২১ জুল, ২০১৬

পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত। পর্ব-০২


কাদিয়ানী সমস্যাঃ 
পাঞ্জাবী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন বাঙ্গালী খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি ১৯৫৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় পাকিস্তানে আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যপক বিস্তার হয়, পাকিস্তানের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন। সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ তখন 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করেন এবং এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষনার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন বড় ধরনের নাড়া দেয় পাকিস্তানকে। অধিকাংশ মুসলিম এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট একশন কমিটি' গঠন করে। জামায়াত এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু তথাপি মার্চ মাসের শুরুতে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে এবং পুলিশের গুলিতে কিছু লোক নিহত হয়।

ডাইরেক্ট একশন কমিটি কাদিয়ানীদের কিছু মানুষকে হত্যা করে, এর ফলশ্রুতিতে দাঙ্গা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে খাজা নাজিমুদ্দিন পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী হন আরেক বাঙ্গালী মোহাম্মদ আলী বগুড়া। তারা সবাই মুসলিম লীগের নেতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার হন সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ। তার গ্রেপ্তারে আন্দোলন আরো ভয়ংকর হয়। সরকার কাদিয়ানীদের মৌখিকভাবে কাদিয়ানীদের নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। পরে একটি সামরিক আদালত সাইয়্যেদ মওদুদী রহ.-কে এই গোলযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। তবে মুসলিম বিশ্বের চাপে সেই দন্ড কার্যকর করতে পারেনি মোহাম্মদ আলী বগুড়ার সরকার। মুক্তি পান সাইয়্যেদ মওদুদী রহ.। [৪,৫]

যুক্তফ্রন্ট সরকার : 
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে অন্যান্য দল মিলে যুক্তফ্রন্ট নামীয় একটি সমন্বিত বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সাথে আরো ছিল মৌলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি। বামপন্থী গনতন্ত্রী দলের নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলি সিলেটি।

১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জ্জন করে। তন্মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ৪৮টি পেয়েছিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামী ইসলাম পার্টি লাভ করেছিল ২২, গণতন্ত্রী দল লাভ করেছির ১৩টি এবং খেলাফত-ই-রাব্বানী নামক দলটি ১টি আসন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়।

এ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত ছিল। এগুলোর মধ্যে কংগ্রেস লাভ করেছিল ২৪টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি, শিডিউল্ড কাস্ট ফাউন্ডেশন ২৭টি, গণতন্ত্রী দল ৩টি এবং ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ১৩টি আসন লাভ করেছিল। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।

এখানে একটা বিষয় গোলমাল লেগে যায়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের পাকিস্তান সভাপতি। আর ভাসানী ছিলে পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৬ সালে। প্রায় বছরখানেক তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া পাস হয়। এবং এর মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। এতটুকুই ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর সফলতা। এছাড়া জামায়াতের ইসলামী সংবিধানের রূপরেখার কিছুই গ্রহন করা হয়নি।

নতুন সংবিধানে গভর্ণর জেনারেল সিস্টেম বাদ পড়ে ইস্কান্দর মির্যা হন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। আগে মূলত রাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হতো। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ইস্কান্দর মির্যার সাথে সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ বাড়তে থাকে। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। এর প্রায় একবছর পর ১৯৫৮ সালে ক্যু করেন আইয়ুব খান। পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। [বাংলাপিডিয়া]

৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ছয় দফার সৃষ্টি :
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক ভারত যুদ্ধ হয়। যুদ্ধটি স্থায়ী ছিল ১৭ দিন। কাশ্মীর সহ নানা ইস্যুতে পাকিস্তানে অতর্কিত আক্রমন করে ভারত। পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত থাকার থাকার কারণে প্রাথমিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। তবে ৫-৬ দিনের মধ্যেই আইয়ুব খানের রণনৈপুণ্যে ও বাঙ্গালী সৈনিকদের নজিরবিহীন আত্মত্যাগে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ভারতের প্রায় ৬০ টি বিমান ৪৫০ ট্যাংক ধ্বংস হয়। এমতাবস্থায় ভারত যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগী হয়ে পড়ে। অপরদিকে পাকিস্তানের গোলাবারুদ সংকট ও যুদ্ধক্ষেত্র পাকিস্তান হওয়ায় পাকিস্তানের জনজীবন হুমকির সম্মুখিন। সব মিলিয়ে পাকিস্তানও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে। [উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া]

ভারতের বন্ধু রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং একটা চুক্তি হয়, যা তাসখন্দের চুক্তি বলে অভিহিত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ জনগণ এই চুক্তি মানে নি। এটা ছিল সূবর্ণ সুযোগ কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের। কিন্তু আইয়ুবের কূটনৈতিক ব্যর্থতায় তা হলো না। ক্ষেপে উঠে রাজনীতিবিদেরা ও পাকিস্তানী জেনারেলরা। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো জোট গঠনের চেষ্টা করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম লীগ। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী লাহোরে সেই মিটিঙে আরো অংশগ্রহন করে আওয়ামীলীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম। আওয়ামীলীগের পূর্বপাকিস্তানের সেক্রেটারী মুজিব সেই প্রোগ্রামে আ. লীগের হয়ে অংশগ্রহন করেন। [৭]

সেই মিটিঙে মুজিব হঠাৎ করে ৬ দফা ঘোষনা করে বসেন। কিন্তু অন্যান্য বিরোধী দল তা মেনে নেন নি। তারা বলেন, আমরা আজ একত্রিত হয়েছি কাশ্মীর, তাসখন্দ ও আইয়ুব খান কে নিয়ে। ফলে মিটিঙের কার্যসূচী থেকে ছয় দফা বাদ পড়ে। মুজিব সভাস্থল ত্যাগ করে। মজার বিষয় হল নিখিল পাকিস্তানের আ. লীগ প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এতে বিস্মিত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এই ছয় দফা নিয়ে আ. লীগে ভাঙ্গন দেখা দেয়। শুধু তাই নয় যারা সেই মিটিঙে আ. লীগের অন্যান্য নেতা যারা মুজিবের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তারাও আগে থেকে কিছুই জানতেন না ৬ দফার ব্যাপারে।

দুঃখজনক ও বিস্ময়কর হলেও সত্য মূলত এই ছয় দফার কারিগর ছিলেন আইয়ুব খান। কারণ তিনি চেয়েছিলেন সেনা অফিসার ও রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি তাসখন্দ থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে। এবং ৬ দফার বিরোধী হয়ে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বজায় রাখতে সবাই যেন তার হাতকেই শক্তিশালী করে। পরিশেষে কিন্তু তাই হয়েছিলো। আইয়ুব ৬ দফাকে হাতিয়ার করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব তথ্য সচিব আলতাফ গওহরকে দিয়ে ৬ দফা প্রনয়ন করেন। আলতাফ সাহেব কর্মসূচীটি রুহুল কুদ্দুসকে দেন। রুহুল কুদ্দুস ছিলেন মুজিবের ইনার সার্কেল। তিনি সেটা কৃষি ব্যংকের এম ডি খায়রুল বাশারকে দিয়ে টাইপ করিয়ে বিমানে উঠার আগ মুহুর্তে মুজিবের হাতে গুঁজে দেন। [৮, ১০]

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে এই কারণে যে, আলতাফ গওহর পাকিস্তানের সমস্ত পত্র-পত্রিকাকে নির্দেশ দেন এই মর্মে যেন তারা ৬ দফার বহুল প্রচার করে। এভাবেই ছয় দফা আলোচিত হয়। নতুবা বিরোধীদের মিটিঙে যেই ছয় দফা নিয়ে কোন আলোচনাই হয় নি সেই ছয় দফা নিয়ে মাতামাতি করার কোন কারণ নেই। লাহোরে ৫ তারিখ ৬ দফা উত্থাপন না করতে পেরে মুজিব ১০ ফেব্রুয়ারী সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে পত্রিকাগুলো আরো রসদ পায়। মানুষ ভুলে যায় তাসখন্দ কিংবা কাশ্মীর সমস্যা। রাজনীতিবিদ ও সামরিক অফিসারদের মাথা ব্যাথার কারণ হয় ৬ দফা। [৮,৯]

এদিকে মুজিবের অবস্থাও ভালো নয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশই ৬ দফা মানে নি। দফা গুলোর সাথে তাদের বিরোধ না হলেও তাদের মূল বিরোধ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবের কারো সাথে পরামর্শ না করে এহেন ঘোষনা কেউ মেনে নিতে পারে নি। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তানের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। এতে অন্যান্য মেম্বার সহ লীগ সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবল আপত্তির মুখে মুজিব ছয় দফা পাশ করাতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে ছয় দফার সাথে আ. লীগের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। হতাশ মুজিব তার শেষ অস্ত্র ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন। [৭,৮,৯]

এই প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন। দুঃখভরা মন নিয়ে শেখ মুজিব আমাদের(ছাত্রলীগ) ডাকলেন। বললেন, আমি তো বিপদে পড়ে গেছি। আমারে তোরা কি সাহায্য করবি না? ছয় দফা বলার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আমার অপর এটাক আসছে। আমার তো এখন ঘরে বাইরে শত্রু। আমরা তখন বললাম নিশ্চয়ই আপনার পাশে থাকবো। যাই হোক ফ্যসিবাদী মুজিব ছাত্রলীগের গুন্ডাদের সহযোগিতায় সভাপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এবং নিজে পূর্ব পাকিস্তান আ. লীগের সভাপতি হন। ছয় দফার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান। [৮]

এভাবেই আইয়ুব-মুজিব ষড়যন্ত্রে নষ্ট হয়ে যায় কাশ্মীরের মুসলমানদের ভাগ্য। হয়তো তখন পাকিস্তানী জেনারেলরা তাসখন্দ চুক্তিকে বাতিল করে ভারতকে চাপ দিয়ে কাশ্মীর অধিকার করে নিতে পারতো।

ড: আনিসুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেন,
"ছয় দফার প্রণেতা কে, এই নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন সিভিল সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য এটা তৈরি করে শেখ মুজিবকে দিয়েছিলেন, কেউ কেউ সে কৃতিত্ব কিংবা দোষ দিয়েছিলেন কয়েকজন সাংবাদিককে। তাদের পেছনে কোন শক্তি কাজ করছিল, সে বিচারও হয়েছিল। প্রথমে উঠেছিল ভারতের নাম। কিন্তু পাকিস্তান হওয়া অবধি তো দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ভারতের প্ররোচনা বলে। পরে বড়ো করে যে নাম উঠলো, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব এবং ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্টের বন্ধুত্বের কারণে পাকিস্তান ভাঙার উদযোগ নিচ্ছে মার্কিনরা, এমন একটা ধারণা খুব প্রচলিত হয়েছিল। আমরা যারা একটু বামঘেঁষা ছিলাম, তারা এই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলাম। ফলে, ফেডারেল পদ্ধতি ও স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষপাতী হলেও ছয় দফাকে আমরা তখন গ্রহণ করিনি। আমরা আরো শুনেছিলাম যে, পাকিস্তান ভাঙতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করতে দেওয়া হবে; সুতরাং এ কাজে মার্কিনদের উৎসাহ তো থাকবেই। যদি প্রশ্ন উঠতো যে, পাকিস্তান তো সেনটো-সিয়াটোর সদস্য, তাহলে জবাব পাওয়া যেতো যে, পাক-ভারত যুদ্ধের পরপ্রেক্ষিতে ওসব জোটের অসারতা প্রমাণ হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান যে কোন সময় তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। পাকিস্তান কখনোই এসব সামরিক জোট ছাড়েনি, তবে আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্সে’র প্রচারিত নীতি কিছুটা এ ধারণাকে পুষ্ট করেছিল।” [১১]

আতাউর রহমান খান (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) বলেন,
"(তাসখন্দে) কয়দিন আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও লালবাহাদুর শাস্ত্রী একটি যুক্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলেন। সিদ্বান্ত হল, শান্তিপূর্ণভাবে উভয় পক্ষ নিজেদের ছোট বড় সমস্যার সমাধান করবে। আশ্চর্যের কথা, যা নিয়ে যুদ্ধ, অর্থাৎ কাশ্মীর, তার নামগন্ধও এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রইল না। এত কান্ড করে, এত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে, সারা পাকিস্তানকে প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি ঠেলে দেওয়ার পর সিদ্ধান্ত হল, ওম্ শান্তি।

পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য শহর বাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেরা সৈনিক নিহত হয়েছেন। পৃথিবীর কোন যুদ্ধে নাকি এত অল্প সময়ে এত অফিসার নিহত হয় নাই। তাদের স্থান পূরণ সম্ভব হবে না। তাই, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বিরুপ ছিল। এত ক্ষয়ক্ষতির পর আয়ুব খাঁ সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে অপমান-জনক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এই চুক্তি অপরাধ স্বীকৃতির শামিল বলে তারা মনে করে।

যে সব সৈনিক কর্মচারী শহীদ হয়েছেন তাদের বিধবা স্ত্রী ও পরিবারবর্গ এক মিছিল বার করল লাহোর শহরে। ধ্বনি তুলল, আমাদের স্বামী পুত্র ফেরত দাও। তারা শাহাদাত বরণ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন নাই। অনর্থক আপনি তাদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছেন। অকারণে তাদের অমূল্য জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। যদি দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য হতো, তা হলে আপনি এমন চুক্তি কেন স্বাক্ষর করলেন? ইত্যাদি –

পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য ফেব্রুয়ারী মাসের পাঁচ-ছয় তারিখে নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স আহ্বান করলেন। এই উপলক্ষে চৌধুরী মহম্মদ আলি ও নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ ঢাকা এসে সব দলের সাথে আলাপ আলোচনা করে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ করলেন। বললেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটজনক এই মূহুর্তে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত।

জামাত, নিজামে ইসলামীও কাউন্সিল লীগ যোগদানে সম্মতি দিল। আওয়ামী লীগেরও দোমনাভাব। শেখ মুজিবের মতামতই দলের মত। প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন অভিমত নাই। শেখ মুজিব কনফারেন্সে যোগদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। এন-ডি-এফ সভা করে মত প্রকাশ করল যে, কনফারেন্সের পক্ষে আমাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে, তবে বর্তমান অবস্থায় কোন সদস্য এতে যোগদান করতে পারছেনা। শেখ মুজিব আমাকে টেলিফোনে বললেন, আপনারা ঠিকই করেছেন। আমরাও যাবনা।

পরদিন সংবাদপত্রে দেখি, শেখ মুজিব সদলবলে লাহোর যাচ্ছেন। প্রায় চৌদ্দ পনেরো জন এক দলে। ব্যাপার কি? হঠাৎ মত পরিবর্তন। মতলবটা কি?

লাহোর কনফারেন্স শুরু হল গভীর উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে।

অধিবেশন চলাকালে হঠাৎ একটি বোমা নিক্ষেপ করলেন – ‘ছয় দফা’। প্রস্তাব বা দাবীর আকারে একটা রচনা নকল করে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হল। কোন বক্তৃতা বা প্রস্তাব নাই, কোন উপলক্ষ নাই, শুধু কাগজ বিতরণ। পড়ে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। জাতীয় কনফারেন্সে এই দাবী নিক্ষেপ করার কি অর্থ হতে পারে? কনফারেন্স ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সম্মিলিত হয়েছে। এই দাবী যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এই সম্মেলন ও এই সময় তার উপযোগী নয় – সম্পূর্ণ অবান্তর। [১২]

তারপর দলবলসহ শেখ মুজিব ঢাকা ফিরে এসে মহাসমারোহে ‘ছয় দফা’ প্রচার করলেন সংবাদপত্রে। শেখ মুজিবের দাবী ও নিজস্ব প্রণীত বলে ছয়-দফার অভিযান শুরু হয়ে গেল।

ছয় দফার জন্মবৃত্তান্ত নিম্নরুপ :
কিছুসংখ্যক চিন্তাশীল লোক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দূরাবস্থার কথা আলাপ আলোচনা করেন। আমাদের ইঙ্গিত ও ইশারা পেয়ে তারা একটা খসড়া দাবী প্রস্তুত করলেন। তারা রাজনীতিক নয় এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টও নয়। তারা ‘সাত দফার’ একটা খসড়া আমাদের দিলেন। উদ্দেশ্য, এটা স্মারকলিপি হিসাবে আয়ুব খাঁর হাতে দেওয়া, কিংবা জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবাকারে পেশ করার ব্যবস্থা করা।

এই খসড়ার নকল বিরোধীদলীয় প্রত্যেক নেতাকেই দেওয়া হয়। শেখ মুজিবকেও দেয়া হয়। খসড়া রচনার শেষ বা সপ্তম দফা আমরাও সমর্থন করি নাই। শেখ মুজিব সেই দফা কেটে দিয়ে ছয়দফা তারই প্রণীত বলে চালায়ে দিল। তারপর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা ছয় দফার দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক মর্ম ও তাৎপর্য লেখায়ে প্রকাশ করা হয়। ইংরেজী ও বাংলায় মুদ্রিত হয়ে পুস্ত্কাকারে প্রচারিত হয় সারা দেশব্যাপী।

লাহোর কনফারেন্স বানচাল হয়ে গেল। নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকেই এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেন। তারা অভিযোগ করেন, শেখ মুজিব সরকার পক্ষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই কর্ম করেছেন। লাহোরে পৌঁছার সাথে সাথে আয়ুব খাঁর একান্ত বশংবদ এক কর্মচারী শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে কি মন্ত্র তার কানে ঢেলে দেয় যার ফলেই শেখ মুজিব সব উলটপালট করে দেয়। তারা এও বলে যে আওয়ামী লীগের বিরাট বাহিনীর লাহোর যাতায়াতের ব্যয় সরকারের নির্দেশে কোন একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বহন করে। আল্লাহ আলীমূল গায়েব।” [১২]

বিঃ দ্রঃ অনেকে মনে করেন ছয় দফা বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলো। তা মোটেই নয়। কারণ আইয়ুবের পতনের সাথে সাথেই মুজিব ভুলে যায় ছয় দফার কথা। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন। ইশতেহারে উল্লেখ করেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ অখন্ডতা রাখবেন, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন করবেন না। ছয় দফা তার ৭০ এর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতো ছিল না।
পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত। পর্ব-০১
পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত। পর্ব-০৩

তথ্যসূত্র
১- ইসলামী বিপ্লবের পথ/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
২- মাওলানা মওদুদী/ একটি জীবন একটি ইতিহাস
৩- The History of Urdu Language
৪- ভাষা আন্দোলন, বাংলা পিডিয়া
৫- কাদিয়ানী সমস্যা/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
৬- মাওঃ মওদুদী, একটি জীবন একটি ইতিহাস/ আব্বাস আলী খান
৭- ছয় দফা থেকে বাংলাদেশ/ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
৮-  বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, প্রামান্য চিত্র।
৯- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' ও সিআইএর ভূমিকা/ মাসুদুল হক।
১০- আব্দুল মালেক উকিলের সাক্ষাতকার, সাপ্তাহিক মেঘনা, ১৯৮৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর
১১- কাল নিরবধি/ ড: আনিসুজ্জামান
১২- স্বৈরাচারের দশ বছর/ আতাউর রহমান খান
১৩- বাংলাদেশে র/ আবু রুশদ
১৪- সত্য মামলা আগরতলা/ কর্ণেল শওকত আলী (অবঃ)
১৫- The last days of United Pakistan/ G.W.Choudhury
১৬- দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ
১৭- বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধঃ বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, এম আই হোসেন।
১৮- দ্যা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, আর্চার ব্লাড
১৯- The 1971 Indo-Pak war, A soldier's Narrative, Hakim Arshad Koreshi
২০- The Crisis in East Pakistan, Govt of Pakistan, 5 August, 1971.
২১- Anatomy Of Violence, Sarmila Bose
২২-The event in East Pakistan, 1971- International Commission of Jurists, Geneva.
২৩- ডেড রেকনিং, শর্মিলা বসু
২৪- পলাশী থেকে বাংলাদেশ/ অধ্যাপক গোলাম আযম

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন