আজ সতেরো জুলাই
২০২৪ সালের এই দিনে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিনমিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে আগের দিন রংপুরের ছাত্রনেতা আবু সাঈদ, চট্টগ্রামের ছাত্রনেতা শান্ত ও ওয়াসিমসহ ৬ জন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।
১. ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল
২. ঢাবিতে হল বন্ধের ঘোষণা দেয় ভার্সিটি প্রশাসন
৩. রাতে শিবিরের নেতৃত্বে ঢাবি'র ১৭ টি হল থেকে ছাত্রলীগকে বহিষ্কার
৪. জাবিতে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে ছাত্রদের ভয়াবহ সংঘর্ষ
৫. বহু ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ
৬. আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহবান হাসিনার ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
৭. ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা আন্দোলনকারীদের
৮. আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রশক্তি নেতা আখতারের গ্রেপ্তার
১৭ জুলাই বুধবার ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন জোরদার হয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিনমিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।
এর আগে হল ত্যাগের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও ছাত্র হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কর্মসূচিতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দিনভর বিক্ষোভ ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সকাল থেকে আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামলে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ আজ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) পালন করবেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচি চলাকালে শুধু হাসপাতাল, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
গতকাল রাত আটটার দিকে ফেসবুকে কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সারা দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই লড়াইটা শুধু ছাত্রদের নয়, দলমত-নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের। আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, কমপ্লিট শাটডাউন বলতে তাঁরা ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ বুঝিয়েছেন।
১৭ তারিখ দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে মোড়ে মোড়ে অবস্থান ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দুপুর থেকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য সাঁজোয়া যান নিয়ে ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কফিনমিছিল শুরু করা মাত্র হামলা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় দুই পাশ থেকে সম্মিলিত আক্রমণের মধ্যে পড়ে আহত হন কয়েকজন নারীসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। আহত হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিকও। এর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলায় আহত হয়ে গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আরও ৩৫ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে টানা অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুপুরের পর তাদের টানা দুই ঘণ্টার অভিযানে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানেও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল বেলা দুইটায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিনমিছিল’ কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পুলিশের বাধায় সেখানে গায়েবানা জানাজা হয়নি। পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে কফিন নিয়ে মিছিল শুরু করলে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা আবার সূর্য সেন হলের সামনে জড়ো হন।
এরপর ঘণ্টাখানেক পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলে। পুলিশ সদস্যরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা মাস্টারদা সূর্য সেন হলের সামনে অবস্থান নেন। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন তাঁরা। পুলিশের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ওই এলাকার হলগুলোর ভেতরে চলে যান শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সূর্য সেন হলের সামনে এসে অবস্থান নেয় পুলিশ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক সেখানে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ বন্ধ করে পুলিশ।
এরপর হলগুলো থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁরা অবস্থান নিলে পুলিশ আবারও তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জবাবে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। আধা ঘণ্টা পর সেখান থেকে চলে যান শিক্ষার্থীরা। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান নেন।
রাত পৌনে ১০টার দিকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আরেক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনে থেকে ঘটনার শুরু। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চানখাঁরপুল মোড় পর্যন্ত দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। প্রায় আধা ঘণ্টা সংঘর্ষ চলার পর আন্দোলনকারীরা পুরান ঢাকার দিকে চলে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ১৯টি। এর মধ্যে ১৩টি ছাত্রদের, ৫টি ছাত্রীদের এবং বাকি ১টি আন্তর্জাতিক হল। বিজ্ঞান অনুষদের তিনটি হলে সোমবার বিকেল থেকেই যেতে পারেনি সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছাত্রীদের পাঁচটি হল এবং ছাত্রদের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। সকালে একে একে ছাত্রদের আটটি হলে একই ঘটনা ঘটে।
ঘটনার শুরু হয় রোকেয়া হল থেকে। মঙ্গলবার রাত ১১টার পর রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের অবরুদ্ধ করে মারধর ও পরে হলছাড়া করা হয়। গভীর রাতে ছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে প্রাধ্যক্ষ রাজনীতি নিষিদ্ধের বিজ্ঞপ্তিতে সই করেন। এরপর শামসুন নাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কবি সুফিয়া কামাল হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা বের হয়ে এসে প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে সই নেন।
রাতে জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগকে বের করে দিয়ে ফটকের ভেতরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে সই নেন। এরপর একে একে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলসহ সব হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। শুধু জগন্নাথ হলে প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে বিজ্ঞপ্তির সই নেওয়া হলেও হলটিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন।
হলগুলোতে জারি করা বিজ্ঞপ্তির ভাষা মোটামুটি একই ছিল। মুহসীন হলের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১. হলে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। ২. হলকে তাৎক্ষণিক নিরস্ত্রীকৃত ও সন্ত্রাসমুক্ত ঘোষণা করা হলো এবং ভবিষ্যতেও এই অভিযান অব্যাহত থাকবে, ৩. কোনো বহিরাগত হলে অবস্থান করতে পারবেন না, ৪. হলের কোনো শিক্ষার্থী শারীরিক, মানসিকভাবে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হলে হল প্রশাসন দায় নেবে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, ৫. গণরুম ও গেস্টরুম (অতিথিকক্ষে হাজিরা দেওয়া) সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা হলো। ৬. যদি কোনো ছাত্রসংগঠন হল দখল করার অপচেষ্টা করে, তৎক্ষণাৎ সেই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এসব কাজে জড়িত সবাইকে বহিষ্কার করা হবে। ৭. ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার এবং শান্তির আওতায় আনা হবে। ৮. প্রথম বর্ষ থেকে মেধা ও চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
স্যার এ এফ রহমান হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও বিজয় একাত্তর হলে সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের কক্ষ, সূর্য সেন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), কবি জসীমউদ্দীন হলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান হলের কক্ষসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেক কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মঞ্চ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল ভোর চারটার দিকে ফেসবুকে লিখেছেন, এখন থেকে হল পরিচালনা করবেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বাধা আসলে বাধবে লড়াই।’
পুলিশের হামলার মুখে সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারী অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে যান। এ সময় শাহবাগ এলাকা দিয়ে বের হওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর ও হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও জনতার ব্যানারে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। জানাজার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে অবস্থান নেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ছাত্রী হলের অনেক শিক্ষার্থী গতকাল রাতে হলে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা জানান, হামলাকারীদের বিচার না করে তাঁরা হল ছেড়ে যাবেন না।
রাজধানীর শনির আখড়ায় গতকাল দিনভর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে পুলিশের ছররা গুলিতে ছয়জন আহত হন। রাজধানীর শনির আখড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক গতকাল দিনভর অবরোধ করে রাখার পর সন্ধ্যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। সর্বশেষ রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলছিল। শনির আখড়ার কাজলায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। সন্ধ্যায় সেখানে সংঘর্ষের সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
১৭ জুলাই রাজধানীসহ দেশের অন্তত আট জেলায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অন্তত ১০টি জায়গায় সড়ক ও মহাসড়ক এবং দুই জায়গায় রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এসব ঘটনায় ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দিনভর সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
মাদারীপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ এ কে এম হাসিবুল হাসানসহ পাঁচজন আহত হন। আহতদের মধ্যে দুজন ছাত্রী ও দুজন ছাত্র রয়েছেন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে গতকাল কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারে সড়কে অবস্থানরত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ মাইকিং করে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। পরে তাঁদের ধাওয়া করলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে দুই পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হন।
জামালপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টাকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এতে পাঁচ আন্দোলনকারী আহত হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আন্দোলনকারী কয়েকজন আহত হয়েছেন। ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজ এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হন।
শেরপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশের ১০ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেন। বেলা দেড়টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে নগরের চৌমাথা এলাকায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসংলগ্ন এলাকায়। সেখানে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অবরোধ চলছিল।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদে বিকেল চারটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুরের ইচলাদী এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এ ছাড়া কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এবং ঘাটাইল কলেজ মোড় এলাকায় শিক্ষার্থীরা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। মুন্সিগঞ্জ শহর ও লৌহজংয়ে পদ্মা সেতু উত্তর থানার সামনে সকাল ১০টা থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এখানে বাধা দেয় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এখানে আহত হন ১০-১২ জন।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকা অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জিরো পয়েন্ট এলাকার চারটি সড়ক বন্ধ করে এ কর্মসূচি শুরু করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁরা এলাকাটি অবরোধ করে রাখেন। পরে কর্মসূচিতে যোগ দেন খুলনার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। জিরো পয়েন্ট অবরোধের ফলে সাতক্ষীরা, যশোর, ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বগুড়ার শেরপুরে বেলা ১১টা থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ শিক্ষার্থী জড়ো হন। মহাসড়কের অন্তত তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ছড়িয়ে পড়ে এ সময়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন।
যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় রাজশাহীগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন থামিয়ে রেলপথ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা জাতীয় পতাকা দেখিয়ে ও ইট-পাথর ছুড়ে ট্রেনটি থামিয়ে দেন। ট্রেনের চালক ট্রেন থামিয়ে পালিয়ে যান। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীরা ট্রেনের ছাদে উঠে জাতীয় পতাকা ওড়ান। এ সময় যশোরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
গাইবান্ধা শহরে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে পৌর পার্কে সমবেত হন। তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রেলগেটের সামনে অবস্থান নিয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন।
#জুলাই_ডায়েরি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন