২৯ আগ, ২০১৯

শতাব্দিশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ.



মিসরের ইতিহাস পাঠ করলে ফেরাউনের অত্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনাবলী সবার মনে আজো মনের অজান্তে ভেসে ওঠে। ফেরাউনের মুখোশ মানুষের সামনে উন্মোচন করে দেওয়ার জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত মুসা (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। মিসরের ইতিহাসে ফেরাউনের পরে অনেক নব্য ফেরাউন জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদেরই একজন ছিলেন জামাল আবদুল নাসের। যিনি মিসরের জালেম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জামাল আবদুল নাসের অন্যায় অত্যাচার জুলুম জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শতাব্দিশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ. ইসলামের জন্য নির্বাচিত করে পাঠিয়েছিলেন।

জন্ম :
বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) ১৯০৬ সালে মিসরের উস্ইউত জেলার মুশা গ্রামে কুতুব বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী ইব্রাহীম কুতুব, মায়ের নাম ফাতিমা হোসাইন ওসমান। বাবা মায়ের পাঁচ সন্তান-সন্ততির মধ্যে সাইয়েদ কুতুব ছিলেন সবার বড়। সকল ভাইবোনই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ইসলামী জীবন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হয়ে কঠোর ঈমানী পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে গোটা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রেরণার উৎস হয়ে রইলেন। 

শিক্ষা ও কর্মজীবন :
সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ হেফজ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে তিনি কায়রোর তাজহিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে ঐ মাদরাসার শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। তিনি ঐ মাদরাসা থেকে ১৯৩৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঐ মাদরাসায়ই অধ্যাপক নিযুক্ত হন। কিছুদিন অধ্যাপনা শেষে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। 

আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির ওপরে অধিক জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করে। সেখানে দু'বছরের কোর্স সমাপ্ত করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেখানে থাকাকালে তিনি বস্তুবাদী সমাজের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। বস্তুবাদী সমাজের অবস্থা দেখে তার এ প্রত্যয় জন্মে যে, একমাত্র ইসলামী সমাজব্যবস্থাই মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে। 

ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতি :
আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি ইখওয়ানুল মুসলেমুন দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গভীরভাবে যাচাই করতে শুরু করেন। তিনি ইখওয়ানের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হয়ে ১৯৫৩ সালে ঐ দলের সদস্য হন এবং দলের তথ্য ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৮ ডিসেম্বর নাকরাশী পাশা ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা করেন। নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ দলের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা ইখওয়ানুল মুসলেমুন দলের প্রতিষ্ঠাতা উস্তাদ হাসানুল বান্নাকে শহীদ করা হয়। ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মিসরে এক সামরিক বিপ্লব ঘটে এবং ঐ বছরই ইখওয়ান পুনরায় বহাল হয়ে যায়। সাইয়েদ কুতুব দলের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত হন এবং দলের আদর্শ প্রচার ও আন্দোলনের সম্প্রসারণ তার পরিচালনাধীনে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে সাইয়েদ কুতুবকে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-ইখওয়ানুল মুসলেমুন-এর সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। 

প্রকাশনা :
তার বিশেষ বিশেষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে একাধিক উপন্যাস ও বেশ কয়েকটি শিশু সাহিত্যসহ তেফলে মিনাল কারিয়া, মদীনাতুল মাশহুর, মাশাহেদুল কেয়ামাহ ফিল কোরআন, মা'রেফাতুল ইসলাম ওয়ার রেসমালিয়াহসহ প্রায় বিশটি গ্রন্থ। তাফসির ফি যিলালিল কোরআন- সাইয়েদ কুতুবের এক অনবদ্য অবদান। আট খন্ডে সমাপ্ত এক জ্ঞানের সাগর। তার এসব গ্রন্থাবলী ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও নেতাদের জন্য পথনির্দেশিকা ও অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস হয়ে আছে।

গ্রেপ্তার ও নির্যাতন :
সাইয়্যেদ কুতুব সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পরেই কর্নেল নাসের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ বছর মিসর সরকার বৃটিশের সঙ্গে নতুন করে যে চুক্তি সম্পাদন করেন ঐ পত্রিকা তার কঠোর সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার ইখওয়ান কর্মীদের উপর কঠোর নির্যাতন শুরু করে এবং এক বানোয়াট হত্যা-ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগ এনে দলটিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং দলের নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় সাইয়েদ কুতুবকেও।

জেলে প্রবেশ করার সাথে সাথে হিংস্র জেল কর্মচারীরা তাকে নির্মমভাবে মারপিট করতে থাকে এবং দুঘণ্টা ধরে এ অত্যাচার চলতে থাকে। এতেই শেষ নয়, বর্বর জালেমরা তাঁর ওপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেয়। কুকুরটি তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়াতে থাকে। এর পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নির্জন কক্ষে। সেখানে তাকে একটানা সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রক্তাক্ত বেদনায় জর্জরিত শরীর এসব শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। কিন্তু ঈমানের বলে বলীয়ান পাহাড়ের মতো অবিচল মর্দে মুজাহিদ এসব অমানুষিক অত্যাচার অকাতরে সহ্য করেন। এ অবস্থায় তাঁর মুখে উচ্চারিত হতে থাকত আল্লাহ আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। 

এভাবে নির্মম নির্যাতনের ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫৫ সালের ২ মে তাকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঐ বছরের ১৩ জুলাই মহকুমাতুস সাব অর্থাৎ জাতীয় আদালতে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। পরে এ দন্ড বাতিল করে তাঁকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। এক বছর কারাভোগের পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করেন, তাহলে তাঁকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। এ প্রস্তাবের জবাবে মর্দে মুমিন বলেন,
আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হচ্ছি যে, জমলুমকে জালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। খোদার কসম। যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবুও আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট। 

পরবর্তীকালে যতবারই তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ততবারই তিনি এই বলে জওয়াব দিয়েছেন, ‘‘যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো না।’’ এর পরে সরকার পক্ষ থেকে প্রলোভন দেখানো হলো যে, যদি তিনি সম্মত হন তাহলে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হবে। সাইয়েদ এ প্রস্তাবের জওয়াবে বললেন, 
আমি দুঃখিত। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সে সময় পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত মিসরের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার এখতিয়ার দেয়া না হবে।

সাইয়েদ কুতুব ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তাররা কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ কায়রো সফর করেন। ইরাকী আলেমদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকী প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের সাথে বৈঠককালে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি প্রদানের অনুরোধ জানান। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি প্রদান করা হয়। কর্নেল নাসের তাকে মুক্তি দিয়ে অত্যন্ত কড়া নজরদারিতে তারই বাসভবনে অন্তরীণ করেন। সাইয়েদ কুতুবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার কারণে মিসরের কমিউনিস্ট গোষ্ঠী এবং তাদের মুরুব্বিরা নাখোশ হয়। শুরু হয় কর্নেল নাসেরের ওপর নানা চাপ। কমিউনিস্ট পার্টি জামাল নাসেরের সহযোগিতার জন্য একটি শর্ত আরোপ করে। তা হচ্ছে মিসর থেকে ইখওয়ানকে নির্মূল করতে হবে। 

১৯৬৫ সালে রাশিয়া থেকে নাসেরকে তলব করা হয়। ২৭ আগস্ট মস্কোয় আরব ছাত্রদের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে জামাল নাসের ঘোষণা করেন যে, মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমুন তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। অতীতে বহুবার সে ইখওয়ানকে ক্ষমা করেছে এবার আর ক্ষমা করা হবে না। মস্কো থেকে নাসের দেশে ফিরে এলেই শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে। পুনরায় গ্রেফতার করা হলো সাইয়েদ কুতুবকে। শুধু তাকেই নয় তার ভাই মুহম্মদ কুতুব, ভগ্নি হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশিসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাতশ' ছিলেন মহিলা। 

বিচারের নামে প্রহসন :
ইখওয়ানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছিল তা ছিল বাহানামাত্র। আসল ‘ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইখওয়ান নেতা ও কর্মীরা ১৯৫৪ সালের শেষভাগ থেকে জেলখানায় বন্দী জীবনযাপন করেন। রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো চিন্তা-কল্পনা করাও তাদের অসম্ভব ছিল। তবু তাদের জ্ঞানী ব্যক্তিরা জেলখানায় অথবা জেলের বাইরে জ্ঞানগত ও চিন্তাধারার দিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে ইসলামকে রক্ষার যতটুকু খিদমত করা সম্ভব ছিল তা তারা করেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তারা সাহিত্য রচনা করেছেন। মিসরে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, ইসলামী ইতিহাস এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ওপর বিপুল সাহিত্য বিগত দশ বছরে রচিত হয় এবং তা বিভিন্ন বিষয়ে এত বেশি ছিল যে, লোকেরা লেখকদেরকে সাহস উদ্যম প্রদান এবং প্রকাশকদেরকে প্রশংসা না জানিয়ে পারেনি। ইখওয়ান নেতা-কর্মীদের বিচার শুরু হলো বিশেষ সামরিক আদালতে। ‘প্রথমত ঘোষণা করা হয় যে, টেলিভিশনে ঐ বিচারানুষ্ঠানের দৃশ্য প্রচার করা হবে। 

কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ ‘অপরাধ স্বীকার' করতে অস্বীকার এবং তাদের প্রতি দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করায় টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর রুদ্ধ দ্বারকক্ষে বিচার চলতে থাকে। আসামীদের পক্ষে কোন উকিল ছিল না। অন্য দেশ থেকে আইনজীবীগণ আসামী পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফরাসী বার এসোসিয়েশনের ভূতপূর্ব সভাপতি উইলিয়ম থরপ ও মরক্কোর দু'জন আইনজীবী আসামী পক্ষ সমর্থনের জন্য রীতিমতো আবেদন করেন। কিন্তু তা নামঞ্জুর করা হয়। সুদানের দু'জন আইনজীবী কায়রো পৌঁছে তথাকার বার এসোসিয়েশনে নাম রেজিস্ট্রি করে আদালতে হাজির হন। পুলিশ তাদের আদালত থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সাইয়েদ কুতুব ও অন্যান্য আসামীগণ ঊনিশ শ'ছেষট্টি সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিচার করাকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, ‘অপরাধ স্বীকার' করার জন্য তাদের প্রতি অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ট্রাইব্যুনালের সভাপতি আসামীদের কোন কথার প্রতিই কর্ণপাত করেন নাই। এমনিভাবে ১৯ মে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আদালতে বিচার প্রহসন নাটক মঞ্চস্থ হয়। 

ট্রাইব্যুনালের বিচারক জামাল নাসেরের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে ১৯৬৬ সালের ২১ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত ৪৩ জন নেতাকর্মীর মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এরা হচ্ছেন সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ ইউসুফ, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, শবরী আরাফাহ, আহমদ আবদুল মজিদ, আব্দুল আজিজ ও আলী উসমাভী। সাইয়েদ কতুবের মৃত্যুদন্ডাদেশ শোনার পর আদালত সংশ্লিষ্ট লোকজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অথচ সাইয়েদ রায় শোনার পর খুশি মনে বলে উঠলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ'। তিনি হাসতে হাসতে বললেন 
আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে, আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে যালিমরা আমার মৃত্যুদন্ড দেবে। আমিতো এতেই সন্তুষ্ট যে, আমি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা হিসাবে শাহদাতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি। 

শাহদাত :
১৯৬৬ সালের ২৮ আগস্ট রাতে সাইয়েদ কুতুব ও তার দুই সাথীকে ফাঁসীর সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৯ আগস্ট ভোর রাত। সাইয়েদ কুতুব ও তার দুই সঙ্গীকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতোমধ্যে ফাঁসির সকল আয়োজন শেষ। সাইয়েদ অত্যন্ত আনন্দিত ও নির্ভীক চিত্তে সামনে পা বাড়াচ্ছেন, তার মুখে তৃপ্তির হাসি। সুবহে সাদিকের আলো ঝলমল ধরণী যেন আজ গভীর বেদনাপ্লুত। সাইয়েদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন। চারদিকে ভেসে উঠল ফজরের আযান। এমনি এক পবিত্র পরিবেশে কার্যকর করা হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম আয়োজন, সাইয়েদ কুতুব ও তার সঙ্গীদের ফাঁসি। সারাবিশ্বের অগণিত মানুষকে কাঁদিয়ে সাইয়েদ কুতুব পৌঁছে গেলেন তার পরম প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে।

কেন হংকং উত্তাল? কী সমাধান হতে পারে?



ঘটনার সূত্রপাত একটি খুনের ঘটনা থেকে। তাইওয়ানে ছুটি কাটানোর সময় অন্তঃসত্ত্বা বান্ধবীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে হংকংয়ের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে হংকংয়ের বন্দি বিনিময়ের কোনও চুক্তি না থাকায় সেই ব্যক্তিকে এখন তাইপেতে বিচারের জন্য পাঠানো যাচ্ছে না। এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে চীন। তারা এই সমস্যা সমাধানের জন্য অপরাধী প্রত্যর্পন আইন করতে চায় যার ফলে এক অঞ্চলের অপরাধীরা অন্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় না নিতে পারে।

হংকং-এর শাসক বেইজিংপন্থী, তাই তিনিও এই আইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এখন তাইওয়ানও জানিয়েছে, সন্দেহভাজন সেই খুনের মামলার আসামিকে ফেরত নিতে চায় না তারা। কেননা এটি এমন এক উদাহরণ তৈরি করবে যা চীন ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে।

চীনবিরোধী অব্যাহত বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে পড়েছে হংকং। গত ৯ জুন রাতে কথিত অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলের বিরুদ্ধে অঞ্চলটির রাজপথে নামে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ঢল এখনও অব্যাহত আছে। বুধবারও অঞ্চলটির সরকারি অফিসে যাওয়ার প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করে রেখেছে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তবে ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্যেই সোমবার অঞ্চলটির শাসক বেইজিংপন্থী হিসেবে পরিচিত ক্যারি ল্যাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কথিত ওই অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলে কোনও কাটছাঁট করা হবে না। বুধবার তার কার্যালয় সংলগ্ন রাস্তায়ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিক্ষুব্ধ মানুষ। এ সময় সেখানে মোতায়েন দাঙ্গা পুলিশের শত শত সদস্য তাদের আর সামনে অগ্রসর না হওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।

হংকং চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হলেও ২০৪৭ সাল অবধি অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। ১৫০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই অঞ্চলটি চীনের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছিল।

হংকংয়ের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ হলেও, ১২শ’ জনের একটি বিশেষ কমিটি নেতা বাছাইয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। অঞ্চলটির নেতা বা প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যামের দাবি, হংকং যে বিশেষ স্বাধীনতা উপভোগ করে, নতুন আইনের ফলে তার কোনও ক্ষতি হবে না। তবে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা বলছেন, আইনটির মাধ্যমে অঞ্চলটির রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে বেইজিং। এর প্রতিবাদ জানাতেই তারা রাজপথের বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন।



সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ক্যারি ল্যাম দাবি করেন, এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে এবং এতে মানবাধিকারের রক্ষাকবচগুলো যুক্ত করা হয়েছে। তার দাবি, প্রস্তাবিত আইনটি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে তোলা হয়নি। বিবেকের তাড়নায় এবং হংকংয়ের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।

হংকংয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া বিক্ষোভকারীরা বলেন, আমরা সবাই বুঝতে পারছি, হংকংয়ের বিচার ব্যবস্থায় নাড়া দিচ্ছে চীন।’ তারা মনে করেন, চীন সরকার কারও ওপর অসন্তুষ্ট হলেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়।

বাংলাদেশে থেকে আপাতদৃষ্টিতে আমার মনে হচ্ছে আইনটি বাস্তবায়ন হওয়া দরকার নইলে চীনের এক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অপরাধীরা অন্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেবে। কিন্তু আবার বিক্ষোভকারীদের অবস্থান দেখে ও চীনের কৌশল দেখে মনে হচ্ছে চীন মূলত এই আইনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবে। হংকং-এর সমাজতন্ত্রবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী জনগণকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেবে এবং বেইজিং-এ নিয়ে আসবে। হংকংকে অবরুদ্ধ করে ফেলবে যেভাবে জিংজিয়াংকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে।



হংকং-এর জনগণ যে চীনকে বিশ্বাস করে না তার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ তারা চায় নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে। কিন্তু চীন তা মানতে নারাজ। ২০১৪ সাল থেকে চীন থেকে বলা হয়, তারা হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী বেছে নেয়ার জন্য সরাসরি নির্বাচনের অনুমতি দেবে, কিন্তু তা কেবলই তাদের অনুমোদিত প্রার্থীদের তালিকার মধ্য থেকে। এই ঘোষণার পর হংকংয়ের জনগণ বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে, কারণ তারা এমন ব্যবস্থা চায়নি। তারা চেয়েছিল পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা।

এখন সমাধান একটাই। অপরাধী প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন হওয়া উচিত তবে তা যেন শুধুমাত্র ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। রাজনৈতিকভাবে সেটি যাতে ব্যবহৃত না হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রেখে বিক্ষোভকারীদের সাথে আলোচনা করে সমাধানে আসা আবশ্যক।

৬ আগ, ২০১৯

কাশ্মীর সমস্যা আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কি একই?

শেখ আব্দুল্লাহ ও নেহেরু
আমাদের দেশে কাশ্মীর নিয়ে কথা শুরু হলেই এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। তারা কাশ্মীর আর পার্বত্য চট্টগ্রামকে মিলিয়ে ফেলেন। তারা দাবী করেন কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামের দোষ কী? পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠেকাতে সেখানে সেনা মোতায়েনের বিরোধীতা করে কাশ্মীর ইস্যুকে সামনে এনে। তারা বলে ভারত কাশ্মিরের সঙ্গে যেটা করেছে, আমরাও একই কাজটাই করে চলেছি পাহাড়ে। এই নিয়ে আমাদের মধ্যেও হীনমন্যতা কাজ করে। আমরাও কনফিউজড হয়ে পড়ি। আজকের আলোচনায় বিষয়টা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করবো। 

যেভাবে ৩৭০ ধারা সৃষ্টি হয়েছে... 
ইংরেজদের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে কাশ্মীরের শাসক ছিলেন মহারাজা হরি সিংহ, যিনি হিন্দু ছিলেন। কাশ্মীর প্রধানত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ছিল। ভারত বা পাকিস্থানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে হরি সিংহ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তার ধারণা ছিল তার গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলে তার রাজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। তিনি ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেয়েছেন অন্যদিকে কাশ্মীর ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। তাই সেখানের জনগণ পাকিস্তানের সাথে থাকতে চেয়েছেন। 

কাশ্মীরের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন মুসলিমদের নেতা। তিনি রাজার চাইতেও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। শেখ আব্দুল্লাহ শুরুতে পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে তার মতামত দেন। এমতাবস্থায় রাজা স্বাধীন থাকার ব্যাপারেই মত দেন। এতে সম্মত হয় শেখ আব্দুল্লাহও। রাজা ভারত ও পাকিস্তানের সাথে একটি ডিফেন্স চুক্তি করার প্রস্তাব দেন যাতে তারা তাকে প্রতিবেশী হিসেবে মেনে নেয় এবং সীমান্ত সুরক্ষা পায়। পাকিস্তান সম্মত হয় এবং তার সাথে চুক্তি করে। কিন্তু ঝুলিয়ে রাখে ভারত। তারা কাশ্মীরকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে।

রাজা হরি সিংহ
কাশ্মীরের নিষ্ঠাবান মুসলিমরা তাদের নেতাদের (রাজা ও শেখ আব্দুল্লাহ) এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা পাকিস্তানের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাদের যুক্তি ছিলো যেহেতু ভারত তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি, সুতরাং ভারত যে কোনো সময়েই কাশ্মীর আক্রমণ করবে। কাশ্মীরের মতো মুসলিম অঞ্চল ভারতের দখলের কবলে পড়লে কাশ্মীরের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে। তারা মুসলিম সংহতির ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করে, শেখ আব্দুল্লাহকে গাদ্দার উপাধি দেয়। শেখ আব্দুল্লাহ ভেবেছিলো কাশ্মীর স্বাধীন থাকলে দিক কয়েক পরে সে কাশ্মীরের প্রধান শাসক হতে পারবে যেহেতু কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। এসময় রাজার লোকেরা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালায়, হত্যা করতে থাকে মুসলিমদের। যেহেতু মুসলিমরা দু'ভাগে বিভক্ত। তাই সে মুসলিম নিধনের সুযোগ গ্রহণ করে।

এই ঘটনার জেরে অল্পকিছুকাল পরেই পাঠান জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে কাশ্মীরে প্রবেশ করে। মুসলিমরা শ্রীনগরের দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। ধারণা করা হয় মুসলিমদের বাঁচাতে জিন্নাহই পাঠানদের কাশ্মীরে পাঠায়। যেহেতু পাকিস্তান কাশ্মীরের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ, তাই সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ করেনি পাকিস্তান। পাঠানদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে কাশ্মীরের রাজা সামরিক সহায়তা চেয়ে ভারতকে চিঠি দেয়। ভারত তখন রাজাকে একীভূতকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এবং সেই সাথে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করার দাবি করে। নেহেরু এখানে চালাকির আশ্রয় নেয়। সে জানে ভারত কাশ্মীর আক্রমণ করলে সব মুসলিম এক হয়ে যাবে। তাই সে ভারত আক্রমণ করার আগে গাদ্দার শেখ আব্দুল্লাহকে কথিত শাসক বানিয়ে নেয়, যাতে মুসলিমরা দ্বিধাগ্রস্থ ও বিভক্ত থাকে। কাশ্মীরের রাজা নিরুপায় হয়ে সব মেনে নেয়।

শেখ আব্দুল্লাহ ও ইন্দিরা
ভারতীয় সৈন্যরা জম্মু, শ্রীনগর দখল করে নেয়। কিন্তু শীতকাল শুরুর সাথে সাথে শুরু হওয়া এই প্রচণ্ড যুদ্ধের ফলে রাজ্যটির অধিকাংশ স্থান দুর্গম হয়ে পড়ে। নেহেরু এই বিবাদের উপর আন্তর্জাতিক দৃষ্টি স্মরণে রেখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন এবং জাতিসংঘের সালিশি কামনা করেন। তিনি বলেন, অন্যথায় উপজাতীয় আক্রমণ থামাতে ভারতকে বাধ্য হয়েই পাকিস্তান আক্রমণ করতে হবে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সিদ্ধান্ত হয় গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মীরের ভাগ্য চুড়ান্ত হবে। ভারত সেই গণভোট কখনই অনুষ্ঠিত হতে দেয় নি। আজ পর্যন্ত না।

২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান ৩৭০ ধারা দিয়ে কাশ্মীরকে অধিভুক্ত করে। ভারত কাশ্মীরের পুরোটা দখলে নিতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের উত্তর এবং পশ্চিম অংশদ্বয়ের উপর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং উক্ত স্থানকে বর্তমানে আযাদ কাশ্মীর বলা হয়। ৩৭০ ধারা হলো কাশ্মীর রাষ্ট্র ও ভারত রাষ্ট্র একীভূত হওয়ার দলিল।

কী ছিলো ৩৭০ ধারাতে? 
ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারাবলে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাজন করে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কার্যকর হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারতভুক্তির বিষয়টি কার্যকরী হয়।

ভারতভুক্তির শর্ত হিসেবে জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সংসদ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাধর। এর বাইরে এখানের নাগরিকরা দ্বৈর নাগরিকত্ব ভোগ করবে, কাশ্মীরের জন্য আলাদা সংবিধান হবে, আলাদা পতাকা থাকবে, এখানে কাশ্মীরি ছাড়া ভারতের অন্য কেউ জমি কিনতে ও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে না। এখানের বিচার ব্যবস্থা ও আইন থাকবে আলাদা। স্বতন্ত্র।

কেন ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীর পুরো দখল করে নিলো? 
কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির মূল লক্ষ্য ভারত সরকার এর ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যার চিত্র বদলে দিতে চায়। আগে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ কাশ্মীরে জমি বা বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারতো না। ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে সে বাধা কেটে গেলো। যে কেউ এখন সরকার থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করে শিল্পকারখানাও স্থাপন করতে পারবে। বিজেপি এখানে প্রচুর হিন্দুদের সেটেল করতে চাইবে অনেকটা ইসরাঈলের মতো। তারা যেভাবে বসতি স্থাপন করে ফিলিস্তিন দখল করেছিলো।


এর মাধ্যমে বর্তমানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট হয়ে যাবে। বিপুলভাবে হিন্দুদের সেটেল করে দিয়ে মুসলিম সংকীর্ণ করে ফেলা হবে। তাদেরকে উদ্বাস্তুও করে ফেলা হতে পারে। ডেমোগ্রাফি চেইঞ্জ হলে কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীনতার দাবীদাররা হামেশাই কন্ট্রোল হয়ে যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কাশ্মীর সমস্যা কি একই রকম? 
না, কখনোই নয়। ভারত একটি স্বাধীন জাতিকে জোরপূর্বক দখল করে তাদের অধীন করে নিয়েছিলো। কাশ্মীরীরা ইংরেজ আমলেও স্বায়ত্বশাসিত ছিলো। কিন্তু ভারত তাদের গোলামে পরিণত করেছে। ৩৭০ ধারা যার মাধ্যমে কাশ্মীর ও ভারত একীভূত হয়েছে সেই চুক্তিকে বিলোপ করে দিতে ভারত ঐ জাতির সাথে প্রতারণা করেছে। আর অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনোই পাহাড়িদের ছিলো না। এই ভূমি সবসময় বাঙালিদের ছিলো।

আমরা কিছু পালিয়ে আসা ও নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। আর তারা এখন আমাদের বলছে তারা নাকি এই অঞ্চলের ভূমিপূত্র। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এখানে দ্রাবিড় জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি। অতএব আমাদের ভূমিতে অন্যরা এসে নিজেদের ভূমি দাবী মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আর আমাদের দেশে পাহাড়িদের সাথে কোনোভাবেই অন্যায় আচরণ করা হয় না। বরং তাদের সকল সুযোগ সুবিধা বাঙালিদের চেয়ে বেশি দেয়া হয়। তাদের স্বাধীনতা দাবী অন্যায্য ও অন্যায়।

১ আগ, ২০১৯

ইরান ও বিশ্বসন্ত্রাসীদের লড়াই

ইরানের হামলায় ভূপাতিত মার্কিন ড্রোন
ইরানের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের সন্ত্রাসীদের লড়াই ভালোই মোকাবেলা করছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে ধীরে ধীরে যুদ্ধের পথে ঠেলে দেবে, এমনটাই ছিলো সন্ত্রাসীদের ইচ্ছে। তবে ইরানের অনমনীয় আচরণ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে দূরে ঠেলে দেবে বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আরো কঠোর হয়েছে। যারাই ইরানের সাথে বাণিজ্য করছে সবাইকে কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে তারা। এই কারণে ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, পানামা, লাইবেরিয়াসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের বিরোধ তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি ইংল্যান্ড আরব উপসাগরে আরো একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে ইরানকে মোকাবিলা করার জন্য।  

ড্রোন যুদ্ধ :
ইরান তার সীমানার ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থানে আছে। আমেরিকার ড্রোন বার বার তাদের সীমানা অতিক্রম করলে প্রথমে ইরান কয়েকবার সতর্ক করে। এরপর গুলি করে নামিয়ে ফেলে। এতে ট্রাম্প ক্ষেপে যায়। মনে হচ্ছিল এই ঘটনাকে পুঁজি করে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত হুমকি ও যুদ্ধের ঘোষণাকে ইরান খুব হালকাভাবে উড়িয়ে দিচ্ছিল। ইরান হরমুজ প্রণালীতে তাদের টহল আরো জোরদার করে। এক পর্যায়ে ট্রাম্প প্রশাসন ইরান আক্রমণ স্থগিত ঘোষণা করে। এর কিছুদিন পর ট্রাম্পের একটি টুইটের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারলো ইরানের একটি ড্রোন নাকি আমেরিকা নামিয়ে ফেলেছে। 

ইরান এই ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে। তারা জানায় তাদের কোনো ড্রোন হারানোর খবর তাদের কাছে নেই। আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমগুলো এই খবর আরো বেশি করে প্রচার করলে ইরান বিষয়টাকে ভালোভাবে খেলিয়ে তোলে। তারা আমেরিকার কাছে ড্রোনের ছবি দাবি করে। আমেরিকার এতে ব্যর্থ হয়। ইরান এরপর তাদের ড্রোন থেকে আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ নজরদারির ভিডিও সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটে অনেকটা ভারতের মতো। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে ভারত এমন অলিক দাবি করে পরে পিছু হটেছে। 

ইরানি তেলবাহী সুপার ট্যাংকার গ্রেস-১ আটক করে ব্রিটেন
পাল্টাপাল্টি ট্যাংকার জব্দ : 
উত্তেজনা নতুন করে মোড় নেয় জুলাইয়ের শুরুতে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়া একটি ইরানী তেলের ট্যাংকার আটক করে ইংল্যান্ড। ইরান কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইইউ-এর নিষেধাজ্ঞার ইস্যু তুলে ব্রিটিশরা ইরানের উদ্যোগকে পাত্তাই দিলো না। এরপর ইরান সামরিক চেষ্টা শুরু করলো। তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়ে অভিযানে নেমেছে। 

তারা একটি ব্রিটিশ তেল ট্যাংকারকে ধাওয়া করলো কিন্তু ধরতে পারেনি। এর পরদিনই পানামার পতাকাবাহী আরব আমিরাতের একটি জাহাজ আটক করে ইরান। তার কিছুদিন পর ব্রিটিশ পতাকাবাহী আরেকটি জাহাজ আটক করে ইরান। এই আটকের দুঃসাহসিক ভিডিও তারা গণমাধ্যমে প্রচার করে। এর একদিন পরই লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী আরেকটি জাহাজ তারা আটক করেছে। এখন সন্ত্রাসীরা সবাই নড়েচড়ে বসেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে জাহাজ বিনিময়ের খবর প্রকাশ হলে ইরান কড়া প্রতিবাদ করে। 

ইরানের কাছে আটক ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ স্টেনা ইমপেরো
লন্ডনে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হামিদ বায়িদিনেজাদ বলেছেন, ইরানে আটক ব্রিটিশ পতাকাবাহী তেল ট্যাংকার এবং জিব্রাল্টার প্রণালীতে আটক ইরানি সুপার তেল ট্যাংকার বিনিময় অসম্ভব। টুইটার বার্তায় তিনি আরও বলেছেন, ব্রিটিশরা ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আটক করেছে। কিন্তু হরমুজ প্রণালীতে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্রিটিশ ট্যাংকার জব্দ করা হয়েছে। কাজেই দু’টি ভিন্ন কারণে আটক জাহাজের মধ্যে বিনিময় সম্ভব নয়। 

এদিকে ব্রাজিল ইরানি জাহাজকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় আমেরিকার নির্দেশে। এর ফলে প্রায় মাস দুয়েক আটকে থাকে ইরানি দুটি জাহাজ। ইরানের বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে সে দেশের হাইকোর্ট ইরানী জাহাজকে জ্বালানি সরবরাহ করতে নির্দেশ দেয়। ইরানের সেই দুটি জাহাজ এখন জ্বালানি নিয়ে ইরানের পথে। এই উত্তেজনার মধ্যে হপ্তাখানেক আগে সৌদি তাদের কাছে থাকা একটি ইরানী জাহাজ হ্যাপিনেস-১ ছেড়ে দিয়েছে। এটি এপ্রিলের শেষ দিকে যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়লে সৌদি নৌবাহিনী সহযোগিতার নাম করে আটক করে ফেলে। 

সম্প্রতি সৌদির ছেড়ে দেওয়া ইরানি জাহাজ হ্যাপিনেস-১
হরমুজ প্রণালী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
যেখানে এই ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথ। এই পথটি হরমুজ প্রণালী হিসেবে পরিচিত। পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে হরমুজ প্রণালী৷ বিশ্বের অন্যতম বড় কয়েকটি অশোধিত তেল উৎপাদক দেশ এই পানিপথ দিয়েই তাদের তেল রপ্তানি করে থাকে৷ এসব দেশের মধ্যে রয়েছে কুয়েত, বাহরাইন, ইরান, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটি উনিশ কিলোমিটার প্রশস্ত৷ আর এই প্রণালীর শিপিং লেন তিন কিলোমিটার প্রশস্ত। 

যেহেতু শীর্ষ পাঁচ তেল রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে, সেহেতু হরমুজ প্রণালী থেকে তেল পরিবহনের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। সমুদ্রপথে বিশ্বের যে পরিমাণ তেল পরিবহণ করা হয়, তার এক তৃতীয়াংশই এই প্রণালী ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়। আর কাতার যেহেতু বিশ্বের অন্যতম বড় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) উৎপাদক, সেহেতু ওই গ্যাসের প্রায় পুরোটাই হরমুজ প্রণালী দিয়ে বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করা হয়।


বিশ্ব অর্থনীতি যতদিন তেলের উপর নির্ভরশীল থাকবে, ততদিন এই প্রণালী থেকে তেল পরিবহনে কিছুটা বা অল্পসময়ের জন্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের বাজারে সেটির ভয়াবহ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কেননা এতে কুয়েত, বাহরাইন, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর সৌদি আরব তখন শুধুমাত্র লোহিত সাগরে থাকা সমুদ্রবন্দর থেকে তেল রপ্তানি করতে বাধ্য হবে।

ইরান কি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে?
১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশন অনুযায়ী একটি দেশের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল অবধি সেই দেশের সমুদ্রসীমা হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন পারস্য উপসাগরে যেতে যেসব সমুদ্রযান উত্তর এবং দক্ষিণ রুট ব্যবহারে বাধ্য হয় সেগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী বাধা দিতে পারে ইরান।

তবে জাতিসংঘের এসংক্রান্ত কনভেনশনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেটি কখনোই সেদেশের সংসদে অনুমোদিত হয়নি। তাছাড়া পানিপথটি ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তাঁর প্রতিবেশী তেল রপ্তানিকারী দেশগুলো, এবং তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করতে সক্ষম হলেও নিজেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেননা, প্রণালীর কিছু অংশ তখন সেদেশও ব্যবহার করতে পারবে না। আর, তেহরান শুধু এখনই নয়, অতীতেও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। সম্ভবত হরমুজ প্রণালীকে স্বাভাবিক রাখতেই বিশ্বসন্ত্রাসীরা একটু পিছু হটেছে।