১৪ আগ, ২০১৮

বাংলা বিহার উড়িষ্যার ১ম নবাবের তৈরি মসজিদের গল্প

করতলব খানের মসজিদ

একের পর এক রিকশাওয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছে আমাদের। কেউ চিনে না সেই মসজিদ। ঘটনা কি? ভাবলাম ভুল নাম বলছি কি না। আবারো গুগুল মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম। না ঠিকই তো আছে। মসজিদের নাম করতলব খানের মসজিদ। পুরান ঢাকার বেগমবাজারে। 

এক রিকশাওয়ালা মামা বললেন পুরানা মসজিদ মানে কি চকবাজার শাহী মসজিদের কথা বলছেন? 
-আরে না চকবাজার না। বেগমবাজারে। আমি আসলে তখনো জানতাম না বেগমবাজার আর চকবাজার যে কাছাকাছি।  

যাই হোক এক প্রায় বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা মামা আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন। আমাদের তিনজনেরই সাইজ খারাপ না। জিজ্ঞাসা করলাম মামা পারবেন তো? তিনি বললেন এই রিকশায় দশ মণ অনায়াসে পার করি। আপনারা তিনজন কিছু না। এবার আমরা আমাদের তিনজনের ওজন যোগ করে দেখলাম মোটে সাত। দশ মণ হতে ঢের বাকী। 

যাই হোক, আমরা চলতে শুরু করলাম। রিকশাওয়ালা মামা যতটা সহজ মনে করেছিলেন আসলে ততটা ছিল না। বেশ কয়েকটি উঁচু নিচু স্থানে আমরা নেমে ওনার বোঝা হালকা করেছি। 

পুরনো দিনের ছবি


বেগমবাজার জেল রোডে এসে গেলাম। পুরাতন কেন্দ্রীয় জেলখানার সামনে। এখানে এখন একজন মাত্র বন্দি। বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। খালেদার জন্য আফসোস করছি, এমন সময়ে গলির ফাঁক দিয়ে ধরা পড়লো সেই মসজিদ। গুগলে যেরকম ছবি দেখেছি সেরকম। ব্যস ব্যাপারটা  সহজ হয়ে গেলো। 

আসলেই সহজ হলো। এই মসজিদটির নাম করতলব খান মসজিদ হলেও স্থানীয়রা একে বেগমবাজার মসজিদ নামেই চিনে। করতলব খান করতে করতে জীবনপাত করলেও মনে হয় মসজিদ বের করতে পারতাম না। আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়লাম। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগের আকার নেই। সংস্কার হয়েছে। মসজিদ বড়ও হয়েছে। 

এ পর্যন্ত যত মসজিদ দেখেছি এর মধ্যে এটাকে বেশ ভালোই লেগেছে কারণ এর সংস্কারের মধ্যে পুরোনোর আভিজাত্য রয়েছে। 

করতলব খাঁ কে ছিলেন? 
করতলব খাঁ এই নামটা আমি প্রথম পেয়েছি মসজিদ খোঁজ করতে গিয়েই। গুগোলে সার্চ করলাম ঢাকার পুরোনো মসজিদ লিখে। অনেক মসজিদের পাশে এই মসজিদের নাম পেলাম। করতলব খান মসজিদ। যদিও করতলব খান নামটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল আসলে তিনি কিন্তু অপরিচিত নন। 



তিনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার প্রথন স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খান। এই সিলসিলার শেষ নবাব হলেন সিরাজ উদ দৌলা।  

মুর্শিদকুলি খান ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। আসলে তিনি নবাব ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুঘলদের দেওয়ান প্রশাসক। আওরঙ্গজেব তাকে বাংলায় নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেবের ছেলেরা ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে বাংলায় তাদের আর প্রভাব থাকে না। কেন্দ্রীয় শাসন নষ্ট হয়ে যায়। সেই সুবাধে মুর্শিদকুলি খান হয়ে উঠেন স্বাধীন নবাব। 

মুর্শিদকুলি খানকে হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি তার যোগ্যতা ও ইসলামপ্রিয়তার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেন।  

১৭০০-১৭০৪ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। দিল্লির তুলনায় ঢাকা সেসময় ছিল অজগাঁ। তিনি এখানে নিজেকে ইসলামের প্রসারে নিয়োজিত করেন। দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন মুসলিমদের মধ্যে। ঢাকায় তিনি মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি তার নামে প্রথমে মুর্শিদকুলি খাঁ নাম হয়। পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব তরুণ মুর্শিদকুলী খাঁকে ১৭১৭ সালে সম্মানসূচক করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে দেওয়ান হিসেবে বাংলায় পাঠান। 

এরপর এই মসজিদের নাম হয়ে যায় করতলব খান মসজিদ। স্থানীয়রা মসজিদটিকে বেগমবাজার মসজিদ নামে চেনে। সময়ের পরিক্রমায় ১৭৩৯-৪০ সালে ঢাকার নায়েবে নাজিম সরফরাজ খাঁর কন্যা লাভলি বেগমের নাম থেকে মাছপ্রধান এই এলাকার বড় বাজারের নাম হয় বেগমবাজার। 

এই বাজারটি মূলত স্থাপন করা হয়েছিল পাঁচ গম্বুজ মসজিদটির ব্যয় নির্বাহ করার জন্য। সময়ের কালস্রোতে, লোকজনের সহজ পরিচিতির জন্য এক সময় বেগম বাজারের নাম জুড়ে দিয়ে মসজিদটির নাম হয়ে যায় বেগম বাজার মসজিদ। যা এখনও চলছে। ধারণা করা হয়, এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর অববাহিকা এই মসজিদের কোল ঘেষে প্রবাহিত হত । পরে নদীর গতি পথ পরিবর্তিত হয়ে প্রায় দেড় কি.মি. দূরে চলে যায়। 

সে সময়কার অন্যান্য মসজিদের মতো করতলব খান মসজিদটিও উঁচু ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের উত্তরদিকে একটি কক্ষের মতো বর্ধিত দোচালা রয়েছে। সংযোজিত দোচালা অংশসহ মসজিদটি একটি উঁচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে। প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি বাব বা বাউলি (ধাপকৃত কুয়া)। উত্তর-দক্ষিণে ৩৯.৬২ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩.৪১ মি প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্ত খিলানাকৃতির। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। 

নামাজ পড়ে বের হয়েই আহা! বিরিয়ানীর গন্ধে মৌ মৌ করছিলো চারদিক। এই এলাকায় আসলে আপনি পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সব খাবারও পেয়েও যাবেন। ভুরিভোজ করার উৎকৃষ্ট সময় তো এখনই...। 

৪টি মন্তব্য:

  1. জাযাকাল্লাহ। বাংলার মুসলিমদের ইতিহাস-ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. জ্বি ভাই। আমাদের সকলেরই এই কাজে এগিয়ে আসা উচিত।

      মুছুন
  2. ভাইয়া, আল্লাহ্‌ আপনার কল্যাণ করুন। আমরা অনুপ্রাণিত এবং প্রতিনিয়তই আপনার ছাত্র ♥

    উত্তরমুছুন