২৪ জানু, ২০১৭

তাদেরকে হত্যা কর যেখানে পাও সেখানেই


কুরআনে কিছু আয়াত আছে যেগুলো মজলুম। মজলুম এই অর্থে বেশীরভাগ মানুষ এই আয়াতগুলো থেকে সঠিক বুঝ নিতে পারেনা। এরকমই একটি আয়াত হলো সূরা বাকারার ১৯১ নং আয়াত। “তোমরা তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো”, “যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করে যাও” — কুর’আনে এরকম কিছু আয়াত রয়েছে, যা দেখলে কিছু অমুসলিম আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তারা এই আয়াতগুলো পড়ে ভাবে, “এই তো পেয়েছি! এইবার মুসলিমরা যাবে কই?” এই ধরনের আয়াতগুলোর আগে-পিছে কিছু না পড়েই, আয়াতগুলোকে কাটছাঁট করে ব্যাপক প্রচার করে, যেন তারা মানুষকে দেখাতে পারে যে, ইসলাম একটি অসহনীয়, আগ্রাসী, অশান্তির ধর্ম, আর তারা নিজেরা কত সাধু। আবার মুসলিমদের মধ্যেও একটি অংশ আছে যারা ইসলামকে ধারণ করতে পারেননি ইসলামের উদ্দেশ্যকেও ধারণ করতে পারেন নি। তারাও ইসলামকে আগ্রাসী বা ভয়ঙ্কররুপে উপস্থাপনে একধরণের পৈশাচিক আনন্দ পান। 

আসুন আমরা দেখি কুরআনে সূরা বাকারার সেই আয়াতগুলোতে আসলে আল্লাহ কি বলেছেন?

১৯০: যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে লড়াই করো, কিন্তু সীমা অতিক্রম করবে না। যারা সীমা অতিক্রম করে, তাদেরকে আল্লাহ কখনোই ভালোবাসেন না। 

১৯১: তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো। আর সেখান থেকে বের করে দাও, যেখান থেকে ওরা তোমাদেরকে একদিন বের করে দিয়েছিল। অন্যায় বাঁধা, নির্যাতন (ফিতনা) হত্যার চেয়েও খারাপ। তবে মসজিদুল হারাম-এর কাছে ওদের সাথে লড়াই করবে না, যদি না তারা সেখানে তোমাদের সাথে লড়াই শুরু না করে। আর যদি তারা সেখানে লড়াই করেই, তাহলে তাদেরকে হত্যা করো — অবিশ্বাসীদের এটাই উচিত প্রাপ্য। 

১৯২: কিন্তু ওরা যদি (যুদ্ধ) বন্ধ করে, তবে অবশ্যই, আল্লাহ অনেক ক্ষমা করেন, তিনি নিরন্তর দয়ালু। 

১৯৩: যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায় বাধা, নির্যাতনের (ফিতনা) অবসান না হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করে যাও। কিন্তু ওরা যদি (যুদ্ধ) বন্ধ করে, তাহলে কোনো বিরোধ থাকা যাবে না, শুধু মাত্র অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ছাড়া। [আল-বাকারা]

কাট ছাঁট না করে আগে পরের সবগুলো আয়াত পড়লে এবং প্রেক্ষাপটসহ পড়লে কত সহজেই বুঝা যায় ইসলাম কতটা মানবিক। বর্তমানে “জিহাদ” শব্দটি সাধারণ মানুষের নিকট আতংকজনক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। এমনভাবে একে উপস্থাপন করা হয় যে, জিহাদ মানেই যেন সন্ত্রাস কিংবা অস্ত্রবাজি ইত্যাদি। অথচ ইসলাম সন্ত্রাসকে কঠোর ভাষায় ঘৃণা করেছে। সন্ত্রাসীর জন্য গুরুতর শাস্তির বিধানও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। হয়তোবা, ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে জিহাদকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার পথকে বেছে নিয়েছে। আর একে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।

আসুন আমরা শুধু কুরআনের জিহাদ সংক্রান্ত এই আয়াতগুলো নিয়ে নয়, টোটাল জিহাদ নিয়েই একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনায় আসি। 

জিহাদের সংজ্ঞা: জিহাদ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল-
১. কোন বিষয়ের চুড়ান্ত সাফল্যে পৌছানোর লক্ষ্যে কথা ও কাজ দ্বারা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো।
২. কষ্ট স্বীকার করা।
৩. শত্রুকে প্রতিরোধ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করা। (তাজুল উরুস,কামুসুল ফিকহী)

জিহাদের পারিভাষিক অর্থঃ
বুখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাতা আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন: কাফেরদের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে শক্তি ক্ষয় করা। এর (জিহাদ শব্দ) দ্বারা নিজের প্রবৃত্তি, শয়তান এবং দুরাচার সকলের সাথে সংগ্রাম করাকেও বুঝায়।

এখানে প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ বলতে দ্বীন শিক্ষাগ্রহণ করা, শিক্ষাদান করা ও নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করা, শয়তানের সাথে সংগ্রাম বলতে তার আনীত সংশয় ও অযাচিত লোভ লালসা প্রতিরোধ করাকে বুঝায়। আর কাফেরের সাথে জিহাদ হাত (শক্তি প্রয়োগ), সম্পদ, কথা কিংবা অন্তর যে কোনটার মাধ্যমেই হতে পারে। এছাড়া দুরাচারীদের সাথে জিহাদ হাত দ্বারা(শক্তি প্রয়োগ) অতঃপর জবান তারপর অন্তর দ্বারা হতে পারে। (ফাতহুল বারী: জিহাদ ও সিয়ার অধ্যায়) 

ইমাম জুরজানী (রহঃ) বলেন: জিহাদ হল-সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করা। (আত-তা’রীফাত)

আল্লামা কাসানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অর্থ হল- প্রচেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা কিংবা কোন কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুখের কথা, সম্পদ ও জীবন ইত্যাদি ক্ষয় করে সফলতার মানদন্ডে পৌছার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার নামই জিহাদ। (আল বাদায়েউস সানায়ে)

ডঃ ইউসুফ আল-কারযাভী বিখ্যাত বই ‘ফিকহুল জিহাদ’-এ জিহাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে তিনি আত্মরক্ষায় জিহাদ (জিহাদ আদ-দাফ’), আক্রমণাত্মক জিহাদ (জিহাদ আত-তালাব) —এই দুই ধরনের জিহাদ সম্পর্কে প্রাচীন আলেমরা, যেমন ইবন তাইমিয়াহ, আস-সুয়ুতি, ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফিই সহ শত ইমাম, ক্বাদি, মুহাদ্দিস, ফকিহদের জিহাদ সম্পর্কে লেখা বই, মতবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, মুসলিমদের মধ্যে জিহাদ সম্পর্কে মূলত দুটো মত রয়েছে

১) একদল মনে করে জিহাদ শুধুমাত্র আত্মরক্ষা এবং ইসলাম মানতে বাধা দূর করতে করা যাবে। জিহাদে শুধুমাত্র যারা আক্রমণ করছে, তাদেরকে পালটা আক্রমণ করা যাবে। আক্রমণ করছে না বা আক্রমণে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করছে না, এরকম কাউকে আক্রমণ করা যাবে না।

২) আরেকদল মনে করে শুধুমাত্র কুফরি, অর্থাৎ ইসলামে বিশ্বাস না করার কারণে, যে কোনো মানুষ, জাতি, দেশকে আক্রমণ করা যাবে, তারা মুসলিমদের ক্ষতি না করলেও যাবে। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তারা যদি ইসলাম মেনে না নেয়, তাহলেই তারা কাফির হয়ে যাবে, এবং কুফরি করার কারণে তাদেরকে আক্রমণ করা যাবে, অথবা তাদের কাছ থেকে জিযিয়া (কর) নেওয়া যাবে।

লেখক তার বইয়ে উভয় পক্ষের বহু দলিল উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন যে, প্রথম অবস্থানের পক্ষে ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সিংহভাগ ইমাম, ফকিহদের সমর্থন রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন ইবন তাইমিয়াহ, আস-সুয়ুতি, ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ সহ শত শত আলেম। দ্বিতীয় অবস্থানের পক্ষে ইমাম শাফিই এবং সংখ্যালঘু কিছু আলেমের সমর্থন রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানের পক্ষে যে সমস্ত দলিল দেখানো হয়, সেগুলো পরিষ্কারভাবে কু’রআনের বহু আয়াতের বিরুদ্ধে যায়। যে কারণে দ্বিতীয় অবস্থানের পক্ষের আলেমরা কু’রআনের সেই সব আয়াতকে মানসুখ অর্থাৎ বাতিল ঘোষণা করে তাদের অবস্থান সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন, যা প্রথম পক্ষের আলেমরা যথেষ্ট দলিল দিয়ে ভুল প্রমাণ করেছেন।

জিহাদের স্তর: জিহাদের বেশ কিছু স্তর রয়েছে। জিহাদ বললেই অস্ত্র ব্যবহার করা বুঝায় না। জিহাদের স্তর সম্বন্ধে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেছেন:

*প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি। সেগুলো হল-
১. সত্য দ্বীন (ইসলাম) শিক্ষাগ্রহণ করা। কেননা, সত্য দ্বীন তথা ইসলাম ছাড়া অন্যত্র কোন কল্যাণ নেই।
২. দ্বীন শিক্ষাগ্রহণের পর তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। কেননা, বাস্তবায়ন ছাড়া শুধুমাত্র শিক্ষাগ্রহণ করলে তাতে ক্ষতি না হলেও কোন লাভ হয় না।
৩. যা শিক্ষাগ্রহণ করেছে তা অপরকে শিক্ষাদান করা। কেননা, দ্বীনের কোন কিছুকে গোপণ করলে আল্লাহ তায়ালার আযাব থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা।
৪. ইসলামের বিধানকে তুলে ধরতে গিয়ে কোন বিপদ আসলে ধৈর্যধারণ করা ও কষ্ট স্বীকার করা।

*শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের রয়েছে দু’টি স্তর:
১. সংশয় দূর করা।
২. কু-প্রবৃত্তিকে প্রতিরোধ করা।

* কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি।
১. অন্তর দিয়ে কাজটাকে ঘৃণা করা,
২. মুখের কথা দ্বারা তা প্রতিরোধ করা,
৩. এ পথে সম্পদ ব্যয় করা ও
৪. নিজের জীবন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করা।

* অত্যাচারী যালিম ও অবাধ্যদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর তিনটি।
১. সক্ষম হলে(ক্ষমতাবান) শক্তি প্রয়োগ করে তা রুখে দেয়া।
২. শক্তি প্রয়োগে অক্ষম হলে মুখের কথা দিয়ে তা রুখবে।
৩. তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে তাকে (কাজকে) ঘৃণা করবে এবং তা প্রতিহত করার চিন্তায় ব্যাপৃত থাকবে।

জিহাদের স্তরগুলো নিয়ে কেউ গবেষণা করলে সে দেখতে পাবে, যে সমস্ত নবীদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত (ইসলামের দিকে আহবান) দিতে বলা হয়েছে। তাদের অবর্তমানে তাদের উম্মতের মধ্যকার যোগ্য ব্যক্তিদেরকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যদি তাদের বাণীকে গ্রহণ না করে এবং এতে বাধা দেয় তবেই যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রথমেই যুদ্ধের নির্দেশ বা অনুমতি দেয়া হয়নি।

জিহাদের আবশ্যকতা: অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম তথা ইসলামীক স্কলারদের মতে জিহাদ করা ফরজ তথা আবশ্যক কাজ। এটা একটা ইবাদাত। 
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমাদেরকে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে অথচ, তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা তোমাদের জন্য কল্যণকর। আবার এমনও হতে পারে কোন জিনিসকে তোমরা পছন্দ করো অথচ, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ সবকিছু জানেন কিন্তু,তোমরা জানো না। (সুরা বাকারা: ২১৬)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমাদের কী হলো,তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য কেন লড়ছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে?তারা ফরিয়াদ করছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ে যাও।নিশ্চিত জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)

কখন জিহাদ ফরজ তথা আবশ্যক হয়?
অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে নিম্নের কয়েকটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়।
প্রথমত: যখন দু’টি দল (মুসলিম ও অমুসলিম) পরস্পর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের সেখান থেকে পলায়ন করা বৈধ নয়। তখন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হয়ে যায় দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়,তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে। আশা করা যায়,এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না,অন্যথায় তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা ধৈর্যধারণের পন্থা অবলম্বন কর,নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সুরা আনফাল: ৪৫-৪৬) 

দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুবাহিনী কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর আবশ্যক হয়ে যাবে তাদের গতিরোধ করা। তারা যদি সক্ষম না হয় তাহলে, তাদের পার্শ্ববর্তী লোকদের উপর পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরজ হবে।

তৃতীয়ত: রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তখন জিহাদে যাওয়া আবশ্যক হবে। তবে, কারো কোন ওজর থাকলে ভিন্ন কথা। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো,যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে জিহাদে বের হতে বলা হয়,তখনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবনকে বেশী পছন্দ করে নিয়েছ? যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখ,দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুবই সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আরেকটি দলকে নিয়ে আসবেন,তখন তোমরা আল্লাহ তায়ালার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা তাওবা: ৩৮-৩৯) 

জিহাদকে কেন বৈধতা দেয়া হল?
যুদ্ধ আসলে ভালো কাজ নয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ দাংগা-হাংগামা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটার দারস্থ হতে হয়। যখন যুদ্ধ ছাড়া সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার আর কোন পথ অবশিষ্ট্য থাকেনা তখনই বাধ্য হয়ে জিহাদের চুড়ান্ত স্তর যুদ্ধের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বৈধ করেছেন। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন: আর এ কাফেরদের সাথে এমন যুদ্ধ করো যেন গোমরাহী ও বিশৃংখলা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা ফিতনা থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহই তাদের কার্যকলাপ দেখবেন। (সুরা আনফাল: ৩৯)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখ যালেম তথা অত্যাচারী ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (সুরা বাকারা: ১৯৩)

জিহাদের উদ্দেশ্যঃ
কোন কাজ করার পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোন কাজ করে না। তেমনি জিহাদেরও বেশ কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলো নিম্নে উপস্থাপিত হল। 

প্রথমত: আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করা। কোন স্বার্থের কারণে নয়। হাদীস শরীফে এসেছে- আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুল (সাঃ) এর কাছে একজন লোক এসে বললেন: একজন লোক যুদ্ধলব্ধ সম্পদের আশায় যুদ্ধ করে, আরেকজন নিজের নাম যশ-খ্যাতির জন্য যুদ্ধ করে এবং অন্যজন নিজের অবস্থান মানুষকে দেখানোর জন্য যুদ্ধ করে। তাদের মধ্যে কে আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ করে? রাসুল (সাঃ) বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করার জন্য যুদ্ধ করে সেই আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ বা জিহাদ করে। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান, বায়হাকী, নাসায়ী, তিরমীজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ) 

দ্বিতীয়ত: মজলুম তথা অত্যাচারিতদেরকে সাহায্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন তোমাদের কী হলো, তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করে বলছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। অতএব, শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)

তৃতীয়ত: শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করে তাদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেফাজত করা। 

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: হারাম (সম্মানিত) মাসের বিনিময় তো হারাম মাসই হতে পারে এবং সমস্ত মর্যাদা সমপর্যায়ের বিনিময়ের অধিকারী হবে। কাজেই যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে তোমরাও তার ওপর ঠিক তেমনিভাবে হস্তক্ষেপ কর। তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালা খোদাভীরুদের সাথে আছেন (যারা সীমালংঘন করা থেকে বিরত থাকে)। (সুরা বাকারা:১৯৪)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে,তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদের একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হত। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৪০)

জিহাদের প্রকারভেদঃ শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ বেশ কয়েক প্রকারের হতে পারে। যেমন-

১. কাফের, মুনাফিক ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ।
২. ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন আকাংখী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন:ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি দল অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে বসে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা হুজুরাত: ৯)

একটি হাদীসে এসেছে- রাসুল (সাঃ) বলেছেন: অচিরেই ফিতনা ফাসাদ ও দুর্ঘটনা ঘটবে। যে এই উম্মাতের (মুসলমানদের) মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে চায় সে যেই হোক না কেন তাকে তরবারী দ্বারা শাস্তি দাও (এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব)। (মুসলিম শরিফ, মুসনাদে আহমাদ)

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইসলামিক স্কলাররা বলেন: যদি কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমানদের ভিতর ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্র করে তাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে বিভিন্নভাবে সতর্ক করার পরেও ক্ষান্ত না হয় তাহলে, তাকে প্রয়োজনে তরবারী দ্বারা শাস্তি দেবে। তবে,এটা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। সরকারের কোন সবুজ সংকেত ছাড়া এটা সাধারণ মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য নয়। 

৩. দ্বীন, জীবন, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ রক্ষায় যুদ্ধ করা বৈধ। রাস্তায় সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করাও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সাঃ) বলেছেন: যে তার সম্পদ হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ, যে পরিবার পরিজনকে হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ। যে নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ এবং যে দ্বীনের (ইসলামের) জন্য নিহত হয়েছে সেও শহীদ। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমীজি, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ)

জিহাদে মানুষ হত্যা কেন?
পৃথিবীর সচেতন সকল ব্যক্তিই বলবে যে, কোন একটা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজস্ব সেনাবাহিনী দরকার। অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া কোন দেশ অন্য আরেকটি দেশ বা গোষ্টির সাথে যুদ্ধ করতে চায় না। শান্তিকামী রাষ্ট্র সব সময় সুযোগ খুজতে থাকবে শান্তির কোন দরজা খোলা রাখা যায় কিনা? যখন শান্তির সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তখনই তারা অন্য দেশ বা গোষ্টির সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইনসাফের ধর্ম ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। কেননা, ইসলাম চায় সমাজে শান্তি বজায় থাকুক। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, মুসলমানরা যেখানেই অন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে গেছেন সেখানেই তাদের একটা অপশন ছিল সন্ধির। সন্ধিতে সাড়া দিলে তাদের সাথে আর তারা যুদ্ধে জড়াতেন না। 

ইসলামে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল কেন? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এ প্রশ্নের খুব সুন্দর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:

প্রথমত: ইসলাম মুসলমানদেরকে ধৈর্য ধারণ ও ক্ষমা করার নির্দেশ দিয়েছে। 
আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা কি তাদেরকে দেখনি,যাদেরকে বলা হয়েছিল,তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও? এখন যুদ্ধের নির্দেশ দেয়ায় তাদের একটি দলের অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে,তারা মানুষকে এমনভাবে ভয় করছে যেমন আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা উচিত অথবা তার চেয়েও বেশী। তারা বলছেঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ কেন দিলে? আমাদের আরো কিছু সময় অবকাশ দিলে না কেন? তাদেরকে বলে দিন দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ অতি সামান্য এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত মানুষের জন্য আখেরাতই উত্তম আর তোমাদের ওপর সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না৷ (সুরা নিসা: ৭৭)

নাসায়ী শরীফের হাদীসে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ও তার কিছু সাথী মক্কায় থাকাকালীন রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন: হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমরা যখন মুর্তিপুজারী ছিলাম তখন সম্মানের সাথেই ছিলাম। আর ইসলাম গ্রহণ করেই আমরা লাঞ্চিত হয়ে গেলাম। (আমাদের কি কিছুই করার নেই?) রাসুল (সাঃ) বললেন: আমাকে ক্ষমা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং, যুদ্ধে জড়িয়ে পড় না।(নাসায়ী,মুসতাদরাকে হাকেম, বায়হাকী,মুসনাদে সাহাবা)

দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুরা মারমুখী হয়ে গেল তখন শুধুমাত্র জিহাদের অনুমতিটুকু দেয়া হয়েছিল। আবশ্যক করা হয়নি। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে,কেননা তারা মজলুম এবং আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম, গীর্জা, ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৩৯-৪০)

তৃতীয়ত: যারা তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের সাথেই যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অন্যদের সাথে নয়। 
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর,যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে,কিন্তু খবরদার, সীমালংঘন কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সীমালংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না। (সুরা বাকারা:১৯০)

চতুর্থত: অন্যান্য অমুসলিমদের সাথে শর্তসাপেক্ষে (রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে নির্দেশ ইত্যাদি) জিহাদকে আবশ্যক করা হয়েছে। সেটাও হতে হবে যৌক্তিক কারণে। কেউ অমুসলিম হলেই যে, তার সাথে যুদ্ধ করা যাবে এটা ঠিক নয়। কেননা, আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই- রাসুল (সাঃ) এর মদীনাতে অনেক অমুসলিম বসবাস করতেন। তাদের সাথে তিনি সু সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: আর মুশরিকদের সাথে সবাই মিলে লড়াই কর, যেমন তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করে। আর জেনে রাখ! আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের (খোদাভীরু) সাথেই আছেন। (তাওবা:৩৬) উল্লেখ্য যে,এখানে যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে শুধুমাত্র তাদের সাথেই যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। যাদের সাথে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছেনা তাদের ক্ষেত্রে এ নির্দেশ নয়। (ফিকহুল জিহাদ দ্রষ্টব্য)


কিন্তু ওরা যদি বন্ধ করে, তাহলে কোনো বিরোধ থাকা যাবে না, শুধু মাত্র অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ছাড়া


মনে করুন আপনি একজন হিন্দু, হিন্দুপ্রধান এক গ্রামে থাকেন, যেখানে হাতে গোণা কয়েকজন মুসলিম হয়েছে। একদিন আপনি ইসলামের সত্য শিক্ষা বুঝতে পেরে নিজেই মুসলিম হয়ে গেলেন। গ্রামের মোড়লরা জানতে পারলো যে, আপনি মুসলিম হয়ে গেছেন। ব্যাস, শুরু হলো আপনার উপর অত্যাচার। প্রথমে তারা আপনাকে রাস্তায় দেখলে গালি দিত, ঢিল ছুঁড়ে মারত। তারপরও আপনাকে টলাতে না পেরে, রাস্তায় একদিন আপনাকে একা পেয়ে ব্যাপক মার দিলো। তারপর আপনাকে একদিন মাঠে নামাজ পড়তে দেখে আপনার উপর চড়াও হয়ে আপনাকে টেনে হিঁচড়ে বাজারে নিয়ে গেল, লোকজনদের সামনে আপনাকে চরম অপমান করলো। শেষ পর্যন্ত একদিন রাতের অন্ধকারে কয়েকজন লুকিয়ে এসে আপনার বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলো। আপনাকে পরিবার সহ বাড়ি ছেড়ে অন্য এক মুসলিমের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হলো। এভাবে বছরের পর বছর ধরে আপনার উপর তারা অত্যাচার করতে থাকলো।

এদিকে গ্রামে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছুল যে, মুসলিমরা  সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের উপর অত্যাচার প্রতিহত করা শুরু করলো। তাদেরকে গ্রামের হিন্দুরা আক্রমণ করলে, তারাও আত্মরক্ষায় উচিত জবাব দেওয়া করা শুরু করলো। এভাবে একসময় মুসলিমরা বেশ শক্তিশালী হয়ে গেল। একটা পর্যায় গিয়ে মুসলিমরা গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী হয়ে গেল। তারা এখন ইচ্ছা করলেই গ্রামের হিন্দুদের উপর চড়াও হয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে পারে, সব হিন্দুকে গ্রাম ছাড়া করে ছাড়তে পারে। কিন্তু এখন আর হিন্দুরা তাদেরকে আক্রমণ করছে না, ইসলাম মেনে চলতে মুসলিমদেরকে কোনো বাধা দিচ্ছে না। তারা মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা মেনে নিয়েছে। সেই অবস্থায় মুসলিমরা ইচ্ছে করলেও প্রতিশোধ নিতে পারবে না, কারণ আল্লাহ নিষেধ করে দিয়েছেন। প্রতিশোধ নেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সাথে কোনো বিরোধ রাখা, কঠোর হওয়া পর্যন্ত যাবে না। শুধুমাত্র যেই মুশরিকরা তখনো অন্যায় করে যাবে, শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারবে। এতদিন ধরে যারা মুসলিমদেরকে এত কষ্ট দিয়েছে, এত অন্যায় করেছে, তাদেরকে আল্লাহ ছেড়ে দিলেন, শুধুমাত্র এই কারণে যে, তারা এখন আর মুসলিমদেরকে বাধা দিচ্ছে না।

শুধু তাই না, তাদের জন্য আল্লাহর বাণী— কিন্তু ওরা যদি থামে, তবে অবশ্যই, আল্লাহ অনেক ক্ষমা করেন, তিনি নিরন্তর দয়ালু।

আল্লাহ আরো বলেন, কোনো মুশরিক (মূর্তি পূজারি, যারা শিরক করে) যদি তোমাদের কাছ নিরাপত্তা চায়, তাহলে তাকে তা দেবে, যেন সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায়। তারপর তাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে। আসলে তারা এমন একটা জাতি, যাদের জ্ঞান নেই। (আত-তাওবাহ ৬)

তাদের এত অন্যায়ের পরেও আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করতে রাজি আছেন। ওদিকে আপনি প্রতিদিন বাইরে গেলে দেখতে পান আপনার ওই প্রতিবেশীকে, যে আপনাকে প্রচন্ড মার দিয়েছিল। বাজারে গেলে দেখেন ওই লোকগুলোকে, যারা আপনাকে বাঁচাতে এগিয়ে তো আসেইনি, বরং আপনাকে অত্যাচার করার সময় উল্টো হাসাহাসি করেছিল। মাঠে গেলে দেখেন সেই সব হিন্দু মোড়লদের, যারা আপনার বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে আপনাকে পথে বসিয়ে দিয়েছিল। প্রতিদিন আপনাকে সেই সব অত্যাচারী হিন্দুদের দেখে হাসি মুখে কথা বলতে হয়। আপনার ভেতরে যতই প্রতিশোধের আগুন জ্বলুক না কেন, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। তিনি কঠিন আদেশ দিয়েছেন যেন, আপনি তাদেরকে কিছুই না করেন, তাদের সাথে সবসময় ভালো ব্যবহার করেন।

এই হচ্ছে কু’রআনের শিক্ষা। এরপরও কেউ যদি ইসলামকে শান্তি এবং দয়ার ধর্ম না বলে, তাহলে সমস্যা ইসলামের নয়, সমস্যা তার অন্ধ চোখে, বধির কানে এবং পাথর হয়ে যাওয়া অন্তরে। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন