২১ অক্টো, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-২০ : পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ কেন ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন?

পলাশী মনুমেন্ট, পলাশী, মুর্শিদাবাদ, ভারত
সিরাজউদ্দৌলা নবাবী অর্জন করার পর থেকেই তিনি বিরোধীতার সম্মুখীন হন। এই বিরোধীতা এসেছে তার আত্মীয়-স্বজন যারা মসনদের দাবীদার ছিলো। সেই বিরোধীতা ক্রমেই ষড়যন্ত্রে রূপ নেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্রাহ্মন্যবাদী হিন্দু ও আধিপত্যবাদী ইংরেজরা। বাংলাসহ এই উপমহাদেশে রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসন চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ শুরু হয় পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। যে গোষ্ঠি এসেছিল এদেশে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, তারা হত্যা করল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। 

পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ ছিল, কিছু ছিল প্রত্যক্ষ কারণ আবার কিছু ছিল পরোক্ষ। পরোক্ষ কারণের প্রধান ছিল আলীবর্দী খানের প্রতি তাঁর নিকটাত্মীয়দের ঈর্ষাপরায়নতা। পুত্রহীন আলীবর্দী খানের দুই জামাতার মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা, তারা আশা করেছিলেন আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে তারা মসনদের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু সিরাজকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেয়ার তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তা অবশেষে শত্রুতায় পরিণত হয়। 

নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান শত্রু ছিল তাঁর খালাত ভাই পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ। সিরাজউদ্দৌলার অপর শত্রু ছিল তার খালা মেহেরুন নেসা। মেহেরুন নেসা ওরফে ঘসেটি বেগম ছিলেন অপুত্রক। তিনি সিরাজ উদ্দৌলার ছোট ভাই ইকরামুদ্দৌলাকে লালন পালন করেন। ঘসেটি বেগমের ইচ্ছা ছিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে ইকরামুদ্দৌলাকে মসনদে বসাবেন। কিন্তু ইকরামুদ্দৌলা অকালে মৃত্যু বরণ করেন। ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে পড়েন। এক সময় ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। 

সিরাজউদ্দৌলার আরেক শত্রু ছিলেন মীর জাফর আলী খান। তিনি আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমকে বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান। মীর জাফর আলী খান ছিলেন অত্যন্ত লোভী ও অকৃতজ্ঞ। মীর জাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাব সিরাজের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠেন। ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সাথে যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্যতিব্যস্ত তখন মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানীর সাথে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। 

নবাব সিরাজউদ্দৌলা খালা ঘসেটি বেগমকে তার প্রাসাদ থেকে নিজ প্রাসাদ মনসুর গঞ্জে নিয়ে আসেন। এসময় সিরাজ মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি থেকে সরিয়ে মীর মদনকে ঐ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। পরে তিনি অবশ্য মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু মীর জাফর আগে থেকেই নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, এই ঘটনা অসন্তুষ্টি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। 

এ সময় মুর্শিদাবাদে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘনিভূত হয়ে ওঠে। সিরাজের প্রতি নাখোশ জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ঊমিচাঁদ প্রমুখ হিন্দু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে তদস্থলে ইয়ার লতীফকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করে। আলীবর্দী খানের হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বীজ বপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দু কর্মকর্তাদের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এ সময় যারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে জানকী রাম, দুর্লভ রাম, রাম নারায়ন, কিরাত চাঁদ, বিরু দত্ত, গোকুল চাঁদ, উমিচাঁদ রায় এবং রাম রাম সিংহের নাম উল্লেখযোগ্য।

সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে হিন্দু কর্মকর্তা অধিক সংখ্যায় নিয়োগ পান। এভাবে আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এর পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত অশুভ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বাংলার মুসলিম রাজত্বের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সিরাজউদ্দৌলাও তাঁর নানার মতই হিন্দুদেরকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তিনি মোহনলাল নামক এক কাশ্মিরী হিন্দুকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। মোহন লাল সিরাজের উপরে প্রভাব বিস্তার করে নবাবের প্রধান উজিরে পরিণত হন। আর এসব হিন্দুরাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করে। নবাব সিরাজের হাতে কলকাতা পতনের পর যদি উমিচাঁদ নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ মানিক চাঁদ প্রমুখ হিন্দুগণ গভর্ণর ড্রেক ও তার লোকজনকে সাহায্য না করতো তা হলে ইংরেজদের জন্য আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

উনত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলী নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিক চাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লিখে তাতে বলা হয়, নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হতে আসিনি তার কাছে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট। মানিক চাঁদ পত্রখানি নবাবকে দিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। হয়তো দেয়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিক চাঁদ সর্বদা নবাবকে বিভ্রান্ত রেখেছে। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইব ৩১ ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১লা জানুয়ারী, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারতো। সে তার কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ ইংরেজদের দ্বারা তার এবং তার জাতির অভিলাষ পূর্ণ হতে দেখে সে আনন্দলাভই করছিল। এমনকি এ সকল স্থান ইংরেজ-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।

ইংরেজদের হাতে বলতে গেলে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তুলে দিয়ে সে হুগলী গমন করে এবং হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাইভ হুগলীতে তার নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানায় যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু’দিন পর হুগলী আক্রমণ করে ক্লাইভ সহজেই তা হস্তগত করে। ইংরেজ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিক চাঁদ নবাবকে জানায় যে, ইংরেজদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলী অধিকারের পর ইংরেজ সৈন্যগণ সমগ্র শহরে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।

হুগলীর পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়া মাত্র সিরাজদ্দৌলা বিরাট বাহিনীসহ ২০ জানুয়ারী হুগলীর উপকন্ঠে হাজির হন। ইংরেজগণ তখন হুগলী থেকে পালিয়ে কোলকাতায় চলে যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে তাদের সাথে সন্ধি করেন। ৯ ফেব্রুয়ারী নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা আলী নগরের সন্ধি বলে পরিচিত। এ সন্ধি অনুযায়ী ১৭১৭ সালের ফরমান মুতাবেক সকল গ্রাম ইংরেজদেরকে ফেরত দিতে হবে। তাদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তারা কোলকাতা অধিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তারা একটা নিজস্ব টাকশাল নির্মাণ করতে পারবে।

সিরাজদ্দৌলাকে এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার কারণ হলো মানিক চাঁদের মতো তার অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা। অপরদিকে ক্লাইভের নিকটে এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র। ইংরেজরা একইসাথে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসীদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এতদুদ্দেশ্যে ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজদ্দৌলার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্যে যে, তারা ফরাসী অধিকৃত শহর চন্দরনগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্যে নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাদের এক বিরাট রণকৌশল। নবাব ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি বিদেশী বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কি করে ভংগ করতে পারেন? 

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ইংরেজদের সাহায্য না করলে তারা এটাকে তাদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসীদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। তদনুযায়ী তিনি সেনাপতি নন্দনকুমারকে নির্দেশ দেন যে, ইংরেজরা যদি চন্দরনগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসীদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসীরা যদি ইংরেজদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ইংরেজদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ দশ-বারো হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে একই পন্থায় নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজদ্দৌলা কোন বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু হিন্দু শেঠ ও বেনিয়াগণ এবং তাঁর নিমকহারাম কর্মচারীগণ, যারা মনেপ্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, সিরাজদ্দৌলাকে হরহামেশা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা বলে যে, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী মুর্শিদাবাদ থেকে সেদিকে প্রেরণ করার কুপরামর্শ দেয়। এভাবে ইংরেজদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেয়া হয়।

ইতোমধ্যে ৫ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কোলকাতা এসে পৌঁছায়। ৮ মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। নবাব রায়দুর্লভ রাম এবং মীর জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দরনগর অভিমুখে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের পৌঁছাবার পূর্বেই ফরাসীগণ আত্মসমর্পণ করে বসে। তারা চন্দরনগর ছেড়ে যেতে এবং বাংলায় অবস্থিত তাদের সকল কারখানা এডমিরাল ওয়াটসন এবং নবাবের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজী হয়। অতঃপর বাংলার ভূখন্ড থেকে ফরাসীদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে ক্লাইভ নবাবের কাছে দাবী জানায়। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসীদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে কোম্পানীর দু’হাজার সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। এতে ফরাসীদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি অভিযোগ আরোপ করা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩শে এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলীনগরের চুক্তি ভংগ করেছেন।

নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পাকাপোক্ত ষড়যন্ত্র করে, সিরাজেরই তথাকথিত আপন লোক রায়দুর্লভ রাম, উমিচাদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে। তাদেরই পরামর্শে মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যেও সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। শুধু উমিচাঁদ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে। সে নবাবের যাবতীয় ধন-সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবী করে বসে। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশী করার জন্যে ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরী করে। মীর জাফরের সংগে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলীনগরের চুক্তির সকল শর্ত পুরাপুরি পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানীকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনিয়ানদেরকে সাত লক্ষ টাকা। কোলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমুদয় এলাকা চিরদিনের জন্যে কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হবে।

পলাশী যুদ্ধের আনুমানিক চিত্র 
এতসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে ব্যর্থ হয় সিরাজউদ্দৌলা। সে মীর জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন যদি তারা ফরাসীদের অনুসরণে উত্তরদিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের সম্মুখীন হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ রাম প্রভৃতির উপর। তারা চরম মুহুর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। এরপরেও মীর মদন বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইংরেজদের গুলিতে নিহত হয়ে গেলেন। এই সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তখনও যুদ্ধের গতি নবাবের পক্ষে ছিল। মীর মদনের সাথে মোহনলাল ও সিনফ্রে ইংরেজদের রপ্ত করে ফেলেছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে মীর জাফর যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেন। রায়দুর্লভের কুপরামর্শে ও চাপে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাতে বাধ্য হলেন।

পরক্ষণে ইংরেজদের দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে অবশেষে নবাবের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হয় এবং নবাব পালিয়ে যান। কিন্তু পথিমধ্যে মীর জাফরপুত্র মীরন তাকে হত্যা করে। এভাবে পলাশীর বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাত হয়। আর এভাবেই বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, যা উদিত হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২০০টি বছর।

পলাশী যুদ্ধের ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হয়

এক. বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সংগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

দুই. ইংরেজগণ হিন্দু প্রধানদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যে হিন্দুদের পুরাপুরি ব্যবহার করে।

তিন. নবাবের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা প্রায় সকলেই ছিলো তার প্রতি নাখোশ এবং তাদের উপরই সিরাজকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। যাদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তারাই তার পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো।

চার. পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। এ ছিল যুদ্ধের প্রহসন। ইংরেজদের চেয়ে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেকগুণ বেশী। নবাবের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ করলে ইংরেজ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো এবং ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। অথবা সিরাজদ্দৌলা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাকে হয়তো পরাজয়বরণ করতে হতো না।

১৯ অক্টো, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১৯ : বাংলার স্বাধীন নবাবেরা যেমন ছিলেন

মুর্শিদকুলী খাঁ
শায়েস্তা খানের পর এদেশে আর যোগ্য ও দক্ষ সুবাহদার আসেননি। গতানুগতিক কয়েকজন সুবাহদার এসেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন করতলব খান বা মুর্শিদকুলি খান। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে মুর্শিদকুলি খান স্বাধীন নবাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। 

শায়েস্তা খানের পর ফিদা খান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মুহাম্মদ আজম পর পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৭৮ সালে মুহাম্মদ আজম সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের অবৈধ সুবিধা আদায়ের জন্যে মুহাম্মদ আজমকে একুশ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব তা জানতে পেরে তাকে পদচ্যুত করে পুনরায় শায়েস্তা খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। এ সময়ে ইংরেজদের ঔদ্ধত্য চরমে পৌঁছে। আকবর নামক জনৈক ব্যক্তি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ইংরেজগণ তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। শায়েস্তা খান এ ষড়যন্ত্র জানতে পেরে পাটনা কুঠির অধিনায়ক মিঃ পিকককে কারারুদ্ধ করেন। কোম্পানীর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডন থেকে ক্যাপ্টেন নিকলসনের নেতৃত্বে কয়েকখানি যুদ্ধ জাহাজ ভারতে প্রেরণ করা হয় এবং চট্টগ্রাম অধিকারের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন নিকলসন বিফল মনোরথ হন। 

ইংরেজদের এহেন দুরভিসদ্ধির জন্যে নবাব শায়েস্তা খান তাদেরকে সুতানটি থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬৮৭ সালে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান জব চার্ণক নবাব প্রদত্ত সকল শর্ত স্বীকার করে নিলে পুনরায় তাদেরকে ব্যবসায় অনুমতি দেয়া হয়। নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলি জব চার্ণক কর্তৃক মেনে নেয়ার কথা ইংলন্ডে পৌঁছলে কোম্পানীর কর্মকর্তাগণ এটাকে অবমাননাকর মনে করে। অতঃপর তারা ক্যাপ্টেন হীথ নামক একজন দুর্দান্ত নাবিকের পরিচালনাধীনে ‘ডিফেন্স’ নামক একটি রণতরী বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে প্রেরণ করে। হীথ সুতানটি পৌঁছে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য কোম্পানীর লোকজনসহ বালেশ্বর গমন করে। এখানে তারা জনগণের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। অতঃপর হীথ বালেশ্বর থেকে চট্টগ্রাম গমন করে আরাকান রাজের সাহায্য প্রার্থনা করে। এখানেও সে ব্যর্থ হয় এবং নিরাশ হয়ে মাদ্রাজ চলে যায়। তাদের এসব দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র জানতে পেরে সম্রাট আওরঙ্গজেব ইংরেজদের মসলিপট্টম ও ভিজেগাপট্টমের বাণিজ্য কুঠিসমূহ বাজেয়াপ্ত করেন। এভাবে কোম্পানী তাদের দুষ্কৃতির জন্যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

শায়েস্তা খানের পর অল্পদিনের জন্যে খানে জাহান বাংলার সুবাদার হন এবং ১৬৮৯ সালে ইব্রাহীম খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। এ দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারকল্পে কোম্পানীর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয়। অতঃপর উড়িষ্যার বন্দী ইংরেজদেরকে মুক্তিদান করে জব চার্ণককে পুনরায় বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। জব চার্ণক পলায়ন করে মাদ্রাজ অবস্থান করছিল। ধূর্ত জব চার্ণক অনুমতি পাওয়া মাত্র ১৬৯১ সালে ইংরেজ বণিকদেরকে নিয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তণ করে এবং কোলকাতা নগরীর পত্তন করে নিজেদেরকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যে, এর সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজগণ বাংলা তথা সমগ্র ভারতভূমিতে তাদের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ অক্ষুণ্ণ রাখে।

এ সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ইস্তানবুলের শায়খুল ইসলাম বাদশাহ আওরঙ্গজেবকে জানান যে, ইংরেজরা ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ যবক্ষার সংগ্রহ করে তা ইউরোপে রপ্তানী করা হয় এবং তাই দিয়ে গোলাবারুদ তৈরী করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। আওরঙ্গজেব যবক্ষার ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু গোপনে তারা যবক্ষার পাচার করতে থাকে। অতঃপর ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসা নিষিদ্ধ করে বাদশাহ আওরঙ্গজেব এক ফরমান জারী করেন। হুগলী কুঠির প্রধান বাংলার সুবাদারের কৃপাপ্রার্থী হলে তিনি এ নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা হ্রাস করে দেন।

ইব্রাহীম খানের অযোগ্যতার কারণে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর স্থলে স্বীয় পৌত্র আজিমুশশানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। আজিমুশশান ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও অর্থলোভী। তার সুযোগে ইংরেজগণ তাঁকে প্রভূত পরিমাণে উপঢৌকনাদি নজরানা দিয়ে সুতানটি বাণিজ্যকুঠি সুরক্ষিত করার অনুমতি লাভ করে। তারপর পুনরায় ষোল হাজার টাকা নজরানা ও মূল্যবান উপহার দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম তিনটি লাভ করে।

১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যুর পর আজিমুশশানের পিতা বাহাদুর শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে পুনরায় আজিমুশশান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। অযোগ্য, অকর্মণ্য ও আরামপ্রিয় সুবাদারকে রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে মুর্শিদ কুলী খানকে দেওয়ান নিযুক্ত করে বাংলায় পাঠানো হয়। বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করা হয়। তবে দুবছরের মধ্যেই ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে আবার ফেরত আনা হয়। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে ফরোখশিয়ার কর্তৃক আজিমুশশান নিহত হন এবং ফরোখশিয়ার মুর্শিদ কুলী খানকেই বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। মুর্শিদ কুলী খান ইংরেজদের হাতের পুতুল সাজার অথবা অর্থদ্বারা বশীভূত হবার পাত্র ছিলেন না। অতএব তাঁর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভে ইংরেজগণ ব্যর্থ হয়। অবস্থঅ বেগতিক দেখে তারা সম্রাটের নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে হ্যাটিল্টন নামে একজন সুদক্ষ চিকিৎসক ছিল। বাংলার সুবাদার ছিলেন ইংরেজদের প্রতি বিরাগভাজন। তাঁর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে সম্রাট ছিলেন নারাজ। কিন্তু এখানে একটি প্রেমঘটিত নাটকের সূত্রপাত হয় যার ফলে ইংরেজদের ভাগ্য হয় অত্যন্ত সুপ্রসন্ন।

উদয়পুরের মহারাণা সিংহের এক পরম রূপসী কন্যার প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন যুবক সম্রাট ফরেখশিয়ার। বিবাহ স্থিরীকৃত হওয়ার পর হঠাৎ তিনি ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হন। বিবাহ অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত হয়ে যায়। কোন চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যামিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর মহারাণার কন্যার কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রিয়তমাকে লাভ করার পর সম্রাট ফরোখশিয়ার ডাঃ হ্যামিল্টনের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ইংরেজ বণিকদিগকে কোলকাতার দক্ষিণে হুগলী নদীর উভয় তীরবর্তী আটত্রিশটি গ্রাম দান করেন। তার নামমাত্র বার্ষিক খাজনা র্নিধারিত হয় মাত্র আট হাজার একশ’ একুশ টাকা। সম্রাটের নিকটে এতকিছু লাভ করার পরও মুর্শিদ কুলি খানের ভয়ে তারা বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেনি।

১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান বাংলার নাজিম পদে উন্নীত হন। তিনি অসংখ্য উপাধি ও পদবিতে ভূষিত হন। প্রথমে তিনি ‘জাফর খান’ উপাধি পান এবং পরে তাঁকে ‘মুতামিন-উল-মুলক আলা-উদ-দৌলা জাফর খান নাসিরী নাসির জঙ্গ বাহাদুর' উপাধি দেওয়া হয়। তাঁকে সাত হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যু হয়।

ঢাকার বেগমবাজারে অবস্থিত করতলব খাঁ'র মসজিদ
মুর্শিদকুলী খান কেবল বাংলার দীউয়ান ও সুবাহদার ছিলেন তা নয়, একই সময়ে তিনি ছিলেন উড়িষ্যার দীউয়ান ও সুবাহদার, বিহারের দীউয়ান এবং কয়েকটি জেলার ফৌজদার। তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল তিনটি প্রদেশ। এই সুবাদে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধ-ুবান্ধবদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। তারা তাঁকে রাজস্বসহ প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান পূর্ববর্তী টোডরমল ও শাহ সুজা প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত পদ্ধতির সংস্কার করে একটি নতুন বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। রাজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি ভূমির উৎপাদনক্ষমতা নিশ্চিত করেন এবং এভাবে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থা মাল জমিনী নামে পরিচিত, অর্থাৎ তিনি জমিদারদের উপর তাদের জমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর আমলে বেশ কিছু নতুন ও বৃহৎ জমিদারির পত্তন হয়। 

মুর্শিদকুলী খানের আমলে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে বাংলার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আরব, পারস্য ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় বেশ সক্রিয় ছিল। সতের শতক থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাংলায় উৎপাদিত সুতা, রেশম ও তা থেকে উৎপন্ন বস্ত্রসামগ্রী ক্রয় শুরু করে। এসব ক্রয়ের জন্য তারা স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি করত। এর ফলে এদেশে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এই ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ব্যবসায়ী, সাহু বা পোদ্দার, মহাজন, বানিয়া ও দালালরা দ্রুত মহাজনি ব্যবসায় উন্নতি লাভ করে। এ ধরনের বহু মহাজনের মধ্যে জগৎ শেঠ অতি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। মুর্শিদকুলী খান বাণিজ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলিকে সৎ ব্যবসায়ে উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি অসৎ ব্যবসায়ীদের কঠিন শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন। মুর্শিদকুলী খান ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তিনি কলকাতার আশেপাশে বেশি গ্রাম ক্রয়ের অনুমতি দেননি, এমনকি কোম্পানির রাজকীয় ফরমান লাভের পরও তিনি অনমনীয় ছিলেন।

মুর্শিদকুলী খান মসজিদ নির্মাণে যত্নবান ছিলেন। তিনিই ঢাকার করতলব খান মসজিদ (বেগম বাজার মসজিদ) এবং মুর্শিদাবাদ মসজিদ নির্মাণ করান। ব্যক্তি-জীবনে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং স্বহস্তে পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরি করে তিনি পবিত্র স্থানে বিতরণ করতেন। মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। তার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের নামমাত্র আধিপত্য ছিল, সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন। তার পরিবার সম্পর্কে কয়েক প্রকার মতভেদ রয়েছে। প্রথম সংস্করণমতে মুর্শিদ কুলি খানকে, হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। ১৭১৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে কার্তালাব খান নামে ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত করেন ও বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন।

১৭২৫ সালে মুর্শিদকুলীর মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজাউদ্দীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদ অলংকৃত করেন। তাঁর আমলে ইংরেজরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ উন্নতি করে এবং তাদের ঔদ্ধত্যও বহুগুণে বেড়ে যায়। হুগলীর ফৌজদার একবার ন্যায়সংগত কারণে ইংরেজদের একটি মাল বোঝাই নৌকা আটক করেন। একথা জানতে পেরে ইংরেজরা একদল সৈন্য পাঠিয়ে প্রহরীদের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নিয়ে যায়। সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান সুবাদার নিযুক্ত হন। নাদির শাহের ভারত আক্রমণ তাঁর সময়ে হয়েছিল।

সরফরাজ খান ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বলচিত্ত। তাঁর সেনাপতি আলীবর্দী খানের সংগে সংঘর্ষে নিহত হন এবং আলীবর্দী খান ১৭৪১ সালে বাংলার সুবাদার হন। আলীবর্দী খানের সময় বার বার বাংলার উপর আক্রমণ চলে বর্গী দস্যুদের। তাদের দৌরাত্ম্য থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে তিনি কয়েকবার ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেন। দেশের আর্থিক উন্নতিকল্পে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দান করতেন।

১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলাদেশে মারাঠা আক্রমণ শুরু হয় এবং ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। প্রায় প্রতি বৎসরই মারাঠী সৈন্যরা এই আক্রমণ করতো। এই আক্রমণের সময় তারা ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ করতো। মূলত পশ্চিমবঙ্গেই এই আক্রমণ হতো। স্থানীয় লোকেরা এই আক্রমণের ভয়ে পূর্ব-বাংলার দিকে পালিয়ে যেতো। এছাড়া বহুমানুষ তখন কলকাতায় আশ্রয় নিতো। ফলে এই সময় পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে। ইতিহাসে এই আক্রমণকে 'বর্গীর হাঙ্গামা' নামে অভিহিত করা হয়।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাব হ্রাস হওয়ার পর, পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথ সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে মারাঠ সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বালাজী বিশ্বনাথের পুত্র পেশোয়া বাজীরাও এই বিষয়ে যত্নবান হন। হায়দ্রাবাদের নিজাম মারাঠী আক্রমণ থেকে নিজ রাজ্য রক্ষার জন্য, নাগপুরের স্বাধীন মারাঠী রাজা রঘুজী ভোঁসলেকে বাংলা আক্রমণে উৎসাহিত করেন। রঘুজী ভোঁসলে সাতরায় তার আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হলে বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ নেন। এই সময় পরাজিত রুস্তম জঙ্গও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রঘুজী ভোঁসলে -কে প্ররোচিত করেন।

১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী খাঁ উড়িষ্যা অভিযানে থাকার সময়, মারাঠী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা আক্রমণ করেন এবং বিনা বাধায় বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর তিনি কাটোয়া দখল করে নেন। এরপর মারাঠী সৈন্যরা আলীবর্দীর খাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে, দ্রুত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে মুর্শিদাবাদ শহর ও জগৎশেঠের কোষাগার লুণ্ঠন করে। এই সময় আলীবর্দীর খাঁ ফিরে এলে, ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে কাটোয়ায় ফিরে যান এবং সেখানে মারাঠী ঘাঁটি স্থাপন করে গঙ্গা নদীর পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হন।

১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণের উদ্যেশ্যে রওনা হন। এই সময় তাঁর প্রধান প্রতিবন্ধক ছিলেন বালাজী রাও। মোগল সম্রাটের অনুরোধে বালাজী রাও রঘুজী ভোসলেঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে, রঘুজী ভোসলেঁ নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ফলে রঘুজী ভোসলেঁর আক্রমণ থেকে আলীবর্দী খান রক্ষা পান। ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। মারাঠী সেনাবাহিনীর তুলনায় আলীবার্দী খাঁর সেনবাহিনী দুর্বল ছিল। এই কারণে আলীবার্দী খাঁ প্রতারণার আশ্রয় নেন। তিনি সন্ধির নাম করে ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানান। পরে আফগান সেনাপ্রধান মুস্তফা খাঁর সহায়তায় ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করতে পারলে, আলীবর্দী খাঁ তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি অনুসারে মুস্তফা খাঁ ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করলেও― আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। এই কারণে মুস্তফা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুস্তফা নিহত হলে, বিহারের শাসনভার আলীবর্দী খাঁ'র পছন্দের শাসকের হাতেই রয়ে যায়।

ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর পর, রঘুজী ভোসলেঁ মারাঠী সৈন্যদের ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যার প্রতিশোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। রঘুজী প্রাথমিকভাবে উড়িষ্যা ও বিহার দখল করে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু আলীবর্দী খাঁরা বাধার মুখে পরাজিত হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজীর পুত্র জনজীর ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করে বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা দখল করে নেন। এরপর টানা তিন বৎসর মারাঠী সৈন্যদের সাথে আলীবার্দীর খাঁর যুদ্ধ হয়। এই সময় আলীবর্দী খাঁর শত্রু মীর হাবিব মারাঠী বাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং নবাবের বাহিনীর আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। নবাব এই বিদ্রোহ দমন করলেও, উড়িষ্যার পুরোপুরি মারাঠীদের দখলে চলে যায়।

১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনীর মধ্যে একটি সন্ধি হয়। এই সন্ধি অনুসারে, উড়িষ্যায় মারাঠীদের অধিকারে থেকে যায়। এছাড়া বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা মারাঠীদের কর প্রদানে আলীবর্দী খাঁ অঙ্গীকার করেন। কিন্তু বাংলাতে মারাঠীরা আর কখনো আক্রমণ করবে না, এই অঙ্গীকার মারাঠীরা প্রদান করে। এই সন্ধির মধ্য দিয়ে বর্গীর হাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আলীবর্দী খান ইংরেজ, ফরাসীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে তিনি ইংরেজদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল তিনি মুর্শিদাবাদে মৃত্যবরণ করেন।

তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তিন কন্যার নাম ছিল- মেহার উন-নিসা বেগম (ঘোশেটি বেগম), মুনিরা বেগম এবং আমিনা বেগম। আমেনা বেগমের বিবাহ হয়েছিল তাঁর কনিষ্ঠ ভাতিজা জৈনুদ্দিন আহমেদ খান-এর সাথে। আমিনা বেগমের গর্ভেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর নিজের কোন পুত্র সন্তান না থাকায়, আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করে গিয়েছিলেন।

সিরাজউদ্দোলার সিংহাসন আরোহণের পর আলীবর্দী-কন্যা ঘসেটি বেগম ও তার দৌহিত্র পুর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জং-এর সকল ষড়যন্ত্র তিনি দক্ষতার সাথে বানচাল করে দেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ করার সাথে সাথেই ঘেসেটি বেগম বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন এবং মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সিরাজদ্দৌলা ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগমের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বেগমকে রাজপ্রসাদে বন্দী করেন। অপরদিকে শওকত জং নিজেকে বাংলার সুবাদার বলে ঘোষণা করলে যুদ্ধে সিরাদ্দৌলা কর্তৃক নিহত হন।


ঘসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহে নওয়াজেশ মুহাম্মদের দেওয়ান রাজবল্লভ ইন্ধন যোগাচ্ছিল। সিরাজদ্দৌলা তা জানতে পেরে রাজবল্লভের কাছে হিসাবপত্র তলব করেন। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেশ মুহাম্মদের অধীনে দেওয়ান হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার তার উপরে ছিল। আদায়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিল বলে হিসাব দিতে অপারগ হওয়ায় নবাব সিরাজদ্দৌলা রাজবল্লভের ঢাকাস্থ ধনসম্পদ আটক করার আদেশ জারী করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভাবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদ সহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজদ্দৌলা ধনরত্মসহ পলাতক কৃষ্ণবল্লভকে তাঁর হাতে অর্পণ করার জন্যে কোলকাতার গভর্ণর মিঃ ড্রেককে আদেশ করেন। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও রাজ্যের মধ্যে অতি প্রভাবশালী হিন্দুপ্রধান মাহতাব চাঁদ প্রমুখ অন্যান্য হিন্দু বণিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজদ্দৌলার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তারপর অকৃতজ্ঞ ক্ষমতালিপ্সু ইংরেজগণ ও তাদের দালাল হিন্দু প্রধানগণ সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরদিরে জন্যে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয় –পলাশীর ময়দানে।

৩ অক্টো, ২০১৯

আমাদের খান সাহেব, আমাদের নেতা

বাইতুল মোকাররমের সামনে বক্তব্য রাখছেন খান সাহেব
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন দেখলাম বাবা হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এলেন আর বলতে লাগলেন খান সাহেব চলে গেছে। ব্যাপক হা-হুতাশ করছেন আর কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। কোন খান সাহেব? আব্বাস আলী খান। ছোট মানুষ ছিলাম। অত কিছু বুঝতাম না, তবে আব্বুর পেরেশানী দেখে বুঝেছি বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। সেদিন নামটা মুখস্ত হলো।

এরপর যখন আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম তখন বইয়ের আলমিরায় দেখি এই নামের লেখকের অনেক বই। আমি যাঁদের কাছ থেকে ইতিহাস শিখেছি তাঁদের মধ্যে অন্যতম আব্বাস আলী খান। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংগঠক।

জন্ম :
জনাব আব্বাস আলী খান ১৯১৩ সাল বা ১৩২১ সালের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে সোমবার বেলা ৯টায় জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন পাঠান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
তিনি নিজ ঘরেই পড়ালেখা শুরু করেন। স্থানীয় মাদরাসা থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর তিনি হুগলী মাদরাসায় পড়তে যান। হুগলী মাদরাসায় পড়াশুনা শেষ করে রাজশাহী সরকারী কলেজ এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোলকাতা যান। কিন্তু অভিভাবকদের ইচ্ছাক্রমে চাকুরী গ্রহণ করেন।

মাওলানা আব্দুস সোবহান ও শহীদ কামারুজ্জামানের সাথে আব্বাস আলী খান (মাঝে)
চাকুরিস্থলে অফিসের বড় বাবু খান সাহেব নামায পড়তে যাওয়ার কারণে সব সময় ঝামেলা করতেন। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি। উল্লেখ্য যে, সে সময় কোলকাতায় জুমার নামাযে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবুল কালাম আযাদের খুতবাহ শুনে তার মধ্যে এক উদ্দীপনা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয়। এ সময় তিনি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও হিযবুল্লাহ বই দুটি অধ্যয়ন করেন এবং আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ভাব অবলম্বনে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখেন যা মাসিক মোহাম্মদী ও তৎকালীন ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘মুসলিম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

১৯৫২ সালে জয়পুরহাটে স্থানীয় স্কুলের হেড মাষ্টার সীমান্ত পার হয়ে চলে যাওয়ায় ম্যাজিট্রেটের অনুরোধে হেড মাষ্টারের পদ গ্রহণ করেন।

ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত :
১৯৫৪ সালে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ইসলামী জলসা ছিল। তাঁরই ছাত্র উক্ত মাদরাসার সেক্রেটারি। ছাত্রের অনুরোধে তিনি ঐ জলসায় যান। উক্ত জলসায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কারমাইকেল কলেজের তরুণ অধ্যাপক গোলাম আযম। অধ্যাপক গোলাম আযমের মুখে কালেমা তাইয়্যেবার ব্যাখ্যা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। সভাশেষে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া ও পরিচয় হয়। জনাব খান অধ্যাপক সাহেবের কাছ থেকে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর লেখা কিছু বই পুস্তক কিনেন এবং তার কাছেই শুনতে পান যে বগুড়ার জামায়াতের দায়িত্বশীল হলেন শায়খ আমীন উদ্দিন।

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম ও অন্যান্য জামায়াত নেতাদের সাথে আব্বাস আলী খান (বামে) 

১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জনাব আব্বাস আলী খান বগুড়ার দায়িত্বশীল শায়খ আমীন উদ্দিনের সাথে দেখা করে মুত্তাফিক ফরম পূরণ করেন এবং নিজ এলাকায় একটি ইউনিট কায়েম করে সেই ইউনিট চালান। ৫৬ সালের মাঝামাঝি জামায়াতের রুকন হন এবং তদানীন্তন রাজশাহী বিভাগের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জনাব আব্বাস আলী খান-এর রুকনিয়াতের শপথ পাঠ করান।

উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী (র) ১৯৫৬ সালে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এসময় থেকে খান সাহেব মাওলানা মওদূদীর (র) সান্নিধ্যে আসেন। মরহুম খান সাহেব খুব ভালো উর্দু জানতেন, তাই তিনি মূল উর্দু ভাষায় মাওলানার সবগুলো বই পড়ে ফেলেন এবং মাওলানার সান্নিধ্যে থেকে মাওলানার বক্তৃতা এবং আলোচনা ভালোভাবে হজম করেন। মাওলানা দ্বিতীয় বার পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন ১৯৫৮ সালে। এ সফরে তিনি রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রাজশাহীতে যেসব জনসভা ও সমাবেশে বক্তৃতা করেন, মরহুম খান সাহেব সেসব সভা সমাবেশে মাওলানার দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে জামায়াতের নির্দেশে তিনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকুরী ত্যাগ করেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি এবং ছাত্ররা তাঁকে কিছুতেই স্কুল থেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। এমনকি স্কুলের শত শত ছাত্র এসে তাঁকে স্কুলে ফিরিয়ে নেবা জন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে।

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর উপর রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব অর্পিত হয়। পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনাব আব্বাস আলী খান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালের রমযান মাসে আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমকে যখন জেলে নেয়া হয় এবং ১৬ মাস বন্দী করে রাখা হয়, তখনো তিনি ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া আমীরে জামায়াত যখনই দেশের বাইরে গিয়েছেন, তখন তিনিই ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতেই ছিলেন আব্বাস আলী খান

রাজনৈতিক জীবন :
আব্বাস আলী খান ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এবং জাতীয় পরিষদে ইসলাম ও গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আইয়ুব খানের কুখ্যাত মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্য ১৯৬২ সালের ৪ঠা জুলাই জাতীয় পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেন। অধিবেশন শুরুর আগের দিন ৩রা জুলাই আইয়ুব খান জনাব আব্বাস আলী খানকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল আইয়ুব খান তাকে মেহমানদারী করার ফাঁকে প্রস্তাবিত বিলটি জাতীয় পরিষদে পেশ না করার জন্য আকারে ইংগিতে শাসিয়ে দেন। সেই সাথে এর বিরোধীতা করার জন্য মহিলাদেরকে উসকিয়ে দেন। কিন্তু তীব্র বিরোধীতার মুখেও জনাব খান বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন।

স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলগুলো ‘কপ’, ‘পিডিএম’এবং ‘ডাক’ নামে যেসব জোট গঠন করেছিল, তিনি ছিলেন এ জোটগুলোর অন্যতম নেতা। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যূত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনাব আব্বাস আলী খান ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার জনাব খানকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে তিনি দু’বছর কারাভোগ করেন।

১৯৭২ সালে আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সংবিধানে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত করার পর থেকে ১৯৭৯ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকাশ্যে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঢাকার হোটেল ইডেনে আয়োজিত এক রুকন সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৭২ সাল থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকার কারণে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কম্যুনিষ্ট ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী ভারতপন্থীরা একতরফাভাবে নানা অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল। এমনি একটি বৈরী পরিবেশে কঠিন পরিস্থিতিতে জনাব আব্বাস আলী খানকে জামায়াতের হাল ধরতে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে সাংবাদিক সম্মেলনসহ সভা-সমাবেশে যুক্তিপূর্ণভাবে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করে আল্লাহর মেহেরবাণীতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।

মরহুম আব্বাস আলী খান ১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীর রমনা গ্রীণে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইসলামী বিপ্লবের সাতদফা গণদাবী ঘোষণা করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় তিন যুগ ধরে তিনি জয়পুরহাট শহরের বৃহত্তম ঈদের জামায়াতের ইমাম ছিলেন।

মানুষের প্রতি ভালবাসা ও দুঃস্থ মানবতার প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডের সাথে তিনি আগাগোড়াই জড়িত ছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণের পেছনে তার এ মনোভাবই বেশী সক্রিয় ছিল। শিশুরা যাতে ছোট বেলা থেকেই আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে সুযোগ পায় সেজন্য জয়পুরহাটে তিনি একটি আদর্শ আবাসিক স্কুল স্থাপন করেন।

বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকান্ড প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে জনাব খান সর্বদাই দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের কল্যাণে যথাসাধ্য ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে বহুক্ষেত্রেই তিনি দুর্গত মানুষের মাঝে স্বহস্তে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। উড়ির চরের জলোচ্ছ্বাসের পরপরই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ সামগ্রীসহ সেখানে পৌঁছান।

খান সাহেবকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন শহীদ মতিউর রহমান নিজামী
সাহিত্যে অবদান :
ভাষা ও সাহিত্য চর্চার প্রতি জনাব খানের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। আরবী ভাষা তিনি সুন্দরভাবে লিখতে পারতেন। বাংলা, ইংরেজী ও উর্দু ভাষায়ও তাঁর দখল ছিল এবং এসব ভাষায় বক্তৃতায় তিনি ছিলেন সাবলীল। অতি ব্যস্ততা সত্ত্বেও জনাব খান গ্রন্থ প্রণয়ন ও অনুবাদের কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। আত্ম-স্মৃতিচারণ মূলক তাঁর গ্রন্থ ‘স্মৃতি সাগরের ঢেউ’ শুধু সুখপাঠ্যই নয়, তদানিন্তন সমাজের একটা দর্পনও বটে। বিলেতে সফরের উপর তাঁর লেখা ‘যুক্তরাজ্যে একুশ দিন’ এবং আমেরিকা-কানাডা সফরের উপর লেখা ‘বিদেশ পঞ্চাশ দিন’ যেমন উপভোগ্য তেমনি তথ্যবহুল ও শিক্ষনীয়। অনুবাদ ও মৌলিক রচনা মিলিয়ে জনাব আব্বাস আলী খানের প্রায় পঁয়ত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সমসাময়িক ও নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপরও সংবাদপত্রের প্রবন্ধ লিখে গিয়েছেন। প্রকাশিত এমন নিবন্ধের সংখ্যা তাঁর অনেক। তিনি অনেক ছোট গল্পের লেখক। তিনি বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেছেন। “বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস” তার এমনি একটি রচনা।

জনাব আব্বাস আলী খানের রচিত গ্রন্থাবলী 
১. জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস
২. জামায়াতে ইসলামীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৩. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
৪. মাওলানা মওদূদী ঃ একটি জীবন, একটি ইতিহাস, একটি আন্দোলন
৫. আলেমে দ্বীন মাওলানা মওদূদী
৬. মাওলানা মওদূদীর বহুমুখী অবদান
৭. মৃত্যু যবনিকার ওপারে
৮. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙিক্ষত মান
৯. ঈমানের দাবী
১০. ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব
১১. একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
১২. ইসলামী বিপ্লব একটি পরিপূর্ণ নৈতিক বিপ্লব
১৩. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক
১৪. MUSLIM UMMAH
১৫.স্মৃতি সাগরের ঢেউ
১৬.বিদেশে পঞ্চাশ দিন
১৭.যুক্তরাজ্যে একুশ দিন
১৮.বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী
১৯.ইসলামী আন্দোলন ও তার দাবী
২০.দেশের বাইরে কিছুদিন

জনাব আব্বাস আলী খানের অনূদিত গ্রন্থাবলী 
২১. পর্দা ও ইসলাম
২২. সীরাতে সরওয়ারে আলম (২-৫খন্ড)
২৩. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং (সহ-অনুবাদ) 
২৪. বিকালের আসর
২৫. আদর্শ মানব
২৬. ইসলাম ও সামাজি সুবিচার
২৭. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
২৮. ইসলামী অর্থনীতি (সহ-অনুবাদ)
২৯. ইসরা ও মিরাজের মর্মকথা
৩০. মুসলমানদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচী
৩১. একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার
৩২. পর্দার বিধান
৩৩. ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ
৩৪. আসান ফিকাহ (১-২ খন্ড)
৩৫. তাসাউফ ও মাওলানা মওদূদী

মহান আল্লাহর কাছে যাত্রা :
৩রা অক্টোবর ১৯৯৯ সাল, বেলা ১-২৫ মিনিটে এ মহান শিক্ষক একমাত্র কন্যা ও নাতি-নাতনীদের রেখে দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। জয়পুরহাট জেলা শহরের প্রশস্ত রাজপথ ঘেঁষে তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় তাঁকে দাফন করা হয়। কবরের কাছে রয়েছে তাঁর নিজ হাতে গড়া ইসলামী পাঠাগার। জাতির শিক্ষক খান সাহেবের জন্য রইলো ভালোবাসা। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর ত্যাগ কবুল করুন। তাকে সম্মানিত করুন। 

১ অক্টো, ২০১৯

আমার শিক্ষক মুমতাজুল মুহদ্দিসীন মাওলানা আবদুর রহীম


কিছু মানুষ আছেন যাদের কখনো দেখিনি। শুধু বই পড়ে উস্তাদ মেনেছি। এমনি একজন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য, ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার ছিলেন হযরত মওলানা মুহাম্মাদ অবদুর রহীম (রহ.)

জন্ম :
১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার কাউখালি থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পৈতৃক বাড়িতে স্থাপিত মক্তব ও ইবতেদায়ী মাদরাসায়। পরে শর্ষীণা আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৪০ সালে ফাযিল এবং ১৯৪২ সালে কামিল (প্রথম শ্রেণী) ডিগ্রি লাভ করে মুমতাজুল মুহদ্দিসীন উপাধিতে ভূষিত হন। 

১৯৪৫-৪৭ সালে বরিশালের নাজিরপুর হাই মাদ্রাসা এবং ১৯৪৭ - ১৯৪৮ সালে কেউন্দিয়া-কাউখালী মাদ্রাসার হেড মাওলানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে বরিশালে ‘তানজীম’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

১৯৫৯-৬০ সালে তিনি দৈনিক নাজাত পত্রিকার জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, বাংলাদেশ ইসলামী ইনস্টিটিউট এবং ওআইসি-র ফিকহ একাডেমীরও সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি সৌদি আরব, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা, থাইল্যান্ড, বৃটেন প্রভৃতি দেশ সফর করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৭ সালে মক্কার বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন, ১৯৭৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত রাবেতার প্রথম এশীয় ইসলামী সম্মেলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তাঁর চিন্তাগত অবদান রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনেও তিনি বিশেষভাবে অবদান রাখেন।

জামায়াত ও ইসলামী রাজনীতি : 
১৯৪২ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামী সম্পৃক্ত হন মাওলানা আবদুর রহীম। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশাল বিভাগীয় জামায়াতের আমীর ছিলেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি পুরো পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ছিলেন।

১৯৭১-এ পট পরিবর্তনের ফলে মাওলানা আব্দুর রহীম আর এদেশে আসতে পারেননি। আর তাছাড়া তিনি পাকিস্তানে নায়েবে আমীরের দায়িত্বও পালন করছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াত থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজ দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও বাংলাদেশ জামায়াতে যোগ দেন। তখন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান। জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে একটিভ ছিলো। 

১৯৭২ সাল থেকে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির পরিবর্তে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত হন। ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম এবং রাজনৈতিক নেতা খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, পি.ডি.পি. খেলাফতে রাব্বানী প্রভৃতি দল সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। 

বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ভেঙ্গে গেলে তিনি ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) জামায়াত গ্রুপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে আইডিএল মুসলিম লীগ নির্বাচনী জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি আইডিএল পার্লামেন্টারী গ্রুপের নেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

জামায়াত যখন নিজ নামে আবার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করতে যায় তখন মাওলানা আব্দুর রহীমসহ জামায়াতের মধ্যকার একটি পক্ষ চান নতুন করে জামায়াত আর রাজনীতিতে না আসুক। জামায়াত যেন ইসলাহ টাইপের একটি দল হিসেবে থাকে। মাওলানার যুক্তি ছিলো জামায়াতের বিরুদ্ধে কিছু আলেম ওলামাদের অবস্থান যা ছিলো তা আর থাকবে না। এছাড়া জামায়াতের বিরুদ্ধে যত প্রকার অভিযোগ আছে সেগুলো আর কাঁধে নিতে হবে না। এছাড়া আইডিএলের প্রধান শক্তি জামায়াত তাই আইডিএলকে সহজেই জামায়াতিকরণ করা যাবে। 

অন্যদিকে অন্যান্য শুরা সদস্যরা এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন জানান নি। তারা দাবি ছিলো আইডিএল থাকবে জোট হিসেবে (যেভাবে আছে)। আর জামায়াত তার নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হবে। জামায়াতের এজেন্ডা কখনোই আইডিএলে বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের চাইতেও বেশি রয়েছে লোক গঠনের এজেন্ডা। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই অঞ্চলে জামায়াতই মুসলিমদের মধ্যে এই জাগরণ ঘটয়েছে যে, রাজনীতি ইসলামের বাইরে নয়। ইসলাম ব্যক্তিজীবনের জন্য নয়, বরং সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার নাম। অতএব জামায়াত যখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবে তখন ইসলামের যে তাজদিদ জামায়াত শুরু করেছে তা ব্যর্থতায় পরিণত হবে। 

অতএব শুরায় জামায়াত নিজ নামে রাজনীতিতে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ শুরা মেম্বার মত দেন। ৪২ জন শুরা সদস্যের মধ্যে ৪০ জনই জামায়াত নাম নিয়ে রাজনীতিতে একটিভ হওয়ার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।

জামায়াতের শুরার এই মতামত মেনে নিতে পারেননি মুমতাজুল মুহদ্দিসীন খ্যাত মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি আইডিএলকে একটি দলে পরিণত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ওনার সহযোগী হিসেবে ছিলেন কুষ্টিয়ার এড. সা'দ আহমদ ও পাবনার মাওলানা আব্দুস সুবহান। এভাবেই তিনি জামায়াত ছেড়ে চলে যান। তিনি ভেবেছেন আইডিএলের মাধ্যমে সহজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। মাওলানা আব্দুস সুবহান অবশ্য কিছুকাল পরেই আবার জামায়াতে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে আইডিএল প্রার্থী হিসেবে মাওলানা আব্দুর রহীম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ১১টি ইসলামী সংগঠনের সমন্বয়ে সম্মিলিত খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে গোটা দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-জোয়ার এবং গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল, আলেম, পীর মাশায়েখদের সমন্বয়ে “ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন” গড়ে তোলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াও তিনি বহু সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

সাহিত্য ও লেখালেখি :
কৈশোরেই মওলানা আবদুর রহীমের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর সাহিত্যিক বড় ভাইয়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত হন। এপর্যায়ে ছোটখাট কিছু পত্র-পত্রিকায় তিনি লেখালেখির কাজও শুরু করেন। সাড়ে ১২ বছর বয়সে তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়, পটুয়াখালীর একটি স্কুল ম্যাগাজিনে। এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে আবুল মনসুর আহমদ সস্পাদিত দৈনিক কৃষক, মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ, সুন্নাতুল জামাত ইত্যাকার পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।

১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম বই ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ প্রকাশিত হয়। এদেশের ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে এ বইটির প্রকাশনা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা কালেমা তাইয়্যেবা ইসলামের মূলমন্ত্র হলেও এ দেশের সাধারণ জনগণ এ কালেমার সঠিক তাৎপর্য জানতেন না।

বাংলা ভাষায় তিনি শুধু ইসলামী সাহিত্যের কলেবরই বৃদ্ধি করেননি, এ ভাষাকে ইসলামী বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করতেও তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। চল্লিশের দশক অবধি বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারা প্রকাশের উপযোগী কোনো পরিভাষা ছিল না। এর প্রায় সমগ্র পরিভাষাই ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতাদুষ্ট। মওলানা আবদুর রহীম নতুন নতুন ইসলামী পরিভাষা উদ্ভাবন করে বাংলা ভাষাকে শিরক ও পৌত্তলিকতার জঞ্জাল থেকে বহুলাংশে মুক্ত করেন এবং ইসলামী সাহিত্যচর্চার পথ সুগম করে তোলেন। তিনিই প্রথম বাংলায় ‘ইসলামী জীবনব্যবস্থা’, ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা’, ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’, ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ এই পরিভাষাগুলো চালু করেন।

মাওলানা আবদুর রহীমের মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০ এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও প্রায় ৭০। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁর মেধা ও প্রতিভার মূল্যায়ন করে ১৯৭৭ ও ১৯৮৩ সালে তাঁকে মৌলিক গবেষণা ও অনুবাদ কর্মের জন্যে দুটি পুরস্কার দিয়েছে।

মাওলানা আব্দুর রহিম-এর গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘বর্তমান বিশ্বে ইসলামের পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা’, ‘মানবতা বিধ্বংসী দু’টি মতবাদ’, ‘ইসলামে ভূমি, কৃষি, শিল্প ও শ্রম আইন’, ‘হাদিসের আলোকে সমাজজীবন’, ‘বিশ্ব সভ্যতার মুক্তি কোন পথে’, ‘ইসলামী সভ্যতায় নারীর মর্যাদা’, ‘সুরায়ে ফাতেহায় তফসীর’, ‘বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ’, ‘ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা’, ‘জিয়ারাতে বায়তুল্লাহ’, ‘পরকালের সাথী’, ‘বেহেশতের চাবি’, ‘যুগের দুর্জন’, ‘নাজাতের পথ’, ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’, 'পরিবার ও পারিবারিক জীবন' ইত্যাদি।

১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান। আজিমপুর গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।