২৬ জুল, ২০১৭

উপমহাদেশের এক ভয়ংকর ডাকাত দলের উপাখ্যান


মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করার প্রবণতা সকল যুগেই ছিল। আজ যেমন শেয়ার বাজার লুট করা হয় ঠিক তেমনি আগেও সাধারণ মানুষদের সম্পদ লুট হতো। তবে সেটা হত অত্যন্ত নৃশংসভাবে। একটা ডাকাত দল যারা ঠগী নামে পরিচিত ছিল। ঠগীরা মানুষের সাথে ঠগ বা প্রতারণা করে ডাকাতি করতো বলে তাদের এমন নামকরণ করা হয়। একজন ঠগী মাসে গড়ে ৮-১০ জনকে খুন করত। ধারণা করা হয় তারা প্রায় ২০ লক্ষেরও অধিক মানুষকে খুন করেছে। বাহরাম নামে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে। 

ঠগীদের ভয়ংকর সেই ইতিহাস হারিয়ে গেলেও বর্তমান সরকারের অনেক কাজ-কর্মে সেই ঠগীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিদিনই মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। গুম হয়ে যাচ্ছে শত শত মানুষ। এরকম গুমের সূত্র ধরেই তাদের বিনাশ হয়। কয়েকটি ব্যবসায়ী দল হারিয়ে গেলে সেসময়ের মানুষরা যখন ঠগীদের কথা ইংরেজদের বলতো তখন তারা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিত। যখন ইংরেজরাও হারিয়ে যেতে থাকে তখন তাদের টনক নড়ে এবং এর নির্মূলে তারা শক্তি প্রয়োগ করে। দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের। বাংলাদেশে এখন ঠগীরাই ক্ষমতায়। কে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে? 

আসুন আমরা ইতিহাসে ফিরে যাই। ঠগি শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সময় যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে থাগ তাদের মধ্যে অন্যতম। শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত। থাগ শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে। ১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস কনফেসনস অফ অ্য থাগ এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই সাথে থাগ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়ে যায়। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের গল্প দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে খুব প্রচলিত ছিল।

ইংরেজ শাসকগণ ঠগী শব্দটিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার আগেও উত্তর ভারতের লোকেরা তাদেরকে ফাঁসি শব্দ হতে ফাঁসিগর বলে অভিহিত করত। ঠগীদের উৎপত্তি অস্পষ্ট। সতেরো এবং আঠারো শতকে, বিশেষ করে কোম্পানির শাসনের প্রতিষ্ঠালগ্নে এদের উদ্ভব ঘটে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের দুষ্কৃতিপরায়ণ উপজাতি হতে উদ্ভূত হয়ে ঠগীরা নওয়াবী আমলের শেষ ও ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্নে ক্রমান্বয়ে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।

ভৃপ্রকৃতি এবং পরিবহণ ব্যবস্থাভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে ঠগীদের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন প্রকার ছিল। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলা এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবী কালীর পূজা করত। তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে। সাধারণত তারা দূরের যাত্রী ও তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে দল বেঁধে চলাচল করত এবং আগন্তুক ভ্রমণকারীদের সঙ্গে মিশে যেত এবং তাদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করত। সময়-সুযোগ বুঝে ও নির্ধারিত স্থানে ঠগীরা তাদের প্রথানুযায়ী হতভাগ্য শিকারের গলায় রুমাল পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত, তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করত এবং ঠগী প্রথানুসারে তাকে সমাহিত করত। পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে অভিযানের আগে তারা সর্বশেষ ঘটনাস্থলে সারা রাত ধরে পান-ভোজন ও নাচগান করত। 

এছাড়াও মুসলিম সমাজে গিয়ে মুসলিমদের কাছে হজ্জের মুয়াল্লিম সাজতো। ধনী মুসলিমদের তারা হজ্জে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতো। ঠিক এভাবে হিন্দু সমাজে গিয়েও তারা কাশী, গয়া ও গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতো। তারপর তাদের নিয়ে তাদের আস্তানার কাছাকাছি গিয়ে হত্যা করে সম্পদ লুট করতো। 

১৩৫৬ সালের জিয়াউদ্দীন বারানি লিখেন, ১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাষন আমলে কিছু ঠগী ধরা পরে, কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার। তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেন নি বরং তাদেরকে নৌকায় তুলে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।”

ঠগীরা সাধারনত বংশপরম্পরায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন ঠগি বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তারা সাধারনত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগতভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগীরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার 'কালীঘাট' ও বিন্ধ্যাচলের 'ভবানী মন্দির'।

ঠগীরা হত্যাকান্ডের জন্য একটি হলুদ রঙের রুমাল ব্যবহার করত যার র্দৈঘ্য ছিল মাত্র ৩০ ইঞি। রুমালটি ভাজ করে তার দুই মাথায় দুটি রুপার মুদ্রা দিযে বেধে দিত। হত্যা সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি ছিল এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যাক্তির গলায় পেচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।

ঠগীরা হত্যার পর লাশগুলো মাটিতে পুতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগীদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারনত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।

ঠগীরা শীত মৌসুমে বাংলার জেলাসমূহে আসত এবং বংশগত স্থানীয় অপরাধীদের সহযোগিতায় বর্ষাকাল আসার আগ পর্যন্ত তাদের কাজ চালিয়ে যেত। উইলিয়ম বেন্টিং এর প্রশাসন ঠগীদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক সামরিক ও বেসামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ফলে শত শত ঠগী ধরা পড়ে। তাদেরকে বিচার করে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ঠগী উচ্ছেদ অভিযানের নেতা ছিলেন কর্নেল শ্লিম্যান। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৭০০ ঠগিকে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগির ফাঁসি দেওয়ার পর ঠগিদের সংখ্যা কমে আসে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি হুমকিস্বরূপ এ ঠগবাজী প্রায় সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়ে যায়। এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগীদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।

তথ্যসূত্র 
৬- ঠগী, শ্রীপান্থ 

একজন বাংলাদেশী বীরের গল্পগাঁথা


এককভাবে এয়ার ফাইটার হিসেবে সবচেয়ে বেশী ইসরাঈলী বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ড বাংলাদেশের এক বীর সন্তানের। তাঁর নাম স্যার সাইফুল আযম। তিনি ১৯৪১ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পর ১৯৫৬ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান যান। ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান জিডি পাইলট ব্রাঞ্চের একজন পাইলট হন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম (মেয়াদ ২০০২-২০০৭) তাঁর ভাই। 

১৯৬৭ সালের জুনের ৫ তারিখ। ছয় দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেদিন। চারটি ইসরাইলি জঙ্গী বিমান ধেয়ে আসছে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে গোটা মিশরীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এবার জর্ডানের ছোট্ট বিমান বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে আসছে ইসরাইলি বিমানগুলো।

ঠিক ঐ মুহূর্তে ইসরাইলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গী বিমানগুলো আরবীয় আকাশে খুব আতঙ্কের নাম। প্রচণ্ড গতি আর বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে সেগুলো উড়িয়ে দিতে পারে আকাশপথের যে কোনো বাধা অথবা ভূমিতে অবস্থানকারী যে কোনো লক্ষ্যবস্তুকে। তবু তাদের পথ রোধ করতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে বুক চিতিয়ে আকাশে ডানা মেললো চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমান। শক্তির দিক থেকে ইসরাইলি বিমানের কাছে সেগুলো কিছুই নয়। মুহূর্তেই উড়ে যেতে পারে এক আঘাতে।

কিন্তু জর্ডানের অকুতোভয় মুসলিম বাহিনীর সদস্যরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললো। জর্ডানের একটি হকার হান্টারে পাইলটের সিটে বসে আছেন অকুতোভয় এক যুবক, এই পাল্টা প্রতিরোধের মূল অধিনায়ক। তিনি আর কেউ নন। আমাদের সাইফুল আযম। সেই হকার হান্টার থেকেই সে তিনি নির্ভুল নিশানায় ঘায়েল করলেন দুই ইসরাইলি সেনাকে। ঐ মুহূর্তে কল্পনাতীত এক কাণ্ডও ঘটালেন, অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত করে ফেললেন একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো করে দিলেন তাদের আরেকটি জঙ্গী বিমান, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটি ফিরে গেল ইসরাইলি সীমানায়। চারটি হকার হান্টারের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ব্যর্থ হলো অত্যাধুনিক ইসরাইলি বিমানগুলো।

দু'দিন পরই ইরাকি বাহিনী কর্তৃক খবর আসে ইসরাঈল হামলা করতে যাচ্ছে ইরাকে। সাহায্য প্রয়োজন জর্ডান থেকে। সাইফুল আযমকে অধিনায়ক করে জর্ডান ৪ জন এয়ার ফাইটারকে পাঠায় ইরাককে সাহায্য করার জন্য। 

জুন ৭, ১৯৬৭ সাল। ইরাকী দলের সামনে ছিল ইসরাইলের চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গী বিমান। এগুলো আক্রমণ করতে এসেছিল ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ বিমানঘাঁটির উপরে। আকাশযুদ্ধে ইরাকি দল শুরু থেকেই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম। তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সে আঘাতের পর বাঁচার যখন আর উপায় নেই তখন ক্যাপ্টেন দ্রোর তার বিমান থেকে ইজেক্ট করে ধরা দেন, আটক হন যুদ্ধবন্দী হিসেবে সাইফুল আযমের কাছে। 

এদিকে চারটি ‘ভেটোর’ বোমারু বিমানের সামনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় আজমের হকার হান্টার। ঈগলের সুতীক্ষ্ণ নজরের মতো আযমের নির্ভুল নিশানায় ধ্বংস হয় একটি ভেটোর বিমান। সেটিতে থাকা ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গোলান নিরাপদে ইজেক্ট করে ধরা দেন যুদ্ধবন্দী হিসেবে। জর্ডানের মতো এখানেও ব্যর্থ হয় ইসরাইলি বিমান দল। দুজন মূল্যবান যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে ইসরাইলের হাতে আটক জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করা হয়। 

সাইফুল আযম ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকে সাময়িক ভাবে সারাগোধাতে অবস্থিত ১৭ স্কোয়াড্রন এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আযম এ সময় এফ-৮৬ স্যাবর জেট বিমান এর পাইলট হিসেবে প্রধানত পদাতিক সহায়ক মিশন পরিচালনা করতেন। ১৯৬৫ সালের ১৯ এ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত চাবিন্দা ট্যাংক যুদ্ধে অংশ নেন তিনি এবং বিমান থেকে রকেট ও গোলা বর্ষন করে একাধিক ভারতিয় ট্যাংককে ধ্বংস ও অকার্যকর করেন। এসময় চারটি ভারতিয় ”Gnat” জঙ্গি বিমান তাদের উপর আক্রমন করে। সাধারন ভাবে বিমান থেকে ভুমিতে যুদ্ধের উপযোগি অস্ত্র সজ্জিত থাকায় এসময় পাকিস্তানি বিমানগুলির পালিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেনান্ট সাইফুল আযম রুখে দাড়ান এবং বিমান যুদ্ধ বা ডগ ফাইটে একটি ভারতিয় ”Gnat” জঙ্গি বিমান ভুপাতিত করেন। সে বিমান থেকে ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করেন তিনি। আকাশপথের মুখোমুখি যুদ্ধে ‘Gnat’ বিমানকে পর্যুদস্ত করা সে সময় এক বিরল ঘটনা ছিল।  এই কৃতিত্বের জন্য তাকে পাকিস্তানে ”সিতারা-ই-জুরাত” পদকে ভুষিত করা হয়। এটি পাকিস্তানের তৃতীয় সামরিক বীরত্বের খেতাব। 

তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের কাছ থেকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক গ্রহণ করছেন সাইফুল আজম

সাইফুল আযম ছিলেন মূলত পাকিস্তানের এয়ার ফাইটার ছিলেন। ভারতের সাথে বীরত্ব নিয়ে যুদ্ধ করার কারণে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেন। তখন জর্ডান পাকিস্তানের কাছে আযমসহ কিছু এয়ার ফাইটার চায় যারা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার সাইফুল আযমকে জর্ডানে পাঠায়। সাইফুল তার মর্যাদা রেখেছেন। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। 

সাইফুল আযম চারটি দেশের বিমান বাহিনীতে কাজ করেছেন 
১- পাকিস্তান 
২- জর্ডান 
৩- ইরাক 
৪- বাংলাদেশ। 

তিনি দুটি দেশের বিরুদ্ধে লড়েছেন 
১- ভারত 
২- ইসরাঈল 

সাইফুল আযম মোট চারটি ইসরাঈলী বিমান ভূপাতিত করেন। এটা একজন এয়ার ফাইটারের জন্য সর্বোচ্চ রেকর্ড। সাইফুল আযম ১৯৬৯ সালে আবার পাকিস্তানে ফেরত আসেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। সেসময় বাঙ্গালিদের গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়। যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে ছুটি কাটান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে অবসর নেন। 

অবসর নেয়ার পর তিনি রাজনীতিতে আসেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে পঞ্চম জাতীয় সংসদে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। 

সম্মাননা 
১- সিতারা-ই-জুরাত, পাকিস্তান 
২- অর্ডার অব ইসতিকলাল, জর্ডান 
৩- নুত আল সুজাত, ইরাক 
৪- লিভিং ঈগল, আমেরিকা 

যেসব এয়ার ফাইটার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের লিভিং ঈগল উপাধি দেয়া হয়। পৃথিবীতে মাত্র ২২ জন লিভিং ঈগলের একজন হলেন সাইফুল আযম।

তথ্যসূত্র
১- পাকিস্তান এয়ার ফোর্স 
২- আল আরাবিয়্যা নিউজ
৩- ডিফেন্স টক
৪- মিলিটারি হিস্ট্রি নাও (MHN)  

২২ জুল, ২০১৭

বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত



মসজিদুল আকসা 

জেরুজালেম। অতি প্রাচীন এক নগরী। বিশ্বাসী মানুষদের প্রিয় নাম। পৃথিবীতে এটি একমাত্র শহর যাকে দু'টি বিবাদমান রাষ্ট্র নিজেদের রাজধানী বলে দাবী করে। ফিলিস্তিন ও ইসরাঈল উভয়েরই রাজধানী জেরুজালেম। আর এই শহরের বিখ্যাত ও প্রাচীন মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাস। এই মসজিদকে আল আকসাও বলা হয়। আকসা মানে দূরবর্তী। মক্কা থেকে দূরের মসজিদ বুঝানোর জন্য আল আকসা বলা হয়। এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা। এছাড়া আল্লাহর রাসূল সা. মিরাজ যাওয়ার সময় এই মসজিদে নামাজ পড়েন। জেরুজালেম ইসরাঈল ও ফিলিস্তিনের সীমান্তে অবস্থিত। এর পূর্বে মৃত সাগর এবং পশ্চিমে ভুমধ্যসাগর অবস্থিত। পুর্ব দিকের অল্প কিছু অংশ ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণে আর পুরো শহর ইসরাঈলের অধীনে। শহর ইসরাঈলী নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি জর্ডা‌নি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এই মসজিদে মুসলিমরা এখনো সালাত আদায় করেন। তবে প্রায়শই ইসরাঈলী নিরাপত্তা রক্ষীরা নানা ধরণের বিধি নিষেধ আরোপ করে। এই নিয়ে সংঘাত নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। 

মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহর আল কুদস নামে পরিচিত। কুদস শব্দের অর্থ পবিত্র। জেরুজালেম শহরে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিষ্টানের ধর্মীয় উপাসনালয়ের কারণে এখানে বহু পর্যটক ও তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে। হযরত ইসা(আঃ)এর জন্মও এই জেরুজালেম শহরে। এখানে মসজিদে আকসা ব্যতীত আরও ৩৫ টি মসজিদ আছে। কুরআনে জেরুজালেম শহরকে বরকতময় ও পবিত্র ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন,
“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।”
-সূরা আল ইসরাঃ১

এখানে মসজিদে আকসার চারদিক বলতে জেরুসালেম শহরকেই বুঝানো হয়েছে। রাসূল সাঃ বলেন আল কুদসের এমন কোন জায়গা খালি নেই যেখানে একজন নবী সালাত আদায় করেননি বা কোন ফিরিশতা দাঁড়াননি। (তিরমিজি)

রাসুল মুহাম্মাদ সা. যখন মক্কায় ছিলেন তখন সালাত আদায় করার সময় তার সামনে কা’বা এবং আকসা দুটোই থাকতো। কিন্তু তিনি যখন মদিনা হিজরত করলেন, তখন মক্কা পড়ে গেল একদিকে, আর আকসা পড়ে গেল আরেকদিকে। যার ফলে তিনি যখন আকসামুখী হয়ে সালাত পড়তেন, তখন কা’বা থাকতো তাঁর পেছন দিকে। নিচের মানচিত্র লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝতে পারবেন। এখানে জেরুজালেম, মদিনা ও মক্কাকে লাল বৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। 



আল্লাহর রাসূল সাঃ কা’বাকে খুব ভালবাসতেন। কারণ এই কা'বার জন্যই সারা বিশ্বে কুরাইশরা ছিল সম্মানিত। কা'বার প্রতি টানের কারণে তিনি সালাতে মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে তাকাতেন। যদিও তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন আল্লাহ যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা তাঁর এই অব্যক্ত চাওয়া পূরণ করলেন। সূরা আল-বাকারাহ’র আয়াত নাজিল হলো। আকসা থেকে কিবলা ঘুরে গেল কা’বার দিকে।

আল্লাহ বলেন, আমি অবশ্যই দেখেছি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আমি তোমাকে সেই কিবলা দিলাম, যা তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মাসজিদুল-হারাম-এর (কা’বা) দিকে মুখ করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন এর দিকে মুখ করো। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো করে বোঝে যে, এটি তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য। ওরা কী করে সে ব্যাপারে আল্লাহ বেখেয়াল নন। 
-সূরা আল-বাকারাহ ১৪৪

বাইতুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ


অনেকে মনে করেন বাইতুল মুকাদ্দাস হযরত সুলাইমান আঃ তৈরী করেছেন। ব্যাপারটা ঠিক নয়। হযরত নবী ইব্রাহিম (আঃ) এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছিলেন। 

শুরুর কথাঃ

খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭০ সালে কা'বা নির্মাণের চল্লিশ বছর পর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেন, আবূ যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! পৃথিবীতে কোন মসজিদটি সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কোনটি। তিনি বললেন, আল মাসজিদুল আকসা বা বায়তুল মাকদিস। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, এ দু'টি মাসজিদের নির্মাণকালের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। (সহীহ মুসলিম)

ইব্রাহিম আঃ এর দুই পুত্রের একজন ঈসমাইল আঃ থাকতেন মক্কায় আর ইবাদত করতেন কা'বায় আর অন্য পুত্র ইসহাম আঃ থাকতেন জেরুজালেমে আর ইবাদত করতেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। তবে হজ্ব পালন করতেন মক্কায় গিয়েই। পরবর্তীতে ইসহাক (আঃ) এর দ্বিতীয় পুত্র ইয়াকুব (আঃ) এই অঞ্চলের বিশ্বাসীদের জন্য ইবাদতের স্থান হিসাবে এটিকে বর্ধিত করেছিলেন। আরো পরে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪ সালে সুলায়মান (আঃ) এই মসজিদটির নান্দনিক স্থাপনা তৈরি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে এই কাজে তিনি জ্বীনদেরকে নিয়োগ করেছিলেন এবং সেখানে আল্লাহ "গলিত তামার ঝরণা" প্রবাহিত করেছিলেন। এই ব্যাপারে সূরা সাবার ১২ ও ১৩ আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ ব্যবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচ্যাডনেজার সুলায়মান (আঃ) এর তৈরি স্থাপত্যগুলি ধ্বংস করে। 

এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে সেখানে হেরড সেকেন্ড টেম্পল তৈরী করে। ইহুদীরা সুলাইমান আঃ এর বাইতুল মুকাদ্দাসকে সুলেমানের টেম্পল বলে। তাই হেরডের টেম্পলকে সেকেন্ড টেম্পল বলে। ইহুদীরা জেরুজালেমে হজ্বের মত করে আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। তাদের পূর্ব পুরুষদের মত মক্কায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেমে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেসময় এই মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর নানান উত্থান-পতন হয় জেরুজালেমে। জেরুজালেম মুসলিম শাসনের আগ পর্যন্ত আর তার জৌলুশ খুঁজে পায়নি। 


জেরুজালেম বিজয়ঃ 

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সৈন্যরা জেরুজালেমের কাছাকাছি চলে আসে। তখন জেরুজালেমের দায়িত্বে ছিলেন বাইজেন্টাইন সরকারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় খ্রিস্টান গীর্জার প্রধানঃ যাজক সোফ্রোনিয়াস। খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ (রাঃ) এবং আম্‌র ইবন আল-আস্ (রাঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী শহর পরিবেষ্টন করা শুরু করলেও উমর (রাঃ) নিজে এসে আত্মসমর্পণ গ্রহণ না করলে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান যাজক সোফ্রোনিয়াস।

এমন পরিস্থিতির খবর পেয়ে উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) একাই একটি উট এবং এক চাকরকে নিয়ে মদীনা ছেড়ে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। জেরুজালেমে সোফ্রোনিয়াস তাঁকে স্বাগত জানান। মুসলিমদের খলিফা, তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি উমর (রাঃ) ছিলেন খুব সাধারণ মানের পোষাকে। তাঁকে ও ভৃত্যের মধ্যে কে উমর তা আলাদা করা যাচ্ছিলনা। এ অবস্থা দেখে সোফ্রোনিয়াস খুবই বিস্মিত হন।

এরপর উমর (রাঃ) কে পবিত্র সমাধির গীর্জাসহ পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়। নামাজের সময় হলে সোফ্রোনিয়াস তাঁকে গীর্জার ভেতর নামাজ আদায় করার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু উমর (রাঃ) তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, যদি তিনি সেখানে নামাজ আদায় করেন তাহলে পরবর্তীতে মুসলিমরা এই অজুহাত দেখিয়ে গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করবে – যা খ্রিস্টান সমাজকে তাদের একটি পবিত্র স্থান থেকে বঞ্চিত করবে। বরং উমর (রাঃ) গীর্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরবর্তীতে একটি মসজিদ নির্মিত হয় (যা “মসজিদে উমর” নামে পরিচিত)।

উমর (রাঃ) এর চুক্তিনামাঃ

ইতিপূর্বে জয় করা শহরগুলোর মতো জেরুজালেমেও মুসলিমদের একটি চুক্তিনামা লিখতে হয়। চুক্তিনামাটি ছিল জেরুজালেমের সাধারণ জনগণ এবং মুসলিমদের নাগরিক অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন উমর (রাঃ) ও যাজক সোফ্রোনিয়াস, এবং মুসলিম বাহিনীর কতিপয় সেনাপতি। 

"পরম দয়ালু এবং করুণাময় আল্লাহ’র নামে। 
এতদ্বারা ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহর বান্দা, ঈমানদারদের সেনাপতি উমর, জেরুজালেমের জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করছে। নিশ্চয়তা দিচ্ছে তাদের জান, মাল, গীর্জা, ‌ক্রুশ, শহরের সুস্থ-অসুস্থ এবং তাদের সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদির। মুসলিমরা তাদের গীর্জা দখল করবেনা এবং ধ্বংসও করবেনা। তাদের জীবন, কিংবা যে ভুমিতে তারা বসবাস করছে, কিংবা তাদের ক্রুশ, কিংবা তাদের সম্পদ – কোনোকিছুই ধ্বংস করা হবে না। তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে না। 

জেরুজালেমের অধিবাসীদের অন্যান্য শহরের মানুষের মতই কর (ট্যাক্স) প্রদান করতে হবে এবং অবশ্যই বাইজেন্টাইনদের ও লুটেরাদের বিতাড়িত করতে হবে। জেরুজালেমের যেসব অধিবাসী বাইজেন্টাইনদের সাথে চলে যেতে ইচ্ছুক, গীর্জা ও ক্রুশ ছেড়ে নিজেদের সম্পত্তি নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছুক, তাদের আশ্রয়স্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত তারা নিরাপত্তা পাবে। গ্রামের অধিবাসীরা চাইলে শহরে থেকে যেতে পারে, কিন্তু তাদের অবশ্যই শহরের অন্যান্য নাগরিকদের মত কর প্রদান করতে হবে। যে যার ইচ্ছেমতো বাইজেন্টাইনদের সাথে যেতে পারে কিংবা নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারে। ফসল কাটার আগে তাদের থেকে কিছুই নেয়া হবেনা।

যদি তারা চুক্তি অনুযায়ী কর প্রদান করে, তাহলে এই চুক্তির অধীনস্ত শর্তসমূহ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ, তাঁর নবীর উপর অর্পিত দায়িত্বের ন্যায় সকল খলিফা এবং ঈমানদারদের পবিত্র কর্তব্য"।

সেই সময় পর্যন্ত এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রগতিশীল চুক্তিগুলোর একটি। তুলনা করলে দেখা যায়, এ ঘটনার মাত্র ২৩ বছর আগেই পারসিকরা (পারস্যের অধিবাসী) বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে জেরুজালেম জয় করার পর জেরুজালেমের মানুষদের উপর গণহত্যা চালায়। একইভাবে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা মুসলিমদের থেকে জেরুজালেম দখল করার পর গণহত্যা চালায়।

জেরুজালেম ও বাইতুল মুকাদ্দাস পূনর্গঠনঃ

উমর (রাঃ) অবিলম্বে শহরটিকে মুসলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনে পরিণত করায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ইহুদীদের টেম্পল মাউন্ট এর এলাকাটি পরিষ্কার করেন যেখান থেকে মহানবী (সাঃ) আসমানে আরোহণ করেছিলেন। খ্রিস্টানরা ইহুদীদেরকে অসন্তুষ্ট করার জন্য এলাকাটিকে আবর্জনা ফেলার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করত। উমর (রাঃ) এবং মুসলিম বাহিনী (এবং সাথে থাকা কিছু ইহুদী) ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকাটি পরিষ্কার করে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা “মসজিদুল আকসা” নামে পরিচিত। উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মসজিদুল আক্‌সা নির্মাণ করেছিলেন।

উমাইয়া খিলাফতের সময় সংস্কারঃ 


বর্তমান আমরা যে স্থাপনাটি দেখি সেটি উমাইয়া যুগের। দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব প্রথম এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। খলিফা আবদুল মালিক ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। সেসাথে তিনি কুব্বাত আস সাখরা নির্মাণ করেন। আবদুল মালিক মসজিদের কেন্দ্রীয় অক্ষ প্রায় ৪০ মিটার পশ্চিমে সরিয়ে আনেন যা হারাম আল শরিফ নিয়ে তার সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ ছিল। পুরনো অক্ষ একটি মিহরাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা "উমরের মিহরাব" বলে পরিচিত। কুব্বাত আস সাখরার উপর গুরুত্ব দিয়ে আবদুল মালিক তার স্থপতিদের দ্বারা নতুন মসজিদকে সাখরার সাথে এক সারিতে আনেন।



কুব্বাত আল সাখরা


আব্বাসীয় ও ফাতেমীয় শাসনামলঃ

৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদুল আকসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর চার বছর পর আস-সাফাহ উমাইয়াদের উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর ৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য তার সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং ৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে তা সমাপ্ত হয়। ৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় একটি ভূমিকম্পের ফলে আল মনসুরের সংস্কারের সময়ের দক্ষিণ অংশ বাদে অনেক অংশ ধ্বংস হয়। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে তার উত্তরসুরি খলিফা আল-মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন।

জেরুজালেমের পতনঃ

১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে নেয়। পুরো শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাইকারি হারে মুসলিমদের হত্যা করে। তারা আল আকসা মসজিদকে "সলোমনের মন্দির" এবং কুব্বাত আস সাখরাকে টেমপ্লাম ডোমিনি (ঈশ্বরের গম্বুজ) নাম দেয়। কুব্বাত আস সাখরা এসময় অগাস্টিনিয়ানদের তত্ত্বাবধানে গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়, আল-আকসা মসজিদকে রাজপ্রাসাদ ও পাশাপাশি ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে আল আকসাকে খ্রিস্টানরা প্রশাসনিক কাজের জন্য ব্যবহার করে। এ সময় মসজিদে কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন করে খ্রিস্টানরা।

জেরুজালেম পুনরুদ্ধারঃ

১১৬৭ সালে কুর্দি সেনাপতি সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে জেরুজালেম পুনরায় মুসলিমদের অধিকারে আসে। বিজয়ের পর মসজিদুল আকসায় কয়েকটি সংস্কার সাধিত হয়। জুমার নামাজের জন্য মসজিদকে প্রস্তুতের নিমিত্তে জেরুজালেম জয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে ক্রুসেডারদের স্থাপন করা টয়লেট ও শস্যের গুদাম সরিয়ে ফেলা হয়। মেঝে কার্পেটে আচ্ছাদিত করা হয়, এবং ভেতরের অংশ গোলাপজল এবং সুগণ্ধি দিয়ে সুগণ্ধযুক্ত করা হয়। সালাহউদ্দিনের পূর্বসূরি সুলতান নুরউদ্দিন জঙ্গি ১১৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে হাতির দাঁত ও কাঠ দিয়ে একটি মিম্বর নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন যা তার মৃত্যুর পর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। সুলতান নুরউদ্দিনের মিম্বরটি সালাহউদ্দিন আল আকসায় স্থাপন করেন। কুব্বাত আল সাখরার গম্বুজের উপরে খ্রিস্টানরা ক্রুশ চিহ্ন বসিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবি সেখানে পুনরায় চাঁদ স্থাপন করেন। দামেস্কের আইয়ুবী সুলতান আল-মুয়াজ্জাম ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি ফটকসহ উত্তরের বারান্দা নির্মাণ করেন।

উসমানিয়া খিলাফতঃ

উসমানিয়া খিলাফতের আমলে মূল মসজিদের কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে এর আশে পাশে প্রচুর সৌন্দর্য বর্ধনকারী স্থাপনা তৈরী করা হয়। প্রথম সুলাইমানের শাসনামলে কুব্বাত আস সাখরাসহ আল আকসা বহির্ভাগ টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। এ কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে। অভ্যন্তরভাগ মোজাইক, ফাইয়েন্স ও মার্বেল দ্বারা সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। এর অধিকাংশই নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার কয়েকশত বছর পরে করা। এতে কুরআনের আয়াত লেখা রয়েছে। সূরা ইয়াসিন ও বনী ইসরাইল এতে খোদিত রয়েছে। ১৬২০ সালে কুব্বাত আস সাখরার পাশে উসমানীয়রা কুব্বাত আন নবী নামক আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করে। ১৮১৭ সালে দ্বিতীয় মাহমুদের আমলে বড় ধরনের সংস্কার সম্পন্ন হয়।

আবার সংকট শুরুঃ

১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানিয়া খলিফা ছিলেন বৃটেন বিরোধী জোটে। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান। উত্তর ছিল অর্থ নয় আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় বৃটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।

ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাঃ

বৃটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় ফিলিস্তিনের দরজা, অন্যদিকে বৃটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাট্রিয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে।


১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসছিল আর বৃটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করলো। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত। এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা দাড়ালো ৫ লাখ ৪০ হাজার। এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ হয় তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র পক্ষে, ১৩টি বিরুদ্ধে এবং ১০টি ভোট দানে বিরত থাকে৷ প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনরা পেল ৪৩% তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত যাতে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে।

ফলে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রহসনের নাটকে জিতে গিয়ে ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরো হিংস্র। তারা হত্যা সন্ত্রাসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতন করে মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করতে লাগলো। ফলে লাখ লাখ আরব বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে। এরপরই ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করলো ইহুদিরা। ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিল, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন-বৃটেন।

বর্তমান অবস্থাঃ

ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা ইসরাঈল ১৯৬৭ সালে জেরুজালেম দখল করে। সেই সাথে আল আকসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণ কার্যত তাদের হাতে চলে যায়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দিনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জর্ডানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধায়ক ছিল। যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হওয়ার পর ইসলামী ওয়াকফ ট্রাস্টের হাতে মসজিদের ভার প্রদান করা হয়। তবে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদ এলাকায় টহল ও তল্লাশি চালাতে পারে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের হামলার পর ওয়াকফ কর্তৃপক্ষ স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ ও কারিগরদের নিয়োগ করে নিয়মিত তত্ত্বাবধান কার্যক্রম চালায়। ইসরায়েলের ইসলামিক মুভমেন্ট এবং ওয়াকফ আল-আকসা ইন্তিফাদার পর থেকে হারাম আল শরিফে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। 

মুহাম্মদ আহমেদ হুসাইন প্রধান ইমাম এবং আল-আকসা মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্ব্বের ক্ষেত্রে আল-আকসা মসজিদের অধিকার একটি ইস্যু। মসজিদসহ পুরো হারাম আল শরিফের উপর ইসরায়েল তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দাবি এর অভিভাবকত্ব ইসলামি ওয়াকফের। ২০০০ ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা মসজিদ এবং পূর্ব জেরুজালেমের অন্যান্য ইসলামি স্থানগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। মুসলিমরা এখনও নামাজ পড়তে পারলেও প্রায়ই এই নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এই লিখাটি এমনই এক পরিস্থিতিতে লিখা। গতকাল নামাজ পড়তে গিয়ে তিনজন মুসলিম শাহদাত বরণ করে আহত হয় শতাধিক।

সহায়ক তথ্যসূত্র
১- আল কুরআন 
২- বাংলা হাদীস
৩- জেরুজালেমের ইতিহাস বিশ্বেরই ইতিহাস - সাইমন সেবাগ মন্টেফিওরি
৪- আল আকসা মসজিদের ইতিকথা, সিরাজুল ইসলাম
৫- আল-আকসা মসজিদ বিভক্ত করতে নেসেটে  নতুন বিল : আরব সদস্যদের তীব্র প্রতিবাদ, দৈনিক সংগ্রাম"। দৈনিক সংগ্রাম। সংগৃহীত ২০১৬-১২-২২।
৬-  Camp David Projections আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক ফিলিস্তিনি  অ্যাকাডেমিক সোসাইটি , July 2000। 

১২ জুল, ২০১৭

বাবিলের হারূত ও মারূতের কাহিনী


ইরাকের বাবিল/ব্যাবিলন শহরে আল্লাহ তায়ালা দুইজন ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন যাদু শেখাতে। যাতে করে মানুষ মু'জিজা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এই ব্যাপারটা সূরা বাকারার ১০২ নং আয়াতে বর্ণিত আছে। এই দুইজন ফেরেশতার নাম হারূত আর মারূত। এই দুইজন নিয়ে আরো চমকপ্রদ ঘটনা আছে যা আমরা অনেকেই শুনেছি।

হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছেনঃ “যখন আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন এবং তাঁর সন্তানেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অতঃপর তারা আল্লাহর নাফরমানী করতে থাকে, তখন ফেরেশতাগণ পরষ্পর বলাবলি করেন- “দেখ এরা কত দুষ্ট প্রকৃতির লোক এবং এরা কতই না অবাধ্য! আমরা এদের স্থলে থাকলে কখনও আল্লাহর অবাধ্য হতাম না।

তখন আল্লাহ তা'আলা। তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা তোমাদের মধ্য হতে দু'জন ফেরেশতাকে নিয়ে এসো; আমি তাদের মধ্যে মানবীয় প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তার পরে দেখা যাক তারা কি করে।’ তারা তখন হারূত ও মারতকে হাজির করেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যে মানবীয় প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তাদেরকে বলেনঃ “দেখ, বানী আদমের নিকট তো আমি নবীদের মাধ্যমে আমার আহ্কাম পৌঁছিয়ে থাকি; কিন্তু তোমাদেরকে মাধ্যম ছাড়াই স্বয়ং আমি বলে দিচ্ছি, আমার সাথে কাউকেও শরীক করবে না, ব্যভিচার করবে না, মদপান করবে না। 

তখন তারা দু'জন পৃথিবীতে অবতরণ করে। তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে আল্লাহ তা’আলা যুহরাকে একটি সুন্দরী নারীর আকারে তাদের নিকট পাঠিয়ে দেন। তারা তাকে দেখেই বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তার সাথে ব্যভিচার করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সে বলেঃ "তোমারা শিরক করলে আমি সম্মত আছি।’ তারা উত্তর দেয়ঃ "এটা আমাদের দ্বারা হবে না।” সে চলে যায়। আবার সে এসে বলেঃ তোমরা যদি এই শিশুটিকে হত্যা কর তবে আমি তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে সম্মত হবো।” তারা ওটাও প্রত্যাখ্যান করে। সে আবার আসে এবং বলেঃ "আচ্ছা, এই মদ পান করে নাও। তারা ওটাকে ছোট পাপ মনে করে তাতে সম্মত হয়ে যায়। এখন তারা নেশায় উন্মত্ত হয়ে ব্যভিচারও করে বসে এবং শিশুটিকে হত্যা করে ফেলে।

তাদের চৈতন্য ফিরে আসলে ঐ স্ত্রীলোক তাদেরকে বলেঃ যে যে কাজ করতে তোমরা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলে তা সবই করে ফেলেছাে।” তারা তখন লজ্জিত হয়ে যায়। তাদেরকে দুনিয়ার শাস্তি বা আখেরাতের শাস্তির যে কোন একটি গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়। তারা দুনিয়ার শাস্তি পছন্দ করে। সহীহ ইবনে হিব্বান, মুসনাদ-ই-আহমাদ, তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই এবং তাফসীর-ই-ইবনে জারীরের মধ্যে এ হাদীসটি বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত আছে। মুসনাদ-ই-আহমাদের এ বর্ণনাটি গরীব। ওর মধ্যে একজন বর্ণনাকারী মুসা বিন যুবাইর আনসারী রয়েছে। ইবনে আবি হাতিমের (রঃ) মতে সে নির্ভরযোগ্য নয়। 

যুহরা ফেরেশতাদের সাথে শর্ত করে বলেছিলঃ “তোমরা আমাকে ঐ দো’আটি শিখিয়ে দাও যা পড়ে তোমরা আকাশে উঠে থাকো। তারা তাকে তা শিখিয়ে দেয়। সে এটা পড়ে আকাশে উঠে যায় এবং তথায় তাকে তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। কতকগুলো মারফু' বর্ণনায় এটা আছে। অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, এ ঘটনার পূর্বে তো ফেরেশতাগণ শুধুমাত্র মুমিনদের জন্যই ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, কিন্তু এর পর তারা সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আরম্ভ করেন।

কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, যখন এই ফেরেশতাদ্বয় হতে এ অবাধ্যতা প্রকাশ পায় তখন অন্যান্য ফেরেশতাগণ স্বীকার করেন যে, বানী আদম আল্লাহ পাক হতে দূরে রয়েছে এবং তাঁকে না দেখেই ঈমান এনেছে, সুতরাং তাদের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ঐ ফেরেশতাদ্বয়কে বলা হয়ঃ “তোমরা দুনিয়ার শাস্তি গ্রহণ করে নাও, অথবা পরকালের শাস্তির জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও।' তারা দু'জন পরামর্শ করে দুনিয়ার শাস্তিই গ্রহণ করে। কেননা, এটা অস্থায়ী এবং পরকালের শাস্তি চিরস্থায়ী। সুতরাং বাবিলে /ব্যবিলনে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

ইবনে কাসীর তার তাফসীরে এই ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেছেন ওটা মুনকার ও বে-ঠিক। এটা ইসরাঈলীয়াত হতে পারে। তবে আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহর রাসূলের সঃ সময় সাহাবীরা আহলে কিতাবদের কাছ থেকে নানান ঘটনা শুনতো। নবী সঃ এর নবুয়্যত প্রাপ্তির আগেও এসব ঘটনা আরবে জনশ্রুতি ছিল। কিন্তু কোন সহীহ হাদীসে এসব ঘটনা আল্লাহর রাসূল থেকে বর্ণনা হয়নি। আমরা লোকমুখে প্রচারিত কোন ঘটনাকে সত্য হিসেবে ধরে নিতে পারি না। তাছাড়া এটা ইসলামের মূলনীতির সাথেও যায় না। আমরা যতটুকু ঘটনা কুরআন ও রাসূল সঃ এর কাছ থেকে জানতে পারবো ততটুকুতেই বিশ্বাস রাখবো। 

হারূত-মারূতের ঘটনাঃ  

প্রথমেই আমরা জেনে নিই এই প্রসঙ্গে কুরআনে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কী ইতিহাস জানিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, অর্থাৎ আর তারা এমন সব জিনিসের অনুসরণে মেতে ওঠে, যেগুলো শয়তানরা পেশ করতো সুলাইমানী রাজত্বের নামে। অথচ সুলাইমান (আঃ) কোন দিন কুফরী করেননি। কুফরী করেছে সেই শয়তানরা, যারা লোকদেরকে যাদু শেখাত। তারা বাবিল শহরে দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছিল তা আয়ত্ব করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। অথচ তারা (ফেরেশতারা) যখনই কাউকে এর শিক্ষা দিতেন, তাকে পরিষ্কার ভাষায় এই বলে সতর্ক করে দিতেন যে, সাবধান! আমরা নিছক একটি পরীক্ষা মাত্র, খবরদার! তুমি কুফরীতে লিপ্ত হইও না। এরপরও তারা তাদের থেকে এমন জিনিস শিখতো, যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এনে দিত। একথা সত্য যে, আল্লাহর হুকুম ছাড়া এ পন্থায় তারা কাউকে ক্ষতি করতে পারত না। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা এমন জিনিস শিখত যা তাদের নিজেদের জন্য লাভজনক ছিল না বরং ক্ষতির কারণ ছিল। তারা ভালো করেই জানত, তারা যা ক্রয় করেছে (এ কাজগুলো করার মাধ্যমে) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। কতই না নিকৃষ্ট জিনিসের বিনিময়ে তারা বিকিয়ে দিল নিজেদের জীবনকে!! হায়, যদি তারা একথা জানতো!
-(সুরা বাকারা:১০২)

এই আয়াত থেকে আমরা যা পাই... 

১- বনী ইসরাঈলের লোকেরা সুলাইমান আঃ এর মৃত্যুর পর যাদু নামক শয়তানী কর্মকান্ডে নিমজ্জিত হয়েছিল।
২- আর এই যাদু তারা প্রচার করতো নবী সুলাইমান আঃ এর নামে। তারা প্রচার করতো সুলাইমান আঃ নিজেই যাদুকর ছিলেন।
৩- আল্লাহ সুলাইমান আঃ কে নিষ্কলুষ এবং নিরাপরাধ ঘোষনা করেন।
৪- কুফরি করেছে শয়তানেরা।
৫- বাবিল শহরে আল্লাহ তায়ালা দুজন ফেরেশতা পাঠিয়েছেন।
৬- তারা ছিল পরীক্ষাস্বরুপ। তারা যাদু শিক্ষা দিত কিন্তু সাথে সাথে সতর্ক করে দিত। 
৭- বনী ইসরাঈলের লোকেরা যাদু দিয়ে খারাপ কাজ করতো। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এনে দিত।
৮- এই কাজ ছিল তাদের জন্য ক্ষতির কারণ।

কেন হারূত মারূতকে পাঠানো হয়েছিল? 

হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর নিকট একটি আংটি ছিল। টয়লেটে গেলে তিনি ওটা তার স্ত্রীর নিকট রেখে যেতেন। হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর পরীক্ষার সময় এলে একটি শয়তান জীন তার রূপ ধরে তাঁর স্ত্রীর নিকট আসে এবং আংটি চায়। তা তাকে দিয়ে দেয়া হয়। সে তা পরে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনে বসে যায়। সমস্ত জীন, মানব ও শয়তান তার খিদমতে হাজির হয়। সে শাসন কাৰ্য চালাতে থাকে। এদিকে হযরত সুলাইমান (আঃ) ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর নিকট আংটি চান। তাঁর স্ত্রী বলেনঃ “তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি সুলাইমান (আঃ) নও। সুলাইমান (আঃ) তো আংটিটি নিয়েই গেছেন।”
হযরত সুলাইমান (আঃ) বুঝে নেন যে, এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে তার উপর পরীক্ষা। এ সময়ে শয়তানরা যাদু বিদ্যা, জ্যোতিষ বিদ্যা এবং ভবিষ্যতের সত্য-মিথ্যা খবরের কতকগুলো কিতাব লিখে এবং ওগুলো হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনের নীচে পুঁতে রাখে। হযরত সুলাইমান (আঃ) । এর পরীক্ষার যুগ শেষ হলে পুনরায় তিনি সিংহাসন ও রাজপাটের মালিক হয়ে যান। স্বাভাবিক বয়সে পৌঁছে যখন তিনি রাজত্ব হতে অবসর গ্রহণ করেন, তখন শয়তানরা জনগণকে বলতে শুরু করে যে, হযরত সুলাইমানের (আঃ) ধনাগার এবং ঐ পুস্তক যার ক্ষমতাবলে তিনি বাতাস ও জীনদের উপর শাসনকার্য চালাতেন তা তাঁর সিংহাসনের নীচে পোঁতা রয়েছে। জীনেরা ঐ সিংহাসনের নিকটে যেতে পারতো না বলে মানুষেরা ওটা খুঁড়ে ঐ সব পুস্তক বের করে। সুতরাং বাইরে এর আলোচনা হতে থাকে এবং প্রত্যেকেই এ কথা বলে যে, হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্বের রহস্য এটাই ছিল। এমনকি জনগণ হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর নবুওয়াতকেও অস্বীকার করে বসে এবং তাকে যাদুকর বলতে থাকে।

আল্লাহ তায়ালা সেসময় হারূত ও মারূতকে বনী ইসরাঈলের নিকট পাঠান। তারা যাতে যাদু ও মু'জিজার মধ্যে পার্থক্য বুঝাতে পারে। এটাও জানানোর জন্য যে, যাদু শুধুমাত্র একটা কৌশল এবং যে কেউ তা আয়ত্ব করতে পারে।

সংক্ষিপ্ত করলে জানা যায় হারূত মারূতের পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো
১- "সুলাইমান আঃ একজন বড় যাদুকর ছিলেন" শয়তানদের এমন মিথ্যা দাবী খন্ডন করার জন্য।
২- মু'জিজা ও জাদুর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে মু'জিজা ও জাদু উভয়ের বৈশিষ্ট্য জানা জরুরী। কিন্তু, মানুষের কাছে জাদুর বৈশিষ্ট্য অজানা ছিল। তাই, তাদেরকে জাদুর বৈশিষ্ট্য শেখানোর জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
৩- মানুষকে আল্লাহমুখী ও তাওহীদপন্থী করার জন্য পাঠানো হয়েছে।

কিন্তু যারা শয়তান তারা শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা কোন ভালো উপদেশবানীকেও খারাপ কাজে ব্যবহার করে। এই ধরণের মানুষ সেসময় যেমন ছিল এখনও আছে। আজও বহু মানুষ কুরআন দিয়ে এসব অনাচার করে অথচ কুরআন নাজিল হয়েছে এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য।

যুহরা ও ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনীর অসারতা   

১- কুরআনে বর্ণিত ঘটনার সাথে মিল নেই। এই ধরণের ঘটানার কোন ইঙ্গিতও নেই।
২- আল্লাহর রাসূল সঃ এই যুহরার সম্পর্কে কোন কথা বলেছেন এমন সহীহ রেওয়ায়েত নেই।
৩- এই ঘটনাকে বিখ্যাত তাফসীরকারকগণ মুনকার বলে উল্লেখ করেছেন।
৪- ফেরেশতাগণ সমস্ত প্রকার গুণাহ থেকে পবিত্র। ফেরেশতারা কখনোই আল্লাহর অবাধ্য হন না। হতে পারেন না। (দ্রঃ সূরা তাহরিম-৬ এবং সূরা আম্বিয়া-১৯,২০)
৫- গল্পটিতে বলা আছে, "দুনিয়া এবং আখিরাতের শাস্তির মধ্যে একটি বেছে নিতে" এটাও গ্রহনযোগ্য নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা বেছে নিতে বললে বলার কথা তাওবা এবং শাস্তি। আর দুনিয়া তো বিচারের জায়গা নয়, পরীক্ষার জায়গা। বিচার হবে আখিরাতে।

এই প্রসঙ্গে রাসায়েল মাসায়েলে মাওলানা মওদুদী বলেছেন,
এ গল্পটি কিছু পুস্তকে লেখা থাকলেও সরাসরি রসূল সা.-এর মুখ থেকে কেউ শুনেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় না। হাফিয ইবনে কাসীর, অধ্যাপক আহমদ মুহাম্মদ শাকের, সাইয়েদ রশীদ রেজা এবং অন্যান্য বিজ্ঞজন এর বিস্তারিত সমালোচনা করেছেন। আসলে এ কিসাসটি প্রধানত কা'ব আহবার থেকে বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যমে অনেক ইহুদি কল্পকাহিনী আমাদের ইতিহাস ও তাফসীরের গ্রন্থাবলীতে ঢুকে গেছে। অথচ এ সবের আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। এ কিসসা তাওরাত বা অন্যান্য লিখিত ইহুদি সাহিত্যেও নেই।

পবিত্র কুরআন থেকে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, ফেরেশতারা আল্লাহর কোনো হুকুম লংঘন করতে পারেননা। একথা সত্য যে, আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে এমন কাজের নির্দেশ দিতে পারেন, যা মানুষের জন্য শাস্তি বা পরীক্ষার রূপ ধারণ করে। কিন্তু তারা আল্লাহর কোনো আদেশের বিরুদ্ধাচরণ বা নৈতিক দিক দিয়ে কোনো অশালীন কাজ করতে পারেন- এটা অকল্পনীয় কেননা তারা প্রকৃতিগত ভাবেই নিষ্পাপ এবং যৌন আবেদন থেকে মুক্ত। তাদের মধ্যে সন্তান প্রজনন বা বংশ বিস্তারের ধারাও চালু নেই। তবু ধরে নেয়া হয় যে, খোদা না করুন, তাদের কারো দ্বারা এমন গুরুতর নাফরমানী হতো এবং সে জন্য এমন কঠিন সাজা দেয়া হতো, তহলে কুরআনে তার উল্লেখও থাকতো।

হাদীসের নামে জালিয়াতী গ্রন্থে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বলেন,
এ বিষয়ক অনেক গল্প কাহিনী হাদীস নামে বা তাফসীর নামে তাফসীরের গ্রন্থগুলিতে বা সমাজে প্রচলিত। কাহিনীটির সারসংক্ষেপ হলো, মানবজাতির পাপের কারণে ফিরিশতাগণ আল্লাহকে বলেন, মানুষের এত অপরাধ আপনি ক্ষমা করেন কেন বা শাস্তি প্রদান করেননা কেন? আল্লাহ তাদেরকে বলেন, তোমরাও মানুষের প্রকৃতি পেলে এমন পাপ কাজ করতে। তারা বলেন, কক্ষনো না। তখন তারা পরীক্ষার জন্য হারূত ও মারূত নামক দুইজন ফিরিশতাকে নির্বাচিত করেন। তাদেরকে মানবীয় প্রকৃতি প্রদান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। তারা যোহরা নামক এক পরমা সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়ে মদপান, ব্যভিচার ও নরহত্যার পাপে জড়িত হন। পক্ষান্তরে যোহরা তাদের নিকট মন্ত্র শিখে আকাশে উড়ে যায়। তখন তাকে একটি তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। এই গল্পগুলি মূলত ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীমালা। তবে কোনো কোনো তাফসীর গ্রন্থে এগুলি হাদীস হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ক সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল ও জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদের কারণে কয়েকটি বর্ণনাকে গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অনেক মুহাদ্দিস সবগুলিই জাল ও বানোয়াট বলে মত দিয়েছেন।

আল্লামা কুরতুবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও মুফাসসির উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল গল্প ফিরিশতাগণ সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত। ইহুদী, খৃস্টান ও অন্যান্য অনেক ধর্মে ফিরিশতাগণকে মানবীয় প্রকৃতির বলে কল্পনা করা হয়। তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তশক্তি আছে বলেও বিশ্বাস করা হয়। ইসলামী বিশ্বাসে ফিরিশতাগণ সকল প্রকার মানবীয় প্রবৃত্তি, নিজস্ব চিন্তা বা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে পবিত্র। তাঁরা মহান আল্লাহকে কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর কোনো কর্ম বা কথাকে চ্যালেঞ্জ করবেন এরূপ কোনো প্রকারের প্রকৃতি তাদের মধ্যে নেই। কাজেই এ সকল কাহিনী ইসলামী আকীদার বিরোধী।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আল্লাহর নাফরমানী এবং রাসূল সঃ এর নামে বানোয়াট কথা বলা ও ছড়ানো থেকে রক্ষা করুন।

সহায়ক গ্রন্থ
১- তাফসীরে ইবনে কাসীর
২- তাফহীমুল কুরআন
৩- রাসায়েল মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
৪- হাদীসের নামে জালিয়াতী