২৮ ফেব, ২০১৮

সিরিয়া ক্রাইসিসের আদ্যপান্ত

ছবিঃ আসাদ সরকারের বোমা হামলার পর বাচ্চাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি 

সাত বছর ধরে চলছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ইতোমধ্যেই পাঁচ লাখ লোক নিহত হয়েছে, আরো অন্তত পাঁচ লাখ আহত হয়েছে, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। অন্তহীন যুদ্ধে যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখনই একটা সমাধান হাতের কাছে বলে মনে হচ্ছিল। রাশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশের এগিয়ে আশায় এই আশার সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু তখনই আবার তীব্র হয়ে ওঠে সিরিয়া যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান এখন আসাদ সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবে নতুন মাত্রা হলো প্রকাশ্যে ইসরাইলের আগমন। আসাদ বাহিনীর বিপক্ষেই তাকে দেখা গেছে। বিমান হামলা পর্যন্ত করেছে। সিরিয়া আবার ইসরাইলি সামরিক ড্রোন ভূপাতিত করার কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও এখন স্বীকার করে নিচ্ছে।

সিরিয়ায় যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে তার এক পক্ষে আছে, সিরিয়ার বিগত ৪০ বছরের ধরে শাসনকারী আলাওয়াইটস গোত্রের নেতৃত্বে বাথ পার্টি এবং তাদের সমমনারা, অন্য দিকে আছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা, যাদের মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার ৬০% জনগোষ্ঠীর সুন্নি জনগোষ্ঠী এবং তাদের সমমনারা।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, রাশিয়া এবং চীন সকল বিষয়ে সিরিয়ার সরকার বাসার আল আসাদ এর পক্ষে থেকেছে এবং আমেরিকা বা তাদের ইউরোপিয়ান বন্ধুরা জাতিসংঘে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যত ধরনের প্রস্তাব এনেছে তার সব গুলোর বিরুদ্ধে তারা ভেটো দিয়েছে। আরব রাষ্ট্রদের প্রধান প্লাটফর্ম আরব লিগ শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল। আরব লিগ ইতিমধ্যেই সিরিয়া সরকার এর মেম্বার-শিপ বাতিল করেছে এবং বিদ্রোহীদের প্লাটফর্ম সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনকে মেম্বারশিপ দিয়েছে।

আলাওয়াইটস কারা?
সিরিয়ার ডেমো গ্রাফিক্স এর মধ্যে ৬৯% সুন্নি। এর মধ্যে ৯% কুর্দি বাকী ৬০% আরবীয়। ১২.৮% আলাওয়াইটস আরব, ১৩% ক্রিস্টিয়ান তার মধ্যে ৯% অর্থোডক্স এবং ৪% আর্মেনিয়ান, ড্রুজ আরব ৩.২% এবং ইসমায়লি শিয়া ৩%। 


আলাউই গোত্রকে ফরাসী শাসকদের ডাকা উচ্চারিত অপভ্রংশ থেকে আলাওয়াইটস নামটা এসেছে। ইতিপূর্বে তাদের নুসায়রী বলেই বেশি ডাকা হতো। নুসায়রী শব্দটা থেকে আলাউই শব্দটা বেশি গ্রহণযোগ্য কারণ আলাওয়াইটস শব্দটার মানে হজরত আলীর অনুসারী। বর্তমানে আসাদ এর বিরোধীরা, গালি দিতে গিয়ে আলাউইদেরকে নুসায়রী বলে ডাকে। শিয়া ধর্মে ১২ জন ইমাম এর একটা ধারা আছে যাদেরকে টুয়েল্ভার বা বারোদের অনুসারী বলা হয়। আলাউইদের ধর্মগুরু ইবনে নুসায়ের শিয়াদের ১২ জন ইমাম এর একজন।

যেভাবে শুরু হয় 
২০১০ এর ডিসেম্বর সালে যখন আরব বসন্তের আগমনে সারা আরব জাহান টালমাটাল, সিরিয়া তখন মোটামুটি শান্ত। অনেকে গবেষক মনে করেছিলেন, সিরিয়াতে আরব বসন্তের প্রভাব পড়বেনা কারণ, কারণ সিরিয়ার শাসন ব্যবস্থায় গত ৪০ বছর ধরে শক্ত কন্ট্রোল বজায় রেখেছে বাসার আল আল আসাদ এর নেতৃত্বে বাথ পার্টি। আর তাছাড়া সেখানে বাসার সেক্যুলার রাষ্ট্র কায়েম করায় অনেক সুন্নী মুসলিমেরও সমর্থন পেয়েছে। 

যাই হোক, খুব সামান্য একটা ঘটনা থেকে সিরিয়াতে প্রটেস্ট শুরু হয়। ২০১১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়। ১০/১২ জন ছেলে দেয়ালে সরকার বিরোধী চিকা মারার ঘটনার পর সরকারি বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করে টর্চার করে। তার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ হয় সেই বিক্ষোভে সরকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে। হতাহত হয় অনেক। কয়েকজন বিক্ষোভকারী মারা যায়। সেই সূত্র ধরেই বিক্ষোভ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পরে। বাসার আল আসাদ এর সরকারি বাহিনী ব্যাপক এগ্রেসিভ ভূমিকা নেয়। ফলে বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পরে এবং এপ্রিল মাসে আসাদ সারা দেশের শহরগুলোতে আর্মি এবং তার অনুগত সিক্রেট সার্ভিসকে মাঠে নামায়। যারা ট্যাঙ্ক , আর্টিলারি এবং হেলিকপ্টার গান-শিপ সহকারে দেশব্যাপী অপারেশন চালায়। মাত্র তিন মাসে ২০১১ সালের জুলাই নাগাদ প্রায় ১৬০০০ বিক্ষোভকারী নিহত হয় আসাদ বাহিনীর হাতে।

এরপর ঘটনা প্রবাহ এত জটিল হয়েছে যে তার সঠিক হিসেব রাখা মুশকিল। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, শহর দখল, দখল থেকে মুক্ত হওয়াসহ অনেক ঘটনার পালাক্রমে সাতবছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ বিদ্রোহী গেরিলা, নিরীহ জনগণ, সরকারী সেনা এবং সরকারী সমর্থক নিহত হয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা প্রথমে অগোছালো থাকলেও ধীরে ধীরে তারা টার্কি এবং সৌদি আরবের সাপোর্ট পেয়ে সংগঠিত হয় এবং সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করে। বিরোধীদের মধ্যে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১২০ গ্রুপ এবং উপগ্রুপ তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব থাকলেও আপাতত বিদ্রোহীরা একত্রিত হয়ে একটি অর্গানাইজড ফোর্স গঠন করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে সিরিয়ান সরকার এর অনেক সৈন্য পক্ষ ত্যাগ করে যোগদান করে। 

ফ্রি সিরিয়ান আর্মি: 
জুলাই ২০১১ সালে সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহীরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। এদের মূল লক্ষ্য ছিল সিরিয়ান বাসার সরকারের পতন। এই বিদ্রোহের ঘোষণার মধ্য দিয়েই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। যদিও ২০১১ সালে বিক্ষোভের বেশিরভাগ অসাম্প্রদায়িক দল ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সশস্ত্র সংঘাত ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়। সিরিয়ার অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান। কিন্তু সিরিয়া আলাউই সম্প্রদায়ের দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে শাসিত হয়েছে, আর আল-আসাদ ঐ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। অধিকাংশ সুন্নী জাতিগত বিরোধকে সামনে রেখে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়। 

ছবিঃ অস্ত্র ও পতাকা হাতে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যোদ্ধারা

১৯৮২ সালে বাশারের বাবা হামার মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর এক সামরিক অভিযানের আদেশ দেয়। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। এর জের ধরে ব্রাদারহুডের কর্মীরাও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়। 

২০১১ সালের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটি ভূমিকা পালন করেছে। ২০০৭ থেকে ১০ সালে সিরিয়া তীব্র খরা জর্জরিত ছিলো। যার ফলে প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষ গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরগুলোতে স্থানান্তরিত হয়, যা দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতাকে ত্বরান্বিত করে। এর ফলশ্রুতিতে গরীব মানুষরাও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়। 

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে, সিরিয়ায় সামরিক বাহিনী আলেপ্পোতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করে। তারপর থেকে FSA উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার সীমিত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি ফ্রি সিরিয়ান আর্মি কুর্দি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আফরিনকে তুরস্ককে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করছে। 

আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ: 
প্রথমে শুধু হালকা অস্ত্র এবং মর্টার বা এই ধরনের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করলেও ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি তুরস্ক থেকে প্রত্যক্ষ সাপোর্ট পায়। ২০১১ সালের অক্টোবরে সরকারি সেনাদের উপর ট্যাঙ্ক এবং হেলিকপ্টার সহযোগে প্রথম হামলা চালায় কোম শহর দখল করার জন্যে। এরপর থেকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি দেশের অনেক অংশ দখল করে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদেশী সমর্থন ও নগ্ন হস্তক্ষেপ বড় ভূমিকা পালন করেছে। রাশিয়া ২০১৫ সালে সংঘাতে প্রবেশ করেছে এবং আসাদ সরকার তখন থেকেই এর প্রধান সহযোগী ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া ইরান ও ইরাক সরকার এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ বাসার আল-আসাদকে সাপোর্ট করে। অন্যদিকে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেমন, তুরস্ক, কাতার, এবং সউদি আরব আসাদ বিরোধী গোষ্ঠীকে সাপোর্ট করে।

২০১৬ সাল থেকে তুরস্কের যোদ্ধারা ইস্লামিক স্টেট অফ ইরাক এবং ISIL এর বিরুদ্ধে তাদের সীমান্তে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থনপুষ্ট কুর্দিশ বাহিনির বিরুদ্ধেও।

যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই অস্ত্র দিয়ে আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সহযোগিতা করে। ২০১৪ সাল থেকে ISIL এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা করে। অনেকে মনে করেন ISIL প্রতিষ্ঠা করে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মাধ্যমে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নিজেদের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করে। 

ইসরাঈল সিরিয়ায় বোমা হামলা করে আসাদ সরকার ও হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। সিরিয়ান সেনাবাহিনী ইসরাঈলী বিমান ভূপাতিত করে। 

২০১৩ সালে CIA আসাদের বিরোধিতা করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র, তহবিল ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি গোপন প্রোগ্রাম শুরু করে। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর মাধ্যমে সিআইএ 500 মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। কিন্তু তারা প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছিল মাত্র ৬০ জন যোদ্ধাকে। 

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়া সিরিয়ায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ও ISIL কে "সন্ত্রাসী গোষ্ঠী" হিসাবে অভিহিত করে এদের বিরুদ্ধে বোমা হামলা শুরু করে। রাশিয়া আসাদের প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে। 

শান্তি আলোচনা
সিরিয়ায় একটি সামরিক যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্জনের জন্য সিরিয়ার সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু থেকেই অব্যাহতভাবে চলছে। 

জেনেভা: ২০১২ সালের জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সিরিয়ার সরকার ও বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে জাতিসংঘের সহযোগিতামূলক আলোচনার প্রথম রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। সিরিয়ার সরকার ও বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি পরিবর্তনশীল সরকারে আল আসাদের ভূমিকা কী হবে, এই আলোচনায় একমতে আসতে পারেনি বিধায় শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হয়। 

আস্টানা: ২০১৭ সালের মে মাসে রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক সিরিয়া মধ্যে সমঝোতা হয় একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরী হওয়ার ব্যাপারে। যেখানে সিরিয়ার এবং রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান ওড়া নিষিদ্ধ হয়েছিল। 

সোচি: ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে সিরিয়া সরকার আলোচনার প্রস্তাব দেয় কৃষ্ণসাগরের নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে। কিন্তু বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সেই শান্তি আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে। 

শরনার্থী পরিস্থিতি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাইতেও বেশি সময় ধরে চলছে এই গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ সময়ের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাবে, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) সিরিয়ায় ৫.৫ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে নিবন্ধিত করেছে। আনুমানিক ৬.৫ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে শরনার্থী হয়েছে। 

ছবিঃ বিভিন্ন দেশে শরনার্থীদের অবস্থান সূত্রঃ UNHCR

লেবানন, জার্মানি, ইরান এবং তুরস্ক সিরিয়ান শরনার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরো ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য। ২০১৭ সালে ৬৬ হাজার শরণার্থী সিরিয়াতে ফিরে আসে।

বর্তমান পরিস্থিতি:
আসলে সিরিয়া পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার সরাসরি সম্পৃক্ততায়। বিমান, নৌ ও স্থল সব বিভাগেই সর্বাত্মক হামলা শুরু করে রাশিয়া। তখন সিরিয়াই ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভালোভাবে পা রাখার একমাত্র স্থান রাশিয়ার কাছে। সেটি তারা হারতে চাইছিল না। আবার ইরান মনে করেছিল, সিরিয়ার পতন ঘটলে, সে মিত্র হারাবে। এই প্রেক্ষাপটে ইরান ও রাশিয়ার সরাসরি অংশগ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক ও সৌদি আরব-সমর্থিত বিদ্রোহীরা বেশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। এই গত ডিসেম্বরে আলেপ্পোর পতন ঘটলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটটি ভয়ঙ্কর আঘাত পায়।

ছবিঃ কোন অংশ কোন পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করছে তার চিত্র। সূত্রঃ আল জাজিরা

তবে এখন সব পক্ষই বুঝতে পেরেছে, সামরিকভাবে সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান হবে না। সমাধান করতে হবে আলোচনার টেবিলে বসে। কিন্তু শান্তি আলোচনার ভিত্তি কী হবে? আরব বসন্তের সময় আসাদ ছিলেন বেশ কোণঠাসা। যেকোনো মুহূর্তে রাজধানী দামেস্কের পতন হতে পারে বলে ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি মুখরক্ষা করে কেটে পড়তেও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বারাক ওবামা সেটা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তো সেটা হয়ে যেত। কিন্তু ইরান, রাশিয়া এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ যে সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে, সেটা ওবামাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। 

যতই দিন গেছে, আসাদের শক্তি বেড়েছে। এখন তারা বেশ শক্ত অবস্থানে। আবার নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কখন কী করেন তা বোঝার উপায় নেই। তবে এটা সত্য, তিনি ওবামার মতো সিরিয়া নিয়ে ভাবতে নারাজ। এতে করে এত দিন সিরিয়ায় যেসব গ্রুপ মার্কিন সহায়তায় ভালো অবস্থায় ছিল তারা বেশ সমস্যায় পড়ে যায়।

এমন প্রেক্ষাপটেই এখন তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়েছে সিরিয়া। শান্তি আলোচনায় নিজ নিজ গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। আর এ কারণেই সবাই লড়াই তীব্র করতে চাইছে। আলেপ্পো থেকে বিদায় নেয়ার পর আসাদবিরোধীরা এখন অন্যান্য স্থানে হামলা জোরদার করতে চাইছে; কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে। 

এদিকে রাশিয়াও তার ঘাঁটির সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না। যুদ্ধের মধ্যেই আসাদ সরকারের সাথে তারা চুক্তি করে নিচ্ছে। ইরান তার প্রভাব বৃদ্ধির প্রক্রিয়াতে সচেষ্ট। 

অন্য দিকে তুরস্কও সিরিয়ার দিকে নজর দিয়েছে। তবে যুদ্ধের শুরুতে তুরস্ক ছিল প্রচণ্ডভাবে রুশবিরোধী। কিন্তু এখন পুতিনের সাথে এরদোগানের চমৎকার বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই বোঝাপড়াও সিরিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ।

২৫ ফেব, ২০১৮

পিলখানা ট্রাজেডিঃ বাংলাদেশ যেদিন হেরে গেল



২০০৯ সালে ঢাকার পিলখানায় দেশের ৫৭ জন চৌকস সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যা কি শুধুমাত্র  বিডিআর জওয়ানদের ডাল ভাত কর্মসূচীর অপ্রাপ্তি থেকে তাৎক্ষনিক ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ? এটা কি স্রেফ একটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? নাকি অতীতের কোনো ঘটনার যোগসূত্র থেকে এই নির্মম ট্রাজেডির প্রকাশ্য দিবালোকে মঞ্চায়ন? এতদিনেও এসব প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়নি অথবা কোন গোষ্ঠীর কারণে সুরাহা করা হয়নি।

এই ঘটনার পর তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ওইসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জাতিকে জানানো হয়নি। তবে ওই তিনটি কমিটির একটি কমিটির সুপারিশে রাতারাতি একটি ঐতিহ্যবাহী আধা সামরিক বাহিনীর পোশাক এবং নাম পাল্টে ফেলা হয়। আর কোনো দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আমরা দেখিনি। অথচ ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের ওই ঘটনা ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্যতম, নির্মম, নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও সেনাবাহিনীর এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা নিহত হননি। অথচ এক সকালেই আমরা হারালাম আমাদের সেনাবাহিনীর ৫৭জন চৌকস এবং মেধাবী কর্মকর্তাকে। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হল সেনাবাহিনীর।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআরে কর্মরত কর্মকর্তারা কারো জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কি না অথবা কারও জন্য হুমকি ছিল কি না সেটা তাৎক্ষণিক ও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যেকোনো হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেহেতু উদ্দেশ্য (মোটিভ) থাকতে বাধ্য, তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে কার পক্ষ থেকে কী মোটিভ থাকতে পারে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। এখানে কিছু অফিসার ছিলেন যাদের সাথে বিডিআরের বিক্ষোভের কোন কারণ ছিল না। এমন একজন ছিলেন কর্নেল গুলজার। অথচ তাদের উপর ক্ষোভ ঝাড়া হয়েছে অনেক বেশি। তার দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তার চেহারা বিকৃত করে ফেলা হয়েছে।   

সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের এতগুলো কর্মকর্তাকে একসাথে হত্যা কোনো কাকতালীয় ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। ৬৩জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেধা ও সক্ষমতাকে করা হয়েছে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ। পিলখানার ঘটনা যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেবার জন্যই যে ঘটানো হয়েছিল তা আজ দিবালোকের মতই স্পষ্ট। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্র। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে এটা এক ধরণের প্রতিশোধও বটে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধে ১৫০ জন বিএসএফ নিহত হয়। এর আগে পাদুয়ায় নিহত হয় ১৫ বিএসএফ। বিডিআর সেই সময়ের ডিজি মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানের নির্দেশে ঐ যুদ্ধে অংশ নেয় বিডিআর জওয়ানরা।

ওই ঘটনার পর ভারতের সেই সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান, ‘এ ঘটনার বদলা নেয়া হবে।’ এই বদলা কি সেই বদলা কিনা তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ওই ঘটনা দমনে কেন সেনাবাহিনী ডাকা হলো না এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। অনেক সাবেক সমর বিশেষজ্ঞ তখন বলেছিলেন, সেনাবাহিনী সেখানে মুভ করা হলে প্রাণহানির মত ঘটনা আরো কমানো যেত। কিন্তু সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সেই সময়ের আলোচিত সেনা প্রধান মইন উ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তখন তিনি নাকি নিজের ইচ্ছায় চাইলেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাহলে ইচ্ছাটা কার ছিল? এটাও একটা বড় প্রশ্ন হিসেবেই থেকে গেল।  

সম্প্রতি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির লিখা একটা বইতে তিনি বলেছেন, জেনারেল মঈনকে হাসিনার নিরাপত্তা ও মুক্তি দিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি বিনিময়ে তার জীবনের ও চাকরীর জিম্মাদার হওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। এই সব ঘটনা একত্র করলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।   

ওই ঘটনায় সেনা কর্মকতাদের যেভাবে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা দেখে যে কারো মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে জওয়ানরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন অফিসারদের প্রতি। কিন্তু দীঘদিনের একটা পেশাদার ও শৃঙ্খল বাহিনীর জওয়ানরা যতই কথিত বৈষ্যম্যের স্বীকার হলেও এভাবে তাদের অফিসারদের প্রতি জিঘাংসা চরিতার্থ করবে এটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয় ঘটনা। শুধু কি তাই! পিলখানায় তখন অবস্থান করা অনেক নারী শিশুই সেদিন পাশবিকতার শিকারও হয়েছিলেন। একটি প্রচলিত বাহিনীর একজন সৈনিক দ্বারা ঘটা একেবারেই ব্যতিক্রম প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ কি জওয়ানরা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল?
দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান একজন জেনারেল সহ একাধিক ব্রিগেডিয়ার, কর্ণেল, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদবীর অফিসারকে হত্যা করা সত্বেও উক্ত হত্যাকারীরা সরকারের তরফ থেকে সাধারন ক্ষমা লাভ করে। সরকারের হাতে সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার কমান্ডো, ট্যাংক, এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ইত্যাদি মজুদ থাকা সত্বেও রহস্যজনক কারনে সেনাবাহিনীর এতগুলো অফিসারকে রক্ষা করার জন্য কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা না করা কতখানি যৌক্তিক বা সঠিক হয়েছে তা অনেক বড় প্রশ্ন হিসেবেই থাকছে। 

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল তা যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর চরম আঘাত তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। ওইদিন বিডিআর সদর দফতরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে যে বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে ত সহজে পূরণ হবার নয়। পিলখানার মত সুরক্ষিত এলাকায় নির্মমভাবে প্রাণ হারালেন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। 

শুধুই ডাল-ভাতের জন্য বিডিআর জওয়ানরা এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল,  এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। জওয়ানরা ছিল নিমিত্ত মাত্র। এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে দেশি- বিদেশী চক্রান্ত কাজ করেছে। ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এমনটা ইংগিত করা হয়েছে। 

সেদিন যা ঘটেছিল? 
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল নয়টায় সদর দপ্তরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ৫৬০ জন।

দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে সকাল নয়টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।

এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তাঁরা মাইকে জানায়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।

আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তাঁরা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।

২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।

মামলার বিচার
পিলখানা বিদ্রোহের পর বদলে গেছে অনেক কিছু-বাহিনীর নাম, পোশাক, আইন। ১৭ হাজারের বেশি জওয়ানের সাজা হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন সাড়ে ১৪ হাজার। হত্যা মামলায় আসামি করা হয় ৮৫০ জনকে। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় এই হত্যা মামলার বিচার শেষে বিচারিক আদালত রায় দেন ২০১৩ সালে।
এরপর হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর হাইকোর্ট রায় দেন গত বছরের নভেম্বরে। তাতে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদুল আলমসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ১৮৫ আসামিকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যাঁদের মধ্যে ৩১ জন বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস পেয়েছিলেন। হাইকোর্টের রায়ে ৪৫ জন সাজা থেকে খালাস পান। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল ও দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় আরও ২০০ আসামিকে।

এর মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। তবে হত্যা মামলার বিচার এগোলেও ওই ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলাটির বিচার এখনো শেষ হয়নি। এটি এখন সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে।

হত্যা মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম জাহিদ সারওয়ার বলেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন থেকে খালাস পাওয়া আসামিদের ক্ষেত্রে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৪ আসামি পলাতক রয়েছেন। ৫৮৮ আসামি কারাগারে আছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের সাজা হয় বাহিনীর নিজস্ব আইনে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রত্যেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর বেকসুর খালাস পাওয়া ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন।

বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বলেন, এই বিদ্রোহের পেছনে আসলে কারা ছিল, কারা এসব করল-তা এত দিনে মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়নি। তিনি বলেন, শুধু কি জওয়ানেরা গুলি করেছিল? কারা তাদের পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়ল? এসব নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। তা যদি ভুল হয় তা হলে সরকারের দায়িত্ব সেই ভুল সংশোধন করে দেওয়া। তা না হলে দিনে দিনে সেই ভুলই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর পুরো বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়। বিডিআর নাম পাল্টে করা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সরকারি সহায়তাও পায় নিহত কর্মকর্তাদের পরিবার। তারপরও স্বজনহারাদের মনের ক্ষত কোনো দিন মুছে যাওয়ার নয়।

এক নজরে বিচারিক আদালতের রায়
ঘটনা: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিহত: ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন 
রায়: ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর 
দণ্ড: ১৫২ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ১৬১ জনের। ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা ২৫৬ জনের। খালাস ২৭৮ জন। সর্বমোট সাজা ৫৬৮ জনের।

নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে, ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। হাইকোর্ট ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিনে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

একনজরে হাইকোর্টের রায়

রায়: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ 
দণ্ড: ফাঁসি বহাল ১৩৯ জনের, যাবজ্জীবন ১৮৫ জনের, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস ৪৫ জন।

যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও মেলেনি 
১- ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল আটটায়। কিন্তু কেন দরবার এক ঘণ্টা পিছিয়ে সকাল নয়টায় করা হয়, তা আজও অজানা।

২- ঘটনার সময় দরবারে থাকা একটি ভিডিও ক্যামেরার কথা সাংবাদিকদের বলেছিলেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু ক্যামেরাটি উদ্ধার হয়নি।

৩-বিদ্রোহের সময় প্রথম যে অস্ত্রটি নিয়ে সিপাহি মঈন দরবারে এসেছিল, তা শনাক্ত হয়নি।

৪-বিদ্রোহের সময় সেনা সদস্যরা পিলখানায় এসে গুলি ছুড়েছিলেন বলে সেনাবাহিনীর তদন্তে বলা হয়েছিল। কিন্তু মামলার তদন্তে তা আসেনি।

৫-তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সাক্ষ্য দেননি।

৬-অনেক সেনা কর্মকর্তা ঘটনার পর গণমাধ্যমের সামনে নানা বিষয়ে কথা বললেও তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি

৭- ঘটনা ঘটার পর প্রায় ১০০ জন সেনা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কেন? 

৮- ২৫ ফেবু্রয়ারি সকালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি গোয়েন্দা তথ্য পাঠানো হয়েছিল? এই ঘটনার আভাস কি ডিজিএফআই পায় নি?

৯- বিডিআরের প্রয়াত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ কি কথা হয়েছিল? 

১০- প্রধানমন্ত্রী কেন ২৬ ফেবু্রয়ারির ডিনারে যেতে অস্বীকার করেছিলেন? 

১১- ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি কার নির্দেশে বিডিআর হেডকোয়ার্টারের আশপাশের লোকজনকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়েছিল? 

১২- ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কেন লে. কর্নেল মুকিত বিডিআর সদর দফতর থেকে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়েছিলেন?

১৩- বিডিআর সদর দফতরের ৫ নম্বর গেটে সেদিন কেন পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়নি? 

১৪- প্রধানমন্ত্রী কেন ঘটনা জানার ৪ ঘণ্টা পর নানক এবং আজমকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন? অথচ এটা কোন রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না। এটা ছিল একটা সামরিক সমস্যা।

১৫- বিডিআর বিদ্রোহীদের যে প্রতিনিধিদলটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তাদের নাম-ঠিকানা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢোকার সময় কেন সংরক্ষণ করা হয়নি? 

১৬- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিদ্রোহীদের নেতা ডিএডি তৌহিদ জানিয়েছিলেন বিডিআর ডিজিসহ কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে-এ বিষয়টি কেন ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত গোপন করা হলো? 

১৭- বাংলাদেশ টেলিভিশন সেদিন বিদ্রোহের ঘটনা কেন প্রচার করেনি? কার নির্দেশে?

১৮- বিদ্রোহীরা কেন প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের নেত্রী বলে উল্লেখ করেছিল?

১৯- কিছু বিদ্রোহী কেন আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান 'জয় বাংলা' বলে স্নোগান দিয়েছিল?

২০- প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ২৭ ফেবু্রয়ারি কেন পালিয়ে যাওয়া কিছু বিদ্রোহীর সঙ্গে দেখা করতে দুবাই এসেছিলেন? 

২১- আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জয় কেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করলেন? 

২২- প্রধানমন্ত্রী বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিলেন না? 

২৩- ২৬ মার্চ আত্মসমর্পণের পর রাতের অন্ধকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য নেতা কেন বিডিআর সদর দফতরে গিয়েছিলেন?

২৪- ঘটনার দিন সকাল ১০টায় র‍্যাব ও সেনাবাহিনী পিলখানা গেইটে গেলেও কেনো তাদের অপারেশনের অনুমতি দেওয়া হয়নি?

২৫- বিকালবেলা আর্মি এবং এয়ারফোর্স ধানমন্ডি অবস্থান করলেও কেনো তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়? অথচ তখনো অপারেশন চালানো হলে কিছু অফিসার রক্ষা পেত। আর না হলেও অন্তত মূল অপরাধীদের সনাক্ত করা যেত। 

২৬- তৎকালীন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ভুমিকা কি ছিল? সারাদিন কোন ভূমিকা না নিলেও কেনো সন্ধার পর বাতি নিভিয়ে কালোগ্লাসের বুলেটপ্রুফ গাড়ী আর মেডিক্যাল টিম নিয়ে প্রবেশ করেন? 

২৭- কেন এতগুলো চৌকস অফিসারকে একসাথে এখানে জড়ো করা হলো? জেনারেল মঈনের অপকর্মের সাক্ষী অফিসারগুলিকে একসাথে গণকবর দিতেই কি এই উদ্যোগ? 

২৮- শেখ হাসিনার যখন সেনা অফিসাররা যখন মুখোমুখি হয়েছিল তখন কর্নেল জামান বলেছিলেন, “১৬৮আর্মি অফিসার
বেরিয়ে আসতে পারলাম না, ৯ হাজার বিডিয়ার সৈন্য আপনাদের পাহারা থেকে বেরিয়ে আসলো কিভাবে”?-

এতগুলো অসঙ্গতি থাকায় এই মামলা ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে এর সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশ এবং সরকারের একটা অংশ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার সার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি কখনোই হয়নি। আজও সরকার এই ট্রাজেডিকে নিয়ে একেবারে নীরব। কথা বলেও দায়সারাভাবে। তবে জনগণ মনে করে সরকারের পরিবর্তন হলে এই ট্রাজেডির ধোঁয়াশা কেটে যাবে। সত্য উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশ তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে পারবে।