নবীদের (আঃ) সম্পর্কে সমাজে বিভিন্ন বর্ণনা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে আমরা ততটাই গ্রহন করবো যতটা আমাদের আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূল সাঃ জানিয়েছেন। আল কুরআনে ৪টি সূরার ৮টি আয়াতে আইয়ূব (আঃ)-এর কথা এসেছে। যথা- সূরা নিসা ১৬৩, সূরা আন‘আম ৮৪, সূরা আম্বিয়া ৮৩-৮৪ এবং সূরা সোয়াদ ৪১-৪৪। আর একটি হাদীস সহীহ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায়। সেগুলো নিম্নরূপ।
আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা বলেন,
হে মুহাম্মাদ ! আমি তোমার কাছে ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি, যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম ৷ আমি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুব সন্তানদের কাছে এবং ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সুলাইমানের কাছে অহী পাঠিয়েছি৷ আমি দাউদকে যবূর দিয়েছি। (নিসা ১৬৩)
তারপর আমি ইবরাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকূবের মতো সন্তান দিয়েছি এবং সবাইকে সত্য পথ দেখিয়েছি, ( সে সত্য পথ যা) ইতিপূর্বে নূহকে দেখিয়েছিলাম৷ আর তারই বংশধরদের থেকে দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুণকে (হেদায়াত দান করেছি)৷ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে তাদের সৎকাজের বদলা দিয়ে থাকি।
(আন'আম ৮৩)
‘আর স্মরণ কর আইয়ূবের কথা, যখন তিনি তার পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি সর্বোচ্চ দয়াশীল’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলাম। তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমাদের পক্ষ হ’তে দয়া পরবশে। আর এটা হল ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (আম্বিয়া ৮৩-৮৪)।
‘আর স্মরণ করো আমার বান্দা আইয়ূবের কথা। যখন সে তার রবকে ডাকলো এই বলে যে, শয়তান আমাকে কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। (আমি তাকে হুকুম দিলাম) তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করো, এ হচ্ছে ঠাণ্ডা পানি গোসল করার জন্য এবং পান করার জন্য। আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম তার পরিবার পরিজন এবং সেই সাথে তাদের মতো আরো, নিজের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং বুদ্ধি ও চিন্তাশীলদের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে। (আর আমি তাকে বললাম) এক গুচ্ছ তৃণশলা নাও এবং তা দিয়ে আঘাত করো এবং নিজের প্রতিশ্রুতি ভংগ করো না। আমি তাকে সবরকারী পেয়েছি, কতই না চমৎকার বান্দা ছিল সে, নিশ্চয়ই সে ছিল নিজের রবের অভিমুখী। (সোয়াদ ৪১-৪৪)
অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আইয়ূব একদিন নগ্নাবস্থায় গোসল করছিলেন (অর্থাৎ বাথরুম ছাড়াই খোলা স্থানে)। এমন সময় তাঁর উপরে সোনার ফড়িংসমূহ এসে পড়ে। তখন আইয়ূব সেগুলিকে ধরে কাপড়ে ভরতে থাকেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, হে আইয়ূব! আমি কি তোমাকে এসব থেকে মুখাপেক্ষীহীন করিনি? আইয়ূব আঃ বললেন, তোমার ইযযতের কসম! অবশ্যই তুমি আমাকে তা দিয়েছ। কিন্তু তোমার বরকত থেকে আমি মুখাপেক্ষীহীন নই’।
প্রচলিত গল্প:
আইয়ুব একজন বড়ই সত্যনিষ্ঠ, খোদাভীরু ও কুকর্ম ত্যাগকারী সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন৷ এই সংগে তিনি এতই ধনাঢ্য ছিলেন যে, "পূর্ব দেশের লোকদের মধ্যে তিনি ই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বড়লোক৷একদিন আল্লাহ তাঁর বান্দা আইয়ুবের জন্য গর্ব করেন৷ শয়তান বলে, আপনি তাকে যা কিছু দিয়ে রেখেছেন তারপর সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে আর কে করবে? তার প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন সেগুলো একবার ছিনিয়ে নেন তারপর দেখুন সে যদি আপনার মুখের ওপর আপনাকে অস্বীকার না করে থাকে তাহলে আমার নাম শয়তান নয়।
আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে তার সব কিছু তোমার হস্তগত করে দেয়া হচ্ছে, শুধুমাত্র তার শারীরিক কোন ক্ষতি করো না৷ শয়তান গিয়ে আইয়ুবের সমস্ত ধন-দওলত ও পরিবার পরিজন ধবংশ করে দেয়৷আইয়ুব সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র একাই থেকে যান। কিন্তু এতে আইয়ুবের মনে কোন দুঃখ ও ক্ষোভ জাগেনি৷ তিনি আল্লাহকে সিজদা করেন এবং বলেন, "আমি মায়ের গর্ভ থেকে উলংগ এসেছি এবং উলংগই ফিরে যাবো; খোদাই দিয়েছেন আবার খোদাই নিয়েছেন, খোদার নাম ধন্য হোক।
আল্লাহ শয়তানকে বলেন, আইয়ুব কেমন সত্যনিষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছে দেখে নাও। শয়তান বলে, আচ্ছা, এবার তার শরীরকে একবার বিপদগ্রস্ত করে দেখুন সে আপনার মুখের ওপর আপনার কুফরী করবে৷ আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে যাও, তাকে তোমার হাতে দেয়া হচ্ছে, তবে তার প্রাণটি যেন সংরক্ষিত থাকে৷ অতপর শয়তান ফিরে যায়৷ সে আইয়ুবকে মাথার চাঁদি থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক ফোড়ায় ভরে দেয়৷ তার স্ত্রী তাকে বলে, "এখনো কি তুমি তোমার সত্যনিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে? আল্লাহকে অমান্য করো এবং প্রাণত্যাগ করো৷তিনি জবাব দেন, তুমি মুঢ়া স্ত্রীর মতো কথা বলছো৷ আমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে শুধু সুখ পাবো, দুঃখ পাবো না?
হযরত ইয়াযিদ ইবনু মাইসারা (রাঃ) বলেন, যখন হযরত আইয়ুবের (আঃ) পরীক্ষা শুরু হয় তখন তার সন্তান সন্ততি মারা যায়, ধন- সম্পদ ধ্বংস হয় এবং তিনি সম্পূর্ণরূপে রিক্ত হস্ত হয়ে পড়েন। এতে তিনি আরো বেশী আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকেন। তিনি বলতে থাকেনঃ “হে সকল পালনকারীদের পালনকর্তা! আমাকে আপনি বহু ধন মাল ও সন্তান সন্ততি দান করেছিলেন। ঐ সময় আমি ঐগুলিতে সদা লিপ্ত থাকতাম। অতঃপর আপনি ঐগুলি আমার থেকে নিয়ে নেয়ার ফলে আমার অন্তর ঐ সবের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছে। এখন আমার অন্তরের মধ্যে ও আপনার মধ্যে কোনই প্রতিবন্ধকতা নেই। যদি আমার শত্রু ইবলীস আমার প্রতি আপনার এই মেহেরবানির কথা জানতে পারতো তবে সে আমার প্রতি হিংসায় ফেটে পড়তো।” ইবলীস তাঁর এই কথায় এবং তার ঐ সময়ের ঐ প্রশংসায় জ্বলে পুড়ে মরে। তিনি নিম্নরূপ প্রার্থনাও করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি এবং পরিবার পরিজনের অধিকারী করেছিলেন। এবং আপনি ভালো করে জানেন যে, ঐ সময় আমি কখনো অহংকার করি নি এবং কারো প্রতি জুলুম ও অবিচারও করি নাই। হে আল্লাহ! এটা আপনার অজানা নেই যে, আমার জন্যে নরম বিছানা প্রস্তুত থাকতো। কিন্তু আমি তা পরিত্যাগ করে আপনার ইবাদতে রাত কাটিয়ে দিতাম এবং আমার নাফসকে ধমকের সুরে বলতামঃ তুমি নরম বিছানাতে আরাম করার জন্যে সৃষ্ট হও নি। হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমি সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশ বিসর্জন দিতাম।”।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই বিপদে জড়িত ছিলেন। হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত কাতাদা (রাঃ) বলেন যে, তিনি সাত বছর ও কয়েক মাস এই কষ্ট ভোগ করেছিলেন। বনী ইসরাঈলের আবর্জনা ফেলার জায়গায় তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তার দেহ পোকা হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর মহান আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হন এবং তাকে সমস্ত বিপদ ও কষ্ট হতে মুক্তি দান করেন। আর তাকে তিনি পুরস্কৃত করেন ও তার উত্তম প্রশংসা করেন। অহাব ইবনু মুনাববাহ (রাঃ) বলেন যে, তিনি পূর্ণ তিন বছর এই কষ্টের মধ্যে পতিত ছিলেন। তার দেহের সমস্ত মাংস খসে পড়েছিল। শুধু অস্থি ও চর্ম অবশিষ্ট ছিল। তিনি ছাই এর উপর পড়ে থাকতেন। তার কাছে শুধু তার একজন স্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘযুগ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর একদা তিনি তার স্বামীকে বলেনঃ “হে আল্লাহর নবী (আঃ)! আপনি মহান আল্লাহর নিকট কেন প্রার্থনা করেন না যাতে তিনি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ "দেখো, আল্লাহ তায়ালা আমাকে সত্তর বছর সুস্থ শরীরে রেখেছিলেন। সুতরাং তিনি যদি আমাকে সত্তর বছর এই অবস্থায় রাখেন এবং আমি ধৈর্য ধারণ করি আল্লাহর জন্যে। তবে এটা তো আল্লাহর জন্যে খুবই অল্প।" একথা শুনে তার স্ত্রী কেঁপে ওঠেন।
এভাবে আরো কিছু বর্ণনা আছে কুরতুবি ও ইবনে কাসীরে। কেন আইয়ুব আঃ তাঁর স্ত্রীর উপর বিরক্ত হয়েছেন এই নিয়েও রয়েছে অনেক চমকপ্রদ কাহিনী। এর মধ্যে আছে দুই ব্যক্তির ঝগড়ার কাহিনী, জান্নাতি পোষাক, রুটি সংক্রান্ত ইত্যাদি। ইবনে কাসীরে এসব বর্ণনা দূর্বল বলা হয়েছে।
আসলে আইয়ুব আঃ এর সাথে কী হয়েছে?
১. সূরা সোয়াদের ৪১ নং আয়াত থেকে অনেকে মনে করেন শয়তান আইয়ুব আঃ কে দুঃখ কষ্টে পতিত করেছে। বস্তুত এই দাবিটি সঠিক নয়। শয়তানের এমন ক্ষমতা নেই। শয়তান আমাকে কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, রোগের প্রচণ্ডতা, ধন-সম্পদের বিনাশ এবং আত্মীয় - স্বজনদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণে আমি যে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছি তার চেয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা আমার জন্য এই যে , শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে আমাকে বিপদগ্রস্ত করছে৷ এ অবস্থায় সে আমাকে আমার রব থেকে হতাশ করার চেষ্টা করে , আমাকে আমার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ করতে চায় এবং আমি যাতে অধৈর্য হয়ে উঠি সে প্রচেষ্টায় রত থাকে৷
হযরত আইয়ূব আঃ এর ফরিয়াদের এ অর্থটি দু'টি কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এক, কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে আল্লাহ শয়তানকে কেবলমাত্র প্ররোচণা দেবার ক্ষমতাই দিয়েছেন। আল্লাহর বন্দেগীকারীদেরকে রোগগ্রস্ত করে এবং তাদেরকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে বন্দেগীর পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদেরকে দেননি ৷ দুই, সূরা আম্বিয়ায় যেখানে হযরত আইয়ূব আঃ আল্লাহর কাছে তাঁর রোগের ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করছেন সেখানে তিনি শয়তানের কোন কথা বলেন নি রবং তিনি কেবল বলেন, আমি রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছি এবং তুমি পরম করুণাময়।
২. আইয়ুব আঃ কেমন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, দেহের সর্বত্র কেমন পোকা ধরেছিল? জিহবা ও কলিজা ব্যতীত দেহের সব মাংস তার খসে পড়েছিল, পচা দুর্গন্ধে সবাই তাকে নির্জন স্থানে ফেলে পালিয়েছিল, ইত্যাকার বিভিন্ন রকমের কাল্পনিক কাহিনী যা বিভিন্ন মুফাসসিরগণ তাদের তাফসীরে স্থান দিয়েছেন, সে সবের কোন ভিত্তি নেই বরং সেগুলো স্রেফ ইসরাঈলী উপকথা মাত্র।
৩. পায়ের আঘাতে পানির ধারা সৃষ্টি এটি অলৌকিক মনে হলেও বিষ্ময়কর নয়। ইতিপূর্বে শিশু ইসমাঈলের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। পরবর্তীকালে হোদায়বিয়ার সফরে রাসূলের হাতের বরকতে সেখানকার শুষ্ক পুকুরে পানির ফোয়ারা ছুটেছিল, যা তাঁর সাথী ১৪০০ সাহাবীর পানির কষ্ট নিবারণে যথেষ্ট হয়। মূলত এগুলি নবীগণের মু‘জেযা। নবী আইয়ূবের আঃ জন্য তাই এটা হয়েছে আল্লাহর হুকুমে।
তবে কতদিন তিনি কষ্ট ভোগ করেছেন এই হিসাব সম্পর্কে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। যেগুলো পাওয়া যায় তা সবই ইসরাঈলীয়াত।
৪. আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে সমপরিমাণ আরও দিলাম আমাদের পক্ষ হতে দয়া পরবশে। এখানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তার বিপদে ধৈর্য ধারণের পুরস্কার দ্বিগুণভাবে পেয়েছিলেন দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। বিপদে পড়ে যা কিছু তিনি হারিয়েছিলেন, সবকিছুই তিনি বিপুলভাবে ফেরত পেয়েছিলেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘এভাবেই আমরা আমাদের সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকি’ (আন‘আম ৮৪)।
এখানে তাঁর মৃত সন্তানাদি পুনর্জীবিত হয়েছিল, না-কি হারানো গবাদি পশু সব ফেরৎ এসেছিল, এসব কল্পনার কোন প্রয়োজন নেই। এগুলো বাহুল্যতা। এতটুকুই বিশ্বাস রাখা যথেষ্ট যে, তিনি তাঁর ধৈর্য ধারণের পুরস্কার ইহকালে ও পরকালে বহুগুণ বেশী পরিমাণে পেয়েছিলেন। যুগে যুগে সকল ধৈর্যশীল ঈমানদার নর-নারীকে আল্লাহ এভাবে পুরস্কৃত করে থাকেন।
৫. পুরস্কার দেয়ার পর আল্লাহ বলেন, رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا ‘আমাদের পক্ষ হতে দয়া পরবশে’ (আম্বিয়া ৮৪)। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ কারও প্রতি অনুগ্রহ করতে বাধ্য নন। তিনি যা খুশী তাই করেন, যাকে খুশী যথেচ্ছ দান করেন। তিনি সবকিছুতে একক কর্তৃত্বশীল। কেউ এই আয়াতে বর্ণিত ‘রাহমাতান’ (رَحْمَةً) থেকে আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম ‘রহীমা’ কল্পনা করেছেন। যা নিতান্তই মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।
বিবি রহিমার নামে আইয়ুব আঃ এর স্ত্রীকে নির্দেশ করে আমাদের দেশে বহু গল্প প্রচলিত আছে। সেগুলোর প্রকৃতপক্ষে সহীহ কোন ভিত্তি নাই। গল্প উপন্যাস গানের মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছে।
৬. সহীহ বুখারীতে আইয়ূব আঃ এর উপর এক ঝাঁক সোনার ফড়িং এসে পড়ার যে কথা বর্ণিত হয়েছে, সেটা হল আউয়ূব আঃ এর সুস্থতা লাভের পরের ঘটনা। এর দ্বারা আল্লাহ বিপদমুক্ত আইয়ূবের উচ্ছ্বল আনন্দ পরখ করতে চেয়েছেন। আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে বান্দা কত খুশী হ’তে পারে, তা দেখে যেন আল্লাহ নিজেই খুশী হন। এজন্য আইয়ূবকে খোঁচা দিয়ে কথা বললে অনুগ্রহ বিগলিত আইয়ূব বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর বরকত থেকে আমি মুখাপেক্ষীহীন নই’। অর্থাৎ বান্দা সর্বদা সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমত ও বরকতের মুখাপেক্ষী। নিঃসন্দেহে উক্ত ঘটনাটিও একটি মু‘জেযা।
৭. আল্লাহ আইয়ূব আঃ কে বলেন,‘আর তুমি তোমার হাতে একমুঠো তৃণশলা নাও। অতঃপর তা দিয়ে আঘাত কর এবং তোমার শপথ ভঙ্গ করো না’ (সোয়াদ ৪৪)। এই আয়াতে আরেকটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, রোগ অবস্থায় আইয়ূব আঃ শপথ করেছিলেন যে, সুস্থ হলে তিনি স্ত্রীকে একশ’ বেত্রাঘাত করবেন। রোগ তাড়িত স্বামী কোন কারণে স্ত্রীর উপর ক্রোধবশে এরূপ শপথ করেও থাকতে পারেন। কিন্তু কেন তিনি এ শপথ করলেন, তার স্পষ্ট কোন কারণ কুরআন বা হাদিসে বলা হয়নি। ফলে তাফসীরের গ্রন্থগুলোতে নানা কল্পনার ফানুস উড়ানো হয়েছে, যা আইয়ূব আঃ এর পুণ্যশীলা স্ত্রীর উচ্চ মর্যাদার একেবারেই বিপরীত। আইয়ূবের আঃ এর স্ত্রী ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দীদের অন্যতম। তাকে কোনরূপ কষ্টদান আল্লাহ পছন্দ করেননি।
আল্লাহ যখন আইয়ুব আঃ কে সুস্থতা দান করলেন এবং যে রোগগ্রস্ত অবস্থায় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি এ কসম খেয়েছিলেন এ ক্রোধ স্তিমিত হয়ে গেলো তখন তিনি একথা মনে করে অস্থির হয়ে পড়লেন যে কসম পুরা করতে গেলে অযথা একজন নিরপরাধকে মারতে হয় এবং কসম ভেঙে ফেললেও গোনাহগার হতে হয়। এ উভয় সংকট থেকে আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করলেন। আল্লাহ তাঁকে হুকুম দিলেন, একগুচ্ছ তৃণশলা নাও। তাতে তুমি যে পরিমাণ কোড়া মারার কসম খেয়েছিলে সে পরিমাণ কাঠি থাকবে এবং সে ঝাড়ু দিয়ে কথিত অপরাধীকে একবার আঘাত করো এর ফলে তোমার কসমও পুরা হয়ে যাবে এবং সেও অযথা কষ্টভোগ করবে না।
কোন কোন ফকীহ ও রেওয়ায়াতটিকে একমাত্র হযরত আইয়ূবের জন্য নির্ধারিত মনে করেন। আবার কতিপয় ফকীহের মতে অন্য লোকেরাও এ সুবিধাদান থেকে লাভবান হতে পারে৷ প্রথম অভিমতটি উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আসাকির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এবং আবু বকর জাসসাস মুজাহিদ থেকে ৷ ইমাম মালেকেরও অভিমত এটিই ৷ ইমাম আবু হানীফা , ইমাম আবু ইউসুফ , ইমাম মুহাম্মাদ , ইমাম যুফার ও ইমাম শাফেঈ দ্বিতীয় অভিমতটি অবলম্বন করেছেন ৷ তাঁরা বলেন , কোন ব্যক্তি যদি তার খাদেমকে দশ ঘা কোড়া মারার কসম খেয়ে বসে এবং পরে দশটি কোড়া মিলিয়ে তাকে এমনভঅবে কেবলমাত্র একটি আঘাত করে যার ফলে কোড়াগুলোর প্রত্যেকটি কিছু অংশ তার গায়ে ছুঁড়ে যায় তাহলে তার কসম পুরো হয়ে যাবে।
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশী রোগগ্রস্ত বা দুর্বল হবার কারণে যে যিনাকারী একশো দোরবার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখতো না তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার ব্যাপারে এ আয়াতে বিবৃত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন৷ আল্লামা আবু বকর জাসসাস হযরত সাঈদ ইবনে সা'দ ইবনে উবাদাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বনী সা 'য়েদে এক ব্যক্তি যিনা করে। সে এমন রুগ্ন ছিল যে, তাকে অস্থি-চর্মসার বলা যেতো। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুকুম দিলেনঃ
"খেজুরের একটি ডাল, নাও, যার একশোটি শাখা রয়েছে এবং তা দিয়ে একবার এ ব্যাক্তিকে আঘাত করো।" (আহকামুল কুরআন )
মুসনাদে আহমাদ , আবু দাউদ , নাসাঈ ইবনে মাজাহ , তাবারানী , আবদুল রাজ্জাক ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসমূহেও এ ঘটনাকে সমর্থন করে এমন কতিপয় হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে ৷ সেগুলোর মাধ্যমে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয় যে , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগী ও দুর্বলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিলেন ৷ তবে ফকীহগণ এ ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করেছেন যে , প্রত্যেকটি শাখা বা পাতার কিছু না কিছু অংশ অপরাধীর গায়ে অবশ্যই লাগা উচিত এবং একটি আঘাতই যথেষ্ট হলেও অপরাধীকে তা যেন কোন না কোন পর্যায়ে আহত করে৷ অর্থাৎ কেবল স্পর্শ করা যথেষ্ট নয় বরং আঘাত অবশ্যই করতে হবে৷
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে , যদি কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে এবং পরে জানা যায় যে , সে বিষয়টি অসংগত, তাহলে তার কি করা উচিত৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেকে এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, এ অবস্থায় মানুষের পক্ষে যা ভালো, তাই করা উচিত এবং এটিই তার কাফফারা অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, এ অসংগত কাজের পরিবর্তে মানুষের ভাল কাজ করা এবং নিজের কসমের কাফফারা আদায় করে দেয়া উচিত। এ আয়াতটি এ দ্বিতীয় হাদীসটিকে সমর্থন করে৷ কারণ একটি অসংগত কাজ না করাই যদি কসমের কাফফরা হতো তাহলে আল্লাহ আইয়ুবকে একথা বলতেন না যে, তুমি একটি ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করে নিজের কসম পুরা করে নাও। বরং বলতেন, তুমি এমন অসংগত কাজ করো না এবং এটা না করাই তোমার কসমের কাফফরা।
এ আয়াত থেকে একথাও জানা যায় যে, কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেলে সংগে সংগেই তা পুরা করা অপরিহার্য হয় না। হযরত আইয়ূব আঃ রোগগ্রস্ত অবস্থায় কসম খেয়েছিলেন এবং তা পূর্ণ করেন পুরোপুরি সুস্থ হবার পর এবং সুস্থ হবার পরও তাও সংগে সংগেই পুরা করেননি।
কেউ কেউ এ আয়াতকে শরয়ী বিধান বাস্তবায়নের বিপক্ষে বাহানার জন্য যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ৷ সন্দেহ নেই, হযরত আইয়ুবকে যা করতে বলা হয়েছিল তা একটি বাহানা ও ফন্দি এ ছিল কিন্তু তা কোন ফরয থেকে বাঁচার জন্য করতে বলা হয়নি বরং বলা হয়েছিল একটি খারাপ কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কাজেই শরীয়াতে একমাত্র এমন বাহানা ও ফন্দি জায়েয যা মানুষের নিজের সত্তা থেকে অথবা অন্য কোন ব্যক্তি থেকে জুলুম , গোনাহ ও অসৎ প্রবণতা দূর করার জন্য করা হয়ে থাকে। নয়তো হারামকে হালাল বা বাতিল অথবা সৎকাজ থেকে রেহাই পাবার জন্য বাহানাবাজি করা বা ফন্দি আঁটা অন্যায়।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
(১) বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার লাভ হয়। আর দুনিয়াতে দ্বীনদারীর কঠোরতা ও শিথিলতার তারতম্যের অনুপাতে পরীক্ষায় কমবেশী হয়ে থাকে। আর সে কারণে নবীগণ হলেন সবচেয়ে বেশী বিপদগ্রস্ত।
(২) প্রকৃত মুমিনগণ আনন্দে ও বিষাদে সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতের আকাঙ্ক্ষী থাকেন। আর বিপদে পড়লে তারা আরও বেশী আল্লাহর নিকটবর্তী হন। কোন অবস্থাতেই নিরাশ হন না।
(৩) প্রকৃত সবরকারীর জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা। আইয়ূব আঃ ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(৪) শয়তান প্রতি মুহূর্তে নেককার মানুষের দুশমন। শিরকী চিন্তাধারার জাল বিস্তার করে সে সর্বদা মুমিনকে আল্লাহর পথ হতে সরিয়ে নিতে চায়।
তথ্যসূত্র
১. তাফহীমুল কুরআন
২. নবীদের কাহিনী/ ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব
৩. হাদিসের নামে জালিয়াতী/ ড.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
৪. তাফসীরে ইবনে কাসির
৫. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১ম খন্ড