১৩ সেপ, ২০১৭

জামায়াতে ইসলামী কেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙ্গনের বিরোধীতা করেছিল?



জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমানের ভূমিকা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী আপোসহীন। দুনিয়ার কোন স্বার্থে জামায়াত কখনও আদর্শ বা নীতির বিসর্জন দেয়নি। এটুকু মূলকথা যারা উপলব্ধি করে, তাদের পক্ষে ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।

প্রথমত
মানুষের বেঁচে থাকার, বিশ্বাস অনুযায়ী চলার, পছন্দমত কাজ করার এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বাধীনতাই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা।১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তখন অন্য অনেকের মতই জামায়াতে ইসলামীও চিন্তা করেছিল এই সংগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আনার পরিবর্তে বিশ্বাস ও কাজের যতটুকু স্বাধীনতা ৪৭ এর পাকিস্তান অর্জনের মাধ্যমে এসেছিল, তাও হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা। এই আশংকা থেকেই জামায়াত ওই সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেনি। শুধু জামায়াত নয়, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ অনেক দল এবং জনগণের বড় একটি অংশও স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারেনি। বলাই বাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত সে সময় অতি ক্ষুদ্র একটি দল ছিল।

দ্বিতীয়ত
বস্তুত বাংলাদেশ নামক যে জনপদে বর্তমানে আমরা বাস করছি, এই জনপদকে শুধু ১৯৭১ থেকে চিন্তা করলে হবেনা, এর ইতিহাস হাজার বছরের। সেই আর্য, পাল, সেন, সুলতানী, শাহী থেকে শুরু করে শায়েস্তা খান, ইসলাম খান, সিরাজুদ্দৌলা, ইংরেজ অতঃপর ৪৭ এর পাকিস্তান হয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ। এর প্রতিটি ধাপেই বহুবার এই ভূখন্ডের মানচিত্র পরিবর্তন হয়েছে, নামের পরিবর্তন হয়েছে, শাসকের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ কখনো স্বাধীনতা পেয়েছে, কখোনো বঞ্চিত হয়েছে।
৪৭ এর পাকিস্তান-ভারত বিভাজনের আগে এই অঞ্চলের মানুষগুলো চরমভাবে নিষ্পেষিত ছিল ব্রিটিশ শাসক আর হিন্দু শেঠ ও জমিদারদের হাতে। ৭১ এ বহু মানুষ বেঁচে ছিলেন যাদের স্মৃতিতে তখনও বৃটিশ-হিন্দুদের নিষ্পেষণ জ্বলজলে ছিল। ৭১ এ ভারতের সহায়তায় যুদ্ধ করে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দূর্বল পূর্ব পাকিস্তান আদৌ পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারবে নাকি ভারতের মত চানক্যবাদী রাষ্ট্রের করাল গ্রাসে বিলিন হতে হবে তা নিয়ে আশংকা ছিল সচেতন মানুষের মনে।

জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ ৪৭ এর অর্জন নস্যাত হয়ে ভারতের গোলামীতে পুনরায় ফিরে যাবার আশংকা থেকেই ৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে পারেনি। যে ইসলামী আন্দোলন এ ভূখন্ডে ইসলামী রাষ্ট্র দেখতে চায় তা ব্রাহ্মণবাদী ভারতের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

তৃতীয়ত
জামায়াত মনে করেছিল শেখ মুজিব যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি তেমনি ভূট্টোও পূর্ব পাকিস্তানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং সমগ্র পাকিস্থানের একক কোন গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি না থাকায় দুই দেশ পার্লামেন্টের মাধ্যমে এমনিতেই ভাগ হয়ে যেত। অনেক দেশই শান্তিপূর্নভাব স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। ভারত-পাকিস্থান তার প্রকৃত উদাহরণ। জামায়াত মূলত এটাই চেয়েছিল। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল ভারতের সহায়তায় এদেশ স্বাধীন হলে এদেশ অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ভারতের বাজারে পরিণত হবে যাকে কখনোই প্রকৃত স্বাধীন বলা যাবে না। এ কারনেই কিছুদিন আগে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন “জামায়াত যে আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি, দেশ এখন সেদিকেই যাচ্ছে।”

চতুর্থত 
আদর্শগত কারণেই জামায়াতের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহকগণের সহযোগী হওয়া সম্ভব ছিল না। যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান বলে সচেতনভাবে বিশ্বাস করে, তারা এ দুটো মতবাদকে তাদের ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী মনে করতে বাধ্য। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস দলের আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই এ মতবাদের অসারতা বলিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে যারা ভাঙ্গনের পক্ষে কাজ করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহক। আর সমাজতন্ত্রের ভিত্তিই হলো ধর্মহীনতা।

পঞ্চমত 
পাকিস্তানের প্রতি ভারত সরকারের অতীত আচরণ থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে এদেশের এবং মুসলিম জনগণের বন্ধু মনে করাও কঠিন ছিল। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সঙ্গত কারণেই তাদের যে আধিপত্য সৃষ্টি হবে এর পরিণাম মংগলজনক হতে পারে না বলেই জামায়াতের প্রবল আশংকা ছিল।

ষষ্ঠত 
জামায়াত একথা বিশ্বাস করত যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলে গোটা পাকিস্তানে এ অঞ্চলের প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে। তাই জনগণের হাতে ক্ষমতা বহাল করার আন্দোলনের মাধ্যমেই জামায়াত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন করতে চেয়েছিল।

সপ্তমত 
জামায়াত বিশ্বাস করত যে, প্রতিবেশী সম্প্রসারণবাদী দেশটির বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্রভুক্ত থাকাই সুবিধাজনক। আলাদা হয়ে গেলে ভারত সরকারের আধিপত্য রোধ করা পূর্বাঞ্চলের একার পক্ষে বেশি কঠিন হবে। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগলিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং ভারত দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় এ অঞ্চলের নিরপত্তা প্রশ্নটি জামায়াতের নিকট উদ্বেগের বিষয় ছিল।

অষ্টমত 
জামায়াত একথা মনে করত যে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে ভারতের সাথে সমমর্যাদায় লেনদেন সম্ভব হবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব জিনিস এখানে আমদানি করা হতো, আলাদা হবার পর সে সব ভারত থেকে নিতে হবে। কিন্তু এর বদলে ভারত আমাদের জিনিস সমপরিমাণে নিতে পারবে না। কারণ রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের আমাদের প্রয়োজন নেই। ফলে আমরা অসম বাণিজ্যের সমস্যায় পড়ব এবং এদেশ কার্যত ভারতের বাজারে পরিণত হবে।

নবমত 
জামায়াত পূর্ণাংগ ইসলামী সমাজ কায়েমের মাধ্যমেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা এবং সকল বৈষম্যের অবসান করতে চেয়েছিল। জামায়াতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে,আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম হলে বে-ইনসাফী, যুলুম ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের সত্যিকার মুক্তি আসবে।

এসব কারণে জামায়াতে ইসলামী তখন আলাদা হবার পক্ষে ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এদেশে যারাই জামায়াতের সাথে জড়িত ছিল, তারা বাস্তত সত্য হিসাবে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়েছে। যে জামায়াত বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য, বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য, ইসলামের আদর্শকে উচ্চকিত রাখার জন্য পাকিস্তান ভাঙ্গনের বিরোধীতা করেছে সে জামায়াত কখনোই বাংলাদেশবিরোধী হতে পারে। এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে জামায়াত। এই ভূখণ্ডকে সব ধরণের অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য জামায়াতের কর্মীরা জীবনবাজী রাখতে প্রস্তুত। 

স্বাধীনতার বিরোধিতা আর যুদ্ধাপরাধ এক জিনিস নয়
মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা আর যুদ্ধের সময় অপরাধ করা এক জিনিস নয়। যে কোন একটি কাজের বিরোধিতা করার অধিকার সকলেরই আছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু পাকিস্তান হয়ে যাবার পর তা মেনে নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তারা পাকিস্তানের শাষন ক্ষমতায়ও এসেছেন, তারা মনে করেছিলেন পাকিস্তান ভাগ না হওয়াটাই ভাল হবে। এ ধরণের বিরোধিতা চিন্তা ও মত প্রকাশ স্বাধীনতারই অংশ। শেরে বাংলা লাহোর প্রস্তাব করলেও ৪৬ এর নির্বাচনে পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন, পরবর্তীতে সেই পাকিস্তানেরই মন্ত্রী হয়েছেন।

জনাব সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে যখন বঙ্গদেশ ও আসামকে মিলিয়ে “গ্রেটার বেংগল” গঠন করার উদ্দেশ্যে তিনি শরৎ বসুর সাথে মিলে চেষ্টা করেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো না। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। পশ্চিমবঙ্গের বিপুল সংখ্যক মুসলমানের স্বার্থরক্ষা এবং কোলকাতা মহানগরীকে এককভাবে হিন্দুদের হাতে তুলে না দিয়ে বাংলা ও আসামের মুসলমানদের প্রাধান্য রক্ষাই হয়তো তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল। কিন্তু পরে যখন তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন, তখন তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে পাকিস্তানের দুশমন বলে ঘোষণা করা হয় এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তিনিই পরে পাকিস্তানের উজিরে আযম (প্রধানমন্ত্রী) হবারও সুযোগ লাভ করেন। বলিষ্ঠ ও যোগ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার প্রয়োজনে দুর্বল নেতারা এ ধরনের রাজনৈতিক গালির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের গালি দ্বারা কোন দেশপ্রেমিক জননেতার জনপ্রিয়তা খতম করা সম্ভব হয়নি।

তাই ’৭১-এর ভূমিকাকে ভিত্তি করে যে সব নেতা ও দলকে “স্বাধীনতার দুশমন” ও “বাংলাদেশের শত্রু” বলে গালি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যতই বিষেদাগার করা হোক, তাদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও জনপ্রিয়তা ম্লান করা সম্ভব হবে না।

*অধ্যাপক গোলাম আযমের লিখিত "পলাশী থেকে বাংলাদেশ" বই থেকে সংকলিত

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন