২৭ জুন, ২০১৮

যেভাবে একটি স্কুল মসজিদে পরিণত হলো



নোয়াখালী ছেড়ে বাসটি যাবে ঢাকা। আমি পথিমধ্যে চড়ে বসলাম। নিজের আসন বুঝে নিয়ে মাত্র আরাম করে চোখ বন্ধ করলাম। তখনি বাসটি কিছু যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু যাত্রী তোলা বাদ দিয়ে চলছে গ্যাঞ্জাম। কৌতুহলী হয়ে দরোজার দিকে তাকালাম। দুজন নারী উঠলেন, আবার নামলেন। গ্যাঞ্জাম তখনো চলছে।

তারপর আরেকজন উঠলেন। আরে, এ যে আমারই সহকর্মী বন্ধু। বুঝলাম গ্যাঞ্জাম তার সাথেই হয়েছে। সে বাসে উঠে তখনো সমানে মুখ চালিয়ে যাচ্ছে। ভুল ছিল সুপারভাইজারের। এতক্ষণে সে ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইতে লাগলো।

আমার আসন ছিল বাসের একেবারে সামনের দিকেই। আমি মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যাতে করে সে আমাকে দেখতে না পায়। একটু মজা করার চিন্তা করলাম। আড় চোখে দেখলাম সে তার সিটে গিয়ে বসেছে। হাতে মোবাইল ফোন।

আমি তাকে মেসেজ করলাম, 'বাসে উঠে এভাবে রাগ করতে হয় না'। সে সচকিত হয়ে মাথা ঘুরাতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড পরই বুঝতে পারলো এই বাসে আমিও আছি। আমি কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকেই তাকিয়ে আছি।

সে তার সিটে বসে আমাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। অবশেষে হেঁটে আমার সিটের সামনে আসলো। দুজনেই হেসে উঠলাম। মুহুর্তেই একটি বিরক্ত মুখ হাসিমুখে পরিণত হলো।

প্রতিটা ঈদের পর পরই বেজে উঠে বিচ্ছেদের সুর। ঈদ আমাদের জন্য বিরাট রহমত। বিশেষ করে আমরা যারা পরিবারের সাথে থাকি না। ঈদ উপলক্ষে আমাদের সুযোগ হয় প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাবার।

আর এবার আমার জন্য বিচ্ছেদ যে অন্যান্য বারের চাইতে অনেক বেশি সে কথা সহজেই অনুমেয়।

বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসার পথে সহকর্মীকে পেয়ে বিচ্ছেদ অনেকটাই বন্ধনে পরিণত হয়েছে। সহকর্মীর অনুরোধে নিজের বাসায় না গিয়ে রাতে তার বাসায় দাওয়াত নিলাম।

পরদিন সে আমাকে বললো মসজিদ দেখবে আমার সাথে। আমি যেভাবে পুরাতন মসজিদ দেখি। বললাম ঠিক আছে, তাই হবে।

কোন মসজিদে যাবো? কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে পেয়ে গেলাম একটি নাম 'খান মুহাম্মদ মৃধা' মসজিদ। অনলাইনে ছবি দেখে দারুণ লোভ হয়েছে দেখার। সেজেগুজে বের হয়ে পড়লাম।

ফাঁকা রাস্তা। ঢাকা তখনো অবগুণ্ঠন খুলে নি। ঝিরি ঝিরি বাতাস। এমন সময়ে রিকশা ভ্রমণ খুবই আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যকর। গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

দেখেই মনে হয়েছে এটা একটা দুর্গ। তিন গম্বুজঅলা এই মসজিদটির অন্যতম বিশেষত্ব হলো এটি প্রায় সতের ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত। মসজিদটি যে যুগে নির্মিত সে যুগে দোতলা মসজিদ নির্মিত হওয়ার নজির নেই। কিন্তু মসজিদটি দোতলায় নির্মিত।

নিচের তলায় অনেকগুলো কক্ষ। সেই কক্ষগুলোকে ভিত্তি করে উপরে অনেকটা মঞ্চের মত করে স্থাপনাটি তৈরী করা হয়েছে। মঞ্চের উপর মুঘল রীতিতে নির্মিত ৪৮ ফুট বাই ২৪ ফুট ক্ষেত্রবিশিষ্ট মসজিদ। দোতলায় মানে মঞ্চে যেমন প্রশস্ত আঙিনা রয়েছে তেমনি নিচে আরো বড় আঙিনা রয়েছে।

আমরা প্রথমে ভেবে নিয়েছি পুরো স্থাপনা একটি দূর্গ। নিচের কক্ষগুলোতে সৈন্যরা থাকতো। কিন্তু আবার খটকা লাগলো লালবাগ কেল্লা এত কাছে থাকতে এখানে আবার কেন ছোট দূর্গ স্থাপনের প্রয়োজন হলো!

বাসায় ফিরে এই মসিজদ নিয়ে পড়তে লাগলাম। পরে জানতে পেরেছি এটা ছিল একটি স্কুল/ মাদ্রাসা। আগের দিনে যেখানে জ্ঞান চর্চা হতো।

মসজিদটির উত্তর-পূর্বদিকে নির্মিত কক্ষগুলো শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মঞ্চের উপর তিন গম্বুজ মসজিদ ও স্কুল ভবন ছাড়া অবশিষ্ট উন্মুক্ত অংশও শিক্ষার্থীদের পাঠদান কাজে ব্যবহৃত হতো।

মঞ্চের নিম্নস্থ কক্ষগুলো মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের বাসস্থান হিসেবে নির্মিত হয়েছে। এটি খুব নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। ধারণা করা হয় খান মুহাম্মদ মৃধা এই স্কুলের প্রধান পন্ডিত ছিলেন।

বর্তমানে এটি মসজিদ হিসেবে পরিচিত হলেও মসজিদ ছিল এখানে গৌণ। মূল ব্যাপার ছিল স্কুল। এই স্কুলটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বাংলার সুবেদার ছিলেন সম্রাট ফররুখ শীয়ার। অবশ্য তিনি তখনো মুঘল সম্রাট হননি। তখন সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব বা আলমগীর। ফররুখ শীয়ার ছিলেন আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র।

ফররুখ শীয়ার যখন বাংলার সুবেদার তখন ঢাকার প্রধান কাজী ছিলেন কাজী ইবাদুল্লাহ। কাজী ইবাদুল্লাহ ঢাকার সন্তানদের সুশিক্ষিত করার জন্য স্কুলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি সুবেদারের কাছে আবেদন করলে ফররুখ শীয়ার তা মঞ্জুর করে ও অর্থ বরাদ্দ করেন।

কাজী ইবাদুল্লাহ সেই অর্থ পন্ডিত খান মুহাম্মদ মৃধাকে দিয়ে একটি স্কুল নির্মানের নির্দেশ দেন। পন্ডিত সাহেব তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। মসজিদটি ছিল স্কুলের মসজিদ।

ইংরেজরা ঢাকা দখল করার পর মুসলিমদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় স্কুলটি বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত স্কুলটি বন্ধই রয়েছে। এখন পুরো স্কুল মসজিদে পরিণত হয়েছে। দোতলার শেণিকক্ষগুলো এখন মসজিদের খাদেমদের থাকার জায়গা। আর নিচতলার কক্ষগুলো ব্যবহৃত হয় লালবাগ কেল্লার কর্মচারীদের হোস্টেল হিসেবে।

খান মুহাম্মদ মৃধা মসজিদ আপনার ভালো লাগবে। বিশেষ করে দোতলায় উঠার জন্য সিঁড়ির ২৩ টি ধাপ আপনাকে নিয়ে যাবে সেই মুঘল আমলে। স্মরণ করিয়ে দেবে ইসলামী ঐতিহ্যের সেই দিনগুলোর কথা।

কৃতজ্ঞতা ও মাগফেরাত কামনা করছি তাদের জন্য যারা আমাদের প্রিয় শহরকে ইসলামের শহর হিসেবে তৈরী করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাত নসীব করুন। আমীন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন