২৪ এপ্রি, ২০১৬

ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের অবস্থান


ইসলাম মানবজীবনের জন্য আশির্বাদ। যখন আরবে দাসদের সাথে এবং গরীব শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো তখন আল্লাহর রাসূল সঃ নিয়ে এসেছেন মানবতার বার্তা। যাতে সমাজের প্রত্যেক মানুষের অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সকল প্রকার জুলুমবাজি বন্ধ করা হয়েছে। ইসলাম মানবতাকে সামনে এনে মানুষকে করেছে সম্মানিত। আল্লাহ্‌ সুবহানাল্লাহু তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
“আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিজিক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি”।
-(সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)

শ্রমনীতি প্রণয়নের কাজটা সর্বপ্রথম ইসলামই করেছে। ইসলামই প্রথম শ্রমিকের প্রতি যথার্থ দৃষ্টি দিয়েছে। তাকে দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা আর শ্রমের স্বীকৃতি। আল্লাহর রাসূল সঃ যখন এই নীতি চালু করেন তখন সমাজে শ্রমিকদের মানুষই মনে করা হতো না, অধিকারতো অনেক পরের ব্যাপার। ইসলাম সমাজের আর দশজন সদস্যের মতো নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাকৃতিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছে। শ্রমিক হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক মূলনীতি ও বিধিও প্রবর্তন করেছে। যাতে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়। 

মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। মুচি জুতা সেলাই করেন, নাপিত চুল কাটেন, দর্জি কাপড় সেলাই করেন, ধোপা কাপড় পরিষ্কার করেন, জেলে মাছ ধরেন, ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র বিক্রি করেন, তাঁতী কাপড় বুনেন, কুমার পাতিল বানান, নৌকার মাঝি মানুষ পারাপার করেন। এসব কাজ এতই জরুরি যে, কাউকে না কাউকে অবশ্যই কাজগুলো করতে হবে। কেউ যদি এসব কাজ করতে এগিয়ে না আসতেন, তা হলে মানবজীবন অচল হয়ে পড়ত। কোনো কাজই নগণ্য নয় এবং যারা এসব কাজ করেন, তারাও হীন বা ঘৃণ্য নন।

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, "ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করা একটি ফরজ ইবাদত।" (বায়হাকী) এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এরশাদ করেছেন, "তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক থেকে আহার কর।" (সূরা: মুলক, আয়াত-১৫)

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজ হাতে জুতা মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ চরায়েছেন। নবীজী ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করেছেন। বাড়িতে আগত মুসাফির কর্তৃক বিছানায় পায়খানা করে রেখে যাওয়া কাপড় ধৌত করে মানবতা ও শ্রমের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, "শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।" (বায়হাকী) মহানবী এ ব্যাপারে আরো বলেন, "নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ (আঃ) নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।" (বুখারী)

কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, নবী-রাসূলগণ শ্রমিকদের কত মর্যাদা দিয়েছেন। অনেক নবী ছাগল চরিয়ে নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া হযরত আদম আ. কৃষক ছিলেন। হযরত নুহ আ. কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। হযরত দাউদ আ. কর্মকার ছিলেন। হযরত ইদ্রিস আ. দর্জি ছিলেন। মালিক হযরত শোয়াইব (আঃ) তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্রমিক নবী মূসাকে (আঃ) জামাই বানিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিক যায়েদ (রাঃ)-এর কাছে আপন ফুফাতো বোন জয়নবের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) যায়েদকে (রাঃ) মুতারের যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন বানানো হয়েছিল শ্রমিক হযরত বিলালকে (রাঃ)। মক্কা বিজয় করে কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় মহানবী (সা.) শ্রমিক বেলাল (রাঃ) ও শ্রমিক খাব্বাবকে (রাঃ ) সাথে রেখে ছিলেন। নবীজী কখনো নিজ খাদেম আনাসকে (রাঃ) ধমক দেননি এবং কখনো কোনো প্রকার কটুবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি। নবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে যাঁতা ঘুরাতেন। আর এজন্য তার হাতে জাঁতা ঘোরানোর দাগ পড়েছিল। তিনি নিজেই পানির মশক বয়ে আনতেন, এতে তাঁর বুকে দড়ির দাগ পড়েছিল।

কোদাল চালাতে চালাতে একজন সাহাবীর হাতে কালো দাগ পড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাত দেখে বললেন, "তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছ ? সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এগুলো কালো দাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাতে গিয়ে হাতে এ কালো দাগগুলো পড়েছে। নবীজী (সা.) এ কথা শুনে ওই সাহাবীর হাতের মধ্যে আলতো করে গভীর মমতা ও মর্যাদার সাথে চুমু খেলেন। এভাবে অসংখ্য কর্ম ও ঘটনার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

একইভাবে ইসলাম শ্রমগ্রহীতার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে শ্রমিকের সঙ্গে মানবিক ও সম্মানজনক আচরণ করতে। তার প্রতি মমতা দেখাতে। তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাকে বারণ করেছে তার সাধ্যাতীত কাজের নির্দেশ প্রদান থেকে। এমনবিধ নানা অধিকার সুযোগ নিশ্চিত করেছে ইসলাম শ্রমিকের জন্য। 

রাসূল সঃ শ্রমিকদের অধিকার সম্বন্ধে বলেন- তারা তোমাদের ভাই আল্লাহ্‌ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ যাদের উপর এরূপ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্তব্য হলো তারা যে রকম খাবার খাবে তাদেরকেও সেরকম খাবার দেবে, তারা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা পরাবার ব্যবস্থা করবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে তাদেরকে কখনও বাধ্য করবে না। যদি সে কাজ তাদের দিয়েই করাতে হয় তা হলে সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই করতে হবে। (বুখারী)

ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির অধিকার : 
একজন শ্রমিকের প্রথম অধিকার তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির অধিকার। তাই ইসলাম এর প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন “মহান আল্লাহ বলেন, আমি তিনজনের বিপক্ষে থাকব কিয়ামতের দিন, তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন, যাকে আমার জন্য প্রদান করার পর সে তার সাথে গাদ্দারী করেছে, আর একজন হচ্ছেন, যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার অর্থ খেয়েছে। আর একজন হচ্ছে সে ব্যক্তি যে কাউকে কর্মচারী নিয়োগ করার পর তার থেকে তার কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ সে তাকে তার প্রাপ্য দেয় নি।”- সহীহ বুখারী 

শ্রমগ্রহীতার জন্য জরুরী হলো শ্রমিককে সেই অধিকারগুলো প্রদান করা যার ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। তাতে হ্রাস বা বিয়োগের চেষ্টা না করা। কারণ, তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনার মতো জুলুম। সেহেতু শ্রমগ্রহীতার জন্য আরও জরুরী শ্রমিকের কাজের তীব্র প্রয়োজনের সুযোগের অসৎ ব্যবহার করত তাকে তার অধিকারে না ঠকানো এবং একই ধরনের কাজের ক্ষেত্রে প্রাপ্য মজুরির তুলনায় তাকে ধোঁকা দিয়ে কম নির্ধারণ না করা। কেননা ইসলাম সর্বপ্রকার ধোঁকা ও প্রতারণাকে হারাম ঘোষণা করেছে। বাস্তবায়ন করেছে ‘লা দ্বারারা ওয়ালা দ্বিরারা’ তথা ‘ক্ষতি করব না আবার ক্ষতির শিকারও হব না’ নীতি। 

একইভাবে তার জন্য আরও জরুরী, শ্রমিকের পাওনা হেফাযত করা যখন সে অনুপস্থিত থাকে কিংবা এর কথা ভুলে যায়। এবং কাজ শেষ কিংবা নির্ধারিত মেয়াদ পূরণ হবার পর মজুরি দিতে টালবাহানা বা বিলম্ব না করা। তেমনি চুক্তির পরিমাণের চেয়ে বেশি কাজ করলে তার (অতিরিক্ত) বিনিময় প্রদানে ব্যয়কুণ্ঠ বা কৃপণ না হওয়া। কেননা আল্লাহ আমাদেরকে প্রত্যেক শ্রমের মর্যাদা দিতে বলেছেন। সব কাজের প্রতিদান দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পূর্ণ কর”। (সূরা আল-মায়িদাহ: ১)

হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
“ধনী ব্যক্তির (পক্ষ থেকে কারও পাওনা প্রদানে) টাল-বাহানা করা জুলুম; আর যখন তোমাদেরকে কোনো আদায় করতে সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয়, তখন সে যেন তার অনুসরণ করে”। 

অপর হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
“শ্রমিককে তার শ্রমের প্রাপ্য তার ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই প্রদান কর”। 

স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বাধ্য না করার অধিকার : 
শ্রমিকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা কাজে অক্ষম বানানোর মতো কাজে তাকে বাধ্য না করা শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সে যুগে দাসদের যাই আদেশ করা করা হতো তাই তারা পালন করতে বাধ্য থাকতো। আল্লাহর রাসূল সঃ তার শ্রমনীতিতে এই ধরণের প্রথা বন্ধ করে দেন। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ক্ষেত্রে শ্রমিকের সম্মতি ছাড়া বাধ্য করা যাবে না। 

শ্রমগ্রহীতা যখন তার প্রতি এমন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন যা তাকে বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয় এবং যার ফলে পরবর্তীতে তার স্বাস্থ্য বা ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে তার অধিকার রয়েছে চুক্তি বাতিল কিংবা বিষয়টি বিচারকের কাছে উত্থাপন করার। যাতে করে তারা তার ওপর থেকে শ্রমগ্রহীতার অনিষ্ট রোধ করেন। 

রাসূলে করীম সাঃ শ্রমিকদের সম্পর্কে বলেছেন, শ্রমিককে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে। (তিরমিযি)

তাদের উপর ততখানি চাপ দেওয়া যেতে পারে, যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না। (মুয়াত্তা, মুসলিম)

শ্রমিকের আত্মসম্মান রক্ষার অধিকার : 
শ্রমগ্রহীতার আরেকটি কর্তব্য হলো, শ্রমিকের সম্মান রক্ষা করা। অতএব তাকে কোনো অবমাননা বা লাঞ্ছনাকর কিংবা দাসসুলভ কাজে খাটানো যাবে না। ইসলাম এবং ইসলামের মহান ব্যক্তিদের জীবনে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও ব্যক্তিতে সমানাধিকারের মূলনীতিকে সমর্থন করে। 

যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিক ও কাজের লোকের সঙ্গে আহার গ্রহণ করতেন। তার কাজের বোঝা লাঘবে সরাসরি সহযোগিতা করতেন। তেমনি শ্রমিককে প্রহার বা তার ওপর সীমালঙ্ঘনেরও অনুমতি নেই। যদি তাকে প্রহার করে তবে তাকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

শ্রমিকের ওপর আল্লাহ যা ফরয করেছেন তা আদায়ের অধিকার :
শ্রম গ্রহীতার আরেকটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো, শ্রমিককে তার ওপর আল্লাহর ফরযকৃত যাবতীয় ইবাদত যেমন সালাত ও সিয়াম ইত্যাদি সম্পাদনের সুযোগ প্রদান করা। মনে রাখবেন একজন দীনদার বা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কিন্তু অন্য যে কারও চেয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বেশি আন্তরিক। কারণ, সে সবার জন্য মঙ্গল সাধন করতে সচেষ্ট থাকে। তার নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি এবং চুক্তি রক্ষার প্রচেষ্টা সঙ্গত কারণেই বেশি হয়। 

আপনার অবস্থান যেন আল্লাহর ইবাদত কিংবা ইসলামের প্রতীক রক্ষার কাজে বাধা প্রদানকারীরদের পক্ষে না হয়। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, যারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাত থেকে অধিক পছন্দ করে, আর আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং তাতে বক্রতার সন্ধান করে; তারা ঘোরতর ভ্রষ্টতায় রয়েছে। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ৩) 

সৎ কাজে বাধা না দিয়ে বরং তাতে ব্রতী হতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেন, তুমি কি দেখেছ, যদি সে হিদায়াতের উপর থাকে, অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়? যদি সে মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়? সে কি জানে না যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ দেখেন? (সূরা আল-আলাক, আয়াত : ১১-১৪)

তাছাড়া শ্রমগ্রহীতা শ্রমিকদের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন। সুন্দর উপায়ে তাদেরকে নিজ ধর্মীয় শিষ্টাচারাবলি আঁকড়ে ধরতে উদ্বুদ্ধ করবেন। কেননা, শ্রমিকরা হলেন শ্রমগ্রহীতার আহল। তাদেরকে আগুন থেকে বাঁচানো তার উপর দায়িত্ব। আল্লাহ্‌ তায়ালা সূরা আত তাহরীমের ৬ নং আয়াতে বলেন, “তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের আহলকে আগুন থেকে বাঁচাও।” এছাড়াও শ্রমিকদের দীনদারির অনুভূতির লালন-অনুশীলনের মাধ্যমে কাজে তাদের মনোযোগ বাড়বে। এটি তাদেরকে আপন কাজে আরও বেশি নিষ্ঠাবান এবং কাজের স্বার্থ রক্ষায় অধিক যত্নবান বানাবে। 

শ্রমিকের অভিযোগ করা এবং বিচার প্রার্থনার অধিকার : 
শ্রম বা কর্ম সম্পর্কিত ইসলামী বিধানগুলো কেবল শ্রমিকদের অধিকার সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলি প্রবর্তনেই সীমিত থাকে নি; বরং এসব বিধান পদ্ধতিগত ও প্রায়োগিক বিধিগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে যা শ্রমিকের অভিযোগ ও বিচার চাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে। 

সেহেতু ইসলাম চুক্তির পক্ষগুলোকে একেবারে ছেড়ে দেয় নি। বরং তাদের জন্য নিজেদের অধিকারগুলো সহজে পাবার পথ প্রশস্ত করেছে। হোক তা স্বেচ্ছায় কিংবা আদালতের ফয়সালায়। পাশাপাশি তাদের অধিকারসমূহ সংরক্ষণে অত্যধিক আগ্রহ দেখিয়েছে এবং এসব অধিকার রক্ষায় সর্বপ্রকার উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। 

আর এই উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের মাঝে অধিকার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। কেননা অধিকার ও ইনসাফ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল প্রশান্তি ছড়ায়। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা পায়। সমাজে একে অপরের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় হয়। মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে আস্থা মজবুত হয়। সম্পদ উন্নত হয়। স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায় এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়। ফলে কেউ অস্থিরতার মধ্যে পতিত হয় না। সর্বোপরি শ্রম ও উৎপাদনে মালিক ও শ্রমিক প্রত্যেকেই নিজ নিজ লক্ষ্যে ধাবিত হয়। পথপরিক্রমায় এমন কিছুর সৃষ্টি হয় না যা শ্রমিকের কর্মস্পৃহাকে ভোঁতা কিংবা মালিকের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করে। 

বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে ইনসাফ ও ন্যায়ানুগতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। জুলুম ও বঞ্চিত করার মানসিকতা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা কোনো মানুষের প্রতি জুলুম করেন না; বরং তিনি কোনো প্রকার জুলুম প্রত্যাশাও করেন না। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আর আল্লাহ বান্দাদের উপর কোন যুলম করতে চান না। (সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ৩১) 

আবূ যর গিফারী রাদিআল্লাহ আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং একে তোমাদের মাঝেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা পরস্পর জুলুম করো না’। আর পূর্ববর্তী জাতিগুলো কেবল তাদের জুলুম ও অত্যাচারী আচরণের কারণেই ধ্বংস হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা যুলুম করেছে।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত : ১৩)

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়ীঘর, যা তাদের যুলমের কারণে বিরান হয়ে আছে’। (সূরা আন-নামল, আয়াত : ৫২)। আল্লাহ তা’আলা আরও ইরশাদ করেন, ‘আর তুমি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও। যখন তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে দুঃখ, কষ্ট সংবরণ অবস্থায়। যালিমদের জন্য নেই কোন অকৃত্রিম বন্ধু, নেই এমন কোন সুপারিশকারী যাকে গ্রাহ্য করা হবে। (সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ১৮) 

আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা আল-হাজ, আয়াত : ৭১)। অন্য হাদীসে রয়েছে, জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো, কারণ জুলুম কিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে।’ আবূ মূসা আশ’আরী রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ জালেমকে অবকাশ দেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন তার পলায়নের অবকাশ থাকে না”। 

ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকার : 
কাজ করতে গিয়ে শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্থ হলে অবশ্যই তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ক্ষতিপূরণের এই ধারণাটি পবিত্র কুরআন যা মূলত ইসলামী আইন-আদালতের প্রথম উৎস- সামাজিক দায়িত্বের ধারণাকে সমর্থন করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, 
‘আর কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত (হলে ভিন্ন কথা)। যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে দিতে হবে না)। (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৯২) 

তেমনি নানা উপলক্ষে পবিত্র সুন্নাহও একে সমর্থন করেছে, যা ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস। সরাসরি ক্ষতি পূরণে একে সমর্থন করেছে। যেমন আনাস রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে তাঁর কোনো এক স্ত্রী একটি থালায় আহার হাদিয়া পাঠান। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা তাতে আঘাত করেন। ফলে থালায় যা ছিল তা পড়ে যায়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আহারের বদলে আহার এবং একটি পাত্রের বদলে আরেকটি পাত্র। 

তাই শ্রমিকের জন্য শ্রমগ্রহীতার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করার সুযোগ রয়েছে। তার জন্য আরও সুযোগ রয়েছে তার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে বিচার বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার। এসব হলো শ্রমিকের অধিকারগুলোর সবচে গুরুত্বপূর্ণগুলো। এভাবেই ইসলাম শ্রমিকের অধিকার, সম্মান রক্ষা করেছে। তার সম্মানিত জীবন নিশ্চিত করেছে। সর্বোপরি সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছে। 

এই কথা অনস্বীকার্য আমাদের সভ্যতা নির্মিত হচ্ছে শ্রমিকের ঘামের উপর। মানুষের উন্নতির চাবিকাঠি হলো শ্রম। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সব ধরনের শ্রমিককেই মর্যাদা দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে শ্রমের মর্যাদা দেয়া হয়, আমাদের দেশে সেভাবে শ্রমের মর্যাদা দেয়া হয় না। একজন দিনমজুরের শ্রম, কৃষকের শ্রম, শিক্ষকের শ্রম, অফিসারের শ্রম, ব্যবসায়ীর শ্রম সবই সমান মর্যাদার অধিকারী। শ্রমের মর্যাদা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। 

১২ এপ্রি, ২০১৬

পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম


মানুষকে আল্লাহ্‌ তায়ালা খলিফা হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এই দুনিয়ায় আমরাই আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই দুনিয়ার সিস্টেমকে নষ্ট হতে না দেয়া এবং এর সংরক্ষন আমাদের উপরেই বর্তায়। সুতরাং পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব মানষেরই। ইসলাম হচ্ছে ফিতরাত বা স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। মহান রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টির অন্যতম সেরা মানুষ বেসিক্যালি সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। তাই পরিবেশ সংরক্ষন ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বৃক্ষ বা গাছ, মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি বিস্তৃত করেছি ভুমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম, বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।” (সূরা কা’ফ ৭-৮)। সবুজ গাছপালার উপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। জীবের জন্য গাছপালা সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করে। শুধু খাদ্য তৈরী নয়, সালোক-সংশ্লেষণের সময় তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন বের করে দেয়। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষা হয়। হাদীসে রাসূল (সা) থেকে জানা যায়, একজন লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙ্গে তখন নবী করিম (সা) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বললেন, “তুমি যেমন শরীরে আঘাত বা কেটে গেলে ব্যথা পাও, গাছের ডাল বা পাতা ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।” পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগাবার শিক্ষা আমরা মহানবী (সা) থেকে পাই। তিনি বলেছেন, “যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।” রাসূল (সা) বৃক্ষরোপনকে উৎসাহিত করে বলেছেন, “বৃক্ষরোপন সদকায়ে জারিয়া হিসাবে পরিগণিত হবে।” (বুখারী ও মুসলিম) রাসূল আরো (সা) বলেছেন, “কোন মুসলমান যদি একটি বৃক্ষ বা গাছ রোপন করে অথবা ক্ষেত-খামার করে, অতঃপর তা হতে মানুষ, পাখি বা কোন প্রাণী ভক্ষণ করে, তা তার জন্য দান বা সদকার সওয়াব হবে।” পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা মহানবী (সা.)-এর উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনা সুস্পষ্ট।

কোরআন-হাদিসে পরিবেশ সংরক্ষণকে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি (আল্লাহ) পানি থেকে সৃষ্টি করলাম’ (সূরা আল আম্বিয়া : ৩০)। দুনিয়ায় যা কিছু প্রাণ পেয়েছে তা কেবল পানি থেকেই পেয়েছে। পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মাটি ও পানি। মূলত মাটি থেকেই বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপাদন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপাদন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সূরা ইয়াসিন : ৩৩)। আল্লাহ পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন: ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ’ (সূরা কাফ:৭-৮)। সূরা আন’আমের ১৪১ নম্বর আয়াতের শেষাংশে তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না’। এই আয়াত আরও গুরুত্ব পেয়েছে, মহানবী তাঁর এক সাহাবীকে সতর্ক করেছিলেন কারণ, ওই সাহাবী গোসলের পর অবশিষ্ট পানি ফেলে দিয়েছিলেন। মহানবী তাকে বলেছিলেন, উদ্বৃত্ত পানি নদীতে ফিরিয়ে দেয়া উচিত, যাতে ভাটির অন্য মানুষের চাহিদা পূরণ হয়। ভাটির মানুষের অধিকার এখানে আল্লাহর রাসূল (সা.) সুস্পষ্ট করেছেন। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় উজানের মানুষেরা বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক স্রোতকে বাধাগ্রস্থ করে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ভাটির মানুষ। পরিবেশ ও ভাটির মানুষের অধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.) সামান্য গোসলের পানির ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন। 

সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সূরা রুম : ৪১) রাসূল(সা) বলেছেন, “ঈমানের ৭৩টি শাখার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দুরীভূত করা। পরিবেশ দুষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অতি জরুরী।রাসূল (সা) বলেছেন, “পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।” হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। রাসূল (সা) আরো বলেছেন, “তোমরা অভিশাপ পাওয়ার তিনটি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়া তলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাক।” হাদীসে রাসূল (সা) থেকে আরো জানা যায়, মৃত শরীরের কোন অংশ তিনি যত্রতত্র ফেলতেন না, কারণ তা একসময় শুকিয়ে বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারে। যা পুঁতে না ফেললে তা কোন প্রাণী বা পাখির দ্বারা ছড়িয়ে পরিবেশ দুষিত করতে পারে। এজন্য রাসূল (সা) রক্ত বা গোশত মাটিতে পুঁতে ফেলতেন বা পুঁতে ফেলার নির্দেশ দিতেন। বায়ু দূষিত হলে নানান রোগজীবাণু সৃষ্টি হয় যা অনেক সময় মহামারীর আকার ধারণ করে। 

আল্লাহপাক পৃথিবীতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাহাড়কে সৃষ্টি করেছে। সমগ্র সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন। ভুমিকম্প, ভুমিধ্বস কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যাতে মানুষকে নিয়ে এ পৃথিবীর নড়া-চড়া করতে না পারে অথবা। সেজন্য আল্লাহপাক্ পাহাড়সমূহকে পেরেকের মত গেড়ে দিয়েছেন বলে এরশাদ করেছেন। “এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয়।” (সূরা আন্ নহল-১৫) অন্যত্র বলা হয়েছে, “তিনিই স্থাপন করেছেন ভুপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন প্রভুত কল্যাণ।” (সূরা হা-মীম-আস্ সাজদা-১০) অন্য আয়াতে আছে, “আর পাহাড় গুলোকে পেরেকের মত গেড়ে দিয়েছি।” (সূরা নাবা-৭) আরো এরশাদ হয়েছে, “আর পাহাড়কে শক্ত করে দাঁড় করানো হয়েছে।” (সূরা গাশিয়া-১৯)। মহান সৃষ্টিকর্তা পাহাড় সম্পর্কে এসব বর্ণনার মাধ্যমে পাহাড়ের গুরুত্ব নিশ্চিত করেছেন। অথচ আমরা মানুষ আমাদের দায়িত্ব ভুলে সাময়িক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছি।

স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণে মানুষ তার খিলাফতের দায়িত্ব এবং নিয়ম-কানুন অনেকাংশে এড়িয়ে যাচ্ছে। নদীকে দূষণ আর দখল করে তাকে বিপন্ন করে তুলছি, বন উজাড় করছি, বায়ু দূষণ করছি, শব্দ দূষণ করছি। ফলে আমাদের ওপর নেমে আসছে সর্বনাশা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালো ছায়া। ইসলামে প্রসঙ্গক্রমে গাছপালা, প্রাণিজগৎ, পাহাড়-নদী সর্বোপরি প্রকৃতি সংরক্ষণের কথা উঠে এসেছে বারবার। ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব আর অসচেতনতার কারণে প্রকৃতি সংরক্ষণের চেয়ে আমরা প্রকৃতির ক্ষতি করছি বেশি। সেই সঙ্গে অনিশ্চিত করে তুলছি আমাদের ভবিষ্যৎ। দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই রক্ষা করা সম্ভব আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ। গড়ে তোলা সম্ভব সুন্দর পরিবেশে সুস্থ জীবন। 

এই সুবিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সকল উপাদান দিয়ে আল্লাহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাদের কারণে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ অধিকতর গলে যাওয়ার ফলে বিশ্বের কিছু কিছু নিম্নভুমি বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণে সুষ্ঠু নিয়ম মেনে চলা, মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া, বন-বনানী থেকে বৃক্ষ উজাড় না করা, পরিকল্পনা ছাড়া ঢালাওভাবে পাহাড় না কাটা, পশু-পাখি নির্বিচারে শিকার না করা, কল-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা, ইটভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণ, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনসাধারণকে আরো অধিক সচেতন হওয়া অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন রচনা করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়াটাও অত্যন্ত জরুরী। আসুন আমরা আমাদের খিলাফতের দায়িত্ব পালনে আরেকটু সচেতন হই। পরিবর্তন শুরু করি আমরা নিজেদের দিয়েই। আমাদের দ্বারা যেন পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয়। 

৭ এপ্রি, ২০১৬

চলচ্চিত্র একটি শিক্ষার মাধ্যম


হাদীসে জিবরাঈল নামে একটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে। সেটি দিয়েই শুরু করেছি। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদিন রসূলুল্লাহ (সা:) এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি দরবারে আত্মপ্রকাশ করলেন। ধবধবে সাদা তাঁর পোশাক। চুল তার কুচকুচে কালো। না ছিল তাঁর মধ্যে সফর করে আসার কোন চিহ্ন, আর না আমাদের কেউ তাকে চিনতে পেরেছেন। এসেই তিনি রসূলুল্লাহ (সা:) এর নিকট বসে পড়লেন। রসূলুল্লাহ (সা:) এর হাটুর সাথে তার হাটু মিলিয়ে দিলেন। তার দু’হাত তার দুই উরুর উপর রেখে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলুন অর্থাৎ ইসলাম কি? 

উত্তরে রসূল (সাঃ) বললেন, ইসলাম হচ্ছে- তুমি সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল, সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমাদান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং পথ পাড়ি দেবার বা রাহা খরচের সামর্থ্য থাকলে বাইতুল্লাহর হাজ্জ আদায় করবে। আগুন্তক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা বিস্মিত হলাম তিনি একদিকে রসূলকে প্রশ্ন করলেন, আবার অপরদিকে রসূলের বক্তব্যকে সঠিক বলে আখ্যায়িত করছেন। 

এরপর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে ঈমান সম্পর্কে কিছু বলুন। রসূলুল্লাহ (সা:) এর উত্তর দিলেন, ঈমান হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রসূলগণ এবং আখিরাতকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। এ ছাড়া জীবন ও জগতে কল্যাণ-অকল্যাণ যা কিছু ঘটছে, সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হচ্ছে অর্থাৎ তাক্বদীরের ভাল মন্দ- এ কথার উপরও বিশ্বাস করা। উত্তর শুনে আগুন্তক বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। 

অত:পর তিনি আবার নিবেদন করলেন, ‘আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন’। রসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, ইহসান হচ্ছে, “তুমি এমনভাবে ইবাদাত করবে যেন তুমি তাকে দেখছো। আর তুমি যদি তাকে না-ও দেখো, তিনি তোমাকে অবশ্য দেখছেন”। আগুন্তক এবার বললেন, “আমাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে বলুন”। উত্তরে রসূল (সা: ) বললেন, ক্বিয়ামাত সম্পর্কে যাকে জিজ্ঞেস কা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকারীর চাইতে বেশী কিছু জানেন না”। 

আগুন্তক বললেন, “তবে ক্বিয়ামাতের নিদর্শন সম্পর্কে বলুন”। রসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “ক্বিয়ামতের নিদর্শন হল, দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে, তুমি আরো দেখতে পাবে-খালি পায়ের উলঙ্গ কাঙ্গাল-রাখালরা বড় বড় অট্টালিকায় গর্ব ও অহংকার করবে”। উমার (রাযিঃ) বললেন, অত:পর আগুন্তক চলে গেলেন আর আমি কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করলাম। পরে রাসূল (সাঃ) আমাকে বললেন, “উমার, প্রশ্নকারীকে চিনতে পেরেছো”? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, “ইনি জিবরাঈল আমীন। তিনি তোমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেবার জন্যই এসেছেন” (সহীহ মুসলিম)।

আপনারা হয়তো অবাক হচ্ছেন এই হাদীসের সাথে চলচ্চিত্র অথবা নাটকের সম্পর্ক কোথায়? এখানে তো ইসলামের মৌলিক বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে। হ্যাঁ এখানে ইসলামের মৌলিক বিষয়ই শিক্ষা দেয়া হয়েছে। একটু খেয়াল করুন, এখানে জিবরাইল আঃ একজন বেদুইন মানুষের রূপ ধরে এসেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ সঃ তাকে চিনতে পারলেন, কিন্তু তিনি এমন ভূমিকা করেছেন যেন আসলেই জিবরাইল আঃ আসলেই আগন্তুক। তিনি তাকে চিনেননা। আরো লক্ষ্য করুন এখানে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়গুলো তারা দুজনেই জানতেন অথচ তারা একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে অভিনয় করেছেন যাতে সাহাবারা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারেন। এটাই নাটক, এই নাটকের সেলুলয়েড ও ইলেক্ট্রনিক্স রুপই তো চলচ্চিত্র। 

শিক্ষা প্রদানের নানানরকম কৌশল আছে। একেকজন একেকভাবে শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে পারে। কেউ বই পড়ার মাধ্যমে, কেউ বক্তব্য শোনার মাধ্যমে, কেউ কাউওকে করতে দেখে ইত্যাদি নানানভাবে মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করে। নাটক বা চলচ্চিত্র হচ্ছে এমনি একটি শিক্ষার মাধ্যম। সত্যিই তাই, আল্লাহর রাসূল স্বয়ং তা বলেছেন। হাদীসে জিবরাঈলের শেষে আল্লাহর রাসূল সঃ বলেছেন, “ইনি জিবরীল আমীন। তিনি তোমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেবার জন্যই এসেছেন”

দেশ সমাজ ও জাতি গঠনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি জাতির প্রকৃত চরিত্র প্রতিফলিত হয়। সেই সাথে জাতির চরিত্রের উপরও চলচ্চিত্র বিশেষ প্রভাব ফেলে। চলচ্চিত্র দিয়েই ধীরে ধীরে মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়। এর মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব যেমন সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও সৃষ্টি হয়। তাই বর্তমানে আমরা দেখতে পাই নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও সাহিত্যের মাধ্যমে অসত্য, অশ্লীল কিছু কার্যক্রম সমাজে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলছে। অসাধু মানুষেরা এই শিল্পটিকে সমাজ ও ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এসব অশ্লীল ও অনৈতিক প্রভাবের কারণে ধর্মপ্রাণ কিছু মানুষ পুরো চলচ্চিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান এবং এই শিল্পটিকে মুসলমানদের জন্য অবৈধ বলে প্রচার করেন। 

ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠাবান মুসলিম সমাজ চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে ক্রমেই দূরে সরে এসেছে এবং নিজেদেরকে এর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিছু মানুষ গতিশীল, সমাজ গতিশীল। মানুষ যখন ভালো কিছু পাবে না তখন সে খারাপের পথে পা বাড়াবেই। নৈতিকতাসম্পন্ন মুসলিমরা চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে আসার কারণে এই অঙ্গন পুরোটাই অশ্লীল ও নৈতিকতা জ্ঞানহীন মানুষের করায়ত্তে চলে যায়। তাই আজ এই সমাজে ভালো কোন চলচ্চিত্র দেখতে পাওয়া যায় না। সেখানে তো শিক্ষার কিছুই নেই বরং সমাজ ধ্বংসের যাবতীয় উপাদান রয়েছে। এখন তাই চলচ্চিত্র মানেই অশ্লীল ও অনৈতিক বিষয়। 

শুধু চলচ্চিত্র নয় সমগ্র সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা আজ লক্ষ্য করছি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন। এটার কারণ এই নয় যে আমাদের বিপরীত আদর্শের মানুষেরা অনেক মেধাবী, অনেক জ্ঞানী। আমরা তাদের সাথে পেরে উঠছি না বরং মূল বিষয় হলো আমাদের কূপমণ্ডূকতা, সংকীর্ণতা, ইসলামের সঠিক জ্ঞান ও বার্তা উপলব্ধি করতে না পারা। আমরা আমাদের ইসলামকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বারবার আমাদের নানান সেক্টরে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত করে চলেছি। সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। চলচ্চিত্রকে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত করা শুধুই উচিত নয় বরং অত্যন্ত জরুরী। 

তাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে হলে ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ প্রয়োজন। শক্তিশালী একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে ঈমানের অপরিহার্য দাবি। এ দাবি পূরণ করতে হলে কেবল সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। সাংস্কৃতিক চর্চা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন এক জিনিস নয়। আমাদের প্রয়োজন সংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রতিটি মানুষ যেন নিজেকে ইসলামের রঙে রাঙিয়ে তোলার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও অব্যাহত গতিতে প্রাণিত হয় তার জন্য যে প্রচেষ্টা তারই নাম ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন যেমন জনগণকে ইসলামের দিকে প্রভাবিত করার মধ্যেই তার কাজকে সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং সর্বস্তরে ইসলামের বিজয় চায়, তেমনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনও কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।

আজকের শিশুরাই নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে। শিশুরা গাছের সবুজ চারার মতো। যদি আমরা সবচাইতে সুন্দর ও সতেজ চারা রোপণ করি তাহলে পৃথিবী হবে সুন্দর বাসযোগ্য। আর যদি আমরা তা না পারি তবে তা হবে ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য ভয়ঙ্কর বিষয়। শিশুরা দেখে দেখে শিখে। এই শিখাটাই তাদের মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। যখন বড় হয় তখন এই শিক্ষাটাকেই তারা প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। গ্রিক বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো তার বিখ্যাত বই রিপাবলিকে লিখেছেন, আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো গল্প লেখকদের ব্যাপারে খুব সতর্কতা অবলম্বন করা। তারা যদি ভালো গল্প লেখেন তাহলে আমরা গ্রহণ করব কিন্তু যদি খারাপ হয় তাহলে পরিহার করব। তারপর মায়েদের বা অভিভাবকদের কর্তব্য হলো যেসব গল্প ভালো এবং বিজ্ঞদের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কেবল সেগুলোই শিশুদেরকে শোনানো। মনে রাখতে হবে গল্পের মাধ্যমে শিশুদের যে মন তৈরি হয় তা খেলাধুলা বা শারীরিক অনুশীলনের প্রশিক্ষণের চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মনে রাখতে হবে শিশুরা যাতে ভালো জিনিস শেখে সেভাবেই যেন চলচ্চিত্রের গল্প নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে ইরানী মুভি “দ্যা চিল্ড্রেন অব হ্যভেন” খুব সুন্দর মডেল হতে পারে। এরকম ইউনিক গল্প ছাড়াও সাহাবাদের অসাধারণ সব জীবনী নিয়ে নির্মিত মুভি শিশুদের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 

শিশুরা সবসময় কার্টুন পছন্দ করে। সম্প্রতি সময়ে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ছোটদের সিনেমা কার্টুনের ভয়ঙ্কর চরিত্রগুলো শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী প্রভাব বিস্তার করছে, বিশেষ করে শিশুরা রাগী মেজাজের হচ্ছে, যা চাচ্ছে তা পেতেই হবে এমন অসহিষ্ণু মানসিকতা তারা ধারণ করে। কারণ কার্টুনের চরিত্রগুলো এরকমই। বর্তমান সময়ে বাবা-মার পরিবর্তে সিনেমা বা কার্টুনের চরিত্রগুলো শিশুদের বেশি প্রিয়। শিশুদের ধর্ম হচ্ছে যার সান্নিধ্যে বেশি থাকবে তাকেই অনুকরণ করবে, তাকেই ভালোবাসবে। শিশুরা কার্টুনের সান্নিধ্যে বেশি থাকায় কার্টুনের চরিত্রগুলো ওদের আদর্শ। তাই এসব কার্টুন চরিত্রগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার যাতে শিশুরা আদর্শবান মানুষে পরিণত হতে পারে। 

সমাজ গঠনে চলচ্চিত্র ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। চলচ্চিত্রে উদ্ভট গল্প না হয়ে যদি বাস্তবজীবনের সাথে মিল রেখে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয় তবেই তা হবে সবচেয়ে বেশী ইফেক্টিভ। বাংলাদেশের আজকের সবচেয়ে বড় সমস্যা চলচ্চিত্রকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে নেয়া হয়েছে। অথচ চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো “শিক্ষা”। শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদন হলে মানুষ যে কোন জিনিস ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারে। তাই নিষ্ঠাবান মুসলিমদের উচিত খুব দ্রুতই আল্লাহর রাসূল সঃ প্রদর্শিত এই শিক্ষার মাধ্যমকে ব্যবহার করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা রাখা। এটা শুধু উচিত নয় বরং অতিশয় জরুরী।

৪ এপ্রি, ২০১৬

নববর্ষের ইতিকথা


পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

নববর্ষ উদযাপন একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে মানুষ নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে রাত দিন গণনা শুরু করেছিল। কিন্তু মাস গণনার ব্যাপারটা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের ছোট-বড় হওয়া দেখে মাস গণনা করতো। এক শুক্ল পক্ষ অন্য শুক্ল পক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত একমাস ধরে মাস গণনা করতো তারা। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। আবার একদিন থেকেও সব বছর গণনা শুরু হয়নি। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ' পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপিত হয় ১লা জানুয়ারি। আবার বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয় গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে। হিজরি নববর্ষ পালিত হয় মুহাররমের ১ তারিখে। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হওয়া উচিত বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষি নির্ভর বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন দরকার কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে।

নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসও অনেক পুরনো। প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকেই পারস্যের ১১ দিনব্যাপী ‘নওরোজ' পালিত হত। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপন হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। রোমানরা অনেক আগেই বসন্তকালের নববর্ষ উৎসব উদযাপন শিখেছিল ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে। ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা' পালন করতো খ্রিস্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জগতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১লা জানুয়ারি Happy new year পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্ভরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পয়লা বৈশাখ’ উদযাপিত হচ্ছে মাত্র কয়েক শতক ধরে।

ভারতবর্ষে মুগল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে হত, যা ছিল সবার জন্যই বিড়ম্বনার কারণ। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।

মুগল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। পারস্যের (ইরানের) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ' এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন তিনি। তার আনুকুল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। ‘নওরোজ' অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনা বাজার'। আর এ মিনা বাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে ‘বৈশাখী মেলার'। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ‘নববর্ষ' উৎসবের মূলে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও জড়িত পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। 

বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য সরকারি বেসরকারি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া অন্যান্য অনুষঙ্গ আমানি, রাজপূণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাস জুড়ে চলতো। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎস। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র যেত বাপের বাড়িতে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম বয়ে যেতো। বৈশাখী মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো বৈশাখী মেলায়। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল্লা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহতো ছিলই।

কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, সংস্কৃতিবিমুখতার কারণে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত বাংলা ‘নববর্ষ' উৎসব ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়েছে। বাংলা নববর্ষে ও বৈশাখী মেলা মুসলমানদের প্রবর্তিত বাঙালি সংস্কৃতি হলেও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিস্মৃত অল্প শিক্ষিত মুসলিমরা বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে ইসলাম গর্হিত ও পাপ মনে করে। আর এ সুযোগে ইসলাম বিদ্বেষীরা অশালীন-অপসংস্কৃতিকে বাংলা ‘নববর্ষ' উৎসবে যোগ করেছে। দেশজ সংস্কৃতির বাতাবরণে প্রতিবেশী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মঙ্গল শোভাযাত্রা, কপালে তিলক-সিঁদুর পরা, উলুধ্বনি দেয়া ইত্যাদি ভিন জাতীয় সংস্কৃতি যোগ হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। অধিকন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের ফলে আমাদের দেশের এলিট শ্রেণী খ্যাত কিছু অর্ধবাঙালি হোটেল-পার্কে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন Happy new year-এর আদলে। যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল ও অপদস্ত করছে।

মূলত, সংস্কৃতি জাতির প্রাণশক্তি। ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে জাতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। হিন্দু মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্ম ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও অভিন্ন মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বিত ও সংস্থিত। তবে বিশ্বায়নের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার আমাদের সংস্কৃতি। অন্তঃসারশূন্য বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদেরকে অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। আর অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করতে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরতে হবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন সার্থক হবে।