস্তিষ্কে তীরের মতো একথা গেঁথে গিয়ে থাকবে। কারণ তারা ছিলো কর্মজীবি গোলাম। নিজেদের মনের গভীর তারা একথা ভালোভাবে অনুভব করতো যে, একজন প্রভুর গোলাম হওয়া ভালো, না একাধিক প্রভুর গোলাম হওয়া?
আর সারা দুনিয়ার একক প্রভু যিনি, তার দাসত্ব করা ভালো, না তার দাসদের দাসত্ব করা? তারপর তিনি একথাও বলেননি যে, তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করো এবং আমার দ্বীন গ্রহণ করো। বরং চমৎকার কৌশল বলছেন, আল্লাহর কতোবড় মেহেরবানী, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারো দাস হিসেবে পয়দা করেননি , অথচ অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা বরং অনর্থক নিজেরাই মনগড়া প্রভু তৈরী করে তাদের পূজা ও দাসত্ব করছে। তারপর তিনি শ্রোতাদের অনুসৃত ধর্মের সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে এবং কোনো প্রকার মনোকষ্ট না দিয়ে।
২. ফেরাউনও নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করতো
আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, 'আর ফেরাউন বললো, হে সভাসদবর্গ! আমি তো আমাকে ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ আছে বলে জানিনা।' [সূরা আল কাসাসঃ ৩৮]
এ উক্তির মাধ্যমে ফেরাউন যে বক্তব্য পেশ করেছে তার অর্থ এ ছিলোনা যে, আমিই তোমাদের এবং পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। কারণ কেবলমাত্র কোনো পাগলের মুখ দিয়েই এমন কথা বের হতে পারতো। অনুরূপভাবে এর অর্থ এও ছিলোনা আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। কারণ মিসরবাসীরা বহু দেবতার পূজা করতো এবং স্বয়ং ফেরাউনকেই যেভাবে উপাস্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিলো তাও শুধুমাত্র এই ছিলো যে, তাকে সূর্য দেবতার অবতার হিসেবে স্বীকার করা হতো। সবচেয়ে বড় সাক্ষী কুরআন মজীদ নিজেই। কুরআনে বলা হয়েছে ফেরাউন নিজে বহু দেবতার পূজারী ছিলো।
তাহলে ফেরাউনের ব্যবহৃত 'ইলাহ' মানে কী? এই 'ইলাহ' মানে হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তথা আদেশ ও নিষেধের কর্তা ফেরাউন। ফেরাউন নিজেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বভৌম মনে করতো। যারা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের দাবীদার, তাদের সাথে ফেরাউনের কোনো পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের নির্বোধ লোকেরা একদিকে ফেরাউনকে অভিসম্পাত করতে থাকে, অন্যদিকে ফেরাউন রীতিনীতির অনুসারী এসব শাসককে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্বে কারো কোনো অংশীদারত্ব নেই
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তিনি হলেন সেই সত্ত্বা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের মালিক। তিনি কাউকেও পুত্র বানাননা। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশীদার নেই। প্রতিটি জিনিস তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর একটি তাকদীর নির্ধারণ করেছেন।' [সূরা আল ফুরকানঃ ২]
মহান আল্লাহই এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। মূলকথা এই যে, তিনি ছাড়া আর কোনো মা'বুদ নেই। কারণ, মানুষ যাকেই মা'বুদে পরিণত করে একথা মনে করেই করে যে, তার কাছে কোনো শক্তি আছে, যে কারণে সে আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে এবং আমাদের ভাগ্যের ওপর ভালো মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। জনগণ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্যও চাইবে না।
৪. আল্লাহর কাছেই সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে
যিনি সার্বভৌমত্বের মালিক, তার কাছেই সকল কর্মকান্ডের জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তোমাদের অন্তরে যা কিছু আছে তা প্রকাশ কারো কিংবা গোপন রাখো সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ সেগুলোর হিসেবে নেবেন। অতপর তিনি যাকে চাইবেন ক্ষমা করে দেবেন, আর যাকে চাইবেন শাস্তি দেবেন, তিনি সবকিছু কারতে সক্ষম।' [সূরা আল বাকারাঃ ২৮৪]
আল্লাহ এই পৃথিবীর ও আকাশ সমূহের মালিক। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁর একক মালিকানাধীন, প্রকৃতপক্ষে এই মৌলিক সত্যের ভিত্তিতেই মানুষের জন্য আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নতো করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কর্মপদ্ধতি বৈধ ও সঠিক হতে পারেনা।
এই বাক্যটিতে আরো দুটি কথা বলা হয়েছে। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে এবং এককভাবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। দুই, পৃথিবী ও আকাশের যে একচ্ছত্র অধিপতির কাছে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে তিনি অদৃশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞান রাখেন। এমনকি লোকদের গোপন সংকল্প এবং তাদের মনের সংগোপনে যেসব চিন্তা জাগে সেগুলিও তাঁর কাছে গোপন নয়।
আল্লাহর ওপর কোনো আইনের বাঁধন নেই। কোনো বিশেষ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি বাধ্য নন। বরং তিনি সর্বময় ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। শাস্তি দেয়ার এবং মাফ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তাঁর রয়েছে।
৫. বৈধ ও অবৈধ নির্ধারণের মালিক আল্লাহ তায়ালা
ঈশা আ.-এর দাওয়াতের কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেন। ঈশা আ. বলেন, 'আমি সেই শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার যুগে তাওরাতে আছে। আর তোমাদের জন্য যেসব জিনিস হারাম ছিলো তার কতকগুলি হালাল করার জন্য আমি এসেছি। দেখো, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আমি নিশানী নিয়ে এসেছি। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব। কাজেই তোমরা তাঁর দাসত্ব করো। এটিই সোজাপথ।' [সূরা আল ইমরানঃ ৫০-৫১]
মানুষের জীবনকে হালাল ও হারাম এবং বৈধতা ও অবৈধতার বিধি-নিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহ দান করবেন। অন্যদের চাপানো সমস্ত আইন ও বিধি নিষেধ বাতিল করতে হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কোনটি বৈধ বা কোনটি অবৈধ হবে তা নির্ধারণ হবে আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী।
৬. সৃষ্টি যার, আইন চলবে তার
এটাই আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। এখানের স্রষ্টার আইন কার্যকর হবে। স্রষ্ট্রার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সব কিছুই বাতিল বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে আসে। তিনি সূর্য ও চন্দ্র ও তারকারাজী সৃষ্টি করেছেন। সবাই তাঁর নির্দেশের অনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তাঁরই এবং নির্দেশও তাঁরই। আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক।' [সূরা আ'রাফঃ ৫৪]
স্রষ্টা ও সৃষ্টির ম্যধকার সম্পর্ক সুস্পস্ট করার জন্য কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এমনসব শব্দ, পরিভাষা, উপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজত্ব ও শাসনের সাথে সম্পর্ক রাখে। এ বর্ণনাভংগী কুরআনে এতো বেশী স্পষ্ট যে, অর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যেকোনো ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেননা।
ভূমন্ডলে ও নভোমন্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। সার্বভৌমত্ব [Sovereignty] বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিকার ও বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও। তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বের সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামতো চলার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি।
বরং কার্যত সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভুত রয়েছে। দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছেনা। বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে। তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আবার যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন। সূর্য, চন্দ্র, তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোনো শক্তির অধিকারী নয়। বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরা একান্ত অনুগত দাসের মতো সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন।
আর ভূপৃষ্ঠে শুধু নিজেদেরকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চলার সামান্য আংশিক ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে। এটাও আল্লাহর ইচ্ছা ও পরীক্ষা। তারাই সফলকাম হবে যারা আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবে ও আল্লাহর আইনের কাছে আর্ত্মসমর্পন করবে।
৭. আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন।[সূরা মায়েদাঃ ১] অর্থাৎ আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো হুকুম দেবার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার মানুষের নেই। তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসংগত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করেনা বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তাঁর আনুগত্য করে।
যে জিনিসটি তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা কেবল তাঁর হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেবে গণ্য। আর ঠিক তেমনি যে জিনিসটি তিনি হালাল করে দিয়েছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলেই এটি হালাল।
তাই কুরআন মজীদ সর্বোচ্চ বলিষ্ঠতা সহকারে এ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোনো বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভিত্তিরে আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এছাড়া মানুষের জন্য কোনো কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোনো মানদন্ড নেই।
৮. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বৈধ কিংবা অবৈধ ঘোষণার অধিকার নেই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর তোমাদের কণ্ঠ ভূয়া হুকুম জারী করে বলতে থাকে এটি হালাল এবং ওটি হারাম, এভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করোনা। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবেনা। [সূরা আন নাহলঃ ১১৬]
এ আয়াতটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হালাল ও হারাম করার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। অথবা অন্য কাথায়, একমাত্র আল্লাহই আইন প্রণেতা। অন্য যে ব্যক্তিই বৈধতা ও অবৈধতার ফয়সালা করার ধৃষ্টতা দেখাবে, সে নিজের সীমা লংঘন করবে। আদর্শ রাষ্ট্রে এই ধরণের সীমা লংঘণের কোনো এখতিয়ার কারো থাকবে না।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, 'হে নবী তাদের বলো, তোমরা কি কখনো একথা চিন্তা করেছো যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিযিক অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্য থেকে তোমরা নিজেরাই কোনোটাকে হারাম ও কোনোটাকে হালাল করে নিয়েছো? নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছো?' [সূরা ইউনুসঃ ৫৯]
৯. যারা আল্লাহর আইন মানে না কাফির, ফাসিক ও জালিম।
আদর্শ রাষ্ট্র আল্লাহর আইন অনুযায়ী চলবে। যারা আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না তারা হয় ফাসিক নয়তো জালিম অথবা কাফির। এই মুহুর্তে প্রায় সবক'টি মুসলিম রাষ্ট্রেই শাসকগণ আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করেনা তারাই কাফির / জালিম / ফাসিক' [সূরা মায়েদাঃ ৪৪-৪৭]
যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুম ও তাঁর নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফয়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি সুবিচার ও ভারসাম্যনীতের বিরোধী। কারণ, আল্লাহ্ সর্বোচ্চ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করলো তখন সে আসলে জুলুম করলো। তৃতীয়ত, দাস হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে পা রাখলো। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসিকী।
যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফালসালা করে, সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, জুলুম ও ফাসিকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে। আদর্শ রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা থাকায় আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে ফয়সালা করার কোনো সুযোগ থাকবে না।
১০. তাগুতই কেবল আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে।
'প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রাসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাগুতের বন্দেগি পরিহার করো।' (সূরা নাহল-৩৬)
এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে 'তাগুত' বলা হবে, যে নিজের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে। কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক দাসকে বলা হয়, যে দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু ও খোদা হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের দাসত্বে নিযুক্ত করে।
তাগুতের ৩ টি পর্যায়
ক. প্রথম পর্যায় হলো বান্দা নীতিগতভাবে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করে। একে বলা হয় ফাসেকী।
খ. দ্বিতীয় পর্যায়ে সে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় কুফরী।
গ.তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে।
কোনো ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোনো দিন সঠিক অর্থে আল্লাহর মুমিন বান্দা হতে পারেনা।
অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
'হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেইসব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছেলো; কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহের ভায়সালা করার জন্য 'তাগুতে'র দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছিলো তাগুতকে অস্বীকার করার।' [সূরা আন নিসাঃ ৬০]
আল্লাহর তায়ালার এই কথা আমাদের বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য। এখানে 'তাগুত' বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোনো আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং এমন বিচার ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করেনা।
কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, নিজের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তার কাছে উপস্থিত হওয়া যে একটি ঈমান বিরোধী কাজ , এ ব্যাপারে এ আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর আল্লাহ্ ও তাঁর কিতাবের ওপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবী অনুযায়ী এই ধরনের আদালতকে বৈধ আদালত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানোই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য।
কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাগুতকে অস্বীকার কার, এদু'টি বিষয় পরস্পরের সাথে অংগাংগীভাবে সংযুক্ত এবং এদের একটি অন্যটির অনিবার্য পরিণতি। আল্লাহ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নতো করাই হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফিকী।
আমাদের আজকের এই আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া ঈমানের দাবী। সার্বভৌমত্বে মানুষের বিন্দুমাত্র অংশ থাকতে পারেনা। একইসাথে আল্লাহ ও জনগণের সার্বভৌমত্ব অথবা কোনো শাসকের সার্বভৌমত্ব মানার কোনো সুযোগ নেই। আদর্শ রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন