২৫ মার্চ, ২০১৬

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং এর পর্যালোচনা


মাওলানা নিজামী কেমন ছিলেন এই ব্যাপারে আমি আমার পূর্বের পোস্টে উল্লেখ করেছি। তাই এখানে কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই মূল আলোচনায় চলে যাচ্ছি। ২০১২ সালের ২৮ মে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই জামায়াত নেতার বিচার শুরু হয়। মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল ৪টি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। আপীলের রায়ে সেখান থেকে একটি অভিযোগে খালাস দিয়ে বাকী তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। আর্টিকেলের আকার বড় হয়ে যাওয়াতে এখানে আমরা শুধু তিনটি অভিযোগ, যে অভিযোগগুলোতে মাওলানাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সে অভিযোগগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করবো। 

অভিযোগ-১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানোর কারণে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউস ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
রায়ঃ মৃত্যুদণ্ড

অভিযোগ-৩: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ব্যবহৃত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হিসাবে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প খুলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-৪: নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রাজাকার বাহিনী পাবনার করমজা গ্রামে হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী ওই গ্রাম ঘিরে ফেলে নয়জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। সেখানে বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগও করা হয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
রায়ঃ মৃত্যুদণ্ড

অভিযোগ-৭: একাত্তর সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর দেওয়া তথ্যে রাজাকার বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে আটক করে। তাকে রাস্তায় নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনেই হত্যা করা হয়। 
রায়ঃ যাবজ্জীবন 

অভিযোগ-৮: একাত্তরের ৩০ আগস্ট ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান নিজামী তার সংগঠনের তখনকার সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদকে সঙ্গে নিয়ে নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে যান এবং সেখানে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে নিজামী বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। নিজামীর পরামর্শ অনুযায়ী পরে জালাল ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়। 
রায়ঃ যাবজ্জীবন 

অভিযোগ-৯: নিজামী ও রাজাকার বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রফুল্ল, ভাদু, মানু, স্বস্তি প্রামানিক, জ্ঞানেন্দ্রনাথ হাওলাদার ও পুতুলসহ ৭০ জনকে হত্যা ও ৭২টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১০: মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে পাবনার সোনাতলা গ্রামের অনিল চন্দ্র কুণ্ডু নিরাপত্তার জন্য ভাই-বোনদের নিয়ে ভারতে চলে যান। পরে অগাস্টে তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। নিজামীর নির্দেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তার এবং আশেপাশের বহু মানুষের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১১: একাত্তরের ৩ অগাস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না। সেদিন তার উপস্থিতিতেই নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য ইসলামী ছাত্র সংঘ, আলবদর, রাজাকারদের মতো সহযোগী বাহিনীগুলোকে উসকানি দেওয়া হয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১২: একাত্তরের ২২ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, যারা পাকিস্তানকে ভাঙতে চায়, তারা ইসলামের শত্রু। পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে ইসলামের শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে মন্তব্য করে পাকিস্তানের শত্রুদের নির্মূল করার আহ্বান জানান তিনি।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১৩: ওই বছর ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডটা রক্ষায় হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদর সদস্যরা প্রস্তুত। উসকানিমূলক ওই বক্তব্যে মুক্তিকামী বাঙালিকে ভারতের সহযোগী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১৫: একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
রায়ঃ খালাস

অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে। 
রায়ঃ মৃত্যুদণ্ড

২ নং অভিযোগের পর্যালোচনাঃ 
অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চারজন সাক্ষী ছিলেন। যাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মাওলানা নিজামীকে ফাঁসী দেয়া হয়। আসুন দেখি সাক্ষীদের অবস্থা কেমন ছিল। 

১- রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মোঃ আইনুল হক একাত্তরের ১৪ মে কথিত হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় মাওলানা নিজামী উপস্থিত ছিলেন- এ ধরণের কোনো বর্ণনা দেননি। তিনি ঘটনার দিন শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেননি। তদন্ত কর্মকর্তার নিকট বলেছেন এক কথা, কোর্টে এসে বলেছেন আরেক কথা। কাজেই মতিউর রহমান নিজামী সাহেব সম্পর্কে তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। 

২- রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী শামসুল হক নান্নু এতো বেশি অসত্য তথ্য ট্রাইব্যুনাল এবং তার বাইরে প্রদান করেছেন তাকে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু তার বক্তব্য যে কতটা অসাড় তার প্রমাণ হলো তার নিজের বক্তব্য- ‘২৪ মার্চ পাবনা আলিয়া মাদরাসার নিকটবর্তী দোকানদার সেকেন্দার আলীর নিকট থেকে জানতে পারি যে, ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইছহাক, রফিকুন নবী ওরফে বাবলু পাবনা আলিয়া মাদরাসায় বসে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য একটি স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন করে’ অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠনের কথা তিনি বলেছেন, এটি হাস্যকর বক্তব্য। আর দুই বছর বয়সে মাওলানা নিজামীকে বোয়াইলমারী মাদরাসায় পড়তে দেখা। 

৩- শামসুল হক নান্নু তার তার এক ভিডিও বক্তব্যে সে বর্ণনা করেছে সে বাধ্য হয়ে নিজামীর বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। তার ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার বানানোর জন্য স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। সে তার ভিডিও বক্তব্যে আরো বলেছে হত্যাকাণ্ড যা হয়েছে পাকিস্তানীরা করেছে নিজামীকে আমদা দেখি নাই, তার নামও শুনি নাই। এই ব্যাপারে আমি আর বিস্তারিত বলছি না, দয়া করে তার বক্তব্য শুনুন। 

৪- প্রসিকিউশনের সাক্ষী জামাল উদ্দিন-এর এই ঘটনা সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। তিনি সাক্ষী মো.আইনুল হক ও শামসুল হক নান্নুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন। এই দু’জনের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় তাকেও বিশ্বাস করা যায় না। 

৫- সাক্ষী জহুরুল হক এই মামলার তদন্ত সমাপ্ত হওয়ার পরে প্রসিকিউশনের সাজানো সাক্ষী হিসেবে হাজির করায় তাকে বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তদুপরি তিনি দাবি করেন ঘটনার রাতে তিনি বাউশগাড়ি শহীদ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানকে জেরা করার সময় তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন বাউশগাড়ী গ্রামে আব্দুল জব্বার নামে ঐদিন শহীদ কোনো ব্যক্তির নাম তিনি পান নাই। সাক্ষী জহুরুল হক তদন্ত কর্মকর্তার সাথে তার দেখা হওয়ার বিষয়েও মিথ্যাচার করেছেন। কারণ তার মতে ১৭ মে, ২০১৩ তারিখের আগে তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে দেখা হয় নাই, দেখা যায় তিনি মূল তদন্তের সময় ২০১০ এর ৬ নভেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা সেটা স্বীকার করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি একজন মিথ্যাবাদী ও সাজানো সাক্ষী।

৬- আরেকজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী সাক্ষী আযহার প্রামানিক যিনি ঐ দিন ঐ ঘটনায় আর্মীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে মাওলানা নিজামী সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। তাকে দিয়ে মিথ্যা বলাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তাকে কোর্টে হাজির করা হয়নি। 

৬ নং অভিযোগের পর্যালোচনাঃ 
অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।

এই অভিযোগের তিনজন সাক্ষী ছিলেন। যাদের কথার উপর ভিত্তি করে আদালত মাওলানা নিজামীকে ফাঁসীর আদেশ দেয়। আসুন তাদের সাক্ষ্যের নমুনা দেখি। 

১- উক্ত চার্জের সাক্ষী মোঃ শাহজাহান আলী মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৮ নবেম্বরের আগে মাওলানা নিজামীকে আমি দেখেছি, আনোয়ারুল হকের নির্বাচনী জনসভায়। নির্বাচনী জনসভা গৌরী গ্রামে হয়েছিল। গৌরী গ্রামটি সাথিয়া থানাধীন, আমার গ্রাম থেকে ৫ মাইল দূরে। এই জনসভা শুনতে আমি যাই নাই।’ তিনি যদি জনসভায় না-ই যান তবে সেই জনসভায় মাওলানা নিজামীকে কিভাবে দেখলেন? সতরাং তিনি জেরায় অসত্য তথ্য দিয়েছেন। 

২- তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি টিভি চ্যানেলে অনেকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তবে তিনি দিগন্ত টি.ভি, চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কিনা মনে করতে পারেন নাই। দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার স্মরণশক্তি কমে গিয়েছে, কখন কি বলেন তা মনে থাকে না বলে তিনি দাবি করেন। তবে তিনি সেই সাক্ষাৎকার সমূহে ‘১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে মাওলানা নিজামীকে দেখেননি’ বলে বলেছিলেন সেটা অস্বীকার করেন। ডিফেন্স সেই সাক্ষাৎকার সমূহের ভিডিও সমূহ প্রদর্শন করেছে। সেখানে দেখা যায় যে, তিনি মাওলানা নিজামীকে ১৯৭১ সালে দেখার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই সাক্ষী শপথ করে কাঠগড়ায় এসে তার পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলায় তার সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। 

৩- উপরন্তু তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার স্মরণশক্তি কমে গেছে তিনি কখন কি বলেন তা মনে থাকে না। সুতরাং ৪৩ বছর আগের বিষয়ে এ ধরণের স্মৃতিশক্তিহীন ব্যক্তির সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি জেরার জবাবে বলছেন, তিনি পাবনা সাঁথিয়ার মিয়াপুর হাজী জসিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এসএসসি পাশ করেছেন। অথচ তিনি তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আহত হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে চার বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেছেন, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর সর্বপ্রথম পাবনায় ১৯৭৫ সালে যান। অতএব তিনি হয় ১৯৭২ সালে পাবনার একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার ব্যাপারে মিথ্যা বলেছেন অথবা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ৪ বছর অবস্থান শেষে ১৯৭৫ সালে সর্বপ্রথম পাবনা যাওয়ার ব্যাপারে মিথ্যা বলেছেন। সুতরাং এই স্ব-বিরোধী ও সাংঘর্ষিক বক্তব্য প্রদানকারী সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং তার জবানবন্দী গ্রহণযোগ্য নয়। 

৪- এই সাক্ষী জেরায় স্বীকার করেছেন যে, ব্যাংক ডাকাতিতে সহযোগী তার অভিযোগে সোনালী ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত হন। তিনি এই চাকরিচ্যুতির আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেননি। সুতরাং এই সাক্ষী অসৎ এবং তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। 

৫- তিনি তার জবানবন্দীতে বলেছেন যে, তার সাথে যেসকল মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মধ্যে তাকে ছাড়া তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। অথচ সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, শাহজাহান ছাড়াও আরও একজন বেঁচে যান তার নাম মাজেদ। সাক্ষী শাহজাহান আলী পরে স্বীকার করেন যে, মাজেদ এখনও জীবিত আছেন। এই ধরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি অসত্য তথ্য দেয়ায় তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। 

৬- উক্ত অভিযোগের আরেক সাক্ষী মোঃ খলিলুর রহমানের মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে দেয়া বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তিনি বলেছেন, ২৭ নবেম্বর দিবাগত রাতে রাত সাড়ে ৩টায় চাঁদের আলোয় তিনি মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন। অথচ ঐদিন বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চন্দ্র অস্ত গিয়েছিল রাত ১টা ২৩ মি. ৫৪ সেকেন্ডে। সুতরাং তার চাঁদের আলোয় মাওলানা নিজামীকে দেখার বিষয়টি অসত্য। 

৭- তার বক্তব্য অনুযায়ী তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জন (শাহজাহান ও মাজেদ) বাদে সকলে ঐদিন নিহত হন। পরে তিনি জেরায় বলেন, উক্ত ২ জন এবং কুদ্দুস ছাড়া তার গ্রুপের বাকী সবাই নিহত হন। পরে তিনি আবার স্বীকার করেন, উক্ত তিন জন ছাড়াও তার গ্রুপের সালাম ঐদিন বেঁচে যায়। একই সাথে তার তিন ধরণের বক্তব্য প্রদান থেকেই বুঝা যায় তিনি অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। 

৭- তিনি বলেছেন, ঘটনাস্থল ধুলাউড়ি গ্রামে তার আত্মীয় গফুর সাহেবের বাড়িতে তিনি ১৯৭১ সালে যাতায়াত করতেন। কিন্তু তিনি একই সাথে উক্ত গফুর ঐ সময় বিবাহিত নাকি অবিবাহিত ছিলেন বলতে ব্যর্থ হন। তিনি যদি ঐ সময়ে তার উক্ত আত্মীয়ের বাড়িতে সত্যই বেড়াতে যেতেন তবে তিনি অবশ্যই বলতে পারতেন উক্ত আত্মীয় ঐ সময়ে বিবাহিত না অবিবাহিত ছিলেন। সুতরাং বলা যায় ঐ সময়ে তার ঘটনাস্থলে যাতায়াতের বিষয়ে তিনি মিথ্যা বলেছেন। 

৮- তিনি দাবি করেছেন যে, মাওলানা নিজামী তার পাশের গ্রামের লোক হওয়ায় এবং তার গ্রামে মাওলানা নিজামীর বোন বিয়ে দেয়ায় তিনি ১৯৭১ সালের আগে থেকেই তিনি তাকে চিনতেন এবং তিনি শুনতে পেয়েছেন যে, নিজামী ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। তিনি দাবী করেছেন তিনি নিজামী সাহেবকে পারিবারিকভাবে চিনতেন অথচ জেরার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মাওলানা নিজামীদের কতজন ভাই-বোন বা মাওলানা নিজামী কোথায় কোথায় লেখাপড়া করেছিলেন তা বলতে ব্যর্থ হন। তিনি মাওলানা নিজামীর পিতার ব্যাপারেও কিছু বলতে ব্যর্থ হন। সুতরাং এতেই প্রমাণিত হয় যে, প্রসিকিউশনের শেখানো মতে তিনি নিজামীকে জড়িয়ে কথাগুলো বলেছেন, বাস্তবে আদৌ তিনি নিজামী সাহেবকে চিনতেন না। 

৯- তিনি স্বীকার করেছেন যে, রেজাউল করিম নামে সাঁথিয়ার একজন সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখেছেন, উক্ত বই ডিফেন্স পক্ষ দাখিল করেছে। উক্ত বইয়ের ২৭-২৮ পৃষ্ঠায় ধুলাউড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে কিন্তু মাওলানা নিজামী সেখানে উপস্থিত ছিলেন মর্মে কোনো বর্ণনা নেই। এখান থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মাওলানা নিজামী সাহেব উক্ত ঘটনার সাথে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নন। তিনি তার জবানবন্দীতে প্রদত্ত ‘ঐদিন রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করে আর্মীদের পায়ের বুটের শব্দ শুনতে পাই। তখন আমি ঐ বাড়ির ঘরের পূর্ব দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দেখতে পাই যে, মাওলানা নিজামী এবং কিছু দখলদার বাহিনী এবং কিছু রাজাকারসহ আমাদের ঘরের দিকে আসছে।’ বক্তব্যটি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছেন বলে দাবি করেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা তার জবানবন্দীতে অস্বীকার করেন যে, উক্ত সাক্ষী তার নিকট উক্ত কথাগুলি বলেছেন। যে ব্যক্তি মাত্র কয়েক বছর আগে প্রদত্ত জবানবন্দীর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলতে পারে, তিনি ৪২ বছর আগের ঘটনা সম্পর্কেও মিথ্যা কথা বলতে পারেন। সুতরাং এই সাক্ষীকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। 

১০- সাক্ষী মোঃ জামাল উদ্দিন এর বক্তব্যও এই ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন এবং এ ঘটনা তিনি সাক্ষী মো.শাহজাহান আলীর কাছ থেকে শুনেছেন। যেহেতু সাক্ষী মো.শাহজাহান আলীর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় সুতরাং তার কাছ থেকে শোনা সাক্ষী জামালউদ্দিনের বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

১১- প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত বই এবং ডিফেন্স পক্ষ কর্তৃক প্রদর্শিত বইতে ধুলাউড়ি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা আছে, অথচ কোথাও মাওলানা নিজামীর সংশ্লিষ্টতার কথা আসেনি। অর্থাৎ প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত দলিলেই ঘটনার সাথে মাওলানা নিজামীর সংশ্লিষ্টতার কথা আসেনি, সুতরাং মাওলানা নিজামী এই ঘটনার সাথে অপরাধী সাব্যস্থ করা জুলুমের নামান্তর। 

১৬ নং অভিযোগের পর্যালোচনাঃ
অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।

১- তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দীসহ অন্যান্য প্রমাণপত্র হতে দেখা যায়, তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের সময় মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়নি। পরবর্তীকালে ফরমায়েশী সাক্ষী সংগ্রহের মাধ্যমে অনেককেই এই অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষী মান্য করা হলেও শুধুমাত্র উল্লেখিত দুজন সাক্ষী ছাড়া প্রসিকিউশন পক্ষ কোনো সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে পারেন নাই। 

২- অপরাধের সময়কাল: চার্জ গঠনের আদেশে উক্ত অপরাধ সংঘটনের সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে বলা না থাকলেও বলা হয়েছে প্রধানত: অপরাধসমূহ সংঘটিত হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ অথবা এর আশেপাশের সময়ে। প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ১৫ নভেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে। এর সমর্থনে প্রসিকিউশন একটি বই দাখিল করেছে। এই চার্জের সমর্থনে প্রসিকিউশনের দুইজন মাত্র সাক্ষী যে দু’টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সে দু’টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ১৫ নভেম্বর এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। এখন বিচার্য বিষয় হলো উক্ত সময়ে মাওলানা নিজামী ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে আলবদরের প্রধান ছিলেন কি না? 

৩- ছাত্রসংঘ প্রধান: প্রসিকিউশনের দাবী মতে মাওলানা নিজামী সাহেব ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। ডিফেন্সের প্রদর্শিত ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এর পরে মাওলানা নিজামী নন বরং তাসনীম আলম মানজার ছাত্র সংঘের প্রধান ছিলেন। সুতরাং ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে আলবদর প্রধান হিসেবে ৩০ সেপ্টেম্বরের পরে সংঘটিত অপরাধের সাথে মাওলানা নিজামীকে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। 

৪- আলবদর প্রধান: প্রসিকিউশনের প্রদর্শিত ডকুমেন্ট অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বরের একটি সভায় আলবদর প্রধান হিসেবে মতিউর রহমান নিজামী নন বরং অন্য একজন উপস্থিত আছেন মর্মে দেখা যায়। সুতরাং প্রসিকিউশন ডকুমেন্টের থেকেই একথা প্রমাণিত যে মাওলানা নিজামী আলবদর প্রধান ছিলেন না। প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী আলবদর একটি সশস্ত্র অক্সিলারি বাহিনী যার স্বতন্ত্র সাংগঠনিক কাঠামো, মিলিটারি ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা, বেতনভাতা ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। একজন বেসামরিক ব্যক্তির এরকম একটি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রসিকিউশনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মাওলানা নিজামী ১৯৭১ সালের পুরো সময়েই একজন বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন। সুতরাং নিজামী সাহেবের আলবদর বাহিনীর প্রধান হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ সংক্রান্তে যুগোশ্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আপিল বিভাগেProsecutor VS Timohir Blaskic, Case No. IT-95-14-A para-114 মামলায় একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, একই ব্যক্তি একই সাথে বেসামরিক নাগরিক এবং সামরিক কর্মকর্তা হতে পারেন না। 

৫- মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন মর্মে প্রসিকিউশন ৪টি বই দাখিল করেছে। উক্ত বইসমূহের আলোচনায় স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে যে, কিভাবে রেফারেন্স বিকৃত করে অথবা রেফারেন্স ছাড়াই আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে মাওলানা নিজামীকে চিত্রিত করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রসিকিউশন প্রদর্শিত দুটি বইতে মাওলানা নিজামীকে আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা দাবি করা হয়েছে। উক্ত বই দুটির আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, একটিতে ভুল রেফারেন্সে এবং অন্যটিতে রেফারেন্স ছাড়াই এ দাবিটি করা হয়েছে এবং বই দুটির লেখকদের ১৯৭১ সালের ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। উল্লেখিত ৬টি বইই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালের পরে লিখিত। সুতরাং নি:সন্দেহে বলা যায়, মাওলানা নিজামীর সাথে আলবদরের কোনো দূরতম সম্পর্ক ছিল একথা প্রমাণে প্রসিকিউশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। 

৬- আলবদরের পরিচয়পত্র হিসেবে প্রসিকিউশন এই মামলায় ১১টি প্রদর্শন করেছে। উক্ত কার্ডগুলি প্রদর্শনকারী তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেন উক্ত পরিচয়পত্রসমূহ ইস্যু করেছেন একজন ক্যাপ্টেন। এর ইস্যুকারী এবং প্রতিস্বাক্ষরকারী উভয়েই পাকিস্তানী আর্মি অফিসার। নিজামী সাহেব যদি আলবদর প্রধান হতেন এবং এর উপর যদি তার কমান্ড এবং কন্ট্রোল থাকতো তাহলে অবশ্যই তার স্বাক্ষর থাকতো। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি আলবদরের প্রধান ছিলেন না এবং আলবদর বাহিনী তার কমান্ড এবং কন্ট্রোলে ছিল না। 

৭- আলবদরের প্রতিষ্ঠা এবং এর কমান্ড ও কন্ট্রোল: প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একাত্তরের ১৬ মে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তরুণ মেজর রিয়াদ হোসাইন মালিক এবং এর প্রথম কমান্ডারের নাম ছিল কামরান। সুতরাং প্রসিকিউশনের ডকুমেন্ট দ্বারাই প্রমাণিত যে, মাওলানা নিজামী আলবদরের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন না এবং প্রধানও ছিলেন না। ডিফেন্সপক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত তৎকালীন পাক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি কর্তৃক লিখিত বই The Betrayal of East Pakistan। উক্ত বইয়ের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় জেনারেল নিয়াজি স্পষ্টভাবে বলেছেন, আলবদর বাহিনী ছিল রাজাকার বাহিনীর একটি শাখা যার প্রতিষ্ঠা এবং কমান্ড ও কন্ট্রোলে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ডিফেন্সপক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত THE VANQUISHED GENERALS AND THE LIBERATION WAR OF BANGLADESH একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বই, যেখানে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল নিয়াজির সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ আছে। বইটির ১৪৯-১৫০ পৃষ্ঠায় জেনারেল রাও ফরমান আলী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং কমান্ড ও কন্ট্রোলে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বিশেষভাবে জেনারেল নিয়াজি। জেনারেল নিয়াজি তার সাক্ষাৎকারে ১৬৪-১৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন, অনেকে বলে রাজাকার আলবদর জামায়াতে ইসলামীর। এটা সত্য নয়। আমিই রাজাকার-আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠা করি এবং আমিই এটা নিয়ন্ত্রণ করতাম, আমি রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করতাম এবং জামায়াতের লোকদেরকে আমার কাছে ঘেষতে দিতাম না। এখান থেকেই পরিষ্কার হয় যে, মাওলানা নিজামী নন বরং পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশেষভাবে জেনারেল নিয়াজি ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং নিয়ন্ত্রক। 

৮- প্রসিকিউশন ১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামীর খবর সম্বলিত ২১টি পেপার কাটিং এবং ৬টি গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রদর্শন করেছে। এর কোন একটিতেও বলা হয়নি যে, মাওলানা নিজামী আলবদর বাহিনীর সাথে কোনভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন অথবা তিনি আলবদরের কোনো বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন। অথচ এ সমস্ত পত্র-পত্রিকা ও গোয়েন্দা রিপোর্ট সমূহে আল বদরের অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। যা চুড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নিজামী সাহেব আলবদরের সাথে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। 

৯- বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে। যদিও তদন্তকারী কর্মকর্তা ৪২টি মামলা হওয়ার বিষয়ে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার প্রদর্শিত বই “একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়” হতে দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে ৪২টি মামলা ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত দায়ের হয়েছে। তার প্রদর্শিত বই থেকে আরও দেখা যায় যে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডটির পরিকল্পনা হামিদুল হকের মালিকানাধীন অবজারভার পত্রিকার অফিসে হামিদুল হকের কক্ষেই সম্পন্ন হয়। এছাড়াও ভিডিও ডকুমেন্ট “রণাঙ্গনের দিনগুলি” হতে দেখা যায়, খান এ সবুরের বাড়ি থেকে মিরপুর মুক্ত হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীল নকশা উদ্ধার করা হয়েছিল। ঐ নীল নকশার বিবরণ বা নীল নকশাটি তদন্তকারী কর্মকর্তা সরকারের নিকট আবেদন করেও পান নাই অর্থাৎ তা আটকে রাখা হয়েছে। অন্যান্য দলিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক জহির রায়হানকে আহবায়ক করে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। ঐ কমিটির নথিপত্র জহির রায়হান সাহেবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম একটি দেশের একজন সাংবাদিকের হাতে তুলে দেয়া হয়, যা তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সংগ্রহের কোনো প্রচেষ্টা করেন নাই বা ঐ কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথেও যোগাযোগ করেননি। এ বিষয়ে সরকার কর্তৃক একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা আমরা বিভিন্ন দলিলপত্র হতে দেখতে পাই কিন্তু এ বিষয়ে ঐ কমিটি কি রিপোর্ট দিয়েছিল বা কি কি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন সে বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো বক্তব্য দেন নাই। তদন্ত সংস্থা কর্তৃক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে ১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা তদন্ত সংস্থায় প্রেরিত হলেও তিনি তা সংগ্রহ করেননি বা বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মামলা সমূহে কি বর্ণনা ছিল তা তিনি জানারও চেষ্টা করেননি। এরপরও যে ২ জন ব্যক্তিকে এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছে অর্থাৎ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এবং শহীদ ডা. আজহারের স্ত্রী সালমা হক তাদের স্বামীদের হত্যাকান্ডের বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা স্বীকার করলেও ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ মামলার আসামী সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি তবে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেছেন যে, ডা. আলীম চৌধুরীর মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। 

১০- এই দু’টি হত্যাকান্ডের বিষয়ে তদন্তে দালাল আইনে রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল। ঐ রিপোর্ট দাখিলের পূর্বে নিশ্চিতভাবে এই দুই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন তারা মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য প্রদান করেননি তা স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়। সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণে আমরা আরও দেখতে পাই, ঐ দুই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্তে স্বাধীনতার পরপরই দুজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাদেরকে ছেড়েও দেয়া হয়েছিল। তারা মাওলানা নিজামী সাহেবের অনুগত ব্যক্তি ছিলেন এই মর্মে কোনো প্রমাণ নাই। উপরন্তু ঐ দুই সাক্ষী যেভাবে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন তা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নাই। কেননা তাদের এই বক্তব্যসমূহ তারা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দেয়া জবানবন্দীর সময় বলেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা এই চার্জের তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পর্কে যে বক্তব্যের অবতারণা করেছেন তা মিথ্যাচার ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কারণ তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরে তিনি এই মামলার তদন্ত অব্যহত রাখেন অতিরিক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এই তদন্তের ধারাবাহিকতাতেই ১৩ তম সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীকে সাক্ষী মান্য করেন যে বিষয়ে তিনি চীফ প্রসিকিউটর বরাবরে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারির স্মারক নং- আন্ত: অপ: ট্রাই:/তদন্ত সংস্থা/৮৮ মূলে প্রেরিত চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, তিনি ৩০ অক্টোবর উক্ত সাক্ষীর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেন। অথচ তিনি তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন যে, তার সহযোগী তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম উক্ত সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন ২০১১ সালের ১০ মার্চ। দেখা যাচ্ছে যে, তদন্তের ধারাবাহিকতাতেই এই সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কথা বললেও এই তদন্তের কয়েক মাস পূর্বেই উক্ত সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে যা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। ইতিহাস পিছন দিকে ঘুরলেই ২০১১ সালের ১০ মার্চ তারিখটি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর হওয়া সম্ভব। কাজেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংক্রান্তে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগটি ফরমায়েশী এবং সাক্ষ্য প্রমাণও অনুরূপভাবে গৃহিত। 

১১- সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী তার জেরায় যে সমস্ত বিষয়ে স্বীকার করেছেন তাতে খুব সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি আদালতে অসত্য জবানবন্দী দিয়েছেন। সাক্ষী সালমা হক তার মামাতো ভাই ইকবাল আর্সালান বর্তমানে কি করেন তা বর্ণনা করতে পারেন, তার খালার স্বামী অর্থাৎ খালু ১৯৭১ সালে কিভাবে নিহত হয়েছেন তার বর্ণনা দিতে পারেন, কিন্তু তার মামা ডা. আসজাদ কোনো সময় জামায়াতে ইসলামী থেকে এম পি নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা বা আদৌ কোনো সময় এম পি নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা জানেন না বলায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ট্রাইব্যুনালে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য গোপন করে অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ ফরমাল চার্জের অসংলগ্ন ও অসত্য বক্তব্য, সে অনুযায়ী চার্জ গঠন, সাক্ষীদের অসংখ্য অসত্য তথ্য প্রদান, মিথ্যাচার, তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তে গাফিলতি, তথ্য গোপন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তদন্ত না করা এবং জেরা ও জবানবন্দীতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, পক্ষাশ্রিত ঘোষিত মিথ্যাচারী ব্যক্তিদের বই পুস্তককে সাক্ষ্য হিসেবে দাখিল করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাখিলি দলিলপত্র ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন না করা প্রমাণ করে যে, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

আমার বক্তব্য বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে কিছু প্রামাণ্য চিত্র।
১ নং ডকুমেন্টারি 
২ নং ডকুমেন্টারি
৩ নং ডকুমেন্টারি
৪ নং ডকুমেন্টারি

এত বিশাল আলোচনার পর আমি বিচারবিভাগ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাইনা। কেবল মহান বিচার দিনের জন্য অপেক্ষা। সেদিন নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা সুবিচার করবেন।

২৩ মার্চ, ২০১৬

আমার নেতা, আমার অহংকার


মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে ২৮ অক্টোবরের কথা। ২০০৬ সালে পল্টনের সেই ভয়াল দিনে মাওলানা নিজামী যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন পল্টনে চলছিল যুদ্ধাবস্থা। তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে শান্তভাবে তার বক্তব্য চালিয়ে গিয়েছেন। বার বার বলছিলেন শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। নেতা কর্মীদের বার বার নির্দেশ দিচ্ছেন সবাই যাতে শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। সেদিন জামায়াত-শিবিরের শত শত নেতাকর্মীরা হতাহত হলেও মাওলানা নিজামীর ধৈর্য্য ধরার কঠোর নির্দেশ তারা পালন করে। একজন নেতার কঠোর দূর্যোগ মুহুর্তেও ঠায় দাঁড়িয়ে ধৈর্য্যের উপদেশ দিতে পারার হিম্মত মাওলানা নিজামীকে না দেখলে বোধহয় আমাদের দেখার সুযোগ হতো না। মাওলানা নিজামী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে তার ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন । ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরপর তিন বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রআন্দোলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দুইবার তিনি গোটা পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

মওলানা নিজামী ছাত্রজীবন শেষ করে বৃহৎ ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। ১৯৭৮-১৯৮২ পর্যন্ত তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং আমীর নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২০০০সাল) দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী ৯০ এর আন্দোলন, ৯৬ তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রর্বতনের আন্দোলন সহ তিনি অন্যান্য সকল রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপামর জনতার সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর তিনি। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন ২০০১-২০০৩ এবং ২০০৪-২০০৬ সেশনে। তিনি ২০০৭-২০০৯ এবং ২০১০-২০১২ সেশনে পুনরায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বচিত হন ।

সুস্থ রাজনীতির চর্চাঃ
বাংলাদেশের কলুষিত রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন শুরু থেকেই। ১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে তার দেয়া বক্তব্য তিনি রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের কেমন আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই বিষয়ে এই বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমে সরকারি দলকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন শিক্ষণীয় ভূমিকা নিতে হবে তাদেরকেই। জাতি এটাই কামনা করে। পরমত সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। বিরোধী দলের সমালোচনা সহ্য করার অনুরোধ করেন। সেই সাথে তিনি বিরোধী দলের ব্যাপারে বলেন, “জাতি বিরোধীদলের ভূমিকাকেও গঠনমূলক দেখতে চায়। আবেগ নির্ভর হয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে গিয়ে যাতে পরিবেশ ক্ষুন্ন না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার। অপজিশনের খাতিরে অপজিশন, বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা যাতে না করে”। তিনি আরো বলেন, “অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যে জাতি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না সত্যিকার অর্থে সে জাতি তার ভবিষ্যতকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারেনা। কিন্তু ইতিহাসের আলোচনা শিক্ষাগ্রহনের উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত। কোন তিক্ততা সৃষ্টির জন্য অতীতের ইতিহাসের আলোচনা হলে যদি পরিবেশ বিঘ্নিত হয় সে ধরণের আলোচনা যেন আমরা সকলেই পরিহার করি”। 

ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টাঃ
মাওলানা নিজামী সবসময় ইসলামপ্রিয় দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এদেশের সকল ইসলামী দলকে আপন মনে করে, অন্তর থেকে তাদেরকে শ্রদ্ধা করে। আমি এতটুকু বলতে চাই, ভুল বুঝাবুঝির কারণে হোক বা যে কারণেই হোক জামায়াত ইসলামীর বিরুদ্ধে যারা সমালোচনা করেন তাদের বিরুদ্ধেও আমরা কোন কথা বলি না বলবো না। সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মত পরিস্থিতিতে জামায়াত ইসলামী আজ পর্যন্ত শরিক হয়নি। ভবিষ্যতেও হবেনা। আজকের এই সময়টি ইখতিলাফ নিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার সময় নয়। ইসলামে মতপার্থক্য ছিল, আছে এবং থাকবে। যে যেমতে বিশ্বাসী তাকে সে মতে থাকতে দিন। জোর করে একজনের মতের উপর আরেকজনের মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেই সেখানে ফিতনা ফাসাদের জন্ম হতে পারে। জামায়াতে প্রথম থেকেই এই ব্যাপারে সজাগ আছে, সজাগ থাকবে"।
"আমরা বিশ্বাস করি, যারা কুরআন হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত তারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে ফতোয়াও দেন তবুও তারা যে কাজটি করছে সে কাজটি আমাদের কাজ। তারা হয়তো কোন ভুল তথ্য পেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ কথা বলছে কিন্তু তারা যেহেতু আমাদেরই কাজ করছে তাই তাদের বুকে টেনে নেয়ার মত উদার আমাদের হতে হবে”। 

মাওলানা নিজামীর স্বভাবসুলভ বিনয়ঃ 
তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনোই কাউকে ধমক দেয়া, বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অসম্মান কিংবা কোন প্রকার কটুক্তি করেননি। অথচ বিরোধী দলের প্রতি কটুক্তি করা বাংলাদেশের খুবই প্রচলিত আচরণ। স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে তিনি সমালোচনার জবাব দিতেন। সংসদে কারো বক্তব্যের বিরোধীতা করার প্রয়োজন হলে অথবা প্রতিবাদ জানানোর দরকার হলে তিনি তা করতেন অত্যন্ত সম্মানের সাথে। ওলামা মাশায়েখদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার সময় তার বিনয় আমাদের কাছে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি ইসলামিক দলের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বলেন “এখানে যারা আসছেন তারা সবাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা মসজিদের ইমাম এবং খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন। আমি নিজে শিক্ষক নই, কোন মসজিদের ইমাম নই খতীব নই। আমি ছাত্র এবং মুক্তাদী। সুতরাং সমস্ত ওলামায়ে কেরামকে আমি আমার ওস্তাদতুল্য মনে করি সম্মান করি। আমি আপনাদের ইমাম ও খতীব হিসেবে শ্রদ্ধা করি”। এভাবে সব দল মত পেশার মানুষকে তিনি সম্মান করতেন। কথা বলতেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। 

বাবরী মসজিদ প্রসঙ্গে মাওলানাঃ
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর উপমহাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন বাবরী মসজিদ ভেংগে দেয়া হয়। ভারতে বাবরী মসজিদ ভাংগার প্রতিবাদে সারা দুনিয়াব্যাপী মুসলমানরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মসজিদ ভাংগার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে এদেশের বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ৫ম জাতীয় সংসদে বাবরী মসজিদের উপর আলোচনার জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রথমে সরকারী দল ও বিরোধী দল আলোচনার প্রস্তাবে রাজী হয়নি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের চাপে অবশেষে সংসদে বাবরী মসজিদ প্রসংগ আলাচনার জন্য উপস্থাপিত হয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশের তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে বাবরী মসজিদ প্রসংগে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। মাওলানা নিজামী মসজিদ ভাংগার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করে বলেন, বাবরি মসজিদ নিছক একটি মসজিদ নয়, ইসলামী আদর্শের, ইতিহাস, ঐতিহ্যের এবং সভ্যতার একটি বিরল প্রতীক এটি। তাই বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া সাধারণ কোন ব্যাপার নয়। এটাকে বিবেচনা করতে হবে আদর্শের উপর আঘাত, ইতিহাসের উপর আঘাত, একটি সভ্যতার উপর আঘাত, একটি ঐতিহ্যের উপরে আঘাত হিসাবে। গোটা বিশ্ব আজ এই কার্যক্রমের নিন্দা করছে। বাংলাদেশের দলমত নির্বিশেষে ১২ কোটি মানুষ এর নিন্দা করছে। সেই ১২ কোটি মানুষের এই সংসদ এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি নিন্দা প্রস্তাব নেবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। মাওলানা নিজামী ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধান ও মুসলিম জাতিসত্ত্বা বিনাশের চক্রান্ত রুখে দাড়ানোর আহবান জানিয়ে জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে বলেন, “বাবরী মসজিদের ঘটনা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সাথে আরো অনেক কিছু জড়িত আছে। আমি মনে করি, শুরু থেকে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের অনুসারী বর্ণ হিন্দুবাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য দৃষ্ট হচ্ছে এ বাবরী মসজিদ ভাংগা তারই একটা প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। বাবরী মসজিদ ভাংগার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হচ্ছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বানচাল করা এবং সার্ককে অকার্যকর করা। কারণ সার্ক এর অস্তিত্ব ভারতের আধিপত্যবাদী, আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী চরিত্র তথা মানসিকতার পথে একটা বড় বাধা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলো একত্রিত হয়ে ভারতের পাশাপাশি এক টেবিলে বসার সুযোগ আধিপত্যবাদী মানসিকতা চিরতার্থ করার পথে একটি বড় অন্তবায়। তাই ভারত সার্ককে মন থেকে চায় না”। মাওলানা নিজামী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে ভারতের মুসলিম জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের সর্বনাশা পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল ও আওয়ামী লীগের ভারতপ্রীতির সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।

ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে সংসদে আলোচনা: 
ফারাক্কা বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের জন্য জীবন মরণ সমস্যা। ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করে আসছে। জাতীয় সংসদে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর ২০ জন এম পি একযোগে দাড়িয়ে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্পীকার জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের দাবীর প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। মাওলানা নিজামী ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাতীয় সংসদে তুলে ধরে এ সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার দাবী জানান। তিনি জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে বলেন, মাননীয় স্পীকার, ফারাক্কার কারণে যে সেচ অসুবিধা হয় তাতে প্রায় ৩ লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আদ্রতা হ্রাসের কারণে ৩০লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, লবনাক্ততার কারণে ৬৪ লক্ষ একর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার আমাদের আছে। আমেরিকা মেক্সিকোর তুলনায় অনেক বড় দেশ, একটি মহাদেশ। কিন্তু কলোরাডা নদীর পানির উপর আমেরিকার যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। সুতরাং এ ব্যাপারে ঐক্যমতে আসা দরকার। সেই সাথে বিকল্প বাধের ব্যাপারে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

বসনিয়া পরিস্থিতিতে উদ্বেগ: 
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় সংসেদ বসনিয়া-হারজেগোভিনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় সংসদের স্পীকারের প্রতি নোটিশ প্রদান করেন। পার্লামেন্টের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর এই প্রথম সার্ববাহিনীর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। মোট এক ঘন্টার আলোচনার মধ্যে মাওলানা নিজামী জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে একাই আধঘন্টা আলোচনা করেন। তার এ আলোচনা জাতীয় সংসদে উপস্থিত সকল সদস্যের আবেগ ও অনুভূতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মজলুম মাবনতার পক্ষে নিজামীর আবেগময় বক্তব্য জাতীয় সংসদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষারে লেখা থাকবে।

পুশব্যাক: 
ভারত সরকার মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে পুশব্যাকের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জননেতা নিজামী জাতীয় সংসদে ভারত সরকারের এ ঘৃণ্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে ভারতের পুশব্যাককে পুশইন বলে আখ্যায়িত করেন। মাওলানা নিজামীর এ পুশইন জাতীয় সংসদে সকলের সমর্থন লাভ করে। ফলে ভারতীয় চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

ফাজিল ও কামিল-এর ডিগ্রী ও মাস্টার্স এর সমমান প্রদান ভূমিকা: 
বহুদিন ধরেই এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যাবস্থা ছিল অবহেলিত। সরকারিভাবে এখান থেকে নেয়া ডিগ্রীর মান দেয়া হতো না। এর প্রভাবে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কারণ মাদ্রাসা ছাত্রদের সার্টিফিকেটের মূল্য না থাকায় সরকারি চাকুরিসহ নানা চাকুরিতে বৈষম্যের শিকার হতে হতো। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মাওলানা নিজামী ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রী ও মাস্টার্স-এর সমমান প্রদান আন্দোলনে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় মন্ত্রীসভার এ সংক্রান্ত কমিটিতে তিনি অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৬ সালে এ কমিটিতে ফাজিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের সমমান প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মন্ত্রীসভায় তা পাস হয় এবং জাতীয় সংসদে তা অনুমোদিত হয়।

টিপাইমুখ নিয়ে মাওলানার ভূমিকা:
সিলেটের জকিগঞ্জ হতে ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের মনিপুর রাজ্যে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করছে ভারত। সুরমা-কুশিয়ারা ও মেঘনা নদীর পানি আসে এই পথে। এটি ৯৩০ মি দীর্ঘ ও ৯৬৯ মি উচু একটি বাঁধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি হবে আরেক ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধ হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গ্রীস্মকালে ৯৪৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে, বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে, প্রায় ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিকর প্রভাবের স্বীকার হবে, ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং শতাধিক নদী মরে যাবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। সিলেটে টিপাইমুখ অভিমুখে নৌমার্চ, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় মহাসমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। পল্টনে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশে মাওলানা নিজামী বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়। কোন বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জামায়াতে ইসলামী অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হলে সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বাংলাদেশের কোন স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে রুখে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। সাউথ এশিয়ান টাস্কফোর্স, টিকফা, ট্রানজিট বিরোধীতায় তিনি ছিলেন সরব। "টিপাইমুখ বাঁধের কারণে পারমানবিক বিস্ফোরণের মতই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ। টিপাইমুখে বাঁধ দিলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদী মরে যাবে। ফারাক্কার ক্ষতি সমূহের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের অহংকার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এক ফারাক্কার কারণে পদ্মা- যমুনা মরে গেছে। এখন মেঘনা যদি মরে যায় বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে ভাতে ও পানিতে মারার ষড়যন্ত্র হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ"। তিনি সরকারকে আহবান করেন টিপাইমুখ নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন করতে। অযথা সরকারের সমালোচনা না করে তিনি বলেছেন সরকার যদি টিপাইমুখের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে আমরা সরকারের হাতকে শক্তিশালী করবো। মাওলানা নিজামীর নেতৃত্বে সকল বিভাগীয় শহরে জামায়াত টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে জনসমাবেশের আয়োজন করে এবং জনগণকে সচেতন করে। জামায়াতে ইসলামীর দেশব্যাপী প্রচারণায় এটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ছাড়া সর্বমহল থেকে এ বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উঠে। অথচ সরকার এদিকে তো কর্ণপাত করেনি বরং সরকারের তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, আগে বাঁধ হোক, পরে দেখা যাবে।

ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কন্ঠঃ
জঙ্গীবাদের নামে ইসলামকে কলুষিত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র নিয়ে তিনি সারাজীবন কথা বলেছেন। এটাকে বিদেশী ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে তিনি বলেছেন বিদেশী শক্তি অনুপ্রবেশের জন্য এবং বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর জন্যই এতসব আয়োজন। জেএমবি নির্মূলে জোট সরকারের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন "পৃথিবীতে একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশই জঙ্গী নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই সক্ষম হওয়ার পিছনে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রেখেছেন এদেশের আলেম সমাজ। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন ওলামায়ে কেরাম। তারা প্রতিটি মসজিদ থেকে এই আওয়াজ তুলেছেন এই জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এতে যারা বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছিলেন তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের জঘন্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়"। 

মাওলানা নিজামী ইসলাম বিরোধী শক্তিদের ষড়যন্ত্র নিয়ে সবসময় সতর্ক করে গেছেন। ইসলাম বিরোধীরা ইসলামের মধ্যে বিভক্তির চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক ইসলাম এবং আধ্যাত্মিক ইসলাম বলে মুসলমানদের আলাদা করার প্রয়াস চালিয়েছে। আধ্যাত্মিক ইসলামকে প্রমোট করার মাধ্যমে যারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছে। পীর-মুরিদ তাসাউফ চর্চাই মূলত ইসলাম অন্য কিছু ইসলাম বহির্ভুত। ইসলামে রাজনীতি বলে কিছু নেই। এই ধরণের অপপ্রচার থেকে বেঁচে থাকার পরামর্শ তিনি সবসময় দিয়েছেন। 

কৃষি মন্ত্রনালয়ে অবদান: 
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা পচাশি জন লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়েই কৃষকদের জন্য কাজ করার ব্যাপারে মনযোগী হন। ফসলের ন্যায্য পাওনা, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাদের যাবতীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এর সুষ্ঠু সমাধানকল্পে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলক্ষ্যে তিনি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সফরের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, বিজ্ঞানী ও কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন। মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয় দায়িত্ব পালনকালে “চাষীর বাড়ী, বাগান বাড়ী” শ্লোগানকে দেশব্যাপী জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিনত করেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি চাষীর বাড়িকে এক একটি বাগান বাড়ি হিসাবে গড়ে তুলে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরন বাড়তি উপার্জন এবং স্বাবলম্বিতা অর্জন সহজ হয়েছে। মাওলানা নিজামীর ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় বৃক্ষ রোপন অভিযানে পৃথকভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে আলাদাভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। সরকারের একজন মন্ত্রী হিসাবে তিনি নিজে বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষরোপন করেন এবং অন্যানের মধ্যে বৃক্ষের চারা বিতরণ করে বৃক্ষরোপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির প্রয়াস চালিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ফল চাষ প্রকল্প ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, জনগণকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই ধানের ফলন বৃদ্ধি এবং সঠিক সংরক্ষনের দিকে ছিল তার সতর্ক দৃষ্টি। ধানের প্রধান দুই শক্র ইদুর এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রনে তার মন্ত্রনালয়ের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসা করার মত । আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সম্মেলনে তার ছিল সরব ভূমিকা। বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে মাওলানা নিজামীর সুপরিকল্পিত নির্দেশনার ছাপ। আখ, পাট, তুলা, ভূট্টা, মধু এমনকি শীতকালীন শাকসবজি পর্যন্ত তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি এবং কৃষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় কৃষি মেলার। এ ক্ষেত্রেও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মাওলানা নিজামীর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তার দিক নির্দেশনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম রাজশাহী, নওগা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশের কৃষি উন্নয়নে মাওলানা নিজামীর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো বি এ ডি সি বীজ উইং শক্তিশালী করণ, মাটিরগুনগত মান পরীক্ষাকরণ, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম পর্যালোচনা, কৃষিবিদ কৃষিবিজ্ঞানীদের যথাযথ পদোন্নতি এবং ব্লক সুপারভাইজার পদবী পরিবর্তন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদ চালু।

শিল্প মন্ত্রনালয়ে অবদান: 
বিগত ২০০৩ সালে ২৫শে মে কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে মাওলানা নিজামীকে শিল্প মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। উদ্দেশ্য ভেঙে পড়া বিপর্যস্ত রাষ্ট্রীয় শিল্পখাতকে পুনরুজ্জীবিত গতিশীল ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনা। দায়িত্ব নিয়েই মাওলানা নিজামী দেশের শিল্পক্ষেত্রে নতুন গতিসঞ্চারের প্রয়াস পান। বাংলাদেশের শিল্পখাতের সমস্যাগুলো তিনি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ সমস্যা দূরীকরণকল্পে তিনি দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দ্রুত বিকাশের লক্ষে পৃথক শিল্পনীতি প্রনয়ন করেন । এ নীতি প্রনয়নকালে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তা ও সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে মত বিনিময় করা হয়। নতুন শিল্পনীতি ২০০৫ সালে ৩২টি শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য মাননীয় শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি দিকনির্দেশনা কমিটিও গঠন করা হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এ কমিটি বৈঠকে মিলিত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিরাজমান সমস্যা সমাধানকল্পে বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা ও সুপারিশমালা প্রনয়নের কাজ করে চলেছে। ২০০১-০২ অর্থ বছরে যেখানে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১৫.৭৬% ভাগ, সেখানে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬.৫৮% ভগে। একই বছরে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪৪% ভাগ যা ২০০৫ সালে এসে দাড়িয়েছিল ৭.৪৮% ভাগে। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের শিল্পভিত্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে । চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাওলানা নিজামীর দায়িত্বাধীন শিল্পমন্ত্রনালয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যা দেশের শিল্পাঙ্গনে নতুন প্রান স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল। দেশে মিশ্রসারের চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামে দৈনিক ৮০০মে: টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট ডিপিএ-১ ও ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট ডিপিএ-২ নামে দুইটি নতুন সার কারখানা স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন কর্পোরেশনের আওতায় সম্ভাবনাময় বন্ধ শিল্পসমূহ পূনরায় চালু করার ব্যাপারে মাওলানা নিজামীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত ইতিবাচক। তারই ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রানান্তকর প্রয়াসে কর্ণফুলী পেপার মিলের বন্ধকৃত কস্টিক ক্লোরিন প্লান্ট, খুলনা হার্ডবোর্ড মিল এবং রংপুর সুগার মিল পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে। ফলে তখন এ ২টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানই লাভজনক অবস্থায় পরিচালিত হয়। এই লাভ ধরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন দীর্ঘ ১০ বছরের মধ্যে ২০০৫-০৬ আখ মাড়াই মৌসুমে মাওলানা নিজামী মন্ত্রী থাকাকালে প্রথম বারের মতো ৭০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ উন্নয়নের জন্য হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারি শিল্পকে সাভারে নতুন স্থাপিত চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন চলছে। এছাড়া ফার্মাসিউটিকেল ইন্ডাস্ট্রি, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ও অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের জন্য পৃথক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে হয়েছে। লবন আমাদের দৈনন্দিন ভোগ্যপন্যের একটি অপরিহার্য উপদান। দেশে মোট সাড়ে ১১ লাখ মে. টন লবনের চাহিদা থাকলেও বিগত ২০০৫-০৬ উৎপাদন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার মে. টন লবন উৎপাদিত হয়েছে যা এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। নি:সন্দেহে এ অর্জন মাওলানা নিজামীর সঠিক দিক নির্দেশনার ফসল। এ ছাড়াও বিগত ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে শিল্প মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ স্টিল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন তাদের উৎপাদন লক্ষমাত্রা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। মাওলানা নিজামীর দায়িত্বাধীন শিল্পনালয়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো বিসিকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৭৫ জন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, বি এস টি আই এর আধুনিকায়ন, ফুড ফর্টিফিকেশন এলায়েন্স গঠন, ন্যাশনাল এক্রিডিটেশন এবো গঠন ইত্যাদি জাতীয় মেধা সম্পদের অধিকার সংরক্ষন শিল্পের ব্যাপারে আমীরে জামায়াতের বক্তব্য ছিলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট এভাবে মন্ত্রী হিসাবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রতিটি ক্ষেত্রেই সততা দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন কালে তার দরদী মন ও সুন্দর আচরণ আজো স্মরণ করেন কর্মকর্তা কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সকলে।

মাওলানা নিজামীর নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন: 
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানামুখী ব্যস্ততার পরও মাওলানা নিজামী তার নিজ এলাকা সাথিয়া বেড়া থেকে এতটুকু বিমুখ হননি। সাথিয়া বেড়াবাসীর নন্দিত নেতা তিনি। এ এলাকার জনগণ তাকে তাদের এযাবতকালের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে গ্রহন করেছে। উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সাথিয়া বেড়া তথা পাবনাবাসীর নিকট তিনি কর্মনিষ্ঠা, সততা আর দক্ষতার মূর্ত প্রতিক। এমন কি প্রাকৃতিক দূর্যোগকে উপেক্ষা করেও তিনি তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। মাওলানা নিজামী বিশ্বাস করেন যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা রাস্তাঘাট ও ব্রীজ কালভার্টের উন্নয়ন যে কোন এলাকার উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই সাথিয়া বেড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে নজর দেন। জোট সরকারের আমলে তিনি ১৮৫ কি মি সড়ক পাকা করেছেন। পৌরসভার প্রায় প্রতিটি রাস্তাই সংস্কার ও উন্নয়নের ছোয়া পেয়েছে। আজ সাথিয়া বেড়া কোন অনুন্নত এলাকার নাম নয় একটি সম্ভবনার নাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ হলো শালগড় ঈদগাহ মাঠ হতে কালাইচড়া আব্দুল হামিদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা, ভবানিপুর থেকে শালগড় ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত সড়ক, বেড়া ডাকবাংলো থেকে সাথিয়া হয়ে মাধবপুর বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়ক, দেবিপুর তেবাডয়া বাজার থেকে স্বরগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়ক, মাধবপুর বিশ্বরোড় হতে দবিরশেখের বাড়ি হয়ে আবু বকর সিদ্দিকের বাড়ি সড়ক, নওয়ানী ফয়জের বাড়ী হতে ফজলুল হকের বাড়ি, হতে ঈদগাহ মাঠ সড়ক হতে নাটিয়া বাড়ী বিশ্বরোড পর্যন্ত রাস্তা মেরামত, আফড়া তমিন সরকারের বাড়ির ব্রীজ, হাজরাতলা বটগাছ মোড় হতে ভুলবাড়িয়া ইউপি অফিস সড়ক, নাড়িয়া গদাই থেকে জোড়গাছা সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ নির্মান, হলুদঘর থেকে গোপালপুর সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ নির্মান, সোনাতলা ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ, ভুলবাড়িয়া হতে হাট বাড়িয়া সড়কে ইছামতি নদীর উপর ব্রীজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আরো অনেক সড়ক তার প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সংস্কার বা মেরামত করা হয়েছে। 

যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অবকাঠামোগত আরও অনেক উন্নয়ন মাওলানা নিজামীর হাত ধরেই হয়েছে। জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা বিস্তারে মাওলানা নিজামীর রয়েছে অনন্য অবদান। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সাথিয়া বেড়া অঞ্চলের ১০টি মাদ্রাসার এমপিওভূক্তি বাতিল করা হয়। জোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরপরই তা পূর্ণবহাল করা হয়। তার প্রত্যক্ষ আনুকূল্যে এখানকার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের সোপান খুজে পেয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : সাথিয়া ডিগ্রী কলেজ, আল হেরা একাডেমী, ইমাম হোসেন একাডেমী, নাকালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাকালিয়া বাতেনিয়া দাখিল মাদ্রাসা, বেড়া আলিম মাদ্রাসা, হুইখালি বাংলা উচ্চবিদ্যালয়, সাথিয়া যশোমন্ত দুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিষ্মুবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, খলিশাখালি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পীরহাটিসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলোকদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরপাইরহাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলন্দা উচ্চ বিদ্যালয়, পাথাইলহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাগডেমরা ১নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাথিয়া ডিগ্রী কলেজ, বোয়াইলমারী কামিল মাদ্রাসা, সাথিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মনজুর কাদের মহিলা কলেজ, বেড়া আল হেরা একাডেমী, বেড়া ডিগ্রী কলেজ, বেড়া আলিম মাদ্রাসা, বেড়া বি বি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি। আমাদের দেশের জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে পরিনত করতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই এ কথাটি তিনি যথাথই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা উন্নয়নই নয়, ছাত্র ছাত্রীদেরকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতেও মনোনিবেশ করেন। এর মধ্যে কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনা, পুরস্কার প্রদান, বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

মাওলানা নিজামীর প্রত্যক্ষ উদ্যোগ ও অর্থানুকূল্যে সাথিয়া বেড়া উপজেলায় বাস্তবায়িত আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে, মসজিদ মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মান, উন্নয়ন ও অর্থায়ন, বিদ্যুতায়ন, বৃক্ষরোপন, স্বস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মান ও উন্নয়ন। আমরা জানি, বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি দুষ্ট ক্ষতের ন্যায় কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগও রয়ে গেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাসই প্রধান। সাথিয়া বেড়া বা পাবনাও এ থেকে মুক্ত নয়। বেড়াকে যমুনা নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষার জন্য তার আন্তরিক প্রয়াস সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। বেড়া পানি উন্নয়ন বোডের অধীনে যমুনার পশ্চিম তীর সংরক্ষন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সে কাজে ব্যয় নিরুপন করা হয়েছে ২৫০,০০,০০০/= টাকা। ফলে কৃষকরা আগে যেখানে বছরে একটি মাত্র মৌসুমে ফসল পেত সেখানে এখন তিনটি ফসল ফলানো সম্ভব হবে। বিগত বন্যায় অসহায় মানুষ তাকে যেভাবে কাছে পেয়েছে তাতে তিনি তাদের চোখের মনিতে পরিনত হয়েছেন। জীবনের ঝুকি অগ্রাহ্য করে তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে দেখছেন বন্যার্তদের অবস্থা। তাদের মাঝে বিতরণ করেছেন চাল ডালসহ খাদ্রদ্রব্য, পরিধেয় বস্ত্রাদি এমন কি জীবন রক্ষাকারী ঔষধও। বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন জনগণের মনে সাহস সঞ্চার করার। শুধু এখানেই নয়, দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্থরা যাতে আবার দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে তার জন্য নগদ অর্থ, ঢেউটিন বিতরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এমন একজন মানুষকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করার কারণ তিনি এদেশে ইসলামকে বিজয়ী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। সেক্যুলার ও ইসলাম বিরোধীরা তা হতে দিতে চায় না। তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশের সত্যিকার স্বাধীনতা ও সার্ভভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে। দেশবিরোধী দালাল চক্র এবং ভারতীয় আধিপত্যের দোসররা তাঁর সেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব সহ্য করতে পারেনি। তাই তাকে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে তারা তাদের পথের কাঁটা সরাতে চায়। মাওলানা নিজামী এদেশের সম্পদ। এ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এমন দূরদর্শী নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধের ধোঁয়া তুলে সাজানো মিথ্যা মামলায় ভীনদেশী এজেন্ডার বাস্তবায়ন হলে এদেশ হারাতে পারে এমন সোনালী মানুষ। হতে পারে অভিভাবকশূন্য। এ সত্য দেশবাসী উপলব্ধি করতে পারলেই কল্যান। আর এর ব্যতিক্রম হলেও মনে রাখা দরকার- আদর্শবাদীদের পরাজয় নেই। সুনিশ্চিত বিজয়ের পথেই তাদের যাত্রা নিরন্তর...

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং এর পর্যালোচনা

২২ মার্চ, ২০১৬

কেন তাফহীমুল কুরআন পড়বেন?


উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তাফসীর গ্রন্থ তাফহীমুল কুরআন উর্দু ভাষায় লিখিত। লিখেছেন এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ হযরত সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রঃ। এই তাফসীরে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আপনাকে কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।   

বৈশিষ্ট্য 

তাফহীমুল কুরআনের কিছু বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করবো যা এই তাফসীরকে অন্যান্য তাফসীর থেকে আলাদা করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রাসঙ্গিক করেছে।

১. কুরআনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক:
এই তাফসীর এমনভাবে লিখা হয়েছে যাতে পাঠক সরাসরি কুরাআনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। নামকরণ, শানে নুযুল, বিষয়বস্তু ধারাবাহিক আকারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে পাঠক নাযিলের সময়ের প্রেক্ষাপটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারেন। এটি কুরআন বুঝা এবং আল্লাহর আদেশ বুঝার ক্ষেত্রে খুবই জরুরী।
   
তাফহীমুল কুরআনে প্রথাগত বাহাস নেই বললেই চলে। এই কিতাব পুরোপুরি ইসরাইলিয়াতমুক্ত। অতীতে আলোচিত বাহাস ও কালামী বাহাস হতেও মুক্ত এই তাফসির গ্রন্থ। ফিকহি বাহাসও এখানে সীমাবদ্ধ। জাতিগোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কুরআনের আদেশ এবং নির্দেশসমূহের বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকায় উসুলে তাফসিরের প্রথাগত বাহাস বা পর্যালোচনার কোন সূত্র পাওয়া যায় না। তাফহীমে কেবলমাত্র শানে নুযুলের বর্ণনা এসেছে একটি ভিন্ন মাত্রায়। এখানে নাসেখ ও মানসুখের বাহাস নেই, মুহকাম ও মুতাশাবেহ আয়াতের বিতর্ক নেই। উপমাসমূহ, প্রকারভেদ এবং কুরআনের কিসসাসমূহ নিয়েও তেমন বাহাস পর্যালোচনা নেই। তবে আবার এমন নয় যে তাফহীমুল কুরআনে এসব একেবারেই নেই। সকল জরুরি এবং প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ নিজ নিজ স্থানে তথা যথাস্থানে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাফসিরে কুরআনের মৌলিক দৃষ্টিকোণকে হালকা করে দেখা হয়নি। বরং এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আল কুরআনের বিষয়বস্তু, মূলবক্তব্য, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবার জন্য। সাথে সাথে কুরআন পাঠকের হৃদয় মনে এমনভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যার দ্বারা এক নতুন মানুষ এবং একটি নতুন মানব সভ্যতা বিকশিত হতে পারে। যেমন সভ্যতা ও মানব সমাজ আল কুরআন দেখতে চায়। এজন্য তাফহীমুল কুরআনের রচয়িতা বিভিন্ন বাহাস বা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে নিজের শ্রম ও মেহনত কুরআনের মৌলিক বিষয় ও পরিভাষাসমূহ পরিষ্কারভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরার পেছনে ব্যয় করে গেছেন। 

২. কুরআনের নান্দনিকতা :
তাফহীমুল কুরআনের দ্বিতীয় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কুরআনের অসাধারণ নান্দনিকতা রক্ষা করা। নাযমে কুরআন বা কুরআনের নন্দনতত্ত্ব তাফসীর শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। পূর্বের বিজ্ঞ মুফাসসিরগণ ব্যাপকভাবে সূরা সমূহের পারস্পরিক মিল ও ধারাবাহিক সংযোগের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। কিছু কিছু মুফাসসিররা আবার আয়াতসমূহের ধারাবাহিক মিল ও পারস্পরিক অন্তমিলের বিষয়টি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। অন্য একটি দল সমগ্র সূরাকে এক একক ধরে সূরার ভেতরের সব আয়াতকে একটিই মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন এবং সেখান হতেই সূরার সকল বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়কে বের করে এনেছেন। 

তাফহীমুল কুরআনে উপরে আলোচিত সব বিষয়েরই ছোঁয়া পাওয়া যায়। তবে এগুলোর মধ্য হতে নন্দনতত্ত্ব, নান্দনিকতা ও অলংকার শাস্ত্রের সকল সূত্রকে ছাপিয়ে যে বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো কুরআনের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং লক্ষ্যবিন্দুর সাথে প্রত্যেকটি সূরা এবং প্রতিটি আয়াতকে সম্পর্কিত ও সংযুক্ত করা হয়েছে। তাফহীমুল কুরআনে দেখানো হয়েছে ‘‘এই কিতাবটি (অর্থাৎ কুরআন) তার সমগ্র পরিসরে কোথাও তার বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে পড়েনি। 

প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সবসময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য ও একাত্মতা সহকারে তার সমস্ত আলোচনা ‘ইসলামী দাওয়াত’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে।

কুরআনের বর্ণনা করার এই নান্দনিক আবিষ্কার তাফহীমুল কুরআনের এক অনন্য কীর্তি। মওদূদী রহ. তার আলোচনায় যথাসম্ভব পরিভাষাগত জটিল শব্দ ব্যবহার পরিত্যাগ করেছেন কিন্তু তার রচিত তাফসীর এক অনন্য স্বতন্ত্র স্বাচ্ছন্দ্য পরিভাষার জন্ম দিয়েছে। তাফহীমুল কুরআনে প্রত্যেক সূরার বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য ও আয়াতসমূহের বক্তব্যকে আল-কুরআনের মূল লক্ষ্য ও দাওয়াত হতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতুৎপন্নমতিময় দ্রুততার সাথে বের হতে থাকে। 

অতঃপর এটা তাফহীমুল কুরআনের এক অনবদ্য কীর্তি যে এই তাফসির শুধুমাত্র আল কুরআনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি বরং কুরআনের এই নান্দনিক সংযোগকে প্রতিটি সূরা এবং কুরআনের সূরাসমূহের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তাফহীমুল কুরআনের সূরাসমূহের ভূমিকার আলোচনা এক্ষেত্রে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং টীকাসমূহের জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণেও কুরআনের সেই নান্দনিকতা তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। 

৩. তাফহীমুল কুরআনের অনুবাদ: 
তাফহীমুল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন দিক হতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। শাব্দিক তরজমা না করে তাফহীমুল কুরআনে স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছন্দ ভাবানুবাদের একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু অসাধারণ বিষয় হলো কোন একটি ক্ষেত্রেও এই স্বচ্ছন্দ অনুবাদ কর্ম অনুবাদের সীমা অতিক্রম করে যায়নি। তাফহীমুল কুরআনেই ধারাবাহিক স্বচ্ছন্দ অনুবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র অনুবাদ অধ্যয়ন করলেই পাঠকের দেহমনে সেই প্রভাব বিস্তৃত হয় যা কুরআন সৃষ্টি করতে চায়। এই স্বচ্ছন্দ অনুবাদে সেই বাণী শোনা যায় যা কুরআন বলতে চায়। 

তাফহীমের অনুবাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানে বক্তৃতার ভাষা লেখনীর ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে- ফলে একটি উৎকৃষ্ট অনুবাদ কর্মের সাথে সাথে এটা কুরআনী জ্ঞান চর্চার নতুন এক মাইল ফলক উন্মোচন করেছে। তাফহীমুল কুরআনের তরজমাতে বক্তৃতার ভাষাকে সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরে মাওলানা মওদূদী র. অর্থের গুরুত্ব বিচারে প্যারাবদ্ধ করেছেন। এই পদ্ধতিতে বয়ানের সিলসিলার সাথে সাথে একটি বিষয় হতে অন্য বিষয়ে যাবার সংকেত ও নির্দেশিকাও দিয়ে দেয়া হয়েছে। 

৪. সূরা সমূহের ভূমিকা :
তাফহীমুল কুরআনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সূরাসমূহের ভূমিকাও অন্যতম। প্রতিটি সূরার তাফসীর ও তরজমা শুরু করবার পূর্বে মওদুদী রহ. সংশ্লিষ্ট সূরার ঐতিহাসিক পটভূমি, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়, বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সূরা সমূহের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং বিষয়বস্তুর সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতাকে কুরআনের সম্মিলিত লক্ষ্যবিন্দু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং কুরআনের মূল দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত করে বর্ণনা করা হয়েছে। নাযিল হওয়ার সময়কাল ও নাযিল হওয়ার উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা করে তার চমকপ্রদভাবে বিবৃত করা হয়েছে।  

৫. আহকামে কুরআন :
তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মধ্যে বর্ণিত ফিকহী নির্দেশসমূহ। কুরআনের যে আয়াত হতে কোন নির্দেশ পাওয়া গেছে তা সেখানেই তথা যথাক্রমিক স্থানেই বলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া অন্য যে সমস্ত জায়গায় একই বিষয় আলোচিত কিংবা বর্ণিত হয়েছে তাও বলে দেয়া হয়েছে। এইভাবে তাফহীমুল কুরআনে কুরআনের তাফসীর করার চেষ্টা করা হয়েছে খোদ কুরআন হতেই। আরও যে বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়েছে তা হলো প্রতিটি বিষয়ে কুরআনের মূল শিক্ষা এবং কুরআন প্রদর্শিত চরিত্রনীতি ও সংস্কৃতির মৌলিক অবকাঠামোর আলোকে বিষয় বিবরণী ও নির্দেশনা দেয়া হোক। সাথে সাথে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। নবী করীম সা. ও সাহাবায়ে কেরাম (র.) কোন আয়াত কিংবা নির্দেশের যে তা’বীর ও ব্যাখ্যা করেছেন তাফহীমুল কুরআনে তাও বিবৃত করবার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে সাহাবাদের মধ্যে অথবা আলেমদের মাঝে মতভেদ দেখা দিয়েছে তাও বিবৃত করা হয়েছে; সাথে সাথে মতভেদের ভিত্তিও বলে দেবার চেষ্টা করেছে তাফহীমুল কুরআন। সাধারণভাবে কোন ব্যাখ্যায় হানাফী চিন্তাধারার আলোকে মূল ব্যাখ্যা করা হলেও অন্যদের দৃষ্টিকোণও তুলে ধরা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ হতে তাফহীমুল কুরআনে ফিকহী মাযহাবসমূহের মতামতের যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে তা আগামী দিনের গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সাহায্যকারী উপাদান ও ফলপ্রসূ হতে পারে। সাথে সাথে সম্মিলিতভাবে উম্মতের ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপনেও নতুন পথের সূচনা করবে।

৬. আহলে কিতাবদের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা :
তাফহীমুল কুরআনে ইহুদীবাদ, খ্রিষ্টবাদ এবং কুরআনের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই পর্যালোচনাসমূহে বাদানুবাদের পরিবর্তে চেষ্টা করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মবেত্তা’ যাজক শ্রেণী এবং পশ্চিমা কর্তৃক উত্থিত প্রশ্নসমূহের সাধ্যমত ন্যায়সংগত এবং সমাধানমূলক উত্তর দেবার। অতঃপর অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে আল কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী এবং বর্তমান বাইবেলের লিখিত রূপের পরিষ্কার পার্থক্য। যেন বিকৃত ওহী এবং অকাট্য অবিকল ওহীর মধ্যকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মানুষ যেন আসল বিষয়টি বুঝতে পারে। মওলানা মওদূদী রহ. আল কুরআনকে নিজস্ব দলিল প্রদানের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে অতঃপর অন্যান্য ধর্মমত আলোচ্য বিষয়কে যেভাবে পেশ করে তার তদ্রূপ সমালোচনা করে দুটোর পার্থক্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। নিজের অবস্থানকে তুলে ধরবার জন্য তিনি ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ, আধুনিক বাইবেলের সমালোচনা ও অন্যান্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনসমূহকে উপস্থাপন করেছেন।

একইভাবে তিনি আধুনিক মতবাদসমূহ এবং সেই যুগে উত্থিত আন্দোলনসমূহের যাচাই পর্যালোচনা এবং সমালোচনা করেছেন এবং সেই মতবাদ ও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত লোকের আল কুরআনের যে মনগড়া অপব্যাখ্যা করার অপচেষ্টা করেছিল তিনি তার বিপরীতে সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তার তাফসীরে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, জ্যোতিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা এবং ভূগোল থেকে শুরু করে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বেশুমার আলোচনা ও পর্যালোচনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তিনি জ্ঞানরাজ্যের ঐ সকল শাখা হতে কমবেশি অনেক কিছু নিয়েছেন কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি কুরআনকে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হিসেবে বিবেচিত করেছেন। 

৭. রেনেসাঁর বা পুনর্জাগরণের ধারণা :
তাফহীমুল কুরআনের আলোচনা থেকে যেটা প্রতীয়মান হয় সেটা হলো সনাতন ও নতুনের মাঝে রেনেসাঁর বোধ তথা জীবন ধারণ ও যাপনের জন্য নতুন দিনের জীবনবিধান। মওলানা মওদূদী রহ. এর কলম সবসময় চরম ও পরমপন্থার পথ পরিহার করে চলেছে। যারা খোদার দ্বীনকে মসজিদ-মিম্বার, ব্যক্তিগত জীবন ও খানকাহের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ করেছিলো মওলানার কলম তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠেছে, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।

যারা ইসলামের নাম নিয়ে ধর্মের আলখেল্লা পড়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কথা বলে কুরআনের আদেশ নিষেধবাণীকে ছেলেখেলার বস্তুতে পরিণত করেছে তিনি কঠোর ভাষায় তাদের সমালোচনা করেছেন। মওলানা মওদূদী রহ. এর বক্তব্যের মূলকথা ছিলো এমন ধারণা ও প্রেরণা জন্মাতে হবে যে, আল কুরআন মোতাবেক নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। এটাই ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন সমূহের সংগ্রামী দাওয়াত ও কর্মনীতি। তাফহীমুল কুরআন নবুয়্যতের যুগ হতে আজ পর্যন্ত উম্মতের সত্যনিষ্ঠ জনমন্ডলীর অনুসৃত এই কর্মনীতিকেই তুলে ধরেছে এবং হেদায়েতের এই রাজপথকে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর আলোতে উদ্ভাসিত করবার চেষ্টা করেছে। 

৮. নতুন ভাবে কুরআন থেকে শিক্ষাগ্রহণ :
তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি বিশেষত্ব হলো এই কিতাব একটি নয়া ইলমে কালামের ভিত্তি গড়েছে। প্রতিটি যুগের মাসলা-মাসায়েল এবং যুক্তিতর্ক বাহাস ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। প্রত্যেক কালে ও যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের নিজস্ব স্তর হয়। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানসমূহও পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। কালস্রোতে যেগুলোর চলন ও প্রভাব চলে আসে। খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন এমনকি স্যার সাইয়েদ স্কুলের পক্ষ হতে যেসব উক্তি করা হয় সেসব প্রশ্নকরণের জবাব দেয়ার ব্যবস্থা আমাদের যুগে অবশ্যই করা হয়েছিল। কিন্তু একথাও একটি বাস্তব সত্য পাশ্চত্য নিশানা লক্ষ্য টার্গেট জ্ঞান ও শিল্পকলার টার্গেট করা হয়নি, যার ছত্রছায়ায় তারা এই সব উক্তি করছিল কিংবা প্রশ্নবান ছুড়ে দিচ্ছিল কিংবা আপত্তি উত্থাপন করছিল। 

কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষা ও নির্দেশনাকে মৌল ভিত্তি ধরে এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে ধর্মের নামে যে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার বর্তমান জমানায় প্রচলিত হয়েছে এ সবের একটি মৌলিক কারণ হলো কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষাকে এবং কুরআনের বাস্তব জীবন দর্শনকে সুন্নাতে রাসূল সা. এর আলোকে না দেখে খন্ডিত রূপে দেখা হয়েছে। 

৯. বিষয় নির্দেশিকা:
তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি অসামান্য বৈশিষ্ট্য এর বিষয় অভিধান। ইংরেজী ভাষায় একে ইনডেক্স বলে। আমরা বাংলাতে সূচী, নির্ঘণ্ট, নির্দেশিকা, কোষগ্রন্থ, অভিধান প্রভৃতি বলে থাকে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অনেক বিচিত্র, মূল্যবান এবং অতুলনীয় বিষয় অভিধান কিংবা কোষগ্রন্থ পাওয়া যায় পৃথিবীর নানা ভাষায়। কিন্তু তাফহীমুল কুরআনের স্বতন্ত্র বিষয় অভিধান এর নিজ তুলনায় স্বয়ং তুলনাহীন। এটা কুরআন ও তাফহীমুল কুরআনের তামাম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সূচীর এক স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। আল কুরআনের যেখানে যেখানে কোন নীতি নির্ধারণী বিষয় কিংবা কোথাও কোন ছোট খাট বিষয়ের আলোচনার অবতারণা ঘটেছে সেসব কিছু অত্যন্ত যত্নসহকারে এই নির্ঘণ্টে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেসব গবেষক মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিয়ে গবেষণা করেন তাদের জন্য কুরআনের বিষয়াবলীর বিশালতা এবং নির্দেশিকার প্রসারতার সামনে এই বিষয় অভিধানকে একটি অন্যতম নেয়ামত মনে হবে। তাফহীমুল কুরআনকে যদি জ্ঞানের একটি বিশ্বকোষ ধরা হয় তাহলে এই নির্ঘণ্ট সেই বিশ্বকোষে গিয়ে চড়বার সিঁড়ির সাথে তুলনীয়। 

আশা করছি কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে এবং নির্যাস আস্বাদন করতে তাফহীমুল কুরআন পাঠ অনন্য ভূমিকা রাখবে। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের সবাইকে কুরআন অনুধাবন এবং সে অনুসারে আমল করার তাওফীক দান করুন। 

২১ মার্চ, ২০১৬

ভারতের পানি আগ্রাসন: নির্যাতিত বাংলাদেশ


কাগজে কলমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে এর সম্পর্ক আসলে তা পুরোপুরি মীন করেনা। এদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়”। এ মূলনীতির ভিত্তিতে সকলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সহাবস্থানে বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারত কখনই সেরকম আন্তরিক সুপ্রতিবেশী ও বন্ধুসুলভ মনোভাব দেখায়নি। বরং এদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একের পর এক আগ্রাসন নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও খুলনার পাটকলগুলোর যন্ত্রাংশ লুণ্ঠন থেকে শুরু করে তিন বিঘা করিডোর, বেরুবাড়ি, দক্ষিণ তালপট্টি দখল, ফারাক্কাবাঁধ নির্মাণ, সীমান্ত সন্ত্রাস, চোরাচালান, নির্বিচারে নিরীহ নাগরিক ও কৃষকদের পাখির মত গুলি করে হত্যা, পুশ ইন, সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরের নদীর চর ও কৃষি জমি দখল করা, ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে নৌ ও সমুদ্র সীমালঙ্ঘন, মাদক পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান দেশের ভেতরে গুপ্তচর নিয়োগ ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে একের পর এক বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে।

ফারাক্কা বাঁধ :
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোটবড় সব মিলিয়ে ২০০টিরও বেশি নদ-নদী রয়েছে। এছাড়াও, ছড়া, নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ইত্যাদি রয়েছে অসংখ্য। এসব নদীর মধ্যে ৫৭টি হল আন্তর্জাতিক নদী যার মধ্যে ৫৪টির উৎস তিব্বত (চীন), নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে। বাকি ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে । বাংলাদেশের অবস্থান ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানে যে কোন ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশই ভোগ করবে। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবানগোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে এক মরণবাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পশ্চিম সীমানা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) উজানে গঙ্গা নদীর ওপর। ১৯৬১ সালে এর মূল নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয় যা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। ১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে এই ৪১ দিনের জন্য অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধটির সকল ফিডার ক্যানেল চালু করে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে এটা ভারত আজ পর্যন্ত বন্ধ করেনি। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে কিছুটা সফলতা থাকলেও ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির সফলতা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এর গ্যারান্টি ক্লজ বা অঙ্গিকার অনুচ্ছেদ না থাকায় বাস্তবে ফলাফল প্রায় শূন্য। এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে আমাদের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিনির্ভর দেশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন এদেশের নদী, মাটি, কৃষি, বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী, পাখি, মৎস্য ও পরিবেশ। এই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধের প্রভাবে দেশের মানচিত্র থেকে প্রায় ২০টি নদী মুছে গেছে এবং প্রায় ১০০টি নদীর মরণদশা (পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী)। আর বাকিগুলোর বুকে চর জেগে ইতোমধ্যে জনবসতি শুরু হয়েছে এবং একই নদী একাধিক ক্ষুদ্র ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। স্রোত না থাকায় এদেশের নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে এর উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নদীসংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর অত্যধিক নদীভাঙনের কারণে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। এর ওপর আবার ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প!


ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প :
ভারত আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং এর সকল অববাহিকার নদ-নদীর পানি বাঁধ, জলাধার ও সংযোগ খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে দক্ষিণের কাবেরী নদী পর্যন্ত টেনে নেবে এবং রাজস্থানের থর মরুভূমিসহ ঐ সকল রাজ্যের খরাপীড়িত অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এটাই River Linking Project বা আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এই “রিভার লিংকিং প্রজেক্ট” এ ব্যয় হবে প্রায় ২শ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই আন্ত:নদী সংযোগের ক্ষেত্রে দু’বার সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করেছে।
এই প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি ছোট-বড় নদীর পানিপ্রবাহকে ৩০টি আন্ত:সংযোগ খালের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধের ভেতর দিয়ে যুক্ত করা হবে এবং এধরনের সংযোগ ঘটিয়ে ৭৪টি জলাধারে পানি সংরক্ষণ করে পানিপ্রবাহ ভারতের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের খরাপ্রবণ রাজ্যগুলোতে বণ্টন করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি প্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা হয়ে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও কর্ণাটক দিয়ে তামিলনাড়ু পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। গঙ্গার পানি পৌঁছবে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটে। উভয় দিকের প্রবাহ প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ঘুরিয়ে আবার একত্রে আনা হবে। তাছাড়া ৯টি বড় এবং ২৪টি ছোট ড্যামের সমন্বয়ে ৪টির মাস্টারপ্লান তৈরি করতে নেপাল ও ভূটানের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ২৮/০৬/০৬ তারিখে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুবর্ণরেখা-মহানন্দা (৩৭৩ কিলোমিটার), গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা (৩৯৩ কিলোমিটার), ফারাক্কা-সুন্দরবন (৬০৩ কিলোমিটার) এবং যোগীগোপা-তিস্তা-ফারাক্কা (৪৪০ কিলোমিটার) পর্যন্ত সংযোগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩০/০৬/০৬)। এই আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের সাথে বাংলাদেশের জন্য আর একটি ভয়াবহ ও বিপজ্জনক মরণফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প। এই প্রকল্প এলাকা সিলেট শহর থেকে ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) এবং সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসাদ সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬১ মাইল) উজানে মণিপুর রাজ্যের বরাক উপত্যকার চারাচাঁদপুর টুইভাইয়ের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে ১৬ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর মিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি জলাধার ও বাঁধ নির্মাণের কাজ বর্তমানে এগিয়ে চলছে। বিকল্পপথে পানিপ্রবাহের জন্য বৃহদাকার দু’টি স্লুইসগেট এবং দুটি সুড়ঙ্গ জলপ্রবাহের পথ তৈরি করে সেখানে ১৫শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে ৫,১৬৩ কোটি টাকা। এক তথ্য মতে, এই বাঁধটি হবে ১২৫ মিটার উঁচু এবং ৩৯০ মিটার দীর্ঘ। এতে মোট ১৫.৯ হাজার মিলিয়ন ঘনমিটার পানি মজুদ করে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। পানি মজুদ করে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ, নৌচলাচল সুবিধা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে এবং এর ফলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এলাকার প্রায় ২ লক্ষ একর জমির ফসল ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে। এর সাথে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মনু প্রকল্পের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়বে। এই বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে মেঘনার মূল স্রোতধারা সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সংশ্লিষ্ট সকল নদীর পানিপ্রবাহ ভীষণভাবে হ্রাস করবে। ভারত কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন উল্লিখিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে পুরো সিলেট অঞ্চল (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা), ময়মনসিংহ অঞ্চলের পূর্ব, কুমিল্লা অঞ্চলের উত্তর এবং ঢাকার পূর্বাঞ্চল বিরাণ ভূমিতে পরিণত হবে। পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, উচ্চাভিলাসী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা ও পুরো ব্রহ্মপুত্র, সংকোশ এবং তিস্তাকে সংযোগ করে বিশাল পানিপ্রবাহ থেকে ১৭৩ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রাপ্ত উক্ত পরিমাণ পানি দিয়ে ভারতের ৩৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে কৃষিকাজ করা সম্ভব হবে এবং আরো ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাওয়া সম্ভব হবে। তবে, ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এই প্রকল্পের ফলে হিমালয় হতে নি:সৃত নদীসমূহের ৩৫ ভাগ পানি বাষ্পাকারে আকাশে উড়ে যাবে। ফলে রাশিয়ার একদা উচ্চাভিলাষী প্রকল্প যেমন- বুমেরাং-এ পরিণত হয়েছিল, ভারতও সেরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে উক্ত বিশেষজ্ঞগণ অভিমত পোষণ করেছেন।


ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবঃ
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, এই আন্ত:নদী প্রকল্পের বাস্তবায়নে তাতে শুধু আরেকটা মাত্রা সংযোজনই করবে না বরং অর্থনীতি, রাজনীতি ও পরিবেশের বিপর্যয়ে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পে খোদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাদের অংশের পরিণতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। 

(১) বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণ : গঙ্গানদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে ইতোমধ্যে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব মধ্যাঞ্চলের সকল নদ-নদীর পানি আসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও মেঘনা থেকে। এসব নদী এবং এর উপনদীগুলোর উৎপত্তি প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, তিববত (চীন) ও ভুটানে অবস্থিত হিমালয়ের হিমবাহ থেকে। এগুলো আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীগুলোর পানি কোন দেশের একক সম্পদ নয় বরং এসব নদীর পানিপ্রবাহ সকল দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা না করে বরং পেশিশক্তির জোরে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের মত উচ্চাবিলাসী প্রকল্প চালু করে পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে আজ পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করাচ্ছে। এছাড়া দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এখন মরুকরণের মত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নদীমাতৃক এই দেশটির বেঁচে থাকার অন্যতম উৎস পানি। এই পানিকে ভারত ফারাক্কা বাঁধের পর দ্বিতীয় উচ্চাভিলাসী প্রকল্প হিসেবে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প (River Link Project) হাতে নিয়েছে। 

বাংলাদেশের মোট পানিপ্রবাহের ৬৫ থেকে ৬৭ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের শুকনো মৌসুমে গড় পানিপ্রবাহ ১,২৩,০০০ কিউসেক। এর ভেতর ঐ ক্যানালে নিয়ে যাওয়া হবে ১,০০,০০০ কিউসেক এবং গঙ্গা নদীর শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ ৮০ হাজার কিউসেক (কম বেশি হতে পারে) এর মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক প্রত্যাহার করে ঐসব ক্যানালে প্রবাহিত করা হবে। ফারাক্কা বাঁধের পর দ্বিতীয় বার এই আন্ত:নদী সংযোগ মেগাপ্রকল্প ছাড়াও মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারার মূল উৎস বরাক নদীর উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের টিপাঁই গ্রামের চারাচাঁদপুর টুইভায়ের সঙ্গমে টিপাইমুখ নামক স্থানে বরাক নদীতে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু (Hydro Electric Power Plant) করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সে লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঁধ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে নাগা-মণিপুর রাজ্যে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এই সব মেগাপ্রকল্প ছাড়া আরও ২২টি নদী শাখা-প্রশাখা থেকে প্রবাহিত পথে বাঁধ দিয়ে নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এগুলোর মধ্যে তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, গুমতি, খোয়াই, মনু, কোদালিয়া, ইসালিছড়া, ফুলছড়ি, আধার মানিকছড়া, ছাগলনাইয়া ছড়া, মহামায়া ছড়া, গইরাছড়া, গজারিয়া ছড়া, কাচুয়া ছড়া, মাবেস নদী ছড়া, মাতাই ছড়া, উজিরপুর ছড়া, চন্দান ছড়া, রাজেশপুর তেতনা ছড়া, কমলা ছড়া ও ভৈরব সঙ্গলী নদী উল্লেখযোগ্য। এ সকল নদীর পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় ইতোমধ্যে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশে ভীষণভাবে প্রভাব পড়েছে। এই সব মরণ ফাঁদ প্রকল্পের ফলে পুরো বাংলাদেশের ভবিষ্যত পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

ভূমিরূপের স্বাভাবিক স্তরের বিপরীতে এ ধরনের কৃত্রিম খাল বাংলাদেশের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করছে এবং করবে। এছাড়াও এ ধরনের কর্মসূচী পুরো দেশের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত করবে। এই আন্ত:নদী সংযোগ থেকে ভারত যদি এই বিশাল পানিপ্রবাহ একসাথে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হবে এবং শিল্প উৎপাদন, সেচ, শক্তি, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ প্রভৃতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাতে সারা বাংলাদেশের নদী অববাহিকা অঞ্চলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

পানির দেশের মানুষ পানির জন্য এ রকম হাহাকার! মাছের দেশের মানুষ মাছের জন্য হাহাকার! কোন সচেতন মানুষ এসকল দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বুঝতেও পারবে না যে, এদেশের নদ-নদী ও পরিবেশ আজ কতটা অসহায়! এই অবস্থার পরেও যদি ভারত আবার আন্ত:নদী সংযোগ কিংবা টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাহলে পুরো দেশ পোরশা, সাপাহার কিংবা নাচোলের মত অবস্থায় পরিণত হবে। এই নদীনির্ভর ছোট্ট ভূ-খন্ডটির বিশাল জনগোষ্ঠী ও পরিবেশ আজ এবং আগামীতে বিপন্ন। এই দেশটি মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফারাক্কা এবং অন্যান্য বাঁধের প্রভাবে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে মরতে শুরু করেছে এবং কিছু নদীর চিহ্ন ইতোমধ্যেই মুছে গেছে। বাকিগুলোও মরণপথের যাত্রী। 

২। লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সুন্দরবন বিনাশ : 
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তর প্রাকৃতিক এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনটি দিন দিন বিনাশ হচ্ছে। উজানে ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে বাঁধের কারণে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই অমূল্য সম্পদ আজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বনটি বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন তা পাচ্ছে না। উজান থেকে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সাগর থেকে জোয়ারের সময় মাত্রাতিরিক্ত লোনাপানি বিভিন্ন নদী, খাল ও ছড়া দিয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে। এই লোনাপানি বনের ভেতর প্রবেশের কারণে সুন্দরবনের পানি ও মাটির লবণাক্ততা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের পাকা ফল মাটিতে পড়ে বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে চারাবৃক্ষ জন্মাতে পারছে না। কেননা ছোট ছোট চারাগাছের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন, তা না পাওয়াতে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে বৃক্ষশূন্য অঞ্চলে বাষ্পীয়ভবন বেশি হওয়ায় পানির স্তর (Ground level water) অনেক নিচে নেমে যায়। অন্য দিকে এই বৈরী পরিবেশের কারণে বনে পাখিকুলের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যে সব পাখি ফল খেয়ে বীজ অন্যত্র নিয়ে ফেলে, সেখানেই স্বাভাবিকভাবে বৃক্ষ জন্মে। আর সেই বীজ বৃক্ষ থেকেই বিশাল বৃক্ষের জন্ম নেয়।

প্রয়োজনীয় পানির অভাবে সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষরাজি আজ বিপন্ন। ইতোমধ্যে অধ্যুধিক লোনাপানি বনে প্রবেশের কারণে সুন্দরী আগা মরা রোগের (টপ ডাইং) বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম সাতক্ষীরা জেলার বৃক্ষ বিনাশকারী এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক হানাহানি, মানুষের ভেতর দেশপ্রেমের অভাব ও জন-সচেতনার কারণে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন আজ ক্রমশ ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, সুন্দরবনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী গাছ আগা মরা রোগে আক্রান্ত। ১৯৭০ দশকের চেয়ে বর্তমানে সুন্দরবনে গাছ, মাছ, পশু এবং পাখিকুলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লোনা ও স্বাদুপানির মিশ্রণের অনুপাত সঠিক না থাকা অর্থাৎ সুন্দরবনের মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেখা দিয়েছে লোনাপানির আধিক্য। ফলে গাছের ডগায় এবং শেকড়ে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। বনের ভেতরে নদী ও খালে পলি পড়ে নাব্যতা হ্রাস হেতু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মৃত্তিকার বিশেষ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে মিঠাপানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধিই সুন্দরবন বিনাশের প্রধান কারণ বলে সর্বজনমহলে স্বীকৃত।

সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে মৃদু লবণাক্ততা উদ্ভিদের জন্য সহায়ক। কিন্তু অতিরিক্ত লবণের কারণে সুন্দরবন ও এর আশপাশের বৃক্ষশোভিত সকল বেষ্টনী বিপন্ন হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটিতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মাইক্রোমস ও পানিতে ৩ হাজার মিলিমস পর্যন্ত লবণের পরিমাণ সহনীয়। সুন্দরবনের আশেপাশে ইছামতি, পশুর, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ প্রভৃতি নদীতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে লবণ ছিল ১৯ হাজার মিলিমস। এর পরিমাণ বেড়ে বর্তমানে ৬০ হাজার মিলিমসে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে সুন্দরবনের মাটিতে লবণ ছিল ৩২ হাজার মাইক্রোমস, যা বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার মাইক্রোমস এ দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের সময় লোনাপানি সাগর থেকে সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রবেশ করে। নদীতে স্বাদু পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে সেই প্রবাহ সাগরের লোনাপানিকে ঠেলে পুনরায় সাগরে নিয়ে যায়। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি লবণাক্ততা। এই লোনায় আক্রান্ত সুন্দরবনের সবুজ বন ও গাছপালা দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সাগরের লোনাপানির আঘাতে বেশ কয়েক প্রজাতির ধান ও মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এমনকি লোনা পানির আধিক্যের কারণে বনের বিভিন্ন এলাকা “ব্লাস্ট ও টপ ডাইং” রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ মারা গেছে এবং যাচ্ছে।

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য বাঁধ দেয়ার কারণে দেশের বৃহত্তম বন সুন্দরবন বিনাশের পথে। কারণ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে এরকম কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে তার আপন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য এবং এর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর কারণে বনটি এখন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। বনটি বিনাশের সাথে সাথে ধ্বংস হচ্ছে দেশের জীববৈচিত্র্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার পথ। ফলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর। এরপর যদি ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয় তাহলে কী হবে আমাদের দেশের অবস্থা! কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিণতি! তাই সময় থাকতে আমাদের শাসকগোষ্ঠী বা সরকার এবং সর্বস্তরের মানুষকে দলমত নির্বিশেষে সচেতন হতে হবে, রক্ষা করতে হবে দেশকে।

১৯৭৪ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৩৮০ মাইক্রোমস। বর্তমানে তা তিনগুণ থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা একাধারে মানবসম্পদ ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। সমুদ্র থেকে যে লবণাক্ত পানি জোয়ারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে তা অপসারণ করতে নদীর স্বাভাবিক মিঠাপানির প্রবাহ প্রয়োজন। তাতে লবণ পানি আবার সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে দেশের নদ-নদীতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ফলে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। সে কারণে সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী খুলনা অঞ্চলের প্রধান কয়েকটি নদীতে গত কয়েক বছর ধরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ নদ-নদীতেই এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ লবণাক্ততা বিরাজ করছে। খুলনা জেলার রূপসা, শিবসা, কাজীবাছা ও পশুর নদীতে ২০০২ সালের মার্চ মাসের তুলনায় ২০০৩ সালের মার্চে লবণাক্ততা গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রূপসা নদীতে গত এক বছরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ, শিবসায় ৫৬ শতাংশ, কাজীবাছায় ২৫ শতাংশ এবং পশুর নদীতে এ হার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩। কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে : বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এদেশের অর্থনীতি। এদেশের প্রায় ৮৫ ভাগ লোক কৃষিজীবী। দেশটিতে রয়েছে বিস্তীর্ণ সমভূমি আর ঊর্বর নদীপলল সমৃদ্ধ মৃত্তিকা। বৃষ্টিবহুল উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এদেশকে উৎকৃষ্ট কৃষিভূমিতে পরিণত করেছে। এদেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশ জমি কৃষিযোগ্য এবং চাষাবাদের জন্য নদীনালার পানির ওপর নির্ভরশীল। এ সব জমিতে আউশ, আমন, ইরি ও বোরোসহ বিভিন্ন প্রজাতির ধান উৎপন্ন হয়। এক সময় এদেশের মাটিকে বলা হত ‘সোনার চেয়েও খাঁটি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, আজ এদেশের মানুষ শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারছে না। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় গভীর অগভীর কোন নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির স্তর ভয়াবহভাবে নিচে নেমে গেছে। পানির জন্য সর্বত্র হাহাকার। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গঙ্গা নদীর ওপর ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানির সিংহভাগ প্রত্যাহার করে ভারতের খরাপীড়িত অঞ্চলে কৃষিকাজ চালাচ্ছে আর আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষি জমিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। ফলে দেশের অনেক জায়গায় পুড়ে যাচ্ছে ফসল এবং ফসলী জমি। পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দু’মাস বর্ষাকাল। অথচ এই বর্ষাকালেও দেশে পর্যাপ্ত পানি নেই। যেখানে দেশের প্রায় ৭০% সেচকার্যে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল সেখানে পানির অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় সেচকার্য চালাতে পারছে না। তারপর পানিপ্রবাহের স্বল্পতার কারণে সমুদ্র থেকে জোয়ারের সাথে প্রচুর লবণ পানি প্রবেশ করে জমির ঊর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে হাজার হাজার নলকূপে আরও বেশি পাইপ বসিয়ে গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্বাভাবিক স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প তথা গঙ্গা- কপোতাক্ষ প্রকল্প (G.K. Project) এলাকায় পাম্পিং ক্যাপাসিটির প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বৃষ্টির আশায় কৃষকরা বিলম্বে চাষাবাদ শুরু করে, ফলে ফলন কমে যাচ্ছে। কৃষকেরা শাক-সবজি চাষের জন্য বৃষ্টি অথবা হাজামজা পুকুরের পানির ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তা-ও ঠিকমত পাচ্ছে না। বৈরী পরিবেশের কারণে নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য থাকা এবং অনাবৃষ্টির কারণে অনেক সময় কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চাষী বা সবজি উৎপাদনকারী ভীষণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশের উজানে প্রধান নদীসমূহে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ এবং দেশের বিভিন্ন নদীতে ক্রস বাঁধ তৈরিতে পানি প্রবাহ হ্রাস, পলি ভরাট এবং জলজ পরিবেশ দূষণের ফলে ৫৬টি নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে শতভাগ ধ্বংস ও কয়েকটি নদীর ওপরের অংশ ৯০ শতাংশ বিচরণক্ষেত্র বিলীন হয়েছে। এর প্রধান কারণ অবাধে জাটকা নিধন ও মিঠা পানির চারণভূমি হ্রাস।

৪। নদ-নদীর বিলুপ্তি : বাংলাদেশে এক সময় নদ-নদী ছড়ানো ছিল জালের মত। এ জন্য এদেশকে বলা হত নদীমাতৃক দেশ। উনিশশ’ সত্তরের দশকের গোড়ার দিকেও ছোটবড় সব মিলিয়ে প্রায় একহাজার থেকে পনেরশ’ নদী ছিল। কিন্তু ঐ সকল নদীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ এ। কোন কোন তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে নদীর সংখ্যা ২৩০টি। এগুলোর মধ্যে প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী। প্রধান নদী পাঁচটির মধ্যে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র এর উৎপত্তি মূল হিমালয়ে এবং এগুলো ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের বর্তমানে প্রধান প্রবাহ নব-ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা (Young Brahmaputra) যা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের উত্তরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। অতঃপর দক্ষিণ-পূর্বে ১০৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের কয়েক কিলোমিটার উজানে মেঘনায় মিলিত হয়ে এটি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। ভারত কর্তৃক ফারাক্কাসহ অন্যান্য নদীর উৎস-মুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে ইতোমধ্যেই দেশের নদীগুলোর করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। 

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য ঘেরা এই গঙ্গা (পদ্মা) এখন মৃত্যুমুখে। গঙ্গা-পদ্মার ক্ষীণদশার জন্য দায়ী ফারাক্কা বাঁধ। আর এর ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তো বাঁধাগ্রস্ত করছেই সেই সাথে ঘটছে সামাজিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ জমি গঙ্গাবিধৌত। শুধু বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মাছ ধরা ও চাষাবাদসহ জীবন জীবিকা নির্ভর এই নদীর ওপর। অথচ নাব্যতা হারিয়ে পদ্মার বুকে প্রতি বছর চরের সংখ্যা ও এর উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসব চরে দিন দিন জনবসতি বেড়েই চলেছে। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারিপুর ও শরিয়তপুরের পদ্মার চরে এ সংখ্যা বেশি। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উত্তরে পদ্মায় একাধিক চরের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পদ্মা নয় পুরনো ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, (নব-ব্রহ্মপুত্র) এবং মেঘনা নদীরও একই অবস্থা। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় দেশের অন্য সকল নদীর চেয়ে বেশি চর সৃষ্টি হয়েছে। এসকল চরে এখন বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে অন্তত ১০টি চরে (২০০৭ এর তথ্য) কমপক্ষে দু’হাজার পরিবারের বসবাস। এদের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এরকম শুধু ব্রহ্মপুত্র আর যমুনায়ই সীমবদ্ধ নয়, সারা দেশের প্রায় সকল বৃহৎ নদীগুলোর একই করুণ দশা। আর শাখা-প্রশাখাগুলো বছরে প্রায় ৮-৯ মাসই পানিশূন্য বা মৃতাবস্থায় থাকে অতএব অতি সহজেই বোঝা যাচ্ছে দেশের প্রধান নদীগুলোর করুণ পরিণতি। তাহলে এদের শাখা-প্রশাখার অবস্থা কী হতে পারে!

গত তিন দশকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের ২৩০টি নদীর মধ্যে অনন্ত ৮০টি নদী, উপনদী ও শাখানদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাসের কারণে বৃহৎ নদীসমূহ মৃত নালায় পরিণত হচ্ছে। যেখানে ১৯৭১ সালে দেশে মোট নাব্য নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১শ’ ৪০ কিলোমিটার। বর্তমানে সেখানে শুকনো মৌসুমে এর পরিধি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮শ’ কিলোমিটার। এ পরিধি দিন দিন আরও কমছে। চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। দু’হাজার কিলোমিটার জুড়ে চর, প্রমত্তা পদ্মা এখন মৃতপ্রায় স্রোতহীন নদী। পাকশি নর্থবেঙ্গল পেপার মিলের পাম্প স্টেশনের নিচে চর জেগে ওঠায় পদ্মা এখন একটি খালে পরিণত হয়েছে। জেগে ওঠা এসব চরে কৃষকেরা আখ, বাদাম ও ধান চাষ করছে। 

সুজলা-সুফলা এই দেশে শীতের শুরু থেকে সমগ্র শুকনো মৌসুম জুড়ে নদীতে পানি থাকে না। পানির অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নদীসমূহের নাব্যতা সংকটের কারণে দেশের নৌপথ প্রতিবছর সংকুচিত হচ্ছে। আবহাওয়ার স্বাভাবিকতার পরিবর্তন বাড়ছে। পলি জমে নদীর তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় বর্ষাকালে উত্তরের পাহাড়ি ও বৃষ্টির পানি সীমিত আয়তনের নদীসমূহ বহন করতে পারছে না। ফলে বন্যার পানি নদী ছেড়ে উপকূলের গ্রাম-গঞ্জে ঢুকে পড়ায় প্রতি বছর বন্যায় দেশের শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করে এবং বানভাসী মানুষেরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। নদীর সংখ্যা হ্রাস এবং নাব্যতা সংকটের কারণে নদীর অস্বাভাবিক এ আচরণ। এর ফলে প্রতিনিয়ত নদী ভাঙন বেড়ে চলছে ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে সহায় সম্বলহীন এবং শহরমুখী।

পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রধান নদীপ্রবাহ তিনটি-পদ্মা (গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র-যমুনা (নব-ব্রহ্মপুত্র) এবং মেঘনা এই তিনটি প্রবাহের সাথে যুক্ত দেশের বড় ও মাঝারি আয়তনের ২৩০টি নদ-নদী। উজান থেকে আসা ঐ তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ কৃত্রিম কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর সাথে সংযুক্ত অন্য নদ-নদীগুলোর অবস্থাই বদলে গেছে। আর এর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে একটি আদি ব্রহ্মপুত্র এখন মৃতপ্রায়। শুকনো মৌসুমে এর অধিকাংশ এলাকায় পানি থাকে না। এই আদি ব্রহ্মপুত্রের পানি এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার একর জমির সেচের উৎস ছিল। কিন্তু এখন পানির অভাবে সেই সমস্ত সেচ প্রকল্পগুলো বন্ধ। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথের ব্যবসা বাণিজ্য, উপরন্তু ব্রহ্মপুত্রের চরে এখন রবিশস্যের চাষ হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের দীর্ঘতম প্রমত্তা নদী তিস্তা ধীরে ধীরে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। যেখানে তিস্তা ব্যারেজকে সচল রাখার জন্য দরকার কমপক্ষে ৫ হাজার কিউসেক পানি সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৫০ কিউসেক। ফলে উত্তরাঞ্চলের সেচভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে ঐ অঞ্চলের তিস্তার পুরনো ধারা আত্রাই, করতোয়া ও পুনর্ভবার ওপর। তিস্তার দু’টো শাখা নদী বাঙ্গালী ও ঘাঘট শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।

এক সময়ের পদ্মার প্রধান শাখানদী প্রমত্তা গড়াই এখন শুকনো মৌসুমে থাকে প্রায় পানি শূন্য। কেবল বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রবাহমান হয়। রাজবাড়ি জেলার ওপর থেকে বয়ে যাওয়া সেরাজপুর হাওড় ও চন্দনা এখন মৃত নদী। ফরিদপুরের কুমার নদী দিয়ে কয়েক দশক আগেও বড় বড় স্টিমার চলাচল করত। কিন্তু সেদিনের সে কুমার এখন কঙ্কাল নদী। বৃহত্তর কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলের প্রায় সকল নদীর মাতানদী ছিল মাথাভাঙ্গা। এখন শুকনো তো দূরের কথা, বর্ষা মৌসুমেও এককালের প্রমত্তা মাথাভাঙ্গা থাকে নীরব, নিথর ও প্রাণহীন।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়াই-মধুমতির নিম্ন প্রবাহ বলেশ্বর। এই বলেশ্বর নদীর নামডাক ছিল বিখ্যাত আর অন্য সব নদীর চেয়ে আলাদা। পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা বিভক্তকারী এই নদীতে প্রচুর ইলিশ ও হাঙ্গর পাওয়া যেত। আর এর স্রোত ছিল তীব্র। কিন্তু ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে কয়েকবার বরিশাল হয়ে খুলনা ভ্রমণকালে দেখা গেল যে, বলেশ্বর ছিল একেবারে নীরব ও নিস্তব্ধ। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে একে দেখলে সকলে ভাববে এটি একটি স্রোতহীন মৃতপ্রায় নদী। সাগরের তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থান বিধায় নাজিরপুর থেকে জিয়ানগর উপজেলা পর্যন্ত ছোট ছোট নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু এই নদীর অবস্থা দিন দিন আশংকাজনক। পদ্মার আর একটি বৃহত্তর শাখানদী আড়িয়াল খাঁ। এই আড়িয়াল খাঁকে প্রমত্তা পদ্মার এক সময় প্রধান প্রবাহ নির্গমন পথ হিসেবে গণ্য করা হত। সেই আড়িয়াল খাঁ-র উৎসমুখ সদরপুর থেকে মাদারিপুর পর্যন্ত অবস্থা অত্যন্ত করুণ। শিবচরের যেখানে আড়িয়াল খাঁ সেতু নির্মিত হয়েছে সেখানে সেতুর ওপরে দাঁড়ালে এর করুণ দৃশ্য সহজেই দেখা যায়। নদীটি বর্ষা মৌসুমে সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে মৃতপ্রায়। দু’তীরের চরে চাষ হচ্ছে চীনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, পাট, গাম, আখ ও শাক-সবজি। সারিবদ্ধভাবে সাদা কাশফুল শোভা পাচ্ছে, এরই কিছু ভাটিতে বিভিন্ন উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রমত্তা পদ্মার শাখা কীর্তিনাশাসহ কয়েকটি নদীর অবস্থাও অত্যন্ত আশংকাজনক। সেখানে সংস্কারের কোন লক্ষণ নেই এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপজ্জনক।

যশোর ও খুলনা অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ, হরিহর, নবগঙ্গা, চিত্রা, ব্যাঙ, ইছামতি, ভৈরবসহ প্রায় সকল নদী শুকনো ঋতুতে মৃতপ্রায় দশা। এছাড়াও কালনী, ডাকুয়া, বেতনা, বেগবতী, মুক্তেশ্বরী, হাঁসকুড়া, বাগমারা, চিলা, শোলামারি (সৈলমারী), ভদ্রা, ঘুমনা, টেকা, হানু, শ্রী, সোনাই ও কালিন্দী নদীর অবস্থাও একই রকম।
কুমিল্লার দুঃখ নামে পরিচিত ছিল গোমতী নদী। এখন শুকনো মৌসুমে সেটি শুকিয়ে থাকে কিন্তু বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। তবে স্রোত আর আগের মত নেই। অপরদিকে তিতাস নদীসহ এর সকল শাখানদীর অবস্থা আরও করুণ। পুবের টিলাপাহাড় থেকে নেমে আসা চোয়ানো পানিতে বর্ষা মৌসুমে সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে নদীটি মৃতপ্রায়। কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর যৌবন হারিয়ে কঙ্কাল। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজিপুর, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, লৌহজং, বানার, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা, বংশী, বালু, কালিগঙ্গা ও তুরাগ নদী প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে এবং উত্তর দিকের মরে যাওয়া অংশে এখন চাষাবাদ চলছে। এ সকল নদীর অবস্থা দিন দিন ক্ষীণ ধারায় পরিণত হচ্ছে।

সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পঞ্চগড়, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল প্রমত্তা করতোয়া ও বাঙ্গালী নদী। সেগুলো এখন প্রায় মৃত। পাবনার ইছামতি এবং মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ইছামতি ছাড়াও পাবনার বড়াল এবং এর সমস্ত শাখা নদীগুলো এখন মৃত নদী।

এই সব নদী-নালা দেশের পরিবেশের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদী-নালার সাথে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর গভীর সম্পর্ক। সুতরাং নদ-নদী হুমকির সম্মুখীন হলে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হতে বাধ্য। ফলে ভারতের নদী প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠবে। বাড়বে তাপমাত্রা, মানুষের জীবনযাপন হবে কষ্টসাধ্য, বিপন্ন হবে Ecological Balance বা প্রতিবেশ ভারসাম্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী অনাবৃষ্টি এবং বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে অত্যাধিক বরফগলা ইত্যাদির অস্বাভাবিকতার কারণে পানিই হবে বর্তমান শতাব্দীর প্রধান সমস্যা। প্রসঙ্গে ২০০৬ সালের ২৩ অকটোবর ‘‘দৈনিক ইত্তেফাক’’ এর প্রধান সম্পাদকীয় ছিল পানি সংকেটে আগামী বিশ্ব। এতে বলা হয়েছে ২০৭০ থেকে ২০৮০ সালে মধ্যে পানিসংকট ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দেখা দিবে। দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্যোৎপাদনে অর্জিত বিশাল সাফল্য ম্লান হয়ে যাবে পানীয় ও জলের সংকটের মুখে। কেবল খাদ্য দুর্ভিক্ষ নয়, বরং দরিদ্র বিশ্বের বহু দেশকে তখন মুকাবিলা করতে হবে পানীয় জলের দুর্ভিক্ষের। ২০৫৬ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর পর পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯শ’ কোটিতে। এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা হতে জানা যায়, ভূ-মন্ডলে বর্তমানে পানির সংস্থান আছে ১ হাজার ৩ শ’ লক্ষ কোটি ঘনমিটার। এর মধ্যে পানযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ২.৫ ভাগ। এর মধ্যে হিমবাহ আকারে আটকে আছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। বাকি ৯৭.৫ ভাগ পানিই পানের অযোগ্য। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে চরম পানীয়জলের সংকটে পড়ে গরীব দেশের কোটি কোটি লোকের মৃত্যু হতে পারে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষ পানির অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে এবং ১ কোটি ৫০ লক্ষ শিশু অনিবার্যভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের আরও আশঙ্কা বর্তমানে বিশ্বে যেভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে তাতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ জেলা অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্লাবিত এবং প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) মানুষ উদ্বাস্ত্ত হয়ে পড়তে পারে। তাদের ধারণা, তাপমাত্রা যদি বর্তমানের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রী বাড়ে তাহলে বাংলাদেশের শীতকালীন ফসল বিশেষ করে গম ও আলুসহ বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি উৎপাদন হ্রাস পাবে। এছাড়া দেশের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভূমির ক্ষয় বৃদ্ধি পাবে।

৫। জীববৈচিত্র্য (Bio-Diversity) ধ্বংস : বাংলাদেশের নদ-নদীর স্বার্থের সাথে শুধু মানুষই নয় বরং প্রতিবেশী হিসেবে জড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও পোকা মাকড়ের জীবনধারা। এদেশের নদ-নদীসমূহ মরে গেলে দেশের দুর্লভ প্রাণী ও কীটপতঙ্গসমূহ আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানবসৃষ্ট পরিবেশ পরিপন্থী পদক্ষেপের কারণে পরিবেশ রক্ষাকারী অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব অবলুপ্ত হতে চলেছে। অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতির নৈসর্গিক ভুখন্ড থেকে বৈচিত্র্যময় প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ক্রমাগতভাবে পরিবেশ হয়ে উঠছে ভারসাম্যহীন। এদেশের অবস্থান উত্তরে হিমালয় পর্বত, সমতল ও দক্ষিণে সাগরের কারণে অসংখ্যা নদী শিরা-উপশিরার মত বয়ে চলেছে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষা অতি জরুরী। কারণ ক্রান্তীয় এ ভূখন্ড অত্যন্ত ঊর্বর। দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু পাহাড় ছাড়া এদেশের বাকি অঞ্চল নবীন পললে গড়া সমতলভূমি। প্রাণী ও উদ্ভিদের যথাযথ বিকাশের জন্য এখানকার আবাহওয়া অত্যন্ত অনুকূল। বিশাল বৈচিত্র্য ধারণ করার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানকার জীববৈচিত্র্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। 

এদেশের সর্বত্র জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ। এখানে ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৬৩০ প্রজাতির বেশি পাখি, ১২৫ প্রজাতির সরীসৃপ ইত্যাদি বাস করে। স্বাদু পানিতে বসবাস করে ২৬০ প্রজাতির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির আছে সামুদ্রিক মাছ। এদেশে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৩২৭ এবং ৬৬ প্রজাতির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির আছে সামুদ্রিক মাছ। এছাড়াও প্রতিবছর শীতের শুরুতে উত্তর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে অসংখ্য প্রজাতির পাখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও সিলেটের হাকালুকি হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে আশ্রয় নেয়, কিন্তু শীতের শেষে স্বাভাবিকভাবে নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারে না। অসাধু শিকারিদের হাত থেকে এরা নির্বিচারে নিধনের শিকার হয়। ফলে ঐ সব অতিথি পাখির আগমন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য, বৈরী আবহাওয়া, নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস এবং সর্বোপরি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের ফলে ১৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্য পশুপাশির বিলুপ্তি ঘটেছে। 

প্রতিবেশী দেশ ভারত বাহুবলে গঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন করে শুরু করেছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। এর ফলে আমাদের দেশের স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্য আরও বিপন্ন হবে। তাই ভারতের আন্ত:নদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে, আধুনিক গণমাধ্যম ও ই-মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে, সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে এবং দেশের ভেতরের বিশাল জনগোষ্ঠিকে সংশ্লিষ্ট করে জনমত গঠন করতে হবে, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন জোরদার করতে হবে। এদেশকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের জীবনকে রক্ষা করতে হবে। সেই সাথে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের মূল দায়িত্ব। এজন্য সকলকে সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশ-বান্ধব নীতি প্রণয়নে, পরিবেশ বিষয় নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের আন্তঃসম্পর্ক বা আন্তঃনির্ভরশীলতা আবিষ্কার জরুরি। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সকলকে আর বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন ও বৃক্ষ যেমন অপরিহার্য, তেমনি বনের স্বাভাবিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন বনচর পশুপাখীর। বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কমপক্ষে ১৮৫টি আইন রয়েছে। এছাড়াও পরিবেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত ২২টি আন্তর্জাতিক চুক্তি বাংলাদেশ অনুমোদন করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশ আরও ২৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশে এখন ১৪টি অভয়ারণ্য ও ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে। কিন্তু কোন বিধিবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে দেশের সংরক্ষিত এলাকাতেও পশুপাখির জন্য নির্ধারিত অভয়ারণ্যে চলছে বন উজাড় ও পশুপাখি নিধনের ঘটনা। 

অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধ ও দেশের নদ-নদী, খাল-বিলের নাব্যতা হ্রাস এবং ভূমি দস্যুদের দখল, গাছপালা কেটে লাগামহীনভাবে বনভূমি ধ্বংস, এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উঁচু ভূমি কিংবা প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ পাহাড় কেটে নিচুভূমি ভরাট করে আবাসভূমি তৈরি এবং অপরিকল্পিত ভাবে নগর ও শিল্পায়ন ইত্যাদি।

৬। দেশের প্রায় সকল নদীবন্দরসমূহের সৃষ্ট অচলাবস্থা : ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের পানিপ্রবাহ ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে নদীগুলোর নাব্যতার অভাবে ঢাকা, খুলনা, নারায়গঞ্জ, ভৈরববাজার, চাঁদপুর, বাঘাবাড়ি, চিলমারী, গোয়ালন্দ, বরিশাল, ঝালকাঠি, হুলারহাট, কাউখালী, স্বরূপকাঠী (নেছারাবাদ), ভান্ডারিয়াসহ বিভিন্ন নদীবন্দরে জাহাজ বা বড় নৌ-যান আগের ন্যায় ভিড়তে পারে না। নদীমাতৃক এদেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্যদ্রব্য আনা-নেয়ার জন্য সকল নৌ-বন্দরমুখী কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ছে ফলে এই নদীনির্ভর দেশটি অর্থনৈতিকভাবে নানামুখী ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

ইতোমধ্যে ফারাক্কার ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ও চিলমারী নৌবন্দরে বছরের প্রায় সময়ই তেলের ট্যাংকারসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন জাহাজ নোঙর করতে পারছে না। বৃটিশ আমলের শেষদিকেও ধানসিঁড়ি নদীর সাথে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চিরপাড়া নদী দিয়ে বিশাল আকারের লঞ্চ-স্টীমার ঢাকা বরিশাল ও খুলনা হয়ে কোলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করত। ১৯৮০ দশকের গোড়ার দিকে চর পড়ে চিরপাড়া চ্যানেলটির মুখ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে বর্তমানে উক্ত নৌযানসমূহ রুট পরিবর্তন করে সুন্দরবন হয়ে খুলনা যেতে হচ্ছে। অতএব, সারাদেশের নৌ-বন্দরসমূহের অচলাবস্থার জন্য দায়ী ভারতের ফারাক্কাসহ অন্য সকল বাঁধ। তাই আজ আমাদের উচিত হবে দেশের মাটি, মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষার জন্য সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৭। নদীভাঙন, অকালবন্যা ও উদ্বাস্তু সমস্যা : নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নদীনালার ওপর নির্ভরশীল। অতএব নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পেশার মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। ভারত কর্তৃক ফারাক্কাসহ অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ পরবর্তী বাংলাদেশের নদ-নদীর বিপন্নদশার কারণে লক্ষ লক্ষ জেলে পেশার মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাসের কারণে সাগরের লোনাপানি উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশের ফলে বনভূমি তথা সুন্দরবনের সুন্দরীবৃক্ষসহ সকল বৃক্ষ বিনাশ ও সংকুচিত হচ্ছে। ফলে এর সাথে নির্ভরশীল বাওয়ালী, কাঠুরে, জেলে ও মধু আহরণকারী (মৌয়ালী) লোকজনও দিনদিন কর্মহীন হয়ে পড়ছে।

পানি সংকটের কারণে নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাস পেয়ে তলদেশের উচ্চতা বেড়ে দেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের মাঝে চর সৃষ্টি হয়। অতঃপর এই সকল চর বা দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়, সেখানে ক্রমান্বয়ে লোকজন ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তৈরি এবং কৃষিকাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভারত পাহাড় পর্বতের অতিরিক্ত পানি ধারণে অক্ষম হয়ে পড়ায় ফারাক্কাসহ যখন সকল বাঁধ খুলে দেয় তখন প্রয়োজনের অধিক পানি বাংলাদেশ ভাটির অঞ্চল বলে এদেশের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। ফলে জনবসতি, রাস্তাঘাট ও ব্যাপক শস্যহানি ঘটে এবং মারাত্মক নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। 

সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের ভূ-ভাগ ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে নতুন নতুন চর সৃষ্টি হচ্ছে। এসব চরের আয়তন দেশের দক্ষিণ দিক বরাবর বেড়েই চলছে। আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে অগভীর উপকূল অঞ্চলে চলমান ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ায় আরও কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি লাভ করবে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং, শরিয়তপুর, সিলেট, পাবনা, নেত্রকোণা, খুলনা, রংপুর, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ি, মাদারীপুর, শেরপুর, বরগুনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশালসহ অনেক বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ ও সন্ধ্যা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রতিবছর। ফলে এসব ভাঙনকবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা সহায়-সম্বল হারিয়ে শহর কিংবা রেললাইনের পাশে আশ্রয় নেয়। তারা উদ্বাস্ত্ত হয়ে মানবেতর অবস্থায় জীবন কাটায়। কাজের সন্ধানে শরহগুলোতে ভিড় জমানোর ফলে তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।

আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের আইনগত ভিত্তিঃ
আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী একটি নদী যদি দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তবে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এমনভাবে আন্তর্জাতিক নদীকে ব্যবহার করবে তা যেন অপরাপর রাষ্ট্রসমূহের সহজাত অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়। যে দেশের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত, নদীর সে অংশের পানি সে দেশের পক্ষে ইচ্ছেমত ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেন ‘‘কোন রাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমন করে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না যার ফলে প্রতিবেশি কোন রাষ্ট্রের ভূখন্ডের প্রকৃত অবস্থায় কোন অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।’’ আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সংক্রান্ত অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক আইন ইনস্টিটিউটও।

পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এই নদীসমূহ একাধিক স্বাধীন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদীর মধ্যে আমাজান, জায়ার, জাম্বেসী, দানিয়ুব, নাইজার, নীল, রাইন, মেকং, লেকচাঁদ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখাযোগ্য। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বণ্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলনে এবং ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে।
১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি সম্মেলনে গৃহীত নীতিমালার ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহার অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। পানি সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতি ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশ সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনফারেন্স ঘোষণাপত্রের ৫১ অনুচ্ছেদে স্থান লাভ করে।

১৯২১ সালে সুদান ও মিশরের মধ্যে নীলনদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সুদান নীলনদে এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনা যাতে মিশরের স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে।

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধু উপত্যকা চুক্তিতেও এমন ঘোষণা উল্লেখ ছিল যে, তীরবর্তী একটি রাষ্ট্র এমন কোন ব্যবস্থা নেবে না যাতে অপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করতে পারে।

যে নদী একবার একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। সেখানে নিজ দেশের আইন দ্বারা কখনোই তা নির্ধারিত হয় না। কিংবা নিজ দেশ এককভাবে সেই পানি ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশকে পানির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ ভারত আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোন আইন মানছে না। শক্তির জোরে একের পর এক বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৫৪টি নদীর প্রায় সকল প্রবাহ পথে বাঁদ দিয়ে বাধার সৃষ্টি করে এর বিশাল পানিপ্রবাহ কৃত্রিম খালের সাহায্যে উঁচু অঞ্চলে প্রবাহিত করে কৃষিক্ষেত্রসহ ইচ্ছেমতো সকল ক্ষেত্রে পানি ব্যবহার করছে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। প্রথম ১৯৭৫ সালে ৪১ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) অজুহাতে বাংলাদেশ সরকারকে আই ওয়াশ (Eye Wash) বা প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বহু বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধটি চালু করে। ওয়াদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও বাঁধটি আর বন্ধ করেনি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সকল আন্তর্জাতিক নদীসহ ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে আসা সকল নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সকল প্রবাহপথ বন্ধ করে দিয়েছে। এদের মধ্যে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ, ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর বাঁধ, মুহুরী নদীতে বেলুনিয়া বাঁধ, পিয়াই নদীর ওপর পিয়াই বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ। এই সকল নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ কিংবা স্লুইচ গেট নির্মাণসহ আরও অসংখ্য ছড়ানদীতে বাঁধ বা স্লুইচগেট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহপথে বাধার সৃষ্টি করছে। এই বেআইনী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার বার প্রতিবাদ জানালেও তাতে তারা কোন কর্ণপাত করছে না। ফলে ফারাক্কাসহ ঐ সকল বিপদজনক বাঁধের প্রভাবে সারা বাংলাদেশ ক্রমশ মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এ অপরূপ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে আজ দিন দিন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দরিদ্র এই দেশটির উন্নয়নের সকল ক্ষেত্র। গুরুত্বপুর্ণ এই সেক্টরের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার দেশের অর্থনৈতিক খাত। পানির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের শিল্পকারখানা, নৌ-পরিবহন, নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ মৃত্তিকার জলীয়তা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশ এক মারাত্মক সংকটের দিকে এগুচ্ছে। প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহের অভাবে প্রায় সকল নদীর নাব্যতা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রতিবছর অকাল বন্যা ও প্রকট নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা। তার শহর, সড়ক, মহাসড়ক ও রেললাইনের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ফারাক্কা বাঁধের পর তিস্তা বাঁধ, টিপাই বাঁধ প্রকল্প এবং আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদির প্রতিক্রিয়ায় দেশ নিশ্চিত মরুময়তার দিকে এগুচ্ছে। নদীসমূহে প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহের অভাব দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল, পুকুর-ডোবাসহ সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মৎস্যক্ষেত্র প্রয়োজনীয় বিচরণভূমির অভাবে মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমেও নদীতে মাছ নেই, হাওড় বাওড় মাছশূন্য। এর ফলে প্রতিবছর মাছের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় দেশের উপকূলীয় নদীসমূহে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে লবণাক্ততার পরিমাণ। লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খুলনা অঞ্চল।
ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের একটি সূদুর প্রসারী চক্রান্ত। বাংলাদেশ নামের এ ভূ-ভাগকে চিরতরে মরুভূমির দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস তাদের। 

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা করা দরকার। 
১. দেশের ভেতরে এবং বাইরে এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
২. শুষ্ক মৌসুমে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা দিচ্ছে কি না সে বিষয়ে দু’দেশের চুক্তির প্রতি খেয়াল বা নজরদারী রাখতে হবে।
৩. দু’দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের কথা বলে যদি সেখানে চাহিদা অনুযায়ী কম পানি দেয়া হয় সেক্ষেত্রে তা গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
৪. অববাহিকা ভিত্তিক নদী উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে হবে।
৫. দেশকে বাঁচাতে হলে নদী বাঁচাতে হবে। প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাথে গঠনমূলক ও সৃজনশীল আলোচনায় ফারাক্কাসহ সকল সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হবে।
৬. প্রয়োজন হলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা এর অন্য সদস্য দেশসমূহের সাহায্য নিতে হবে। আমাদের নদীর নাব্যতা বাড়াতে প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত নদী ও হাওড় বরেন্দ্র এলাকার নদী সমূহে পরিকল্পিতভাবে জলাধার তৈরি করতে হবে যাতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও সেচ কাজে প্রয়োজন মত ব্যবহার করা যায়।
৭. ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
৮. বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে।
৯. কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। আধুনিক গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।

তথ্যসূত্র :
১.ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প : বাংলাদেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবঃ আখতার হামিদ খান
২. বি.এম.এ.টি আব্বাস : ১৯৮০ : ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশ, ঢাকা।
৩. আবদুল জলিল; ১৯৮২ : সুন্দরবনের ইতিহাস, ঢাকা।
৪. বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি: ২০০৭, ঢাকা।
৫. সচিত্র বাংলাদেশ বিশেষ সংখ্যা (১৯৯৫) ঢাকা।
৬. মোকাররম হোসেন; ১৯৯৫ : বাংলাদেশের নদী, ঢাকা।
ঢাকা।