১৩ জুন, ২০১৮

আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের শাসন ও পতন

Add caption
আফগানিস্তান মানেই আমাদের মনে হয় আগাগোড়া ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু আসলে তা ছিল না। আফগানিস্তানে যেমন ইসলামপন্থীদের উত্থান হয়েছে তেমনি কমিউনিস্টদেরও উত্থান হয়েছে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সেখানে ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এর একটি বড় কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আফগানিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আর অন্য কারণ ছিল সেসময় পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এটি ছিল একটি জনপ্রিয় আদর্শ।

আফগানিস্তানে স্বৈরশাসককে উৎখাত করে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে ১৯৭৮ সালে। মুহাম্মদ দাউদ খান ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের শাসন। এই সময় আফগানিস্তান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপিএ) শাসন করেছে। সাওর বিপ্লবের মাধ্যমে এই দল ক্ষমতায় আসে। এই বিপ্লবে মুহাম্মদ দাউদ খানের সরকার উৎখাত হয়।

দাউদ খানের পতনের পর পিডিপিএ প্রধান নূর মুহাম্মদ তারাকি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হন। তারাকি ও হাফিজউল্লাহ আমিন তাদের শাসনামলে বেশ কিছু সংস্কার করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে নারী অধিকার, শিক্ষা ও ভূমি সংস্কার।

ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে তারা জনগণের বিপক্ষে চলে যায়। জনগণ তাদের এই সংস্কার কার্যক্রম ভালোভাবে নিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে তখন জনগণ কমিউনিস্টদের অসাধুতা ও প্রতারণার সাথে পরিচিত হয়। একই সাথে তারাকী ইসলামপন্থীদের নির্মুলে গনহত্যা শুরু করে। প্রায় ২৭০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় তারাকি।

কমিউনিস্টদের একটি বড় জনসমর্থন ছিল আফগানিস্তানে। সেসময় আফগানিস্তান জামায়াতের আমীর শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লিখালিখি ও বক্তব্য দিয়ে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট বিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। যখন জনগণ তারাকী গংদের সম্পদ লিপ্সা ও রক্তলিপ্সা দেখতে পায় তখন জনসমর্থন জামায়াতের দিকে আসতে থাকে।

এদিকে আবার কমিউনিস্টরা মধ্যে দুটো দলে বিভক্ত ছিল। তারা ক্ষমতা গ্রহণের পর শীঘ্রই তারাকি ও আমিনের নেতৃত্বাধীন খালকপন্থি এবং বাবরাক কারমালের নেতৃত্বাধীন পারচামপন্থিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব্ব শুরু হয়। খালকপন্থিরা এতে জয়ী হয় পারচামপন্থিরা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়। অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য পারচাম নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্বাঞ্চলীয় ব্লকে পালিয়ে যান।

খালক-পারচাম দ্বন্দ্ব্বের পর এবার খালকপন্থিদের অভ্যন্তরে তারাকি ও আমিনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব্ব শুরু হয়। আমিন এই দ্বন্দ্ব্বে জয়ী হন এবং তার নির্দেশে তারাকিকে হত্যা করা হয়। তারাকি গণহত্যা ও ভূমি সংস্কারের ফলে দেশে অজনপ্রিয় ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নেও সে জনপ্রিয় হতে পারেনি।

ইতিমধ্যে তারাকি ও আমিনের ইসলাম বিরোধী অবস্থান ও জনগণের সম্পদ রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করার কারণে সেনাবাহিনী থেকে ইসলামপন্থীরা ও দেশপ্রেমিকরা পদত্যাগ করে। আফগানিস্তান জামায়াতের নেতৃত্বে মুজাহিদিন বাহিনী গঠিত হয়। যারা আফগানিস্তানকে কমিউনিস্টদের হাত হতে রক্ষা করার জন্য লড়াই শুরু করে।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে জামায়াত নেতৃত্বাধীন মুজাহিদিন গ্রুপকে দমন করার জন্য আফগান সরকারের সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করে। ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর হাতে আমিন নিহত হন। এরপর পালিয়ে যাওয়া পারচাম নেতা কারমালকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের নতুন নেতা বানায়। কারমাল ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামল সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের জন্য পরিচিত।

১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আফগানিস্তান থেকে "সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি এবং নি:শর্ত প্রত্যাহারের" দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করে, অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪–১৮ ভোটে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত সেনাদের হাতে ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু এসময় পাকিস্তান ও ইরানে পালিয়ে যায়। ১৯৮০ সালের এপ্রিল একটি সংবিধান প্রণীত হয় এবং সমর্থন মজবুত করার জন্য দলের বাইরে থেকে সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কারমালের কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে শান্তি আনয়ন করা যায়নি। ১৯৮৬ সালে মুহাম্মদ নজিবউল্লাহ দলের মহাসচিব হিসেবে কারমালের উত্তরসুরি হন।

নজিবউল্লাহ বিরোধীদের সাথে সমঝোতা চেষ্টা করেন। ১৯৮৭ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮৮ সালে আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুজাহিদিনরা এই নির্বাচন বয়কট করে এবং যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।

নজিবুল্লাহ তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নানান পলিসি এপ্লাই করে। নজিবুল্লাহ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ওয়াতান পার্টিতে রূপান্তর করে। দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার ঘোষণা পর্যন্ত দেয়। কিন্তু কোন কিছুই তার পক্ষে যায় নি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপে জেনেভা চুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয়।

চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত সেনাদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় নাজিবুল্লাহ। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাগাদ আফগানিস্তান ত্যাগ করে সোভিয়েত সেনারা। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর সরকার ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

সোভিয়েত সেনারা চলে যাওয়ার পর খালকপন্থী কমিউনিস্টরা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। নানামুখী সমস্যা ও মুজাহিদিনদের প্রবল আক্রমণে অবশেষে নজিবুল্লাহ পদত্যাগে আগ্রহী হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে নজিবউল্লাহ তার সরকারকে পদত্যাগের প্রস্তাব দেন। জাতিসংঘের সাথে এক সমঝোতার পর তার সরকারের পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নজিবউল্লাহর পদত্যাগের পর আবদুর রহিম হাতিফ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান হন। মুজাহিদিনদের হাতে কাবুলের পতনের পূর্বে নজিবউল্লাহ জাতিসংঘের কাছে ক্ষমা চাইলে তা মঞ্জুর করা হয়। নজিবউলাহ কাবুলের স্থানীয় জাতিসংঘ দপ্তরে আশ্রয় নেন।

মুজাহিদিনদের সাথে যুদ্ধে আফগান কমিউনিস্ট সরকার ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। আফগানিস্তানের সরকারি হিসেবে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে ২,৫০,০০০ এবং আফগান সরকারের হাতে ১,৭৮,০০০ ব্যক্তি নিহত হয়।

কমিউনিস্টদের পতনের পর ১৯৯২ সালে কমিউনিস্ট বিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে জামায়াতে ইসলামীর আমীর শহীদ বুরহানউদ্দিন রব্বানী ইসলামী প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সরকার স্থায়ী হয়নি পশতুন জাতীয়তাবাদী নেতা গুলুবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হটকারিতা ও সিআইএ সৃষ্ট আল কায়েদা কর্তৃক ষড়যন্ত্রের কারণে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন