২৬ ফেব, ২০১৭

আকাশের মা


থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। খুবই ব্যস্ত সময় যাচ্ছে শাহিদের। অধিকাংশ ভার্সিটির ছেলেদের যা হয়, সারাবছর বইয়ের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। পরীক্ষা এলেই চোখের জল আর নাকের জল এক হয়ে যায়। শাহিদও তার ব্যতিক্রম নয়। তারই ক্লাসফ্রেন্ড রকিবের কাছে তার ছোটাছুটি এখন নিয়মিত। রকিব গ্রামের ছেলে, রাজনীতি করে না বলে হলে স্থান হয়নি। মেস ভার্সিটির আরো কিছু ছাত্রদের সাথে থাকে। অথচ ক্লাসের সেরা ছাত্রদের মধ্যে সে একজন। বৈধভাবে সিট বরাদ্দ হলে সেই সবার আগে পাবার কথা। কিন্তু হলতো এখন ক্ষমতাসীন দলের অফিস। সেখানে অরাজনৈতিক ছাত্র কিভাবে থাকবে! শাহিদ তার কাছে নিয়মিত আসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।

এই নিয়ে চারদিন শাহিদ রকিবের মেসে এসেছে, এরমধ্যে তিনদিনই একই ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দিন থেকেই সে ভাবছে বিষয়টা রকিবকে জিজ্ঞাসা করবে। বলি বলি করেও একথা সেকথায় আর বলা হয়নি। আজতো মহিলাটা তাকে প্রায়ই ধরেই ফেলেছিল। শাহিদও ভয় পেয়েছে ভীষণ। রাস্তার মোড়ে যেখানে বাস থামে সেখানেই গত চারদিন ধরে একটি মহিলাকে দাঁড়ানো দেখেছে শাহিদ। যখনই শাহিদ বাস থেকে নামে তখনই তিনি এগিয়ে আসেন। শাহিদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন আকাশ কোথায়? তোমাদের সাথেই তো ছিল। তোমরা সবাই চলে এলে। আকাশ আসে না কেন? প্রথমদিন বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও প্রতিদিনের বিষয়টা শাহিদকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। 

মহিলাটির বয়স আনুমানিক ৪৫ হবে। একটু স্বাস্থ্যবান। রাস্তার মোড় থেকে গলির দিকে ঢুকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ বিদ্যমান। চোখ দুটোর দিকে একটু খেয়াল করলে বুঝা যাবে রাজ্যের ক্লান্ত তিনি। মনে হবে বহু বছর ঘুমাননি তিনি। আজ রকিবের বাসা থেকে বের হতে একটু দেরী হয়ে গেল। রাত সাড়ে দশটা। এখন গলির মুখটা প্রায় ফাঁকা। মানুষজনের চলাচল একেবারে কমে গেছে। সে হঠা দেখে সেই মহিলাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে দুজন। পাশেই বিলাসবহুল গাড়ি। তারা গাড়িতে উঠাতে চাচ্ছেন সেই মহিলাকে। কিন্তু ভদ্রমহিলা কোনভাবেই উঠতে চাইছেন না। তিনি এককথা বার বার বলছেন আকাশ বলেছে তো, সে ফিরবে। আরেকটু দাঁড়াই। বাচ্চা একটা ছেলে। অন্ধকার হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে ভয় পাবে তো। আরেকটু থাকি। অন্যদিকে যে দুজন লোক গাড়িতে উঠাতে চাইছেন তারা বুঝানোর চেষ্টা করছেন, আকাশের সাথে তাদের কথা হয়েছে। সে আজ ফিরবে না। চলেন মা চলেন। এক পর্যায়ে মহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। হঠাত সেই মহিলাটি দেখতে পেল শাহিদকে। দেখা মাত্রই তার দিকে প্রায় দৌড়ে আসলেন। লোক দু’জন প্রথমে বুঝতে পারেননি কি হচ্ছে। পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা মহিলাটিকে ধরে ফেললেন। আবার সেই জিজ্ঞাসা শাহিদকে। আমার আকাশ কই। লোক দুজন শাহিদকে স্যরি বলে এবার প্রায় জোর করে গাড়িতে তুললো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। শাহিদের খুব খারাপ লাগছে। তার খুব ইচ্ছে করছে মহিলাটার সাথে কথা বলতে। 

পরদিন রকিবের বাসায় আসতে গিয়ে খোঁজ করলো শাহিদ। না মহিলাটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে খুঁজলো। না, কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রকিবের বাসায় গিয়ে প্রথমে মহিলাটির কথা জিজ্ঞাসা করলো রকিবকে। রকিব তুই চিনিস? 

২.
গল্প বলার নেশায় থাকা শাহিদ এতক্ষন টের পায়নি রকিবের মানসিকতা। প্রশ্ন করে তার দিকে তাকাতেই দেখলো রকিব দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। কাছে এগিয়ে এসে তার হাত ধরলো শাহিদ। 
কি হয়েছে রকিব? চিনিস তুই ওনাকে? কি হল? কথা বলছিস না যে? 
রকিব কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, বড় নিষ্ঠুর হয়ে গেছি রে...।

আমি তখন নতুন ভর্তি হয়েছি বিজ্ঞান কলেজে। গ্রাম থেকে এসেছি। আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাবাকে বলেছি আমি শহরেই পড়বো। গ্রামের কলেজে পড়লে ভালো কোন ক্যরিয়ার তৈরী হবে না। বাবাও চাইতেন আমার ক্যারিয়ার যাতে ভালো হয়। কিন্তু তিনি সামর্থের কথা চিন্তা করে আমাকে বলতেন মফস্বলের কলেজে পড়েও অনেকে মানুষ হয়েছে। বাবার সাথে অনেকটা জেদ করেই কলেজে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু বাবা যে আমাকে কিছু টাকা পাঠাবে আমার থাকা-খাওয়ার জন্য সেটাও নিয়মিত পাঠাতে পারতেন না। ভালো টিউশনিও পাচ্ছিলাম না। খুব কষ্টে যাচ্ছিল দিন। একদিন অর্থাভাবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। সেদিন প্রায় ঠিক করে ফেললাম পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাব। আল্লাহর উপর খুব রাগ হচ্ছিল। কত মানুষের কত টাকা। অল্প কিছু টাকার জন্য আমার পড়ালেখা হচ্ছে না। বাবা-মায়ের উপর রাগ করেও পারছি না। বয়সও তো কম ছিল। সব মিলিয়ে চাপ সহ্য করতে না পেরে চোখে পানি চলে আসছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। 

এমন সময় কে যেন আমার পিঠে হাত রাখলো। আমি চমকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম আমারই মত বয়স। হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে ভাই? কোন সমস্যা? প্রথম দেখাতেই আমার মনে হল এটা আমার আপনজন। কত দিনের পরিচয়। আমি আমার দুঃখের কথা বলতে গিয়েও আর বলতে চাই নি। বললাম, আপনি কে? আপনাকে তো চিনলাম না। সে বললো আমার বাসা এখানেই। চল বাসায় চল। আমি কেন যেন সেই নিমন্ত্রন ফেলতে পারিনি। কেমন যাদুকরি কথা, সুন্দর হাসিমুখ, অপরিচিত মানুষকে আপন করে নেয়ার তীব্র ব্যকুলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি চললাম তার বাসায় তার সাথে। বিশাল বাসা। আলিশান অবস্থা। বাসায় আমাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে তার মাকে বললো, মা আমার এক বন্ধু এসেছে। খাবার দাও একসাথে খাব। সে জানতে চায় নি আমি ক্ষুদার্ত কি না। সম্ভবত দেখেই বুঝেছে আমি ক্ষুদার্ত ছিলাম। 

খাওয়া-দাওয়ার পর জানতে চাইলো আমার পরিচয়। আমি বললাম। সেও তার পরিচয় দিল। সে আরেকটি কলেজে পড়ে। আমার মতই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। আমাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করতে আমি বৃত্তান্ত খুলে বললাম। আমাকে বসিয়ে রেখে বাসার ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পর এসেই তাড়াহুড়ো করে বললো, চল তোমার মেসে যাব। আমি বুঝতে পারিনি কি হতে যাচ্ছে। সে আর আমি আমার মেসে আসলাম। সে বললো তোমার জিনিস কোনগুলো? আমি আমার বেডিং তাকে দেখালাম। সে নিজহাতে সব গুছাতে লাগলো, আর বললো চল সব বেঁধে নাও এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে। আমি প্রতিবাদ করলাম, কিন্তু তার কড়া চোখ রাঙ্গানিতে কিছুই বলতে পারলাম না। এমন করে শাসন করলো যেন সে আমার বহুদিনের বন্ধু। অথচ তার সাথে পরিচয় মোটে কয়েক ঘন্টা। মেসে আমার থেকে পাওনা দুইহাজার টাকাও পরিশোধ করে আসলো। 

সেই থাকে তাদের বাসায় উঠে গেলাম। তখন বুঝতে পারলাম ও এমনই পরোপকারী। এলাকার সবাই তাকে এক নামে চিনে। সে ছাত্রদের ভালো উপদেশ দেয়। এলাকায় এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের আয়োজন করে। আমার যাতে হাত খরচ চলে এজন্য সে একটা ভালো টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়। মোটকথা যেখানে আমার পড়াশোনা বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল সে সেখানে আমার সব সমস্যা দূর করার চেষ্টা করে। আকাশ কেন এত ভালো? এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে খুব সোজা যারা আকাশের মাকে জানে। বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি। আকাশের বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক অবস্থায় কিছুটা সমস্যা হলেও সামলে নিয়েছেন তিনি। নিজেই পারিবারিক ব্যবসা দেখেন।

আকাশরা তিন ভাই। এর মধ্যে আকাশ ছিল সবার ছোট। আমার প্রায়ই মনে হত, আকাশ আমাকে বন্ধু বলে তার বাড়িতে তুলেছে। তার মধ্যে আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা দেখিনি। কিন্তু তার ফ্যামিলির অন্যরা আমাকে কিভাবে দেখে? এইভেবে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যেতাম। আকাশদের বাসায় থাকা অপমান মনে হত। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি আমার বাবা-মা। আমি তো ভীষণ অবাক। পরে জানতে পারি আকাশ আমার মায়ের মোবাইল নাম্বার তার মাকে দিয়েছে। সেই থেকে তিনিও আমার মাকে তাঁর বন্ধু বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি আমার বাবা-মাকে একদিন দাওয়াত করলেন অথচ আমাকে জানালেন না সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। আমার মধ্যে থাকা সেই হীনমন্যতা কেটে গেল। 

আকাশ ইসলামের কথা বলতো। আল্লাহর উপর ভরসা রাখার কথা বলতো। আমাকে প্রায়ই বলতো চল, নামাজ পড়ে আসি। একদিনের ঘটনা। আমি আর সে একই রুমেই ঘুমাতাম। সকালে উঠত বলে সে একটু আগেই ঘুমাত। একদিন গভীর রাতে আমি হঠাৎ জেগে যাই। শুনতে পাই কে যেন কাঁদছে। কান খাড়া করে থাকলাম। দেখলাম সে এলাকার কিছু ছেলের কথা বলছে যাদেরকে সবাই খারাপ ছেলে হিসেবেই জানে। সে তাদের নাম ধরে দোয়া করছে তারা যেন ভালো হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে তাদের হিদায়াতের জন্য কাঁদছে সে। অবাক হলাম। আর সেই সাথে বুঝলাম, আকাশরা সাধারণ কোন মানুষ নয়। তারা জান্নাতি মানুষ। 

এইচ এস সি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। একদিন পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে দেখি আকাশদের বাড়িতে থমথমে নীরবতা। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো ছোট ভাইয়ারে একটা সাদা মাইক্রোবাসে করে আসা লোকেরা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। সবাই থানায় খোঁজাখুঁজি করছে। আশেপাশের কোন থানাই স্বীকার করেনি তারা নিয়েছে। ডিবি অফিসে যোগাযোগ করেও কোন হদীস পাওয়া যায়নি। সেদিনই খালাম্মা আমাকে বললেন বাবা তুমি এখানে থাকলে বিপদে পড়বে। তুমি তোমার কোন বন্ধুর সাথে আপাতত থাক। তোমার কিছু হলে তোমার মাকে আমি কি জবাব দেব? আমার পরীক্ষার কথা চিন্তা করে আমি প্রয়োজনীয় কিছু বই-পত্র আর জামাকাপড় নিয়ে বের হলাম। খালাম্মা আমার হাতে বিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন, যাতে আমার থাকা খাওয়ার অসুবিধা না হয়। আমি নিতে না চাইলে কড়া ধমক দেন।

তখন সারাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, আকাশও সেই আন্দোলনে যোগ দেয়। স্বৈরাচারী সরকারের নাগপাশ ছিন্ন করে এদেশকে মুক্ত করার কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় আকাশ। মিছিল-মিটিং, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সরকারের অন্যায় আচরনের প্রতিবাদ সে ছোট বয়সেই করা শুরু করেছে। তার মত মেধাবী ছেলে সহজেই নজর কেড়েছে পুলিশের। তাই তাকে তুলে নিয়ে গেল। আকাশের মা দিনের পর দিন থানায় থানায় ঘুরেছেন। সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কিছুতেই কিছু হয়নি। একদিন জানতে পারলেন ডিবি অফিসে আছে। দু’দিন দু’রাত বসে ছিলেন ডিবি অফিসের সামনে রাস্তায়। ছেলের দেখা পেলেন না। সারাজীবন কারো কাছে ছোট না হওয়া আকাশের মা গেলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতার বাসায়। ভিখারির মত বসে ভিক্ষা চাইলেন ছেলেকে। ঘৃণাভরে তাড়িয়ে দিলেন। 

এরপর সারাদেশের কোথাও লাশ পাওয়া গেলেই ছুটে যান আকাশের মা। এক পর্যায়ে আকাশের মা বুঝতে পারেন আকাশ আর নেই। এবার তিনি পুলিশের লোকদের পিছে পিছে ঘোরেন যাতে তার লাশটা কোথায় এটা জানায়। পুলিশের বড় অফিসারদের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন ওর কবরটা দেখিয়ে দেন, যত টাকা লাগে দেব। শুধু ওর কবরটা দেখিয়ে দেন। নিয়মিত পুলিশের অফিসে যাওয়ায় পুলিশরা বিরক্ত হয়ে উঠে। একদিন তাকেও আটক করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। মাসখানেক পর জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু তারপরও তিনি আকাশের খোঁজ বন্ধ করেন না। এভাবে এক বছর পার হয়ে যায়। একদিন এক পুলিশ অফিসার একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মারে আকাশের মায়ের কপালে। কপাট কেটে যায় তাঁর। আকাশ বলে চিৎকার করে পড়ে যান থানার সামনে। চিকিৎসা হয়। সুস্থও হন। কিন্তু আকাশের শোক আর মাথায় আঘাত দু’টো মিলে তিনি একটু অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েন। 

আকাশের কোন বন্ধু-বান্ধব পেলেই জানতে চান আকাশ কবে ফিরবে? আকাশ কেন ফিরে না? আকাশের জন্য তিনি এখন দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তায়। আমিও বহুদিন তাকে ঘরে এনে দিয়েছি। আমাকে দেখলেই বেশী অস্থির হয়ে পড়তেন। তিনি মনে করতেন আমার সাথেই সে আছে। আমাকে দেখলেই জিজ্ঞাসা করতেন আমিও কিছু না কিছু বুঝিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেতাম। একদিন আমার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তিনি আমার হাত জড়িয়ে ধরে রাখছেন। আমি যাতে আকাশকে এখনই নিয়ে আসি এসব বলছেন। সেদিন আমার বের হতে দেরী হয়েছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার বাকী ছিল পনের মিনিট। আমি ওনার হাত হতে বাঁচার জন্য খুব কড়া করে ওনাকে একটা ধমক দেই। তিনি ভীষন শক খেলেন। আমার হাত ছেড়ে দিলেন। সেই থেকে আমাকে আর কোন দিন ডিস্টার্ব করেন নি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি মানুষ না, কখনোই ছিলাম না। পশু না হলে কি সেদিন খালাম্মাকে ধমক দিতে পারতাম! 

৩. 
শাহিদ ও রকিব এখন আকাশের মায়ের পাশে। আজ তিনি অসুস্থ। ১০২ ডিগ্রী জ্বর। রকিবকে দেখেই উঠে বসলেন! এতদিনে বুঝি আসার সময় হল মায়ের কাছে! শাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন আমার আকাশটা ঠিক এর মত না? আকাশ আমাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য ওকে পাঠিয়েছে। আচ্ছা বলো, আমি কি আকাশকে আদর করতাম না? কেন সে আসে না? কতদিন তাকে খাওয়াই না। বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন, আমার আকাশের বন্ধুরা এসেছে। তাদের খাওয়াতে হবে না! হই চই করে রান্না-বান্না শুরু করলেন। 

আচ্ছা রকিব, আকাশরা যে জন্য প্রাণ দিয়েছে, গুম হয়েছে, সেই স্বৈরাচারতো এখনো আছে। তাদের প্রাণ দেয়া তো বৃথা গেল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রকিব বললো আকাশরা ছিল আমার, তোমার, সবার। সবাইকে মুক্ত করতে গিয়ে তারা মুক্ত হয়ে গেল। মুক্তি পাইনি আমরা। আকাশরা সবার জন্য হলেও আমরা কেউ আকাশদের জন্য হতে পারিনি। আমাদের মুক্তি নেই...

১৯ ফেব, ২০১৭

ভাষা আন্দোলন নাকি সংকীর্ণতা?


ভাষা আন্দোলনকে আমার মনে হয়েছে বাঙ্গালী জাতির সংকীর্ণতা। তাই আদতেই আমি এর বিপক্ষে। কোন ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা না হলে সেই ভাষা ধ্বংস হয়ে যায় না। আর এটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের সংহতির বিরোধী। পাকিস্তানী নেতারা (ইনক্লুডেড বাঙ্গালী) এমন একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে যা মাত্র ৩-৪ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ছিল। এটি সহজ এবং বোধগম্য ছিল। কোন নেতারই এটা মাতৃভাষা ছিল না। তাছাড়া উর্দু মুসলিমদের ভাষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলিম লীগ গঠনের পর থেকেই।

আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে উর্দু কারো মাতৃভাষা না। এটি একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এইখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে। 

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকতো। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খাড়ি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে উঠে।

হিন্দি ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয় এবং এর শব্দভাণ্ডারের বেশির ভাগই সংস্কৃত থেকে এসেছে। অন্যদিকে উর্দু ভাষা ফার্সি লিপিতে লেখা এবং এর শব্দভাণ্ডার ফার্সি ও আরবি থেকে বহু ঋণ নিয়েছে। এছাড়া ভাষা দুইটির ধ্বনি ব্যবস্থা ও ব্যাকরণেও সামান্য পার্থক্য আছে। ১২শ শতক থেকে উর্দু ও হিন্দি উভয় ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮শ শতকে ইংরেজির প্রভাবে উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।

মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সভ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে আমাদের কিছু বাঙ্গালী। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটাও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। তারা যেসব পোস্টার ছাপিয়েছিল ছবিতে সেগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় দু'টি দেয়া আছে। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন কেউ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সর্বপ্রথম অফিসিয়ালি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তৎকালীন সকল বাঙ্গালী সংসদ সদস্যরা ওনার বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃএব এটা বাংলার গণমানুষের দাবী এটা বলা অযৌক্তিক। 


ছবি সূত্রঃ ডেইলি স্টার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫


আরো মজার বিষয় হলো ২১ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় আমরা অবাঙ্গালী পাকিস্তানীদের দোষারোপ করি। অথচ আমাদের মনে থাকে না আমরাই সেসময় পাকিস্তানের শাসক ছিলাম। তৎকালীন পাকিস্তানে আমরা ৫৬ শতাংশ ছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আলোচনায় আসলেই আমরা ঐ সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বিষোধগার করি এবং বলে থাকি ৫৬ শতাংশ মানুষের উপর উর্দু চাপিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ সেই তারা হলেন বাঙ্গালীরাই।

১৯৫২ তে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব পরিবারের। ভাষা আন্দোলনের যারা আন্দোলনকারী, যারা আন্দোলন দমনকারী, যারা জেলে গিয়েছে, যারা জেলে নিয়েছে, যারা গুলি করেছে, যারা গুলির নির্দেশ দিয়েছে, যারা গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে সবাই বাঙ্গালী। বামপন্থি কিছু নেতা ছাড়া এদেশের কোন বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অনুসারীরা বাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না। বামদের গ্রহনযোগ্যতা তৎকালীন ৫২’র পাকিস্তানে ছিল না। 

সেসময়ের বাঙ্গালী শীর্ষ নেতা ছিলেন 
১- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী 
২- নবাব খাজা নাজিমুদ্দিন 
৩- এ কে ফজলুল হক 
৪- মোহাম্মদ আলী বগুড়া 
৫- নুরুল আমীন 
৬- মাওলানা আতাহার আলী 
৭- হাজী মুহাম্মদ দানেশ

ওনারা কেউই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার নিমিত্তে। ভাষা আন্দোলন প্রথমে কিছু সাধারণ ছাত্র এবং খেলাফতে রব্বানীর সাংস্কৃতিক উইং তমুদ্দিন মজলিশের মাধ্যমে শুরু হলেও পরে এটির লক্ষ্য অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে জিন্নাহর বৈঠকে জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরী। আন্দোলন থামিয়ে দিতে চায় তমুদ্দুন মজলিশ। কিন্তু কমরেড তোয়াহা তমুদ্দুন নেতা শামসুল হক থেকে বাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব ছিনিয়ে নিয়ে বামদের আন্দোলনে পরিণত করে। 

এখন স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে জনবিচ্ছিন্ন এই আন্দোলন কেন সফল হলো?

১- পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেসময়ে তখনো কোন স্বৈরশাসক আসেনি। সাধারণ কোন বিষয়ে গুলি চালানো মানুষের কল্পনার বাইরে ছিল। সাধারণ মানুষ গুলি চালানো মেনে নিতে পারেনি। আন্দোলনকারীদের প্রতি সবাই সিম্পেথাইজড হয়। দাবিটাও জোরালো হয়। আর এতেই পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরে যায়। যদিও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে সেদিন সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিছু সিদ্ধান্ত অমান্যকারী মিছিল শুরু করলেই পুলিশ গুলি করে।

২- ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ঐ ঘটনার দায় মুসলিম লীগের উপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে এবং ভাষা আন্দোলন তাদের অর্জন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন।

ভারত চেয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তান কে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য। এই ভাষা আন্দোলনের পেছনে ভারতের যথেষ্ট অবদান আছে। ভাষা আন্দোলনের এই বিষয়টি সর্বপ্রথম জনসম্মুখে আনেন তৎকালে ভারতীয় চর হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু গণপরিষদের অন্য কোন সদস্য তার এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি। বহুজাতি নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার প্রস্তাব নাকচ হয়।

বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় নিয়ে আসে তথাকথিত প্রগতিবাদী ইসলামী সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামের প্রবক্তা খেলাফতে রব্বানী। তাদেরই কালচারাল উইং তমুদ্দুনে মজলিশ।

১৬ ফেব, ২০১৭

মিথ্যেবাদী বাবা

১। 
রাত দেড়টা। এপাশ ওপাশ করছেন আজমল সাহেব। চোখের দুই পাতা এক করতে পারছেন না। ঘুম তো দূরের কথা মাঝে মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। জেলখানায় এই বিষয়টা খুব সাধারণ হলেও আজমল সাহেবের জন্য মোটেই সাধারণ কোন ঘটনা নয়। খুব শক্ত মানসিকতার মানুষ তিনি। যখনই জেলখানায় কেউ ভেঙ্গে পড়ে তখন তিনি সান্ত্বনার হাত দিয়ে তাকে আগলে রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার বহু ছাত্র আটক হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে তারা যখনই তাদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ওনার কাছে আসতেন তখন আজমল সাহেবের দরদ মাখা হাত বুলানো আর উদ্দিপনামূলক বক্তব্য তাদের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। সেই আজমল সাহেব কান্না করছেন বিষয়টা সহজ কিছু নয়। 

অনেকক্ষণ ধরেই বিষয়টা লক্ষ্য করছে শাহেদ। সে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে আজমল সাহেবের কাছে আসলো। জেলখানায় রাতে জেগে থাকাটা অপরাধ। দশটায় সবাইকে ঘুমাতে হবে এটা বাধ্যতামূলক। ঘুম না এলেও শুয়ে থাকতে হয়। শাহেদ ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ। রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়া এখনকার ছাত্রদের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তাদের কত কাজ(!)। ফেসবুকিং, ব্লগিং, আড্ডা, গুল্প-গুজব ইত্যাদি করতে করতে কমসে কম দু’টা তো বাজেই। তাই শাহেদদের মত তরুণরা জেলখানার এই নিয়ম মেনে নিতে পারে না। দশটায় শুয়ে পড়লেও কিছুক্ষণ পর উঠে তারা গল্প-গুজবে মাতে। এর মধ্যে কারারক্ষীর হাতে ধরা পড়েছে বার পাঁচেক। জরিমানা গুনতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে রাত জাগা থেকে সে বিরত থাকতে পারেনি। অভ্যাস বলে কথা। অভ্যাসের দাম কোটি টাকা। 

তার বন্ধু সমাজ ইদানিং জেগে থাকার শক্তি পায় না। জেলখানার পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে সবাই নিজেদেরকে তাল মিলিয়ে নিচ্ছে। সেদিনও পঞ্চাশজনের পুরো ওয়ার্ডে সে আর আজমল সাহেব জেগে আছে। আজমল সাহেব কাঁদছেন আর সে বই পড়ছে। এই ওয়ার্ডের সবাই আজমল সাহেবের ভক্ত। এমনকি বিড়ালটা পর্যন্ত। আজমল সাহেবের বিষয়টা প্রথমে শাহেদ টের না পেলেও টের পায় বিড়ালটি। সেই ইশারা করে শাহেদকে দেখায় আজমল সাহেব কাঁদছে। বিড়ালটা শাহেদের খুব প্রিয়। নাদুস নুদুস সাদা বিড়াল। জেলখানায় মানুষগুলো লিকলিকে থাকলেও বিড়ালগুলো থাকে হৃষ্টপুষ্ট। মানুষের জন্য দেয়া খাদ্য নামের অখাদ্যগুলো বিড়ালদের জন্য অমৃত। 

আলতো করে একটি হাত রাখে শাহেদ আজমল সাহেবের কপালে। চমকে উঠে তাকায় আজমল সাহেব। এবার তাকে দেখে চমকে উঠে শাহেদ। চোখ দু’টি ভয়ানক ফোলা, রক্তাভ। স্যার কি হয়েছে আপনার? কিছু না বলে সামলানোর চেষ্টা করেন তিনি। উঠে বসলেন। হঠাত শাহেদকে জড়িয়ে ধরেন। কান্নার চাপে কেঁপে কেঁপে উঠছেন তিনি। শাহেদ প্রাণপণে চেপে ধরে রাখছে। জেলখানায় দুটো জিনিস সংক্রামক একটি হল চুলকানি অন্যটি কান্না। প্রত্যেকের হৃদয়ে থাকা দুঃখ আরেকজনের কান্না দেখলেই উথলে উঠে। শাহেদ নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চেপে রাখা কান্না যখন একবার তার বাঁধ ভেঙ্গে ফেলে তখন নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। এর মধ্যেই শাহেদ আবিষ্কার করে আজমল সাহেব হাতে চেপে আছে একটি কাগজ। 

পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়ে শাহেদ আজমল সাহেবের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নেয়। মেলে ধরে চোখের সামনে। ছোট কোন মানুষের হাতের লিখা। গোট গোট করে তাতে শিরোনাম দেয়া আমার প্রিয় মানুষ।
২। 
কলেজে তার চেয়ারে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছেন আজমল সাহেব। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে এবার বাসায় যাওয়ার পালা। হঠাত তিনটি পুলিশের গাড়ি বেশ সাড়াশব্দ করে ঢুকে পড়ে কলেজে। ঘিরে ফেলে আজমল সাহেবের কক্ষ। প্রায় উড়ে এসে তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে তার কক্ষেই শুইয়ে ফেলে। পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। মনে হচ্ছে যেন বিশাল কোন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে তারা ঘায়েল করেছে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো গাড়ির কাছে। ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলছে এমন সময় পুলিশের তিনটি গাড়ি ঘিরে ফেলে ছাত্র আর শিক্ষকরা। কলেজের পাশের মসজিদের বৃদ্ধ মুয়াজ্জিন দৌড়ে মসজিদে গিয়ে মাইকে বলতে থাকে ‘এলাকাবাসী বাইর হই আইয়্যেন, বাইর হই আইয়্যেন, হারামজাদারা আঙ্গো আজমল স্যাররে লই যার। ব্যাকে বাইর হই আইয়্যেন। 

ব্যাস! আর যায় কোথায়। মুহুর্তেই মফস্বল শহরের হাজারখানেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। পুলিশ বিপদ বুঝেই আজমল সাহেবের বাঁধন খুলে দেয়। বিচক্ষন আজমল সাহেব বুঝতে পারেন আজ যদি তাকে পুলিশ না নিয়ে যেতে পারে তবে বিপদ শুধু তার একার হবে না, পুরো এলাকাবাসী বিপদে পড়বে। তাই তিনি নিজেই পুলিশের ভ্যনে উঠে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিলেন। সবাই শান্ত থাকতে বললেন। আর বললেন আমার ছাত্ররা যে সত্যকে বুকে ধারণ করে জেলে যাচ্ছে সে সত্যের শিক্ষক হয়ে আমি কেন তাদের পাশে থাকবো না। আমি যাচ্ছি পুলিশের সাথে, তাদের সাথে আমার আলাপ আছে। ততক্ষনে পুলিশ অফিসার জনতাকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো, আপনারা যার যার যায়গায় ফিরে যান। আমরা স্যারের সাথে কিছু জরুরী কথা বলে স্যারকে আবার বাসায় পৌঁছে দেব। 

থানায় এসে আজমল সাহেব তার অপরাধ বুঝতে পারলেন। তার ছাত্রদের কাবু করার জন্য তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। রফিক আজমল সাহেবের প্রিয় ছাত্র। সে সংগ্রাম পরিষদের নেতা। দিন পনের আগে তাকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ রীতিমত অস্বীকার করে আসছে তারা রফিককে গ্রেফতার করে নি। তাকে দেখে চমকে উঠে আজমল সাহেব। পিটিয়ে কিছু রাখে নি। তবুও তার থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ চায় সে একটা ঘোষনা দিক যেখানে বলা থাকবে সংগ্রাম পরিষদ সব কার্যক্রম বন্ধ করছে সেই সাথে তারা আন্দোলন করে অন্যায় করেছে এমন একটি স্বীকারোক্তি থাকবে। আরো স্বীকারোক্তি তারা চায় এখন থেকে রফিক সরকারের সাথে কাজ করবে। এমন ঘোষণা দিলে তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে। সেই সাথে তাকে দেয়া হবে গাড়ি বাড়ি ইত্যাদি। রফিকের এক কথা, কোন মিথ্যে কথা আমার থেকে বলিয়ে নিতে পারবে না। কখনো না... 

রফিকের আঙ্গুলগুলো যখন থেতলে দেয়া হচ্ছিল, রফিক তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোন শব্দ করেনি। সব সহ্য করেছে। পরদিন তাকে থানা থেকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হলে একদিন তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। এরপর আবার শুরু হয় কথা আদায়। স্বীকারোক্তি আদায়। নির্যাতনের নতুন সব কলাকৌশল। কোন কিছুই নমনীয় করতে পারেনি রফিককে। এভাবে চলছে পনের দিন। এরপর তারা বুঝতে পারে তার শিক্ষক আজমল সাহেব থেকেই সবসময় সে বুদ্ধিপরামর্শ নেয়। আজমল স্যারকে সে ভালবাসে। আজমল সাহেবকে তারা রফিকের সাথে দর কষাকষির বস্তু বানাতে চায়। কথাবার্তা ছাড়া হঠাত মারতে থাকে আজমল সাহেবকে রফিকের সামনে। বহু নির্যাতনের ধকলে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়া রফিকের কোন বিষয়েই চাঞ্চল্য ছিল না। আজমল সাহেবের উপর নির্যাতনে সে চিৎকার করে উঠে। থাম! থাম!! তোরা সব থাম! তোদের যা ইচ্ছা লিখে দে আমি বলবো। সাবধান আমার স্যারের গায়ে হাত তুলবি না। 

আকস্মিক আক্রমনে হতচকিত আজমল সাহেব রফিকের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেলেন। মলিন অথচ আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে রফিককে শান্ত স্বরে বললেন “যে সত্যের দীক্ষা তুমি আমার কাছ থেকে পেয়েছ সেই শিক্ষার মর্মান্তিক মৃত্যু তুমি আমার সামনে ঘটাতে পারো না”। কপাল কেটে বেয়ে পড়া নোনা রক্ত শার্টের হাতা দিয়ে যেই মুছতে গেলেন তখনি হাত বাড়িয়ে দুই পা এগিয়ে গেল রফিক। আজমল স্যারের কপাল থেকে রক্ত নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে বললো শপথ করলাম স্যার, কোনদিন মিথ্যার সাথে আপোষ করবো না। কোনদিন না। আবার শুরু হল বেদম মার। দুইজনেই বেহুঁশ হয়ে পড়লো। 

জ্ঞান ফেরার পর থেকে আজমল সাহেব আর রফিককে দেখতে পাননি। বার বার জিজ্ঞাসা করেও কারো থেকে উত্তর পাননি। বাইরের লোকেরা এখনো জানে রফিক হারিয়ে গেছে। পুলিশের বরাবরের মত গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে যাচ্ছে। তিনদিন পর আজমল সাহেবকে কোর্টে তোলা হল। জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হল। কোর্টে তার নিকট আত্মীয়-স্বজনরা প্রায় সবাই এসেছে। শুধু আসেনি তার ছয় বছরের মেয়ে লুবনা। ধুলামলিন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত আজমল সাহেবকে দেখে সবাই কান্না-কাটি শুরু করলো। আজমল সাহেব স্ত্রীকে বললেন তার গ্রেপ্তারের কথা যাতে লুবনাকে বলা না হয় কারণ এতে তার ভয়ংকর মানসিক চাপ হতে পারে। তাই তিনি কিছু একটা বলে চালিয়ে নিতে বললেন। আরো বললেন বলবে আমার বাহিরে কাজ পড়েছে। নতুন অফিস হয়েছে। অফিসে অনেক কাজ তাই বাসায় যাওয়া হয় না। কয়েকদিন পর আমার সাথে দেখা করতে নিয়ে আসবে। সবাইকে সান্তনা দিয়ে তিনি কারাগারে চলে গেলেন। 

কারাগারে যাওয়ার তৃতীয়দিনেই পেলেন দুঃসংবাদটি। সেই গথবাঁধা গল্প। রাতের বেলা মটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছে রফিক। পুলিশ তাকে চেক করার জন্য থামতে বলে। সে তো থামেই নি বরং গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে পুলিশের দিকে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করে। গুলিতে নিহত হয় রফিক। সব পত্রিকা পুলিশের সাজানো এমন গল্পই ছাপে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আজমল সাহেব। সেই সাথে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রুজল। স্বগতোক্তির মত বলতে থাকেন হাসবুন আল্লাহ ওয়া নে’মাল ওয়াক্বীল নে’মাল মাওলা নে’মান নাসির। 

৩। 
বাংলা ক্লাস চলছে। আয়েশা করিম ক্লাসে সবাইকে রচনা লিখতে বলেছেন। রচনার নাম “আমার প্রিয় মানুষ” সবাই লিখছে, সেই সাথে লিখছে লুবনাও। ছোট ছোট মানুষগুলো লিখছে তাদের প্রিয় মানুষের কথা। লুবনা লিখছে তার বাবাকে নিয়ে। ছোট ছোট হাতে গোট গোট অক্ষরে লিখছে। সবাই একের পর এক তাদের লিখা জমা দিচ্ছে। আয়েশা করিম দেখলেন লুবনা তার খাতার উপর মাথা নামিয়ে দিয়ে আছে। তিনি ডাক দিলেন, লুবনা কি করছো তুমি? তোমার কি লিখা শেষ হয়েছে? ডাক শুনে লুবনা মাথা তুলতেই আয়েশা ম্যাম বুঝতে পারলেন এতক্ষন কাঁদছিল লুবনা। মামণি কি হয়েছে তোমার? একথা বলে তিনি দৌড়ে আসলেন। তাকে জড়িয়ে ধরলেন আর তার লিখা পড়তে লাগলেন। 

আমার প্রিয় মানুষ আমার আব্বু। আব্বু আমাকে গল্প শোনায়। আব্বু আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। আব্বু একটুও বকা দেয় না। আব্বু আমাকে খাইয়ে দেয়। রাতে আমি যখন শুয়ে পড়ি তখন আব্বু আমার কপালে চুমু দেয়। সে আমাকে স্কুলে নিয়ে আসে। আম্মু যখন আমাকে বকা দেয় তখন আব্বু আমাকে আদর করে। একবার আব্বুর সাথে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। অনেকক্ষণ ভিজেছি। পরে আমার জ্বর হয়। আব্বু সারারাত আমার পাশে বসে কাঁদছিল। আম্মু সেদিন আব্বুকে অনেক বকেছে। আসলে আব্বুর দোষ ছিল না। আমিই আব্বুকে বার বার বলে বিরক্ত করে ভিজেছি। 

আব্বু সবসময় বলতেন কাউকে কষ্ট না দিতে। দুঃখীকে সাহায্য করতে। বড়দের সম্মান করতে। ছোটদের আদর করতে। আব্বু সবসময় মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করতো। আর এখন আব্বু সমানে মিথ্যা কথা বলে। আব্বু বলেছিল নতুন অফিস থেকে এক সপ্তাহ পরে বাসায় আসবে। আসেনি। সে আমাকে এখন স্কুলে নিয়ে আসে না। আমি আর আম্মু যখন নতুন অফিসে দেখা গিয়েছি তখন আব্বু বলেছিল আমার ফার্স্ট টার্মের আগেই সে বাসায় আসবে। এখন ফাইনাল টার্ম চলে আসছে এখনো সে আসেনি। আমাকে সে সবসময় বলে অল্প কিছুদিন পরে সে বাসায় আসবে। কিন্তু সে আসেনা। সে বলেছে রোজার আগে আসবে। আসেনি। গতমাসে বলেছে ঈদের আগে আসবে। আমার মনে হয়েছে সে আসবে না। সত্যিই সে আসেনি। ঈদের দিন শুধু আমাকে নতুন অফিসে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আমিও কেঁদেছি। 

আব্বু মিথ্যা বলেছে। আসলে ওটা আব্বুর অফিস নয়। ওটা জেলখানা। আমাকে সামিহা বলেছে। ওখানে খারাপ মানুষ থাকে। আব্বু এখন মিথ্যাবাদী। আমি আর এখন আব্বুকে ভালবাসি না।