৫ জুল, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১০ : বাংলায় দিল্লীর শাসন যেভাবে শুরু হয়



বাংলায় দিল্লীর শাসন প্রতিষ্ঠা হয় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাত ধরেই। তিনি বিহার, বাংলা ও তদসংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নির্যাতিত মানুষের আহবানে সাড়া দিয়ে জয় করে নেন। এরপর তিনি দিল্লির শাসক সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের সাথে দেখা করেন এবং নিজেকে সমর্পন করেন। কুতুবুদ্দিন খুশি হন এবং এই অঞ্চলের শাসনভার তার হাতে অর্পন করেন। এরপর প্রায় একটানা ১৩৬ বছর দিল্লীর অধীনে ছিল বাংলা।

বখতিয়ার খলজী একজন সুশাসক ছিলেন। তিনি তার রাজ্যকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন এবং সেগুলির শাসনভার তার প্রধান অমাত্য ও সামরিক প্রধানদের ওপর ন্যস্ত করেন। তাদেরকে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা, রাজস্ব আদায় করা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং জনগণের পার্থিব ও নৈতিক উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপনের পর খুৎবা পাঠ করেন এবং দিল্লীর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনি দিনাজপুর ও রংপুরের নিকট দুটি ছাউনি শহর নির্মাণ করেন। তার সময়ে প্রচলিত প্রশাসনিক বিভাগকে ইকতা এবং এর শাসনকর্তাকে মুকতা বলা হতো। তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন।

কুতুবুদ্দিন আইবেক মধ্য এশিয়ার কোনো এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন; তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন তুর্কি। শিশুকালেই তাকে দাস (গোলাম) হিসেবে বিক্রি করা হয়। তাকে ইরানের খোরাসান অঞ্চলের নিসাপুরের প্রধান কাজী সাহেব কিনে নেন। কাজী তাকে তার নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন এবং আইবেককে তিনি ভাল শিক্ষা দিয়েছিলেন, তিনি আইবেককে ফার্সি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলেন। তিনি আইবেককে তীর এবং অশ্বচালনায়ও প্রশিক্ষণ দেন। আইবেকের প্রভুর মৃত্যুর পরে প্রভুর ছেলে আইবেককে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। কুতুবুদ্দিনকে এবার কিনে নেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরি।

মোহাম্মদ ঘুরির কোনো সন্তান না থাকায় তার প্রিয় সন্তানের মতো কুতুবুদ্দিন আইবেকই হন দিল্লির শাসনকর্তা। তিনিই প্রথম দিল্লীকে রাজধানীতে পরিণত করেন। তিনি মামলুক সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। মামলুক সালতানাত ১২০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্য এশিয়ার তুর্কি সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক মামলুকদের উত্তর ভারতে নিয়ে আসেন। দিল্লি সালতানাত শাসনকারী পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে মামলুক রাজবংশ প্রথম। এর শাসনকাল ছিল ১২০৬ থেকে ১২৯০ সাল পর্যন্ত। ঘুরি রাজবংশের প্রতিনিধি শাসক হিসেবে কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। এসময় তিনি গাঙ্গেয় অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নতুন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির প্রাচীন মুসলিম স্মৃতিস্থাপনাগুলোর নির্মাণ তিনি শুরু করেন। এর মধ্যে রয়েছে কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ ও কুতুব মিনার। ১২১০ সালে তিনি পোলো খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান। লাহোরের আনারকলি বাজারের কাছে তাকে দাফন করা হয়। এরপর শাসক হন আরাম শাহ। আরাম শাহ কুতুবুদ্দিনের সাথে কী সম্পর্কিত এই নিয়ে দ্বিমত আছে ঐতিহসিকদের মধ্যে। কেউ বলেছেন ভাই, কেউ বলেছেন ছেলে। যাই হোক আরাম শাহের ক্ষমতায় বেশিদিন ছিলেন না। চিহালগনি নামে পরিচিত ৪০ জন অভিজাত ব্যক্তির একটি দল আরামশাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাদাউনের গভর্নর শামসউদ্দিন ইলতুতমিশকে আমন্ত্রণ জানায়। ১২১১ সালে ইলতুতমিশ আরামশাহকে দিল্লির নিকটে জুদের সমতল ভূমিতে পরাজিত করেন।

ইলতুতমিশ দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি মুলতানের নাসিরউদ্দিন কাবাচা ও গজনির তাজউদ্দিন ইলদুজকে পরাজিত করে। এই দুজন দিল্লির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তার শাসনামলে মঙ্গোলরা জালালউদ্দিন খোয়ারিজম শাহর খোঁজে ভারত আক্রমণ করে। ইলতুতমিশ শত হাতে মঙ্গোলদের প্রতিহত করেন। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর ইলতুতমিশ হারানো এলাকা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে উত্তর ভারতে তার নিয়ন্ত্রণ মজবুত করেন। ১২৩০ সালে তিনি মেহরাউলিতে হাউজ-ই-শামসি নামক জলাধার নির্মাণ করেন। ১২৩১ সালে তিনি দিল্লিতে প্রথম মুসলিম সমাধি 'সুলতান গারি' নির্মাণ করেন।

ইলতুতমিশ কণ্যা রাজিয়া সুলতানা ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শাসক। তিনি অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন এবং সালতানাত পরিচালনায় সফল ছিলেন।আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জামালউদ্দিন ইয়াকুতের সাথে তার সহযোগিতার কারণে মধ্য এশিয়ার তুর্কীয় বংশোদ্ভূত অভিজাতরা তার বিরূপ হয়ে পড়ে। এছাড়া নারী সম্রাজ্ঞীর শাসনকে তারা নেতিবাচক হিসেবে দেখতেন। ক্ষমতাশালী অভিজাত মালিক আলতুনিয়া তাকে পরাজিত করেছিলেন। রাজিয়া সুলতানা তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন। রাজিয়ার ভাই মুইজউদ্দিন বাহরাম চিহালগনিদের সহায়তায় সিংহাসন দখল করেন এবং রাজিয়া ও তার স্বামীর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরাজিত হয়ে তারা কাইথাল পালিয়ে যান। তাদের সাথে থাকা অবশিষ্ট সৈনিকরা এরপর তাদের ত্যাগ করে। তারা দুজনেই জাটদের হাতে ধৃত হন। ১২৪০ সালের ১৪ অক্টোবর তাদের হত্যা করা হয়। এরপর কয়েক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়।

১২৪৬ সালে ইলতুতমিশের আরেক ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ক্ষমতা দখল করেন। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ধার্মিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অধিকাংশ সময় তিনি নামাজ এবং দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তা করতেন। তার অধীনস্থ গিয়াসউদ্দিন বলবন রাষ্ট্রীয় বিষয় দেখাশোনা করতেন। তিনি ও গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লি সালতানাতে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। প্রায় ২০ বছর শাসক থাকার পর নাসিরউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যু হয়। তারপর ১২৬৬ সালে গিয়াসউদ্দিন বলবন শাসক হন। তিনি ১২৮৭ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবন কঠোর হস্তে শাসন পরিচালনা করেন। তিনি চিহালগনিদের প্রভাব খর্ব করেন। ভারতে তিনি শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইচ্ছুক ছিলেন। বিশৃঙ্খল অঞ্চলগুলোতে তিনি অনেক চৌকি নির্মাণ ও সেনা মোতায়েন করেন। আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য তিনি সফল গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এরপর আর উল্লেখযোগ্য মামলুক সুলতান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন নি। এরপর শুরু হয় দিল্লীর ২য় সালতানাত খিলজি রাজবংশ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন